শনিবার, ২৯ আগস্ট, ২০২০

হিন্দী ভাষা ~ নবারুণ ঘোষাল

যদি কৃত্তিবাস ওঝাকে জিজ্ঞেস করা হত, তিনি কোন ভাষায় রামায়ণ লিখেছেন, তিনি কি উত্তর দিতেন? তিনি বলতেন, "বঙ্গভাষা" ।
যদি গোস্বামী তুলসীদাসকে জিজ্ঞেস করা হত, তিনি কোন ভাষায় রামায়ণ লিখেছেন, তিনি কি উত্তর দিতেন? তিনি বলতেন, "অওয়ধী" (अवधी) ভাষা।
অথচ আজকে প্রচার করা হয়, তুলসীদাস ছিলেন হিন্দী কবি।
"হিন্দী" শব্দটা লক্ষ্য করলেই বোঝা যায়, এটা আদি ভারতীয় শব্দ নয়। এটা এদেশে এসেছে ইসলামিক পর্যটকদের এবং আক্রমণকারীদের মাধ্যমে, যাঁরা সিন্ধু নদীকে হিন্দ কিম্বা হিন্দু নদী বলতেন, এবং তার এপারের দেশকে বলতেন হিন্দুস্তান।
প্রকৃতপক্ষে ভারতবর্ষে হিন্দী বলে কোনও ভাষাই ছিল না। উত্তর ভারতের ভাষাগুলি ছিল পাঞ্জাবী, রাজস্থানী, হরিয়ানভী, গুজরাতী, ভীল, কোল, গাহরওয়ালী, অওয়ধী, খড়িবোলী, ভোজপুরী, মগধী, মৈথিলী ইত্যাদি। আর একটু দক্ষিণে ছিল বুন্দেলখন্ডী, রোহিলখন্ডী, ছত্তিসগড়ী ইত্যাদি। ছোটনাগপুর অঞ্চলে ছিল খোরঠা, মানভূমী বাংলা, ইত্যাদি।
এছাড়া ছিল ভারতের আদি বাসিন্দাদের অস্ট্রিক-দ্রাবিড় ভাষাগুলি, যেমন সাঁওতালী, মুন্ডারী, ওরাওঁ, বিরহোড়, হো ইত্যাদি।
উত্তর ভারতের ভাষাগুলির সঙ্গে ইসলামিক ভাষাগুলির সঙ্গমে সৃষ্টি হয় উর্দু নামে একটি ভাষা, যেটি মূলতঃ পাঠান এবং মুঘল সৈন্যদের মধ্যে প্রচলিত ছিল। ওয়র্দ (वर्द) কথাটার মানে হল সৈন্য, যার থেকে ভাষাটির নামকরণ হয়েছে।
ইংরেজরা এসে এখানকার সব অধিবাসীদেরই নামকরণ করল নেটিভ হিন্দু, জাতিধর্মনির্বিশেষে। বলাই বাহুল্য, কথাটা খুব সম্মানজনক অর্থে তারা ব্যবহার করত না। পরাজিত জাতিকে কে-ই বা সম্মান করে? আর সরকারী ভাষা হিসেবে ইংরেজির সঙ্গে রইল ফারসী। কথ্য ভাষা হল উর্দু।
মির্জা গালিব থেকে মুনসী প্রেমচন্দ পর্যন্ত সবাই লিখতেন উর্দুতে। ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের পর ইংরেজের মাথায় ঢোকে হিন্দু আর মুসলিমরা হল দুটো আলাদা ধর্মের লোক, যাদের ঐক্যে ফাটল ধরাতে না পারলে আবার অনুরূপ একটি বিদ্রোহের সম্ভাবনা। এই পরিকল্পনার অঙ্গ হিসেবে জন্ম নিল মুসলিম লীগ এবং তার হিন্দু সংস্করণ, হিন্দু মহাসভা। এবার হিন্দুদের দরকার একটা ভাষা, কারণ উর্দুটা বড্ড মুসলিম ঘেঁষা। রাতারাতি সংস্কৃত অর্থাৎ দেবনাগরী অক্ষরগুলি দিয়ে উর্দু লেখা শুরু হল। একটা জগাখিচুড়ি ভাষার সৃষ্টি করা হল, যার অধিকাংশ শব্দ উর্দু, ব্যাকরণ উর্দু, উচ্চারণও উর্দু। শুধু কিছু সংস্কৃত শব্দ ঢুকিয়ে তাকে হিন্দী ভাষা বলে চালানো হতে লাগল। মাঝখান থেকে উর্দু ভাষার যে মিষ্টতা, সেটা গেল নষ্ট হয়ে।
হিন্দী ভাষা যে আদতে উর্দু ভাষা, তার প্রমাণ এখনও এই ভাষার সর্ব অঙ্গে। প্রথমতঃ, সংস্কৃত বাক্যে কর্তার লিঙ্গ কর্তার গায়ে, কর্মের লিঙ্গ কর্মের গায়ে থাকে।
रामस्य माता। सीताया पिता।
উর্দুতে তার উল্টো। কর্মের লিঙ্গ কর্তার গায়ে চলে আসে। হিন্দীতেও তাই।
राम की माता। सीता का पिता।
এর ফলে ভারতের বেশিরভাগ লোক সঠিকভাবে হিন্দী বলতে পারে না। কারণ বেশিরভাগ ভারতীয় ভাষায় এই লিঙ্গের ঝামেলা নেই।
হিন্দীর "अ"-এর উচ্চারণ উর্দু "अलिफ"-এর মতন। মোটেই দেবনাগরী "अ"-এর মতন নয়। দেবনাগরী মানে সংস্কৃত "अ"-এর সঠিক উচ্চারণ হয় ভোজপুরী, মৈথিলী, মগধী, ওড়িয়া, অসমিয়া এইসব ভাষায়। বাংলা ভাষায কোনো কোনো শব্দে দেবনাগরী "अ"-এর উচ্চারণ হয়, যেমন বল, পথ, সরোবর ইত্যাদি, আবার কোনো কোনো শব্দে তা ও-কারের মতন উচ্চারণ হয়, যেমন মন, বন, গরু ইত্যাদি।
কিন্তু হিন্দীতে अ-এর সবসময় উর্দু अलिफ-এর মতন উচ্চারণ হয়।
সংস্কৃত শব্দের অ-কারান্ত উচ্চারণ ওড়িয়া ভাষায় রয়ে গেছে, বাংলায় কিছু কিছু ক্ষেত্রে রয়েছে। কিন্তু হিন্দীতে উর্দুর হসন্তযুক্ত উচ্চারণ থেকে যাওয়ার ফলে অদ্ভুত শুনতে লাগে।
যেমন, "भारत" শব্দের উচ্চারণ "ভারত" কিন্তু "भारती" শব্দের উচ্চারণ হল "ভার্তী"। "कमल" শব্দের উচ্চারণ হল "কমল" কিন্তু "कमला" শব্দের উচ্চারণ হল "কম্লা"।
এই জগাখিচুড়ি ভাষাটিকে সরকারী ভাবে চাপিয়ে দেবার ফলে উত্তর ভারতের বেশিরভাগ ভাষা অবলুপ্ত হতে বসেছে। অনেক শিক্ষিত বাঙালি এখন ভোজপুরী, মৈথিলী, খোরঠা ইত্যাদি উত্তর ভারতের মূল ভাষাগুলিকে হিন্দীর উপভাষা বলে মনে করেন।
দুঃখের কথা হল, এমন একটা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা বলে চালানোর চেষ্টা হচ্ছে, যেটা ভারতের কোনও অঞ্চলের মানুষের মাতৃভাষা নয়। কিন্তু উত্তর ভারতের মানুষের মগজধোলাই করে তাদেরকে নিজেদের মাতৃভাষা ভুলিয়ে দিয়ে হিন্দীকে তাদের মাতৃভাষা বলে চালানো হচ্ছে।
দক্ষিণ ভারতে তামিল এবং তার আনুষঙ্গিক ভাষাগুলি যেমন মালয়ালম, কন্নড়, তেলুগু এগুলি অবশ্য তাদের অস্তিত্ব বজায় রেখেছে, আর এখনও হিন্দীর আধিপত্য অস্বীকার করে চলেছে।
যারা হিন্দু হিন্দী হিন্দুস্তান বলে লাফাচ্ছে, তারা যদি বুঝত যে এটা আসলে মুসলমানদের ভাষা, তাহলে বোধহয় লাফাত না। যাই হোক, সেটা তাদের সমস্যা।
আমাদের সমস্যা হল, আমাদের প্রিয় মাতৃভাষা বাংলা, যার প্রায় হাজার বছরের বেশি সাহিত্যের ইতিহাস আছে, কুক্কুরীপাদ, ভুসকু-র থেকে শুরু করে চন্ডীদাস, গোবিন্দদাস, কৃত্তিবাস, কাশীরাম দাস, মাইকেল, বঙ্কিমচন্দ্র, বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, ত্রৈলোক্যনাথ, সুকুমার রায়, পরশুরাম, শরৎচন্দ্র, প্রেমেন্দ্র মিত্র, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, সত্যজিৎ রায় ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি মহামূল্যবান রত্নের সমাবেশে তৈরি এই সমৃদ্ধ ভাষা, পৃথিবীর সাহিত্য জগতে যার বেশি তুলনা পাওয়া যাবে না, সেই ভাষাও এরপর অওয়ধি, মগধী, মৈথিলী, বুন্দেলখন্ডী ভাষার মতন হিন্দীর চাপে অবলুপ্ত হয়ে যাবে কিনা।
যদিও এই এক হাজার বছর ধরে অনেক আঘাত সামলে এই ভাষা এখনও শুধু টিঁকে আছে তাই নয়, অনেক সমৃদ্ধ হয়েছে। কিন্তু ব্যবসায়ী মহলের প্রচন্ড চাপে এই ভাষা যাতে হারিয়ে না যায়, তা দেখা আপনার, আমার, সবার কর্তব্য।

শুক্রবার, ২১ আগস্ট, ২০২০

সব'ই মায়া ~ অমিতাভ প্রামাণিক

'আমি কে' এই প্রশ্নের উত্তর মানুষ খুঁজে ফিরেছে আদ্যিকাল থেকে। সে রকম গোছানো উত্তর না পেয়ে 'সোঽহম' টাইপের দুর্বোধ্য জিনিস লিখে রেখেছে উপনিষদের পাতায়। তৈরি করেছে মাণ্ডূক্য উপনিষদের সপ্তম শ্লোকের মত 'তূরীয়' ধাঁধা। এর ফলে কূপমণ্ডূক পৃথিবীতে মহা অশান্তির সৃষ্টি হয়েছে। ভাগ্যিস বিজ্ঞান বলে হালে একটা জিনিস এসেছে, না এলে পৃথিবীটা এর চাপেই এতদিনে শেষ হয়ে যেত। 

উপনিষদ-টুপনিষদ টাইপের সাম্প্রদায়িক বইপত্তর পড়ে বিবেকানন্দ আমেরিকায় ব্রেনওয়াশ করে এসেছিলেন আর রবীন্দ্রনাথ ভুলভাল অনেক গান লিখে গেছিলেন। 'বিপুল তরঙ্গ রে, বিপুল তরঙ্গ রে'। হাহ্‌। আগেকার দিনে মূর্খ মুনিরা ভাবত এলিমেন্ট নাকি পাঁচখানা – ক্ষিতি অপ্‌ তেজ মরুৎ ব্যোম্‌। এই ব্যোম্‌ নিয়ে তাদের যত মাথাব্যথা। কিছুই বোঝেনি এর, তাই এইসব তরঙ্গ ফরঙ্গ বলে চালিয়ে দিয়েছে। সায়েন্স সকলের বোঝার জিনিস হলে তো হয়েই যেত! 

তখনও রবীন্দ্রনাথ সম্ভবত দাড়িবাবা হননি, তাও গানটার পরের লাইনে লিখে ফেললেন – 'সব গগন উদ্‌বেলিয়া মগন করি' অতীত অনাগত আলোকে-উজ্জ্বল জীবনে-চঞ্চল এ কী আনন্দ-তরঙ্গ! বিপুল তরঙ্গ রে, বিপুল তরঙ্গ রে!' মানে ঐ ঢপের তরঙ্গকেই কখনও বিপুল তরঙ্গ, কখনও আনন্দ-তরঙ্গ এইসব অ্যাডজেক্টিভ লাগানো কথার প্যাঁচে জনগণকে বুদ্ধু বানানো আর-কি! মেহনতি মানুষের চাই রোটি-কাপড়া-মকান, চাই ইস্কুল-কলেজ-হাসপাতাল, চাই চাকরি-ইকনমি-জিডিপি, চাই স্মার্টফোন-ল্যাপটপ-আন্দোলন। এসব থেকে দৃষ্টি অন্যদিকে ঘোরাতে এইসব তরঙ্গ-ফরঙ্গ আমদানি হল! 

১৯০৮ সালে রবীন্দ্রনাথ যখন এই কমিউনাল গানখানা লিখলেন, তার ছ' বছর আগে বিবেকানন্দ মারা গেছেন, যাওয়ার আগে রামকৃষ্ণ মিশন নামে মন্দির বানিয়ে মানুষের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতার বীজ পুঁতে গেছেন। আশপাশের এলাকার খবর হচ্ছে ক্ষুদিরাম বসু নামে এক ষোল বছরের বালককে ফাঁসি দেওয়া হয়েছে, আলিপুর বোমার মামলার বিচার শুরু হচ্ছে, কাঠগড়ায় আর এক কমিউনাল কবি অরবিন্দ ঘোষ। তিনিও কিছুদিন পরে সামহাউ বেঁচে গিয়ে তরঙ্গের খোঁজে ব্রিটিশদের কাছ থেকে পালিয়ে যাবেন ফ্রেঞ্চ কলোনি পন্ডিচেরিতে। সেখানে উনিও আশ্রম নামের মন্দির বানিয়ে মানুষের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টিতে আত্মনিয়োগ করবেন। 

ব্রিটেনে তখন সায়েন্স চলছে রমরমিয়ে। আর্নেস্ট রাদারফোর্ড নামে এক সাঁইত্রিশ বছর বয়সী যুবক ক্যানাডা থেকে সদ্য জয়েন করেছেন ম্যাঞ্চেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ে। প্রফেসর আর্থার সুস্টার নামে এক পদার্থবিদ সেখান থেকে রিটায়ার করেছেন, তার জায়গায়। সুস্টারের কাছে পোস্টডক করছিলেন হান্স গাইগার নামে ছাব্বিশ বছর বয়সী এক জার্মান ছাত্র। তিনি আর আর্নেস্ট মার্সডেন নামে স্থানীয় এক উনিশ বছর বয়সী ছাত্র একদিন পাতলা একটা সোনার পাতের ওপর আলফা-কণার বুলেট মেরে এমন সব রেজাল্ট পেলেন, যাতে পরমাণুর গঠন সম্বন্ধে মানুষের ধারণাই বদলে গেল। 

বিবেকানন্দ শিকাগোতে বক্তৃতা দিয়ে যখন একগাদা ভক্ত জোগাড় করছিলেন, তখন থেকেই ইওরোপে এইসব জিনিস নিয়ে নাড়াচাড়া হচ্ছে। রন্টজেন নামে একজন বিজ্ঞানী দুর্দান্ত প্ল্যান-ট্যান করে এক্স-রে আবিষ্কার করে ফেললেন। হেনরি বেকারেল চোখে আঙুল দিয়ে দেখালেন ইউরেনিয়ামের কম্পাউন্ড থেকে এমনিই 'রে' বেরোয়, তিনি তাকে বললেন ইউরেনিক রে। ফ্রান্সে পি এইচ ডি করতে এসেছে একটা ইয়াং মেয়ে, মেরি স্ক্লোডস্কা, তাকে ডিপার্টমেন্টের হেড বললেন, এই ইউরেনিয়ামের কেসটা বেশ ইন্টারেস্টিং, এটা একটু দেখো তো। মেরি সেটা নিয়ে যে লড়বে, তার চাই একটা যন্ত্র, যা দিয়ে অল্প পরিমাণ কারেন্ট মাপা যায়। ল্যাবের এক কোণে পড়ে ছিল চোদ্দ-বছর আগে ওখানেই তৈরি এক ইলেক্ট্রোমিটার, বানিয়েছিলেন ওখানকার ল্যাব অ্যাসিস্ট্যান্ট পিয়ের কুরি। মেরি গিয়ে তাকে ধরল, তোমার ঐ মেশিনটা একটু ঝেড়েঝুড়ে চালু করে দাও না। সেই নিয়ে লড়তে লড়তে মেরি পিয়েরের প্রেমে পড়ে তাকে বিয়ে করেই ফেললেন না শুধু, আবিষ্কার করে ফেললেন দু-খানা নতুন এলিমেন্টও। ইউরেনিক রে-র ব্যাপারটার তিনি নামকরণ করলেন রেডিও-অ্যাক্টিভিটি। আলফা রে, বিটা রে, গামা রে নামের সব অদ্ভুত রশ্মি বেরোয় সেই সব এলিমেন্ট থেকে। পুরনো আমলের মাইকের চোঙার মত শঙ্কু-আকৃতির এক ভ্যাকুয়াম টিউবে – ক্রুকস টিউবে – ইলেকট্রিক ডিসচার্জ ঘটিয়ে আগে ক্যাথোড রে নামের এক জিনিস পাওয়া গেছিল। ১৮৯৭ সালে জে জে থমসন দেখালেন এই রশ্মি আসলে ঋণাত্মক তড়িৎবাহী এক কণা, তিনি তার নাম দিলেন ইলেকট্রন। পরমাণুর মধ্যে এই ইলেকট্রন কীভাবে থাকে, তার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে লর্ড কেলভিন বললেন, নিশ্চয় পরমাণু হচ্ছে একটা তরমুজ, আর ইলেকট্রন থাকে যেমন তরমুজে থাকে কালো কালো বিচি। এই থিওরি অবশ্য খুব বেশি লোকের পছন্দ হল না। ইলেকট্রনের চার্জ নেগেটিভ। তাহলে পজিটিভ জিনিসটা কই? পরমাণু তো নিউট্রাল। 

গাইগার-মার্সডেনের রেজাল্ট হাতে পেয়ে রাদারফোর্ড ব্যাখ্যা করলেন কেলভিনের ঐ তরমুজ স্ট্রাকচার ঠিক না। পরমাণুর মধ্যে ব্যাপক জায়গা ফাঁকা, তরমুজের মত রসালো শাঁস দিয়ে ভর্তি না। মধ্যে এক ছোট্ট জায়গায় এর যাবতীয় ভর সন্নিহিত, তিনি তাকে বললেন নিউক্লিয়াস। এই নিউক্লিয়াসের চারদিকে অনেক দূর দিয়ে ঘুরছে ইলেকট্রন, নিউক্লিয়াসের তুলনায় তার ভর প্রায় কিছুই না। ইলেকট্রন নেগেটিভ মানে নিউক্লিয়াস পজিটিভ। বছর দশ-বারো পরে তিনি সেই নিউক্লিয়াসের মধ্যের কণাগুলোর নামকরণ করলেন প্রোটন। 

কিন্তু এ তো অনেক পরের ব্যাপার। এর মধ্যে অনেক ঝামেলা হয়ে গেছে। গাইগারদের ঐ পরীক্ষার বছর তিনেক আগেই পর পর দুখানা ইকুয়েশন বাজারে নামিয়েছেন ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক আর অ্যালবার্ট আইনস্টাইন। একজন বললেন ই ইজুকাল্টু এইচ নিউ। ই মানে এনার্জি, নিউ মানে ফ্রিকুয়েন্সি, এইচ হচ্ছে একটা কনস্ট্যান্ট, তার নামানুসারে সেটা হয়ে গেল প্ল্যাঙ্ক কনস্ট্যান্ট। আইনস্টাইন বললেন ই ইজুকাল্টু এম সি-স্কয়ার। এম হচ্ছে মাস, সি হচ্ছে ভ্যাকুয়ামে আলোর অর্থাৎ ফোটনের গতিবেগ, যেটা একটা কনস্ট্যান্ট। 

ডি ব্রগলি নামে এক করিৎকর্মা তরুণ এই দুটো ইকুয়েশন দেখেই এইচ নিউ ইজুকাল্টু এম সি-স্কয়ার করে নিউ আর এম-এর একটা সম্পর্ক বের করে বললেন – এই দ্যাখো, জনগণ, এম মানে মাস, যা থাকে পার্টিকেলের; নিউ মানে ফ্রিকুয়েন্সি, যা থাকে তরঙ্গের। সুতরাং প্রত্যেক পার্টিকেলের ওয়েভও আছে। মাস বেশি হলে এই ওয়েভ হয়ত সেভাবে বুঝতে পারবে না, কিন্তু মাস যদি ছোট হয়, যেমন কিনা পরমাণু বা তার মধ্যের জিনিসপত্র, তবে তার ওয়েভ-নেচারও থাকবে। 'বিপুল তরঙ্গ রে, বিপুল তরঙ্গ রে!'

যাহাই পার্টিকেল, তাহাই ওয়েভ – এই তত্ত্বের নাম হয়ে গেল ওয়েভ-পার্টিকল ডুয়ালিটি। আইনস্টাইনের ইকুয়েশন অনেকে বুঝল না, বলতে লাগল মাস ক্যান বি কনভার্টেড টু এনার্জি। আরে ধুর, উনি থোড়াই মাসকে কনভার্ট করার কথা বলছিলেন – মাসই এনার্জি। দুটো রাশি যদি কনস্ট্যান্ট দিয়ে জোড়া হয়, তবে তারা একই জিনিস। এক কিলোমিটার ইজুকাল্টু এক হাজার মিটার মানে কিলোমিটার আর মিটার বলতে একই জিনিস বোঝায়, সেটা দূরত্ব। সেই রকম ই আর এম একই জিনিস, মাসকে আলোর গতিবেগের বর্গ দিয়ে গুণ করলে ই পাওয়া যায়। 

রাদারফোর্ডের পরমাণুর গঠনও সমালোচনার মুখে পড়ল। একটা পজিটিভ চার্জের জিনিসের চারদিকে একটা নেগেটিভ চার্জের জিনিস ঘুরবে কী করে? মুখ থুবড়ে পড়বে না ওর ওপরে? পজিটিভ-নেগেটিভ নিউট্রালাইজ হয়ে যাবে না? একে একে এগিয়ে এলেন নীলস বোর, সমারফিল্ড আরও তাবড় তাবড় সব বিজ্ঞানীরা। বললেন, না, তা হত যদি ইলেকট্রনকে যেমন-তেমন ঘুরতে দিতে। কিন্তু এরা যদি কিছু নির্দিষ্ট কক্ষপথে নির্দিষ্টভাবে ঘুরতে থাকে, তাহলে তেমন হবে না। শ্রডিঙ্গার ঝোলা থেকে বের করলেন অদ্ভুত বেড়াল। তৈরি হতে লাগল কোয়ান্টাম তত্ত্ব। 

ব্যাপারটা এখানেই শেষ হয়ে গেলে তো কথাই থাকত না। কিন্তু এর ফলে আরও গুচ্ছ গুচ্ছ প্রশ্ন তৈরি হল। এর মধ্যে নিউক্লিয়াসে প্রোটনের সঙ্গে নিউট্রন নামে এক ধর্ম- থুড়ি, তড়িৎ-নিরপেক্ষ কণারও সন্ধান পাওয়া গেছে। অর্থাৎ, নিউক্লিয়াসে আছে প্রোটন আর নিউট্রন, খুব অল্প জায়গা জুড়ে। পরমাণুর ভর প্রায় পুরোটাই সেখানে থাকে। তাদের চারদিকে নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে বিভিন্ন কক্ষপথে ঘুরে বেড়ায় ইলেকট্রনরা। হাইড্রোজেন পরমাণুতে নিউট্রন নেই, তাই সিম্পল স্ট্রাকচার, একটা প্রোটনকে বেষ্টন করে বৃত্তাকার পথে ঘোরে একটা ইলেকট্রন। এই ইলেক্ট্রনের স্পিড আলোর স্পিডের দশভাগের একভাগের কিছু কম, প্রতি সেকেন্ডে নিউক্লিয়াসের চারদিকে সাড়ে ছয় কোয়াড্রিলিয়নবার ঘুরে (একের পর পনেরটা শূন্য মানে এক কোয়াড্রিলিয়ন) সেই একলা ইলেকট্রন নাকি ২২০০ কিলোমিটার দূরত্ব অতিক্রম করে। 

তো এর পর প্রশ্ন উঠল, একাধিক পজিটিভ চার্জওয়ালা প্রোটন অত্যন্ত ঘনসন্নিবিষ্ট অবস্থায় নিউক্লিয়াসে কী করে থাকে? হাইড্রোজেন পেরোলেই হিলিয়াম থেকে সমস্ত পরমাণুতে একাধিক প্রোটন থাকে। তারা কী করে থাকে? একা রামে রক্ষা নেই, তাদের সঙ্গে সুগ্রীব দোসরের মত লেপ্টে থাকে নিউট্রনও। 

কাজেই প্রোটন এবং সেই সঙ্গে নিউট্রনকেও আর ফান্ডামেন্টাল পার্টিকল বলা গেল না। তাদের স্টেবিলিটি ব্যাখ্যা করার জন্যে এসে গেল আরও জটিল তত্ত্ব, অধিকাংশটাই অঙ্ক। 

আমি যেহেতু অঙ্ক বলতে যোগ বিয়োগ গুণ ভাগের ওপরে কিছু বুঝি না, তাই এ সব বোঝার আগে ফিরে গেলাম 'আমি কে' – এই প্রশ্নে। ধরে নিলাম, আমি সত্তর কেজি ভরের এক বস্তু, যার অধিকাংশটাই জল আর কেমিস্ট্রি খানিকটা পড়েছিলাম বলে পিরিয়ডিক টেবিলের মালপত্তরগুলো মুখস্থ করেছিলাম। তো আমার এই সত্তর কেজির কম্পোজিশন মোটামুটি এই রকম – 
৬৫% অক্সিজেন, ১৮.৫% কার্বন, ৯.৫% হাইড্রোজেন, ৩.২% নাইট্রোজেন, ১.৫% ক্যালশিয়াম, ১% ফসফরাস, ০.৪% পটাশিয়াম, ০.৩% সালফার, ০.২% সোডিয়াম, ০.২% ক্লোরিন, ০.১% ম্যাগনেশিয়াম আর বাদবাকি অতি সামান্য অংশ অন্যান্য গোটা পঁচিশেক এলিমেন্ট দিয়ে। এর প্রত্যেকটার মধ্যে কটা করে ইলেকট্রন, প্রোটন, নিউট্রন আছে, তা আমার জানা। একটা ইলেকট্রনের তুলনায় একটা প্রোটন প্রায় ১৮৩৬ গুণ আর নিউট্রন প্রায় ১৮৩৮ গুণ ভারী। কাজেই আমার সত্তর কেজির শরীর এইসব জটিল পাটিগণিত কষে দাঁড়াল – ৩৮.৪২১ কেজি প্রোটন, ৩১.৫৫৮ কেজি নিউট্রন এবং ২১ গ্রাম ইলেকট্রন। এই কেলেঙ্কারিয়াস ক্যালকুলেশন আর কেউ করেছে কিনা আমি জানি না, মনে হয় আমিই প্রথম।  

কিন্তু দাঁড়ান। ওই যে বললাম, প্রোটন আর নিউট্রন এখন আর ফান্ডামেন্টাল পার্টিকল না, কেননা একাধিক ইলেকট্রোপজিটিভ প্রোটন এক জায়গায় চেপেচুপে থাকতে পারে না। এর ব্যাখ্যায় প্রতিটি প্রোটন তৈরি হয়েছে তিনখানা কোয়ার্ক নামের পার্টিকল দিয়ে, দুটো আপ-কোয়ার্ক যাদের প্রত্যেকটার চার্জ ২/৩ই (এই ই হচ্ছে ইলেকট্রনের চার্জ, এখানে পজিটিভ) করে মোট ৪/৩ই, আর একটা ডাউন-কোয়ার্ক, যার চার্জ নেগেটিভ ১/৩ই, তাহলে তিনে মিলে প্লাস-ই। তেমনি নিউট্রনও তৈরি তিনখানা কোয়ার্ক দিয়ে, একটা আপ-কোয়ার্ক যার চার্জ ২/৩ই, দুখানা ডাউন-কোয়ার্ক, এক একটা নেগেটিভ ১/৩ ই করে মোট নেগেটিভ ২/৩ই, ফলে মোটমাট শূন্য। 

চার্জ মিলে গেল, এবার মাস। এখানেই আসল খেল। তিনখানা কোয়ার্ক মিলে যা ভর, তা প্রোটন বা নিউট্রনের ভরের অতি সামান্য অংশ, প্রায় ১% মত। বাকি ৯৯% ভর কোত্থেকে আসছে? এদের ব্যাখ্যা দিতে তৈরি হল বিশেষ থিওরি – এই ভর হচ্ছে কোয়ার্কদের বেঁধে রাখার জন্যে গ্লুয়ন নামে এক ফিল্ডে কোয়ান্টাম ক্রোমোডায়নামিক বাইন্ডিং এনার্জির জন্যে, যার মধ্যে আছে এই কোয়ার্কগুলোর বীভৎস স্পিডে ঘূর্ণনে উৎপন্ন গতিশক্তিও। ঐ যে আইনস্টাইন বলে গেছেন মাসই এনার্জি, এ হচ্ছে সেই এনার্জি। অ্যাটম বোম-টোম থেকে আমরা যে শক্তি পাই, তা এর কাছে কিছুই না। কেননা তাতে একটা বড় নিউক্লিয়াস ভেঙে দু-টুকরো হয় মাত্র। যে কোনো পরিমাণের বস্তু থেকে তার সমতুল আইনস্টাইনীয় এনার্জি সম্ভবত পাওয়া যাবে যদি তার প্রত্যেকটা ফান্ডামেন্টাল পার্টিকলকে আলাদা করে ফেলা যায়। 

সে যাই হোক, এ সবের মানে হচ্ছে আমার এই সত্তর কেজির শরীরে ঐ ২১ গ্রাম ইলেকট্রন ছাড়া বাকি যে ভর, তার নিরানব্বই শতাংশই হচ্ছে অঙ্ক। আপ-ডাউন কোয়ার্ক গ্লুয়ন ফিল্ডে পাঁই পাঁই করে ঘুরছে বলে সেই ভর নাকি তৈরি হয়েছে। বিপুল তরঙ্গ রে, বিপুল এ রঙ্গ রে!

আপাতত বলা যায়, এই ব্যাপারটাও নিঃসন্দেহ নয়। মানে এই অঙ্কের মধ্যেও অনেক ঘাপলা আছে, যে জন্যে জানা যায়নি অনেক গূঢ় প্রশ্নের উত্তরও। নিউট্রনের যেমন একলা থাকার উপায় নেই, তাকে আলাদা করে রাখলে ১৫ মিনিটেই সে একটা প্রোটন ও একটা ইলেকট্রনে পরিণত হয়ে যায়। প্রোটন কি পুরো স্টেবল? সে যদি গ্লুয়ন-ফিল্ডে কোয়ার্ক দিয়ে তৈরি, তবে প্রোটনের স্পিন কী করে ব্যাখ্যা করা যায়? 

সেই যে কারা যেন বলে গেছিলেন, সবই মায়া, হয়ত আল্টিমেটলি সেখানেই পৌঁছে যাওয়া যাবে এক সময়। এখনও অবধি কোয়ার্কে ১% ভর রেখে কিছুটা ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে। এর পর কোয়ার্কগুলো ভরশূন্য কী দিয়ে তৈরি হয়া সম্ভব, যার ফলে এখনকার অমীমাংসিত প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে, সে সব তত্ত্ব কবে আসবে, কে জানে। 

আপাতত আধুনিক বিজ্ঞান বলছে আমাদের ভরের ৯৯% হচ্ছে কোয়ার্কের গতি। 

আগে বলা হল মাস যার থাকে সেই পার্টিকল, এখন মাস ব্যাপারটাই ধোঁয়া হয়ে গেল! তাহলে পার্টিকল জিনিসটা আসলে কী? আলোকের কণাকে বলা হয় ফোটন, যা কিনা ইলেকট্রোম্যাগনেটিক রেডিয়েশন। ইলেকট্রিক আর ম্যাগনেটিক ফিল্ড মিলে ইলেকট্রোম্যাগনেটিক ফিল্ডের ব্যাপার আমরা জানি। যে-কোনো ফিল্ডের এক্সাইটেড স্টেটকে বলা হয় পার্টিকল। পাতি বাংলায় হয়ত তুলনা করা যেতে পারে এই রকম - আমাদের মাথার মধ্যে অহরহ বিচিত্র ভাবনা চলছে, যা আমরা টেরও পাই না। তাকে যদি আমরা ধরে নিই একটা ফিল্ড, হঠাৎ যখন তাতে একটা আইডিয়া এসে যায় (যে জন্যে আমি এই লেখাটা লিখছি, ধরা যাক সেই আইডিয়াটাই), সেটা আসে এই ফিল্ডের একটা মোমেন্টারি এক্সাইটমেন্ট থেকেই। এই ইউরেকা-মার্কা আইডিয়া হচ্ছে ঐ ফিল্ডে উৎপন্ন পার্টিকলের সমতুল।

ভেবে দেখুন, এই যে জটিল সব ফান্ডামেন্টাল পার্টিকল, এর আদ্ধেকের ব্যাপারটা অঙ্ক কষে বলে গেছিলেন আমাদের সত্যেন্দ্রনাথ বসু। তাঁর নামেই বোসন কণা, যারা বোস-আইনস্টাইন স্ট্যাটিসটিক্স মানে, যেমন ফোটন, গ্লুয়ন এই ভরহীন জটিল বস্তুগুলো। বাকিরা মানে ফার্মি-ডিরাক স্ট্যাটিস্টিক্স, তাদের নাম ফার্মিয়ন, যেমন ইলেকট্রন, আপ-ডাউন কোয়ার্ক, এটসেট্রা।

তাহলে আল্টিমেটলি কী দাঁড়াল? দিন দিন আধুনিক বিজ্ঞানও ভয়ঙ্করভাবে সাম্প্রদায়িক হয়ে উঠছে। বলছে বস্তু মানে গতি, মানে সবই মায়া! সত্তর কেজির মালে হিসেব পাওয়া যাচ্ছে মাত্র সাতশো একুশ গ্রামের! জিডিপির বারোটা বাজবে না তো কী হবে?

ডাক্তারবাবুর মেস ~ অর্ক ভাদুরী

110 College Street

১১০ নম্বর, কলেজ স্ট্রিট।

বি বি গাঙ্গুলি মোড়ের শহীদবেদী ছাড়িয়ে একটু এগোলেই ছানাপট্টির প্রায় গা ঘেঁষে এই তিনতলা বাড়িটা। ১৯১১ থেকে ১৯১৬ পর্যন্ত এর তিনতলায় ছিল 'ডাক্তারবাবুর মেস'। ডাক্তারবাবু মানে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়। প্রফুল্লচন্দ্র নিজে থাকতেন না বটে, কিন্তু প্রেসিডেন্সি কলেজে ক্লাস শেষ হলে প্রায় প্রতিদিন বিকেলে তাঁর ঘোড়ায় টানা গাড়ি এসে দাঁড়াত এই মেসবাড়ির দরজায়। এখানে থাকতেন মেঘনাদ সাহা, জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ, জ্ঞানেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, সতীশচন্দ্র সেন, ক্ষিতীশচন্দ্র সেন-সহ জনা পনেরো তরুণ। সকলেই প্রফুল্লচন্দ্রের ছাত্র বা ছাত্রস্থানীয়।


মেঘনাদ সাহা ১৯১১ সালে ইন্টারমিডিয়েটে থার্ড হয়ে প্রেসিডেন্সিতে পড়তে এসে প্রথমে থাকতে শুরু করেন ইডেন হিন্দু হস্টেলে। কিন্তু 'ছোট জাত' হওয়ায় সেখানে তাঁকে নানাবিধ হেনস্থা সহ্য করতে হত। একসঙ্গে খেতে চাইতেন না বাকিরা, বারান্দার এক কোণে বসে খেতে হত ইত্যাদি ইত্যাদি। কিছুদিন পরে তাই তিনি উঠে এলেন ১১০ নম্বর মেসবাড়িতে। এখানে আর কোনও সমস্যা রইল না, সকলেই হাতে হাতে কাজকর্ম করতেন- রান্না করা, বাজার করা, বাটনা বাটা- সবই নিজেদের দায়িত্বে।

প্রতিদিন বিকেলে প্রফুল্লচন্দ্র তো আসতেন বটেই, সঙ্গে আসতেন বঙ্গবাসী কলেজের প্রিন্সিপাল গিরিশচন্দ্র বসু, সুরেন্দ্রনাথের সহকর্মী সত্যানন্দ বসু, জবাকুসুম তৈল প্রতিষ্ঠানের উপেন্দ্রনাথ সেন-সহ একঝাঁক দিকপাল। ছাত্রসম মেঘনাদ সাহাদের সঙ্গে নিয়ে তাঁরা চলে যেতেন ময়দানে, লর্ড রবার্টের মূর্তির (১৯৬৯ সালে অপসারিত) নিচে। সেখানে প্রায় ঘন্টা দু'য়েক ধরে চলত নির্ভেজাল আড্ডা- যুদ্ধ থেকে রাজনীতি, সংস্কৃতি থেকে ফুটবল- সবকিছু নিয়েই  প্রাণখোলা তর্কবিতর্ক, হাসিঠাট্টা। গড়ের মাঠের এই আড্ডার খবর রাখতেন মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধিও। তিনিই নাকি এই আড্ডার নাম দিয়েছিলেন 'ময়দান ক্লাব'। বলা বাহুল্য, আড্ডার মধ্যমণি ছিলে স্বয়ং প্রফুল্লচন্দ্র।


জমজমাট এই মেস-বাড়িতে আর একজনও ছিলেন নিয়মিত অতিথি। বিপ্লবী যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়। বাঘা যতীন। ততদিনে তিনি গুপ্ত বিপ্লবী সংগঠনের অন্যতম প্রধান সংগঠক। বিদেশ থেকে অস্ত্র এনে সশস্ত্র বিদ্রোহের পরিকল্পনা করছেন। এর ফাঁকেই মাঝেমধ্যে হাজির হতেন বন্ধু মেঘনাদ সাহার মেসে। সময় পেলে মেঘনাদের ভাই কানাইলালকে ইংরেজিও পড়াতেন।

একদিন খবর এল মেস থেকে বেরিয়ে যতীন্দ্রনাথ আহিরিটোলায় এক পুলিশ অফিসারকে গুলি করে পালিয়েছেন। ১১০ নম্বর কলেজ স্ট্রিটে তুমুল উত্তেজনা! মেস থেকে বেরনোর সময় যতীন্দ্রনাথের সঙ্গে ছিল জ্ঞানচন্দ্রের নাম লেখা একখানা বই। যদি কোনও কারণে পুলিশ বাঘা যতীনকে ধরতে পারে, তাহলে তো মহাবিপদ! মেসবাড়ির বাসিন্দারাও রক্ষা পাবেন না।


সেই যাত্রা অবশ্য যতীন্দ্রনাথের নাগাল পায়নি পুলিশ। তবে এই মেস-বাড়িতে আর কখনও আসা হয়নি তাঁর।এর কিছুদিন পরেই বুড়িবালামের তীরে নিজের রক্ত দিয়ে তিনি লিখবেন নতুন ইতিহাস। সেটা ১৯১৫ সালের অগস্ট মাস।

ওই বছরেই মেঘনাদ সাহা এম এস সি পরীক্ষায় ফার্স্ট ক্লাস সেকেন্ড হলেন, ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হলেন সত্যেন্দ্রনাথ বসু। তারপর আরও কিছুদিন ওই মেস-বাড়িতেই ছিলেন সকলে। তখনও মেঘনাদ সাহা চাকরি পাননি, একটা সাইকেলে করে শহরের উত্তর থেকে দক্ষিণে চড়কিপাক খেয়ে তিনটি টিউশন করতেন। চাকরি পেলেন পরের বছর, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফলিত গণিতের অধ্যাপনা। মেসের বাকি আবাসিকরাও আস্তে আস্তে ছড়িয়ে পড়লেন বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে। সিট তো আর ফাঁকা থাকে না, নতুন আবাসিকেরা আসতে শুরু করলেন।

ডাক্তারবাবুর মেসের সোনার দিনগুলি শেষ হয়ে গেল।


লকডাউনে পুরনো কলকাতার খোঁজখবর নিচ্ছি ঘুরে ঘুরে। সুনীল মুন্সির বইতে এই বাড়িটার কথা প্রথম পেয়েছিলাম। তারপর ডোয়ার্কিনের ইতিহাস ঘাঁটতে গিয়েও দেখলাম ১১০ নম্বর কলেজ স্ট্রিটের উল্লেখ। একদিন দুপুরবেলার পৌঁছে গেলাম বাড়িটায়। বাইরে রঙের প্রলেপ, ভিতরটা ঘুপচি, অন্ধকার। সিঁড়িতে বিকট গন্ধ। দো'তলায় পাইপ মার্চেন্টদের দোকান, তিনতলায় কয়েকটি পরিবারের বাস। ডাক্তারবাবুর মেসের কথা কেউ কেউ জানেন, অনেকে প্রফুল্লচন্দ্রের নামই শোনেননি৷ বৃষ্টি হচ্ছিল, খানিকক্ষণ আড্ডা দিয়ে  চা-বিস্কুট খেয়ে বিদায় নেওয়া গেল।

সোমবার, ১৭ আগস্ট, ২০২০

পক্ষপাতদুষ্ট ফেসবুক ~ সুশোভন পাত্র

আপনার প্রোফাইলের রিচ কমে গেছে? আগের মত 'লাইক' হচ্ছে না? পেজের এনগেজমেন্ট ঝাড় খাচ্ছে? আপনার বন্ধুও কি "স্টিকার কমেন্ট প্লিজ" –করুন আর্তি জানাচ্ছে? রিফ্রেশ করলেও বারবার বস্তাপচা পোস্টই দেখতে পাচ্ছেন? সেক্সিস্ট, মিসোজিনিস্ট, হেট-স্পিচের প্রোফাইল গুলো মার্কেটে দিব্যি কলার তুলে ঘুরে বেড়াচ্ছে? রিপোর্ট করে লাভ হচ্ছে না বলছেন? ঠিকই বলছেন! অবাক হবেন না। আসলে আপনি ফেসবুকের ফাঁদে পড়েছেন! সিট ব্যাক, রিল্যাক্স অ্যান্ড লেট মি এক্সপ্লেন! 
প্রতিটা রান্নার যেমন নির্দিষ্ট একটা রেসিপি আছে; যেমন আপনি শুক্তো তে শুঁকনো লঙ্কা, আদাবাটা পাঁচ-ফোড়ন ব্যবহার করেন, ভিনিগার তো ঢালেন না, চিলি চিকেনে ক্যাপ্সিকাম ব্যবহার করেন কাঁচকলা তো দেন না; ঠিক সেরকমই যেকোনো কম্পিউটার গত বিষয়েও একটা রেসিপি আছে –টেকনিক্যাল টার্মে, অ্যালগরিদম। রেসিপি যেমন ধাপে ধাপে আপনাকে বলে দেয় কোন তেল ব্যবহার করবেন, কোন রান্নার শেষ চিনি মেশাবেন, কোনটায় কসুরি মেথি তড়কা মারবেন; ফেসবুকের অ্যালগরিদমও তেমন ঠিক করে দেয় কোন পেজের পোস্ট লোকে বেশি দেখবে, কার পোস্ট না চাইলেও টাইমলাইনে ভেসে উঠবে, কোনটা হালকা চেপে যাবে, কি করলে কমিউনিটি স্ট্যান্ডার্ড ভায়োলেট হবে, কোন ক্ষেত্রে প্রোফাইল রিপোর্ট খাবে। 
আচ্ছা এই অ্যালগোরিদম কি নিজে নিজেই রাজনৈতিক পক্ষপাতদুষ্ট হতে পারে? না! কিন্তু অ্যালগোরিদম লেখার কিম্বা ব্যবহার করার মানুষটা তো রাজনৈতিক পক্ষপাতদুষ্ট হতেই পারে, তাই না? আর সেরকমই গুরুতর অভিযোগ ফেসবুকের বিরুদ্ধে। আমেরিকার সংবাদমাধ্যম ওয়ালস্ট্রিট জার্নাল ১৪ই অগাস্টের আর্টিকেলে নির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে লিখেছে যে, ভারতে ফেসবুকের পলিসি মেকাররা ব্যাপকভাবে বিজেপির পক্ষে রাজনৈতিক পক্ষপাত দুষ্ট। কেমন?
অ্যালগরিদম অনুযায়ী ফেসবুকে ঘৃণা ছড়ানোর পোস্ট করা যায় না। এই বিষয়ে নজরদারির জন্য ভারতে ফেসবুকের যে টিম রয়েছে, সেই টিমই তেলেঙ্গানার বিজেপি নেতা টি রাজা সিং-র "মুসলিমরা বিশ্বাসঘাতক এবং রোহিঙ্গা মুসলিমদের গুলি করে মারা উচিৎ" –সংক্রান্ত ফেসবুক পোস্টটি ডিলিট করার এবং তাঁকে 'বিপজ্জনক ব্যক্তি' হিসেবে চিহ্নিত করে অ্যাকাউন্টটি স্থায়ী ভাবে ব্যান করার প্রস্তাব পাঠায় টিম-লিড অফিসারের কাছে। তালিকায় ছিল দিল্লির দাঙ্গার আগে কপিল মিশ্রর উস্কানি মূলক ভিডিও, অনন্ত হেগড়ের সাম্প্রদায়িক মন্তব্যও। 
কিন্তু সর্ষের মধ্যেই ভূত। টিম লিড, সাউথ এশিয়ান জোনের ফেসবুকের পাবলিক পলিসি এক্সিকিউটিভ অফিসার আঁখি দাস বিজেপির নেতাদের পোস্ট ডিলিট কিম্বা অ্যাকাউন্ট ব্যান তো দুরস্ত, 'ব্যবসার ও শাসক পক্ষের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষতি হবে' -অজুহাতে একের পর এক সাম্প্রদায়িক পোস্ট অনুমোদন করতে থাকেন। 

কে এই আঁখি দাস? যিনি নিজে মোদীর প্রশংসায় অহরহ পোস্ট করেন। রবিশঙ্কর প্রসাদ, স্মৃতি ইরানির সঙ্গে গদগদ সেলফি তোলেন। ফেসবুকে ভারতীয় মুসলিমদের সম্পর্কে অবমাননাকর মন্তব্যকে সমর্থন করেন। এবং যার দিদি রশ্মি দাস JNU-র ABVP-র প্রেসিডেন্ট ছিলেন। রশ্মি দাস বর্তমানে WOSY-র নামে একটি NGO চালান। যে WOSY-র লিঙ্ক আপনি দেখতে পাবেন ABVP-র ওয়েবসাইটে। যে WOSY-র অফিস আপনি খুঁজে পাবেন দিল্লির RSS ভবনে! 
চেস বোর্ডে আঁখি দাস নেহাত বোড়ে। আড়ালের সমীকরণটাই রাজা। বিজেপি সরকার পলিসি মেকিং-এ ফেসবুক কে ব্যবসার  বাড়তি সুযোগ দেবে। আর বিনিময়ে ফেসবুকে বিজেপি নেতারা ফেসবুকে ইচ্ছেমত ঘৃণা ছড়াবে। বিজেপি বিরোধী পোস্ট সেন্সর হবে। এটা বুঝতে আপনাকে শার্লক হোমস লাগবে না। রাজস্থান নির্বাচনের আগে অমিত শাহই বলেছিলেন -"যে কোন খবর মুহূর্তের মধ্যে ভাইরাল করার ক্ষমতা আমাদের আছে। সে খবর টক-মিষ্টি-ঝাল কিম্বা মিথ্যা যাই হোক।" 
ফেসবুকের সর্ববৃহৎ মার্কেট ভারতে। ইউজার ২৯০ মিলিয়ন। তাই মোদীর জয়ের পরেই জুকেরবার্গ নিজেই আসেন ভারতে। সরকারের সঙ্গে ফেসবুকের বাণিজ্যিক প্রকল্পও চূড়ান্ত হয়। আর হালফিলের ক্রনলজিটাও দেখুন, ফেসবুক জিও-র সঙ্গে ৫.৭ বিলিয়ন ডলারের চুক্তি করল। টিকটক ব্যান হল। ফেসবুকের অধীনস্থ ইন্সট্রাগ্রাম টিকটকের অনুরূপ 'রিল্স' অ্যাপ বের করল এবং মুখ থুবড়ে পড়ল। দেরি না করে জিও-ও টিকটক কেনার নেগোশিয়েশন শুরু করল। 
রাজনৈতিক পক্ষপাত ছাড়া ব্যবসায়িক কারণেও ফেসবুকের অ্যালগরিদম খুবই চপল। ২০১২-র পরবর্তী সময়ে এই চপলতার মুখ্য লক্ষ্য, পোস্টের অরগ্যানিক রিচ কমিয়ে ইউজারদের পয়সা খরচে বাধ্য করা। ২০১২ তে, ফেসবুকে, আপনার পোস্ট অরগ্যানিক ভাবে, নিজেদের টাইমলাইনে দেখতে পেতেন প্রায় ১৬% 'ফ্রেন্ডস-ফলয়ার্স'। ২০১৫ তে সেটা ৫.৪%। ২০২০ শুরু থেকে সেটা ১%-র কাছাকাছি। অর্থাৎ আপনার ফ্রেন্ডলিস্টে ৫০০০ বন্ধু থাকলেও, কোন একটি নির্দিষ্ট সময়ে, আপনার পোস্ট দেখতে পাচ্ছেন হাতে গোনা কয়েকজন। সোজা হিসেব, ফেলো কড়ি মাখো তেল। 
রইলো বাকি ডেটা সিকিউরিটি! ট্রাম্প কে জয়ী করতে কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা কে কিভাবে ফেসবুক সাধারণ মানুষের ব্যক্তিগত ডেটা ব্যবহার করার সুযোগ করে দিয়েছিল কিম্বা সম্প্রতি দিল্লির দাঙ্গা তে সাধারণ মানুষের ব্যক্তিগত ডেটা কিভাবে সাম্প্রদায়িক কারণে ব্যবহার হয়েছিল এসব আপনি ইন্টারনেট ঘাঁটলেই টুকটাক পাবেন। কিন্তু ডেটা সিকিউরিটি, বিগ ডেটা, ডেটা মাইনিং, AI-র হাতে গরম একটা উদাহরণ হল, ফেসবুক লগ-ইন থাকা অবস্থায় অ্যামাজনে একটা মিক্সচার গ্রাইন্ডার, কিম্বা মিন্ত্রা তে একটা সালোয়ার কামিজ সার্চ করে দেখুন; দুদিন পর দেখবেন ফেসবুকে বন্ধুদের পোস্টের মাঝে জুকেরবার্গ আপনাকে মিক্সচার গ্রাইন্ডার কিম্বা সালোয়ার কামিজের বিজ্ঞাপন দেখাতে শুরু করেছে।
যদি মনে হচ্ছে এসব আধুনিক তথ্য-প্রযুক্তির বিষয়ে সরকার কি করবে -তাহলে আপনি কার্টুন নেটওয়ার্ক দেখুন। ডেটা সিকিউরিটির কারণেই চিনের মত ফেসবুক ব্যান করে বিকল্প প্ল্যাটফর্ম বানাতে না পারলেও, পৃথিবীর বহু দেশ নাগরিকদের ব্যক্তিগত ডেটা নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে শক্তিশালী আইন প্রণয়ন করে, সেই শর্তের স্বত্বেই ফেসবুককে সে দেশ ব্যবসা করা অনুমোদন দিয়েছে। ফ্রান্স-জার্মানি সহ EU-র বহু দেশ ছাড়াও তালিকায় আছে ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়াও। 
নিশ্চয় ফেসবুকের রাজনৈতিক পক্ষপাতদুষ্টতার বিরুদ্ধে লড়তে হবে। নিজেদের পোস্টে এনগেজমেন্ট বাড়িয়ে সংঘবদ্ধ হয়েই লড়তে হবে। ডেটা সিকিউরিটি, নেট নিউট্রালিটির দাবিতে লড়তে হবে। ডেটা মনোপলির বিরুদ্ধে লড়তে হবে। কিন্তু লড়াই মানে পাল্টা 'হেট স্পিচ' নয়, পাল্টা ফেক নিউজ নয়, ছবি কিম্বা বক্তব্য বিকৃত করা নয়, কপিরাইট মিউজিক নিজের ভিডিও তে ব্যবহার করে IPR-র বাঁশ খাওয়া নয়। কারণ এগুলো সুস্থ মস্তিষ্কের লক্ষণ নয়। আর সুস্থ মস্তিষ্কের লোকেরা বিজেপিও নয়।
কি বললেন? ফেসবুকের বিরুদ্ধে লড়ার কথা ফেসবুকেই? ব্যাপারটা Oxymoron হয়ে যাচ্ছে না? হ্যাঁ, হচ্ছে তো। আসলে দেশটাই Oxymoron-এ ভরে গেছে। জনকল্যাণকামী সরকার –Oxymoron, বিজেপি আর বিকাশ -Oxymoron, ভারতের গণতন্ত্র –Oxymoron, সংবিধান মেনে মোদীর শপথ –Oxymoron,  ফ্রিডম অফ স্পিচ –Oxymoron, স্বাধীন নিরপেক্ষ মিডিয়া –Oxymoron, সাংবাদিক অর্ণব গোস্বামী –Oxymoron। তাই ওস্তাদ বলেছেন, রাষ্ট্রের মাথায় Moron-রা বসলে, Moron তাড়াতে, হেঁটে লড়তে হবে, নেটে লড়তে হবে, Oxymoron-এও লড়তে হবে।

সূত্র:


ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে ~ অর্ক ভাদুরী

Md Ismail

সোহরাওয়র্দী সবেমাত্র ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে ঘোষণা করেছেন। ১৯৪৬ সাল। গোটা কলকাতা শহর রক্তে ভাসছে। একদিকে মুসলিম গার্ড আর উল্টোদিকে গোপাল পাঁঠার দলবল দখল নিয়েছে গলি থেকে রাজপথ। শহর ছাড়িয়ে দাঙ্গার আগুন ছুঁয়ে ফেলছে গ্রাম-মফস্বল। বাড়িঘর ভিটেমাটি ছেড়ে পালাচ্ছে মানুষ। এর মধ্যেই সম্প্রীতির পাঁচিল তুলে দাঁড়াল কমিউনিস্টরা। দাঙ্গাবাজদের চোখে চোখ রেখে প্রতিরোধ করলেন ট্রাম শ্রমিক আন্দোলনের নেতা মহম্মদ ইসমাইল।

সামরিক পরিভাষায় যাকে ফায়ার পাওয়ার বলে, সেই ফায়ার পাওয়ার অনেক বেশি ছিল দাঙ্গাবাজদের।তাদের ছিল পেট্রল বোমা আর এই গরীব মানুষগুলোর সম্বল ছিল জেদ। মুসলিম গার্ডের দাঙ্গাবাজদের সেদিনের লক্ষ্য ছিল ভিক্টোরিয়া কলেজের নিরস্ত্র ছাত্রীরা। তাদের চোখে মুখে খুন ,ধর্ষণ লুটপাটের প্রবৃত্তি সুস্পষ্ট।
মহম্মদ ইসমাইলের নেতৃত্বেই সেদিন মধ্য-কলকাতা অঞ্চলের শ্রমিকরা, মজুর, কলাবাগান বস্তির মহিলারা, ঘরোয়া হাতা-খুন্তি বেলনা আর লাঠি, বেলচা নিয়ে এদের আটকে দেন। এক ঘন্টার লড়াই, স্রেফ ইট এবং খেটো লাঠি নিয়ে সোহরাওয়ার্দীর বাহিনীর মহড়া নিলেন শ্রমিকরা। সংখ্যায় বেশি হয়েও শ্রমিকদের প্রতিরোধের মুখে লেজ গুটিয়ে পালায় দাঙ্গাবাজরা। 

এতক্ষণ পড়ে কি মনে হল , ক্লাসিক টেল অফ ডেভিড ভার্সেস গোলাইয়াথ ?
মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক।সেদিন বাজপাখির সামনে পাজামা ভিজিয়ে ফেলেছিল রাজাবাজারের কুখ্যাত ডন। তিনদিন তিনরাত ছাত্রীদের আগলে রাখার পর যেদিন পুলিশের হাতে তাদের নিরাপদে তুলে দেওয়ার পালা এল সেদিন এক যুবক ব্রিটিশ অফিসার সেই শ্রমিকদের একজনকে প্রশ্ন করেন যে কোন অসম সাহসে তাঁরা এভাবে দুর্গের মতো দাঁড়িয়ে রইলেন ....

শ্রমিকটির উত্তর ছিল ; " উও সুরখী ঝান্ডা দেখ রাহে হ্যায় সাহাব , উও সুরখী ঝান্ডা জব একবার উড়তা হ্যায় না তব উসকো উতারনা নামুনকিন হ্যায় "
বাজপাখির ডানা সেদিন আগলে রেখেছিল বাংলার সম্প্রীতি । 'সুরখী ঝান্ডা' অর্থাৎ লাল পতাকাকে টেনে নামানোর সাহস হয়নি ওদের ।

পাঁঠা হোক বা শুয়োর , প্যাদানি খাওয়ার ওয়ার্দী যে , তাকে কখনো রেয়াত করেনি এই 'সুরখী ঝান্ডা'।
সেই মাস্তানির উত্তরাধিকার আজও শিরায় উপশিরায় প্রবাহিত।

কৃতজ্ঞতা : 
*সাংবাদিক অর্ক ভাদুড়ির ফেসবুক পোস্ট
*ছেচল্লিশ এর দাঙ্গায় ট্রাম শ্রমিকদের অসামান্য বীরগাথা/সাধন ব্যানার্জি

কলকাতার ভাতের হোটেল ~ অর্ক ভাদুরী





বেশ কিছুদিন ধরেই ভাবছিলাম, করোনা আর লকডাউনের মাঝে কলকাতার ভাতের হোটেলগুলো কেমন আছে একটু খোঁজখবর নেব। আসলে, কয়েক মাস আগেও আমার কাছে চারবেলার খাওয়াদাওয়াটা ছিল অ্যাডভেঞ্চারের মতো। বাড়িতে রান্নাবান্নার পাট ছিল না। শহরের একপ্রান্তে লাঞ্চ করতাম, অন্যপ্রান্তে ডিনার। ব্রেকফাস্টে কখনও শ্যামবাজারের হরিদাস মোদক, কখনও রাসবিহারীর রাধুবাবু, কখনও বাগবাজারের পটলা। কখনও গড়িয়াহাটের দাস কেবিন, কখনও দেশপ্রিয় পার্কের আশেপাশের সাউথ ইন্ডিয়ান খাবারের দোকান বা এই রকম কোথাও। সন্ধেবেলায় কখনও সদানন্দ রোডের আপনজন, কখনও রাসবিহারী অ্যাভিনিউতে শংকরের ফ্রাই, কখনও কালিকা। উত্তরের দিকে গেলে শ্যামবাজারে বড়ুয়ার প্যান্থারাস, ফিয়ার্স লেনের অ্যাডামের কাবাব, গিরীশ পার্কের নিরঞ্জন আগারের কাটলেট। হাজরা মোড়ের কাফেতে প্রায় নিয়মিত চা-কফি-পুডিং। মাঝেমধ্যে শোভাবাজারের অ্যালেন কিচেনে বা অন্য কোথাও। কিন্তু লাঞ্চ আর ডিনারে তো এত অপশন নেই। শহরের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ৫-৬টা দোকানে ভাত খেতাম। কখনও কখনও যে অন্য কোথাও খাইনি তা নয়, কিন্তু চেষ্টা করতাম ওই কয়েকটা দোকানেই যেতে।

লকডাউনের শুরু থেকে গল্পটা বদলে গেল। বাড়িতে রান্নাবান্না শুরু হল। সেও এক নতুন মজা। কিন্তু আমার পছন্দের ভাতের হোটেলগুলো কেমন আছে, লকডাউন শিথিল হওয়ার পর ব্যবসাবাণিজ্য আদৌ হচ্ছে কিনা, সেসব না জানলে চলে! কিন্তু কিছুতেই আর সময় বের করে যাওয়া হচ্ছিল না। আচমকাই একটা সুযোগ চলে এল। একটি সংস্থা বলল, কলকাতার খাবারের দোকানগুলো নিয়ে একটু খোঁজখবর করতে হবে। অবশ্যই কেবলমাত্র আমার পছন্দের দোকানগুলো নিয়েই। তাই মনে হল, খুব সংক্ষেপে আমার প্রিয় ভাতের হোটেলগুলো কেমন আছে, বন্ধুদের সঙ্গে শেয়ার করি।


স্বাধীন ভারত হিন্দু হোটেল
৮/২ ভবানী দত্ত লেন

এই হোটেলটা সম্ভবত কলকাতার সবচেয়ে বিখ্যাত পাইস হোটেল। ১৯১০ সালে ভূবনেশ্বর থেকে দুই ভাই মনগোবিন্দ আর প্রহ্লাদচন্দ্র কলকাতায় এসে প্রেসিডেন্সি কলেজের কাছে হিন্দু হোটেল খুলে বসলেন। এক আনায় মাছ-ভাত। পেটচুক্তি খাওয়া। বাড়িটা ছিল এক মুসলিম পরিবারের। কিন্তু কোনওদিন সাম্প্রদায়িক ঝামেলা পোহাতে হয়নি। বরং বিপদে আপদে আশেপাশের মুসলিম বাসিন্দারা বুক দিয়ে রক্ষা করেছেন হিন্দু হোটেলকে। হিন্দু হোটেলে সুভাষচন্দ্র বসুর নিয়মিত আসা এবং পাত পেড়ে পুঁই-চচ্চড়ি খাওয়ার গল্প এখনও এই চত্বরে কান পাতলে শোনা যায়। মেয়র থাকাকালীনও সহকর্মীদের নিয়ে এসে দুপুরবেলায় ভাত খেয়ে যেতেন সুভাষচন্দ্র। আসতেন চিত্তরঞ্জন দাশ, সত্য বক্সী, হেমচন্দ্র গুহরা। লালবাজারের নথিতে ফেভারিট কেবিনের মতো হিন্দু হোটেলে কারা আসছেন, তার উপর নজর রাখার কথা রয়েছে।

১৯৪৩ সালে যখন মন্বন্তর এল, মনগোবিন্দ আর প্রহ্লাদচন্দ্র হোটেলের দরজা খুলে দিলেন সক্কলের জন্য। বিরাট বিরাট ডেকচিতে খিচুড়ি রান্না করে নিরন্ন মানুষের মুখে তুলে দিলেন তাঁরা। তার চার বছর পর দেশভাগ, ইংরেজ রাজত্বের অবসান। হিন্দু হোটেলের সামনে জাতীয় পতাকা তোলা হল ১৯৪৭-এর ১৫ অগস্ট। পরের বছর হোটেলের নাম বদলে হল- স্বাধীন ভারত হিন্দু হোটেল।

মনগোবিন্দ মারা গিয়েছেন আগেই। অতিবৃদ্ধ প্রল্হাদচন্দ্র  গত বছরের জানুয়ারি মাস পর্যন্ত বেঁচে ছিলেন। প্রতি বছর ২৩ জানুয়ারি হিন্দু হোটেলে যাঁরা খেতে আসেন, তাঁদের পাতে বিনামূল্যে কয়েকটি পদ পরিবেশন করা হয়। ২০১৮ পর্যন্ত প্রতি বছর ১৫ অগস্ট দোকানের সামনে জাতীয় পতাকা তোলা হত। সাইনবোর্ডে নতুন রং করা হত। প্রল্হাদবাবুর মৃত্যুর পর থেকে সেসব বন্ধ আছে।

লকডাউনে একটানা কয়েক মাস ঝাঁপ বন্ধ ছিল স্বাধীন ভারত হিন্দু হোটেলের। তৃতীয় প্রজন্মের মালিক অরুণাংশু পণ্ডা এখনও ওড়িশায় আটকে আছেন। কিছুদিন হল হোটেল খুলছে বটে, কিন্তু খরিদ্দার নেই। আগে দিনে ২০০-২৫০ পাত পড়ত, এখন ২০-৩০ জনও আসেন না।


প্রেসিডেন্সি বোর্ডিং হাউজ / মহল
৬/৩ রমানাথ মজুমদার লেন

আমার খুব প্রিয় হোটেল। চমৎকার রান্না। ১৯১৭ সালে, রুশ বিপ্লবের বছরে নন্দলাল দত্ত প্রেসিডেন্সি বোর্ডিং হাউজ খুললেন। শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়, জীবনানন্দ দাশ, তপন সিংহ-সহ আরও অনেকে ছিলেন প্রেসিডেন্সি বোর্ডিং হাউজের বোর্ডার। একটা সময় ৫০-৬০ জন থাকতেন। এখন কমতে কমতে ১০-১২ জন। প্রথমে কেবল বোর্ডারদের জন্যই রান্নাবান্না হত। এখন যেখানে মহল হোটেলটা হয়েছে, সেটাই ছিল বোর্ডিং হাউজের রান্নাঘর। আর ভিতরে ঢুকে যে প্যাসেজটা রয়েছে, সেখানে সারিবদ্ধ ভাবে বসে খাওয়ার ব্যবস্থা ছিল। ১৯৯১ সালে নন্দলালের নাতি সন্দীপ দত্ত রান্নাঘরটাকে ভিতরে নিয়ে গেলেন, বাইরের ঘরে খুললেন সর্বসাধারণের জন্য ভাতের হোটেল। সন্দীপবাবু বলছিলেন, "আটের দশক থেকেই মেস/বোর্ডিং ব্যবসা ক্রমশ অলাভজনক হয়ে পড়ছিল। তখন থেকেই অধিকাংশ মেস এবং বোর্ডিং বোর্ডারদের জন্য রান্না বন্ধ করে দিতে শুরু করে। আমরাও হোটেল খুলি তখনই।"

সন্দীপবাবুর বাবা নৃপেন্দ্রনাথ ছিলেন মেস-বোর্ডিং মালিকদের সংগঠনের প্রধান। ওই এলাকায় তো মেস আর বোর্ডিং-এর ছড়াছড়ি। একটু দূরে শিবরাম চক্রবর্তীর মেস। আরেকটু এগোলে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র, সত্যেন বসুদের বিখ্যাত মেসবাড়ি, যেখানে বাঘাাযতীন আসতেন। কয়েকদিন আগে প্রফুল্লচন্দ্রের জন্মদিনে ওই মেসবাড়িটায় গিয়েছিলাম। সে অন্য গল্প।

লকডাউনের শুরু থেকেই মহল বন্ধ। এখনও খোলেনি৷ মাঝখানে রটে গিয়েছিল প্রেসিডেন্সি বোর্ডিং হাউজ নাকি বন্ধ হয়ে যাবে। যদিও সেটা সর্বৈব বাজে কথা।


জগন্মাতা ভোজনালয়
৪০, কৈলাশ বোস স্ট্রিট

এই দোকানটাও বেশ বিখ্যাত। তবে আমার যাতায়াত একটু কম। জগন্মাতার বৈশিষ্ট্য হল, এখানে টেবিল-চেয়ারের পাশাপাশি এখনও মাটিতে বসে খাওয়ার ব্যবস্থা আছে। রান্না বেশ ভাল। মুরগি ঢোকে না। কেবল পাঁঠার মাংস। বৃহস্পতিবারে মাংস হয় না। জগন্মাতায় রান্না হয় কয়লার উনুনে। শিলে বাটা মশলা ছাড়া অন্য কিছু ব্যবহার করা হয় না।

ওড়িশা থেকে এসে বিকলচন্দ্র দাস জগন্মাতা ভোজনালয়ে খাবারের ব্যবসা শুরু করেন। এখন তৃতীয় প্রজন্মের গঙ্গাধর দাস দায়িত্বে। লকডাউনের শুরু থেকেই দোকান বন্ধ। এখনও খোলেনি।


হোটেল সিদ্ধেশ্বরী আশ্রম
১৯, রানী রাসমণি রোড

দোকানের গায়ে প্রতিষ্ঠার বছর হিসাবে ১৯৩৮ থাকলেও পুরসভার নথি অনুযায়ী ১৯২৮ সালে ক্ষুদিরাম সরকার হোটেল সিদ্ধেশ্বরী আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন। রানী রাসমণির জানবাজারের বাড়ির খুব কাছে রানীর জমিতেই ভাড়া বাড়িতে হোটেল শুরু হয়। আগে একতলায় মেস ছিল, মূলত চাকরিজীবীরা থাকতেন। এখন মেস উঠে গিয়েছে। হোটেলের কর্মচারীরাই মেস করে থাকেন।

সিদ্ধেশ্বরী আশ্রমের বৈশিষ্ট্য হল নানা রকমের মাছের চমৎকার রান্না। প্রতিদিন প্রায় ১২-১৫ রকমের মাছ থাকে। মাছের ডিশগুলোর দাম নির্দিষ্ট নয়, বাজারের দামের সঙ্গে ওঠানামা করে। প্রতি বছর পয়লা বৈশাখে বিনামূল্যে দই-রসগোল্লা খাওয়ানো হয়।

সিদ্ধেশ্বরী আশ্রমও এখন বন্ধ। একটু দূরেই রয়েছে ঢাকেশ্বরী হোটেল। সেটাও বন্ধ। কবে খুলবে কে জানে!


তরুণ নিকেতন
১/৪ রাসবিহারী অ্যাভিনিউ

এই হোটেলের খাবার আমার যত না পছন্দ, তার চেয়েও পছন্দ হোটেলের পরিবেশ। ছোট ছোট খাটের চেয়ার, শ্বেতপাথরের টেবিল, লম্বা আয়না। ঢুকতেই চোখে পড়বে - 'এই হোটেল সম্পূর্ণভাবে পাইস হোটেলের নিয়ম অনুসারে পরিচালিত।' তরুণ নিকেতন পাঁঠার মাংসের একটা হাল্কা ঝোল করে, বেশ লাগে। অরুণ দে এখন মালিক। আড্ডাবাজ মানুষ। নিজেই লেক মার্কেট থেকে বাজার করেন। প্রতি বছর পয়লা বৈশাখে বিনামূল্যে সকলকে পায়েস খাওয়ান। 

এই দোকানেও আগে মুরগির মাংস ঢুকত না, খাইয়েদের চাপে এখন ঢোকে। তবে মুরগির ডিমের এখনও প্রবেশ নিষেধ। লকডাউন শিথিল হওয়ার পর তরুণ নিকেতন খুলছে। তবে খদ্দের প্রায় নেই। আগে দুপুরবেলা বসার জায়গা পাওয়া যেত না, অপেক্ষা করতে হত, এখন শুনশান।

....................................................

এই ৫ টা হোটেল আমার সবচেয়ে প্রিয়। এর বাইরেও আরও অনেক হোটেল চমৎকার রান্না করে। খিদিরপুরের ইয়ং বেঙ্গল হোটেল, কলেজ স্ট্রিটে জগন্নাথ হোটেল, গড়িয়াহাট বাজারের দো'তলায় কালীপদ মাইতির হোটেল, ফার্ন রোডের ফার্ন হোটেল, হাতিবাগানের বেশ কয়েকটা হোটেল, যাদবপুরে হালে তৈরি হওয়া শেফ, ভবানীপুরে জগুবাবুর বাজারের কাছে পার্বতী হোটেল- তালিকা শেষ হবে না। সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ আর গণেশ অ্যাভিনিউ ক্রসিংটার কাছে, হেয়ার স্ট্রিট আর বউবাজার থানার গলিতে দু'টো চমৎকার হোটেল আছে। একদম ছোট, ঘিঞ্জি, টুলে বসে খেতে হয়। তার একটা এত ভাল মাটন করে যে বলে বোঝানো যাবে না। চাঁদনি চকের ভিতরের হোটেলটাও মন্দ নয়।
জেলার হোটেলগুলোও চমৎকার। কয়েকদিন আগে মুর্শিদাবাদে গিয়ে পদ্মপাতায় ভাত খেলাম, মন ভরে গেল। বীরভূম, নদীয়াতেও বেশ খেলাম। তবে করোনা আর লকডাউনের জাঁতাকলে কেউ ভাল নেই। ব্যবসা লাটে উঠেছে প্রায় সকলেরই। কলকাতার চপ-কাটলেটের দোকানগুলোরও প্রায় একই অবস্থা।

কবে সব ঠিক হবে কে জানে!

মঙ্গলবার, ১১ আগস্ট, ২০২০

শহীদ ক্ষুদিরাম বসুর ছবি ~ অর্ক ভাদুরী

Sahid Khudiram

প্রতি বছর ১১ অগস্ট শহীদ ক্ষুদিরাম বসুর ছবিতে টাইমলাইন ভরে ওঠে। শুধু সোস্যাল মিডিয়ায় তো নয়, পাড়ায়-মহল্লায়-রাস্তার মোড়ে অসংখ্য মানুষ গভীর আবেগ ও শ্রদ্ধায় স্মরণ করেন তাঁকে। কিন্তু কিশোর বিপ্লবীর যে ছবিটি সবচেয়ে জনপ্রিয়, অধিকাংশ পোস্টারে, ব্যানারে যে ছবিটি দেখতে পাই, সেটি কিন্তু ক্ষুদিরামের কোনও ফটোগ্রাফ নয়, কলকাতা হাইকোর্টের সামনে যে চমৎকার মূর্তিটি রয়েছে, তার ছবি। ভাস্কর্য সম্পর্কে আমার তেমন কোনও জ্ঞান নেই, কিন্তু ক্ষুদিরামের এই মূর্তিটি বড্ড প্রিয়। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলে মনে হয়, ভাস্কর্যটির মধ্য দিয়ে মূর্ত হয়ে উঠেছে একটা আস্ত সময়। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে মরণজয়ী সংগ্রামের আঁচে অগ্নিশুদ্ধ হওয়া ওঠা সময়ের স্মারক যেন ওই ন'ফুট লম্বা মূর্তিটি।

কিন্তু কে তৈরি করেছিলেন ক্ষুদিরামের এই আশ্চর্য মূর্তি? তাঁর অন্য কোনও কাজের খোঁজ মেলে না কেন? উত্তর নেই। প্রতি বছর ১১ অগস্ট আসে, চলে যায়। শিল্পীর নাম সামনে আসে না। আমরা কেউ জানতেও পারি না এক আশ্চর্য কমিউনিস্টের গল্প।

চারের দশকের প্রায় শেষ। সবেমাত্র দেশ স্বাধীন হয়েছে। বিহারের বাসিন্দা তাপস দত্ত শিল্পী হতে চেয়ে চলে এলেন কলকাতায়। ভর্তি হলেন আর্ট কলেজে। কিন্তু উত্তাল সময়ের ঢেউ বদলে দিল জীবনের গতি। একের পর এক আন্দোলনে রাজপথ তখন উত্তাল। সেই স্রোতে ডিঙি ভাসালেন তাপসবাবুও। বন্ধু শীতেশ দাশগুপ্তের হাত ধরে জড়িয়ে পড়লেন বামপন্থী রাজনীতিতে। সোস্যালিস্ট ইউনিটি সেন্টার (এস ইউ সি) দলের সর্বক্ষণের কর্মী হয়ে ভিড়ে গেলেন লাল পতাকার মিছিলে। শিল্পী হওয়া আর হ'ল না বটে, কিন্তু পেয়ে গেলেন একটা অন্য রকমের জীবন। কমিউনিস্ট জীবন।

রাজনৈতিক কাজকর্মের ফাঁকে শিল্পচর্চা চলতে লাগল ঠিকই, কিন্তু ধ্যানজ্ঞান সবই তখন রাজনীতি। কখনও ডক শ্রমিকদের নিয়ে ইউনিয়ন করছেন, কখনও ছুটে যাচ্ছেন জুটমিলের শ্রমিক মহল্লায়, কখনও পার্টির নির্দেশে চষে ফেলছেন ওড়িশার গ্রাম, শহর, মফস্বল। আর এই এতকিছুর মাঝে, কখনও একটু অবসর জুটে গেলে বসে পড়ছেন রংতুলি নিয়ে।

এমন করেই চলছিল। অনেক বছর পর এল ১৯৬৭ সাল। কংগ্রেসকে হারিয়ে বাংলার বুকে তৈরি হল প্রথম যুক্তফ্রন্ট সরকার। জ্যোতি বসু হলেন উপ-মুখ্যমন্ত্রী, তাপসবাবুদের দলের নেতা সুবোধ ব্যানার্জি শ্রমমন্ত্রী। কিন্তু সেই সরকার টিঁকল না। তারপর ১৯৬৯। আবার ক্ষমতায় এল যুক্তফ্রন্ট। এই দ্বিতীয় যুক্তফ্রন্টের পূর্ত দফতর সিদ্ধান্ত নিল শহর জুড়ে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের মূর্তি বসানো হবে। রাস্তাঘাট আর গুরুত্বপূর্ণ সরকারি দফতরগুলির নাম রাখা হবে বিপ্লবীদের স্মরণে। অ্যান্ডারসন হাউজ হল বিপ্লবী ভবানী বন্দ্যোপাধ্যায়ের নামে ভবানী ভবন, বিনয়-বাদল-দীনেশের স্মরণে হল বিবাদী বাগ, এমন আরও অনেক কিছু। ঠিক হল হাইকোর্টের সামনে বসবে ক্ষুদিরামের মূর্তি। শিল্পীদের কাছ থেকে নকশা আহ্বান করল সরকার।

অনেকদিন, অনেক অনেক দিন পর আবার সিরিয়াসলি খাতাকলম নিয়ে বসলেন তাপস দত্ত। ততদিনে তিনি বিশিষ্ট ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠন। আরও অনেকের মতো তাপসবাবুও সরকারের কাছে মূর্তির একটি মডেল জমা দিলেন। এবং সেটিই নির্বাচিত হল! তারপর একটানা কয়েক মাস অক্লান্ত পরিশ্রম করে তাপসবাবু তৈরি করে ফেললেন এই মূর্তিটি। বিপুল প্রশংসিত হলেন। প্রশংসা করলেন স্বয়ং রামকিঙ্কর বেইজ। কিন্তু ওই শেষ। তারপর দীর্ঘদিন তাপসবাবু আর কোনও মূর্তি তৈরি করেননি। বহু বছর পর ঘাটশিলা তাঁদের দলের প্রতিষ্ঠাতার একটি পূর্ণাবয়ব মূর্তি বাদে তাপসবাবুর সম্ভবত কোনও মেজর কাজ নেই। ইন্দিরা গান্ধির আমলে কেন্দ্রীয় সরকার জওহরলাল নেহরুর মূর্তি তৈরির প্রস্তাব দিয়েছিল বলে শুনেছি। কিন্তু রাজনৈতিক মতপার্থক্যের কারণে তাপসবাবু রাজি হননি।

শহীদ ক্ষুদিরামের অধিকাংশ মূর্তিই কলকাতা হাইকোর্টের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা এই মূর্তিটির আদলে নির্মিত। ক্ষুদিরামের অধিকাংশ ছবিও তাই। পোস্টারে, ব্যানারে সর্বত্র এই মূর্তিটির ছবি দেখি। কিন্তু কেন জানি না তাপস দত্তের কথা কেউ বলেন না। পরবর্তীকালে তাপসবাবু সোস্যালিস্ট ইউনিটি সেন্টারের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হয়েছিলেন, শ্রমিক সংগঠন ইউ টি ইউ সি-র (লেনিন সরণী) সর্বোচ্চ পর্যায়ের দায়িত্ব সামলেছেন। কিন্তু ভাস্কর তাপস দত্তের কথা কেন সামনে আসে না? তাঁর দলের কমরেডরাও কি আরেকটু বিশদে বলতে পারেন না এই কমিউনিস্ট শিল্পীর গল্প?

ক্ষুদিরাম ~ ঋতুপর্ণ বসু

----- আমি মেদিনীপুর জেলার অধিবাসী। বাপ মা নেই, ভাই নেই, কাকা, মামা কেউ নেই। এক দিদি আছেন। তাঁর অনেক ছেলেপুলে, বড়টি আমার সমবয়সী। মেদিনীপুরে, জজের হেডক্লার্ক, বাবু অমৃতলাল রায়ের সঙ্গে দিদির বিয়ে হয়। ওঁরাই আমার একমাত্র আত্মীয়। অবিনাশচন্দ্র বসুও আমার আত্মীয় কিন্তু আমার সম্পর্কে তাঁর কোন আগ্ৰহ আছে বলে মনে হয় না।
Khsudiram Basu
আমি সেকেন্ড ক্লাস পর্যন্ত পড়েছিলাম কিন্তু দুতিন বছর আগে পড়া ছেড়ে দিয়েছি। তখন থেকে আমি স্বদেশী আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্ৰহণ করি। সেই থেকে আমার জামাইবাবু ( অমৃতলাল রায় ) আমাকে ত্যাগ করেন। আমার মা নেই, আমার বাবা দশ এগারো বছর আগে মারা যান। আমার সৎমা ছিলেন। তিনি তাঁর ভাই সুরেন্দ্রনাথ ভন্জের কাছে থাকতেন। আমি তাঁর ঠিকানা জানি নে, কি করেন তাও জানি নে।
প্রশ্ন ; তুমি কি কাউকে দেখতে চাও ?
--- হ্যাঁ, আমি একবার মেদিনীপুর যেতে চাই, আমার দিদি ও ছেলেপুলেদের দেখতে চাই।
প্রশ্ন ; তোমার মনে কোন কষ্ট আছে ?
---- না, কোন কষ্ট নেই।
প্রশ্ন ; আত্মীয় স্বজনকে কোন কথা জানাতে চাও কি ? অথবা ওঁদের কেউ এসে তোমায় সাহায্য করুক এমন ইচ্ছে করে কি ?
---- না, আমার কোন ইচ্ছা তাঁদের জানাবার নেই। তাঁরা যদি ইচ্ছে করেন আসতে পারেন।
প্রশ্ন ; জেলে তোমার সাথে কি রকম ব্যবহার করা হয় ?
---- মোটামুটি ভাল। খাবারটা ( ভাতটা ?) বড় মোটা, আমার ঠিক সহ্য হয় না। শরীরটা খারাপ করে দিয়েছে। নচেৎ, আমার সঙ্গে অসৎ ব্যবহার করা হয় না। আমাকে একটা নিঃসঙ্গ সেলে আটকে রাখে। সেখানে দিনরাত্রি থাকতে হয়। একবার মাত্র স্নান করার সময় বেরিয়ে আসতে দেওয়া হয়। একা থাকতে থাকতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। সংবাদপত্র বা অন্য কিছু পড়তে দেওয়া হয় না। এগুলো পেতে খুবই ইচ্ছা করে।
প্রশ্ন ঃ কোন রকম ভয় করে তোমার ?
---- ভয় করবে কেন ? ( হাসি )
প্রশ্ন ; গীতা পড়েছ ?
---- হ্যাঁ পড়েছি।
প্রশ্ন ; তুমি জান আমরা রংপুর থেকে তোমার পক্ষ সমর্থনে এসেছি, কিন্তু তুমি তো এর আগেই দোষ স্বীকার করেছ ?
----- কেন করব না ? ( হাসি )
( ক্ষুদিরামকে আইনি সহায়তা দেবার জন্য কালিদাস বসুর নেতৃত্বে একদল উকিল রংপুর থেকে মজঃফরপুরে এসেছিলেন। তাঁদের সঙ্গে বিচারাধীন ক্ষুদিরামের কথোপকথন প্রকাশিত হয়েছিল সাপ্তাহিক সন্জীবনি পত্রিকায়। তারিখ ১৮ ই জুন, ১৯০৮। ক্ষুদিরামের পক্ষ সমর্থনকারী বাবু সতীশচন্দ্র চক্রবর্তীর প্রশ্নের উত্তরে ক্ষুদিরাম উপরোক্ত কথাগুলি বলেন। )
ক্ষুদিরাম বসুর ফাঁসির সময় দুজন বাঙালী উপস্থিত ছিলেন। একজন হলেন বেঙ্গলী কাগজের সংবাদদাতা ও উকিল উপেন্দ্র নাথ বসু আর অন্যজন হলেন ক্ষেত্রনাথ বন্দোপাধ্যায়। উপেন্দ্র নাথ বসু ক্ষুদিরাম বসুর ফাঁসি নিয়ে সেই সময় একটা লেখা লেখেন, নিচে রইল সেই লেখাটিই............
"মজঃফরপুরে আমাদের উকিলদের একটি ছোট্ট আড্ডা ছিল। আমরা প্রতি শনিবার সেখানে একত্রিত হইয়া গল্প করিতাম, রাজা উজির বধ করিতাম। ১লা মে শোনা গেল মজঃফরপুর হইতে ২৪ মাইল দূরে উষা নামক স্টেশনে একটি বাঙ্গালী ছাত্রকে পুলিশ ধরিয়া আনিয়াছে। দৌড়িয়া স্টেশনে গিয়া শুনিলাম পুলিশ ছাত্রটিকে লইয়া সোজা সাহেবদের ক্লাবের বাড়িতে গিয়াছে। সেখানে ম্যাজিস্ট্রেট মিঃ উডম্যান তাহার বর্ণনা লিপিবদ্ধ করিতেছেন। পরদিন সকালে ডিস্ট্রিক ম্যাজিস্ট্রেট মিঃ উডম্যান বাঙালী উকিলদিগকে নিজের এজলাসে ডাকাইয়া পাঠাইলেন। আমাদের মধ্যে প্রবীন উকিল শ্রীযুক্ত শিবচরণ চট্টোপাধ্যায় ছিলেন সরকারী উকিল। তাঁর সঙ্গে আমরা ম্যাজিস্ট্রেটের এজলাসে উপস্থিত হইয়া দেখি, কাঠগড়ায় দাঁড়াইয়া রহিয়াছে একটি ১৫/১৬ বছরের প্রিয়দর্শন বালক। এতোগুলো বাঙালী উকিল দেখিয়া ছেলেটি মৃদু মৃদু হাসিতেছে। কি সুন্দর চেহারা ছেলেটির, রঙ শ্যামবর্ণ কিন্তু মুখখানি এমনই চিত্তাকর্ষক যে দেখিলেই স্নেহ করিতে ইচ্ছা করে। উডম্যান সাহেব যখন ছেলেটির বর্ণনা পড়িয়া আমাদের শোনাইতে লাগিলেন, তখন জানিলাম ছেলেটির নাম ক্ষুদিরাম বসু নিবাস মেদিনীপুর। ক্ষুদিরামের বর্ণনা পড়িতে পড়িতে ক্রোধে উডম্যান সাহেবের বদন রক্তবর্ণ ও ওষ্ঠ কম্পিত হইতেছিল। দায়রায় ক্ষুদিরামের পক্ষ সমর্থনের জন্য কালিদাসবাবুর নেতৃত্বে আমরা প্রস্তুত হইতে লাগিলাম। নির্ধারিত দিনে রঙপুর হইতে দুজন উকিল এই কার্যে সহয়তা করিতে আসিলেন। একজনের নাম সতীশ চন্দ্র চক্রবর্তী। এজলাস লোকারণ্য, তিন-চার জন সাক্ষীর জবানবন্দী, জেরা ও বক্তৃতা শেষ হইলে, ক্ষুদিরামের উপর মৃত্যুদণ্ডের আদেশ হইল। আদেশ শুনিয়া ক্ষুদিরাম জজকে বলিলো, 'একটা কাগজ আর পেনসিল দিন, আমি বোমার চেহারাটা আঁকিয়া দেখাই। অনেকেরই ধারণাই নাই ওই বস্তুটি দেখিতে কিরকম'। জজ ক্ষুদিরামের এ অনুরোধ রক্ষা করিলেন না। বিরক্ত হইয়া ক্ষুদিরাম পাশে দাঁড়ানো কনস্টেবলকে ধাক্কা দিয়া বলিল, 'চলো বাইরে'। ইহার পর আমরা হাইকোর্টে আপিল করিলাম। ক্ষীণ আশা ছিল, যদি মৃত্যুদণ্ডের বদলে যাব্বজীবন কারাদণ্ড হয়। জেলে তাহাকে এ প্রস্তাব করিতেই সে অসম্মতি জানালো, বলিল 'চিরজীবন জেলে থাকার চেয়ে মৃত্যু ভালো'। কালিদাস বোঝাইলেন দেশে এমন ঘটনা ঘটিতেও পারে যে তোমায় বেশিদিন জেলে থাকিতে নাও হইতে পারে। অবশেষে সে সম্মত হইল। কলকাতা হাইকোর্টের আপিলে প্রবীন উকিল শ্রীযুক্ত নরেন্দ্র নাথ বসু হৃদয়গ্রাহী বক্তৃতা দিলেন। কিন্তু ফাঁসীর হুকুম বহাল রহিল। ১১ আগস্ট ফাঁসির দিন ধার্য হইল।
আমরা দরখাস্ত দিলাম যে ফাঁসীর সময় উপস্থিত থাকিব। উডম্যান সাহেব আদেশ দিলেন দুইজন মাত্র বাঙালী ফাঁসির সময় উপস্থিত থাকিতে পারিবে। আর শব বহনের জন্য ১২ জন এবং শবের অনুগমনের জন্য ১২ জন থাকিতে পারিবে। ইহারা কতৃপক্ষের নির্দিষ্ট রাস্তা দিয়া শ্মশানে যাইবে। ফাঁসির সময় উপস্থিত থাকিবার জন্য আমি ও ক্ষেত্রনাথ বন্দোপাধ্যায় উকিলের অনুমতি পাইলাম। আমি তখন বেঙ্গলী কাগজের স্থানীয় সংবাদদাতা। ভোর ছ'টায় ফাঁসী হইবে। পাঁচটার সময় আমি গাড়ির মাথায় খাটিয়াখানি ও সৎকারের অত্যাবশকীয় বস্ত্রাদি লইয়া জেলের ফটকে উপস্থিত হইলাম। দেখিলাম নিকটবর্তী রাস্তা লোকারন্য। সহজেই আমরা জেলের ভিতরে প্রবেশ করিলাম। ঢুকিতেই একজন পুলিশ কর্মচারী প্রশ্ন করিলেন বেঙ্গলী কাগজের সংবাদদাতা কে?
আমি উত্তর দিলে হাসিয়া বলিল, আচ্ছা ভিতরে যান। দ্বিতীয় লোহার দ্বার উন্মুক্ত হইলে আমরা জেলের আঙ্গিনায় প্রবেশ করিলাম। দেখিলাম ডানদিকে একটু দূরে প্রায় ১৫ ফুট উঁচুতে ফাঁসির মঞ্চ। দুই দিকে দুই খুঁটি আর একটি মোটা লোহার রড যা আড়াআড়িভাবে যুক্ত তারই মধ্যখানে বাঁধা মোটা একগাছি দড়ি ঝুলিয়া আছে। তাহার শেষ প্রান্তে একটি ফাঁস। একটু অগ্রসর হইতে দেখিলাম ক্ষুদিরামকে লইয়া আসিতেছে চারজন পুলিশ। কথাটা ঠিক বলা হইল না। ক্ষুদিরামই আগে আগে অগ্রসর হইয়া যেন সিপাহীদের টানিয়া আনিতেছে। আমাদের দেখিয়া একটু হাসিল। স্নান সমাপন করিয়া আসিয়া ছিল। মঞ্চের উপস্থিত হইলে তাহার হাত দুইখানি পিছন দিকে আনিয়া রজ্জুবদ্ধ করা হল। একটি সবুজ রঙের টুপি দিয়া তাহার গ্রীবামূল পর্যন্ত ঢাকিয়া দিয়া ফাঁসি লাগাইয়া দেওয়া হইল। ক্ষুদিরাম সোজা হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল। এদিক ওদিক একটুও নড়িল না।
উডম্যান সাহেব ঘড়ি দেখিয়া একটি রুমাল উড়াইয়া দিলেন। একটি প্রহরী মঞ্চের একপ্রান্তে অবস্থিত একটি হ্যান্ডেল টানিয়া দিল। ক্ষুদিরাম নিচে অদৃশ্য হইয়া গেল। কেবল কয়েক সেকেণ্ড ধরিয়া উপরের দিকের দড়িটা একটু নড়িতে লাগিল। তারপর সব স্থির। কর্তপক্ষের আদেশে আমরা নির্দিষ্ট রাস্তা দিয়া শ্মশানে চলিতে লাগিলাম। রাস্তার দুপাশে কিছু দূর অন্তর পুলিশ প্রহরী দাঁড়াইয়া আছে। তাহাদের পশ্চাতে শহরের অগণিত লোক ভীড় করিয়া আছে। অনেকে শবের উপর ফুল দিয়া গেল। শ্মশানেও অনেক ফুল আসিতে লাগিল। চিতারোহণের আগে স্নান করাইতে মৃতদেহ বসাইতে গিয়া দেখি মস্তকটি মেরুদণ্ড চ্যুত হইয়া বুকের উপর ঝুলিয়া পড়িয়াছে। দুঃখে – বেদনায় – ক্রোধে ভারাক্রান্ত হৃদয়ে মাথাটি ধরিয়া রাখিলাম। বন্ধুগণ স্নান শেষ করাইলেন তারপর চিতায় শোয়ানো হইলে রাশিকৃত ফুল দিয়া মৃতদেহ সম্পূর্ণ ঢাকিয়া দেওয়া হইল। কেবল উহার হাস্যজ্বল মুখখানা অনাবৃত রহিল। দেহটি ভস্মিভূত হইতে বেশী সময় লাগিলো না। চিতার আগুন নিভাইতে গিয়া প্রথম কলসী ভরা জল ঢালিতেই তপ্ত ভস্মরাশির খানিকটা আমার বক্ষস্থলে আসিয়া পড়িল। তাহার জন্য জ্বালা যন্ত্রনা বোধ করিবার মতন মনের অবস্থা তখন ছিল না। আমরা শ্মশান বন্ধুগণ স্নান করিতে নদীতে নামিয়া গেলে পুলিশ প্রহরীগণ চলিয়া গেল। আর আমরা সমস্বরে বন্দেমাতরম বলিয়া মনের ভার খানিকটা লঘু করিয়া যে যাহার বাড়ি ফিরিয়া আসিলাম। সঙ্গে লইয়া আসিলাম একটি টিনের কৌটায় কিছুটা চিতাভস্ম, কালিদাসবাবুর জন্য। ভূমিকম্পের ধ্বংসলীলায় সে পবিত্র ভস্মাধার কোথায় হারাইয়া গিয়াছে ।"
বেঙ্গলী পত্রিকা, আগষ্ট, ১৯০৮
ফাঁসির সাজা ঘোষণা শুনে শুধু হেসেছিলেন। ফাঁসিকাঠে দাঁড়িয়ে যখন কালো মুখোশ পরানো হল, তখনও শেষবারের মতো দেখাগিয়েছিল সেই হাসি। তাঁর ফাঁসির পর ব্রিটিশ পত্রিকা 'এম্পায়ার'এ প্রকাশিত হয়, '…নিথর মৃতদেহ। কিন্তু, মুখের হাসি সেই হাসি।' এভাবেই দেশের জন্য প্রাণ দিয়েছিলেন বিপ্লবী ক্ষুদিরাম বসু। এই অগ্নিযুবকই হলেন ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামের কনিষ্ঠতম শহিদ। আজ তাঁর ১০৯তম মৃত্যুদিবস।

অবিভক্ত মেদিনীপুরে জন্ম ক্ষুদিরামের। শৈশবেই বাবা মা-কে হারান। মাত্র ১২ বছর বয়সেই বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েছিলেন ক্ষুদিরাম। স্কুলে পড়াকালীন রিভলবার চেয়ে চমকে দিয়েছিলেন হেমচন্দ্র কানুনগোকে। মাত্র ১৬ বছর বয়সে প্রথমবার ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে হাতে বোমা তুলে নেন। একাধিকবার পুলিশের হাতে ধরাও পড়েন।

তৎকালীন সময়ে বিহারের মুজাফ্ফরপুরের মেজিস্ট্রেট ছিলেন বড়লাট ডগলাস কিংসফোর্ড। কলকাতা প্রেসিডেন্সির চিফ মেজিস্ট্রেট থাকাকালীন বহু তরুণ রাজনৈতিক কর্মীদের নির্মম সাজা দিয়েছিলেন তিনি। অত্যাচারী এই ব্রিটিশ প্রশাসককে হত্যার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল ক্ষুদিরাম বসু ও প্রফুল্ল চাকীকে।

মুজাফ্ফরপুরের মোতিঝিল এলাকায় পাঠানো হয় ক্ষুদিরামকে। সেখানে হরেন সরকার নাম নিয়ে এক ধর্মাশালায় থাকতে শুরু করেন ক্ষুদিরাম। একইসঙ্গে নজর রাখছিলেন কিংসফোর্ডের গতিবিধির উপর।


১৯০৮ সালের ৩০ এপ্রিল সন্ধ্যায় ইউরোপিয়ান ক্লাবের গেটে কিংসফোর্ডের গাড়ির অপেক্ষা করছিলেন ক্ষুদিরাম ও প্রফুল্ল চাকী। গাড়ি ক্লাবের গেটে পৌঁছলে, একহাতে বন্দুক তুলে তা থামান ক্ষুদিরাম। এরপর আরেক হাতে বোমা নিয়ে গাড়ি লক্ষ্য করে ছোড়েন। বিস্ফোরণে ৩ জনের মৃত্যু হয়। কিন্তু, তাঁদের মধ্যে কিংসফোর্ড ছিলেন না। মুজাফ্ফরপুরের বার অ্যাসোসিয়েশনের অ্যাডভোকেট প্রিঞ্জল কেনেডির পরিবারের সদস্যরা ওই বোমায় নিহত হন।

এরপরই প্রফুল্ল চাকী ও ক্ষুদিরামের পিছনে ধাওয়া করে ব্রিটিশ পুলিশ। পরের দিনই পুলিশের হাতে ধরা পড়েন ক্ষুদিরাম। কয়েকদিন পর মোকামঘাটের কাছে এক রেলস্টেশনে পুলিশের জালে ধরা পড়েন চাকী। কিন্তু, তিনি নিজেকে গুলি করে আত্মহত্যা করেন। আদালত দোষীসাব্যস্ত করে ক্ষুদিরাম বসুকে। ১৯০৮ সালের ১১ অগাস্ট ফাঁসি দেওয়া হয় ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের কনিষ্ঠতম বিপ্লবীকে। মাত্র ১৮ বছর বয়সেই শহিদ হন ক্ষুদিরাম।

দুঃসাহসী ক্ষুদিরামের বলিদান দেশের যুব সম্প্রদায়ের কাছে চিরঅমর রয়ে গেছে।