শুক্রবার, ২৭ ডিসেম্বর, ২০২৪

সাত নম্বর কুকুরের বাচ্ছা ~ ডাঃ সমুদ্র সেনগুপ্ত

কিছুদিন আগে কথা। কাজের দায়িত্বের অঙ্গ হিসেবে একটা বড় হাসপাতালে গিয়েছিলাম প্রেসক্রিপশন অডিট করতে সঙ্গে আরো কিছু দেখতে। সময়টা ছিল বড়দিন এর আশপাশে। সেই ভিজিটের রিপোর্ট লিখতে বসে ভেবেছিলাম যে অনেক কিছুই ভালো দেখলাম। লেবার রুম খুব সুন্দর, সাজানো গোছানো। ডাক্তার সিস্টারদের বিভিন্ন বিষয়ে দক্ষতা ও জ্ঞানও খুবই ভালো। কেবল একটা জিনিস একটু আপত্তিজনক মনে হয়েছিল। মায়েদের একটু বেশি কড়া হায়ার জেনারেশন এন্টিবায়োটিক লেখা হচ্ছে যা স্ট্যান্ডার্ড ট্রিটমেন্ট প্রটোকল অনুযায়ী ঠিক নয়। এনিয়ে সুপারের সাথে আলোচনার ফাঁকে গাইনোকলজিস্ট আসলেন। ঘটনাচক্রে সে আমার পুরানো বন্ধু বেরিয়ে গেল। মেডিক্যাল কলেজের সহপাঠী। 

একথা সেকথার পরে আমার আপত্তির প্রসঙ্গটা তোলার পরেই হঠাৎ খেপে গেলো বন্ধুটি। আমার হাত ধরে টানতে টানতে ওয়ার্ডে নিয়ে গেল। সেখানে এত ভিড় যে মায়েদেরও মেঝেতে রাখতে হচ্ছে। তাদের দেখিয়ে বন্ধু বললো উত্তেজিত হয়ে, "এই যে দেখছিস, মেঝেতে শুয়ে আছে, এরা মানুষ নয়, কুকুর, আর ওদের সাথে শুয়ে আছে, ওরা মানুষের বাচ্ছা নয়, ওরা কুকুরের বাচ্চা। আর আমি মানুষ নয়, কুকুরের ডাক্তারি করি। তোর কোন টেক্সট বই বা স্ট্যান্ডার্ড প্রটোকলে লেখা আছে যে প্রসব বা সিজার হওয়া মাকে মেঝেতে শুতে হয় ? " 

বন্ধু তখন উত্তেজিত হয়ে যা তা অবস্থা, আমাকে প্রায় চিৎকার করে বলছে, " হ্যাঁ আমি জানি, আমি হায়ার এন্টিব্যাওটিক লিখি। ইচ্ছে করেই লিখি, যাতে মেঝেতে থাকা এদের ইনফেকশন না হয়, কাল থেকে তুই এদের বেডে শোয়ার ব্যবস্থা করে দে, আর লিখবো না।"

সত্যি বলতে কি আমি এতদিনের আগের বন্ধুর এই অবস্থা দেখে নিজেকে খানিকটা গুটিয়ে নিয়েই ফেরত এসেছি। এসে নেট ঘেঁটে দেখছিলাম যে ভারত সরকার সত্যিই স্বাস্থ্য নিয়ে কতটা চিন্তাভাবনা করে।

এ বছরের কেন্দ্রীয় প্রতিরক্ষা খাতে বাজেট ৬,২১,৯৪০ কোটি, গ্রামীণ খাতে বাজেট ২,৬৫,৮০৮ কোটি, কৃষি খাতে ১,৫১,৮৫১ কোটি, গৃহ মন্ত্রক খাতে ১,৫০,৯৮৩ কোটি, শিক্ষা খাতে ১,২৫,৬৩৮ কোটি, আই টি টেলিকম খাতে ১,১৬,৩৪২ কোটি টাকা বরাদ্দ আর সাত নম্বরে আছে স্বাস্থ্য যার বরাদ্দ মাত্র ৮৯,২৮৭ কোটি টাকা।

ফিরে আসার আগে আমার সেই বন্ধুর সাথে আবার দেখা। তখন ওর মেজাজ অনেক ঠান্ডা হয়ে এসেছে। হাসপাতাল চত্বরে দাঁড়িয়ে চায়ে চুমুক দিয়ে অনেক পুরোনো সুখ দুঃখের গল্প হল। বলেছিল, "রাগের মাথায় বলেছি, তুই কিছু মনে করিস না, আমার অসহায় অবস্থা টা একটু বোঝার চেষ্টা করিস।"

ফিরে এসে রিপোর্টে আমাকে লিখতেই হয়েছিল সেই স্ট্যান্ডার্ড ট্রিটমেন্ট প্রটোকল ভাঙার কথা, বন্ধুকে যতই ভালোবাসি। আমি নিরুপায়। কিন্তু রিপোর্ট লিখতে বসে ওর সেই রাগী মুখটা বারবার মনে পরে যাচ্ছিল আর সেই কথাটা। "আমি মানুষের নয়, কুকুরের চিকিৎসা করি"।

আমরা ভারতের নাগরিকরা স্বাধীনতার এত বছর বাদেও ভারত সরকারের চোখে সত্যিই বোধহয় "মানুষ" হয়ে উঠতে পারলাম না। পারলে প্রসূতি মাকে তার সদ্যজাত শিশুকে নিয়ে হাসপাতালের মেঝেতে ঠাঁই নিতে হত না। 

আমরা আবার আমাদের দেশ নিয়ে বড়াই করি। লেটেস্ট রাফায়েল জেট বিমান আমাদের অস্ত্র সম্ভারে যোগ করে আমরা উল্লসিত হই। ভারতের মাননীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রী তাঁর চিরাচরিত ধুতি খুলে ফাইটার পাইলট এর ড্রেস পরে ছবি তুলে, লেবু ঝুলিয়ে পোজ দেন ফটোর জন্য। সেই ছবি হাজার লক্ষ শেয়ার হয়, লাইক হয়। আমরাই করি। 

অনেকদিন আগে আস্তাবলে এক দেবশিশুর নাকি জন্ম হয়েছিল। সেই দিনটা যাকে আমরা বড়দিন বলে মানি। সেটাও কনকনে ঠান্ডার দিন ছিল। আজও তাই। আজও অনেক দেবশিশুর জন্ম হবে। আমাদের কেবল ভাবা দরকার যে তাদের কজন মানুষের বাচ্চা আর কজন তালিকায় সাত নম্বর এ থাকা "কুকুরের বাচ্ছা" আমার সেই বন্ধুর ভাষায় ? 

বুধবার, ১১ ডিসেম্বর, ২০২৪

জাতীয় পতাকা ও হিন্দুত্ববাদী ~ ডাঃ সমুদ্র সেনগুপ্ত

প্রতিবেশী দেশে আমাদের জাতীয় পতাকার অবমাননা এর ঘটনায় যখন গোটা দেশ সরব,আমরা মানে সাধারণ মানুষরা দুঃখিত, ব্যথিত এমনকি ক্রুদ্ধ, তখন এই ঘটনার ফায়দা তুলতে কিছু ছদ্ম জাতীয়তাবাদী আসরে নেমে পড়েছে। জঙ্গী জাতীয়তাবাদের জিগির তোলা এইসব হিন্দু মৌলবাদীদের স্বরূপ জানা বোঝার জন্য আমাদের জাতীয় পতাকা নিয়ে তাদের প্রকৃত মুল্যায়ন কি সেটা জেনে রাখা দরকার হয়ে পড়েছে।

সংঘ পরিবার ও জাতীয় পতাকা ১:
১৯২৯ সাল এর ডিসেম্বর মাসে লাহোরে অনুষ্ঠিত অধিবেশনে কংগ্রেস সিদ্ধান্ত নেয় যে পরের বছর ২৬শে জানুয়ারি দিনটিকে স্বরাজ দিবস হিসেবে পালন করা হবে এবং চরকা চিহ্নিত তেরঙ্গা পতাকা তোলা হবে সর্বত্র। এর প্রেক্ষিতে ২১শে জানুয়ারি ১৯৩০ সংঘ প্রধান কেশব বলিরাম হেডগেওয়ার একটি সার্কুলার দেন যার মোদ্দা কথা হল যে রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘের শাখাগুলি গেরুয়া ঝান্ডা (ভাগোয়া ঝান্ডা) কেই জাতীয় পতাকা হিসেবে মান্যতা দেবে, ওই তেরঙ্গা ঝান্ডাকে নয়। [সূত্র: পালকার, ডক্টর হেড গেওয়ার পত্ররূপ ব্যক্তি দর্শন, অর্চনা প্রকাশন, পৃষ্ঠা ১৮]

সংঘ পরিবার ও জাতীয় পতাকা ২:
১৯৪১ সালের ২২শে সেপ্টেম্বর এক বিবৃতিতে সাভারকার বলেন যে যার মতে ওম এবং স্বস্তিকা চিহ্ন আঁকা হিন্দু মহাসভার পতাকা ই হিন্দুদের একমাত্র পতাকা যেসব অনুষ্ঠানে ওই পতাকা থাকবে না সেগুলি বয়কট করতে হবে। চরকা চিহ্নিত ওই তেরঙ্গা পতাকা কেবল কংগ্রেসের পতাকা ওটা গর্বিত হিন্দুদের প্রতিনিধিত্ব মূলক নয়। [সূত্র: ভিডে এ এস, বিনায়ক দামোদর সাভারকার, এক্সট্র্যাক্ট ফ্রম প্রেসিডেন্টস ডায়েরি, পৃষ্ঠা ৪৬৯, ৪৭৩]

সংঘ পরিবার ও জাতীয় পতাকা ৩:
১৪ই জুলাই, ১৯৪৬ সালে গুরুপূর্ণিমা উপলক্ষে অনুষ্ঠিত এক জমায়েতে সংঘের উচ্চ নেতৃত্ব কে গোলয়ালকর বলেন যে কেবল মাত্র গেরুয়া ঝান্ডা ই ভারতীয় সংস্কৃতিকে হাজির করতে পারে। এটাই ঈশ্বরের ইচ্ছা। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস যে একদিন গোটা জাতি এই পতাকার সামনে মাথা নত করবে। [সূত্র: গোলয়ালকর শ্রী গুরুজী সমগ্র দর্শন, নাগপুর সং, পৃষ্ঠা ৯৮]

সংঘ পরিবার ও জাতীয় পতাকা ৪:
১৯৪৭ সালের ১৪ই আগষ্ট, সমগ্র জাতি যখন আসন্ন স্বাধীনতা দিবস নিয়ে উদ্বেল তখন আর এস এস এর ইংরেজি মুখপত্র অর্গানাইজার এ লেখা হয়, "ভাগ্যের ধাক্কায় যারা ক্ষমতায় এসেছে তারা আমাদের হাতে তেরঙ্গা ঝান্ডা তুলে দিতে পারে কিন্তু ওই পতাকা কখনোই হিন্দুদের শ্রদ্ধার জায়গা নিতে পারবে না। তিন শব্দটাই অশুভ এবং তিন রঙে সজ্জিত ওই পতাকা আমাদের ওপর অতি ক্ষতিকারক মানসিক প্রভাব ফেলবে এবং দেশের পক্ষে আঘাত স্বরূপ [সূত্র: অর্গানাইজার ওই সংখ্যা]

সংঘ পরিবার ও জাতীয় পতাকা ৫:
স্বাধীনতার পরেও দেশের আইন অনুযায়ী স্বীকৃত জাতীয় পতাকার মর্যাদাকে ক্রমাগত অস্বীকার করার চেষ্টা সংঘ পরিবার দেখিয়ে গেছে। গেরুয়া ঝান্ডা কে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে সংঘ প্রধান গোলোয়ালকর এর কথায় আমাদের দেশের নেতারা নাকি নকল নবীশ, অন্যদেশের টুকলি করে আমাদের জাতীয় পতাকা বানানো হয়েছে যার কোনো প্রয়োজনই ছিল না আমাদের দেশে যার সুমহান ঐতিহ্য আছে। হাজার বছর ধরে আমাদের কি কোনো নিজস্ব ঝান্ডা ছিল না? [সূত্র গোলোয়ালকর, বাঞ্চ অফ থটস, সাহিত্য সিন্ধু প্রকাশন, ১৯৬৬, পৃষ্ঠা ২৩৭-২৩৮]

সংঘ পরিবার ও জাতীয় পতাকা ৬:
২০০১ সাল অবধি আর এস এস এর সদর দপ্তরে কোনোদিন জাতীয় পতাকা তোলা হতো না। ওই বছর রাষ্ট্রোপ্রেমী যুবা দল বলে একটি সংগঠন আর এস এস স্মৃতি ভবনে ঢুকে পরে জোর করে জাতীয় পতাকা ওঠায়। ওই সংগঠনের বিরুদ্ধে আর এস এস এর অভিযোগে মামলা হয়। ২০১৩ সালে অভিযুক্ত এরা ছাড়া পায়। [পিটিআই রিপোর্ট, ২০১৩]

ওপরের তথ্য গুলি অনুধাবন করলে একথা স্পষ্ট যে জাতীয় পতাকার অবমাননার জন্য কুমিরের কান্না কেঁদে যাওয়া সংঘ পরিবারের ছোট বড় কোনো সদস্যের কোনো নৈতিক অধিকার ই নেই এ নিয়ে কোনো কথা বলার কারণ সুযোগ পেলে ওরা আমাদের জাতীয় পতাকাকে ওদের গেরুয়া ঝান্ডা দিয়ে প্রতিস্থাপিত করবে এটা নিশ্চিত। কেউ ফেক জাতীয়তাবাদী না  প্রকৃত দেশপ্রেমিক, আমাকে আপনাকে বুঝে নিতে হবে।