সম্প্রতি টাইমস অব ইন্ডিয়া সংবাদপত্রে প্রকাশিত দু'দিনের (১৭ মার্চ ও ১৯ মার্চ, ২০২৩) দু'টো খবর। প্রতিপাদ্য: ১৯৮৯ সালে বোম্বে ডাইংয়ের কর্ণধার নসলি ওয়াদিয়াকে হত্যার চক্রান্তে অভিযুক্ত দু'জন বেকসুর খালাস এবং কোর্টের রায়ের পিছনে যুক্তি কী কী।
নড়েচড়ে বসলাম। বহু পুরনো স্মৃতির ধাক্কায় চালিত হয়ে পড়ে ফেললাম আগাগোড়া। পত্রিকার মুম্বইয়ের প্রতিবেদক জানাচ্ছেন, মামলাটির অবশিষ্ট দুই অভিযুক্ত- ইভান সেকুয়েরা ও রমেশ যোগাথিয়াকে মুম্বইয়ের বিশেষ সিবিআই আদালত নির্দোষ ঘোষণা করেছে। অন্য দুই অন্যতম অভিযুক্ত, অর্থাৎ রিলায়েন্স ইন্ড্রাস্ট্রিজের পদস্থ কর্তা কীর্তি আম্বানি ও তাঁর সহযোগী অর্জুন বাবারিয়া আগেই মারা গিয়েছেন। এঁরা সকলে অবশ্য জামিনে মুক্ত ছিলেন। প্রায় পঁয়ত্রিশ বছর বাদে ওয়াদিয়া মার্ডার প্লট মামলায় দাঁড়ি পড়ল।
সেই ঘটনা!
মনে পড়ে গেল একের পর এক। স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে কার্যত নজিরবিহীন এক পর্ব। ব্যবসায়িক টক্করের দাঁত-নখ বার করা প্রাণঘাতী চেহারার সঙ্গে সঙ্গে শাসক-রাজনীতিক-বণিকমহলের ঘৃণ্য স্বার্থ-সম্পর্ক বেআব্রু হয়ে ধরা দিয়েছিল দেশবাসীর সামনে। ফের প্রমাণিত হয়ে গিয়েছিল, যুগে যুগে আদতে বণিকের মানদণ্ডই রাজদণ্ড হয়ে কাজ চালায়। অধিকন্তু দেশের শীর্ষস্থানীয় দুই কর্পোরেট কোম্পানির বাণিজ্যিক প্রতিযোগিতায় যখন খুনের চক্রান্ত, ভাড়াটে খুনিকে সুপারির মতো অভিযোগ জুড়ে যায়, আর নেপথ্যে চলতে থাকে বহুধাবিস্তৃত রাজনীতির অসংখ্য সুতোর টানাটানি ও লোম খাড়া করা কোর্টরুম ড্রামা, পুরো ছবিটা জবরদস্ত থ্রিলার হয়ে দাঁড়ায় বইকি!
ওয়াদিয়া-কাণ্ডও তা-ই দাঁড়িয়েছিল। সে রোমহর্ষক থ্রিলার মুভির পর্দা ওঠে ১৯৮৯-এর শেষ জুলাইয়ে, যেদিন মুম্বই পুলিশের এক ইন্সপেক্টর মারফত একটা অতি গুরুত্বপূর্ণ ও টপ সিক্রেট 'টিপ অফ' এসে পৌঁঁছয় বাণিজ্যনগরীর দুই শীর্ষ পুলিশকর্তার টেবিলে। মুম্বইয়ের তদানীন্তন পুলিশ কমিশনার বসন্ত শরাফ ও জয়েন্ট কমিশনার (ক্রাইম) অরবিন্দ ইনামদার জানতে পারেন, মাস সাত-আট আগে 'ওজনদার' কাউকে খালাস করার জন্য এক ভাড়াটে খুনিকে সুপারি দেওয়া হয়েছে। দিয়েছেন যিনি, তাঁরও ওজন কম নয়।
প্রসঙ্গত, শরাফ ও ইনামদার, দু'জনের ভাবমূর্তি নিষ্কলঙ্ক, ঊর্দিতে একফোঁটা কালির দাগ নেই, অপরাধ ও অপরাধীর সঙ্গে তিলমাত্র আপসরফা ওঁদের চরিত্রের বাইরে। শরাফ ইতিমধ্যে সিবিআই, র এবং সেন্ট্রাল আইবি'তে সুনামের সঙ্গে কাজ করে এসেছেন। 'প্রবল চাপেও মাথা না নোয়ানো'র শাস্তিস্বরূপ ইনামদার পঁচিশ বছরের ক্যারিয়ারে বদলি হয়েছেন বাইশবার।
উল্লেখ্য, মুম্বই পুলিশের প্রসিদ্ধ 'এনকাউন্টার-রাজ' তখন সদ্য ডানা মেলেছে, পুলিশি বুলেট-ঝড়ের মুখে ক্রমশ পিছু হঠছে দোর্দণ্ডপ্রতাপ মাফিয়ারা। নামীদামি কন্ট্র্যাক্ট কিলাররা হয় পগার পার, নয়তো জেলে, কিংবা পুলিশের গুলিতে খতম। এমতাবস্থায় এ হেন 'বড়মাপের' সুপারির খবর শুনে স্বাভাবিক ভাবেই ভ্রূ কোঁচকায় দুই টপ কপের। দীর্ঘ অভিজ্ঞতাজারিত সিক্সথ সেন্সে আঁচ পান, একেবারে উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়। ''হু আর দ্য ক্যারেক্টারস অ্যাট বোথ এন্ডস? গ্যাদার অ্যাচ মাচ ইনফর্মেশন অ্যাজ পসিবল। বি কুইক প্লিজ।''
আন্ডার ওয়র্ল্ডের সোর্স মারফত ইন্সপেক্টর 'পাকা' খবর আনেন। সুপারি দিয়েছেন কীর্তি আম্বানি যিনি কিনা রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজের জেনারেল ম্যানেজার (পাবলিক রিলেশনস), হামেশা সংস্থার মুখপাত্রের ভূমিকায় দেখা যায়। আর তাঁর টার্গেট হলেন নসলি ওয়াদিয়া, বোম্বে ডাইং খ্যাত ওয়াদিয়া গ্রুপের চেয়ারম্যান।
খটখটে শুখা দুপুরে মাথায় বাজ পড়লেও শরাফ-ইনামদার এতটা চমকাতেন না। রিলায়েন্সের টপ অফিসার সুপারি দিয়েছেন বোম্বে ডাইংয়ের মালিককে মারতে? কী সাংঘাতিক!
পাকিস্তানের জনক, 'কয়েদ এ আজম' মহম্মদ আলি জিন্নার দৌহিত্র নসলি ওয়াদিয়ার বোম্বে ডাইং সে সময় ভারতীয় বস্ত্রশিল্পের আকাশে দৃপ্ত সূর্যের মতো বিদ্যমান। পার্সি-ব্রিটিশ-ভারতীয় রক্তের মিশ্রণে যারপরনাই বনেদি, এলিগ্যান্ট, রুচিশীল এক ব্র্যান্ড, ওয়াদিয়া পরিবারের সুশিক্ষিত আভিজাত্যের সঙ্গে পুরোপুরি মানানসই। 'লিভ লাইফ ইন কলর.. ফ্যাশনেবলি', বোম্বে ডাইং.. সামথিং হ্যাজন'ট চেঞ্জ ওভার টাইম', কিংবা হান্ড্রেড পার্সেন্ট পলিয়েস্টার শাড়িতে সজ্জিতা পারভিন ববির মুখে 'আয়্যাম ইন লভ' -- আমাদের ছোটবেলায়, সত্তর-আশির দশকে দেখা বোম্বে ডাইংয়ের হরেক স্লোগানেও সেই এস্থেটিক অ্যারিস্টোক্রেসির ছোঁয়া। পত্রপত্রিকায় পাতাজোড়া বাহারি অ্যাডে সোনালিচুলো করণ কাপুরের রংদার উপস্থিতি। অন্য দিকে রিলায়েন্সের জনক ধীরুভাই আম্বানির উত্থানগাথা হল ফুটপাথের ধুলো থেকে রাজপ্রাসাদে উঠে আসার মতো-- কঠোর, রুক্ষ, অমার্জিত, আগ্রাসী। বনেদিয়ানা, সফিস্টিকেশন বা এলিগ্যান্সের ছিটেফোঁটা নেই, বরং বিবিধ বিতর্কের কাঁটায় কণ্টকিত, অনৈতিকতার নানা অভিযোগে বিদ্ধ। এর আগে ভারতীয় বস্ত্রশিল্প তথা পলিয়েস্টার শিল্পে ধীরুভাইয়ের কিছু প্রতিদ্বন্দ্বীর যে বিচিত্র ও অস্বাভাবিক পরিণতি হয়েছে, তার পিছনে রিলায়েন্সের ভূমিকার কোনও প্রত্যক্ষ প্রমাণ না মিললেও সন্দেহের তির আটকানো যায়নি। কী রকম?
যেমন ১৯৭৪ সালের নয়াদিল্লির চাঞ্চল্যকর ঘটনাটি। রিলায়েন্স সবে সবে মার্কেটে কব্জা কায়েম করছে, তাদের অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী হাকোবা এম্ব্রয়ডারি। দিল্লির আকবর হেটেলের সামনে হাকোবার কর্ণধার বিপিন কাপাডিয়ার উপর চাপাতি হাতে চড়াও হয় একজন। ১৯৮২'তে ওরকে মিলসের কর্ণধারের ছেলে পঙ্কজ মেহরাকে পিটিয়ে আধমরা করে নয়ানজুলিতে ফেলে দেওয়া হয়, ঘটনাচক্রে সে সময় রিলায়েন্স-ওরকে ব্যবসায়িক টক্কর তুঙ্গে। চার বছর বাদে মুম্বইয়ের মুরজানি-কাণ্ডই বা বাদ যায় কেন? টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রিতে ফ্যাব্রিকের কাজে যে সব কর্মীর বিশেষ ভূমিকা, সেই 'ক্রিম্পার'দের সর্বভারতীয় সংগঠনের প্রেসিডেন্ট যমুনাদাস মুরজানি ছিয়াশির এক সন্ধ্যায় তরোয়াল হামলায় মারাত্মক ঘায়েল হন। ঘটনাচক্রে, ওই সময় রিলায়েন্সের বিবিধ 'অপকীর্তি'র প্রতিবাদে মুরজানি ভীষণ রকম সোচ্চার।
সমাপতন?
হতে পারে। তবু স্বাভাবিক ভাবেই আঙুল ওঠে রিলায়েন্সের দিকে। কিন্তু পুলিশি তদন্তে কোনও প্রমাণ মেলেনি। সমালোচকদের মুখও বন্ধ করা যায়নি। সব টপকে এবার খোদ নসলি ওয়াদিয়াকে খুনের সুপারির অভিযোগ!
খবরটির গুরুত্ব ও সুদূরপ্রসারী প্রতিক্রিয়া আন্দাজ করে শিহরিত হন শরাফ-ইমানদার। রিলায়েন্স সে মুহূর্তে দেশের সবচেয়ে বিকাশশীল শিল্পগোষ্ঠী, চোখ ধাঁধানো গ্রোথ রেট। রাজ্য-রাজনীতির গণ্ডি ছাড়িয়ে দিল্লির ক্ষমতা-অলিন্দের গলি-ঘুঁজিতে তার প্রভাবের জাল বিস্তৃত, মহারাষ্ট্রের মসনদ ঘিরেও রিলায়েন্সের অদৃশ্য ক্ষমতা-বলয় বিরাজমান। শোনা যায়, এই 'ক্ষমতার' জোরেই ব্যবসার ময়দানে ধীরুভাই প্রথম 'বিলো দ্য বেল্ট' হিট করেন নসলিকে, যার রেশ ক্রমে তিক্ততায় দাঁড়িয়েছে। কী ভাবে?
পলিয়েস্টার তৈরিতে ওয়াদিয়া গ্রুপ ব্যবহার করত ডাইমিথাইল টেরিফ্যাথ্যালেট (ডিএমটি), অন্যদিকে রিলায়েন্সের ভরসা পিউরিফায়েড টেরিফ্যাথালিক অ্যসিড (পিটিএ)-র উপর। পলিয়েস্টার শিল্পের উপাদান হিসেবে এই দুই রাসায়নিকের গুরুত্ব অপরিসীম। অভিযোগ, দিল্লিতে রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে ধীরুভাই ডিএমটি'তে কেন্দ্রীয় শুল্কহার এতটাই চড়া হারে বাড়িয়ে দেন যে, বোম্বে ডাইং দস্তুরমতো সমস্যায় পড়ে যায়।
দ্বৈরথের সেই সূত্রপাত। ব্যবসার বহর বা 'আগ্রাসীপনা'র নিরিখে রিলায়েন্সের নীচে থাকলেও নসলি ওয়াদিয়াকে দুর্বল ভাবার কারণ নেই, বহু বছরের ঐতিহ্যের গরিমা ছাড়াও ওঁর মস্ত খুঁটি ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস সংবাদপত্র গোষ্ঠী, যাঁর কর্ণধার রামনাথ গোয়েনকা হলেন নসলির গডফাদার। উপরন্তু মহারাষ্ট্রের তদানীন্তন কংগ্রেসি মুখ্যমন্ত্রী শরদ পাওয়ারের সঙ্গে নসলির সখ্যতা সর্বজনবিদিত।
এমতাবস্থায় নসলিকে খুনের জন্য সুপারি দেওয়া হয়েছে শুনলে ওয়াদিয়া গ্রুপ চুপ করে বসে থাকবে না, বলাই ব্যহুল্য। ঝড় উঠবে দেশ জুড়ে। "আঁটঘাট বেঁধে এগোতে হবে, কেস যেন হয় এয়ারটইট, একতিল ছিদ্রও থাকা চলবে না।" জয়েন্ট কমিশনারকে নির্দেশ দিয়ে কমিশনার শরাফের প্রশ্ন, ''হোয়্যার ইজ মিস্টার ওয়াদিয়া রাইট নাও?''
জানা গেল, নসলি এখন বিদেশে, ফিরবেন ক'দিন পরে।
খানিক স্বস্তির নিশ্বাস পড়ল দুই পুলিশকর্তার। যাক, অন্তত সামনের ক'টা দিন কোনও অঘটন ঘটবে না। এর মধ্যে জাল গুটিয়ে আনতে হবে।
পরবর্তী ঘটনাক্রম এগোয় রকেটগতিতে।
১০ জুলাই ১৯৮৯। নসলি ওয়াদিয়া বিদেশ সফর সেরে মুম্বই ফিরলেন। তাঁকে একান্তে প্রেক্ষাপট জানিয়ে ১২ জুলাই সিকিউরিটিতে মোতায়েন হল মুম্বই পুলিশের বিশেষ টিম। ১৭ জুলাই মুখ্যমন্ত্রী শরদ পাওয়ারের সঙ্গে জরুরি ও প্রাইভেট অ্যাপয়ন্টমেন্ট চাইলেন পুলিশ কমিশনার। ইনামদারকে পাশে নিয়ে ঘণ্টাখানেকের রুদ্ধদ্বার বৈঠকে কেসটির অস্বাভাবিক গুরুত্ব ও মাত্রা বিশদে ব্যাখ্যা করলেন সিএম'কে। একই সঙ্গে আশঙ্কা প্রকাশ করলেন, কোনও ভাবেই আম্বানিদের কাছে যেন খবরটা 'লিক' না হয়, কারণ সে ক্ষেত্রে ইনফর্মেশনে বিন্দুমাত্র সত্যতা যদি থেকেও থাকে, প্রমাণ করা কঠিন হয়ে যাবে। এবং এই যুক্তিতেই কমিশনারের আর্জি, স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী তথা রাজ্যের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শরদ পাওয়ার এবং হোম সেক্রেটারি এস রামমূর্তি ছাড়া সরকারের তৃতীয় কারও কানে যেন সংবাদটা না যায়। বিশেষত স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বিলাস সাওন্তের কানে তো নয়ই, কেননা তিনি আম্বানির খাস লোক, টপ এজেন্ট।
শরদ পাওয়ারের চেয়ে সেটা কে আর বেশি জানেন!
এ প্রসঙ্গে দেশের তৎকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এক ঝলক চোখ বোলানো যাক। সময়টা ১৯৮৯-এর মাঝামাঝি, কেন্দ্রে রাজীব গান্ধীর কংগ্রেস সরকারের অন্তিম লগ্ন। বফর্সের গোলায় ইন্দিরাতনয় ক্ষতবিক্ষত, ভিপি সিংহের গর্জন স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর, আমলা-রাজনীতিক কর্পোরেট হাউসের বিবিধ জটিল সমীকরণের প্যাঁচে শাসনযন্ত্র ঘেঁটে ঘ (বছরশেষে লোকসভা নির্বাচনে রাজীব সরকারের পতন ঘটবে, কুর্সি দখল করবে বিশ্বনাথপ্রতাপ সিংহের জনতা দল)। কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের মতো মহারাষ্ট্র কংগ্রেসও গোষ্ঠীকোন্দলে জেরবার, সরকারের বিরুদ্ধে গণ অসন্তোষ ঘনায়মান, পুরকর্মী হরতাল থেকে ট্রাক-ট্যাক্সি ধর্মঘট সামাল দিতে শরদ পাওয়ারের ঘুম ছুটেছে। তার উপর রয়েছে দিল্লির নেতাদের একাংশের রোষবহ্নির আঁচ।
ঠিক এমনই সঙ্কটকালে নসলি ওয়াদিয়া হত্যা-চক্রান্তের প্রাথমিক চমক কাটিয়ে পাওয়ার সুচিন্তিত পদক্ষেপ করেন। শাসক ও বিরোধীপক্ষের অন্দরে সমান প্রভাবশালী আম্বানি গোষ্ঠী গত কয়েক মাসে নানা ভাবে তাঁকে উত্ত্যক্ত করেছে, ফলে ওয়াদিয়ার সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা ক্রমবর্ধমান। শোধ তুলতে মুখ্যমন্ত্রী পুলিশকে 'গো অ্যাহেড' দিতেই পারতেন। তা না করে সুচতুর রাজনীতিক গোড়াতেই বল ঠেলে দিলেন দিল্লির কোর্টে। কেন?
কারণ পওয়ার ভাল জানেন, চির দিন কাহারও সমান নাহি যায়। আজ যে শত্রু, কাল সে মিত্র হতে কতক্ষণ? বিশেষত আম্বানিরা যেখানে সর্বঘটে কাঁঠালিকলা! খামোখা আমি আগ বাড়িয়ে দোষের ভাগী হতে যাব কী করতে? দিল্লি কী করে দেখি, তারপর ভাবব।
সিএমের নির্দেশে মহারাষ্ট্রের হোম সেক্রেটারি রামমূর্তি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রসচিবকে 'ক্ল্যাসিফায়েড' চিঠি পাঠালেন ২০ জুলাই। বিস্তারিত অবহিত করে চিঠিতে আর্জি, সিবিআই মুম্বই আসুক তদন্ত করতে। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বুটা সিংকে ব্যাপারটা জানানো হোক।
উল্লেখ্য, দিল্লির সরকারে আম্বানি-বিরোধীদের অন্যতম মুখের নাম বুটা সিং।
দিল্লি নিশ্চুপ। 'রাজ্য সরকারের কী করণীয়, প্লিজ বলুন।'-- ২৩ জুলাই ফের চিঠি দিয়ে জানতে চাইলেন রামমূর্তি। কোনও উত্তর নেই।
পাঁচ দিন অপেক্ষা করে পাওয়ারের গ্রিন সিগন্যাল কমিশনারকে-- অ্যারেস্ট কীর্তি আম্বানি।
কীর্তি তো মুম্বইয়ের বাইরে।
পুলিশ ওত পেতে রইল, টেলিফোনে আড়ি পাতা। এদিকে দিল্লিতে যে তলে তলে তোলপাড় চলছে, তার প্রমাণস্বরূপ সিবিআই ডিরেক্টর মোহন কাটরে আচমকা মুম্বইয়ে হাজির। নসলির ভিসা সংক্রান্ত এক মামলার শুনানিতে তিনি কেন মুম্বই হাইকোর্টে দেখা দিলেন? ওই মামলায় তো সিবিআইয়ের এককণা লেনাদেনা নেই!
যাঁরা বোঝার ঠিক বুঝেছেন। কাটরে হাওয়া মাপতে এসেছেন। আম্বানিদের 'একান্ত শুভানুধ্যায়ীদের' তালিকার ওঁর নাম যে উজ্বল! রিলায়েন্সের নামজাদা শেয়ারহোল্ডারও বটে!
অর্থাৎ, খবর ঠিকই লিক হয়ে গেছে।
যাবে না, এমন আশা অবশ্য পওয়ার করেননি। আম্বানি, ওয়াদিয়া, দু'তরফে ঘুঁটি সাজানোও শুরু। পরিস্থিতি ক্লাইম্যাক্সে পোঁছল ৩১ জুলাই। সন্ধ্যায় কীর্তি মুম্বই ফিরতেই ওঁর নরিম্যান পয়েন্টের অফিসে পুলিশি হানা, একই সঙ্গে টুইন টাওয়ার কমপ্লেক্সের ঝাঁ চকচকে বাসভবনে, যার দু'পা দূরে নসলি ওয়াদিয়ার সুদৃশ্য বিচ বাংলো। ভিন্ডি বাজারের ঘিঞ্জি গলির ডেরা থেকে পাকড়াও অর্জুন বাবারিয়া। আন্ডারওয়র্ল্ডের পাকা খবর, রেস্তোরাঁয় ব্যান্ডবাদক যুবকটি বিভিন্ন ক্রিমিন্যাল ও তাদের সম্ভাব্য 'কাস্টমারদের' মধ্যে যোগসূত্রের কাজ করে। পরিভাষায় ফিক্সার, যে কিনা কন্ট্রাক্টের দালালি খায়।
১ অগস্ট ১৯৮৯। বোম্বে ডাইং চেয়ারম্যান নসলি ওয়াদিয়াকে খুনের ছক কষার অভিযোগে রিলায়েন্সের জেনারেল ম্যানেজার কীর্তি আম্বানি ও 'সুপারির মেডিয়েটর' অর্জুন বাবারিয়াকে হেফাজতে নিল মুম্বই পুলিশ। বিষয়টি সম্পর্কে প্রথম প্রকাশ্যে ব্রিফ করল মিডিয়াকে।
অ্যাটম বোমার মতো বিস্ফোরিত হয়ে তা কাঁপিয়ে দিল তামাম দেশ। দুই টেক্সটাইল ব্যারনের রেষারেষির এই পরিণাম? এমনই দুশমনি যে, ব্যবসায়িক প্রতিদ্বন্দ্বীকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিতে হবে!
বিস্ময়ের অভিঘাতে সকলে থরোথরো। আমি তখন পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন ফাইনাল ইয়ার, হস্টেলে গোগ্রাসে খুঁটিয়ে পড়তাম বিভিন্ন কাগজের প্রতিবেদনগুলো। বাংলা কাগজে তেমন কভারেজ না থাকলেও ইংরেজি পত্রিকা, বিশেষত স্টেটসম্যান, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস ও হিন্দু ফলাও করে ছাপত, দিনের পর দিন। ঠিক এক বছর আগে ব্যাডমিন্টন তারকা সৈয়দ মোদীর হত্যাকাণ্ডের জেরে দেশ দেখেছে অপরাধী-রাজনীতিক আঁতাতের ক্লেদাক্ত রূপ। ওয়াদিয়া মার্ডার প্লট সামনে আনল অপরাধী-বণিক-রাজনীতিকের অশুভ নেক্সাসকে।
এবং সৈয়দ মোদী হত্যা-তদন্তের মতো এবারও চোখ কপালে তোলা সব তথ্য বেরিয়ে আসতে থাকে। যেমন?
মুম্বই পুলিশ দাবি করে, নিরন্তর জেরার মুখে কীর্তি-বাবারিয়া ভেঙে পড়েছেন, ষড়যন্ত্রের ঘাঁতঘোঁত পুলিশের মুঠোয়। জানা গিয়েছে, নসলি খুনের ষড়যন্ত্রের সূচনা ৮৮-র নভেম্বরে। একজন 'বিগ বিজনেসম্যান'কে খালাস করার বন্দোবস্ত করতে কীর্তি পঞ্চাশ লাখ টাকার কন্ট্রাক্ট দেন বাবারিয়াকে। এমনিতেও নামজাদা সুপারি কিলারেরা তখন বাজার নেই, উপরন্তু নিজের কমিশন বাড়ানোর তাগিদে বাবারিয়া 'ছোটখাটো' অ্যাসাসিনের সন্ধান করতে থাকে। মানে এমন কেউ, যাকে দিয়ে কম টাকায় কাজ হাসিল হবে। 'শানু' নামে একটা আনকোরা ছেলেকে সে কীর্তির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে জানায়, কাজটা ও-ই করবে। দর বাড়ানোর মতলবে শানুকে ছোটা শাকিলের প্রাক্তন গ্যাং মেম্বার হিসেবে পেশ করে। পুলিশের অভিযোগ, গত কয়েক মাসে বাবারিয়া-শানুর সঙ্গে কীর্তি একাধিকবার বৈঠক করেছেন দু'টি বিলাসবহুল হোটেলে, খুনের ছকও কষা হয়ে গিয়েছিল। কী ছক?
প্ল্যান ছিল, নসলি তাঁর প্রভাদেবীর বাংলো থেকে বেরোলে একটা গাড়ি দিয়ে তাঁর লিমুজিনের রাস্তা আটকানো হবে, তারপর গুলিতে গুলিতে ঝাঁঝরা। প্ল্যান বি-ও রেডি। সন্ধের পর নসলি তাঁর ব্যালার্ড পায়ারের অফিস থেকে বার হলেই গুলি। এতে বাড়তি সুবিধা, রাতের দিকে ওই তল্লাট একদম নির্জন থাকে, কাজ সেরে পালানো তুলনায় সহজ।
পুলিশের দাবি, প্ল্যান ইমপ্লিমেন্ট করার পথে চক্রীরা যথেষ্ট এগিয়েছিল। দু'টো রিভলভার জোগাড় হয়, আরও কিছু লোক ভাড়া করা হয় মোটা টাকায়। যেমন রিভলভার সংগ্রহ ও নসলির রাস্তা ব্লক করা গাড়ি চালানোর জন্য বাবারিয়ার মহল্লা থেকে ঘাতক টিমে নেওয়া হয়েছিল জনৈক ভার্মাকে, এ বাবদ তাকে পঞ্চাশ হাজার টাকা দেওয়া হয়। শানুর ব্যাকআপ হিসেবে আর একজন বন্দুকবাজ ভাড়া করা হয় দশ হাজারে। কন্ট্রাক্ট 'ফুলপ্রুফ' করতে বাবারিয়া তৃতীয় বন্দুকবাজের খোঁজ চালাচ্ছিল, যে কারণে অপারেশন পিছোতে থাকে। প্ল্যান 'এ' মাফিক অপারেশন হলে পালাবে কী ভাবে, তা নিয়েও দোলাচল ছিল।
সর্বোপরি, নসলির ঘনঘন বিদেশ সফর সব প্ল্যান ঘেঁটে দেয়।
তাই বারবার অপারেশনের দিনক্ষণ স্থির করেও বানচাল করতে হচ্ছিল। যে কারণে কীর্তি অধৈর্য হয়ে উঠছিলেন বলে পুলিশের দাবি। তদন্তকারীরা জানান, গ্রেফতারির আগে কীর্তি-বাবারিয়ার-শানুর একাধির ল্যান্ডফোন কথোপকথন তাঁরা রেকর্ড করেছেন। তাতে কীর্তিকে আক্ষেপ করতে শোনা গিয়েছে, ''খালাস করতে আর কত দেরি! 'বস'রা যে আমাকে তিষ্ঠোতে দিচ্ছে না!'
শেষমেশ 'অপারেশন নসলি ওয়াদিয়া'র দিন ঠিক হয়েছিল ২৪ জুলাই। তার আগেই পালে বাঘ, মানে পুলিশ পড়ল।
কিন্তু কীর্তির বস কারা? রিলায়েন্স?
জনমানসে একটাই প্রশ্ন ধূমায়িত, অনুচ্চারিত কৌতূহলে কর্পোরেট দুনিয়া টগবগিয়ে ফুটছে। মুখ খোলেন স্বয়ং ধীরুভাই আম্বানি। তাঁর দাবি, পুরোটা সাজানো। সাজিয়েছে সেই একই লোকজন, যারা আগেও আমাদের নামে এ ধরনের আষাঢ়ে গল্প ফেঁদেছে। বিশেষত রিলায়েন্স যখনই কোনও কোম্পানির বড় শেয়ার কিনতে যায়, তখনই এই সব গাঁজাখুরি গপ্পো বাজারে চাউড় করাটা ওদের অভ্যাসে দাঁড়িয়েছে। এবারও ব্যতিক্রম নয়।
প্রসঙ্গত, কয়েক সপ্তাহ বাদে এক নামজাদা নির্মাণ কোম্পানির ১২০ কোটি টাকার পাবলিক ইস্যু রিলায়েন্স কিনতে চলেছে, তখনকার বাজারদরের নিরিখে অবিশ্বাস্য পরিমাণ বিনিয়োগ। সেই সংবাদ কাদের গায়ে চিড়বিড়িয়ে জ্বলুনি ধরিয়েছে, ব্যবসায় পাল্লা টানতে না পেরে কারা রিলায়েন্সের বিরুদ্ধে বারবার মনগড়া অভিযোগ করছে, নামোল্লেখ না করেও ধীরুভাই পষ্টাপষ্টি জানিয়ে দিলেন।
এবং তাঁর ইঙ্গিত যে ওয়াদিয়া গ্রুপের দিকে, বুঝতে কারও অসুবিধে নেই। রিলায়েন্সের তরফে আরও কয়েকটা প্রশ্ন তোলা হল। যেমন, সম্পদ ও বিজনেসের নিরিখে ওয়াদিয়া রিলায়েন্সের ধারেকাছে আসে না। খামোখা আমরা ছুঁচো মেরে হাত গন্ধ করব কেন? আর করতে হলে বাবারিয়ার মতো হেঁজিপেঁজির দোর ধরব কেন? রিলায়েন্স যদি সত্যি কাউকে খালাস করতে চায়, টপমোস্ট প্রফেশনালকে কন্ট্রাক্ট দেবে, যারা এমনভাবে কাজ সারবে, কেউ টেরটি পাবে না। যত্ত সব ফালতু বকোয়াস!
নরিম্যান পয়েন্টে এক্সপ্রেস টাওয়ারের চেম্বারে রামনাথ গোয়েনকার পাশে বসে নসলি ওয়াদিয়াও স্ট্র্যাটেজি তৈরি করছেন। তাঁদের তরফে পাল্টা যুক্তি বাজারে আসতে দেরি হয়নি। ওয়াদিয়া শিবিরের বক্তব্য, ছিয়াশিতে এক্সপ্রেস গ্রুপ ও ভিপি সিংহের চাপে রিলায়েন্সের যে নাভিশ্বাস উঠেছিল, তার জন্য ওরা (পড়ুন ধীরুভাইয়ের দুই পুত্র- মুকেশ ও অনিল) নসলিকেই দায়ী ঠাউরায়। শোধ তোলার জন্য ওরা সর্বদা তক্কে তক্কে রয়েছে। উপরন্তু ওদের ভয়, কেন্দ্রে ভিপি সিংহের সরকার এলে এক্সপ্রেস গ্রুপের মদতে ওয়াদিয়ারা আম্বানিদের পিষে মারবে। তাই চিরতরে নসলি ওয়াদিয়ার মুখ বন্ধ করতে চাইছে, কারণ ওদের ধারণা, এক্সপ্রেস গোষ্ঠীর প্রাণভোমরা হল ওয়াাদিয়া গ্রুপ। তাছাড়া আম্বানিরা ওই নির্মাণ সংস্থার বিপুল শেয়ারের জন্য আবেদন করার আগেই খুনের ছক কষা শুরু হয়েছিল। আর হেঁজিপেঁজিকে সুপারি না দিয়ে উপায় কী? নামজাদা খুনিরা তো এখন বাজারেই নেই।
বাগযুদ্ধে কেস জমে পুরো ক্ষীর! কেন্দ্রীয় সরকার এখনও চুপ?
আজ্ঞে না। কীর্তি-বাবারিয়া গ্রেফতার হতেই কেন্দ্র নড়েচড়ে বসে। চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে দিল্লি বিজ্ঞপ্তি জারি করে জানায়, মহারাষ্ট্র সরকারের আর্জি মেনে কেসটা সিবিআই হাতে নিচ্ছে। ব্যুরোর দুঁদে অফিসারেরা পত্রপাঠ মুম্বই এসে যেন তেন প্রকারেণ দুই অভিযুক্তকে নিজেদের হেফাজতে নিতে মরিয়া চেষ্টা চালাতে থাকেন।
এলেনই যখন, এত দেরিতে কেন?
এখানেই কাহিনীর বিরাট ডাইমেনশন। বিগ কর্পোরেট হাউসের সঙ্গে পলিটিসিয়ানদের অম্লমধুর ইকোয়েশনের জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত নসলি মার্ডার প্লট কেস, যা বুঝিয়ে দেয় সরকারে কাজকর্মে 'বণিকের মানদণ্ডের' ভূমিকা কতটা গভীর ও সুদূরপ্রসারী। মহারাষ্ট্র হোম সেক্রেটারির প্রথম চিঠিতেই কার্যত দিল্লির দরবারে ধুন্ধুমার বেঁধে গিয়েছিল। আম্বানিপন্থীদের সঙ্গে আম্বানিবিরোধী লবির প্রবল টানাপড়েন। কংগ্রেস ও রাজীব সরকারের তালেবরেরা তখন স্পষ্টত দুই শিবিরে বিভক্ত-- প্রো আম্বানি ও অ্যান্টি আম্বানি। আম্বানি লবির প্রধান মুখ হলেন রাজীবের রাজনৈতিক উপদেষ্টা আর কে ধবন, প্রতিপত্তিতে এক নম্বর, যার আঙুলের ইশারা ছাড়া সংগঠন বা সরকারের বাগানে গাছগাছালির একটা পাতাও বাতাসে গা নাড়া়তে দু'বার ভাবে। ওঁর সঙ্গে আছেন অর্থমন্ত্রী এসবি চহ্বান, বিদেশমন্ত্রী পিভি নরসিমহা রাও, পিএমও'র প্রতিমন্ত্রী শীলা দীক্ষিত, ফিনান্স কমিশনের চেয়ারম্যান এনকেপি সালভে, বোম্বে কংগ্রেস প্রধান মুরলী দেওরা প্রমুখ। উল্টো দিকে অ্যন্টি আম্বানি ক্যাম্পে জ্বলজ্বলে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বুটা সিং, রেলমন্ত্রী মাধবরাও সিন্ধিয়া, পার্সোনেল মন্ত্রকের দায়িত্বপ্রাপ্ত পি চিদম্বরম এবং একগুচ্ছ কংগ্রেস এমপি। আমলামহলেও বিভাজন প্রকট।
এই পরিস্থিতে আম্বানিপন্থীরা অবিলম্বে সিবিআই পাঠাতে চাইলেও বিরোধীরা তীব্র আপত্তি তোলেন। যুক্তি দেন, ভোটের মুখে এমন পদক্ষেপ রাজীব সরকারকে খোলাখুলি আম্বানি সমর্থক হিসেবে দেগে দেবে, কারণ এটা সম্পূর্ণত রাজ্যের আইনশৃঙ্খলার বিষয়। মহারাষ্ট্র সরকারই তদন্ত করুক। এমনকী সব নজির ভেঙে অন্তত ষাট জন কংগ্রেস সাংসদ প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে এক স্মারকপত্রে সই করেন, যার আর্জি-- দলের ভাবমূর্তির স্বার্থে মামলা কোনও মতেই সিবিআইয়ের হাতে দেবেন না।
শেষ মুহূর্তে ধবনের হস্তক্ষেপে স্মারকলিপি পেশের উদ্যোগটা বাতিল হয়। না হলে দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে অভূতপূর্ব ঘটনা হিসেবে তা চিহ্নিত হয়ে থাকত।
তবে শেষে আম্বানি লবিই জেতে। এমনটা যে হতে পারে, ওয়াদিয়ারা ধরেই রেখেছিল। সেই মতো তাদের তরফে আইনি লড়াইয়ের প্রস্তুতিও নেওয়া হয়, যার পুরোভাগে আর কেউ নন, প্রবাদপ্রতিম আইনজীবী রাম জেঠমালানি স্বয়ং। বোম্বে হাইকোর্টে আবেদন পেশ হয়, কোর্ট সিবিআই তদন্তে স্থগিতাদেশ দেয়।
মাথা খারাপ করা এক বেনজির আইনি সংঘাতের সেই সূচনা।
ধীরুভাইয়ের বড় ছেলে মুকেশ আম্বানি দিল্লি উড়ে গেলেন। নসলি মামলায় সিবিআই তদন্তের অনুমতি চেয়ে ৯ অগস্ট সুপ্রিম কোর্টে নিঃশব্দে রিট পিটিশন দাখিল হল। মজার কথা, আবেদনটি রুজু করলেন বিজেপি জাতীয় কর্মসমিতির এক সদস্য। বিরোধী শিবিরেও যে আম্বানিদের শিকড় যারপরনাই পোক্ত! আবেদন পেশের এক ঘণ্টাও কাটল না, সুপ্রিম কোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ শুনানি করে আর্জি মঞ্জুরও করে দিল!
গোটাটা হয়ে গেল চুপিসারে, আলোর গতিতে। কেউ জানতেই পারল না!
কিন্তু তালেগোলে এক জন জেনে ফেলেছিলেন। তার দৌলতেই প্ল্যান চৌপাট হয়ে যায়। তিনি এক্সপ্রেস গ্রুপের সঙ্গে যুক্ত এক জুনিয়র অ্যাডভোকেট। নেহাত ঘুরতে ঘুরতে সেদিন ওই এজলাসে পৌঁছে রায় শোনেন। সঙ্গে সঙ্গে দৌড়। গাড়ি হাঁকিয়ে সোজা পার্লামেন্ট হাউসে। রাজ্যসভার অধিবেশনে উপস্থিত জেঠমালানির কানে সংবাদটা ফেলামাত্র বাঘা কৌঁসুলি ছুটে বেরিয়ে গাড়িতে সওয়ার। হু হু গাড়ি ছোটে। সুপ্রিম কোর্টে পৌঁছে সোজা এজলাসে ঢুকে বাঘের মতো গর্জন করে ওঠেন, ''ধর্মাবতার, এখানে তো বিচারের নামে একটা জালিয়াতি হয়ে গেল!
( He jumped into the courtroom and roared like a tiger, ''Me Lord, A fraud had been committed on the judiciary! )
নির্দেশ পুনর্বিবেচনার জন্য জোরালো আর্জি জানান। ডিভিশন বেঞ্চ আগের রায় রদ করে নতুন নির্দেশ জারি করে। ২১ অগস্ট পর্যন্ত বোম্বে পুলিশ বা সিবিআই, কেউ নসলি মামলার তদন্ত করতে পারবে না।
সুপ্রিম কোর্ট বা ভারতের কোনও আদালত এমন নাটকীয়তার সাক্ষী থেকেছে কি? আমার অন্তত জানা নেই।
তবে সিবিআই আটকানো যায়নি। পরে কেন্দ্রীয় ব্যুরোই তদন্ত চালায়। চার্জশিট দেয়। নসলি ওয়াদিয়া নিজে কোর্টে বয়ান দেন। সপ্তাহের পর সপ্তাহ, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর মামলা গড়ায়। ইতিমধ্যে রিলায়েন্স কর্তৃপক্ষ ও নসলি ওয়াদিয়া একাধিকবার নিজেদের ব্যক্তিগত বৈরিতার কথা অস্বীকার করেন। ঘটনাটা ধীরে ধীরে বিস্মৃতির অন্তরালে তলিয়ে যায়।
রুদ্ধ স্মৃতিভাণ্ডারের আগল ভেঙে আচমকাই গত সপ্তাহে, মানে সাড়ে তিন দশক বাদে বিষয়টা ফের ভেসে উঠল, যবনিকাপাত হল নসলি ওয়াদিয়া হত্যা চক্রান্ত মামলায়। অভিযুক্তরা জামিনে আগেই ছাড়া পেয়ে গিয়েছিলেন। ২০১৭ সালে কীর্তি আম্বানির মৃত্যু হয়, ওঁর অপরাধ প্রমাণিত হলে মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত হতে পারত। বাকিদের বেকসুর খালাস করে মুম্বইয়ের সিবিআই আদালত জানিয়েছে, অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে গ্রহণযোগ্য কোনও প্রমাণ নেই। পঁয়ত্রিশ বছরের পুরনো যে ক্যাসেটে তাদের কল রেকর্ড ধরা রয়েছে, ধুলোর আস্তরণ পড়ে তা অকেজো, কিছু শোনাই যাচ্ছে না। টেলিফোন এক্সচেঞ্জের কোনও নথিও নেই। যে দুই লাক্সারি হোটেলে বসে অভিযুক্তরা নসলি খুনের ছক কষেছিল বলে পুলিশের দাবি, সেখানকারও এমন কোনও প্রত্যক্ষদর্শী মেলেনি, যিনি ওদের একসঙ্গে বসে থাকতে দেখেছেন।
৯৭ পাতার রায়ে বিশেষ আদালতের মোদ্দা কথা, উপযুক্ত সাক্ষ্যপ্রমাণের অভাবেই অভিযুক্তদের বেকসুর ঘোষণা করে মামলা বন্ধ করতে হচ্ছে।
হয়তো গোটাটাই রজ্জুতে সর্পভ্রম। হয়তো নয়। কিন্তু নসলি ওয়াদিয়া হত্যা ষড়যন্ত্রের অভিযোগের হাত ধরে রাজনীতি, আইন, কর্পোরেট দুনিয়ার বিচিত্র সব রূপ সামনে এসেছিল। অনেকের মতে, ওয়াদিয়া-আম্বানি দ্বৈরথের ছায়া পড়ে ৮৯ -এর সাধারণ নির্বাচনে, কার্যত তা ভিপি-রাজীব লড়াইয়েরই প্রিল্যুড ছিল।
সময়টাকে একটু ফিরে দেখা গেল। তা-ই বা কম কী!
সূত্র: ইন্টারনেট ও নিজস্ব স্মৃতি