শনিবার, ৩০ জুলাই, ২০২২

হিন্দুত্বের মিথ্যে কীভাবে ছড়ায় ~ অরিজিত মুখোপাধ্যায়

হিন্দুত্বের মিথ্যে কীভাবে ছড়ায় তার আরো একটা চাক্ষুষ নমুনা দেখলাম...

অনেকদিনের চেনা লোক, একসাথে কাজ করি - আপাতদৃষ্টিতে সায়েন্টিফিক টেম্পারামেন্ট ইত্যাদি আছে, কাজের দিক থেকেও ভালোই...মানে অফিসের কাজে যা যা লাগে, মোটামুটি সবই রয়েছে। দুপুরে ক্যাফেটারিয়ায় বসে খাওয়ার সময় কথাবার্তা ঘুরে গেলো পার্থ চ্যাটার্জী, তৃণমূলের দূর্নীতি, সেখান থেকে উত্তরপ্রদেশে কীভাবে বদমাইশদের ঢিট করা হয়েছে, আর ইউপি কীভাবে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের কোন কোন লিস্টে টপ ফাইভে আছে ইত্যাদি। না না, কেরল বাদ যায়নি, কেরলও প্রশংসাযোগ্য, কিন্তু ইউপিতে ঢিট করা ব্যাপারটা বেশ কাজের। সেটা একটু চেপে গেলো সেই ইউপিতেই করোনাকালে লাশের ছবি আর হিউম্যান ইন্ডেক্সের কথা ওঠায়...

তারপর, কোনোভাবে আলোচনা ঘুরলো ইতিহাসের দিকে - কেন আমাদের ইতিহাস এত "ডিফিটিস্ট"... আমাদের যে লুঠ করা হয়েছে সেটা কেন ইতিহাসে লেখা নেই?

আমি বললাম - কে বলেছে নেই? কলোনিয়াল আমলে কীভাবে এখানকার সম্পদ ইউরোপে চালান হয়েছে সেটা তো ওয়েল ডকুমেন্টেড। মুঘল আমলে জিডিপি ছিলো...

ব্যাস, ওই অবধি শুনেই - " মুঘল আমল কেন বলবে? কেন চোল বা চালুক্য আমল নয়? কেন তাদের কথা ইতিহাসে থাকবে না?"

"ভাই, ইতিহাস বইয়ে মৌর্য্য, গুপ্ত, শুঙ্গ, পাল, চোল, চালুক্য সবই তো ছিলো।"

"না, ওসব পড়ানো হয় না..." ইত্যাদি। 

তারপর পেলাম দুটো লিংক - জনৈক জে সাই দীপকের ইউটিউব ভিডিও "হিস্টরি, আইডেন্টিটি, ইন্ডিয়া" আর সঞ্জীব সান্যালের ইউটিউব ভিডিও "হাউ মাচ অফ ইন্ডিয়ান হিস্টরি ইজ রিয়েলি ট্রু"। এই দুজনই নাকি "নামকরা" ঐতিহাসিক। যখন বললাম উক্ত সাই দীপক অপইন্ডিয়ার লোক, আর সঞ্জীব সান্যাল ভারত সরকারের অর্থনীতির কিছু একটা উপদেষ্টা, আদৌ ইতিহাসের লোক নয়, তখন আবার কিছুটা চুপ...

তারপর কথায় কথায় যেটা দেখা গেল, সেটা হল এর সমস্ত যুক্তিই একেবারে স্ট্যাম্পমারা আইটি সেলের ডায়লগ, মানে আইটি সেল যেসব জিনিস ছড়িয়ে বেড়ায়। যেমন, একটা বেশ লম্বা প্রশ্নঃ

"আমাদের ইতিহাস কেন শুধু হেরে যাওয়ার ইতিহাস? রেজিস্টেন্সের ইতিহাস কই? গজনীর মামুদের শেষ আক্রমণের পর ফের আক্রমণ করতে কেন ১২০ বছর লাগলো? সুহেলদেবের কথা ইতিহাসে লেখে না কেন? উত্তরপূর্ব ভারতের রাজাদের কথা কেন লেখে না? ব্রিটিশ ঐতিহাসিকদের কেন বিশ্বাস করবো যখন তারা আসার আগেও ভারত বলে একটা বিরাট ব্যাপার ছিলো? স্ক্রিপচার আর শিলালিপিকে কেন প্রমাণ হিসেবে ধরা হবে না? ভারতের সবচেয়ে বড় ইতিহাসের দলিল - নালন্দাকে যদি ইচ্ছে করে ধ্বংস করা হয়ে থাকে, তাহলে অন্য দলিল কেন মেনে নেবো? অন্য দেশ, যেমন চীন বা আমেরিকা তাদের অতীতকে গ্লোরিফাই করে। আমরা কেন করবো না? বিদেশীদের বলা ইতিহাস কেন মানবো?"

এসবের এক কথায় উত্তর হয় না, আর সিউডো-ইতিহাসের লক্ষ্যই এইগুলো ছড়ানো। যেমন, সুহেলদেব - একটা লেজেন্ড ছাড়া যার সম্পর্কে কোনো ঐতিহাসিক দলিল নেই [১]। পৃথ্বীরাজ চৌহান সিনেমাটা নিয়েও যে বিতর্কটা হয়েছে তাও মোটামুটি এই লাইনেই - যে পৃথ্বীরাজ রসো কোনো প্রামাণ্য ঐতিহাসিক দলিল নয়। আর এই তথাকথিত ঐতিহাসিকরা, মানে বিক্রম সম্পত বা সঞ্জীব সান্যাল - এদের স্টাইলটাই হল বিনা রেফারেন্সে কিছু দাবীদাওয়া বাজারে ছেড়ে অ্যাকাডেমিক হিস্টোরিয়ানদের কোনোভাবে ডিসক্রেডিট করা - যে আদতে ভারতের গৌরবময় ইতিহাসকে বামপন্থী, কমিউনিস্ট আর নেহরুভিয়ান ঐতিহাসিকরা চেপে দিয়েছে। হিট অ্যান্ড হাইড স্টাইল বলে একে, অ্যালিগেশন ছুঁড়ে পালিয়ে যাওয়া [২]।

এইসব বেশ কিছু বোঝানোর পর যেটা শুনলাম সেটাতেই খটকাটা লাগলো - যে এই পুরো অ্যাফিচিউডটা আসে একটা কোনো কমপ্লেক্স থেকে - যে আমি এত খেটেছি, এত করেছি, অথচ কিছু পাইনি, অন্য লোকে আমার থেকে এগিয়ে গেছে।

"হিন্দু বা বিজেপি নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যথা নেই। এত কিছু করার পরেও আমার কেন এত ইনফিরিয়রিটি কমপ্লেক্স সেইটা খুঁজতে খুঁজতে আমি ডিফিটিস্ট মেন্টালিটি শব্দটা পেলাম, সেখান থেকে এইগুলো পেয়েছি..."

খুঁজে পেয়েছে, পড়েছে, কিন্তু প্রশ্ন করেনি। যে মানসিকতা নিয়ে রিসার্চের কাজ করে, সেই মানসিকতা নিয়ে এইগুলো পড়েনি বা শোনেনি। রিসার্চের ভাষায় বলতে গেলে ডীপ লার্নিং নিয়ে গুগলের ডীপ মাইন্ড থেকে পাব্লিশ করা পেপার ছেড়ে অমিটি বা লাভলি প্রফেশনাল ইউনিভার্সিটির পেপারের ওপর ভরসা করেছে। কারণ এদের দাবীগুলোর সাথে নিজের সাবকনশাসে থাকা ধ্যানধারণা মিলে গেছে। নিজের অপূর্ণ কিছু ইচ্ছে বা না পাওয়ার হতাশার জন্যে কাউকে দায়ী করার জন্যে লোক খুঁজে পেয়ে গেছে। 

উগ্র জাতীয়তাবাদের গজিয়ে ওঠার ক্লাসিক পন্থা এই  দুর্বলতাগুলোকে এক্সপ্লয়েট করা। এই লোকগুলোই ভালনারেবল। হিন্দুত্ব আর জাতীয়তাবাদ ছড়ানোর জন্যে ঊর্বর জমি।

থার্ড রাইখের ইতিহাস পড়লেও এই একই নমুনা দেখতে পাবেন - নাৎসীরা যেটাকে কাজে লাগিয়েছিলো।


শনিবার, ২৩ জুলাই, ২০২২

পার্থ ~ সুশোভন পাত্র

মিস্টার পার্থ চট্টোপাধ্যায় হাও ইস দা জোশ? ২০১৩, বেহালা। তৃণমূল সরকারের দ্বিতীয় বর্ষপূর্তির জনসভা। আপনি তখন  শিক্ষামন্ত্রী, আপনি তখন হুকুমত, আপনার তখন হেব্বি রোয়াব! মঞ্চ কাঁপিয়ে, গলা ফাটিয়ে আপনি বললেন,      
- ২০০৭-এ শালবনীতে কি একটা পটকা ফাটল, আর বুদ্ধ ধুতি তুলে দৌড় মারল! জ্যোতি ডুবে গেছে, বুদ্ধ বুদ্ধু হয়ে গেছে, আজকাল সুজ্জ্যি মামা ডোবে আর ওঠে! সিপিএম এখন মায়ের ভোগে! 
মনে পড়ে? আজ সকালে ইডির অফিসাররা যখন আপনাকে বগল দাবা করে গাড়িতে চাপিয়ে মামাবাড়ি নিয়ে যাচ্ছিল, ২৭ ঘণ্টা ইডির জেরার বাউন্সারে আপনি যখন বিধ্বস্ত, রণক্লান্ত; তখন আপনার সেদিনের ঐ বাচালতাটা বড্ড মনে পড়ছিল! কোথায় আপনার সেই মাঞ্জা দেওয়া পাঞ্জাবি, পায়ে নাইকির ব্র্যান্ডেড স্পোর্টস সু, যত্ন করা ফ্রেঞ্চ কাট, হুঁশ করে চলে যাওয়া লাল বাতি গাড়ি, সামনে পাইলট পিছনে ব্ল্যাক ক্যাটের ফেরেকবাজি? 'আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম!' তাই না মিস্টার পার্থ চট্টোপাধ্যায়? 
এই তো আজ বিকেলে রিপন স্ট্রিটের বাসস্ট্যান্ডে শুনলাম এক ভদ্রলোক চিৎকার করে বলছেন 'শালা রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রীটা চোর। ৩৪ বছরে এমন দেখতে হয়নি।' বাকিরা সবাই চুপ করে শুনছেন। মিস্টার পার্থ চট্টোপাধ্যায় রাস্তা ঘাটে লোকে আপনাকে চোর বলছে! আপনার কেমন লাগছে শুনতে? 
কি করবেন বলুন? আসলে রাজ্যের প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী কে দুর্নীতির দায়ে ইডি জেরা করছে, প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রীর ঘনিষ্ঠর ফ্ল্যাট থেকে দু'হাজার, পাঁচশো টাকার নোটের পাহাড় আবিষ্কার হচ্ছে -এসব তো বাঙলার মানুষ আগে দেখেনি। প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রীর ঘনিষ্ঠর দক্ষিণ কলকাতার কেতাদুরস্ত আবাসনে ঘুষের আর তোলাবাজির টাকা গোনার জন্য ইডি'র আধিকারিকরা মেশিন আনতে বাধ্য হচ্ছে -বাঙলার মানুষ আগে দেখেনি। 
ইডি-সিবিআইর গদাইলস্করি চাল, প্রচুর টাকা বিদেশে পাচার; তারপরেও শুধু একজন ঘনিষ্ঠর বাড়ি থেকে উদ্ধার হওয়া টাকার পরিমাণ ২০কোটির বেশি! ডলার, সোনা, মোবাইল। ১৮টি বাড়ি, ফ্ল্যাট, জমির নথিপত্র। পশ্চিম মেদিনীপুরের পিংলাতেও স্ত্রীর নামে ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, আত্মীয় স্বজন, মেয়ে জামাইয়ের নামে বিপুল সম্পত্তি! 
সবটাই তো গরীব খেটে খাওয়া বাঙলার সাধারণ যুবক যুবতীর কষ্টার্জিত টাকা লুঠ করে, তাঁদের চাকরি পাওয়ার স্বপ্নে বুলডোজার চালিয়ে, পেটে লাথি মেরে! স্বাধীনতার পরে পশ্চিমবঙ্গের বুকে নিয়োগ নিয়ে সবথেকে বড় কেলেঙ্কারি। প্রাইমারি টেট থেকে এসএসসি, শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী নিয়োগে বেনজির দুর্নীতি। অবৈধভাবে অকৃতকার্য এমনকি খালি খাতা জমা দেওয়া পরীক্ষার্থীরাও চাকরি পেয়েছে স্রেফ এই দুর্নীতি চক্রের মদতে। আদালতের নির্দেশে একাধিকজন চাকরি হারিয়েছেন এই দুর্নীতির জেরেই। সেখানে রাস্তা ঘাটে আপনাকে কে 'চোর' বললে কি, খুব ভুল বলছে? আপনি কি বলেন মিস্টার পার্থ চট্টোপাধ্যায়?  
কান্তি বিশ্বাস, পার্থ দে, সত্যসাধন চক্রবর্তী, শম্ভু দে, সুদর্শন রায়চৌধুরী  -শিক্ষামন্ত্রী বামফ্রন্ট সরকারের আমলেও ছিল। ১৯৯৮-২০১০, এরাজ্যে প্রতি বছর এস.এস.সি'র মাধ্যমে নিয়োগ হয়েছিল মোট ১,৮৫,৮৪৫ জন। হ্যাঁ, ৮-১০ লক্ষ টাকার ঘুষ না দিয়েই, মেধা তালিকা গোপন না রেখেই, স্বজন পোষণ আর বেনিয়মের কলঙ্ক গায়ে না মেখেই! 
৩৪ বছরের অনেক গল্প আপনারা শুনেছেন, পাড়ার তৃণমূলের মস্তানদের নন্দীগ্রাম-সিঙ্গুর-আনন্দমার্গী-মরিচঝাঁপি-সাঁইবাড়ি'র নামতা ঘুষতে শুনেছেন, সেই মস্তান'দের একটু জানিয়ে দেবেন, ৩৪ বছরের ঐ বাংলায় একটা অনিয়ম, একটা দুর্নীতির প্রমাণও কিন্তু তাঁদের দিদি আর দিদির পদলেহনকারী পুলিশ-সিআইডি-কমিশন আজ অবধি দিতে পারেনি, ৩৪ বছরের ঐ বাংলায় টাকার বিনিময়ে কলেজে অনার্সের সিট বিক্রি হয়নি, ৩৪ বছরের ঐ বাংলায় মেধা তালিকার ছাত্র-ছাত্রী'দের স্রেফ ঘুষ দিতে না পারায় আত্মহত্যার করতে হয়নি, ৩৪ বছরের ঐ বাংলায় মুখ্যমন্ত্রী'দের কাটমানির ৭৫% পার্টি ফান্ডে জমা করার হুইপ দিতে হয়নি, ৩৪ বছরে এই রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রীকে রাস্তায় ঘাটে লোকজন প্রকাশ্যে 'চোর' বলেনি!  
মিস্টার পার্থ চট্টোপাধ্যায়, তৃণমূল আপনাকে ঝেড়ে ফেলছে। মুখ্যমন্ত্রী নাকি আপনার ফোন ধরছেন না, মিডিয়ার অলিন্দে কান পাতলে শোনা যাচ্ছে আপনাকে ক্যাবিনেট থেকে ছেঁটে ফেলা হয়েছে, তৃণমূলের সব পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে, আপনাদের দু-পয়সার মুখপাত্র টুইট করে বলে দিয়েছেন, এই দুর্নীতির দায় কেবলমাত্র আপনার, দলের না! কিন্তু আমরা জানি, আপনি একা না। তৃণমূলে পা থেকে মাথা, প্রত্যেকে দুর্নীতিগ্রস্ত। আর সেই দুর্নীতিগ্রস্তদের রিং-মাস্টারের নাম মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়! 
২০১১ তে মুখ্যমন্ত্রী হয়ে এগারোটা কমিশন গড়েছিল মেয়েটা। বছর ঘুরতেই আরও ছটা। এত কমিশন একসঙ্গে জীবনে দেখেনি রাজ্যবাসী। নবান্নের চোদ্দ তলার প্রথম থাকে সে রাখল 'জমি বণ্টনে অনিয়মে'র তদন্ত কমিশনদের। রাজারহাটের কমিশনটাকে জড়িয়ে ধরে সে বলল, তুই আমার তুরুপের তাস। দ্বিতীয় থাকে রাখল সব 'গণহত্যার' কমিশন'দের। ২১শে জুলাই কমিশনটাকে জড়িয়ে ধরে বলল তোর নাম 'বুদ্ধ ভট্টাচাজ বধ'।
কমিশনের হাতি পুষতে সেদিন খরচা হয়েছিল রাজ কোষাগারের ৫ কোটি। সিপিএম'র নেতাদের পিণ্ডি তর্পণের দিবাস্বপ্নে বিগলিত বুদ্ধিজীবীরা কমিশন'কেই দরাজ সার্টিফিকেট বিলিয়ে বলেছিলেন "এহি হ্যা রাইট চয়েস বেবি।" মিডিয়ার ক্যাকাফনি তে সেদিন অনায়াসেই চাপা পড়ে গিয়েছিলো শালকু সরেন, অজিত লোহার-পূর্ণিমা ঘোড়ুই-জিতেন নন্দী'দের লাশের নিস্তব্ধতা। আজ ১১ বছর অতিক্রান্ত, ২১শে জুলাইর মঞ্চে ধমক-চমক ছাড়া মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হিম্মত আছে নাকি কমিশনের রিপোর্ট সামনে এনে সিপিএম-র নেতাদের দুর্নীতির দায়ে জেলে ভরার?     
তাই, মিস্টার পার্থ চট্টোপাধ্যায়, আপনি জেলে গেলেন বলে গায়ের ঝাল মিটিয়ে বসে থাকার সুযোগ বামপন্থীদের নেই। সারদা, নারদা, রোজভ্যালি, বালি কয়লা, গরু, পার্থ চট্টোপাধ্যায়, মদন মিত্র, মুকুল রায় –তৃণমূলের রাজনীতির ল্যান্ডস্কেপে ছড়িয়ে থাকা এই বিক্ষিপ্ত বিন্দু গুলোকে একসাথে জুড়লে যে নকশাটা তৈরি হয় সেটা ধারাবাহিক দুর্নীতির, সেই নকশাটা দুর্নীতি কে রাজনীতির আঙিনায় প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার, সেই নকশাটা বাঙলায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাত ধরে একটা লুম্পেন সর্বস্ব রাজনীতির নিয়ন্ত্রক শক্তি হয়ে ওঠার! 
আমাদের লড়াইটা বাঙলার বেকার যুবকদের ন্যায্য চাকরি ফিরিয়ে দেবার লড়াই, মানুষের কষ্টার্জিত লুঠের টাকা ফিরিয়ে দেওয়ার লড়াই, যে মিডিয়া মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে মেরুদণ্ড বন্দক রেখেছে সেই মেরুদণ্ড ফিরিয়ে দেওয়ার লড়াই। লড়াইটা আসলে, যে রাজনীতি ব্যবস্থা আমাকে-আপনাকে প্রতিনিয়ত এই দুর্নীতির সাথে আপোষ করতে শেখাচ্ছে, সেই রাজনীতি কে হারিয়ে দেওয়ার লড়াই। বরুণ বিশ্বাস, সত্যেন্দ্র দুবে, নরেন্দ্র দাভোলকার রক্তে ভেজা পথের লড়াই। দুর্নীতি মুক্ত নতুন বাঙলায় সূর্যোদয় ঘটাবার লড়াই। শোষণহীন রাঙা প্রভাত ছিনিয়ে আনার লড়াই। 
বাই দা ওয়ে, মিস্টার পার্থ চট্টোপাধ্যায়, বুদ্ধবাবু আজও বাঙলার মানুষের মনে সম্মান নিয়েই বাঁচেন, ইনকিলাবি শ্লোগানের গর্ব নিয়ে বাঁচেন, আজও লাল ঝাণ্ডার নেতৃত্বে নতুন বাঙলা গড়ার স্বপ্ন নিয়েই বাঁচেন। 
আপনিও বাঁচবেন, দুর্নীতিবাজের তকমা নিয়ে, মানুষের ঘেন্না কুড়িয়ে, পথ চলতি মানুষের ঐ খিস্তি খেউরে! ঐ যে কথায় বলে না, 'আমরা', 'ওরা'। তফাৎ ছিলই। তফাৎ থাকবেও।

ক্যাপ্টেন লক্ষী সেহগল ~ অর্কপ্রভ সেনগুপ্ত

ক্যাপ্টেন সেহগল সম্পর্কে একটা প্রশ্ন আমার মাথায় বারেবারেই ঘুরত। যে মানুষের রাজনৈতিক চেতনা তৈরি হয়েছে মিরাট ষড়যন্ত্র মামলার প্রেক্ষাপটে সুহাসিনী চট্টোপাধ্যায়ের হাত ধরে, যিনি ডাক্তারি পড়ার পাশাপাশি সমাজতন্ত্র বা সাম্যবাদ নিয়ে যে বই পেতেন সেই বইই পড়ে ফেলতেন, যাঁর মনে গভীরতম রেখাপাত করেছিল এডগার স্নো-এর 'Red Star over China', সেই ক্যাপ্টেন সেহগল দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিলেন না কেন ? আমি দীর্ঘদিন এর উত্তর ভেবে এসেছিলাম হয়তো দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের প্রেক্ষিতে সুভাষ-কমিউনিস্ট বিরোধের জন্য ক্যাপ্টেন লক্ষ্মী নিজে মতাদর্শের দিক থেকে কমিউনিস্ট হলেও ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে কোনো সম্পর্ক রাখতে চাননি। কিন্তু পরবর্তী সময়ে ক্যাপ্টেনের স্মৃতিকথা সহ বিভিন্ন বইপত্র পড়ে দেখেছি বিষয়টি ছিল আদতে উল্টো। ক্যাপ্টেন সেহগল তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন - 

"যাইহোক, এত কাজ সত্ত্বেও আমার মধ্যে একটা ছটফটানি ছিল, সেটা প্রধানত রাজনৈতিক। যে-ভাবে কাজকর্ম চলছে তাতে আমি একটুও সন্তুষ্ট ছিলাম না। স্বাধীনতার ফলভোগ করছে কেবলমাত্র কয়েকটি লোক। শ্বেতকায়দের জায়গা দখল করেছে কৃষ্ণকায়রা। নিয়ম সব একই রকম রয়েছে, যদি এর পরিবর্তন না হয় তবে অবস্থা ক্রমেই খারাপ হতে থাকবে। আমার নিজের বিশ্বাস ছিল, এখনও আছে, যে কেবলমাত্র আমাদের মূল্যবোধের সঙ্গে খাপ খেতে পারে এমন সমাজতন্ত্র আমাদের সমস্যার সমাধান করার সাহায্য করতে পারে। বার্মা থেকে ফেরার পর থেকে আমি ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছি, রাজনৈতিক কাজ করার জন্য। কিন্তু তাঁরা আমায় (ফ্যাসিস্ট) জাপানী যোগাযোগের জন্য এড়িয়ে চলেছেন।"   

কংগ্রেসের লোকেরা তাঁকে আরও জঘন্য ভাবে অপমান করেছিল, তার বিস্তৃত বিবরণও তাঁর স্মৃতি কথায় আছে। ভারতীয় জনসঙ্ঘের রাজনীতিকে তিনি প্রবল অপছন্দ করতেন। সোশ্যালিস্ট রাজনীতিতেও তাঁর ভরসা ছিল না। তিনি শুরু থেকেই কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গেই কাজ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু কমিউনিস্টরাই তাঁকে এড়িয়ে যেতেন। সুভাষচন্দ্রের স্মৃতির প্রতি ক্যাপ্টেন দায়বদ্ধ ছিলেন। 'যা করেছি ভুল করেছি' এই মুচলেকা দিয়ে কমিউনিস্ট পার্টিতে আসা তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিল না। ক্যাপ্টেন সেহগলের পক্ষে দীর্ঘকাল আর রাজনীতিতে আসা সম্ভব হয় নি। সুযোগ হল পার্টি ভাগের পর, বাংলাদেশ মুক্তি যুদ্ধের প্রেক্ষিতে। সিপিআই-এর সুভাষচন্দ্র বা আই.এন.এ নিয়ে যে মূল্যায়ন বা ছুঁতমার্গ ছিল, নবগঠিত সিপিআই(এম)-এর তা ছিল না। বাংলাদেশ মুক্তি যুদ্ধের প্রেক্ষিতে স্বয়ং জ্যোতি বসু ক্যাপ্টেন সেহগলকে চিঠি দিয়ে অনুরোধ করলেন কলকাতায় পিপলস রিলিফ কমিটিতে যোগ দিতে। লক্ষ্মী অভিমান করতে পারতেন, কমিউনিস্টদের পূর্ববর্তী শীতলতার, প্রত্যাখ্যানের শোধ নিতে পারতেন। তিনি তার ধারে কাছ দিয়ে গেলেন না, কমিউনিস্টদের তিনি চিরকালই আপন মনে করে এসেছেন, কমিউনিস্টরাই তাঁকে নিজেদের লোক মনে করেনি। যখন এই ব্যবধান দূর করার সুযোগ এল, তিনি সানন্দেই নিলেন। প্রথমে পিপলস রিলিফ কমিটি পরে গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতির সদস্যদের নিয়ে উদ্বাস্তুদের মধ্যে তিনি যা কাজ করলেন তা অনেকেরই দৃষ্টি আকর্ষণ করল। এই প্রেক্ষিতে তাঁকে সদস্যপদ দেওয়ার কথা হয়।  লক্ষ্মী অবশ্য সিপিআই(এম) পলিটব্যুরোর সদস্যদের সঙ্গে একবার দেখা করেছিলেন পার্টিতে যোগ দেওয়ার আগে। সেখানে সুভাষচন্দ্র আর আই.এন.এ নিয়ে পার্টির নেতাদের মতামত কি সেটা বুঝে নিয়ে তারপরই পার্টিতে যোগ দেন। পূর্বেই বলেছি, সুভাষচন্দ্র সম্পর্কে সঠিক মূল্যায়ন করে না, এমন দলে তিনি যোগ দিতে আগ্রহী ছিলেন না। 

ক্যাপ্টেন সেহগলের আজ প্রয়াণ দিবস। তিনি বারবার বলেছিলেন, স্বাধীনতা তিন ধরণের হয় - রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক। ভারতে শুধু আমরা প্রথম স্বাধীনতাটি অর্জন করেছি। বাকি দুই স্বাধীনতা এখনও অর্জিত হয় নি। সেই অর্জনের পথে যে বিরাট পাহাড় আছে, তাতেই আমাদের হাতুড়ির ছোট ছোট ঘা মেরে যেতে হবে। একদিন পাহাড় ভেঙে রাস্তা দেখা যাবেই। ক্যাপ্টেন বিশ্বাস করতেন এই কথা, আমরাও করি।

বুধবার, ২০ জুলাই, ২০২২

কি ঘটেছিল ২১শে জুলাই? ~ গার্গী চ্যাটার্জী

কি ঘটেছিল ২১শে জুলাই ?

● ৩টি বাস পোড়ানো হয়েছিল,

● ৩৫টি গাড়ি ভাঙচুর হয়েছিল,

● গুলি-বোমা-পাথরে জখম হন ২১৫পুলিশ,

● ধর্মতলায় সাংবাদিক মার খেয়েছিলেন,

● 'বহু সশস্ত্র দুষ্কৃতী (অ্যান্টিসোস্যাল) নেশাগ্রস্ত অবস্থায় জড়ো হয়েছিল' জানান মণীশ গুপ্ত 

● জ্যোতি বসুকে গাড়ি থেকে নামাতে ছদ্মবেশ সোনালী গুহদের,

● মৃতদের একজনের নাম এখনও জানে না তৃণমূল,

● ১জন মারা যায় 'সিরোসিস অব লিভারে',

● বিরোধিতা করে জ্যোতি বসুর শরণাপন্ন হন গণিখান,

জন্মের আগেই ২১শে জুলাই চরিত্র বুঝিয়েছিল তৃণমূল!
দলটি আসলে 'দুষ্কৃতীদের ক্লাস্টার'। ইতিহাসে এমন উদাহরণ খুব একটা নেই, যেখানে তৈরি হওয়ার আগেই কোনও দলের চরিত্র এভাবে প্রকাশিত হয়েছে। 

মমতা ব্যানার্জির নেতৃত্বাধীন কোনও দল কী হতে পারে, কী কী করতে পারে তা স্পষ্ট করেছিল ২১শে জুলাই-ই।

তখন ১৯৯৩। মুখ্যমন্ত্রী তখন কমরেড জ্যোতি বসু। স্বরাষ্ট্রসচিব ছিলেন মণীশ গুপ্ত। তৃণমূল কংগ্রেস তৈরিই হয়নি। মমতা ব্যানার্জি তখন কংগ্রেসে। তিনি তখন যুব কংগ্রেসের সভানেত্রী। তিনিই ডাক দিয়েছিলেন —'মহাকরণ অভিযান'-র। ঘোষণা ছিল 'মহাকরণ দখল করা হবে'। যদিও প্রদেশ কংগ্রেস এই 'অভিযান'-র বিরোধিতা করে। 

আজকাল পত্রিকায় ১৯৯৩-র ২৪শে জুলাই একটি খবর প্রকাশিত হয়। শিরোনাম ছিল —'গুন্ডামি রুখতে গণি বসুর সঙ্গে'। সংবাদে জানা যায়, তৎকালীন কংগ্রেস নেতা এ বি এ গণিখান চৌধুরী নয়াদিল্লির বঙ্গভবনে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর সঙ্গে দেখা করেছিলেন ২১শে জুলাইয়ের আগে। গণিখান চৌধুরী সেদিন পশ্চিমবঙ্গের আইনশৃঙ্খলা শক্ত হাতে রক্ষা করার জন্য মুখ্যমন্ত্রী যে ধরনের ব্যবস্থা নেবেন তাকে নিঃশর্তে সমর্থন জানানোর প্রতিশ্রুতি দেন। জ্যোতি বসুকে গণিখান চৌধুরী বলেন, ''গুন্ডামি করে মহাকরণে মুখ্যমন্ত্রীকে ঢুকতে না দেওয়া গণতান্ত্রিক আন্দোলন হতে পারে না। আপনাকে আমি নির্বাচনের মাধ্যমে গদি থেকে টেনে নামানোর চেষ্টা করবো। আপনিও তার বিরোধিতা করবেন। কিন্তু কেউ যদি জোর করে আপনার চেয়ারটা কেড়ে নিতে চায় তা হলে সেটা হবে স্রেফ গুন্ডামি। এটা কোনভাবেই বরদাস্ত করা যায় না।'' প্রধানমন্ত্রী নরসীমা রাও-ও যে যুব কংগ্রেসের এই ধরনের বেপরোয়া ঘটনার সমালোচনা করেছেন তা জ্যোতি বসুকে গণিখান চৌধুরী জানান সেদিন।

কিন্তু তবু রক্ত ঝরেছিল। কী হয়েছিল ২১শে জুলাই? পুলিশের গুলিতে ১৩জন যুব কংগ্রেস 'কর্মী' নিহত হয়েছিলেন ময়দানে। '২১শে জুলাই' বলতে সোজা কথায় এমনটাই বলা হয়। কিন্তু কেন পুলিশ গুলি চালালো? যারা মারা গিয়েছিলেন, তাঁরা কারা? সেদিন মমতা ব্যানার্জি, মদন মিত্র, সোনালি গুহদের কাণ্ডকারখানা কেমন ছিলো? মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর মমতা ব্যানার্জি ওই ২১শে জুলাই নিয়ে কী করেছেন? এই প্রশ্নের উত্তরগুলি খুঁজলেই বোঝা যায় — কী হয়েছিল ১৯৯৩-র ২১শে জুলাই।

স্বরাষ্ট্রসচিব হিসাবে মণীশ গুপ্ত সেদিনের ঘটনার বিষয়ে হাইকোর্টে ১৯৯৩-র ২রা আগস্ট একটি হলফনামা জমা দিয়েছিলেন। সেই হলফনামা অনুসারে, ''ওইদিন(১৯৯৩-র ২১শে জুলাই)-এ জমায়েতে 'বহু সশস্ত্র দুষ্কৃতী(অ্যান্টিসোস্যাল) নেশাগ্রস্ত অবস্থায় জড়ো হয়েছিলো।'' সেদিন ১৩ জন যুবকের মৃত্যু হয়েছিলো। আশ্চর্য হলো মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর সেই ঘটনার বিচারবিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ দিয়েছিলেন মমতা ব্যানার্জি। কিন্তু আজও তৃণমূল জানে না ওই ঘটনায় মৃত ১৩তম ব্যক্তিটি কে? তৃণমূলের ওয়েবসাইটে এখনও ওই ১৩ নম্বর জায়গার পাশে লেখা আছে —'অ্যানোনিমাস'। অর্থাৎ অজানা। কেন তাঁর পরিচয় গোপন রাখেন মমতা ব্যানার্জি? 

অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি সুশান্ত  চ্যাটার্জির নেতৃত্বে '২১ শে জুলাইয়ের তদন্ত কমিশন' তৃণমূল সরকার ২০১১ সালে ক্ষমতায় আসার পরই গঠিত হয়। ২০১৪-র ডিসেম্বরে এই কমিশন রিপোর্ট জমা দেয়। কমিশন সাক্ষ্য দিতে ডেকেছিল বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসু, প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে। কিন্তু যিনি সেই 'অভিযান'-র উদ্যোক্তা, সেই মমতা ব্যানার্জিকেই এই কমিশন কখনো ডাকেনি। কমিশন কেমন কাজ করেছে, তা এরথেকেই কিছুটা বোঝা যায়। তবু কমিশনের চেয়ারম্যান অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি সুশান্ত চ্যাটার্জি তাঁর তদন্ত রিপোর্ট জানাতে বাধ্য হয়েছেন, যে ১৩জনের মৃত্যু হয়েছিল সেদিন, তাদের মধ্যে একজনের গায়ে গুলির কোনও আঘাতই মেলেনি। সেই ব্যক্তির মৃত্যুর কারণ 'সিরোসিস অব লিভার'। সাধারণত এই রোগটি বেপরোয়া মদ্যপানের কারণে হয়। আর বেপরোয়া মদ্যপান দুষ্কৃতীদের পরিচিত বৈশিষ্ট্য।

রাজ্যের স্বরাষ্ট্রসচিব তখন ছিলেন মণীশ গুপ্ত। পালাবদলের পর মমতা ব্যানার্জির ঘনিষ্ঠ হয়ে তিনি হন রাজ্যের বিদ্যুৎমন্ত্রী। ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে পরাস্ত হলে তাঁকে মমতা ব্যানার্জি রাজ্যসভার সাংসদ (মিঠুন চক্রবর্তী পদত্যাগ করলে তাঁর শূূন্যস্থানে) করেছেন। স্বরাষ্ট্রসচিব হিসাবে তিনি সেদিনের ঘটনার বিষয়ে হাইকোর্টে একটি হলফনামা জমা দিয়েছিলেন। ১৯৯৩-র ২রা আগস্ট তাঁর জমা দেওয়া সেই হলফনামা অনুসারে, ''ওই দিন(১৯৯৩-র ২১শে জুলাই)-এ জমায়েতে বহু সশস্ত্র দুষ্কৃতী(অ্যান্টিসোস্যাল) নেশাগ্রস্ত অবস্থায় জড়ো হয়েছিলো। ওই দিন সকাল সাড়ে ৯টা থেকে সারা রাজ্যের কয়েক হাজার যুব কংগ্রেসকর্মী স্ট্র্যান্ড রোড, বি বি গাঙ্গুলি স্ট্রিট, রানি রাসমণি অ্যাভিনিউ, এসপ্ল্যানেড রো ইস্ট এবং ব্রেবোর্ন রোডে জমায়েত হয়। মেয়ো রোডে ১৫ হাজার, ধর্মতলায় ১৫ হাজার, ব্রেবোর্ন রোডে, স্ট্র্যান্ড রোডে ১০ হাজার, বি বি গাঙ্গুলি স্ট্রিটে ৭ হাজার জমায়েত ছিলো। যুব কংগ্রেস কর্মীরা মহাকরণের দিকে ছুটতে থাকে। পুলিশ প্রথমে নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জনতাকে শান্ত করতে চেষ্টা করে। কিন্তু পুলিশের সেই চেষ্টা ফলপ্রসূ হয়নি। 'জনতা' পুলিশকে লক্ষ্য করে পাইপগান থেকে গুলি ছোঁড়ে। ইট, পাথর, সোডার বোতলও ছোঁড়া হয় যথেচ্ছ। পুলিশ তখন লাঠি চালায়। ৩৪১ রাউন্ড কাঁদানে গ্যাসের শেলও ফাটায় পুলিশ এবং রাইফেল থেকে ৭৫ রাউন্ড ও রিভলভার থেকে ৪৬ রাউন্ড গুলি চালানো হয়।'' 

অর্থাৎ সেদিন 'আন্দোলনকারীরা' বোমা, পাইপগান নিয়ে এসেছিলো! তারা মহাকরণ দখল করতে ছুটছিলো। গুলি ছুঁড়ছিলো, বোমা মারছিলো। 

মণীশ গুপ্তর হলফনামা আরও জানিয়েছিল, ''সেদিন ৩টি বাস পোড়ানো হয়েছিলো। ৩৫টি গাড়ি ভাঙচুর হয়েছিলো। সব মিলিয়ে জখম হয়েছিলেন ২১৫ জনেরও বেশি পুলিশ। তাঁদের মধ্যে অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার, যুগ্ম কমিশনার, ডি সি (সদর), ৭জন ডি সি, ১০ জন অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার রয়েছে। ৩৪ জন পুলিশকে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাওয়া হয় পুলিশ হাসপাতালে। তাঁদের অনেকেরই পাইপগানের গুলি এবং বোমার স্প্লিন্টার লেগেছিলো। তালতলা থানার সার্জেন্ট ডি কে ঘোষালের গুলি লেগেছিলো। এক সাব ইনস্পেক্টর কালাচাঁদ সমাদ্দারের শরীরে আঘাত ছিল বোমার। কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের সাব ইনস্পেক্টর এ কে গাঙ্গুলিকে এস এস কে এম হাসপাতালের সামনে মেরে মাথা ফাটিয়ে, হাত ভেঙে দিয়েছিলো দুর্বৃত্তরা।''

আক্রান্ত, রক্তাক্ত হয়েছিলো পুলিশ। 
তাই গুলি চালিয়েছিলো। 
সেদিনও সাংবাদিক পিটিয়েছিলো মমতা ব্যানার্জির দলবল, হুবহু আজকের মতো। দুপুর পৌনে তিনটে নাগাদ ধর্মতলায় স্কুটার আরোহী 
সংবাদসংস্থা পিটি‌আই-র বরিষ্ঠ সাংবাদিক সঈদ আহ্‌মেদকে মমতা ব্যানার্জির কর্মীরা ঘিরে ধরে মেরেছিলো। মারাত্মক আহত হন তিনি।

আরও কী চক্রান্ত ছিল? 

সোনালি গুহর কথাই শোনা যাক। সাতগাছিয়ার বিধায়ক সোনালি গুহ এখন রাজ্য বিধানসভার উপাধ্যক্ষা। ১৯৯৩সালের ২১শে জুলাইয়ের স্মৃতিচারণা করতে তৃণমূলের মুখপত্র 'জাগো বাংলা'-য় একটি ছোট প্রবন্ধ লিখেছিলেন তিনি ২০১২-তে। সোনালি গুহ দলীয় মুখপত্রের (বর্ষ -৮,সংখ্যা ৩৯০, সাপ্তাহিক) সংখ্যার তৃতীয় পৃষ্ঠায় লিখেছিলেন,''১৯বছর আগের ২১শে জুলাই। দিনটি ছিল বুধবার। সকাল-সকাল আমরা দিদির বাড়ি চলে এসেছিলাম। আগে থেকেই আমাদের কয়েকজন মেয়েকে গোপনে একটা দায়িত্ব দেওয়া ছিলো।'' কী সেই দায়িত্ব? বিধানসভার উপাধ্যক্ষা লিখছেন,''তা হলো, জ্যোতি বসুর গাড়ি আটকে দিতে হবে। আমরা তাই সটান চলে গেলাম রেড রোডে। কারণ ওই রাস্তা দিয়ে জ্যোতি বসুর কনভয় যাবে। মুসলিম মহিলাদের মতো বোরখা পরে সেদিন ওই রাস্তায় গিয়ে আমরা অপেক্ষা করছিলাম। কিন্তু শ্যামলী ভদ্র (প্রয়াত প্রাক্তন কাউন্সিলর)-র হাতের শাঁখা-পলা বেরিয়ে পড়ায় পুলিশ ধরে ফেলে।'' 
পুলিশ সেদিন তাঁদের সেখান থেকে সরিয়ে দেয়।

কিন্তু যা স্পষ্ট, তা হলো — ১৯৯৩সালের ২১শে জুলাই মহানগরের ফাঁকা রাস্তায় তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর গাড়ি আটকানোর চক্রান্ত করেছিলেন মমতা ব্যানার্জি। তারজন্য রীতিমতো আগে থেকে ছক কষা হয়েছিলো। এমনকি ছদ্মবেশেরও সাহায্য নেওয়া হয়েছিল। উল্লেখ্য, সেই সময় মুখ্যমন্ত্রীর জন্য নির্ধারিত নিরাপত্তা আজকের মতো আঁটোসাঁটো, কড়া ছিলো না। রাজ্যস্তরে 'ব্ল্যাক ক্যাট কমান্ডো' কথাটির অস্তিত্বই ছিলো না। ছিলো না এ কে ৪৭হাতে নিরাপত্তাকর্মী। মুখ্যমন্ত্রীর কনভয় ছিল ছোট। ফলে সহজেই অনুমান করা যায়, কমরেড জ্যোতি বসুকে ঘিরে নিরাপত্তা ছিল যথেষ্ট শিথিল। সেই সুযোগে মুখ্যমন্ত্রীর গাড়ি আটকে ঠিক কী করার ভাবনা ছিলো মমতা ব্যানার্জির— তা স্বাভাবিকভাবেই এড়িয়ে গেছেন সোনালি গুহ। তবে বলাবাহুল্য, জ্যোতি বসুর গাড়ি আটকে তাঁকে নেহাতই প্রণাম করা, শুভেচ্ছা জানানোর বাসনা নিশ্চয়ই ছিলো না তাঁদের। যদি শুধু বিক্ষোভ দেখানোর ইচ্ছাও থাকতো, তাহলে ছদ্মবেশ নেওয়ারও কোনো দরকার পড়তো না। এখানেই দানা বাঁধে সন্দেহ।



রবিবার, ১০ জুলাই, ২০২২

বুক রিভিউ ~ ডাঃ সমুদ্র সেনগুপ্ত

বুক রিভিউ
বই এর নাম: লুই নেপোলিয়নের অষ্টাদশ ব্রুমেয়ার
লেখক: কার্ল মার্ক্স 

এই বই এর রিভিউটা উল্টো ভাবে শুরু করা যাক, প্রথমে টীকা তারপরে টিপ্পনী, তারও পরে সময় থাকলে রিভিউ। 

টীকা নম্বর এক: ফরাসি বিপ্লবের সময় একটা ক্যালেন্ডার তৈরি করা হয়েছিল যেটা ফ্রেঞ্চ রিপাবলিকান ক্যালেন্ডার নামে পরিচিত। ১৭৯৩ থেকে ১৮০৫ সাল অবধি এই বারো বছর আর পরের দিকে ১৮৭১ সালের পারি কমিউনের সময় ১৮ দিন ধরে এই ক্যালেন্ডার টি ব্যবহার করা হয়েছিল।সব রকমের ধর্মীয় ও রাজতান্ত্রিক প্রভাব মুক্ত একটা ক্যালেন্ডার তৈরির তাগিদ থেকে এর আবির্ভাব। এছাড়াও দশমিক পদ্ধতির প্রচলনও ছিল আরেকটা উদ্দেশ্য। এই ক্যালেন্ডার এর দ্বিতীয় মাসটি "ব্রুমেয়ার" নামে পরিচিত, শব্দটি এসেছে ব্রুমে বা কুয়াশা থেকে (বছরের ওই সময়টা ফ্রান্সে প্রচুর কুয়াশা হয় বলে); মোটামুটি ২২/২৪সে অক্টোবর থেকে একমাস। 

টীকা নম্বর দুই: ১৭৯৯ সালের ৯ নভেম্বর যে প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে জেনারেল নেপোলিয়ন বোনাপার্ট ক্ষমতায় আসেন গভর্নমেন্ট অফ ডিরেকটরী কে সরিয়ে কনস্যুলেট স্থাপন করেন সেই তারিখটি ছিল ওই ক্যালেন্ডার অনুযায়ী অষ্টম বছরের ব্রূমেয়ার মাসের ১৮ তারিখ। এর অনেক পরে ১৮৫১ সালে আরেকটি প্রাসাদ ষড়যন্ত্র এর মাধ্যমে ওই নেপোলিয়ন এর ভাইপো ল্লুই নেপোলিয়ন এর ক্ষমতা দখলকে বর্ণনা করতে গিয়ে কার্ল মার্ক্স সেই আঠেরই ব্রূমেয়ারের প্রসঙ্গ টেনে আনেন এবং একটি পুস্তিকা রচনা করেন ওই নামে যেটি ১৮৫২ সালে প্রকাশিত হয়। 

টিপ্পনী নম্বর এক: পুস্তিকাটির এক্কেবারে গোড়াতেই মার্ক্স বলছেন যে, " হেগেল কোথাও একটা মন্তব্য করেছিলেন যে পৃথিবীর সব মহান ঐতিহাসিক ঘটনা আর চরিত্রগুলি বলতে গেলে দু'বার করে আমাদের সামনে হাজির হয়। উনি এটা যোগ করতে ভুলে গেছিলেন যে প্রথম বার ওটা হয় বিয়োগান্তক নাটক হিসেবে আর দ্বিতীয় বার ওটা আসে প্রহসন হিসেবে।" এই লাইনটি পরবর্তীকালে একটি জগৎ বিখ্যাত কোটেশন হিসেবে পরিচিত হয়ে যায়। 

এই অবধি লিখতে গিয়েই লেখাটা অনেক দীর্ঘ হয়ে গেল তাই বইটার রিভিউ আরেক দিন হবে খন। আজ কেবল দ্বিতীয় টিপ্পনীটা দিয়েই শেষ করা যাক।

টিপ্পনী নম্বর দুই: ইতিহাসের পাতায় ব্যক্তিমানুষের কি ভূমিকা সেটা বিশ্লেষণ করতে গিয়ে এই বইতে মার্ক্স যা বলেছিলেন সেটি পরবর্তীকালে একটি জগৎ বিখ্যাত কোটেশন হিসেবে পরিচিত হয়। ইংরেজি অনুবাদ দে কথা গুলো এই রকম: "Men make their own history, but they do not make it as they please; they do not make it under self-selected circumstances, but under circumstances existing already, given and transmitted from the past."

প্রথম লাইনটার কেবল বাংলা অনুবাদ করলে দাঁড়ায়, "জনগনই তাদের ইতিহাস রচনা করে।" চেনা চেনা লাগছে ? লাগবার কথা। লাল ঝান্ডা দিয়ে সাজানো ব্রিগেডের মাঠে জড়ো হওয়া বারুইপুরের পেয়ারা চাষী, বলাগড়ের মাঝি, ব্যারাকপুরের মজুর, সবাই শুনছে এই কথাগুলো সেই উঁচু মাচায় বসে থাকা ধুতি পাঞ্জাবি পাম্প শু পরা রোগা পাতলা চেহারার একজন বক্তা'র মুখ থেকে। সেই বক্তা কোনোদিন ঘাড়ে ধরে বুঝিয়ে দেন নি যে তিনি মার্ক্স এর এই আঠেরো ব্রুমেয়ার থেকে অনায়াসে কোট করে যাচ্ছেন, অথচ কি অদ্ভুত সাবলীল ভাবে জনগণের মধ্যে নিমেষে ছড়িয়ে দিয়ে যাচ্ছেন সেই মহান জার্মান দার্শনিক বিপ্লবীর বাণী। এর নাম নেতা, শিক্ষক, গুরু। তত্বকথাটি পড়ে, শিখে, আত্মস্থ করে জনগণের মধ্যে নিয়ে যাওয়া যার কাজ। সেই বক্তা'র পরিচয় দিতে হলে বৃথাই আপনি আমার দেয়ালে এসেছেন। 

(তথ্যঋণ: অজয় দাশগুপ্ত দা)

মঙ্গলবার, ৫ জুলাই, ২০২২

দোষ ট কিসে? ~ সুস্মিতা ওঝা

"শুনছ ন কি হারু খুড়া,
পোধান মন্ত্রী অটল বুড়া,
সিদ্ধান্ত ট লিবার আগে
দিদির সাথে করথ শলা!
আজকে সবাই জানত্যে পাল্য,
বুঢ়া যখন চল্যেই গেল,
পোতি বছর জন্মদিনে
চলথ উপহারের পালা!"
"ইত্যে অবাক হছিস ক্যানে? 
পোখরানে বিস্ফোরন দিনে,
ইকটু ইকটু জানথ, সে কি
ভাব্যেছিলি বুকনি মিছা?
করব্যে কাকে রাষ্ট্রপতি?
ভাব্যে বুঢ়া পায় না গতি!
মুশকিল আসান আবুল কালাম,
নাম ট, সে ত দিদির বাছা! 
মিছা নয়খ, কিন্তু যে ট, 
জানথ নাইখ, সিটও দেখ!,
ব্যাঙ্কে, বিমায় ফরেন মানি,
বেচল্য যখন বালকো খনি!
রাষ্ট্রায়ত্ব শিল্প ছ'টা,
বন্ধ করার সিদ্ধান্ত টা,
ইসব পাপের কথা দিদি
তখন কনহই জানে ত নি ! 
বুড়া কালের সাথী পেনশন,
শেয়ার ঘাটে খাটা-টেনশন,
থাকল্য তদের! দিদি সুখে
তেলে-জলে রইল্য মিশে।
দিদি হছ্যে সাপের মনি,
তেমনি চলন, আর বুকুনি।
মরিস যদি ফণী'র বিষে!
দিদির তাথে দোষ ট কিসে?"
           -----------