বুধবার, ৩০ আগস্ট, ২০১৭

খচ্চরের ডিএ ~ অরুনাচল দত্তচৌধুরী

অ্যাই শোন, তোরা কিছু… সরকারি খচ্চর

ডিএ চেয়ে কেঁদেছিস নাকি সারা বচ্ছর?
আজীবন সেবা দিয়ে, প্রাণপাত হর্ষে
কাল যে চাকর, আজ কেন খচ্চর সে?


খচ্চর মানে গালি? মোটেই ভাবিস না
ভারবাহী জন্তু সে, নেই ক্ষিদে তৃষ্ণা।
গাধাদের চেয়ে যদি কিছু চাস বেশি… নে
হলফনামাটি ছাপা সরকারী মেশিনে।


আদালতে গিয়েছিস। ডিএ চেয়ে বাহানা?
চাইলেই পাওয়া সোজা, ব্যাপারটি তাহা না।
এই যে চতুর্দিকে এত পরিবর্তন
উন্নয়নের তাস রুইতন হরতন…


এত মেলাখেলা চলে, দেখেও থাকিস চুপ!
শ্রেণীসংগ্রাম খুঁজে পেল তার অভিরূপ।
এ'তো আর বিধায়ক-সাংসদ ভাতা না!
সরকার তোর বেলা তত বড় দাতা না।


দাম বেড়ে যায় বলে ডিএ পেতে বাসনা?
মূল্যবৃদ্ধি? আহা টমেটো তো খাসও না!
ওই সব দামি চিজ খেলে তোরা জানতি
কাকে যে মূল্য বলে, কীসে বিভ্রান্তি।


হলফনামাতে খুশি, জো হুজুর চামচা
মুখেতে কুলুপ আর পেটে বাঁধা গামছা।
হিটলারপুজো করে কৃমিকীট মচ্ছর।
বৃথা লড়ে যায় একা… ভারবাহী খচ্চর!

সোমবার, ২৮ আগস্ট, ২০১৭

শ্রেণীসংগ্রাম ~ আর্কাদি গাইদার

আইরিশ স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং তার পরবর্তী সময়ের আইরিশ গৃহযুদ্ধ নিয়ে তৈরি কেন লোচের সিনেমা - 'দ্য উইন্ড দ্যট শেকস দ্য বার্লি'। দুই ভাইয়ের গল্প। আইরিশ গৃহযুদ্ধের দুই যুযুধান পক্ষ - ন্যাশনালিস্ট আর সোশ্যালিস্ট। দুই ভাই, যারা স্বাধীনতার জন্যে পাশাপাশি লড়েছে, তারা এই দুই পক্ষে ভাগ হয়ে গেলো। সিনেমার শেষে, যে ভাই সোশ্যালিস্ট, সে ন্যাশনালিস্টদের হাতে বন্দী। ফায়ারিং স্কোয়াডের অপেক্ষায়। কারাকক্ষে দেখা করে অন্য ভাই বারবার বোঝানোর চেষ্টা করে, আমরা একসাথে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়েছি, তোমাদের আমরা মারতে চাইনা, তোমরা অস্ত্র কোথায় লুকিয়েছো জানিয়ে দাও, তাহলে আমি তোমায় বাঁচাতে পারবো। স্মিত হেসে উত্তর আসে - It is important to know what you are fighting against. But it is more important to know what you are fighting for.

বাংলা জুড়ে কানহাইয়ার সভাগুলোকে কেন্দ্র করে যে সমস্ত কমরেডদের মধ্যে উচ্ছাসের জোয়ার এসেছে - ফ্যাসিস্টদের প্রতিহত করতে পেরে, তাদের ওপর পালটা আঘাত হানতে পেরে, প্রতিটি জায়গায় তাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পেরে - তাদের ফ্যাসিস্টদের প্রতি ঘৃণা নিয়ে আমার কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু শুধু ঘৃণা দিয়ে নিজেদের চেতনার উন্মেষ কতটা ঘটানো যায়, এই বিষয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। প্রেক্ষিত ছাড়া ঘৃণা ক্ষতিকর। চর্চার মধ্যে দিয়ে ঘৃণাকে যদি শ্রেণীঘৃণায় পরিণত করা যায়, তাহলেই তার থেকে আগামী দিনের দীর্ঘমেয়াদী লড়াইর রসদ পাওয়ার সুযোগ থাকে। 

আর শ্রেণীঘৃণার পূর্বশর্তই হলো শ্রেণীপ্রেম। ফ্যাসিস্টদের 'বিরুদ্ধে' লড়ছি, শুধু এইটুকুই যথেষ্ট নয়, শ্রেণীর 'পক্ষে' লড়ছি, এই বোঝাপড়ার জায়গা থেকেই আগামীদিনের লড়াই। শ্রেণীপ্রেম ছাড়া শ্রেণীঘৃণার কোন মূল্য নেই। শ্রেণীশত্রুর প্রতি ঘৃণার থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ন শ্রেণীমিত্রর প্রতি ভালোবাসা। যে শ্রেণীর পক্ষে লড়ছি, সেই শ্রেণীর প্রতি প্রেম, তাদের সাথে একাত্মবোধ, এবং তাদের আগামীদিনের সমস্ত লড়াইতে যুক্ত হওয়া, যুক্ত করা, এটা করতে আমরা কতটা আগ্রহী? ফ্যাসিস্টদের মারতে আমরা যতটা আগ্রহী, গরীব মানুষের পাশে দাঁড়াতে আমরা ততটা আগ্রহী কি? মানুষের বেসিক দাবিদাওয়াগুলো নিয়ে লড়াই সংগঠিত করতে ততটা আগ্রহী কি? দীর্ঘমেয়াদী কর্মসূচী গড়ে তুলতে ততটা সক্রিয় কি?

এই প্রশ্নগুলোর মাঝেই নিচের খবরটা। 
বাঁকুড়া জেলার সিমলাপোলে তালডাঙ্গরা বিধানসভার ভ্যালাইডাহা গ্রাম। ২০১৬ র নির্বাচনের পর পরেই জমিদার জোতদারদের উত্তরসূরিরা জবরদখল করে নিয়েছিলো ১৩৯ জন পাট্টাদারদের জমি। আজকে সংগঠিত ভাবে লাল ঝান্ডার মিছিলে সেইসব জমি আবার পুনর্দখল করলেন পাট্টাদাররা। কোন সংগঠনের ফ্ল্যাগ, নাম করলাম না। সংগঠনের নামে কি এসে যায়? লাল ঝান্ডা তো।

রবিবার, ২৭ আগস্ট, ২০১৭

চিকিৎসার খরচ ~ কৌশিক দত্ত

আপনাদের আগলে দাঁড়িয়ে মৃত্যুর বিরুদ্ধে লড়েন যে মানুষেরা, তাঁরা যদি দলবদ্ধভাবে কোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে থাকেন, তবে তা বৃহত্তর অর্থে আপনাদের স্বার্থেই। স্বাস্থ্যক্ষেত্রের পরিবেশ বিষিয়ে দিয়ে আসলে আপনাদের স্বাস্থ্যকেই গভীর অতলে ঠেলে ফেলে দেবার চেষ্টা চলছে। না, কোনো সরকার বা দলের বিরুদ্ধে অভিযোগটা নয়। তাঁদের ভোটকেন্দ্রিক রাজনৈতিক স্বার্থ চিরকাল থেকেছে, আছে, থাকবে, কিন্তু আপনাদের বড় বিপদ সেটা নয়। বড় বিপদ হল, চিকিৎসা পরিষেবাকে আপনাদের নাগালের বাইরে নিয়ে যাবার দীর্ঘমেয়াদী প্রচেষ্টা চলছে। চক্রান্তটা বহুজাতিক বাণিজ্যগোষ্ঠীগুলির।  

সহজভাবে ভাবুন। একজন চিকিৎসক আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে চিকিৎসা করলে বেশীরভাগ ক্ষেত্রে নিজের ক্লিনিকাল স্কিল আর অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে আপনার চিকিৎসা করবেন। যদি তাঁর ভেতর আতঙ্ক ঢুকিয়ে দেওয়া যায় যে পান থেকে চুন খসলে তিনি বিপদে পড়বেন, তাহলে তিনি নিজের ডায়াগনোসিস বা চিকিৎসার পক্ষে যুক্তি বা প্রমাণ সাজানোর জন্য পাঁচরকম পরীক্ষা করাবেন এবং চারজন স্পেশালিষ্টকে রেফার করতে বাধ্য হবেন। পেটে আর বুকে একটু কষ্ট থাকলেই কার্ডিওলজিস্ট, পালমোনোলজিস্ট, গ্যাস্ট্রোএন্টেরোলজিস্ট। যাঁদের কাছে রেফার হল, তাঁরাও ভয়ে ভয়ে ওপিনিয়ন দেবেন। "তেমন কিছু তো পাচ্ছি না, কিন্তু ইকো আর অ্যাঞ্জিও করিয়ে নিলে হয়।" "পেটে ব্যথা আছে যখন, পেটের একটা সিটি স্ক্যান আর এণ্ডোস্কোপি হোক", কারণ বইতে সেসব লেখা আছে আর না করালে কোর্ট দোষী সাব্যস্ত করবে। ১০০ জন রোগীর মধ্যে একজনের যদি একজনের ক্ষেত্রে কোনো অঘটন ঘটে (এমনকি সম্পূর্ণ অন্য কারণে) তাহলে "ফেঁসে যাবার" ভয়। অতএব ১০০ জনের ক্ষেত্রেই এই পরীক্ষানিরীক্ষা করতে হবে।   তাতে আপনার চিকিৎসার খরচা বাড়বে ৮-১০ গুণ। খেয়াল করে দেখুন, দুই দশক আগের তুলনায় এখন আপনার চিকিৎসার খরচ কতটা বেড়েছে? আরো বাড়বে। 

সম্প্রতি আদালতের নির্দেশ এসেছে আল্ট্রাসাউন্ড গাইডেন্স ছাড়া প্লুরাল ট্যাপ (ফুসফুসের বাইরে জমে যাওয়া জল বের করা) করলে ৪১ লক্ষ টাকা জরিমানা। আমরা প্রত্যেকেই বোধহয় কয়েকশ রোগীর এই প্রসিডিওর করেছি ওয়ার্ডেই, নিখরচায়। আর কোনো ডাক্তার সাহস পাবেন না। এবার থেকে এই কাজটির জন্য আপনার হাজার কুড়ি-ত্রিশ টাকা খরচা হবে। তবে সর্বনাশের উল্টো পিঠেই থাকে পৌষ মাস। হাজার হাজার আল্ট্রাসাউন্ড, সিটিস্ক্যান, এম আর আই মেশিন বিক্রি হবে। সিমেন্স-ফিলিপ্সের রমরমা বাণিজ্য। খরচা সামলাতে আপনারা সকলে ইনসিওরেন্স করাবেন। গ্রাহকসংখ্যা বাড়লেই লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়বে প্রিমিয়াম। একসময় দেখবেন বছরে পঞ্চাশ-ষাট হাজার টাকা স্বাস্থ্যবীমার প্রিমিয়াম জমা দিচ্ছেন এবং চিকিৎসার সময় নানা ছুতোয় আপনার খরচা দিতে অস্বীকার করছে বীমা কোম্পানি। 

এসব আইনি প্যাঁচ নিয়ে তাও সরাসরি কোনো আপত্তি নেই, বিতর্ক থাকলেও। দেশে আইন থাকা উচিত এবং আদালতকে আমরা সম্মান করি। কিন্তু নিত্যদিনের মারপিট? ওয়ার্ড সিস্টার আর মহিলা ডাক্তারের শ্লীলতাহানি? এগুলো আপনারা তো নিজেরা করেন না বা সমর্থনও করেন না। তাহলে আপনাদের নাম নিয়ে যারা এসব করছে, তাদের থামাবেন না? তাদের উদ্দেশ্যটা কী? তাদের উদ্দেশ্য হল চিকিৎসক ও রোগীর সম্পর্ক এতটাই তিক্ত করে দেওয়া, যাতে চিকিৎসকেরা আপনাদের শত্রু ভাবেন, ভয় পান। কোনো চিকিৎসক যাতে আর আপনাদের কথা সহানুভূতির সঙ্গে বিবেচনা করতে না পারেন। পাশ্চাত্যের বহুজাতিক বাণিজ্যপুঁজিগুলি আসন্ন সঙ্কটের মুখে। তাদের দেশে স্যাচুরেশন এসে গেছে। এখন তৃতীয় বিশ্বের বাজার দখল করতে হবে। এই বাজার থেকে সর্বাধিক মুনাফা লোটা তখনই সম্ভব হবে, যখন এখানকার পারস্পরিক বিশ্বাস নির্ভর সরল মানবিক আদানপ্রদান একেবারে ধ্বংস করে দেওয়া যাবে। ডাক্তার এবং রোগীর মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সহানুভূতি নষ্ট করে দিতে পারলেই স্বাস্থ্যক্ষেত্রকে ব্যবসায়িক মৃগয়াক্ষেত্র বানানো সম্ভব হবে। হচ্ছে ইতোমধ্যে।

গত আড়াই দশক এদেশে স্বাস্থ্যক্ষেত্রে যে পরিবর্তন এবং অশান্তি চলছে, তা একটি বৃহৎ এবং সুনিপুণ পরিকল্পনার অংশ। নিখুঁত গেমপ্ল্যান। যেসব বুদ্ধিজীবী এবং সংবাদমাধ্যম নিয়মিত আপনাদের উসকাচ্ছেন অশান্তি বাড়ানোর লক্ষ্যে, তাঁদের অনেকেই (সবাই নন) চুক্তি অনুযায়ী অর্থের বিনিময়ে এ কাজ করছেন। এঁদের চিনুন। মুখোশের আড়ালে মুখগুলো দেখুন। ইতিহাস মনে করুন, কীভাবে রেড ইন্ডিয়ানদের মিথ্যায় ভুলিয়ে তাদের জমি-জিরেত লুটে নেওয়া হয়েছিল। এবার ইন্ডিয়ানদের পালা। উসকানিতে নাচবেন কিনা, প্রলোভনে পা দেবেন কিনা, সে সিদ্ধান্ত আপনাদের। 

ডাক্তারকে যতই শত্রু মনে হোক, সত্যিটা হল, আপনার এবং বৃহৎ পুঁজির সর্বগ্রাসী ক্ষুধার মধ্যে যে একমাত্র পাঁচিল দাঁড়িয়ে আছে, তার নাম চিকিৎসক, কারণ একমাত্র তার সঙ্গেই আপনার সরাসরি মানবিক সম্পর্ক। এই পাঁচিলটিকে ধসিয়ে দিতে পারলেই কেল্লা ফতে। তখন আপনি বাঘের মুখে। এমতাবস্থায় চিকিৎসকেরা যদি সংগঠিতভাবে এই আগ্রাসনের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেন, তবে তা রোগী-চিকিৎসকের যৌথ স্বার্থে, কারণ এই দুই গোষ্ঠীর স্বার্থ অনাদিকাল থেকেই যৌথ। আপনি কী করবেন? বাঘের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবেন, নাকি পাঁচিলটা ভেঙে ফেলার কাজেই হাত লাগাবেন? সিদ্ধান্ত আপনার। ভবিষ্যতও আপনারই।

মঙ্গলবার, ১৫ আগস্ট, ২০১৭

স্বাধীনতা ~ আর্কাদি গাইদার

স্বাধীন ভারতের ধারনা নিয়ে দ্বন্দ্ব বহুদিনের।
ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ থেকে স্বাধীনতার জন্যে যারা লড়েছিলেন, তাদের প্রত্যেকের মাথার মধ্যে স্বাধীন ভারতের ধারনা সম্পর্কে অবশ্যই আলাদা মতামত ছিলো। ভগত সিং যেই স্বাধীন ভারতের ধারনা মাথায় নিয়ে ফাঁসির দড়ি গলায় পড়েছিলেন, আর গান্ধী যে স্বাধীন ভারতের ধারনা বুকে নিয়ে গডসের গুলি খেয়েছিলেন, তার মধ্যে বিস্তর ফারাক রয়েছে। চট্টগ্রামের পাহাড়ে সূর্য সেনের নেতৃত্বে যেই সুবোধ রায়, অম্বিকা চক্রবর্তী, গনেশ ঘোষ আর লোকনাথ বল একইসাথে কাধে কাধ মিলিয়ে দাঁড়িয়ে ব্রিটিশদের তাক করে রাইফেল ছুড়েছেন, স্বাধীন ভারতে তারাই কংগ্রেস আর কমিউনিস্ট - দুই শিবিরে ভাগ হয়ে গিয়ে একে অপরের বিরোধী হয়ে রাজনীতি করেছে্ন, ভারত নিয়ে তাদের প্রত্যেকের নিজস্ব ধারনা কে বাস্তবায়িত করতে।

আমরা, স্বাধীন ভারতের নাগরিক যারা, প্রত্যেকেই হয়তো আমাদের এই দেশের কাঙ্খিত চরিত্র সমন্ধে ভিন্ন ধারনা পোষণ করি। এবং এই ভিন্ন ধারনা কে বাস্তবায়িত করতে হয়তো আমরা অনেকেই নিজেদের স্বল্প পরিসরে কোনরকম ভূমিকা পালন করবার চেষ্টা করি। একদিক দিয়ে দেখতে গেলে, আমরা যারা ধারনার জগতে একে অপরের বিরোধী, তারাই আবার সহযাত্রীও বটে। কারন স্বাধীনতা তো কোন গন্তব্য নয়, স্বাধীনতা তো যাত্রা। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের হাত থেকে যারা লড়ে স্বাধীনতা আনলেন, তারা একটা অধ্যায় সমাপ্ত করলেন, এবং স্বাধীনতা যাত্রার পরবর্তী অধ্যায়ের সূচনা করলেন। এই অধ্যায়ের অনেক বৈরিতার মধ্যেও একটা ধারনা অবিচল রয়েছে - বহুত্ববাদ। আর এই বহুত্ববাদের বিরোধী ভারতের ধারনা যাদের, তারা কেউই স্বাধীনতার জন্যে বিশেষ লড়াই করেননি, মুচলেকা লিখে আর ব্রিটিশদের দালালি করে সময় কাটিয়েছেন। স্বাধীন ভারতের উদ্দ্যেশ্যে লড়াই করা সৈনিকদের ইতিহাসের ভার যদি আমরা স্বেচ্ছায় বহন করবার দায়িত্ব নিই, তাহলে তাদের ভারতের ধারনা যা এই ইতিহাসের মধ্যে প্রবহমান, তাকে আমরা অস্বীকার করি কি করে?

স্বাধীন ভারতের ধারনার লক্ষ্যে আজকে ভারতের বুকে লং মার্চ করছেন কানহাইয়া কুমার এবং তার কমরেডরা, তাদের সাথেই পা মেলাচ্ছেন সদ্য আন্দামান থেকে ফিরে তেভাগার বিদ্রোহ সংগঠির করা সুবোধ রায়, স্লোগানের কোরাসে গলা শোনা যাচ্ছে মাষ্টারদা সূর্য সেনের।
গুরগাঁও তে মারুতি কারখানার যে শ্রমিকরা ইউনিয়নের অধিকারের দাবিতে স্ট্রাইক করে জেল খাটছেন, তাদের সাথেই জেলের ভেতর  ভগত সিং আর বটুকেশ্বর দত্ত বসে ১৯২৯ এ ট্রেড ডিসপুট এক্ট পাশ করবার দিন এসেম্বলিতে বোম মারবার গল্প শোনাচ্ছেন। 
গুজরাটে আহমেদাবাদ থেকে উনা অবধি দলিতদের মহামিছিলের শেষে জিগ্নেশ মেওয়ানি স্টেজে উঠে যখন দৃপ্ত কন্ঠে ঘোষনা করছেন - 'তুমহারা মাতা তুম রাখো, হামে আপনি জমিন দো', তখন আকাশে ছোড়া হাজারটা মুষ্ঠিবদ্ধ হাতের মধ্যে একটা হাত আম্বেদকারের। 
বস্তারে শোনি সোরি যখন কর্পোরেট মাফিয়ার হাতে আদিবাসীদের জল-জমি লুঠের বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে কোন এক থানায় পুলিশের হাতে অত্যাচারিত হয়ে এক কোনে রক্তাত, ক্ষতবিক্ষত, খুবলে নেওয়া দেহ নিয়ে পড়ে আছেন, তখন ওই একই সেলে বন্দী মিত্রর কোলে নিজের কোলে তার মাথা টেনে নিয়ে হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন।
আগামী নভেম্বরে দিল্লিতে শ্রমিকদের ধর্ণা এবং লাগাতার ধর্মঘটের আহ্বানের সময় সেই মঞ্চের ওপরেই বসে মুচকি হাসবেন নৌবিদ্রোহের সময় বোম্বেতে ধর্মঘট করা শ্রমিকরা। মঞ্চ থেকে মুষ্টিবদ্ধ হাত ছুড়বেন সাত এর দশকে শিবসেনার হাতে খুন হয়ে যাওয়া কমরেড কৃষ্ণ দেশাই। 
দিল্লি ইউনিভার্সিটির পিঞ্জরা তোড় আন্দোলনের মেয়েরা যখন পুলিশ আর এবিভিপির হাতে মার খাবে দেশদ্রোহী হিসেবে, তখন তাদের সাথে কয়েকটা লাঠির বাড়ি পড়বে প্রীতিলতা ওয়াদেদ্দার আর কল্পনা দত্তর মাথাতেও।
বাংলার বন্যায় যখন ছাত্র, ছাত্রী, যুবক, যুবতীরা ত্রান সংগ্রহ করে পৌছে যাবে জলমগ্ন দুর্গম অঞ্চলে, তখন জলের মধ্যে তাদের হাত ধরে থাকবে ১৯৪৩ এর দুর্ভিক্ষে ত্রানের কাজ করা পিপলস রিলিফ কমিটির অরুনা আসফ আলি, মুজফফর আহমেদরা।
দেশের দিকে দিকে দাঙাবাজ এবং খুনিরা যখন নখ দাত বার করে ঝাপিয়ে পড়বে, তখন সাধারন মানুষকে প্রতিরোধের তালিম দেবেন ট্রাম শ্রমিক মহম্মদ ইসমাইল, তেলেঙানার সামরিক প্রশিক্ষক মেজর জয়পাল সিং।
গোরখপুরে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে খুন হয়ে যাওয়া ৯০টি শিশুর রক্তের হিসেব চাইতে একদিন আগুন জ্বলে উঠবে। খুনিদের কাছে হিসেব চাইতে পৌছে যাবে একদল তরুন তরুনী, তাদের হাতে পিস্তল তুলে দেবেন জেনারেল ডায়ারের ঘাতক শহীদ উধম সিং।

স্বাধীনতা নামক মহাকাব্যের বর্তমান অধ্যায়ে এই নাগরিক চরিত্রগুলো যখন দেশ জুড়ে তাদের ভারতের ধারনা কে বাস্তবায়িত করতে মাঠে নেমেছে, 'আজাদি'র যাত্রায় সহযাত্রী হয়েছে, তখন আমরা সহনাগরিক হিসেবে স্বাধীনতার এই যাত্রা কে মহাড়ম্বরে উদযাপন করবো না কেন? আমরা প্রত্যকেই তো লড়ছি এই আজাদির জন্যে - আমাদের ভারতের ধারনা কে রক্ষা করবার জন্যে। এই স্বাধীনতা দিবসে লাল কেল্লা থেকে স্বাধীনতা দিবসের বক্তৃতা দেবেন যে প্রধানমন্ত্রী, তিনি এমন একটি সংগঠনের সদস্য যারা ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামকে শুধু খাতায়-কলমে বিরোধিতাই করে থামেননি, মাঠে নেমে তার বিরুদ্ধে লড়েছেন,  এই দেশের পতাকা, সংবিধান কোনটাকেই স্বীকৃতি দেননি। স্বাধীন ভারতের যাত্রায় পায়ে পা মেলানোর এই সন্ধিক্ষনের মুহুর্তের ডাকে সাড়া দেবো না? 

আজাদির যাত্রা থামবে কেন?

মধ্য আগস্টের কবিতা ~ অনামিকা

কী লাভ বলো এই স্বদেশে 
কে দিচ্ছে কার প্রক্সি, জেনে
সেই তো শেষে মরবে শিশু। 
টান পড়বেই অক্সিজেনে।

তার পরে? খুব তদন্ত আর 
চক্ষু মোছার বসবে আসর
চতুর্দিকে ঢোলশহরত 
লজ্জাবিহীন ঘণ্টা কাঁসর।

ভোট হারলে নেই কুছ পরোয়া, 
দখলদারির শিরশিরানি 
পরস্পরের জেরক্স ছবি, 
কেন্দ্রে রাজা, রাজ্যে রাণী। 

ধর্ম অন্ধ নিদান দেবে 
জাতীয় গান গাইতে মানা
ভোট ভিখিরি এ'সব শুনেও
তুলবে না তার কণ্ঠখানা।

ভোট জিতলেই অগাধ টাকা, 
কাজের যা চাপ! তাই তা' মেলে!
ডিগ্রি পেয়েও কাজ পাবে না… 
মরতে থাকবে বেকার ছেলে।

এ টিম বি টিম খেলায় ব্যস্ত, 
লোক ঠকানোর কুমিরডাঙা।
খুব সেজেছেন ডেমোক্রেসি, 
যদিও তাঁর কপাল ভাঙা।

মাঝ আগস্টে রেড রোড ফের 
তিনটি রঙের বিপুল সাজে 
করবে প্রমাণ আমরা স্বাধীন 
সকালবেলার কুচকাওয়াজে।

অবাধ্য এক স্বপ্নে তবু 
মারছে ঝিলিক যৌথখামার…
সত্তর পার স্বাধীনতার 
সমস্তটাই তোমার আমার।

শুক্রবার, ১১ আগস্ট, ২০১৭

যাদবপুর ও ছাত্রসমাজ ~ আর্কাদি গাইদার

আজ সারারাত যাদবপুর ইউনিভার্সিটি জাগছে। তারা ধর্নায় বসেছে।
কেন? 
কারন আমাদের রাজ্য সরকার একটি নতুন আইন আনছে। সেই আইনে বলা আছে যে কলেজ বা ইউনিভার্সিটিতে ছাত্র ইউনিয়ন বলে কিছু থাকবে না। কোনরকম গনতান্ত্রিক নির্বাচন হবে না। কোনরকম সংগঠনের ব্যানার থাকবে না। 
তাহলে কি হবে?
স্টুডেন্টস কাউন্সিল নামে এক প্রহসন। যেখানে কলেজ কতৃপক্ষ নিজেরা কয়েকজন ছাত্রকে মনোনীত করবে এই কাউন্সিলের সদস্য হিসেবে। সেই ছাত্রদের দ্বারা গঠির স্টুডেন্টস কাউন্সিল ছাত্র ইউনিয়নের জায়গা নিয়ে তাদের ভূমিকা পালন করবে।

আমাদের রাজ্য সরকারকে কিন্তু কেউ বোকা বলতে পারবে না। তারা জানে যে তাদের এরকম আইনের ব্যাপারে এই রাজ্যের বৃহত্তর ছাত্রসমাজের কিছুই যায় আসে না। যাদবপুর, প্রেসিডেন্সি, এবং আরও কয়েকটা হাতেগোনা কলেজে মোটামুটি গনতান্ত্রিক পরিবেশ কিছুটা হলেও বজায় আছে, সেখানে ছাত্ররা সুষ্ঠুভাবে তাদের গনতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগ করে ভোট দেয়, সংগঠনগুলো ক্যাম্পেন করে, ইউনিয়নের সদস্যরা নির্বাচিত হয়। এর বাইরে শহর এবং জেলার বিভিন্ন কলেজে ছাত্র ইউনিয়ন একটা হাস্যকর ব্যাপার। গত ৬ বছর ধরে তৃণমুল ছাত্র পরিষদ নামক সংগঠন ছাত্র ইউনিয়ন এর ধারনাকে একটি ছেলেখেলায় পরিনত করেছে। কলেজের ছাত্র ছাত্রীদের কাছে ইউনিয়ন মানে তৃণমুলের গুন্ডাদের দাদাগিরি, ঘুষচক্র, গোষ্ঠীদ্বন্দ, মারামারি, তোলা, ছাত্রীদের যৌন হেনস্থা। সুতরাং তাদের কাছে যদি বলা হয় যে রাজনৈতিক ইউনিয়ন উঠিয়ে দিয়ে তার জায়গায় ব্যানারহীন কাউন্সিল আসবে, তারা কোনরকম দুঃখ তো পাবেই না, বরং উলটে আনন্দিত হবে।
এখানে বলে রাখা ভালো, আপনারা বলবার আগেই, যে আগের আমলে বিভিন্ন কলেজে এস এফ আই'র সময় কি স্বর্গরাজ্য ছিলো? একদম না। এই দাদাগিরি, ইউনিয়নের ভোটের নামে প্রহসন, মারামারি এইসব ছাত্র ফেডারেশন বা অন্য কোন রাজনৈতিক ইউনিয়নের ক্ষেত্রেও ছিলো। কিন্তু তার সাথেও যেটা ছিলো, এসবের মধ্যেই, সেটা হলো কিছুটা হলেও ছাত্র রাজনীতি। মানে ছাত্রদের নিজস্ব দাবিদাওয়া, ইস্যু, শিক্ষাক্ষেত্রের পলিসি, এবং বৃহত্তর সমাজের ইস্যু নিয়ে লড়াই আন্দোলন। এই ইস্যুগুলো নিয়ে মোটামুটি এই দেশের বা রাজ্যের সমস্তরকম ছাত্র সংগঠন, কখনো না কখনো লড়াই আন্দোলনে যুক্ত থেকেছে। এমনকি সংঘ পরিবারের সংগঠন এবিভিপিও বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে লড়াই আন্দোলন করেছে। তাদের সেই ইস্যু বা স্ট্যান্ডের আমি বিরোধী, কিন্তু তার মধ্যে যে রাজনীতি আছে সেটা অস্বীকার করা যায় না। 
ব্যাতিক্রম একটা মাত্র ছাত্র সংগঠন। তৃণমুল ছাত্র পরিষদ। গত ৬ বছরে রাজ্য বা দেশের কোনরকম ছাত্রদের ইস্যু নিয়ে তাদের কোনরকম লড়াই বা আন্দোলন দেখা যায়নি। এমনকি কোনরকম স্ট্যান্ড বা বিবৃতিও দেখা যায়নি। রিসার্চ গ্রান্ট থেকে শুরু করে শিক্ষাক্ষেত্রে বাজেট, এইসব বিষয়ে নিয়ে তারা কোনদিন মাথা ঘামায়েনি। তারা ব্যাস্ত থেকেছে ঘুষ নিতে, তোলা তুলতে বা ইভটিজিং করতে। এরকম অদ্ভুত একটি 'ছাত্র সংগঠন' গত ৬ বছর ধরে আমাদের রাজ্যের সিংহভাগ উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জাঁকিয়ে বসে আছে, তার খুব স্বাভাবিক ফল হবে যে এই সমস্ত প্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীদের ধারনা হবে যে এই রাজনীতির থেকে অরাজনীতি ভালো। 
সার্বিক ভাবে আমাদের মধ্যে যেরকম অরাজনীতির ইনজেকশন ফুটিয়ে দেওয়া হয় - দেখো রাজনীতি কত নোংরা, দেখো রাজনীতির কারনে দেশ রসাতলে যাচ্ছে, দেখো পার্লামান্টে কোন কাজ হয় না, দেখো এই তোমাদের গনতন্ত্র, তোমাদের ভোটাধিকার এগুলোর কোন লাভ নেই, অতএব রাজনীতি নিয়ে মাথা ঘামিয়ে সময় নষ্ট করো না, নিজের মতন জীবনযাপন করো, নিজেরটা বুঝে নাও - রাজ্য সরকারের এই পদক্ষেপ এই বৃহৎ চক্রান্তের অংশের বাইরে নয়। এবং তাদের সাহায্য করতে গত ৬ বছরের বিভিন্ন কলেজের ছাত্র রাজনীতির ইতিহাস তৈরি রয়েছে।

ইতিহাস শেখায় -  ছাত্ররা সমাজের সমস্ত গুরুত্বপূর্ন লড়াইতে অগ্রনী ভূমিকা পালন করে। সেই ছাত্রসমাজকেই যদি রাজনৈতিক ভাবে পঙ্গু করে দেওয়া যায়, তাদের মাথায় অরাজনীতির পাঠ ঢুকিয়ে দেওয়া যায়, তাহলে এই স্থিতাবস্থা বজায় রাখা আরও সোজা হয়ে যাবে। ক্ষমতার কেন্দ্রকে বোকা ভাববেন না। সে জানে, ঠিক কোন কোন পদক্ষেপ পর পর নিলে আস্তে আস্তে সাধারন মানুষ রাজনীতির প্রতি নিস্পৃহ হয়ে পড়বে, এবং ক্ষমতায় টিকে থাকা সোজা হবে।

তাই যাদবপুর ইউনিভার্সিটিকে শুধু আজকের রাত নয়, এরকম অনেক রাত জাগতে হবে। তাদেরকে এই লড়াইটা পৌছে দিতে হবে রাজ্যের প্রতিটা কোনে, প্রতিটি ছাত্র ছাত্রীর মগজে। এই আইন থাকলো কি গেলো তাই দিয়ে তাদের হার-জিতের বিচার হবে না। মেদিনীপুর বা পুরুলিয়ার কলেজের ছেলে মেয়েগুলো এই লড়াইটাকে নিজেদের লড়াই বলে অনুধাবন করতে পারলো কিনা, সেটাই হবে হার-জিতের আসল মাপকাঠি।