সোমবার, ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২২

ভালোরে ভালো ~ মধুশ্রী বন্দোপাধ্যায়

দাদা গো দাদা ! দেখ্‌ছি ভেবে অনেক দূর—
এই দুনিয়ার সকল ভাল,
আসল ভাল নকল ভাল,
রামও ভালো, কেষ্ট ভালো,
তুমিও ভাল, আমিও ভাল,
বাজপেয়ীজির কবতে ভাল,
আদবানীজির রথও ভাল,
তোমার দুধের চাও ভালো,
মুড়ির সাথে চপও ভালো,
কাশ ফুলের বালিশ ভাল,
গরুও ভালো, রথও ভাল, 
তোমার আমার পোলাও ভাল, 
অন্য সবার পটল ভাল,
সোজাও ভাল বাঁকাও ভাল,
নিলও ভাল সাদাও ভাল, 
গেরুয়া রং তো বেজায় ভাল,
কিন্তু সবার চাইতে ভাল—
তোমার আমার দিল্লি মিটিং।
সঙ্গে থাকে ফুল ও ইটিং। 

- শাহজী, অপেক্ষা করুন। আপনারও দিন আসবে। 


19/09/2022

রবিবার, ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০২২

দীপান্বিতা জানা ~ আর্কাদি গাইদার

একদম প্রথম যখন রাজনীতি নিয়ে ভাবতে শিখেছি, - মানে চটকদার টপিক বা ট্রেন্ড হিসেবে না -  জীবন-মৃত্যুর প্রশ্ন হিসেবে, সেই সময়ে বাংলায় সন্ধিকাল - সিঙুর, নন্দীগ্রামের একের পর এক ঘটনার ঘনঘটা। পুলিশের গুলি, চাষের জমি - প্রতিনিয়ত হেডলাইন হাতুড়ি মারছে মগজে, আর সেই সময়েই অল্প অল্প করে সরকারবিরোধী বামদলের লোকজন, তৃতীয় ধারার লোকজন, এদের সাথে সখ্যতা তৈরি হচ্ছে, এদের রাজনৈতিক বক্তব্য আকৃষ্ট করছে, এনারাও মাঝেমধ্যে অনলাইন অফলাইন 'সিটিং' দিচ্ছেন।

এমনই একদিন একটি ছবি বেরোয় আবপ'তে, একটি মৃতদেহের ছবি। এর আগেও বহুবার দুদিকেরই অনেক ঘটনার ছবি বা খবর বেরিয়েছে, অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীকে ধর্ষণ করে জ্যান্ত কবর দেওয়া, দুধওয়ালা কে পুলিশের চর ঘোষণা করে গুলি করা, কিন্তু সেসব মনে সেরকম দাগ কাটেনি, গণঅভ্যুত্থানের বাস্তব চিত্র হিসেবে হয়তো অবচেতনে নিজেই নিজের কাছে এর জন্যে সম্মতির নির্মাণ করে ফেলেছিলাম। 
কিন্তু এই ছবিটিতে তা হয়নি। কেন জানি না, কিন্তু এই ছবিটি খুব গভীরভাবে মনে দাগ কেটেছিলো। আজকাল সচেতন লোকজন যাকে বলে 'ট্রিগার' করা। 

দীপান্বিতা জানা নামক নন্দীগ্রামের সীতানন্দ কলেজের ভূগোলের প্রথম বর্ষের ছাত্রী। এসএফআই করবার অপরাধে তাকে ধর্ষণ করে খুন করে হলদি নদীর ধারে তার দেহ ফেলে রাখা হয়েছে। আবপ'র পাতায় সেই দেহেরই পেছন থেকে তোলা ছবি। হঠাত এই ছবিটিই এত বিচলিত করেছিলো কেন জানিনা, কিন্তু এই নিয়ে সেই সময়ের রাজনৈতিক পরিসরে বারবার প্রশ্ন করতে শুরু করলাম, তর্ক শুরু করলাম। আমাদের প্রত্যেকের জীবনেই হয়তো এরকম মাইলফলকের মতন ঘটনা আসে, যা জীবনের দিকনির্ণয় করে দেয়। দীপান্বিতা জানার মৃতদেহের জাস্টিফিকেশনে ঘুরেফিরে আমায় একটি কথাই বলা হয়েছিলো- কোল্যাটারাল ড্যামেজ হিসেবে ধরতে হবে। তো এই দুটো শব্দ - কোল্যাটারাল ড্যামেজ - আমার বাদবাকি জীবনের  রাজনীতির দিকনির্ণয় করে দেয়।

সেই তখন যারা আমায় কোল্যাটারাল ড্যামেজ বুঝিয়েছিলেন, সেই পরিসরের রাজনীতির ধারক ও বাহকরাও অনেকটা পথ পেরিয়ে এসেছেন। তারাও পরিবর্তনের স্রোতে এখনকার বিপ্লবী, ফ্যাসিবাদ-বিরোধী নাগরিক নেতা, সোশ্যাল মিডিয়ার নারীবাদী থিওরিটিশিয়ান, অন্যধারার প্রকাশক, ওয়েবজাইনের কর্ণধার হিসেবে আমাদের মধ্যে থেকে গেছেন। মাঝেমধ্যে দীপান্বিতা জানার সংগঠনকে পেট্রোনাইজিং জ্ঞান দেওয়া বিশ্লেষণমূলক থিসিস, বক্তব্য তারা বিভিন্ন জায়গায় রেখে থাকেন। 

দীপান্বিতা জানা - ২২ আগস্ট, ২০১০ সংবাদপত্রে দেখা যেই অচেনা মেয়েটির মৃতদেহের ছবি  আজও ২০ বছর পরে আমার মাথায় হানা দেয় - অথচ আমি তার মুখই জানি না। তার দেহের ছবি তোলা পেছন থেকে, তার অন্য কোন ছবি নেটে নেই, কোথাও নেই। এসএফআই'র সেন্ট্রাল কমিটি ওয়েবসাইটে শহীদদের তালিকার মধ্যে লিস্টে একজায়গায় তার নাম আছে। এইটুকুই। আমি কোনদিনও জানতে পারবো না দীপান্বিতার মুখটা কিরকম দেখতে। 

সাধারণত আজকাল এধরনের লেখা লিখলে বা ছবি দিলে সাথে নাকি লিখতে হয় - T/W বা Trigger  Warning. কিন্তু সচেতন ভাবেই এসব শব্দ এড়িয়ে চলছি - ওই কোল্যাটারাল ড্যামেজ শেখানো রাজনীতির ব্যক্তিবর্গ আসলে এই শব্দগুলোকে  কার্ড হিসেবে ব্যবহার করে করে অপবিত্র করে ফেলেছে। যেমন করেছে আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক শব্দকে - নারীবিদ্বেষ, কাঠামোগত হিংসে, পুরুষতান্ত্রিকতা, আধিপত্য - এগুলোকে নিয়ে ওনারা সুবিধেমতন নিঃশব্দ হয়ে আর সুবিধেমতন লেবেলিং আর তর্কের কার্ড হিসেবে ব্যবহার করে এই শব্দগুলোর রাজনীতিকে অপবিত্র করেছেন। দীপান্বিতার নামটা ভুলতে না দেওয়ার যে লড়াই - সেই ইনসাফের পাশাপাশি এই শব্দগুলোর রাজনীতিকেও এদের সুবিধেবাদী হাত থেকে ছিনিয়ে নেওয়ার লড়াইটাও লড়তে হবে। 

আগামী ২০ তারিখ ছাত্র-যুবদের ইনসাফ সভা ভিক্টোরিয়া হাউজের সামনে। পুরনোদের অনেকেরই হয়তো দীপান্বিতার নাম মনে নেই, নতুনদের জানারই কথা নয়। ইনসাফ সভায় যারা যাবেন, এবং লড়াইয়ের রসদ জোগাড় করবেন, তাদেরই কাছে অনেকের সাথে দীপান্বিতার নামটাও যাতে জানানো যায়, মনে পড়ানো যায়, তাই এই লেখা।

সোমবার, ২২ আগস্ট, ২০২২

ফুল্লরা হারেনি ~ মালিনী ভট্টাচার্য

*****************************************
( ২০১৮ সালে গণশক্তিতে এই নিবন্ধ লিখেছিলেন মালিনী ভট্টাচার্য। 
অবশেষে জামিন পেয়েছেন কমরেড ফুল্লরা মণ্ডল। তাই মালিনী ভট্টাচার্যের এই লেখা ফিরে পড়া।)
******************************

'তোমরা এলে কেন? এভাবে তোমাদের দেখার চাইতে না দেখাই তো ভালো ছিল!' আমাদের দেখে এই ছিল তার প্রথম কথা। তার মতোই ক্ষোভ ছিল আমাদের মনেও। ক্ষোভের কারণ? 'সংশোধনাগারে'র অধ্যক্ষকে আগে থেকে আবেদন জানানোর পরেও ফুল্লরার সঙ্গে আমাদের দেখা করতে হলো খোলা বারান্দায় বসে অফিসঘরের সাতপুরু দেওয়াল এবং জানালার গরাদ ও তিনপুরু কালো জালের ফাঁক দিয়ে। বছরদুয়েক আগে যখন ফুল্লরার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম তখনও কিন্তু এই খাঁচার ফাঁক দিয়ে সম্ভাষণের অমানবিক ব্যবস্থা জারি হয়নি! অথচ এটা নাকি জেল নয়, সংশোধনাগার! আমরা তবু কাকুতিমিনতির রাস্তায় যেতে চাইনি। হামলা এবং মামলার এই জমানায় আর বেশি কী প্রত্যাশা করব? আর অফিসঘরের চেয়ারে যাঁরা বসে আছেন তাঁদেরও তো এই জমানায় চাকরি করতে হবে, তাঁরাই বা কী করবেন? ফুল্লরাও সেকথা জানে, তাই ক্ষোভ সামলে সে জনে জনে খবর নেয় পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা মহিলা সমিতি থেকে আসা বা আসতে না-পারা প্রতিটি সাথির, যাদের সঙ্গে দীর্ঘদিন লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে জীবনকে সে জড়িয়ে নিয়েছিল, যাদের সঙ্গে তার প্রাত্যহিকের আজ এক বড়ো ব্যবধান তৈরি করেছে জেলখানার গরাদ।
ফুল্লরা মণ্ডল। মেদিনীপুরের কৃষক পরিবারের মেয়ে সে, যার বাবা এবং দাদাও নিজে হাতে লাঙল ধরে চাষ করেছেন। নিজের চেষ্টায় পড়াশোনা করে ফুল্লরার ইচ্ছা ছিল শিক্ষকতা করার। ঘরের মেয়ে বাইরে গিয়ে চাকরি করবে, বাবার এই দোনোমনাকে মেনে নিতে সে চায়নি। এমন সময়ে ডাক এল পার্টির কাজ করার। সেও তো আরও বৃহত্তর ক্ষেত্রে একরকম শিক্ষকতার কাজই। নিজের পুরো জীবনটাকেই সে লাগিয়ে দিল এই কাজে, দ্বিধা না করে হয়ে গেল হোলটাইমার। পার্টি অফিসই তার ঘর, নিজের বাড়ি আর তার বাড়ি নয়, সপ্তাহে দুই তিনবার যাতায়াতের জায়গামাত্র। পঞ্চায়েত সমিতির কাজ করতে গিয়ে বাড়ল প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের সঙ্গে তার যোগাযোগ। তৃণমূল- মাওবাদী সাজশের রক্তাক্ত দিন যখন জঙ্গলমহলে এল, তখনও তাকে কেউ গণসংযোগের ময়দান ছেড়ে ঘরে ঢুকে পড়তে দেখেনি। আমাদের সঙ্গে এবার দেখা হতে বারবার যেকথা সে বলছিল, তা হলো, বিপদ হতে পারে জেনেই তো পার্টিতে আসা, তাহলে বিপদের সময়ে ভয় পাব কেন? সে বলে, বাড়ির লোকদের জন্য আমি কখনো কিছু করিনি, তাদের কিছুই দিতে পারিনি। কিন্তু তার ভাইপোর কথায়, তুমি আমাদের পুরো পরিবারকে একটা আদর্শ দিয়েছ, তার থেকে বেশি আর কী দেবে? সেটা ধরেই তো আমরা আছি।
ফুল্লরা অনেকবছর ধরে আর বাড়ি ঢুকতেই পারেনি। প্রায় চারবছর হলো বিচারের প্রত্যাশায় সে জেলখানায়। তার জামিনের আবেদন এতদিনেও মঞ্জুর হয়নি, এর মধ্যে মারা গেছেন তার মা ও দাদা, শেষবারের দেখাও সে দেখতে পায়নি। ফুল্লরা মণ্ডল একা নয়। ২০০৭-৮ সাল থেকেই এরাজ্যে যে রাজনৈতিক উথালপাথাল শুরু হয়েছে— যার একটি চরম মুহূর্তই ৩৪ বছরের বামফ্রন্ট জমানার অবসান— তারই ধাক্কায় যেমন ভয় বা বিভ্রান্তি বা লোভ বা সুবিধাবাদের শিকার হয়ে নানাবিধ চাপের মুখে বহু বামপন্থী কর্মীর পশ্চাদপসরণ ঘটেছে, তেমনই এসবকে উপেক্ষা করেই যারা এ আন্দোলনে রয়ে গেছে, সাহস এবং জেদের সঙ্গে প্রতিকূলতার মোকাবিলা করছে এমন কর্মীর সংখ্যাও নগণ্য নয়। দূরবীন দিয়ে তাদের দেখা যাবে না, দেখতে হবে অণুবীক্ষণ যন্ত্রে। কারণ এই বিপন্ন সময়ের শিরা-উপশিরার মধ্যে তাদের অস্তিত্ব, খবরের কাগজে তাদের নাম ওঠে না, টিভি চ্যানেলে তাদের মুখ দেখা যায় না, তবু বিপর্যস্ত হয়েও তারা হাল ছেড়ে দেয়নি, সুবিধাবাদের স্রোতে গা ঢেলে দেয়নি। কেউ হয়তো আছে ফুল্লরার মতোই কয়েদখানায় মিথ্যা মামলার বোঝা মাথায় নিয়ে, কেউ বছরের পর বছর বাড়ির আশেপাশে যেতে পারেনি, কারো অন্নসংস্থান নেই, ভিন রাজ্যে চলে যেতে হচ্ছে।
এই অবস্থায় যাদের পড়তে হয় শুধু তারাই জানে, হতাশাকে এড়িয়ে চলা কত কঠিন, মনোবল ভেঙে পড়ার সম্ভাবনা কত প্রবল। কারণ হতাশা তো হঠাৎ একদিন সকালে মুখের সামনে এসে হাজির হয় না, তা তলায় তলায় অস্তিত্বকে কুরে কুরে খায়, প্রত্যেক বারের হার বা পিছিয়ে যাওয়া একটু করে আত্মপ্রত্যয়কে ক্ষইয়ে দিতে থাকে, মনুষ্যত্বকে নষ্ট করে দীর্ঘমেয়াদি সংশয়ের বিষ ঢেলে। যতদিন না আমরা ভাবতে শুরু করি, যে দিনবদলের লক্ষ্যে জীবনটাই ঢেলে দিলাম তা মরীচিকা মাত্র। যারা গা বাঁচিয়ে ছিল তারা তো দিব্যি আছে। ফুল্লরাদের মনেও যদি কখনো কখনো এ হতাশা আসে, তাহলে কি সেটা খুব অস্বাভাবিক? তাদের অধৈর্য হবার কি কোনও কারণ নেই? আমার এত ধৃষ্টতা নেই যে আমি তাকে বলব, হতাশ হোয়ো না, ভেঙে পোড়ো না, কারণ আমি এটুকু জানি যে, যে কখনো বুক-মোচড়ানো হতাশা অনুভব করে না, যে সংশয়ে বিপন্ন হয় না, তার প্রত্যয়টা মুখের কথামাত্র। আমি এটুকু জানি, যে ফুল্লরা এবং তার মতো আরও অনেকের নিজেদের প্রত্যয়কে ঝালিয়ে নিতে হয় প্রতিদিনের হতাশা আর সংশয়ের আগুনেই। সেখানে ভাবের ঘরে চুরি চলে না।
ফুল্লরা জেলখানার মধ্যে বসেও পড়াশোনা করে, 'গণশক্তি' থেকে নিত্য আহরণ করে বাইরের খবর, অন্য মহিলা কয়েদিদের চিঠি লিখে দেয়, তাদের নানাভাবে সাহায্য করে, যে বাচ্চারা মায়ের সঙ্গে জেলে এসেছে তাদের লেখাপড়া শেখায়। এই মেয়েকে বাইরে থেকে কে সাহস জোগাবে? তাকে আমরা শুধু দিয়ে এসেছি একটি মোটা খাতা আর কলম। বলেছি, এই খাতায় তুমি তোমার নিজের কথা লেখো, লেখো তোমার ছোটবেলা কেমন ছিল, কীকরে তুমি লেখাপড়া শিখলে, পার্টির কাজ করতে গিয়ে মানুষের জীবনের যে অভিজ্ঞতা তুমি সংগ্রহ করেছ লেখো সেই কথা, লেখো এই গারদের আড়ালে যেসব মানুষের সঙ্গে তোমার আলাপ হচ্ছে তাদের কথা। লেখো, ফুল্লরা, লেখো, লেখো। তোমার কলম তো কেউ কেড়ে নিতে পারবে না। যেকাজ সারাজীবন করে এলে, এও তো সেই কাজেরই রকমফের। এর মধ্য দিয়ে তোমার প্রিয়সাথিদের সঙ্গে তোমার সংযোগ থাকবে। আমরা তোমার কথা শুনতে পাব, তোমার অভিজ্ঞতা থেকে নিজেদের অভিজ্ঞতার প্রদীপ জ্বালিয়ে নিতে থাকব।

চলে আসার আগে দুই তিন মিনিটের জন্য আমরা বড়ো লোহার গেটের সামনে এসে দাঁড়ালাম। ফটকের ওপারে সে চলে যাবার আগে একটুক্ষণের জন্য স্পষ্ট কাছ থেকে দেখা গেল তাকে। যে অফিসারটি দরজার পাশে বসেছিলেন, শুনলাম জিগগেস করছেন, এত ভিড় কি তোমার জন্যই নাকি? গেটের ফাঁকে হাত বাড়িয়ে তার হাত দু'টি ধরলাম। সে বলল, এই তো এবার মনটা খানিকক্ষণ খারাপ হয়ে থাকবে, কিন্তু তা হোক, আমি তো আছি এখানে, তোমরা লড়াই করো, জেদ করে গা লাগিয়ে লড়াই, ভাসা-ভাসা লড়াই করলে চলবে না। উঁচু মাথা উঁচু রেখেই সে চলে গেল ফটকের আড়ালে। জানিয়ে গেল সে হারেনি। আমাদেরও হার মানতে বারণ করে গেল। ফুল্লরাকে যদি বিনা অপরাধে জেলে আটক থাকতে হয়, তাহলে বলব তার এই শাস্তি আমাদের সকলের শাস্তি। সেই শাস্তিকে সবাই মিলে ভাগ করে নিতে হলে ফুল্লরার বার্তাকে আমাদের মূল্য দিতেই হবে। ফুল্লরা তার জন্য আমাদের চোখের জল ফেলতে তো বলেনি। সেকথা ভুলে এখনো যদি ভ্রান্তিবশে ভাবি, যা দিনকাল পড়েছে তাতে আগ বাড়িয়ে ফ্যাসাদ না বাড়ানোই ভালো, গয়ংগচ্ছ ভাবে চলাটাকেই যদি এখনও চলা বলে মনে করি, আলস্য আর আত্মাভিমানে যদি বাস্তবের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকি, তাহলে বৃথাই হবে ফুল্লরার বার্তা। তার সঙ্গে এই বিশ্বাসঘাতকতা আমরা যেন না করি। 

#TMCJungleRaj #WestBengal

শুক্রবার, ১২ আগস্ট, ২০২২

চাঁদের রং কি? ~ ডাঃ দোলনচাঁপা দাশগুপ্ত

একটি সাম্প্রতিক আলোচনার পরে, একজন তরুণ স্কুলছাত্র আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিল- "জলবায়ু পরিবর্তন কীভাবে চাঁদকে প্রভাবিত করে"?

প্রথমে আমি ভেবেছিলাম প্রশ্নটি তুচ্ছ, কিন্তু পরে  আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে এটি বেশ গভীর প্রশ্ন। আমাদের বায়ুমণ্ডলের পরিবর্তন চাঁদকে প্রভাবিত করে না, তবে আমরা কীভাবে চাঁদ দেখি সেটাকে প্রভাবিত করে।

APOD থেকে:

 "চাঁদের রঙ কি? এটি রাতের উপর নির্ভর করে। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের বাইরে, প্রতিফলিত সূর্যালোক দ্বারা আলোকিত অন্ধকার চাঁদ,  চমৎকার  বাদামী - ধূসর দেখায়।

পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের ভিতর থেকে দেখা গেলেও, চাঁদ ভিন্নভাবে দেখা যেতে পারে। বৈশিষ্ট্যযুক্ত চিত্রটি খেয়াল করলে বোঝা যাবে, সমস্ত ইতালির  বিভিন্ন অবস্থান থেকে ১০ বছরেরও বেশি সময় ধরে একজন জ্যোতির্বিজ্ঞানীর রেকর্ড করা  (নথিভুক্ত) পূর্ণ চাঁদের আপাত রঙের একটি সংগ্রহ  এই ছবিগুলো। 

একটি লাল বা হলুদ রঙের চাঁদ সাধারণত দিগন্তের কাছাকাছি দেখা চাঁদকে বোঝায় । সেখানে, কিছু নীল আলো পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের মধ্য দিয়ে দীর্ঘ পথ দিয়ে বিক্ষিপ্ত হয়েছে, কখনও কখনও সূক্ষ্ম ধূলিকণাতে ভরা। নীল রঙের চাঁদ আরও বিরল এবং বড় ধূলিকণা বহনকারী বায়ুমণ্ডলের মধ্য দিয়ে দেখা চাঁদকে নির্দেশ করতে পারে। বেগুনি চাঁদ ঠিক কীভাবে  তৈরি হয়েছে  তা স্পষ্ট নয় - এটি বিভিন্ন প্রভাবের সংমিশ্রণ হতে পারে। শেষ চিত্রটি ২০১৮  সালের জুলাইয়ের মোট চন্দ্রগ্রহণকে ক্যাপচার করেছে  -- যেখানে পৃথিবীর ছায়ায় চাঁদ ক্ষীণ লাল দেখাচ্ছে  -- পৃথিবীর চারপাশে বাতাসের মাধ্যমে আলো প্রতিসরণ করার কারণে। পরবর্তী পূর্ণিমা এই মাসের শেষে ঘটবে এবং কোনও কোনও সংস্কৃতিতে 'বিভার মুন'  নামে পরিচিত।

Image Credit & Copyright: Marcella Giulia Pace 


আজ পূর্ণিমা। রাখিপূর্ণিমা। একটি খুব সুন্দর বিষয়কে তুলে ধরেছেন স্যার Somak Raychaudhury  বাংলা মাধ্যমের ছাত্রছাত্রীদের জন্য স্যারের পোস্টটা আমি বাংলায় অনুবাদ করে দিলাম।


সোমবার, ৮ আগস্ট, ২০২২

এসএসকেএমে মেরুদণ্ডের জন্ম (একটি কল্প-গল্প) ~ ডাঃ অরুণাচল দত্ত চৌধুরী

ল্যাবরেটরির নামটা ভজঘট। সলিড সায়েন্টিফিক কাইনেটিকস অফ মিউটেশন সংক্ষেপে এসএসকেএম।  

আসলে কাজ হয় জেনেটিকস আর ইভোলিউশন নিয়ে। রাষ্ট্রীয় কাজ। অতীব গোপন, বলাই বাহুল্য।  ল্যাবে আজকে প্রবল উত্তেজনা। কাগজে একটা খবর বেরিয়েছে। তাই নিয়েই সিনিয়ার সায়েন্টিস্ট মহীতোষ মহলানবিশের নামে গুরুতর অভিযোগ। 

এমনিতে এই ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা পর্যবেক্ষণ ও সিদ্ধান্ত নেবার যে বৈজ্ঞানিক প্রথা সারা বিশ্বে চালু আছে সেইটিই চালু। কিন্তু সে সবই মলিকিউলার লেভেলে। প্রোটিন কার্বোহাইড্রেট ফ্যাট মিনারেল নিয়ে জটিল কাজ কারবার। কখনও কমপিউটার সিমুলেশনে রেজাল্ট দেখে আন্দাজ করার চেষ্টা করা হয় অনাগত ভবিষ্যতে কী ধরণের পরিবর্তন আসতে চলেছে। সাধারণের পক্ষে একপ্রকার অবোধ্যই। সেই সব কাজ জাতির কী কাজে লাগে কেউই জানে না।

ইভোলিউশন মানে বিবর্তন সবাই জানে একটি ধীর প্রক্রিয়া। শতাব্দীর পর শতাব্দী কেটে যায় খুব ছোট পরিবর্তন আসতেও। কাজেই সরাসরি বিবর্তন চাক্ষুষ করা এই ল্যাবের তো বটেই সবাইরই সাধ্যাতীত। তবু কখনও জিন পালটে নতুন প্রজাতি তৈরি করার চেষ্টাও করা হয় অবশ্যি।

বিজ্ঞানী মহীতোষ আবার কবি টাইপের। এই ল্যাবের সর্বাধিনায়ক ডঃ সর্বজ্ঞ এই কবিতার ইস্যুতে ওর ওপর একটু বিরক্তও বটে। ব্যাপার তত সিরিয়াস কিছু না। আসলেই আবেগ সামলাতে না পেরে ওর কবিতা ছাপতে পাঠায় বিভিন্ন ম্যাগাজিনে। সেই আপদগুলি ছাপাও হয়। ডঃ সর্বজ্ঞর ধারণা সেই সব কবিতা ডিকোড করে বিদেশি প্রতিদ্বন্দ্বীরা এই ল্যাবের গোপন সাফল্যগুলি জেনে যাচ্ছে। অথচ এখানে গবেষণার শর্তই হল, কিছুতেই এখানের খবর বাইরের কারওর সঙ্গে শেয়ার করা যাবে না। 

এই না মানে সর্ব অর্থেই না। এখানের চাকরি ছেড়ে দেওয়ার পরও না। এই মর্মে চুক্তিপত্র সই করতে হয়েছে সব রিসার্চারকেই। গতমাসেই তিনি মহীতোষকে তাঁর ঘরে, যেটিকে লোকে আড়ালে টর্চার চেম্বার বলে, ডাকিয়ে এনেছিলেন। 
– তোমাকে আজকেই শো কজ্ নোটিশ ধরাব।
নিরীহ মহীতোষ কাঁপতে কাঁপতে জিজ্ঞেস করেছিল,
– কেন স্যার? 

সর্বজ্ঞ গম্ভীর ভাবে বিজ্ঞান কথাঞ্জলি নামের ওঁচা লিটল ম্যাগাজিনটা তার দিকে এগিয়ে দিলেন। 
– এই কবিতাটা তুমি কেন লিখেছ? 

মহীতোষ গলা বাড়িয়ে দেখে নিয়ে ঢোঁক গিলল। একটা নির্দোষ লিমেরিক। স্যার এটারও খোঁজ পেয়ে গেছেন? বড়ই আপশোষের কথা। 

লিমেরিকটা হল,
লঙ্কা গাছের কোষে মুরগির জিন দিয়ে ঠেসে
নিরামিষ ফলে পাই, মাংসের স্বাদ অবশেষে।
চিলি চিকেনের ভোজ
জুটছে এখন রোজ।
খবরটা গোপনীয়, এক্ষুনি দিচ্ছি না প্রেসে। 

জলদগম্ভীর গলায় বস জিজ্ঞেস করলেন,
– আমাদের এই ল্যাবটা কি খেয়াল খুশির জায়গা? এই ভাবে তুমি ল্যাবের গোপন খবর কবিতাপত্রিকা দিয়ে বাইরে আউট করছ? তুমি জানো, কেনটাকি চিকেন কিম্বা ম্যাকডোনাল্ড আরও কতজন এই রকম আবিষ্কারের জন্য ওঁৎ পেতে বসে আছে? তোমার মাথায় আইডিয়া এসেছে ভালো কথা। সেটা পাবলিশ করার সাহস তোমার হয় কী করে? 

– কিন্তু স্যার এই আইডিয়াটা তো…
– কোনও এক্সপেরিমেন্টেই এখন অবধি ইমপ্লিমেন্টেড হয়নি। এই তো বলবে? কিন্তু এই আইডিয়াটা তোমার মাথায় এসেছে কাজেই এটা ল্যাবের সম্পত্তি, বুঝেছ?
বাধ্য ছাত্রের মত ঘাড় নাড়ে মহীতোষ 

আজ আবার মহীতোষের ডাক পড়েছে টর্চার চেম্বারে।
– তুমি আবারও সেই কাজ করেছ? খবর পাচারের সেই জঘন্য কাজ?
ঘাড় নেড়ে প্রতিবাদ করে মহীতোষ। 

– না হে, ঘাড় নাড়লেই হবে না। ওই যে আগের মাসে কবিতাটার শেষ লাইনে লিখেছিলে  "খবরটা গোপনীয়, এক্ষুনি দিচ্ছি না প্রেসে" লিখেছ তাতেই তো বোঝা যাচ্ছে তোমার ইয়ে কী বলে প্রেস মানে সাংবাদিকদের সঙ্গে দহরম মহরম মানে চেনা জানা মানে গোপন যোগাযোগ মানে… 

মানের সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে ক্লান্ত হয়ে হাঁপাতে থাকেন ডঃ সর্বজ্ঞ।

ততক্ষণে তাঁর হাতে উঠে এসেছে আজকের আনন্দ বার্তা কাগজ।
সেইটি টেবিলের ওপর বিছিয়ে তার হেড লাইনে হাত রাখেন তিনি। প্রশ্ন করেন,
–এটা কী? কে এদের খবর দিল তুমি ছাড়া?

মহীতোষ ঘুম থেকে উঠতে দেরি করে তড়িঘড়ি চলে এসেছে। পড়তে হয় নইলে পিছিয়ে পড়তে হয়। 
পড়েনি। তাই পিছিয়ে পড়েছে। 

আনন্দবার্তা আঠারো পয়েন্টে হেড লাইনে লিখেছে,

অবশেষে বিবর্তনের নতুন দিশা। এসএসকেএমের পরীক্ষাগারে বিশেষ তাপে ও চাপে কিছু কেঁচোর শরীরে শিরদাঁড়ার আভাস দেখা দিয়েছে।

শনিবার, ৩০ জুলাই, ২০২২

হিন্দুত্বের মিথ্যে কীভাবে ছড়ায় ~ অরিজিত মুখোপাধ্যায়

হিন্দুত্বের মিথ্যে কীভাবে ছড়ায় তার আরো একটা চাক্ষুষ নমুনা দেখলাম...

অনেকদিনের চেনা লোক, একসাথে কাজ করি - আপাতদৃষ্টিতে সায়েন্টিফিক টেম্পারামেন্ট ইত্যাদি আছে, কাজের দিক থেকেও ভালোই...মানে অফিসের কাজে যা যা লাগে, মোটামুটি সবই রয়েছে। দুপুরে ক্যাফেটারিয়ায় বসে খাওয়ার সময় কথাবার্তা ঘুরে গেলো পার্থ চ্যাটার্জী, তৃণমূলের দূর্নীতি, সেখান থেকে উত্তরপ্রদেশে কীভাবে বদমাইশদের ঢিট করা হয়েছে, আর ইউপি কীভাবে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের কোন কোন লিস্টে টপ ফাইভে আছে ইত্যাদি। না না, কেরল বাদ যায়নি, কেরলও প্রশংসাযোগ্য, কিন্তু ইউপিতে ঢিট করা ব্যাপারটা বেশ কাজের। সেটা একটু চেপে গেলো সেই ইউপিতেই করোনাকালে লাশের ছবি আর হিউম্যান ইন্ডেক্সের কথা ওঠায়...

তারপর, কোনোভাবে আলোচনা ঘুরলো ইতিহাসের দিকে - কেন আমাদের ইতিহাস এত "ডিফিটিস্ট"... আমাদের যে লুঠ করা হয়েছে সেটা কেন ইতিহাসে লেখা নেই?

আমি বললাম - কে বলেছে নেই? কলোনিয়াল আমলে কীভাবে এখানকার সম্পদ ইউরোপে চালান হয়েছে সেটা তো ওয়েল ডকুমেন্টেড। মুঘল আমলে জিডিপি ছিলো...

ব্যাস, ওই অবধি শুনেই - " মুঘল আমল কেন বলবে? কেন চোল বা চালুক্য আমল নয়? কেন তাদের কথা ইতিহাসে থাকবে না?"

"ভাই, ইতিহাস বইয়ে মৌর্য্য, গুপ্ত, শুঙ্গ, পাল, চোল, চালুক্য সবই তো ছিলো।"

"না, ওসব পড়ানো হয় না..." ইত্যাদি। 

তারপর পেলাম দুটো লিংক - জনৈক জে সাই দীপকের ইউটিউব ভিডিও "হিস্টরি, আইডেন্টিটি, ইন্ডিয়া" আর সঞ্জীব সান্যালের ইউটিউব ভিডিও "হাউ মাচ অফ ইন্ডিয়ান হিস্টরি ইজ রিয়েলি ট্রু"। এই দুজনই নাকি "নামকরা" ঐতিহাসিক। যখন বললাম উক্ত সাই দীপক অপইন্ডিয়ার লোক, আর সঞ্জীব সান্যাল ভারত সরকারের অর্থনীতির কিছু একটা উপদেষ্টা, আদৌ ইতিহাসের লোক নয়, তখন আবার কিছুটা চুপ...

তারপর কথায় কথায় যেটা দেখা গেল, সেটা হল এর সমস্ত যুক্তিই একেবারে স্ট্যাম্পমারা আইটি সেলের ডায়লগ, মানে আইটি সেল যেসব জিনিস ছড়িয়ে বেড়ায়। যেমন, একটা বেশ লম্বা প্রশ্নঃ

"আমাদের ইতিহাস কেন শুধু হেরে যাওয়ার ইতিহাস? রেজিস্টেন্সের ইতিহাস কই? গজনীর মামুদের শেষ আক্রমণের পর ফের আক্রমণ করতে কেন ১২০ বছর লাগলো? সুহেলদেবের কথা ইতিহাসে লেখে না কেন? উত্তরপূর্ব ভারতের রাজাদের কথা কেন লেখে না? ব্রিটিশ ঐতিহাসিকদের কেন বিশ্বাস করবো যখন তারা আসার আগেও ভারত বলে একটা বিরাট ব্যাপার ছিলো? স্ক্রিপচার আর শিলালিপিকে কেন প্রমাণ হিসেবে ধরা হবে না? ভারতের সবচেয়ে বড় ইতিহাসের দলিল - নালন্দাকে যদি ইচ্ছে করে ধ্বংস করা হয়ে থাকে, তাহলে অন্য দলিল কেন মেনে নেবো? অন্য দেশ, যেমন চীন বা আমেরিকা তাদের অতীতকে গ্লোরিফাই করে। আমরা কেন করবো না? বিদেশীদের বলা ইতিহাস কেন মানবো?"

এসবের এক কথায় উত্তর হয় না, আর সিউডো-ইতিহাসের লক্ষ্যই এইগুলো ছড়ানো। যেমন, সুহেলদেব - একটা লেজেন্ড ছাড়া যার সম্পর্কে কোনো ঐতিহাসিক দলিল নেই [১]। পৃথ্বীরাজ চৌহান সিনেমাটা নিয়েও যে বিতর্কটা হয়েছে তাও মোটামুটি এই লাইনেই - যে পৃথ্বীরাজ রসো কোনো প্রামাণ্য ঐতিহাসিক দলিল নয়। আর এই তথাকথিত ঐতিহাসিকরা, মানে বিক্রম সম্পত বা সঞ্জীব সান্যাল - এদের স্টাইলটাই হল বিনা রেফারেন্সে কিছু দাবীদাওয়া বাজারে ছেড়ে অ্যাকাডেমিক হিস্টোরিয়ানদের কোনোভাবে ডিসক্রেডিট করা - যে আদতে ভারতের গৌরবময় ইতিহাসকে বামপন্থী, কমিউনিস্ট আর নেহরুভিয়ান ঐতিহাসিকরা চেপে দিয়েছে। হিট অ্যান্ড হাইড স্টাইল বলে একে, অ্যালিগেশন ছুঁড়ে পালিয়ে যাওয়া [২]।

এইসব বেশ কিছু বোঝানোর পর যেটা শুনলাম সেটাতেই খটকাটা লাগলো - যে এই পুরো অ্যাফিচিউডটা আসে একটা কোনো কমপ্লেক্স থেকে - যে আমি এত খেটেছি, এত করেছি, অথচ কিছু পাইনি, অন্য লোকে আমার থেকে এগিয়ে গেছে।

"হিন্দু বা বিজেপি নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যথা নেই। এত কিছু করার পরেও আমার কেন এত ইনফিরিয়রিটি কমপ্লেক্স সেইটা খুঁজতে খুঁজতে আমি ডিফিটিস্ট মেন্টালিটি শব্দটা পেলাম, সেখান থেকে এইগুলো পেয়েছি..."

খুঁজে পেয়েছে, পড়েছে, কিন্তু প্রশ্ন করেনি। যে মানসিকতা নিয়ে রিসার্চের কাজ করে, সেই মানসিকতা নিয়ে এইগুলো পড়েনি বা শোনেনি। রিসার্চের ভাষায় বলতে গেলে ডীপ লার্নিং নিয়ে গুগলের ডীপ মাইন্ড থেকে পাব্লিশ করা পেপার ছেড়ে অমিটি বা লাভলি প্রফেশনাল ইউনিভার্সিটির পেপারের ওপর ভরসা করেছে। কারণ এদের দাবীগুলোর সাথে নিজের সাবকনশাসে থাকা ধ্যানধারণা মিলে গেছে। নিজের অপূর্ণ কিছু ইচ্ছে বা না পাওয়ার হতাশার জন্যে কাউকে দায়ী করার জন্যে লোক খুঁজে পেয়ে গেছে। 

উগ্র জাতীয়তাবাদের গজিয়ে ওঠার ক্লাসিক পন্থা এই  দুর্বলতাগুলোকে এক্সপ্লয়েট করা। এই লোকগুলোই ভালনারেবল। হিন্দুত্ব আর জাতীয়তাবাদ ছড়ানোর জন্যে ঊর্বর জমি।

থার্ড রাইখের ইতিহাস পড়লেও এই একই নমুনা দেখতে পাবেন - নাৎসীরা যেটাকে কাজে লাগিয়েছিলো।


শনিবার, ২৩ জুলাই, ২০২২

পার্থ ~ সুশোভন পাত্র

মিস্টার পার্থ চট্টোপাধ্যায় হাও ইস দা জোশ? ২০১৩, বেহালা। তৃণমূল সরকারের দ্বিতীয় বর্ষপূর্তির জনসভা। আপনি তখন  শিক্ষামন্ত্রী, আপনি তখন হুকুমত, আপনার তখন হেব্বি রোয়াব! মঞ্চ কাঁপিয়ে, গলা ফাটিয়ে আপনি বললেন,      
- ২০০৭-এ শালবনীতে কি একটা পটকা ফাটল, আর বুদ্ধ ধুতি তুলে দৌড় মারল! জ্যোতি ডুবে গেছে, বুদ্ধ বুদ্ধু হয়ে গেছে, আজকাল সুজ্জ্যি মামা ডোবে আর ওঠে! সিপিএম এখন মায়ের ভোগে! 
মনে পড়ে? আজ সকালে ইডির অফিসাররা যখন আপনাকে বগল দাবা করে গাড়িতে চাপিয়ে মামাবাড়ি নিয়ে যাচ্ছিল, ২৭ ঘণ্টা ইডির জেরার বাউন্সারে আপনি যখন বিধ্বস্ত, রণক্লান্ত; তখন আপনার সেদিনের ঐ বাচালতাটা বড্ড মনে পড়ছিল! কোথায় আপনার সেই মাঞ্জা দেওয়া পাঞ্জাবি, পায়ে নাইকির ব্র্যান্ডেড স্পোর্টস সু, যত্ন করা ফ্রেঞ্চ কাট, হুঁশ করে চলে যাওয়া লাল বাতি গাড়ি, সামনে পাইলট পিছনে ব্ল্যাক ক্যাটের ফেরেকবাজি? 'আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম!' তাই না মিস্টার পার্থ চট্টোপাধ্যায়? 
এই তো আজ বিকেলে রিপন স্ট্রিটের বাসস্ট্যান্ডে শুনলাম এক ভদ্রলোক চিৎকার করে বলছেন 'শালা রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রীটা চোর। ৩৪ বছরে এমন দেখতে হয়নি।' বাকিরা সবাই চুপ করে শুনছেন। মিস্টার পার্থ চট্টোপাধ্যায় রাস্তা ঘাটে লোকে আপনাকে চোর বলছে! আপনার কেমন লাগছে শুনতে? 
কি করবেন বলুন? আসলে রাজ্যের প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী কে দুর্নীতির দায়ে ইডি জেরা করছে, প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রীর ঘনিষ্ঠর ফ্ল্যাট থেকে দু'হাজার, পাঁচশো টাকার নোটের পাহাড় আবিষ্কার হচ্ছে -এসব তো বাঙলার মানুষ আগে দেখেনি। প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রীর ঘনিষ্ঠর দক্ষিণ কলকাতার কেতাদুরস্ত আবাসনে ঘুষের আর তোলাবাজির টাকা গোনার জন্য ইডি'র আধিকারিকরা মেশিন আনতে বাধ্য হচ্ছে -বাঙলার মানুষ আগে দেখেনি। 
ইডি-সিবিআইর গদাইলস্করি চাল, প্রচুর টাকা বিদেশে পাচার; তারপরেও শুধু একজন ঘনিষ্ঠর বাড়ি থেকে উদ্ধার হওয়া টাকার পরিমাণ ২০কোটির বেশি! ডলার, সোনা, মোবাইল। ১৮টি বাড়ি, ফ্ল্যাট, জমির নথিপত্র। পশ্চিম মেদিনীপুরের পিংলাতেও স্ত্রীর নামে ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, আত্মীয় স্বজন, মেয়ে জামাইয়ের নামে বিপুল সম্পত্তি! 
সবটাই তো গরীব খেটে খাওয়া বাঙলার সাধারণ যুবক যুবতীর কষ্টার্জিত টাকা লুঠ করে, তাঁদের চাকরি পাওয়ার স্বপ্নে বুলডোজার চালিয়ে, পেটে লাথি মেরে! স্বাধীনতার পরে পশ্চিমবঙ্গের বুকে নিয়োগ নিয়ে সবথেকে বড় কেলেঙ্কারি। প্রাইমারি টেট থেকে এসএসসি, শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী নিয়োগে বেনজির দুর্নীতি। অবৈধভাবে অকৃতকার্য এমনকি খালি খাতা জমা দেওয়া পরীক্ষার্থীরাও চাকরি পেয়েছে স্রেফ এই দুর্নীতি চক্রের মদতে। আদালতের নির্দেশে একাধিকজন চাকরি হারিয়েছেন এই দুর্নীতির জেরেই। সেখানে রাস্তা ঘাটে আপনাকে কে 'চোর' বললে কি, খুব ভুল বলছে? আপনি কি বলেন মিস্টার পার্থ চট্টোপাধ্যায়?  
কান্তি বিশ্বাস, পার্থ দে, সত্যসাধন চক্রবর্তী, শম্ভু দে, সুদর্শন রায়চৌধুরী  -শিক্ষামন্ত্রী বামফ্রন্ট সরকারের আমলেও ছিল। ১৯৯৮-২০১০, এরাজ্যে প্রতি বছর এস.এস.সি'র মাধ্যমে নিয়োগ হয়েছিল মোট ১,৮৫,৮৪৫ জন। হ্যাঁ, ৮-১০ লক্ষ টাকার ঘুষ না দিয়েই, মেধা তালিকা গোপন না রেখেই, স্বজন পোষণ আর বেনিয়মের কলঙ্ক গায়ে না মেখেই! 
৩৪ বছরের অনেক গল্প আপনারা শুনেছেন, পাড়ার তৃণমূলের মস্তানদের নন্দীগ্রাম-সিঙ্গুর-আনন্দমার্গী-মরিচঝাঁপি-সাঁইবাড়ি'র নামতা ঘুষতে শুনেছেন, সেই মস্তান'দের একটু জানিয়ে দেবেন, ৩৪ বছরের ঐ বাংলায় একটা অনিয়ম, একটা দুর্নীতির প্রমাণও কিন্তু তাঁদের দিদি আর দিদির পদলেহনকারী পুলিশ-সিআইডি-কমিশন আজ অবধি দিতে পারেনি, ৩৪ বছরের ঐ বাংলায় টাকার বিনিময়ে কলেজে অনার্সের সিট বিক্রি হয়নি, ৩৪ বছরের ঐ বাংলায় মেধা তালিকার ছাত্র-ছাত্রী'দের স্রেফ ঘুষ দিতে না পারায় আত্মহত্যার করতে হয়নি, ৩৪ বছরের ঐ বাংলায় মুখ্যমন্ত্রী'দের কাটমানির ৭৫% পার্টি ফান্ডে জমা করার হুইপ দিতে হয়নি, ৩৪ বছরে এই রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রীকে রাস্তায় ঘাটে লোকজন প্রকাশ্যে 'চোর' বলেনি!  
মিস্টার পার্থ চট্টোপাধ্যায়, তৃণমূল আপনাকে ঝেড়ে ফেলছে। মুখ্যমন্ত্রী নাকি আপনার ফোন ধরছেন না, মিডিয়ার অলিন্দে কান পাতলে শোনা যাচ্ছে আপনাকে ক্যাবিনেট থেকে ছেঁটে ফেলা হয়েছে, তৃণমূলের সব পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে, আপনাদের দু-পয়সার মুখপাত্র টুইট করে বলে দিয়েছেন, এই দুর্নীতির দায় কেবলমাত্র আপনার, দলের না! কিন্তু আমরা জানি, আপনি একা না। তৃণমূলে পা থেকে মাথা, প্রত্যেকে দুর্নীতিগ্রস্ত। আর সেই দুর্নীতিগ্রস্তদের রিং-মাস্টারের নাম মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়! 
২০১১ তে মুখ্যমন্ত্রী হয়ে এগারোটা কমিশন গড়েছিল মেয়েটা। বছর ঘুরতেই আরও ছটা। এত কমিশন একসঙ্গে জীবনে দেখেনি রাজ্যবাসী। নবান্নের চোদ্দ তলার প্রথম থাকে সে রাখল 'জমি বণ্টনে অনিয়মে'র তদন্ত কমিশনদের। রাজারহাটের কমিশনটাকে জড়িয়ে ধরে সে বলল, তুই আমার তুরুপের তাস। দ্বিতীয় থাকে রাখল সব 'গণহত্যার' কমিশন'দের। ২১শে জুলাই কমিশনটাকে জড়িয়ে ধরে বলল তোর নাম 'বুদ্ধ ভট্টাচাজ বধ'।
কমিশনের হাতি পুষতে সেদিন খরচা হয়েছিল রাজ কোষাগারের ৫ কোটি। সিপিএম'র নেতাদের পিণ্ডি তর্পণের দিবাস্বপ্নে বিগলিত বুদ্ধিজীবীরা কমিশন'কেই দরাজ সার্টিফিকেট বিলিয়ে বলেছিলেন "এহি হ্যা রাইট চয়েস বেবি।" মিডিয়ার ক্যাকাফনি তে সেদিন অনায়াসেই চাপা পড়ে গিয়েছিলো শালকু সরেন, অজিত লোহার-পূর্ণিমা ঘোড়ুই-জিতেন নন্দী'দের লাশের নিস্তব্ধতা। আজ ১১ বছর অতিক্রান্ত, ২১শে জুলাইর মঞ্চে ধমক-চমক ছাড়া মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হিম্মত আছে নাকি কমিশনের রিপোর্ট সামনে এনে সিপিএম-র নেতাদের দুর্নীতির দায়ে জেলে ভরার?     
তাই, মিস্টার পার্থ চট্টোপাধ্যায়, আপনি জেলে গেলেন বলে গায়ের ঝাল মিটিয়ে বসে থাকার সুযোগ বামপন্থীদের নেই। সারদা, নারদা, রোজভ্যালি, বালি কয়লা, গরু, পার্থ চট্টোপাধ্যায়, মদন মিত্র, মুকুল রায় –তৃণমূলের রাজনীতির ল্যান্ডস্কেপে ছড়িয়ে থাকা এই বিক্ষিপ্ত বিন্দু গুলোকে একসাথে জুড়লে যে নকশাটা তৈরি হয় সেটা ধারাবাহিক দুর্নীতির, সেই নকশাটা দুর্নীতি কে রাজনীতির আঙিনায় প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার, সেই নকশাটা বাঙলায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাত ধরে একটা লুম্পেন সর্বস্ব রাজনীতির নিয়ন্ত্রক শক্তি হয়ে ওঠার! 
আমাদের লড়াইটা বাঙলার বেকার যুবকদের ন্যায্য চাকরি ফিরিয়ে দেবার লড়াই, মানুষের কষ্টার্জিত লুঠের টাকা ফিরিয়ে দেওয়ার লড়াই, যে মিডিয়া মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে মেরুদণ্ড বন্দক রেখেছে সেই মেরুদণ্ড ফিরিয়ে দেওয়ার লড়াই। লড়াইটা আসলে, যে রাজনীতি ব্যবস্থা আমাকে-আপনাকে প্রতিনিয়ত এই দুর্নীতির সাথে আপোষ করতে শেখাচ্ছে, সেই রাজনীতি কে হারিয়ে দেওয়ার লড়াই। বরুণ বিশ্বাস, সত্যেন্দ্র দুবে, নরেন্দ্র দাভোলকার রক্তে ভেজা পথের লড়াই। দুর্নীতি মুক্ত নতুন বাঙলায় সূর্যোদয় ঘটাবার লড়াই। শোষণহীন রাঙা প্রভাত ছিনিয়ে আনার লড়াই। 
বাই দা ওয়ে, মিস্টার পার্থ চট্টোপাধ্যায়, বুদ্ধবাবু আজও বাঙলার মানুষের মনে সম্মান নিয়েই বাঁচেন, ইনকিলাবি শ্লোগানের গর্ব নিয়ে বাঁচেন, আজও লাল ঝাণ্ডার নেতৃত্বে নতুন বাঙলা গড়ার স্বপ্ন নিয়েই বাঁচেন। 
আপনিও বাঁচবেন, দুর্নীতিবাজের তকমা নিয়ে, মানুষের ঘেন্না কুড়িয়ে, পথ চলতি মানুষের ঐ খিস্তি খেউরে! ঐ যে কথায় বলে না, 'আমরা', 'ওরা'। তফাৎ ছিলই। তফাৎ থাকবেও।

ক্যাপ্টেন লক্ষী সেহগল ~ অর্কপ্রভ সেনগুপ্ত

ক্যাপ্টেন সেহগল সম্পর্কে একটা প্রশ্ন আমার মাথায় বারেবারেই ঘুরত। যে মানুষের রাজনৈতিক চেতনা তৈরি হয়েছে মিরাট ষড়যন্ত্র মামলার প্রেক্ষাপটে সুহাসিনী চট্টোপাধ্যায়ের হাত ধরে, যিনি ডাক্তারি পড়ার পাশাপাশি সমাজতন্ত্র বা সাম্যবাদ নিয়ে যে বই পেতেন সেই বইই পড়ে ফেলতেন, যাঁর মনে গভীরতম রেখাপাত করেছিল এডগার স্নো-এর 'Red Star over China', সেই ক্যাপ্টেন সেহগল দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিলেন না কেন ? আমি দীর্ঘদিন এর উত্তর ভেবে এসেছিলাম হয়তো দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের প্রেক্ষিতে সুভাষ-কমিউনিস্ট বিরোধের জন্য ক্যাপ্টেন লক্ষ্মী নিজে মতাদর্শের দিক থেকে কমিউনিস্ট হলেও ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে কোনো সম্পর্ক রাখতে চাননি। কিন্তু পরবর্তী সময়ে ক্যাপ্টেনের স্মৃতিকথা সহ বিভিন্ন বইপত্র পড়ে দেখেছি বিষয়টি ছিল আদতে উল্টো। ক্যাপ্টেন সেহগল তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন - 

"যাইহোক, এত কাজ সত্ত্বেও আমার মধ্যে একটা ছটফটানি ছিল, সেটা প্রধানত রাজনৈতিক। যে-ভাবে কাজকর্ম চলছে তাতে আমি একটুও সন্তুষ্ট ছিলাম না। স্বাধীনতার ফলভোগ করছে কেবলমাত্র কয়েকটি লোক। শ্বেতকায়দের জায়গা দখল করেছে কৃষ্ণকায়রা। নিয়ম সব একই রকম রয়েছে, যদি এর পরিবর্তন না হয় তবে অবস্থা ক্রমেই খারাপ হতে থাকবে। আমার নিজের বিশ্বাস ছিল, এখনও আছে, যে কেবলমাত্র আমাদের মূল্যবোধের সঙ্গে খাপ খেতে পারে এমন সমাজতন্ত্র আমাদের সমস্যার সমাধান করার সাহায্য করতে পারে। বার্মা থেকে ফেরার পর থেকে আমি ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছি, রাজনৈতিক কাজ করার জন্য। কিন্তু তাঁরা আমায় (ফ্যাসিস্ট) জাপানী যোগাযোগের জন্য এড়িয়ে চলেছেন।"   

কংগ্রেসের লোকেরা তাঁকে আরও জঘন্য ভাবে অপমান করেছিল, তার বিস্তৃত বিবরণও তাঁর স্মৃতি কথায় আছে। ভারতীয় জনসঙ্ঘের রাজনীতিকে তিনি প্রবল অপছন্দ করতেন। সোশ্যালিস্ট রাজনীতিতেও তাঁর ভরসা ছিল না। তিনি শুরু থেকেই কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গেই কাজ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু কমিউনিস্টরাই তাঁকে এড়িয়ে যেতেন। সুভাষচন্দ্রের স্মৃতির প্রতি ক্যাপ্টেন দায়বদ্ধ ছিলেন। 'যা করেছি ভুল করেছি' এই মুচলেকা দিয়ে কমিউনিস্ট পার্টিতে আসা তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিল না। ক্যাপ্টেন সেহগলের পক্ষে দীর্ঘকাল আর রাজনীতিতে আসা সম্ভব হয় নি। সুযোগ হল পার্টি ভাগের পর, বাংলাদেশ মুক্তি যুদ্ধের প্রেক্ষিতে। সিপিআই-এর সুভাষচন্দ্র বা আই.এন.এ নিয়ে যে মূল্যায়ন বা ছুঁতমার্গ ছিল, নবগঠিত সিপিআই(এম)-এর তা ছিল না। বাংলাদেশ মুক্তি যুদ্ধের প্রেক্ষিতে স্বয়ং জ্যোতি বসু ক্যাপ্টেন সেহগলকে চিঠি দিয়ে অনুরোধ করলেন কলকাতায় পিপলস রিলিফ কমিটিতে যোগ দিতে। লক্ষ্মী অভিমান করতে পারতেন, কমিউনিস্টদের পূর্ববর্তী শীতলতার, প্রত্যাখ্যানের শোধ নিতে পারতেন। তিনি তার ধারে কাছ দিয়ে গেলেন না, কমিউনিস্টদের তিনি চিরকালই আপন মনে করে এসেছেন, কমিউনিস্টরাই তাঁকে নিজেদের লোক মনে করেনি। যখন এই ব্যবধান দূর করার সুযোগ এল, তিনি সানন্দেই নিলেন। প্রথমে পিপলস রিলিফ কমিটি পরে গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতির সদস্যদের নিয়ে উদ্বাস্তুদের মধ্যে তিনি যা কাজ করলেন তা অনেকেরই দৃষ্টি আকর্ষণ করল। এই প্রেক্ষিতে তাঁকে সদস্যপদ দেওয়ার কথা হয়।  লক্ষ্মী অবশ্য সিপিআই(এম) পলিটব্যুরোর সদস্যদের সঙ্গে একবার দেখা করেছিলেন পার্টিতে যোগ দেওয়ার আগে। সেখানে সুভাষচন্দ্র আর আই.এন.এ নিয়ে পার্টির নেতাদের মতামত কি সেটা বুঝে নিয়ে তারপরই পার্টিতে যোগ দেন। পূর্বেই বলেছি, সুভাষচন্দ্র সম্পর্কে সঠিক মূল্যায়ন করে না, এমন দলে তিনি যোগ দিতে আগ্রহী ছিলেন না। 

ক্যাপ্টেন সেহগলের আজ প্রয়াণ দিবস। তিনি বারবার বলেছিলেন, স্বাধীনতা তিন ধরণের হয় - রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক। ভারতে শুধু আমরা প্রথম স্বাধীনতাটি অর্জন করেছি। বাকি দুই স্বাধীনতা এখনও অর্জিত হয় নি। সেই অর্জনের পথে যে বিরাট পাহাড় আছে, তাতেই আমাদের হাতুড়ির ছোট ছোট ঘা মেরে যেতে হবে। একদিন পাহাড় ভেঙে রাস্তা দেখা যাবেই। ক্যাপ্টেন বিশ্বাস করতেন এই কথা, আমরাও করি।

বুধবার, ২০ জুলাই, ২০২২

কি ঘটেছিল ২১শে জুলাই? ~ গার্গী চ্যাটার্জী

কি ঘটেছিল ২১শে জুলাই ?

● ৩টি বাস পোড়ানো হয়েছিল,

● ৩৫টি গাড়ি ভাঙচুর হয়েছিল,

● গুলি-বোমা-পাথরে জখম হন ২১৫পুলিশ,

● ধর্মতলায় সাংবাদিক মার খেয়েছিলেন,

● 'বহু সশস্ত্র দুষ্কৃতী (অ্যান্টিসোস্যাল) নেশাগ্রস্ত অবস্থায় জড়ো হয়েছিল' জানান মণীশ গুপ্ত 

● জ্যোতি বসুকে গাড়ি থেকে নামাতে ছদ্মবেশ সোনালী গুহদের,

● মৃতদের একজনের নাম এখনও জানে না তৃণমূল,

● ১জন মারা যায় 'সিরোসিস অব লিভারে',

● বিরোধিতা করে জ্যোতি বসুর শরণাপন্ন হন গণিখান,

জন্মের আগেই ২১শে জুলাই চরিত্র বুঝিয়েছিল তৃণমূল!
দলটি আসলে 'দুষ্কৃতীদের ক্লাস্টার'। ইতিহাসে এমন উদাহরণ খুব একটা নেই, যেখানে তৈরি হওয়ার আগেই কোনও দলের চরিত্র এভাবে প্রকাশিত হয়েছে। 

মমতা ব্যানার্জির নেতৃত্বাধীন কোনও দল কী হতে পারে, কী কী করতে পারে তা স্পষ্ট করেছিল ২১শে জুলাই-ই।

তখন ১৯৯৩। মুখ্যমন্ত্রী তখন কমরেড জ্যোতি বসু। স্বরাষ্ট্রসচিব ছিলেন মণীশ গুপ্ত। তৃণমূল কংগ্রেস তৈরিই হয়নি। মমতা ব্যানার্জি তখন কংগ্রেসে। তিনি তখন যুব কংগ্রেসের সভানেত্রী। তিনিই ডাক দিয়েছিলেন —'মহাকরণ অভিযান'-র। ঘোষণা ছিল 'মহাকরণ দখল করা হবে'। যদিও প্রদেশ কংগ্রেস এই 'অভিযান'-র বিরোধিতা করে। 

আজকাল পত্রিকায় ১৯৯৩-র ২৪শে জুলাই একটি খবর প্রকাশিত হয়। শিরোনাম ছিল —'গুন্ডামি রুখতে গণি বসুর সঙ্গে'। সংবাদে জানা যায়, তৎকালীন কংগ্রেস নেতা এ বি এ গণিখান চৌধুরী নয়াদিল্লির বঙ্গভবনে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর সঙ্গে দেখা করেছিলেন ২১শে জুলাইয়ের আগে। গণিখান চৌধুরী সেদিন পশ্চিমবঙ্গের আইনশৃঙ্খলা শক্ত হাতে রক্ষা করার জন্য মুখ্যমন্ত্রী যে ধরনের ব্যবস্থা নেবেন তাকে নিঃশর্তে সমর্থন জানানোর প্রতিশ্রুতি দেন। জ্যোতি বসুকে গণিখান চৌধুরী বলেন, ''গুন্ডামি করে মহাকরণে মুখ্যমন্ত্রীকে ঢুকতে না দেওয়া গণতান্ত্রিক আন্দোলন হতে পারে না। আপনাকে আমি নির্বাচনের মাধ্যমে গদি থেকে টেনে নামানোর চেষ্টা করবো। আপনিও তার বিরোধিতা করবেন। কিন্তু কেউ যদি জোর করে আপনার চেয়ারটা কেড়ে নিতে চায় তা হলে সেটা হবে স্রেফ গুন্ডামি। এটা কোনভাবেই বরদাস্ত করা যায় না।'' প্রধানমন্ত্রী নরসীমা রাও-ও যে যুব কংগ্রেসের এই ধরনের বেপরোয়া ঘটনার সমালোচনা করেছেন তা জ্যোতি বসুকে গণিখান চৌধুরী জানান সেদিন।

কিন্তু তবু রক্ত ঝরেছিল। কী হয়েছিল ২১শে জুলাই? পুলিশের গুলিতে ১৩জন যুব কংগ্রেস 'কর্মী' নিহত হয়েছিলেন ময়দানে। '২১শে জুলাই' বলতে সোজা কথায় এমনটাই বলা হয়। কিন্তু কেন পুলিশ গুলি চালালো? যারা মারা গিয়েছিলেন, তাঁরা কারা? সেদিন মমতা ব্যানার্জি, মদন মিত্র, সোনালি গুহদের কাণ্ডকারখানা কেমন ছিলো? মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর মমতা ব্যানার্জি ওই ২১শে জুলাই নিয়ে কী করেছেন? এই প্রশ্নের উত্তরগুলি খুঁজলেই বোঝা যায় — কী হয়েছিল ১৯৯৩-র ২১শে জুলাই।

স্বরাষ্ট্রসচিব হিসাবে মণীশ গুপ্ত সেদিনের ঘটনার বিষয়ে হাইকোর্টে ১৯৯৩-র ২রা আগস্ট একটি হলফনামা জমা দিয়েছিলেন। সেই হলফনামা অনুসারে, ''ওইদিন(১৯৯৩-র ২১শে জুলাই)-এ জমায়েতে 'বহু সশস্ত্র দুষ্কৃতী(অ্যান্টিসোস্যাল) নেশাগ্রস্ত অবস্থায় জড়ো হয়েছিলো।'' সেদিন ১৩ জন যুবকের মৃত্যু হয়েছিলো। আশ্চর্য হলো মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর সেই ঘটনার বিচারবিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ দিয়েছিলেন মমতা ব্যানার্জি। কিন্তু আজও তৃণমূল জানে না ওই ঘটনায় মৃত ১৩তম ব্যক্তিটি কে? তৃণমূলের ওয়েবসাইটে এখনও ওই ১৩ নম্বর জায়গার পাশে লেখা আছে —'অ্যানোনিমাস'। অর্থাৎ অজানা। কেন তাঁর পরিচয় গোপন রাখেন মমতা ব্যানার্জি? 

অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি সুশান্ত  চ্যাটার্জির নেতৃত্বে '২১ শে জুলাইয়ের তদন্ত কমিশন' তৃণমূল সরকার ২০১১ সালে ক্ষমতায় আসার পরই গঠিত হয়। ২০১৪-র ডিসেম্বরে এই কমিশন রিপোর্ট জমা দেয়। কমিশন সাক্ষ্য দিতে ডেকেছিল বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসু, প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে। কিন্তু যিনি সেই 'অভিযান'-র উদ্যোক্তা, সেই মমতা ব্যানার্জিকেই এই কমিশন কখনো ডাকেনি। কমিশন কেমন কাজ করেছে, তা এরথেকেই কিছুটা বোঝা যায়। তবু কমিশনের চেয়ারম্যান অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি সুশান্ত চ্যাটার্জি তাঁর তদন্ত রিপোর্ট জানাতে বাধ্য হয়েছেন, যে ১৩জনের মৃত্যু হয়েছিল সেদিন, তাদের মধ্যে একজনের গায়ে গুলির কোনও আঘাতই মেলেনি। সেই ব্যক্তির মৃত্যুর কারণ 'সিরোসিস অব লিভার'। সাধারণত এই রোগটি বেপরোয়া মদ্যপানের কারণে হয়। আর বেপরোয়া মদ্যপান দুষ্কৃতীদের পরিচিত বৈশিষ্ট্য।

রাজ্যের স্বরাষ্ট্রসচিব তখন ছিলেন মণীশ গুপ্ত। পালাবদলের পর মমতা ব্যানার্জির ঘনিষ্ঠ হয়ে তিনি হন রাজ্যের বিদ্যুৎমন্ত্রী। ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে পরাস্ত হলে তাঁকে মমতা ব্যানার্জি রাজ্যসভার সাংসদ (মিঠুন চক্রবর্তী পদত্যাগ করলে তাঁর শূূন্যস্থানে) করেছেন। স্বরাষ্ট্রসচিব হিসাবে তিনি সেদিনের ঘটনার বিষয়ে হাইকোর্টে একটি হলফনামা জমা দিয়েছিলেন। ১৯৯৩-র ২রা আগস্ট তাঁর জমা দেওয়া সেই হলফনামা অনুসারে, ''ওই দিন(১৯৯৩-র ২১শে জুলাই)-এ জমায়েতে বহু সশস্ত্র দুষ্কৃতী(অ্যান্টিসোস্যাল) নেশাগ্রস্ত অবস্থায় জড়ো হয়েছিলো। ওই দিন সকাল সাড়ে ৯টা থেকে সারা রাজ্যের কয়েক হাজার যুব কংগ্রেসকর্মী স্ট্র্যান্ড রোড, বি বি গাঙ্গুলি স্ট্রিট, রানি রাসমণি অ্যাভিনিউ, এসপ্ল্যানেড রো ইস্ট এবং ব্রেবোর্ন রোডে জমায়েত হয়। মেয়ো রোডে ১৫ হাজার, ধর্মতলায় ১৫ হাজার, ব্রেবোর্ন রোডে, স্ট্র্যান্ড রোডে ১০ হাজার, বি বি গাঙ্গুলি স্ট্রিটে ৭ হাজার জমায়েত ছিলো। যুব কংগ্রেস কর্মীরা মহাকরণের দিকে ছুটতে থাকে। পুলিশ প্রথমে নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জনতাকে শান্ত করতে চেষ্টা করে। কিন্তু পুলিশের সেই চেষ্টা ফলপ্রসূ হয়নি। 'জনতা' পুলিশকে লক্ষ্য করে পাইপগান থেকে গুলি ছোঁড়ে। ইট, পাথর, সোডার বোতলও ছোঁড়া হয় যথেচ্ছ। পুলিশ তখন লাঠি চালায়। ৩৪১ রাউন্ড কাঁদানে গ্যাসের শেলও ফাটায় পুলিশ এবং রাইফেল থেকে ৭৫ রাউন্ড ও রিভলভার থেকে ৪৬ রাউন্ড গুলি চালানো হয়।'' 

অর্থাৎ সেদিন 'আন্দোলনকারীরা' বোমা, পাইপগান নিয়ে এসেছিলো! তারা মহাকরণ দখল করতে ছুটছিলো। গুলি ছুঁড়ছিলো, বোমা মারছিলো। 

মণীশ গুপ্তর হলফনামা আরও জানিয়েছিল, ''সেদিন ৩টি বাস পোড়ানো হয়েছিলো। ৩৫টি গাড়ি ভাঙচুর হয়েছিলো। সব মিলিয়ে জখম হয়েছিলেন ২১৫ জনেরও বেশি পুলিশ। তাঁদের মধ্যে অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার, যুগ্ম কমিশনার, ডি সি (সদর), ৭জন ডি সি, ১০ জন অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার রয়েছে। ৩৪ জন পুলিশকে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাওয়া হয় পুলিশ হাসপাতালে। তাঁদের অনেকেরই পাইপগানের গুলি এবং বোমার স্প্লিন্টার লেগেছিলো। তালতলা থানার সার্জেন্ট ডি কে ঘোষালের গুলি লেগেছিলো। এক সাব ইনস্পেক্টর কালাচাঁদ সমাদ্দারের শরীরে আঘাত ছিল বোমার। কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের সাব ইনস্পেক্টর এ কে গাঙ্গুলিকে এস এস কে এম হাসপাতালের সামনে মেরে মাথা ফাটিয়ে, হাত ভেঙে দিয়েছিলো দুর্বৃত্তরা।''

আক্রান্ত, রক্তাক্ত হয়েছিলো পুলিশ। 
তাই গুলি চালিয়েছিলো। 
সেদিনও সাংবাদিক পিটিয়েছিলো মমতা ব্যানার্জির দলবল, হুবহু আজকের মতো। দুপুর পৌনে তিনটে নাগাদ ধর্মতলায় স্কুটার আরোহী 
সংবাদসংস্থা পিটি‌আই-র বরিষ্ঠ সাংবাদিক সঈদ আহ্‌মেদকে মমতা ব্যানার্জির কর্মীরা ঘিরে ধরে মেরেছিলো। মারাত্মক আহত হন তিনি।

আরও কী চক্রান্ত ছিল? 

সোনালি গুহর কথাই শোনা যাক। সাতগাছিয়ার বিধায়ক সোনালি গুহ এখন রাজ্য বিধানসভার উপাধ্যক্ষা। ১৯৯৩সালের ২১শে জুলাইয়ের স্মৃতিচারণা করতে তৃণমূলের মুখপত্র 'জাগো বাংলা'-য় একটি ছোট প্রবন্ধ লিখেছিলেন তিনি ২০১২-তে। সোনালি গুহ দলীয় মুখপত্রের (বর্ষ -৮,সংখ্যা ৩৯০, সাপ্তাহিক) সংখ্যার তৃতীয় পৃষ্ঠায় লিখেছিলেন,''১৯বছর আগের ২১শে জুলাই। দিনটি ছিল বুধবার। সকাল-সকাল আমরা দিদির বাড়ি চলে এসেছিলাম। আগে থেকেই আমাদের কয়েকজন মেয়েকে গোপনে একটা দায়িত্ব দেওয়া ছিলো।'' কী সেই দায়িত্ব? বিধানসভার উপাধ্যক্ষা লিখছেন,''তা হলো, জ্যোতি বসুর গাড়ি আটকে দিতে হবে। আমরা তাই সটান চলে গেলাম রেড রোডে। কারণ ওই রাস্তা দিয়ে জ্যোতি বসুর কনভয় যাবে। মুসলিম মহিলাদের মতো বোরখা পরে সেদিন ওই রাস্তায় গিয়ে আমরা অপেক্ষা করছিলাম। কিন্তু শ্যামলী ভদ্র (প্রয়াত প্রাক্তন কাউন্সিলর)-র হাতের শাঁখা-পলা বেরিয়ে পড়ায় পুলিশ ধরে ফেলে।'' 
পুলিশ সেদিন তাঁদের সেখান থেকে সরিয়ে দেয়।

কিন্তু যা স্পষ্ট, তা হলো — ১৯৯৩সালের ২১শে জুলাই মহানগরের ফাঁকা রাস্তায় তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর গাড়ি আটকানোর চক্রান্ত করেছিলেন মমতা ব্যানার্জি। তারজন্য রীতিমতো আগে থেকে ছক কষা হয়েছিলো। এমনকি ছদ্মবেশেরও সাহায্য নেওয়া হয়েছিল। উল্লেখ্য, সেই সময় মুখ্যমন্ত্রীর জন্য নির্ধারিত নিরাপত্তা আজকের মতো আঁটোসাঁটো, কড়া ছিলো না। রাজ্যস্তরে 'ব্ল্যাক ক্যাট কমান্ডো' কথাটির অস্তিত্বই ছিলো না। ছিলো না এ কে ৪৭হাতে নিরাপত্তাকর্মী। মুখ্যমন্ত্রীর কনভয় ছিল ছোট। ফলে সহজেই অনুমান করা যায়, কমরেড জ্যোতি বসুকে ঘিরে নিরাপত্তা ছিল যথেষ্ট শিথিল। সেই সুযোগে মুখ্যমন্ত্রীর গাড়ি আটকে ঠিক কী করার ভাবনা ছিলো মমতা ব্যানার্জির— তা স্বাভাবিকভাবেই এড়িয়ে গেছেন সোনালি গুহ। তবে বলাবাহুল্য, জ্যোতি বসুর গাড়ি আটকে তাঁকে নেহাতই প্রণাম করা, শুভেচ্ছা জানানোর বাসনা নিশ্চয়ই ছিলো না তাঁদের। যদি শুধু বিক্ষোভ দেখানোর ইচ্ছাও থাকতো, তাহলে ছদ্মবেশ নেওয়ারও কোনো দরকার পড়তো না। এখানেই দানা বাঁধে সন্দেহ।



রবিবার, ১০ জুলাই, ২০২২

বুক রিভিউ ~ ডাঃ সমুদ্র সেনগুপ্ত

বুক রিভিউ
বই এর নাম: লুই নেপোলিয়নের অষ্টাদশ ব্রুমেয়ার
লেখক: কার্ল মার্ক্স 

এই বই এর রিভিউটা উল্টো ভাবে শুরু করা যাক, প্রথমে টীকা তারপরে টিপ্পনী, তারও পরে সময় থাকলে রিভিউ। 

টীকা নম্বর এক: ফরাসি বিপ্লবের সময় একটা ক্যালেন্ডার তৈরি করা হয়েছিল যেটা ফ্রেঞ্চ রিপাবলিকান ক্যালেন্ডার নামে পরিচিত। ১৭৯৩ থেকে ১৮০৫ সাল অবধি এই বারো বছর আর পরের দিকে ১৮৭১ সালের পারি কমিউনের সময় ১৮ দিন ধরে এই ক্যালেন্ডার টি ব্যবহার করা হয়েছিল।সব রকমের ধর্মীয় ও রাজতান্ত্রিক প্রভাব মুক্ত একটা ক্যালেন্ডার তৈরির তাগিদ থেকে এর আবির্ভাব। এছাড়াও দশমিক পদ্ধতির প্রচলনও ছিল আরেকটা উদ্দেশ্য। এই ক্যালেন্ডার এর দ্বিতীয় মাসটি "ব্রুমেয়ার" নামে পরিচিত, শব্দটি এসেছে ব্রুমে বা কুয়াশা থেকে (বছরের ওই সময়টা ফ্রান্সে প্রচুর কুয়াশা হয় বলে); মোটামুটি ২২/২৪সে অক্টোবর থেকে একমাস। 

টীকা নম্বর দুই: ১৭৯৯ সালের ৯ নভেম্বর যে প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে জেনারেল নেপোলিয়ন বোনাপার্ট ক্ষমতায় আসেন গভর্নমেন্ট অফ ডিরেকটরী কে সরিয়ে কনস্যুলেট স্থাপন করেন সেই তারিখটি ছিল ওই ক্যালেন্ডার অনুযায়ী অষ্টম বছরের ব্রূমেয়ার মাসের ১৮ তারিখ। এর অনেক পরে ১৮৫১ সালে আরেকটি প্রাসাদ ষড়যন্ত্র এর মাধ্যমে ওই নেপোলিয়ন এর ভাইপো ল্লুই নেপোলিয়ন এর ক্ষমতা দখলকে বর্ণনা করতে গিয়ে কার্ল মার্ক্স সেই আঠেরই ব্রূমেয়ারের প্রসঙ্গ টেনে আনেন এবং একটি পুস্তিকা রচনা করেন ওই নামে যেটি ১৮৫২ সালে প্রকাশিত হয়। 

টিপ্পনী নম্বর এক: পুস্তিকাটির এক্কেবারে গোড়াতেই মার্ক্স বলছেন যে, " হেগেল কোথাও একটা মন্তব্য করেছিলেন যে পৃথিবীর সব মহান ঐতিহাসিক ঘটনা আর চরিত্রগুলি বলতে গেলে দু'বার করে আমাদের সামনে হাজির হয়। উনি এটা যোগ করতে ভুলে গেছিলেন যে প্রথম বার ওটা হয় বিয়োগান্তক নাটক হিসেবে আর দ্বিতীয় বার ওটা আসে প্রহসন হিসেবে।" এই লাইনটি পরবর্তীকালে একটি জগৎ বিখ্যাত কোটেশন হিসেবে পরিচিত হয়ে যায়। 

এই অবধি লিখতে গিয়েই লেখাটা অনেক দীর্ঘ হয়ে গেল তাই বইটার রিভিউ আরেক দিন হবে খন। আজ কেবল দ্বিতীয় টিপ্পনীটা দিয়েই শেষ করা যাক।

টিপ্পনী নম্বর দুই: ইতিহাসের পাতায় ব্যক্তিমানুষের কি ভূমিকা সেটা বিশ্লেষণ করতে গিয়ে এই বইতে মার্ক্স যা বলেছিলেন সেটি পরবর্তীকালে একটি জগৎ বিখ্যাত কোটেশন হিসেবে পরিচিত হয়। ইংরেজি অনুবাদ দে কথা গুলো এই রকম: "Men make their own history, but they do not make it as they please; they do not make it under self-selected circumstances, but under circumstances existing already, given and transmitted from the past."

প্রথম লাইনটার কেবল বাংলা অনুবাদ করলে দাঁড়ায়, "জনগনই তাদের ইতিহাস রচনা করে।" চেনা চেনা লাগছে ? লাগবার কথা। লাল ঝান্ডা দিয়ে সাজানো ব্রিগেডের মাঠে জড়ো হওয়া বারুইপুরের পেয়ারা চাষী, বলাগড়ের মাঝি, ব্যারাকপুরের মজুর, সবাই শুনছে এই কথাগুলো সেই উঁচু মাচায় বসে থাকা ধুতি পাঞ্জাবি পাম্প শু পরা রোগা পাতলা চেহারার একজন বক্তা'র মুখ থেকে। সেই বক্তা কোনোদিন ঘাড়ে ধরে বুঝিয়ে দেন নি যে তিনি মার্ক্স এর এই আঠেরো ব্রুমেয়ার থেকে অনায়াসে কোট করে যাচ্ছেন, অথচ কি অদ্ভুত সাবলীল ভাবে জনগণের মধ্যে নিমেষে ছড়িয়ে দিয়ে যাচ্ছেন সেই মহান জার্মান দার্শনিক বিপ্লবীর বাণী। এর নাম নেতা, শিক্ষক, গুরু। তত্বকথাটি পড়ে, শিখে, আত্মস্থ করে জনগণের মধ্যে নিয়ে যাওয়া যার কাজ। সেই বক্তা'র পরিচয় দিতে হলে বৃথাই আপনি আমার দেয়ালে এসেছেন। 

(তথ্যঋণ: অজয় দাশগুপ্ত দা)

মঙ্গলবার, ৫ জুলাই, ২০২২

দোষ ট কিসে? ~ সুস্মিতা ওঝা

"শুনছ ন কি হারু খুড়া,
পোধান মন্ত্রী অটল বুড়া,
সিদ্ধান্ত ট লিবার আগে
দিদির সাথে করথ শলা!
আজকে সবাই জানত্যে পাল্য,
বুঢ়া যখন চল্যেই গেল,
পোতি বছর জন্মদিনে
চলথ উপহারের পালা!"
"ইত্যে অবাক হছিস ক্যানে? 
পোখরানে বিস্ফোরন দিনে,
ইকটু ইকটু জানথ, সে কি
ভাব্যেছিলি বুকনি মিছা?
করব্যে কাকে রাষ্ট্রপতি?
ভাব্যে বুঢ়া পায় না গতি!
মুশকিল আসান আবুল কালাম,
নাম ট, সে ত দিদির বাছা! 
মিছা নয়খ, কিন্তু যে ট, 
জানথ নাইখ, সিটও দেখ!,
ব্যাঙ্কে, বিমায় ফরেন মানি,
বেচল্য যখন বালকো খনি!
রাষ্ট্রায়ত্ব শিল্প ছ'টা,
বন্ধ করার সিদ্ধান্ত টা,
ইসব পাপের কথা দিদি
তখন কনহই জানে ত নি ! 
বুড়া কালের সাথী পেনশন,
শেয়ার ঘাটে খাটা-টেনশন,
থাকল্য তদের! দিদি সুখে
তেলে-জলে রইল্য মিশে।
দিদি হছ্যে সাপের মনি,
তেমনি চলন, আর বুকুনি।
মরিস যদি ফণী'র বিষে!
দিদির তাথে দোষ ট কিসে?"
           -----------

বুধবার, ২৯ জুন, ২০২২

​গর্ভপাতের অধিকার প্রসঙ্গে ~ বিষাণ বসু

মার্কিন শীর্ষ আদালত মেয়েদের গর্ভপাতের অধিকারে হস্তক্ষেপ করেছে। এটুকু নিশ্চিত। সেই রায়ের সূত্র ধরে সেদেশের বিভিন্ন রাজ্য নিজেদের আইনে ঠিক কী কী বদল আনবে, তা এখুনি বলা মুশকিল। তবে আসছে। ভবিষ্যতে আরও আসবে বলেই মনে হয়। মার্কিন দেশে মেয়েরা গর্ভপাতের অধিকার সহজে পায়নি। এদেশে যত অবাধে গর্ভপাত সংক্রান্ত আইন পাস হয়েছিল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তা এসেছিল বিস্তর জটিলতা সহকারে।
Abortion is Legal 1971 India

ইহুদিরা বিশ্বাস করে, মনুষ্যজীবন শুরু হয় জন্মের মুহূর্ত থেকে। তাঁদের গর্ভপাত নিয়ে আপত্তির কিছু নেই। কিন্তু খ্রিষ্টানদের, বিশেষত ক্যাথলিক খ্রিষ্টানদের, বিশ্বাস - মনুষ্যজীবনের শুরু শুক্রাণু ও ডিম্বাণুর নিষেক ঘটার মুহূর্ত থেকেই (পরবর্তীতে জিনবিজ্ঞান থেকে লব্জ ধার করে যুক্তি সাজানো হয়, নিষেকের মুহূর্তেই জাইগোট তার একান্ত নিজস্ব জেনেটিক গঠন পেয়ে থাকে, যা জারি থাকবে জীবনভর)। অতএব, যেকোনও গর্ভপাতই হত্যা। সুতরাং ক্যাথলিক খ্রিষ্টানদের দ্বারা চালিত আমেরিকায় গর্ভপাত নিয়ে আপত্তি থাকবে, সে তো বলাই বাহুল্য। সে তুলনায়, হিন্দুধর্মের অপরিবর্তনীয় ও দেহাতীত আত্মায় বিশ্বাস - যে আত্মা কিনা ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে - এদেশে, সম্ভবত, গর্ভপাত বিষয়ক আইন নিয়ে বিচলিত না হওয়ার কারণ। তাছাড়া, এদেশে যখন সে আইন পাস হয়, তখন রাষ্ট্রব্যবস্থা ও ব্যক্তিগত ধর্মের খুব একটা মাখামাখি বা সঙ্ঘাত ছিল না, কাজেই ধর্মসংক্রান্ত আপত্তি - যা হওয়ার এমনিতেও কারণ ছিল না - বা তদসংশ্লিষ্ট শোরগোল ওঠেনি।
কিন্তু গর্ভপাতের বিরুদ্ধে ধর্মীয় যুক্তি বাদ দিয়েও এথিক্সের দিক থেকে আপত্তিগুলো ঠিক কী ছিল? সে যুক্তির বিরুদ্ধে প্রতিযুক্তিই বা কী কী? সেই কথাগুলো ফিরে দেখা যাক। তবে সে আলোচনায় যাওয়ার আগে মানবশিশুর জন্মের আগেকার পর্যায়গুলো বুঝে নেওয়া দরকার।
একেবারে শুরুর পর্যায়টা হলো নিষেক - ফার্টিলাইজেশন। শুক্রাণু ডিম্বানুর মিলন - দুইপক্ষের জিনের মিশ্রণে তৈরি হলো জাইগোট-এর জেনেটিক গঠন। এক থেকে দুই সপ্তাহের মধ্যে জাইগোট এসে আঁকড়ে ধরবে জয়ায়ুর দেওয়াল। ইমপ্ল্যান্টেশন। মায়ের জরায়ু আগলে রাখবে তাকে। (ক্যাথলিক খ্রিষ্টানদের মত অনুসারে, ফার্টিলাইজেশন থেকেই জাইগোট-টি মানুষ। অতএব, ইমপ্ল্যান্টেশন আটকানোটাও অনুচিত।) জাইগোট থেকে এমব্রায়ো, অর্থাৎ ভ্রূণে পরিবর্তন, ঘটতে থাকবে ধীরে ধীরে। শুরুর পর্যায়ের কোষগুলো থেকে শরীরের সবরকম কোষ তৈরি হতে পারে, কিন্তু আস্তে আস্তে 'বিশেষজ্ঞ কোষ' তৈরি হতে থাকে, যা থেকে কিনা নির্দিষ্ট অঙ্গ বা তন্ত্রের কোষই তৈরি হওয়া সম্ভব। ভ্রূণের রূপও বদলে যেতে থাকে। বারো থেকে ষোল সপ্তাহের মধ্যে ভ্রূণটি মানব-ভ্রূণের চেহারা নেয়। তার আগে অব্দি ভ্রূণটিকে আর পাঁচটা স্তন্যপায়ী প্রাণীর ভ্রূণ থেকে আলাদা করা মুশকিল। আগে ভাবা হতো, চব্বিশ থেকে আটাশ সপ্তাহ বয়সের মাথায় গর্ভস্থ শিশু মাতৃজঠরের বাইরে এসে বেঁচে থাকতে সক্ষম। বিজ্ঞানের অগ্রগতির সঙ্গে সময়টা এগিয়ে এসেছে - মাতৃগর্ভে বাইশ সপ্তাহ কাটিয়ে আসা শিশুকেও বাঁচানো সম্ভব। ঠিকঠাক পরিকাঠামো থাকলে চব্বিশ সপ্তাহে জন্মানো শিশুর বাঁচার সম্ভাবনা প্রায় পঞ্চাশ-ষাট শতাংশ, বাইশ সপ্তাহে সেটা পঁচিশ শতাংশ।
এই সময়কালের মধ্যে ভ্রূণ ঠিক কবে মানবশিশু হিসেবে গণ্য হওয়ার যোগ্য হয়ে উঠল, তা বুঝে ওঠা মুশকিল। ২০১০ সালে নেব্রাস্কায় কুড়ি সপ্তাহের বেশি বয়সের ভ্রূণের গর্ভপাত নিষিদ্ধ হয়। কেননা, কুড়ি সপ্তাহে নাকি ভ্রূণ ব্যথা-যন্ত্রণা অনুভবে সক্ষম (যদিও ধাত্রীবিদরা এ বিষয়ে সহমত নন)। নেব্রাস্কার দেখাদেখি আরও বেশ কিছু রাজ্যে অনুরূপ আইন পাস হয়, যদিও ২০১৫ সালে মার্কিন সংসদে এই বাবদ বিল (Pain-capable Unborn Child Protection Act) পাস করানোর চেষ্টা ব্যর্থ হয়।
এবারে আসা যাক এথিক্সের প্রশ্নে।
গর্ভপাতের বিরুদ্ধে প্রাথমিক যুক্তিটা ধর্মীয়, যা শুরুতেই বললাম। কিন্তু এথিক্স ব্যাপারটা ধর্মের হাত ধরেই এসেছে, সুতরাং ধর্মীয় যুক্তিটা কিয়দংশে এথিক্সেরও যুক্তি। সেই যুক্তি অনুসারে, গর্ভাবস্থার প্রতিটি পর্যায়েই ভ্রূণটি মানব-ভ্রূণই। অতএব তাকে হত্যা মানব-হত্যা। আবার ধরুন, চব্বিশ সপ্তাহে গর্ভস্থ শিশু শরীরের বাইরে বেঁচে থাকতে সক্ষম - অন্তত এক-চতুর্থাংশ ক্ষেত্রে বাইশ সপ্তাহের শিশুও তা-ই। মানুষ হিসেবেই। তাহলে কোনও একটি বিশেষ দিনে কেমন করে বলা সম্ভব, যে, ঠিক তার আগের দিনটিতে গর্ভস্থ ভ্রূণটি - নাকি শিশুটি - 'মানুষ' হিসেবে গণ্য হওয়ার উপযুক্ত নয়? এমন করে একদিন একদিন করে পেছোতে থাকলে একেবারে শুরুর মুহূর্ত, অর্থাৎ ফার্টিলাইজেশন, অব্দি যুক্তি পাওয়া যায়।
এটা অবশ্য লজিকের ভাষায় স্লিপারি স্লোপ আর্গুমেন্ট। এমন যুক্তি ধরতে থাকলে পরীক্ষায় পাসমার্ক বা গাড়ির স্পিড লিমিট, সবকিছুর বিরুদ্ধেই অনুরূপ যুক্তি দেওয়া সম্ভব। অর্থাৎ, পরীক্ষায় তেত্রিশ পাওয়া মেয়েটি কি চৌত্রিশ পাওয়ার থেকে খারাপ? তাহলে কোন যুক্তিতে সে ফেল? আবার তেত্রিশকে যদি মানেন, বত্রিশ নয় কেন? এমন করে শূন্য অব্দি অনায়াসে পৌঁছে যাওয়া যায়।
পরের যুক্তিটা আরেকটু জটিল। যেকোনও মানুষকে হত্যা অনুচিত কেন? মানে, এ তো জানা-ই কথা যে, মানুষটা একদিন না একদিন মরতই। কী এমন ক্ষতি যদি সেই অনিবার্য দিনটিকে কয়েক বছর এগিয়ে আনা হয়? গ্রহণযোগ্য উত্তর হলো, অন্যায়, কেননা মানুষটা তার ভবিষ্যত বেঁচে থাকার অধিকার, তার জীবনের পুরো ক্ষমতা, জীবনের পুরো সম্ভাবনা - আর পাঁচজন মানুষের মতো জীবন - তা উপভোগ করা থেকে বঞ্চিত হলো। একটি মানব-ভ্রূণের ক্ষেত্রে সেই সম্ভাবনা জন্মানো মানবশিশুর থেকে খুব আলাদা কি? এবং সেই সম্ভাবনা ভ্রূণাবস্থার প্রতিটি পর্যায়েই সমান (স্বাভাবিক কোনও কারণে গর্ভপাত হয়ে গেলে তা সেই সম্ভাবনার অপমৃত্যু)। অতএব, গর্ভপাত মানে সেই সম্ভাবনাকে বিকশিত হতে না দেওয়া। মানুষ খুনেও যেমনটা ঘটে, তেমনই।
প্রথমত, এই যুক্তি মানলে, গুরুতর রোগগ্রস্ত মানুষ বা মানবশিশু - যাদের 'আর পাঁচজন মানুষের মতো জীবন' গড়ে ওঠার সম্ভাবনা নেই - তাদেরকে মেরে ফেলার যুক্তিও পাওয়া যেতে পারে।
দ্বিতীয়ত, 'আর পাঁচজন মানুষের মতো জীবন' এই সম্ভাবনা একজন মানুষেরই থাকে - 'পার্সন' অর্থে মানুষের, যার একটা স্বতন্ত্র অস্তিত্ব ও চিন্তাশক্তিসম্পন্ন মন রয়েছে। তার আগে অব্দি সে স্রেফ জিন-পরিচয় বা প্রজাতি-পরিচয়ে মানুষ - 'অর্গানিজম' হিসেবে মানুষ, 'পার্সন' হিসেবে নয়। অতএব, গর্ভপাত মানে 'অর্গানিজম' থেকে 'পার্সন'-এ পরিণত হতে না দেওয়া। অর্থাৎ 'পার্সন'-টি তৈরি হতে পারল না - যা তৈরি হলে আনুষঙ্গিক মনুষ্য-সম্ভাবনাও তৈরি হতো - কিন্তু যেহেতু 'পার্সন'-টি এক্ষেত্রে তৈরিই হয়নি, সেক্ষেত্রে সম্ভাবনার অপমৃত্যু হিসেবে ভাবার যুক্তি নেই। অর্থাৎ, গর্ভপাত সেই অর্থে 'পার্সন' তৈরি হওয়া প্রতিরোধ করছে - গর্ভনিরোধকের ব্যবহারকে যদি 'সম্ভাবনার অপমৃত্যু' হিসেবে না দেখেন, গর্ভপাতকেও তেমন করে দেখার কারণ নেই।
যাঁরা গর্ভপাতের পক্ষে, তাঁরা মানব-ভ্রূণ ও মানবশিশুর মধ্যে এই 'পার্সন' কি 'পার্সন' নয়, এই যুক্তির উপরেই ভরসা করেন। অন্তত করতেন।
পরবর্তীতে জুডিথ থমসন ভ্রূণকে মনুষ্য-পদভুক্ত হিসেবে ধরেও চমৎকার এক যুক্তি সাজান। তাঁর বক্তব্য, ধরা যাক, মানব-ভ্রূণ একটি সম্পূর্ণ জীবন ও তাকে মায়ের দেহ ও অস্তিত্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করে এক পৃথক অস্তিত্ব হিসেবে ভাবা সম্ভব। কিন্তু এক 'পৃথক অস্তিত্ব' যখন অপর একজনের শরীরকে আশ্রয় হিসেবে ব্যবহার করছে, তখন তা তো পারস্পরিক সম্মতি ভিন্ন উচিত নয়। অর্থাৎ ভ্রূণ যদি পৃথক অস্তিত্বসম্পন্ন হয়, তাহলে যে নারীর শরীর - অর্থাৎ মায়ের শরীর - সে আশ্রয় হিসেবে ব্যবহার করছে, তা মায়ের সম্মতি ব্যতিরেকে হওয়া অনুচিত। সুতরাং, মা যদি চায়, ভ্রূণকে আশ্রয়চ্যুত - মাতৃজঠর থেকে বিচ্যুত - করতে পারে।
মূল যুক্তি-প্রতিযুক্তির জায়গাগুলো এই।
এছাড়া নারীর নিজের শরীরের উপর অধিকার, নিজের শরীর-বিষয়ক সিদ্ধান্তগ্রহণের অধিকার ইত্যাদি যুক্তি তো আছেই। কিন্তু সেক্ষেত্রে ভ্রূণের বাকি অর্ধেক জিন যে তরফ থেকে আসে - অর্থাৎ পুরুষ বা পিতার অধিকার, তাঁর সিদ্ধান্তগ্রহণের অধিকার - সেসব যুক্তিও উঠে আসতে পারে।
ধর্ষণ বা বলাৎকারের ফলে গর্ভবতী হয়ে পড়া নারীর গর্ভপাতের অধিকারের বিরুদ্ধে অবশ্য খুব জোরালো গলায় কেউই বলেন না, কিন্তু বাস্তবটা হলো, গর্ভপাতের ব্যাপারে আইন জটিল হলে তেমন নারীর পক্ষেও গর্ভপাত করাতে পারা দুস্তর হয়ে যায়।
পাশাপাশি এও বলে রাখা প্রয়োজন, গর্ভধারণ সংক্রান্ত জটিলতার কারণে গর্ভবতী নারীর প্রাণসংশয় ঘটলে গর্ভপাত করানোর অধিকার - যা কিনা চিকিৎসকের সিদ্ধান্ত - সে নিয়ে বিশেষ বিতর্ক ছিল না।
এবারে সেই রায়ের প্রসঙ্গ, যা কিনা বারবার উঠে আসছে গত কয়েকদিন। মার্কিন শীর্ষ আদালতের Roe vs Wade মামলা, যেখানে আদালতের রায়ে সেদেশের মেয়েরা গর্ভপাতের যুক্তিসিদ্ধ অধিকার - নারীদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার স্বাধীনতার স্বীকৃতির পথে একটি বড় ধাপ- তা অর্জন করতে পেরেছিলেন। মামলাটি বিষয়ে বিশদে জানতে হলে উইকিপিডিয়া থেকে দেখে নিতে পারেন। আমি সংক্ষেপে সারকথাটুকু বলব।
মামলার রায় আসে ১৯৭৩ সালে। কিন্তু ঘটনাটা ১৯৬৯ সালের। টেক্সাসের নর্মা ম্যাককর্ভে - বহুলপরিচিত এই মামলায় ব্যক্তিপরিচিতি গোপন রাখার জন্য আইনি ছদ্মনাম জেন রো - তৃতীয়বারের জন্য গর্ভবতী হন, এবং উপলব্ধি করেন যে তাঁর পক্ষে তৃতীয় সন্তানকে মানুষ করা সম্ভব নয়। এমন ক্ষেত্রে, টেক্সাসে আইন অনুযায়ী, গর্ভপাতের অধিকার স্বীকৃত নয়। অতএব মামলা স্থানীয় ডিস্ট্রিক্ট অ্যাটর্নি, হেনরি ওয়েড, তাঁর বিপক্ষে। রো বনাম ওয়েড।
মার্কিন সুপ্রিম কোর্ট রায় দেন মূলত দুটি দিক থেকে। প্রথমত, মানব-ভ্রূণের ক্ষেত্রে আইনি অবস্থান - লিগাল স্টেটাস। আদালতের পর্যবেক্ষণ, এই গর্ভপাত আইন বাদে আর কোথাওই মানব-ভ্রূণের আর পাঁচটা মানুষের সমতুল্য আইনি পরিচিতি বা অধিকার - যেমন সম্পত্তির অধিকার ইত্যাদি - সেসব নেই। অতএব, মানব-ভ্রূণ সম্পূর্ণ মানুষের সমান কিনা সেসব পৃথক তর্কের বিষয়। দ্বিতীয়টি হলো, একজন মানুষের ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকার। তেমন তেমন পরিস্থিতিতে রাষ্ট্র সে অধিকারে হস্তক্ষেপ করতে পারে, ঠিকই - কিন্তু এই বিশেষ ক্ষেত্রে তেমন পরিস্থিতি ঘটেছে কি? তাহলে রাষ্ট্র কোন অধিকারে এক নাগরিকের এমন একান্ত ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তে হস্তক্ষেপ করতে চাইছে?
রো বনাম ওয়েড মামলায় শীর্ষ আদালতের রায়ে গর্ভপাতের অধিকার স্বীকৃত হয় - অন্তত কিয়দংশে, কেননা রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপের সুযোগ খানিক থাকেই, বিশেষত বারো সপ্তাহের পরে গর্ভপাত চাইলে। তবুও মার্কিন দেশের বাস্তবতার প্রেক্ষিতে এই রায় যথার্থই বৈপ্লবিক। কিন্তু বর্তমান রায়ে উলটপুরাণ ঘটল। পুনর্মূষিকোভবর সম্ভাবনা। সম্ভাবনা নয়, খুবই বাস্তব।
গত কয়েক দশকে মার্কিন বিচারব্যবস্থায় রক্ষণশীলদের প্রভাব বেড়েছে। গত দুই দশকে অন্তত শীর্ষ আদালতে অন্তত এমন পাঁচজন বিচারপতি নিযুক্ত হয়েছেন, যাঁরা গর্ভপাতের বিরুদ্ধে। গত বছর টেক্সাসে এমন আইন পাস হয়, যাতে ভ্রূণের হৃদস্পন্দন পাওয়া গেলে গর্ভপাত নিষিদ্ধ। ভ্রূণের হৃদস্পন্দন ধরা পড়তে পারে মাত্র ছয় সপ্তাহেই। ওকলাহোমায় বিল পাস হয়, আইনবিরুদ্ধ গর্ভপাতের সাজা দশ বছরের জেল। লুইজিয়ানায় বিল আনা হয়, গর্ভপাতের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা মানুষ খুনের সমান - বিলটি যদিও আইনে পরিণত হয়নি। ওকলাহোমা-র নতুন আইন অনুসারে, নিষেক থেকেই মনুষ্যজীবনের শুরু - গর্ভনিরোধক হিসেবে আইইউডি (কপার-টি ইত্যাদি) কাজ করে অনেকাংশে নিষেকের পর, তার উপরও নিষেধাজ্ঞা আসবে না তো? গর্ভধারণের কারণে গর্ভবতী মহিলার প্রাণসংশয় ঘটলে গর্ভপাত এখনও আইনসিদ্ধ। কিন্তু গর্ভপাত আর মানুষ খুন সমান, এমন আইন হলে কজন ডাক্তার সাহস পাবে গর্ভপাত করাতে!!
আরও বড় সংশয়, রো বনাম ওয়েড মামলার রায়ের মূল বিবেচ্য ছিল, নাগরিকের একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়ে রাষ্ট্রের নাক-গলানোর অধিকারের উচিত নাকি অনুচিত। শেষ বিচারে এটুকুর ভিত্তিতেই এসেছিল ঐতিহাসিক রায়। সেই রায় বাতিল হওয়ার পথ ধরে আসবে না তো ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তগ্রহণের স্বাধীনতার উপর আরও বড় কোনও আঘাত?
বিশ্বের রাজনীতিতে তো বটেই, গণতন্ত্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে রক্ষণশীলদের প্রভাব ক্রমশ বাড়ছে। বেড়ে চলেছে। সব দেশেই। এদেশেও। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়া ঘর অব্দি পৌঁছে না যায়, এই জন্যই না এত শত ভাবনা।

© বিষাণ বসু


রবিবার, ২৬ জুন, ২০২২

ভারতের গর্ভপাত আইন ~ স্বাতী রায়

আমেরিকার সুপ্রিম কোর্ট গতকাল এক কলমের খোঁচায় সেখানকার মেয়েদের সংবিধানগত গর্ভপাতের অধিকারটিকে খারিজ করে দিয়েছেন। তারপরই বেশ একটু ভারতের প্রগতিশীলতা নিয়ে আনন্দ দেখা গেছে। হওয়ারই কথা। বলে কিনা সেই ১৯৭১ সাল থেকে এদেশে গর্ভপাত আর অপরাধ নয়। ০-১২ সপ্তাহের মধ্যে ( দুই ডাক্তারের অনুমতিক্রমে ২০ সপ্তাহ অবধি )। (সাম্প্রতিক বদলে অবশ্য উভয় সময়সীমা বেড়েছে।)   সেই '৭১ সালের আইনে অবশ্য বিবাহিত মেয়েদেরই শুধু আরও সন্তান আনতে না চেয়ে ব্যবহৃত কন্ট্রাসেপশন ফেলিয়রের সম্ভাবনা বলা ছিল। ধর্ষণজাত ভ্রূণের গর্ভপাত করতে হলে অবশ্য বিবাহিত-অবিবাহিত বাধা নেই। এই সবে ২০২১ সালে সেই বিবাহিত-অবিবাহিতের ফ্যাঁকড়া সরিয়ে বলা হল মহিলা ও তার পার্টনার, আর জোড়া হল সন্তান না চেয়ে ব্যবহার করা কন্ট্রাসেপশন মেথডের কথা । এইটুকুই ভারতের আধুনিকতার অর্জন।   

 কিন্তু সত্যিই সেই আইনের কতটা ছাপ পড়েছে সমাজের উপর? পশ্চিমবঙ্গের মেয়েদের অভিজ্ঞতা কি বলে? মেয়েদের কথা বাদ দিন, এমনিতেই ওদের বারোহাত কাপড়ে কাছা জোটে না, তাদের আবার মতামত! তার থেকে ডেটা দেখুন। ডেটা পাওয়া গেছে  http://www.johnstonsarchive.net/policy/abortion/india/ab-indias.html থেকে।  এখানে এই যে ১৯৯৩-৯৪ সালে রিপোর্টেড এবরশনের সংখ্যা ৬৪ হাজারের বেশি হল, এমন তো নয় যে সেবার কোন গ্রহ নক্ষত্রের যোগে সংখ্যাটা ওই মাত্রায় পৌঁছাল। বরং প্রশ্ন উঠুক, অন্যান্য বছর এত কম কেন? সত্যিই কি আবর্শনের দরকার পড়েনি ? নাকি দরকার পড়েছে, আর দরকার মেটাতে মেয়েরা বাধ্য হয়েছেন হাতুড়ের কাছে যেতে, বাড়িতে বিভিন্ন উপায় চেষ্টা করতে? 



কমিউনিটি মেডিসিনের চার অধ্যাপক ২০১৫-১৬ সালে নক্সালবাড়ি ব্লকে ৪২০ জন ১৫-৪৯ বছরের মহিলার মধ্যে সার্ভে করে জানিয়েছিলেন যে যদিও গড়ে প্রতি মহিলার ১.৩ টি গর্ভপাতের অভিজ্ঞতা রয়েছে, এর মধ্যে ৪৮.৩%ই আপনাআপনি হয় না, অর্থাৎ কিনা সেগুলো ইনডিউসড এবরশন, ওষুধ দিয়ে বা সার্জিক্যালি করা হয়। আর তার ৫৮% হয় বাড়িতে, হাতুড়ে ডাক্তারের কাছে ইত্যাদি। অনুমান করছি সেগুলো নিশ্চয় আর কোনভাবে রিপোর্টেড হয়না। ১৭৮টা এবর্শনে ৫০ টা  হিসেবের বাইরে থেকে গেল। আরও ৭১ টা হয় বেসরকারি জায়গায় – তারই বা কটা রিপোর্টেড হয় তা কে জানে! এই অবস্থায় প্রথম ছবির ওই পেন্ডুলামের মতন একবার চাগিয়ে উপরে ওঠা আবার ঝপ করে নেমে যাওয়া দেখলে কেমন সন্দেহজনক লাগে না? ( সূত্রঃ https://www.ijph.in/article.asp?issn=0019-557X;year=2019;volume=63;issue=4;spage=298;epage=304;aulast=Dasgupta )

আরও অবাক হতে হয়, দ্বিতীয় ছবিটা দেখলে। ডেটা সোর্স ঃ http://www.johnstonsarchive.net/policy/abortion/india/ab-indiad-westbengal.html  এটা ২০১০-১১ সালের ডেটা। কলকাতায় যেখানে প্রায় ১৫০০০ এবর্শন, সেখানে বীরভূমে মাত্র ৮২ টা, বাঁকুড়ায় মাত্র ৩২৭ টা। কী জানি হয়ত সেখানকার মানুষের জীবন খুবই সংযমী, কোনও উল্টোপাল্টা পা পড়ে না সেখানকার মানুষের, তবে আমি পাপী তাপী মানুষ আমার কেমন মনে হয় যে আসল কারণটা হয়ত অন্যত্র। রিপোর্ট যতদূরে দেখতে পায়, তার বাইরে হয়ত থেকে যায় অনেকটাই। সেই বাইরে যেটা থেকে যাচ্ছে,  তার কতটা সেফ এবর্শন? দেবা ন জানন্তি, কুতো মনুষ্যাঃ … 

বিবাহিত মেয়েদেরই হাতের আওতায় এল না সেফ এবর্শন, অবিবাহিত হলে তো কথাই নেই! কত যে কথা শুনতে হয়! একটি এমটিপি করতে আসা মেয়েকে নার্স বিভিন্ন ব্যক্তিগত প্রশ্ন করায় এক বেসরকারি হাসপাতালের (পশ্চিমবঙ্গের বাইরের) ডাক্তার নার্সকে ডেকে কাউন্সেল করেছিলেন, বলেছিলেন এই সব কথা তো তোমার জানার দরকার নেই। ও একটা সার্ভিস নিতে এসেছে আমাদের কাছে, আমরা দেব এইটাই ওর সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক, বাকিটা ওকে বুঝে নিতে দাও। এই ডাক্তার মহিলাকে অসীম শ্রদ্ধা জানাই। এর পাশে রাখি সেই সব কলকাত্তাই ডাক্তারদের যারা শুধু সিঁদূর দেখতে না পাওয়ার জন্য একটি মেয়েকে কুমারী ধরে নিয়ে মোরাল পিসিমা হয়ে এমটিপি করা নিয়ে ব্ল্যাকমেইল করতে চেষ্টা করেছিলেন।  

এমনিতেই ভারতের এবর্শন সংক্রান্ত আইন নিয়ে একটা বড় বক্তব্য যে গর্ভ রাখা না রাখা গর্ভবতী জনের ইচ্ছার অধীন না, ডাক্তারের মতামতের দ্বারা পূর্ণ নিয়ন্ত্রিত। তারউপর পিএনডিটি এক্টের জন্য এখন ডাক্তাররা চাপে থাকেন কি? গর্ভপাত করাতে হেজিটেট করেন? তাহলে কিন্তু আনসেফ এবর্শন বাড়বে বই কমবে না। আরও একটা কথা এই প্রাইড মাসে না তুললে অন্যায় হবে, এই আইন কিন্তু আগাগোড়া মেয়েদের কথাই বলে গেছে শুধু। অন্যদের কি হবে?
     
তবে এসব তো পরের কথা, এমনকি আইনে যেটুকু আছে, সেটুকুও যে কতটা হয় এই ছবিগুলো তার প্রমাণ। আইন থাকলেই হয় না, আইনকে সবার হাতের আওতায় পৌঁছে দিতে হয়। সেজন্য ইনফ্রাস্ট্রাকচার লাগে, মানুষ লাগে, সদিচ্ছা লাগে। নাহলে হয়ত প্রগতিশীলতার খাতায় অফিসিয়াল টিকটা মারা যায়, কিন্তু আখেরে কাজের কাজ কিছু হয় না। সংবিধানসম্মত অধিকারের আওতায় থাকা ভারত আর আওতার বাইরে থাকা আমেরিকার তফাৎটা তখন ঝাপসা হয়ে যায়।

সোমবার, ২০ জুন, ২০২২

পুড়ছ্যে রাবন ~ সুস্মিতা ওঝা

বল্যেছিলিস দেশট জুড়্যে চালাইন্ দিবিস 'বিকাশ' রথ!
দেশের বেকার ছেল্যা পাল্য কেমন ধারা 'অগ্নিপথ'!
বিকাশ যাঁয়্যে গড়গড়ায়্যেঁ ঢুকল্য পুঁজিপতির ঘর,
কাজ হারাল্যেক কত মানুষ, মরল্য কত পথের পর। 
কাঠ-কুচরি কুড়াইঁ আন্যে রাঁধত্য হামার গরীব মা,
দেখ্যে ত তর চ'খের আঁশু বাঁধন যেমন মানথ্য না!
একট ফিরি সিলিণ্ডারে, মায়ের সাথে ফটক ট,
গরীব মানুষ সাধাসিধা, বুঝল্য বাদে রগড় ট। 
দাম বাঢ়ালিস চড়চড়ায়্যেঁ, সব ল'কেরই মাথায় হাত,
দ্যাখ হুলক্যে উনানশালে, উনানে ফের পাল্হা-পাত। 
নোটবন্দী, সেটও ছিল তর কাছে এক মজার খেল,
কাল' টাকা করলি সাদা, ন্যাড়ার মাথায় ভাঙলি বেল! 
বল্যেছিলিস ফি বছরে দু'কোটি চাকরি হব্যেক,
আজ শুনাছিস দেড় বছরে চুক্তি কর‍্যে লাখ দশেক!
বারে বারে ভাঁওতা দিবিস, করবি তবে মস্ত ভুল,
চার বছরের চুক্তি সেনা! লড়ব্যে যারা জান কবুল! 
ভণ্ডামি তর দেখলি বহুত, ভণ্ডামি তর বেলাগাম,
'অগ্নিপথেই' পুড়ছ্যে রাবন, যতই সাজিস নকল রাম।
                      ----------------

সোমবার, ১৩ জুন, ২০২২

পাঠশালা কেন বন্ধ ~ ঊর্বা চৌধুরী

কয়েকটা বিষয় নজরে আনতে চাইছি -

১) নানা ছুতোয় স্কুলে লম্বা লম্বা ছুটি দেওয়ার ও বাড়ানোর সিদ্ধান্ত আদ্যন্ত অস্বাভাবিক একটি সরকারি শিক্ষানীতি। শিক্ষা প্রসঙ্গে কোনো সরকার সাধারণত এসব ক্রুড ঘটনা ঘটিয়ে ফেলার সাহস চট্ করে দেখানোর কথা ভাবতে পারে না। আজকের জমানায় ধনতান্ত্রিক দেশেও না। 

কারণ, স্কুল বন্ধ থাকা কেবল বাচ্চার জীবনযাত্রাকে বদলে দেয় না, অভিভাবকদের জীবনযাত্রাকেও চোখে পড়ার মতো করে বদলে দেয় - সকলে সহজেই বুঝতে পারেন যে, স্কুল বন্ধের সিদ্ধান্ত তাঁদের জীবনকে সম্পূর্ণ তালগোল পাকিয়ে দিচ্ছে। কুরাজনীতির সরকার এতটা বড় গোলমাল সমাজে পাকাতে চায় না।

এটি চরিত্রে কেবল ব্যতিক্রমী রকমের ক্ষতিকর নয়, সম্পূর্ণ "উৎকট" ব্যতিক্রমী রকমের ক্ষতিকর। আড়াই বছর হতে চলল এ রাজ্যে এই "একশ' শতাংশ উৎকট" ঘটনাটাই ঘটে চলেছে। 

অতএব এত বড় অনাচারের পিছনে গূঢ় কোনো বিপজ্জনক পরিকল্পনা, এবং বড়সড় পৃষ্ঠপোষকতা যে আছে - সে কথা নিশ্চিত। যা সরকারকে এ জাতীয় মোটাদাগের অনাচার চালাতে সহায়তা করছে।

২) বিপজ্জনক পরিকল্পনা সম্বন্ধে নিশ্চিত হচ্ছি কারণ, এ রাজ্যে আড়াই বছর ধরে স্কুল বন্ধ করে রাখা হয়েছে কেবল নয়, বন্ধ হয়ে থাকা সরকারি স্কুলের লাখ লাখ ছাত্রের জন্য ন্যূনতম কার্যকরী কোনো বিকল্প ব্যবস্থা সরকারের পক্ষ থেকে নেওয়া হয়নি, হচ্ছে না। 

আবারও উল্লেখ করছি - আড়াই বছর ধরে লাখ লাখ বাচ্চাদের সরকারি স্কুলগুলি বন্ধ করে রাখা হয়েছে এমনটাই নয় - বিকল্প কোনো বন্দোবস্ত চালু করা তো দূরের কথা, সরকারি তরফে তা কোনো চর্চার মধ্যেই নেই। 

অর্থাৎ বিদ্যালয় শিক্ষা প্রসঙ্গে এ রাজ্যের সরকার নিজেকে একশ' শতাংশ দায়হীন করে ফেলছে। দেশে রাইট অফ চিলড্রেন টু ফ্রি অ্যান্ড কমপালসারি এডুকেশন অ্যাক্ট ২০০৯ থাকা সত্ত্বেও সে দায়হীন হয়ে থাকতে পারছে। এবং এই আইনটি সংবিধানের মৌলিক অধিকার-এর ভিত্তিতে তৈরি করা। অর্থাৎ রাষ্ট্রের দরাজদিলীর ব্যাপার নয়, এটি সরকারের একটি  বাধ্যতামূলক দায় সংক্রান্ত আইন। 

সংবিধানের নির্দেশমূলক নীতির কারণে কোনো সরকার এই দায় অস্বীকার করার জায়গায় দর্শনগত দিকে থেকে ১৯৫০ সাল থেকেই ছিল না , এবং পরবর্তীকালে আইনতও ২০০৯ সাল থেকে এমন কাজ সরকার করার জায়গায় নাই।

৩) বাচ্চাদের লেখাপড়া, পুষ্টি, শারীরিক, বুদ্ধিগত, প্রাক্ষোভিক, সামাজিক, ভাব প্রকাশগত, ও নৈতিক বিকাশ, যা জড়ো করলে "শিক্ষা", তা সম্পর্কে এমন উৎকট সরকারি নীতির কথা শিক্ষাক্ষেত্রে কর্মরত কর্মীরা, শিক্ষাবিদেরা, শিক্ষা গবেষকেরা আজগুবি কল্পনাতেও আনতে পারেন কি না সন্দেহ! 

৪) যে স্কুলগুলি বন্ধ রাখা হচ্ছে সেগুলি সরকারি, সরকার পোষিত, সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত, স্থানীয় কর্তৃপক্ষ পরিচালিত - অর্থাৎ কি না এগুলি স্থায়ী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। কোনো সাময়িক প্রতিষ্ঠান বা প্রকল্পের প্রতিষ্ঠান নয় - প্রকল্পের শুরু আর শেষ উদ্বায়ী। মূলস্রোতের প্রতিষ্ঠান কিন্তু তা নয় - এগুলি সাময়িক আপৎকালীন পরিস্থিতিতে তৈরি হওয়া প্রতিষ্ঠান নয়। এই স্কুলগুলি সমাজে কোনো ইভেন্ট ঘটানোর জন্য বা প্রতীকী কাণ্ড ঘটানোর জন্য তৈরি হয়নি। জনগণের ৩৬৫ দিনের বিতর্কের ঊর্ধ্বে থাকা দরকার মেটানোর জায়গা এই স্কুলগুলি। 

গোটা রাজ্যে আড়াই বছর ধরে বিদ্যুৎ, জল সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া আর এই আড়াই বছর ধরে স্কুল বন্ধ রাখার মানে যে এক্কেবারে এক - সে কথা কাউকে বোঝাতে হয় না।

নজর করাতে চাই এই সিদ্ধান্তের প্রশাসনিক তাৎপর্যটির দিকে - এমন কাছাখোলা প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত কোনো স্বাভাবিক মাথা গ্রহণ করতেই পারে না।

নজর করাতে চাই এই সিদ্ধান্তের রাজনৈতিক তাৎপর্যটির দিকে - এমন ডেসপারেট রাজনৈতিক সিদ্ধান্তও কোনো স্বাভাবিক মাথা গ্রহণ করতে পারে না...

...যদি না শাসককে কোনো না কোনো শক্তপোক্ত ফোর্স পিছন থেকে মনোবল, কায়িক বল অবিশ্রাম জোগান দিতেই থাকে। 

এছাড়াও যেটি বলার - লক্ষ করবেন জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০ -র "স্কুল ক্লাস্টার/ স্কুল কমপ্লেক্স " অংশটিতে - বোঝা যাবে সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি বন্ধ করে দেওয়ার বন্দোবস্ত সেখান থেকেই শুরু। নতুন নতুন স্কুল তৈরি করার নীতি গত শতাব্দীর ছয়ের দশক থেকে এ শতাব্দীর প্রথম দশক অবধি বাধ্যতামূলকভাবে নেওয়া হয়েছে। হঠাৎ করে পরিস্থিতির গুণগত তফাত না ঘটা সত্ত্বেও, একাধিক সরকারি স্কুল বন্ধ করে "ক্লাস্টার" করে ফেলার পিছনে কোনো  সৎ উদ্দেশ্য থাকা সম্ভবই না - সরকারি স্কুল কমাতে কমাতে শূন্য করে ফেলাই একমাত্র জাস্টিফিকেশন। 

প্রসঙ্গত, বিরাট বিরাট কর্পোরেট স্কুলের ব্যবসা করে কিন্তু বিশাল মুনাফা করে। সরকারি স্কুলের নথিভুক্ত শিশুরা এখনো তাদের খরিদ্দার নয়। তবে খরিদ্দার যে তাদের বানাতে হবেই - তা নিয়ে ব্যবসাদারের মাথা দৃঢ়নিশ্চয়। কারণ সরকারি স্কুলের বাচ্চাদের সংখ্যা বিশাল। ফলে মুনাফাও অনেক।

কর্পোরেটদের ব্যবসার একটি উল্লেখযোগ্য দিক হল কর্পোরেট সোশাল রেসপন্সিবিলিটি (সিএসআর)। মুনাফা কামিয়ে না, কর ছাড় পেয়ে। এই সিএসআর-এর আওতাভুক্ত কাজকর্ম করে বিরাট কর ছাড় পাওয়া যায় - শিক্ষাক্ষেত্রও এই কাজকর্মের মধ্যে একটি এবং এদের কাজকর্মের দর্শন, মতাদর্শগত অবস্থান, কার্যপ্রক্রিয়া, লক্ষ্য, উদ্দেশ্য - গোটাটাই নানা প্রকারে গভর্নেন্সের মিনিমাইজেশানকে সুনিশ্চিত করে, যাতে সেই সূত্রে কর্পোরেটদের ব্যবসায়িক আবাদ জমিকে সুবিধাজনক অবস্থায় রাখা যায়। এ কোনো তত্ত্ব চাবানোর ব্যাপার না - ব্যবহারিক ব্যাপার। 

আবারও উল্লেখ করছি - এ রাজ্যে আড়াই বছর ধরে স্কুল বন্ধ রাখার এ জাতীয় সিদ্ধান্তের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিকটি হল - 

স্কুল বন্ধ রেখে বিকল্প যদি কিছু বন্দোবস্ত হত, তাহলে অন্তত তা নিয়ে চর্চা, তার মানোন্নয়ন করা সম্ভব হত। 

কিন্তু এক্ষেত্রে স্কুল শিক্ষা ক্ষেত্রে এইরকম সিদ্ধান্ত নজিরবিহীন কারণ -

আড়াই বছর ধরে স্কুল বন্ধ রাখা হচ্ছে কেবল নয় - আড়াই বছর ধরে শিক্ষা প্রসঙ্গে কোনোরকম সরকারি বিকল্পের চর্চাই হচ্ছে না। গোটা সরকারি শিক্ষাব্যবস্থাটাকে একটি "অনালোচ্য" বিষয়বস্তু বানিয়ে ফেলা হচ্ছে। 

সরকারের মুখে শিক্ষা নিয়ে কার্যত তালা চাবি দিয়ে রাখা হয়েছে।

সিদ্ধান্তটি মামুলি বঞ্চনার নয়। অস্বাভাবিক। আনপ্রিসিডেন্টেড।

বৃহস্পতিবার, ২ জুন, ২০২২

কেকের মৃত্যু~ সুশোভন পাত্র

- আর ইউ নট এন্টারটেন্ড?
রোমান কলজিয়ামে গ্ল্যাডিয়েটর ফাইটে, সশস্ত্র যোদ্ধাদের খুন করে প্রশ্ন করেছিলেন, ট্র্যাজিক হিরো ম্যাক্সিমাস! হয়ত নজরুল মঞ্চের কনসার্ট শেষে গতকালও একই প্রশ্ন করেছিলেন কেকে! 'আর ইউ নট এন্টারটেন্ড?'  
সামাজিক মাধ্যমে ভাসছে হোয়াইট বোর্ডের ছবি। কেকের ২০টি হিট গানের লিস্ট! সম্ভবত লিস্টটা কালকের কনসার্টে কেকের গাওয়া গানের। মোটামুটি একটা সাদামাটা হিসেব, সবমিলিয়ে ১০০ মিনিটের গান। আড়াই থেকে পৌনে তিন ঘণ্টার কনসার্ট! কলকাতার ভ্যাপসা গরম, নজরুল মঞ্চের ক্যাপাসিটির তিন-চার গুণ বেশি ভিড়, বন্ধ এসি, মঞ্চ জুড়ে উদ্যোক্তাদের উদ্ধত দাপাদাপি, বাহারি আলোর তীব্র ঝলকানি, আর অত্যুৎসাহী মাতব্বরদের র‍্যাম্পে উঠে কমপ্রেসড কার্বন ডাই-অক্সাইডের ফায়ার এক্সটিংগুইশার স্প্রে! 
সবকিছু উপেক্ষা করেই কনসার্ট শেষ করেছিলেন কেকে! কেন? কেউ বলছে, প্রফেসেনালিসজম। কেউ বলছে মোটা টাকা। কেউ বলছে উদ্যোক্তাদের চাপ। হয়ত তাই! কিম্বা হয়ত সকালে একজন শিল্পী যেমনটা বলছিলেন তেমনটাই! এত গুলো মানুষের গানের তালে উদ্বেলিত হওয়া, সুর-লয়ের মূর্ছনায় সাইন কার্ভের মত দুলে ওঠা, উচ্ছ্বাসে পাগল হয়ে ফেটে পড়া, ভালোবাসা, মুহূর্তের আনন্দে সমস্ত কষ্ট ভুলে যাওয়া ঐ মায়াবী পরিবেশের মোহময়তা –যে কোন শিল্পীই তো থ্রাইভস ফর দিস!  
সামান্য একটা গুগল সার্চ আপনাকে বলে দেবে কেকের মত প্রথিতযশা একজন প্লে-ব্যাক সিঙ্গারের আড়াই থেকে পৌনে তিন ঘণ্টার কনসার্টের আনুমানিক চার্জ ২৫-৩০ লাখ! সঙ্গে নজরুল মঞ্চের বুকিং। আনুষঙ্গিক খরচা আর পুরো ট্রুপের লজিস্টিক মিলিয়ে, জাস্ট একটা সন্ধ্যার কনসার্টের খরচা প্রায় ৩৫-৪০ লাখ! কলকাতার বহু কলেজের মধ্যে এই গুরুদাস মহাবিদ্যালয়ের একটা ফেস্টের একটা কনসার্টে এই বিপুল খরচা! চোখে লাগে না আপনার? এত টাকা আসছে কোথা থেকে? কিভাবে, কোন নিয়মে খরচা হচ্ছে টাকা? কারা এই ফেস্টের স্পন্সরার? উত্তর কলকাতার গলিতে কান পাতলে যে নাম গুলো উঠে আসবে সেগুলো কোন ছাত্র সংসদের চুনোপুঁটিদের না বরং লাল বাতি নিয়ে ঘুরে বেড়ানো রাঘব বোয়ালদের! 
বাঙলার কলেজে নির্বাচন হয়না বহুদিন। 'শিক্ষায় অনিলায়ন'র থিওরি নামানো কাগুজে বাঘরা খবরই পাননা যে প্রত্যেক কলেজে বকলমে ছাত্র সংসদের নামে লোকাল তৃণমূলে নেতার সিন্ডিকেট চলছে। নিন্দুকে বলে গুরুদাস মহাবিদ্যালয় ছাত্র সংসদ নাকি প্রয়াত সাধন পাণ্ডের স্নেহধন্য! পেট্রোল-ডিজেলে সেস বেড়েছে, টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে, বাজার আরও অগ্নিমূল্য হয়েছে; তাই মা-মাটি-মানুষের দামাল ভাইরাও কন্যাশ্রীর বোন'দের আর যুবশ্রীর ভাই'দের জন্য ফি-বছরে কলেজে কলেজে অনার্সের 'রেটে' ইনক্রিমেন্ট দিচ্ছে। কোথাও ইংরেজি যাচ্ছে ৬৫হাজার! আবার কোথাও ইতিহাসে লাগছে ৩৫হাজার! 
মেধা-অধ্যবসায়-নিয়ম-নীতি এসব এখন ব্যাকডেটেড, কনটেম্পোরারি ফ্যাশনে টাকা দিলে ইউনিয়ন রুমেই মার্কশিট জমা হয়ে যাবে, পছন্দের অনার্সের রেট ঠিক হয়ে যাবে, ভর্তির জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠের আনুষ্ঠানিকতা -ইউনিয়নের দাদারা নির্ঝঞ্ঝাটে সব করে দেবে। আর দাদা'দের সাথে 'হাই-হ্যালোর' সম্পর্ক থাকলে তো কেল্লা ফতে; মদের বোতলেই কেরিয়ার একদম 'সেট' হয়ে যাবে।
নির্বাচিত ছাত্র সংসদের অবর্তমানে তৃণমূলের 'গাঁয়ে মানে না আপনি মোড়ল' ছাত্র সংসদের হাতে কলেজ কর্তৃপক্ষ ফি বছর ফেস্ট-ফ্রেশারের নামে কত টাকা তুলে দিচ্ছেন? ভর্তির সময়ে সাধারণ গরীব ছাত্র-ছাত্রীদের কাছ থেকে আদায় করা তোলাই কি খরচা হচ্ছে এই মোচ্ছবে? সরকারের কাছে এই আয়-ব্যয়ের অডিট রিপোর্ট আছে? যে কলেজে কোন নির্বাচিত ছাত্র সংসদ নেই তারা টাকা পাচ্ছে কোন আইনি ভিত্তিতে? পাস ছাড়া কালকে কেকের অনুষ্ঠানে তো কেউ ঢুকতে পারারই কথা না। তিনগুণ ভিড় হল কি করে? জাল পাস? দায় কার? কলেজের হোতাদের না 'গাঁয়ে মানে না আপনি মোড়ল' তৃণমূল ছাত্র সংসদের? 
হ্যামলিনের বাঁশিওয়ালার মত প্রজন্ম কে বিমোহিত করেছেন কেকে! সারাদিন ধরে সামাজিক মাধ্যমের দেওয়াল ভেসে যাচ্ছে আবেগে। এই মাপের একজন শিল্পীর মৃত্যুর সামাজিকরণ হবে, সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু রাজনীতি কে বাদ দিয়ে তো এই সমাজ নয়, শিল্প কর্মও নয়। বরং সমাজের ও শিল্পের নিয়ন্ত্রক এই রাজনীতি!  আর তাই একজন শিল্পীর মৃত্যু তে বাঙলার এই রাজনীতির স্খলনটা বে-আব্রু হয়ে যাচ্ছে। 'সততা', 'রাজনৈতিক আদর্শ', 'মূল্যবোধ'–সব ক্লিশে হয়ে গিয়ে বাঙলার রাজনীতির পর্যবসিত হচ্ছে লাভ-লোকসানের অঙ্কে! পর্যবসিত হচ্ছে 'করে খাওয়ার' রসায়নে! খেলা হচ্ছে আগুন নিয়ে। খেলা হচ্ছে বাঙলার ভবিষ্যৎ নিয়ে। কেকে থেকে তুহিনা খাতুন, আনিস থেকে বিদ্যুৎ মণ্ডল -খেলা হচ্ছে মানুষের জীবন নিয়ে। 
বাঙলার শিল্পীদের বানানো হচ্ছে রাজনৈতিক বোড়ে! কেউ ভোটে দাঁড়াচ্ছেন, কেউ ২১শে জুলাইয়ের মঞ্চ আলো করছেন, কেউ কমিটি তে জায়গা পাচ্ছেন, কেউ তো সরাসরি তৃণমূলের পদাধিকারী সেজে যাচ্ছেন! সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক, চার্লি চ্যাপলিন, জোন বায়েজ, বব ডিলানদের মত সত্যের প্রতি, সমাজের বহমান বঞ্চনা ও শোষণের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের দায়বদ্ধতা, আপোষহীনতা তো দূরের কথা কোদাল কে কোদাল বলার ক্ষমতা কেড়ে নেওয়া হচ্ছে বাঙলার শিল্পীদের কাছ থেকে! আর যারা আত্মসমর্পণ করছেন না? তাঁদের ভাতে মারার ফন্দি হচ্ছে ১৪ তলা থেকেই! তাই কেকের মৃত্যু ঘিরে সামাজিক আবেগের বাইরে গুরুতর রাজনৈতিক প্রশ্ন গুলো কে যত্ন করে ডজ করছেন বাঙালী শিল্পীরা!
রূপঙ্করের লাইভ, কলকাতার কালচার, বাঙালির চয়েস, জনগণের সচেতনতা -এই সব এন্টিটির ফিলজফির সাবজেক্টিভিজমে কেকের মৃত্যু কে আড়াল করে আদপে লাভ নেই! কেকের মৃত্যুকে ঘিরে প্রশ্নটা অবজেক্টিভ! প্রশ্নটা নিয়ন্ত্রক শক্তির কোয়ালিটির! প্রশ্নটা তৃণমূলের রাজনৈতিক সংস্কৃতির! 
বাঙালি দীর্ঘদিন এই রাজ্যে ছাত্র সংসদের নির্বাচন দেখেছে। নির্বাচিত ছাত্র সংসদের কলেজ পরিচালনা দেখেছে। ফেস্ট দেখেছে, ফ্রেশার দেখেছে, কলেজে ভর্তি প্রক্রিয়াও দেখেছে। ছাত্র সংসদের আয় ব্যয়ের অডিট হয়েছে। হোপ ৮৬-এ বোম্বের তামাম সুপারস্টারদের অনুষ্ঠান দেখেছে। ইন্দিরা গান্ধীর উপস্থিতিতে বঙ্গবন্ধুর গলায় 'জয় ভারত/জয় বাংলাদেশের' শ্লোগানে এই তিলোত্তমা কল্লোলিত হয়েছে। ৯০'র শীতে দীর্ঘ ২৭ বছর কারাগারে কাটানোর পর ম্যান্ডেলার কলকাতা সফরে ইডেন গার্ডেনস মানবসমুদ্রের উষ্ণতা মেপেছে। দেশ বিদেশের বহু কীর্তিমানদের বাঙালি সমাদর করেছে। আপ্যায়ন করেছে। আপন করেছে। দশকের পর দশক বাঙালি বহু আবেগের সাক্ষী থেকেছে! 
এই আবেগটাই ফাইন লাইন পেরিয়ে বেলাল্লাপনা তে বদলে যায় যখন তৃণমূলের মত একটা লুম্পেন সর্বস্ব দল রাজনীতির নিয়ন্ত্রক শক্তি হয়ে ওঠে! কেকের মৃত্যু আপামর দেশের কাছে যে প্রশ্নটা আবার একবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে গেলো, শুধু গান স্যালুটের গর্জনে কি সেই প্রশ্ন ঢেকে রাখা যাবে মাননীয়া?

সোমবার, ২ মে, ২০২২

বিজন সেতু গণহত্যা ~ সমুদ্র সেনগুপ্ত

Purulia Arms Drop Anandamargi
পুরুলিয়া অস্ত্র বৃষ্টি 
বিজন সেতু গণহত্যা: প্রকাশ্য দিবালোকে মহানগরীর এক কলঙ্কের ইতিহাস
প্রথম ভাগ: সংগঠন ও তার কার্যকলাপ:
১৯৫৫ সালের ৯ই জানুয়ারি জামালপুর রেলওয়ে ওয়ার্কশপের একজন একাউনটেন্ট প্রভাত রঞ্জন সরকার একটি "সোসিও-স্পিরিচুয়াল" সংগঠন গড়ে তোলেন এবং নিজের নামকরণ করেন "শ্রী শ্রী আনন্দমুর্তিজি"।
বিভিন্ন মাধ্যমে প্রভাত সরকারের শিব দর্শন, শৈশবে বাঘের পিঠে জঙ্গল ভ্রমণের অলৌকিক সব কাহিনী প্রচারিত হয়। আনন্দমার্গ'র সর্বক্ষণের কর্মী হতে দীক্ষা লাগে। পোশাকি নাম পড়ল 'অবধূত'। [সূত্র: সুশোভন পাত্র]
১৯৫৯ সালে পুঁজিবাদ ও সাম্যবাদের বিকল্প হিসেবে আনন্দমার্গ তাদের "প্রোগ্রেসিভ ইউটিলাইজেশন থিওরি" বা প্রাউট তত্ত্ব কে খাড়া করে। মার্গের রাজনৈতিক কর্মসূচী পরিচালনার জন্য তৈরি হয় 'প্রাউটিস্ট ব্লক অফ ইন্ডিয়া'। তাদের মুখপত্র 'প্রাউট' থেকে এদের বিভিন্ন বিচারধারা জানা যায়। যেমন, "অহিংসা উপর ভিত্তি করে আধ্যাত্মিকতা মানবতার কোন উপকারেই আসবে না", "ভারতবর্ষের গণতন্ত্রে নিরক্ষর ও অশিক্ষিতদের ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়া উচিত", "কমিউনিজম মানুষ কে জন্তুতে পরিণত করে" ইত্যাদি।
১৯৬০ এর শেষের দিকে মার্গ ও তার দর্শন বেশ কিছু অনুগামীকে আকৃষ্ট করতে সমর্থ হয়। এর সাথে যুব সম্প্রদায়ের মধ্যে তাদের ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তা এবং গুপ্ত ধর্মীয় ব্যঞ্জনার ফলে তদানীংতন যুক্তফ্রন্ট ও পরবর্তীতে বামফ্রন্টের সাথে সরাসরি আদর্শগত সংঘাত বাধে।
এই অনুগামীদের মধ্যে বেশ কিছু ধনী ও প্রভাবশালী ভক্ত ছিলেন। যাদের একজন, রাজস্থানের গড় এর মহারাজা পুরুলিয়াতে ৫০০ একর জমি দান করে যেখানে আনন্দনগর নামে হেড কোয়ার্টার তৈরি হয়। এই নগর কে ঘিরে শুরু থেকেই সন্দেহ দানা বাঁধে যে আধ্যাত্মিক কাজকর্মের আড়ালে কোনো ক্রিমিনাল কাজকর্ম চলছে কিনা। আশ্রমের বিপুল ধন সম্পত্তির আসল উৎস হিসেবে অস্ত্র স্মাগলিং কে সন্দেহ করা হয় তখন থেকেই। পরবর্তীতে কিম ডেভি দ্রষ্টব্য। [আউটলুক, ৩১শে আগস্ট, ২০১৭]
মতাদর্শগত সমস্যা ছাড়াও বামফ্রন্ট সরকার এই বিতর্কিত ধর্মীয় সম্প্রদায় কে তার সদস্যদের "সশস্ত্র" প্রশিক্ষণের দায়ে অভিযুক্ত করে এবং তাদের বার্ষিক "তান্ডব" মিছিলের ওপর ধরপাকড় করে। প বঙ্গ ও বিহারে রক্তবস্ত্র পরিহিত লাঠি, তরোয়াল ও নরমুন্ড সজ্জিত মার্গদের সাথে মার্ক্সবাদী ক্যাডারদের ঘন ঘন সংঘর্ষ হয়। ১৯৬৭ সালের ৫ই মার্চ পুরুলিয়ার আনন্দনগরে, হেড কোয়ার্টার এ পাঁচ জন মার্গ মারা যায়।
১৯৭০ সালের ৩১শে মার্চ পাটনা স্টেশনে দিল্লি এক্সপ্রেস ট্রেন থেকে নামার পরেই জ্যোতি বসুর ওপরে গুলি চালানো হয়। সেই গুলি বিদ্ধ হয়ে মারা যান তার সাথে হাত মেলানো পার্টিকর্মী আলী ইমাম। সন্দেহের তীর আনন্দমার্গীদের দিকে।
প্রভাত সরকার ওরফে আনন্দমূর্তি তার এক শিষ্য অবধুত কে খুনের দায়ে ১৯৭১ সালে গ্রেপ্তার হয়। কিন্তু তাকে ১৯৭৮ সালে মুক্তি দেওয়া হয়। ওই বছরে "সিডনি হিলটন বোমা বিস্ফোরণ" এর ফলে তিন জন মারা যান এবং ইভান পেডেরিক নামের একজন মার্গ তার অপরাধ স্বীকার করে।
১৯৭১'এ কলকাতার 'ধর্ম মহাচক্র'র পর 'আনন্দমূর্তি'র স্ত্রী উমা সরকার ও প্রাক্তন অবধূত, 'প্রাউটের' অর্থসচিব নওল কিশোর ফাঁস করে দেন যে "গুরুর বিরুদ্ধে জেহাদের অপরাধে ৩৬ জন আনন্দমার্গী কে ছোটনাগপুরের জঙ্গলে নিয়ে গিয়ে পেট চিরে, চোখ উপড়ে হত্যা করা হয়।" পরে ঐ মামলায় অভিযুক্ত অন্য এক অবধূত মাধবানন্দ'ও আদালতে জানান 'গুরুর নির্দেশে তিনি নিজেই ১৮ জন অবধূত কে হত্যা করেছেন।' [নওল কিশোর তাঁর 'আনন্দমার্গঃ সয়েলিং দি সাফরন রোব' ]
১৯৭৩ সালের ২৫শে এপ্রিল নয়াদিল্লির আচার্য দিনেস্বরানন্দ নামে এক অবধুত গায়ে আগুন লেগে মারা যান। তার সংগঠনের পক্ষ থেকে দাবি করা হয় যে এটি প্রতিবাদের আত্মহুতি, আনন্দ মূর্তির গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে। দিল্লি পুলিশের বয়ান অনুযায়ী এটি হত্যাকান্ড এবং সেই অভিযোগে দু জন বিদেশি মার্গীকে গ্রেপ্তার করে যারা আগুন লাগিয়ে ওই অবধুত কে পুড়িয়ে মেরেছে বলে অভিযোগ।
[নিউ ইয়র্ক টাইমস, ২৬শে এপ্রিল, ১৯৭৩]
১৯৭৫ সালে রেলওয়ে মন্ত্রী ললিত নারায়ণ মিশ্র কে বোমা মেরে খুনের দায়ে চারজন মার্গ কে সাজা দেওয়া হয়। তাদের মধ্যে একজন বাদে বাকিরা আবার তদানীংতন চিফ জাস্টিস এ এন রায় কে হত্যার চেষ্টায় অভিযুক্ত। এদের সতেরো বছর সশ্রম কারাদণ্ডের সাজা হয়।
এই সংগঠনের চরিত্র বোঝার জন্য একটি ঘটনার উল্লেখ প্রয়োজন। ১৯৮৩ সালে কলকাতার পুলিশ কমিশনারের বিরুদ্ধে এক অবধুত একটি রিট পিটিশন দাখিল করে বলেন যে প্রকাশ্যে ছুরি, ত্রিশূল ও করোটি নিয়ে "তান্ডব নৃত্য" করার ওপরে জারি করা নিষেধাজ্ঞা বাতিল করতে হবে কারণ এটি তাদের (আনন্দ মার্গীদের) ধর্মীয় আচরণ করার অধিকারে হস্তক্ষেপ।
সুপ্রিম কোর্ট এই আবেদন বাতিল করে ঘোষণা করে যে মার্গের প্রতিষ্ঠাতার রচনাপত্র লিখিত হয়েছে মূলত হিন্দু দর্শনকে আধার করে এবং আনন্দমার্গীদের "শৈব" বলে বিবেচনা করতে হবে যা আসলে হিন্দু ধর্মের একটি সম্প্রদায়। এটি কোনো পৃথক ধর্ম হিসেবে বিবেচিত হবে না। [ল, কলোনিয়ালিজম এন্ড রিলিজিয়াস প্লেস ইন ইন্ডিয়া- গীতাঞ্জলি শ্রীকান্তন]
১৯৭৮ সালের ৭ই ফেব্রুয়ারি ফিলিপিন্স এর ম্যানিলায় ভারতীয় দূতাবাসের কর্মচারী জ্যোতি স্বরূপ বৈদ্য কে খুন করার চেষ্টার অপরাধে স্টিভেন মাইকেল ডায়ার (কানসাস) ও ভিকটোরিয়া সেফার্ড (মেরিল্যান্ড) নামের দুই মার্কিন আনন্দ মার্গীকে ১৭ বছরের কারাবাসের দন্ড হয়। এফবিআই আনন্দ মার্গ কে একটি সন্ত্রাসবাদী সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত করে।
[এফবিআই ফাইল নম্বর ১০৫-২৮৯৪২০]
১৯৯০ সালের ১৪ই এপ্রিল অমৃত্সরে পাক-ভারত সীমান্তে বিএসএফ এর হাতে দুজন আনন্দ মার্গী ধরা পড়ে, অটোম্যাটিক অস্ত্র ও গুলি সহ। "মানব মুক্তি মঞ্চ" নামে মার্গীদের একটি শাখা সংগঠনের সাথে যুক্ত হয়ে পাকিস্তান থেকে এসব অস্ত্র আমদানি হচ্ছিল মার্গীদের প্রশিক্ষণের জন্য। [১৯৯০ সালের ১৮ই এপ্রিল লোকসভায় কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বিবৃতি]
ভারত সরকার আনন্দমার্গ কে একটি রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষী জঙ্গি, ছদ্ম-ধর্মীয় সংগঠন বলে বর্ণনা করেন যারা প্রায়শই হিংসার পথ নেয় এবং স্থানীয় অধিবাসীদের প্রতি দাদাগিরি ফলায়। [প্রাগুক্ত বিবৃতি]
পুরুলিয়া ও বিহার সীমান্তে জয়পুর ও ঝালদা ২ নং ব্লকের আদিবাসী, সরকারী ও রায়তি জমি মিলিয়ে হাজার একর জমি বেআইনি ভাবে দখল করতে উদ্ধ্যত হয় এই মার্গীরা। পুরুলিয়ার বাঁশগড়ের জঙ্গলে বিদেশ থেকে আমদানি করা বে-আইনি অস্ত্র মজুতের দায়ে অভিযুক্ত [প্রাগুক্ত বিবৃতি]
১৯৯৫ সালে ১৭ই ডিসেম্বর পুরুলিয়ায় একটি এএন-২৬ বিমান থেকে কয়েকশ একে-৪৭ রাইফেল ও হাজার রাউন্ড গুলি ফেলা হয়। কিম ডেভি ধরা পড়ে। অভিযোগ ওঠে যে ওই অস্ত্রবর্ষণ এর গ্রাহক ছিল আনন্দমার্গীরা।
জরুরি অবস্থার সময় এই সংগঠনকে ভারত সরকার নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। ১৯৭৭ সালে জনতা সরকার ক্ষমতায় আসার পরে এই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয়।
পৃথিবীর ১৮০ টি দেশে এদের প্রায় ২০ লাখ সদস্য আছে। ভারতে প্রায় সাত হাজার শাখা আছে যার মধ্যে প বঙ্গে প্রায় তিন হাজার। এরা স্কুল, কলেজ, অনাথ আশ্রম ও হাসপাতাল চালায়। [ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস ১৪ই ডিসেম্বর, ২০১১]
দ্বিতীয় ভাগ: বিজন সেতু গণহত্যা ও বিচার:
১৯৮২ সালের ৩০শে এপ্রিল দক্ষিণ কলকাতার বালিগঞ্জ রেল স্টেশন, বিজন সেতু ও বন্ডেল গেট সংলগ্ন এলাকায় আনন্দ মার্গের সাথে যুক্ত ব্রহ্মচারী ও ব্রহ্মচারিণী দের ওপরে আক্রমন ও নিগ্রহের এক দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা ঘটে যার ফলে ১৭ জন মারা যান
[কান্তি গাঙ্গুলি বনাম রাজ্য সরকার ও অন্যান্য: রিট পিটিশন নং ৯৯০৯ এর প্রেক্ষিতে জাস্টিস দীপঙ্কর দত্ত এর রায়, ৮ই জুলাই, ২০১৬]
জনস্বার্থে তাৎপর্যপূর্ণ এই ঘটনার তদন্তের জন্য রাজ্য সরকার ১৯৮২ সালের ১২ই মে কলকাতা হাইকোর্টের জাস্টিস সমরেন্দ্র চন্দ্র দেব কে নিয়ে গঠিত এক সদস্যের একটি তদন্ড কমিশন গঠন করেন। ওই কমিশনের টার্মস অফ রেফারেন্স ছিল:
(১) ১৭ জন মানুষ নিহত ও আরো মানুষ আহত হওয়ার সময় কি পরিস্থিতি ছিল ও ঘটনাক্রম ছিল; (২) আক্রমণ ও নিগ্রহ এর পেছনে কি কারণ ছিল নার ফলে ১৭ জন আনন্দমার্গী নিহত ও অন্যান্যরা আহত হয়েছিলেন; (৩) আনন্দমার্গীদের মৃত্যুর কি তাৎক্ষণিক কারণ ছিল; (৪) ঘটনাস্থলে পুলিশের পৌঁছতে দেরি হয়েছিল কি না; (৫) অন্যান্য যে কোনও অনুসন্ধানের বিষয় যা তদন্ত কমিশন প্রাসঙ্গিক মনে করবে; (৬) ভবিষ্যতে এ ধরণের ঘটনা এড়ানোর জন্য সুপারিশ।
প্রাপ্ত নথিপত্র থেকে এটাই প্রতীয়মান হয় যে দেব কমিশনের রিপোর্ট জমা দেওয়ার তারিখ ১২ই জানুয়ারি, ১৯৮২ অবধি বাড়ানো হয় ও পরে ১৩ই সেপ্টেম্বর, ১৯৮৩ অবধি। দেব কমিশন এর পরে রিপোর্ট জমা দিয়েছেন কিনা তার সপক্ষে কোনও নথি পাওয়া যাচ্ছে না।
২০১১ সালে বামফ্রন্ট কে পরাস্ত করে টিএমসি সরকার ক্ষমতায় আসে। বিজন সেতুর ঘটনাটির গুরুত্ব অনুধাবন করে আনন্দ মার্গীদের গণহত্যার অনুসন্ধানের জন্য ২০১২ সালের ১৪ই মার্চ জাস্টিস সন্তোষ কুমার ফৌজদার কে নিয়ে এক সদস্যের তদন্ত কমিশন গঠন করা হয়। তিন মাসের মধ্যে রিপোর্ট জমা দিতে বলা হয়। পরে মেয়াদকাল আরও ছয় মাস বাড়িয়ে দেওয়া হয়।
এর পরে ২০১৩ সালের ৯ই এপ্রিল এলাহাবাদ হাইকোর্টের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি জাস্টিস অমিতাভ লালা কে নিয়ে এক সদস্যের তদন্ত কমিশন গঠিত হয় জাস্টিস ফৌজদারের জায়গায়।
রিপোর্ট জমা দেওয়ার মেয়াদ ২রা মে, ২০১৩ থেকে আরো ছয় মাস বাড়িয়ে দেওয়া হয়। এর পরে ২০১৫ সালের ৭ই সেপ্টেম্বর আরো এক বছরের জন্য লালা কমিশনের মেয়াদ বাড়ানো হয়।
কান্তি গাঙ্গুলি নামে সিপিআইএম এর এক রাজনৈতিক নেতা হাইকোর্টে রিট পিটিশন দাখিল করেন। মূলত তিনটি বক্তব্য তুলে ধরেন।
(১) এই ধরনের ঘটনায় এক বার কমিশন গড়া হলে সেটিকে অবৈধ ঘোষণা না-করা পর্যন্ত দ্বিতীয় কোনও কমিশন গঠন করা যায় না। এ ক্ষেত্রে জ্যোতি বসুর আমলের দেব কমিশনকে অবৈধ ঘোষণা করা হয়নি।
(২) সিআইডি ওই হত্যাকাণ্ডের তদন্ত শেষ করে আদালতে চার্জশিট পেশ করেছিল। নিম্ন আদালতে সাজাও হয়েছিল কয়েক জন অভিযুক্তের। সিআইডি নিম্ন আদালতের রায়কে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে উচ্চ আদালতে আপিল করেনি। আপিল করা হয়নি আনন্দমার্গীদের পক্ষ থেকেও।
(৩) এই অবস্থায় নতুন তদন্ত কমিশনে ডেকে তাঁদের মক্কেলকে সিআইডি বা আনন্দমার্গীদের তরফে জেরা করার কোনও আইনি অধিকার নেই বলে দাবি করেন কান্তিবাবুর আইনজীবীরা। তাঁদের অভিযোগ, কান্তিবাবু নতুন কমিশনে যান। কিন্তু কমিশনের চেয়ারম্যানের বদলে তাঁকে জেরা করেন সিআইডি এবং আনন্দমার্গীদের আইনজীবীরা। এটা আইনবিরুদ্ধ।
এই পিটিশনের বিচার শেষে জাস্টিস দীপঙ্কর দত্তের রায়ে জানানো হয় যে বিজন সেতুতে আনন্দ মার্গী হত্যার তদন্তে গঠিত অমিতাভ লালা কমিশন বৈধ। ফলে তদন্তে স্বার্থে সিপিএম নেতা কান্তি গাঙ্গুলিকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারবে কমিশন। তবে প্রশ্নের উত্তর দেওয়া না দেওয়ার স্বাধীনতা থাকছে কান্তি গাঙ্গুলির। সিআইডিও তাঁকে জেরা করতে পারবে না।
[প্রাগুক্ত রায়]
সর্বশেষ পাওয়া খবরের ভিত্তিতে বলা যায় এখন পর্যন্ত লালা কমিশনের পেছনে খরচ হয়েছে ৩.২ কোটি টাকা।
কমিশন এ পর্যন্ত ৬১ জনের সাক্ষ্য নিয়েছেন। বেশ কিছু সাক্ষী মারা গেছে। কমিশনের মেয়াদ ২০১৯ সালের ১লা এপ্রিল পর্যন্ত বর্ধিত হয়েছে। এর মাঝে কমিশনের সচিবের পদ বহুদিন শূন্য ছিল। বিচারপতি লালা কমিশনের গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে মন্তব্য করতে নারাজ [এই সময়, ২রা সেপ্টেম্বর, ২০১৮]
ইতোমধ্যে সংবাদপত্রের এক অংশে এই ঘটনার জন্য অর্থাৎ আনন্দ মার্গীদের পরিকল্পিতভাবে ষড়যন্ত্র করে অপহরণ (ট্যাক্সি থেকে নামিয়ে), গায়ে আগুন ঢেলে পুড়িয়ে মারার দায়ে সিপিআইএম এর ছোট মাঝারি নেতাদের নামে অভিযোগ চালু আছে। সিপিএম বিধায়ক শচিন সেন, কান্তি গাঙ্গুলি প্রমুখের বিরুদ্ধে মামলা রুজু হয়, বিচারও শুরু হয়।
স্বভাবতই ওই দলের পক্ষ থেকে পাল্টা অস্বীকার করাও চালু আছে। একটি থিওরি অনুযায়ী ছেলেধরা সন্দেহে উত্তেজিত জনগণ এই কাজ করেছিল।
যতদিন না লালা কমিশনের রিপোর্ট জমা পড়বে ততদিন এই চাপ ও পাল্টা চাপ চলতে থাকবে।
বিজন সেতুতে অগ্নিদগ্ধ হয়ে ১৭ জন মার্গী মারা যাওয়ার ঘটনা ন্যক্কারজনক। 'ছোট্ট' , 'সাজানো ঘটনা' বা 'বিরোধীদের চক্রান্ত' নয় বরং ৪ঠা মে, সিপিএম রাজ্য সম্পাদক প্রমোদ দাশগুপ্ত জানান "আনন্দমার্গীর ঘটনাতে আমরা গভীর ভাবে উদ্বিগ্ন। এই ঘটনার তীব্র নিন্দা করছি। প্রকৃত ঘটনার সঠিক তদন্ত ও দোষীদের শাস্তি দেওয়া হোক" [সূত্র: Sushovan Patra]
আজ আবার ৩০শে এপ্রিল। বাম আমলে দুই যুগ, আর এই আমলে অর্ধযুগ কেটে গেল। প্রয়াত দাসগুপ্তর মতো আমিও চাই প্রকৃত দোষীদের শাস্তি হোক। অবিলম্বে চাই।
(কোনো সংগঠন বা ব্যক্তিবিশেষ কে আঘাত দেওয়া এই পোস্টের উদ্দেশ্য নয়)