মিস্টার পার্থ চট্টোপাধ্যায় হাও ইস দা জোশ? ২০১৩, বেহালা। তৃণমূল সরকারের দ্বিতীয় বর্ষপূর্তির জনসভা। আপনি তখন শিক্ষামন্ত্রী, আপনি তখন হুকুমত, আপনার তখন হেব্বি রোয়াব! মঞ্চ কাঁপিয়ে, গলা ফাটিয়ে আপনি বললেন,
- ২০০৭-এ শালবনীতে কি একটা পটকা ফাটল, আর বুদ্ধ ধুতি তুলে দৌড় মারল! জ্যোতি ডুবে গেছে, বুদ্ধ বুদ্ধু হয়ে গেছে, আজকাল সুজ্জ্যি মামা ডোবে আর ওঠে! সিপিএম এখন মায়ের ভোগে!
মনে পড়ে? আজ সকালে ইডির অফিসাররা যখন আপনাকে বগল দাবা করে গাড়িতে চাপিয়ে মামাবাড়ি নিয়ে যাচ্ছিল, ২৭ ঘণ্টা ইডির জেরার বাউন্সারে আপনি যখন বিধ্বস্ত, রণক্লান্ত; তখন আপনার সেদিনের ঐ বাচালতাটা বড্ড মনে পড়ছিল! কোথায় আপনার সেই মাঞ্জা দেওয়া পাঞ্জাবি, পায়ে নাইকির ব্র্যান্ডেড স্পোর্টস সু, যত্ন করা ফ্রেঞ্চ কাট, হুঁশ করে চলে যাওয়া লাল বাতি গাড়ি, সামনে পাইলট পিছনে ব্ল্যাক ক্যাটের ফেরেকবাজি? 'আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম!' তাই না মিস্টার পার্থ চট্টোপাধ্যায়?
এই তো আজ বিকেলে রিপন স্ট্রিটের বাসস্ট্যান্ডে শুনলাম এক ভদ্রলোক চিৎকার করে বলছেন 'শালা রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রীটা চোর। ৩৪ বছরে এমন দেখতে হয়নি।' বাকিরা সবাই চুপ করে শুনছেন। মিস্টার পার্থ চট্টোপাধ্যায় রাস্তা ঘাটে লোকে আপনাকে চোর বলছে! আপনার কেমন লাগছে শুনতে?
কি করবেন বলুন? আসলে রাজ্যের প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী কে দুর্নীতির দায়ে ইডি জেরা করছে, প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রীর ঘনিষ্ঠর ফ্ল্যাট থেকে দু'হাজার, পাঁচশো টাকার নোটের পাহাড় আবিষ্কার হচ্ছে -এসব তো বাঙলার মানুষ আগে দেখেনি। প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রীর ঘনিষ্ঠর দক্ষিণ কলকাতার কেতাদুরস্ত আবাসনে ঘুষের আর তোলাবাজির টাকা গোনার জন্য ইডি'র আধিকারিকরা মেশিন আনতে বাধ্য হচ্ছে -বাঙলার মানুষ আগে দেখেনি।
ইডি-সিবিআইর গদাইলস্করি চাল, প্রচুর টাকা বিদেশে পাচার; তারপরেও শুধু একজন ঘনিষ্ঠর বাড়ি থেকে উদ্ধার হওয়া টাকার পরিমাণ ২০কোটির বেশি! ডলার, সোনা, মোবাইল। ১৮টি বাড়ি, ফ্ল্যাট, জমির নথিপত্র। পশ্চিম মেদিনীপুরের পিংলাতেও স্ত্রীর নামে ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, আত্মীয় স্বজন, মেয়ে জামাইয়ের নামে বিপুল সম্পত্তি!
সবটাই তো গরীব খেটে খাওয়া বাঙলার সাধারণ যুবক যুবতীর কষ্টার্জিত টাকা লুঠ করে, তাঁদের চাকরি পাওয়ার স্বপ্নে বুলডোজার চালিয়ে, পেটে লাথি মেরে! স্বাধীনতার পরে পশ্চিমবঙ্গের বুকে নিয়োগ নিয়ে সবথেকে বড় কেলেঙ্কারি। প্রাইমারি টেট থেকে এসএসসি, শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী নিয়োগে বেনজির দুর্নীতি। অবৈধভাবে অকৃতকার্য এমনকি খালি খাতা জমা দেওয়া পরীক্ষার্থীরাও চাকরি পেয়েছে স্রেফ এই দুর্নীতি চক্রের মদতে। আদালতের নির্দেশে একাধিকজন চাকরি হারিয়েছেন এই দুর্নীতির জেরেই। সেখানে রাস্তা ঘাটে আপনাকে কে 'চোর' বললে কি, খুব ভুল বলছে? আপনি কি বলেন মিস্টার পার্থ চট্টোপাধ্যায়?
কান্তি বিশ্বাস, পার্থ দে, সত্যসাধন চক্রবর্তী, শম্ভু দে, সুদর্শন রায়চৌধুরী -শিক্ষামন্ত্রী বামফ্রন্ট সরকারের আমলেও ছিল। ১৯৯৮-২০১০, এরাজ্যে প্রতি বছর এস.এস.সি'র মাধ্যমে নিয়োগ হয়েছিল মোট ১,৮৫,৮৪৫ জন। হ্যাঁ, ৮-১০ লক্ষ টাকার ঘুষ না দিয়েই, মেধা তালিকা গোপন না রেখেই, স্বজন পোষণ আর বেনিয়মের কলঙ্ক গায়ে না মেখেই!
৩৪ বছরের অনেক গল্প আপনারা শুনেছেন, পাড়ার তৃণমূলের মস্তানদের নন্দীগ্রাম-সিঙ্গুর-আনন্দমার্গী-মরিচঝাঁপি-সাঁইবাড়ি'র নামতা ঘুষতে শুনেছেন, সেই মস্তান'দের একটু জানিয়ে দেবেন, ৩৪ বছরের ঐ বাংলায় একটা অনিয়ম, একটা দুর্নীতির প্রমাণও কিন্তু তাঁদের দিদি আর দিদির পদলেহনকারী পুলিশ-সিআইডি-কমিশন আজ অবধি দিতে পারেনি, ৩৪ বছরের ঐ বাংলায় টাকার বিনিময়ে কলেজে অনার্সের সিট বিক্রি হয়নি, ৩৪ বছরের ঐ বাংলায় মেধা তালিকার ছাত্র-ছাত্রী'দের স্রেফ ঘুষ দিতে না পারায় আত্মহত্যার করতে হয়নি, ৩৪ বছরের ঐ বাংলায় মুখ্যমন্ত্রী'দের কাটমানির ৭৫% পার্টি ফান্ডে জমা করার হুইপ দিতে হয়নি, ৩৪ বছরে এই রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রীকে রাস্তায় ঘাটে লোকজন প্রকাশ্যে 'চোর' বলেনি!
মিস্টার পার্থ চট্টোপাধ্যায়, তৃণমূল আপনাকে ঝেড়ে ফেলছে। মুখ্যমন্ত্রী নাকি আপনার ফোন ধরছেন না, মিডিয়ার অলিন্দে কান পাতলে শোনা যাচ্ছে আপনাকে ক্যাবিনেট থেকে ছেঁটে ফেলা হয়েছে, তৃণমূলের সব পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে, আপনাদের দু-পয়সার মুখপাত্র টুইট করে বলে দিয়েছেন, এই দুর্নীতির দায় কেবলমাত্র আপনার, দলের না! কিন্তু আমরা জানি, আপনি একা না। তৃণমূলে পা থেকে মাথা, প্রত্যেকে দুর্নীতিগ্রস্ত। আর সেই দুর্নীতিগ্রস্তদের রিং-মাস্টারের নাম মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়!
২০১১ তে মুখ্যমন্ত্রী হয়ে এগারোটা কমিশন গড়েছিল মেয়েটা। বছর ঘুরতেই আরও ছটা। এত কমিশন একসঙ্গে জীবনে দেখেনি রাজ্যবাসী। নবান্নের চোদ্দ তলার প্রথম থাকে সে রাখল 'জমি বণ্টনে অনিয়মে'র তদন্ত কমিশনদের। রাজারহাটের কমিশনটাকে জড়িয়ে ধরে সে বলল, তুই আমার তুরুপের তাস। দ্বিতীয় থাকে রাখল সব 'গণহত্যার' কমিশন'দের। ২১শে জুলাই কমিশনটাকে জড়িয়ে ধরে বলল তোর নাম 'বুদ্ধ ভট্টাচাজ বধ'।
কমিশনের হাতি পুষতে সেদিন খরচা হয়েছিল রাজ কোষাগারের ৫ কোটি। সিপিএম'র নেতাদের পিণ্ডি তর্পণের দিবাস্বপ্নে বিগলিত বুদ্ধিজীবীরা কমিশন'কেই দরাজ সার্টিফিকেট বিলিয়ে বলেছিলেন "এহি হ্যা রাইট চয়েস বেবি।" মিডিয়ার ক্যাকাফনি তে সেদিন অনায়াসেই চাপা পড়ে গিয়েছিলো শালকু সরেন, অজিত লোহার-পূর্ণিমা ঘোড়ুই-জিতেন নন্দী'দের লাশের নিস্তব্ধতা। আজ ১১ বছর অতিক্রান্ত, ২১শে জুলাইর মঞ্চে ধমক-চমক ছাড়া মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হিম্মত আছে নাকি কমিশনের রিপোর্ট সামনে এনে সিপিএম-র নেতাদের দুর্নীতির দায়ে জেলে ভরার?
তাই, মিস্টার পার্থ চট্টোপাধ্যায়, আপনি জেলে গেলেন বলে গায়ের ঝাল মিটিয়ে বসে থাকার সুযোগ বামপন্থীদের নেই। সারদা, নারদা, রোজভ্যালি, বালি কয়লা, গরু, পার্থ চট্টোপাধ্যায়, মদন মিত্র, মুকুল রায় –তৃণমূলের রাজনীতির ল্যান্ডস্কেপে ছড়িয়ে থাকা এই বিক্ষিপ্ত বিন্দু গুলোকে একসাথে জুড়লে যে নকশাটা তৈরি হয় সেটা ধারাবাহিক দুর্নীতির, সেই নকশাটা দুর্নীতি কে রাজনীতির আঙিনায় প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার, সেই নকশাটা বাঙলায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাত ধরে একটা লুম্পেন সর্বস্ব রাজনীতির নিয়ন্ত্রক শক্তি হয়ে ওঠার!
আমাদের লড়াইটা বাঙলার বেকার যুবকদের ন্যায্য চাকরি ফিরিয়ে দেবার লড়াই, মানুষের কষ্টার্জিত লুঠের টাকা ফিরিয়ে দেওয়ার লড়াই, যে মিডিয়া মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে মেরুদণ্ড বন্দক রেখেছে সেই মেরুদণ্ড ফিরিয়ে দেওয়ার লড়াই। লড়াইটা আসলে, যে রাজনীতি ব্যবস্থা আমাকে-আপনাকে প্রতিনিয়ত এই দুর্নীতির সাথে আপোষ করতে শেখাচ্ছে, সেই রাজনীতি কে হারিয়ে দেওয়ার লড়াই। বরুণ বিশ্বাস, সত্যেন্দ্র দুবে, নরেন্দ্র দাভোলকার রক্তে ভেজা পথের লড়াই। দুর্নীতি মুক্ত নতুন বাঙলায় সূর্যোদয় ঘটাবার লড়াই। শোষণহীন রাঙা প্রভাত ছিনিয়ে আনার লড়াই।
বাই দা ওয়ে, মিস্টার পার্থ চট্টোপাধ্যায়, বুদ্ধবাবু আজও বাঙলার মানুষের মনে সম্মান নিয়েই বাঁচেন, ইনকিলাবি শ্লোগানের গর্ব নিয়ে বাঁচেন, আজও লাল ঝাণ্ডার নেতৃত্বে নতুন বাঙলা গড়ার স্বপ্ন নিয়েই বাঁচেন।
আপনিও বাঁচবেন, দুর্নীতিবাজের তকমা নিয়ে, মানুষের ঘেন্না কুড়িয়ে, পথ চলতি মানুষের ঐ খিস্তি খেউরে! ঐ যে কথায় বলে না, 'আমরা', 'ওরা'। তফাৎ ছিলই। তফাৎ থাকবেও।