বৃহস্পতিবার, ৩ অক্টোবর, ২০১৯

বাংলায় এনআরসি ~ সেঁজুতি দত্ত

যেদিন প্রথম আসামে এনআরসির লিস্ট বেরোল, খুব সম্ভবত শতাক্ষীর "স্ট্রেঞ্জ ফ্রুট"-এর প্রথম শো দেখে বাড়ি ফিরেছি। এক বছর বা দুবছর আগে…মনে পড়ছে না। বাড়ি আসতে আসতেই ভাবছিলাম ওর কাজটা নিয়ে লিখবো। কিন্তু আসামের খবর পড়ে এতটাই অপমানিত লেগেছিল যে কয়েকদিন আর কিছু করতেই পারলাম না। হয়ত তখনও এতটাই সরল ছিলাম যে রাগের থেকে অপমানটা বেশি গায়ে লেগেছিল। হয়ত ভেবেছি যে বাংলায় এনআরসি হওয়া তো দূরের কথা, ভাবাও যাবে না। একটা গোটা জাতি, যারা নিজেদের উদ্বাস্তু সত্তা নিয়ে গর্ব করেন, সেখানে এধরণের কিছু ঘটাতে চাইলে রাজপথে আগুন জ্বলবে। তাই আসামের পসিবল ঠাইহীন মানুষগুলির পক্ষ নিয়েছিলাম শুধু। ভেবেছিলাম, আমার মত ওই মানুষগুলোরও বেঁচে থাকার অধিকার, নাগরিকত্বের অধিকার থাকা উচিৎ। 

কিন্তু রাজনীতি বড়ই চালাক জিনিস। তখন অনেকেই এটাকে শুধু বাংলাবিদ্বেষী তকমা দিয়ে থেকে গেলেন। এই রাজ্যের শাসক গোষ্ঠীও তাই করলেন যতদূর মনে আছে। এই যে এখন এনআরসি নিয়ে এত আলোচনা, কথা, আমাদের দৈনন্দিনতায় চলে এসেছে, সেরকম যে হতে পারে সেটা নিয়ে কেউ চিন্তিত হলেন না, পাবলিক ওপিনিয়ন তৈরি করতেও সাহায্য করলেন না। ওদিকে যখন এই থ্রেট ঘরের দোরে চলে এসেছে তখনও, এবছর ভোটের সময়, লেফট দলগুলো এটাকে নির্বাচনি প্রচারের হাতিয়ার করলেন না। তার ফলস্বরূপ, ঠিক পূজার আগে শাহবাবুকে এ রাজ্যে আসতে হয় নন-মুসলমান মানুষদের আশ্বস্ত করবার জন্য।

আসা করি আমরা এবারে নিশ্চিন্তে আছি। সবই ভোটের খেলা। একের পর এক মানুষ আতংকে আছেন, আত্মহত্যা করছেন আর ওদিকে ঘোষিত সংখ্যাগুরুর দলনেতা বলছেন মানুষের লাশের ওপর দিয়ে এনআরসি হবে। তবে আমার বিশ্বাস, যে দল উনি করেন এবং সেখানে জাতপাত এবং 'বিধর্মী' নিয়ে প্রকাশ্যেই তাদের যে রূপ দেখা যায়, সেখানে হয়ত তারা ওই লাশের মধ্যেও দলিত আর মুসলমানের লাশ এড়িয়ে যাবেন। এটাই আশার, যে ওই মৃত মানুষগুলিকে হয়ত মরণোত্তর সাবর্ণ-হিন্দু-লাথি খাবার মত অপমান সইতে হবে না।

মুষ্টিমেয় কিছু মানুষ, সেই আসাম এনআরসির সময় থেকেই সিঁদুরে মেঘ দেখেছিলেন। তারা এখনও গলায় রক্ত তুলে বিরোধিতা করে চলেছেন। একটু যদি চেষ্টা করে হিন্দু আর নন-হিন্দু বাইনারি থেকে বেরনো যায় তাহলে কিন্তু এই লড়াই যেতা সম্ভব। যারা সংবিধানে বিশ্বাস রাখেন তারা অন্তত আর্টিকেল ১৫র দোহাই দিয়ে এই রক্তের দাগ নিজেদের হাতে লাগতে দেবেননা প্লিজ। যারা এই সংবিধান নির্মাণের কাণ্ডারি আম্বেদকরের ভাবনা এবং দর্শন শুধুই জেনারেল নলেজের মধ্যে আটকে রেখেছেন, তারাও অন্তত শুধুই ঠিকভুলের লজিকে এর বিরোধিতা করুন। যারা হই হই করে কাল গান্ধী বাবার নাম করলেন তারা একটু ভেবে দেখুন এরকম স্বচ্ছ ভারত আপনারা চান কিনা। আর যারা প্রকৃত উদ্বাস্তু অথবা বেআইনি ঘুসপেটিয়া, একবার ধর্মের লাথি খেয়ে নিজের দেশ ছেড়েছেন, তারা অন্তত ওই একই জিনিস একইভাবে আপনার পাশের মানুষটির সাথে হতে দেবেন না। 

শুনলাম শাহবাবু বলেছেন বাংলায় এতো ভোট না পেলে কাশ্মীরের এই হাল নাকি করে উঠতে পারতেন না। বুঝে দেখুন একবার, আর 'নট ইন মাই নেম' বলতে পারবেন না কিন্তু। এই মেজরিটি নিয়েই কিন্তু সিএবি (সিটিজেনশিপ অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট) আনতে চলেছে ওরা। দায় কিন্তু আছে। এই অ্যাক্ট না আনলে কিন্তু আইনত 'মুসলমান'দের 'তাড়ানো'-ই সম্ভব নয়। অর্থাৎ এই 'তাড়ানো'-র আকাঙ্খা মানুষ খুন করার মতই অসাংবিধানিক এবং আইনবিরুদ্ধ। সংবিধান কিন্তু ধর্মভিত্তিক সেগরিগেশনের অধিকার দেয় না। একমাত্র এই সংবিধানকে পাল্টে ফেললেই স্বচ্ছ হিন্দু রাষ্ট্র বানানো সম্ভব। কাশ্মীর থেকে এনআরসি, গণতান্ত্রিক দেশের সরকার কিন্তু বাংলার ভোটদাতাদেরই ধন্যবাদ জানাচ্ছে। আবার বাংলার কিন্তু ইতিহাসে নাম লেখাবার সময় হয়ে এসেছে। আজকে বুড়ো আঙুল দেখালে, কে জানে, কাল আপনাকে নিয়েই স্বাধীন ভারতের আরেক ইতিহাস রচিত হবে। একবার লাথি খেয়েছেন, এবারে আর লাথি দেবেন না। পেছন থেকে ছুরি না মারলে দেখবেন হাত শক্ত হবে, সবাই পাশে থাকবে। 
বাঙালি সংখ্যাগুরুর পুজো ভালো কাটুক।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন