শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০১৯

উন্নয়ন ~ অভিজিৎ মজুমদার

ভয় পেও না, ভয় পেও না, তোমায় আমি মারব না, 
উন্নয়নের বিয়াল্লিশে, একটি সিটও ছাড়ব না। 

মনটা আমার বড্ড নরম, হাড়ে আমার রাগটি নেই,
তাই না হলে এমনি এমনি মশলামুড়ির ভাগটি দেই? 

মাথা আমার গরম দেখে ভয় পেলে ভাই, লক্ষীটি?
অক্সিজেনের অভাব ওটা, মারি না কাকপক্ষীটি। 

এই যে দেখ ভোটিং মেশিন, ভোট দিয়ে যাও দু-চার ছয়
মিষ্টি করে বলছি তোমায়, কিন্ত তবু পাচ্ছো ভয়? 

দেব না কি মুন্ডু কেটে? জ্বালিয়ে দিয়ে ঘরবাড়ি?
ভোট দেওয়া না প্রাণ বাঁচানো? কোনটা বেশী দরকারি? 

আমি আছি, কেষ্টা আছে, আছে আমার নয় ছেলে, 
ঘরের ভেতর ঢুকিয়ে দেব, মিথ্যে এমন ভয় পেলে।

বামকে ভোট দিয়ে কী হবে ~ প্রতিভা সরকার

স্পষ্ট কথায় কষ্ট নেই। 

অনেকেই বলছেন, ছি ছি বাঙালী, দেশের সর্বত্র এখন শান্তিতে ভোট হয়, ঘরে আগুন লাগানো, বুথ জ্যাম বা হাঁসুয়া দিয়ে পেট ফাঁসিয়ে দেওয়া কোথায় হয় ? সর্বত্র শান্তিপূর্ণ ভোট হলে পশ্চিমবঙ্গের কপালে এই দুর্ভোগ কেন ? এই প্রশ্নকারীদের অনেকেরই মনে মনে বাসনা একবার বিজেপিকে ভোট দিয়ে দেখি কী হয়। 

একটু ভাবলেই পরিষ্কার হয় যে, যে ফ্যাক্টরটির কারণে অভূতপূর্ব সন্ত্রাস ক'রে পঞ্চায়েত ভোটে ৩৪% আসনে বিরোধীদের প্রার্থী দিতে না দিয়ে শাসকদল নির্বাচনের আগেই দিব্যি জিতে যায় তা হচ্ছে বামশক্তির উপস্থিতি এবং পাছে সে শক্তি ফিরে আসে সেই আতঙ্ক। 
 
ত্রিপুরাতে বামখতম অভিযানে সাফল্য পেয়েছে দক্ষিণপন্থীরা। তাই চাকুরেদের মাইনের ব্যবস্থা করতে না পারলেও সেখানে তথাকথিত শান্তিতে ভোট হয়। যদিও এবার ত্রিপুরা পশ্চিমে প্রায় ৪৫০টি বুথে সিসি ক্যামেরা অচল করে রাখা হয়েছিল। আর দেদার ছাপ্পা ভোট নির্বাচন কমিশনকেও এতো হতবুদ্ধি করে দিয়েছে যে পুনর্নিবাচনের ব্যাপারে এখনো কোন সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়নি। 

কেরালা শক্ত ঘাঁটি, ফলে পশ্চিমবঙ্গে কোনভাবেই যেন বাম আস্কারা না পায় সেব্যাপারে দাদাদিদি একমত। জন্ম থেকেই আর এস এসের তিন শত্রু - কমিউনিস্ট, মুসলমান এবং দলিত। রীতিমতো মিটিং করে ঠিক হয়েছে বামেদের পিষে মারো। অন্তর্জালে সে লিংক দেদার ঘুরে বেড়াল এই ক'দিন। কেন্দ্রীয় বাহিনীর দয়ালু ব্যবহারেও তা প্রমাণিত। ফলে পশ্চিমবঙ্গে লাগামছাড়া সন্ত্রাস ভবিতব্য। টিয়ারুলরা ভোট দিতে এসে মরুক, প্রার্থীকে নির্বাচনকেন্দ্রের বাইরে ঘিরে ফেলুক সশস্ত্র ভোটসন্ত্রাসীরা, কিন্তু বামের এক ইঞ্চি অগ্রগতিও রুখতে হবে। এতো কান্ডের পরেও যে বামের মনোবল ভাঙে না, শত অত্যাচার সহ্য করেও তার সমর্থকরা কানায় কানায় ভরিয়ে তোলে ব্রিগেডের মাঠ, সেই বামকে রুখতে হবে যে কোন মূল্যে এই হল সোজা হিসেব। এই ব্যাপারে ছোট ফ্যাসিস্ট, বড় ফ্যাসিস্টে কোন মতপার্থক্য নেই।    

অথচ বাম ছাড়া এ দেশের গতি নেই। সেটা ইউপিএ১ এর শাসনকালে ভালভাবেই প্রমাণ হয়েছে। আত্মবিস্মৃত বলে আমরা ভুলে যাই, আমাদের ভুলিয়ে দেবার প্রাণপণ চেষ্টাও চলে। যত জনকল্যানকর প্রোগ্রামের ক্রেডিট নেবার জন্য দাদা এবং দিদিরা এখনও দৌড়োদৌড়ি করে, তার বেশিরভাগই ২০০৪-২০০৯ এই সময়সীমায় রূপায়িত হয়েছে। এবং তার সবগুলোই হয়েছে পার্লামেন্টে বামের জোরদার উপস্থিতির কারণে। নাহলে মুক্তবাজারী আর উদারীকরণের দিকে ঝুঁকে পড়া কংগ্রেস সরকারের কোন নৈতিক দায় ছিল না সারা দেশ জুড়ে কৃষকের ঋণ মকুব করার, ১০০দিনের কাজ চালু করা, শিক্ষার অধিকার, অরণ্যের অধিকার এবং তথ্যের অধিকার চালু করা। এই অধিকারভিত্তিক আইনগুলি বাস্তবায়নে সরকার বাধ্য বলেই এখন প্রাণপণ চেষ্টা চলছে সেগুলিকে পালটে দেবার, নিদেনপক্ষে লঘু করার। ২০০৪ থেকে ২০০৯ একটিও বেসরকারীকরণের ঘটনা ঘটেনি। যেই বাম সরে দাঁড়ালো আবার বেসরকারিকরণের মরশুম শুরু হল। 

ঘৃণার রাজনীতিতে ছুপা রুস্তম সব রাজনৈতিক দল। পয়লা বৈশাখী আম মিষ্টি কুর্তা সে কথাই বলে। ব্যতিক্রম শুধু বাম। দলবদলের ঘোড়া কেনাবেচায় যত মুখ দেখা যায় তার মধ্যে সবচেয়ে কম চোখে পড়ে বাম সাংসদ বা বিধায়কের মুখ। 

তবু প্রশ্ন ওঠে বামকে ভোট দিয়ে কী হবে ! মানুষের মতো বাঁচতে চাই, চূড়ান্ত বেকারির হতাশা থেকে সন্তানকে বাঁচাতে চাই, দেশের বিক্রি হয়ে যাওয়া আটকাতে চাই, কৃষকের আত্মহত্যা বন্ধ করতে চাই, শ্রমিকের ন্যায্য মজুরি চাই, সম কাজে সম বেতন চাই, নারীর সমানাধিকার চাই, সাম্প্রদায়িক বিভেদের রাজনীতির বিলোপ চাই,সমস্ত প্রান্তিক মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা হোক চাই। এতো চাই-য়ের লম্বা লিস্টি নিয়ে বামশক্তি ছাড়া আর কার কাছে যাওয়া যেতে পারে ? 

আছে নাকি আপনার কাছে আর কোন ঠিকানা?

শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০১৯

আপনার বাচ্চার পটেটো চিপসে রক্ত ~ কনিষ্ক ভট্টাচার্য্য

শকুবাই ওয়াগলেকে মনে আছে?

চাষের জল আর ফসলের ন্যায্য দামের জন্য যে কৃষক মহিলা ফোসকা পড়ে ছাল উঠে যাওয়া ক্ষতবিক্ষত পা নিয়ে মহারাষ্ট্রের নাসিক থেকে মুম্বাইয়ের আজাদ ময়দান অবধি হেঁটেছিলেন। যে কৃষক লং মার্চ বহু বহুবছর বাদে কৃষকের সমস্যাকে মধ্যবিত্তের আলোচনার পরিধিতে এনেছিল। তাদের সব দাবি কিন্তু এখনো পূরণ হয়নি।

এর মাঝে ভোটরঙ্গ চলছে দেশজুড়ে। কে বড়ো চোর, কে বেশি মিথ্যেবাদী, নেতানেত্রীদের সেইসব ইতর বচন আপনার কানে উগড়ে দিচ্ছে মিডিয়া। 

কিন্তু দরকারি খবরটা আপনার কাছ থেকে দায়িত্ব নিয়ে লুকিয়ে রাখছে কর্পোরেট মিডিয়া।

আপনার বাচ্চা পটেটো চিপস খেতে খুব ভালোবাসে না? লে'জ পটেটো চিপস! আসুন দেখি লে'জ চিপসের কোম্পানি 'পেপসি কো' এদেশে কী করছে। 

'পেপসি কো' গুজরাটের ৯ জন ক্ষুদ্র কৃষকের বিরুদ্ধে জনপ্রতি ১০,৫০০,০০০ (১কোটি ৫লক্ষ) টাকা করে দাবি করেছে কেবল নিজের জমিতে আলুর একটি প্রজাতি চাষ করার জন্যে। এই নিয়ে আমেদাবাদ হাই কোর্টে কেস চলছে। 

'পেপসি কো'র করা এই কেস সরাসরি এদেশের 'ফসলের বৈচিত্র্য রক্ষা এবং কৃষক অধিকার আইন ২০০১'- কে লঙ্ঘন করে। এই আইনে স্পষ্টত উল্লেখ করা আছে যে এ দেশের  কৃষক ব্র্যান্ডেড বীজ ব্যতীত তাঁর ক্ষেতের ফসল এবং বীজের বৈচিত্র্য  সংরক্ষণ, ব্যবহার, বপন, পুনঃবপন, আদান-প্রদান, বিক্রি করতে পারেন। 

'সারা ভারত কৃষক সভা' দাবি করেছে, 'পেপসি কো'কে এখনই এই কেস তুলে নিতে হবে এবং ভারতের কৃষকদের কাছে ক্ষমা চাইতে হবে।

কৃষক সভা এবং অন্যান্য কৃষক সংগঠন ইতোমধ্যে 'উদ্ভিদ বৈচিত্র্য রক্ষা এবং কৃষক অধিকার কর্তৃপক্ষ'র (PPV&FRA) কাছে জরুরি ভিত্তিতে হস্তক্ষেপ করতে বলেছে। 

বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা রাজত্বে বহুজাতিক কোম্পানির শোষণের এটা একটা পরীক্ষামূলক কেস। এই কেস কর্পোরেট জিতলে ভারতের কৃষক ও কৃষির সমূহ বিপদ। এখনই তারা জল কেড়ে নিয়েছে। সারের দাম তারা ঠিক করছে। তখন কর্পোরেট ঠিক করে দেবে কৃষক কী চাষ করবেন, কীভাবে করবেন। 

কর্পোরেটের স্বার্থে কাজ করা এই নব্য উদারবাদী নীতিকে পরাস্ত করার জন্যে সমস্ত কৃষক, শ্রমিক, কর্মচারী আজ একসঙ্গে প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে না তুললে এই দেশ গোটাটা কর্পোরেটের হাতের পুতুলে পরিনত হবে। 

'পেপসি কো' পটেটো চিপস বয়কট করুন। পেপসি কো' বাধ্য করুন এই কেস তুলে নিতে। আপনার সন্তানকে বলুন তার ভাতটা যে চাষি ফলান সেও তার বাবা-মা, কাকা-জেঠা, মামা-মাসির মতোই একটা কাজ করেন। এ দেশের আইন মেনে করেন। কর্পোরেট আজ তার কাজটা কেড়ে নিলে কাল তার বাবা-মা, মাসি-পিসির কাজটাও থাকবে না।

আপনার সন্তানের হাতে আপনার দেশের কৃষকের রক্তে নোনতা চিপস তুলে দেবেন না।

বলুন প্লিজ। 

সময় খুব কম।

#Boycott_PepsiCo
#Boycott_Lays

বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০১৯

ইসলামিক মৌলবাদ ~ অনির্বাণ অনীক

১৯৫৮ সাল, কায়রোর রাজপথ । মঞ্চে দাঁড়িয়ে হাসছেন গামাল আবদেল নাসের। মিশরের জননায়ক । হাসছে মঞ্চের সম্মুখের সারিবদ্ধ জনতা । দিচ্ছে হাততালি । জনতার মুখরিত সখ্যের নদীতে ভেসে চলেছেন সুপুরুষ নাসের । ধুয়ে দিচ্ছেন মুসলিম ব্রাদারহুডের খোয়াবনামা । কবছর আগেই কায়রো শহরে তীব্র বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে মুসলিম ব্রাদারহুড । বোমা বিস্ফোরিত করে তোলপাড় করেছে থিয়েটার , হোটেল , নাইট ক্লাব , মিউজিয়াম - আধুনিক সভ্যতার যত বিজয়রথ । না , তখনো মুজাহিদিনদের পেছনে আমেরিকা এসে হাজির হয়নি । বারবাক কারমাল , নাজিবুল্লাহদের পশ্চিমী মদতপ্রাপ্ত ইস্লামিস্টদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের দিন তখনো বহু দূর । জনতার সামনে নাসের দিয়ে চলেছেন মুসলিম ব্রাদারহুডের নেতার সাথে তাঁর মোলাকাতের জবানবন্দী । বলছেন - ব্রাদারহুডের নেতা তাকে প্রস্তাব দিয়েছেন মিশরের প্রতিটি নারীর হিজাব পরিধান বাধ্যতামূলক করতে । তিনি উত্তর দিয়েছেন - আপনার মেয়েটিকে সেদিন দেখলাম মেডিসিন পড়তে যাচ্ছে । মাথায় হিজাব দিতে তো দেখলাম না । ব্রাদারহুডের নেতা দুঃখ করে বলেছেন তাকে পশ্চিমী ভাবধারা থেকে বাগে আনতে তিনি ব্যর্থ । তাই ভবিষ্যতের নারীদের আধুনিক সভ্যতার প্রভাবমুক্ত করতে তাঁর চাই বাধ্যতামূলক হিজাব । মিশরের রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে নাসেরের হাতেই বর্তায় সেই গুরুদায়িত্ব । নাসের শুনে হেসেছেন । বলেছেন - আপনি একটি মেয়েকেই হিজাব পরাতে অপারগ , আর আমাকে বলছেন দেশের লক্ষ লক্ষ মেয়েকে হিজাব পরাতে বাধ্য করতে ? হাততালিতে মুখরিত হয়ে উঠলো সভাস্থল । অস্তাচলে যেতে থাকা সূর্যের আলোর ধারায় নীল নদের বুকে তখন গোধূলির স্নিগ্ধ রং ।

আসুন টাইম মেশিনে চড়ে ঘুরে আসি বিংশ শতকের সূচনায় আঙ্কারার রাজপথে । বিজয়রথ ছুটিয়ে চলেছেন কামাল আতাতুরক । বন্ধ করছেন আরবি নাম রাখার চল । মাতৃভাষার নরম আলোর ছটায় আলোকিত করছেন মানুষের মন । আরবির পরিবর্তে বাধ্যতামূলক করছেন মাতৃভাষা শিক্ষা । মোল্লা, মৌলবি , ইসলামিক শিক্ষার পরিবর্তে বাধ্যতামূলক করছেন আধুনিক শিক্ষা । প্রবল প্রতিবাদের মুখেও উদ্ধত মেরুদণ্ডের ঋজুতা । এনলাইটেনমেন্টের আলোয় ধুইয়ে দিচ্ছেন ১৪০০ বছর আগের অন্ধকার ।

দেখে নি ৫'এর দশকের সূচনার ইরান । জনতার জয়ধ্বনিতে মুখরিত শত শত বছরের ইতিহাস বিজড়িত তেহরানের রাজপথ । ভারতের সাথে শত শত বছরের সুখে দুঃখে জড়িয়ে থাকা প্রাচীন পারস্য । রক্তপতাকায় ঢেকে গেছে শহরের প্রতিটি প্রান্তর । জনতার বিপুল সমর্থনে জয়লাভ করেছেন বামপন্থী মোসাদেগ । তখনো অজানা , আমেরিকার চক্রান্তে অনুষ্ঠিত হতে চলেছে বিংশ শতাব্দীর অন্যতম ক্যু-দেতা । কিছুদিন বাদেই অপসারিত হবেন সেদিনের ইরানীয় গণমানুষের অবিসংবাদিত নেতা মোসাদেগ । অধিষ্ঠিত হবেন মার্কিন মদতপুষ্ট কিন্তু সেকুলার শাসক পারস্যের শাহ । আর বছর পঁচিশেক বাদেই সেকুলার সংস্কারে ক্ষুব্ধ হবে ইসলামিক নেতৃত্ব । ধর্মীয় কঠোরতা রূপায়নের তাগিদে অর্থনৈতিক সমস্যার উপর ভর করে উঠে আসবে সবুজ পতাকার ঢল । ইরানের মাটিতে নিশ্চিনহ হবে রক্তপতাকারও শেষ অস্তিত্ব । আমেরিকা বুঝে যাবে চিলি , ভিয়েতনাম বা মেক্সিকোর পথ নয় । পারস্যের শাহের মত ক্যু-দেতা করে বসিয়ে দেয়া সেকুলার বিকল্প নয় , মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বিশ্বে বামপন্থা হঠানোর সেরা ঢাল ইস্লামিজম ।

গুটি গুটি পায়ে চলে এসেছি ৮'এর দশকের আফগানিস্তান । প্রাচীন ভারতীয় সংস্কৃতির সাথে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত গান্ধার । স্বপ্ন দেখছেন বারবাক কারমাল - স্বপ্ন দেখছেন নাজিবুল্লাহ - রুক্ষ শুষ্ক মাটিতে ১৪০০ বছর আগের বন্ধ্যাত্ব কাটিয়ে আধুনিকতার আবাদ । আফগান ইস্লামিস্টরা সন্ত্রস্ত । আমেরিকাও সন্ত্রস্ত - না আধুনিকতার আবাদের জন্য নয় । ওরা কমিউনিস্ট । ওরা সোভিয়েতের সহযোগী । কোল্ড ওয়ারের সময় । পাক-আফগান-রুশ-ভারত সীমান্তে সে এক ভয়ানক বিষয় । ততদিনে বুঝে গেছে আমেরিকা । মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বিশ্বে বামপন্থা হঠানোর সেরা ঢাল ইস্লামিজম । মুজাহিদিন , তালিবান । আমেরিকার প্রিয় পাত্র । নাজিবুল্লাহর দেহটা ল্যাম্পপোস্টে ঝোলার দিনে যারা নিউ ইয়র্ক টাইমসের প্রথম পাতায় মুক্তিযুদ্ধের অগ্রদূত ।

চলে এল সেই দিন । মডারেট ন্যাশনালিস্ট বা বামপন্থী শক্তিগুলোর হাত থেকে লড়াইটা চলে গেল ক্রমশ ইস্লামিস্ট এক্সট্রিমিস্টদের হাতে । প্যালেস্টাইনের ইয়াসের আরাফতদের হাত থেকে কর্তৃত্ব চলে গেল হামাসের হাতে । আফগান ওয়ারের পর মুজাহিদিনদের অধক্ষেপ ঢুকে পড়ল ভারতের কাশ্মীরেও । মডারেট ন্যাশনালিস্টদের হাত থেকে হুরিয়ত হয়ে ঢুকে পড়ল লস্কর ই তইবারা । বদলে গেল আন্দোলনের চরিত্র ।

এবার আমেরিকা ব্রিটেনদের এই কূটকচালী না থাকলে কি ইসলামী মৌলবাদ থাকত না ? নিশ্চয় থাকত । ইসলামিক মৌলবাদের কার্যকারিতা , মানুষের উপর তার প্রভাব ইত্যাদি আঁচ করেই তো এই শক্তিগুলি এককালে নিজ নিজ অর্থনৈতিক স্বার্থ পূরণের স্বার্থে ইসলামিস্ট দানবের সাথে হাত মিলিয়েছিল । ওয়াহাবী , সালাফী, দেওবন্দী বিবিধ নামের কট্টর গোষ্ঠীগুলির মধ্যেই রয়েছে মৌলবাদের বীজ । ৭১'এর আগের পূর্ব পাকিস্তান , পরবর্তীকালে বাংলাদেশের মাটিতেও হয়েছে ভয়াবহ মৌলবাদের চাষ , সন্ত্রাসের আবাদ । রক্তাক্ত হয়েছে বাঙালী জাতিটাই । এর সূচনায় তো নেই পশ্চিমী মদতের কোন অবদান । ভিয়েতনামে আমেরিকা বৌদ্ধ মৌলবাদ দিয়ে কাজ হাসিল করার চেষ্টা করেনি । কিউবাতে ক্রীস্টান মৌলবাদ দিয়ে কমিউনিজম প্রতিহত করার চেষ্টা করেনি । অথচ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বিশ্বে সহযোগী তার ইস্লামিজম । কিন্তু , ইসলামিক দানবের অস্তিত্ব থাকলেও এদের দেশগুলির অভ্যন্তরেই গত শতকের মধ্যভাগ থেকে যে সেকুলার/সমাজতান্ত্রিক/ জাতীয়তাবাদী শক্তিগুলি বৃদ্ধি পাচ্ছিল তারা অন্তত লড়াইটা করতে পারত । বর্তমানে সেই শক্তিগুলি বিধ্বস্ত ।

সম্প্রতি আমেরিকা পুণরায় ইরানের তেলের ভাণ্ডারের দখল নিতে উদ্গ্রীব হয়ে উঠেছে । 
"ইরান কে ভাতে মারার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইরানের চারপাশে এক দৃশ্যমান ও শক্তিশালী প্রভাব বলয় তৈরি করেছে।কার্যত সামরিক, আর্থিক ও সাংস্কৃতিক অবরোধ তৈরি করেছে । মূল লক্ষ্য ইরানকে আর্থিক ও কূটনৈতিক ভাবে নিঃসঙ্গ করা। ভারত, চীন, জাপান, তুরস্ক, মেক্সিকো, ইতালি, গ্রিস,দক্ষিণ কোরিয়াকে কার্যত হুমকি দিয়ে ইরানের থেকে অপরিশোধিত তেল কেনার জন্য চাপ দিতে শুরু করেছে।ভারতকে যেহেতু জ্বালানির জন্য ইরানের ওপর নির্ভর করতে হয় ,এককথায় ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করা সম্ভব নয়।দ্বন্দটা এখানেই।একদিকে চীনের সঙ্গে পাকিস্তানের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক ক্রমশ মজবুত হয়েছে।চায়না ,পাক ইকোনোমিক করিডোর ভারতের কাছে তার স্বার্বভৌমত্বের জন্য বিরাট চ্যালেঞ্জ।পাশাপাশি সুদীর্ঘ দিন ধরে চাবাহর বন্দরকে দিল্লি নিজেদের ভুসামরিক স্বার্থের জন্য ব্যবহার করার প্রস্তুতি নিয়েছে।ইরানের থেকে জ্বালানী কেনা বন্ধ করার অর্থ মধ্যএশিয়ার ওপর কতৃত্ব ও পাক চীন দ্বিপাক্ষিক অক্ষের পাল্টা জোট হিসেবে ইরান-আফগানিস্তান-ভারতের মৈত্র দুর্বল হওয়া।"

" ইরানে যুদ্ধের দামামা বাজলে আপনি আক্রান্ত হবেন কি করে?উপসাগরীয় অঞ্চলে নতুন সংঘাতের অর্থ সেই যুদ্ধে সৌদি , সংযুক্ত আমিরশাহীর মতো দেশগুলোর যুদ্ধে আর্থিক ভাবে জড়িয়ে পড়া।সেদেশের তেলের উৎপাদনের মূল্য বাড়লে আপনার আমার রান্না ঘরে তার প্রভাব পড়বেই।পড়তে বাধ্য। শুধু তাই নয়, মনে রাখবেন আফগান ওয়ারের পর মুজাহিদিনদের অধক্ষেপ ঢুকে পড়েছিল ভারতের কাশ্মীরেও । বদলে দিয়েছিল আন্দোলনের চরিত্র । বাড়িয়েছিল আপনার দেশেরই প্রতিরক্ষা বাজেট । সাম্রাজ্যবাদ , নয়া ঔপনিবেশিক শক্তি শুধু রান্নাঘরে হানা দেয় না,কৌশলে তৃতীয় বিশ্বের রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা বাজেট বাড়ায়।তার কোপ পরে স্বাস্থ্য,প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা হয়ে জনমুখী প্রকল্পে।"

বামপন্থী মোসাদেগকে অন্যায় ভাবে অপসারিত করে আমেরিকা যে বদমাইশির সূচনা করেছিল সেই মুকুটে যুক্ত হতে চলেছে আরেকটি নতুন পালক ।

পুনশ্চ - আপনি কমিউনিজমের সমালোচনা করতেই পারেন । কমিউনিস্ট দেশে গণতন্ত্রের অভাব নিয়ে আলোচনাও করতে পারেন (মানে অন্য দেশেও গণতন্ত্রের বহু সমস্যা দেখা যায় , কিন্তু অন্য দেশে আছে বলে কমিউনিস্ট দেশে গণতন্ত্রের অভাব থাকবে সেটাও কোন কাজের কথা না ) । আলোচনা করতেই পারেন আরব ন্যাশনালিস্ট বা কমিউনিস্ট শক্তিগুলির বিশ্ব বাজার থেকে মুখ ঘুরিয়ে থাকাটা ইন দ্য লঙ রান আদৌ কোন ফলপ্রসূ বিষয় ছিল কিনা । আপনি সাম্প্রতিক কালের এক শ্রেণীর বিপ্লবী বাম লিবেরাল শক্তির ইসলাম-প্রেম নিকষিত-হেম'এর সমালোচনাও করতেই পারেন । কিন্তু সেই কারণে ইঙ্গ-মার্কিন শক্তির ইস্লামিস্ট দানবের সাথে হাত মিলিয়ে পথযাত্রাটি তো অস্বীকার করতে পারবেন না । ইস্লামিজমকে অস্বীকার করা যেমন অপরাধ , তেমনি এই সত্য স্বীকার না করাটাও সত্যের অপলাপ । মুক্তচিন্তার সাথেই বৈরিতা ।


গ্রামীণ চিকিৎসকদের না নিয়ে সবার জন্য স্বাস্থ্য-এর স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করা যাবে না ~ পুণ্যব্রত গুণ

১৯৭৭-এ তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের আলমা আটায় প্রাথমিক স্বাস্থ্যপরিষেবা নিয়ে এক কনফারেন্সে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা '২০০০ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে সবার জন্য স্বাস্থ্য'-এর লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিল অর্থাৎ সকল দেশের সরকার ঐ সময়ের মধ্যে নিজ নিজ দেশের সমস্ত নাগরিকের স্বাস্থ্যরক্ষার দায়িত্ব নেবে। আলমা আটার ঘোষণা পত্রে স্বাক্ষরকারী দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল ভারত। ২০০০ খ্রীষ্টাব্দের পর ১৫ বছর কেটে গেছে, তবু আমাদের দেশে এই লক্ষ্য অধরা।  

এমনই এক প্রেক্ষাপটে দ্বাদশ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার আগে ২০১০-এ ভারতের যোজনা কমিশন সবার জন্য স্বাস্থ্য-পরিষেবা নিয়ে এক উচ্চ-স্তরীয় বিশেষজ্ঞ দল (High Level Expert Group on Universal Health Coverage) নিয়োগ করে। পাব্লিক হেলথ ফাউন্ডেশন অফ ইন্ডিয়ার প্রধান ডা শ্রীনাথ রেড্ডির নেতৃত্বাধীন এই বিশেষজ্ঞ দল ২০১১-এ স্বাস্থ্যমন্ত্রীর কাছে তার সুপারিশ পেশ করে। 

উচ্চস্তরের বিশেষজ্ঞ দল যেসব বিষয় নিয়ে বিবেচনা করে, সেগুলো এরকম—
1. মানব সম্পদের প্রয়োজন
2. চিকিৎসা-পরিষেবা নাগালে আনা
3. ব্যবস্থাপনায় সংস্কার
4. জনসমুদায়ের অংশগ্রহণ
5. ওষুধপত্র নাগালে আনা
6. স্বাস্থ্য-পরিষেবায় অর্থের যোগান
7. সামাজিক যে বিষয়গুলো স্বাস্থ্যকে প্রভাবিত করে।
 
এই উচ্চ-স্তরীয় বিশেষজ্ঞ দল ইউনিভার্সাল হেলথ কভারেজ অর্থাৎ সবার জন্য স্বাস্থ্য-এর সংজ্ঞা নিরূপণ করেন এভাবে—আয়ের স্তর, সামাজিক অবস্থান, লিঙ্গ, জাতি বা ধর্ম নিরবিশেষে দেশের যে কোন অংশে বসবাসকারী সমস্ত ভারতীয় নাগরিকের জন্য যথাযথ খরচের, দায়বদ্ধ ও সঠিক, নিশ্চিত গুণমানের স্বাস্থ্য-পরিষেবার (উন্নয়নমূলক, প্রতিরোধমূলক, নিরাময়মূলক ও পুনরবাসমূলক) সমান লভ্যতা নিশ্চিত করা, ব্যক্তিদের ও জনসমুদায়গুলোকে স্বাস্থ্যের বৃহত্তর নির্ণায়কগুলোকে নির্ধারণ করে এমন জনস্বাস্থ্য পরিষেবা দেওয়া—, সরকার এসব স্বাস্থ্য ও স্বাস্থ্য-সম্পর্কিত পরিষেবার ব্যবস্থা করবেন এবং নিশ্চিত করবেন, যদিও সরকারই একমাত্র পরিষেবাপ্রদানকারী হবেন—এমনটা নয়।

সরবজনীন স্বাস্থ্য পরিষেবার যে নির্দেশক নীতিগুলো উচ্চ-স্তরীয় বিশেষজ্ঞ দল স্থির করেন, সেগুলো এরকম—
• পরিষেবা সবার জন্য, 
• পরিষেবা সবার জন্য সমান, 
• কাউকে বাদ দেওয়া হবে না আর কারুর প্রতি বৈষম্য করা হবে না,
• পরিষেবা হবে যুক্তিসঙ্গত ও ভালো গুণমানের, 
• আর্থিক সুরক্ষার ব্যবস্থা থাকবে,
• রোগীর অধিকারগুলোকে সুরক্ষা দেওয়া হবে, 
• সরকারী স্বাস্থ্য-পরিষেবা মজবুত করা হবে,   
• পরিষেবায় দায়বদ্ধতা ও স্বচ্ছতা থাকবে, 
• নীতি-নির্ধারণ ও পরিচালনায় জনসমুদায়ের অংশগ্রহণ থাকবে।

তাঁরা সরকারী পরিসংখ্যান উদ্ধৃত করে বলেন কেন স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে সংস্কার জরুরী—
 যাঁদের হাসপাতালে ভর্তি হতে হয় তাঁদের ৪০%-এরও বেশী ক্ষেত্রে চিকিৎসা করাতে ধার নিতে হয় বা সম্পত্তি বিক্রি করতে হয়।
 গ্রামীণ এলাকায় ১৮% ও শহরী এলাকায় ১০% অসুখের কোনও চিকিৎসা হয় না।
 গ্রামীণ এলাকার ১২% ও শহরের ১% বাসিন্দা চিকিৎসা কেন্দ্রে পৌঁছতেই পারেন না।
  ২৮% গ্রামবাসী ও ২০% শহরবাসীর চিকিৎসা করানোর পয়সাই নেই।
  হাসপাতালে ভর্তি মানুষদের ৩৫%-এরও বেশী হাসপাতালের খরচের ভারে দারিদ্রসীমার নীচে চলে যান।
  জনসংখ্যার ২.২%-এর বেশী হাসপাতালের খরচের ভারে গরীব হয়ে যান।
  নাগরিকদের অধিকাংশ যাঁরা স্বাস্থ্য-পরিষেবার সুযোগ নিতে পারেন না তাঁরা কম আয়ের মানুষ।

গ্রাম-শহরের বৈষম্যের কথা বলতে গিয়ে তাঁরা দেখান—
৮০% ডাক্তার,৭৫% ডিস্পেন্সারী, ৬০% হাসপাতাল আছে শহরে। পাশকরা ডাক্তারের ঘনত্ব যেখানে শহরে ১০০০০ মানুষ-পিছু ১১.৩ জন, সেখানে গ্রামে ১০০০০ জনে ১.৯।
 
বিশেষজ্ঞ-দল সমস্ত নাগরিকের জন্য সারবজনীন স্বাস্থ্য-পরিষেবার প্যাকেজ-এর কথা বলেন, যাতে প্রয়োজনীয় প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চতর চিকিৎসা-পরিষেবা থাকবে, সরকার যার খরচ যোগাবে। তাঁরা বলেন—এক বিশেষজ্ঞ দল মাঝে মাঝে প্যাকেজের উপাদানগুলো ঠিক করবেন, রাজ্যভেদে প্যাকেজের উপাদানে পার্থক্য থাকতে পারে।

চিকিৎসার খরচ ও আর্থিক সুরক্ষা বিষয়ে বিশেষজ্ঞ দলের বক্তব্য ছিল—
• কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারগুলো মিলে স্বাস্থ্যখাতে সরকারী ব্যয় বর্তমানের জিডিপির ১.৪% থেকে বাড়িয়ে দ্বাদশ পরিকল্পনার শেষে অন্তত ২.৫% এবং ২০২২-এর মধ্যে অন্তত ৩% করা উচিত।
• ওষুধ কেনায় সরকারী ব্যয় বাড়িয়ে বিনামূল্যে অত্যাবশ্যক ওষুধ সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে।
• চিকিৎসা-পরিষেবার অর্থের মূল উৎস হবে সাধারণ কর, সঙ্গে যাঁরা মাইনে পান বা আয়কর দেন তাঁদের মাইনে বা করযোগ্য আয়ের অনুপাত হিসেবে অতিরিক্ত বাধ্যতামূলক অর্থ।

স্বাস্থ্য পরিষেবার জন্য মানব সম্পদ সম্পর্কে উচ্চ স্তরীয় দলের সুপারিশ—
• পরযাপ্ত সংখ্যায় বিভিন্ন স্তরে প্রশিক্ষিত চিকিৎসক ও চিকিৎসাকর্মী নিশ্চিত করা হোক, গুরুত্ব পাক প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিষেবা।
• গ্রামীণ ও আদিবাসী এলাকায় ASHA-র সংখ্যা দ্বিগুণ করা হোক, জনসংখ্যার ১০০০ পিছু ১ থেকে বাড়িয়ে ১০০০ পিছু ২।
• মাঝারি স্তরের স্বাস্থ্য কর্মী চালু করা হোক—গ্রামীণ উপকেন্দ্রগুলোতে ব্যাচেলর অফ রুরাল হেলথ কেয়ার (BRHC) প্র্যাকটিশনার ও শহরের উপকেন্দ্রগুলোতে নার্স প্র্যাকটিশনার। 

আমরা যদি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশিকা দেখি তাহলে দেখব প্রতি ১০০০০ মানুষ পিছু ২৫ জন চিকিৎসাকর্মীর সুপারিশ করা হয়েছে—অর্থাৎ ডাক্তার, নার্স, দাই, ইত্যাদি, কতজন কি তা নির্দিষ্ট করা হয়নি। আমাদের দেশে এই সংখ্যা ১০০০০জনে ১৯ জন (প্রশিক্ষিত ও অপ্রশিক্ষিত মিলিয়ে)। পাশ-করা ডাক্তারের সংখ্যা যদি দেখি তা হয়—১০০০০জনে ৬ জন। গ্রামে যেখানে ১০০০০ জনে পাশকরা ডাক্তারের সংখ্যা ৩.৯ জন, সেখানে শহরাঞ্চলে ১৩.৩ জন অর্থাৎ প্রায় চারগুণ বেশী। দেশের প্রায় ৫ লক্ষ মেডিকাল গ্র্যাজুয়েটের তিন-চতুর্থাংশ শহর বা শহরের আশেপাশে কাজ করেন, যেখানে দেশের এক-তৃতীয়াংশেরও কম মানুষের বাস। আর গ্রামীণ জনতার সামান্য প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিষেবাটুকুও নেই অধিকাংশ ক্ষেত্রে।

উত্তর প্রদেশের গ্রামাঞ্চলে এক সার্ভেতে দেখা যায়—মাত্র ৬% রোগীর চিকিৎসা করেন এমবিবিএস ডাক্তার, ২৮%-এর AYUSH ডাক্তার আর ৬৬%-এর চিকিৎসা হয় অপ্রশিক্ষিত গ্রামীণ চিকিৎসকদের হাতে।

পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ ২৪ পরগণার পাথরপ্রতিমা ব্লকের সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়—সেখানকার জনসংখ্যা প্রায় সাড়ে তিন লাখ, সরকারী ডাক্তারের সংখ্যা ১০ জনেরও কম, অথচ গ্রামীণ ডাক্তার প্রায় ৪০০ জন। একজন অসুস্থ শিশুকে সরকারী ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হয় অধিকাংশ সময় নদীপথে, সময় লাগে ৪ থেকে ৬ ঘন্টা। ফলে ৮৫% অসুস্থ শিশুকেই চিকিৎসা পেতে হয় গ্রামীণ ডাক্তারের কাছে। 
 
২০০৯-এ পশ্চিমবঙ্গের তিনটে জেলায় সার্ভে করে দেখা যায় ৫৪% গ্রামীণ মানুষ গ্রামীণ চিকিৎসকদের দ্বারা চিকিৎসিত হন। খুব সম্প্রতি ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ কলেরা এন্ড এন্টেরিক ডিজিজেজ (NICED)-এর এক সমীক্ষক-দল দেখেন মালদা জেলার গ্রামবাসীদের অর্ধেকেরও বেশী সাধারণ রোগের জন্য গ্রামীণ ডাক্তারদেরই সাহায্য নেন। 

পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান পরিসংখ্যানটা মোটামুটি এরকম—পাশকরা ডাক্তার আছেন প্রায় ৪৩ হাজার। সবার কাছে স্বাস্থ্য-পরিষেবা পাশকরা ডাক্তারের মাধ্যমে পৌছাতে হলে দরকার আরও ৬৫ হাজার ডাক্তার, বর্তমান হারে ডাক্তার তৈরী হলে আমাদের অপেক্ষা করতে হবে ২০৫৫ সাল অবধি। 

আর সমস্ত স্বাস্থ্য সমস্যার জন্য পাশকরা ডাক্তার কিন্তু জরুরীও নয়। জাতীয় গ্রামীণ স্বাস্থ্য মিশন (NRHM)-এর টাস্ক ফোর্স ২০০৭-এর রিপোর্টে বলে—মারক রোগগুলোকে প্রতিহত করার জন্য উঁচু মানের ডাক্তারী দক্ষতা বা দামী রোগ-নির্ণয় প্রযুক্তির দরকার হয় না। প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিষেবা দিয়েই এই সমস্যাগুলোর সমাধান করা যায়। আসল সমস্যা হল মানুষের কাছে প্রাথমিক স্বাস্থ্য-পরিষেবা না পৌঁছনো। 

এমবিবিএস-এর চেয়ে কম সময় যাঁরা প্রশিক্ষণ পেয়েছেন, তাঁদের ডাক্তারী দক্ষতা নিয়ে এক পরযবেক্ষণের কথা বলি। পাব্লিক হেলথ ফাউন্ডেশন অফ ইন্ডিয়ার কৃষ্ণ ডি রাও এই সমীক্ষাটা করেন ছত্তিশগড়ের এক এলাকায়। ছত্তিশগড় ও আসাম হল দেশের দুটো রাজ্য যেখানে কম সময়ের ডাক্তার তৈরীর কোর্স চালু করা হয়। অবশ্য ডাক্তার বলা হয় না, ছত্তিশগড়ে বলা হয় রুরাল মেডিকাল এসিস্টেন্ট বা আরএমএ। দেখা যায় প্রাথমিক পরিষেবায় যে রোগ বা সমস্যাগুলো দেখা যায় সেগুলো সামলাতে এমবিবিএস ডাক্তার ও আরএমএ-রা সমান দক্ষ। কম দক্ষ AYUSH চিকিৎসকরা। প্যারামেডিকাল কর্মীরা সবচেয়ে কম দক্ষ। 

বর্তমান সময় থেকে অনেক বছর পিছিয়ে যাই, নজর রাখি প্রতিবেশী দেশ চীনে। চীনে পাশ্চাত্য মেডিসিনের প্রথম স্কুল স্থাপিত হয় ১৮৮১ সালে। ১৯৪৯-এ শোষণমুক্তির আগে সে দেশে মেডিকাল কলেজ ছিল মাত্র একটা, ১৯১৬-এ স্থাপিত পিকিং ইউনিয়ন মেডিকাল কলেজ। সেই কলেজ থেকে ১৯২৪ থেকে ১৯৪২ অবধি পাশ করে বেরোনো মেডিকাল গ্র্যাজুয়েটের সংখ্যা ছিল মাত্র ৩১৩ জন, তাঁরাও মূলত বিদেশী শাসক-শোষকদের সেবায় লাগতেন। ১৯৪৯-এর পর কিন্তু শ্রমিক-কৃষকের সরকার সমস্ত নাগরিকের জন্য স্বাস্থ্য পরিষেবা সম্ভব করেছিল, তা সম্ভব হয়েছিল আধুনিক ডাক্তারদের সঙ্গে প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণহীন গ্রামীণ চিকিৎসকদের যুক্ত করে। 

পশ্চিমবঙ্গে গ্রামীণ চিকিৎসকদের যুক্তিসঙ্গত চিকিৎসায় প্রশিক্ষিত করার কাজ করে সোসাইটি ফর সোশ্যাল ফার্মাকোলজি রুরাল মেডিকাল প্র্যাকটিশনার্স' এসোশিয়েশনের সঙ্গে। কাজ করে বাঁকুড়ার আমাদের হাসপাতাল, বীরভূমে লিভার ফাউন্ডেশন। 

প্রশিক্ষিত গ্রামীণ চিকিৎসকদের ওপর এক সমীক্ষা চালান ম্যাসাচুসেটস ইন্সটিটিউট অফ টেকনোলজি-র অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়। দেখা যায়—তাঁদের চিকিৎসাপদ্ধতির মানোন্নয়ন হয়েছে, ভুল ওষুধের ব্যবহার কমেছে, রোগীদের ক্ষতি কম হচ্ছে, রোগীরাও তাঁদের ওপর আস্থা স্থাপন করছেন।  

জয়পুরের ইন্সটিটিউট অফ হেলথ ম্যানেজমেন্ট রিসার্চ-এর বরুণ কাঞ্জিলাল গ্রামীণ চিকিৎসকদের নিয়ে গবেষণা চালাচ্ছেন বহুদিন। তাঁর সুপারিশ হল—সমস্ত গ্রামীণ ডাক্তারদের নথিভুক্ত করা হোক। তাঁদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ দেওয়া হোক যাতে তাঁরা যুক্তিসঙ্গত ভাবে প্রাথমিক চিকিৎসা করতে পারেন এবং নিজের সীমা কতোটা তা বোঝেন। তাঁদের সরকারী প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলোর সঙ্গে যুক্ত করা হোক, যাতে তাঁরা সরকারী ডাক্তারদের নজরদারিতে কাজ করতে পারেন। 

আমরাও মনে করি—গ্রামীণ চিকিৎসকদের স্বাস্থ্য-পরিষেবা ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত করার মধ্যে দিয়েই চিকিৎসা-কর্মীর অভাব পূরণ হতে পারে, কিছুটা বাস্তবায়িত হতে পারে সবার জন্য স্বাস্থ্যের স্বপ্ন। 

তাছাড়া গ্রামীণ তরুণ-তরুণীদের যথাযথ স্বল্পকালীন ট্রেনিং দিয়ে স্বাস্থ্যকর্মী হিসেবে তৈরি করেও প্রাথমিক চিকিৎসার কাজ অনেকটা করানো যায়। এই বিষয়ে আমার সংগঠন শ্রমজীবী স্বাস্থ্য উদ্যোগ প্রায় দেড় দশক ধরে কাজ করে যাচ্ছে। আমার আরেক সংগঠন সুন্দরবন শ্রমজীবী হাসপাতালও প্রত্যন্ত দ্বীপে  তরুণ-তরুণীদের ট্রেনিং দিয়ে স্বাস্থ্যকর্মী রূপে গড়ে তোলার পরিকল্পনা করছে। আমাদের অভিজ্ঞতা আর আমাদের স্বপ্নের কথা বলব পরে কখনও।     

লেখক পরিচিতিঃ ডা পুণ্যব্রত গুণ এমবিবিএস শ্রমজীবী স্বাস্থ্য উদ্যোগের সংগঠক ও স্বাস্থ্যের বৃত্তে পত্রিকার সম্পাদক।

রবিবার, ২১ এপ্রিল, ২০১৯

বিজেপির কৃতিত্ব ~ কৌশিক দত্ত

ভোটের আগে বিজেপির হয়ে একটু প্রচার করি। ভারতের ইতিহাসের গৌরব গাথা, পাশ্চাত্য সভ্যতার চেয়ে আমাদের এগিয়ে থাকার কাহিনি, যা স্বদেশপ্রেমে আমাদের মথিত করবে। 

গণেশের হেড ট্রান্সপ্লান্ট, কুবেরের জেট প্লেন ইত্যাদির কথা আমরা জানি। এসব হল প্রাচীন ভারতের গৌরব। আজ বলতে চাই যে মধ্যযুগেও ভারত ছিল সর্বাগ্রগামী। আজকের পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিধর দেশ আমেরিকা কী করে এই জায়গায় পৌঁছল? কারা আমেরিকা তৈরি করেছে? কারা সেখানে পৌঁছে দিল সভ্যতার আলো? এসবের যে উত্তর আপনারা দেবেন, তা ভ্রান্ত। মিথ্যেবাদী ইউরোপীয়রা আপনাদের ভুল শিখিয়েছে। সঠিক উত্তর জানুন। আমেরিকার পত্তন করেছেন ভারত মায়ের মহান সন্তানেরাই। তার মধ্যে আবার বাঙালিদের ভূমিকা সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য। (এই কারণে বিশ্ব বাঙলার কপিরাইট হোল্ডার এবং বাঙলা পক্ষের যোদ্ধারা ক্রেডিটের একাংশ বিজেপির থেকে নিজেদের দিকে টেনে নিলে সেই অঘটনের জন্য কোং দায়ী নহে।) আপাতত আমাদের প্রতিপাদ্য প্রমাণ করতে অল্প কয়েকটি ঐতিহাসিক উদাহরণ দেব, যা থেকে ব্যাপারটা জলের মতো 'পোস্কার' হয়ে যাবে৷           

১) বাঙলায় শ্রীরাম পাঁচালি (যা রামায়ণের অনুবাদ হিসেবে সমধিক পরিচিত) রচনা করেন সাধক কবি কৃত্তিবাস ওঝা। তাঁর জেঠতুতো ভাই শ্রীনিবাস। শ্রীনিবাসের মেজো ছেলের নাম ছিল কলমবাস। তিনি প্রথম জেন্ডার ইকুয়ালিটি প্রতিষ্ঠাকল্পে বেহুলার কায়দায় কলার ভেলায় চড়ে সাগরে ভেসে পড়েন। ভাসতে ভাসতে তিনি চলে যান পশ্চিমে। সেখানে কিছু দ্বীপ আবিষ্কার করে দেশপ্রেমিক কলমবাস তার নামকরণ করেন পশ্চিম ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জ।  

২) কলমবাসের কৃতিত্বে অনুপ্রেরিত হয়ে কৃষ্ণনগরের মহারাজার শ্যালক তথা বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের খুড়শ্বশুরের অতিবৃদ্ধ প্রপিতামহ একটি আম আঁটির ভেঁপু বাজাতে বাজাতে দ্বীপপুঞ্জ ছেড়ে নিকটবর্তী মহাদেশের মূল ভূখণ্ডে উপস্থিত হন। সেদেশের প্রাচীন বাসিন্দারা বিচিত্র বাদ্যযন্ত্রটি দেখে কৌতূহল প্রকাশ করছেন মনে করে শ্যালক মহাশয় ব্যাখ্যা দাখিল করেন, "আমেরই গো ভেঁপুটি।" বাস্তবে রেড ইন্ডিয়ানদের দলপতি আগন্তুকের নাম জানতে চাইছিলেন। এই উত্তর পেয়ে তিনি ধরে নেন অতিথির নাম আমেরিগো ভেসপুচি৷ সেই নামটিই তাঁদের থেকে ইউরোপীয়দের কানে পৌঁছায় এবং ইতিহাসে স্থায়িত্ব লাভ করে। এই ঘটনার ফলেই মহাদেশটির নাম হয় আমেরিকা। 

৩) অতঃপর শীলভদ্র এবং বলভদ্র নামে নামে দুই ভাই সেখানে যান। শীলভদ্র মধ্য আমেরিকার এক দুর্গম অঞ্চলে পদার্পণ করেন। তাঁর আগমনের পূর্বরাত্রে সেখানকার রাজা স্বপ্নাদেশ পান, নতুন রাজা আসছেন, তাঁর হাতেই তুলে দিতে দেশের শাসন ভার। রাজা পরদিন ভোরবেলা উঠে "এল শীলভদ্র, এল শীলভদ্র…" বলতে বলতে নগরের সিংহদুয়ার অভিমুখে ছুটে যান এবং শীলভদ্রের পাদবন্দনা করে তাঁর মাথায় রাজমুকুট পরিয়ে দেন। সেই ঘটনা থেকে দেশটির নতুন নাম হয়, "এল শীলভদ্র।" দেবভাষা না জানা ইস্পাহানিদের উচ্চারণ প্রমাদে যা আজ "এল সালভাদর"। 

৪) বলভদ্র ছিলেন উত্তম রাঁধুনি। আমেরিকার পশ্চিম উপকুলে একটি মনোরম স্থানে তিনি প্রথম আমেরিকানদের কালি জিরা (কালো জিরে) ফোড়ন দিয়ে রান্না করা শেখান। সেই থেকে রাজ্যটির নাম হল কালিফোড়নিয়া। বলভদ্রের নামে একটি নগরের নাম হয় বেলভেদর।     

৫) ওয়াশিংটন যে পঞ্জাব দা পুত্তর ওয়াহে সিং তনবীরের নিজের হাতে প্রতিষ্ঠিত, তা নিশ্চয় নতুন করে কাউকে বলে দিতে হবে না। 

এরকম অজস্র উদাহরণ আছে, কিন্তু এখন খিদে পেয়েছে। তাই আজ এটুকুই।

শুক্রবার, ১২ এপ্রিল, ২০১৯

হল্লা বোল ~ অরিজিৎ গুহ

কমরেড সফদার হাশমি
দিল্লির সেন্ট স্টিফেন কলেজের ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্রটি পড়াশোনার ফাঁকেই কিভাবে যেন জড়িয়ে পড়েছিল এসএফআই আর আইপিটিএ র সাথে। পড়াশোনার পাশাপাশি চুটিয়ে চলত নাটকে অভিনয়। পড়াশোনা শেষ হওয়ার পর যখন সিপিআই(এম) এর সদস্য পদ পেল তখন নাটকে অভিনয়ের পাশাপাশি শুরু হয়ে গেছে কবিতা লেখা, নাটক লেখা, বাচ্চাদের জন্য গল্প লেখা। ৭০ সালের একটা পথ নাটক কাঁপিয়ে দিয়েছিল দিল্লি আর আশেপাশের অঞ্চল। একজন রাজা, তিনি যেখানেই যান, সাথে তাঁর সিংহাসনটা নিয়ে ঘোরেন। যদি কখনো সেটা বেহাত হয়ে যায় সেই ভয়ে। ইন্দিরা গান্ধীর কুর্সির প্রতি আশক্তিকে ব্যঙ্গ করে 'কুর্সি, কুর্সি, কুর্সি' নাটকটা নিউ দিল্লির বোট ক্লাবের লনে প্রতি সপ্তাহে অভিনীত হত। সেখান থেকেই উঠে আসে 'জন নাট্য মঞ্চ' বা সংক্ষেপে 'জনম' গ্রুপ তৈরি করার চিন্তা ভাবনা। ৭৫ সাল অব্দি জনম একের পর এক পথ নাটক করে গেছে যেসব নাটকের মূল সুর ছিল শ্রমজীবী মানুষ৷ সাধারণতই পছন্দ হয় নি শাসকদের। ৭৫ এ এমার্জেন্সি ঘোষণা করার পর দেশে সমস্ত রকম রাজনৈতিক অ্যাক্টিভিটি বন্ধ করে দিতে হয়। সাথে সাথে রাজনীতির গন্ধ যেখানে রয়েছে সেসবও বন্ধ করতে হয়। স্বাভাবিকভাবেই জনমের কার্যক্রমও বন্ধ হয়ে যায়৷ সেই সময়ে ইংরেজির অধ্যাপক হিসেবে গাঢ়োয়াল ইউনিভার্সিটিতে যোগ দেয় সফদার হাশমি। এমার্জেন্সি উঠে যাওয়ার পর আবার ফিরে আসে মানুষের মাঝে রাস্তায়। শুরু হয় 'আওরত', 'মেশিন' ইত্যাদির মত যুগান্তকারী পথ নাটক।
   ১৯৮৯ সালের জানুয়ারি মাসের প্রথম দিন দিল্লির কাছে গাজিয়াবাদের ঝাণ্ডাপুরে লোক ভেঙে পড়েছে সিআইটিইউ আর কিষান সভার উদ্যোগে শ্রমিক আর কৃষকদের দুর্দশা নিয়ে তৈরি পথনাটক 'হাল্লা বোল' দেখার জন্য৷ ইতিমধ্যে নাটকটার কথা ছড়িয়ে পড়েছে দিল্লি ছাড়িয়ে উত্তর প্রদেশের দারিদ্র্য সমন্বিত বিভিন্ন অঞ্চলে। খেটে খাওয়া মানুষ তাঁদের প্রতিদিনের লড়াইকে উঠে আসতে দেখছে নাটকের দৃশ্যে। কিন্তু মানুষকে এভাবে প্রভাবিত করলে যে কায়েমী স্বার্থে আঘাত লাগবেই! সেই কায়েমী স্বার্থের আঘাত তারা ফিরিয়ে দিল সফদারকে পিটিয়ে মেরে। কংগ্রেসি গুণ্ডাবাহিনী নাটকের ওপর হামলা চালাল। গাজিয়াবাদ মিউনিসিপালিটি নির্বাচনে কমিউনিস্ট পার্টির প্রার্থী রামানন্দ ঝা এর সমর্থনে চলছিল সেই নাটকের শো৷ কংগ্রেসি প্রার্থী মুকেশ কুমারের গুণ্ডার দল নৃশংসভাবে পেটাল নাটকের দলকে। ঘটনাস্থলে সাথে সাথেই মারা গেল নেপালী অভিনেতা রাম বাহাদুর। সফদারকে ভর্তি করা হল রাম মনোহর লোহিয়া হাসপাতালে। সেই রাতে হাসপাতালে এসে হাজির হয়েছিল সফদারের বন্ধু সহমর্মীরা। হাসপাতাল লাগোয়া পার্ক আর বাস স্ট্যান্ড সেদিন ভরে গেছিল মানুষে। শুধু মানুষ আর মানুষ। সফদার হাশমির টানে ছুটে এসেছে সবাই। ছুটে এসেছিল তৎকালীন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী, কিন্তু লোকের প্রবল বিক্ষোভে তিনি আর ঢুকতে পারেন নি ভেতরে।  মৃত্যুর সাথে লড়াই করে পরদিন মারা যায় সফদার। থেমে গেছিল কালের কন্ঠ। কিন্তু থামানো যায় নি হাল্লা বোলকে। দুদিন পর সেই একই জায়গায় সফদারের বন্ধু কমরেড ও স্ত্রী মলয়শ্রী হাশমি কমরেডের মৃত্যু শোক নিয়েই মঞ্চস্থ করে হাল্লা বোল। 
   সফদার বা সফদারদের আসলে মৃত্যু হয় না। ১২ ই এপ্রিল জন্মদিনটা আসলে ছুঁতো, সফদারদের মনে রাখার জন্য জন্মদিন সব নয়। আনন্দ পটবর্ধন কবিতা লিখেছিলেন সফদারের স্মৃতিতে

'বাবরি মসজিদ ভাঙতে তুমি দেখো নি
তুমি দেখো নি তার পরের হিংসা আর ঘৃণাকে
তুমি রামাবাঈ আর অন্যান্য দলিতের মৃত্যু দেখো নি
পরমাণু বোমার জন্য দেশের আকুলতা তুমি দেখো নি
২০০২ এ গুজরাটের সাম্প্রদায়ীক হিংসা তুমি দেখো নি
প্রতিবেশি পাকিস্তানে তালিবানের উৎপত্তি তুমি দেখো নি
আর এখানে তুমি হত্যাকারীর রাজ্যাভিষেক দেখো নি
আমরা যারা এখনো বেঁচে রয়েছি তারা এগুলো সব দেখেছি
কিন্তু তোমাকে দেখতে পাচ্ছি না।'

"So you missed the demolition of the Babri Masjid
And the violence and hate that followed
You missed Ramabai and other Dalit massacres
You missed your nation's love for the atom bomb
In 2002, you missed the Gujarat pogrom
And in neighbouring Pakistan you missed
The creation of the Taliban and here
This year you missed the coronation of killers

We who survived you missed none of these
We missed you."

কমরেড সফদার হাশমি অমর রহে

সোমবার, ৮ এপ্রিল, ২০১৯

মিসিং গার্লস ~ স্বাতী রায়

        এক

শেষরাতের আধোঘুমের সর চোখের উপর লেগে থাকার সময়ে নানান স্তরের স্বপ্ন আসে। সে স্বপ্ন অনেকটা মেঘের উপর ভাসতে থাকা, আলতো দোলায় নেমে আসার মত। স্বপ্নভেলায় ভেসে ভেসে শিশিরে ভেজা নরম ঘাসের উপরে নেমে আসার ঠিক আগেই আজ  টানা কলিং বেলের ডিং ডং আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেলো ডঃ সাম্যদর্শী বর্ধনের। কেউ মরিয়া হয়ে বেল টিপেই চলেছে। ধরমর করে ঘুম ভেঙে উঠে কোনো মতে রাতপোশাকের উপরে হাউজকোট টা চাপিয়ে নিয়েই দরজা খুলতে ছুটলেন। দরজা খুলতেই দড়াম করে পায়ের উপর উপুর হয়ে পড়লো ফুলিয়ার বাবা মা। পাশের বস্তির ফুলিয়ার মা এ বাড়ির ঠিকে কাজ করে আর বাবা টোটো চালায়। ষোড়শী ফুলিয়া এবার মাধ্যমিক পাশ করেছিলো। চটকদার সাজুনি ফুলিয়াকে কাল বিকেল থেকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা। এই নিয়ে এ বছর পঞ্চম মেয়েটি কারো সাথে পালিয়েছে। হ্যাঁ এরকমই হয় এই বস্তিতে। বছরে আট দশটি মেয়ে পালিয়ে বিয়ে থা করে নেয়, বছর ঘুরতে ক্ষয়াটে চেহারা, কোলে বাচ্চা নিয়ে ফিরে এসে ফ্যামিলি ট্রেন্ড অনুযায়ী কারো বাড়িতে কাজে লেগে পড়ে। কেউ কেউ ফেরেনা আর। পুলিশ কিছুদিন খোঁজখবর করে অন্যান্য গুরুতর কাজের চাপে এদিকে সময় দিতে পারেনা, দিন আনা দিন খাওয়া লোকজন গুলিরও অত সময় থাকে না যে রোজ গিয়ে  থানায় ধর্না দেবে। ফলতঃ পুলিশ ও বস্তিবাসী দুই পক্ষর কাছেই এরা মিসিং গার্ল হয়ে থেকে যায়। 

দুই

আজ বছর পনেরো ধরে এই বস্তিতে একটি ফ্রি স্কুল চালান ডঃ বর্ধন। অনেক অনিচ্ছুক, হত-দরিদ্র পরিবারের বাচ্চাদের পড়াশোনা করায় উদ্বুদ্ধ করে মূলস্রোতে ফিরিয়ে এনে সরকারী স্কুলে পাঠিয়েছেন তিনি। পড়াশুনায় অপেক্ষাকৃত ভালো ও ইচ্ছুক দের আর্থিক সাহায্যও করে থাকেন। নিজের নার্সিংহোমে সপ্তাহে পাঁচদিন কাজ করার পর বাকি দুটি দিন তিনি সম্পূর্ণ ভাবে নিয়োজিত করেন এই বস্তিবাসীদের উন্নয়নে, মানে তাঁর একার পক্ষে যতটা সম্ভব। তাঁকে দেখে আরও কিছু কলেজস্টুডেন্ট এগিয়ে এসেছে এই মহান কাজে তাঁর অংশীদার হয়ে। বস্তিবাসী ও প্রতিবেশীদের কাছে এই ডাক্তার ঈশ্বরের আরেক রূপ। বাবা মেয়ের সংসারে কাজ খুব বেশী কিছু নেই। বছর বারোর মেয়ে জোনাকি কে নিয়ে এই গোটা দোতলা বাড়িতে থাকেন তিনি। জোনাকি কথা বলতে পারেনা, কিন্তু অসম্ভব ট্যালেন্টেড বাচ্চা। দুর্দান্ত ছবি আঁকে ও গিটার বাজায়। মা নেই বলে জোনাকির মনের সব খবর ডঃ বর্ধনকেই রাখতে হয়। 

তিন

"হামি কুছু জানিনা ডাগতার বাবু, হামার বিটিয়াকে আপনি ঢুণ্ডিয়ে দিন।" সেই সকাল থেকে বসে এই একই কথা সুর করে বলে কেঁদেই চলেছে ফুলিয়ার মা। এতদিন ধরে এত কিছু বলে বুঝিয়েও লাভ হয়নি এই উঠতি বয়েসের মেয়ে গুলোর। কী বলবেন ভেবে না পেয়ে খানিক থমকে ডঃ বর্ধন জিজ্ঞাসা করলেন "আচ্ছা পুলিশে রিপোর্ট করেছো তো?"
"পুলিশ তো বল্লো দেখ কার সাথে পালিয়েছে, একবছর বাদেই পেট করে ফিরে আসবে"। "আমার ফুলিয়া পালায়নি বাবু, কেউ উকে ধরে লিয়ে গ্যাছে।"
একটু নড়ে বসে জিজ্ঞাসা করলেন "কি করে জানলে?"
"ফুলিয়া বলছিলো একটা হিরো কাটিং ছেলে উকে দেখে, পিছে পিছে স্কুল তক যায় গো বাবু" 
"আর কী বলেছিলো ফুলি?" 
"বলেছিলো উ পড়বে, অনেক বড় হবে, আপনার মত ডাগতার হবে বাবু। ফুলিয়া রেএএএএ" 

চিন্তিত মুখে উঠে দাঁড়ালেন ডঃ বর্ধন। এ বস্তির বাচ্চা থেকে বুড়ো অবধি সব্বাইকে তিনি চেনেন। হিরোপানা ছেলেটা কে? 

"ঠিক আছে, তোমরা বাড়ি যাও, আমি দেখছি কী করা যায়।" বলে ড্রাইভার কে গাড়ি বের করতে বললেন। লা মার্টস এ জোনাকি কে নামিয়ে দিয়ে নার্সিং হোম চলে যাবেন তিনি।

সিটে বসে মেয়ের রেশম রেশম চুলে ভরা মাথাটা ঘেঁটে দিয়ে বললেন সিট বেল্ট টা লাগিয়ে নাও জনাই। বাধ্য মেয়ের মত সিট বেল্ট বেঁধে ভাসা ভাসা চোখের জনাই সামনের রাস্তায় মন দিলো। হ্যাঁ, সব শুনতে পায় সে, হয়তো একটু বেশীই শুনতে পায়। নিস্তব্ধ দুপুরের পাতা ঝরে পড়া বা হিমেল রাতের শিশিরের শব্দও জোনাকির কানে ধরা পড়ে। 

চার

খুব উচ্ছাসের সাথে গাড়িতে বসে বাবাকে তার ইনভিটিশন লেটার টা দেখালো জোনাকি। ব্যাঙ্গালোরে একটি মিউজিক কনফারেন্সে ডাক পেয়েছে সে। তার করা কম্পোজিশন সিলেক্টেড হয়েছে বলে টিচার ও তার বন্ধুরা সব্বাই দারুণ খুশী। হাত পা নেড়ে চোখের ইশারায় বাবাকে এটাই বলছিলো জোনাকি। হঠাৎ বাবার পিছনে গাড়ির জানালা দিয়ে দেখলো একটি খুব সুন্দর দেখতে ছেলে এক দৃষ্টে তাকিয়ে আছে তার দিকে। খুব ঠাণ্ডা, নির্মম একটা দৃষ্টি। 

বাড়ি ঢোকার সময় আবার ফুলিয়ার বাবা ও মা - বারান্দায় হেলান দিয়ে শূন্য চোখে তাকিয়ে বসে ছিলো। ডাগতার সাবের গাড়ি ঢুকতে দেখে হুড়মুড়িয়ে উঠে দাঁড়ালো দুজনে। হাতে একটা প্রায় দোমড়ান ছবি। একমাথা মেটে সিঁদুর পরা ফুলিয়া, পাশে সেই খুব সুন্দর দেখতে ছেলেটি। আবেশে ফুলিয়ার চোখ বুজে আছে, গলায় কানে ঝুঠো সোনার গয়না। ছবি দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলে ডঃ বর্ধন বললেন "বলেছিলাম"! 

পাঁচ

শহরের বাতাসে শীতের ছোঁয়া লাগছে। ফুলিয়ার গল্প চাপা পড়ে গিয়ে সবাই নিজের নিজের কাজে ব্যস্ত। ডঃ বর্ধনের স্কুলে নতুন কিছু স্টুডেন্ট এসেছে। তার মধ্যে চারটি মেয়ে। বয়স ১২-১৪র মধ্যে। শোয়ার জন্য তৈরি হয়ে রাত সাড়ে এগারোটায় জানলা বন্ধ করতে গিয়ে জোনাকি দেখলো দরজা খুলে কে একজন চোরা পায়ে এগিয়ে আসছে। চুপি চুপি দরজা খুলে একতলায় নেমে এলো সে। বাবার ঘর থেকে হালকা কথার চাপান উতোর শোনা যাচ্ছে। মিনিট খানেক সেখানে কাটিয়ে থমথমে মুখে নিজের ঘরে ফিরে গেলো জোনাকি। 

ঘণ্টাখানেক বাদে নিজের ঘরের দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন ডঃ বর্ধন, সঙ্গে একটি খুব সুন্দর দেখতে ছেলে। হাতে তার পেট মোটা একটি খাম। "কয়েকদিনের জন্য আন্ডারগ্রাউন্ড হয়ে যাও, নতুন পাখি পেলে ডেকে নেবো। এখন দিন কয়েক ফুলিয়াকে যে সিডেটিভ টা দিয়েছিলাম সেটাই অঞ্জুকেও খাইয়ে রাখবে। খুব দরকার না পড়লে আমায় ফোন করবেনা।" বলতে বলতে তাকে গেট খুলে বের করে দিয়ে নিজের ঘরে ঢুকতে গিয়ে ডঃ বর্ধন দেখলেন তার ঘরের সাদা দেওয়ালে চারকোল দিয়ে পাকা হাতে সদ্য আঁকা নিটোল একটি নারীমূর্তি, নীচে লেখা ১০৯৮। 

জনাইয়ের ঘর থেকে মৃদু ভেসে আসছে - "জানি সে কোথায়, এই শহরের কোন বাগানে সে হয়ে আছে ফুল।
প্রতি সন্ধ্যায়, পাপড়ি মেলে দিয়ে সে আবার ভোরে ঝরা বকুল।"...