শুক্রবার, ৩১ জানুয়ারী, ২০১৪

​ব্রিগ্রেড বচন ~ রকল্প ভট্টাচার্য

আজকের সমাবেশে ২৫ লক্ষ মানুষ এসেছেন।(যাঁরা বলছেন আড়াই লাখ, তাঁরা আমাদের প্রতিটি রাবণের একটিমাত্র মাথাই গুনেছেন।)

নন্দীগ্রামে কাণ্ডে সিবিআই কংগ্রেসের এজেন্ট হিসাবে কাজ করেছে। (সাধে কি আমি সারদা কান্ডেও সিবিআই তদন্ত চাইনি? যারাই আমার বিরুদ্ধে কথা বলতে সাহস পাবে, তারাই...)

আমাকে মানবাধিকার শেখাবেন না।(ওই অধিকার কেবল মানবদেরই শিক্ষণীয়।)

কেন্দ্রে পরিবর্তন আনতে হবে। গ্রামে গিয়ে প্রত্যেকের কাছ থেকে সাক্ষর নিন। (আর না দিলে, হ্যাঁরে অনু, কী যেন বললি, গাড়িচাপা না কি?)

কেন্দ্র সব টাকা কেটে নিয়ে না-গেলে বছরে ১০ লক্ষ বেকারদের চাকরি দিতাম।(এই তো, আজই পঁচিশ লক্ষ কে রাহাখরচ হাতখরচ দিয়ে... আর এরকম 'বিগ্রেড' তো আমার লেগেই থাকে...)

মেয়েদের পাশে আমরা পরিপূর্ণ ভাবে আছি। কড়া অ্যাকশান আমরা নিই, নেব। (পার্ক স্ট্রীট কান্ডের পর দময়ন্তী কে বদলি করে দিই নি? কামদুনি-র মূল অভিযুক্তা মৌসুমি কয়ালকে শাস্তি দেওয়াই নি? পাশে আমরা আছি। সামনে আসিনা, পুলিশকেও বারণ করে দিয়েছি সামনে আসতে।)

বিরোধীরা কথায় কথায় কোর্টে যাচ্ছে। সিপিআইএম, কংগ্রেস, বিজেপি এক হয়েছে।(আমি জীবনে আদালতে যাইনি, আমার বিরুদ্ধে, দলের কোনও একজনের বিরুদ্ধে কোনোদিন একটাও কেস উঠেছে? সাহস হয়েছে কারও?)

চিটফান্ডের জনক সিপিআইএম। তৃণমূল চিটফান্ডের টাকায় চলে না।(এই তো, সরদা-র সব টাকা লুটেপুটে সাফ, সুদীপ্তও জেলে। তাই বলে কি আমাদের পার্টি চলছে না?)

তৃণমূল আজ দেশের বিকল্প।(তাই হয় তৃণমূলে যোগ দে, নয়তো দেশ ছাড়।)

বাংলার বাইরে লোকসভার প্রচারে যাব। দিল্লিতে সংহতির সরকার চাই।(নেহাত আমার ইংরাজীটা গরমেন্ট বোঝেনা, না হলে...)

আমি চেয়ার চাই না, মানুষের ভাল চাই।(আমার পেটো মানুষগুলোর ভাল হলে চেয়ার আপসে আসবে, জানি।)

কালো টাকা দেশে ফেরাতে হবে।(আমাদের দিক থেকে সমস্ত চেষ্টা জারি রয়েছে। পার্টি ফান্ডে জমা দিন, হিসাব কেন, কারোকে জানতে দেবোই না।)

বৃহস্পতিবার, ৩০ জানুয়ারী, ২০১৪

পিএম করো ~ অনামিকা

​ব্যর্থ টেট-এর আবর্জনা পুড়িয়ে ফেলে
ব্রিগেড ভরো… ব্রিগেড ভরো…
লোকসভা ভোট নাড়ছে কড়া,
আমায় পিএম করো… পিএম করো

ভারতবর্ষ দখল করার স্বপ্ন দেখি
নন্দীগ্রামের মিথ গুলোকে…
সবাই ভাবছে মেকি!

ফালতু ও'সব উড়িয়ে দেবে
গ্রাম শহরও…
আমায় পিএম করো… পিএম করো


সোমবার, ২৭ জানুয়ারী, ২০১৪

​আপেল সংক্রান্ত ~ অরুণাচল দত্তচৌধুরী

আদি পিতা আপেল খেলেন
সেই পাপে আজও
সামান্য রুটির খোঁজে
সময়ের অনন্ত ঢালে গড়িয়ে চলেছি।

রুটির দুঃস্বপ্ন ভুলে, কী আশ্চর্য
আপেলও খুঁজেছি মাঝে মাঝে
এসো পাপ … দয়া করো… আমাকেও ছোঁও

আপেল দূরের কথা
রুটি আজও পাইনি তেমন

রবিবার, ২৬ জানুয়ারী, ২০১৪

খুকুর জীবন ~ সংগীতা দাশগুপ্তরায়

তখন -
বেরোনোর আগে ঠাকুরকে প্রণাম করে বেরিও ... দিদু বলতেন। 
জল খেয়ে বেরোস ... বলত বড়মা
ছাতা নিতে ভুলিস না ... মামিমা মনে করিয়ে দিত
ছাতা নিচ্ছ নাও, হারিয়ে এস না ... মায়ের সাবধানবাণী 
মউ-দির থেকে অঙ্ক খাতাটা ফেরত আনিস দিদিভাই ... বোনের পিছুডাক 

এখন -
বেরোনোর আগে দেখে নিস ছুরি আর পেপার স্প্রে ব্যাগে ঢুকিয়েছিস নাকি... 
আর কেউ গায়ে হাত দিলে, জানিসই তো, গান আনলক করাই আছে। সোজা ফুঁড়ে দিস । হাসপাতালে শুয়ে তিল তিল করে মরা বা গায়ে আগুন দিয়ে মরার থেকে অনেক ভাল জেলে গিয়ে জীবনকাটানো । 
গারদের ওপারটুকু বোধহয় এপারের তুলনায় সেফ...... সমাজ

আধখানা আকাশ ~ অভিজিৎ মুখোপাধ্যায়

বাইরে নাচে অমানুষের দল,
মনের ঘরেও পিশাচেরই বাস,
কন্যা এবার যাবি কোথায় তুই?
হারালো তোর অর্ধেক আকাশ। 

ঠিকদুপুরে দশ দিক নিঃঝুম,
ভাল্লাগে না পুতুল পুতুল খেলা,
মন চলে যায় গোল্লাছুটের মাঠে।
ক্যামনে যাবি? এখন দুপুরবেলা।

মাঠে যখন দৌড়োদৌড়ি করিস
হাত টেনে মা ফেরত নিয়ে আসে,
মায়ের চোখে এতো কিসের ভয়?
সূয্যি ডোবে, আঁধার চারিপাশে।

দিদি গেছে কবেই বাড়ী ছেড়ে,
নামও নেই কারো চোখে মুখে।
মা বলে, সে বেজাত হয়ে গেছে,
কেমন আছে? আছে কি সে সুখে?

পাশের বাড়ীর পিয়া গেলো কাজে,
তারপরে আর নেইকো দেখা তার,
থানা থেকে পুলিশ এসেছিলো,
পিয়া তো নেই, পুলিশই বার বার -

কাগজ খুলে বাবা রোজই বলে
চলছে দেশে নরকের উল্লাস,
দিদি শুধু আধেক চেয়েছিলো,
তুই কি পাবি একটুকু আকাশ?

শুক্রবার, ২৪ জানুয়ারী, ২০১৪

লোড়সেরিঙ ~ অবিন দত্তগুপ্ত


টেবিলের উল্টো দিকে বসা চিতাবাঘকে,কোলকাতা সম্পর্কিত মধ্যবিত্ত ভালোবাসা ব্যক্ত করার এক ব্যর্থ প্রচেষ্টা করছিলাম। ট্রাম-বাস,ভিক্টোরিয়ার বাদামভাজা,নিওন আলো, মেট্রো বার,মিছিল ইত্যাদি বহু ব্যবহৃত (এবং ব্যবহার হতে হতে ক্লান্ত)উদাহরণে না গিয়ে,একটু  subtle হওয়ার চেষ্টায় অন্ধকার হাতড়াতে হলো । অর্থাৎ অন্ধকারেরই হাত ধরতে হলো । কিন্তু উনি চিতা, জাতে  বাঘ..শান্ত স্বরে জানালেন তার বাড়ি যে অরন্যে,সেখানে অন্ধকার একটা নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার । আমার মতো শহুরে ছোঁড়ার কাছে ব্যাপারটা যতই রোম্যান্টিক হোক না কেন,ওনার কাছে অন্ধকার গা-সওয়া..প্রতিদিন সূর্য ওঠার মতো আর কি !! মেনে নিলাম। উনি বাঘ... আমি নেহাত মানুষ,তায় কোলকাত্তাইয়া(তাও আবার দক্ষিনের)....এটুকু তফাৎ থাকাই স্বাভাবিক । বাঘের চোখে চোখ রেখে তর্ক অনর্থক,অতএব খাতা-পেন্সিল ভরসা ।

                                     আমার বাড়ি যে অঞ্চলে,সেখানে কাঠ বাঙালের বাস । প্রায় সব-ই উদবাস্তু পরিবার ।  ছোটবেলার সেই বাসস্থানগুলি মূলত অস্থায়ী,মধ্যবিত্ত জবানিতে জবরদখ্‌লি । তা ঐ অঞ্চলের লোকজনের এক স্বভাবিক দোষ এবং গুণ ছিল । তারা প্রায় সকলেই,প্রচণ্ড তাড়াতাড়ি রেগে যেতেন,এবং ততোধিক তাড়াতাড়ি ভুলেও যেতেন. ৯০এর গোড়ার দিকের এক গ্রীষ্মের রাতে,এমনি এক রাগি বাঁজখাই গলার "জ্যোতিবাবু চলে গেলেন",আমাকে প্রথম অন্ধকার উৎসুক করেছিলো । এই বক্তব্য এবং তারপরের জটলা, গভীর আলোচনা,চিল-চিৎকার,খিস্তি ইত্যাদির কোনকিছুরই কারণ বুঝতে না পারলেও,"আলো  বা জ্যোতি চলে যাওয়া" বিষয়ক একটা one liner-এর এই বিপুল ক্ষমতা আমাকে অবাক করেছিলো । চটজলদি বাঙাল উচ্চারণে, সেদিনই প্রথম
লোড়সেরিঙের সাথে পরিচয়। এবং হ্যা ব্যাঘ্রকুল নন্দিনি( অথবা পাঠিকার চাহিদায় রঞ্জন ),আপনার অরণ্যের নিশ্ছিদ্র অন্ধকারের সাথে হঠাৎ বিদ্যুৎহীন শহরের শরীরের,লোড়সেরিঙের কোলকাতার শরীরের একটা তফাৎ আছে বইকি ।

                                     ছোটবেলার পড়ার সময় ছিল লোড়সেরিঙের সন্ধ্যাগুলি ।  লন্ঠনের আলোয় সাদা পাতাগুলি আগুন আগুন ঠেকত।কালো কালো অক্ষরেরা আগুনে খেলে বেড়াত. সেই রহস্যময় অক্ষরের তানেই,আমার লন্ঠনময় পড়াশুনা ।  অন্য রহস্যরা আস্তেও আস্তে বাড়তে শুরু করলো যখন,যখন  লোড়সেরিঙের যাতায়াত অনিয়মিত হয়ে পড়ল,তখন নিরুপায় হয়েই ওই অভ্যাসটি আমায় বিদায় জানিয়েছিল।

                                    লোড়সেরিঙের ছেলেবেলার আরেকটা স্মৃতি মাঝে মাঝেই ফিরে আসে ।  যে কোন প্রাণের মিছিলেই ফিরে ফিরে আসে ।  প্রথম মিছিল দেখা -মায়ের কোলে চেপে, অমনই এক শরীরি অন্ধকার রাতে. ঘরের ভেতরের লন্ঠন ঠিকরানো চার-আনা হাল্কা আলোয় দেখা প্রথম প্রাণের মিছিল......অন্ধকার ফুঁড়ে বেরিয়ে আসা দৃপ্ত কণ্ঠস্বর "হাতে হাতে কমরেড ।" হাজার মূস্থিবদ্ধ হাত অন্ধকার আকাশ ছুচ্ছে ।আজ জানি প্রতিবার হাতে এক চিলতে আকাশ ধরা পড়ে...সেদিন জানতাম না। সেদিন মিছিলের শব্দ শুনেছিলাম,সেদিন-ই প্রথম দেখা তার পেশীবহুল শরীর । ঠিক যেন, টি.ভি তে দেখা আফ্রিকান বক্সার। অন্ধকার গ্রেনাইটে গড়া পেশী বেয়ে,চুয়ে চুয়ে পড়ছে তাজা রক্তবিন্দু...প্রতি বিন্দুতে নতুন লড়াইয়ের অঙ্গিকার । সেই দিন অন্য এক শরীরী অন্ধকারের সাথে দেখা হয়েছিলো । এখানে উল্লেখ করা ভালো, প্রথম রাতের "জ্যোতি হারানো" ভদ্রলোক তখন barricade গড়ার শপথ গলায় নিয়ে,মিছিলের মধ্যভাগে । 

                                    আচ্ছা আপনার অরণ্যে শব্দের তো একটা কন্টিনুইটি আছে। মানে ঠিক যেমনটা থাকার কথা,ভয় ধরানো সুন্দর... কিন্তু একঘেয়ে । ইট-কাঠ- কংক্রিটের  জঙ্গলে, হঠাৎ নৈশব্দের বাজনা  কি তার থেকে একটু আলাদা নয় ? আপনাকে বলেছিলাম,সেলিমপুর থেকে যোধপুর পার্ক হয়ে আমার পুরনো পাড়ার রাস্তাটা,আমার প্রিয় ... পৃথিবীর অন্য যে কোন লোড়সেরিঙের রাতের রাস্তা, যার ধারে কাছে আসে না । এর কারণও হঠাৎ নৈশব্দ । ধরুন আপনি গড়িয়াহাট পেরিয়ে,ঢাকুরিয়া পেরিয়ে,ভয়ঙ্কর ভিড় ঊষাগেটের মিনি থেকে সেলিমপুরে নামলেন । হঠাত-ই  লোড়সেরিঙের সঙ্গে দেখা । আপনি জানতেনি না,সেদিন পূর্ণিমা । মুহূর্তে আপনার সামনের রাস্তা বদলে গেলো । অনেকক্ষণ ধরে আশে-পাশে ঘাপটি মেরে থাকা ঝিঁঝিঁরা, হঠাৎ পাওয়া নৈশব্দের সুযোগে তাদের উপস্থিতি জানান দিলো । হঠাৎ দুধ-সাদা মাটিতে ঘন ছায়া দেখে, আপনি চোখ তুললেন....দেখলেন ঝাঁকড়া চুলের দারুণ সুপুরুষ এক গাছ ।  হঠাৎ করে আশে-পাশে থাকা সুন্দর, অন্ধকারের বোর্খা পড়ে ,আপনার সম্পূর্ণ অজান্তে, আপনার পাশে এসে দাঁড়ালো....চোখে চোখ রাখলো । এই ভালো লাগাটা যেহেতু আকস্মিক,তাই তার রেশটাও দীর্ঘস্থায়ী । শব্দের-নৈশব্দের এবং  চোখের ভাষার এই ঝটিকা আক্রমনে,আপনি যথেস্ট পটু।  সুতরাং এবিষয়ে আপনাকে জ্ঞ্যান দেওয়া, মোটামুটি বাঙালকে হাইকোর্ট দেখানোর সমগোত্রীয় হবে । এখানে আমি ধরে নিচ্ছি দক্ষিনবঙ্গের বাঘ যখন,তখন আপনি বাঙাল বাঘ-ই হবেন।  

                                   আপনাদের বাঘেদের মধ্যে প্রেমপত্র দেওয়া-নেওয়ার ব্যাপারটা এখনো আছে কিনা জানি না ! আমাদের  শহুরে মানুষদের  মধ্যে ব্যাপারটা প্রায় উঠেই গেছে । সে জায়গায় গুড়ি মেরে ঢুকে পরেছে  sms,watsapp ইত্যাদি বিবিধ রতন । আপনি যেমন  মোনোসিলেবিক-বাইসিলেবিক হালুম-হুলুমের মধ্যে দিয়ে আপনার ভালোলাগা-খারাপলাগা ইত্যাদি প্রকাশ করেন,আমরাও তেমনি ইদানিং :),:-P,:,:<3 ইত্যাদি সংকেত মারফৎ আমাদের ভাললাগা,খুনসুটি ও ভালবাসার জানান দিয়ে থাকি। তো, লোড়সেরিঙ সেই সময়ের চরিত্র যখন এইসব সঙ্কেতবাহি যন্ত্রগুলো সম্পর্কে আমাদের কোন ধারণা ছিল না। সুতরাং, সংকেতগুলোরও কোন অস্তিত্ব ছিল না। হ্যাঁ,বাড়িতে ফোন অবশ্যি ছিল,কিন্তু যা বলার যখন বলার,তা কি আর তৎক্ষণাৎ গলা থেকে কবিতা হয়ে ঝরে-পড়ে ? সুতরাং কাগজ-পেন্সিল তার প্রয়জনিয়তা হারায়নি। সেই সব দুর্ধর্ষ নিষিদ্ধ ইস্তেহারের হাত বদল হওয়ার আদর্শ সঙ্গী ছিল লোড়সেরিঙ। সে, তার উপস্থিতি জানান দেওয়া মাত্র,চাঞ্চল্য ছড়িয়ে পড়ত। কোথাও কাজলা দিদির ঘরের জানলায়,খোকন মামার টর্চের ইশারা । কোথাও বা তিনতলার খুকি,মায়ের সাথে কথা বলতে বলতে জানলা দিয়ে হাত গলিয়ে হাওয়ায় ভাসিয়ে দিলেন প্রাণের বার্তা। অন্ধকারে নীচে দাঁড়িয়ে খ্যাদার সেই আকাশবাণী খিমচে ধরার সে কি অদ্ভুত উত্তেজনা। বয়েসে কাঁচা হওয়ায়,আমরা তখন মূলত দূতের কাজ করতাম। আমাদের উত্তেজনাও কিছু কম ছিল না। প্রতিটা চিঠি পৌঁছে দেওয়ার পর সুন্দরি দিদিদের হাতে গাল টেপা,অথবা পাড়ার নায়কদের পিঠ চাপড়ানি...সেই তখন পরম পাওয়া। মাঝেসাঝে আকাশবার্তা নায়ক হৃদয় উতফুল্ল করে দিলে,এক-আধটা কোকা-কোলাও জুটে যেত। এই সবই হতো দুরন্ত গতিতে। অসংখ্য হাত বদলের, ছুঁয়ে জাওয়ার,নিঃশব্দ ইশারার,উত্তেজনার,মন খারাপের, চাপা কান্নার একমাত্র নিরব সাক্ষী লোড়সেরিঙের কোলকাতা। 

ওঃ,সময় হয়ে এলো । লাস্ট মেট্রো ছেড়ে যাবে। আপনার মবাইল নম্বরটাই নেওয়া হয় নি....ফেসবুকে আছেন তো ?

বৃহস্পতিবার, ২৩ জানুয়ারী, ২০১৪

কেষ্টার চেষ্টা ~ নয়না চৌধুরী

সবকিছু ফেল, হয়ে যাবে জেল
তবু ও ছাড়িনা চেষ্টা
কাঁদোকাঁদো হয়ে প্রানপনে হেঁকে
তোলপাড় করি দেশটা!

এতো চেষ্টার ভার কে যে বয় ?
সেই পুরাতন কেষ্টা ?
রাত দিন ধোঁকে, বসন্তে মরে
তবু বয়ে যায় চেষ্টা !

ম'রবে তো ম'র, যা ক'রবে ক'র
ছাড়ব না আমি চেষ্টা
কেষ্টার বানী আমি খুব ই মানি
দেখেই ছাড়ব শেষটা

বুধবার, ২২ জানুয়ারী, ২০১৪

​কমরেড কমরেডকে মারতে পারে কি ~ অবিন দত্তগুপ্ত

আমার সমস্ত ছোটো গল্পের জন্য আমি চার জনের কাছে ঋণী । প্রথম সত্যজিত,দ্বিতীয় স্বপ্নময়,তৃতীয় ইলিয়াস হলে শেষ জন দেবু দত্তগুপ্ত। এই গল্পটা শেষ জনের থেকে পাওয়া। ভাগ করে নিলাম। এটা মূল দ্বন্দের গল্প নয়। চলতি মারক্সিস্ট পরিভাষায় পার্শিক দ্বন্দের(secondary contradiction)এর গল্প। নিজের মতো করে বলি,কারণ আমারও পেন আছে।

গল্পটা তেভাগার । সজনেখালির কোন এক গ্রাম। প্রভাস রায়-যতীন মাইতিরা গেছেন এক কর্মীসভায়। তা পুরো গ্রাম ভেঙ্গে পড়েছে। যতীন জানালেন, কৃষকসভা পরবর্তী সংগ্রামের জন্য প্রতিটা ঘর থেকে একটা মরদ, একটা লাঠি আর একটা টাকা চাইছে (মানে মধ্যবিত্ত জবানিতে ঐ কৌটো নাড়াচ্ছে আর কি ।) যে সমস্ত জায়গায় সংগঠন দুর্বল,সেখানে সবল অঞ্চল থেকে শক্তি বিকেন্দ্রীভূত হবে।

নেতৃত্বের ভাবনার সাথে অব্যর্থ কো-অরডিনেশানে এক বৃদ্ধ,হাজার বছর পড়ে পড়ে মার খাওয়া, শিরিঙ্গে চাষি হাত তুললেন। জানতে চাইলেন "মরদরাই যদি না থাকলো ,তবে ঘাটি আগলাবে কারা ?" । উত্তুত্তর মিনিট খানেকের নিস্তব্ধতা। উত্তর দিল ভিড়। এ ভিড় অনেক বেশি ঘন, অমাবস্যার অর্ধেক আকাশের মতো মায়ের ভিড় উত্তর দিল " কেন ? ফসলের মরশুমে আমাদের কাস্তে কি মরদের চেয়ে আস্তে চলে। যে কাস্তেতে ফসল কাটি, সেই কাস্তে ধরতে শেখায় কোন মরদে। আমরাই আমাদের গ্রাম রক্ষা করতে পারবো " । এই বক্তব্যে

একটু নড়ে উঠে,প্রভাস বাবু বললেন " হ্যা, তোরাও তো আমাদের কমরেড । মরদরা যা পারে,তোরা আরও ভালো পারবি। আমি এই প্রস্তাব সম্পূর্ণ সমর্থন করছি।" কেমন যেন একটা বিদ্যুৎ খেলে গেলো দলা পাকানো অর্ধেক অন্ধকারে। অমন একটা মানুষ,দুই জেলার পুলিশ যাকে ছুঁতে পারে না, জোতদারের ধুতি ভেজে যার নামে, এই অরণ্যের আসলি বাপ তাদের কমরেড বলেছে। অন্ধকার ঘন হয়। এদিক-ওদিক ঠেলা-ঠেলির মধ্যেই এক দলা অন্ধকারে ছিটকে বেরিয়ে আসে। অর্ধেক আকাশ তার সদ্য কমরেড প্রভাস-যতীন কে প্রশ্ন করে " আচ্ছা, একজন কমরেড কি আরেকজন কমরেডকে মারতে পারে?"। নেরিত্বেন
স্বভাবতই,মাটি চেনা নেতৃত্ব এই প্রশ্নের উৎস বুঝতে পারে। যতীনদের সম্মতি সূচক নিস্তব্ধতার নিড়েন দেওয়া জমিতে,ফসল ফোটাতে শুরু করে যুগ যুগ ধরে বোবা হয়ে থাকা এক চিরপ্রাচীন-নিষ্পেষিত শক্তি।" আমার মরদ,রোজ জন খাটে। মহাজনে মারে,টাকা দেয় না। যা পায়,তার অর্ধেক যায় সাহা বাবুর চোলাইয়ের ঠেকে। বাড়ি ফিরে আমায় বেদম মারে। আচ্ছা দাদা,তুই তো বললি আমি তোর কমরেড। আমার মরদ-ও তোর কমরেড। তাহলে তো আমি আর আমার মরদ কমরেড। এবার বল, কমরেড কমরেডকে মারতে পারে কি ?"
যুগ যুগ ধরে চাপা পড়ে থাকা ভয়ঙ্কর অগ্নি শিখায়,তখন অন্য অর্ধেক আকাশ জলছিল। এক অন্য আগুনে পুরে ইস্পাত হচ্ছিল নিশ্ছিদ্র চাঁদহিন আকাশ। এক শ্রেণি যুদ্ধ যখন, অন্য এক অজানা দ্বন্দের মুখ চেনাচ্ছে, মানুষ সিদ্ধান্ত নিলো "আজ রাতেই ভাঙ্গবে সাহার চোলাইয়ের ঠেক"।

রবিবার, ১৯ জানুয়ারী, ২০১৪

ক্যাডার ~ অবিন দত্তগুপ্ত

দৃশ্য এক


         সত্তরের কোনো এক গ্রীষ্মের দুপুর। গড়িয়া চৌমাথার মোড় । এখন যেখানে রাষ্ট্রীয় পরিবহনের বাস গুমটি,ঠিক তার উল্টো দিকে দাড়িয়ে অর্ক দরদর করে ঘামছে। কালো সস্তা কাপড়ের প্যান্ট আর সাদা চেক-চেক জামা গায়ে অর্ক সেদিন নতুন অনিশ্চয়তার মুখোমুখি। লুকিয়ে থাকার অভিজ্ঞতা তার নতুন নয় । গত সাত মাস সে লুকিয়েই ছিল,কিন্তু এবার সম্পূর্ণ অপরিচিত এলাকায়। ৮ নম্বর রেল বস্তির ঘুপচি আস্তানার আশেপাশে সব কিছুই সে হাতের তালুর মতো চিনতো। কিন্তু পার্টি জানিয়েছে,কোনো কিছু পরিচিতই এখন আর নিরাপদ নয় । পার্টি-ই তার সন্তানকে বলেছে ১০ই মে ১৯৭১ বেলা আরাইটের সময় গড়িয়া চৌমাথার মোড়ে,ঠিক এই জায়গায় দাঁড়াতে। আর বলেছে,নিল লুঙ্গি-সাদা ফতুয়া-লাল গামছা পরিহিত কোনো একজন অর্ককে তার নতুন আস্তানা দেখাবে।


        আশেপাশে দুটো কালো ভ্যান, মাছির মতো ভনভন করছে। কিছুদিন আগেই সি আর পি আর কংগ্রেসি গুণ্ডারা বেধড়ক মার খেয়েছে কামাড়পাড়ায়ে,দক্ষিন কলকাতার স্তালিনগ্রাদে। এখনো সেই ঘা শুকায়নি । তাই,পাগল কুকুরের মতো জোয়ান ছেলে-মেয়েদের গায়ে বামপন্থি গন্ধ খুজছে। অতএব,অভ্যাসবসত পকেট থেকে রুমাল বার করে অর্ক নাকে চাপা দিল, যদিও সে জানে তার চোখ দুটোই তাকে ধরিয়ে দেওয়ার পক্ষে যথেস্ট। কুকুরগুলো যখন প্রায় ঘাড়ের উপর,ঠিক তখনি উল্টোদিকের ভিড় ফুঁড়ে এক ক্ষয়াটে লোক রাস্তায় এসে পড়ল। পরনে নিল লুঙ্গি-সাদা ফতুয়া। ঘাম মুছে লাল গামছাটা কাধে ফেলতেই অর্ক পথপ্রদর্শককে চিনে নিলো । ভিড়ের মানুষটি অনায়াসে ভিড়ে মিশে এগিয়ে চললেন। ঠিক দশ পা পেছনেই অর্ক। এগলি-ওগলি-তস্যগলি ঘুরে অর্ক তার নতুন আস্তানায় পৌঁছল। পথপ্রদর্শক একটা কথাও বলেননি। অর্ক আজ-ও তার নাম জানে না।


                                                                     দৃশ্য দুই 


         ১৯৮২ সাল। অর্ক এখন এক সরকারি ব্যাঙ্কে কেরানির কাজ করে। পরিক্ষা দিয়ে চাকরি পাওয়ার পরদিনই সে ব্যাঙ্কের বামপন্থি ইউনিয়ানের খোজ নিয়েছিলো। পুরানো ইউনিয়ানে পচন ধরায়,সবে তৈরি হয়েছে নতুন শিশু গনসঙ্গঠন। ডেকার্স লেনে পোস্টার মারার কাজ চলছে। বেশির ভাগ লোকজনেরই অনভ্যস্ত হাত। পোস্টার মারতে দেরি হচ্ছে। হঠাৎ এক গালভাঙ্গা,উষ্কখুষ্ক চুলের মানুষ অর্কের পাশে এসে উপস্থিত। কোন ভুমিকা ছাড়াই বলল "সাহায্য করতে পারি?" প্রচলিত অর্থে,ভদ্রলোকের চেহারা নয়, অর্কর চিনে নিতে ভুল হল না। একটু সরে জায়গা করে দিতে ভদ্রলোক প্রথমেই বালতি ভর্তি আঠার মধ্যে খানিক জল মিশিয়ে নিলেন। তারপর অদ্ভুত কায়দায়,দু-বগলে পোস্টার চেপে ধরে,মই বেয়ে তরতর করে উপরে উঠে গেলেন। যুদ্ধকালীন তৎপরতায়  চার-চারটি দেওয়াল একঘণ্টার মধ্যে পোষ্টারে ভরে গেল। কর্মসূচী শেষ। চা-মুড়ি খাওয়া চলছে। গোগ্রাসে মুরি গেলা লোকটার পাশে এসে অর্ক জিজ্ঞেস করলো " আপনি কে ?"  ভদ্রলোক উত্তর দিলেন, "আমি আপনাদের লোক, এটুকুই কি যথেস্ট নয়?"


অর্ক - " আপনি কি এই অঞ্চলের ?"

অপরিচিত- "মেটিয়াবুরুজ"

অর্ক-"এখানে ?"

অপরিচিত-" যেখানে লড়াই সেখানেই তো আমাদের থাকার কথা!" 

 অর্ক- "আপনার নামটা?"

অপরিচিত (মুচকি হেসে) - "ক্যাডার"


        মেটিয়াবুরুজে, অর্কর এক কলেজের কমরেডের বাড়ি। বহুদিন দেখা-সাক্ষাত নেই। এই ঘটনার প্রায় দশ বছর পরে অর্ক সেই কমরেডকে ব্রিগেডে দেখেছিল। দশ বছর আগের ঘটনার পূর্ণাঙ্গ বিবরণ দেওয়ার পর অর্কর কমরেডের মুখে মেঘ ঘনিয়েছিল। মাটির দিকে তাকিয়ে সে জানিয়েছিল "শামিম আর পার্টিতে নেই"।  

                                                               

                                                                     দৃশ্য তিন


        ২০১১। অনেক কিছুই ভেঙ্গেচুরে গেছে। শরির ভেঙ্গেছে ,সম্পর্ক ভেঙ্গেছে,মন ভেঙ্গেছে,স্বপ্নগুলো ভেঙ্গেছে বেশ অনেকদিন হল।

শেষ ভাঙ্গাটা,মানে অর্কের মতে প্রয়োজনীয় ভাঙ্গাটা শেষ হয়েছে কয়েকদিন আগে। ষাট ছুঁইছুঁই অর্ক জানে ভিত শক্ত করে নতুন স্বপ্ন গড়তে হলে, পুরনো জরাজীর্ণ অস্তিত্ব ভেঙ্গে পড়াই ভালো। তবুও, কোথাও যেন একটা কাঁটা খচখচ করে। যাই হোক,এতো ভাঙ্গনের মধ্যেও নিজের মনের মতো করে সে তার সন্তানকে গড়েছে। ভবিষ্যতের নরকে লড়াই করতে অপু মোটামুটি প্রস্তুত। অর্ক এখন অনেকটাই ঝারা হাত-পা। 

    

বহুদিন পরে সে আজ বালিতে এসেছে তার অভিন্নহৃদয় বন্ধু কল্যানের সাথে দেখা করতে। বালিহল্ট স্টেশান থেকে রিক্সায়ে ঘোষপাড়া বাজার। কল্যানের বাড়ির সামনে রিক্সা থামিয়ে অর্ক রিকশাচালককে ১০টাকার নোট বাড়িয়ে দিল। "লাগবেনি বাবু",রিক্সাওলার খ্যানখ্যানে গলা ভাবনার অতল থেকে অর্ককে আকস্মিক কান ধরে টেনে হিঁচড়ে বাস্তবে আনল। তার বিরক্তির উত্তরে ফোকলা হাসি ফেরত দিলেন চালক। "সমীরদা,তুমি আবার ভাড়া নেবে না বলে জিদ ধরেছ ?",কল্যান যে কখন এসে পেছনে দাঁড়িয়েছে অর্ক খেয়ালি করেনি। সমিরের হাতে দশটাকার নোট গুজে দিয়ে অর্ক হেসে বলল "বিনে পয়সায় কারো ঘাম কিনতে আমার বাপ শেখায়েনি।" ডাইনোসরের যুগের রিক্সাটা আস্তে আস্তে দূরে মিলিয়ে গেলো। 


   ঘরে বসে একটা নেভিকাট ধরিয়ে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই,কল্যান হেসে ফেললো। "পুরানো মানুষ,সত্তরের কমরেড"।  


পুরানো নোনতা স্বাদটা জিভে হঠাৎ ফিরে পাওয়ায়ে, অর্ক সোজা হয়ে বসল । কল্যাণ স্মৃতি হাতড়াচ্ছে,"এই সমীরদার জন্যই বার চারেক খুন হতে হতে বাঁচা। কোনো রাস্তার মোড়ে বিপদ দেখলেই , ঐ হরিদার চায়ের দোকানের সামনে দাড়িয়ে পাঁচবার পর পর হর্ন বাজাতো। কাছে গেলেই বলে দিত,কোন রাস্তায় বিপদ,কোন রাস্তা ফাঁকা। এক ছেলে -এক মেয়ে। মেয়েটার বিয়ে হয়ে গেছে। ছেলে এস এফ আই করত,বদলের পর থেকে নিখোজ।প্রতিসন্ধায়ে এল.সি তে বসে নেতাদের গল্প শোনে। চা-বিড়ি এনে দেয়। নিজেও খায়। আর সব মিছিলে রিক্সা চালিয়ে সবার আগে আগে যায়। অর্ক হাসে। নিজেই বোঝে হাসিটায় একটা "আমি তো এই পার্টিটাই করি "গোছের প্রচ্ছন্ন গর্ববোধ আছে। হঠাৎ কল্যানের গলার শব্দে ভাবনার উড়ান থমকে যায়। 


"তোকে হাসতে দেখে সমীরদাকে নিয়ে একটা মজার গল্প মনে পড়ে গেলো।এই সেদিন ভোটের আগে,এখানে একটা পার্টির জনসভা ছিল। মঞ্চের সামনে শতরঞ্জি পাতা। তারপর চেয়ার,তারপর দাড়ানোর জায়গা। তা সমিরদা,তার ঢাউস ঝাণ্ডা নিয়ে শতরঞ্জিতে  বসেছে। হঠাৎ ঝামেলা।। পেছনের লোকজন পতাকায় ঢেকে যাওয়া নেতাদের দেখতে পারছেন না। বুড়োকে অনেকে মিলে বোঝানর চেষ্টা করল,গালি দিল,কিন্তু কিছুতেই সে পতাকা নামাবে না। ঘাড় ত্যারা করে তার সেই এক যুক্তি,লাল ঝাণ্ডা মাটিতে রাখবো না। পুরো মিটিঙে ঝাণ্ডা মাটি ছোয়ে নি।"


         সেই সুন্দর দুপুরের ঠিক এক সপ্তাহ পড়ে অর্কর মবাইলে কল্যানের নাম ভেসে উঠেছিল। কল্যাণ জানিয়েছিল ,নয়া ফ্যাসিস্টরা বুড়ো সমীরকে মিছিলে যাওয়ার অপরাধে বেধড়ক মেরেছে। রিক্সা ভেঙ্গে দিয়েছে। সমিরদা এখন, ঘরছাড়াদের ভিড়ের একজন। 


                                                              শেষ দৃশ্য


          আজ সন্ধ্যা। আজকে রানী রাসমনি রোডে পার্টির জনসভা ছিল। অভ্যাসবশত এদিনও অর্ক একদম শেষের সাড়িতে দাঁড়িয়ে। দু চোখ ভরে কালো মাথার ভিড় দেখছে। পরিচিত,মাফলার জড়ানো একটা মুখ দৃষ্টিপথ আড়াল করলো। এক গাল হাসি নিয়ে, পূর্ণদৃষ্টিতে তাকিয়ে,অর্কের সেই মেটিয়াবুরুজের কমরেড খবর দিলেন "শামিমকে পার্টিতে ফেরানো হয়েছে। ও কোন প্রশ্ন করেনি। আগের মতই যুদ্ধ খোঁজে এখনো।" অর্ক মনে মনে বলল "আমরাও কি খুঁজি না ?"


          দুতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে,অন্ধকার আকাশের দিকে তাকিয়ে অর্ক শামিমদের দেখতে পেল। আকাশ ভরা মিছিলে শামিম হাটছে,ঢাউস পতাকা হাতে সমীরদা,রহিমস্তাগর রোডের সুফল, যোধপুরপার্কে গনশক্তি বেচতে গিয়ে হারিয়ে যাওয়া তাপস হাঁটছে দৃপ্ত ভঙ্গিতে। হাটছেন,মিছিলে দেখা নাম না জানা কতো মানুষ। হাঁটছেন, নিল লুঙ্গি-সাদা ফতুয়া কাধে ফেলা লাল গামছায় সত্তরের আপনজন। হাঁটছে স্মৃতি।  আজ দুপুরে অর্ক যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল, তার অনতিদুরেই কালো মাথার ভিড়ে সে অপুকে দেখেছে। নিজের কমরেডদের সাথে অপু ব্যাচ আর পিন আটকে দিচ্ছে সকলের বুকের বা-দিকে। আবার আকাশের দিকে মুখ তুললো অর্ক  এবারের মিছিলের শেষে,মানুষের ভিড়ে সে তার অপুকে খুজে পেলো। আর কিছু না পারুক, অর্ক জানে,সে ভবিষ্যতের এক মানুষকে গড়ে তুলেছে। মানুষের আন্দলনের ঋজু সৈনিক।  ক্যাডার বাপের ক্যাডার সন্তান। 

শনিবার, ১৮ জানুয়ারী, ২০১৪

গগন ~ অমিতাভ প্রামাণিক

শিলাইদহ কুঠিবাড়িতে এক জমজমাট দুপুর। বাড়িতে অতিথি হয়ে এসেছেন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট দ্বিজেন্দ্রলাল। উনি জমিদারের বন্ধু, ওঁর তদারকিতে ব্যস্ত সব মানুষজন।

এসব আতিথ্যে গানবাজনা তো আছেই। দ্বিজুবাবুকে দুবার অনুরোধ করতে হয় না। হাসির ছড়া, নাটক আর গান তার কলমের নিবেই বাস করে, কাগজ পেতে বসলেই হয়। হারমোনিয়াম বাজিয়ে তিনি বেশ রসিয়ে রসিয়ে পরিবেশন করলেন – বাহবা, বাহবা নন্দলাল। সকলেই বাহবা, বাহবা করতে লাগল।

জমিদারমশাইয়ের গলায় আজ অল্প ব্যথা। তিনি বন্ধুবরকে বললেন, আমার গান তো শুনেছেন অনেক, আজ এর গান শুনুন। ফরাসের ওপর সঙ্কুচিত হয়ে বসে থাকা এক রোগা-প্যাংলা মানুষের দিকে নির্দেশ করতে সে আরো কাঁচুমাচু হয়ে গেল। ভাবটা যেন, সত্যি আমাকে ডাকছেন?

একে এলাকার সবাই চেনে। দ্বিজুবাবুকে এর পরিচয় দেওয়া হল, এখানকার ডাকঘরের ডাক হরকরা, এর নাম গগন। আপনারা লালন ফকিরের গান তো শুনেছেন নিশ্চয়, এবার এর গান শুনুন।

গগনের দিকে একবার তাকিয়ে কার উদ্দেশে নমস্কার ঠুকে গগন গান ধরল, আমি কোথায় পাব তারে, আমার মনের মানুষ যে রে ...

উদাত্ত কণ্ঠের গান, প্রাণের গান, এই মাটির গান। শেষ হলে অনেকক্ষণ কারো মুখ দিয়েই কথা বেরোলো না।

অনুষ্ঠান ও খাওয়া দাওয়া শেষে দ্বিজুবাবুকে নিয়ে চারপাশটা একটু ঘুরতে যাওয়া হল। দ্বিজুবাবু পন্ডিত মানুষ, বিদেশ থেকে চাষবাস নিয়ে পড়াশুনা করে এসেছেন। বন্ধুকে বললেন, নদীর চরে এখানে এত উর্বর পলির জমি, কচু-ঘেঁচু হয়ে জঙ্গল হয়ে আছে। এসব পরিস্কার করে এখানে আলুর চাষ করুন। আমি ভাল আলুর বীজ পাঠিয়ে দেব, দেখবেন খুব সুন্দর আলু হবে এখানে।

জমিদারমশাই ঘাড় নেড়ে তাকে সমর্থন জানাতেই কোত্থেকে একপাল লোক এসে সেই মানকচুর জঙ্গল সাফ করতে লেগে গেল।

বিদায় নেবার সময় অন্যান্য কিছু স্মারক উপহারের সঙ্গে প্রত্যেক অতিথিদের দেওয়া হল সেই মানকচু। জমিদারমশাই বললেন, এ আমাদের অতি প্রাচীন খাদ্য, আলু অবশ্য চাষ করব এখানে, তবে একে অবহেলা করা অন্যায় হবে। কত রকম যে সুখাদ্য এ থেকে প্রস্তুত করা যায়, আপনারা চেষ্টা করে দেখুন।

জমিদারপত্নী আড়াল থেকে শুনে মৃদু হাস্য করলেন। কিছুদিন আগেই নাছোড়বান্দা পতির নির্দেশে তাকে মানকচুর জিলিপি বানাতে হয়েছিল। সে পরীক্ষায় তিনি সসম্মানে উত্তীর্ণও হয়েছিলেন।

কয়েক সপ্তাহ পরে আবার সেই গৃহে জলসা। দ্বিজেন্দ্রলাল-গগন-পাড়ার মোড়ল-পোস্টমাস্টার সবাই এসেছেন। দ্বিজেন্দ্রলালের স্ত্রী রান্না করে এনেছেন মানকচুর কালিয়া। মানকচুর কোপ্তা বানিয়ে এনেছে মোড়লগিন্নী।

আজ আর রবীন্দ্রনাথকে অনুরোধ করতে হল না। কেউ কিছু বলার আগেই তিনি গান ধরলেন, রাজা সবারে দেন মান, সে মান আপনি ফিরে পান ...

18 January 2014

সোমবার, ১৩ জানুয়ারী, ২০১৪

পঞ্চানন কর্মকার ~ রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য

কোলকাতার নন্দনে চলছে- ক্ষুদ্র পত্রিকা মেলা,২০১৪ । চারিদিকে আলো, হইহই, হরিপদর চা, সারি সারি ষ্টলে শোভা পাচ্ছে বিভিন্ন পত্রিকা । লোকজনের আনাগোনা ।

একটু খোলামেলা জায়গায় এসে বসলাম, একটা চেয়ার টেনে নিয়ে ।

হঠাৎ মনে হলো, চারিদিকে অন্ধকার হয়ে এলো । সব আলো, হইহই নিমেষে উধাও।
শুধু সামনে, কয়েকটা চেয়ার পড়ে আছে । বুঝতে পারছি না, কি হচ্ছে ?

আমি কি অসুস্থ বোধ করছি, নাকি মরে যাচ্ছি !!!!!!!

এমন সময়ে একজন, মলিন ধূতি / কামিজ পরা এক আধা বয়েসী ভদ্রলোক সামনের চেয়ারে এসে বসলেন ।

বাঁ হাতে, যেভাবে ইলিশ মাছ দড়ি দিয়ে ঝোলায়, ঠিক সেই ভাবে দুটো লম্বা পাবদা মাছ আছে আর বড় বড় দুটো পেঁয়াজ কলি ।

চিনতে না পেরে, অবাক হয়ে ওনার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম ।

মনের ভাবটা বুঝতে পারলেন বোধহয় ভদ্রলোক ।

- আমাকে তো দেখো নি হে তাই চিনতে পারছো না !!! দেখবেই বা কি করে !! সেই ইংরেজি ১৮০৪ সালে মারা গেছিলাম ।
- আপনার নামটা বলবেন কি দয়া করে ?
- নাম বললে, চিনবে কি !!!! আজকাল তো কেউ চেনেই না !!! অথচ এই যে মেলা হচ্ছে, তার জন্য আমার কিছু অবদান আছে বৈকি !!
- আহা, নামটা বলুন না, তারপর দেখা যাক, চিনতে পারি কিনা !
- আমার নাম, পঞ্চানন কর্মকার ।
- নামটা শোনা শোনা লাগছে !!! আপনার নিবাস ?
- হুগলী জেলার ত্রিবেণীতে। আমার পূর্বপুরুষ পেশায় ছিলেন কর্মকার বা লৌহজীবি। কিন্তু বেশ কয়েক পুরুষ আগে আমরা ছিলাম লিপিকার। তামার পাতে, অস্ত্রশস্ত্রে অলঙ্করণ বা নামাঙ্কনের কাজে পূর্বপুরুষরা ছিলেন অত্যন্ত দক্ষ। আমিও পূর্বপুরুষদের এই শিল্পবৃত্তির গুনপনা পাই। পূর্বপুরুষেরা প্রথমে ছিলেন হুগলী জেলার জিরাট বলাগড়ের অধিবাসী, পরে ত্রিবেণীতে গিয়ে বসবাস শুরু।
- বাপরে !!! এতো লম্বা ইতিহাস ? তাও ঠিক বুঝতে পারছি না, আপনার সঠিক পরিচয় ।
- ওই যে বললুম, আমাদের আর কে চেনে ? বলি, উইলিয়াম কেরীর নাম শুনেছো?
- শুনবো না !!! কি যে বলেন !
- সায়েবের নাম বলাতে চিনলে ? আমি সেই পঞ্চানন কর্মকার, যে...
- যে ?
- ১৭৭৮ খ্রিস্টাব্দে চার্লস উইলকিন্স যখন হুগলীতে নাথানিয়াল ব্রাসি হ্যালহেডের লেখা এ গ্রামার অব দ্যা বেঙ্গল ল্যাঙ্গুয়েজ বইটি মুদ্রণের উদ্যোগ গ্রহণ করে, তখন আমিই প্রথম আমার প্রযুক্তি জ্ঞান নিয়ে বাংলা হরফ প্রস্তুতের কাজে উইলকিন্স কে সাহায্য করতে এগিয়ে আসি। 
- আচ্ছা, আচ্ছা- মনে পড়েছে !!! দিন দিন, পায়ের ধুলো দিন !
- থাক! আর আদিখ্যেতা করতে হবে না !! ঢের হয়েছে ।
- আরে রাগ করেন কেন ? আপনি না থাকলে এই সব কখনও হতো ?

- ছাপার জন্য ছেনিকাটা, ঢালাই করা চলনশীল বা বিচল যে ধাতব হরফ ব্যবহার করা হয়, তা উইলকিন্স এবং আমার যৌথ প্রচেষ্টায় সম্ভব হয়েছিলো। 
১৭৭৯ সালে তদানীন্তন গভর্ণর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংসের উৎসাহে উইলকিন্সের পরিচালনাধীনে কলিকাতায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর ছাপাখানায় আমি কাজ শুরু করি। 

১৭৮৫ সালে পুরোদমে এই সরকারি ছাপাখানা চালু ছিল,আমি সেখানে কাজ করতাম। হরফ নির্মাণের কলাকৌশল আমি না থাকলে সায়েবরা করতেই পারতো না। 
আমি মারা যাবার আগে, জামাই মনোহর কর্মকারকে সমস্ত জ্ঞান ও কলাকৌশল শিখিয়ে যাই । 

- হ্যাঁ হ্যাঁ মনে পড়েছে । তা, এই খানে কেন আপনি ?

- একটা কথা বলতে এলাম । আমার শ্রীরামপুরের বাড়ীটা ভেঙ্গে একটা রাজার প্রাসাদ তৈরী করেছে । তোমরা যাকে এখন ফ্ল্যাট বাড়ী বলো । ওটা ঠিক নিউ গেট ষ্ট্রীটে পঞ্চানন সিঙ্গির বাড়ীর উল্টোদিকে ।

এই ব্যাপারে তোমরা একটু প্রচার করো বাপু । এই বসত বাড়ীটা অনেক কষ্টে তৈরি করেছিলাম ।

- নিশ্চয়ই বলবো !!! কাজ হবে কিনা জানি না !

- ঠিক আছে, ভাই আমি চলি এখন । মনোহর এয়েচে । ও আবার পেঁয়াজকলি দিয়ে পাবদা মাছ ভালো বাসে । বৌ রাঁধবে বলে বসে আছে ।

আঁধার চলে গেল । হরিপদ বলল – লেবু না দুধ চা ?

রবিবার, ১২ জানুয়ারী, ২০১৪

শকুন-তলা ~ অনামিকা মিত্র

'বেল ভিউ'-এর উঠোনে ঘোরে পেটুক শকুন পাখি।
কাজ কর্ম নেই কি কোনও? বলি ব্যাপারটা কী?

'মৈত্র' মশাই খবর দিতে ব্যস্ত সকাল সন্ধ্যে। 
শকুনটি নট নড়নচরন আগাম পাওয়া গন্ধে।

সাকসেস রেট ঈর্ষনীয়। বুক ভরে যায় গর্বে।
তেরচা নজর দিলেই রোগী ভেন্টিলেটর চড়বে।

হাত পাকানোর খবর জানা, অনেক বছর থেকে।
দখল করে পুড়িয়ে দেওয়া, সুভাষ মুখুজ্জেকে।

মান্না দে খুব অভদ্রলোক, ভীষণ রকম বাজে।
ডেড বডিটা দেবেন না যে, আসেই নি আন্দাজে।

নীললোহিতের জবর দখল, দেখেছিলাম তা'ও।
সুচিত্রা সেন? ওঁকেও, হুঁ হুঁ! একটু সময় দাও।

এমনি ভাবে সব্বাইকেই! সব ক'টা নাম ভেবো।
শকুন-তলার লিস্টে আছেন 'প্রসেনজিৎ' আর 'দেব'ও।

ও কিছু না ~ দেবাশিস লাহা

 "আয় তোকে আদর করি "
এই বলে মেয়েটার পিছু নিল এক হাজার দাঁত আর নখ !

ছূট ! ছুট! ছূট !
ছূটতে ছুটতে মাটি চিরে ফেললো মেয়েটার পা 
বললো -- আমায় ফিরিয়ে নাও !
মাটি বললো না !
মেঘ ছুঁয়ে ফেললো ওড়না!
বললো -- "আমায় উড়িয়ে দাও "
মেঘ বললো না !
সূর্য ছুঁয়ে ফেলল চোখ 
বললো "আমায় পুড়িয়ে দাও "
সূর্য বললো না !
বাতাস জড়িয়ে ধরলো ঠোঁট 
বললো "আমায় কুড়িয়ে নাও "
বাতাস বললো না ! 

তবু ছুটতে থাকল মেয়েটা
ঘাসের উপর ছিটকে পড়ল স্কুল ব্যাগ! 
সকাল ফুরিয়ে দুপুর , দুপুর ফুরিয়ে বিকেল !
তবু পিছু ছাড়ল না থাবা ! 
শিশিরের মতো মিলিয়ে গেল দূরত্ব, 
এক দিন মেয়েটাকে ধরেই ফেললো ওরা

তারপর শুধু মট মট শব্দ !
এত কিছু ভাঙা যায় কে জানতো !
প্রথমে চুড়ি,
তারপর আঙুল আর হাত ,
তারপর পা !
সব কিছু ভাঙতে ভাঙতে আরও 
এগিয়ে এলো ওদের থাবা,
ঝনঝনিয়ে ভেঙে গেলো পুতুল বাড়ি,
টেডি বিয়ার, 
সদ্য ফোটা গোলাপ, 
তারপর আরও কত কি! 

বাবার মুখ, ছোট্ট ভাই বিনুর চোখ ,
মামা বাড়ির নদী, পাশের বাড়ির ছাদ ,
এমন কি ইস্কুলের জানালা দিয়ে দেখা ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি ! 
তাও ভেঙে ফেলল ওরা ! 

তবু ওড়ার চেষ্টা করলো মেয়েটা
পারলো না ! 
ধুলো উড়িয়ে থেমে গেল ডানা !

ঠিক তখনই নেমে এলো অন্ধকার, 
এক বুক জোনাকি নিয়ে জড়িয়ে ধরলো ওকে 

"তোর নাম কি রে ? " ফিসফিসিয়ে জানতে চাইল মেয়েটা,

"কেন , চিনলি না আমায়? আমি যে তোর নীল পরী "

"ওহ, তাই বুঝি এত দেরি করে এলে ? "

টুপ করে একটা শব্দ, 
ও কিছু না ! 
ঘাসের উপর গড়িয়ে পড়লো আরেক ফোঁটা রক্ত

ফ্রেন্ড লিষ্ট ~ দেবাশিস লাহা

বন্ধু কজন জানতে চাস? 
ছাড়িয়ে গেছে হাজার
বন্ধু দিয়ে শহর গড়ি
বন্ধু দিয়ে বাজার 

তোর বুঝি মেরেকেটে
ডজন খানেক হলো ?
আমায় দ্যাখ হাজার দুয়েক
করছে শুধু ফলো !

বন্ধু করার কায়দা তুই
আমার কাছে শেখ 
কেমন করে বন্ধু বাড়ে
তাকিয়ে শুধু দ্যাখ ! 

এই বলে সেই মেয়েটা
মাউস দিলো টিপে
খুলে গেলো ফ্রেন্ড লিষ্ট
ইয়াব্বড়া পিপে 

মাইল মাইল পড়ে আছে
বন্ধু শুধু বন্ধু
বন্ধু দিয়ে ভরছে আকাশ
বন্ধু দিয়ে সিন্ধু 

বলরে মেয়ে সত্যি করে
কজন কে চিনিস 
জানিস কি তুই ভাল করে
বন্ধু কি জিনিষ ?

বন্ধু দিয়ে স্টেটাস বাড়াস
বন্ধু দিয়ে পুকুর
বন্ধু যেন খানদানি 
এলশেসিয়ান কুকুর !

কার মনে মেঘ করেছে
কার চোখে জল
কার পাতে শুধুই বিষ
অযুত হলাহল 

কোন ছেলেটা মোমবাতি
যাচ্ছে শুধু ক্ষয়ে
কোন ছেলেটা নদীর জলে
ভাসছে খড় হয়ে

এসবের তুই রাখিস খবর
সোনার বরণ মেয়ে ?
মাউস টিপে বন্ধু বাড়াস
রবি ঠাকুর গেয়ে !

মানুষ সে তো গাছের মতো
বাইরে থেকে দেখা 
মাটির নিচেই আছে তার 
কান্নাকাটি রাখা 

আসলে তুই ভীষণ একা
কান্না নিয়ে থাকিস
মাটির তলার শেকড় বাকর 
স্টেটাস দিয়ে ঢাকিস

শনিবার, ১১ জানুয়ারী, ২০১৪

শীতঘুম ~ অরুণাচল দত্তচৌধুরী

সেই ক্রিসমাস থেকে চুপচাপ শীতঘুমে আছি
বিকেলের বেলা কমল বয়সের ব্যস্ত অনুপাতে
ক্লান্ত পরিযায়ী পাখি… বুঝে যায় ওড়া নেই ধাতে
তুষার বাতাস এসে খেলে গেছে ভুল কানামাছি।

প্রগাঢ় অন্ধকারে কুণ্ডলিত সময়ের ধাঁধাঁ
শুয়ে আছে। মাথার মণিটি যত্নে পাশে রাখা তার।
সে'সব সরিয়ে যদি আলগোছে চুমু রাখি ঠোঁটে,
যাবতীয় বিষদাঁত কলগেটে মেজে সেজে ওঠে।

আরও কারা এসেছিল? বল দেখি এসেছিল কে কে?
বিষাদগন্ধ মাখা আমাদের এ' মায়াশহরে
প্রশ্নটুকু করলেই বিস্মৃতির স্বপ্নে চোখ রেখে
প্রেম হেসে ওঠে তার নিশিলাগা বিকারের ঘোরে।

কবিতা আসেনা কোনও। মাঝে মাঝে জেগে ওঠে ক্ষুধা
শীত রাতে ভস্ম হই। পুড়ে যায় সমগ্র বসুধা।

শুক্রবার, ৩ জানুয়ারী, ২০১৪

​বাৎ শরিক ~ অমিতাভ প্রামাণিক

মেয়েটা মাত্র ষোল বছরের, বাড়ি মধ্যমগ্রাম -
মুদ্রাস্ফীতি, তবুও এদেরই সবচেয়ে কম দাম।

সে এবং তার মত আর যারা বেড়ে উঠছে গোকুলে,
পথ চলা বড় কষ্ট তাদের, কে কোথায় নেবে তুলে!
কাগজে লিখছে পৃথিবী খুলছে, ওরা দেখে বন্ধ –
আকাশে উড়ছে চিল শকুনেরা, কখন মারবে ছোঁ।
ওদের কোথাও যাবার আছে কি? আশ্রয় আছে আইনে?
শেয়ালে শকুনে ফের ঠোকরায়, ফেলে রাখে রেললাইনে।
তুলসীপ্রদীপ জ্বালার আগেই ছেড়ে যেতে হয় গাঁ,
এ দেহটা ওরা ছুঁয়ে দিয়েছে যে, এ দেহে হাজার ঘা!

এ পাড়াতে থ্রেট, অপমান, খোঁজো অন্য আর এক কলোনি –
দূষিত বাতাস সেখানেও ছোটে, বলে, এসব তো বলো নি!
তাকে নিয়ে ফের কাটাছেঁড়া করে পাড়ার টাইমকল;
বাড়িওলা বলে, এই মেয়েদের রাখা যায় নাকি, বল!
কোথায় যাবে সে, কোনখানে মেলে এতটুকু আশ্রয়?
শেয়াল-শকুন, নাকি প্রতিবেশী, কোনটাকে কম ভয়?
কী ভুল করেছে, এ বিষ ছড়ানো, এ সব কাদের পাপ?
আগুনও এদের চেয়ে আরও বেশি ছাড়ে নাকি উত্তাপ!

মেয়েটা মাত্র ষোল বছরের, বাড়ি মধ্যমগ্রাম,
নতুন বছর দেখতে পেলো না, মুছে গেল তার নাম।

৩ জানুয়ারি ২০১৪

প্রশাসন ~ অনামিকা

ধৃতরাষ্ট্র আদেশিল, হে মিত্র সঞ্জয়
প্রেস ডেকে ব্রিফ করো, করো মন জয়।
ক্ষমতায় অন্ধ আমি বক্তৃতাতে দড়
যা হুকুম করি সে'টা মন দিয়ে করো।
সচিব মুখ্য তুমি। তোমারই একার
এ'কঠিন কার্য। তর্ক কোরো না বেকার।
কঠিন কুরুক্ষেত্রে মজাদার গদি
ভোগে যাবে তুমি এবে বেঁকে বস যদি।
ডেড বডি রাজনীতি, তাপসী মালিক
খুবই যে মন্দ ছিল কোরো না তা' লিক।
নিজে যা করেছি… মেতে ছিলাম যা নিয়ে
সেই রাজনীতি মন্দ বল তা' বানিয়ে।
আইএএস মুখ খুললে মিডিয়া তা শোনে
তুমি প্রশাসন, যাও অনৃত ভাষণে।
ঠিকঠাক কাজে জেনো পুরস্কার মেলে।
অবসর নিলে হবে এমপি বা এমএলএ।

বৃহস্পতিবার, ২ জানুয়ারী, ২০১৪

উল্লাস ~ কৌশিক সেনগুপ্ত

মধ্যমগ্রামের হারিয়ে যাওয়া মেয়েটির প্রতিঃ



বর্ষ শেষের রাত,
একটু পরেই নতুন বছর দরজায় সাক্ষাৎ,
রঙ্গিন জল আর গানের তালে তালে,
নানান প্রান্তে শরীরগুলো ক্রমশ উঠেছে দুলে।
সেই শহরের হাস্পাতালের ভিতর,
তোমার শরীর ধীরে ধীরে ঠিক তখনই হচ্ছে নিথর।
নতুন বছর পাওয়ার লোভে ঘুরেছে কাঁটাও ঘড়ির,
চোখের সামনে ভেসেছে ততই তোমার দগ্ধ শরীর।
প্রশ্ন তুলেছে তোমার শোয়ানো লাশ,
বাইরে কিসের বাজির শব্দ, কিসের এত উল্লাস?
তোমায় ছাড়াই পেরিয়ে গেলাম পুরানো বছর সদ্য,
বলতে গিয়েছি, বলতে পারিনি, শুভ দুহাজার চোদ্দ।
মুছে গেছে সব, শুধু রয়ে গেছে তোমার প্রতিবাদ,
চেষ্টা করেও ঢাকতে পারেনি,
বর্ষ শেষের রাত।

বুধবার, ১ জানুয়ারী, ২০১৪

স্বীকারোক্তি ~ প্রকল্প ভট্টাচার্য

পিশাচেরা আজও রক্তই চায়, আঁটে শোষণের ফন্দি।
আমাদের হাতে চুষিকাঠি দিয়ে ব'লে যেন কাজে মন দিই।
এভাবেই যদি বেঁচে থাকি, তবে
আগামী হত্যা আমাদেরই হবে।

স্বীকারোক্তির প্রশ্ন ওঠেনা, আমার জবান বন্দী।