হিন্দুত্বের মিথ্যে কীভাবে ছড়ায় তার আরো একটা চাক্ষুষ নমুনা দেখলাম...
অনেকদিনের চেনা লোক, একসাথে কাজ করি - আপাতদৃষ্টিতে সায়েন্টিফিক টেম্পারামেন্ট ইত্যাদি আছে, কাজের দিক থেকেও ভালোই...মানে অফিসের কাজে যা যা লাগে, মোটামুটি সবই রয়েছে। দুপুরে ক্যাফেটারিয়ায় বসে খাওয়ার সময় কথাবার্তা ঘুরে গেলো পার্থ চ্যাটার্জী, তৃণমূলের দূর্নীতি, সেখান থেকে উত্তরপ্রদেশে কীভাবে বদমাইশদের ঢিট করা হয়েছে, আর ইউপি কীভাবে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের কোন কোন লিস্টে টপ ফাইভে আছে ইত্যাদি। না না, কেরল বাদ যায়নি, কেরলও প্রশংসাযোগ্য, কিন্তু ইউপিতে ঢিট করা ব্যাপারটা বেশ কাজের। সেটা একটু চেপে গেলো সেই ইউপিতেই করোনাকালে লাশের ছবি আর হিউম্যান ইন্ডেক্সের কথা ওঠায়...
তারপর, কোনোভাবে আলোচনা ঘুরলো ইতিহাসের দিকে - কেন আমাদের ইতিহাস এত "ডিফিটিস্ট"... আমাদের যে লুঠ করা হয়েছে সেটা কেন ইতিহাসে লেখা নেই?
আমি বললাম - কে বলেছে নেই? কলোনিয়াল আমলে কীভাবে এখানকার সম্পদ ইউরোপে চালান হয়েছে সেটা তো ওয়েল ডকুমেন্টেড। মুঘল আমলে জিডিপি ছিলো...
ব্যাস, ওই অবধি শুনেই - " মুঘল আমল কেন বলবে? কেন চোল বা চালুক্য আমল নয়? কেন তাদের কথা ইতিহাসে থাকবে না?"
"ভাই, ইতিহাস বইয়ে মৌর্য্য, গুপ্ত, শুঙ্গ, পাল, চোল, চালুক্য সবই তো ছিলো।"
"না, ওসব পড়ানো হয় না..." ইত্যাদি।
তারপর পেলাম দুটো লিংক - জনৈক জে সাই দীপকের ইউটিউব ভিডিও "হিস্টরি, আইডেন্টিটি, ইন্ডিয়া" আর সঞ্জীব সান্যালের ইউটিউব ভিডিও "হাউ মাচ অফ ইন্ডিয়ান হিস্টরি ইজ রিয়েলি ট্রু"। এই দুজনই নাকি "নামকরা" ঐতিহাসিক। যখন বললাম উক্ত সাই দীপক অপইন্ডিয়ার লোক, আর সঞ্জীব সান্যাল ভারত সরকারের অর্থনীতির কিছু একটা উপদেষ্টা, আদৌ ইতিহাসের লোক নয়, তখন আবার কিছুটা চুপ...
তারপর কথায় কথায় যেটা দেখা গেল, সেটা হল এর সমস্ত যুক্তিই একেবারে স্ট্যাম্পমারা আইটি সেলের ডায়লগ, মানে আইটি সেল যেসব জিনিস ছড়িয়ে বেড়ায়। যেমন, একটা বেশ লম্বা প্রশ্নঃ
"আমাদের ইতিহাস কেন শুধু হেরে যাওয়ার ইতিহাস? রেজিস্টেন্সের ইতিহাস কই? গজনীর মামুদের শেষ আক্রমণের পর ফের আক্রমণ করতে কেন ১২০ বছর লাগলো? সুহেলদেবের কথা ইতিহাসে লেখে না কেন? উত্তরপূর্ব ভারতের রাজাদের কথা কেন লেখে না? ব্রিটিশ ঐতিহাসিকদের কেন বিশ্বাস করবো যখন তারা আসার আগেও ভারত বলে একটা বিরাট ব্যাপার ছিলো? স্ক্রিপচার আর শিলালিপিকে কেন প্রমাণ হিসেবে ধরা হবে না? ভারতের সবচেয়ে বড় ইতিহাসের দলিল - নালন্দাকে যদি ইচ্ছে করে ধ্বংস করা হয়ে থাকে, তাহলে অন্য দলিল কেন মেনে নেবো? অন্য দেশ, যেমন চীন বা আমেরিকা তাদের অতীতকে গ্লোরিফাই করে। আমরা কেন করবো না? বিদেশীদের বলা ইতিহাস কেন মানবো?"
এসবের এক কথায় উত্তর হয় না, আর সিউডো-ইতিহাসের লক্ষ্যই এইগুলো ছড়ানো। যেমন, সুহেলদেব - একটা লেজেন্ড ছাড়া যার সম্পর্কে কোনো ঐতিহাসিক দলিল নেই [১]। পৃথ্বীরাজ চৌহান সিনেমাটা নিয়েও যে বিতর্কটা হয়েছে তাও মোটামুটি এই লাইনেই - যে পৃথ্বীরাজ রসো কোনো প্রামাণ্য ঐতিহাসিক দলিল নয়। আর এই তথাকথিত ঐতিহাসিকরা, মানে বিক্রম সম্পত বা সঞ্জীব সান্যাল - এদের স্টাইলটাই হল বিনা রেফারেন্সে কিছু দাবীদাওয়া বাজারে ছেড়ে অ্যাকাডেমিক হিস্টোরিয়ানদের কোনোভাবে ডিসক্রেডিট করা - যে আদতে ভারতের গৌরবময় ইতিহাসকে বামপন্থী, কমিউনিস্ট আর নেহরুভিয়ান ঐতিহাসিকরা চেপে দিয়েছে। হিট অ্যান্ড হাইড স্টাইল বলে একে, অ্যালিগেশন ছুঁড়ে পালিয়ে যাওয়া [২]।
এইসব বেশ কিছু বোঝানোর পর যেটা শুনলাম সেটাতেই খটকাটা লাগলো - যে এই পুরো অ্যাফিচিউডটা আসে একটা কোনো কমপ্লেক্স থেকে - যে আমি এত খেটেছি, এত করেছি, অথচ কিছু পাইনি, অন্য লোকে আমার থেকে এগিয়ে গেছে।
"হিন্দু বা বিজেপি নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যথা নেই। এত কিছু করার পরেও আমার কেন এত ইনফিরিয়রিটি কমপ্লেক্স সেইটা খুঁজতে খুঁজতে আমি ডিফিটিস্ট মেন্টালিটি শব্দটা পেলাম, সেখান থেকে এইগুলো পেয়েছি..."
খুঁজে পেয়েছে, পড়েছে, কিন্তু প্রশ্ন করেনি। যে মানসিকতা নিয়ে রিসার্চের কাজ করে, সেই মানসিকতা নিয়ে এইগুলো পড়েনি বা শোনেনি। রিসার্চের ভাষায় বলতে গেলে ডীপ লার্নিং নিয়ে গুগলের ডীপ মাইন্ড থেকে পাব্লিশ করা পেপার ছেড়ে অমিটি বা লাভলি প্রফেশনাল ইউনিভার্সিটির পেপারের ওপর ভরসা করেছে। কারণ এদের দাবীগুলোর সাথে নিজের সাবকনশাসে থাকা ধ্যানধারণা মিলে গেছে। নিজের অপূর্ণ কিছু ইচ্ছে বা না পাওয়ার হতাশার জন্যে কাউকে দায়ী করার জন্যে লোক খুঁজে পেয়ে গেছে।
উগ্র জাতীয়তাবাদের গজিয়ে ওঠার ক্লাসিক পন্থা এই দুর্বলতাগুলোকে এক্সপ্লয়েট করা। এই লোকগুলোই ভালনারেবল। হিন্দুত্ব আর জাতীয়তাবাদ ছড়ানোর জন্যে ঊর্বর জমি।
থার্ড রাইখের ইতিহাস পড়লেও এই একই নমুনা দেখতে পাবেন - নাৎসীরা যেটাকে কাজে লাগিয়েছিলো।