পর্যটনের থিম
সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়
চিন্তায় মোটে ঘুম হচ্ছে না। ওপর থেকে নির্দেশ এসেছে, পর্যটন মানচিত্রে বাংলা কে ওপর দিকে তুলে আনতে হবে। লোকে যেন বাড়ি থেকে বেরোবার কথা ভাবলেই মাথার মধ্যে গুনগুন করে ওঠে “আমার সোনার বাংলা”। মন্ত্রি সেদিন ডেকে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, বাংলাকে বেচতে হবে। “আমরা বাংলা কে বেচবো পর্যটকদের কাছে”। বলে দিয়েছেন অনেক চর্বি জমেছে গত ৩৪ বছরে আপনাদের, মানে পর্যটন দফতরের আমলাদের। এবারে খেটে খাওয়ার কথা ভাবুন। ওপরতলার সতর্ক নজর রয়েছে প্রতিটি সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে। হয় সুইজারল্যান্ড, লন্ডন, গোয়া তৈরি করুন, নাহলে ফুটুন। মুশকিল হলো যে চাকরি থেকে অবসর নিতে আর মাত্র দেড় বছর বাকি, এই বয়সে তিনি কোন কাননের ফুল হয়ে ফুটবেন? ফুল তো যা ফুটবার, গত বছরেই বেশ ভালো ভাবে ফুটে গেছে। এখন তার ফলভোগ করছেন রাজ্যের মানুষ। দুশ্চিন্তায় ঘুম গেছে ছেড়ে, বদহজম, পেটে গ্যাসও হচ্ছে। বাতানুকুল ঘরে বসেও ঘাম দিচ্ছে। মেয়ের উচ্চমাধ্যমিকের চিন্তা উবে গেছে। ছেলেকে অবশ্য কোন দিনই হিসেবের মধ্যে ধরেন নি। সে থাকে তার নিজের মেজাজ-মর্জি নিয়ে। গলায় গিটার ঝুলিয়ে ঠায় ঝ্যাঙর ঝ্যাঙর করে আরো কয়েকটা অপগন্ডের সঙ্গে। কিছুদিন আগে “ভুতের ভবিষ্যত” ছবিতে নিজের ছেলের একদম জীবন্ত প্রতিমুর্তি দেখতে পেয়েছিলেন। এমনকি পরনের “চে” মার্কা টি-শার্টটি পর্যন্ত।
একটা ভালো থিম চাই পর্যটনের। কাশ্মীর তো সেই মুঘল বাদশাহীর সময় থেকেই ভূস্বর্গ। মধ্যপ্রদেশ বলছে ভারতের হৃদয়ের কাছাকাছি থাকতে গেলে, মধ্যপ্রদেশে আসতেই হবে, “হিন্দুস্তান কা দিল দেখো”। রাজস্থান অত চিন্তা ভাবনায় যায়নি। তাদের ওখানে বরাবরই লোকজন বেড়াতে যায়, তাই স্রেফ “ইনক্রেডীবল স্টেট” বলেই ছেড়ে দিয়েছে। উড়িষ্যা বলছে ভারতের আত্মা খুঁজতে হলে আসুন আমাদের এখানে। উত্তর প্রদেশ লোক ডাকছে বনেদীয়ানায় ভর করে। ভগবানের বাড়ি যেতে চাইলে কেরালা, আর দেবভূমি খুঁজলে উত্তরাঞ্চল। কিন্তু বাংলার থিম কি হবে? এ তো আর দুগ্গা পুজো নয় যে, এবছর “খালাসীটোলা” থিম হলো আর পরের বছর ঠেলাগাড়ি কি ভাঙ্গা ক্যাসেট দিয়েই সাজানো হয়ে গেল। এখানে যেটা বলা হবে, সেটাই থাকবে বেশ কিছু বছর। এবং তার ওপরে ভরসা করেই পর্যটনের মানচিত্র সাজানো হবে, প্যাকেজ তৈরি হবে, রিসর্ট হবে, এবং সেখানে নানা রকম নৈসর্গিক এবং অনৈসর্গিক বিনোদনের উপাদান সাজানো থাকবে। বড় কর্তা মহাকরনে শুনে এসেছেন আদেশ। গত দেড় বছরে কিস্যু হয়নি। লোকে কলকাতার রাস্তায় দেদার প্যাঁক মারছে লন্ডন বলে। এবারে নাকি কিছু একটা না করলে চাকরি, মুন্ডু যে কোন একটা, বা দুটোই যেতে পারে। কাজেই উঠে পড়ে লাগতে হবে। একটা সময়ও দিয়ে দেওয়া হয়েছে। এক মাস। তার একটা দিনও বেশি নয়। ইতি মধ্যে সেই সময়সিমার কুড়ি দিন পেরিয়ে গেছে। এখন ঘন্টা গোনার পালা। মাত্র দশ দিন, মানে দুশো চল্লিশ ঘন্টা বাকী। হয়ত কিছু কমই। খেতে বসে কিছুক্ষন খাবার নিয়ে নাড়াচাড়া করেই উঠে পড়তে হচ্ছে, মুখে কিছুই রুচছে না। চোখ বন্ধ করলেই মনে হচ্ছে করালবদনী – মুন্ডমালিনী খাঁড়ায় ধার দিচ্ছেন মুন্ডু নেবেন বলে, আর তাঁর চেলারা তর্ক করছে মুন্ডুটা মালার মাঝখানে নাকি কোন এক প্রান্তে ঝোলালে মানানসই লাগবে। যতবারই সেই থিম চোখের সামনে ভেসে উঠছে, বাকি সব থিম মাথা থেকে হাওয়া যাচ্ছে। আজকাল কত কিছু বেরোচ্ছে রোজ, কেউ যদি একটা থিমের উপায় করে দিত, আহা সেরকম কি হবে?
সকালে কাগজ আজকাল বড় একটা পড়েন না। কাগজ খুললেই তো খুন, জখম,ধর্ষণ,ডাকাতি এই সব খবর। খেলার পাতায় ও খালি হার আর ঘুষের গল্প। পড়বেনটা কি? তবু একবার হাতে করেন কাগজটা, অফিসে বেরোবার ঠিক আগে, পাউরুটি চিবোতে চিবোতে। জলখাবারের বরাদ্দ ডিমটা কয়েক বছর আগে নিষিদ্ধ ঘোষনা করেছেন ডাক্তার। এখন স্রেফ চা পাউরূটিতেই জলখাবার। সেটা গলা দিয়ে পাচার করতে করতেই কাগজটা নিয়ে একটু নাড়াচাড়া করার অভ্যেস রয়ে গেছে। এই নাড়াচাড়া করতে করতেই চোখে পড়লো বিজ্ঞাপনটা। লিখেছে – “ সমস্যাকে বড় করে দেখবেন না। সমাধানের জন্য আমরা আছি। চিন্তা করতে পারছেন না? সামনে কি ভাবে এগোবেন ভেবে পাচ্ছেন না? মনে হচ্ছে সব রাস্তা বন্ধ? শুধু ডায়াল করুন নিচের নম্বরে“। অফিসের তাড়া ছিলো, তাই আর কিছু ভাবতে পারলেন না, জলদি কাগজটা ভাঁজকরে বাক্সে ঢুকিয়ে তাড়াতাড়ি বেরোলেন। জ্যামজমাট রাস্তায় ভুলেই গিয়েছিলেন বিজ্ঞাপনের কথাটা। মনে পড়লো ফের, যখন বড়কর্তার ফোন এলো, কাজের কথা জানতে চেয়ে। বড়কর্তার অবস্থাও ভালো না। তিনি ফোন করেছিলেন ধমক দিতে নয়, বরং নিজের মানসিক চাপ কাটাতে একটু ভরসা পাবার জন্য। কিন্তু কোন ভরসার কথা শোনানো গেলনা বড়সাহেব কে। কাজেই কিঞ্চিত গরমা গরম শুনতে হলো। ফোনটা রেখে একটা তোয়ালের কাপড়ের রুমাল দিয়ে টাক মুছতে লাগলেন। আর তখনি বিজ্ঞাপনটার কথা মনে পড়লো। প্রথমে কিঞ্চিত দ্বিধা, তার পরে নম্বরটা ডায়াল করেই ফেললেন।ওপারে কিছুক্ষন একটা টুং টাং আওয়াজ, তার পরে একটি মেয়ে বেশ সুরেলা গলায় জানতে চাইল, তিনি বাংলা হিন্দি বা ইংরেজি, কোন ভাষায় কথা বলতে চান। প্রশ্নটা প্রথমে ইংরেজিতেই করা হয়েছিলো, তার পর বাংলা ও হিন্দি তে, কিন্তু মেয়েটি বাংলায় শুরু করতেই ধড়মড় করে বলে বসলেন - ”বাংলা...বাংলা”।
- বেশ, বলুন আপনাকে আমরা কি ভাবে সাহায্য করতে পারি?
- আ আমি খুব বিপদে পড়েছি, মা মানে খুবই সমস্যা, চাকরি নিয়ে টানাটানি
- আপনি আমাদের কাছে সম্পুর্ন নিরাপদ। আপনার নাম বা পরিচয় আমরা জিজ্ঞেস করবো না, শুধু একটি নম্বর দেওয়া হবে আপনাকে, সেই ক্রমিক সংখ্যাটি দিয়ে আপনাকে আমরা চিহ্নিত করব।
বড় সুন্দর বাংলা বলে মেয়েটি। আর কথা বলার ধরনটিও ভারি সুন্দর। থেমে থেমে, পরিস্কার করে কথা। বলে চলে মেয়েটি –
- আপনার ক্রমিক সংখ্যাটি হলো ১৪১০২০১২১, দয়া করে সংখ্যাটি টুকে রাখুন। আর একবার বলছি ১৪১০২০১২১।
- আজ্ঞে আমি লিখে নিয়েছি
- এবারে মন দিয়ে শুনুন, আমাদের অফিসে আসতে হবে আপনাকে। টেলিফোনে তো সব কথা বলা সম্ভব নয়। আপনাকে আমাদের অফিসে একজন পরামর্শদাতা সাক্ষাৎ করবেন। ওনার কিন্তু প্রতিটি সাক্ষাতের জন্য ৬২০০ টাকা করে পারিশ্রমিক লাগে, দয়া করে নগদে আনবেন।
- আজ্ঞে সে নিয়ে আসবো, কিন্তু সাক্ষাৎ টি কবে পাওয়া যায়? আজকে হবে?
- না, আজকে তো সম্ভব নয়, কাল সকাল এগারোটার সময় আপনি আসুন। এই নম্বরে ফোন করে ঠিকানা জেনে নেবেন বেলা নটার মধ্যে। দয়া করে ক্রমিক সংখ্যাটি হাতের কাছে রাখবেন।
- আজ্ঞে থ্যাঙ্ক ইউ। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
- ধন্যবাদ, আর কিছু ভাবে আপনাকে সাহায্য করতে পারি?
- আজ্ঞে, ইয়ে, মানে ...
- আমাদের যোগাযোগ করার জন্য ধন্যবাদ, আপনার দিনটি ভালো কাটুক।
ফোনটা কেটে গেল। একটু ভরসা কি পাওয়া যাচ্ছে? এখনো নয়। তবে মনটা আগের চেয়ে খুব সামান্য হলেও হালকা লাগছে এটা ঠিক। এখন তাঁর খড়কুটো আঁকড়ে ধরার মত অবস্থা।
ভোর ভোর ঘুম ভেঙ্গে গেছে আজ। সকাল নটা বাজতে বোধহয় কয়েক সেকেণ্ড আগেই ফোনটা করে ফেললেন। ক্রমিক সংখ্যা লেখা চিরকুট সযত্নে রাখা ছিল মানি ব্যাগে। ঘরের দরজা বন্ধ করে, কেউ যেন না শুনতে পায় এই ভাবে কথা বলে ঠিকানা টুকে নেওয়া হলো। জায়গাটা একটু দূর। একটা ট্যাক্সি নিলেন আজকে। কড়কড়ে দুশো টাকা গচ্চা গেল, তা কি আর করা যাবে? জায়গাটা খুঁজে পেতে একটি অসুবিধেই হলো। কোন সাজানো অফিস নয়, একটা এঁদো গলির মধ্যে ইঁট বারকরা একটা পুরোনো বাড়ি। নম্বরটা নেহাত লেখা ছিল দরজার ওপর, তাই খুঁজে পাওয়া গেল। দরজা খুলে দিলো একটি বছর ২২-২৪ এর ছেলে। ভেতরে বৈঠকখানা গোছের একটা ঘর। বেশ সাজানো গোছানো। একটা সোফায় বসিয়ে ছেলেটি চলে গেল ক্রমিক সংখ্যাটি নিয়ে। কিছু পরে ফিরে এলো, সঙ্গে আর একটি সুবেশ তরুন। এই ছেলেটির বেশ কেতা আছে। টাই পরেছে। একটা হালকা নীল ফুলহাতা জামা, গাঢ় নেভি ব্লু প্যান্ট, পায়ে চকচকে কালো বুট। দেখেই বেশ ভক্তি আসে। হালকা হেসে ছেলেটি হাত বাড়ালো –
- হাই , আমি আপনার পরামর্শদাতা
- আজ্ঞে আপনার নামটা ?
- আমাকে আপনি না বলে তুমি বলতে পারেন স্বচ্ছন্দে, আর নাম? না এখানে আমরা কেউই কারোর নাম নিয়ে কথা বলবো না। আমরা শুধু সমস্যা নিয়ে আলোচনা করবো, এবং সমাধানের রাস্তা খুঁজবো।
- খুঁজবে? যদি না পাও ভাই সমাধান? তখন কি হবে?
- আমি খুঁজবোনা, খুঁজবেন আপনি নিজেই, কারন আমরা মনে করি, আপনার চেয়ে ভালো, কেউ আপনার অবস্থাটা বুঝতে পারবেন না। আমরা কেবল কিছু নির্দিষ্ট পদ্ধতি ব্যবহার করে আপনাকে ভাবতে সাহায্য করবো। বলুন আপনার সমস্যাটা ঠিক কি।
ছেলেটার কথাবার্তা খুব বুদ্ধিদীপ্ত। আহা নিজের ছেলেটা যদি একটু এরকম হতো! কিন্তু একে কি সব কথা বলাটা ঠিক? হাজার হোক সরকারী তথ্য। একটু দ্বিধা, তার পরে একবার ইষ্টদেবতার নাম স্মরন করে এক নিশ্বাসে পুরো ঘটনা টা খুলে বললেন ছেলেটিকে।
- বুঝলাম আপনার সমস্যা, কিন্তু এতে অসুবিধে কোথায়?
- মানে কি থিম সেটাই তো ভেবে পাচ্ছি না, কি যে মুশকিল ।
- আপনি শেষ কবে বেড়াতে গেছেন?
- মানে ফ্যামিলির সঙ্গে?
- হ্যাঁ, কবে গেছেন?
- ওই তো গত বছর পুজোর ঠিক পরে গেলাম, আন্দামান।
- কেন গেলেন?
- মানে? ছুটি নিয়ে বছরে একবার তো যাই ই পরিবার কে নিয়ে।
- সে কথা বলছিনা, আন্দামান কেন গেলেন? মানে খাজুরাহোও যেতে পারতেন তো।
- না না, ছেলে মেয়ে নিয়ে ঠিক খাজুরাহো পোষাবে না, আর অনেক বছর আগে আমরা গেছি একবার, বিয়ের ঠিক পরে। তখন তো বেড়ানো অন্য রকম ছিলো, এখন তো সবই পালটে গেছে দেখি।
- যেমন?
- এই যে ধরো, আগে লোকে বেড়াতে যেত পশ্চিমে। মানে দেওঘর, মধুপুর, গিরিডি, গয়া, রাজগীর অথবা দিল্লি, আগ্রা। এখন তো আর সেসব কেউ যায় না, এখন জঙ্গল সাফারি চাই, বাঘ ভালুক দেখা চাই, অথবা তাল ঢ্যাঙা কোন পাহাড়ে উঠে জিভ বের করে ট্যাঙস ট্যাঙস করে পাঁচ দিন হেঁটে কোন এক খোদায় মালুম জায়গায় পৌঁছে দামি ক্যামেরায় নীল নীল ছবি তুলতে হবে, নাহলে থাইল্যান্ড বা শ্রীলঙ্কা গিয়ে সমুদ্রে স্কুবা ডাইভিং বা সারফিং করতে হবে।
- কেন এরা এসব চায় ভেবেছেন?
- আরে, আগে তো লোকে গপ্প লেখা টেখা পড়তো দুচারটে, এখনতো সে সবের পাঠ নেই, কাজেই দিল্লি আগ্রা সেকেন্দ্রার সম্পর্কেই এরা ভালো করে জানে না, তো মধুপুর। এখন চাই অ্যাকশন, চাই অ্যাডভেঞ্চার। আর তার জন্যে যথেচ্ছ টাকা খরচ করতেও রাজী।
- তা এই ভাবে পশ্চিম বাংলার পর্যটনের থিম পেতে অসুবিধে হচ্ছে কেন?
- আরে আমাদের সব আছে, কিন্তু মুশকিল হলো, শুধু অ্যাডভেঞ্চারটাই নেই। শান্তিনিকেতনে পরকিয়া ছাড়া অ্যাডভেঞ্চার নেই। দার্জিলিং এ প্রচন্ড ভিড়, অ্যাডভেঞ্চারের কোন সুযোগই নেই, আর যেটুকু আছে, তার চেয়ে অনেক ভালো সুযোগ দিচ্ছে হিমাচল বা লাদাখ। বিদেশী ট্যুরিস্ট সব ওই দিকেই চলে যায়। তুমি ট্রেক করতে যাবে? সে পথেও আজকাল সাংঘাতিক ভিড়। লোকে লাইন দিয়ে হাঁটে। তার ওপরে পাহাড়ের লোকজন খেপে আছে, যখন তখন কিছু একটা বন্ধ্ ডেকে দিলেই হলো। আর দক্ষিনে? মানে দীঘা – মন্দারমনি? সেখানে একে তো বড় নোঙরা সী-বিচ। দু দিন মদ খাবার জন্য তবু চলে, তার বেশি না। জানো তো আজকাল লোকে তো সরাসরি জিজ্ঞেস করে আমাদের অফিসে খোঁজ নিতে এসে, যে বোতল কি নিয়ে যাবো? না ওখানে পাওয়া যাবে? তা দেশ বিদেশের ট্যুরিস্ট কেন আসবে বলো এখানে? বাঙালি যায়, কিছুটা ধরো কুটির শিল্পদ্রব্য কেনার মতো করে।
- বলছেন, বিদেশী ট্যুরিস্টের জন্য প্রয়োজনীয় মসলা নেই, তাই তো?
- একদম ঠিক। আর শাঁসালো দিশী বা মালদার বিলিতি ছাড়া ভালো ব্যবসা কি করে হয় বলো?
- আচ্ছা, বাংলা বলতে আপনার চোখে কি ভেসে ওঠে?
- হে হে, সে সব তো বহুকাল আগেই ছেড়ে দিয়েছি, এখন উইকএণ্ডে অল্প ভদকা ... ব্যাস
- ধ্যুত্তেরি , পশ্চিম বাংলা বলতে কি ভেসে ওঠে চোখের সামনে ?
- ওহো, দাঁড়াও ...এই, ধরো সবুজ ধানখেত, দুর্গা ঠাকুর, ট্রাম গাড়ি, রবীন্দ্রনাথ, রিক্সা, পোড়া মাটির ঘোড়া এই সব।
- আর কিছু? যদি আপনি বাংলার লোক না হন? যদি ধরুন ওই “না পড়া” পর্যটক হন?
- মানে, তাহলে... একটু ভাবতে হবে। তাহলে ওই ধরো অবরোধ, মারামারি, খুন, ধর্ষন, মাওবাদী, লুঠ, দাঙ্গা... মানে, বাইরের কাগজে যা বেরোয় আর কি।
- এগুলো অ্যাডভেঞ্চার নয়?
- আরে এগুলো অ্যডভেঞ্চার কেন হবে? এগুলো তো গন্ডগোল? মানে, সাধারন ভাবে এগুলো তো ঝামেলা, বিপদ।
- ধরুন যে আমেরিকান নেপালে গিয়ে বিশ হাজার ফুটের ওপরে হাড় জমে যাওয়া ঠান্ডায় তাঁবু খাটিয়ে বসে আছে, তার চারিদিকে হাজার ফুট গভীর খাদ, আর বরফের চোরা ফাঁদ ক্রীভাস, সে কোন আরামের খোঁজে গেছে সেখানে?
- সেটা তো অ্যাডভেঞ্চার স্পোর্ট, তার সঙ্গে এই সব ঝামেলার কি সম্পর্ক?
- এক সময় তো জঙ্গলে যাওয়াটাও লোকে ঝামেলা আর বিপদ বলতো, এখন যাচ্ছে কিনা? জলে ডুবে যাওয়াটাও হলো অ্যাডভেঞ্চার স্পোর্ট, যাকে বলে স্কুবা ডাইভিং।
- কিন্তু তাই বলে অবরোধ মারামারি বা মাওবাদী সন্ত্রাসবাদীদের সঙ্গে ট্যুরিজমের কি সম্পর্ক?
- এখানে যে বিপদের সম্ভাবনা গুলো আছে, সেগুলোকেই আপনারা অ্যাডভেঞ্চার হিসেবে প্রোমোট করুন। বেচতে পারলে ডলারে ভরে যাবেন মশায়।
- টেরর-ট্যুরিজম?
- বাঃ এই তো, দিব্যি একটা নাম দিয়ে ফেলেছেন।
- দাঁড়াও দাঁড়াও, কেমন যেন গুলিয়ে যাচ্ছে।
- কিছু গুলোচ্ছে না, আপনার মাথা শুধু নতুন দৃষ্টিভঙ্গিটায় অভ্যস্ত হতে একটু সময় নিচ্ছে। ভেবে দেখুন, একজন বাইরের ট্যুরিস্ট আসছেন এই বাংলায় শুধু দেখতে, যা বাইরে কোথাও সেই ভাবে পাওয়া যায় না। যেখানে বিপদ আছে, উৎকন্ঠা আছে, ছবি তোলার মতো হাজার একটা বিষয় আছে, যা দেখে শিউরে উঠতে হয়, আছে অজানার হাতছানি।
- কিন্তু এটা নিয়ে কি সত্যিই লোকে উৎসাহী হবে?
- আরে আপনি আমাদের গীটার গলায় সাংসদকেই দেখুন না, কবে একবার নিকারাগুয়ায় গিয়ে কয়েকটা পেটো আর পাইপগান ছোঁড়াছুঁড়ি দেখেছিলেন, সেইটা বেচে কত দিন চালিয়ে গেলেন।
- সেটা ঠিক। না, তোমার কথায় একটা ব্যাপার সত্যিই আছে। কিন্তু মুশকিল হলো টেররিস্টরা যদি সত্যি অপহরন করে? যদি সত্যি লাস পড়ে যায়? তখন?
- দেখুন দাদা, এটাকেই আপনি ট্যুর প্যাকেজের মধ্যে রাখুন না। অফার হিসেবে।
- মানে?
- মানে খুব সোজা, আপনি ট্যুরিস্ট কে নিয়ে যাবেন গা ছমছমে জঙ্গল মহলের মধ্যে কোনো এক ফরেস্ট বাংলোয়। সাহেব সেখানে সন্ধ্যেবেলায় মহুয়ার চুমুক দিতে দিতে আগুনের আলোয় মুরগী সেঁকা চিবোচ্ছেন আর সাঁওতালী মেয়েদের নাচ দেখছেন, এমন সময় হা-রে-রে-রে করে হামলা করলো একদল মাওবাদী...
- মাওবাদীরা হা-রে-রে-রে বলে হামলা করে?
- আহা, আপনাকে একটু বাংলার লোকসংস্কৃতিও ঢোকাতে হবে তো। স্বয়ং রবীঠাকুর লিখে গেছেন “হা-রে-রে-রে ... ওই যে কারা আসতেছে ডাক ছেড়ে”। একটু রবীন্দ্রনাথ ও হয়ে যাবে। আরে দাদা আপনার ওপর তলায় ও খাওয়াতে সুবিধে হবে।
- কিন্তু তারপর? অপহরন করে মেরে ফেলে যদি? মুক্তিপন দেবে কে?
- আরে দাদা, সাহেবের কাছে আপনি পঁচিশ হাজার নিয়েছেন তো
- পঁচিশ হাজারে মুক্তিপন?
- আজ্ঞে ওটা ডলার। খোঁজ নিয়ে দেখুন, অ্যাডভেঞ্চারের জন্যে এটা নেহাৎই কম টাকা
- ওর মধ্যে দশ হাজার, মানে ধরুন পাঁচ লাখ টাকা আপনি দিয়ে দেবেন মাওবাদীদের
- ওরা রাজি হবে?
- আরে স্টেডি ফ্লো অফ মানি যে। বছরে যদি ওরা এরকম দেড়শো থেকে দুশো অপহরন করে, তাহলে আপনি টাকা টা ভেবে দেখেছেন? আর আপনি তো একদল ট্যুরিস্ট নিয়ে যাবেন। একা তো কেউ যাবে না। কাজেই ধরুন প্রতি অপহরনে তারা পঞ্চাশ কি ষাট লাখ টাকা পাবে। বছরে যদি কুড়ি টা ট্রীপ করেন.........
- বাপ রে বাপ। আর বাকি টাকা?
- আরে দাদা, কটা লোক কে জিপে তুলে জঙ্গলমহল নিয়ে যাওয়া, দশ দিন বাদে ফিরিয়ে নিয়ে আসা, আর খাওয়ানো নিয়ে কত খরচা হবে আপনার? বড়জোর কয়েক হাজার টাকা।
- আর বাকি টা সরকারের লাভ?
- আজ্ঞে হ্যাঁ। শুধু বিদেশে বিজ্ঞাপন বাবদে একটু খরচা আছে। তবে সেটা উঠে আসবে দু দিনেই। এ ছাড়া যাঁরা আর একটূ কম খরচে অ্যাডভেঞ্চার চান, তাঁদের জন্য রাস্তা অবরোধ দাঙ্গা। কিম্বা বিরোধীদের পার্টি অফিস পোড়ানো। মহিলাদের জন্য স্পেশাল প্যাকেজ রাত দশটায় বারাসাতের রাস্তায় একা হেঁটে বেড়ানো।
- তুমি জিনিয়াস
- আজ্ঞে আপনিই কিন্তু বের করেছেন, আমি শুধু আপনাকে সাহায্য করেছি। আমাদের ফী টা কিন্তু ভুলবেন না স্যর
- পাগল? ফী তো বটেই, তোমাকে আরো কিছু দেওয়া উচিত
- ফী টা দিলেই হবে স্যর
- এই নাও, এই খামে আছে, আর একটা কথা বলো, এই পরিকল্পনা বড় সাহেবকে কি করে খাওয়াবো?
- আজ্ঞে স্যর আপনাকে ঠিক যে ভাবে আমি বোঝালাম, ঠিক সেই ভাবে
- তিনি একটু ভিতু লোক, তার ওপরে মাথায় বুদ্ধি ও ঠিক ...
- তাহলে স্যর টাকার অঙ্ক দিয়ে শুরু করবেন, এতে আপনার বড় সাহেব শুধু নয়, একদম টপ লেভেল পর্যন্ত ম্যানেজ হয়ে যাবে।
বেরিয়ে একটা ট্যাক্সি তে উঠলেন। বেশ হালকা লাগছে। সামনে যদিও বড়সাহেব কে বোঝানোটা রয়েছে, কিন্তু একটা অদ্ভুত আত্মবিশ্বাস পাচ্ছেন নিজের ভেতরে। অফিসে পৌঁছে সোজা ঢুকে গেলেন বড় সাহেবের ঘরে।
তিন মাস পর ওয়েবসাইটে আর বিভিন্ন বড় বড় কাগজে বিজ্ঞাপন বেরোল –
“ আতঙ্কের বাংলা - The ultimate Terror Tourism Experience. Come to Bengal, the home of terror. ”
[এই গল্পের সমস্ত চরিত্র ও ঘটনাপ্রবাহই কাল্পনিক।]