মঙ্গলবার, ২৮ মার্চ, ২০২৩

পলিয়েস্টার প্লট ~ অতনু বন্দ্যোপাধ্যায়

সম্প্রতি  টাইমস অব ইন্ডিয়া সংবাদপত্রে প্রকাশিত দু'দিনের (১৭ মার্চ ও ১৯ মার্চ, ২০২৩) দু'টো খবর। প্রতিপাদ‌্য: ১৯৮৯ সালে বোম্বে ডাইংয়ের কর্ণধার নসলি ওয়াদিয়াকে হত‌্যার চক্রান্তে অভিযুক্ত দু'জন বেকসুর খালাস এবং কোর্টের রায়ের পিছনে যুক্তি কী কী।
  নড়েচড়ে বসলাম। বহু পুরনো স্মৃতির ধাক্কায় চালিত হয়ে পড়ে ফেললাম আগাগোড়া। পত্রিকার মুম্বইয়ের প্রতিবেদক জানাচ্ছেন, মামলাটির অবশিষ্ট দুই অভিযুক্ত- ইভান সেকুয়েরা ও রমেশ যোগাথিয়াকে মুম্বইয়ের বিশেষ সিবিআই আদালত নির্দোষ ঘোষণা করেছে। অন‌্য  দুই অন‌্যতম অভিযুক্ত, অর্থাৎ  রিলায়েন্স ইন্ড্রাস্ট্রিজের পদস্থ কর্তা কীর্তি আম্বানি ও তাঁর সহযোগী অর্জুন বাবারিয়া আগেই মারা গিয়েছেন। এঁরা সকলে অবশ‌্য জামিনে মুক্ত ছিলেন। প্রায় পঁয়ত্রিশ বছর বাদে ওয়াদিয়া মার্ডার প্লট মামলায় দাঁড়ি পড়ল।

  সেই ঘটনা!
  মনে পড়ে গেল একের পর এক। স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে কার্যত নজিরবিহীন এক পর্ব। ব‌্যবসায়িক টক্করের দাঁত-নখ বার করা প্রাণঘাতী চেহারার সঙ্গে সঙ্গে শাসক-রাজনীতিক-বণিকমহলের ঘৃণ‌্য স্বার্থ-সম্পর্ক বেআব্রু হয়ে ধরা দিয়েছিল দেশবাসীর সামনে। ফের প্রমাণিত হয়ে গিয়েছিল, যুগে যুগে আদতে বণিকের মানদণ্ডই রাজদণ্ড হয়ে কাজ চালায়। অধিকন্তু দেশের শীর্ষস্থানীয় দুই কর্পোরেট কোম্পানির বাণিজ্যিক প্রতিযোগিতায় যখন খুনের চক্রান্ত, ভাড়াটে খুনিকে সুপারির মতো অভিযোগ জুড়ে যায়, আর নেপথ্যে চলতে থাকে বহুধাবিস্তৃত রাজনীতির অসংখ‌্য সুতোর টানাটানি ও লোম খাড়া করা কোর্টরুম ড্রামা, পুরো ছবিটা জবরদস্ত থ্রিলার হয়ে দাঁড়ায় বইকি!
  ওয়াদিয়া-কাণ্ডও তা-ই দাঁড়িয়েছিল। সে রোমহর্ষক থ্রিলার মুভির পর্দা ওঠে ১৯৮৯-এর শেষ জুলাইয়ে, যেদিন মুম্বই পুলিশের এক ইন্সপেক্টর মারফত একটা অতি গুরুত্বপূর্ণ ও টপ সিক্রেট 'টিপ অফ' এসে পৌঁঁছয় বাণিজ‌্যনগরীর দুই শীর্ষ পুলিশকর্তার টেবিলে। মুম্বইয়ের তদানীন্তন পুলিশ কমিশনার বসন্ত শরাফ ও জয়েন্ট কমিশনার (ক্রাইম) অরবিন্দ ইনামদার জানতে পারেন, মাস সাত-আট আগে 'ওজনদার' কাউকে খালাস করার জন‌্য এক ভাড়াটে খুনিকে সুপারি দেওয়া হয়েছে। দিয়েছেন যিনি, তাঁরও ওজন কম নয়।
  প্রসঙ্গত, শরাফ ও ইনামদার, দু'জনের ভাবমূর্তি নিষ্কলঙ্ক, ঊর্দিতে একফোঁটা কালির দাগ নেই, অপরাধ ও অপরাধীর সঙ্গে তিলমাত্র আপসরফা ওঁদের চরিত্রের বাইরে। শরাফ ইতিমধ্যে সিবিআই, র এবং সেন্ট্রাল আইবি'তে সুনামের সঙ্গে কাজ করে এসেছেন। 'প্রবল চাপেও মাথা না নোয়ানো'র শাস্তিস্বরূপ ইনামদার পঁচিশ বছরের ক‌্যারিয়ারে বদলি হয়েছেন বাইশবার।  
  উল্লেখ‌্য, মুম্বই পুলিশের প্রসিদ্ধ 'এনকাউন্টার-রাজ' তখন সদ‌্য ডানা মেলেছে, পুলিশি বুলেট-ঝড়ের মুখে ক্রমশ পিছু হঠছে দোর্দণ্ডপ্রতাপ মাফিয়ারা। নামীদামি কন্ট্র‌্যাক্ট কিলাররা হয় পগার পার, নয়তো জেলে, কিংবা পুলিশের গুলিতে খতম। এমতাবস্থায় এ হেন 'বড়মাপের' সুপারির খবর শুনে স্বাভাবিক ভাবেই ভ্রূ কোঁচকায় দুই টপ কপের। দীর্ঘ অভিজ্ঞতাজারিত সিক্সথ সেন্সে আঁচ পান, একেবারে উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়। ''হু আর দ‌্য ক‌্যারেক্টারস অ‌্যাট বোথ এন্ডস? গ‌্যাদার অ‌্যাচ মাচ ইনফর্মেশন অ‌্যাজ পসিবল। বি কুইক প্লিজ।''
  আন্ডার ওয়র্ল্ডের সোর্স মারফত ইন্সপেক্টর 'পাকা' খবর  আনেন। সুপারি দিয়েছেন কীর্তি আম্বানি যিনি কিনা রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজের জেনারেল ম‌্যানেজার (পাবলিক রিলেশনস), হামেশা সংস্থার মুখপাত্রের ভূমিকায় দেখা যায়। আর তাঁর টার্গেট হলেন নসলি ওয়াদিয়া, বোম্বে ডাইং খ‌্যাত ওয়াদিয়া গ্রুপের চেয়ারম‌্যান।
   খটখটে শুখা দুপুরে মাথায় বাজ পড়লেও শরাফ-ইনামদার এতটা চমকাতেন না। রিল‌ায়েন্সের টপ অফিসার সুপারি দিয়েছেন বোম্বে ডাইংয়ের মালিককে মারতে? কী সাংঘাতিক!
  পাকিস্তানের জনক, 'কয়েদ এ আজম' মহম্মদ আলি জিন্নার দৌহিত্র নসলি ওয়াদিয়ার বোম্বে ডাইং সে সময় ভারতীয় বস্ত্রশিল্পের আকাশে দৃপ্ত সূর্যের মতো বিদ‌্যমান। পার্সি-ব্রিটিশ-ভারতীয় রক্তের মিশ্রণে যারপরনাই বনেদি, এলিগ‌্যান্ট, রুচিশীল এক ব্র‌্যান্ড, ওয়াদিয়া পরিবারের সুশিক্ষিত আভিজাত্যের সঙ্গে পুরোপুরি মানানসই। 'লিভ লাইফ ইন কলর.. ফ‌্যাশনেবলি', বোম্বে ডাইং.. সামথিং হ‌্যাজন'ট চেঞ্জ ওভার টাইম', কিংবা হান্ড্রেড পার্সেন্ট পলিয়েস্টার শাড়িতে সজ্জিতা পারভিন ববির মুখে 'আয়‌্যাম ইন লভ' --  আমাদের ছোটবেলায়, সত্তর-আশির দশকে দেখা বোম্বে ডাইংয়ের হরেক স্লোগানেও সেই এস্থেটিক অ‌্যারিস্টোক্রেসির ছোঁয়া। পত্রপত্রিকায় পাতাজোড়া বাহারি অ্যাডে সোনালিচুলো করণ কাপুরের রংদার উপস্থিতি। অন‌্য দিকে রিলায়েন্সের জনক ধীরুভাই আম্বানির উত্থানগাথা হল ফুটপাথের ধুলো থেকে রাজপ্রাসাদে উঠে আসার মতো-- কঠোর, রুক্ষ, অমার্জিত, আগ্রাসী। বনেদিয়ানা, সফিস্টিকেশন বা এলিগ‌্যান্সের ছিটেফোঁটা নেই, বরং বিবিধ বিতর্কের কাঁটায় কণ্টকিত, অনৈতিকতার নানা অভিযোগে বিদ্ধ। এর আগে ভারতীয় বস্ত্রশিল্প তথা পলিয়েস্টার শিল্পে ধীরুভাইয়ের কিছু প্রতিদ্বন্দ্বীর যে বিচিত্র ও অস্বাভাবিক পরিণতি হয়েছে, তার পিছনে রিলায়েন্সের ভূমিকার কোনও প্রত‌্যক্ষ প্রমাণ না মিললেও সন্দেহের তির আটকানো যায়নি। কী রকম?
  যেমন ১৯৭৪ সালের নয়াদিল্লির চাঞ্চল‌্যকর ঘটনাটি। রিলায়েন্স সবে সবে মার্কেটে কব্জা কায়েম করছে, তাদের অন‌্যতম  প্রতিদ্বন্দ্বী হাকোবা এম্ব্রয়ডারি। দিল্লির আকবর হেটেলের সামনে হাকোবার কর্ণধার বিপিন কাপাডিয়ার উপর চাপাতি হাতে চড়াও হয় একজন। ১৯৮২'তে ওরকে মিলসের কর্ণধারের ছেলে পঙ্কজ মেহরাকে পিটিয়ে আধমরা করে নয়ানজুলিতে ফেলে দেওয়া হয়, ঘটনাচক্রে সে সময় রিলায়েন্স-ওরকে ব‌্যবসায়িক টক্কর তুঙ্গে। চার বছর বাদে মুম্বইয়ের মুরজানি-কাণ্ডই বা বাদ যায় কেন? টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রিতে ফ‌্যাব্রিকের কাজে যে সব কর্মীর বিশেষ ভূমিকা, সেই 'ক্রিম্পার'দের সর্বভারতীয় সংগঠনের প্রেসিডেন্ট যমুনাদাস মুরজানি ছিয়াশির এক সন্ধ‌্যায় তরোয়াল হামলায় মারাত্মক ঘায়েল হন। ঘটনাচক্রে, ওই সময় রিলায়েন্সের বিবিধ 'অপকীর্তি'র প্রতিবাদে মুরজানি ভীষণ রকম সোচ্চার।
  সমাপতন? 
  হতে পারে। তবু স্বাভাবিক ভাবেই আঙুল ওঠে রিলায়েন্সের দিকে। কিন্তু পুলিশি তদন্তে কোনও প্রমাণ মেলেনি। সমালোচকদের মুখও বন্ধ করা যায়নি। সব টপকে এবার খোদ নসলি ওয়াদিয়াকে খুনের সুপারির অভিযোগ!
  খবরটির গুরুত্ব ও সুদূরপ্রসারী প্রতিক্রিয়া আন্দাজ করে শিহরিত হন শরাফ-ইমানদার। রিলায়েন্স সে মুহূর্তে দেশের সবচেয়ে বিকাশশীল শিল্পগোষ্ঠী, চোখ ধাঁধানো গ্রোথ রেট। রাজ‌্য-রাজনীতির গণ্ডি ছাড়িয়ে দিল্লির ক্ষমতা-অলিন্দের গলি-ঘুঁজিতে তার প্রভাবের জাল বিস্তৃত, মহারাষ্ট্রের মসনদ ঘিরেও রিলায়েন্সের অদৃশ‌্য ক্ষমতা-বলয় বিরাজমান। শোনা যায়, এই 'ক্ষমতার' জোরেই ব‌্যবসার ময়দানে ধীরুভাই প্রথম 'বিলো দ‌্য বেল্ট' হিট করেন নসলিকে, যার রেশ ক্রমে তিক্ততায় দাঁড়িয়েছে। কী ভাবে?
   পলিয়েস্টার তৈরিতে ওয়াদিয়া গ্রুপ ব‌্যবহার করত ডাইমিথাইল টেরিফ‌্যাথ‌্যালেট (ডিএমটি), অন‌্যদিকে রিলায়েন্সের ভরসা পিউরিফায়েড টেরিফ‌্যাথালিক অ‌্যসিড (পিটিএ)-র উপর। পলিয়েস্টার শিল্পের উপাদান হিসেবে এই দুই রাসায়নিকের গুরুত্ব অপরিসীম। অভিযোগ, দিল্লিতে রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে ধীরুভাই ডিএমটি'তে কেন্দ্রীয় শুল্কহার এতটাই চড়া হারে বাড়িয়ে দেন যে, বোম্বে ডাইং দস্তুরমতো সমস‌্যায় পড়ে যায়।
   দ্বৈরথের সেই সূত্রপাত। ব‌্যবসার বহর বা 'আগ্রাসীপনা'র নিরিখে রিলায়েন্সের নীচে থাকলেও নসলি ওয়াদিয়াকে দুর্বল ভাবার কারণ নেই, বহু বছরের ঐতিহ্যের গরিমা ছাড়াও ওঁর মস্ত খুঁটি ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস সংবাদপত্র গোষ্ঠী, যাঁর কর্ণধার রামনাথ গোয়েনকা হলেন নসলির গডফাদার। উপরন্তু মহারাষ্ট্রের তদানীন্তন কংগ্রেসি মুখ‌্যমন্ত্রী শরদ পাওয়ারের সঙ্গে নসলির সখ‌্যতা সর্বজনবিদিত।
  এমতাবস্থায় নসলিকে খুনের জন‌্য সুপারি দেওয়া হয়েছে শুনলে ওয়াদিয়া গ্রুপ চুপ করে বসে থাকবে না, বলাই ব‌্যহুল‌্য। ঝড় উঠবে দেশ জুড়ে। "আঁটঘাট বেঁধে এগোতে হবে, কেস যেন হয় এয়ারটইট, একতিল ছিদ্রও থাকা চলবে‌ না।" জয়েন্ট কমিশনারকে নির্দেশ দিয়ে কমিশনার শরাফের প্রশ্ন, ''হোয়‌্যার ইজ মিস্টার ওয়াদিয়া রাইট নাও?''
  জানা গেল, নসলি এখন বিদেশে, ফিরবেন ক'দিন পরে। 
   খানিক স্বস্তির নিশ্বাস পড়ল দুই পুলিশকর্তার। যাক, অন্তত সামনের ক'টা দিন কোনও অঘটন ঘটবে না। এর মধ্যে জাল গুটিয়ে আনতে হবে।
  পরবর্তী ঘটনাক্রম এগোয় রকেটগতিতে।
  ১০ জুলাই ১৯৮৯। নসলি ওয়াদিয়া বিদেশ সফর সেরে মুম্বই ফিরলেন। তাঁকে একান্তে প্রেক্ষাপট জানিয়ে ১২ জুলাই সিকিউরিটিতে মোতায়েন হল মুম্বই পুলিশের বিশেষ টিম। ১৭ জুলাই মুখ‌্যমন্ত্রী শরদ পাওয়ারের সঙ্গে জরুরি ও প্রাইভেট অ‌্যাপয়ন্টমেন্ট চাইলেন পুলিশ কমিশনার। ইনামদারকে পাশে নিয়ে ঘণ্টাখানেকের রুদ্ধদ্বার বৈঠকে কেসটির অস্বাভাবিক গুরুত্ব ও মাত্রা বিশদে ব‌্যাখ‌্যা করলেন সিএম'কে। একই সঙ্গে আশঙ্কা প্রকাশ করলেন, কোনও ভাবেই আম্বানিদের কাছে যেন খবরটা 'লিক' না হয়, কারণ সে ক্ষেত্রে ইনফর্মেশনে বিন্দুমাত্র সত‌্যতা যদি থেকেও থাকে, প্রমাণ করা কঠিন হয়ে যাবে। এবং এই যুক্তিতেই কমিশনারের আর্জি, স্বয়ং মুখ‌্যমন্ত্রী তথা রাজ্যের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শরদ পাওয়ার এবং হোম সেক্রেটারি এস রামমূর্তি ছাড়া সরকারের তৃতীয় কারও কানে যেন সংবাদটা না যায়। বিশেষত স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বিলাস সাওন্তের কানে তো নয়ই, কেননা তিনি আম্বানির খাস লোক, টপ এজেন্ট।
  শরদ পাওয়ারের চেয়ে সেটা কে আর বেশি জানেন!
  এ প্রসঙ্গে দেশের তৎকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এক ঝলক চোখ বোলানো যাক। সময়টা ১৯৮৯-এর মাঝামাঝি, কেন্দ্রে রাজীব গান্ধীর কংগ্রেস সরকারের অন্তিম লগ্ন। বফর্সের গোলায় ইন্দিরাতনয় ক্ষতবিক্ষত, ভিপি সিংহের গর্জন স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর, আমলা-রাজনীতিক কর্পোরেট হাউসের বিবিধ জটিল সমীকরণের প‌্যাঁচে শাসনযন্ত্র ঘেঁটে ঘ (বছরশেষে লোকসভা নির্বাচনে রাজীব সরকারের পতন ঘটবে, কুর্সি দখল করবে বিশ্বনাথপ্রতাপ সিংহের জনতা দল)। কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের মতো মহারাষ্ট্র কংগ্রেসও গোষ্ঠীকোন্দলে জেরবার, সরকারের বিরুদ্ধে গণ অসন্তোষ ঘনায়মান, পুরকর্মী হরতাল থেকে ট্রাক-ট‌্যাক্সি ধর্মঘট সামাল দিতে শরদ পাওয়ারের ঘুম ছুটেছে। তার উপর রয়েছে দিল্লির নেতাদের একাংশের রোষবহ্নির আঁচ।
  ঠিক এমনই সঙ্কটকালে নসলি ওয়াদিয়া হত‌্যা-চক্রান্তের প্রাথমিক চমক কাটিয়ে পাওয়ার সুচিন্তিত পদক্ষেপ করেন। শাসক ও বিরোধীপক্ষের অন্দরে সমান প্রভাবশালী আম্বানি গোষ্ঠী গত কয়েক মাসে নানা ভাবে তাঁকে উত্ত‌্যক্ত করেছে, ফলে ওয়াদিয়ার সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা ক্রমবর্ধমান। শোধ তুলতে মুখ‌্যমন্ত্রী পুলিশকে 'গো অ‌্যাহেড' দিতেই পারতেন। তা না করে সুচতুর রাজনীতিক গোড়াতেই বল ঠেলে দিলেন দিল্লির কোর্টে। কেন?
  কারণ পওয়ার ভাল জানেন, চির দিন কাহারও সমান নাহি যায়। আজ যে শত্রু, কাল সে মিত্র হতে কতক্ষণ? বিশেষত আম্বানিরা যেখানে সর্বঘটে কাঁঠালিকলা! খামোখা আমি আগ বাড়িয়ে দোষের ভাগী হতে যাব কী করতে? দিল্লি কী করে দেখি, তারপর ভাবব।
  সিএমের নির্দেশে মহারাষ্ট্রের হোম সেক্রেটারি রামমূর্তি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রসচিবকে 'ক্ল‌্যাসিফায়েড' চিঠি পাঠালেন ২০ জুলাই। বিস্তারিত অবহিত করে চিঠিতে আর্জি, সিবিআই মুম্বই আসুক তদন্ত করতে। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বুটা সিংকে ব‌্যাপারটা জানানো হোক।
  উল্লেখ‌্য, দিল্লির সরকারে আম্বানি-বিরোধীদের অন‌্যতম মুখের নাম বুটা সিং।
  দিল্লি নিশ্চুপ।  'রাজ‌্য সরকারের কী করণীয়, প্লিজ বলুন।'-- ২৩ জুলাই ফের চিঠি দিয়ে জানতে চাইলেন রামমূর্তি। কোনও উত্তর নেই। 
‌‌  পাঁচ দিন অপেক্ষা করে পাওয়ারের গ্রিন সিগন‌্যাল কমিশনারকে--  অ‌্যারেস্ট কীর্তি আম্বানি।
  কীর্তি তো মুম্বইয়ের বাইরে।
  পুলিশ ওত পেতে রইল, টেলিফোনে আড়ি পাতা। এদিকে দিল্লিতে যে তলে তলে তোলপাড় চলছে, তার প্রমাণস্বরূপ সিবিআই ডিরেক্টর মোহন কাটরে আচমকা মুম্বইয়ে হাজির। নসলির ভিসা সংক্রান্ত এক মামলার শুনানিতে তিনি কেন মুম্বই হাইকোর্টে দেখা দিলেন? ওই মামলায় তো সিবিআইয়ের এককণা লেনাদেনা নেই!
   যাঁরা বোঝার ঠিক বুঝেছেন। কাটরে হাওয়া মাপতে এসেছেন। আম্বানিদের 'একান্ত শুভানুধ‌্যায়ীদের' তালিকার ওঁর নাম যে উজ্বল! রিলায়েন্সের নামজাদা শেয়ারহোল্ডারও বটে!
  অর্থাৎ, খবর ঠিকই লিক হয়ে গেছে। 
‌‌  যাবে না, এমন আশা অবশ‌্য পওয়ার করেননি। আম্বানি, ওয়াদিয়া, দু'তরফে ঘুঁটি সাজানোও শুরু। পরিস্থিতি ক্লাইম‌্যাক্সে পোঁছল ৩১ জুলাই। সন্ধ‌্যায় কীর্তি মুম্বই ফিরতেই ওঁর নরিম‌্যান পয়েন্টের অফিসে পুলিশি হানা, একই সঙ্গে টুইন টাওয়ার কমপ্লেক্সের ঝাঁ চকচকে বাসভবনে, যার দু'পা দূরে নসলি ওয়াদিয়ার সুদৃশ‌্য বিচ বাংলো। ভিন্ডি বাজারের ঘিঞ্জি গলির ডেরা থেকে পাকড়াও অর্জুন বাবারিয়া। আন্ডারওয়র্ল্ডের পাকা খবর, রেস্তোরাঁয় ব‌্যান্ডবাদক যুবকটি বিভিন্ন ক্রিমিন‌্যাল ও তাদের সম্ভাব‌্য 'কাস্টমারদের' মধ্যে যোগসূত্রের কাজ করে। পরিভাষায় ফিক্সার, যে কিনা কন্ট্রাক্টের দালালি খায়।
  ১ অগস্ট ১৯৮৯। বোম্বে ডাইং চেয়ারম‌্যান নসলি ওয়াদিয়াকে খুনের ছক কষার অভিযোগে রিলায়েন্সের জেনারেল ম‌্যানেজার কীর্তি আম্বানি ও 'সুপারির মেডিয়েটর' অর্জুন বাবারিয়াকে হেফাজতে নিল মুম্বই পুলিশ। বিষয়টি সম্পর্কে প্রথম প্রকাশ্যে ব্রিফ করল মিডিয়াকে।
  অ‌্যাটম বোমার মতো বিস্ফোরিত হয়ে তা কাঁপিয়ে দিল তামাম দেশ। দুই টেক্সটাইল ব‌্যারনের রেষারেষির এই পরিণাম? এমনই দুশমনি যে, ব‌্যবসায়িক প্রতিদ্বন্দ্বীকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিতে হবে!
 বিস্ময়ের অভিঘাতে সকলে থরোথরো। আমি তখন পোস্ট গ্র‌্যাজুয়েশন ফাইনাল ইয়ার, হস্টেলে গোগ্রাসে খুঁটিয়ে পড়তাম বিভিন্ন কাগজের প্রতিবেদনগুলো। বাংলা কাগজে তেমন কভারেজ না থাকলেও ইংরেজি পত্রিকা, বিশেষত স্টেটসম‌্যান, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস ও হিন্দু ফলাও করে ছাপত, দিনের পর দিন। ঠিক এক বছর আগে ব‌্যাডমিন্টন তারকা সৈয়দ মোদীর হত‌্যাকাণ্ডের জেরে দেশ দেখেছে অপরাধী-রাজনীতিক আঁতাতের ক্লেদাক্ত রূপ। ওয়াদিয়া মার্ডার প্লট সামনে আনল অপরাধী-বণিক-রাজনীতিকের অশুভ নেক্সাসকে।
  এবং সৈয়দ মোদী হত‌্যা-তদন্তের মতো এবারও চোখ কপালে তোলা সব তথ‌্য বেরিয়ে আসতে থাকে। যেমন?
   মুম্বই পুলিশ দাবি করে, নিরন্তর জেরার মুখে কীর্তি-বাবারিয়া ভেঙে পড়েছেন, ষড়যন্ত্রের ঘাঁতঘোঁত পুলিশের মুঠোয়। জানা গিয়েছে, নসলি খুনের ষড়যন্ত্রের সূচনা ৮৮-র নভেম্বরে। একজন 'বিগ বিজনেসম‌্যান'কে খালাস করার বন্দোবস্ত করতে কীর্তি পঞ্চাশ লাখ টাকার কন্ট্রাক্ট দেন বাবারিয়াকে। এমনিতেও নামজাদা সুপারি কিলারেরা তখন বাজার নেই, উপরন্তু নিজের কমিশন বাড়ানোর তাগিদে বাবারিয়া 'ছোটখাটো' অ্যাসাসিনের সন্ধান করতে থাকে। মানে এমন কেউ, যাকে দিয়ে কম টাকায় কাজ হাসিল হবে। 'শানু' নামে একটা আনকোরা ছেলেকে সে কীর্তির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে জানায়, কাজটা ও-ই করবে। দর বাড়ানোর মতলবে শানুকে ছোটা শাকিলের প্রাক্তন গ‌্যাং মেম্বার হিসেবে পেশ করে। পুলিশের অভিযোগ, গত কয়েক মাসে বাবারিয়া-শানুর সঙ্গে কীর্তি একাধিকবার বৈঠক করেছেন দু'টি বিলাসবহুল হোটেলে, খুনের ছকও কষা হয়ে গিয়েছিল। কী ছক?
  প্ল‌্যান ছিল, নসলি তাঁর প্রভাদেবীর বাংলো থেকে বেরোলে একটা গাড়ি দিয়ে তাঁর লিমুজিনের রাস্তা আটকানো হবে, তারপর গুলিতে গুলিতে ঝাঁঝরা। প্ল‌্যান বি-ও রেডি। সন্ধের পর নসলি তাঁর ব‌্যালার্ড পায়ারের অফিস থেকে বার হলেই গুলি। এতে বাড়তি সুবিধা, রাতের দিকে ওই তল্লাট একদম নির্জন থাকে, কাজ সেরে পালানো তুলনায় সহজ।
  পুলিশের দাবি, প্ল‌্যান ইমপ্লিমেন্ট করার পথে চক্রীরা যথেষ্ট এগিয়েছিল। দু'টো রিভলভার জোগাড় হয়, আরও কিছু লোক ভাড়া করা হয় মোটা টাকায়। যেমন রিভলভার সংগ্রহ ও নসলির রাস্তা ব্লক করা গাড়ি চালানোর জন‌্য বাবারিয়ার মহল্লা থেকে ঘাতক টিমে নেওয়া হয়েছিল জনৈক ভার্মাকে, এ বাবদ তাকে পঞ্চাশ হাজার টাকা দেওয়া হয়। শানুর ব‌্যাকআপ হিসেবে আর একজন বন্দুকবাজ ভাড়া করা হয় দশ হাজারে। কন্ট্রাক্ট 'ফুলপ্রুফ' করতে বাবারিয়া তৃতীয় বন্দুকবাজের খোঁজ চালাচ্ছিল, যে কারণে অপারেশন পিছোতে থাকে। প্ল্যান 'এ' মাফিক অপারেশন হলে পালাবে কী ভাবে, তা নিয়েও দোলাচল ছিল। 
  সর্বোপরি, নসলির ঘনঘন বিদেশ সফর সব প্ল‌্যান ঘেঁটে দেয়। 
  তাই বারবার অপারেশনের দিনক্ষণ স্থির করেও বানচাল করতে হচ্ছিল। যে কারণে কীর্তি অধৈর্য হয়ে উঠছিলেন বলে পুলিশের দাবি। তদন্তকারীরা জানান, গ্রেফতারির আগে কীর্তি-বাবারিয়ার-শানুর একাধির ল‌্যান্ডফোন কথোপকথন তাঁরা রেকর্ড করেছেন। তাতে কীর্তিকে আক্ষেপ করতে শোনা গিয়েছে, ''খালাস করতে আর কত দেরি! 'বস'রা যে আমাকে তিষ্ঠোতে দিচ্ছে না!'
  শেষমেশ 'অপারেশন নসলি ওয়াদিয়া'র দিন ঠিক হয়েছিল ২৪ জুলাই। তার আগেই পালে বাঘ, মানে পুলিশ পড়ল।
 কিন্তু কীর্তির বস কারা? রিলায়েন্স?
 জনমানসে একটাই প্রশ্ন ধূমায়িত, অনুচ্চারিত কৌতূহলে কর্পোরেট দুনিয়া টগবগিয়ে ফুটছে। মুখ খোলেন স্বয়ং ধীরুভাই আম্বানি। তাঁর দাবি, পুরোটা সাজানো। সাজিয়েছে সেই একই লোকজন, যারা আগেও আমাদের নামে এ ধরনের আষাঢ়ে গল্প ফেঁদেছে। বিশেষত রিলায়েন্স যখনই কোনও কোম্পানির বড় শেয়ার কিনতে যায়, তখনই এই সব গাঁজাখুরি গপ্পো বাজারে চাউড় করাটা ওদের অভ‌্যাসে দাঁড়িয়েছে। এবারও ব‌্যতিক্রম নয়।
  প্রসঙ্গত, কয়েক সপ্তাহ বাদে এক নামজাদা নির্মাণ কোম্পানির ১২০ কোটি টাকার পাবলিক ইস‌্যু রিলায়েন্স কিনতে চলেছে, তখনকার বাজারদরের নিরিখে অবিশ্বাস‌্য পরিমাণ বিনিয়োগ। সেই সংবাদ কাদের গায়ে চিড়বিড়িয়ে জ্বলুনি ধরিয়েছে, ব‌্যবসায় পাল্লা টানতে না পেরে কারা রিলায়েন্সের বিরুদ্ধে বারবার মনগড়া অভিযোগ করছে, নামোল্লেখ না করেও ধীরুভাই পষ্টাপষ্টি জানিয়ে দিলেন। 
   এবং তাঁর ইঙ্গিত যে ওয়াদিয়া গ্রুপের দিকে, বুঝতে কারও অসুবিধে নেই। রিলায়েন্সের তরফে আরও কয়েকটা প্রশ্ন তোলা হল। যেমন, সম্পদ ও বিজনেসের নিরিখে ওয়াদিয়া রিলায়েন্সের ধারেকাছে আসে না। খামোখা আমরা ছুঁচো মেরে হাত গন্ধ করব কেন? আর করতে হলে বাবারিয়ার মতো হেঁজিপেঁজির দোর ধরব কেন? রিলায়েন্স যদি সত‌্যি কাউকে খালাস করতে চায়, টপমোস্ট প্রফেশনালকে কন্ট্রাক্ট দেবে, যারা এমনভাবে কাজ সারবে, কেউ টেরটি পাবে না। যত্ত সব ফালতু বকোয়াস!
  নরিম‌্যান পয়েন্টে এক্সপ্রেস টাওয়ারের চেম্বারে রামনাথ গোয়েনকার পাশে বসে নসলি ওয়াদিয়াও স্ট্র‌্যাটেজি তৈরি করছেন। তাঁদের তরফে পাল্টা যুক্তি বাজারে আসতে দেরি হয়নি। ওয়াদিয়া শিবিরের বক্তব‌্য, ছিয়াশিতে এক্সপ্রেস গ্রুপ ও ভিপি সিংহের চাপে রিলায়েন্সের যে নাভিশ্বাস উঠেছিল, তার জন‌্য ওরা (পড়ুন ধীরুভাইয়ের দুই পুত্র- মুকেশ ও অনিল) নসলিকেই দায়ী ঠাউরায়। শোধ তোলার জন‌্য ওরা সর্বদা তক্কে তক্কে রয়েছে। উপরন্তু ওদের ভয়, কেন্দ্রে ভিপি সিংহের সরকার এলে এক্সপ্রেস গ্রুপের মদতে ওয়াদিয়ারা আম্বানিদের পিষে মারবে। তাই চিরতরে নসলি ওয়াদিয়ার মুখ বন্ধ করতে চাইছে, কারণ ওদের ধারণা, এক্সপ্রেস গোষ্ঠীর প্রাণভোমরা হল ওয়াাদিয়া গ্রুপ। তাছাড়া আম্বানিরা ওই নির্মাণ সংস্থার বিপুল শেয়ারের জন‌্য আবেদন করার আগেই খুনের ছক কষা শুরু হয়েছিল। আর হেঁজিপেঁজিকে সুপারি না দিয়ে উপায় কী? নামজাদা খুনিরা তো এখন বাজারেই নেই।
  বাগযুদ্ধে কেস জমে পুরো ক্ষীর! কেন্দ্রীয় সরকার এখনও চুপ?
  আজ্ঞে না। কীর্তি-বাবারিয়া গ্রেফতার হতেই কেন্দ্র নড়েচড়ে বসে। চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে দিল্লি বিজ্ঞপ্তি জারি করে জানায়, মহারাষ্ট্র সরকারের আর্জি মেনে কেসটা সিবিআই হাতে নিচ্ছে। ব‌্যুরোর দুঁদে অফিসারেরা পত্রপাঠ মুম্বই এসে যেন তেন প্রকারেণ দুই অভিযুক্তকে নিজেদের হেফাজতে নিতে মরিয়া চেষ্টা চালাতে থাকেন। 
  এলেনই যখন, এত দেরিতে কেন?
  এখানেই কাহিনীর বিরাট ডাইমেনশন। বিগ কর্পোরেট হাউসের সঙ্গে পলিটিসিয়ানদের অম্লমধুর ইকোয়েশনের জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত নসলি মার্ডার প্লট কেস, যা বুঝিয়ে দেয় সরকারে কাজকর্মে 'বণিকের মানদণ্ডের' ভূমিকা কতটা গভীর ও সুদূরপ্রসারী। মহারাষ্ট্র হোম সেক্রেটারির প্রথম চিঠিতেই কার্যত দিল্লির দরবারে ধুন্ধুমার বেঁধে গিয়েছিল। আম্বানিপন্থীদের সঙ্গে আম্বানিবিরোধী লবির প্রবল টানাপড়েন। কংগ্রেস ও রাজীব সরকারের তালেবরেরা তখন স্পষ্টত দুই শিবিরে বিভক্ত-- প্রো আম্বানি ও অ‌্যান্টি আম্বানি।  আম্বানি লবির প্রধান মুখ হলেন রাজীবের রাজনৈতিক উপদেষ্টা আর কে ধবন, প্রতিপত্তিতে এক নম্বর, যার আঙুলের ইশারা ছাড়া সংগঠন বা সরকারের বাগানে গাছগাছালির একটা পাতাও বাতাসে গা নাড়া়তে দু'বার ভাবে। ওঁর সঙ্গে আছেন অর্থমন্ত্রী এসবি চহ্বান, বিদেশমন্ত্রী পিভি নরসিমহা রাও, পিএমও'র প্রতিমন্ত্রী শীলা দীক্ষিত, ফিনান্স কমিশনের চেয়ারম‌্যান এনকেপি সালভে, বোম্বে কংগ্রেস প্রধান মুরলী দেওরা প্রমুখ। উল্টো দিকে অ‌্যন্টি আম্বানি ক‌্যাম্পে জ্বলজ্বলে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বুটা সিং, রেলমন্ত্রী মাধবরাও সিন্ধিয়া, পার্সোনেল মন্ত্রকের দায়িত্বপ্রাপ্ত পি চিদম্বরম এবং একগুচ্ছ কংগ্রেস এমপি। আমলামহলেও বিভাজন প্রকট। 
  এই পরিস্থিতে আম্বানিপন্থীরা অবিলম্বে সিবিআই পাঠাতে চাইলেও বিরোধীরা তীব্র আপত্তি তোলেন। যুক্তি দেন, ভোটের মুখে এমন পদক্ষেপ রাজীব সরকারকে খোলাখুলি আম্বানি সমর্থক হিসেবে দেগে দেবে, কারণ এটা সম্পূর্ণত রাজ্যের আইনশৃঙ্খলার বিষয়। মহারাষ্ট্র সরকারই তদন্ত করুক। এমনকী সব নজির ভেঙে অন্তত ষাট জন কংগ্রেস সাংসদ প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে এক স্মারকপত্রে সই করেন, যার আর্জি-- দলের ভাবমূর্তির স্বার্থে মামলা কোনও মতেই সিবিআইয়ের হাতে দেবেন না। 
  শেষ মুহূর্তে ধবনের হস্তক্ষেপে স্মারকলিপি পেশের উদ্যোগটা বাতিল হয়। না হলে দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে অভূতপূর্ব ঘটনা হিসেবে তা চিহ্নিত হয়ে থাকত।
  তবে শেষে আম্বানি লবিই জেতে। এমনটা যে হতে পারে, ওয়াদিয়ারা ধরেই রেখেছিল। সেই মতো তাদের তরফে আইনি লড়াইয়ের প্রস্তুতিও নেওয়া হয়, যার পুরোভাগে আর কেউ নন, প্রবাদপ্রতিম আইনজীবী রাম জেঠমালানি স্বয়ং। বোম্বে হাইকোর্টে আবেদন পেশ হয়, কোর্ট সিবিআই তদন্তে স্থগিতাদেশ দেয়।   
   মাথা খারাপ করা এক বেনজির আইনি সংঘাতের সেই সূচনা।
  ধীরুভাইয়ের বড় ছেলে মুকেশ আম্বানি দিল্লি উড়ে গেলেন। নসলি মামলায় সিবিআই তদন্তের অনুমতি চেয়ে ৯ অগস্ট সুপ্রিম কোর্টে নিঃশব্দে রিট পিটিশন দাখিল হল। মজার কথা, আবেদনটি রুজু করলেন বিজেপি জাতীয় কর্মসমিতির এক সদস‌্য। বিরোধী শিবিরেও যে আম্বানিদের শিকড় যারপরনাই পোক্ত! আবেদন পেশের এক ঘণ্টাও কাটল‌ না, সুপ্রিম কোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ শুনানি করে আর্জি মঞ্জুরও করে দিল! 
  গোটাটা হয়ে গেল চুপিসারে, আলোর গতিতে। কেউ জানতেই পারল না!
 কিন্তু তালেগোলে এক জন জেনে ফেলেছিলেন। তার দৌলতেই প্ল্যান চৌপাট হয়ে যায়। তিনি এক্সপ্রেস গ্রুপের সঙ্গে যুক্ত এক জুনিয়র অ‌্যাডভোকেট। নেহাত ঘুরতে ঘুরতে সেদিন ওই এজলাসে পৌঁছে রায় শোনেন। সঙ্গে সঙ্গে দৌড়। গাড়ি হাঁকিয়ে সোজা পার্লামেন্ট হাউসে। রাজ‌্যসভার অধিবেশনে উপস্থিত জেঠমালানির কানে সংবাদটা ফেলামাত্র বাঘা কৌঁসুলি ছুটে বেরিয়ে গাড়িতে সওয়ার। হু হু গাড়ি ছোটে। সুপ্রিম কোর্টে পৌঁছে সোজা এজলাসে ঢুকে বাঘের মতো গর্জন করে ওঠেন, ''ধর্মাবতার, এখানে তো বিচারের নামে একটা জালিয়াতি হয়ে গেল! 
  ( He jumped into the courtroom and roared like a tiger, ''Me Lord, A fraud had been committed on the judiciary! )
  নির্দেশ পুনর্বিবেচনার জন‌্য জোরালো আর্জি জানান। ডিভিশন বেঞ্চ আগের রায় রদ করে নতুন নির্দেশ জারি করে। ২১ অগস্ট পর্যন্ত বোম্বে পুলিশ বা সিবিআই, কেউ নসলি মামলার তদন্ত করতে পারবে না।

  সুপ্রিম কোর্ট বা ভারতের কোনও আদালত এমন নাটকীয়তার সাক্ষী থেকেছে কি? আমার অন্তত জানা নেই।
  তবে সিবিআই আটকানো যায়নি। পরে কেন্দ্রীয় ব‌্যুরোই তদন্ত চালায়। চার্জশিট দেয়। নসলি ওয়াদিয়া নিজে কোর্টে বয়ান দেন। সপ্তাহের পর সপ্তাহ, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর মামলা গড়ায়। ইতিমধ্যে রিলায়েন্স কর্তৃপক্ষ ও নসলি ওয়াদিয়া একাধিকবার নিজেদের ব‌্যক্তিগত বৈরিতার কথা অস্বীকার করেন। ঘটনাটা ধীরে ধীরে বিস্মৃতির অন্তরালে তলিয়ে যায়।
 রুদ্ধ স্মৃতিভাণ্ডারের আগল ভেঙে আচমকাই গত সপ্তাহে, মানে সাড়ে তিন দশক বাদে বিষয়টা ফের ভেসে উঠল, যবনিকাপাত হল নসলি ওয়াদিয়া হত‌্যা চক্রান্ত মামলায়। অভিযুক্তরা জামিনে আগেই ছাড়া পেয়ে গিয়েছিলেন। ২০১৭ সালে কীর্তি আম্বানির মৃত‌্যু হয়, ওঁর অপরাধ প্রমাণিত হলে মৃত‌্যুদণ্ড পর্যন্ত হতে পারত। বাকিদের বেকসুর খালাস করে মুম্বইয়ের সিবিআই আদালত জানিয়েছে, অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে গ্রহণযোগ‌্য কোনও প্রমাণ নেই। পঁয়ত্রিশ বছরের পুরনো যে ক‌্যাসেটে তাদের কল রেকর্ড ধরা রয়েছে, ধুলোর আস্তরণ পড়ে তা অকেজো, কিছু শোনাই যাচ্ছে না। টেলিফোন এক্সচেঞ্জের কোনও নথিও নেই। যে দুই লাক্সারি হোটেলে বসে অভিযুক্তরা নসলি খুনের ছক কষেছিল বলে পুলিশের দাবি, সেখানকারও এমন কোনও প্রত‌্যক্ষদর্শী মেলেনি, যিনি ওদের একসঙ্গে বসে থাকতে দেখেছেন।
  ৯৭ পাতার রায়ে বিশেষ আদালতের মোদ্দা কথা, উপযুক্ত সাক্ষ‌্যপ্রমাণের অভাবেই অভিযুক্তদের বেকসুর ঘোষণা করে মামলা বন্ধ করতে হচ্ছে।
  হয়তো গোটাটাই রজ্জুতে সর্পভ্রম। হয়তো নয়। কিন্তু নসলি ওয়াদিয়া হত‌্যা ষড়যন্ত্রের অভিযোগের হাত ধরে রাজনীতি, আইন, কর্পোরেট দুনিয়ার বিচিত্র সব রূপ সামনে এসেছিল। অনেকের মতে, ওয়াদিয়া-আম্বানি দ্বৈরথের ছায়া পড়ে ৮৯ -এর সাধারণ নির্বাচনে, কার্যত তা ভিপি-রাজীব লড়াইয়েরই প্রিল্যুড ছিল। 
  সময়টাকে একটু ফিরে দেখা গেল। তা-ই বা কম কী!

সূত্র: ইন্টারনেট ও নিজস্ব স্মৃতি

শনিবার, ২৫ মার্চ, ২০২৩

দূর্নীতি কমিশন ও ম্যাডাম হীরক রাণী ~ সুশোভন পাত্র

মুখ্যমন্ত্রী হয়ে এগারোটা কমিশন গড়েছিল মেয়েটা। বছর ঘুরতেই আরও ছটা। এত কমিশন একসঙ্গে জীবনে দেখেনি রাজ্যবাসী। নবান্নের চোদ্দ তলার প্রথম থাকে সে রাখল 'চিরকুটে চাকরি বিলি' কমিশন। দ্বিতীয় থাকে সে রাখল 'জমি বণ্টনে অনিয়মে'র তদন্ত কমিশন'দের। রাজারহাটের কমিশনটাকে জড়িয়ে ধরে সে বলল, তুই আমার 'তুরুপের তাস'। তৃতীয় থাকে রাখল সব 'গণহত্যা' কমিশনদের। ২১শে জুলাই কমিশনটাকে জড়িয়ে ধরে বলল তোর নাম 'বুদ্ধ ভট্টচাজ বধ'।
কিন্তু বছর যেতে না যেতেই ঘটে গেল সেই ঘটনাটা; বার সাতেকের নোটিশের প্যানপ্যানানি, বার তিনেকের জেরার কচকচানির পরেও, জেলে পাঠানো গেল না গৌতম দেবদের, মনীশ গুপ্ত কে বগল দাবা করেও, স্পর্শ করা গেলো না বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যর কেশাগ্র। উল্টে জেলে চলে গেলো মেয়েটার হেভিওয়েট বিধায়ক-নেতা-মন্ত্রীরা। মদন-কুণাল-সুদীপ-তাপসরা জেল ফেরত আসামী। মানিক-কুন্তল-শান্তনু-অয়নরা আপাতত ঘানি টানছে জেলের। বাইরে যারা, জেলে যাবার দিন গুনছে তারা। আর কাটমানির 'রিং মাস্টার' ভাইপোর ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলছে ইডি। মুখ্যমন্ত্রী হয়ে এগারোটা কমিশন গড়েছিল মেয়েটা! বছর ঘুরতেই আরও ছটা!
কমিশনের হাতি পুষতে খরচা রাজ কোষাগারের কোটি কোটি। সিপিএম নেতাদের পিণ্ডি তর্পণের দিবাস্বপ্নে বিগলিত বুদ্ধিজীবীরা কমিশনকে দরাজ সার্টিফিকেট বিলিয়ে বলেছিলেন "এহি হ্যা রাইট চয়েস বেবি"। মিডিয়ার ক্যাকাফনি তে সেদিন চাপা পড়ে গিয়েছিল অজিত লোহার-পূর্ণিমা ঘোড়ুই-জিতেন নন্দীদের লাশের নিস্তব্ধতা। ঠিক যেমন আজ "আঁতুড়ঘর-আলমারি-চিরকুট-ফাইল-অর্পিতা-শ্বেতার" রঙচটা খবরের ডেসিবেলে অবলীলায় অবহেলিত হচ্ছে বাস্তবটা। বাস্তব, তৃণমূল আপাদমস্তক একটা চোর-লুম্পেনদের দল! আর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সেই দলের নেত্রী! পিরিয়ড! 
ডিয়ার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কিসের চিরকুট? কি আলমারি? কোন ফাইল? কার কমিশন? সিপিএম কে আপনি ভয় দেখাচ্ছেন কোন অউকাদে? আরে ম্যাডাম আপনি কি বলবেন, আমরাই আপনাকে বলছি ১২ বছরে সিপিএম-র দুর্নীতি খুঁজতে কি কি করেছেন আপনি! 
২০১২-র ৩রা জানুয়ারি, কেতাদুরস্ত রাইটার্সের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে আপনি বলেছিলেন "বামেরা দুর্নীতির আঁতুড়ঘর তৈরি করে গেছে। অডিট করানো হয়েছে। একটু একটু করে প্রকাশ্যে আনব।" 'একটু একটু করে' প্রকাশ্যে আনতে ১২ বছর লেগে গেল ম্যাডাম? ২০২২-র ১৯শে মে, ঝাড়গ্রামে আপনি বললেন, "সিপিএমের ৩৪ বছরে চিরকুট দিয়ে চাকরি হত, বদলি হত। আস্তে আস্তে চ্যাপ্টার ওপেন করব। এত দিন ভদ্রতা করে এসেছি।" এমনিতে ভদ্রতা আপনার অ্যান্টোনিম, কিন্তু 'সিপিএম-র চিরকুট' নিয়ে আপনি আদালতে যাচ্ছেন না কেন? বে-আইনি চাকরিগুলো ঘ্যাচাং ফুঁ করে টার্মিনেট করিয়ে দিচ্ছেন না কেন? ২১শে জুলাইর মঞ্চ কাঁপিয়ে আপনি হুমকি দিলেন, "সিপিএম-র ফাইল গুলো খুলব নাকি?"; আরে ম্যাডাম, পারমিশন নিচ্ছেন কেন? হিম্মত নেই কলজেতে? "বামফ্রন্ট দুর্নীতির আলমারি" ১১ বছরেও খুঁজে পেলেন না? কি অপদার্থ মুখ্যমন্ত্রী মাইরি আপনি! 
সিপিএমকে শায়েস্তা করতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কমিশন গড়েছিলেন, সাঁইবাড়ি নিয়ে। বরানগর-কাশীপুর গণহত্যা নিয়ে। বিজন সেতু, দিনহাটায় গুলি, ২১শে জুলাই, নিউটাউনে ফ্ল্যাট বণ্টন, রাজারহাটের জমি অধিগ্রহণ, গড়বেতায় হুল উৎসবের দুর্ঘটনায় আদিবাসী মৃত্যু, এমপিএস সংস্থার কাজকর্ম নিয়ে। এছাড়াও আছে আমরির অগ্নিকাণ্ড, মগরাহাটের নৈনানে গ্রামবাসীদের নিহত হওয়ার ঘটনা, সারদা কেলেঙ্কারি। বসিরহাটে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, তেহট্টে পুলিশের গুলি, বিধায়ক মোস্তাফা বিন কাশেমের মৃত্যুর ঘটনা নিয়ে। মোট ১৬টা কমিশন, ১টা তদন্ত কমিটি! 
বন্ধুগণ আপনাদের ধারে পাশে তৃণমূলের কোন মাতব্বর কচিনেতা, উপনেতারা থাকলে জাপটে ধরে অনুরোধ করুন, এই কমিশনগুলোর রিপোর্ট একটু প্রকাশ্যে আনতে! জিজ্ঞেস করুন না, এই কমিশনের তদন্তের যজ্ঞে ৭ মণ ঘি ঢেলে তৃণমূলের দালাল পুলিশ কোন সিপিএম নেতা কে গ্রেপ্তার করল? 
শিক্ষাক্ষেত্রে তৃণমূলের আমলে নিয়োগে দুর্নীতি কমপক্ষে ১০০০ কোটির। স্রেফ দক্ষিণবঙ্গের ৬০টি পৌরসভাতে ৫০০০ পদে নিয়োগ হয়েছে ৫-৮ লক্ষ টাকার বিনিময়ে। মিডল-ম্যান অয়ন শীলের মাধ্যমেই কাটমানি তোলা হয়েছে ৫০ কোটি। এর সঙ্গে যুক্ত করুন বীরভূমের বীর হনুমানের গরু পাচার, বালি চুরি, জমি দখল, একের পর রাইসমিল হাতানোর, লটারি বাগানোর অঙ্ক। যুক্ত করুন ফ্ল্যাট থেকে উদ্ধার হওয়ার টাকার পাহাড়। যুক্ত করুন গ্রাম বাঙলার প্রতিটি কোণায় আবাস যোজনার ব্যাপক ও বিপুল দুর্নীতি। 
আচ্ছা, আপনি খোঁজ নিয়ে দেখুন তো, বাঙলার যেকোনো প্রান্তে, তৃণমূলের নেতা আজ কারা? কি এদের ব্যাকগ্রাউন্ড? চুরি ছাড়া এরা কি করে? তৃণমূলের র‍্যাঙ্ক অ্যান্ড ফাইলস ভদ্র-সভ্যর কেন ব্রাত্য? লুম্পেন বা মস্তান ছাড়া কি তৃণমূলে নেতা হওয়া যায় না? উচ্চ নেতৃত্বের মাথায় হাত ছাড়া দুর্নীতিকে এতটা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া যায়? ঘাসে মুখ না দিয়ে চললে তো বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয় যে, এই সমস্ত দুর্নীতির 'কিং পিন' আসলে ভাইপো। আর কুইন অফ দা কিংস, মুখ্যমন্ত্রী নিজে!    
তৃণমূলের ভাঁড়, যিনি মুখপাত্র না হয়ে সার্কাসে নাম লেখালে জোকারদের চাকরি চলে যেত, তিনি একসময় প্রকাশ্যে বলেছিলেন "সারদার সবচেয়ে বড় বেনিফিসিয়ারি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়"। ভুল বলেছিলেন? সারদা কর্তা সুদীপ্ত সেন ১৩০ কোটি টাকা দেয়নি তৃণমূলকে? ২০১১-র নির্বাচনে দেদার বিলায়নি সারদার টাকা? প্রার্থী পিছু ১৫ লক্ষ টাকার যৌতুকে ব্যবহার হয়নি গরীব মানুষকে লুটে খাওয়া এই টাকা? 
ম্যাডাম, ভুল পথে হলেও বহুদিন রাজনীতিতে আপনি আছেন। আপনি জানেন, তিনটে বিধানসভা উপ-নির্বাচনে তৃণমূল-বিজেপির যৌথ ভোট ক্ষয় আর বামেদের ব্যাপক ভোট বৃদ্ধি নেহাত কাকতালীয় নয়! পৌরসভা আর কর্পোরেশনে ভোটে বামেদের উত্থান নেহাত কাকতালীয় নয়! দুর্নীতি নিয়ে আপনার বিধায়কদের প্রকাশ্যে ক্ষোভ দেখানো নেহাত কাকতালীয় নয়! বিভিন্ন জায়গায় তৃণমূলের নেতাদের গ্রামে ঢুকতে না দিয়ে খেদিয়ে দেওয়া নেহাত কাকতালীয় নয়! আর তাই, ১-২০ এপ্রিল দুয়ারের সরকারের নামে আপনার পঞ্চায়েত নির্বাচনের জল মাপার চেষ্টা কাকতালীয় নয়। পাঁচ কানে আপনি যে শুনছেন, তৃণমূলে শেষের শুরু হয়ে গেছে, সেটাও আসলে কাকতালীয় নয়। 
ম্যাডাম, বাঙলা থেকে তৃণমূল খেদানোর লড়াই শুরু হয়ে গেছে। আপনি আবার সিপিএম-র ভূত দেখুন। আপনি আবার ধর্না-ধর্না খেলুন। আপনার এরকম ধর্নার ব্লু-প্রিন্ট বাঙলার মানুষ বাখুবি জানেন, আলবাত বোঝেন। আসলে কি জানেন ম্যাডাম, ধর্না বড় সস্তা, রাস্তা, আটকে দিয়েই ছাড়তো/ ছেলে মেয়েরা ভুল করেছে চাকরি পাবে ভেবে/ রেট ছিলো তো ফিক্সই, ঘুষে, কিনে নিলেই পারতো/ বেকার ছেলে, শিল্প হবে, ডিএ আটকে মামলায়/ মাননীয়ার রাজ্যপাটে সব হয়েছে ব্যর্থ/ স্যান্ডুইচে, ক্যাডবেরিতে অনশনে মত্ত/ধর্না বড় সস্তা, শিল্প তাড়িয়ে দিলেই পারতো!

শুক্রবার, ১০ মার্চ, ২০২৩

দার্জিলিং মেলের ইতিহাস




দক্ষিণবঙ্গের সঙ্গে উত্তরবঙ্গ কে সংযুক্ত করার জন্য প্রচুর ট্রেন আছে কিন্তু তার মধ্যেও সবথেকে জনপ্রিয় একটি ট্রেন হলো (১২৩৪৩/১২৩৪৪-দার্জিলিং মেল)আজ তারই কথা বলবো, এটি হলো উত্তরবঙ্গের এবং দক্ষিণবঙ্গের মানুষদের কাছে যাতায়াতের জন্য প্রথম চয়েস, দার্জিলিং মেল প্রথম চালু হয় ব্রিটিশ ভারতের সময় ১লা জানুয়ারি ১৮৭৮ সালে এই কিংবদন্তি ট্রেনটি, ব্রিটিশ আমলে কলকাতা কে উত্তরবঙ্গের সঙ্গে সংযুক্ত করার জন্য পূর্ববঙ্গের(বতর্মানে যার নাম বাংলাদেশ) মাধ্যমে যেতে হতো,১৯৭৮ সালে কলকাতা থেকে শিলিগুড়ি মধ্যে রেল পথটি ছিল দুই ভাগে বিভক্ত, এর প্রথম ভাগটি ছিল ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ের একটি ১৮৫কিলোমিটার এর যাত্রা পথ যেটি ছিল কোলকাতা স্টেশন(যার বর্তমান নাম শিয়ালদহ স্টেশন) থেকে পদ্মা নদীর দক্ষিণ তীরে অবস্থিত দামূখদিয়াহ ঘাট পর্যন্ত।এরপর ফেরি করে নদী পার করে দ্বিতীয় ভাগের যাত্রা শুরু হতো যেটা পদ্মা নদীর উত্তর তীরে অবস্থিত সরাঘাট থেকে শিলিগুড়ি পর্যন্ত ৩৬৬কিলোমিটার এর দূরত্ব, নর্থ বেঙ্গল রেলওয়ের মিটারগেজ লাইনের মাধ্যমে সম্পূর্ণ করা হতো।
Sealdah Station History

পদ্মা নদীর ওপারে ১.৮কিলোমিটার দীর্ঘ লম্বা হার্ডিঞ্জ ব্রিজ,১৯১২সালে তৈরি করা হলে,১৯২৬সালে এই সেতুর উত্তরে মিটার গেজ সেকশন টি ব্রডগেজে রূপান্তরিত করা হয়, এর ফলে কলকাতা থেকে শিলিগুড়ি রুটটি পুরোটাই ব্রডগেজ হয়ে ওঠে।তখন এই দার্জিলিং মেলের রুট এইরকম ছিল-কোলকাতা(বর্তমান নাম-শিয়ালদহ),রানাঘাট,(ভেড়ামারা,হার্ডিঞ্জ ব্রিজ, ঈশ্বরদী, সান্তাহার, হিলি, পার্বতীপুর, নীলফামারী - এই প্রতিটি স্টেশন বর্তমানে বাংলাদেশের অন্তর্ভূক্ত), হলদিবাড়ি, জলপাইগুড়ি এবং শিলিগুড়ি।দার্জিলিং মেল ভারত বিভাগের আগে থেকেই এই রুটে চলাচল করতো, এমনকি ভারত বিভাগের পরেও কিছু বছর এই রুটেই চলাচল করেছে।এই রুটে ট্রেনটি এই জন্য চসলানো হতো কারণ ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাজনের পর কলকাতা কে শিলিগুড়ির মধ্যে সংযোগ স্থাপনের জন্য পশ্চিমবঙ্গে বা বিহার জুড়ে গঙ্গার ওপরে কোনো ব্রিজ ছিল না,. তবে শিলিগুড়ি অবধি একটি সাধারণত গ্রহণযোগ্য রুট ছিল সাহিবগঞ্জ লুপ এর মাধ্যমে সাকরিগালি অবধি এবং কখনও কখনও সাহিবগঞ্জ ঘাট অবধি| ফেরি করে গঙ্গা পার করে মনিহারী ঘাট। তারপর মিটার গেজ এ কাটিহার এবং বার্সই এর মাধ্যমে কিষণগঞ্জ এবং অবশেষে ন্যারো গেজ এ শিলিগুড়ি। এরপর ১৯৬০এর দশকের প্রথম দিকে যখন ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণ করা হচ্ছিল, তখন আর একটি আমূল পরিবর্তন করা হয়, ভারতীয় রেল কলকাতা থেকে একটি নতুন ব্রডগেজ রেল লিংক তৈরি করে যেটি শিলিগুড়ি টাউনের দক্ষিণ দিকে একটি গ্রীনফিল্ড সাইটে একটি সম্পূর্ণ নতুন ভাবে ব্রডগেজ স্টেশনের নির্মাণ করা হয় যেটির নাম নিউ জলপাইগুড়ি, ১৯৭১সালে ফারাক্কা সেতুটি তৈরি হয়ে যাবার পর দার্জিলিং মেল এখন যে রুটে চলাচল করছে এর পর থেকে দার্জিলিং মেল হাওড়া-নিউ জলপাইগুড়ি লাইন বেবহার করে আসছে। (বর্তমানে দার্জিলিং মেল-শিয়ালদহ থেকে হলদিবাড়ি পর্যন্ত চলাচল করে)
Darjeeling Mail Time Table 1941


দার্জিলিং মেল শিয়ালদহ থেকে প্রতিদিন রাত্রি-১০:০৫মিনিটে ছেড়ে ৬৩০কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে পরের দিন সকাল ১০:০০মিনিটে হলদিবাড়ি পৌঁছায়।

বিগত ১৪৫বছর ধরে এই কিংবদন্তি ট্রেনটি আজও নিরন্তন যাত্রী পরিষেবা দিয়ে চলেছে।

বুধবার, ১ মার্চ, ২০২৩

জাতীয় বিজ্ঞান দিবস ~ অরিজিৎ গুহ

আকাশের রঙ কেন নীল? দূর থেকে লাল রঙকে যত সহজে চিহ্নিত করা যায়, নীল রঙকে আবার অত সহজে চিহ্নিত কেন করা যায় না? অর্থাৎ যে কারণে ট্রাফিক সিগনালের আলো লাল রঙের হয় যাতে করে দূর থেকে গাড়ি সেই সিগনাল দেখেই থেমে যেতে পারে, কিন্তু নীল রঙের সিগনাল হয় না। এদিকে আবার আকাশে রামধনু উঠলে দেখা যায় বিভিন্ন আলো বিভিন্ন জায়গা অধিকার করে রয়েছে। কেন?
এই কেন'র উত্তর খুঁজতে গিয়ে বিজ্ঞানের নানা অবিষ্কার হয়ে এসেছে এখনো অব্দি। মানুষের একটা বেসিক কোশ্চেন এই কেন। খুঁজতে শুরু করলেন বিজ্ঞানীরা। অবশেষে ঊনবিংশ শতাব্দির এক প্রখ্যাত ব্রিটিশ বিজ্ঞানী, রয়াল সোসাইটির ফেলো, লর্ড র্যালে সঠিকভাবে ব্যাখ্যা দিতে সমর্থ হলেন এই ঘটনার। উনি বললেন যে কোনো ধরণের তরঙ্গ যদি কোনো কণার সাথে সংঘর্ষ হয় তাহলে সেই তরঙ্গ নিজের নিজের ওয়েভলেংথ অনুযায়ী বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে পড়ে।
ব্যাপারটাকে একটা সহজ সরল প্রাকৃতিক উদাহরণ দিয়ে বোঝালে কেমন হবে? ধরা যাক একটা কাদামাটির তাল নুড়ি পাথর সহ পাহাড়ের ঢাল দিয়ে নামছে। সেই তালে যেমন ছোট ছোট পাথরের টুকরো রয়েছে, তেমনই আবার বড় পাথরের টুকরোও রয়েছে, আবার তার সাথে বালি, মাটি এসবের সাথে জলের মিশ্রণও রয়েছে।
যখন এই কাদামাটির তালের সামনে কোনো বাধা রাখা হবে, তখন কাদামাটির স্রোত সেই বাধার সামনে ভেঙে যাবে। বড় পাথরের টুকরোগুলো যেখানে স্রোতটা ভাঙবে সেখানেই পড়ে থাকবে, ছোট পাথরের টুকরোগুলো হয়ত আরেকটু দূরে গিয়ে থামবে, আর বালি আর কাদার মিশ্রণটা পুরো ছড়িয়ে গিয়ে বাধাটার আসেপাশে গিয়ে অনেকটা দূরে ছড়িয়ে যাবে।
আলোর ক্ষেত্রে কি হয়, সাদা আলো যেহেতু অনেকগুলো আলোর রঙের মিশ্রণ (আসলে সব কটাই ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ওয়েভ), কাজেই আলোর ক্ষেত্রে বলতে পারি যে ওয়েভ যত লম্বা, মানে যার ওয়েভলেংথ অর্থাৎ একটা সাইকেলে যতটা পথ অতিক্রম করে সেটা যত বেশি, সেই ওয়েভকে তত ভারী বলতে পারি। সেই হিসেবে লাল রঙের ওয়েভলেংথ সব থেকে বেশি, মানে লাল আলো আলোদের মধ্যে ভারী আর নীল আলোর ওয়েভলেংথ সব থেকে কম, মানে সব থেকে হাল্কা।
অর্থাৎ আলো যখন কোনো বায়বীয় মাধ্যমের মধ্যে দিয়ে অতিক্রম করবে, তখন সেই মাধ্যমের কণার সাথে ধাক্কা খেলে লাল আলো সব থেকে কম ছড়াবে, আর নীল আলো সব থেকে বেশি ছড়িয়ে পড়বে। লর্ড র্যালে শুধু ঘটনার ব্যাখ্যাই দিলেন না। অঙ্ক কষে বেরও করে দিলেন কোন আলো কতটা ছড়িয়ে পড়বে। এই ছড়িয়ে পড়ার ইনটেন্সিটি অর্থাৎ তীব্রতাকে আই(I) বলি আর ওয়েভলেংথ অর্থাৎ তরঙ্গদৈর্ঘ্যকে ল্যাম্বডা বলি, তাহলে ইন্টেনসিটি ল্যাম্বডার চতুর্থ বর্গের ব্যাস্তানুপাতিক। অর্থাৎ ইন্টেনসিটি প্রোপোরশোনাল টু ওয়ান বাই ল্যাম্বডা টু দি পাওয়ার ফোর। ঠিক এই কারণে যেহেতু নীল রঙ ছড়িয়ে পড়ে বেশি সেইজন্যই আমরা আকাশকে নীল দেখি। আবার এই একই কারণে লাল আলো যেহেতু ছড়ায় কম সেই জন্য লাল আলোকে অনেক দূর থেকেও দেখা যায়। ট্রাফিক সিগনালে লাল আলো ব্যবহার করার কারণও এটাই।

এতক্ষণ ধরে বিজ্ঞানের শুকনো কচকচি চালালাম। কিন্তু যে লেখার জন্য এর অবতারণা করেছি সেখানে এখনো অব্দি আসিই নি। ১৯০৪ সালে যখন র্যালে নোবেল পুরষ্কার পান 'আর্গন' গ্যাস আবিষ্কার এবং গ্যাস সমূহের ঘনত্ব আবিষ্কারের জন্য, তখন সেই বছরই লর্ড র্যালের দেশের এক উপনিবেশ ভারতের মাদ্রাজে মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এক উজ্জ্বল ছাত্র পদার্থবিজ্ঞানে স্নাতক হয়ে প্রথম স্থান অধিকার করে গোল্ড মেডেল পায়।
সেই ছাত্রের যখন আঠারো বছর বয়স, তখন সে একটা পেপার লিখে তার অধ্যাপকদের দেখায়। ছোটবেলা থেকেই ছেলেটির বিভিন্ন বিষয়ে অনুসন্ধিৎসা ছিল। ছোটবেলায় সে তার ভাই বোনেদের নানারকম চমৎকার চমৎকার সব বৈজ্ঞানিক এক্সপেরিমেন্ট দেখাত।
পেপারটা দেখে তার অধ্যাপকরা খুব একটা পাত্তা দিলেন না। তাঁরা ভেবেছিলেন হয়ত বাচ্চা ছেলে একটা গোল্ড মেডেল পেয়ে নিজেকে কী না কী ভাবছে। পেপার তো লেখে রিসার্চ স্কলাররা। এ আবার কি পেপার লিখবে।
ছেলেটি তখন পেপারটা সরাসরি পাঠিয়ে দিল ব্রিটিশ জার্নাল 'ফিলজফিকাল ম্যাগাজিন' এ। পেপারটির নাম ছিল Unsymmetrical diffraction-bands due to a rectangular apperture. পেপারটি ছিল আলোর ধর্ম সম্পর্কিত।
এই জায়গায় অপ্রাসঙ্গিক ভাবে একটা ঘটনার কথা বলা যায়। ঠিক যে সময়ে ওই ছাত্রটির পেপার পাবলিশ হচ্ছে, তার আগের বছরই পদার্থবিদ্যার জগতে এক বিস্ময় ঘটে গেছে। সে বছর এক তরুণ জার্মান বিজ্ঞানি একসাথে 'ব্রাউনিয়ান মোশন', 'স্পেশাল থিওরি অফ রিলেটিভিটি' আর 'ফটোইলেক্ট্রিক এফেক্ট' এই তিনটে বিষয়ে তিনটে পেপার পাবলিশ করেন যা আজও পদার্থবিজ্ঞানের দুনিয়ায় এক বিস্ফোরণ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে রয়েছে। ফটো ইলেক্ট্রিক এফেক্টের জন্য পরবর্তীকালে সেই বিজ্ঞানী নোবেল প্রাইজ পান এবং ওই তিনটে বিষয়ের প্রতিটা বিষয়ই পদার্থবিজ্ঞানে এক নতুন দুনিয়ার উন্মোচন ঘটায়। তরুণ বিজ্ঞানীর নাম যে আইনস্টাইন সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। ১৯০৫ সাল যেন ফিজিক্সের দূনিয়ার এক নভেম্বর বিপ্লবের সাল যা ফিজিক্সের অভিমুখ পালটে দিতে সমর্থ হয়েছিল।

ফিরে আসি সেই ছাত্রের কথায়। ফিলজফিকাল ম্যাগাজিনে পেপার পাবলিশ হওয়ার পর বিজ্ঞানী মহলে যথেষ্ঠ প্রশংসিত হয় সেই পেপার। যথারীতি লর্ড র্যালেরও চোখে পড়ে সেই পেপার। তিনি পড়ে অভিভূত হয়ে যান। আঠেরো বছরের ছাত্রটিকে প্রফেসার সম্বোধন করে আস্ত একটা চিঠিই পাঠিয়ে দেন তিনি।
১৯১৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে তারকনাথ পালিতের নামে পালিত প্রফেসার বলে একটা চেয়ার তৈরি হল। ছাত্রটি ততদিনে ভারতের বিজ্ঞানের জগতে যথেষ্ঠ নাম ধাম কামিয়েছে। প্রথম পালিত প্রফেসার হিসেবে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিল সেই ছাত্রটি। বিজ্ঞানী মহলে তিনি তখন পরিচিত সি ভি রমন হিসেবে।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেওয়ার পাশাপাশি মহেন্দ্রলাল সরকার প্রতিষ্ঠিত ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্যা কাল্টিভেশন অফ সাইন্সেও তাঁর গবেষণা চলতে লাগল। মূলত আলোর ধর্ম নিয়েই চলছিল তাঁর গবেষণা।
১৯২১ এ ভারতের প্রতিনিধি হয়ে অক্সফোর্ডে উপনিবেশ সমূহের বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মেলনে যোগ দিতে সি ভি রমন জাহাজে উঠে বসলেন। সেই সময়ে সারাক্ষণ সমুদ্রে থাকার ফলে খুব কাছ থেকে সমুদ্রকে পর্যবেক্ষণ করলেন। সমুদ্রযাত্রায় বন্ধু হিসেবে পেয়েছিলেন বিপ্লবী বিপিনচন্দ্র পালের ছেলে নিরঞ্জন পাল আর হিমাংশু রায়ের অ্যাসিস্ট্যান্ট সুকুমার যিনি পরে মধু বসু নামে বিখ্যাত চিত্র পরিচালক হন। দুজনে চলেছিলেন হিমাংশু রায়ের 'লাইট অফ এশিয়া' ছবির প্রচারে জার্মানিতে।
লর্ড র্যালে যে আকাশের নীল রঙের ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন, তার সাথে বলেছিলেন আকাশের এই নীল রঙেরই প্রতিফলন ঘটে সমুদ্রের জলে, তাই সমুদ্রের জলকেও নীল দেখায়। রমন সাধারণ মানের কিছু যন্ত্রপাতি দিয়ে সমুদ্রে পরীক্ষা করে দেখলেন যে র্যালের তত্ত্ব সম্পূর্ণরূপে ঠিক নয়। তিনি দেখলেন সমুদ্রের জল নিজেও scatter করে। সূর্যের আলো পড়লে সেই আলোতে জলের অনুগুলো ঠিক তরঙ্গের মতই ছড়িয়ে পড়ে।

্যালে যখন তাঁর তত্ত্ব প্রকাশ করেছিলেন তখন আলো যে একটা তরঙ্গ এই মতই প্রতিষ্ঠিত ছিল। কিন্তু ১৯০৫ সাল আগেই উল্লেখ করেছি পদার্থবিজ্ঞানের বিপ্লবের বছরে আইনস্টাইন যে ফটো ইলেক্ট্রিক এফেক্ট আবিষ্কার করেন, যার জন্য নোবেল প্রাইজ পান, সেই তত্ত্ব দেখিয়ে দিয়েছিল যে আলো শুধু তরঙ্গ নয়। আলোর কণাও হয়। অর্থাৎ আলোর তরঙ্গধর্ম এবং কণা ধর্ম দুইই পাওয়া যায়। একে আলোর দ্বৈত চরিত্র বলা হয়। সমুদ্রের জলের নিজস্ব scattering এর ব্যাখ্যা আলোর এই কণা ধর্মের মধ্যে লুকিয়ে ছিল।
দেশে ফিরে এসে রমন এবার পুরোপুরি light scattering নিয়ে কাজ করতে শুরু করলেন। র্যালের scattering ছিল elastic scattering। অর্থাৎ এই scattering process এ শক্তির কোনো আদান প্রদান হত না। বায়বীয় মাধ্যেম বিভিন্ন আলোর ছড়িয়ে পড়ার মধ্যে শক্তির কোনো তারতম্য ঘটত না। আলোর কণা ধর্ম দিয়ে যখন সি ভি রমন scattering ব্যাখ্যা করতে শুরু করলেন তখন উনি দেখলেন যে আলোর বিভিন্ন মাধ্যমে বিভিন্ন ভাবে ছড়িয়ে পড়ার মধ্যে আলো যে কণা দিয়ে তৈরি সেই ফোটন কণার শক্তির তারতম্য ঘটে। ফোটন কণা কখনো কখনো যে কণাগুলোর সাথে ধাক্কা লাগছে তাদের থেকে শক্তি গ্রহণ করে আবার কখনো কখনো তাদেরকে শক্তি হস্তান্তর করে। যে কণার সাথে ফোটন কণার সংঘর্ষ হয়, সেই কণাটি তখন কাঁপতে থাকে, অর্থাৎ ভাইব্রেশন হয় আর ফোটন কণার যেহেতু শক্তিক্ষয় বা শক্তির অর্জন ঘটে কাজেই সংঘর্ষের আগে আলোর যে রঙ ছিল, সংঘর্ষের পর আলোর রঙ পরিবর্তিত হয়। এই রঙের পরিবর্তন দিয়ে আমরা আলোকে কোন্ মাধ্যমের মধ্যে দিয়ে প্রবেশ করানো হয়েছে সেই মাধ্যমটিকে অনায়াসে শনাক্ত করতে পারি। কোনো মাধ্যমের মধ্যে দিয়ে সাদা আলো প্রবেশ করালে যদি নির্গত আলোর রঙ হলুদ হয় তাহলে আমরা বলে দিতে পারব মাধ্যমটি সোডিয়াম।
্যালের স্ক্যাটারিং এর আরো বিস্তৃত তত্ত্ব আবিষ্কার করলেন সি ভি রমন ১৯২৮ সালের ফেব্রুয়ারির আজকের দিনে অর্থাৎ ২৮শে ফেব্রুয়ারি যা আজ রমন এফেক্ট নামে খ্যাত। এই scattering এ যেহেতু শক্তির আদান প্রদান হয়, কাজেই এই scattering কে বলে inelastic scattering. এই রমন এফেক্টের প্রথম প্রতিক্রিয়া হল আলোর কণাধর্ম আরো দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হওয়া। ফোটন পার্টিকলকে বিজয়ীর আসনে বসিয়ে দিয়ে গেলেন সি ভি রমন। এছাড়াও স্পেক্ট্রোমেট্রির জগতে এক নতুন দ্বার খুলে গেল রমন এফেক্টের ফলে।
পরপর দু বছর ১৯২৮ আর ১৯২৯ যথাক্রমে ওয়েন রিচার্ডসন আর লুই ডি ব্রগলি পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল প্রাইজ পাওয়ার পর ১৯৩০ সালে সি ভি রমন নিজের পুরষ্কার পাওয়ার ব্যাপারে এতটাই আত্মবিশ্বাসী ছিলেন যে জুলাই মাসেই স্কটল্যান্ডের টিকিট কেটে ফেলেন যদিও পুরষ্কার ঘোষণা হওয়ার কথা নভেম্বরে। প্রতিদিন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে খবরের কাগজে পুরষ্কার ঘোষণার খবর খুঁজতেন। অবশেষে তাঁর নাম ঘোষিত হয় এবং রবীন্দ্রনাথের পর দ্বিতীয় ভারতীয় হিসেবে নোবেল পুরষ্কার জয়ী হন।

১৯৮৭ সাল থেকে ভারত সরকারের পক্ষ থেকে ২৮ শে ফেব্রুয়ারি দিনটিকে জাতীয় বিজ্ঞান দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। আজকের দিনের অবৈজ্ঞানিক অবাস্তব বিভিন্ন গল্পগাঁথাকে যখন বিজ্ঞান বলে চালানোর চেষ্টা করা হচ্ছে, তখন আরো বেশি করে সাধারণ ভারতবাসীকে বিজ্ঞান সম্পর্কে সচেতন করাই হোক আজকের দিনের লক্ষ্য। অপবিজ্ঞান নয়, বিজ্ঞানই হোক আজকের দিনে দেশ গঠনের হাতিয়ার।

বুধবার, ২২ ফেব্রুয়ারী, ২০২৩

মাতৃভাষা দিবস ~ ডঃ সমুদ্র সেনগুপ্ত

যার অক্লান্ত প্রয়াসে বাংলা ভাষার শহীদ প্রয়াণ দিবস ২১শে ফেব্রুয়ারি কে ইউনাইটেড নেশন্স বা সম্মিলিত জাতিপুঞ্জকে সারা পৃথিবী জুড়ে "মাতৃভাষা দিবস" হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিল তিনি হলেন কানাডা নিবাসী তরুণ বাংলাদেশি রফিকুল ইসলাম।
রফিকুল, যিনি একজন প্রাক্তন মুক্তিযোদ্ধাও বটে, ৯ই জানুয়ারি, ১৯৯৮ তে কানাডায় বসে তৎকালীন ইউএন মহাসচিব কোফি আন্নান কে ভাষা দিবস ঘোষণা করার অনুরোধ জানিয়ে একটি চিঠি লেখেন। যাইহোক, তার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যাত হয় কারণ ওই ধরণের প্রস্তাব কোনো সদস্য দেশের বদলে, ব্যক্তিমানুষের বা সংগঠনের কাছ থেকে আসলে গৃহীত হয় না।
এটি শোনার পরে হতাশ না হয়ে বন্ধু আব্দুস সালামকে সঙ্গে নিয়ে রফিকুল একটি সংগঠন গড়ে তোলেন। তার সেই সংগঠন, Mother Language Lovers of the World" এর আদি সহযোদ্ধা ছিলেন যে ন'জন, তারা হলেন:
◆আব্দুস সালাম ( বাংলা)
◆এলবার্ট ভিনজন ও কারমেন ক্রিস্টোবল (ফিলিপিনো)
◆জ্যাসন মনির ও সুসান হজিন্স (ইংরেজি ভাষা)
◆কেলভিন চাও (ক্যান্টোনিজ)
◆রিনাতে মারটেন্স (জার্মান)
◆নাজনীন ইসলাম (কাছি) এবং
◆করুণা জোশি (হিন্দি)
৭০ এর দশকে নিউ ইয়র্ক শহরে কালচারাল
এসোসিয়েশন অফ্ বেংগল প্রতিষ্ঠিত হয়। তার প্রাণপুরুষ তথা প্রতিষ্ঠাতা রণজিত্ রায়।রফিকুল এবং আব্দুস নিউ ইয়র্ক এ গিয়ে ওঁর সংগে বিস্তারিত আলোচনার পর এই পুরো অপারেশন এর মানচিত্র তৈরি করেন যে কিভাবে এগোলে জাতিপুঞ্জ এর কাছ থেকে এই দাবি আদায় করা যাবে।
এসব সংক্রান্ত মিটিং এ কোনও সদস্য-দেশ কে আনুষ্ঠানিক ভাবে প্রস্তাব পেশ করতে হয়।
ওই মিটিং এ বাংলাদেশ সরকার এই প্রস্তাবটি পেশ করে। সেই হিসাবে বাংলাদেশ সরকারও তার ভূমিকা যথাযথ ভাবে পালন করেছে ।
বাংলাদেশ সরকারের এই প্রস্তাবটি একটি খসড়া সিদ্ধান্ত আকারে ২৬শে অক্টোবর, ১৯৯৯ সালে প্রকাশিত হয়। ২৮ টি সদস্য দেশ সমর্থন করে। এর পরে ১২ই নভেম্বর, ১৯৯৯ ইউএন জেনারেল এসেম্বলিতে ওই খসড়া আরেকটু বড় আকারে পেশ করে ইউনেস্কো এর টেকনিক্যাল কমিটি, কমিশন দুই।
এর পাঁচদিন পরে ১৭ই নভেম্বর, ১৯৯৯ ইউএন ঘোষণা করে যে একুশে ফেব্রুয়ারি কে "আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস", হিসেবে পালন করা হবে। ইউনেস্কো প্রস্তাব স্বীকৃতি দেয় ১৯৫২ সালের ২১শে এর ভাষা শহীদদের। ১৮৮ দেশের ৬৫২৮ টি মাতৃভাষার গৌরবের দিন।
অবশ্যই রফিকুল ও রণজিৎ, ঘটনাচক্রে, একজন মুসলিম আর অন্যজন হিন্দু, এই দুই বাঙালির এই অবিস্মরণীয় অবদান কে মনে রাখবো কিন্তু কি করে ভুলে যেতে পারি ওপরের তালিকায় তার সহযোদ্ধাদের? তালিকার শেষ নামটি ছিল এক হিন্দিভাষী যুবকের, করুণা জোশি।
যারা ভাষাকে ভালোবাসতে জানে তাদের কোনও ধর্ম হয় না, জাত হয় না, জাতিও হয় না। ভাষা সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়তে হলেই অন্য ভাষাকে বা সেই ভাষায় কথা বলা মানুষজনকে অপমান করতে হয় না। যে নিজের মাকে সম্মান করতে জানে, সে অন্যের মা কেও সম্মান করতে শিখে যায়।

মঙ্গলবার, ২১ ফেব্রুয়ারী, ২০২৩

বাঙালী মানে কী ~ রেজাউল করীম

বড় লেখা। না পড়লেই ভালো। পড়লে ক্ষতি হবে না অবশ্য।
জাঁ পল সাত্রে ইহুদি সম্পর্কে বলেছিলেনঃ "ইহুদি" একজন স্বাভাবিক মানুষ। অন্যরা তাকে ইহুদি ভাবে ও তার উপর "ইহুদি" তকমা আরোপ করে। তার উপর যে ঘৃণার পাহাড় গত দুহাজার বছর ধরে নেমে এসেছে তারজন্য তার দায় যৎসামান্য।
এই কথা কটি বলে রাখলাম এজন্য যে আমার পরের কথাগুলো বুঝতে একটু সুবিধা হবে। ১৯৭৯ সাল। গাঁয়ের বাংলা মিডিয়ামে পড়ে কলকাতা শহরে পড়তে এসেছি। ১৫ বছর বয়স আর ত্রিশ কেজি ওজনের বালক মাত্র। ক্লাসে একজন জিজ্ঞাসা করলো, নাম কি? বললাম নাম। বললোঃ ও আমি ভেবেছিলাম, তুমি বাঙালী! এর পরের ধাক্কাটা আরো ভয়ানক। আমার পাশে দুজন আর্টসের ছেলে বসতো। তারা উর্দু মিডিয়ামের কিন্তু নাসির আলির ইংরেজি ক্লাসে তারা আসতো। একজনের নাম এখনো মনে আছে, রিয়াজ। সে বললোঃ তুমি মুসলমান কি রকম? তুমি তো বাংলায় কথা বলছো!
আত্মপরিচয়ের এই সংকট নিয়ে আমার বেড়ে ওঠা। যে হীনমন্যতা পরিচয়ের সংকট থেকে গড়ে ওঠে তা মানুষের অস্তিত্বকে বিপন্ন করে, তার স্বাভাবিক মানসিক বিকাশের অন্তরায় হয়ে ওঠে।
আজ একুশে ফেব্রুয়ারি ফেসবুক ও শহরের আনাচেকানাচে বাঙালীত্বের ঝড় উঠবে। আজ সবচেয়ে বেশি মনে রাখার দিন যে বাঙালী একটি স্বতন্ত্র সংস্কৃতি, কেবলমাত্র একটি বিশেষ ভৌগলিক অঞ্চলের মধ্যে তার সীমানা নয়। শুধু ধর্ম আলাদা বলেই কেউ ব্রাত্য নয়, বাঁকাচোখে হাসা নয়।
গঙ্গা-পদ্মা-করতোয়া-লোহিত্য ছাড়িয়ে মগধ ও প্রাগজৌতিষ একসময় ছিল বাঙালীর চারণভূমি।বাঙালী প্রাচীন জাতি, নিদেন পাঁচহাজার বছরের পুরনো। বাঙালী বর্ণসংকর জাতি- মূলতঃ আদি-অস্ট্রেলিয়, মিশর-এশিয় মেলানিড , আলপাইন ব্রাকিড এবং স্বল্প পরিমান নেগ্রিটো ও মঙ্গোলীয় এই সাড়ে বত্রিশ ভাজা বাঙালী জীনে উঁকি মারে। রক্তপরীক্ষা করে দেখা গেছে বাঙালী উঁচু জাতি, নীচু জাত, হাড়ি বাঙালী, ডোম বাঙালী, মুসলমান বাঙালী, খৃষ্টান বাঙালী সবার জিনগত বৈশিষ্ট্য এক। নাকের উচ্চতা, চোয়ালের হাড়, করোটির আকার, মুখ ওচোখের আকার ও উচ্চতার যে বাহ্যিক ফারাক তার কারন হল দীর্ঘ মুণ্ড ও দীর্ঘ বা মধ্যনাসা এসেছে যথাক্রমে তার অস্ট্রেলিয় ও মেলানিড জীন থেকে আর তুলনামূলক গোল মুণ্ড এসেছে ব্রাকিড জীন থেকে।
বাঙালীর যে বিভেদ তারজন্য শুধু ইংরেজের দোষ দিলে ইতিহাসের শিক্ষা ভুলে করতে হবে। The rise of Islam in eastern frontier বইয়ে ইটন সাহেব লিখেছেন মূলতঃ নীচু শ্রেণীর ১৪টি জাতি হিন্দু থেকে মুসলমান হয়েছে। মূলত চণ্ডাল, লোধ, শবর ও নমস্য শুদ্ররা এবং কারুশিল্পী শ্রেণী মুসলিম হয়। তথাকথিত নীচু শ্রেণীর হিন্দু ও জলচল গোষ্ঠী ও তার উপরের শ্রেণীর নৈমিত্তিক দ্বন্দ্ব ধর্মান্তরের সাথে সাথে বন্ধ হয়নি বরং তা আরো তীব্র হয়েছে। ধর্মত্যাগীর প্রতি বিদ্বেষ হয়তো বেশিই। তাই বাঙালীর ধর্মীয় বিভেদের ইতিহাস ও কম করে হলেও দু হাজার বছরের পুরনো।
আবার এখন যেমন হিন্দু-মুসলমান বিদ্বেষ দেখছি, একসময় এই বাংলায় শাক্ত-বৈষ্ণব বিদ্বেষ ছিল। তার আগে ছিল বৌদ্ধ হিন্দু লড়াই। হরপ্রসাদ লিখেছেন: বৃহত বঙ্গে এক কোটি বৌদ্ধ ছিলেন। এই বঙ্গে হেন গ্রাম ছিল না যেখানে বৌদ্ধ বিহার ছিল না। এখন তার এক খানা ইঁট ও দেখা যায় না। মাঝ খানে ছিল বৌদ্ধ মুসলিম লড়াই। তার ও আগে ছিল উঁচু হিন্দুর সাথে নীচু হিন্দুর লড়াই। বাঙালী ছিল ব্রাত্য। " অঙ্গ বঙ্গ কলিঙ্গ মগধেহপি চ। তীর্থযাত্রা বিনা গচ্ছন্ পুনঃ সংস্কারমর্হতি।।" এই ছিল বিধান- এই সব দেশে যেতে পারেন কিন্তু ফিরতে হলে প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে।
জরাসন্ধ, ভগদত্ত, নরক, পৌণ্ড্র, বাসুদেব এমনকি কৃষ্ণ-জ্ঞাতি নেমিনাথ ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। বৌদ্ধ পুঁথি, বৌদ্ধ বিহার নিশ্চিহ্ন হয়েছে, বৌদ্ধ দেবতা নাম বদলে হিন্দু দেবতা হয়েছেন। তারাদেবী, একজটা, ভদ্রকালি ইত্যাদি। নেড়ে বৌদ্ধ প্রাণভয়ে নেড়ে মুসলিম হয়েছে। অনেকে হিন্দু সমাজে ঠাঁই পেয়েছে অন্তঃজ হিসেবে। উদাহরণ স্বরূপ বৌদ্ধ ডোম পণ্ডিতের কথা উল্লেখ করা যায়। মেথর যে বৌদ্ধ তান্ত্রিকের হিন্দু ধর্মে পুনর্বাসিত হওয়ার চিহ্ন তা দীনেশচন্দ্র সহ অনেকেই মনে করেন। যদি চৈতন্যদেব না থাকতেন তাহলে বাংলায় হিন্দু থাকতেন কিনা সন্দেহ আছে (বৃহত বঙ্গ, পৃঃ ১০-১১)।
বাংলায় চারটি প্রখ্যাত বৌদ্ধ বিহার ছিল। নালন্দা ধ্বংস হয়েছে বখতিয়ারের হাতে। কিন্তু, বিক্রমশীলা, ওদন্তপুর ও সুবর্ণবিহারের কোন খোঁজ নেই। প্রকৃতপক্ষে, বৌদ্ধযুগের অন্তিমপর্ব থেকে সেনযুগ পর্যন্ত লিখিত ধারাবাহিক ইতিহাসের অভাব আছে। অথচ, অজস্র শাস্ত্রের বই রচিত হলেও যেন, ইচ্ছা করেই সামাজিক ইতিহাস লেখা হয় নি। শঙ্কর বিজয় ও শূন্য পুরানে তার কিছু পরিচয় লিপিবদ্ধ আছে বলে অনেকে উল্লেখ করেছেন।
আজ ভাষা দিবসে বাঙালী কি শিখবে যে বাঙালী মানে যে বাংলায় কথা বলে সে নয়, বরং তার চেয়ে বেশি? যে বাংলা বলে, বাঙালীর মতো খায়, বাংলায় ভাবে, বাংলায় স্বপ্ন দেখে সেই বাঙালী- এমন স্বপ্ন যে স্বপ্ন বাঙালীর ঘরে যত ভাইবোন আছে তাকে সে আপনার ভাববে। মুসলমান শুনলেই ভুরু কুঁচকে উঠবে না। শুনতে হবে না যে তুমি বাঙালী না মুসলমান।
বাঙালী যেদিন নিজের ভাষা, সংস্কৃতিকে ভালোবাসতে শিখবে আস্তে আস্তে সে নিজের ভাষায় নিজেকে প্রকাশ করবে, বাংলায় নাম উচ্চারণ করবে গর্বের সাথে। আরবি উর্দুর প্রতি কোন বিদ্বেষ নেই কিন্তু ভবিষ্যতের বাঙালী মন প্রাণ দিয়ে নামে-কর্মে-মরমে বাঙালী হয়ে উঠবে। তবু মনে রাখতে হবে উদার বাঙালী যেমন মিশ্র জাতি তার ভাষাও তেমনি মিশ্র।
বাংলা সংস্কৃতিতে আরবীয় প্রভাব আছে কিন্তু ভাষার ক্ষেত্রে আরবীর চেয়ে ফার্সি প্রভাব বেশি। কোন কোন ক্ষেত্রে ফারসি শব্দ বাদ দিয়ে দৈনন্দিন কথাবার্তা চালানোই মুস্কিল। মনে রাখা দরকার পারসিরা কিন্তু আরবী ভাষা ও সংস্কৃতির বিরোধী। তারাই সর্বপ্রথম কোরান আরবীতে পড়তে অস্বীকার করেছিল।
নীচের অসম্পূর্ণ সারনী গুগল থেকে নেওয়া-
১) বাংলা ভাষায় প্রচুর ফারসি শব্দ এবং ফারসির মাধ্যমে আরবি ও তুর্কি শব্দের অনুপ্রবেশ ঘটেছে; কোনো কোনো ক্ষেত্রে এদের প্রভাবে মূল বাংলা শব্দেরই বিলুপ্তি ঘটেছে। দৃষ্টান্তস্বরূপ বিলুপ্তপ্রায় কয়েকটি বাংলা শব্দ বন্ধনীতে উল্লেখ করা হলো: খরগোশ (শশারু), বাজ (সাঁচান/সয়চান), শিকার (আখেট), নালিশ (গোহারি), বিদায় (মেলানি), জাহাজ (বুহিত), হাজার (দশ শ) ইত্যাদি।
২)দস্তখত জরিমানা, জেরা, অছিয়তনামা, তামাদি, দারোগা, নালিশ, ফয়সালা, ফরিয়াদ, রায়, সালিশ, পারওয়ানে, ফরমান, মুনশি, ওকালতনামা, পেশকার ইত্যাদি।
৩) জমিদার, তখত, তহশিলদার, তালুক, তালুকদার, নবাব, বাদশা, বেগম, বাহাদুর, কামান, তীর, তোপ, ফৌজ ইত্যাদি।
৪) কাগজ, কেচ্ছা, পীর, বুজুর্গ ইত্যাদি।
৫) আতর, আয়না, গোলাপ, গুলদানি, চশমা, দালান, মখমল, ফারাশ ইত্যাদি।
৫)পা, সিনা, গরদান, পাঞ্জা,চশমা।
৬) আচকান, জোববা, চাদর, পর্দা, শালওয়ার, পিরাহান, কামারবান্দ ইত্যাদি।
৭) বিরিয়ানি, গোশত, হালুয়া, কাবাব, কিমা, মোরববা, সব্জি, আনার, কিশমিশ, পেস্তা, বাদাম ইত্যাদি।
৮) হিন্দু, ফিরিঙ্গি ইত্যাদি।
৯) কারিগর, খানসামা, খিদমাতগার, চাকর, দোকানদার, বাজিকর, জাদুকর ইত্যাদি।
১০) বাবা, মা, দাদা, খালা, দামাদ, কানীজ, দোস্ত, ইয়ার ইত্যাদি।
১১) সরাইখানা, মোসাফেরখানা, ইয়াতীমখানা, কারখানা, বালাখানা, আসমান, যমীন, বাজার ইত্যাদি।
১২) খরগোশ, বুলবুল, কবুতর, বাজ, তোতা, হাইওয়ান, জানোয়ার ইত্যাদি।
১৩) আওয়াজ, আবহাওয়া, আতশ, আফসোস, কম, কোমর, গরম, নরম, পেশা, সফেদ, হুশিয়ার, হরদম, সেতার ইত্যাদি।
ফারসি ভাষা বাংলা ব্যাকরণকেও প্রভাবিত করেছে। যেমন ফারসি 'মাদী' ও 'মর্দা' (মার্দ) শব্দের প্রয়োগে লিঙ্গ নির্ধারিত হয়: মর্দা-কবুতর, মাদী-কবুতর; মর্দা-কুকুর, মাদী-কুকুর ইত্যাদি। অপরদিকে ফারসি 'মোর্গ' শব্দটি মোরগ ও মুরগি ।
ফারসি তদ্ধিত প্রত্যয় ও উপসর্গের মাধ্যমে অনেক বাংলা শব্দ গঠিত হয়েছে; আবার অনেক ফারসি শব্দ মূল অর্থসহ বাংলায় ব্যবহূত হচ্ছে; তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে ফারসি আ বা া-চিহ্ন বাংলায় লোপ পেয়েছে; যেমন: কামার কমর; গারম গরম; নারম নরম ইত্যাদি। আবার অনেক বাংলা শব্দ ফারসি তদ্ধিত প্রত্যয় ও উপসর্গের সঙ্গে একাত্ম হয়ে একটি স্বতন্ত্র অর্থ ও ভাববিশিষ্টি শব্দ তৈরি করেছে, যেমন: কেরানিগিরি, বাবুগিরি, দর-পত্তর, বে-গতিক ইত্যাদি।
আজ এই ভাষা দিবসে প্রত্যেক বাঙালী নিজের ইতিহাস নিয়ে ভাবুক। কিভাবে ধর্ম পরিবর্তন হয়েছে, নানা ভাষার সম্মিলনে ভাষা পরিবর্তন হয়েছে, কিভাবে বাঙালী উদারতা অর্জন করেছে।
এই লেখা শুরু করেছিলাম যে কথা দিয়ে সেখানে ফিরে যাই- কোন গোষ্ঠীকে যদি ধর্ম দিয়ে ব্যাখা করার চেষ্টা করা হয়, তার সব সামাজিক সত্ত্বার গায়ে যদি ধর্মের আলখাল্ল পরিয়ে ব্রাত্য করে রাখা হয় তাহলে বৃথা আমাদের বাঙালীত্ব।
বর্তমানে উগ্র ওয়াহাবী চিন্তা-চেতনা ১৮৪০-৭৮ কে মনে করিয়ে দেয়, উগ্র হিন্দুত্ব শশাঙ্কের যুগ মনে করিয়ে দেয়। এই দুই উগ্রতার বিরুদ্ধে বাঁচতে হলে বাঙালীত্বকেই হাতিয়ার করতে হবে। বাঙালী মানে উদারতা, বাঙালী মানে সংস্কৃতির পীঠস্থান, বাঙালী মানে কফি হাউসের আড্ডা, বইমেলা-সংস্কৃতিমেলা, বৈশাখে নববর্ষ উৎসব, বসন্ত উৎসব, দোল, রাখি বন্ধন, ইলিশ উৎসব, রবিবার দুপুরে খাসির মাংস, ফুচকা, ঝালমুড়ি, বাঙালী মানে ঘনাদা-ফেলুদা-টেনিদা-বাঁটুলদা-কেল্টুদা-হাঁদা-ভোদা। আরো কতকি সে লিষ্টির শেষ নেই। মিষ্টিরও শেষ নেই। পৃথিবীতে মিষ্টি দই একমাত্র আমরাই খাই। সাত দশ খানা বাটি সাজিয়ে গাদা গুচ্ছের তরকারি দিয়ে ভাত আমরা ছাড়া আর কেউ খায় না। সুক্তো কেউ খেতে জানে? ফিস্টির নাম কেন পৌষালো কেউ জানে? (বাঙালীর আবেগ ঝরে পড়ে ফিদেলে, চে তে। মাও সে তুং, লিন পিয়াও, মার্কস-এঙ্গেলস- লেনিন- বিপ্লব স্পন্দিত বুকে আমিই লেনিন! এটুকু না বললে বাঙালীর বোঝা যাবে না।)
স্বাধীনতার আগে বিশ্বের জিডিপির ২০ শতাংশ আমাদের ছিল। আবার আমরা জগৎ সভায় আসন নিতে চাই। তার জন্য দরকার জনগনমন ঐক্য, চাই শয়নে স্বপনে বাঙালী হয়ে ওঠার সাধনা।

শুক্রবার, ১৭ ফেব্রুয়ারী, ২০২৩

স্মৃতি বিস্মৃতি ও মৃত্যু ~ শৈবাল বিষ্ণু

বিষাণ বসুর ফ্যান ক্লাবের সদস্য সে বহুযুগ হলো! বিয়ের আগেই হবু স্ত্রীএর কাছে প্রচুর সুখ্যাতি আর সুনাম শুনেছি। আমার বৌ যেহেতু সে ফ্যান ক্লাবের সদস্য, তাই আমিও তাই। কিন্তু সে তো শুধু শুনে শুনেই। ভাগ্যিস ফেবু এলো, আলাপ হলো, লেখা পড়লাম। দেখলাম, নাহ এই লোকটা বেশ চিন্তাশীল প্রবন্ধ লেখে তো, কালচার করতে হচ্ছে মশাই! গুণমুগ্ধ পাঠক হিসেবে ওর লেখা পত্তর পড়ি, চিন্তার খোরাক পাই। এই পর্যন্ত বেশ চলছিল। হঠাৎ করে একটা নীল বই হাতে এসে গেলো। মানে বইটার মলাট নীল রঙের। শুরু তো করে ফেললাম, কিন্তু এগোতেই পারছিনা। ওদিকে লেখক বারবার জিগায় পড়লাম কি? ভালো লাগলো না খারাপ। আবার নাম করা সাহিত্যিকরা বইটা পড়ে ফেলে উচ্ছসিত প্রশংসা করে ফেলছে। আমি এগোতে পারছিনা।

বইটা আসলে মৃত্যু নিয়ে। সহজ পাচ্য? নাহ! গল্পের বইও নয় যে এক ভাবে টেনে নিয়ে যাবে। সমস্যাটা দাঁড়িয়ে গেলো, যত পড়ি, তত মিল পাই। প্রতি পাতায় এমন কিছু কথা পাই, যেগুলো আমার মনের কথা, যেগুলো আমার জীবনের কথা। যে কথা গুলো বলা হয়নি, ঠিক সেই কথা গুলোই। আর তত দেরী হয়। মিলগুলোর জন্যেই দেরী হয়।
না আমার বাবা বুদ্ধিজীবি ছিলোনা, মা যদিও ইস্কুলে পড়াতো। দুর্গাপুর কারখানার শহর, শ্রমিকদের বসবাস। শ্রমিকদের মধ্যেই বেড়ে ওঠা। তারাই আমার বাবা, কাকা, কাকু, জেঠু, মামু, মাসী, পিসী, কাকিমারা। পাড়ার, ওপাড়ার, বাবার অফিসের, বাবার পার্টির। পার্টির গোষ্ঠী ও গোষ্ঠী দ্বন্দ্বের গল্প গুলোও তো এক। এগোই কি করে হুড়হড়িয়ে। সম্ভব নাকি? আমার বাবা আবার নীরব কর্মী থাকতে পছন্দ করতো, স্টেজে উঠে বক্তব্য রাখার ধরে কাছ দিয়েও যেত না। কিন্তু জীবনানন্দ পাঠে নিবীড় মনোযোগ ছিলো, সেই তাঁবুতে থাকার জীবন থেকেই, যখন ডিভিসি, যখন প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা, ড্যাম তৈরী হচ্ছে, ক্যানেল তৈরী হচ্ছে, বাবারা সুইস কটেজে থেকে সার্ভে করছে। সারাদিনের পরে জীবনানন্দ আর সঞ্চয়িতা টুকুই সম্বল, সভ্যতার সাথে যোগাযোগ। আর দুদিনের পুরোনো ডাকে আসা অমৃতবাজার পত্রিকা।
প্রতি পাতায় এমন কিছু প্রশ্ন, এমন কিছু স্মৃতি, এমন কিছু চিন্তা, এমন কিছু ঘটনা পড়ছি, যে মনে হচ্ছে এ তো আমারও গল্প। বাবার যে বছর আশি হলো, সব দাঁত তুলে দিয়ে বাঁধিয়ে দিলো আমার বৌ। বাবার খুশী আর ধরে না। কোনোমতেই কাছ ছাড়া হতে দিত না সেই বাঁধানো দাঁত দুপাটি। সব দাঁত বাঁধানো হয়ে যাওয়া মাত্রেই বায়না ধরলো দুর্গাপুর যাবে, যাবেই। আর ভালো লাগছেনা। আমার বৌকে বললো আশি তো হয়ে গেলো, অনেকদিন হয়ে গেলো পৃথিবীতে, আর কি হবে বেঁচে থেকে। মনে মনে মৃত্যুর জন্যে প্রস্তুতি কি হচ্ছিলো তখন থেকেই? বুঝিনি। বায়না করে দুর্গাপুরে গিয়ে দিন দশেকের মধ্যে হাঁটতে গিয়ে পড়ে গিয়ে ঠিক সেই ফ্রাকচার নেক অফ দা ফিমার, আরও সাত দিনের মধ্যে চুল্লী তে চললো বাবা, সাথে সেই দুপাটি বাঁধানো দাঁত। রোজই মনে হয়, কত কত কথা বাকি রয়ে গেলো। কত কি জিজ্ঞেস করা হয়নি। কত গল্প ভালো করে শোনা হয়নি। কত প্রশ্ন করা হয়নি। বিষাণ লিখেছে অপেক্ষা করে। সেই ২০০৭ থেকে অপেক্ষা করছি, বৃথাই অপেক্ষা। আর হ্যাঁ আমিও তো স্টেডি ছিলাম। কাঁদিনি, প্রলাপ বকিনি , এমনকি প্রকাশ্যে দুঃখপ্রকাশ ও করিনি। বিরিভমেন্টের প্রক্রিয়া নিয়ে লিখেছে বিষাণ, ও পড়াশোনার মধ্যে দিয়ে বোঝার চেষ্টা করেছে। বিষাণের এই বই যদি ২০০৭ এ হাতে পেতাম, কিছু সুবিধে হতো? মনে হয় হতো।
বিষাণ বলেছিলো ওর লেখা বই নিয়ে লিখতে। আর আমি আমার কথা, আমার বাবার কথা লিখে চলেছি। আসলে হয়তো এটাই এই বইয়ের মূল সার্থকতা। মনের কোনো কোণে বাবাকে নিয়ে যে চিন্তাভাবনা গুলো কাউকে বলিনি, কোথাও লিখিনি, সেগুলো বেরিয়ে এলো অজান্তেই । বিষাণ প্রতিটা অধ্যায়ে একটা নতুন দিক নিয়ে ভেবেছে, এবং সব থেকে বড় ব্যাপার একজন পেশেন্ট পার্টি হিসেবে ভেবেছে, দেখেছে, দেখিয়েছে। এটাও কম পাওয়া নয়। মাঝে মাঝে মনে হয় এই যে এতো দৌড়চ্ছি , কেন দৌড়োচ্ছি? যা কিছু দৌড়াদৌড়ি, যা কিছু সঞ্চয় সে কি শুধুই জীবনের শেষের কয়েক ঘন্টা এসি ঘরে, পাঁচ তারা হাসপাতালে চারিপাশে বিপ বিপ শব্দের মধ্যে একটা বেড নাম্বার হয়ে অস্তিত্বহীন, একটা স্টেরাইল, যান্ত্রিক মৃত্যুর জন্যে? জাস্ট কোনো মানে হয়? বিষাণ প্রশ্নটা রেখেছে। আমার মতো এলোমেলো ভাবে নয়, বিশ্লেষণাত্মক ভাবে রেখেছে। তাই বইটা শুধুই যে মৃত্যু নিয়ে তা একেবারেই নয়, বিষাণ বসুর "টুকরো স্মৃতি... ছেঁড়া শোক" প্রকৃত প্রস্তাবে জীবন নিয়েই। যাপন নিয়েই।

তুলসীদাস বলরাম ~ অর্ক ভাদুড়ী

ব্যস্ততার মধ্যে থাকলে বোধহয় দূরবর্তী শোকের অভিঘাত কমে যায়। শোক তো সেয়ানা৷ সে অপেক্ষা করে। নির্জনে কামড়ে ধরবে বলে চুপ করে থাকে। শিকারীর মতো।

তুলসীদাস বলরামের মৃত্যুর খবর পেলাম একটা চা বাগানে বসে। চারদিকে সবুজ আর সবুজ৷ ছোট্ট তিরতিরে নদী। শীতকালে তাকে নদী বলে চেনাই যায় না। নদীর ধারে একটা সরস্বতীর মূর্তি৷ চা বাগানের নির্জনতায় একলা সরস্বতী অপেক্ষা করছেন। নদীতে জল বাড়ুক। সবশুদ্ধ ভাসিয়ে নিয়ে যাবে৷ ততদিন অপেক্ষা।

বলরামও তো থাকতেন নদীর ধারেই। একাকী। ভিড় থেকে দূরে। কোলাহল থেকে দূরে। তাঁর বুকের মধ্যে অভিমান জমতে জমতে পাথর হতে পারত। হয়নি৷ আগ্নেয়গিরি হয়ে ছিল। পরিত্যক্ত, বৃদ্ধ আগ্নেয়গিরি। শেষ কয়েকটা দশক যার অগ্নুৎপাতও ঢেকে যেত বিষন্নতার স্যাঁতস্যাঁতে চাদরে।

মাঝে মাঝে ঝাঁকুনি দেওয়ার চেষ্টা করছিলাম নিজেকে। বলরাম মারা গেলেন! তুলসীদাস বলরাম! যে জার্সি আমার সর্বনাশ ও সর্বস্ব, তার শ্রেষ্ঠ সাধকদের একজন। আমেদ খান ছাড়া তাঁর তুলনা আর কে! যে অবহেলা তিনি পেলেন দশকের পর দশক, যে অভিমান আর অপমানের পাহাড় তাঁকে বইতে হল শেষদিন পর্যন্ত, যে দুষ্টচক্র তাঁকে ঠেলে দিল ছোট্ট ফ্ল্যাটের জেলখানায়, তার ক্ষমা নেই, তার ক্ষমা নেই।

বলরামের প্রতিটি উচ্চারণ যে নির্জন ক্রোধের পবিত্র আগুন জ্বেলে রাখত, সেই অপাপবিদ্ধ অগ্নিই হবে আগামীর মশালের প্রাণ। হয়তো আজ নয়। হয়তো দেরি হবে৷ কিন্তু বলরাম ব্যর্থ হবেন না।

যারা পূর্বজদের থেকে হাঁটার গল্প শুনতে শুনতে বড় হয়েছি, যারা অসংগঠিত সমর্থক মাত্র, ভালোবাসা ছাড়া যাদের এখনও পর্যন্ত আর কোনও অস্ত্র নেই, তাদের বুকের মধ্যে বেঁচে থাকবেন তুলসীদাস বলরাম।

যারা শুনেছি নাটোর থেকে হলদিবাড়ি হাঁটার গল্প, যারা শুনেছি হাঁটতে হাঁটতে পিছনে তাকানো, আগুন আর ধোঁয়ার মধ্যে পুড়ে যাওয়া ঘর যারা শুনেছি হলদিবাড়ি থেকে কলকাতায় আসা, কুকুরবিড়ালের মতো বেঁচে থাকা, যারা শুনেছি ট্রেনের মাথায় মাথায় ভিড়, আঠার গায়ে মাছির মতো ট্রেনের গায়ে জাপটে থাকা মানুষ আর মানুষ যারা শুনেছি ইউসিআরসি, শুনেছি ফুটপাথ থেকে কলোনিপাড়ার হোগলাচালের ঘর, যারা শুনেছি লাল আর লাল-হলুদে বেঁচে নেওয়া প্রজন্মের মহাকাব্য যারা শুনেছি ভাঙা বাংলার প্রতিটি কলোনির সদ্যোজাত কুয়ো আর ইস্কুলের দেওয়ালে কেমন করে আল্পনা এঁকে দিতেন আপনার পূর্বসূরি আমেদ খান, সহস্র যন্ত্রণাকে রাধাচূড়া-কৃষ্ণচূড়ায় রাঙিয়ে দিতেন পঞ্চপাণ্ডব, তাঁদের মধ্যে আপনি বেঁচে থাকবেন, তুলসীদাস বলরাম যারা কখনও ভুলব না কেমন করে টলমলে উদ্বাস্তু কলোনিকে কাঁচা বাঁশের শক্ত ভিতে দাঁড় করাতেন সেকেন্দ্রবাদের যুবক, তাদের বুকের ভিতরে আপনি বেঁচে থাকবেন, তুলসীদাস বলরাম।

আপনার অপমানের বদলা তারা নেবে। আজ না হোক কাল।

বুধবার, ১৫ ফেব্রুয়ারী, ২০২৩

হেরো, ক্লডিয়াস তুমি হেরো ~ মৌমিতা তারণ

সময়টা তখন তৃতীয় শতক। আমার প্রিয় শহর রোম শাসিত হচ্ছে সম্রাট ক্লডিয়াসের খেয়ালখুশিতে। শহরবাসী মোটেই খুশি নয় তাদের স্বৈরাচারী সম্রাটের উপর। আর দশজনের মতো আমিও ক্লডিয়াসকে পছন্দ করতাম না। কেন করতাম না সেকথা আজ তোমাদের শোনাব। তার আগে নিজের পরিচয়টা দিয়ে নিই। 

আমি সেন্ট ভ্যালেন্টাইন। হ্যাঁ সেই ভ্যালেন্টাইন যার নামে গোটা একটি দিন বিশ্ব সংসার প্রেমদিবস পালন করে। ১৪ ফেব্রুয়ারি ---ভ্যালেন্টাইন'স ডে। চার্চের একজন পুরোহিত হিসেবে আমার সবথেকে প্রিয় কাজ ছিল দুটি প্রেমিক মানুষকে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ করা। দুটি হৃদয়ের মিলন ঘটানো। বলা ভাল মানুষকে প্রেমিক করে তোলাই আমার মূলমন্ত্র। আমৃত্যু আমি আমার এই মূলমন্ত্র আঁকড়ে থেকেছি। এর ফলে ওরা আমায় পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিয়েছে। ভ্যালেন্টাইনকে সরালেও পৃথিবীকে ওরা প্রেমহীন করতে পারেনি। আজও 'প্রেমের ফাঁদ পাতা ভূবনে, কে কোথা ধরা পড়ে কে জানে...।' এই রে ! রবি ঠাকুরের বলা কথা আমি তোমাদের শোনাচ্ছি। কোনও মানে হয় ! অবশ্য শোনাব নাই বা কেন ? রবি তো শুধু তোমাদের কবি নন। বিশ্ব তাঁকে স্বীকৃতি দিয়েছে। তিনি বিশ্বকবি। এই রবির কল্পনাই তো একদিন লিখেছিল, 'প্রেমের জোয়ারে, ভাসাব দোহারে....।' আমি জানি সারা পৃথিবী এমনই প্রেমের জোয়ারে ভাসতে চায়। আমার মৃত্যুদিনটি প্রেমের দিন হিসেবে চিহ্নিত হওয়ায় আরও একবার প্রমাণিত হল প্রেম চিরন্তন। তাকে নি:শেষ করার মতো শক্তি এখনও জন্মায় নি। তবে প্রেমের উপর আঘাত এসেছে বারে বারে। সম্রাট ক্লডিয়াস এমনই এক আঘাতকারী। 

নিজের সেনাবাহিনীকে আরও শক্তিশালী করে গড়ে তোলার জন্য ক্লডিয়াস সমাজে বিবাহ নিষিদ্ধ করলেন। তাঁর মনে হয়েছিল বিবাহিত পুরুষ পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এসে সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে চায় না। সম্রাটের এহেন নিষেধাজ্ঞা যুবসমাজের কাছে অমানবিক ঠেকে। ওই হঠকারী নির্দেশে আমিও হতবাক হয়ে পড়ি। পরস্পরের হাত ধরে প্রেমের জোয়ারে ভাসতে চাওয়া মুখগুলো মনে করে আমি কষ্ট পাই । পারলাম না, কিছুতেই পারলাম না ক্লডিয়াসের এই খামখেয়ালিপনা মেনে নিতে। বেশ বুঝতে পারছিলাম এভাবে চলতে দেওয়া ঠিক হচ্ছে না। প্রতিবাদ করা দরকার। এবং তা এখনই। কিন্তু সম্রাটের ক্ষমতার সামনে চার্চের এক পুরোহিতের ক্ষমতা আর কতটুকু ? তাই হাতিয়ার করলাম সেই প্রেমকেই। প্রেম দিয়েই প্রেম বাঁচিয়ে রাখতে চাইলাম। আবার শুরু করলাম দুই প্রেমিককে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ করার মতো পবিত্র কাজ। তবে এবার খুব গোপনে, খুব সন্তর্পণে। ভাবতে পারো চার্চের ভেতর গোপন এক জায়গায় শুধুমাত্র একটি মোমের আলো। তার সামনে বর, কনে আর আমি। আমি ফিসফিস করে বিবাহমন্ত্র আওড়াচ্ছি। আমার সঙ্গে সঙ্গে দু'জোড়া ঠোঁট সেইমতো ফিসফিস করছে। আমি কেবল ওদের ঠোঁট নড়া আন্দাজ করতে পারছি। আমার দুই কান সজাগ। এই বুঝি শোনা যাবে সম্রাটের সেনাদলের বুটের আওয়াজ। সে এক উত্তেজনাময় পরিবেশ। ভয় আর ভালবাসার মিশেল যেন। তবে বেশিদিন পারা গেল না এভাবে। সত্যিই একদিন চার্চের মেঝে কেঁপে উঠল ক্লডিয়াস সেনার পদধ্বনিতে। সেদিনও ছিল এমন এক বিয়ের দিন। অবশ্য ভগবান সহায় ছিলেনন। ছেলেমেয়ে দুটো ঠিক সময়ে পালিয়ে যেতে পেরেছিল। সেনারা কেবল আমায় পেল এবং নিয়ে গেল আমায় জেলকুঠুরিতে। শাস্তি ঘোষণা করল ক্লডিয়াস --- মৃত্যুদণ্ড। কী ভাবছ ? আমি হেরে গেলাম ? উঁহু, একেবারেই না। প্রেমের পূজারী ভ্যালেন্টাইনরা কখনও হেরে যায় না।

সেই অন্ধকার জেলকুঠুরিতে আমার কাছে প্রেমের আলো বয়ে নিয়ে এল শহরের অজস্র তরুণ - তরুণীর পাঠানো ফুল, ভালবাসার চিরকূট এবং' সে '। আমাকে পাহারা দিত যে রক্ষীটি সম্ভবত সেও ছিল এক তুখোড় প্রেমিক। নয়তো আমার সঙ্গে গল্প করার জন্য নিজের মেয়েকে সে অনুমতি দেবে কেন !! মেয়েটি প্রতিদিন আমার কাছে আসতো। বসতো আমার পাশটিতে। আমরা গল্প করতাম। ঘড়ির কাঁটায় খেয়াল রাখিনি কখনও। মনে হত, গল্প তো এখনও শুরুই হল না। এইমাত্র তো এল আমার প্রিয়া। হ্যাঁ ও ছিল আমার প্রিয়া। ওর হাসি, ওর কথা, ওর চাউনি আমার উদ্যম নষ্ট হতে দেয় নি। ক্লডিয়াসকে অস্বীকার করে যে আমি ভুল করি নি সেকথা বারে বারেই ও মনে করিয়ে দিত।

শেষ পর্যন্ত ১৪ ফেব্রুয়ারি ২৬৯ এ. ডি. দিনটির মুখোমুখি হলাম। আর কিছুক্ষণ পর ক্লডিয়াসের সেনা আসবে। পালন করবে তারা সম্রাটের নির্দেশ। কার্যকর হবে আমার মৃত্যুদণ্ড। প্রিয়ার সঙ্গে আজ আর দেখা হওয়ার কোন উপায় নেই। কিন্তু ওকে না জানিয়ে আমি যাই ই বা কি করে ! এদিক ওদিক খুঁজলাম। এক টুকরো কাগজও কোথাও নেই যার উপর আমি ওর জন্য কিছু লিখে যেতে পারি। অগত্যা ওর রেখে যাওয়া কালকের চিরকূটটা হাতে তুলে নিলাম। এই টুকরো কাগজে গতকাল ও আমার জন্য একমুঠো ভালবাসা লিখে এনেছিল। সেই ভালবাসার অপর পিঠে ওর জন্য আমার ভালবাসার প্রতিধ্বনি রাখলাম আমি। লিখলাম, "লাভ, ফ্রম ইয়োর ভ্যালেন্টাইন।"

আমাদের পরস্পরের ভালবাসা বিনিময়ের এই স্টাইল সেদিনের পর থেকে পৃথিবীর সব প্রেমিক প্রেমিকা রপ্ত করল। জানি ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ তেও এর ব্যতিক্রম ঘটবে না। কাগজ কলম হয়ত সেভাবে আর আঙুলের স্পর্শ পাবে না। কিন্তু মোবাইল কিপ্যাড বা স্ক্রিন টাচ করতে আঙুল কসুর করবে না। ১৪ ফেব্রুয়ারি দিনটি আমার মৃত্যুদিন হিসেবে কোনও প্রেমিক মনে রাখে নি। তাদের কাছে ১৪ ফেব্রুয়ারি মানে ভ্যালেন্টাইন'স ডে। আর ভ্যালেন্টাইন মানেই প্রেম, প্রেম এবং প্রেম। পৃথিবীর তাবৎ প্রেমিকের কাছে এক্কেবারে হেরে ভূত সম্রাট ক্লডিয়াস। তবে আর চুপ কেন ? এস সবাই মিলে আমরা ক্লডিয়াসকে দুয়ো দিই --
" হেরো, ক্লডিয়াস তুমি হেরো "।

বৃহস্পতিবার, ২৬ জানুয়ারী, ২০২৩

ডাঃ দিলীপ মহলানবীশ ~ ডাঃ কৌশিক লাহিড়ী

-আপনার কাছে প্রশান্ত মহলানবীশের ফোন নাম্বার আছে?

রাত ন'টার একটু পর একটি চ্যানেল থেকে ফোন এলো।

একটা সামাজিক অনুষ্ঠানে ছিলাম । 
আচমকা এই প্রশ্নে বিলকুল ভেবড়ে গেলাম !
কি উত্তর দেব ভেবে পেলাম না !
চেনা নাম্বার !

ভিড় ঠেলে একটু ফাঁকায় এসে জিজ্ঞেস করলাম,

-প্রশান্ত মহলানবীশ?

-হ্যাঁ স্যার !

-মানে স্ট্যাটিস্টিশিয়ান প্রশান্ত চন্দ্র মহলানবীশ!

-হ্যাঁ স্যার ! উনি পদ্মবিভূষণ পাচ্ছেন তো !

-কিন্তু উনি তো বছর পঞ্চাশ আগে মারা গেছেন ! আর খুব যদি ভুল না করি বেঁচে থাকতেই পদ্মবিভূষণ পেয়েই l কিন্তু ওঁর নাম্বার তো...

-মারা গেছেন ! ওঃ হো !
ও প্রান্তে একরাশ হতাশা।

-তাহলে ওঁর কোনো আত্মীয়র নাম্বার...

আমি সত্যিই এক দম্পতিকে চিনি যাঁরা প্রশান্ত মহলানবীশের দূর সম্পর্কের আত্মীয়, কিন্তু সেটা তো এই চ্যানেলের জানবার কথা নয় !

-না আমি ওঁদের কাউকে চিনি না !
শুকনো গলায় বললাম।

-কিন্তু কিছুদিন আগে ওনাকে নিয়ে আপনি লিখলেন যে ফেসবুকে !

এই বার পরিষ্কার হলো ব্যাপারটা !

-ডাঃ দিলীপ মহলানবীশের কথা বলছো ? যিনি ও আর এস এর আবিষ্কর্তা ?

-হ্যাঁ, হ্যাঁ ! উনিই, উনিই ! ওঁর কোনো ফোন নাম্বার!

-কিন্তু উনিও তো নেই ! গতবছর চলে গেছেন পুজোর পরে ! ফোন নাম্বার জোগাড় করাই যায়, কিন্তু সে নাম্বার নিয়েই বা আর কি করবে ? 
ওঁর স্ত্রীও তো মারা গেছেন !

-না মানে, আসলে, এই মাত্র অফিসে লিস্টটা এলো তো ! 
উনি এবার পদ্মবিভূষণ পাচ্ছেন !

মসিয়েঁ ভের্দু তে অঁরি ভের্দুর মুখ দিয়ে চ্যাপলিন বলেছিলেন "One murder makes a villain, millions a hero. Numbers sanctify"
অর্থাৎ "একটি মানুষকে মারলে খলনায়ক, লক্ষ মানুষকে মারলে নায়ক ! সংখ্যাই পবিত্র করে !"
সংখ্যাই পাপ ধুয়ে তাকে মহান করে !

আর কেউ যদি মানুষ না মেরে, মানুষকে বাঁচান  !
আর সংখ্যাতত্ত্বের হিসেবে সেই বাঁচানোর পরিমাপটা যদি এক জন-দুজন বা শত-সহস্র মানুষ  না হয়ে কোটি তে পৌঁছয় ?
তাহলেও কি তিনি নায়ক হয়ে যান না !

উত্তরটা হল "না" !

ডাঃ  দিলীপ মহলানবীশ ।

এই মানুষটাকে প্রায় কেউই চিনতেন না !
চেনা তো দূরের কথা, বেঁচে থাকতে নাম ও শোনেন নি প্রায় কেউই !

অথচ তাঁর আবিষ্কারের ফলে গত পঞ্চাশ বছরে প্রাণ বেঁচেছে বিশ্বজুড়ে কোটি কোটি মানুষের !
হ্যাঁ !
কোটি কোটি মানুষের !

ওরাল রিহাইড্রেশন সল্ট বা ORS তাঁরই আবিষ্কার যে !

তাঁকে নিয়েও হাসাহাসি হয়েছে! গালিভারদের নিয়ে লিলিপুটরা যে হাসি হেসে থাকে ! 

না বুঝে, অবিশ্বাসের হাসি ! 
অথবা বুঝেও ঈর্ষার হাসি !

আমাদের শহরেই থাকতেন !
আমাদের রাজ্যেই !
আমাদের দেশেই !

আমরা চিনতাম না !

অন্তত দুটো  নোবেল পাওয়া উচিৎ ছিল !
চিকিৎসাশাস্ত্রে আর শান্তির জন্য !

বেঁচে থাকতে আমরা তাঁকে চিনতাম না !
কোনো শ্রী বা ভূষণের যোগ্য মনে করি নি !

কারণ পুরস্কার পেতে হলে সুপারিশ লাগে ! মনোনয়ন লাগে !

মানুষটি সেসব জোগাড় করতে উৎসাহী ছিলেন না।

ডাঃ দিলীপ মহলানবীশ কাল পদ্মবিভূষণ হবেন।

লিখেছেন Koushik Lahiri

রবিবার, ৮ জানুয়ারী, ২০২৩

লোভেতে পড়ি ~ অরিন্দম সেন

প্রভাতে উঠিয়া দেখি ঘন কুয়াশা
তবু দেখা দেবে রবি রাখি দুরাশা
বার দুই কাপে ভরা 
কফি খাওয়া হলো সারা
বহিল শীতল হাওয়া খরপরশা
পূবে দেখা দিল রবি ভাঙি  কুয়াশা।

যদিও শীতেতে লোকে মরিছে কেশে
নলেনগুড়ের কাল এসেছে দেশে
খাও যত খেতে চাও
কিনে নিও মোয়াটাও
কনকচূড়ের চষি কিনিও শেষে
যদিও শীতেতে লোকে উঠিছে কেশে।

প্রভাতে উঠিয়া দেখি ঘন কুয়াশা
তবু দেখা দেবে রবি রাখি দুরাশা
বার দুই কাপে ভরা 
কফি খাওয়া হলো সারা
বহিল শীতল হাওয়া খরপরশা
পূবে দেখা দিল রবি ভাঙি  কুয়াশা।

বিছানায় শুয়ে আমি সকালবেলা
দেখি রোজ কত পাখি করিছে খেলা
সাঁঝে ফের দেখি আঁকা
আকাশেতে চাঁদ বাঁকা
সোয়েটারে থাকি ঢাকা রোজ দুবেলা
শীতেতে কাতর আমি নহি একেলা।

খেজুরের গাছে যেবা উঠিতে পারে
শিউলি বলিয়া সবে চেনে তাহারে
গাছে গাছে উঠে যায়
দড়ি বাঁধা দুটি পায়
কাস্তেতে কাটে হায় গাছের গা-রে
শিউলি বলিয়া সবে চেনে তাহারে।

যদিও শীতেতে লোকে মরিছে কেশে
নলেনগুড়ের কাল এসেছে দেশে
খাও যত খেতে চাও
কিনে নিও মোয়াটাও
কনকচূড়ের চষি কিনিও শেষে
যদিও শীতেতে লোকে উঠিছে কেশে।

যত চাও তত নাও পরাণ ভরে
পয়সা গণিয়া দিও আপন করে
সারা দেহ মোড়া উলে
হাঁমুখ রাখিও খুলে
ব্যাগেতে লও হে তুলে
দুহাতে ভরে
এবারে ফিরিয়া চলো আপন ঘরে।

খাই নাই খাই নাই বিষম ডরি
শর্করা লহুমাঝে গিয়াছে ভরি
পউষ গগনে ধীরে
কুয়াশা উড়িয়া ফিরে
লোভ সংবরি আমি রহিনু পড়ি
গুড় মোয়া খাই নাই বিষম ডরি।

-----

_কবিগুরুর কাছে ক্ষমাপ্রার্থী হয়ে 'সোনার তরী' কবিতার শীতকালীন প্যারোডি।_

বৃহস্পতিবার, ৫ জানুয়ারী, ২০২৩

বাঘ ~ প্রকল্প ভট্টাচার্য

আমি বাঘকে ভয় পাই না। কখনোই পেতাম না। 
গত বছর শীতের ছুটিতে বাবা চিড়িয়াখানায় নিয়ে গেছিল, দেখিয়েছিল কেমন করে অসহায়ভাবে খাঁচায় বন্দী হয়েও পশুটা রাজকীয় ভঙ্গীতে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বাইরে লোকেরা চেঁচামেচি করছে, কেউ কেউ ঢিল ছোঁড়ার চেষ্টা করছে, হাততালি দিয়ে, শিস দিয়ে বিরক্ত করছে। বাঘটা পাত্তাও দিচ্ছে না। একবার একটু গা-ঝাড়া দিতেই সবাই হুড়মুড়িয়ে পালালো।
বাবা বলেছিল, "দেখেছিস! সত্যিকারের সাহসী যারা, পরিস্থিতিও তাদের চরিত্র বদলাতে পারে না! অন্যায় কৌশলে ওকে বন্ধ করে রেখেছে, কিন্তু ওর সাহস, ওর তেজ কমাতে পেরেছে কী? বরং খাঁচার বাইরে, নিরাপদে থাকা লোকেরা ওকে এতদূর থেকে দেখেও ভয় পাচ্ছে!"  
আমার বাবার খুব সাহস। বাবার বন্ধুরা বলে বাবার নাকি বাঘের মতো সাহস! 
আর আমি তো তারই ছেলে, আমি কেন বাঘকে ভয় পাব! 
বাবার একটা বুলেট মোটরবাইক আছে। আমাকে সামনে বসিয়ে যখন সেটা চালিয়ে ভটভট করে বড় রাস্তা দিয়ে যায়, লোকেরা রাস্তা ছেড়ে দেয়। কেউ ভয়ে, কেউ সম্ভ্রমে। 
বাবার নাম বিপ্লব, অনেকে ডাকে বুলেট বিপ্লব বলে। 
আমাদের স্কুলে মিস সকলের নামের মানে জেনে আসতে বলেছিলেন। আমি বাবাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, "বাবা, বিপ্লব মানে কি?" 
একটু হেসেছিল বাবা, তারপর বলেছিল, "তোকে এবার থেকে ক্লাবে নিয়ে যাব।" 
শুনে মা খুশী হয়নি, "আবার ওকে টানছ কেন..." 
বাবা শুনেও শোনেনি। 
আমি ভেবেছিলাম, বিপ্লব মানে ক্লাব। 
রাত্তিরে বাবার পাশে শুয়ে বাবার বুকে সুড়সুড়ি দিচ্ছিলাম। একটা কাটা দাগ আছে বাবার বুকে, আগেও দেখেছি, কিন্তু প্রশ্ন করিনি। সেদিন জানতে চাইলাম, "বাবা, এই দাগটা কিসের?" 
একটু হেসে বাবা বলেছিল "ওটা একটা বাঘের থাবার দাগ।" 
-"তোমাকে বাঘে থাবা মেরেছিল?" 
-"না, মারতে পারেনি। চেষ্টা করেছিল।" 
-"তারপর! বাঘটার কি হলো?" 
-"আর কী, এমন তাড়া করলাম, পালিয়ে গেল আমার ভয়ে!" 
-"বাবা, পুরো গল্পটা বলো, আমি শুনবো!"
-"আজ নয়, আর একদিন বলব, কেমন?" 
আমি ভেবে নিলাম, বিপ্লব মানে বাঘ। 
বাবা খুব মোটা সোটা ছিল না, কিন্তু হাতদুটো ছিল লোহার মতো শক্ত, আর পরিশ্রম করতে পারতো খুব। যখন রাস্তার মাঝখান দিয়ে বুলেট বাইক চালিয়ে যেত, সামনে বসে আমি বাবার শক্ত হাতদুটো ধরে থাকতাম। গাড়ি যতোই জোরে যাক না কেন, আমার ভয় করতো না। সেদিনও ঐভাবেই ক্লাবে নিয়ে গেল বাবা। যেতে যেতে আমার মনে হল, বিপ্লব মানে নিশ্চয়ই ভরসা, সাহস! 
আমি ভাবতাম ক্লাবে দোলনা থাকে, ছোটরা খেলাধুলো করে, বড়রা গান গায়, খাওয়াদাওয়া হয়। কিন্তু এই ক্লাবে দেখি সবাই অনেক বড়, খুব গম্ভীর আলোচনা করছে। এক একজন করে উঠে দাঁড়িয়ে কিছু বলছে, আর সকলে হাততালি দিচ্ছে। আমার বাবাও কিছুক্ষণ কথা বললো, সবাই খুব হাততালি দিল। তারপর বললো, 'ইঙ্কলাব জিন্দাবাদ'। আমিও বললুম তাদের সঙ্গে।  দু'জন কাকু সেটা দেখে আমার গাল টিপে আদর করে বললো, হবে না! বাঘের বাচ্চা তো! 
ফেরার সময় বাবাকে বললাম, "বাবা, ক্লাবের মধ্যে বলে ইন ক্লাব বলতে হয়, তাই না?" 
বাবা হা-হা করে হেসে বললো, "আরে না না, কথাটা ইনকিলাব জিন্দাবাদ, তার মানে বিপ্লব দীর্ঘজীবি হোক!' 
ভালো লাগলো যে এতজন কাকু চাইছেন আমার বাবা দীর্ঘজীবি হোন! বিপ্লব মানে তাহলে দীর্ঘজীবি! 
তার কয়েকদিন পরেই শুনলাম "অবরোধ অবরোধ"। ভোরবেলা বাবা বেরিয়ে গেল। মা ফুঁপিয়ে কাঁদছিল আর গজগজ করছিল। সারাদিন কেটে গেল, বাবা ফিরলো না। সন্ধ্যেবেলা দু'জন কাকু এসে মা-কে কীসব বলল, মা তাড়াতাড়ি শাড়ি বদলে, একটা ব্যাগ নিয়ে, আমাকে ঘরের পোশাকে নিয়েই কাকুদের সংগে একটা গাড়িতে উঠে চলল। আমি কিছু বুঝতে না পেরে চললাম চুপচাপ। মা মুখে শাড়ির আঁচল চেপে কাঁদছিল। কিছুদূর যাওয়ার পর একজন কাকুকে জিজ্ঞেস করলাম, "আমরা কোথায় যাচ্ছি?" 
-"তোমার বাবাকে দেখতে।" 
-"বাবা কোথায়? কী হয়েছে বাবার?" 
-"কিছু খারাপ লোক তোমার বাবাকে মেরেছে, বাবা হাসপাতালে ভর্তি।" 
-"কেন! আমার বাবাকে অন্যরা মারবে কেন!" 
-"তোমার বাবা তো ভাল লোক, তাই খারাপ লোকেরা বাবাকে ভয় পায়। সেই ভয় থেকেই মারে। তোমার বাবা মানুষের ওপর অত্যাচার মেনে নেয় না, অন্যায়ের প্রতিবাদ করে। তাই খারাপ লোকেরা বাবাকে ভয় পায়। " 
-"খারাপ লোকেদের পুলিশ ধরে না কেন? কেন তারা অন্যায় করবে?" 
-"পুলিশও যে তাদের কথা শুনে চলে! তারাই যে দেশ চালায়, তাই তাদের অনেক ক্ষমতা! তাদের অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে সাহস লাগে, আর সেই সাহস সকলের থাকে না। তোমার বাবার আছে।" 
-"হ্যাঁ, বাবার খুব সাহস। জানো কাকু, একবার বাবা একটা বাঘের সংগে লড়াই করেছিল, বুকে কাটা দাগ আছে!" 
-"বাঘ নয়। এই খারাপ লোকেরাই আগে একবার বাবাকে মেরে ফেলতে চেয়েছিল, পারেনি। ওটা তারই দাগ। বাঘ তো সাহসী, আড়ালে লুকিয়ে মারে ভিতুরা। তোমার বাবার মতো যারা প্রতিবাদ করে, তাদের মারার চেষ্টা করে।" 
-"কাকু, বিপ্লব মানে কি প্রতিবাদ?" 
কাকু হাসলো। "ঠিক বলেছ। বিপ্লব মানে প্রতিবাদের লড়াই। একে চেপে রাখা যায় না।" 
হাসপাতালে মাথায়, হাতে ব্যাণ্ডেজ বাঁধা বাবাকে শুয়ে থাকতে দেখে কেমন অচেনা লাগছিল, সারা গা কাঁপছিল আমার রাগে, অসহায়তায়। বাবা ইশারায় আমাকে কাছে ডাকল, মাথায় হাত রেখে ধীরে ধীরে, কেটে কেটে বলল, "ভয় পাসনা, আমি সেরে উঠব শিগগির! পড়াশোনা করবি, মায়ের খেয়াল রাখবি, কেমন?" 
আমার বলতে ইচ্ছে করল, "ইনকিলাব জিন্দাবাদ!" কিন্তু গলায় কী যেন আটকালো, তাই বলতে পারলাম না।  
 মনে পড়লো খাঁচায় বন্দী সেই অসহায় বাঘটার কথা। কৌশলে বন্দী করে রেখে সক্কলে মজা দেখছে আর টিটকিরি দিচ্ছে। যদি একবার বাবা গা ঝাড়া দিয়ে ওঠে... 
বিপ্লব দীর্ঘজীবি হবে। 
হবেই!!