'আমি কে' এই প্রশ্নের উত্তর মানুষ খুঁজে ফিরেছে আদ্যিকাল থেকে। সে রকম গোছানো উত্তর না পেয়ে 'সোঽহম' টাইপের দুর্বোধ্য জিনিস লিখে রেখেছে উপনিষদের পাতায়। তৈরি করেছে মাণ্ডূক্য উপনিষদের সপ্তম শ্লোকের মত 'তূরীয়' ধাঁধা। এর ফলে কূপমণ্ডূক পৃথিবীতে মহা অশান্তির সৃষ্টি হয়েছে। ভাগ্যিস বিজ্ঞান বলে হালে একটা জিনিস এসেছে, না এলে পৃথিবীটা এর চাপেই এতদিনে শেষ হয়ে যেত।
উপনিষদ-টুপনিষদ টাইপের সাম্প্রদায়িক বইপত্তর পড়ে বিবেকানন্দ আমেরিকায় ব্রেনওয়াশ করে এসেছিলেন আর রবীন্দ্রনাথ ভুলভাল অনেক গান লিখে গেছিলেন। 'বিপুল তরঙ্গ রে, বিপুল তরঙ্গ রে'। হাহ্। আগেকার দিনে মূর্খ মুনিরা ভাবত এলিমেন্ট নাকি পাঁচখানা – ক্ষিতি অপ্ তেজ মরুৎ ব্যোম্। এই ব্যোম্ নিয়ে তাদের যত মাথাব্যথা। কিছুই বোঝেনি এর, তাই এইসব তরঙ্গ ফরঙ্গ বলে চালিয়ে দিয়েছে। সায়েন্স সকলের বোঝার জিনিস হলে তো হয়েই যেত!
তখনও রবীন্দ্রনাথ সম্ভবত দাড়িবাবা হননি, তাও গানটার পরের লাইনে লিখে ফেললেন – 'সব গগন উদ্বেলিয়া মগন করি' অতীত অনাগত আলোকে-উজ্জ্বল জীবনে-চঞ্চল এ কী আনন্দ-তরঙ্গ! বিপুল তরঙ্গ রে, বিপুল তরঙ্গ রে!' মানে ঐ ঢপের তরঙ্গকেই কখনও বিপুল তরঙ্গ, কখনও আনন্দ-তরঙ্গ এইসব অ্যাডজেক্টিভ লাগানো কথার প্যাঁচে জনগণকে বুদ্ধু বানানো আর-কি! মেহনতি মানুষের চাই রোটি-কাপড়া-মকান, চাই ইস্কুল-কলেজ-হাসপাতাল, চাই চাকরি-ইকনমি-জিডিপি, চাই স্মার্টফোন-ল্যাপটপ-আন্দোলন। এসব থেকে দৃষ্টি অন্যদিকে ঘোরাতে এইসব তরঙ্গ-ফরঙ্গ আমদানি হল!
১৯০৮ সালে রবীন্দ্রনাথ যখন এই কমিউনাল গানখানা লিখলেন, তার ছ' বছর আগে বিবেকানন্দ মারা গেছেন, যাওয়ার আগে রামকৃষ্ণ মিশন নামে মন্দির বানিয়ে মানুষের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতার বীজ পুঁতে গেছেন। আশপাশের এলাকার খবর হচ্ছে ক্ষুদিরাম বসু নামে এক ষোল বছরের বালককে ফাঁসি দেওয়া হয়েছে, আলিপুর বোমার মামলার বিচার শুরু হচ্ছে, কাঠগড়ায় আর এক কমিউনাল কবি অরবিন্দ ঘোষ। তিনিও কিছুদিন পরে সামহাউ বেঁচে গিয়ে তরঙ্গের খোঁজে ব্রিটিশদের কাছ থেকে পালিয়ে যাবেন ফ্রেঞ্চ কলোনি পন্ডিচেরিতে। সেখানে উনিও আশ্রম নামের মন্দির বানিয়ে মানুষের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টিতে আত্মনিয়োগ করবেন।
ব্রিটেনে তখন সায়েন্স চলছে রমরমিয়ে। আর্নেস্ট রাদারফোর্ড নামে এক সাঁইত্রিশ বছর বয়সী যুবক ক্যানাডা থেকে সদ্য জয়েন করেছেন ম্যাঞ্চেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ে। প্রফেসর আর্থার সুস্টার নামে এক পদার্থবিদ সেখান থেকে রিটায়ার করেছেন, তার জায়গায়। সুস্টারের কাছে পোস্টডক করছিলেন হান্স গাইগার নামে ছাব্বিশ বছর বয়সী এক জার্মান ছাত্র। তিনি আর আর্নেস্ট মার্সডেন নামে স্থানীয় এক উনিশ বছর বয়সী ছাত্র একদিন পাতলা একটা সোনার পাতের ওপর আলফা-কণার বুলেট মেরে এমন সব রেজাল্ট পেলেন, যাতে পরমাণুর গঠন সম্বন্ধে মানুষের ধারণাই বদলে গেল।
বিবেকানন্দ শিকাগোতে বক্তৃতা দিয়ে যখন একগাদা ভক্ত জোগাড় করছিলেন, তখন থেকেই ইওরোপে এইসব জিনিস নিয়ে নাড়াচাড়া হচ্ছে। রন্টজেন নামে একজন বিজ্ঞানী দুর্দান্ত প্ল্যান-ট্যান করে এক্স-রে আবিষ্কার করে ফেললেন। হেনরি বেকারেল চোখে আঙুল দিয়ে দেখালেন ইউরেনিয়ামের কম্পাউন্ড থেকে এমনিই 'রে' বেরোয়, তিনি তাকে বললেন ইউরেনিক রে। ফ্রান্সে পি এইচ ডি করতে এসেছে একটা ইয়াং মেয়ে, মেরি স্ক্লোডস্কা, তাকে ডিপার্টমেন্টের হেড বললেন, এই ইউরেনিয়ামের কেসটা বেশ ইন্টারেস্টিং, এটা একটু দেখো তো। মেরি সেটা নিয়ে যে লড়বে, তার চাই একটা যন্ত্র, যা দিয়ে অল্প পরিমাণ কারেন্ট মাপা যায়। ল্যাবের এক কোণে পড়ে ছিল চোদ্দ-বছর আগে ওখানেই তৈরি এক ইলেক্ট্রোমিটার, বানিয়েছিলেন ওখানকার ল্যাব অ্যাসিস্ট্যান্ট পিয়ের কুরি। মেরি গিয়ে তাকে ধরল, তোমার ঐ মেশিনটা একটু ঝেড়েঝুড়ে চালু করে দাও না। সেই নিয়ে লড়তে লড়তে মেরি পিয়েরের প্রেমে পড়ে তাকে বিয়ে করেই ফেললেন না শুধু, আবিষ্কার করে ফেললেন দু-খানা নতুন এলিমেন্টও। ইউরেনিক রে-র ব্যাপারটার তিনি নামকরণ করলেন রেডিও-অ্যাক্টিভিটি। আলফা রে, বিটা রে, গামা রে নামের সব অদ্ভুত রশ্মি বেরোয় সেই সব এলিমেন্ট থেকে। পুরনো আমলের মাইকের চোঙার মত শঙ্কু-আকৃতির এক ভ্যাকুয়াম টিউবে – ক্রুকস টিউবে – ইলেকট্রিক ডিসচার্জ ঘটিয়ে আগে ক্যাথোড রে নামের এক জিনিস পাওয়া গেছিল। ১৮৯৭ সালে জে জে থমসন দেখালেন এই রশ্মি আসলে ঋণাত্মক তড়িৎবাহী এক কণা, তিনি তার নাম দিলেন ইলেকট্রন। পরমাণুর মধ্যে এই ইলেকট্রন কীভাবে থাকে, তার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে লর্ড কেলভিন বললেন, নিশ্চয় পরমাণু হচ্ছে একটা তরমুজ, আর ইলেকট্রন থাকে যেমন তরমুজে থাকে কালো কালো বিচি। এই থিওরি অবশ্য খুব বেশি লোকের পছন্দ হল না। ইলেকট্রনের চার্জ নেগেটিভ। তাহলে পজিটিভ জিনিসটা কই? পরমাণু তো নিউট্রাল।
গাইগার-মার্সডেনের রেজাল্ট হাতে পেয়ে রাদারফোর্ড ব্যাখ্যা করলেন কেলভিনের ঐ তরমুজ স্ট্রাকচার ঠিক না। পরমাণুর মধ্যে ব্যাপক জায়গা ফাঁকা, তরমুজের মত রসালো শাঁস দিয়ে ভর্তি না। মধ্যে এক ছোট্ট জায়গায় এর যাবতীয় ভর সন্নিহিত, তিনি তাকে বললেন নিউক্লিয়াস। এই নিউক্লিয়াসের চারদিকে অনেক দূর দিয়ে ঘুরছে ইলেকট্রন, নিউক্লিয়াসের তুলনায় তার ভর প্রায় কিছুই না। ইলেকট্রন নেগেটিভ মানে নিউক্লিয়াস পজিটিভ। বছর দশ-বারো পরে তিনি সেই নিউক্লিয়াসের মধ্যের কণাগুলোর নামকরণ করলেন প্রোটন।
কিন্তু এ তো অনেক পরের ব্যাপার। এর মধ্যে অনেক ঝামেলা হয়ে গেছে। গাইগারদের ঐ পরীক্ষার বছর তিনেক আগেই পর পর দুখানা ইকুয়েশন বাজারে নামিয়েছেন ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক আর অ্যালবার্ট আইনস্টাইন। একজন বললেন ই ইজুকাল্টু এইচ নিউ। ই মানে এনার্জি, নিউ মানে ফ্রিকুয়েন্সি, এইচ হচ্ছে একটা কনস্ট্যান্ট, তার নামানুসারে সেটা হয়ে গেল প্ল্যাঙ্ক কনস্ট্যান্ট। আইনস্টাইন বললেন ই ইজুকাল্টু এম সি-স্কয়ার। এম হচ্ছে মাস, সি হচ্ছে ভ্যাকুয়ামে আলোর অর্থাৎ ফোটনের গতিবেগ, যেটা একটা কনস্ট্যান্ট।
ডি ব্রগলি নামে এক করিৎকর্মা তরুণ এই দুটো ইকুয়েশন দেখেই এইচ নিউ ইজুকাল্টু এম সি-স্কয়ার করে নিউ আর এম-এর একটা সম্পর্ক বের করে বললেন – এই দ্যাখো, জনগণ, এম মানে মাস, যা থাকে পার্টিকেলের; নিউ মানে ফ্রিকুয়েন্সি, যা থাকে তরঙ্গের। সুতরাং প্রত্যেক পার্টিকেলের ওয়েভও আছে। মাস বেশি হলে এই ওয়েভ হয়ত সেভাবে বুঝতে পারবে না, কিন্তু মাস যদি ছোট হয়, যেমন কিনা পরমাণু বা তার মধ্যের জিনিসপত্র, তবে তার ওয়েভ-নেচারও থাকবে। 'বিপুল তরঙ্গ রে, বিপুল তরঙ্গ রে!'
যাহাই পার্টিকেল, তাহাই ওয়েভ – এই তত্ত্বের নাম হয়ে গেল ওয়েভ-পার্টিকল ডুয়ালিটি। আইনস্টাইনের ইকুয়েশন অনেকে বুঝল না, বলতে লাগল মাস ক্যান বি কনভার্টেড টু এনার্জি। আরে ধুর, উনি থোড়াই মাসকে কনভার্ট করার কথা বলছিলেন – মাসই এনার্জি। দুটো রাশি যদি কনস্ট্যান্ট দিয়ে জোড়া হয়, তবে তারা একই জিনিস। এক কিলোমিটার ইজুকাল্টু এক হাজার মিটার মানে কিলোমিটার আর মিটার বলতে একই জিনিস বোঝায়, সেটা দূরত্ব। সেই রকম ই আর এম একই জিনিস, মাসকে আলোর গতিবেগের বর্গ দিয়ে গুণ করলে ই পাওয়া যায়।
রাদারফোর্ডের পরমাণুর গঠনও সমালোচনার মুখে পড়ল। একটা পজিটিভ চার্জের জিনিসের চারদিকে একটা নেগেটিভ চার্জের জিনিস ঘুরবে কী করে? মুখ থুবড়ে পড়বে না ওর ওপরে? পজিটিভ-নেগেটিভ নিউট্রালাইজ হয়ে যাবে না? একে একে এগিয়ে এলেন নীলস বোর, সমারফিল্ড আরও তাবড় তাবড় সব বিজ্ঞানীরা। বললেন, না, তা হত যদি ইলেকট্রনকে যেমন-তেমন ঘুরতে দিতে। কিন্তু এরা যদি কিছু নির্দিষ্ট কক্ষপথে নির্দিষ্টভাবে ঘুরতে থাকে, তাহলে তেমন হবে না। শ্রডিঙ্গার ঝোলা থেকে বের করলেন অদ্ভুত বেড়াল। তৈরি হতে লাগল কোয়ান্টাম তত্ত্ব।
ব্যাপারটা এখানেই শেষ হয়ে গেলে তো কথাই থাকত না। কিন্তু এর ফলে আরও গুচ্ছ গুচ্ছ প্রশ্ন তৈরি হল। এর মধ্যে নিউক্লিয়াসে প্রোটনের সঙ্গে নিউট্রন নামে এক ধর্ম- থুড়ি, তড়িৎ-নিরপেক্ষ কণারও সন্ধান পাওয়া গেছে। অর্থাৎ, নিউক্লিয়াসে আছে প্রোটন আর নিউট্রন, খুব অল্প জায়গা জুড়ে। পরমাণুর ভর প্রায় পুরোটাই সেখানে থাকে। তাদের চারদিকে নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে বিভিন্ন কক্ষপথে ঘুরে বেড়ায় ইলেকট্রনরা। হাইড্রোজেন পরমাণুতে নিউট্রন নেই, তাই সিম্পল স্ট্রাকচার, একটা প্রোটনকে বেষ্টন করে বৃত্তাকার পথে ঘোরে একটা ইলেকট্রন। এই ইলেক্ট্রনের স্পিড আলোর স্পিডের দশভাগের একভাগের কিছু কম, প্রতি সেকেন্ডে নিউক্লিয়াসের চারদিকে সাড়ে ছয় কোয়াড্রিলিয়নবার ঘুরে (একের পর পনেরটা শূন্য মানে এক কোয়াড্রিলিয়ন) সেই একলা ইলেকট্রন নাকি ২২০০ কিলোমিটার দূরত্ব অতিক্রম করে।
তো এর পর প্রশ্ন উঠল, একাধিক পজিটিভ চার্জওয়ালা প্রোটন অত্যন্ত ঘনসন্নিবিষ্ট অবস্থায় নিউক্লিয়াসে কী করে থাকে? হাইড্রোজেন পেরোলেই হিলিয়াম থেকে সমস্ত পরমাণুতে একাধিক প্রোটন থাকে। তারা কী করে থাকে? একা রামে রক্ষা নেই, তাদের সঙ্গে সুগ্রীব দোসরের মত লেপ্টে থাকে নিউট্রনও।
কাজেই প্রোটন এবং সেই সঙ্গে নিউট্রনকেও আর ফান্ডামেন্টাল পার্টিকল বলা গেল না। তাদের স্টেবিলিটি ব্যাখ্যা করার জন্যে এসে গেল আরও জটিল তত্ত্ব, অধিকাংশটাই অঙ্ক।
আমি যেহেতু অঙ্ক বলতে যোগ বিয়োগ গুণ ভাগের ওপরে কিছু বুঝি না, তাই এ সব বোঝার আগে ফিরে গেলাম 'আমি কে' – এই প্রশ্নে। ধরে নিলাম, আমি সত্তর কেজি ভরের এক বস্তু, যার অধিকাংশটাই জল আর কেমিস্ট্রি খানিকটা পড়েছিলাম বলে পিরিয়ডিক টেবিলের মালপত্তরগুলো মুখস্থ করেছিলাম। তো আমার এই সত্তর কেজির কম্পোজিশন মোটামুটি এই রকম –
৬৫% অক্সিজেন, ১৮.৫% কার্বন, ৯.৫% হাইড্রোজেন, ৩.২% নাইট্রোজেন, ১.৫% ক্যালশিয়াম, ১% ফসফরাস, ০.৪% পটাশিয়াম, ০.৩% সালফার, ০.২% সোডিয়াম, ০.২% ক্লোরিন, ০.১% ম্যাগনেশিয়াম আর বাদবাকি অতি সামান্য অংশ অন্যান্য গোটা পঁচিশেক এলিমেন্ট দিয়ে। এর প্রত্যেকটার মধ্যে কটা করে ইলেকট্রন, প্রোটন, নিউট্রন আছে, তা আমার জানা। একটা ইলেকট্রনের তুলনায় একটা প্রোটন প্রায় ১৮৩৬ গুণ আর নিউট্রন প্রায় ১৮৩৮ গুণ ভারী। কাজেই আমার সত্তর কেজির শরীর এইসব জটিল পাটিগণিত কষে দাঁড়াল – ৩৮.৪২১ কেজি প্রোটন, ৩১.৫৫৮ কেজি নিউট্রন এবং ২১ গ্রাম ইলেকট্রন। এই কেলেঙ্কারিয়াস ক্যালকুলেশন আর কেউ করেছে কিনা আমি জানি না, মনে হয় আমিই প্রথম।
কিন্তু দাঁড়ান। ওই যে বললাম, প্রোটন আর নিউট্রন এখন আর ফান্ডামেন্টাল পার্টিকল না, কেননা একাধিক ইলেকট্রোপজিটিভ প্রোটন এক জায়গায় চেপেচুপে থাকতে পারে না। এর ব্যাখ্যায় প্রতিটি প্রোটন তৈরি হয়েছে তিনখানা কোয়ার্ক নামের পার্টিকল দিয়ে, দুটো আপ-কোয়ার্ক যাদের প্রত্যেকটার চার্জ ২/৩ই (এই ই হচ্ছে ইলেকট্রনের চার্জ, এখানে পজিটিভ) করে মোট ৪/৩ই, আর একটা ডাউন-কোয়ার্ক, যার চার্জ নেগেটিভ ১/৩ই, তাহলে তিনে মিলে প্লাস-ই। তেমনি নিউট্রনও তৈরি তিনখানা কোয়ার্ক দিয়ে, একটা আপ-কোয়ার্ক যার চার্জ ২/৩ই, দুখানা ডাউন-কোয়ার্ক, এক একটা নেগেটিভ ১/৩ ই করে মোট নেগেটিভ ২/৩ই, ফলে মোটমাট শূন্য।
চার্জ মিলে গেল, এবার মাস। এখানেই আসল খেল। তিনখানা কোয়ার্ক মিলে যা ভর, তা প্রোটন বা নিউট্রনের ভরের অতি সামান্য অংশ, প্রায় ১% মত। বাকি ৯৯% ভর কোত্থেকে আসছে? এদের ব্যাখ্যা দিতে তৈরি হল বিশেষ থিওরি – এই ভর হচ্ছে কোয়ার্কদের বেঁধে রাখার জন্যে গ্লুয়ন নামে এক ফিল্ডে কোয়ান্টাম ক্রোমোডায়নামিক বাইন্ডিং এনার্জির জন্যে, যার মধ্যে আছে এই কোয়ার্কগুলোর বীভৎস স্পিডে ঘূর্ণনে উৎপন্ন গতিশক্তিও। ঐ যে আইনস্টাইন বলে গেছেন মাসই এনার্জি, এ হচ্ছে সেই এনার্জি। অ্যাটম বোম-টোম থেকে আমরা যে শক্তি পাই, তা এর কাছে কিছুই না। কেননা তাতে একটা বড় নিউক্লিয়াস ভেঙে দু-টুকরো হয় মাত্র। যে কোনো পরিমাণের বস্তু থেকে তার সমতুল আইনস্টাইনীয় এনার্জি সম্ভবত পাওয়া যাবে যদি তার প্রত্যেকটা ফান্ডামেন্টাল পার্টিকলকে আলাদা করে ফেলা যায়।
সে যাই হোক, এ সবের মানে হচ্ছে আমার এই সত্তর কেজির শরীরে ঐ ২১ গ্রাম ইলেকট্রন ছাড়া বাকি যে ভর, তার নিরানব্বই শতাংশই হচ্ছে অঙ্ক। আপ-ডাউন কোয়ার্ক গ্লুয়ন ফিল্ডে পাঁই পাঁই করে ঘুরছে বলে সেই ভর নাকি তৈরি হয়েছে। বিপুল তরঙ্গ রে, বিপুল এ রঙ্গ রে!
আপাতত বলা যায়, এই ব্যাপারটাও নিঃসন্দেহ নয়। মানে এই অঙ্কের মধ্যেও অনেক ঘাপলা আছে, যে জন্যে জানা যায়নি অনেক গূঢ় প্রশ্নের উত্তরও। নিউট্রনের যেমন একলা থাকার উপায় নেই, তাকে আলাদা করে রাখলে ১৫ মিনিটেই সে একটা প্রোটন ও একটা ইলেকট্রনে পরিণত হয়ে যায়। প্রোটন কি পুরো স্টেবল? সে যদি গ্লুয়ন-ফিল্ডে কোয়ার্ক দিয়ে তৈরি, তবে প্রোটনের স্পিন কী করে ব্যাখ্যা করা যায়?
সেই যে কারা যেন বলে গেছিলেন, সবই মায়া, হয়ত আল্টিমেটলি সেখানেই পৌঁছে যাওয়া যাবে এক সময়। এখনও অবধি কোয়ার্কে ১% ভর রেখে কিছুটা ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে। এর পর কোয়ার্কগুলো ভরশূন্য কী দিয়ে তৈরি হয়া সম্ভব, যার ফলে এখনকার অমীমাংসিত প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে, সে সব তত্ত্ব কবে আসবে, কে জানে।
আপাতত আধুনিক বিজ্ঞান বলছে আমাদের ভরের ৯৯% হচ্ছে কোয়ার্কের গতি।
আগে বলা হল মাস যার থাকে সেই পার্টিকল, এখন মাস ব্যাপারটাই ধোঁয়া হয়ে গেল! তাহলে পার্টিকল জিনিসটা আসলে কী? আলোকের কণাকে বলা হয় ফোটন, যা কিনা ইলেকট্রোম্যাগনেটিক রেডিয়েশন। ইলেকট্রিক আর ম্যাগনেটিক ফিল্ড মিলে ইলেকট্রোম্যাগনেটিক ফিল্ডের ব্যাপার আমরা জানি। যে-কোনো ফিল্ডের এক্সাইটেড স্টেটকে বলা হয় পার্টিকল। পাতি বাংলায় হয়ত তুলনা করা যেতে পারে এই রকম - আমাদের মাথার মধ্যে অহরহ বিচিত্র ভাবনা চলছে, যা আমরা টেরও পাই না। তাকে যদি আমরা ধরে নিই একটা ফিল্ড, হঠাৎ যখন তাতে একটা আইডিয়া এসে যায় (যে জন্যে আমি এই লেখাটা লিখছি, ধরা যাক সেই আইডিয়াটাই), সেটা আসে এই ফিল্ডের একটা মোমেন্টারি এক্সাইটমেন্ট থেকেই। এই ইউরেকা-মার্কা আইডিয়া হচ্ছে ঐ ফিল্ডে উৎপন্ন পার্টিকলের সমতুল।
ভেবে দেখুন, এই যে জটিল সব ফান্ডামেন্টাল পার্টিকল, এর আদ্ধেকের ব্যাপারটা অঙ্ক কষে বলে গেছিলেন আমাদের সত্যেন্দ্রনাথ বসু। তাঁর নামেই বোসন কণা, যারা বোস-আইনস্টাইন স্ট্যাটিসটিক্স মানে, যেমন ফোটন, গ্লুয়ন এই ভরহীন জটিল বস্তুগুলো। বাকিরা মানে ফার্মি-ডিরাক স্ট্যাটিস্টিক্স, তাদের নাম ফার্মিয়ন, যেমন ইলেকট্রন, আপ-ডাউন কোয়ার্ক, এটসেট্রা।
তাহলে আল্টিমেটলি কী দাঁড়াল? দিন দিন আধুনিক বিজ্ঞানও ভয়ঙ্করভাবে সাম্প্রদায়িক হয়ে উঠছে। বলছে বস্তু মানে গতি, মানে সবই মায়া! সত্তর কেজির মালে হিসেব পাওয়া যাচ্ছে মাত্র সাতশো একুশ গ্রামের! জিডিপির বারোটা বাজবে না তো কী হবে?