করোনা লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
করোনা লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

শুক্রবার, ১৫ মে, ২০২০

গ্লানি ~ অংশুমান ভট্টাচার্য্য

ভারত বর্ষ এই কোভিডের লড়াই শেষ পর্যন্ত জিতেই যাবে। অন্য দেশের তুলনায় সংক্রামিত হবেন অনেক কম, জনসংখ্যার নিরিখে। মৃত্যুহারও হয়তো কমই হবে। কয়েক মাস বাদে আমরা ফিরে যাবো পুরনো জীবনে। নতুন ছন্দে ফিরে আসবে গোটা সমাজ।

তবুও এইসব আশা-ভরসার মাঝেই আমাদের তাড়া করে যাবে কিছু ছবি। ছবিগুলো অনেক কাল আমাদের খোঁচাবে, ভাবাবে, ভয় পাওয়াবে। মাঝে মাঝে হয়তো শিরদাঁড়া দিয়ে নেমে যাবে ঠান্ডা একটা স্রোত। কখনো কারো চোখের কোনে দু ফোঁটা জল।

জামলো মাকদম। বছর বারোর সেই কিশোরী যে তেলেঙ্গানার লঙ্কার ক্ষেতের কাজ হারিয়ে দুশ মাইল হেঁটে ফিরে আসছিল ছত্তিশগড়ে। বন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে। কিংবা নাম না জানা বছর তিনেকের সেই ছেলেটি। চাকা লাগানো সুটকেসের উপরে যে ঘুমিয়ে পড়েছে মে মাসের দুপুরের রাস্তায়। মা তার টেনে চলেছেন দড়ি বাঁধা সুটকেস। অথবা রেললাইনে ছড়িয়ে থাকা রুটিগুলো। মাল গাড়ির চাকা ষোল জন মানুষকে পিষে দিয়ে গেলেও রুটিগুলো রয়ে গেছে। আবার মুজাফফরনগরের থেঁতলানো ট্রাক্টর, যাতে করে ছজন বাড়ি ফিরছিলেন। অথবা মধ্যপ্রদেশের গুনা রাস্তায় পড়ে থাকা ট্রাকের নিচে পিষ্ট কটা লাশ।

চলচ্ছবির মত আমরা দেখে যাই অগুনতি মানুষ হেঁটে চলেছেন ন্যাশনাল হাইওয়ে ধরে। গুরগাঁও রাজস্থান গুজরাট মহারাষ্ট্র কেরল থেকে পুবের রাজ্যে। ঘাড়ে মাথায় বস্তা, ব্যাগ‌, সস্তার সুটকেস। আর বাচ্চা। ভবিষ্যতের ভারতবর্ষ। এই স্মৃতি নিয়েই তারা নাগরিক হতে চলেছে। 

নতুন একটা শব্দ শিখলো ভারতবাসী - পরিযায়ী শ্রমিক। অর্থনীতির ছাত্র রা আরেকবার ঝালিয়ে নিল মাইগ্রেশনের থিওরি, গ্রাম থেকে শহরে শ্রমিকের গতায়াত। সাধারণ মানুষ আবার শিখলো ভূগোল। তেলেঙ্গানা থেকে ঔরঙ্গাবাদ হয়ে মোজাফফরপুর অব্দি ছড়ানো ভূগোল সেই দেশের।

লকডাউন শুরু হওয়ার পর প্রায় পঞ্চাশ দিন বাদে কেন্দ্রীয় সরকারের মুখে শোনা গেল এদের কথা। কি আশ্চর্য যে এত বড় পরিকল্পনার ফাঁকে হারিয়ে গেছিলেন প্রায় দশ কোটি মানুষ। প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন যিনি যেখানে আছেন তিনি সেখানেই রয়ে যাবেন। এই প্রান্তিক মানুষদের ব্যবস্থা রাজ্য কেন্দ্র কেউই করে উঠতে পারলো না প্রায় দু'মাসে, স্রেফ ভোটার নয় বলে। ইতিহাস কেন আমাদের ক্ষমা করবে!

অর্থমন্ত্রীর বয়ানে আগামী প্রকল্প পরিকল্পনা জানা গেল। কিন্তু এই পরিকল্পনা কি পঞ্চাশ দিনের গবেষণার ফসল! এক দেশ এক রেশন কার্ড তো খাদ্যমন্ত্রী পাসোয়ান গত বাজেটেই ঘোষণা করেছিলেন। এই বছরের মার্চে তা সম্পূর্ণ হওয়ার কথা ছিল। সে যদি নাও হয়ে থাকে, এক দেশ এক আধার কার্ড তো ছিলই। তা দিয়ে ভিন রাজ্যের শ্রমিকদের রেশন কেন দেওয়া গেল না তার সদুত্তর পাওয়া যায় না। 

পঞ্চাশ দিন বাদে যে ব্যবস্থা নিয়ে আপনি আসলেন মাননীয়া অর্থমন্ত্রী তা খুবই সাধারন, খুবই অপ্রতুল। আশা ও প্রয়োজন দুটোই অনেক অনেক বেশি ছিল। ক্ষমা করবেন ম্যাডাম কিছুতেই বলতে পারছিনা যে দের আয়ে দুরস্ত আয়ে। 

দিনের শেষে রাজ্য কেন্দ্র সব সরকারই আমাদের বিশ্বাস করিয়ে ছাড়বেন যে এই করোনা যুদ্ধে আমাদেরই জয় হয়েছে। সংখ্যাতত্ত্বও সে কথাই সপ্রমাণ করবে। রাষ্ট্র তার বিধি নিষেধ পালনে, নিয়মের নিগড়ে, নাগরিকের বাধ্যতায় প্রমাণ রেখে যাবে কি কঠোরতায় আমরা এ জয় সম্ভব করেছি। 

তবুও জামলো মাকদমের মাতৃভূমি হিসেবে, সুটকেসের ওপরের নাম-না-জানা ঘুমন্ত বাচ্চাটির জন্মভূমি হিসেবে, এই দেশ শেষমেষ পরাজিত। রেল লাইনের উপরে ছড়িয়ে থাকা রুটিগুলো আজন্ম এই পরাজয়ের দলিল হয়ে থাকবে। সরকার বা রাষ্ট্র জয় ঘোষণা করলেও এই দেশ শেষ পর্যন্ত হেরেই গেছে। পরাজয়ের এই গ্লানি থেকে আমাদের কোনো মুক্তি নেই।

ছবি গুলো বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম থেকে নেওয়া। এত পরিচিত হয়ে গেছে আজ যে আলাদা করে নাম দেবার দরকার নেই। কোলাজ ও  স্কেচ এফেক্ট আমার করা কম্পিউটারে।

সোমবার, ১১ মে, ২০২০

করোনা ও শ্রমিক ~ পুরন্দর ভাট

প্রতিদিন আমরা দেখতে পারছি লক্ষ লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিক শ'য়ে শ'য়ে কিলোমিটার পথ পায়ে হেঁটে বা সাইকেল চালিয়ে নিজের দেশে পৌঁছনোর চেষ্টা করছে শহরগুলো থেকে। অনেকে শেষ অবধি পৌঁছতে পারছে না, রাস্তাতেই হার স্বীকার করে নিচ্ছে। মৃত শ্রমিকের সংখ্যা করোনায় মৃতের সংখ্যার মত গোনা হচ্ছে না, কোনো ওয়েবসাইট মৃত শ্রমিকের সংখ্যার "ইউনিফর্ম" বা "লগারিদমিক" - কোনো স্কেলেই "কার্ভ" তৈরি করে দেখাচ্ছে না। হাতে গোনা কিছু খবর আসছে যেমন ট্রাকের ধাক্কায় গুজরাটে ৫ জনের মৃত্যু বা অরঙ্গাবাদে ট্রেনের তলায় ১৫ জন অথবা আম বোঝাই ট্রাক উল্টে ৫ জন। এর বাইরেও যে অনেক বড় সংখ্যক শ্রমিক মাঝরাস্তায় হারিয়ে যাচ্ছে সেই নিয়ে সন্দেহ নেই।

তবে করোনায় মৃত্যুর সঙ্গে শ্রমিকের মৃত্যুর একটা তফাৎ রয়েছে। করোনায় মৃত্যু ভাইরাসে, আর শ্রমিকের মৃত্যু রাষ্ট্রের জন্য। করোনায় মৃত্যুগুলো রোখা সম্ভব ছিল না, শ্রমিকদের মৃত্যুগুলো রোখা যেত। রাষ্ট্র যদি এদের থাকার-খাওয়ার ব্যবস্থা করতো, অথবা প্রত্যেকের হাতে এক মাসের রোজগার পৌঁছে দিত তাহলে এই পরিণতি হতো না। কিছু কিছু বিজ্ঞ দেখছি বলছে যে সরকারের কী দোষ, সরকার কী করবে ইত্যাদি। তাদেরকে শুধু একটাই কথা বলব যে অপেক্ষা করুন, যে অর্থনৈতিক সংকটে পড়তে চলেছে দেশ এবং বিশ্ব তাতে সরকারি চাকুরেদেরও মাইনে এবং চাকরিতে কাট ছাঁট হতে চলেছে, বেসরকারি চাকরি... হেঁ হেঁ। আপনি আইটিতে কাজ করেন? ভাবছেন আইটিতে ওয়ার্ক ফ্রম হোম হয়, চাকরিতে টান পড়বে না? কে নেবে আপনার সার্ভিস? কে হবে আপনার ক্লায়েন্ট? আমেরিকা, ইউরোপ, জাপান - যে দেশগুলোয় ভারতের সবচেয়ে বেশি আইটি রফতানি সেখানকার সব থেকে বড় বড় কোম্পানিগুলোও চরম অর্থনৈতিক সংকটে। ২০০৮-এর মত এখনো লেম্যান ব্রাদার্স বা এআইজি দেখতে পাননি তার কারণ এদের ব্যালেন্স শিট এবং ব্যাংকগুলোর কাছে প্রকৃত বকেয়া ঋণের হিসেব এখনো করে ওঠা হয়নি। লকডাউন ওঠার পরেই আসল চিত্র দেখতে পাবেন। আমেরিকায় বেকারত্ব ১৫%-এ পৌঁছেছে যা ঐতিহাসিক। সেখানকার সরকারও আউটসোর্সিংয়ের ওপর বিধিনিষেধ চাপাবে। মার্কিনী বিশেষজ্ঞরা সকলেই এক মত যে এই ক্রাইসিস ২০০৮-এর গ্রেট রিসেশনের থেকেও অনেক গ্রেটার। তাই আইটি ভাই বোনেরা একটু ধৈর্য ধরুন, আমি নিশ্চিত যারা এখনো পরিযায়ী শ্রমিকদের সাথে সমব্যথী হতে পারছেন না তারা কয়েক মাস পরেই হতে পারবেন।

তবে শুধু কয়েক কোটি পরিযায়ী শ্রমিকই এতে বিপর্যস্ত এটা খুব ভুল ধারণা। তাদের কষ্টটা হয়ত সর্বাধিক এবং তারা শ'য়ে শ'য়ে কিলোমিটার হাঁটছে বলে সেটা সামনে আসছে, কিন্তু অর্থনৈতিক বিপর্যয় চিত্রটা যে অনেক বিপুল বুঝতে পারবেন যখন আপনি নিজের পাড়ায় খোঁজ নেবেন। ছোট কারখানা, রেস্তোরাঁ, দোকান, ট্যাক্সি বা অটোচালক, রিকশাচালক, হকার - এই বিপুল সংখ্যক মানুষ, যারা ছোট ব্যবসা বা অস্থায়ী চাকরি করে পেট চালান তাদের রেশনের চাল আর আটা ছাড়া বাকি কোনো কিছু কেনার আর পয়সা নেই। শুধু এরাই নন, টিউশন করে পেট চালানো, অথবা স্কুল বা কলেজের অস্থায়ী শিক্ষক/শিক্ষিকা, যারা আপাত মধ্যবিত্ব তাদেরও অনেকের অবস্থা এরকম, আত্মীয় স্বজনের থেকে ধার চাইতে হচ্ছে বিদ্যুতের বা টেলিফোনের বিল দিতে। যাঁরা ত্রাণ দিচ্ছে পাড়ায় পাড়ায়, অথবা কমিউনিটি কিচেন চালাচ্ছেন তাদেরকে জিজ্ঞেস করুন, কত মধ্যবিত্ব বাড়ির লোকজনকেও খাবার দিতে হচ্ছে কারণ তাদের বাড়িতে গ্যাস কেনার টাকা নেই।

অথচ এই অর্থনৈতিক সংকট আটকানো না গেলেও কিছুটা সুরাহা মানুষকে হয়ত দেওয়া যেত। আমেরিকা ও ইউরোপের অধিকাংশ দেশের সরকার নিঃশর্তে প্রত্যেকটা মানুষের একাউন্টে বেশ কিছু টাকা দিয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উচ্চবিত্ত বাদ দিয়ে বাকি প্রতিটা মানুষের একাউন্টে ১,২০০ ডলার দিয়েছে, ৯০,০০০ টাকা। জার্মান সরকার প্রত্যেকের একাউন্টে দিয়েছে ৮০০ ইউরো, তা ছাড়া ছোট ব্যবসায়ীদের দিয়েছে ৫০০০ ইউরো করে যাতে তারা কর্মচারীদের মাইনে দিতে পারে। উন্নত দেশ বাদ দিন, অধিকাংশ উন্নয়নশীল দেশও ভারত সরকারের চেয়ে বেশি ত্রাণ দিয়েছে। নীচে একটি গ্রাফ রয়েছে (চিত্র-১)। ইউরোপের সেন্টার ফর ইকোনোমিক পলিসি রিসার্চ বিশ্বের অর্থনৈতিক গবেষণার একটি অন্যতম প্রধান কেন্দ্র। তারা প্রতি সপ্তাহে কোভিড-১৯-এর অর্থনৈতিক প্রভাব নিয়ে কিছু গবেষণাপত্র প্রকাশ করছে। এই গ্রাফটি সেখানকারই একটি গবেষণাপত্র থেকে নেওয়া যার লিংক শেষে পাবেন (লিংক-১)। এই গ্রাফে এক একটা নীল বিন্দু হলো এক একটি দেশ। এই গ্রাফে এক একটি দেশের অর্থাৎ বিন্দুর অবস্থান নির্ভর করছে দুটো সংখ্যার ওপর - এক, সে দেশের সরকার কতটা কঠোর লকডাউন ঘোষণা করেছে এবং দুই, সে দেশের সরকার কতটা ইকোনোমিক রিলিফ দিয়েছে জাতীয় আয়ের শতাংশের হিসেবে। যে দেশের সরকার যত বেশি কঠোর লকডাউন ঘোষণা করবে তত বেশি সেই দেশের মানুষ অর্থনৈতিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে, এবং তাই মানবতার খাতিরে ধরে নেওয়া যায় যে সেই দেশের সরকার তত বেশি অর্থনৈতিক ত্রাণ দেবে। ওই চিত্রটিতে দেখা যাচ্ছে যে অধিকাংশ রাষ্ট্রের ক্ষেত্রেই সেটা সত্যি - যত কঠিন লকডাউন তত বেশি ত্রাণ, একটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কখনো দেশের নাগরিকদের আধ পেটা খেয়ে থাকতে বাধ্য করতে পারে না। কিন্তু দেখুন, একমাত্র ব্যতিক্রম কে? ভারতবর্ষ! এই দেশ লকডাউনের দিক দিয়ে প্রায় কঠোরতম অথচ অর্থনৈতিক ত্রাণের দিক দিয়ে প্রায় কৃপণতম। ভুল বুঝবেন না, এখানে কিন্তু ত্রাণের হিসেবটা জাতীয় আয়ের শতাংশে করা হচ্ছে তাই আমাদের দেশ গরিব সেই যুক্তি খাটবে না। ও হ্যাঁ, এই গ্রাফ তৈরির জন্য সমস্ত তথ্যই অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের কোভিড ডেটাবেস থেকে জোগাড় করা। এই ডেটাবেসের হিসেবেই ভারতের লকডাউনকে বিশ্বের মধ্যে কঠিনতম বলা হয়েছিল, যা দেখিয়ে ভারতের সরকারপন্থী মিডিয়া মোদির গুনগান গেয়েছিল। তখন বোধয় তারা জানতো না যে সেই ডেটাবেসে অর্থনৈতিক ত্রাণেরও হিসেবও দেওয়া থাকে।

অর্থাৎ ভারতের রাষ্ট্র বিশ্বের সমস্ত দেশের তুলনায় সব থেকে শ্রমিক বিরোধী অবস্থান নিয়েছে করোনাযুদ্ধে। কিন্তু প্রশ্ন হলো - কেন? এই কোটি কোটি মানুষের তো ভোটাধিকার আছে, ভারত এখনো গণতন্ত্র, এখনো ভোট হয়, তাহলে কী এমন দায় পড়লো সরকারের যে তারা এই কোটি কোটি মানুষের চরম বিপর্যয়ে একটু সাহায্যের হাতও বাড়াতে চাইছে না? কার স্বার্থ কোটি কোটি শ্রমিক ও খেটে খাওয়া মানুষের চেয়েও বেশি? এর উত্তর আছে দ্বিতীয় চিত্রে। দ্বিতীয় চিত্রে ফের এক একটি বিন্দু হলো এক একটি দেশ এবং এই গ্রাফে এক একটি দেশের অবস্থার নির্ধারিত হয়েছে ফের দুটি সংখ্যামানের দ্বারা যার একটি আগের মতোই অর্থনৈতিক ত্রাণ কিন্তু অপরটি হলো "সভরেন ক্রেডিট রেটিং"। সভরেন ক্রেডিট রেটিং কী? এটি হলো একটা মাপকাঠি যা নির্ধারণ করে কোন দেশের বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছে কতটা আকর্ষণীয় হওয়া উচিত। সভরেন ক্রেডিট রেটিং যদি খারাপ হয়ে যায় কোনো দেশের তাহলে সে দেশের শেয়ার বাজার থেকে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা পয়সা তুলে নেবে, সে দেশের কোম্পানিগুলোর বিদেশ থেকে ঋণ পাওয়া মুশকিল হবে বা সুদের হার বেশি দিতে হবে, সে দেশের সরকারকেও বিদেশ থেকে ধার করলে সুদের হার বেশি দিতে হবে। এই গ্রাফটিতে দেখতে পাচ্ছেন যে যেসব দেশগুলির ক্রেডিট রেটিং খারাপ সেই দেশগুলো করোনার জন্য অর্থনৈতিক ত্রাণও কম দিয়েছে এবং ভারতও সেই দেশগুলির মধ্যে একটা। এর কারণ হলো সরকারি খরচ বাড়ালে ক্রেডিট রেটিং কমার সম্ভাবনা থাকে, তাই যাদের ক্রেডিট রেটিং আগের থেকেই খারাপ তারা ত্রাণও কম দেবে এই ভয়ে যে রেটিং তাতে আরো খারাপ হয়ে যেতে পারে।

তাহলে এটা বোঝা গেল যে ভারত সরকার শ্রমিক বিরোধী অবস্থান নিচ্ছে, ত্রাণ দিচ্ছে না তার কারণ ক্রেডিট রেটিংয়ের ভয়। কিন্তু ক্রেডিট রেটিং খারাপ হলেই বা কী? অসুবিধে কোথায়? আগেই বলেছি যে তাতে শেয়ার বাজার ধাক্কা খাবে কারণ বিদেশি বিনিয়োগ বেরিয়ে যাবে। শেয়ার বাজারে এই বিদেশি বিনিয়োগটা মূলত ফাটকা পুঁজি। কিন্তু তা বেরিয়ে গেলেই বা কী? অনেকেরই ভুল ধারণা থাকে যে শেয়ার বাজারের ওপর অর্থনীতির স্বাস্থ্য নির্ভর করে, কিন্তু আসলে বিষয়টা উল্টো - অর্থনীতির স্বাস্থ্যর ওপর শেয়ার বাজার নির্ভর করে (যদিও সেটাও সবসময় হয় না)। তাই শেয়ার বাজার পড়লে অর্থনীতির আলাদা করে বড় ক্ষতি হবে না, বিশেষ করে যেখানে আমাদের দেশে খুব কম সংখ্যক মানুষ শেয়ার বাজারে অনেক টাকা বিনিয়োগ করে। তাহলে? শেয়ার বাজারে বড় বিনিয়োগকারীদের অনেকের সাথে বিজেপি আরএসএস-এর দহরম মহরম কোনো গোপন তথ্য নয়, তাদের স্বার্থ রক্ষা করাটা হয়ত একটা উদ্দেশ্য হতে পারে। অপর একটা যুক্তি হতে পারে যে বিদেশি ফাটকা পুঁজি বেরিয়ে চলে গেলে টাকার দাম পড়বে। সেটার একটা সম্ভাবনা আছে। কিন্তু এ কথাও সত্যি যে ভারতের বিদেশি মুদ্রার ভান্ডার বিশ্বের মধ্যে অন্য বৃহত্তম, তা ছাড়া তেলের ও সোনার দাম তলানিতে। এই দুটো দ্রব্য ভারতের সবচেয়ে বড় আমদানি, তাই এদের দাম কমলে/বাড়লে টাকার দামও বাড়ে/কমে। সেই দিক দিয়ে তাই এক্ষুনি টাকার ওপর চাপ আসার তেমন কারণ নেই। সম্প্রতি, আইএমএফ উন্নয়নশীল দেশগুলোর মুদ্রার দাম করোনা সংকটের জন্য যাতে হঠাৎ করে পড়ে না যায়, আর তাদের বিদেশি মুদ্রার কোষাগার যাতে ফাঁকা না হয়ে যায়, তার জন্য সব উন্নয়নশীল দেশকে ব্যাপক বিদেশি মুদ্রা ঋণ দেওয়ার প্রস্তাব দেয় (স্পেশ্যাল ড্রয়িং রাইটসের লিমিট বাড়িয়ে), কিন্তু ভারত একমাত্র উন্নয়নশীল দেশ যে এটার বিরোধিতা করেছে। তাই ধরে নেওয়া যায় যে ভারত সরকার টাকার মূল্য পড়া নিয়ে ভাবিত নয়।

তাহলে ক্রেডিট রেটিং খারাপ হলে আর কী কী ক্ষতি হতে পারে যার জন্য সরকার এত ভাবিত? ভারত সরকার বিদেশ থেকে ঋণ নিতে চাইলে সুদ বেশি দিতে হতে পারে। কিন্তু ভারত সরকারের বিদেশ থেকে ঋণ খুবই সামান্য, আর যেটুকু সেগুলোও ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের মত সংস্থা থেকে স্পেশ্যাল ডেভেলপমেন্টাল লোন যাতে সুদ নামমাত্র। তাহলে? দেখুন আরো একটা কারণ ওপরে লেখা রয়েছে। দেখছেন? - ভারতীয় "কোম্পানিগুলোর বিদেশ থেকে ঋণ পাওয়া মুশকিল হবে বা সুদের হার বেশি দিতে হবে"। এই, এইটেই হলো সেই গোপন কথাটি যেটা সরকার কোনোদিন উচ্চারণ করবে না। ব্যাংক অফ ইন্টারন্যাশনাল সেটেলমেন্ট জানাচ্ছে যে ভারতের কর্পোরেট সেক্টরের মোট বিদেশী ব্যাংকগুলো থেকে বিদেশী মুদ্রার ঋণ হলো ৫৯০০ কোটি ডলার, ৩ লক্ষ ৭৫ হাজার কোটি টাকা (লিংক-২)। এটা শুধুই কিন্তু বিদেশী ব্যাংক থেকে। অন্য জায়গা থেকে বিদেশী মুদ্রার ঋণ ধরলে সংখ্যাটা আরো বেশি। শুধু ২০-টা বৃহত্তম কর্পোরেট সংস্থার বিদেশী ঋণই ১৮০০ কোটি ডলার, ১ লক্ষ ৩০ হাজার কোটি টাকা। তার মধ্যে রিলায়েন্স, টাটা, বিড়লা - সবই আছে (কোম্পানিগুলির ব্যালেন্স শিট থেকে এই তথ্য পেয়ে যাবেন।) সভরেন রেটিং খারাপ হলে সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়বে এদের ওপরেই। এই ঋণের ওপর সুদ বেড়ে যাবে, নতুন ঋণ পেতে অসুবিধে হবে, লাভ কমবে।

তাহলে বোঝা গেল যে ভারতের কোটি কোটি শ্রমিক, ছোট ব্যবসায়ী, দিন আনি দিন খাই মানুষের প্রতি সরকারের অমানবিক আচরণ এবং পর্যাপ্ত অর্থনৈতিক ত্রাণ দেওয়ায় অনীহার পেছনে কারণ হলো যে এই সরকার বৃহৎ পুঁজিপতি ও শেয়ার বাজারে বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষা করতে বেশি ব্যস্ত। শ্রমিকদের ট্রেনের টিকিটের টাকা না দেওয়ার অমানবিক সিদ্ধান্তের পেছনেও রয়েছে টাটা আম্বানি - যারা বিজেপির ইলেক্টরাল বন্ডে হাজার হাজার কোটি টাকা দিয়েছে - সেই তাদের স্বার্থ রক্ষার তাগিদ। ভারতের শ্রেণী সংঘাত বোধয় এতটা সরাসরি এবং এতটা ক্ষিপ্র আকার ইদানিংকালে নেয়নি। কিন্তু অধিকংশ মানুষ জানবে না যে লক্ষ লক্ষ মানুষ হাজার হাজার কিলোমিটার হাঁটছে আসলে শ্রেণী সংঘাতের কারণে, তারা জানবে না যে তাদের ওপর শ্রেনিযুদ্ধর ঘোষণা হয়েছে। ভাববার সময় হয়েছে যে এই বৃহৎ পুঁজিপতিরা কতটুকু সম্পদ ও চাকরি তৈরি করে দেশের জন্য যার জন্য এরকম কোটি কোটি মানুষ আধপেটা খাবে? যারা এখনও পুঁজিপতিদের পক্ষ নেবে তাদের সাথে এখনই কোনো তর্ক করবো না, তিন মাস পর করবো কারণ আমি নিশ্চিত যে তিন মাসের মধ্যে এর আঁচ কর্পোরেট চাকরি করা মধ্যবিত্ত শ্রেণীর গায়ও লাগবে। তখন না হয় তাদের মতামত শুনতে চাইবো।
*******************

লিংক ১: https://cepr.org/si…/default/files/news/CovidEconomics11.pdf

লিংক ২: https://stats.bis.org/statx/srs/table/A6.1?c=IN&p

রবিবার, ১০ মে, ২০২০

রাষ্ট্র তুমি কার ~ শমীক লাহিড়ী

১৯৩৫ সাল। জানুয়ারী মাসের শীতের রাত। নিউইয়র্ক শহরে ঠান্ডার রাতে নৈশবিচারসভায়  শতচ্ছিন্ন পোশাকের একজন বয়স্ক মহিলাকে এনে উপস্থিত করলো নিউইয়র্ক সিটি পুলিশ। বিবর্ণ চেহারা। দেখেই বোঝা যাচ্ছে অভুক্ত।

বিচারক তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন - আপনি কি সত্যি রুটি চুরি করেছেন? 
মাথা নীচু করে মহিলা বললেন - হ্যাঁ,  আমি রুটি চুরি করেছি। 
বিচারক - কেন আপনি রুটি চুরি করেছেন - ক্ষিদের জ্বালায়? 
মহিলা এবার সরাসরি বিচারকের দিকে তাকালেন। মৃদু কিন্তু দৃঢ় গলায় বললেন - আমার মেয়েকে তার স্বামী পরিত্যাগ করেছে। আমার মেয়ে অসুস্থ। সে তার দুই ছোট্ট সন্তানকে নিয়ে আমার কাছে থাকে। গত কয়েকদিন ধরে তারা অভুক্ত। আমি তাদের দিকে তাকাতে পারছিলাম না। 
বিচার কক্ষে গুঞ্জন শুরু হয়ে গেল। যে দোকানদার চুরির অভিযোগ এনেছিলেন, দাঁড়িয়ে বললেন, একে উদাহরণযোগ্য শাস্তি দিন, যাতে আর কেউ এই কাজ করার সাহস না পায়।

বিচারক তাঁর চেয়ারে গা এলিয়ে কিছুক্ষণ চিন্তা করে মহিলার উদ্দেশ্যে বললেন - দেখুন আমাকে আইন অনুযায়ী চলতে হবে। আইন অনুযায়ী আপনাকে ১০ ডলার ফাইন দিতে হবে, না পারলে ১০ দিনের জেল।

এই কথা বলেই নিজের পকেট থেকে ১০ ডলার বের করে নিজের টুপি খুলে তার মধ্যে রেখে বললেন - আমি ওনার জরিমানার অর্থ দিয়ে দিলাম। আর যতজন এই বিচার কক্ষে উপস্থিত আছেন, প্রত্যেকে ৫০ সেন্ট করে জরিমানা জমা করুন। আপনাদের এই জরিমানা দিতে হবে কারণ, আপনারা ওনার দুর্দশা সম্পর্কে জানতেন অথচ উদাসীন ছিলেন। অথচ ইনি আমাদের সমাজেরই অংশ। বেইলিফকে নির্দেশ দিলেন উপস্থিত সকলের কাছ থেকে, জরিমানা নিয়ে আসতে। এমনকি সেই দোকানদার, পুলিশকেও জরিমানা দিতে হ'লো।

পরেরদিন নিউইয়র্ক সিটি টাইমস সংবাদপত্রের প্রথম পাতায় ছাপা হয়েছিল এই খবর বিচারকের মন্তব্যসহ  - '৫০ সেন্ট জরিমানা করা হয়েছিল মানুষের সমস্যার প্রতি উদাসীনতাকে'।

আমাদের দেশের রাষ্ট্র ব্যবস্থা কি শুনছে? 

৫ই মে সুপ্রিম কোর্টে দায়ের হওয়া এক আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বলেছে - কেন্দ্র শ্রমিক স্পেশাল ট্রেন চালাচ্ছে, এটা জানিয়েছে। কেন্দ্র ৮৫% এবং রাজ্য ১৫% দেবে কি না এটা তাদের বিচার্য বিষয়। তাই কোর্ট এই বিষয়ে কোনও নির্দেশ দেবে না।

৪৫/৫০ দিন ধরে মজুরি না পাওয়া শ্রমিকদের ফেরৎ আনার দায়িত্ব রাষ্ট্র নেবেনা। রাষ্ট্রের বিচার ব্যবস্থা দায়িত্ব নেবে না। কর্পোরেট নিয়ন্ত্রিত সংবাদমাধ্যমের বড় অংশই মুখ কুলুপ এঁটেছে। 

৪ঠা মে সরকারি বিজেপি দলের মুখপাত্র শ্রী সম্বিত পাত্র তড়িঘড়ি ঘোষণা করছিলেন - কেন্দ্রীয় সরকার শ্রমিক স্পেশাল ট্রেনের ৮৫% ভাড়া বহন করবে, বাকিটা রাজ্য সরকারগুলো দিক। আর সরকারি উকিল তুষার মেহেতা ৫ই মে সুপ্রিম কোর্টে বলছেন, সরকার বা রেল এইরকম কোন তথ্য আমাকে দেয়নি এবং কেন্দ্রীয় সরকার রেলের খরচ বহন সম্পর্কে কিছু জানাতে রাজি নয়।

কোনও কর্পোরেট নিয়ন্ত্রিত সংবাদ মাধ্যমকে, এই অসত্যবাদী দল এবং সরকারের উদাসীনতা সম্পর্কে কিছু বলতে শুনেছেন?  বিচারব্যবস্থা কত বিষয় নিয়ে নিজে থেকে মামলা রুজু করে, আর কয়েক কোটি এই দেশের নাগরিক ৫০ দিন ধরে মজুরি না পেয়ে অভুক্ত/আধাপেটা হয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছে, সেই প্রশ্নে নীরবতাকেই বেছে নিল!! প্রধানমন্ত্রী উদাসীন - এটা দেখেও নিজে থেকে মামলা রুজু করে সরকারকে ব্যবস্থা নেওয়ার কড়া নির্দেশ দেওয়ার পরিবর্তে, দায়িত্ব ছাড়লো সেই উদাসীন-অসত্যবাদী সরকারের উপর!!!! বিনা ভাড়ায় এদের নিয়ে যেতে নির্দেশ দিতে পারলো না দেশের বিচার ব্যবস্থা!!!

১৬ টা লাশ ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকার বিভৎস দৃশ্য দেখে গোটা দেশ শোকে মুহ্যমান,  আর রাষ্ট্র নিশ্চিন্তে জলখাবার খেতে খেতে খবরের কাগজে চোখ বুলিয়ে প্রশ্ন তুলছে - রেললাইন কি ঘুমাবার জায়গা!!!
এবার পাল্টা প্রশ্ন তোলার সময় এসেছে - দেশের মানুষের ট্যাক্সের টাকা কি প্রধানমন্ত্রীর বা রাষ্ট্রের কেষ্টুবিষ্টুদের  পিতৃপুরুষের?

ধনীদের ফেরৎ আনার জন্য উড়োজাহাজ বিনি পয়সায় ওড়ে, আর ৫০ দিন মজুরি না পাওয়া আধপেটা সর্বহারা মানুষগুলো গুনে গুনে হাজার টাকা দিলে তবে ট্রেনে উঠতে পারবে। না পারলে রেললাইন ধরে ট্রেনের পিছু পিছু হাঁটো। কেউ লাইনে কাটা পড়বে, কেউ মাথা ঘুরে পড়ে মরবে, আর সরকার বাহাদুর, মাইবাপ বিচারক, মান্যবর আইনসভার সদস্যবৃন্দ, সমাজের প্রতিচ্ছবি সংবাদমাধ্যম গা এলিয়ে লকডাউনের ছুটি উপভোগ করবে??

সংবিধানের ৪৪৮টা ধারা যা ২৫টি অনুচ্ছেদে বর্ণনা করা আছে ১২টি  তপশীল সহ - এর কোথাও কি লেখা নেই, লকডাউনের বিশেষ পরিস্থিতিতে দেশের কোটি কোটি ভুখা মানুষের বাড়ি ফেরার জন্য সরকারকে ট্রেন/বাস ভাড়া দিতে হবে! যদি নাই থাকে তাহলে বিনি পয়সায় ধনীদের উড়োজাহাজে উড়িয়ে আনার আইন কোন ধারায়  লেখা আছে? 

কি বলে রাষ্ট্র? কি বলছে রাষ্ট্র পরিচালনার প্রধান অঙ্গ বিচারব্যবস্থা, প্রশাসন, সংসদ আর ৪র্থ স্তম্ভ সংবাদমাধ্যম?  সবার বিবেক কি অর্থময় হয়ে গেল? ১৫৮ জন বিলিওনিয়ার কি কিনে নিল রাষ্ট্রের বিবেক? দেশটা কি শুধু ওদের বলেই মনে করছে রাষ্ট্র ব্যবস্থা ও তার প্রধান অঙ্গগুলো??
এবার লড়াই বাঁধবে, গরীব নিম্নবিত্ত মধ্যবিত্ত খেটে খাওয়া মানুষের সাথে রাষ্ট্রের। দেশটা শুধু লুঠে খাওয়াদের জন্য নয়, দেশটা সবার। এদেরও সমান অধিকার আছে দেশের কোষাগারের উপর।

১৯৩৫ সালে নিউইয়র্ক আদালতের সেই বিচারক ফাওরেলো  ল্যা গোয়ার্দুয়া আজকের ভারত দেখে বিস্মিত না স্তম্ভিত হতেন জানি না - তবে বিচারকের আসনে বসলে বিচারপতি, আমলা, প্রধানমন্ত্রী, রেলমন্ত্রী, রাজ্যগুলোর মুখ্যমন্ত্রীদের থেকে নিঃসন্দেহে জরিমানা আদায় করে এদের ট্রেন ভাড়া মিটিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দিতেন।


রেল লাইন কি ঘুমনোর জায়গা? ~ সুশোভন পাত্র

আমার বন্ধু বলেছে, রেল লাইন কি ঘুমনোর জায়গা?  
ঠিকই তো বলেছে বলুন আমার বন্ধু। রেল লাইন ঘুমোতে গিয়েছিলো কেন পরিযায়ী শ্রমিক গুলো? নিশ্চিন্তে ঘুমনোর জন্য মুকেশ আম্বানির মত ৪৯হাজার স্কয়ার ফুটের বাড়ি বানিয়ে নিলেই পারতো। ভালোবেসে বাড়িটার 'অ্যান্টিলিয়া' নাম রাখত। ২৭ তালা বাড়িতে ১৬৮টি গাড়ি রাখার গ্যারেজ, ৩টে হেলিপ্যাড থাকতো। ইনডোরের ঝুলন্ত উদ্যানের পাশে ৯টা লিফট সারাদিন ওঠা নামা করত। বডি-স্পা সেন্টার লাগোয়া ইন হাউস সিনেমা হলে বসে বেশ একটা ম্যাটিনি শো চলত। অতিথি সেবার জন্য ৬০০ 'চাকর' পুষত। আর সকালবেলায় নীতা আম্বানির মত জাপানের নরিটেক কোম্পানির ৩লক্ষ টাকার কাপে আমেজ করে চা খেয়ে প্রাতরাশ সারতো। তা না করে, রেল লাইন ঘুমোতে গিয়েছিলো কেন পরিযায়ী শ্রমিক গুলো? রেল লাইন গুলো কি ওঁদের বাপের?
আমার বন্ধু বলেছে, হেঁটে ঘরে ফিরতে গিয়েছিলো কেন পরিযায়ী শ্রমিক গুলো?  
ঠিকই তো বলেছে বলুন আমার বন্ধু। মহারাষ্ট্র থেকে ১৫৭ কিলোমিটার হেঁটে মধ্যপ্রদেশের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেওয়ার কি দরকার ছিল পরিযায়ী শ্রমিক গুলোর? বাড়ি যদি ফিরতেই হত একটা চ্যাটার্ড বিমান কিনে নিলেই পারতো। আগামী জুলাই মাসে ফ্লোরিডা থেকে প্রধানমন্ত্রীর জন্য যে ৮.৫হাজার কোটির বোয়িং-৭৭৭ বিশেষ বিমান আসছে সেটা ভাড়া করলেই পারতো। ক্লান্তি এলে এলিয়ে নেওয়ার জন্য বিলাস বহুল লাউঞ্জ থাকবে। অন বোর্ড ওয়াইফাই থাকবে। মিড এয়ার বিনোদন থাকবে। মিডিয়াম সাইজ কনফারেন্স রুম থাকবে। দেশ-বিদেশের রকমারি কুসিন রান্নার কিচেন থাকবে। তা না করে, পায়ে হেঁটে ঘরে ফিরতে গিয়েছিলো কেন পরিযায়ী শ্রমিক গুলো? কমপক্ষে একটা বুলেট ট্রেনে চাপলেই তো পারতো। 
মৃত এক পরিযায়ী শ্রমিকের বাড়ি মধ্যপ্রদেশের মাঝগাঁও ব্লকের কেওত্রা গ্রামে। পরিবারে ৭ মাসের গর্ভবতী স্ত্রী। ডাক্তার বলেছেন, ২৭বছরের হবু মায়ের এই সময়ে একটু মানসিক ভাবে চাপহীন থাকা চাই। সুষম একটু আহার চাই। প্রতিদিন অল্প কিছু ফল চাই, পারলে একটু দুধ চাই। আমার বন্ধু বলেছে, দুধই যখন চাই, তখন একটু ডালগোনা কফি খেলেই তো পারতো। টেস্টি হবে, ক্রিমী হবে, মুখে দিলেই মেল্ট হয়ে যাবে। সুষম আহারই যদি একটু চাই, একটা চিজ বার্স্ট পিৎজা অর্ডার দিলেই তো পারতো। পুষ্টি পাবে, বার্বে-কিউর টপিংস পাবে। মানসিক চাপ থেকে যদি মুক্তিই চাই, অ্যামাজন প্রাইমে ফরেস্ট গাম্প দেখলেই তো পারতো। রিল্যাক্স করতে সপ্তাহে একবার গোল করে কাটা শসা, চোখে চেপে ত্বকের যত্ন নিলেই তো পারতো।
আসলে আমার বন্ধু সরকারী কর্মচারী। 'প্রিভিলেজড'। প্রিভিলেজড কারণ, আমার বন্ধু অর্থনীতির পোশাকি ভাষায় 'অরগানাইজড সেক্টর'। মাস গেলে বেতনের নিশ্চয়তা আছে, চাকরি'র নিরাপত্তা আছে, সরকার ধার্য ছুটি আছে, শ্রম আইনে বোনাস আছে, ইনক্রিমেন্ট আছে, প্রভিডেন্ট ফান্ড আছে, প্রোমোশন আছে। লকডাউনের সময় তাই একটু চিল-পিল করতে, আমার বন্ধুর বৌ-র কোলে মাথা রেখে, হাতে অ্যান্ড্রয়েড ফোন গুঁজে, দেশের অর্থনীতি নিয়ে বাতেলা দেওয়ার সুযোগ আছে। হোয়াটস-অ্যাপ ইউনিভার্সিটি তে কলার তুলে ফেক নিউজ বিলি করার সময় আছে। রেল লাইন ঘুমনোর জায়গা কিনা প্রশ্ন তোলার বিলাসিতা আছে। 30ml স্কচের পেগে, 'হেঁটে ঘরে ফিরতে গিয়েছিলো কেন?' ভেবে নাবালক সুলভ অবাক হবার ফ্যান্টাসি আছে। দুঃখ একটাই, এতো কিছু 'আছে'র মধ্যে শুধু গায়ে মানুষের চামড়া রাখার অভ্যাসটাই বাদ পড়ে গেছে।
না হলে জানতো, ১৩০ কোটির দেশে এরকম প্রিভিলেজড মানুষের সংখ্যাটা মেরে কেটে ৩কোটি। জনসংখ্যার ২.৩%। আর স্রেফ পরিযায়ী শ্রমিকদের সংখ্যাটা ১২কোটি। জনসংখ্যার ৯.২৩%। না হলে জানতো, ১৯৫৭'তে অর্থনীতিবিদ গুলজারি লাল নন্দা'র নেতৃত্ব ১৫তম ইন্ডিয়ান লেবার কংগ্রেস বলেছিল –"শ্রমিকের ন্যূনতম মজুরি, চারজনের পরিবারের প্রতিজন কে প্রতিদিন ২৭০০ ক্যালরির ব্যালেন্স ডায়েট, পরিবার প্রতি বছরে ৬৫ মিটার কাপড়, সরকারি আবাসন প্রকল্পে প্রদত্ত এলাকার সংশ্লিষ্ট ঘর ভাড়া এবং জ্বালানি, বিদ্যুৎ সহ বিবিধ খরচা পুরোপুরি ভাবে বহন করার উপযুক্ত হওয়া প্রয়োজন।" ১৯৯২'এ সুপ্রিম কোর্ট এই ন্যূনতম মজুরির উপর আরও ২৫% ছেলেমেয়ের পড়াশুনা, চিকিৎসা, বিনোদন এবং উৎসবের জন্য সংযোজনার নির্দেশ দেয়। সব মিলিয়ে বর্তমান বাজার মূল্যে ন্যূনতম মজুরিটা প্রায় মাসিক ২৬,০০০ টাকা। একটু খোঁজ নিয়ে দেখুন তো, আপনার পাড়-মহল্লায় মাসিক ২৬,০০০ রোজগারের নিশ্চয়তা আছে শতকরা কতজনের?
হোয়াটস-অ্যাপ ইউনিভার্সিটির সিলেবাসে আপনি পাবেন না যে, ১৯৮৭-২০১৫, যে ২৮ বছরে সেনসেক্স-নিফটি-জিডিপি'র ঊর্ধ্বগামী অর্থনীতিতে শ্রমিক'রা ২১০% নিট মূল্য সংযোজন করেছে, সেই ২৮ বছরেই শ্রমিক'দের নিট পারিশ্রমিক নাম মাত্র ১৪% বেড়েছে। যে ২৮ বছরে ভারতবর্ষে বিলিয়নারির সংখ্যা ১ থেকে ১৩২ হয়েছে, সেই ২৮ বছরেই ১০০ টাকা উৎপাদন মূল্যে শ্রমিক'দের প্রাপ্য মজুরি কমতে কমতে ৯.৯ টাকায় ঠেকেছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক ১২ই এপ্রিল সুপ্রিম কোর্টে জানিয়েছে, পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য গোটা দেশে রাজ্য ও কেন্দ্র সরকার মিলে যে মোট ২২,৫৬৭টি শিবিরের ব্যবস্থা করেছে তার ১৫,৫৪১টি, অর্থাৎ ৬৯%-ই কেরালায়। একটু খোঁজ নিয়ে দেখুন তো, মিডিয়ার সাধের গুজরাট মডেলে এই শতকরাটা কত?
ফুটেজ খোর প্রধানমন্ত্রী তৃতীয় লকডাউন ঘোষণার সময় ক্যামেরার সামনে আসার রিস্ক নেননি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ৯মিনিট মোমবাতি জ্বালিয়ে সেই যে গর্তে ঢুকেছেন আর বেরিয়ে আসেননি। অর্থমন্ত্রী সেই যে হালুয়া পূজা করে ইতিহাসের দীর্ঘতম বাজেট ঘোষণা করে ঠাণ্ডা ঘরে বসেছেন আর উঠে দাঁড়াতে পারেননি। ঘটা করে PM Care হয়েছে। ১৯৪৮ থেকে PMNRF থাকা সত্ত্বেও PM Care কেন? উত্তর নেই সরকারের কাছে। PM Care-র পরিচালক মণ্ডলী তে অন্য কোন রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিত্ব নেই কেন? উত্তর নেই সরকারের কাছে। PM Care–এ CAG-র অডিটে সরকারের আপত্তি কেন? উত্তর নেই সরকারের কাছে। PM Care থেকে পরিযায়ী শ্রমিকদের ট্রেনের টিকিটের ভাড়া, তাঁদের শিবিরের, রেশনের, universal income support-র ব্যবস্থা করা যাচ্ছে না কেন? উত্তর নেই সরকারের কাছে। 
এই প্যান্ডেমিকের অভিজ্ঞতা দিয়ে কর্পোরেটদের দালাল এই সরকারটাকে চিনুন। আদ্যোপান্ত দুর্নীতি তে ডুবে থাকা এই রাষ্ট্রযন্ত্রটাকে চিনুন। আর চিনুন, আপনার আশে পাশের ঐ মানুষ গুলো কে। যারা কদিন আগে পালাগড়ে দুজন 'হিন্দু' সন্ন্যাসীর গণ পিটুনি তে মৃত্যুর পর, 'হিন্দু খতরে মে হ্যা' বলে পাড়া মাথায় তুলেছিল; আর আজ ১৬জন 'হিন্দু' পরিযায়ী শ্রমিকদের মৃত্যুর পর 'রেল লাইন কি ঘুমনোর জায়গা?' বলে দায় সারছে, তাঁদের চিনুন। যারা 'শ্রমিক স্পেশাল' ট্রেনে সরকার পরিযায়ী শ্রমিকদের কাছে নির্লজ্জের মত ভাড়া চাইলে মুখে কুলুপ এঁটে বসেছিল, আর আজ 'হেঁটে ঘরে ফিরতে গিয়েছিলো কেন?' বলে ফেসবুক কাঁপাচ্ছে, তাঁদের চিনুন। যারা পাড়ার মস্তান তৃণমূল নেতা ক্যালাবে বলে রাজ্যে সীমাহীন রেশন দুর্নীতি দেখেও চোখ বুজে বসে আছে, তাঁদের চিনুন। চিনুন এই কারণেই যে বিজ্ঞান কে ভিত্তি করে প্যান্ডেমিকের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ মানুষ আজ না হয় কাল জিতবেই। পৃথিবীর রোগ ঠিক সেরে যাবে। তখন অবিকল মানুষের মত দেখতে এই জন্তুদের সোশ্যাল ডিসটেন্সিং লাগবে। কোয়রেন্টাইন লাগবে। দীর্ঘ মেয়াদি চিকিৎসা লাগবে।

সোমবার, ৪ মে, ২০২০

কোরেন্ট আইন ~ প্রকল্প ভট্টাচার্য

লকডাউনের আপন দেশে
আইন কানুন সর্বনেশে।
কেউ যদি যায় রোজ বাজারে, 
প্যায়দা এসে পাকড়ে ধরে। 
অনলাইনে হয় বিচার, 
কোরেন্টাইন দণ্ড তার! 
সেথায় সন্ধ্যে ছ'টার আগে
হাঁচতে সার্টিফিকিট লাগে। 
হাঁচলে পরে বিন কাগজে, 
'কোভিড পেশেন্ট' লোকে বোঝে। 
কোটাল তোলে পাকড়ে ভ্যানে, 
দেয় পাঠিয়ে কোরেন্ট্যানে! 
কারুর যদি দাঁতটি নড়ে, 
'মুখোশ পরো!' আদেশ করে। 
কারুর যদি গোঁফ গজায়,
সাবান দিয়ে হাত ধোয়ায়। 
খুঁচিয়ে পিঠে গুঁজিয়ে ঘাড়, 
কোরেন্টাইন যায় আবার!! 
চলতে গিয়ে কেউ যদি চায়
এদিক ওদিক ডাইনে বাঁয়, 
রাজার কাছে খবর ছোটে, 
পল্টনেরা লাফিয়ে ওঠে।
দুপুর রোদে ঘামিয়ে তায় 
কোরেন্টিনে ফের পাঠায়। 
যে সব লোকে খবর লেখে 
তাদের ধরে খাঁচায় রেখে 
কানের কাছে নানান সুরে 
শেখায়, "বালির স্তুপ সে গুড়ে!" 
সামনে রেখে মুদীর রেশন, 
বানান শেখায় "আইসোলেসন"!
হঠাৎ সেথায় রাত দুপুরে 
নাক ডাকালে ঘুমের ঘোরে 
অমনি তেড়ে মাথায় ঘষে 
রসুন গুলে লেবুর রসে।
পিপিই নেই, রাত পোশাকে 
 কোরেন্টিনে ভর্তি রাখে।।

ইমিউনিটি ~ ডাঃ সমুদ্র সেনগুপ্ত

করোনা রোগের মোকাবিলায় ভ্যাকসিন নিয়ে আলোচনা বহু চর্চিত। ওটা বেসিক্যালি ইমিউনিটির দু নম্বর ধারা, এডপটিভ ইমিউনিটি। আমি আপনি করোনায় একবার আক্রান্ত হলে আমাদের T সেল, B সেল একই ভাবে তৈরি হয়ে যাবে রোগটার মোকাবিলায়। এই সূত্র কাজে লাগিয়েই ওই কোনভালেসেন্ট সেরা থেরাপি অর্থাৎ সেই এন্টিজেন আর এন্টিবডি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে। ভ্যাকসিন কবে পাওয়া যাবে চিত্রটা আশাপ্রদ নয়।

কোনো কোনো জনস্বাস্থ্যবিদ আবার হার্ড ইমিউনিটির কথা বলছেন। R নট ১.৫ ধরলে মোটামুটি ভাবে জনসংখ্যার ৬০% সংক্রমিত হয়ে পড়লে বাকি ৪০% ওই হার্ড বা পাল এর ইমিউনিটির দৌলতে বেঁচে যেতে পারে। মুস্কিল একটাই। সবাই চাইবে সে যেন ওই ৪০% এর দলে থাকে। না থাকলে তার দশা ওই বরিস জনসনের মতো হতে পারে।

আমাদের সবাই কেমন অদ্ভুত ভাবে ইমিউনিটির প্রথম ধারা টা ভুলে যেতে বসেছি। ইনেট বা সহজাত ইমিউনিটি। সেই মনোসাইট ম্যাক্রফ্যাজ, সেই ডেন্দ্রাইটিক সেল, সেই এলভিওলার এপিথেলিয়াম। যারা যে কোনো ব্যাকটেরিয়া ভাইরাস এর বিরুদ্ধে আমাদের শরীরে প্রথম লড়াইটা দেয়। সেই বিশ্বস্ত, পুরোনো, প্রাচীন পাহারাদারদের কথা আমরা বেমালুম ভুলে গেছি। 

ওদের কথা একটু বোধ হয় ভাবা দরকার। ওদের একটু যত্নআত্মি প্রয়োজন। অতি সম্প্রতি একটি প্রবন্ধে বেশ কিছু মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট বা অনুপুষ্টি খাদ্য কে চিহ্নিত করা হয়েছে যারা সাইনারজিস্টিক উপায়ে বা একযোগে দেহের ইমিউন সিস্টেম বা প্রতিরোধ ক্ষমতা কে শক্তিশালী করে। তার মধ্যে রয়েছে ভিটামিন A, D, C, E, B6, B12, ফলেট, কপার, আয়রন, জিঙ্ক এবং সেলেনিয়াম [সূত্রঃ Gombart AF, Pierre A, Baghini S.A.; Nutrients 2020; 12: 236]।  এদের মধ্যে আবার ভিটামিন C, D এবং জিঙ্ক নিয়ে সবচেয়ে বেশি পরিমাণ এভিডেন্স বা তথ্য-প্রমাণ জোগাড় হয়েছে। খুব সংক্ষেপে রেসপিরেটরি হেলথ বা শ্বাসযন্ত্র এর সুস্বাস্থ্য বজায় রাখতে এদের ভূমিকা উল্লেখ করা হল কারণ আমরা জানি যে কোভিভ-১৯ মূলতঃ শ্বাসযন্ত্রের অসুখ।

ভিটামিন সি এর ভূমিকা সেই ১৯৩০ এর দশক থেকে আলোচিত হয়ে আসছে। ২০১৭ সালের একটি গবেষনায় তিনখানি কন্ট্রোলড ট্রায়ালে দেখা গেছে যে ভিটামিন সি নিউমোনিয়া প্রতিরোধে সাহায্য করে [সূত্রঃ Hemlia H, Nutrient 2017; 9:339]

শক্তিশালী ইমিউনো রেগুলেটর হিসেবে কমিউনিটি একোয়ার্ড নিউমোনিয়া তে ভিটামিন ডি এর ভূমিকাও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বিভিন্ন গবেষণায় [ সূত্রঃ Zdrenghea MT, Markrinioti H, Bayaran C, Rev Med Virol 2017, 27:e 1909]

জিঙ্ক কে বিবেচনা করা হয় ইমিউন ফাংশন এর "গেট কিপার হিসেবে [ সূত্রঃ Weasels I, Maywald M, Rink L, et al. Nutrients, 2017, 9:1286]। জিঙ্ক এর অভাবে বয়স্ক মানুষদের মধ্যে নিউমোনিয়া এর প্রকোপ ও তীব্রতা, দুটোই বেড়ে যায় [ সূত্রঃ Barnett JB, Hamer DH, Meydani SN; Nutr Rev 2010; 68:30-7]

এই ভিটামিন সি, ডি আর জিঙ্ক এমনি এমনি শরীরে পাওয়া যাবে না। খাবারের মধ্যে দিয়ে ওদের শরীরে ঢোকাতে হবে। একটু সুষম খাবার। এই লক ডাউন এর বাজারে অনেকের কাছেই এই শব্দটা উপহাস মনে হতে পারে। তাই পাল্টে বলা যায়, একটু পেট ভরে খাবার। বেশি কিছু নয়। একটু ডাল ভাত সবজি, আর পাতের কোনে এক টুকরো পাতি লেবু। সঙ্গে যদি একটা ডিম জুটে যায়। আহা।

বিশ্বাস করুন, গুরুর দিব্যি। এটুকু পেলেই আমার শরীরের এলভিওলার এপিথেলিয়াম চাঙ্গা হয়ে উঠবে। আমি জানতেও পারবো না যে সে কিভাবে ও সার্স কোভ ২ সেই নোভেল করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়ে যাবে।

আমি আমার ক্ষুদ্র সামর্থ্য দিয়ে ভাইরাসের বিরূদ্ধে লড়তে চাই। আমি চাই ভারতের সব অপুষ্ট শিশু আর বৃদ্ধ লড়ে যাক তাদের মতো করে। আপনার কাজ কেবল নজর রাখা যে তাদের পাতে যেন ভাত পরে দুবেলা। তাদের মুখের গ্রাস কেউ যেন কেড়ে না নেয়। করোনা আটকাতে গেলে চালচোরদের, রোজগার চোরদের আটকাতে হবে। নইলে বৃথা এ লড়াই। আপনার ইনেট ইমিউনিটির দোহাই।

শনিবার, ২ মে, ২০২০

মমতার রাজ্যে করোনা ~ পুরন্দর ভাট

"ওরে আয়রে ছুটে আয়রে ত্বরা, হেথা নাইকো মৃত্যু নাইকো জ্বরা"

পশ্চিমবঙ্গ সরকারের করোনা মোকাবিলায় ব্যর্থতা ক্রমশ নতুন নতুন শিখর স্পর্শ করে চলেছে। সাধারণ মানুষের কাছে নিত্য তথ্য লুকোনোর, তথ্য পরিবর্তন করার এমন এক ইতিবৃত্ত রচনা করেছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে রীতিমত এক রোমহর্ষক গোয়েন্দা গল্প হয়ে যায়। 

 শুরুতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আত্মবিশ্বাস এবং করোনা মোকাবিলায় স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে তৈরি রাখার তোড়জোড় দেখে মানুষ আশ্বস্তই হয়েছিল। অনেকে তো বলা শুরু করেছিলেন যে ভারতের সব রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে একমাত্র মমতাই গুরুত্বটা বুঝছে। করোনা আর নিশ্চিন্তে নিদ্রিত বাংলার মানুষের মাঝে তিনি প্রাচীরের মত দাঁড়িয়ে, অথবা বাংলার চারপাশে লক্ষণরেখা আঁকছেন - এমন সব কল্পচিত্রতে ফেসবুক ভরে গেছিল, রাজনৈতিক সত্তা নির্বিশেষে সকলে মমতার ওপর ভরসা করেছিলেন, এমন কি আমার  পরিবারের লোকেরাও। আমি পারিনি করতে, কিন্তু সে কথা থাক। প্রথম কনফার্মড কেস সেই লন্ডন ফেরত আমলাপুত্র। সেই ঘটনাতেই সন্দেহ হয়েছিল আদৌ কতটা তৈরি প্রশাসন। একজন উচ্চপদস্থ আমলার যদি এইটুকু সেন্স না থাকে যে ছেলেকে আইডিতে কোয়ারানটাইন করার পরামর্শ দেওয়ার পরও তাকে বাড়িতে নিয়ে আসবে, সেখানে তার সাথে স্বাভাবিক মেলামেশা করবে, এবং এত কিছুর পর নবান্নে গিয়ে মিটিংও করবে, তাহলে বোঝাই যায় যে প্রশাসনের উপরমহলেই কোনো সচেতনতা নেই। রাজ্যের প্রথম দিকের করোনা আক্রান্তের মৃত্যু নিয়েও ধোঁয়াশা তৈরি হয়। প্রথমে প্রশাসন বলে যে তিনি বিদেশ ভ্রমণে গিয়ে রোগ এনেছেন কিন্তু পরিবার থেকে সম্পূর্ণভাবে তা নাকচ করা হয়।  এর পর সেই নিয়ে কী তদন্ত হলো আর তার কী ফল হলো কেউ জানতে পারে না। ফেসবুকে তার ইতালীয় পুত্রবধূর ছবি ছড়িয়ে যায় যে ছেলে আর বউকে বাড়িতে লুকিয়ে রেখেছিল তাই করোনা হয়েছে। কিন্তু সেই সবই গুজব। একই ভাবে বেলঘড়িয়ায় করোনা আক্রান্ত রোলের দোকানের মালিকের মৃত্যু নিয়েও রহস্য তৈরি হয়। আজও জানা যায়নি কী ভাবে তাঁর করোনা হয়েছিল। সরকার শুরুর দিকে করোনা আক্রান্তদের নিয়ে বিস্তারিত রিপোর্ট দিচ্ছিল, কী ভাবে তারা আক্রান্ত হলো, কত জন কনট্যাক্টকে ট্রেস করা হয়েছে, ইত্যাদি। কিন্তু ক্রমশ একের পর এক কেসে বিদেশযোগ খুঁজে না পেয়ে সরকার সেই বিস্তারিত রিপোর্ট করাই বন্ধ করে দিলো। যদি কারুর ক্ষেত্রে বোঝা না যায় যে সে কী ভাবে আক্রান্ত হয়েছে তাহলে সে ক্ষেত্রে ওই এলাকায় কমিউনিটি স্প্রেড হচ্ছে সেটা স্বীকার করা প্রয়োজন এবং সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। সরকার সে সবের ধার ধারেনি, উল্টে তথ্যই চেপে দেওয়ার রাস্তা নেয়। বোধয় এই সময় তাবলীগি জামাত সূত্রে হওয়া সংক্রমণগুলো সামনে আসতে থাকে, সরকার সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষার্থে হয়ত সেগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত বলতে চায়নি। এই সময় অপর একটি বিষয়ও সামনে আসে। তা হলো পশ্চিমবঙ্গ বাকি রাজ্যের তুলনায় অনেক কম পরীক্ষা করছে, এমন কি বিহার বা ঝাড়খণ্ডের মত রাজ্য যেগুলোয় করোনা আক্রান্তের সংখ্যা অনেক কম - তাদের চেয়েও। এবং এই অভিযোগ ওঠা শুরু হতেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তথ্য লুকোনোর আর মিথ্যা বলার এমন এক কানাগলির মধ্যে প্রবেশ করে যে তার থেকে বেরোনোর পথ সে এক মাস পরেও খুঁজে পাচ্ছে না।

অথচ এই রেগুলার হেলথ বুলেটিন, অথবা সাংবাদিক সম্মেলনে করোনা পরিস্থতি মানুষকে জানানোর  প্রথা শুরু করায় পশ্চিমবঙ্গ কিন্তু প্রথম সারিতে থাকবে। ফেব্রুয়ারি থেকে পশ্চিমবঙ্গ স্বাস্থ্য দফতর দু তিন দিনে একবার করে রাজ্যের করোনা পরিস্থিতি নিয়ে বুলেটিন প্রকাশ করা শুরু করে। মার্চের শুরু থেকে এটা প্রায় প্রতি দিন নিয়মিত হয়ে যায়। সেই সময় খুব কম রাজ্যই এতটা স্বচ্ছভাবে তথ্য দিচ্ছিল মানুষকে, বহু রাজ্যের তো কোনো নিয়মিত বুলেটিনই ছিল না। কিন্তু টেস্ট নিয়ে প্রশ্ন শুরু হতে পশ্চিমবঙ্গ পথ বদলায় এবং বাকি দেশের সব রাজ্য যে পথে চলছে তার উল্টোদিকে হাঁটা শুরু করে। কী রকম? এপ্রিলের শুরু থেকে সমস্ত রাজ্যগুলো প্রতিদিন নিয়মিত বুলেটিনে কত জন নতুন আক্রান্ত হলো, শুরু থেকে সেই দিন অবধি কত জন মোট আক্রান্ত, কত জন মারা গেছেন, কত জনের পরীক্ষা হয়েছে এসমস্ত কিছুর জেলাওয়ারী হিসেব দেওয়া শুরু করে। তখন পশ্চিমবঙ্গ জেলাওয়ারী হিসেব  বা  পরীক্ষার হিসেব দেওয়া তো ছেড়েই দিন, এমন কি কত জন মোট করোনা আক্রান্ত এবং কতজন মোট মৃত সেটা নিয়েও পরিষ্কার ভাবে জানানো বন্ধ করে দেয় বুলেটিনে। মার্চ অবধি পশ্চিমবঙ্গও বাকিদের মত মোট আক্রান্তের হিসেব দিত তাদের বুলেটিনে কিন্তু এপ্রিলের ১ থেকে ৫ হঠাৎ বুলেটিন প্রকাশ স্থগিত হয়ে যায়। ফের তা চালু হলে দেখা যায় দুটি বিষয় - এক, বুলেটিনের ফরম্যাট বদলে গেছে, মোট আক্রান্তের সংখ্যা দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে আর তার বদলে সেই দিন কতগুলো একটিভ কেস,  কতজনের মৃত্যু হয়েছে, এবং সেই দিন কত জন রুগী সুস্থ্য হয়েছে - এই তথ্য দেওয়া শুরু করে। এই তথ্য থেকে মোট আক্রান্তের সংখ্যা বের করা সম্ভব নয় যতক্ষন না শুরু থেকে কত জনের মৃত্যু হয়েছে এবং শুরুর থেকে কতজন সুস্থ হয়েছে তা জানা যাচ্ছে। এবং দুই,  এই সময়তেই এক্সপার্ট কমিটি গঠন হয় যারা করোনা আক্রান্ত কারুর মৃত্যুকে করোনায় মৃত্যু নাকি অন্য কারণে - তা ঠিক করে দিতে থাকে। দেখা যায় যে মৃতের সংখ্যা হঠাৎ করে কমে যায়। যে সব করোনা আক্রান্তের মৃত্যুকে করোনা মৃত্যু বলে স্বীকৃতি দেওয়া হয় না তাদের সরকারের তালিকাতেও জায়গা হয় না। এই রিপোর্টিংয়ের বদল দেখেই বুঝে যাই যে সরকার তথ্য লুকোনো শুরু করেছে। বামপন্থীরা এই নিয়ে প্রতিবাদে সরব হন। গণশক্তি পত্রিকা এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহে ৩০ জন মৃতের তালিকা প্রকাশ করে যখন সরকারি হিসেবে মৃত ছিল বোধয় ১১ জন। গণশক্তির বিরুদ্ধে পুলিশে ডাইরি হয়। বামপন্থী নেতারা আটক হন। চারপাশে খবর রটতে থাকে যে পুলিশ রাতের অন্ধকারে দেহ দাহ করছে। সরকার গুজব বলে সেগুলোকে উড়িয়ে দেয়, যাঁরা ফেসবুকে পোস্ট করেছিলেন তাদের পোস্ট উড়ে যেতে থাকে, পুলিশ ধমকি দিতে থাকে। অথচ ব্যক্তিগত আলাপে পুলিশকর্মীদের কাছেই জানতে পারি যে স্পেশ্যাল শ্মশানে দাহ করা মৃতের সংখ্যা সরকারিভাবে স্বীকৃত মৃতের অন্তত ১০ গুন। বেশিদিন লাশের গন্ধ চাপা থাকে না। শেষে ২৪  এপ্রিল সরকার স্বীকার করে যে করোনা আক্রান্তে মৃতের সংখ্যা আসলে ৫৭ কিন্তু তার মধ্যে ৩৯ জন "অন্য কারণে" মারা গেছে। সরকারি ভাবে স্বীকৃত মৃতের সংখ্যা সেদিন অবধি ১৮। অর্থাৎ গণশক্তির দেওয়া হিসেবই মেনে নেয় সরকার। চারপাশে সরকারি তথ্য চাপবার প্রয়াসকে নিয়ে হই চই পড়ে যায়, সবাই নিন্দে করতে থাকে, সরকারের দেওয়া সমস্ত তথ্যই সন্দেহ করতে থাকে মানুষ। এর মধ্যে কিছু তৃণমূলী সাফাই গাইতে থাকে যে অন্য অসুস্থতার কারণে মৃত্যু হলে তার শরীরে করোনা পাওয়া গেলেও তাকে করোনায় মৃত বলা উচিত না, অন্য কেউই তাদেরকে কাউন্ট করছে না, ইত্যাদি। একদম সর্বৈব মিথ্যে কথা। সব রাজ্যই করোনা পজিটিভ কারুর মৃত্যুকে করোনা মৃত্যু বলেই ধরছে। মহারাষ্ট্রে মৃতর তালিকায় ৭০%-এরই শরীরে অন্য রোগও ছিল, তাদের রাজ্যের রোজের হেলথ রিপোর্টেই সেটা থাকছে।  উন্নত দেশগুলোতে তো করোনা পরীক্ষা না হলেও যদি কারুর মধ্যে কিছু সিম্পটম দেখা যায় আর সে মারা যায় তাহলে তাকেও করোনায় মৃত বলে ধরে নিচ্ছে। হু-এর গাইডলাইন রয়েছে এক্সপার্ট কমিটি গঠন করার বিষয়ে কিন্তু সেটা করোনায় মৃতের সংখ্যা কমানোর জন্য নয়, উল্টে টেস্ট করা সম্ভব না হলে সিম্পটম দেখে করোনায় মৃত কি না তা যাচাই করার জন্যে অর্থাৎ মৃতের সংখ্যা বাড়ানোর জন্যে সেই কমিটি করার কথা বলেছে। মৃতের সংখ্যা আন্ডারএস্টিমেট করাটা সমস্যার, ওভারএস্টিমেটটা সমস্যার নয় কারণ মৃতের সংখ্যা বেশি হলে বেশি টেস্ট করার তাগিদ হবে, উল্টে সংখ্যা কম দেখালে মানুষও সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা বা মুখ ঢাকার গা করবে না। এই ৫৭ সংখ্যাটিকেও লোকে অবিশ্বাস করতে থাকে। সেটাই স্বাভাবিক, একবার মিথ্যে বলতে ধরা পড়ে গেলে বিশ্বাসযোগ্যতা থাকে না। আরো বাড়তে থাকে জল্পনা, আরো লুকিয়ে দাহ করার ঘটনা সামনে আসতে থাকে। এর পর বিভিন্ন জায়গায় লুকিয়ে দাহ করা নিয়ে প্রতিরোধ শুরু হয়। করোনা আক্রান্তকে রাতের অন্ধকারে, ফাঁকা শ্মশানে দাহ করাটা খুবই যুক্তিযুক্ত কিন্তু আক্রান্তের বাড়ির লোককে কেন অন্তত শ্মশান অবধি আসতে দেওয়া হবে না? তারা লাশের সংস্পর্শে না এলেই তো কোনো অসুবিধে নেই। বাড়ির লোকেরা যদি দেহর সাথে আসে তাহলে পাড়ার লোকও ঝামেলা করবে না। নাকি বাড়ির লোকজনকে না জানিয়েই দাহ করা হচ্ছে যাতে লুকিয়ে ফেলা যায়? ডেথ সার্টিফিকেটে করোনা পজিটিভ লিখতেও যেখানে কমিটির পারমিশন চাই সেখানে করোনা লুকোনোটাই উদ্দেশ্য মনে হচ্ছে। এত হই চইয়ের পরেও কিন্তু কমিটি বাতিল হয়নি। এরপরও তারা করোনা আক্রান্তের মৃত্যুকে করোনা মৃত্যুর তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার কাজ চালিয়ে যেতে থাকে। এই করতে করতে এপ্রিলের ২৯ তারিখ মোট করোনা আক্রান্ত মৃতের সংখ্যা দাঁড়ায় ১০৫-এ যেখানে সরকারি তালিকায় করোনায় মৃত বলে স্বীকার করা হয়েছে মাত্র ৩৩ জন। 

এই মৃত্যু লুকোনোর কারণ কী? কেন মৃতের সংখ্যা কমানোর চেষ্টা? কারণ হলো যে মৃতের প্রকৃত সংখ্যা স্বীকার করে নিলে পশ্চিমবঙ্গে করোনায় মৃতের হার সারা ভারতে সর্বোচ্চ হয়ে যাবে। সারা দেশে যেখানে মৃতের হার মাত্র ৩-৪% সেখানে এই রাজ্যে তা দাঁড়াবে ১২%। কেন বেশি মৃত্যু? কারণ যথেষ্ট সংখ্যক করোনা রুগী ধরা পড়েনি। মৃত্যুর হার  গণিত হয় মোট আক্রান্তের সংখ্যার ওপর, আর মোট আক্রান্তের সংখ্যা নির্ধারিত হয় মোট পরীক্ষার ওপর। এবার যদি মোট পরীক্ষাই কম হয় তাহলে মোট আক্রান্তও কম হবে এবং মৃতের হার বেশি মনে হবে। টেস্টিংয়ের ব্যর্থতা ঢাকতে গিয়ে তাই মৃতের সংখ্যায় জল মেশানোর রাস্তা নেয় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু ছোটর থেকে আমরা জানি যে একবার মিথ্যে বললে ক্রমশ সেই মিথ্যেকে ঢাকতে আরো মিথ্যের আশ্রয় নিতে হয়। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রশাসন ঠিক সেই ফাঁদেই ক্রমশ জড়িয়ে পড়েছে। এই যে অতিরিক্ত ৭২ জন মৃত এরা কিন্তু সরকার প্রকাশিত করোনা তালিকায় কোথাও কাউন্টেড নন। কারণ আগেই বলেছি যে সরকার মোট আক্রান্তের সংখ্যা দিচ্ছে না, তার বদলে গত দু সপ্তাহ ধরে তারা জানাচ্ছে শুধু মোট বর্তমানে আক্রান্ত, কত জন সুস্থ হয়েছে, এবং কত জন মৃত। মৃতের মধ্যে এদের নাম নেই, এরা বর্তমানে আক্রান্ত, অথবা সুস্থও হয়ে ওঠেননি। তাই মোট করোনা আক্রান্তের মধ্যে এরা নেই। রাজ্যে মোট করোনা আক্রান্ত কত জন? এই সংখ্যাটাই আর পরিষ্কার নয়। রাজ্য ৩০-এ এপ্রিল সকালের পর আর বুলেটিন বের করেনি। শেষ বুলেটিনের হিসেবে ধরলে মোট আক্রান্ত ৭৫০ জন। অথচ কালকে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রককে দেওয়া চিঠিতে রাজ্য সরকার জানিয়েছে যে মোট আক্রান্তের সংখ্যা ৯৩১ জন। এই ১৮০ জন কি এক দিনে আক্রান্ত হলো নাকি আগের হিসেবে গরমিল ছিল?  কেউ জানে না। সেই চিঠিতে জেলাওয়ারী হিসেবও দিয়েছে রাজ্য অথচ বুলেটিনে জেলা বাবদ আক্রান্তের সংখ্যা জানানো হচ্ছে না।

 যদি বুঝতাম যে মানুষকে তথ্য না দিলেও সরকার যা ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন তা নিচ্ছে তাহলেও হতো। কিন্তু সেটাও নেয়নি। আসলে আমাদের দেশ তো আর চীন নয়, এখানে কোনো পদক্ষেপ নিতে গেলে আগে মানুষকে বলতে হয় কেন সেই পদক্ষেপ প্রয়োজন। তাই তথ্য লুকিয়ে মানুষের ওপর নিষেধাজ্ঞা চাপিয়ে দিলে মানুষ মানে না। মানুষ বাজার হাট, দোকান পাটে ভিড় করছে গুরুত্ব না বুঝে, এতে বিপদ বাড়ছে। আমি অনন্তকাল লকডাউন রাখার পক্ষে নই, কিন্তু লকডাউন তুলে নিতে গেলে একটা নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া মেনে তা করতে হবে যাতে টেস্টিংয়ের এবং সংক্রমণকে চিহ্নিত করে রুগীদের তাড়াতাড়ি আলাদা করার ভূমিকা খুব গুরুত্বপূর্ণ। সেটাই যদি না হয় তাহলে লকডাউন তুললে দুদিন পর পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যাবে।

করোনা মোকাবিলায় বিশ্বের সব উন্নত দেশও পর্যদুস্ত। পশ্চিমবঙ্গে করোনা আক্রান্ত এবং মৃতের প্রকৃত সংখ্যা মানুষকে জানালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে কেউ খারাপ প্রশাসক বলতো না, আমেরিকাই পারছে না তো মমতা পারবেন এই আশা কেউ করে না। কেরালার প্রসঙ্গ আলাদা। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেকে দক্ষ প্রশাসক প্রমাণ করতে সংখ্যা নিয়ে এই লুকোচুরি করলো। এতে উল্টে রাজ্যের মানুষের বিশ্বাস খোয়ালো সরকার। এখন গোটাটার দায়ে মমতা চাপিয়ে দিয়েছে চিফ সেক্রেটারি আর হেলথ সেক্রেটারির ওপর এবং ওই মৃত্যু বিচারের এক্সপার্ট কমিটিকে প্রায় বিদায় দিয়েছে। তবুও এর দায় নিজে নেয়নি। নিজের ইমেজের কথা না ভেবে যদি একটু রাজ্যের মানুষের কথা ভাবতেন মমতা তাহলে আজকে রাজ্য এই বিপদের সামনে পড়ত না। এখন পরিস্থিতি এমনই যে রাজ্যে কেন্দ্রীয় শাসন জারি করলেও অধিকাংশ মানুষ সেটাকেও মেনে নেবে। যদি শেষ অবধি সেটাই হয় তাহলে তার জন্য দায়ী হবেন একা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

(নিচে সমস্ত তথ্যর লিংক দেওয়া রইলো)

শুক্রবার, ১ মে, ২০২০

"ভুল করে তুই চিনলি না রে..." ~ ডঃ সমুদ্র সেনগুপ্ত

এর আগে রাষ্ট্র ও সরকারের নানান নীতির সমালোচনা করে অনেক কিছু লিখেছি। জ্ঞানত কোনো মিথ্যে কথা লিখিনি, কোনো বিকৃত তথ্যও পরিবেশন করিনি। তাতে প্রচুর সাধুবাদও পেয়েছি। কিন্তু বারবার একটি কথাই মনে হয়েছে। সমস্ত সমালোচনা কি কেবল ওদেরই প্রাপ্য? আমাদের অর্থাৎ আম-আদমিদের নিয়ে গঠিত জনসমাজ এর কোনই দায়িত্ব নেই, বা ছিল না?

আজকে সারা পৃথিবী জুড়ে, দেশ জুড়ে, রাজ্য জুড়ে যখন জনস্বাস্থ্যের করুন চেহারাটা একটু একটু করে বে-আব্রু হচ্ছে, তখন আমরা ক্ষোভে ফেটে পড়ছি। কিন্তু একদিনে তো এটা হয় নি। বছরের পর বছর ধরে স্বাস্থ্যের জন্য ১% ২% বাজেট বরাদ্দ হয়েছে। আমরা চুপ করে ছিলাম। আমরা মেতে ছিলাম বিদেশে বেআইনি অভিবাসী নিয়ে অথবা দেশে মন্দির-মসজিদ, এনআরসি নিয়ে। 

আমাদের দেশে স্বাস্থ্যখাতে বাজেট কত বরাদ্দ হল, কোনো নির্বাচনে এটা ইস্যু হয়েছে কোনোদিন? স্বাস্থ্যের মধ্যে আবার চিকিৎসাখাতে আর জনস্বাস্থ্যের খাতে কত বরাদ্দ হল আমরা ভেবেছি কোনোদিন?

আজ স্টার আনন্দের সাংবাদিকের মা ভর্তি হতে হয়রানি হওয়ার পরে সংবাদের চর্চায় এসেছে কোন বেসরকারি হাসপাতালে কত আইসলেশন বেড। এর আগে তো আসেনি। ওই আনন্দতেই তো সার্জিক্যাল স্ক্রাব সুট পরা মুখপাত্ররা প্রচার করতে ব্যস্ত ছিলেন যে বাইপাসের ধারের পাঁচতারা হাসপাতালগুলি কোনো অংশে দক্ষিণ ভারতের চেয়ে কম নয়। আমরা দর্শক-শ্রোতারা তখন কেবল হাততালি দিতেই ব্যস্ত ছিলাম।

আজকে তৃণমূলস্তরের স্বাস্থ্যকর্মী এএনএম আর আশাকর্মীরা বাড়ি গিয়ে জ্বরের সার্ভেলেন্সে কি উজ্জ্বল ভূমিকা নিতে পারেন তার কথা বলা হচ্ছে। অথচ এরা যখন চাকরিগত কিছু সামান্য সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর জন্য আন্দোলন ধর্মঘট করেছিল তখন আমরা জনসাধারণ পাত্তাই দিই নি। আমাদের মনোভাব ছিল - এরা কারা, চিনিনা তো। এক পদ এক বেতনের দাবিতে সেকেন্ড এএনএমরা জমায়েত করলে পুলিশ দিয়ে গলা ধাক্কা দিয়ে বিগ বসরা নিজের নীল বাতি জ্বালানো গাড়ি নিয়ে হুশ করে বেরিয়ে গেছেন। এবিপি আনন্দ কভার করেনি কিন্তু সেই ফুটেজ। আজ সুমন কাঁপা কাঁপা গলায় কাঁদুনি গাইছে।

আজকে টেস্ট বাড়াও, টেস্ট বাড়াও বলে আমরা যারা চিল্লিয়ে বাজার মাত করে দিলাম তারা ক'জন খোঁজ নিয়েছিলাম যে নবগঠিত মেডিক্যাল কলেজগুলোর মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের কটাতে বায়ো-সেফটি ক্যাবিনেট আছে। ক'জন আমরা মাথা ঘামিয়েছি যখন একের পর এক ল্যাব টেকনোলজিস্ট, বা অক্সিলিয়ারী নার্স কাম মিডওয়াইফ N95 এর অভাবে এমডিআর যক্ষায় আক্রান্ত হয়েছেন। আজ টোটেম পোলের সর্বোচ্চ কোনো ডাক্তার পিপিই পাচ্ছেন না বলে আমরা আহা-উহু করছি। কেন, ওই ল্যাব টেক, ওই এএনএম কি মানুষ ছিল না? ডাক্তার সংগঠন থেকে দাবি জানানো হচ্ছে, মৃত ডাক্তার কে শহীদের মর্যাদা দিতে হবে। একশো বার দিতে হবে। কেবল তুচ্ছ প্রশ্ন, যে এএনএম টিবিতে মারা গেল তার শহীদের মর্যাদার জন্য কোন ডাক্তার সংগঠন কবে মুখর হল কেউ জানাবেন? পাবলিক হেলথের অন্যতম স্তম্ভ হেলথ এসিস্টেন্ট মেল নামে একটা গোটা ক্যাডার অবলুপ্ত করে দেওয়া হল, ডান-বাম কারুর কোনো হেলদোল দেখিনি। গ্রামের ছোট্ট পিএইচসির ডাক্তারকে "অর্ডিনারী এমবিবিএস" বলে উপহাস করেছি পাবলিক হেলথে তার লিডারশিপের ভূমিকা অক্লেশে ভুলে।

আমরা প্রাণভরে মন্দির-মসজিদ, ইউনিফর্ম সিভিল কোড ৩৭০ এসব বড় বড় বিষয় নিয়েই মেতে ছিলাম। আজ করোনা আসাতে স্বাস্থ্য নিয়ে একটু আধটু মাথা ঘামাচ্ছি। লিখে রাখুন, আগামী নির্বাচনে স্বাস্থ্য কোনো এজেন্ডাই হবে না। আমরা আলোকিত ফ্লাইওভার, বিশাল প্যাটেল মূর্তি, নেতা নেত্রীর ছবি ঝোলানো ফিল্ম উৎসব, আম/ইলিশ উৎসব এসব নিয়েই আবার মেতে উঠবো।

কেবল, কেবল আমরা গুটিকয় মানুষ সীমিত সাধ্য নিয়ে, মানুষের হাজার সমালোচনা মেনে নিয়ে তখনও লড়ে যাবো। আমাদের গ্ল্যামারহীন জগতে কোনো তারকা খচিত লিভার বিশেষজ্ঞ নেই। আমরা মাঠে ঘাটে কাজ করা মানুষ, প্রতিদিন মানুষের প্রত্যাশার চাপ নেওয়া মানুষ, যাদের পয়সা দিয়ে স্বাস্থ্য কেনার ক্ষমতা নেই তাদের সেবা করা মানুষ, যাদের কেউ টিভি টক শোতে ডাকে না, তেমন গ্ল্যামারহীন মানুষ। 

আমরা সীমিত সাধ্য নিয়ে ময়দানে আছি। এই কারণেই আছি যে নিউইয়র্ক এর কুইন্স বোরোর ছোট্ট রাব্বি পরিবারে জন্মানো আমার, আমাদের না দেখা শিক্ষক, জন হপকিন্সের প্রবাদপ্রতিম শিক্ষক লিওন গর্ডইস শিখিয়ে ছিলেন যে এপিডেমিওলজিটা কেবল ক্লাস রুমে শেখা যায় না, মানুষের মাঝে গিয়ে শিখতে হয়।

কেবল একটাই অনুরোধ, পরের বার কেউ ভোট চাইতে এলে একটি বার জিজ্ঞেস করবেন, স্বাস্থ্য বাজেট এ ক'পয়সা খরচ করবে বাবারা? সিয়াচেনে সৈনিকদের আত্মত্যাগের পাশাপাশি নিজের পাড়ায় কাজ করা আশা কর্মী, HHW, এএনএমদের কথাও বোধহয় একটু ভাবা দরকার। সৈনিক কি কেবল জলপাই বা খাকি রঙের ইউনিফর্মই পরে?

"রাধে, ভুল করে তুই চিনলি না তোর প্রেমের শ্যাম রাই;
ঝাঁপ দিলি তুই মরণ যমুনায়..."

শনিবার, ১৮ এপ্রিল, ২০২০

করোনা হবি ~ ডাঃ তপোব্রত বসু

কত রকমের যে হবি রয়েছে জগতে !

ক্লাস সিক্স থেকে মেয়েদের প্রেমপত্র পাঠানো মনোজিৎ এখন মাস্টার হয়েছে। সে  ছোট থেকেই প্রেমপত্র থেকে খুলে খুলে ডাক টিকিট জমায়।

বুড়ো আমাদের বন্ধুদের সবাইকেই ক্লাস ফাইভে বিড়ি খেতে শিখিয়েছিল,  সে সেই স্কুল জীবন থেকেই দেশলাই বাক্স জমায়।

আমার ছোটকাকা, এখন মারা গ্যাছেন, তিনি পুরনো গানের রেকর্ড জমাতেন। 

আমার এক বন্ধু আছে বুবাই। আই টি  সেক্টরে। কথায় কথায় চাকরি ছাড়ে। সন্ধেবেলার আড্ডায় প্রায়ই বলে, আজ ম্যানেজারের মুখের ওপর পাতা ফেলে দিলাম। পকেটে রেজিগনেশন লেটার নিয়েই অফিস আসে। এত চাকরি ব্যাটা পায় কিকরে সেটাই রহস্য। সে হারামজাদা আবার একটা ফাইল বানিয়ে তাতে এপয়েন্টমেন্ট লেটার জমায়।

মামাতো ভাই গাবুল, সে জমায় দেশি বিদেশি মুদ্রা। নতুন যখন দশ টাকার কয়েন বেরোল, ট্রেনে করে বাঁকুড়া থেকে ডালহৌসি এসে জিপিও র সামনে থেকে পনের টাকা দিয়ে দশ টাকার করেন কিনে নিয়ে গেছিল। আমি ওকে মুদ্রারাক্ষস বলে ডাকি।

আমার নিজের কাছেই নতুন পুরোনো মিলিয়ে চারটে বুলেট মোটরসাইকেল আছে। বলতে পারেন আমি বুলেট জমাই।

আমার বউ যেমন আমার করা ভুলগুলোকে যত্ন করে জমায়। আমি বিয়ের পর থেকে কবে কি ভুল বলেছি আর ভুল করেছি সেগুলো পোঁটলা বেঁধে জমিয়ে রাখে, এখনো প্রতিদিন জমাচ্ছে।

ছেলে পেন জমাচ্ছে। এটা বোধহয় আমরা সবাই ছোটবেলায় জমাই।

পাগলা চিরঞ্জীব ডজন খানেক হার্ড ডিস্ক কিনে তাতে যত রাজ্যের বইয়ের পিডিএফ জোগাড় করে জমাচ্ছে।

আপনারা জ্ঞানী গুণী মানুষ, হয়তো আরও অনেক হবির কথা জানেন। 

কিন্তু এই যে করোনার টেস্ট কিট জমিয়ে রাখা, এমন হবি দেখেছেন কখনো?


বুধবার, ১৫ এপ্রিল, ২০২০

করোনার প্রেতাত্মা ~ ইন্দ্রনীল মজুমদার

সহসা অস্থিসন্ধি ও পেশীতে প্রবল ব্যথা অনুভব করিলাম। সঙ্গে খকখক কাশি। শ্বাসরোধ হইবার উপক্রম হইলো। গৃহিনী এক প্রৌঢ় বিলাতফেরত বৈদ্যের শরনাপন্ন হইলেন। তিনি অবিলম্বে আমাকে এক বৃহৎ চিকিৎসালয়ে ভর্তি করিয়া লইলেন। কিছু পরেই মহাকাশচারীর বেশ ধরিয়া আবার বৈদ্যমহাশয় আবির্ভূত হইলেন।
 বলিলেন, হাঁ করুন। সিগারেট কলঙ্কিত দন্ত বিকশিত করিলাম। লালারস লইলেন। হাঁ করিয়াই রহিলাম। বৈদ্য গম্ভীরভাবে বলিলেন মুখ বন্ধ করুন। করিলাম। বৈকালে সংবাদ আসিলো। সম্প্রতি এক রোগ আসিয়াছে নাকরো-৯১। উহাই আমার ফুসফুসে চাপিয়াছে। নাসিকায় নল ঢুকাইয়া বিশুদ্ধ বায়ু প্রবেশ করানো হইলো। তথাপি খাবি খাইতেছি দেখিয়া বৈদ্যমহাশয় বিজাতীয় ভাষায় বলিলেন... ভেন্টিলেটর। কিছুতেই কিছু হইলো না। সহসা ফট করিয়া একটি আওয়াজ শুনিলাম। দেখিলাম আমি জানালার ওপর বসিয়া আছি। আবার শয্যাতেও শুইয়া আছি। বুঝিলাম আমি মরিয়া গিয়াছি। ওই আমার পার্থিব দেহ। এতোদিন বৃথাই বস্তুবাদের সাধনা করিয়াছি। আজ বুঝিলাম আত্মা আছে। ঈশ্বর, আল্লা, গড, ভূত, প্রেত, ঘোস্ট, জিন, স্বর্গ, দোজখ সঅঅঅব সত্য। যাহা হউক, জানালায় ঝুলন্ত অবস্থায় সব দেখিতেছিলাম। বিলাতফেরত বৈদ্য পরিস্কার লিখিয়া দিলেন যে আমি নাকরো-৯১ রোগে মরিয়াছি। চিকিৎসালয়ের প্রধান আসিয়া বলিলেন আপনি বলিলে তো আর হইবে না। নদীর তীরে জমিদারনীর 'দুর্ভিক্ষ' নামের প্রাসাদ হইতে যতোক্ষণ না বলা হইতেছে...। বিলাতফেরত বৈদ্য জ্বলিয়া উঠিলেন। বলিলেন, আমি চিকিৎসা করিলাম... আর কি রোগে মরিলো বলিবে পঞ্চা তেলী? প্রধান জানাইলেন তিনি নিরুপায়। আর জমিদারনীর নিজেরও বিদেশী ডিগ্রী আছে। তদুপরি তিনি ৯১ টি বই লিখিয়াছেন। তাই নাকরো-৯১ রোগ সম্পর্কে  বলিবার তিনি বিশেষ অধিকারিনী। বিলাতফেরত বিখ্যাত বৈদ্য অপমানিত বোধ করিয়া চিকিৎসালয় ত্যাগ করিলেন। ধাপার মাঠে দেহের সদ্গতি হইলো।
আমার লঘু আত্মা হাওয়ায় ভাসিয়া ' দুর্ভিক্ষ' প্রাসাদে উপনীত হইলো। খুব ইচ্ছা করিতেছিলো এই প্রবলপ্রতাপশালিনী জমিদারনীকে একটি প্রণাম ঠুকিবার। প্রাসাদের সর্বোচ্চ তলে তিনি অধিষ্ঠিতা। বামপার্শ্বে বসিয়া আছেন বৈদ্যকূলের পিতামহপ্রতিম অতিপ্রবীন 'সুমু'- বাবু। দক্ষিণে বসিয়াছেন তাঁহারই ছাত্রতুল্য 'অচ'- বাবু। অচ- বাবু যকৃত লইয়া কাজ করেন। ফুসফুসের রোগের সহিত তাঁহার ওঠাবসা নাই। তবে মাঝে মাঝে কবিতা বলেন বলিয়া কবিতাপ্রেমী জমিদারনী তাঁহাকে দলে টানিয়াছেন‌। সুমুবাবু এবং অচবাবু'র মধ্যে বয়সের প্রভূত ফারাক। জমিদারনী তথাপি দুজনকেই সুমুদা এবং অচদা বলিয়া ডাকিতেছিলেন। জমিদারনী বলিতেছিলেন একটা লোক মরিয়াছে আজ। অমুক বৈদ্য বলিতেছে নাকোরো- ৯১... কি করা যায়? সুমুদার বয়স হইয়াছে। বলিয়া ফেলিলেন, ও... অমুক বলিয়াছে? খুব ভালো শিষ্য ছিলো আমার। ও যখন বলিয়াছে তখন নাকরো -৯১ হইবেই। জমিদারনীর মুখ ভার হইলো। অচদা উঠিয়া গিয়া সুমুদার কানে কানে কি বলিলেন। বৈদ্যরাজ সুমুদা যেন সহসা ঘুম হইতে জাগিয়া উঠিলেন। বলিলেন... উহার কি পূর্বতন কোনো রোগ ছিলো? অচদা বলিলেন উনি লকডাউনে ঘরে বসিয়া কোষ্ঠকাঠিন্যে ভুগিতেছিলেন। ওনার স্ত্রী সিগারেট বন্ধ করিয়া দিয়াছিলেন। জমিদারনী বলিয়া উঠিলেন... ইউরেকা। তাহা হইলে লিখুন লোকটা অর্শে মরিয়াছে। দেখিলেন তো কেমন ফটাফট সমাধান দিলাম। তাহা হইলে মৃত্যুসংখ্যা আর বাড়াইয়া কাজ নাই। ওই সাতজনই রহিল। অচদা আপনি ফেরার সময় ভবানীপুরে আমার ওই তাজা ছেলেটাকে একটু দেখিয়া আসিবেন তো! পরপর দু'বার নির্বাচনে পরাজিত হইয়া কারনসেবা বাড়াইয়া দিয়াছে। উহার যকৃতটা একটু দেখিয়া আসিবেন। অচদা বলিলেন আমাদের দুজনকেও একটু দেখিবেন। জমিদারনী মুচকি হাসিলেন।
আমি ভারাক্রান্ত হৃদয়ে উড়িয়া চলিলাম। শেষ অবধি কোষ্ঠকাঠিন্যে মৃত্যু!! উড়িতে উড়িতে অনেক বন্ধু পাইলাম। সকলেই দুঃখিত। কেউ নতুন জীবাণুতে মৃত্যুর সম্মান পায় নাই। জমিদারনী প্রাসাদে বসিয়া সুমুদা, অচদার সাহায্যে  সবার ভাগ্য বদলাইয়া দিতেছেন। এমত ক্ষমতাশালী জমিদারনীর প্রজা ছিলাম বলিয়া গর্ব অনুভব করিলাম। দুঃখ ঘুচিয়া গেলো। মহানন্দে উড়িয়া বেড়াইতে লাগিলাম।

মঙ্গলবার, ১৪ এপ্রিল, ২০২০

পরিযায়ী শ্রমিক ও আমাদের সরকার ~ উদিত সেনগুপ্ত

কয়েক ঘন্টা আগেই দেখলেন কী কান্ড টা ঘটে গেছে বান্দ্রা স্টেশন চত্বরে? প্রায় সহস্রাধিক পরিযায়ী শ্রমিক জড়' হয়েছিলেন এই ভেবে যে আজ লকডাউনের পরিসমাপ্তি ঘটছে এবং তাঁরা বাড়ি ফিরতে পারবেন। সকাল ১০টার স্পীচ শোনার সুযোগ তাদের ঘটেনি কিংবা ঘটে থাকলেও তা মান্য করার মত বাস্তবতা তাদের ছিল না। কেন' ছিলনা সেই বাস্তবতা? কারণ তাঁদের নো ওয়ার্ক নো পে জীবনের রোজগার বন্ধ গত তিন সপ্তাহ ধরে লকডাউনের কল্যাণে, NGO দের মারফৎ পাওয়া চাল আলু ও হয় শেষ হয়ে গেছে, বা হওয়ার মুখে। তাঁরা তো কেউ প্যাকেজ ট্যুরে মুম্বই দর্শন করতে আসেন নি উত্তর প্রদেশ, মালদা, মুর্শিদাবাদ থেকে, এসেছিলেন পেটের দায়ে মূলতঃ নির্মাণকর্মী কিংবা দর্জির কাজ নিয়ে। এবং তাঁরা বাড়ি ফিরতে চান আরো একটা কারণে। তাঁদের করোনা হলে তার দায়িত্ব বা চাল আলু ফুরোলে তা পুনরায় তাদের কে তা পৌছে দেওয়ার দায়িত্ব কারা নেবে, সে বিষয়ে ঘোর অনিশ্চয়তা। কেন অনিশ্চয়তা? কারণ একটা জরুরি শব্দ ইতিমধ্যে আপনারা মিস করে গেছেন।

 কোনো সরকার নয়, NGO নিয়েছিল গত তিন সপ্তাহে তাদের ত্রাণের ব্যবস্থা। খেয়াল করে দেখুন বা টিভি/অনলাইন খবর পড়ে দেখুন শ্রমিকরা বলছে যে কিছু NGO এইটুকু অন্ততঃ করেছে, তাদের মালিক/ঠিকেদার নয়, সরকার নয়। এই সকল NGO শব্দবন্ধের সাথে তাদের পরিচিতি অল্প কিছুদিনের, কিন্তু চিরপরিচিত মালিক/ঠিকেদার/সরকার, অর্থাৎ যে কোনো শ্রমিকের প্রাথমিক নিরাপত্তাবোধের প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের জন্য এগিয়ে আসে নি। এতএব, প্রবল এই নিরাপত্তাহীনতা। ফলতঃ ঘটল' লাঠিচার্জ এবং বর্তমানে টুইটার যুদ্ধ চলছে মহারাষ্ট্র সরকার আর কেন্দ্রীয় সরকারের মধ্যে, কে কার দায়িত্ব পালন করেনি, সেই নিয়ে। আর আমি প্রবল আতঙ্কে টিভি চ্যানেলে এই সব দেখে প্রেডিক্ট করার চেষ্টা করছি যে সমষ্ঠিগত সংক্রমণ বা কমিউনিটি ট্রান্সমিশনের ফলে আগামীকালের করোনা কাউন্ট কত' দাঁড়াবে। 

কোনোদিন নির্মীয়মাণ বান্দ্রা মেট্রো স্টেশনের সাইটে গিয়ে দাঁড়ান কয়েক মুহূর্ত। হঠাৎ ই আপনার মনে হবে ২০০০ কিমি দূরে আরব সাগরের পাড়ে এত বাংলা ভাষার স্রোত কোথেকে ভেসে আসছে?! সেখান থেকে হাঁটতে শুরু করুন এ দেশের "ক্যানারি ওয়ার্ফ" বান্দ্রা কুরলা কমপ্লেক্সের দিকে। নির্মীয়মাণ মেট্রোর লাইন বরাবর শুনতে পাবেন মুর্শিদাবাদ, মালদা, এমনকি পুরুলিয়ার ডায়ালেক্টে বাংলা ভাষা। পাশেই নির্মীয়মাণ বহুতল বাণিজ্যিক বিল্ডিংগুলোর দিকে এগিয়ে যান। শুনতে পাবেন ছাপড়া, সিওয়ান, সীতামরহি, বারাবাঁকি, সাসারাম, বিজনৌর, শামলির ভাষা। অপেক্ষা করুন দিনের আলো ফুরনো অবধি। তারপরে ভাষার এই কলকল স্রোতের পিছু পিছু হাঁটতে থাকুন। পৌছে যাবেন প্যাটেল নগর, কালিনা হয়ে লাল বাহাদুর শাস্ত্রী মার্গ ধরে সুন্দরনগর, আজাদ নগর, ভীম নগর, সূর্যনগর, কাজুপাড়া, মোহিলিগাঁও, মিলিন্দনগর। এই প্রত্যেকটি অঞ্চল আসলে একেকটি বৃহৎ বস্তি অঞ্চল। এই সব মানবস্রোতের আশ্রয়স্থল। বান্দ্রা থেকে একদিকে গেলে ধারাভি (এশিয়ার বৃহত্তম বস্তি অঞ্চল) হয়ে সায়ন-মাহিম; আরেকদিকে কুরলা থেকে ঘাটকোপার হয়ে মুলুন্ড অবধি, প্রায় ১৩ লক্ষ মানুষের মধ্যে ৮০% মানুষ বাস করে এই সকল বস্তিতে। এই সকল গতরে খেটে খাওয়া মানুষ ২১ দিন ধরে কোনো রোজগার না করে, কিছু NGOর ভরসায় বেঁচে আছে। তারাই আজ বাড়ি ফেরার তাগিদে, প্রাণের দায়ে জড়' হয়েছিল' বান্দ্রা স্টেশনে। 

না না, আমি জানি যে আপনি এর মধ্যে পদবী খুঁজতে চাইছেন এবারে!! ব্যাপার টা কে "that one particular community" বলার জন্য আপনার জিভ সকসক করছে এই মুহূর্তে!! দাঁড়ান! এরা কেউ কোনো মার্কাজ বা কেত্তন বা অমুকনবমী বা অমুকলালা'র উৎসব পালন করতে জড়' হয়নি। ভরসার অভাবে, মানে রাষ্ট্রের কোনোরকম আস্থাপ্রদানকারী পদক্ষেপের অভাবে এরা নিজেদের সংসারে, পরিবারে ফিরতে চেয়েছেন। টাকা নয়, জমি নয়, মন্দির নয়, মসজিদ নয়, এরা মরিয়া হয়ে উঠেছেন উপার্জনের অভাবে, খাদ্যের অনিশ্চয়তায় তাদের শেষ নিরাপত্তার খুঁটিটাকেই আঁকড়ে ধরতে, নিজের গ্রামে, নিজের ঘরে ফিরতে। করোনায় মৃত্যু হতে পারে, এই জ্ঞানটুকু থাকা সত্ত্বেও তারা মরিয়া। 

এইবারে আপনি ওই "দ্যাট পার্টিকুলার কমিউইনিটি" থেকে হাল্কা সরে গিয়ে "কী আর করা যাবে বল' " বলতে চাইছেন। উত্তর টা হলঃ অনেক কিছুই করা যেত'। ২২শে মার্চ অবধি বিদেশী বিমান চলতে না দেওয়া যেত'। ৩০শে জানুয়ারি এলার্ম পাওয়ার পর থেকে দু তিন সপ্তাহের মধ্যে স্পেশাল ট্রেনের এরেঞ্জমেন্ট করে এই সকল পরিযায়ী শ্রমিক কে বাড়ি ফিরিয়ে এনে ফুড কর্পোরেশনের পর্যাপ্ত স্টক থেকে খাদ্যশষ্যের রেশনের ব্যবস্থা করা যেত', এককালীন পদক্ষেপ হিসেবেই ১৫ লাখ না হোক, ৫০০০ টাকা করেই না হয় এদের জন ধন একাউন্টে ঢালা যেত' এবং প্রতিটা স্টেশনে অন্ততঃ থার্মাল স্ক্যানিং করানো যেত' (অবশ্যই সম্ভব)। সরকার বাহাদুর তিনটি প্রতিবেশী রাষ্ট্রের নিপীড়িত মানুষকে নাগরিকত্ব প্রদান করতে মানবিক আশঙ্কায় সদা উদগ্রীব আর নিজের দেশের এই বিশ্বকর্মাদের প্রতি এত অনীহা, এত অবহেলা?! নাকি এঁরা নাগরিক ন'ন? যদি নাই হ'ন, এঁদের ঘামের মধ্যে দিয়ে সৃষ্ঠ শ্রমদিবস মেনে নিচ্ছিলেন কেন? এঁদের কে দিয়ে সব শয়ে শয়ে কোটি টাকার নির্মাণ প্রকল্প করাচ্ছিলেন কেন? কোথায় এদের ঠিকেদার রা? সেই ঠিকেদার দের রাজনৈতিক মুরুব্বি রা? লাঠিচার্জ টা আজ বিকেলে এদের ওপর হল' কেন? করোনা ছড়ানোর দায়ে মহামারি আইন ও পীনাল কোডের আওতায় এঁদের ঠিকেদার আর সরকারের শ্রম দপ্তর বা সমাজকল্যাণ দপ্তরের কর্তা-কত্রীদের উপর লাঠি চার্জ বা জামিন-অযোগ্য ধারায় কেস করা হচ্ছে না কেন? কেন' লাঠিচার্জ হবে না সেই সকল রাজ্যসরকারের বিরুদ্ধে যাদের কাছে জনগণের অর্থে নিজ নিজ রাজ্যে কর্মসংস্থান সৃষ্টির সৎ প্রয়াসের বদলে মন্দির- কুম্ভমেলা- ক্লাবতোষণ- পীরভাতা- মস্তানদের Y category র নিরাপত্তাপ্রদাণ অগ্রাধিকার পায়? কেন' লাঠিচার্জ হবে না সেই সকল রাজনৈতিক দলগুলির বিরুদ্ধে যারা এই জাতীয় সঙ্কটের সময়েও বিধায়ক কেনা বেচার জন্য রোলস রয়েস থেকে বিলাসবহুল রিসর্টে অর্থের হড়কা বান এনে ফেলছেন অথচ' রিলিফ দেওয়ার বেলায় রেশনের আটা, চালের বস্তায় নিজেদের "বিকাশপুরুষ", "মা জননী", "লৌহপুরুষ" দের সহাস্য ছবি লাগিয়ে "দান" করছেন? কেন' লাঠিচার্জ করা হবে না সেই সকল রাজ্যের সরকার কে, যাদের রাজ্য থেকে এই সকল পরিযায়ী শ্রমিক কাজ করতে গিয়ে আটকে পড়েছেন অথচ' তারা স্রেফ সরকারি লেটারহেডে একটা করে চার লাইনের চিঠি লিখে দায়িত্ব সম্পাদন করে ফেলেছে? 

এই সকল শ্রমিকের এই সব শহরের বাসস্থানগুলিতে ঢুকুন। বুঝবেন যে আন্দামানের সেই কুখ্যাত সেলুলার জেলের একেকটি খুপড়িতে মাথাপিছু যতখানি স্কোয়ারফুটের মধ্যে দ্বীপান্তরী মানুষরা বাস করতেন, তার চেয়েও মাথাপিছু কম স্পেসে এই সব অঞ্চলে পেটের দায়ে একেকটি শ্রমিক বাস করে মাসের পর মাস, বছরের পর বছর (প্রোফেসর  ইন্দ্রনীল দাশগুপ্তর কাছে কৃতজ্ঞ এই বস্তুনিষ্ঠ তুলনাটা আজ সকালেই করার জন্য)। এদের কে "বিপ্লবী" বলবেন না আপনারা, বর্ষাকালে ধ্বস নামার ফলে (হ্যাঁ, মুম্বই শহরের বহু বস্তি অঞ্চলে ফী বর্ষায় ধ্বসে যায় মাটি) যখন এঁদের কেউ না কেউ অকালে মরে যায়, তাঁদের "শহীদ" বলেন না আপনারা। অথচ' খেয়াল করে দেখুন, আপনার পিপিটি প্রেজেন্টেশনের যাবতীয় সুচারু বক্তব্যে যখন এ দেশটা কে "ইনভেস্টমেন্ট ডেস্টিনেশন" প্রমাণ করতে আপনি ব্যাগ্র হয়ে ওঠেন, আপনি আদতে এই শ্রমিকগুলোর কথাই বলছেন কিন্তু। আপনার অর্থনৈতিক মহাযুদ্ধের শহীদ এঁরাই, আপনার যাবতীয় লক্ষ্মীদেবীর মহাযজ্ঞের সমিধ থেকে হবি সবটাই এঁরা। 

কিন্তু এতখানি পড়ার পর ও আপনি ওই কমিউনিটি ট্রান্সমিশন নিয়েই ভেবে ঘেমে যাছেন। অবিশ্বাসের, অসহায়তার কমিউনিটি ট্রান্সমিশন গত ৩০ বছর ধরে উত্তোরত্তর বৃদ্ধিই পেয়েছে, যা বিগত ছ' বছরে বিমুদ্রাকরণ থেকে আজকের ওই চূড়ান্ত অপরিকল্পিত লকডাউনের মধ্যে দিয়ে, হিন্দু-মুসলমান প্রফিটেব্ল ব্যবসার মধ্য দিয়ে তা প্রায় প্রতিটি গৃহস্থালি অবধি পৌছে গেছে ধর্ম, বর্ণ, ভাষা নির্বিশেষে। স্যানিটাইজার খুঁজছেন? আছে। কিন্তু তা বোতলে বিক্রী হয়না। একমাত্র বোধ ও চেতনার বিকাশেই তা পাওয়া যাবে। আর তদ্দিন অবধি দেখতে থাকুন কোন বারুদ কোথায় কখন সামাজিক অগ্ন্যুৎপাত ঘটায়।

সোমবার, ৬ এপ্রিল, ২০২০

ঐক্যপুজো ~ আর্যতীর্থ

ফাটছে বাজি দড়াম দুড়ুম , হুররা হো হুররা হো,
আয় করোনা আমার বাড়ি, নিয়মটিয়ম দূর রহো।
তিনহাজারে গেছে রোগী, মৃত্যু হলো একশো পার,
আও বাবাজী, ফাটাও বাজি, আয়েশ করি সব ইয়ার!

এটাই যদি ঐক্যধ্বনি, গড় করি ভাই দূর থেকে
ঢোলক নিয়ে নাচন কোদন, বাইরে গেলো ঘুরতে কে?
এই মারীতেও এমন বাজি, তবে কোথায় ভয় শুনি?
আপন মনে ছড়াক কোভিড, আমরা বরং নয় গুনি।

বিশ্ববাসীর কাছে গেলো ভারত থেকে এই আওয়াজ
ষাট হাজারের মৃত্যু তো কি, দ্যাখ কিরকম ফূর্তি আজ।
মোবাইল আলো আর প্রদীপে কম পড়ে দেশভক্তিতে
ঐক্যপুজোয় নিয়ম বোধহয় পটকা দিয়ে ভোগ দিতে।

লকডাউন আর করা কেন, দেশ আছে বেশ উৎসবে,
ফালতু নাটক শেষ করা হোক, কজনে আর ভূত হবে!
চিন্তাবিহীন তাকধিনাধিন, কে খুঁজে যায় বিপর্যয়?
বাকি আছে হাঁকা শুধু, বোল করোনা মাঈকি জয়!

ঐক্যপুজো আবার কবে, পাঁজি দেখে নিই শিখে,
কোভিডবাবার থানে এবার ভেট চড়াবো পাঁচসিকে।

শনিবার, ৪ এপ্রিল, ২০২০

কোরোনা ও সরকার ~ ইন্দ্রনীল রায়চৌধুরী

কত্তা, একটু রোসেন। কিছুতেই যে কথাটা ফাইজলামি করে বোঝানো যাচ্ছে না সেটা একটু ঘুরিয়ে কই। ঠাকুর বলেছিলেন পথ দুটো ।একটা ভক্তির আর একটা তর্কের। আমার মতো অনেকেরই পথটা তর্কের। কিন্তু তাতে করে আপনার ভক্তির পথ নিয়ে আমার কোনো আপত্তি নেই। কাজেই আমার প্রশ্ন করার অভ্যাস নিয়ে আপনার রেগে যাওয়ার কিছু হয়নি। আমি ওভাবেই বুঝি। যেমন আপনি বোঝেন , মোদিজী যখন বলেছেন তখন নিশ্চই কিছু একটা ভেবেই বলেছেন। নিশ্চই মঙ্গলের দ, চাঁদের প, আর ৯এর ছ মিশিয়ে কিছু একটা দারুন হবে। ছোটবেলা ক্লাসে মনে নেই? কয়েকজন প্রশ্ন করতো আর বাকিরা মুখস্ত করতো এই ভেবে যে বইতে যখন লেখা আছে নিশ্চই ঠিকই হবে। এখন তারা ঠিক সেই অভ্যেসটা whatsapp এও চালু রেখেছেন। ওতেও সমস্যার কিছু নেই। আমি প্রশ্ন করতে করতে বুঝবো, আপনিও একদিন বিশ্বাস করতে করতেই বুঝবেন। । সেই সম্ভাবনা খোলা থাক। কালকেই পৃথিবী শেষ হচ্ছে না। প্রশ্নের কোনো ঐতিহাসিক দায়বদ্ধতাও নেই। প্রশ্ন প্রশ্নই। যেমন ভক্তি ভক্তিই। নাড়ু কেন আমার বাড়ির দেওয়ালে হিসি করলো এই নিয়ে প্রশ্ন করলে আপনি বলতে পারেন না নাড়ুর বাপ জাঙ্গিয়া না পরে পাতলা লুঙ্গি জড়িয়ে যখন বাজারে যেত তখন তুমি কোথায় ছিলে? ঠিক যেমন আমি আপনাকে জিগাই না, তোমার এত ভক্তি এখন, আদবানি যখন একটা রাম লেখা ইঁট বানাতে বলেছিল… সেই ইঁট তোমার বাপ বানিয়েছিল? নাড়ু বা আপনার বাপ কারো দায় আমাদের নয়। আমরা এখন নিয়ে কথা বলছি, অতীত নিয়েও। কিন্তু তখন তুমি কোথায় ছিলে বল্লে খেলব না। তখন আমি নাক খুঁটছিলাম, আপনি ছোঁচাচ্ছিলেন। কাজেই শোধবোধ হেগো পোঁদ। বাদ দিন।
ঠাকুরে আসি। ঠাকুর ভক্ত হতে বলেছিলেন। দাস হতে একবারও বলেননি। দাস আর ভক্তের বিস্তর ফারাক। একজন মাইনে পায় একজন ফ্রিতে খাটে। এইটা ঠাকুর বলেননি।কারন ঠাকুর আপনাকে দেখেননি। আপনার মত জীব দেশে তখন খুব কম ছিল। যে কটা ছিল তাদের জন্যে যা বলার নরেনই বলে গেছেন। একটু ভক্তিভরে ওর জীবনী পরবেন… গোসেবক নিয়ে ওনার মতামত খুব পষ্ট। মুশকিল হল আপনি গোসেবক আর হিঁদু গুলিয়ে ফেলেছেন whatsapp পড়ে। আপনার তালগোল পাকিয়ে গেছে। ঠিক যেমন আপনি সরকার আর জনগণে গুলিয়ে ফেলছেন।
সরকার পরিকল্পনা করে।তার কাছে সাধারন মানুষের থেকে অনেক বেশি তথ্য থাকে। সেগুলি সে সমন্বয় করে। তার থেকে নীতি তৈরি হয়। ভবিষ্যতের দিশা দেয়। দুর্বলের পাশে এসে দাঁড়ায়। না পারলে তার যুক্তি দেয়।খতিয়ান দেয়। এগুলি বইতে লেখা ছিল মনে আছে? তখন না বুঝে দুলে দুলে মুখস্ত করেছিলেন বলে ভুলে গেছেন। এগুলো সরকারের কাজ। সেই জন্য সরকারকে মানুষ নির্বাচিত করে। এটাও বইতে লেখা ছিল। তার জন্য আপনার আমার পকেট থেকে অনেক অনেক টাকা খসে।এইবার একটু খেয়াল করুন এই সরকার এই করোনা  নিয়ে কি কি করেছে? ( রাহুল গান্ধী রাহুল গান্ধী করবেন না।ও টুইট করে আর থাইল্যান্ড যায়… নিজের পার্টি ছাড়া কারুর ভিটে মাটি চাঁটি আপাতত ও করছে না)। সরকার দুমাস আগাম সময় পেয়েছিল।সরকার পাড়ার ছেলু গয়লা নয়। তার বহু মাইনে করা ইয়াব্বড় শলাহকার আছে। তারা Whatsapp এর ডিগ্রীধারি নয়।তারা কি বলেছিল আর সরকার কি বুঝেছিল আমাদের কেউ জানায়নি। এই রোগ আমদানিকৃত। অনেক আগে বর্ডার সীল করলে আজ হয়ত আপনি আমি কেউ বাড়ি বসে নেই। যখন WHO বলেছিল গ্লোবাল হেলথ এমার্জেন্সি, সরকার বলেছিল তেমন ভয়ের কিছু নেই। সরকার তখন ব্যাস্ত ছিল। ট্রাম্পের নধর নিতম্ব, শাহীনবাগের কারেন্ট, শালাদের গুলি আর মধ্যপ্রদেশের এমএলএ দের খুলি নিয়ে। এগুলো আপনিও দেখেছেন। এই দুই মাসে টেস্টিং, PPE, মাস্ক, ভেণ্টিলেটর কিচ্ছুটির কিছু হয়নি। রাজ্যগুলি অনেক আগে মাঠে নেমেছিল। তারা কেন্দ্রের থেকে বেটার নয়।তাদের মানুষের খিস্তি ডাইরেক্ট খেতে হয় তাই। কিন্তু তারা GSTর হাজার হাজার কোটি প্রাপ্য টাকা পায়নি মাসের পর মাস। কেরালা সরকার হাইকোর্টে গিয়ে মানুষ যাতে নেক্সট তিন মাস কোনো ট্যাক্স না দেয় তার রায় নিয়ে এসেছিল। কেন্দ্র সুপ্রিম কোর্টে গিয়ে সেটা ক্যান্সেল করিয়ে এসেছে। 
তারপর প্রথম বার্তা সরকারবাহাদুর দিলেন একটা চুকিতকিত কার্ফুর আর থালা বাজানোর। তার জন্য টাইম দিলেন চার দিন। দ্বিতীয়বার এসে ২১ দিনের লকডাউন। সময় দিলেন চার ঘন্টার। এর ফলে কি হয়েছে আপনি গুহায় না বাস করলে জানেন। এর মধ্যে আপনিও দেখেছেন সরকার যে প্যাকেজ ঘোষনা করেছে তার আর্ধেক NREGA আর পিএম কিষানের পুর্ব ঘোষিত টাকা। সেটাকে প্যাকেজে জুড়ে দিয়ে মালটাকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে দেখানো হয়েছে। আপনি হাফিইয়ারলির ইতিহাসের নম্বরটা ফাইনালের সঙ্গে জুড়ে দিয়ে পাশের বাড়ির ঘোঁতনকে ঢপ দিলে সেও এটা একদিন ধরে ফেলতো। ঘোঁতন যদি আপনার ভক্ত না হয়। যারা ভক্ত নয় তারাও তাই করেছে। আপনি ভক্ত বলে বাকিরা ঢপটা গিলবে কেন? যে গালভরা ইএমাই মকুব হয়েছে সেটা না দিলে সুদ সমেত সেটাও আপনাকে পরে শুধতে হবে সেটাও সরকার আপনাকে পরিষ্কার করে একবারো বলেনি।আপনার একবারো মনে হয়নি এটা সরকার বললো না কেন? সরকার কি জনগণের ভাসুর? এত আকার ইঙ্গিতে কথা বলার কি প্রয়োজন? 
 যে লক্ষ কোটি টাকা সরকার তেলের জন্য বাঁচাচ্ছে তার এক পয়সাও মানুষ কে ট্রানফার করছে না। একটা সরকারি পিএম রিলিফ ফান্ড থাকতে সরকার একটা ট্রাস্ট খুলে মানুষের থেকে টাকা তুলছে। একটু দুলে দুলে মোদি মোদি না করলেই দেখবেন আপনি ক্লাস টু এর ফাইনালের আগে যেটুকু হোমওয়ার্ক করতেন সেটুকুও এই গরমেন্ট করেনি। এই অবস্থায় সে এসে আপনাকে বলছে একটু পদিপ জ্বালাবি ভাই? আমরা সবাই দেখবি কেমন মনে বল পাব!
আপনি দুবার ফেল করে আপনার বাপকে যদি বলতেন একটু রেহমানিয়ার বিরিয়ানি খাওয়াবে বাবা? তাহলে এই কঠিন সময় আমি একটু মনে বল পাই। কি হত? নিজের বাপের মুখটা একটু মনে করুন। মালুম পাবেন। আমাদেরো না ঠিক এইরকম লাগছে।
আপনি গুলিয়ে ফেলেছেন কাকু। সারা পৃথিবীতে মানুষ নিজের উদ্যোগে ঘন্টা বাজায়, গান গায়, কবিতা পড়ে, মোমবাতি জ্বালায়। সরকার তাকে কিছু বলে না। সরকার ত্রাণ দেয়, খাবার দেয়। চিকিৎসা দেয়।এখানে সাধারন মানুষ (that includes স্বাস্থ্যকর্মী) ত্রাণ, খাবার, চিকিৎসার প্রাণপণ চেষ্টা করছে আর সরকার মন দিয়ে ধুপ, কাঁসর, প্রদীপ, ন মিনিট এসব করে যাচ্ছে। উলটে গেছে পুরোটা। মানুষের দ্বায়িত্ব নিজেকে বাঁচানো। সরকার শুধু ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক দেবে।
উলটে গেলে ভীষন বিপদ জানেন। মানুষের দেহে ব্রেন আর রেক্টাম খুব কাজের জিনিস। কিন্তু এরা জায়গা পাল্টালে ঘোর দুর্দিন। ভাবুন তো কি বিপদ? 
তাই আমরা প্রদীপ টদীপ জ্বালাবো না বুইলেন। আপনি জ্বালান। আপনার মঙ্গল হোক। আমরা তো একই সুতোয় বাঁধা। তাই আপনার হলে আমাদেরো হবে। চিন্তা করবেন না।
পুঃ পাছে কমিউনিস্ট জেহাদি টেহাদি ভাবেন তাই আবার ঠাকুর দিয়েই শেষ করি। ঠাকুর ভক্ত হতে বলেছিলেন ঠিক। কিন্তু মার। বা গুরুর । বা আরাধ্য যা কিছুর।রাজার ভক্ত হতে একবারো বলেননি। আপনি রাজার ভক্ত হয়েছেন। রাজা খুব ডেঞ্জার জিনিস। সে রাজা হিন্দু হোক বা খ্রিশটান বা মোছলমান বা কমিউনিস্ট। রাজা শুধু নৈবেদ্যি বোঝে। আর বোঝে লাঠি, তেল ও গুহ্যদ্বার। আর গুহ্যদ্বারের হিঁদু মোছলমান হয়না।

বৃহস্পতিবার, ২ এপ্রিল, ২০২০

করোনা ও মানুষ ~ বিষাণ বসু

এই শালা মাইগ্র‍্যান্ট ওয়ার্কারদের জন্যে দেশে করোনা এবার মহামারী হয়ে যাবে। 

ঠিকই। একেবারে ১০০% সহমত।

দেখেছেন? দেখেছেন শালাদের গাদাগাদি করে বাসস্ট্যান্ডে ভিড় জমাতে? লকডাউন ফেইল করবে না এরপরেও? বাস নেই, তো হেঁটে হেঁটে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় চলে যাচ্ছে - কে ট্র‍্যাক করবে এদের? কে টেস্ট করবে? মিনিমাম সচেতনতা না থাকলে…

একদম ঠিক জায়গাটা ধরেছেন, সিরিয়াসলি। আমি তো আরেকটু আগের কথা বলছি। এই ধরুন, বিলেত-আমেরিকার ডলার-পাউন্ডের মাইগ্র‍্যান্ট বাবুরা যদি এমন করে তাঁদের ফেলে যাওয়া দেশটিতে  না ফিরতে থাকতেন, ফেরার পর তাঁদের যদি এমন করে বাজারে ছেড়ে না দেওয়া হত, কে জানে, লকডাউন না করেই হয়ত আমরা বেঁচে যেতাম, তাই না? আরেকটু আগেই যদি মাইগ্র‍্যান্ট ওয়ার্কারদের দেশে ফেরার ঢল বন্ধ করতে প্লেনগুলো আটকানো যেত? প্লেনে চেপে যাঁরা ফিরলেন, তাঁদের সবাইকে  যদি কোয়ার‍্যান্টাইন করে টেস্ট হত, তাহলে??    

এই হচ্ছে আপনাদের প্রবলেম। রাজনীতি বাদ দিয়ে কথা বলতে শেখেন নি।

ঠিকই। কাদের মাইগ্র‍্যান্ট ওয়ার্কার বলা হবে আর কাদের নয়, এটা তো একেবারেই রাজনীতির সিলেবাসের বাইরে, তাই না? উন্নত দেশে বসে চাকরি করে মাসে কয়েক লাখ কামালে তাঁকে তো আর ওয়ার্কার বলা যাবে না, তাই তো? ভালো আয়ের সুযোগ বুঝে এদেশ থেকে ওদেশে পাড়ি জমালে, বিপাকে পড়ে ওদেশ থেকে এদেশে ফিরে এলে, তাকে মাইগ্রেশন বলাও নেহাত অনুচিত। মাইগ্র‍্যান্ট ওয়ার্কার মানে শুধুই তারা যারা দিনমজুরির কাজ হারিয়ে মাথায় হাঁড়িকুঁড়ি চাপিয়ে ঠা ঠা রোদ্দুরে হেঁটে চলেছেন। এবং, এই সংজ্ঞায় রাজনীতি নেই। তাই না??

আরে, তারা আর এরা?? এদের মধ্যে কোনো কনশাসনেস আছে??

সে তো বটেই। করোনার সংস্পর্শ জেনেও লন্ডন থেকে ফিরে যিনি বাজার-শপিং মলে ঘুরে বেড়ালেন, বিদেশ থেকে ফিরে যাঁরা মস্ত পার্টিতে হুল্লোড় করলেন, এমনকি যাঁরা বিদেশ থেকে ফিরেই স্রেফ গাঢাকা দিয়ে হাওয়া হয়ে গেলেন, হয়ে গেলেন ননট্রেসেবল - তাঁরা সাঙ্ঘাতিক সচেতন নাগরিক বই কি!!

দেখুন, আপনার এই সব কথাতেই সো-কলড গরীবের ছুতো দেওয়া বন্ধ করবেন, প্লীজ??

বেশ, বন্ধ করলাম। মধ্যবিত্তদের কথা বলি তাহলে? আচ্ছা, ফ্ল্যাটে যেসব বুড়োবুড়িরা থাকেন, তাদের অবস্থাটা ভেবেছেন?? তাঁরা কিন্তু কাজের লোক রান্নার লোকের উপর খুব নির্ভরশীল। এই বাজারে তাঁরা কেমন আছেন, জানেন?? এঁরা খাবার পাচ্ছেন কিনা, কী খেয়ে থাকছেন, জানার চেষ্টা করেছেন? ওষুধের দোকানের সামনে লাইনটা দেখেছেন? হয়ত খবর রাখেন না, নিখিল বিশ্বে করোনা-ই এক এবং একমাত্র অসুখ নয়। আপনি যখন মধ্যবিত্তদের কথা ভাবছেন, এটুকু নিশ্চয়ই জানেন, এইসব বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের অধিকাংশই দিনে চারপাঁচটা ওষুধ খান - সুগার-প্রেসার ইত্যাদি। সে ওষুধ বন্ধ করার জো নেই। এনারা যদি ওষুধের দোকানে লাইন দিয়ে করোনা বাধিয়ে বসেন - জানেন তো, করোনায় মরার ভয় মেইনলি এঁদেরই।           

হুমমমমম…. 

আর হ্যাঁ, মাথায় রাখুন, এঁদের অনেকেই নির্ভর করেন সঞ্চয়ের টাকার উপর যে মাসিক সুদটুকু মেলে, তার উপরে। সরকার যে আচমকা সুদ কমিয়ে দিল - আমার-আপনার সঞ্চয়ে যে সুদ কমলো, তার থেকেও কিছুটা বেশী করে কমে গেল বয়স্কদের সঞ্চয়ে - এনাদের দিন চলবে কী করে, ভেবেছেন?? হ্যাঁ, এঁরা কিন্তু আমার-আপনার মতোই মধ্যবিত্ত - মানে, সেরকমই ছিলেন - করোনার দিনগুলো কাটলে, এবং বেঁচে থাকলে, এঁরা হয়ত নিম্ববিত্তের জীবনযাত্রায় নতুন করে অভ্যস্ত হবেন। নাঃ, থাক - আপনি তো আবার রাজনীতির কথা পছন্দ করেন না!!

© বিষাণ বসু

বুধবার, ১ এপ্রিল, ২০২০

কোরোনা ভাইরাস ও কিউবা ~ সুশোভন পাত্র

ধরুন, লকডাউনে আপনি ঘরবন্দী। খাচ্ছেন-দাচ্ছেন-ঘুমোচ্ছেন। হয়ত অ্যামাজন প্রাইমে প্যারাসাইট দেখছেন কিম্বা নেটফ্লিক্সে মানি হেইস্ট রিভাইজ দিচ্ছেন। এমন সময় কেউ আপনার দরজায় কড়া নাড়ল। 'অসময়ে আবার কে?' -বলে ব্যাজার মুখে দরজা খুলে দেখলেন দাঁড়িয়ে আছে পাড়ার সরকারী মেডিক্যাল টিম। একজন ডাক্তার, একজন নার্স আর দু-জন মেডিক্যাল স্টুডেন্ট। তাঁরা আপনার গত কয়েকদিনের মেডিক্যাল হিস্ট্রি নোট করলেন। COVID-19-এ আক্রান্ত হওয়ার প্রাথমিক লক্ষণ আছে কিনা টেস্ট করলেন। যদি টেস্ট নেগেটিভ হয় তাহলে 'থ্যাঙ্কু, গুড বাই' বলে, আপনাকে আবার নেটফ্লিক্স-অ্যামাজন প্রাইমের দুনিয়ায় ছেড়ে আপনার প্রতিবেশীর ঘরে চলে গেলেন। 
কিন্তু ধরুন, আপনার জ্বর, কাশি, সর্দি, শ্বাসকষ্টের প্রাথমিক লক্ষণ দেখা গেলো। তখন ঘণ্টা খানেকের মধ্যে আপনার দুয়ারে অপেক্ষা করবে অ্যাম্বুলেন্স। আপনার পরিবারের সকলকে আবশ্যিক কোয়ারেন্টাইনে পৌঁছে দিতে আর আপনাকে নিকটবর্তী পলিক্লিনিকে নিয়ে যেতে। পলিক্লিনিক মানে, অত্যাধুনিক প্যাথলজি, এক্স-রে, আলট্রাসাউন্ড, অপ্টোমেট্রি, এন্ডোস্কোপি, ম্যাটনারনাল চাইল্ড কেয়ার, ডায়াবেটিক, প্যাডিয়াট্রিক্স, গাইনকোলজি, কার্ডিওলজি সহ ২২টি জরুরী পরিষেবা যুক্ত সরকারী স্বাস্থ্য-পরিষেবার দ্বিতীয় স্তর। পলিক্লিনিকে জরুরী পরীক্ষায় যদি দেখা যায় আপনার সংক্রমণ গুরুতর এবং অচিরেই ভেন্টিলেশেনের প্রয়োজন পড়তে পারে তাহলে আপনাকে স্থানান্তরিত করা হবে সরকারী স্বাস্থ্য-পরিষেবার তৃতীয় কিম্বা চতুর্থ স্তরে। অর্থাৎ হসপিটালে কিম্বা মেডিক্যাল স্কুলে। না হলে আপনি বিন্দাস রইলেন পলিক্লিনিকে। আইসোলেশেনে আর অবজারভেশেনে¹। 
কি ভাবছেন স্বপ্ন দেখছি? ঘরে বসে খেয়ালি পোলাও রান্না করছি? বাড়ি বাড়ি ঘুরে মেডিক্যাল টিমের এভাবে রোগ নির্ণয় সম্ভব নাকি? সম্ভব! হচ্ছেও! তবে সেটা কিউবা তে। আসলে কমিউনিটি ক্লিনিক-পলিক্লিনিক-হসপিটাল-মেডিক্যাল স্কুল, কিউবার স্বাস্থ্য-পরিষেবার এই পিরামিড প্যান্ডেমিকের মোকাবিলায় ব্যাঙের ছাতার মত গজিয়ে ওঠা কোন স্ট্রাকচার নয় বরং গত ৫০ বছরের ধারাবাহিক সরকারী স্বাস্থ্য নীতির ফসল। 'Alma-Ata'; WHO যখন প্রাথমিক স্বাস্থ্য-পরিষেবা কে গোটা বিশ্বে মৌলিক নাগরিক অধিকার হিসেবে সার্বজনীন করার ডাক দিয়েছিল ১৯৭৮-এ, কিউবার এই প্রজেক্ট তারও আগের, ১৯৭০-র²। 
সেই প্রজেক্টের হাতধরেই কিউবা জুড়ে গড়ে ওঠে সরকারী স্বাস্থ্য-পরিষেবার নিউক্লিয়াস 'কমিউনিটি ক্লিনিক'। নির্দিষ্ট ভৌগোলিক বৃত্তে প্রতি ১৫০টি পরিবার পিছু গড়ে একটি। ডাক্তার, নার্স ছাড়াও মেডিক্যাল স্টুডেন্টদের তিন বছর দেশের কোন একটি কমিউনিটি ক্লিনিকে কাজ করা কিউবায় বাধ্যতামূলক। বছরের প্রতিদিন সকালে কমিউনিটি ক্লিনিকে বসে আউটডোর। বিকেলে ঐ ভৌগোলিক বৃত্তে মেডিক্যাল টিমের ফিল্ড ভিজিট, ক্রনিক রুগীদের চেক-আপ। আর সপ্তাহান্তে কমিউনিটি ক্লিনিকের জরুরী রুগীদের নিয়ে মেডিক্যাল টিম যায় পলিক্লিনিকে।দেশের মোট ৪৯৮টি পলিক্লিনিকের ঘাড়ে গড়ে ২০-৪০টি কমিউনিটি ক্লিনিকের রোগীদের সেকেন্ডারি স্বাস্থ্য-পরিষেবার গুরু দায়িত্ব ন্যস্ত। মোটামুটি কিউবার ৯৫% চিকিৎসা কমিউনিটি ক্লিনিক কিম্বা পলিক্লিনিকেই সীমায়িত³। বাকি ৫%-র জন্য আছে ১৫০টি ন্যাশনাল হসপিটাল। ১৪টি মেডিক্যাল রিসার্চ সেন্টার। এবং অবশ্যই দুনিয়ার বৃহত্তম মেডিক্যাল স্কুল ELAM। যেখানে পড়াশোনা করে ১১০টি দেশের ২০,০০০ স্টুডেন্ট। সম্পূর্ণ বিনামূল্যে, স্ট্রাইপেন সহ⁴। 
অবশ্য শুধু পড়াশুনা না, কিউবার স্বাস্থ্য-পরিষেবার আলপিন টু এলিফ্যান্ট সবটাই সরকারী এবং বিনামূল্যে। ওষুধও বিনামূল্যে কিম্বা ভর্তুকিতে⁵। উন্নয়নশীল দেশ তো ছেড়েই দিন, এমনকি উন্নত দেশের তুলনাতেও স্বাস্থ্য-পরিষেবার সূচকে কয়েক ক্রোশ এগিয়ে কিউবা। প্রতি ১০০০ জনে কিউবা তে ডাক্তার ৮.২। আমেরিকায় ২.৬, ভারতে ০.৮⁶। নাগরিকদের গড় আয়ু ৭৯। আমেরিকায় ৭৮, ভারতে ৬৮⁷। স্কিল্ড তত্ত্বাবধানে প্রসব কিউবায় ১০০%। আমেরিকায় ৯৯%, ভারতে মেরে কেটে ৮১%⁸। কিউবা তে স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ জিডিপির ১২.১৯%, ভারতে ১.২% ⁹ ¹⁰। এমনকি শুনলে অবাক হবেন যে উত্তাল আটলান্টিকের কোলে বসেও শেষ ১৭টি ঘূর্ণি ঝড়ে কিউবা তে মারা গেছেন মাত্র ৩৫জন। আর শুধু ২০০৮-র ঘূর্ণিঝড়ে আমেরিকা তে মারা গিয়েছিল ১৮০০জন¹¹।  
'বেসরকারি হলে পরিষেবা ভালো হবে' বলে পাড়া মাথায় তোলা দাদা-বৌদিরা রাগ করবেন না প্লিজ। ক্যাপিটালিজমের পা চাটা দালালরা বিরক্ত হবেনা না প্লিজ। কারণ উপরের তথ্য গুলো চে গেভেরার 'মোটরসাইকেল ডাইরিজ'-এ নেই বরং আছে WHO-র ওয়েবসাইটে। তাই আজকে যে শুনছেন কিউবার অ্যান্টিভাইরাল ড্রাগ Interferon Alfa-2B করোনার চিকিৎসাতে কার্যকরী ভূমিকা পালন করছে¹², আজকে যে শুনছেন বিশ্বের ৪৫টি দেশে কিউবার ডাক্তাররা করোনা ভাইরাসের আক্রান্তদের চিকিৎসা করছে¹³, আজকে যে শুনছেন করোনা আক্রান্ত যাত্রীসহ জাহাজ কে বিশ্বের তাবড় দেশ নোঙর ফেলতে না দিলেও কিউবা বুকে টেনে নিচ্ছে, -এর কোনটাই ফ্লুক কিম্বা পিসি সরকারের ম্যাজিক নয়¹⁴।
আসলে, হোক না কিউবা বহু দেশের তুলনায় অর্থনীতি তে চুনোপুঁটি, থাক না যতই বিপ্লব পরবর্তী ৬০ বছরের বেশি সময় ধরে আমেরিকার অর্থনৈতিক বয়কট, হলেই বা ডাক্তার, নার্স এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের পারিশ্রমিক কম; তবুও লড়াইয়ে হার মানতে, বশ্যতা স্বীকার করতে জানেনা একরত্তির ঐ কিউবা। স্বাস্থ্য-পরিষেবা নিয়ে ব্যবসা করেনা কিউবা। মানুষের জীবন কে প্রফিট মেকিং-র পণ্য করে ফি-বাজারে বিক্রি করেনা কিউবা। ফিদেল কাস্ত্রো বলতেন কিউবার ডাক্তাররা কেবল ডাক্তার না, তারা 'সাদা পোশাকের সৈনিক'¹⁵। 
আমাদের দেশেও তাই! করোনা প্যান্ডেমিকে দেশের মানুষ কে বাঁচাতে প্রতিদিন যে অসংখ্য ডাক্তার-নার্স-স্বাস্থ্য কর্মীরা অবিশ্বাস্য নিষ্ঠায় প্রাণপাত পরিশ্রম করছেন তারাও আমাদের দেশের 'সাদা পোশাকের সৈনিক'। আমরা জানি যে দেশে গড়ে হসপিটাল বেড ১টি/১,৮২৬জন, ডাক্তার ১টি/১১,৬৬০জন, আইশোলেশেন বেড ১টি/৮৪,০০০জন আর ভেন্টিলেটর ১টি/৩,৩৩,৩৩৩জন -সে দেশের 'সাদা পোশাকের সৈনিক'দের জন্য যুদ্ধটা আরও কঠিন¹⁶। আমরা জানি রাতারাতি আমাদের দেশের স্বাস্থ্য-পরিষেবা কিউবার মত হয়ে যাবে না। কিন্তু সরকারী পলিসি মেকিং-র অগ্রাধিকার তো বদলাতে পারে। তাই ভয়ঙ্কর স্বাস্থ্য-পরিষেবার কঙ্কালসার চিত্রের বদল চাইলে, আমাদের 'সাদা পোশাকের সৈনিক'দের ঢাল তরোয়ালহীন নিধিরাম সর্দার বানানো বন্ধ করার স্বার্থে কিছু প্রশ্নের উত্তর খুঁজলে কি "এই সময় রাজনীতি করবেন না" বলে হুমকি দেবেন?
দিলে দেবেন! কিন্তু প্রশ্ন আমরা করবই! প্রশ্ন করব যে প্যান্ডেমিকের প্রাদুর্ভাবে দেশ যখন জর্জরিত তখন সরকার কেন ৮৮০কোটি দিয়ে ইজরাইল থেকে ১৬,৪৭৯টি মেশিনগান কিনছে¹⁷? যেখানে ঐ একই পরিমাণ টাকায় এই মুহূর্তে দেশে ১৬,০০০ নতুন ভেন্টিলেটর বানানো যেত¹⁸। প্রশ্ন করব যে প্যান্ডেমিকের প্রাদুর্ভাবে সরকার কেন আপনার-আমার ট্যাক্সের ২০হাজার কোটি খরচা করে সেন্ট্রাল দিল্লি ও পার্লামেন্টে কে নতুন করে সাজানোর পরিকল্পনা করছে¹⁹? যখন করোনা মোকাবিলায় স্বাস্থ্য-খাতে মাত্র ১৫ হাজার কোটি বরাদ্দ হয়েছে। প্রশ্ন করব যে সরকার স্রেফ কলমের খোঁচায় ৭.২৭লক্ষ কোটির কর্পোরেট ট্যাক্স মকুব করতে পারছে²⁰, সেই সরকার কেন নতুন বোতলে পুরনো মদ ভরে, মাত্র ১.৭লক্ষ কোটির আর্থিক প্যাকেজে আই-অয়াশ করছে? সরকার কে ছাড়ুন, আপনিই না হয় বলুন। এখন কোনটা বেশি জরুরী মেশিনগান না ভেন্টিলেটরর? পার্লামেন্টে সাজানো না পরিযায়ী শ্রমিকদের নিরাপদে ঘরে ফেরানো? কর্পোরেট ট্যাক্স মকুব না স্বাস্থ্য-কর্মীদের মাস্ক, কিট? 
কিউবা না হয় নাইবা হলেন, ট্রাম্পের নমক খেয়ে ফিদেলের প্রশংসা না হয় নাইবা করলেন, সমাজতন্ত্র না হয় নাইবা চাইলেন, কমিউনিস্টদের না হয় ঘেন্নাই করলেন; কিন্তু মানবিক তো হতেই পারেন। সুলভ স্বাস্থ্য-পরিষেবার দাবীতে আওয়াজ তো তুলতেই পারেন। মানুষের জীবন কে পণ্য করার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ তো করতেই পারেন। না ক্যাপিটালিজমের আফিমে বুঁদ হয়ে 'প্রফিট'র অঙ্ক কষলে অমানবিক হতেই হয়?



সোমবার, ৩০ মার্চ, ২০২০

কারোনা ভাইরাস প্রতিরোধ ~ আশুতোষ ভট্টাচার্য্য

কারোনা ভাইরাস প্রতিরোধে বিশ্ব স্বাস্থ্য সং স্থার প্রধান নির্দেশ হল, টেস্ট টেস্ট টেস্ট, মানে অসুস্থ বা আপাত সুস্থ মানুষ এই ভাইরাস আক্রান্ত কিনা তা টেস্ট মানে পরীক্ষা করে নিশ্চিত হওয়া আর সাথে সাথে তাকে কোয়ারেন্টাইন কর আর চিকিৎসা কর। এই পরীক্ষা কিভাবে করতে হবে সে সম্পর্কেও তারা জানিয়ে দিয়েছেন। এবার টেস্ট করতে কিছু সরঞ্জাম লাগবে যাকে আমরা কিট বলছি, তবে এ কিট প্রেগ্নেন্সি কিটের মত সহজ সরল নয়, মানে এক ড্রপ ইউরিন ফেলে রঙ পাল্টে গেলেই পজিটিভ। এ কিট ব্যাবহার করতে একটা যন্ত্রও লাগে আর সম্পূর্ণ টেস্ট করতে কিছু দক্ষতা লাগে যা শিখতে হয়।

প্রধানমন্ত্রীর একটি সাইন্টিফিক এডভাইসরি বোর্ড আছে সে এখন আমরা জেনে গেছি( যার প্রধান বিজয় রাঘবন) যারা করোনা প্রতিরোধে কি কি করা উচিৎ সে টেস্ট বল, চিকিৎসা বল বা লকডাউন বল সাজেস্ট করেন আর সেই অনুসারে তা কার্যকর করা হয়। এই যে টেস্ট ব্যাপারটা কত বেশি কত দ্রুত করা যায় তার একটা ব্লু প্রিন্ট তারা বানিয়েছেন। দেশের প্রায় ১০০ টি গবেষণা কেন্দ্রকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে এই পরীক্ষা পদ্ধতি বিভিন্ন হাসপাতাল, ডায়াগনস্টিক কেন্দ্রকে হাতে কলমে শেখাতে যাতে তারা কিছুদিনের মধ্যে স্বয়ংসম্পুর্ন হয়ে ওঠে।

এবার দেখা যাক এ পরীক্ষা পদ্ধতি কেমন, স্যাম্পল বা নমুনা হিসেবে নেওয়া হয় সন্দেহভাজন ব্যক্তির লালারস।সেই লালারসে থাকে ভাইরাস, মানুষের অন্য কোষ (cell) এর সাথে।এই কোরোনা ভাইরাস  RNA গোত্রের( জিনোম), মানে সেই নাইন টেনে পড়া ডিএনএ আরএনএ, বেশ মেয়েদের চুলের বিনুনির মত দেখতে। এই লালারসকে প্রথমে নিষ্ক্রিয় করা হয় কিছু রাসায়নিক দিয়ে, যাতে ভাইরাস গুলো মরে যায়, তারপর এই নিষ্ক্রিয় নমুনা থেকে আরএনএ আলাদা করা হয়। মুশকিল হল আরএনএ তো আরএনএ ই, মানে এই যে আলাদা করা হল এতে মানুষের আর ভাইরাস দু রকমের আরএনএ-ই থাকে।এবার এই আলাদা করা আরএনএ কে প্রথমে complementary DNA (cDNA) তে পরিনত করে নেওয়া হয়, আর এ কাজে যে এনজাইম লাগে তার নাম রিভার্স ট্রান্সক্রিপ্টেজ এনজাইম( reverse transcriptase enzyme) সাথে লাগে প্রাইমার আর সেই নাইনে পড়া এডিনিন, গুয়ানিন, থাইমিন আর সাইটসিন deoxyribonucleotide triphosphates(dNTP)। 
বোঝা গেল এতদূর, জলের মত। হ্যাঁ একটা কথা ভাইরাসের যে আরএনএ তারা উচ্চঘর, কংসরাজের বংশধর, তাতে সেই A T G C, দিয়ে যেন ছন্দ কবিতা লেখা থাকে। এবার ওই যে প্রাইমার যোগ করা হয়েছিল, সে আরএনএ এর ওপর বেশ আয়েস করে বসতে পারে, সেই আইসক্রিমের ওপর চেরি যেমন, তবে সে ভাইরাস আরএনএ এর ওপর বসবে না মানুষের আরএনএ এর ওপর বসবে তা নির্ভর করে তার ক্রমের(sequence) ওপর( মানে ধরা যাক সেই ছন্দ), মানে তা ভাইরাসের আরএনএ ছন্দর সাথে ভাল যাবে না মানুষের আরএনএ এর ছন্দের সাথে। আর যদি ভাইরাস আরএনএ এর ওপর বসে যায়( মানে সেই খাপে খাপ মন্টুর বাপ), সেই যে রিভার্স ট্রান্সকিপ্টেজ এনজাইম বলেছিলাম না, তা dNTP       
গুলোকে জুড়ে জুড়ে ভাইরাস আরএনএ এর ক্রমানুসারে( মানে as per sequence) cDNA বানাতে থাকবে, (মানে করোনা ভাইরাস আরএনএ না থাকলে এই cDNA ও তৈরি হতে থাকবে না)। এক বার cDNA তৈরি হয়ে গেলে , আর একটা শক্তপোক্ত robust ( আগের এনজাইমের তুলনায় শক্তিশালী ) TAQ পলিমারেজ নামে এনজাইম টাকে  আরও বেশ কয়েক বার কপি করে দেয়। এই এমপ্লিফায়েড কপিগুলো ডাই এর সাথে জুড়ে বিশেষ রঙ মানে কালার ইন্ডিকেশন দেয় যাতে বোঝা যায় সেই লালারসে কারোনা ভাইরাস ছিল কিনা! এই কপি বানানো যাকে বলছি এমপ্লিফিকেশন, যে মেশিনে করা হয় তা হল, RT-PCR (Real Time Polymerase Chain Reaction) machine. মোদ্দা কথা অনেকটা সেই ছেলেবেলার জলছবির মত, কাগজের ওপর জলছবি রেখে পয়সা দিয়ে জলছবি ঘষলে আস্তে আস্তে সেই ছবির অবয়ব কাগজের ওপর স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হতে থাকে। এখানেই অনেকটা তাই, যদি লালারসে সেই ভাইরাস থাকে সেটা ওই দুই এনজাইমের উপস্তিতিতে জানান দেয় সে আছে, মানে পজিটিভ।
এই সমস্ত উপাদান , প্রাইমার আর উপযুক্ত বিক্রিয়া মাধ্যম- এই সব মিলিয়ে বলা হয় কিট। 

এই যন্ত্র আগে তো তেমন দরকার ছিল না মূলত কিছু গবেষণাগারে আর বড় মেডিক্যাল কলেজে থাকত, প্রধানত বিদেশী, এখন দেশেও তৈরি হচ্ছে। ছোট আর বড় দু ধরনের যন্ত্রে যথাক্রমে ৯৬ আর ৩৮৪ খানা নমুনা এক এক বারে পরীক্ষা করা যায়। এই পরীক্ষা এক একটা সাইকেল চার ঘণ্টা লাগে, মানে দিনে কমবেশি চারবার চালাতে পারলে ১৫০০ নমুনা পরীক্ষা করা যায়। আর কিট এখন অনেক সংস্থা বানাচ্ছে এ দেশেই।

মানে ১০০ টা যন্ত্রে দিনে প্রায় দেড় লক্ষ নমুনা পরীক্ষা করতে পারবে। সেই অনুসারে বিভিন্ন হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারকে অনুমতি দেওয়া হচ্ছে (ICMR এ অনুমতি দিচ্ছে), তারা তৈরি হচ্ছে অনেকে শুরুও করে দিয়েছে।ন্যাশনাল ইন্সটিটুট অফ ভাইরলজি ( NIV pune) আর  NCDC Delhi প্রথমে নতুন তৈরি করা কিট গুলো পরীক্ষা করে দেখে, পাস করলে ছাড়পত্র দেয় আর সেই সংস্থা কিটের বানিজ্যিক উৎপাদন শুরু করে।  

আমি গরিব আদমি আছি, এসব বিজ্ঞান টিজ্ঞান বড় ভয়, বুঝিও না, আমি ওপর ওপর( ভেতরে ঢুকলে কিছুই বুঝব না সেজন্য)  কিছু বুঝি উচ্চশিক্কিত বন্ধুদের জ্ঞানের বিচ্ছুরণ থেকে! আমাদের অনুজ সৌভিক আর দেবজ্যোতি, দিল্লীর এমন একটা গবেষণাগারের দলবলের সদস্য। সেই দল এই ট্রেনিং তত্বাবধান করছে গত ১৫ দিন ধরে, সে অনেক দৌড়াদৌড়ি, মাঠে নেমে কাজ, ভলেন্টিয়ার  তৈরি করা, হাসপাতালের সাথে যোগাযোগ রাখা, ল্যাবরেটরির তত্ত্বাবধান করা, ওদিকে ওপর মহলের  অফিসে আপডেট দেওয়া, মাল মসলার ( মানে ইনগ্র্যাডিয়েন্ট, কিটের) অর্ডার দেওয়া ইত্যাদি ইত্যাদি।

এনিওয়ে জাস্ট জানিয়ে রাখলাম আর কি, চলুন আমরা ফেসবুক, টুইটার কি হোয়াতে জুজু জুজু খেলি, সংখ্যা নিয়ে খেলি( বাজারে এত আই এস আই ফেরত বি স্টাট, এম স্টাট ঘুরঘুর করছে, ফটাস করে লাল নীল উঁচু নিচু সব গ্রাফ এক তুড়িতে এক্স আর ওয়াই অক্ষ বরাবর প্লট করে বলে দিচ্ছে আগামী পরশু কেরলে কজনের টেস্ট পজিটিভ হবে!!!  ),তর্ক করি ( মানে ফেসবুক ফ্রম হোম)।

সবাই সাবধানে থাকুক,যারা মাঠে নেমে কাজ করছেন স্যালুট তাদের আর যথাসম্ভব সাবধানে কাজ করুন। উই শ্যাল ওভারকাম।

শনিবার, ২৮ মার্চ, ২০২০

দ্য ওয়ার্ল্ড আফটার করোনা ভাইরাস ~ ইউভ্যাল নোহা হারারি

বিশ্বব্যাপী সঙ্কটের মুখোমুখি মানবসমাজ। সম্ভবত আমাদের প্রজন্মের সবচেয়ে বড় সঙ্কট। সামনের কয়েকটা সপ্তাহে সাধারণ মানুষ আর সরকারগুলো যা যা সিদ্ধান্ত নেবে, তা সম্ভবত আগামী বেশ কয়েকটা বছর ধরে সারা পৃথিবীকে প্রভাবিত করবে। শুধু স্বাস্থ্য-পরিসেবা নয়, গভীর ভাবে প্রভাবিত হবে আমাদের অর্থনীতি, রাজনীতি, এমনকি সংস্কৃতিও। যা করার, তা দ্রুত করতে হবে। ডিসিসিভলি করতে হবে। আজকে আমরা যা করবো, আগামীদিনে তার সুদূরপ্রসারী প্রভাব থেকে যাবে। শুধু অল্টারনেটিভ বেছে নেওয়া নয়, নিজেকে প্রশ্ন করুন, এই ঝড়-ঝাপটা কেটে গেলে ঠিক কি রকম পৃথিবীকে আপনি দেখতে চান। হ্যাঁ, যে ঝড়টা এসেছে সেটা কেটে যাবে, মানবসমাজ উঠে দাঁড়াবে, এমনকি আমি-আপনি সহ আমাদের মধ্যে বেশীরভাগ মানুষ বেঁচে-বর্তেও থাকবে ... তবে সেটা এক নতুন পৃথিবীতে!  
   
আজকে যেগুলো আপনি 'শর্ট-টার্ম এমারজেন্সি পদক্ষেপ' হিসাবে দেখছেন, তার অনেকগুলোই কিন্তু ভবিষ্যতে থেকে যাবে। 'এমারজেন্সি'-র মজাই তাই। এই পদক্ষেপগুলো ইতিহাসের চাকাকে ঝপ্‌ করে অনেকটা এগিয়ে দেয়। নর্মাল সময়ে যে ডিসিশন-গুলো নিতে বছরের পর বছর লেগে যায়, সমাজ জুড়ে তর্ক-বিতর্ক চলে, এমারজেন্সি-সিচুয়েশনে সেই ডিসিশন-গুলো নিয়ে ফেলাটা জাস্ট কয়েক ঘন্টার মামলা। ইম্‌ম্যাচিওর, এমনকি ভয়ঙ্কর কিছু টেকনোলজিকেও এই সময় আমরা ছাড়পত্র দিয়ে ফেলি, কারন হাত-পা গুটিয়ে কিছু না করে বসে থাকার বিপদ তার চেয়েও বেশী। তখনকার মতো আস্ত একটা দেশ হয়ে ওঠে লার্জ স্কেল সোশ্যাল এক্সপেরিমেন্টের গিনিপিগ মাত্র। কেমন হবে, সমস্ত ক্ষেত্রে যদি 'ওয়ার্ক ফ্রম হোম' চালু হয়? কিংবা ধরুন দূর থেকে কম্যুনিকেট করাটাই যদি নিয়ম হয়ে দাঁড়ায়? কেমন হবে, যদি সমস্ত স্কুল-কলেজ-ইউনিভার্সিটিগুলোকে অনলাইন করে দেওয়া হয়? নর্মাল সময়ে সরকার, এডুকেশনাল বোর্ড অথবা ব্যবসায়ীরা এ'সব কথা ভুলেও ভাববে না। কিন্তু এটা নর্মাল সময় নয়। এই সঙ্কট-মুহূর্তে দুটো ক্ষেত্রে আমাদের অপশন বেছে না নিয়ে উপায় নেই। প্রথমটা হলো 'সর্বগ্রাসী নজরদারি' এবং 'নাগরিক ক্ষমতায়নের' মধ্যে। দ্বিতীয়টা হলো 'জাতীয়তাবাদী বিচ্ছিন্নতা' ও 'বিশ্বব্যাপী সংহতির' মধ্যে। 
    
*চামড়ার নীচে নজরদারি*  
আজকের মহামারী রুখতে গেলে, সবাইকেই নির্দিষ্ট একটা গাইডলাইন বাধ্যতামূলক ভাবে মেনে চলতে হবে। দু'ভাবে এটা করা যায়। তার মধ্যে একটা হলো, সরকার সর্বত্র নজরদারি করুক এবং নিয়ম ভাঙলেই কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করুক। মানব-ইতিহাসে এই প্রথম টেকনোলজিকে কাজে লাগিয়ে সেটা সম্ভবও বটে। মাত্র ৫০ বছর আগেও কে.জি.বি-র পক্ষে সোভিয়েত ইউনিয়নের ২৪০ মিলিয়ন নাগরিকের ওপর ২৪ ঘন্টা ধরে নজরদারি চালানো সম্ভব ছিলো না। সমস্ত নাগরিকদের সম্পর্কে গাদা গাদা ইনফর্মেশন জোগাড় করে সেই বিপুল তথ্যকে প্রসেস করাটা তো ছিলো কল্পনারও অতীত। এই কাজগুলো করার জন্য কে.জি.বি-কে তখন কিছু চর তথা অ্যানালিস্টের ওপরেই ডিপেন্ড করতে হয়েছিল। আর এটাও ঠিক, যে দেশের সবগুলো মানুষের পেছনে একটা করে চর লাগানোটা জাস্ট অসম্ভব ছিলো। কিন্তু আজকের দিনের সরকারগুলো ঠিক এই কাজটাই নিঃশব্দে করে ফেলতে পারে সর্বব্যাপী সেন্সর আর শক্তিশালী অ্যালগোরিদমকে কাজে লাগিয়ে। নাঃ, একটাও রক্ত-মাংসের মানুষ লাগবে না!  

করোনা-ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়তে ইতিমধ্যেই বেশ কিছু দেশের সরকার এই রাস্তায় হাঁটছে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো চীন। সাধারণ মানুষের স্মার্টফোনে নিবিড় নজরদারি চালিয়ে, কোটি কোটি ফেস-রেকগনাইজিং ক্যামেরাকে কাজে লাগিয়ে, এবং মানুষকে তাদের শরীরের তাপমাত্রা থেকে শুরু করে অন্যান্য মেডিকেল-রিপোর্ট দিতে বাধ্য করে সরকার অত্যন্ত দ্রুত করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত লোকজনকে চিহ্নিত করতে পেরেছে। তাদের গতিবিধিকে ট্র্যাক করতে পেরেছে। কারা কারা তাদের সংস্পর্শে আসছে, সেটাও ঝপ্‌ করে আইডেন্টিফাই করে ফেলতে পেরেছে। মোবাইল অ্যাপেই নাগরিকদের জানিয়ে দেওয়া হয়েছে যে একজন করোনা-ইনফেক্টেড মানুষের থেকে তিনি কতোটা দূরত্বে আছেন।

এই ধরনের টেকনোলজির ব্যবহার আজ কেবল পুর্ব-এশিয়াতেই সীমাবদ্ধ নেই। ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু সম্প্রতি করোনা-আক্রান্তদের চিহ্নিত করতে সে'দেশের সিকিউরিটি এজেন্সিকে এমন একটি নজরদারি-প্রযুক্তি ব্যবহার করার অনুমোদন দিয়েছেন, যা সাধারনত টেররিস্টদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয়। কিছু পার্লামেন্ট সদস্য এই নিয়ে আপত্তি জানালে তিনি পত্রপাঠ 'এমারজেন্সি-ডিক্রি' জারি করে ব্যাপারটি চালু করে দেন। 

আপনি বলতেই পারেন, এ আর এমন নতুন কথা কি? আজকালকার দিনে সরকার এবং কর্পোরেট সংস্থাগুলি এর চেয়েও শক্তিশালী প্রযুক্তি ব্যাবহার করছে মানুষকে ট্র্যাক করার জন্যে, নজরে রাখার জন্যে, ম্যানিপুলেট করার জন্যে। কিন্তু তবুও বলবো, আমরা যদি সতর্ক না হই, তাহলে অচিরেই এই মহামারীটি 'মানুষের ওপর নজরদারি চালানোর' ইতিহাসে একটা গুরুত্বপূর্ণ মোড় হয়ে উঠবে। কারন, দু'দিন আগেও যাঁরা রাষ্ট্রের এই নজরদারি-ব্যবস্থাটির সোচ্চার বিরোধিতা করতেন, অ্যাবনর্মাল সিচুয়েশনে পড়ে তাঁরাও আজ নিজের থেকেই ব্যাপারটি নিপাট ভালো মানুষের মতো মেনে নিয়েছেন। তার চেয়েও বড় কথা হলো, সমগ্র নজরদারি-ব্যবস্থাটি 'চামড়ার ওপর' থেকে তার দৃষ্টিকে গেঁথে দিচ্ছে আরও গভীরে, 'চামড়ার ভেতরে'! এর আগে পর্যন্ত, আপনার আঙুলটি একটি মোবাইল ফোনের স্ক্রিন টাচ্‌ করলে অথবা কোনও লিঙ্কে ক্লিক করলে সরকার বড়জোর জানতে পারতো যে আপনি কোন্‌ লিঙ্কে ক্লিক করেছেন। এখন সরকার আপনার আঙুলের তাপমাত্রা এবং চামড়ার নীচের ব্লাড-প্রেশারও জানতে পারবে। ড্রামাটিক চেঞ্জই বটে!  

*এমারজেন্সি পুডিং*
মুশকিল হলো, আজকের নজরদারি-ব্যবস্থায় আমরা কেউই জানি না যে ঠিক কিভাবে আমাদের জরীপ করা হচ্ছে, অথবা আগামী দিনেই বা ঠিক কি কি ঘটতে চলেছে। নজরদারি-প্রযুক্তি সাংঘাতিক দ্রুতবেগে ডেভালপ করছে। ১০ বছর আগেও যেগুলো কল্পবিজ্ঞানের গপ্প মনে হতো, আজ সেগুলো নিছকই প্রস্তর-যুগের প্রযুক্তি বলে মনে হয়। কল্পনার খাতিরে, মনে করুন সরকার বললো যে প্রত্যেক নাগরিককে একটা করে 'বায়োমেট্রিক-ব্রেসলেট' পরতে হবে, যা ২৪ ঘন্টা ধরে আপনার ব্লাড-প্রেসার এবং শরীরের তাপমাত্রা মাপবে। সেই তথ্যগুলো তারপর অ্যালগোরিদমে ফেলে সরকার খতিয়ে দেখবে। আপনি অসুস্থ কিনা, সেটা আপনি নিজে টের পাওয়ার আগেই অ্যালগোরিদমগুলি ব্যাপারটা বুঝে ফেলবে। আপনি কোথায় কোথায় ছিলেন, কার কার সাথে দ্যাখা করেছেন, সেটাও সরকার পরিষ্কার বুঝতে পারবে। ইনফেকশনের চেন-কে এই পদ্ধতিতে ছোট করে আনা, এমনকি একেবারে কেটে ফেলাও সম্ভব। এই ধরনের একটা সিস্টেম মাত্র কয়েক দিনের মধ্যেই করোনার মতো মহামারী রুখে দিতে পারে। ফাটাফাটি ব্যাপার, তাই না? 

কিন্তু সমস্যাটা হলো, এটাই আবার একটা ভয়াবহ নজরদারি-ব্যবস্থাকেও সমাজে বৈধতা দেবে। এদ্দিন পর্যন্ত আমি মোবাইলে 'ফক্স নিউজের' একটি ভিডিও লিঙ্কে ক্লিক করেছি, নাকি 'সি.এন.এন'-এর, তা থেকে আপনি বড়জোর আমার রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে বুঝতে পারতেন, কিংবা খুব বেশী হলে আমার ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে। কিন্তু এবার আপনি তার সাথে সাথে আমার হার্ট-রেট, ব্লাড-প্রেসার অথবা বডি-টেম্পারেচার দেখে এটাও বুঝতে পারবেন যে ওই ভিডিওটি দেখে আমি হাসলাম, কাঁদলাম, নাকি প্রচন্ড রেগে গেলাম!    

মাথায় রাখতে ভুলবেন না, রাগ – আনন্দ – একঘেঁয়েমি – ভালোবাসা হলো জ্বর অথবা কাশির মতোই জৈবিক ক্রিয়াকলাপ। কাশি-শনাক্তকারী একই প্রযুক্তি হাসিকেও চিহ্নিত করতে পারে। কর্পোরেট সংস্থা অথবা সরকারগুলি যদি পাইকারি রেটে আমাদের এই বায়োমেট্রিক-ডেটা অ্যানালাইসিস করে, তাহলে আমাদের নিজেদের চেয়েও ভালোভাবে ওরা আমাদের বুঝতে পারবে। ওরা কেবল আমাদের অনুভুতিগুলির পূর্বাভাসই পাবে না, চাই কি সেগুলোকে ম্যানিপুলেটও করতে পারবে। এবং সর্বোপরি সেই পদ্ধতিতে ওরা আমাদের কাছে যা ইচ্ছে তাই বেচে দিতে পারে, সেটা একটা পণ্যই হোক, অথবা একটা বিশেষ রাজনীতি। বায়োমেট্রিক নজরদারির কাছে কেমব্রিজ অ্যানালিটিকার ডেটা-হ্যাকিং কৌশলও জাস্ট শিশু। ২০৩০ সালের উত্তর কোরিয়ার একটি সিচুয়েশন কল্পনা করুন। আপনার কব্জিতে বায়োমেট্রিক-ব্রেসলেট লাগানো রয়েছে। আপনি রাষ্ট্র-নায়কের ভাষণ শুনতে শুনতে ভীষণ রেগে উঠছেন। ওমনি বায়োমেট্রিক-ব্রেসলেট সেটা ধরে ফেললো। আপ্‌ তো গ্যায়া!  

এমারজেন্সি পরিস্থিতিতে একটি 'অস্থায়ী ব্যবস্থা' হিসাবে বায়োমেট্রিক-নজরদারিকে আপনি অবশ্যই অ্যালাউ করতে পারেন। কিন্তু এই 'অস্থায়ী ব্যবস্থা'গুলির একটা খারাপ স্বভাব হলো এমারজেন্সি কেটে গেলেও এরা বহাল তবিয়তে থেকে যেতে চায়। কারন, দেশে নিত্য-নতুন এমারজেন্সি পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার তো আর বিরাম নেই! আমার স্বদেশ ইজরায়েলে ১৯৪৮ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় এই রকম জরুরী অবস্থা জারি হয়েছিলো। তাতে প্রেস-সেন্সরশিপ থেকে শুরু করে জমি বাজেয়াপ্তকরন হয়ে পুডিং তৈরির পদ্ধতির ওপরেও (আমি একদম ইয়ার্কি মারছি না) কিছু 'অস্থায়ী বিধি-নিষেধ' আরোপিত হয়েছিলো। বহুদিন হয়ে গেলো স্বাধীনতা যুদ্ধে ইজরায়েল জিতেছে। তারপর থেকে আর কখনও জরুরী অবস্থা জারিও করেনি। কিন্তু ১৯৪৮ সালে জারি হওয়া সেই 'অস্থায়ী বিধি-নিষেধ'গুলোর মধ্যে বেশ কিছু পরবর্তীতে দিব্যি স্থায়ী ভাবেই রয়ে যায় (মাত্র এই সেদিন, ২০১১ সালে, সেদিনের সেই জরুরী 'পুডিং-ডিক্রি'টি সরকার দয়া করে বাতিল করলো)!   

করোনা ভাইরাসের প্রকোপ থেমে গেলেও বেশ কিছু দেশের তথ্য-লোভী সরকার বায়োমেট্রিক নজরদারি চালিয়েই যেতে চাইবে। তখন তাদের অজুহাত হবে, করোনা-সংক্রমণের সেকেন্ড ওয়েভ আসতে চলেছে ... অথবা মধ্য আফ্রিকায় একটি নতুন ইবোলা ভাইরাস ধরা পড়েছে ... অথবা অন্য কিছু। ব্যাপারটা নিজেই বুঝে নিন। আমাদের প্রাইভেসি বজায় রাখতে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে একটা বড় লড়াই চারদিকে শুরু হয়েছে। করোনা-সঙ্কট সেই লড়াইয়ে একটা টিপিং-পয়েন্ট হয়ে উঠতে পারে। 'প্রাইভেসি' আর 'হেলথ'-এর মধ্যে মানুষকে কোনও একটা বেছে নিতে বললে স্বাভাবিক ভাবে সে 'হেলথ'-কেই বেছে নেবে। 

*সাবান পুলিশ* 
কিন্তু মানুষকে 'প্রাইভেসি' আর 'হেলথ'-এর মধ্যে কোনও একটাকে বেছে নিতে বলাটাই বিরাট গোলমেলে ব্যাপার। এটা কি 'বেছে নেওয়ার' মতো কোনও বিষয় নাকি? 'প্রাইভেসি' আর 'হেলথ', এই দুটোই তো আমার চয়েস। এই দুটো জিনিসের ওপরেই তো আমার অধিকার থাকা উচিৎ। আমাদের স্বাস্থ্যকে সুরক্ষিত রাখতে এবং করোনা-সংক্রমণকে আটকাতে আমরা 'সর্বব্যাপী নজরদারি ব্যবস্থা'র বদলে 'নাগরিক ক্ষমতায়ন'কেও বেছে নিতে পারি। দক্ষিন কোরিয়া, সিঙ্গাপুর এবং তাইওয়ান এই পদ্ধতিতে করোনা-সংক্রমণ রুখতে দুর্দান্ত সাফল্য পেয়েছে। হ্যাঁ, এটা ঠিক যে কিছু কিছু 'নজরদারি ব্যবস্থা' ওরাও নিয়েছিলো। কিন্তু মূলত ওরা নির্ভর করেছিলো ব্যাপক টেস্টিং-এর ওপর, ওয়েল-ইনফর্মড নাগরিকদের স্বতঃস্ফূর্ত রিপোর্টিং এবং সহযোগিতার ওপর। 

কেন্দ্রীয় নজরদারি এবং কঠোর শাস্তির সাহায্যেই কেবল মানুষকে দিয়ে কার্যকারী-গাইডলাইন মানিয়ে চলানো যায়, এটা ভুল ধারনা। সরকার যদি নিষ্ঠার সাথে মানুষের কাছে বৈজ্ঞানিক ভাবে বিষয়গুলো তুলে ধরে, মানুষের কাছে সরকারের যদি বিশ্বাসযোগ্যতা তৈরি হয়, তাহলে ঘাড়ের ওপর সর্বক্ষণ কোনও 'বিগ ব্রাদার' নিঃশ্বাস না ফেললেও মানুষ গাইড-লাইন মেনে চলে। নিজের থেকেই। সাধারণ ভাবে বলতে গেলে একটি স্বতঃপ্রানিত এবং সচেতন জনগোষ্ঠী, পুলিশের ডান্ডার ভয়ে সিঁটিয়ে থাকা অজ্ঞ একটি জনগোষ্ঠীর তুলনায় অনেক বেশী কার্যকরী।   

'সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার' বিষয়টাকেই দেখুন। স্বাস্থ্যবিজ্ঞানে এটা একটা যুগান্তকারী ব্যাপার ছিলো। ছোট্ট এই পদক্ষেপটা আজও লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রাণ বাঁচিয়ে চলেছে। অথচ সেভাবে দেখলে মাত্র এই সেদিন, ১৯শতকে বিজ্ঞানীরা বিষয়টির গুরুত্ব বুঝতে পেরেছিলেন। তার আগে এমনকি ডাক্তার-নার্সরাও হাত-টাত না ধুয়েই একটার পর একটা অপরেশন করতেন। আজকে যে কোটি-কোটি মানুষ নিজের থেকেই রোজ সাবান দিয়ে হাত ধোয়, তার পিছনে কি কোনও 'সাবান-পুলিশের' চোখরাঙানি আছে? একদম নয়। বরং তারা সহজ-সরল একটা বৈজ্ঞানিক সত্যকে বুঝতে পেরেছে। আমি সাবান দিয়ে হাত ধুই, কারন আমি জানি যে ব্যাকটেরিয়া-ভাইরাসের মতো ক্ষতিকর জীবানুগুলো সাবান দিয়ে হাত ধুলে নষ্ট হয়ে যায়। সিম্পল। 

তবে গণ-সম্মতি এবং সহযোগিতার এ'রকম একটি স্তরে পৌঁছতে গেলে একটা বিষয় লাগবেই, সেটা হলো 'বিশ্বাস'। মানুষকে বিজ্ঞানের ওপর বিশ্বাস রাখতে হবে, সরকারি কর্তৃপক্ষের ওপর বিশ্বাস রাখতে হবে, মিডিয়ার ওপর বিশ্বাস রাখতে হবে। বিগত কয়েকটা বছর ধরে দায়িত্বজ্ঞানহীন রাজনীতিবিদরা ইচ্ছাকৃতভাবে বিজ্ঞানের বিশ্বাসযোগ্যতাকে, সরকারি কর্তৃপক্ষের বিশ্বাসযোগ্যতাকে এবং মিডিয়ার বিশ্বাসযোগ্যতাকে ধূলোয় মিশিয়ে দিয়েছেন। এখন সেই দায়িত্বজ্ঞানহীন লোকগুলোই আরও কর্তৃত্ববাদের রাস্তায় দেশকে নিয়ে যেতে পারে এই যুক্তিতে, যে, 'সঠিক রাস্তায় চলতে গেলে আম-পাবলিকের কথা শুনলে চলে না'!  

সাধারণভাবে, বছরের পর বছর ধরে একটু একটু করে নষ্ট হয়ে যাওয়া বিশ্বাস রাতারাতি ফিরে আসে না। তবে এটাও ঠিক যে এখন নর্মাল সময় নয়। সঙ্কটকালীন মুহূর্তে মনেরও দ্রুত পরিবর্তন ঘটে। আপনি বছরের পর বছর ধরে আপনার ভাই-বোনদের সাথে তিক্ত তর্ক-বিতর্ক চালিয়ে যেতে পারেন। কিন্তু পরিবারে একটা সঙ্কট আসুক। ওমনি দেখবেন পারস্পরিক আস্থা আর ভালোবাসার বন্ধন আপনাদেরকে পাশাপাশি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। সর্বব্যাপী নজরদারি-ব্যবস্থার বদলে বিজ্ঞান, সরকারী কর্তৃপক্ষ এবং মিডিয়ার ওপর মানুষের বিশ্বাস পুনর্নির্মাণ করতেও আবার খুব বেশি দেরি হয় না। আমাদের অবশ্যই নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করা উচিত, তবে এই প্রযুক্তিগুলো যেন নাগরিকদের ক্ষমতায়নকে নিশ্চিত করে। আমি অবশ্যই আমার শরীরের তাপমাত্রা এবং রক্তচাপ মনিটারিং-এর পক্ষে, তবে সেই ডেটা যেন কোনভাবেই একটা 'সর্বশক্তিমান সরকার' গঠনের জন্য ব্যবহার করা না হয়। বরং সেই ডেটা যাতে আমাকে আরও ওয়েল-ইনফর্মড একজন নাগরিক হিসাবে আমার চয়েস বেছে নিতে সাহায্য করে, এবং সরকারকেও তার পদক্ষেপের জন্য জবাবদিহি করতে বাধ্য করে। 

আমি যদি ২৪ঘন্টা আমার মেডিকেল-কন্ডিশন ট্র্যাক করতে পারি, তাহলে অন্যের জন্য আমি বিপদের কারন হয়ে উঠছি কিনা সেটা যেমন বুঝতে পারবো, তেমনি নিজের ভালোটাও একই সাথে খেয়াল করতে পারবো। আমি যদি করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার ব্যাপারে নির্ভরযোগ্য তথ্য অ্যাক্‌কেস করতে পারি, অ্যানালাইসিস করতে পারি, তাহলে সরকার এই সংক্রমণ রুখতে ঠিক কি কি করছে, সেটাও আমার কাছে জলের মতো পরিষ্কার হয়ে যাবে। মনে রাখবেন, যে প্রযুক্তি দিয়ে সরকার আমাদের ওপর নজরদারি করে, সেই একই প্রযুক্তি দিয়ে চাইলে আমরাও সরকারের ওপর নজরদারি চালাতে পারি।

করোনা-মহামারী, সেই হিসাবে নাগরিকত্ব-কেও একটা বড় পরীক্ষার সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। সামনের দিনগুলোতে আসুন আমরা নির্ভর করি কেবলমাত্র বিজ্ঞান-সম্মত তথ্য এবং স্বাস্থ্য-বিশেষজ্ঞদের ওপর, কোনও মতেই ভিত্তিহীন 'কন্সপিরেসি-থিওরি' অথবা স্বার্থপর রাজনৈতিক নেতাদের ওপর নয়। সঠিক চয়েসটা বেছে নিতে না পারলে হয়তো আমরা আমাদের পরম প্রিয় ব্যক্তি-স্বাধীনতাকে বিসর্জন দিয়ে ফেলবো স্রেফ এটা ভেবে, যে নিজের শরীর-স্বাস্থ্য সুরক্ষিত রাখতে এ'ছাড়া আমার আর অন্য কিছুই করার ছিলো না। 

*আমাদের একটা গ্লোবাল-প্ল্যান দরকার*
এবার আসা যাক দ্বিতীয় চয়েসটি প্রসঙ্গে। 'জাতীয়তাবাদী বিচ্ছিন্নতা' ও 'বিশ্বব্যাপী সংহতির' মধ্যে কোনটিকে আমরা বেছে নেবো? করোনা-সংক্রমণ এবং তজ্জনিত অর্থনৈতিক সঙ্কট, দুটোই হলো গ্লোবাল-ক্রাইসিস। দুনিয়া জোড়া সঙ্কট। কাজেই বিশ্বব্যাপী সহযোগিতার মাধ্যমেই একমাত্র এই সঙ্কট থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব। 

করোনা-সংক্রমণকে আটকাতে সবার আগে দরকার দুনিয়া জুড়ে তথ্যের অবাধ আদান-প্রদান। এই জায়গাটায় আমরা, মানুষরা, করোনা ভাইরাসের তুলনায় এগিয়ে। মানুষকে আক্রমণ করার ব্যাপারে চীনের একটি করোনা ভাইরাস, আমেরিকার একটি করোনা ভাইরাসকে কার্যকরী টিপ্‌স দিতে অক্ষম। কিন্তু চীনের মানুষ আমেরিকার মানুষকে করোনা-সংক্রমণ রোখার ব্যাপারে অনেক গুরুত্বপূর্ণ টিপ্‌স দিতে পারে। একজন ইতালিয়ান ডাক্তার সকালবেলায় মিলান শহরে বসে যা আবিষ্কার করলেন, তা সন্ধ্যের মধ্যেই তেহ্‌রানে অসংখ্য মানুষের প্রাণ বাঁচাতে পারে। যখন ইংল্যান্ডের সরকার অনেকগুলি আর্জেন্ট স্টেপের মধ্যে কোন্‌টি আগে নেওয়া উচিৎ তাই নিয়ে কনফিউশনে পড়ে, তখন কোরিয়া তাকে দারুণ ভাবে সাহায্য করতে পারে, যারা হয়তো মাসখানেক আগেই ওই একই সমস্যায় পড়েছিলো। এ'সব কিছুই অসম্ভব নয়, তবে তার জন্য সবার আগে আমাদের মধ্যে বিশ্ব-ব্যাপী সহযোগিতা ও বিশ্বাসের মনোভাব গড়ে তোলা দরকার। 

দেশগুলোকে নিজেদের মধ্যে ইনফর্মেশন শেয়ার করার ব্যাপারে মুক্ত মনে এগিয়ে আসতে হবে। নম্র ভাবে অন্য দেশের কাছে পরামর্শ চাইতে হবে। অন্য দেশের দেওয়া তথ্য এবং বিশ্লেষণগুলোকে খোলা মনে গ্রহণ করতে হবে। বিশ্বাস করতে হবে। টেস্টিং কিট এবং রেস্পিরেটরি মেশিনের মতো অত্যাবশ্যক মেডিকেল-ইক্যুইপমেন্টগুলি তৈরি করা এবং ছড়িয়ে দেওয়ার জন্যও আমাদের একটা গ্লোবাল উদ্যোগ নিতে হবে। প্রতিটি দেশ আলাদা আলাদা করে এই কাজটি নিজের চৌহদ্দিতে করার বদলে যদি একটি গ্লোবাল উদ্যোগকে ঠিক ভাবে কোঅর্ডিনেট করা যায়, তাহলে জীবনদায়ী যন্ত্রগুলির আরও ব্যাপক উৎপাদন ও প্রয়োজন অনুযায়ী সেগুলির বিতরন সম্ভব। একটি যুদ্ধের সময় দেশগুলি যেমন মূল শিল্পগুলিকে 'জাতীয়করণ' করে, তেমনি করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে মানব-যুদ্ধের সময় আমাদের গুরুত্বপূর্ণ উৎপাদন-লাইনকে 'মানবিক' করার প্রয়োজন হতে পারে। 'ন্যাশনালাইজ' করার বদলে দরকার হতে পারে 'হিউম্যানাইজ' করা। অল্প কিছু করোনা-আক্রান্ত রোগী আছে, এমন কোনও ধনী দেশকে স্বেচ্ছায় এগিয়ে এসে বহুমূল্য সরঞ্জাম পাঠিয়ে দিতে হবে সেই সব গরীব দেশে, যেখানে করোনা-আক্রান্তের সংখ্যা অনেক। সেই ধনী দেশকে এটা বিশ্বাস করতে হবে যে প্রয়োজনে সে-ও একই রকমের সাহায্য পাবে অন্য দেশগুলোর কাছ থেকে। 

চিকিৎসকদের একজোট করার জন্যও আমরা এ'রকম একটা গ্লোবাল-উদ্যোগ নিতে পারি। কম আক্রান্ত দেশগুলো তাদের চিকিৎসকদের পাঠাতে পারে বেশী আক্রান্ত দেশগুলোতে। তাতে, প্রয়োজনীয় সাহায্য করাও হবে, আবার সেই চিকিৎসকরা অমূল্য অভিজ্ঞতা অর্জন করে নিজের দেশে ফেরার পর সেটা কাজেও লাগাতে পারবেন। মহামারীর ভরকেন্দ্র উল্টে গেলে, সাহায্যের গতিমুখকেও উল্টে দিতে হবে।     

অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও এই একই রকমের গ্লোবাল-সহযোগিতা প্রয়োজন। গ্লোবাল-ইকোনমির যুগে প্রতিটি দেশের সরকার যদি অন্যের স্বার্থকে উপেক্ষা করে খালি নিজের স্বার্থ দেখে, তাহলে সামগ্রিক ভাবে ক্যাওস বাড়বে বৈ কমবে না; দুনিয়া জোড়া অর্থনৈতিক সঙ্কট আরও গভীরই হতে থাকবে। আমাদের একটা গ্লোবাল-প্ল্যান-অফ্‌-অ্যাকশন চাই। এবং সেটা এক্ষুনি।

আরও একটা জিনিস দরকার। সেটা হলো পৃথিবীর এ'প্রান্ত থেকে ও'প্রান্তে যাতায়াত করার জন্য একটি গ্লোবাল-বোঝাপড়া। মাসের পর মাস ধরে আন্তর্জাতিক যাতায়াত বন্ধ করে রাখলে তা পরিস্থিতিকে আরও বিগড়ে দেবে। করোনা-সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াই তাতে আখেরে দূর্বলই হবে। গুরুত্বপূর্ণ বিজ্ঞানী, চিকিৎসক, সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ীদের একটি লিস্ট বানিয়ে তাঁদের এক দেশ থেকে অন্য দেশে যাতায়াত করার ব্যাপারে সবাই সবাইকে সহযোগিতা করুক, এটাই কাঙ্খিত। একটা কমন বোঝাপড়ার ভিত্তিতে প্রথমে প্রতিটা দেশ তার নিজের দেশের এই ধরনের মানুষদের স্বাস্থ্য-পরীক্ষা করুক, যাঁরা অন্য দেশে যাবেন। আপনি যখন নিশ্চিত হবেন যে ভালো ভাবে পরীক্ষা করা একদল নীরোগ, সুস্থ-সবল কাজের মানুষই কেবল প্লেনে করে আপনার দেশে আসছে, দেখবেন আপনার টেনশনও কমবে। আপনিও তাতে উৎসাহীই হবেন। 

দুঃখের বিষয়, বর্তমানে খুব কম দেশই এ'সব নিয়ে ভাবছে। আন্তর্জাতিক ভাবেই আমরা প্যারালাইসড হয়ে পড়ছি। মনে হচ্ছে একটা বদ্ধ ঘরে কিছু বাচ্চা আটকে পড়েছে, যেখানে বড়রা কেউ নেই। গত সপ্তাহে সারা পৃথিবীর বড় বড় রাষ্ট্রনায়কদের একটা এমারজেন্সি মিটিং হবে বলে মনে হয়েছিলো, যাতে করে অন্তত একটা কমন প্ল্যান বানানো যায়। এই সপ্তাহে জি-সেভেনের নেতারা কোনোক্রমে একটা ভিডিও-কনফারেন্স করেছেন বটে, কিন্তু কাজের কাজ কিস্যুই হয়নি। 

অতীতে এই ধরনের সঙ্কটকালীন পরিস্থিতিতে, যেমন ২০০৮ সালের অর্থনৈতিক সঙ্কটই হোক অথবা ২০১৪ সালের ইবোলা-মহামারী, আমেরিকা একটা বিশ্ব-নেতৃত্বসুলভ ভূমিকা গ্রহণ করেছিলো। এবারে নেতার ভূমিকা থেকে সে পরিষ্কার ইস্তফা দিয়ে দিয়েছে। মার্কিন-মহত্ত্বকে আঁকড়ে ধরাই এখন তার কাছে প্রায়োরিটি, বিশ্ব-মানবতার ভবিষ্যতের চেয়েও। 

এই মার্কিন প্রশাসন এমনকি তার ঘনিষ্ঠ বন্ধুদেরও ত্যাগ করেছে। ইউরোপিয়ন ইউনিয়ন থেকে আমেরিকায় ঢোকার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করার আগে এরা একবার বিষয়টা আগাম জানানোর পর্যন্ত প্রয়োজনীয়তা বোধ করেনি। জার্মানির একটি ফার্মাসিউটিক্যাল সংস্থাকে ১বিলয়ন ডলার দিয়ে করোনা ভাইরাসের ভ্যাক্সিনের একচেটিয়া অধিকার কিনতে চেয়ে এরা জার্মানিকেও কলঙ্কিত করেছে। এমনকি এই মার্কিন প্রশাসন আজ যদি হঠাৎ ভোল পালটে কোনও গ্লোবাল-প্ল্যান নেয়ও বা, তাহলেও খুব কম দেশই তাকে নেতা বলে মানবে, যে নেতা আবার কখনোই কোনও দায়িত্ব নেয় না, যে নেতা কখনোই নিজের ভুল স্বীকার করে না এবং যে নেতা সবসময়েই অন্যের ঘাড়ে সমস্ত দোষ চাপিয়ে ক্রেডিটের পুরোটা নিজে মেরে দেয়। 

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই ফেলে যাওয়া শূন্যস্থানকে যদি দ্রুত অন্য দেশগুলি পূরণ করতে না পারে, তাহলে বর্তমান মহামারীটিকে সামলানো তো কঠিন হবেই, তার সাথে সাথে আন্তর্জাতিক সম্পর্কগুলোও আগামী দিনে আরও বিষিয়ে উঠবে। প্রতিটি সঙ্কট তবু একটি সুযোগকেও সামনে আনে। আমরা আশা করবো করোনা-মহামারী, পৃথিবীর দেশে-দেশে বর্তমান বিভেদের সাংঘাতিক বিপদটা সম্পর্কে মানবজাতিকে সতর্ক করবে।

বিশ্ব-মানবতার সামনে আজ দুটো রাস্তা খোলা। যে কোনও একটা বেছে নিতে হবে। আমরা কি বিভেদ-বৈষম্যের সঙ্কীর্ণ পথেই পা বাড়াবো? নাকি বিশ্ব-সংহতির পথে? যদি আমরা অনৈক্যের পথ বেছে নিই, তাহলে তা শুধু এখনকার সঙ্কটকেই দীর্ঘায়িত করবে না, ভবিষ্যতে এর চেয়েও আরও খারাপ সঙ্কটকে ডেকে আনবে। আর আমরা যদি বিশ্ব-ব্যাপী সংহতি তথা সৌভ্রাতৃত্বের পথকে বেছে নিই, তাহলে তা শুধু করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধেই নয়, ভবিষ্যতের সমস্ত মহামারী তথা সঙ্কটের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আমাদের জয়কে নিশ্চিত করবে। একবিংশ শতাব্দীতে গভীর ভাবে প্রভাবিত হবে গোটা মানব জাতি।

**********************************************

ইউভাল নোহা হারারি একজন ইজরায়েলি ঐতিহাসিক। "সাপিয়েন্স" গ্রন্থটির জন্য মূলত বিশ্ব ওনাকে চিনেছে। সম্প্রতি উনি The world after corona virus শীর্ষক একটি আর্টিকেল প্রকাশ করেন। আর্টিকেলটির বঙ্গানুবাদ করেছেন বিশ্বজিৎ হাজরা। বঙ্গানুবাদ এবং আর্টিকেল লিঙ্ক দুটোই দিলাম আগ্রহীরা পড়তে পারেন।

~ অনির্বান মাইতি