শনিবার, ১৩ ফেব্রুয়ারী, ২০১৬
পেট্রোল - সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়
রবিবার, ২৫ অক্টোবর, ২০১৫
এক সন্ধ্যের গল্প (উদ্ভুট্টে সিরিজ) - সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়
মঙ্গলবার, ১৪ জুলাই, ২০১৫
না-মানুষের উপকথা - সুদীপ্ত চক্র
শনিবার, ৯ মে, ২০১৫
শেষ হয়েও ... - সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়
মঙ্গলবার, ১১ নভেম্বর, ২০১৪
ক্যাকফনি ~ অবিন দত্তগুপ্ত
তা ভারত সেবাশ্রমের তৎকালীন ' ভারতীয় কাল্চার ' জানা সর্বেসর্বা তার ব্রহ্মচর্যের আগে যাদবপুরে থাকতেন । তা তিনি , জাগতিক আনন্দ থেকে সম্পূর্ণ বিমূখ তিনি , তৃতীয় স্বর্গে সপ্তম মেঘে যার বাস তিনি , আমার বাড়ির পথ চিনতে বি.দাশগুপ্তকে ল্যান্ডমার্ক ধরলেন । যাদবপুরিইয় বা তদসম-তদ্ভব অঞ্চলের বাইরের মানুষদের সুবিধার্থে জানাই , বি দাশগুপ্ত অঞ্চলের সর্বশ্রেষ্ঠ মদের দোকান । দশমি,কালীপূজোর এবং ভোটের আগের দিন মোটামুটি সেলিম্পুর থেকে ঢাকুরিয়া অব্দি লাইন পরে । ব্রহ্মচারী উনি , ওইটাই ঠিকঠাক ল্যান্ডমার্ক ধরেছিলেন ।
সে যাই হোক , দুপুর বেলায় হাঁটতে হাঁটতে একটা গাছে ছাওয়া ধু ধু জমি দেখতে পাই আশ্রমের থেকে ঠিক দু মিনিট দূরে । স্বভাবসুলভ জানার তাড়নায় , জমিটায় ঢোকার মুখেই একটি বাচ্চা ছেলে পথ আটকে দাঁড়ায় । " এখানে আমার বাপ-দাদা শুয়ে আছে ,এটা বেড়ানোর জায়গা নয়" , গম্ভীর কিশোর কণ্ঠ পিছিয়ে আসতে বাধ্য করে ।
ভাগ্যিস হাতে শহুরে ক্যামেরা ছিল । ছোপ ছোপ গাল ,নাকে শিকনি, ফোকলা দাঁতের দু-তিন ফুটরা জুটে যায় । সক্কলের মুখের হাসি একরকমের , হাঁসিতে ধর্ম আলাদা করা মুশকিল । একমাত্র জল চাইলাম যখন , তখন একজন পানি আর একজন জল আনতে তাদের ঘর ছুটলেই বুঝে ছিলাম , হাসি বাঁ উচ্চতা এক হলেও আশ্রমের চোখে এরা আলাদা ।
সমস্ত খেলার মধ্যে , টেবিল টেনিস আর ভলিবলটা আমি মোটামুটি খেলে দিতে পারি । বিকেল বেলা সেবাশ্রমে ফিরে দেখলাম , মাঠে ভলি খেলা হচ্ছে । তো আমি আর আমার বন্ধু খেলতে শুরু করলাম । মিথ্যে বলব না ,দুজনে বেশ ভালোই খেলেছিলাম । নীল বেশ লম্বা , নেটে ভালোই খেলে, আর আমি থার্ড কোর্ট(পাড়ায়)...উলু বনে মিডল ম্যান( ডাইভ ভালো মারতাম , যে কোন বিষয় ) ।
খেলার সময় একটা ১২-১৩ বছরের বাচ্চা বার বার চোখ টানছিল । খেলতে একদম জানে না, কিন্তু ঠিক বলের কাছে পৌঁছে গিয়ে বল তুলে দিচ্ছিল । দারুণ ফিটনেস । খেলার পর, টিউবওয়েলে পা ধুতে গেলাম যখন , ছেলেটা কল টিপছিল । নাম জোসেফ । বন্ধুত্ব করে ফেললাম । বললাম তোর গ্রামটা দেখা । ও বলল "আগে ভজনটা হয়ে যাক , নইলে খেতে পাব না "...
সন্ধ্যা নেমছে । ওই অঞ্চলে আশ্রমে গোটা দশেক টিউব এবং আশে পাশের গ্রাম গুলোতে গোটা ৫এক ৬০ ওয়াটের বাল্ব ছাড়া কিস্যু জ্বলত না । সন্ধ্যা সাড়ে পাঁচটায় নিকষ অন্ধকার , একটা তেলেভাজার দোকানের সামনে বসে , গ্রামের বুড়োদের গল্প শুনছিলাম । বয়স্ক মানুষদের নিজেদের মধ্যে গল্প, তৃতীয় ব্যক্তি হিসেবে শুনতে বেশ লাগে । তা হঠাতি ভজনের আওয়াজ শোনা গেল । আশ্রমের ভিতরে ঢুকে দেখি , মা সহ সব ভক্তরাই ভক্তি ভরে গান শুনছে । কনকনে শীতে , গায়ে চাদর জড়িয়ে গান গাইছে ,শাওতালি বাচ্চারা। বয়স ৭ থেকে ১৩ , বেশীর ভাগ আশেপাশে খোঁচাখুচি করছে, খরগোশের মতো সাদা সাদা দাঁত বের করে, কালো মুখে এক একটি পোট্রেট হচ্ছে প্রতি মুহূর্তে । আমাদের জোসেফ ( ১৩ বছরের ভলি মাঠের বন্ধু) , তাদেরি মধ্যে একটি মুখ । বার বার ,মুখ ফিরিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে ,অদ্ভুত সারল্যে হেসেই যাচ্ছে। সাধারণত নাগরিক আমরা এতো সহজে হাসতে পারি না , অবশ্য নাগরিক আমার এই ধারনাটা আমার-ই এক কমরেড অক্লেশে ভেঙ্গেছেন বেশ কিছুমাস হল...অবশ্যি তিনি কলকাতার নন ,তবে নাগরিক বটে । বছর পাঁচেকের একটা বাচ্চা ছেলে অবিরাম আরতি করে যাচ্ছে , আর বাকিরা বিরিবির ,এভাবেই ভজন শেষ হল । তারপর খাবার ঘরে একটা লম্বা লাইন । আমি বাইরে এসে গোল্ডফ্লেক ধরালাম । হঠাত হাতে একটা নরম হাতের ছোঁয়া । এক হাতে শালপাতায় মোড়া খাওয়ার ,জোসেফ আমার হাত টানছে ।
জোসেফের বাড়িটা গ্রামের একদম মাঝখানে । পাতকুয়া থেকে পুকুর অব্দি সব দেখিয়ে , এ গলি ও গলি ঘুড়িয়ে যখন বাড়ি নিয়ে এলো, ততক্ষনে আমি দেখে নিয়েছি প্রতিটাবাড়ির দরজায় ক্রস ঝোলানো । সন্ধ্যায় , বুড়োদের আড্ডায় বসে জেনেছিলাম, পাকা রাস্তা থেকে লাল রাস্তায় ঢোকার মুখে প্রথম গ্রামটা হিন্দু,ডানদিকেরটা মুসলমান এবং সেবাস্রমের পাশের দুটো সাওতালি গা ক্রিশ্চান । বুঝতে অসুবিধে হল না , কেন ঠিক এখানেই ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘ ।
তা আমি আর নীল বাড়িতে ঢুকলে , জোসেফের দাদু আমাদের মহা সমাদরে বসতে দিলেন তার খাটিয়ায় । জোসেফের মা কোলের বাচ্চাটকে কোনক্রমে ওর দিদির কোলে দিয়ে দৌরে ভেতরে চলে গেলেন । দাদু জিজ্ঞেস করলেন " একটু চা খেয়ে যাবেন, আমাদের বাড়ি ?" কোন ভেজাল ছিল না , নাতির অসম বয়িসী বন্ধু ,'ভিনদেশী' নাগরিকদের প্রতি অকৃত্রিম আতিথেয়তাও বলতেই পারি । জোসেফের মা দৌড়ে বাইরে বেরিয়ে জোসেফের হাতে কিছু একটা দিলেন । জোসেফ-ও হুট বলতেই ছুটে পালাল । ওদের বাড়িতে চিনি ছিল না । দাদু জানালেন, সবাশ্রম সাঁওতাল বাচ্চাদের ক্লাস ৫ পর্যন্ত পড়ায় , তারপর ধর্মান্তরের চেষ্টা করে। যারা হিন্দু হয় না , তাদের তাড়িয়ে দেয় । যারা ধর্মান্তরিত হয়, তারা খাওয়া পড়া পায় । জোসেফের দাদু জানিয়েছিলেন , জোসেফ ধর্মান্তরিত হবে না । জোসেফ জানিয়েছিল , ও অঙ্কতে ভালো ,ইংরিজিটা তেমন পারে না ।
তারপর যা হয়ে থাকে । নীল জোসেফের বোনকে কোলে নিল । আমি ছবি তুললাম । চিনি এলো । চা খেলাম । বেড়িয়েও এলাম । ঘুটঘুটে অন্ধকার রাস্তা দিয়ে হাঁটছি , হঠাতি কানে এলো বাঁদিকের গ্রামটা থেকে সন্ধ্যের শঙ্খের আওয়াজ , প্রায় একি সাথে ডানদিকের গ্রামটা থেকে আজান ভেসে আসতে শুরু করল । রুপকথায় এমন হয় বোধহয় , সাঁওতাল গ্রামটায় বহু বহু দূরে দ্রিম দ্রিম শব্দে ধামসা বাজল । যে সেদিন ঐ নিকষ কালো রাতে ,অসংখ্য তারার নীচে,লাল কাঁকড়ে দাঁড়িয়ে ওই অদ্ভুত ক্যাকফনি শোনেনি, তাদের প্রত্যেকের জন্য খারাপ লাগে । সন্ধ্যে ভালো লাগলেই নাগরিক আমি ,নাগরিক কবিয়ালের "সন্ধ্যে হল,সন্ধ্যে হল " গানেই অভ্যস্ত। এই অদ্ভুত সুরটা অচেনা হলেও 'ছোঁয়াচ' লাগে । প্রতিটা আলাদা সুর , প্রতিটা আলাদা তাল , কিন্তু কেউ কাউকে কাটছে না-কেউ কাউকে ছাপিয়ে যাচ্ছে না। হয়ত আমার কানটাই গণ্ডগোলের ,কিন্তু সেদিন আমি কোন সুর কে কাউকে ছাপাতে শুনিনি , একটি অন্যটিকে আরও বেশী ভরাট করে তুলেছিল বোধহয় ।
পরদিন সকালে (আগন্তুক আমি) জোসেফকে বলেছিলাম , " তোদের কোন পরব আছে নাকি রে ? কাল আওয়াজ শুনলাম" ।
"না দাদা কাল রাতে বস্তিতে একজন মারা যায় , তাই শুনেছ"
"তোদের নাচ হয় না ? কবে হয় "
"হয় তো পরবে।"
মাস খানেক পর ,অফিস থেকে বাড়ি ফিরছি ,তখনো শিত ভালোই । হঠাত মোবাইল বেজে উঠল । অপিরিচিত নাম্বার । তুললাম । ওদিক থেকে বলছে " দাদা পরশু পরব আছে , লাচ্ হবে , আসবে ?"
"তুই..."
"আমি জোসেফ । চিনতে পাড়ছ না ?"
" হ্যা পাড়ছি,তুই আমার নম্বর মনে রেখেছিস?"
"ও মা, দাদু লিখে রাখল যে ...আসবে ?"
"কি করে আসব ... আমার তো অনেক কাজ। মন দিয়ে অঙ্ক করছিস্ তো ।"
"হ্যা , একদিন কলকেতা যাব... তুমি বলেছিলে আমায় শহর দেখাবে। আমি কিন্তু গ্রাম দেখিয়েছিলাম "
"নিশ্চয়ই । তুই এলেই দেখাবো ...চিড়িয়াখানা, ভিক্টরিয়া সব । "
শেষের কথা গুলো আর মনে নেই । আমার কানে তখন সেই নিকষ কালো রাত্রের মিউজিকটা বাজছে । সরল সুন্দর একে অপরকে না ছাপিয়ে যাওয়া মানুষের সঙ্গিত ।মানুষ এভাবেও মনে রাখে ?
মোবাইল হারিয়েছিল কয়েকমাস পর । জোসেফ নামটা , নামের জন্য দেওয়া । নাম হারিয়েছি শহরের ভিড়ে । কিন্তু ছেলেটার মুখটা , সোজা সরল বাঁচার লড়াইটা, আর সেদিনের রাতের সুর আমায় কোনদিন-ও ছেড়ে যাবে না । আজকেও , যে কোন অন্ধকার রাতে ,যখন আলো দেখতে পাই না , তখন ওই মানুষের সুর-ই বাঁচিয়ে রাখে ।
সরি জোসেফ , চিড়িয়াখানা দেখানো হল না ।
বৃহস্পতিবার, ৩০ অক্টোবর, ২০১৪
ছোটলোক ~ প্রকল্প ভট্টাচার্য়্য
টেবিলে বসতে না বসতেই মি: রায়ের ফোন -
' সন্দীপ, একবার আসতে পারবে ?'
ছোটো অফিস, আর মি: রায় হলেন হেড অফিসের লোক, মানে মালিকের ঘরের লোক| তাই ডিপার্টমেন্ট আলাদা হলেও সন্দীপ তাঁকে একটু খাতির করতে বাধ্য | যদিও মনে মনে গালাগালই দেয়, এই কাজ গুছিয়ে নেওয়া, গায়ে - পড়া আত্মীয়তা, সব কিছুর মধ্যেই একটা ছোটোলোকোমি তার চোখে পড়ে | পারতপক্ষে উনি কারোকেই আপনি - আগ্গে করেন না, এই ডাকের মধ্যেও আন্তরিকতা ছাপিয়ে প্রছন্ন অপমান উঁকি দেয় বইকি !
কিন্তু কী আর করা, ছোটো চাকরির দায় | অগত্যা হাতের সমস্ত কাজ মুলতুবি রেখে সে মি: রায়ের কেবিনে গেল |
- ' আর বোলো না, ছোটোলোক একেবারে | অডিটিং- এর এত ঝামেলা- একটা লাইসেন্স আটকে দিয়েছে ব্যাটারা এদিকে | যাক্গে কাজের কথাটা বলি | এখুনি আমার গাড়িটা নিয়ে ব্যাঙ্কে যাও, পাঁচ লাখ টাকা ক্যাশ রেডি রাখতে হবে এখনই !
- ' মানে, আমি ? আসলে কয়েকটা জরুরি কাজ ছিল-'
- ' আরে সব পরে হবে, এ হল বড়ো সাহেবের হুকুম | আমি ব্যাঙ্কে ফোন করে ক্যাশ রেডি রাখতে বলেছি, শুধু যাবে আর আসবে | রমেশ !'
রমেশ ওনার ড্রাইভার | তাকে ডাকা মানেই সন্দীপের আর কোনো কথাই উনি শুনবেন না | অগত্যা সন্দীপ বিড়বিড় করে গালাগাল দিতে দিতে বেরোল |
ব্যাঙ্কে সত্যিই ভিড় নেই, আর টাকাটাও রেডিই ছিল |
চেক জমা দিতেই ক্যাশিয়ার বললেন - " স্যার, হান্ড্রেডে প্রবলেম নেই তো ?"
সর্বনাশ ! একশো টাকার বান্ডিলে পাঁচ লাখ মানে তো থলি করে নিয়ে যেতে হবে ! না:, আজ দিনটাই খারাপ সন্দীপের |
- ' কোনো চিন্তা নেই স্যার, এই যে আমি বান্ডিলগুলো খবরের কাগজে মুড়ে দিচ্ছি |' ক্যাশিয়ার দেঁতো হাসল | তবে স্যার গাড়ি থাকলেও একটু সাবধানে ' বুঝলেন তো, জায়গাটা ছোটোলোকদের কিনা !'
বগলে বড়ো বড়ো দুটো কাগজের বান্ডিলে টাকা নিয়ে সন্দীপ কোনো মতে বেরিয়ে গাড়িতে উঠতে যাবে, রাস্তার দুটো ছেলে তাকে ধরল | ' বাবু, পয়সা !'
সর্বনাশ ! সন্দীপ পা চালাল | রমেশ গাড়িটা পার্ক করেছে রাস্তার ওধারে আর এখন পেছনে জুটেছে এই দুটো আপদ | সন্দীপ যত তাড়াতাড়ি পারল এগোতে লাগল, কিন্তু ছেলে দুটোও ছুটতে লাগল তার পেছনে -
" বাবু, পয়সা বাবু !"
প্রাণপণে রাস্তা পেরিয়ে গাড়ির কাছে পৌঁছতেই ছেলে দুটো সন্দীপকে ধরে ফেলল | রমেশকে দেখে সাহস পেয়ে সন্দীপ ঘুরে দাড়াল ওঁদের টেনে একটা চড় মারবে বলে, কিন্তু ঘুরেই সে থমকে গেল, তোলা হাতটা তোলাই রয়ে গেল |
' বাবু আপনার পয়সা পড়ে গেছিল !' হাঁপাতে হাঁপাতে ছেলে দুটো তাকে কথাটা বলে আর তার হাতে কিছু একটা গুঁজে দিয়েই হাসিমুখে দৌড়ে পালাল |
হতভম্ব সন্দীপ একশো টাকার বান্ডিলটা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়েই রইল | কোন ফাঁকে কাগজের মোড়কের ফাঁক দিয়ে পড়ে গেছিল বান্ডিলটা !!
সোমবার, ২৫ নভেম্বর, ২০১৩
গেছো দাদার পপাত চ ~ অনির্বান সরকার
চেয়ে দেখি রুমাল তো আর রুমাল নেই, দিব্যি মোটা-সোটা লাল টক্টকে একটা বেড়াল গোঁফ ফুলিয়ে প্যাট্ প্যাট্ করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে!
আমি বললাম, ``কি মুশকিল! ছিল রুমাল, হয়ে গেল একটা বেড়াল।''
অমনি বেড়ালটা বলে উঠল, ``মুশকিল অবার কি? ছিল একটা পোকা , হয়ে গেল দিব্যি একটা মাছ । এ তো হামেশাই হচ্ছে।''
আমি খানিক ভেবে বললাম, ``তা হলে তোমায় এখন কি বলে ডাকব? তুমি তো সত্যিকারের বেড়াল নও, আসলে তুমি হচ্ছ রুমাল।''
বেড়াল বলল, ``বেড়ালও বলতে পার, রুমালও বলতে পার, অবনমন ও বলতে পার।'' আমি বললাম, ``অবনমন কেন?''
শুনে বেড়ালটা ``তাও জানো না?'' বলে এক চোখ বুজে ফ্যাচ্ফ্যাচ্ করে বিশ্রীরকম হাসতে লাগল। আমি ভারি অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম। মনে হল, ঐ অবনমন এর কথাটা নিশ্চয় আমার বোঝা উচিত ছিল। তাই থতমত খেয়ে তাড়াতাড়ি বলে ফেললাম, ``ও হ্যাঁ-হ্যাঁ, বুঝতে পেরেছি।''
বেড়ালটা খুশি হয়ে বলল, ``হ্যাঁ, এ তো বোঝাই যাচ্ছে--- অবনমন এর মা , বেড়ালের চন্দ্রবিন্দু, রুমালের চা --- হল মাঁচা । কেমন, হল তো?''
আমি বললাম, ``চন্দ্রবিন্দু কেন?' বেড়ালটা আবার হাসলো -- "এটাও বুঝতে পারছ না ভায়া?"
আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না, কিন্তু পাছে বেড়ালটা আবার সেইরকম বিশ্রী করে হেসে ওঠে, তাই সঙ্গে সঙ্গে হুঁ-হুঁ করে গেলাম। তার পর বেড়ালটা খানিকক্ষণ আকাশের দিকে তাকিয়ে হঠাত্ বলে উঠল, ``গরম লাগে তো সেকেন্ড ডিভিশন এও তো খেলতে পারো।''
আমি বললাম, ``বলা ভারি সহজ, কিন্তু বললেই তো আর সেটা করা যায় না?''
বেড়াল বলল, ``কেন, সে আর মুশকিল কি?''
আমি বললাম, `পাবলিক এর ভয় , সমর্থকেরা কি বলবে? তুমি কোনো উপায় জানো? তাহলে বাতলে দাও ''
বেড়াল একগাল হেসে বলল, ``তা আর জানি নে? কলকাতা , ডায়মন্ডহারবার, রানাঘাট, তিব্বত, ব্যাস্! সিধে রাস্তা, সওয়া ঘণ্টার পথ, তারপর শীর্ষাসন , কঠিন অনুশীলন , no ফাকিবাজি। মাঝে মাঝে প্রাণায়াম ও করতে পারো তো , খুব কাজের জিনিস ।''
আমি বললাম 'প্রাণায়াম করলেই জিতে যাবো?'
বেড়াল রেগে গিয়ে বলল 'সেটা আমি কখন বললাম ।ওটা করলে ধৈর্য বাড়বে । হার টাকে sportingly মেনে নিতে পারবে '
আমি বললাম, ``'তা হলে দায়িত্ব টা তুমি নিতে পার?''
শুনে বেড়ালটা হঠাত্কেমন গম্ভীর হয়ে গেল। তার পর মাথা নেড়ে বলল, ``উঁহু, সে আমার কর্ম নয়। আমার গেছোদাদা যদি থাকত, তা হলে সে ঠিক-ঠিক বলতে পারত।''
আমি বললাম, ``গেছোদাদা কে? তিনি থাকেন কোথায়?''
বেড়াল বলল, ``গেছোদাদা আবার কোথায় থাকবে? Austrelia''
আমি বললাম, ``কোথায় গেলে তাঁর সাথে দেখা হয়?''
বেড়াল খুব জোরে মাথা নেড়ে বলল, সেটি হচ্ছে না, সে হবার জো নেই।''
আমি বললাম, ``কিরকম?''
বেড়াল বলল, ``সে কিরকম জানো? মনে কর, তুমি যখন যাবে উলুবেড়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে, তখন তিনি থাকবেন মতিহারি গাঁজার ঠেকে। যদি মতিহারি যাও, তা হলে শুনবে তিনি আছেন রামকিষ্টপুর দুগ্গা পুজোর ভাসানে। আবার সেখানে গেলে দেখবে তিনি গেছেন কাশিমবজার ছট পুজো কমিটির মিটিং attend করতে । কিছুতেই দেখা হবার জো নেই।''
আমি বললাম, ``তা হলে তোমরা কি করে দেখা কর?''
বেড়াল বলল, ``সে অনেক হাঙ্গাম। আগে হিসেব করে দেখতে হবে, দাদা কোথায় কোথায় নেই; তার পর হিসেব করে দেখতে হবে, দাদা কোথায় কোথায় থাকতে পারে; তার পর দেখতে হবে, দাদা এখন কোথায় আছে। তার পর দেখতে হবে, সেই হিসেব মতো যখন সেখানে গিয়ে পৌঁছবে, তখন দাদা কোথায় থাকবে। তার পর দেখতে হবে---''
আমি তাড়াতাড়ি বাধা দিয়ে বললাম, ``সে কিরকম হিসেব?''
বেড়াল বলল, ``সে ভারি শক্ত। জ্যামিতি ছিল ছোটোবেলায়?'' এই বলে সে একটা কাঠি দিয়ে ঘাসের উপর লম্বা আঁচড় কেটে বলল, ``এই মনে কর গেছোদাদা ।'' বলেই খানিকক্ষণ গম্ভীর হয়ে চুপ করে বসে রইল।
তার পর আবার ঠিক তেমনি একটা আঁচড় কেটে বলল, ``এই মনে কর তুমি,'' বলে আবার ঘাড় বাঁকিয়ে চুপ করে রইল।
তার পর হঠাত্ আবার একটা আঁচড় কেটে বলল, ``এই মনে কর চন্দ্রবিন্দু।'' এমনি করে খানিকক্ষণ কি ভাবে আর একটা করে লম্বা আঁচড় কাটে, আর বলে, ``এই মনে কর তিব্বত---'' ``এই মনে কর গেছোবৌদি ইলিশ রান্না করছে---'' ``এই মনে কর গাছের গায়ে একটা ফুটো---ইলিশ ভাপা ,ইলিশ পাতুরি, দৈ ইলিশ ... ''
এইরকম শুনতে-শুনতে শেষটায় আমার কেমন রাগ ধরে গেল। আমি বললাম, ``দূর ছাই! কি সব আবোল তাবোল বকছে, একটুও ভালো লাগে না .... ক্ষিদে পাচ্ছে''
বেড়াল বলল, ``ও আচ্ছা, তোমার তো আবার পেট গরম ..ইলিশ হজম হবে না ।'' আমি চোখ বুজলাম।
চোখ বুজেই আছি, বুজেই আছি, বেড়ালের আর কোনো সাড়া-শব্দ নেই। হঠাত্ কেমন সন্দেহ হল, চোখ চেয়ে দেখি বেড়ালটা ল্যাজ খাড়া করে বাগানের বেড়া টপকিয়ে পালাচ্ছে আর ক্রমাগত ফ্যাচ্ফ্যাচ্ করে হাসছে।
কি আর করি, ফস করে একটা সিগারেট ধরিয়ে ব্যলকনিতে গিয়ে বসলাম । বসতেই কে যেন ভাঙা-ভাঙা মোটা গলায় বলে উঠল, ``লাস্ট কবে বড় ট্রফি হাতে নিয়েছ খোকা ?''
আমি ভাবলাম, এ আবার কে রে? এদিক-ওদিক তাকাচ্ছি, এমন সময় আবার সেই আওয়াজ হল, ``কই জবাব দিচ্ছ না যে? শেষ কবে জিতেছ?'' তখন উপর দিকে তাকিয়ে দেখি, একটা দাঁড়কাক শ্লেট পেনসিল দিয়ে কি যেন লিখছে, আর এক-একবার ঘাড় বাঁকিয়ে আমার দিকে তাকাচ্ছে।
আমি বললাম, ``২০১২ ''
কাকটা অমনি দুলে-দুলে মাথা নেড়ে বলল, ``হয় নি, হয় নি, ফেল্।''
আমার ভয়ানক রাগ হল। বললাম, ``নিশ্চয় হয়েছে। ২০১২ কলকাতা ফুটবল লীগ।''
কাকটা কিছু জবাব দিল না, খালি পেনসিল মুখে দিয়ে খানিকক্ষণ কি যেন ভাবল। তার পর বলল, ``দু হাজার বারোর নামে হরিবল , হাতে রইল কাচকলা , ঘন্টার মাথা !''
আমি বললাম, ``তবে যে বলছিলে ২০১২ তে পাই নি ? এখন কেন?''
কাক বলল, ``কাচকলা কোনো ট্রফির নাম নয় । তুমি যখন বলেছিলে, তখনো পুরো ট্রফি হয় নি। ওটা ছিল, রানার্স ট্রফি । আমি যদি ঠিক সময় বুঝে ধরে না ফেলতাম, তা হলে এতক্ষণে ওটাকেই বড় ট্রফি বলে চালিয়ে দিতে ।''
আমি বললাম, ``এমন আনাড়ি কথা তো কখনো শুনি নি। ট্রফি মানে ট্রফি , তা সে বড় হোক ছোটো হোক অথবা পুচকে । তা সে পাড়ার খেলা হলেও ট্রফি আবার স্বান্তনা পুরস্কার হলেও ।''
কাকটা ভারি অবাক হয়ে বলল, ``তোমাদের ক্লাবে winners ট্রফির কোনো দাম নেই বুঝি?''
আমি বললাম, ``winners ট্রফি!! সেটা কিরকম?''
কাক বলল, ``পাসের ক্লাবে কদিন থাকতে, তা হলে বুঝতে।ওদের তো ট্রফি রাখার আর জায়গাই নেই ।প্রতি বছর এত্তগুলো করে । এই তো কদিন খেটেখুটে খানিকটে সময় জমিয়েছিলাম, তাও তোমার সঙ্গে তর্ক করতে অর্ধেক খরচ হয়ে গেল।'' বলে সে আবার হিসেব করতে লাগল। আমি অপ্রস্তুত হয়ে বসে রইলাম।
এমন সময়ে হঠাত্গাছের একটা ফোকর থেকে কি যেন একটা সুড়ুত্ করে পিছলিয়ে মাটিতে নামল। চেয়ে দেখি, দেড় হাত লম্বা এক বুড়ো, তার পা পর্যন্ত সবুজ রঙের দাড়ি, হাতে একটা হুঁকো তাতে কলকে-টলকে কিচ্ছু নেই, আর মাথা ভরা টাক। টাকের উপর খড়ি দিয়ে কে যেন কি-সব লিখেছে।
বুড়ো এসেই খুব ব্যস্ত হয়ে হুঁকোতে দু-এক টান দিয়েই জিজ্ঞাসা করল, ``কই হিসেবটা হল?কবে শেষ বার ট্রফি পেয়েছিল''
কাক খানিক এদিক-ওদিক তাকিয়ে বলল, এই হল বলে।''
বুড়ো বলল, ``কি আশ্চর্য! উনিশ দিন পার হয়ে গেল, এখনো হিসেবটা হয়ে উঠল না?''
কাক দু-চার মিনিট খুব গম্ভীর হয়ে পেনসিল চুষল তার পর জিজ্ঞাসা করল, ``কতদিন বললে উনিশ ?তা সে লাগবে না সে কি আজকের কথা -- stone age ছিল তখন ''
কাক অমনি গলা উঁচিয়ে হেঁকে বলল, ``লাগ্ লাগ্ লাগ্ দু হাজার বারো ।''
বুড়ো বলল, ``এগারো ।'' কাক বলল, ``দশ ।'' বুড়ো বলল, ``নয় ।'' ঠিক যেন নিলেম ডাকছে।
ডাকতে-ডাকতে কাকটা হঠাত্ আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ``তুমি ডাকছ না যে?''
আমি বললাম, ``খামকা ডাকতে যাব কেন? আমি তো জানি ২০০৯ সুপার কাপ ''
বুড়ো এতক্ষণ আমায় দেখে নি, হঠাত্আমার আওয়াজ শুনেই সে বন্বন্ করে আট দশ পাক ঘুরে আমার দিকে ফিরে দাঁড়াল।
তার পরে হুঁকোটাকে দূরবীনের মতো করে চোখের সামনে ধরে অনেকক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে রইল। তার পর পকেট থেকে কয়েকখানা রঙিন কাঁচ বের করে তাই দিয়ে আমায় বার বার দেখতে লাগল। তার পর কোত্থেকে একটা পুরনো দরজির ফিতে এনে সে আমার মাপ নিতে শুরু করল, আর হাঁকতে লাগল, ``I League (ন্যাশনাল ফুটবল League) এ ১৩-১০ ,ফেডারেশন কাপে ৮-৫,Calcutta ফুটবল লীগ এ ৪৮-৪৩ , I.F.A. শিল্ড এ ২০-৭,ডুরান্ড কাপে ৮-৬, রোভার্স কাপে ৪-৪, এয়ারলাইন্স ট্রফি তে ৭-১ -- আর পারছি না আমি হিসেব করতে ।সর্ব সাকুল্যে ১১৫-৮৫।''
আমি ভয়ানক আপত্তি করে বললাম, ``এ হতেই পারে না। বুকের মাপও ছাব্বিশ ইঞ্চি, গলাও ছাব্বিশ ইঞ্চি? আমি কি ইলতুতমিস? নিশ্চই রেফারির কারসাজি । ব্যাটাদের বিশ্বাস নেই ''
বুড়ো বলল, ``বিশ্বাস না হয়, wikipedia দেখ।''
দেখলাম ফিতের লেখা-টেখা সব উঠে গিয়েছে, খালি ২৬ লেখাটা একটু পড়া যাচ্ছে, তাই বুড়ো যা কিছু মাপে সবই ছাব্বিশ ইঞ্চি হয়ে যায়।
তার পর বুড়ো জিজ্ঞাসা করল, ``ওজন কত?''
আমি বললাম, ``জানি না!''
বুড়ো তার দুটো আঙুল দিয়ে আমায় একটুখানি টিপে-টিপে বলল, `থাক অনেক হয়েছে ওটা সবাই জানে।২-৩ তো হবেই চোখ বুজে `।''
আমি বললাম, ``সেকি, পটল টার ওজনই তো একুশ সের, সে আমার চাইতে দেড় বছরের ছোটো।''
কাকটা অমনি তাড়াতাড়ি বলে উঠল, ``সে তোমাদের হিসেব অন্যরকম।''
বুড়ো বলল, ``তা হলে লিখে নাও--- ওজন আড়াই সের, বয়েস একশ চব্বিশ।''
আমি বললাম, ``দূত্!আমার বয়স হল আট বছর তিনমাস, বলে কিনা একশ চব্বিশ।''
বুড়ো খানিকক্ষণ কি যেন ভেবে জিজ্ঞাসা করল, ``বাড়তি না কমতি?'' কাক মাথা নিচু করে বলল , 'পড়তি । আবার ঝরতি ও বলতে পারো।'
আমি বললাম, ``সে আবার কি?''
বুড়ো বলল, ``বলি বয়েসটা এখন বাড়ছে না কমছে?''
আমি বললাম, ``বয়েস আবার কমবে কি? তবে লাস্ট ৫-৬ বছর ধরে কোনো হিসেব কাজ করছে না''
বুড়ো বলল, ``তা নয় তো কেবলই বেড়ে চলবে নাকি? তা হলেই তো গেছি! কোনদিন দেখব বয়েস বাড়তে বাড়তে একেবারে ষাট সত্তর আশি বছর পার হয়ে গেছে। শেষটায় ঝাপি বন্ধ হয়ে যায় আর কি ! যা দিন কাল লোকের ক্ষোভ ক্রমশ যে হারে বাড়ছে নতুন ফর্মুলা আবিস্কার না হয়ে যায় আবার ।আর ওদের ই বা দোষ কিসের এইটুকু আপদার তো থাকতেই পারে ।কষ্ট হয় দেখলে ''
আমি বললাম, ``তা তো হবেই। আশি বছর বয়েস হলে মানুষ বুড়ো হবে না!''
বুড়ো বলল, ``তোমার যেমন বুদ্ধি! আশি বছর বয়েস হবে কেন? সেবার তো অবনমন ছিল, এক কম হবে''।.ঠিক কি না ?. শুনে আমার গা পিত্তি জ্বলে গেলো।
কাক বলল, ``তোমরা একটু আস্তে আস্তে কথা কও, আমার হিসেবটা চট্পট্ সেরে নি।
(সুকুমার রায়ের আশ্রয় নিলাম)
সোমবার, ৫ আগস্ট, ২০১৩
অঙ্ক ও তার উত্তর ~ সুমন্ত্র মাইতি
আমার পছন্দের বিষয় ছিল সাহিত্য, কিন্তু আমাদের মধ্যবিত্তীয় শিক্ষামনস্কতায় সেই ছেলেকে তখনই সাহিত্য নিয়ে পড়তে অনুমতি দেওয়া হয় যখন প্রমানিত হয় যে তার দ্বারা অঙ্ক বিষয়টি করায়ত্ত করা অসম্ভব এবং যতক্ষণ না পরীক্ষার নম্বর সেই ধারনায় সরকারী সিলমোহর বসাচ্ছে ৷ কতজনকে বলতে শুনেছি, "ছেলেটা না অঙ্কে কাঁচা, তাই ওকে আর্টসেই দিলাম বুঝলি?" কিম্বা "ওরে বাবা, ওসব অঙ্ক টঙ্ক আমার দ্বারা হবে না, আমার বাবা আর্টসই ভালো" ৷ অবশ্য শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে কচকচানি করতে বসি নি , ওসব নিয়ে অনেক নিউজপ্রিন্ট খরচ হয়ে গেছে, অনেক গুরুগম্ভীর সেমিনার আয়োজিত হয়েছে, কিন্তু কাজের কাজ কিছু হয় নি ৷ আমি অঙ্ক নিয়ে কিছু ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলব ৷
পরমেশ্বরণ নামে এক দক্ষিন ভারতীয় ভদ্রলোক আমাদের অঙ্ক পড়াতেন, আড়ালে আমরা তাকে বাঘ বলে ডাকতাম ৷ ভদ্রলোক এককালে সৈন্যবাহিনীতে ছিলেন, মেজাজটা ছিল একবারে মিলিটারীয় এবং ক্লাসে ছিলেন সাক্ষাত যম ৷ আমার অবশ্য কোনদিনই পরমেশ্বরণকে পছন্দ ছিল না, কারণ বাচ্চা বাচ্চা ছেলেদের সাথে ঐরকম ব্যাঘ্রসুলভ আচরণে কি বাহাদুরি ছিল আমি এখনো বুঝে উঠতে পারি না ৷ যাইহোক, পরমেশ্বরনের অঙ্ক শেখানোর মন্ত্র ছিল নিয়মানুবর্তিতা এবং নিয়মানুবর্তিতা ৷ আমরা তখন অঙ্ক কষতাম চৌকো খোপের সেইসব খাতায়, একেকটা খোপে একেকটা সংখ্যা নিয়ে কারবার , তারপর তাকে যোগ বিয়োগ গুন ভাগ করে অবশেষে সেই কাঙ্খিত ম্যাজিক সংখ্যায় পৌছনো, যেটাকে বলা হত রেজাল্ট ৷ মাঝপথে কোনো ভুল হলে একটা সংখ্যায় পৌছনো যেত বটে, তবে তা কাঙ্খিত রেজাল্ট নয়, অতএব ভুল ৷ অবশ্য অঙ্কের এটাই নিয়ম, একই অঙ্কের কখনো দুটো উত্তর হতে পারে না ৷ পরমেশ্বরণ এই নিয়মের ব্যতিক্রম নন, তার কঠোর নির্দেশ ছিল পরীক্ষার খাতা যেন ঝকঝকে হয়, প্রত্যেকটা সংখ্যা এবং চিহ্ন যেন নির্দিষ্ট প্যাটার্ন ফলো করে, এর অন্যথা হলে ঠিক উত্তরেও নম্বর কাটা যাবে ৷ এবং এতসব পরেও যদি উত্তরটা শেষ লগ্নে গিয়ে ভুল হয়, তাহলে নম্বরের খোপে বসবে এক শুন্য ৷
স্যার রয় ছিলেন আমাদের অঙ্কের রবীন্দ্রনাথ ৷ "সায়েন্সের ছেলে" হবার দরুন বহুদিন অঙ্ক নিয়ে নাড়াঘাটা করতে হয়েছে, অনেকের ক্লাস করেছি, সবার প্রতি যথার্থ সন্মান রেখেই বলছি, ওনার কাছে যদি আরো কিছুদিন নাড়া বাঁধার সুযোগ হত, বিষয়টাকে হয়ত আরেকটু বেশি ভালবাসতে পারতাম ৷ স্যার রয়ের কোনো ধরাবাঁধা নিয়মের বিষয়ে ছুতমার্গ নেই , অঙ্কের নিয়ম মেনে উত্তরে পৌছতে পারলেই তিনি খুশি ৷ তদুপরি নিয়ম মেনেও যদি শেষবেলায় সামান্য হিসেবের ভুলে উত্তরটা বেঠিক হয়, তিনি সেই ভুলটা লালকালি দিয়ে সংশোধন করে পুরো নম্বর বসাতেও দ্বিধাবোধ করেন নি ৷
বহুদিন পর জীবনের খাতায় কিছু অঙ্কের হিসেব মেলাতে গিয়ে কেমন যেন গোলমাল হয়ে যাচ্ছে ৷ কোনটা আসল, উত্তরটা পৌছনোর পথ, নাকি উত্তরটা? শেষ লগ্নে যদি সামান্য হিসেবের ভুলে উত্তরটা ভুল হয়ে যায়, তাহলে নম্বর কত পাব স্যার ? ফুল মার্কস, নাকি শুন্য ?
শনিবার, ৩ আগস্ট, ২০১৩
আজ আমার তোতলা দাদার গপ্পো ~ সুমন্ত্র মাইতি
" এ কি বৌমা ? দুই ভাইয়ের মিলিয়ে নাম রাখতে হবে তো ৷ এটাই তো এই বংশের নিয়ম ৷ "
অগত্যা মায়ের দেওয়া নাম নাকচ , আমার নাম হলো রিন্টুর সাথে মিলিয়ে টিন্টু আর সৌমিত্রের সাথে সুমন্ত্র ৷
মজার কথা এর পরে আমাদের বংশের প্রায় সবার নাম মা রেখেছিলেন ৷ পিসতুতো ভাই বোনেরা, মামাত ভাই , দাদার বড় মেয়ে এবং সবশেষে আমার ছেলে , সবার নাম মা রেখেছেন ৷ ছেলের ডাকনাম অবশ্য আমি রেখেছি ৷ জিষ্ণু ৷ কলেজে পড়ার সময় এই নামটা প্রথম শুনে মনে হয়েছিল , ছেলে হলে এই নামই রাখব ৷ আরেকটা সাধ ছিল , মেয়ে হলে নাম রাখতাম লাইজু ৷ এ জন্মে আর সে সাধ পূরণ হলো না ৷
যাইহোক, নামকরণের ইতিহাস এবং সার্থকতার আলোচনা থাক ৷ যেটা দিয়ে শুরু করেছিলাম , দাদার তোতলামীর গপ্পো ৷
আমাদের গ্রামের বাড়িতে সম্পত্তির পরিমান বেশ ভালই ৷ বাস্তু ভিটে,পুকুর, ধানি জমি, বাগান বাড়ি , প্রায় খান শয়েক নারকেল গাছ, দেবোত্তর মন্দির ,মন্দিরের পাশেই বিয়েবাড়ি ভাড়া দেওয়ার জন্য ছোটমত রিসেপশন হল -সব যোগ করলে আয় মন্দ নয় ৷ দাদা কলকাতায় পড়াশুনো শেষ করার পর জেঠু আদেশ দিলেন গ্রামে ফিরে আসার ৷ পারিবারিক সম্পত্তির দেখাশুনোর সাথে বাবা এবং জেঠু ঠিক করলেন দাদাকে ব্যবসায় নামাতে হবে ৷ কি ব্যবসা ? চিংড়ি মাছের ভেরির ৷
দাদা তখন নব্য যুবক, কলকাতার আধুনিকতা গায়ে লেগেছে, তার ইচ্ছে কলকাতায় থেকে চাকরির চেষ্টা করবে ৷ কিন্তু দোর্দণ্ডপ্রতাপ বাপের সামনে মুখ খোলার সাহস নেই ৷ তাই অনিচ্ছাসত্বেও ব্যবসায় মনোনিবেশ করলো ৷ গোল বাঁধলো যখন তার কিয়ত্কাল পরে জেঠু নিদান দিলেন বিয়ের পিড়িতে বসার ৷ দাদা পুরোপুরি বেঁকে বসলো ৷ বিয়ে সে কিছুতেই করবে না এত কম বয়সে ৷ এমন নয় যে সে কাউকে কথা দিয়ে এসেছে , তবু সে বিয়ে করবে না ৷ জেঠু অনড়, মেয়ের বাড়িতে তিনি ততদিনে মেয়ে দেখে এসেছেন , প্রাথমিক কথাবার্তা সেরে এসেছেন, এখন দাদা বেঁকে বসলে ঘোর প্রেস্টিজ ইসু ৷ অগত্যা মাঠে নামলেন মা ও জেঠিমা , দাদাকে রাজি করলেন , " অন্তত একবার যা, মেয়ে দেখে আয় ৷ " গোঁজ হয়ে দাদা রাজি হলো ৷
বিজয়া দশমীর পরের দিন মেয়ে দেখতে যাওয়ার দিন ঠিক হলো ৷ দাদা, সাথে আমি আর আমার জেঠতুত দিদির বর ৷ গাড়িতে উঠেই দাদা গজগজ আরম্ভ করেছে, সাথে যোগ হলো তোতলামো ৷ (উত্তেজিত হয়ে পড়লেই দাদা তোতলায় ৷ )
" আমার প-প্রবলেম টা কেউ ব-বুঝছে না ৷ আমি এখন বিয়ে ক-করব না ৷ " এই বলে চলেছে সমানে ৷ মাঝরাস্তায় যখন গাড়ি থামল চা সিগারেটের জন্য, আমি আর জামাইবাবু আলাদা করে ডেকে বললাম , " শোন দাদা , জেঠুর সাথে বাওয়াল নিয়ে লাভ নেই , এঁড়ে পাবলিক ৷ কায়দা করে সামলা ৷ আমরা যাব, মেয়ে দেখব আর ফিরে এসে বলবি মেয়ে পছন্দ হয় নি ৷ ব্যাস , খেল খতম ৷"
বুদ্ধিটা সবার মনে ধরল ৷
আমরা মেয়ের বাড়িতে বেশ খাতির যত্ন পেলাম ৷ কিন্তু আমার মনে সর্বদা একটা খচ খচ করতে লাগলো , তোতলাবে না তো ? তাহলে আর ফিরে গিয়ে নাকচ করার ব্যাপারটা নিয়ে আরেকবার ভাবতে হবে ৷ দাদা কিন্তু না তুতলিয়ে সপ্রতিভ ভাবে কথা বলে চলল ৷
যথাসম্ভব বিনয়ী হয়ে আমরা বিদায় গ্রহণ করলাম ৷ গাড়ি ছুটছে বাড়ির পথে , পেছনের সিটে আমি আর জামাইবাবু, সামনের সিটে দাদা ৷
জামাইবাবু গলাখাঁকারি দিয়ে বলে , "তা হলে বাড়ি গিয়ে ওই কথাটাই হবে ? "
দাদার দৃষ্টি সামনের কাঁচে , খানিক চুপ থেকে বলে , "অপ-পছন্দের তো ক-ক-কোনো কারণ দেখলাম না ৷ "
আগেই বলেছি, উত্তেজিত হলেই দাদা তোতলায় ৷
শনিবার, ২৭ জুলাই, ২০১৩
এগ্রিকালচার ~ অমিতাভ প্রামাণিক
হাওয়ায় খবর ভেসে এল, জানিস, পূবদিকে এক দেশ আছে, যেখানে মানুষ নিজের খাবার নিজে বানায় চাষবাস করে। চাষবাস ব্যাপারটা কী, তা তো তারা জানে না। তাই সরেজমিনে তদন্ত করতে এক সদস্যের একটি দল এসে হাজির হল হরপ্পার পাশের গ্রামে।
সেখানে চাষীরা তখন গমের ক্ষেতের পাশে বসে বিশ্রাম নিচ্ছে। হঠাৎ দেখে অশোকবনে সীতার মত এক অদ্ভুতাকৃতি অ্যালায়েন তাদের দিকে জুলজুল করে তাকিয়ে আছে। তারপর কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে কী একটা খটোমটো ভাষায় জিজ্ঞেস করলো, এইসব গমের ক্ষেত তোমাদের নিজের বানানো?
এরা কিস্যু না বুঝে মুণ্ডি হিলিয়ে দিল। স্ট্যান্ডার্ড ইন্ডিয়ান রেসপন্স, বুঝতে না পারলে মুন্ডি হিলাও, যার মানে হ্যাঁ-ও হতে পারে, না-ও হতে পারে। বিদেশী লোকটা বলল, এগুলো কী খুব ডিফিকাল্ট টাস্ক? আবার মুন্ডি হিলালো ওরা।
- তোমরা অনেক বছর ধরে এইসব করো?
আরেক প্রস্থ মাথা নাড়ানো।
- কী করে শিখলে এইসব? আমাকে শেখাবে? ধরো আমি যদি ফিরে গিয়ে আরো কিছু আমার জ্ঞাতিভাইদের নিয়ে আবার মাসখানেক পরে ফিরে আসি, আমাদের শিখিয়ে দেবে তো কী করে চাষবাস করতে হয়?
যাই জিজ্ঞেস করে সেই লোক, এরা কেবল পেন্ডুলামের মত মাথা দোলায়। লোকটা ভাবলো এরা সব প্রশ্নের উত্তরেই হ্যাঁ বলে।
লোকটা ফিরে যাওয়ার পথে ডাইরীতে লিখে রাখল তার ভ্রমণের অভিজ্ঞতা। দেশে ফিরে যাওয়ার পথে মরুভূমিতে পথ হারিয়ে মারা যায় সে। বহু বছর পরে তার কঙ্কালের পাশে সেই ডাইরী উদ্ধার হয়। সেখানে লেখা, Indian culture is so developed, they can make their own food. The strength lies in their agree culture.
সেই থেকে চাষবাসের ইংরাজী প্রতিশব্দ এগ্রিকালচার।
বৃহস্পতিবার, ২৫ জুলাই, ২০১৩
'অলীক’ প্রেম এবং... - সাগর চক্রবর্ত্তী
“রূপা!!!মা আমার!!! ফিরে আয় মা আমার কাছে !!! নিজের বলতে তো আমার একমাত্র তুই-ই আছিস। কথা দিচ্ছি মা, আর কখনো এত রাগ করবোনা!!!” চিৎকার আর কান্নার মধ্যে এই কথা গুলো শুনে বাবার গলার আওয়াজ-টা কে অবশ্য আমি সনাক্ত করতে পারছিলাম।
ঠিক কতক্ষণ আগে সেটা স্মৃতিচারণ করার ক্ষমতা আমার ছিল না, তবে শুধু মনে হচ্ছিল, সেই সময় তো বাবা এত মাথা গরম না করলেও পারত। আমাকে বা ওকে আলাদা করে ডেকে এনে কথা বলতেও তো পারত। মতিঝিল এর মণ্ডলপাড়ার ওই ছোট্ট গলি, তার চেয়েও ছোট তপনদের বাড়ীর এক চিলতে উঠোন; সেখানে নিজের ব্যক্তিত্ব, রাজনৈতিক পদে থাকার সুবিধা থেকে পাওয়া ক্ষমতার খতিয়ান না জাহির করলেও তো পারত। তপন কে ওর প্রতিবেশীদের সামনে নিজের দেহরক্ষীদের দিয়ে বেদম প্রহার করিয়ে পরিবেশটাকে এতখানি উত্তপ্ত করে পরিস্থিতিটাকে আয়ত্তের বাইরে না নিয়ে গেলেও তো পারত।
জানি না, বাবা ঠিক কি করতে পারত কিন্তু করার চেষ্টা করেনি। ঠিক যেমন জানি না, কি ভাবে আমি, সুরূপা রায়, বাড়ীর ভোগবিলাসী, উচ্চবিত্ত জীবনযাত্রার মায়া ছেড়ে এই শান্ত, গ্রাম্য পরিবেশে প্রকৃতির কোলে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছিলাম।
জমিদার বাড়ীর বংশধর আমি। আমার উপর অভিমান করে কি না জানি না, মায়ের স্নেহ কি, সেটা ঠিকমত বোঝার বয়স না হতেই মা আমাকে ছেড়ে ভগবানের কাছে চলে গিয়েছিলেন। বাবাকে অপমান করার কোন অভিপ্রায় আমার না থাকলেও যেহেতু বাবা খুব বড় রাজনীতিবিদ ছিলো,বাড়ীটা তার কাছে ছিল তীর্থস্থানের মত,মাঝেমধ্যে আসতো, টানা ৪ দিন বাড়ীতে থাকলে আমার ওই ৪ দিন ১ মাসের মত লাগত। সেই কারণেই হয়ত নীলরতনে ডাক্তারি পড়ার সময় ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের আজ্ঞানুসারে আবশ্যিক ভাবে মহিলা ছাত্রাবাসে থাকার সময় আমার বান্ধবীদের মধ্যে জীবনটাকে অনেক সহজ মনে হত। ওদের মধ্যে আমার একাকী, একমাত্রিক জীবনের বদলে যাওয়ার রসদ খুঁজে পেতাম।
সেই বহুমাত্রিক জীবনকে হয়ত আরও রঙিন করে কাছে পেতে কলেজ এর লাস্ট ইয়ার এ লাস্ট সেমিস্টার এর ঠিক আগে আমি আর আমার ৩ জন সবচেয়ে কাছের বান্ধবী ঘুরতে গিয়েছিলাম ইমামবাড়া। বলাই বাহুল্য,বন্ধুদের সঙ্গে এটাই ছিল আমার প্রথম এবং একমাত্র সফর। ১৩ মাস আগের সেই সফর আজ এত শারীরিক কষ্টের মধ্যেও আমার স্বপ্নের সফর বলে মনে হয়।
ফেরার টিকিট কনফার্ম না হওয়াতে আমাদের জেনারেল কামরায় ফিরতে হয়েছিল। আজ পিছনের দিকে তাকালে মনে হয়, ১৩৪০২ ডাউন হাজারদুয়ারী এক্সপ্রেস এ ভগবানগোলা থেকে শিয়ালদহ ফেরার সেই যাত্রাটাই হয়ত আমার জীবনের সবচেয়ে উত্তেজক যাত্রা।
কথায় বলে, “ভাগ্য যার, দুনিয়া তার”। সেদিন ট্রেনে ওঠার পর দেবলীনা,সায়নী,পরমাদের ভাগ্য দেখে আমার বার বার এই প্রবাদবাক্যটার বহুবচনে রূপান্তরটা মনে পড়ছিল, “ভাগ্য যাদের, দুনিয়া তাদের...।” কারণ ১টাই,ট্রেনে ওঠার ১০ মিনিটের মধ্যে ওরা সিট পেয়ে গেলেও আমাকে দাঁড়িয়েই থাকতে হচ্ছিল। আরও ১ টা ব্যাপার লক্ষ্য করছিলাম আমি, সময় যত যাচ্ছিল, ট্রেনে ভিড় বাড়ছিল, আর আমি আমার বান্ধবীদের থেকে ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছিলাম। ২টো বড় ব্যাগ কাঁধে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে আমার কষ্ট হচ্ছিল, এটা যেমন ঠিক, তেমনি যে সমস্ত লোকেরা চারদিকের সিট,বাঙ্কার গুলোতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসেছিল, তাদের আমার দিকে তাকিয়ে থাকার ভঙ্গিমা আমাকে তাদের সাহায্য নেবার থেকে বিরত রাখছিল।
“Madam!!! Please be careful…!!! আপনি আনমনা হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছেন আর আপনার ব্যাগ মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে।”কথাগুলো শুনে পিছন ফিরে তাকাতেই বক্তার চোখেমুখে একটা অদ্ভুত নিষ্পাপ সারল্য অনুভব করলাম। চোখগুলো দেখেই মনে হয়েছিল এ হয়ত চারদিকে ছড়িয়ে থাকা পিপাসু লোকগুলোর চেয়ে কিছুটা হলেও আলাদা। যাক কিছুক্ষণ পর যখন সম্বিত ফিরল আমার, আবিষ্কার করলাম ছেলেটাও একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। কিছুক্ষণ পর যখন নিজে থেকেই বুঝতে পারল যে, আমি ২টো লাগেজ ব্যাগের ভার সামলে তৃতীয় ব্যাগটাকে তুলতে অক্ষম, নিজে থেকেই ব্যাগটাকে তুলে আমার হাতে দিয়ে দিল। আমি আবার মুখ ঘুরিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম।
“আপনার তো মনে হয় দাঁড়িয়ে থাকতে খুব কষ্ট হচ্ছে। আপনি আপনার লাগেজ গুলো নিয়ে আমার জায়গায় বসতে পারেন।” প্রায় ২০ মিনিট পরের কথা। আনমনা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেও দাঁড়াতে যে আমার বেশ কষ্টই হচ্ছিল, সেটা বলাই বাহুল্য। হঠাৎ সেই চেনা কণ্ঠস্বরের আবেদনে আমার ঘোর কাটল। আবিষ্কার করলাম এ তারই গলা যে কিছুক্ষণ আগে আমার ব্যাগ ফেরত দিয়েছে। দেবলীনা,সায়নীরা বেশ খানিকটা সামনে বসে থাকায় আর সেই জায়গাটাতে প্রচুর লোক দাঁড়িয়ে থাকায় সমস্ত ঘটনা গুলোই ঘটছিল ওদের চোখের আড়ালে।
বসতে যে আমার একেবারেই ইচ্ছে করছিল না তা নয়, বরং দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে আমার পা কাঁপছিল। কিন্তু পিছনে তাকিয়ে যে সিটটাতে ও বসেছিল, তার পাশের ২ টো সিটেও ২ টো পিপাসু চোখের লোককে দেখে আমার বসার ইচ্ছেটা তখনকার মত চলে গেল। আর জানি না কেন, ওর বসতে দেওয়ার আবেদনে সাড়া না দেবার সাথে সাথে ওর আবেদনের কোনও প্রত্যুত্তর না দেওয়ার অভদ্রতাটাও করেই ফেললাম আমি।
ঘুরে দাঁড়িয়ে রয়েছি, হঠাৎ করে আবিষ্কার করলাম সেই কণ্ঠস্বর; তবে এবার অনেক কাছ থেকে; গলার আওয়াজ যেন আরও বেশী মার্জিত। “বুঝতে পেরেছি!!! আপনার কি অসুবিধা। দাঁড়ান দেখছি কি করা যায়!!!”
কথাগুলো আমার কানে বলার পরই ও পিছন থেকে উঠে দাঁড়িয়ে পকেট থেকে মনে হয় তাসের একটা প্যাকেট বার করল। তার পর ওর পাশের আর সামনের বাঙ্কারে বসা লোকগুলোর উদ্দেশ্যে ওর হাতে থাকা তাসটা দেখিয়ে জিজ্ঞাসা করল, “কি কাকু, হবে নাকি?”
দেখলাম প্রায় সবাই একসাথে বলে উঠল, “এইতো, হবেনা মানে... আলবাত হবে...।”
তারপর অনেকেই একসঙ্গে বলে উঠল, “আমিও খেলব।।!!”
লক্ষ্য করলাম, ওর পাশের সিটে বসা লোক ২টো ও একই কথা বলতে বলতে উঠে দাঁড়াল।
দেখলাম, ও খুব উৎসাহ নিয়ে ওদের ২জন কে কাছে ডেকে নিয়ে তাস খেলা শুরু করল। কিছুক্ষণ পরে ও চোখের ইশারায় আমাকে ওর সিটটাতে বসতে বলল। তার কিছুক্ষণ পরে যেন আমার মনে হল, যে সমস্ত পিপাসু চোখগুলো কু-অভিপ্রায় নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল, তাদের সবার মনঃসংযোগই এখন তাসের দিকে চলে গেছে।
ব্যাগগুলোকে গুছিয়ে বেশ আরাম করে বসলাম আমি। মিনিট খানেক পর দেখলাম, ট্রেন এসে দাঁড়াল রানাঘাট স্টেশনে। ব্যস!! “যেখানে ভুতের ভয়, সেখানে সন্ধে হয়...” প্রবাদ টাকে সত্যি প্রমাণ করতে কিনা জানিনা, স্টেশনে ট্রেন থামার সঙ্গে সঙ্গে টিকিট পরীক্ষক যে দিকটায় আমি বসে আছি, সেই দিকের দরজা দিয়ে উঠে সমস্ত যাত্রীদের টিকিট পরীক্ষা করা শুরু করলেন। যেহেতু এক্সপ্রেস ট্রেনের টিকিট কনফার্ম হয়নি, লোকাল ট্রেনের টিকিট নিয়ে বসে আছি... পরীক্ষক ধরলে জরিমানা অন্তত ৫০০ টাকা- রেলের নিয়মাবলীর এই ধারাটা সঙ্গে সঙ্গে মাথায় চলে এল।
“Excuse me!!! একটু এদিকে আসতে পারবেন প্লিজ...” তাস খেলার লোকেদের ভিড়ে ওকে উদ্দেশ্য করে বললাম আমি।
জটলা থেকে বেরিয়ে এসে আমার অস্বস্তির জায়গাটা শুনে নিয়ে সহজাত ভঙ্গীতে ব্যক্ত করা ওর সেই প্রতিক্রিয়া, যা আমাকে মুহূর্তের মধ্যে চিন্তামুক্ত করল, এবং অদৃশ্য ভরসাও যোগাল; আবার... “দাঁড়ান, দেখছি...”
দেখলাম ও এগিয়ে গেল টিকিট পরীক্ষকের দিকে, আমার দিকে আঙুল রেখে ওনাকে উদ্দেশ্য করে উত্তেজিত ভাবে কিছু কথা বলতে দেখলাম ওকে। টিকিট পরীক্ষক ওর কথা শুনে কাঁধে হাত দিয়ে কিছু একটা বললেন, মনে হয় সান্ত্বনা দিলেন। তারপর আবার সমস্ত যাত্রীদের টিকিট পরীক্ষা করা শুরু করলেন, আবার ওর মার্জিত আওয়াজ আমার কানে এসে পৌঁছল...“কাজ হয়ে গেছে। আশা করি আপনার সমস্যা হবে না।”
সত্যি!! দেখলাম, উনি আমায় বাদ দিয়ে ওখানে থাকা সমস্ত যাত্রীর টিকিটের বৈধতা পরীক্ষা করলেন...তারপর মিশে গেলেন সামনের ভিড়টাতে। যদিও আমার কাজ হয়ে যাওয়ায় আমার আর জানতে ইচ্ছা হয়নি ও টিকিট পরীক্ষককে আমার ব্যাপারে ঠিক কি বলেছিল। আর যেভাবে এক চিলতে জায়গার মধ্যে তিনটে ব্যাগ নিয়ে বসেছিলাম, আমার পক্ষ্যে মোবাইল এ ফোন করে দেবলীনাদের খোঁজ নেওয়ার ব্যাপারটাও বেশ অসম্ভব ঠেকছিল।
মিনিট পাঁচেক পর ট্রেন রানাঘাট ছেড়ে চলতে শুরু করল। মোবাইল এর দিকে তাকিয়ে দেখলাম, “Deblina calling….” ফোন পেয়ে বুঝতে পারলাম, নেটওয়ার্ক নেই, তাই ওর কথা কিছুই শুনতে পারছি না।প্রথমবার বেড়াতে বেরিয়ে এভাবে ট্রেনে অচেনা লোকেদের মাঝে বসে থাকতে নিজের যেমন ভয় লাগছিল, তেমনি ওদের ব্যাপারেও খুব চিন্তা হচ্ছিল। তাই হয়ত অনভিজ্ঞতার বশেই ব্যাগগুলো বসার জায়গায় রেখে দরজার কাছে যাওয়া... এই আশায়, যে হয়ত ওখানে গেলে ফোনের ওই প্রান্ত থেকে আশা আওয়াজ একটু হলেও স্পষ্ট শুনতে পাব।
ঠিক তাই হল, দ্বিতীয়বার দেবলীনা ফোন করতেই ওর গলা স্পষ্ট হল... “তুই ঠিক আছিস তো? এখানে খুব ভিড়, তাই তোকে দেখতে পাচ্ছি না।”
“হ্যাঁ রে, তোদের খানিকটা পিছনেই বসে আছি, চিন্তা করিস না।”
নেটওয়ার্ক এর না থাকার প্রবণতা এবার দরজার সামনে থাকা অবস্থাতেও প্রকট হল... যার ফলে ফোনটাও গেল কেটে।
যাই হোক; ফিরে এসে দেখছি, যেখানে আমার ব্যাগগুলো রেখে গিয়েছিলাম, সেখানে অন্য কেউ বসে পড়েছে। আশেপাশে খুঁজে কোথাও ব্যাগগুলোর কোনও চিহ্ন না পেয়ে আমার চিন্তা শুরু হয়ে গেল...কি করব?? কোথায় খুঁজব?? তাসুড়ে ওই লোকেদের ভিড়ে আমার চোখ ওকে খোঁজা শুরু করতেই...
“কি ম্যাডাম!!” সেই বিশ্বস্ত আওয়াজ তবে এবার মনে হল পিছন থেকে আসছে।
পিছন ফিরে তাকাতেই ওর উপদেশ, “ব্যাগগুলোকে এইভাবে ফেলে চলে গেলেন। এরকম কেউ করে নাকি? এখানে কেউ আপনার আত্মীয় নয় যে ব্যাগের মালিক নেই দেখেও যতক্ষণ সে না আসছে, ব্যাগটাকে যত্ন করে আগলে রাখবে।”
“ওকে!! থ্যাংকস!!ব্যাগগুলোকে আগলানোর জন্য।” আমি বললাম... কিছুটা নীরস ভাবেই।
“ক্ষিদে পায়নি আপনার? নিন, মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে;” বলে নিজে যে ঠোঙা থেকে তেলেভাজা খাচ্ছিল, সেটা আমার দিকে বাড়িয়ে দিল ও।
ক্ষিদে যে আমার পাচ্ছিল না তা নয়, কিন্তু; ওই...যতই হোক, ওকে যতই বিশ্বস্ত লাগুক; ও তো এখনও আমার কাছে অপরিচিতই... এমনকি, ওর নামটা পর্যন্ত তখন আমি জানতাম না।
অগত্যা; “না না; ঠিক আছে; আমার ক্ষিদে নেই। আপনি খান। আর, আমার ব্যাগগুলো...”
“দাঁড়ান, ওই জায়গাটা ফাঁকা করার চেষ্টা করি;১ জোড়া তাসের বান্ডিল ছিল আমার কাছে, ভালই কাজে এসেছে; কি বলেন?” আমার বসার জায়গাটার দিকে তাকিয়ে আলতোভাবে হাসল ও।
আমিও মাথা নাড়লাম... কিন্তু সঙ্গে এটাও মনে হল, একটা তেলেভাজা খেয়ে নিলে বোধহয় মন্দ হত না।
যাক; আবার ওর মুখ থেকে “Excuse me!!!” ডাকটা শুনে বুঝতে পারলাম, আমাকেই ডাকছে। যেখানে বসেছিলাম, সেদিকটায় তাকিয়ে দেখি, হ্যাঁ; ঠিক তাই। ওখানে যে বসেছিল, তাকে কিছু ১ টা বলে বার্থের উপরে বসিয়ে দিয়েছে।
“চলে আসুন”- ডাকল আবার আমায়।
সমস্ত ব্যাগগুলোকে কোলে নিয়ে বসলাম আবার আমি।ট্রেন খুব দ্রুত গতিতে চলছিল, পিছন থেকে বেশ একটা আলগা ঠাণ্ডা হাওয়ার রেশ এসে শরীর-মন জুড়িয়ে দিচ্ছিল। কখন যে চোখ ভারী হয়ে গেছে, বুঝতেই পারিনি।
পেটে ছুঁচোরা ডনবৈঠক দেওয়া শুরু করতে আমার ঘুম কিছুটা আলগা হল। ঘুম ভাঙতে আবিষ্কার করলাম, ট্রেন নৈহাটি স্টেশনে দাঁড়িয়ে আছে। পুরো স্টেশন চত্বরটা গমগম করছে। মাইকে ঘোষণা শুনে বুঝলাম, এরপরে ট্রেন দাঁড়াবে নিজের গন্তব্যে; অর্থাৎ শিয়ালদহে। শরীর আভাস দিল, এখনি কিছু না খেয়ে নিলে ট্রেন পৌঁছে গেলেও আমি পৌঁছতে পারব না...!!
এবার সতর্কতার খাতিরে আমি আমার ৩ টে ব্যাগ সঙ্গে করেই ট্রেন থেকে নামলাম। স্টেশনের একেবারে মাঝের অংশে একটা কচুরির দোকান চোখে পড়ল, যেটাতে আমার মনে হল, অন্য সমস্ত খাবারের দোকানের থেকে ভিড় কিছুটা হলেও কম।
“৩ টে কচুরি প্লিজ; তাড়াতাড়ি”- অর্ডার করার পর চেয়ারে গা এলিয়ে দিলাম আমি।
প্রায় ১০ মিনিট পর দোকানের একটা ছেলে পাশে এসে দাঁড়াল; নিশ্চয়ই খাবার নিয়ে এসেছে...এই ভেবে আমি মাথা তুলতেই...
“ম্যাডাম; জল”- বুঝতে পারলাম এতক্ষণ পর জল নিয়ে এসেছে।
“প্রায় ১০ মিনিট হল বসে আছি; এতক্ষণে শুধু জলটা আনার বন্দোবস্ত করতে পারলেন আপনারা”-পিছন ফিরে চিৎকার করে এই কথাগুলো দোকানের মালিককে বলার সঙ্গে সঙ্গে আমার চোখে পড়ল, হাজারদুয়ারী এক্সপ্রেস বেশ গতিতে প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছে।
হায় হায়!! একে তো অচেনা জায়গা, তার উপর এমন টেবিলে বসলাম যে ট্রেনটা আমার পিছনে রইল!! সত্যি... এত জনসমাগম, মিনিটে মিনিটে ট্রেনের হুইসেল; বুঝতেই পারিনি ট্রেনটা কখন ছেড়ে দিয়েছে।
খালি পেটে ভারি জিনিষ হাতে দৌড়নো যে কি শক্ত কাজ, সেটা আমি ওইদিন বুঝতে পেরেছিলাম।
‘সুরুচি জলখাবার’ থেকে বেরিয়ে ২ হাতে ২ টো আর পিঠে ১ টা ব্যাগ নিয়ে প্রাণপণে প্ল্যাটফর্ম ধরে সোজা ট্রেনের পিছনে ছোটা শুরু করলাম। প্রতি মুহূর্তে যেন ট্রেনটা আমার থেকে দূরে চলে যাচ্ছিল। হাঁপাতে হাঁপাতে লক্ষ্য করলাম, ট্রেনের শেষ কামরাটাও প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে বেরিয়ে গেল।
প্রথমবার একা এদিকে আসা, রাস্তাঘাট কিছুই চিনি না... কি ভাবে বাড়ী পৌঁছব; বাবাকে কি বলব; এত কিছু ভাবতে ভাবতে আমার চোখে জল এসে গেল!!
মাথা নিচু হয়ে গেল...১ ফোঁটা চোখের জল মাটিতে পড়তে না পড়তেই আবার সেই বিশ্বস্ত গলার আওয়াজ এল সামনে থেকে...
“আপনি আর শুধরলেন না। যখন ট্রেনে খেতে বললাম খেলেন না; আর এখন খাবার দোকানে আনমনা হয়ে বসে থেকে ট্রেন মিস করে দিচ্ছিলেন।”
“দিচ্ছিলেন”- ওর মুখ থেকে বেরনো এই শব্দটা আমাকে কৌতূহলী করে তুলল। মুখ তুলে সামনে তাকিয়ে দেখি, ট্রেন স্টেশনের বাইরে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
“এবার দয়া করে চলুন তাড়াতাড়ি”-আমার ব্যাগগুলো নিজের কাঁধে নিতে নিতে বলল ও।
চোখ মুছতে মুছতে আবার দৌড়নো শুরু করলাম ওর সাথে। না খেয়েও যেন শরীরে নতুন করে জান পেলাম।
“চলুন, আগে আপনি উঠুন; আপনাকে মনে হচ্ছে হয় বেঁধে রাখতে হবে; নয়ত সবসময় চোখে চোখে রাখতে হবে।”
কথাগুলো বলার পর আমার পিছন পিছন ব্যাগগুলো নিয়ে ও ও উঠল ট্রেনে। ট্রেন আস্তে আস্তে চলা শুরু করল; ওর মুখও।
“আচ্ছা; সত্যি বলুন তো, আপনার সঙ্গে সবসময় দেহরক্ষীরা থাকে, তাই না? কিছু মনে করবেন না, চোখমুখ,সাজ-পোশাক আর চলন-বলন দেখলে কিন্তু বেশ বোঝা যায়, আপনি বড়লোক ঘরের মেয়ে... চলুন, আসুন।”
আমি ওই কামরায় আগে যে দিকটায় বসেছিলাম, সেদিকে যাওয়া শুরু করতেই...
“আরে; ওদিকে নয়; এদিকে।”দেখলাম এবার ও আমায় উল্টোদিকে যেতে বলছে।
“বারবার ওই সিটটা থেকে লোকজনকে তুলে আপনার বসার ব্যবস্থা করছি; আর আপনি কিছুক্ষণ পরপরই উঠে চলে যাচ্ছেন। কত লোককে আর বুঝিয়ে ওঠাব? তার চেয়ে আপনি এদিকটায় বসুন... এখন আমি ঠিক আপনার সামনের সিটটাতেই বসছি।যে কোনও অসুবিধা হলে আপনি আমায় বলুন।কিন্তু প্লিজ; নিজে উঠবেন না। আমি তাসের মায়া ছেড়ে দিয়েছি; ওগুলো নিয়ে বরং ওরাই খেলুক।”-আমায় বসার জায়গাটা দেখিয়ে দিয়ে ওই দিকের তাস খেলা লোকেদের ভিড়ের দিকে তাকিয়ে বলল ও।
ব্যাগগুলো আমার হাতে দিতেই আমি এমন একটা ব্যপারে অকে প্রশ্ন করে বসলাম, যেটা সেই মুহূর্তে আমার কিছুতেই বোধগম্য হচ্ছিল না; “আচ্ছা, ট্রেনটা থামল কেমন ভাবে?”
“ওই দেখুন, আপনার প্রশ্নের উত্তর নিজেই হেঁটে এদিকে আসছে”- ওর কথা শুনে পিছন ফিরে দেখি, সেই টিকিট পরীক্ষক যিনি আমায় বাদ দিয়ে বাকি সবার টিকিট পরীক্ষা করেছিলেন, তিনি রাগে গজগজ করতে করতে আসছেন।
“কি হয়েছে কাকা?” বেশ হালকা চালেই ও প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিল টিকিট পরীক্ষকের দিকে।
“আরে!! আর বোলো না।কে যেন ট্রেনের চেন টেনে দিয়েছে। কেউ নাকি তাকে দেখতে পায়নি।দেখ তো, ১০ মিনিট দেরী করিয়ে দিল। যাচ্ছে তাই একেবারে!!”- টিকিট পরীক্ষক হতাশ গলায় বললেন।
“একদম ছাড়বেন না”- ও বেশ জোশ নিয়ে বলল।
“আরে!! আগে ধরতে তো পারি... তারপর তো ভাবব যে ছাড়ব নাকি ছাড়ব না।” বেশ রাগী গলায় বললেন উনি।
“আরে, তুমি ঠিক আছো তো মা?” টিকিট পরীক্ষক দেখলাম আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন।
ওর ইশারায় বুঝতে পারলাম, উনি আমাকেই বলছেন।
তারপর দেখলাম, ওকে বললেন উনি, “আরে এই তো সেই মেয়ে নাকি যার কথা তুমি বলছিলে?”
ওকে দেখলাম সম্মতিসূচক ভাবে মাথা নাড়াতে।
“হ্যাঁ, আঙ্কেল...আমি ঠিক আছি”-আমিও টিকিট পরীক্ষকের প্রশ্নের উত্তর দিলাম।
“এই সময় এরকম একটু হয়। লোকে আনন্দে অনেক কিছুই ভুলে যায়। সব ঠিক হয়ে যাবে মা।”- বেশ গদগদ গলায় বললেন উনি।
কি জানি ও কি সব গল্প বলেছে ওনার কাছে... যার জন্য উনি এইসব কথা বলছেন।
“আসছি; হ্যাঁ”-বললেন উনি। তারপর সামনের কামরার দিকে হাঁটা শুরু করলেন।
আমার রাগের চেয়ে বেশী কৌতূহল হচ্ছিল, তার বশেই জিজ্ঞাসা করলাম ওকে, “আপনি আমার ব্যপারে কি বলেছেন ওনাকে?”
ও বেশ শান্ত গলায় বলল, “ছাড়ুন না সেটা। আপনার সমস্যার তো সমাধান হয়ে গেছে নাকি?নিন; এখন অন্তত কিছু খেয়ে নিন।যে দোকানে আপনি বসেছিলেন,সেই দোকানেরই কচুরি... আর আমি কাকাকে কি বলেছিলাম,সেটা না হয় অন্য কোনও সময় বিস্তারিত ভাবে বলা যাবে।”
এক মুহূর্তের জন্য চুপ করে গিয়ে আবার বলল ও; “আর ভয় পাবেন না প্লিজ। আমি এর মধ্যে কিছু মেশাইনি।”
এবার ওর প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলে সেটা সত্যি লজ্জার ব্যপার হত। গোগ্রাসে ৪ টে কচুরি খেয়ে ট্রেনের বেসিনে হাত ধুয়ে এসে বসলাম ওর ঠিক উল্টোদিকের সিটটাতে।
“আপনার বিন্দিটা কপাল থেকে সরে গেছে”- ও বলল আমায়।
“হতে পারে...মুখ ধোয়ার সময় হয়ে গেছে”- ওর কথার উত্তর দিয়ে বিন্দিটা ঠিক করার চেষ্টা করতে করতে বললাম আমি।
“ঠিক আছে এবার?”- আমি প্রশ্ন করলাম ওকে নিজের মত করে ঠিক করে নেওয়ার পর।
ও ওর জায়গা থেকে উঠে আমার কপালে হাত দিয়ে বিন্দিটা ঠিক করে আমার মুখের দিকে বেশ মন দিয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, “হ্যাঁ, এবার ঠিক আছে!!”
আমাকে চুপ করে বসে থাকতে দেখে আবার বলা শুরু করল ও, “আচ্ছা, আপনি ট্রেনে একা প্রথমবার যাচ্ছেন, তাই না?”
“আমি একা যাচ্ছি না তো!আসলে আমরা ৪জন বান্ধবী গিয়েছিলাম ইমামবাড়া। ফেরার টিকিট কনফার্ম না হওয়াতেই যত ঝামেলা।”
“তো বাকি ৩জন কোথায়?”
“ওরা আগের কামরাতেই সামনের দিকটায় বসেছিল। ভিড়ের চোটে আমি ওদের থেকে আলাদা হয়ে যাই। এদিকে আমার ফোনটাও গেছে বন্ধ হয়ে, ওরা তো মনে হয় অনেকবার আমায় ফোন করেছে।”
“নিন,আমার ফোন নিন। ওদের সাথে অন্তত একবার কথা বলে নিন। ব্যারাকপুর পেরিয়ে গেল,আর হয়ত খুব বেশী হলে ১৫ মিনিটে ট্রেন শিয়ালদহ পৌঁছে যাবে। আমি একটু ওইদিক থেকে ঘুরে আসছি।”-কথাটা বলার পর দেখলাম ২ টো সিট পিছনে বসা ১ টা মেয়ের কাছে গিয়ে ওর সাথে কথা বলা শুরু করল ও। ওদের কথা বলার ধরণ দেখে বোঝা গেল, ওরা নিজেদেরকে বেশ ভালভাবেই চেনে। মেয়েটার সাথে হাসাহাসি করতে করতে বাঙ্কার থেকে ২জনে লাগেজ নামানো শুরু করল।
আমি দেবলীনাকে ফোন করলাম ওর ফোন থেকে। সমস্ত ঘটনা ওকে বলার পর ৩জনকেই কামরার এদিকটায় আসতে অনুরোধ করলাম।
মিনিট ২ পর ওরা ৩ জন হাজির হল নিজেদের সমস্ত ব্যাগপত্র নিয়ে।
“যার ফোন থেকে ফোন করেছিলি, সে-ই কি তোকে বাঁচিয়েছে? আমাদের তো প্রাণই বার করে দিয়েছিলি। আর একটু দেরী হলে হয়ত কাকুকে ফোনই করে দিতাম।”-দেবলীনা বলে উঠল।
“হ্যাঁ রে, ওরই ফোন এটা। ভালই হয়েছে, বাবাকে ফোন করিস নি। কি যে কাণ্ড হত তাহলে!!”বলতে বলতে দেখলাম ও আবার ফিরে এসেছে।
“থ্যাংকস!! দুঃসময়ে ওর পাশে দাঁড়ানোর জন্য।”-দেবলীনা নিজের হাতটা বাড়িয়ে দিল ওর দিকে।
“আরে! ঠিক আছে। এইটুকু তো যে কোনও লোকেরই করা উচিৎ। ওনাকে দেখেই মনে হয়েছিল, ট্রেনে প্রথমবার চড়ছেন।তাই... কিন্তু, এমনভাবে বার বার থ্যাংকস বলে আমাকে লজ্জা দেবেন না প্লিজ।”- করমর্দন করে এই কথাগুলো বলার সাথে সাথে মাথা নিচু হয়ে যায় ওর।
“আপনারা সবাই ভাল থাকবেন”- ওদের ৩জনের উদ্দেশ্যে বলে উঠল ও।
আমি ফোনটা ওর হাতে তুলে দিয়ে বললাম, “আর নতুন করে থ্যাংকস বলে আপনাকে লজ্জিত করব না। শুধু এইটুকু অনুরোধ, সবসময় এরকমই থাকবেন।”
“হ্যাঁ, আপনি ভাল থাকবেন, আর নিজের খেয়াল রাখবেন।”
ওর কথাগুলো শেষ হতেই ট্রেন শিয়ালদহে এসে দাঁড়াল। পিছনের সিটে বসা ওই মেয়েটার সাথে ওর ব্যাগগুলো নিয়ে ট্রেন থেকে নেমে ও স্টেশনের ভিড়ে মিলিয়ে গেল।
“ছেলেটার তোর প্রতি দুর্বলতা জন্মে গেছে”-দেবলীনা বলে উঠল।
“তুই কি করে বুঝলি?”
“আরে বোঝা যায়, বোঝা যায়, চোখের দিকে তাকালে সব বোঝা যায়”- সায়নী টিপ্পনী কাটল।
সত্যি কথা বলতে, খুব বেশী বার ওর চোখের দিকে তাকাইনি, তবে আমার যত্ন নেবার একটা প্রবণতা যে ইতিমধ্যেই ওর মধ্যে জন্মে গেছে, সেটা ভালই উপলব্ধি করতে পারছিলাম। মনটা বেশ হালকা লাগছিল, হঠাৎ তাল কাটল একটা ঘটনায়।
“আমার Purse-এ একটাও পয়সা নেই। অদ্ভুত ব্যপার!!” অবাক বিস্ময়ে উপলব্ধি করলাম আমি।
“কত টাকা ছিল Purse-এ? মাঝে কি কখনো ব্যাগ হাতছাড়া হয়েছিল?”-সায়নীর কৌতূহলী গলাতেও উত্তেজনার রেশ।
“ছিল প্রায় ৩০০০ টাকার মত। আর ব্যাগ তো যতবার হাতছাড়া হয়েছে, আমি ওর থেকেই ফেরত নিয়েছি।”- একটানা কথাগুলো বলে গেলাম আমি।
“ভাল চেহারার পিছনে কোনও চোর লুকিয়ে নেই তো? বলনে তো ওকে চোর বলে মনে হয়নি, কিন্তু চলনে যে ও চোর নয়, তার তো কোনও নিশ্চয়তা নেই।”-পরমা বলল।
যে যাই বলুক, আমার মন প্রথমে কিছুতেই মানতে চাইছিল না যে, ওর মত কেউ চুরি করার মতলব নিয়ে উপকার করার ভান করতে পারে। কিন্তু কেন জানি না তারপর আবার মনে হল, ওর তো ভালই বোঝা হয়ে গেছিল যে, আমার আর্থিক স্বাচ্ছল্য ওর থেকে অনেকটাই বেশী। সুতরাং, চুরি করা ওর পক্ষ্যে অসম্ভব কিছু নয়।বেশ তাগড়া পরিকল্পনা করেই চুরিটা করেছে ও।
“যাবি নাকি আর.পি.এফ-এর কাছে অভিযোগ জানাতে?হতে পারে, ওরা এখনও স্টেশন থেকে বেরয়নি”-দেবলীনার প্রস্তাবে ঘোর কাটল আমার।
“হ্যাঁ অবশ্যই। ঝানু চোর মশাই আমার সাথে ভাল ব্যবহার করার নাটক করে আমারই টাকা নিয়ে বেরিয়ে যাবে, সেটা আমি কিছুতেই হতে দেব না।চল তো দেখি।”- ৪ জনে মিলে আর.পি.এফ অফিসের দিকে হাঁটা শুরু করলাম।
আমাদের বেশ অবাক করেই; আমাদের অভিযোগ জানানোর ৩ মিনিটের মধ্যে আর.পি.এফ জওয়ানরা ওদের ২ জনকে ওদের অফিসে ধরে আনল। এটা আর.পি.এফ-এর তৎপরতার জন্য ঘটল নাকি, ওদের ২ জনের অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসের জন্য, সেটা ঠিকমত বুঝে ওঠার আগেই ডাকাবুকো আর.পি.এফ অফিসার ওদের জেরা করা শুরু করলেন।
ওঁর করা প্রশ্নের ভিত্তিতেই আমি প্রথম ওর নাম জানতে পারলাম।
“তোর নাম কি?”- প্রশ্নের উত্তর এল; “তপন মণ্ডল”।
ওর সঙ্গের মেয়েটাও নিজের নাম বলল... “চুমকি তালুকদার”।
“ব্যাগে ২৪০০০ টাকা ক্যাশ নিয়ে কোথায় যাচ্ছিলি?”- দাম্ভিক গলায় পরের প্রশ্নটা করেন আর.পি.এফ অফিসার পাণ্ডে।
প্রশ্ন শুনে ৪ দিকে চোখ ঘোরাতেই আমাদের দিকে চোখ যায় তপনের। “আপনারা?”- কৌতূহলী গলায় বলে ওঠে ও।
এবার পাণ্ডের গলা আরও ভারী-“৪ দিকে না তাকিয়ে আমার প্রশ্নের উত্তর দে। ওঁদের টাকা চুরি করে এখন
ওঁদেরকেই চিনতে পারছিস না?”
“ও!! তার মানে ওঁরা আপনাদের কাছে আমাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেছেন, তাই তো? এইজন্য শহরের লোকদের কক্ষনো সাহায্য করতে নেই; বিশেষ করে বড়লোকদের। ওরাই পরে সাপ হয়ে আমাদের কামড়াতে আসে। আরে, নিজের হাতের ব্যাগটা...” চুমকি উত্তেজিত হয়ে আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল; ওকে থামিয়ে দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলে তপন, “কত টাকা চুরি গেছে আপনার?”
ওর ওই চাহুনির মধ্যে আমার যত্ন নেবার, আগলে রাখার অনুভূতিটা খুঁজে না পেলেও উত্তর দি আমি; “হুম!নিজে জানো না কত টাকা চুরি করেছ?”
“না, ভুলে গেছি।” তপনের স্বীকারোক্তিতে শুধু আমরা নয়, ওখানে থাকা সমস্ত পুলিশ কর্মীরাও হেসে উঠল।
যাই হোক, আমার ওই পরিবেশটাতে থাকতে খুব অস্বস্তি হচ্ছিল। তাড়াতাড়ি রেহাই পাবার আশায় উত্তর দি আমি, “৩০০০”।
ওর চাহুনিতে আমার যত্ন নেবার,বা আমাকে আগলে রাখার অনুভূতি খুঁজে না পাওয়া যেতে পারে; কিন্তু ও যে তখনও বেশ ভাল করেই আমার মন পড়তে পারছিল, সেটা আমি বুঝতে পারি এরপর আর.পি.এফ অফিসার পাণ্ডের উদ্দেশ্যে করা ওর মন্তব্যে, “আপাতত ওই ২৪০০০ এর মধ্যে ৩০০০ টাকা ওঁদের দিয়ে দিন। এখানে থাকতে ওঁদের কষ্ট হচ্ছে। ওঁরা টাকা নিয়ে বেরিয়ে যান, তারপর আমি আপনার সমস্ত প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছি।”
টাকা পেতেই আমরা স্টেশনের বাইরে থেকে ট্যাক্সি নিয়ে হোস্টেলের উদ্দেশ্যে রওনা দি।
এরপর পরীক্ষার চাপে;এই ঘটনার ব্যপারে প্রায় সব কিছুই ভুলে যাই।
প্রায় ১ বছর পরের কথা। এই ১ বছরে পাল্টেছে অনেক কিছুই। আমার এম.বি.বি.এস পড়া শেষ হয়েছে; এমনকি আমার বিয়ে পর্যন্ত ঠিক হয়ে গেছে। পাত্র; আবির ভট্টাচার্য, নিউ জার্সির অন্যতম বড় নিউরোসার্জেন।
পাল্টানোর তালিকাটা নেহাত এইটুকু বললে খুব কম বলা হয়। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বদলটা এসেছে আমার বাবার মানসিকতায়। যতদূর আমি জানি,বাঙালী সমাজের রীতি অনুসারে, কোনও ছেলে বা মেয়ের বিয়ে ঠিক হয়ে গেলে; বিয়ে হবার আগে তাকে তার সমস্ত নিকট বা দূর সম্পর্কের আত্মীয়দের বাড়ীতে অন্তত একবারের জন্য হলেও যেতে হয়। আমার ক্ষেত্রেও এই নিয়মের ব্যতিক্রম হয়নি। আর বাবা নিজের বদলে যাওয়া মানসিকতার বশবর্তী হয়ে আমায় আমাদের অনেক আত্মীয়ের বাড়ীতেই একা ছেড়ে দিচ্ছিল। হয়ত বাবারও মনে হয়েছিল, ১ বছর পর আমায় আমেরিকাতে গিয়ে তো একাই থাকতে হবে; তাই আমি এখন থেকেই সেই ধরণের জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত হয়ে গেলে ভবিষ্যৎ-এ আমার সুবিধাই হবে।
বিয়ের ঠিক ৩ সপ্তাহ আগে আমি বাবার কাছে বহরমপুর নিবাসী দূরসম্পর্কের ১ পিসির ব্যপারে জানতে পারি। বাবার কাছে খবর পাঠিয়ে উনি আমার বিয়ে হবার আগে আমাকে একটিবারের জন্য দেখার ইচ্ছা প্রকাশ করেন।
বাবার মনে হয়েছিল,বহরমপুর জায়গাটা আমাকে একা ছাড়ার পক্ষে একটু বেশীই দূর। বিয়ের পর আমাকে একা প্লেনে সিডনি থেকে নিউ জার্সি যেতে হতে পারে... আমার খাড়া করা এই যুক্তির ভিত্তিতে বাবা অনেক কষ্টে আমাকে একা ট্রেনে বহরমপুর ছাড়তে রাজি হয়। তবে পিসিকে আগে থেকে বলে রাখে যে, শিয়ালদহ থেকে ওর লোকেরা আমাকে ট্রেনে তুলে দেবে; বহরমপুর আসতেই পিসির লোকেরা যেন আমাকে ট্রেন থেকে গাড়ীতে ওঁদের বাড়ীতে নিয়ে যায়।
ট্রেনে এটা আমার দ্বিতীয় সফর। শুধু ট্রেন তো নয়, যাত্রাপথটাও আমার চেনা। এই ঘটনাটা শুধু আমিই জানতাম, কারণ,১ বছর আগের সেই সফর সম্বন্ধে কোনও কথাই আমি বাবাকে জানাইনি।
সন্ধ্যা ৬-৪০ মিনিটের ভাগীরথী এক্সপ্রেসের এ.সি. কামরায় ছিল আমার বুকিং। ট্রেন স্টেশনে এসে দাঁড়ানো মাত্রই ২ জন দেহরক্ষী আমার লাগেজ ট্রেনে গুছিয়ে দিয়ে, আমায় নির্দিষ্ট সিটে বসিয়ে দিয়ে বাবাকে খবর দিল।
“সাবধানে যাস মা”-১ জন ফোনটা আমার হাতে দিতে ও পাশ থেকে বাবার উপদেশ।
“হ্যাঁ বাবা, চিন্তা কোরো না।”-ফোনটা কেটে ওদের হাতে দিতেই ওরা বেরিয়ে গেল।
আমি আই-প্যাডে গান শোনা শুরু করার ১০ মিনিট পরের ঘটনা। আমার সামনের সিটটা যাদের জন্য সংরক্ষিত ছিল, তাদের মুখগুলো চোখের সামনে আসতেই কিছুক্ষণের জন্য নিজের ভাগ্যকে বিশ্বাস হচ্ছিল না। দেখতে পেলাম সেই তপনকে, ওর সঙ্গী চুমকিকে। প্রথমটায় সিটের নিচে ব্যাগপত্র রাখতে ব্যস্ত থাকায় ওদের ২ জনের কেউই আমায় খেয়াল করেনি। পরে আমার উপর প্রথম চোখ পড়ল চুমকির, তপনকে চোখের ইশারায় আমার দিকে তাকাতে বলল ও। ওদের ২ জনের মুখের ভাবেই আমার সাথে দেখা এভাবে দেখা হয়ে যাবার হতাশা স্পষ্ট হয়ে উঠল।
হতাশ কি আমিও কম হয়েছিলাম!! রাস্তায় কখনো বাস মিস করলে, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের বিন্দি ঠিক করার সময়... এমন অনেক মুহূর্তই আমার জীবনে এই মাঝের ১ বছরের দীর্ঘ সময়টাতে এসেছে, যখন আমার মন ওর কথা মনে করে খুশী হতে চেয়েছে, কিন্তু ও চোর... এটা মনে করেই আমি আমার সমস্ত অনুভূতি গুলোকে নিজের মত করে দাবিয়ে গেছি।
এখন মনে হল, ভাগ্যের পরিহাসকে মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় নেই। ৩ ঘণ্টার জন্য তো ট্রেনে থাকব, না হয় ওদের দিকে তাকাবোই না। কিন্তু এক মুহূর্তের মধ্যেই আমার মধ্যেকার ডাক্তার-সত্ত্বা আমাকে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে বাধ্য করল।
হঠাৎ খেয়াল করলাম, খুব কষ্ট করে একজন অসুস্থ পক্ষাঘাতগ্রস্ত বৃদ্ধাকে হুইলচেয়ারে করে প্ল্যাটফর্ম থেকে কামরায় ওঠাতে চেষ্টা করছে তপন আর চুমকি। হাজার হোক; ও চোর। ও প্রতারক। কিন্তু আমি ডাক্তার হয়ে তো আর একজন অসুস্থ মানুষের কষ্ট পাওয়া চোখের সামনে দেখে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারি না।
অগত্যা; কামরার দরজার দিকে এগিয়ে যাওয়া; ওরা প্রথমে সামান্য ইতস্তত বোধ করলেও পরে আমার সাহায্য নিয়ে বৃদ্ধাকে কামরায় তুলে নিল।
খুব স্বাভাবিকভাবেই, আমার থেকে কোনোরকম সাহায্য নিতে অপারগ তপনের অভিমানী প্রতিক্রিয়া ধেয়ে এল আমার দিকে, “আপনার কাছে কি আমরা সাহায্য চেয়েছিলাম? প্লিজ, আমাদের উপর আর ঋণের বোঝা চাপাবেন না। আপনি আমার জন্য যা করেছেন...”- বলতে বলতে গলা ধরে আসে ওর।
“শুনুন, আপনি আমাদের চেনেন না, আমরাও আপনাকে চিনি না; সেটা ভেবে চলাটাই শ্রেয়”- চুমকির বক্তব্য শেষ হতে না হতেই বৃদ্ধা অতি কষ্টে জড়িয়ে জড়িয়ে বললেন, “কি রে তোরা! অমন ফুলের মত মিষ্টি মেয়েটা এভাবে সাহায্য করল..কোথায় ধন্যবাদ দিবি; তা না...ওকে কথা শোনাচ্ছিস। বাজে ছেলে কোথাকার!!”- কথাগুলো বলে যেভাবে তপনের দিকে রাগী মুখে তাকাতে ও মাথা নিচু করে নিল, স্পষ্ট বোঝা গেল, উনি ওর মা।
মিনিট খানেকের মধ্যে ট্রেন ছেড়ে দিল।কিছুক্ষণ চুপ করে থেকেই বৃদ্ধা আমায় প্রশ্ন করলেন, “মা, তুমি কি করো?”
“আমি ডাক্তার”- আমার উত্তর দেওয়া শেষ হতে না হতেই লক্ষ্য করলাম, তপন সিট ছেড়ে উঠে চলে গেল। ওর মায়ের আমার সাথে কথা বলাটা যে ও একেবারেই পছন্দ করছেনা, সেটা শুধু আমি নয়, বৃদ্ধাও বুঝতে পারলেন।সেইজন্যই হয়ত পরের প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিলেন চুমকির দিকে, “এই সত্যি করে বলতো ও কে?”-কিছুক্ষণ ভেবে নিয়ে যোগ করলেন; “আচ্ছা; ও কি সে-ই, যার জন্য আমার এক রাত্রি ইনসুলিন ইনজেকশন নেওয়া হয়নি?”
বৃদ্ধার প্রশ্নটা একটু অদ্ভুত ঠেকল আমার কানে। তবে প্রশ্নের আকস্মিকতায় চুমকির দেওয়া প্রত্যুত্তরটা শুনতে অবশ্য আমার ভুল হল না, “হ্যাঁ কাকিমা, এই সেই মেয়ে।”
বৃদ্ধা খুব কষ্ট করে হাসার চেষ্টা করলেন। ওঁর হাসি দেখেই বুঝতে পারলাম, ওঁর শরীরের ডান দিকটা অসাড়।“আমি আগেই আন্দাজ করতে পেরেছিলাম। আমার ছেলে কখনো কারুর সঙ্গে এমন আচরণ করে না...”- ওঁর প্রতিক্রিয়া।
জানি না কেন, আস্তে আস্তে তপন আর চুমকির উপর আমার রাগটা কমে গিয়ে অভিমান বেড়ে যাচ্ছিল। বিশেষ করে ওর মা কে দেখার পর থেকে। এই ছোট্ট সময়ের মধ্যেই ওঁর সঙ্গে ১ টা অদ্ভুত মধুর সম্পর্ক তৈরি হয়ে গেছিল আমার। সেইজন্যই হয়ত যে প্রশ্নের উত্তরটা আমার মন আন্দাজ করতে পারছিল, সেই প্রশ্নটাই আমি আবার করে বসি চুমকি কে, “তোমরা কি বলতে চাইছ? আমাকে একটু বুঝিয়ে বলবে প্লিজ”-আমার মনের ভাবনাকে সমর্থন করার উদ্দেশ্যেই হয়ত এই যাচাই করে নেওয়ার উদ্যোগ।
“দাদা আপনার ব্যাগটা আপনাকে ফেরত দেবার অনেক আগে থেকেই হয়ত আপনার ব্যাগটা নিচে পড়ে গেছিল। আসলে যে আপনার ব্যাগটা নিচে ফেলেছে, সে-ই আপনার টাকা চুরি করেছিল হয়ত। দাদা যতবার আপনার ব্যাগটা ধরেছে,১ বারের জন্যও খুলে দেখেনি।সেদিন আমরা হাসপাতালের বকেয়া টাকা নিয়ে যাচ্ছিলাম। আপনাকে ৩০০০ টাকা দেওয়ার জন্যই আমরা কাকিমার সেদিনের ইনসুলিন ইনজেকশনটা কিনতে পারিনি।খুব অসুবিধা হয়েছিল...কিন্তু কি আর করা যাবে?”-একটানা কথাগুলো বলতে বলতে চুমকির গলা ধরে আসে।
চুমকির কথাগুলো শুনে আমার চোখে জল এসে গেল। অনেক কষ্টে কান্না আটকে জিজ্ঞাসা করলাম আমি, “এই কথাগুলো আগে ১ বারও বলোনি কেন তোমরা?”
“দাদা বলার সুযোগ দিলে তো...! আমি তো আর.পি.এফ অফিসেই অনেকবার বলতে চেয়েছিলাম। কিন্তু, ও আমায় বারণ করছিল। দাদার শুধু ১ টাই কথা, ‘যার জন্য জেলে যাবার ঝুঁকি নিয়ে, ট্রেনের চেন টেনে ট্রেন থামালাম, ট্রেনে সারাক্ষণ আগলে রাখলাম, সে যদি চুরির অপবাদ দিতে পারে, তাকে আমরা আমাদের সাফাইয়ে যাই বলি না কেন, তার বিশ্বাস হবে না।’... আজ পিছন ফিরে তাকালে আমারও মনে হয়, ও ঠিকই ভাবছিল। আপনি সত্যি করে বলুন তো, আমরা চুরি করিনি বললে আপনি তখন বিশ্বাস করতেন?”
চুমকির করা প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার নির্লজ্জতা আমার মধ্যে ছিল না; তার চেয়ে আমি ১টা অনুরোধ রাখি ওর কাছে,“প্লিজ আমাকে আর আপনি বলে লজ্জিত করো না। তুমি বল।”
বৃদ্ধার পক্ষাঘাতগ্রস্ত মুখের দিকে তাকাতে আমার আরও লজ্জা লাগছিল। কান্না আটকে রাখতে না পেরে বলি আমি, “আমি আপনার কাছে অপরাধী মা। আপনি আমাকে শাস্তি দিন। যা শাস্তি দেবেন, মাথা পেতে নেব।”
“ধুর!! বোকা মেয়ে। তোর মন যে কত পরিষ্কার; সেটা তোর চোখমুখ দেখলেই বোঝা যায়। ট্রেনে ওঠার সময় আমার জন্য কি কম করলি!! তখন একটা ভুল-বোঝাবুঝি হয়েছিল, এটা মনে করে ব্যপার টাকে ভুলে যাওয়ার চেষ্টা কর।”-নিজের কাছে ডেকে নিয়ে আমার চোখ মুছতে মুছতে বলেন বৃদ্ধা।
এবার যার কাছে নিজেকে সবচেয়ে বেশী অপরাধী বলে মনে হচ্ছিল, তার কাছে যাই আমি। ট্রেনের দরজার সামনে ওকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মনের সেই সুপ্ত ইচ্ছাগুলোকে ছুঁয়ে দেখার ইচ্ছা আরও প্রবল হতে থাকে। মন শুধু বলে,এখন ওকে নিয়ে আমার ভাবনা আর সেটা বাস্তবায়িত হওয়ার মধ্যে তো আর ওর চোর হওয়ার অপবাদ বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়ে নেই। ঐ অপবাদগুলোকে সাগরের জলে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে প্রশ্নটা রাখি ওর কাছে, “একবার তো আমাকে বলার চেষ্টা করে দেখতে পারতে? অন্তত; মায়ের অসুস্থতার ব্যপারটা?”
“বললে আপনি বিশ্বাস করতেন না। আর যদিও বা করতেন, আপনি কষ্ট পেতেন...আমায় সান্ত্বনা দিতেন। তাতে আমার কষ্ট বাড়ত বই কমত না; সঙ্গে বাড়ত আমার আফসোসও। আর আমি আফসোস করে বাঁচতে চাই না।”- বাস্তবের মাটিতে দাঁড়িয়ে দেওয়া ওর রুক্ষ জবাব আমাকে মানসিকভাবে ওর আরও কাছে নিয়ে আসে।
কেন জানি না,আমার মনে হতে থাকে, খুব ভাল হত যদি তপন সারাজীবনই আমার কপালের বিন্দি টা ঠিক করে দিতো। এমন নয় যে চুমকি বলার আগে আমি জানতাম না যে,সেদিন ট্রেনের চেনটা তপনই টেনেছিল; কিন্তু আজ প্রথমবার কথাটা ভেবে খুব আনন্দ হচ্ছিল। এটাও জানি না, কেন আরও বেশী করে মনে হতে থাকে যে,আবিরের সাথে নিউ জার্সির রাস্তায় চিকেন বার্গার খাওয়ার বদলে তপনের বাড়ীতে ডাল-ভাত খেয়ে হয়ত আমি বেশী খুশী থাকবো।
আমার ঘোর কাটে মা তপনের নাম ধরে ডাকায়। “আমাকে গিয়ে দেখতে দাও না প্লিজ”- তপনের কাছে অনুরোধ করতে ও মেনে নেয়।
ওঁর ক্যাথিটারটা ঠিক করে দেওয়ার পর আমার মনের ইচ্ছা পড়তে পারেন বৃদ্ধা, “জানি তুই ওকে পছন্দ করিস। শোন,ও তোকে তার চেয়েও বেশী পছন্দ করে; কিন্তু বলতে লজ্জা পাচ্ছে। আর আমার ইচ্ছা যদি জানতে চাস, তাহলে তোকে বলব আমাদের কাছেই থেকে যেতে। তোকে খুব জ্বালাব, এইসব কাজ করাব, কিন্তু খুব ভালওবাসব!!”
এমন নয় যে ওঁদের আমার বিয়ে ঠিক হয়ে যাবার কথা জানিয়ে দিলেও মা আমার কাছে এই আবদারটা রাখতেন; কিন্তু আমি জানি না, বিয়ের ব্যপারে কোনও তথ্য না দিয়ে আমি, “আপনার ছেলে যা, ওর লজ্জা কাটতে এই জীবনটাই না বেরিয়ে যায়!”-বলে ওঁর প্রস্তাবের উত্তর দিলাম।
এর প্রতিক্রিয়ায় বেরিয়ে আসা মায়ের আনন্দাশ্রু আমাকে স্বস্তি দেয়। “তোকে কিছুতেই কাছছাড়া করবো না আমি। থাকবি তো মা আমার কাছে?”-আবেগ-ঘন মুহূর্তে মায়ের চোখ মুছতে মুছতে বলি আমি, “কাঁদছ কেন মা?আমি আছি তো!!”
সেই মুহূর্তেই তপন আর চুমকি ট্রেনের দরজার কাছ থেকে ফিরে এসে ব্যাগপত্র গোছান শুরু করে। ওদের এই সক্রিয়তা আমাকেও আমার গন্তব্যের উপস্থিতির কথা জানান দেয়। ট্রেন বহরমপুর পৌঁছনর মিনিট দু’এক আগে তপনের থেকে ওদের বাড়ীর ঠিকানা নেবার সময় ওকেও সেই অনুরোধটা করি, যেটা কিছুক্ষণ আগে করেছিলাম চুমকিকে, “প্লিজ আমাকে আর আপনি বোলো না। তুমি বলো।”
আমার প্রস্তাবের উত্তরে মুখ লুকিয়ে ওর মুচকি হাসি আমাকে, আমার ব্যপারে ওর অনুভূতি সম্পর্কে বেশ স্বচ্ছ ধারণা দেয়। গাড়ীতে পিসির বাড়ীতে যাবার সময়ও ওর ঐ লাজুক মুখের ভাব আমাকে ওর কথাই ভাবতে বাধ্য করে। রাতে ঘুমনোর সময়ও একটা অদ্ভুত উত্তেজনা অনুভব করি আমি।
তার পরের ২টো দিন আমার এই স্বল্প-দীর্ঘ জীবনে সবচেয়ে সুখের দিন বলে মনে হয় আমার।কক্ষনো সকালে তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠতে এত ভালো লাগেনি। শুধু কি সকালে ওঠা...!! মা কে সময়মত ওষুধ কিংবা খাবার খাওয়ানো, ব্যায়াম করানো, ঘুম পাড়ানো থেকে শুরু করে; স্কুলে যাবার আগে চুমকির চুল বেঁধে দেওয়া, এমনকি বাড়ীতে বিজলি’দিকে যে কাজটা করতে দেখে আমার জ্বর আসত, তপন বাজার থেকে ফিরলে সেই রান্না করা-প্রত্যেকটা কাজ করার সময়ই যে আমার মধ্যে এত স্বতঃস্ফূর্ততা থাকবে, সেটা আমি নিজেও ধারণা করতে পারিনি।
ভোরবেলা পিসির বাড়ী থেকে বেরিয়ে সারাদিন ওদের বাড়ীতে থেকে রাতে মা’কে ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে তবে আবার পিসির বাড়ীতে ফিরতাম আমি। ওদের বাড়ীতে কাটানো তৃতীয় দিনটার দুপুরের ঐ মুহূর্তটাকেই বারবার করে কাছে পেতে ইচ্ছে করে; যখন দুপুরে মা’কে ঘুম পাড়ানোর পর ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত আমি উঠোনে বেরিয়ে এসে দেখতে পাই তপনকে, হাতের ইশারায় ও কাছে ডেকে নেয় আমায়।
পাশে এসে বসতেই ওর সেই আদুরে আবদার আমার মনপ্রাণ জুড়িয়ে দেয়, “আর একটু কাছে এসে বসা যায় না!!”
ওকে জড়িয়ে ধরে যখন আমি জিজ্ঞাসা করি, “এবার...?” ;তখন ও একই রকম লাজুকভাবে হেসে ওর ভালোলাগার অনুভূতিটাকে ব্যক্ত করে।
“কতদিন আর এভাবে আয়া, Physiotherapist, রাঁধুনি সব রকম দায়িত্ব নিয়ে মা’কে আগলে রাখবে?”- মুহূর্তে চিন্তাগ্রস্ত হয়ে যায় ওর মুখ।
“তুমিই বা আর কতদিন অফিস কামাই করে বাড়ীতে বসে থাকবে? আমি আছি, নিশ্চিন্তে অফিস যাওয়া শুরু করো!” একটু থেমে আবার যোগ করি আমি, “যেটুকু ডাক্তারি বিদ্যে পেটে আছে, তাতে করে আমি এখানেও পসার জমিয়ে নিতে পারি। কি আর হবে, আমার ক্লিনিকের ঠিকানাটা শুধু বদলে যাবে। আগে মা’কে একটু ঠিক হতে দাও!!”
আমার আশ্বাস ওর মনে ভরসা যোগায়। “তবে তোমাকে একটা কথা দিতে হবে... যখন সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে, সপ্তাহে ২দিনের বদলে ৩দিন ছুটি নিতে হবে কিন্তু তোমায়! ২দিন তুমি মা, বোনের সঙ্গে কাটিও, তবে তৃতীয় দিনটা শুধুই আমার। আমরা একসঙ্গে সময় কাটাবো, ঘুরবো-ফিরবো...আর যদি তোমার তা-ও না ভালোলাগে, ঐ দিনটা আমাকে শুধু তোমার বুকে মাথা রেখে থাকতে দিও; আর কিছু চাই না তোমার কাছে...” কথাগুলো বলতে বলতে গলা ধরে আসে আমার।
“তোমার জন্য একদিন কেন, যদি পুরো সপ্তাহটাই অতিরিক্ত ছুটি নিতে হয়, তাতেও আপত্তি থাকবেনা আমার!!”-প্রথমবার নিজের লাজুক ভাবমূর্তি থেকে বেরিয়ে এসে দৃপ্ত অথচ আদুরে ভাবে দেওয়া ওর এই উত্তর; সঙ্গে আমার চোখের জল মুছতে মুছতে ওর আমাকে জড়িয়ে ধরা...মনে হয়, যেন আমাকে স্বপ্নের দুনিয়াতে নিয়ে যায়!!
আবিরকে মন থেকে পুরোপুরি ভাবে মুছে ফেলার নিরিখেই পরের প্রশ্নটা আমি করি ওকে, “তাহলে কবে যাবে বল, আমার বাবার সঙ্গে আমাদের বিয়ের ব্যপারে কথা বলতে?”- দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারিনি, ও এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগেই এরকম বিস্ময়ের মুখোমুখি হতে হবে আমাদের ২জনকে।
তপনদের বাড়ীর সামনের প্রায় কাঁচা রাস্তাটার উপর খানিক আচমকাই এসে দাঁড়ানো ২ টো গাড়ীর মধ্যে বাবার পাজেরো গাড়ীটাকে সহজেই চিনতে পারি আমি। অন্য জিপগাড়ীটার থেকে হঠাৎ করে পুলিশের লোকেদের নামতে দেখে আমি আর তপন ২জনেই প্রথমে খানিকটা হকচকিয়ে যাই।
হুঁশ ফেরে বাবার চিৎকারে, “তুই কি করছিস, কিছু খেয়াল আছে তোর?”
“বাবা!!! তুমি এখানে?”-নিজেকে কোনোরকমে সামলে নিয়ে বলি আমি।
“আমার প্রশ্নের উপর প্রশ্ন করিস না রূপা!! পিসি বিশ্বাস করে রোজ সকালে তোকে ছেড়ে দেয়, আর তুই এখানে, এই নোংরা গেঁয়ো জায়গায় চলে আসিস!! আজ পিসির রান্না করার লোকটা তোকে এখানে দেখতে না পেলে তোর এই ক্রিয়াকলাপের ব্যপারে তো আমরা কিছুই জানতে পারতাম না!! আমাদের বিশ্বাসের এই প্রতিদান দিলি তুই?”
“বাবা, তুমি আগে পুরো ব্যপারটা শুনে নাও। বিশ্বাস করো, ওদের আমাকে দরকার। আমি এখানে থাকলে; আমি,তুমি আর এরা সকলেই খুব খুশী থাকবো...”আমার কথা পুরো শেষ না হতেই বাবা আরও উত্তেজিত হয়ে উঠে বলে, “আমি কিচ্ছু শুনতে চাই না। আমি শুধু বুঝি, তুই এখানে থাকলে আমাদের পরিবারের মান, মর্যাদা সব ধুলোয় মিশে যাবে!! আমার এত বছরের রাজনৈতিক প্রতিপত্তি... সব শেষ হয়ে যাবে!!আমি সব বুঝি, তোর মাথায় কাদা ঢুকিয়েছে এই নিচু জাতের কুকুরগুলো। নির্লজ্জ বেহায়ার দল। ওদের তো সব কাজই হয় সার্টিফিকেটের দৌলতে! পরিশ্রম সবাই করবে, শুধু ফল বেরনোর সময়ে খয়রাত নিয়ে যাবে এরা। যাদের আমাদের সাথে সমানে সমানে লড়ার ক্ষমতা নেই, তাদের বাড়ীর অংশ হয়ে যাবি তুই??”
“কোন লড়াইয়ের কথা বলছেন আপনি? সকালে এ.সি. লাগানো ঘরে ঘুম থেকে উঠে মার্বেলের তৈরি বাথরুমের বাথটাবে চান করে এ.সি. গাড়ীতে চড়ে সারাদিন ঘুরে বেরিয়ে আমাদের সমান হওয়ার কথা বলছেন! আগে এই আরামের জীবন ছাড়ুন। সকালে ঘুম থেকে উঠে পাড়ার নলকূপ থেকে বাড়ীর প্রয়োজনের জন্য জল নিয়ে আসুন। বৃষ্টিতে জল জমে যাওয়া উঠোন পেরিয়ে প্রতিদিন বাড়ী থেকে কাঁচা বাথরুমে যান। লড়াইয়ের Baselineটাকে আগে সমান করুন, নাহলে প্লিজ এই বিষয়টাকে টেনে এনে আমাদের অপমান করবেন না।”- এতক্ষণ চুপ করে থাকার পর বাবাকে দেওয়া তপনের এই কড়া জবাব আমাকে ওর ঐ লাজুক স্বভাবের পিছনে লুকিয়ে থাকা ব্যাক্তিত্বটাকে নতুন করে চেনায়।
তপনের দেওয়া জবাবে যারপরনাই রেগে গিয়ে দিগ্বিদিক জ্ঞান হারিয়ে ফেলে বাবা; যার প্রতিফলন পাওয়া যায় বাবার প্রতিক্রিয়ায়,“আমাকে চিনিস না। মাথা গরম হয়ে গেলে কিন্তু তোর বুড়ি মা-কেও ছাড়ব না!আমার মেয়ের জীবন থেকে সরে যা বলছি!!!”
সেই সময় বাবা অন্যরকম ভাবে পরিস্থিতিটাকে সামলাতে পারত, এটা যেমন ঠিক; তেমনি আমরাও সেই মুহূর্তে নিজেদের জেদ থেকে ক্ষণিকের জন্য সরে এসে বাবাকে ওভাবে উত্তেজিত না করলেও হয়ত পারতাম।
বাবা হয়ত এটা ভেবেই এসেছিল যে, আমি কথা শুনবো না। ছোট বয়স থেকে জেদি মানসিকতা আমার। সেইজন্যই হয়ত এতটা নিষ্ঠুর হয়ে যাওয়া, এত পুলিশ,দেহরক্ষীদের নিয়ে আসা; যারা কোনওকিছু বুঝে ওঠার আগেই তপনকে বেদম প্রহার করতে শুরু করে;পরিস্থিতি ক্রমশ উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। বাবাকে বোঝানোর নিষ্ফল চেষ্টা আমাকে বাধ্য করে দেহরক্ষীদের হাত থেকে ওকে বাঁচাতে উদ্যত হতে। ভুলবশত এক দেহরক্ষীর চালানো লাঠি এসে লাগে আমার মাথায়...!!
যার জেরেই আমার এখানে আসা। নিজের ডাক্তারি পড়ার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, এখন আমার শরীরের যা অবস্থা তাতে যদি আমি প্রাণে বেঁচেও যাই, আমাকে সারাজীবন পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে বাঁচতে হবে।
তবে সত্যি কথা বলতে,আমি আর বাঁচতে চাই না।আমার কাছে বসে কাঁদার আগে অন্য একটা অচেনা লোকের সাথে বাবার কথোপকথন শোনার পরে তো আরওই না।
“চিন্তা করবেন না স্যর। লালগোলা সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে মেয়ে পাচার করার সময় গ্রামবাসীরা বেদম প্রহার করার পর পুলিশ নিয়ে এসে হাসপাতালে ভর্তি করে। এই কেসে হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাবার পর ওকে জেলের ঘানি টানাবোই।”-তপনের ব্যপারেই যে কথাটা হচ্ছে সেটা বুঝতে অসুবিধা হয় না আমার।
আজ হয়তো আমার চোখের পাতা আর খুলবে না...এই জন্মে হয়তো আমি আর পৃথিবীর আলো দেখবো না।তবে এখন ক্ষণিকের জন্য যাঁর কাছে যাচ্ছি, সেই ভগবানের কাছে প্রার্থনা করবো, আবার কখনও আমাকে সুরূপা রায় বানিয়ে এই পৃথিবীতে পাঠাতে; চাইবো আবার কোনও তপন মণ্ডলের প্রেমে পড়তে; শুধু বহরমপুর নয়, পৃথিবীর সমস্ত প্রান্তে ঘুরতে....তবে তখনই, যখন জাতপাতের এই রক্তচক্ষু আর আমাদের মাঝে থাকবে না.......যখন আমাদের প্রেম দুনিয়ার চোখে ‘অলীক’হবে না.........!!!!!!!
(এই গল্পের সমস্ত ঘটনা এবং চরিত্রাবলী কাল্পনিক।এর সঙ্গে বাস্তবের কোনও সম্পর্ক নেই।)