মিউনিখের গেস্টাপো কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পর সৌমেন্দ্রনাথ, ঠাকুর প্যারিসে যান, যেখানে তিনি ফ্যাসিবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন। ১৯৩৩ সালের সেপ্টেম্বরে, প্যারিসে একটি বিশাল ফ্যাসিবাদবিরোধী সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে সুপরিচিত ফরাসি নেতারা, টরেস এবং ডি মোরো-গাইফেরি ও অন্যান্য নেতারা কমিউনিস্টদের দাবিয়ে দেয়ার ভূমিকা হিসেবে তাদের বিরুদ্ধে গোয়ারিং, গোয়েবলস এবং অন্যান্য নাৎসি নেতারা অজুহাত হিসেবে রাইখকস্ট্যাগে আগুন দেওয়ার অভিযোগ এনেছিলেন। ঠাকুরও সভায় বক্তব্য রাখেন। বক্তৃতা এখানে আবার দেওয়া হল। [এই বক্তৃতাটি সৌমেন্দ্রনাথের 'রাইখস্ট্যাগ ফায়ার' রচনা হিসেবে পরিচিত। আর্কাইভ থেকে বঙ্গানুবাদ আমার]
আজকের দিনে দাঁড়িয়ে এত পুরোনো একটা বক্তৃতা কতটা প্রাসঙ্গিক সেটা সুধী পাঠক লক্ষ করবেন। উনি বলছেন, "কমরেডস, আমরা আজ এখানে মানব ইতিহাসের একটি সুনির্দিষ্ট কালে মিলিত হচ্ছি। আমাদের এই সময়ে মানবজাতিকে এমন দুটি তীব্রভাবে পৃথক, বিরোধী গোষ্ঠীতে বিভক্ত করা হয়েছে যা মানবজাতির ইতিহাসে এর আগে কখনোই করা হয়নি। অগ্রগতির অদম্য শক্তিরা কাজ করছে এবং একই সময়ে মানুষের ইতিহাসে এখন পর্যন্ত পরিচিত সবচেয়ে নৃশংস এবং অন্ধকারাচ্ছন্ন শক্তিরাও রাগী জন্তুর মতো চারদিক থেকে গর্জন করছে। প্রতিক্রিয়া ব্যাপকমাত্রায় সর্বত্র বিদ্যমান, এবং এর জান্তব গর্জন সারা বিশ্বে শোনা যাচ্ছে। কিন্তু সন্ত্রাস এবং উস্কানি ছাড়া এই প্রতিক্রিয়ার পক্ষে নিজেকে টিঁকিয়ে রাখার কোন সম্ভাবনা নেই। বিশ্বের অর্থনৈতিক শক্তিগুলো প্রতিক্রিয়ার বিরুদ্ধে। অতএব, এটি তার অস্তিত্বের জন্য শুধুমাত্র সন্ত্রাস এবং উস্কানির উপর নির্ভরশীল। কিন্তু কোথাও হিটলারাইট জার্মানির মত প্রতিক্রিয়ার বিশুদ্ধ ও সহজ সন্ত্রাসবাদী এবং উস্কানিমূলক চরিত্র এতটা স্পষ্ট হয়নি।"
সন্ত্রাস আর উস্কানি ছাড়া ফ্যাসিবাদ টিঁকে থাকতে পারে না এটা বোঝাতে গিয়ে সৌমেন্দ্রনাথ নিজের কারাবাসের কথা তুলে এনেছেন। সুধী পাঠকরা খেয়াল করে দেখবেন অধুনা ভারতে প্রচলিত ভাষ্য 'আর্বান নকশাল' আর কারাগার বন্দী স্ট্যান স্বামীদের সাথে সেই সময়ের এক জার্মানিতে এক বাঙালি ইন্টেলেকচুয়াল এর কি মিল। উনি বলছেন, "হিটলারের ফ্যাসিবাদী একনায়কত্বটি সন্ত্রাস এবং শুধুমাত্র সন্ত্রাসের দ্বারা তার অস্তিত্ব অব্যাহত রেখেছে। মরফিনিস্ট গোয়ারিং এবং সেই অধঃপতিত জন্তু গোয়েবলস শুধুমাত্র উস্কানি তৈরির জন্য রাইখস্ট্যাগ পোড়ানোর আয়োজন করেছিল। বার্লিনে উড়োজাহাজ থেকে কমিউনিস্ট প্রচারপত্র ছড়িয়ে দেওয়ার গোয়ারিংয়ের "আবিষ্কার" আসলে এই ওই অপকর্মার উস্কানি ছাড়া অন্য কিছু নয়।"
"হিটলারকে হত্যার পরিকল্পনা করার বিদ্বেষমূলক এবং মিথ্যা অভিযোগে আমাকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। জার্মান পুলিশের এটা খুব ভালভাবেই জানা ছিল যে বার্লিনে আমার সব কাজকর্ম জানত যে আমার রাজনৈতিক মতবাদ সম্পূর্ণভাবে ব্যক্তিকেন্দ্রিক সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে। কিন্তু আমার গ্রেফতারের কারণটা সেই একই রকম যেমনটি ছিল রাইখস্ট্যাগ অগ্নিকাণ্ডের ক্ষেত্রে অথবা বার্লিনে বিমান হামলার ক্ষেত্রে। এর উদ্দেশ্য ছিল উস্কানি। নাৎসি সংবাদপত্র আমার গ্রেফতারের খবর প্রকাশ করার সময়, উস্কানিমূলক চরিত্রের সাথে বেশ স্পষ্টভাবে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। তারা আমাকে হারকিউলিয়ান চেহারার একজন ব্যক্তি হিসেবে বর্ণনা করে এবং বলেছিল যে আমি যে গাড়িতে করে ঘোরাঘুরি করছিলাম সেখানে অনেক সন্দেহজনক জিনিসপত্র পাওয়া গিয়েছিল, যখন বাস্তবে কিছুই পাওয়া যায়নি, কারণ সেখানে কিছুই ছিল না। নাৎসিদের দ্বারা নির্মিত এই দীর্ঘ ধারাবাহিক প্ররোচনার একটি উদ্দেশ্য রয়েছে।"
ফ্যাসিবাদ যে আসলে পুঁজিবাদের ব্যর্থতারই একটা বহিঃপ্রকাশ, অন্য কিছু নয়, সেটা দেখাতে গিয়ে উনি বলছেন, "হিটলারিজম ইতোমধ্যেই জার্মান জনগণের অবস্থার অবনতি ঘটিয়েছে এবং ফ্যাসিবাদী শাসনের অধীনে জার্মান জনতার অবস্থা খারাপ এবং আরও খারাপ হবে বলে নিশ্চিত। ফ্যাসিবাদী সরকার লক্ষ লক্ষ ক্ষুধার্ত শ্রমিকদের রুটি দিতে যত বেশি ব্যর্থ হবে, বেকারত্বের সমস্যা সমাধানে যতই ব্যর্থ হবে, ততই উস্কানির পথ অবলম্বন করবে।অর্থনৈতিক কর্মসূচির সম্পূর্ণ অভাব এবং অর্থনৈতিক সংকট সমাধানে তার সম্পূর্ণ ব্যর্থতা ঢাকার জন্য এরা একের পর এক উস্কানিমূলক পরিকল্পনার জন্ম দেবে।"
এবারে উনি মুখোশ খুলছেন একটি বিশেষ সম্প্রদায়কে ঘিরে নাৎসি অপবাদ আর অপপ্রচারের মুখোশ।সেদিনের নাৎসি কৌশলের সাথে আজকের ভারতকে মিলিয়ে দেখুন সুধী পাঠক। কেন একটা বিশেষ সম্প্রদায়কে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে সকল দুঃখ দুর্দশার জন্য তাদের দায়ী না করতে পারলে ফ্যাসিবাদ বাঁচে না, তা বোঝাতে গিয়ে উনি বলছেন, "জার্মানিতে, নাৎসিদের ইহুদি-বিরোধীতা দুটি উদ্দেশ্য সাধন করছে। একটি হলো শ্রমিক শ্রেণীর শ্রেণীসংগ্রামকে জাতিগত সংগ্রামের অন্ধ গলিতে ঠেলে সরিয়ে বিপথগামী করা; দ্বিতীয়টি হল জার্মান জনগণের অর্থনৈতিক দুর্দশার জন্য ইহুদিদের দায়ী করে নাৎসি শাসনের ব্যর্থতা ঢাকা দেওয়া। নাৎসিদের এই ইহুদি-বিরোধী জাতিগত নরখাদকবাদকে বিশ্বের প্রতিটি সুসভ্য ব্যক্তি দ্বারা তিরষ্কার ও নিন্দা করা উচিত।"
নির্বিচারে জেলবন্দী বা ডিটেনশন ক্যাম্পিবন্দী মানুষজনের দুঃখদুর্দশা নিয়ে আমরা তেমন সরব হই না কারণ আমাদের বেশিরভাগেরই প্রত্যক্ষ কোনও অভিজ্ঞতা নেই, বীভৎসতা নিয়ে কোনও ধারণাই নেই। আর বৃহৎ পুঁজির কাছে বিকিয়ে যাওয়া সংবাদমাধ্যমও আমাদের পুরো খবর দেয় না, কোনোদিন দেয় নি, সেদিনের সেই নাৎসি জার্মানিতেও নয়। উনি বলছেন, "নাৎসি অপরাধী নেতারা বিদেশি প্রচারযন্ত্রের 'জান্তব হাহাকার' নিয়ে চিৎকার করে, কিন্তু নাৎসি সন্ত্রাসের শিকার, যাদের সাথে আমি কারাগারে ছিলাম, তারা আমাকে তাদের শরীরে নির্মম মারধরের চিহ্ন দেখিয়েছে এবং আমার কাছে নাৎসিদের নির্মমতার চমকপ্রদ কাহিনী বর্ণনা করেছে। আমি নিজে যা দেখেছি এবং যা শুনেছি তা সংবাদপত্রের মাধ্যমে জানতে পারা বর্বরতার সমস্ত বিবরণকে ছাপিয়ে যায়।"
ফ্যাসিবাদের বিপ্রতীপে বুর্জোয়া লিবারালদের তথাকথিত সংগ্রামী ভূমিকা নিয়ে কিছু কিছু বামপন্থীদেরর মনে সেই সময়েও বেশ ইলিউসন ছিল। কিন্ত মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদের এই মেধাবী ছাত্রের মনে সংশয় ছিল না। তিনি বলছেন, "কমরেডস, আমাকে আপনাদের সতর্ক করতে দিন যে সাম্রাজ্যবাদী সরকার সম্পর্কে আপনারা মনে কোন বিভ্রম রাখবেন না। আপনি যদি মনে করেন যে এই সরকারগুলি জার্মানিতে নৃশংস নাৎসি শাসনের অবসান ঘটানোর জন্য সত্যিই কিছু করবে, তাহলে আপনি সম্পূর্ণ ভুল করছেন। তারা কিছুই করবে না। ইতিমধ্যে সারা বিশ্বের বুর্জোয়া প্রেস জার্মানিতে নাৎসি সন্ত্রাসের প্রতি উদাসীন হয়ে পড়েছে। তাদের কাছ থেকে কিছু আশা করবেন না।"
বুর্জোয়াদের প্রগতিশীল ভূমিকার ওপর ভরসা করে তাদের সাথে জোট টোট নয়, শ্রমিকশ্রেণীকে তার নিজের পায়ে দাঁড়াতে হয়। তাঁর একমাত্র নির্ভরযোগ্য মিত্র হল অন্যদেশের শ্রমিক শ্রেণী। সর্বহারার আন্তর্জাতিকতাবাদ এটা বোঝাতে গিয়ে উনি বলছেন, "দীর্ঘ বক্তৃতা করার সময় শেষ। ক্রিয়াকর্মের সময় এসেছে, বিপ্লবী ক্রিয়াকর্মের সময়। মনে রাখবেন, কমরেডস, যে শৃঙ্খলটি জার্মানিতে আমাদের কমরেডদের আবদ্ধ করে, তার অন্য প্রান্তের সাথে, আমাদেরকে বিশ্বের সমস্ত দেশে, এবং জার্মানিতে যে কারাগারেগুলিতে তারা বসে আছে তা আমাদের চারপাশে অদৃশ্যভাবে বিদ্যমান। আসুন আমরা সকলেই এটি মনে রাখি এবং সংগ্রাম চালিয়ে যাই যতক্ষণ না আমরা কেবল জার্মানিতেই নয়, সারা বিশ্বেই প্রতিক্রিয়াকে ধ্বংস করতে পারবো।"
ফ্যাসিবাদীরা গোটা কয়েক দেশে শাসন ক্ষমতাচ্যূত হলেও ফ্যাসিবাদ কিন্তু পরাস্ত হয় নি। লেনিনের রাশিয়া থেকে থরেজ এর ফ্রান্স - ইউরোপ থেকে আমেরিকা - এশিয়ার নানান দেশ, সর্বত্র অতি দক্ষিণপন্থীরা ঘুরে ফিরে ফিরে আসছে। আজকের ভারতে এই সময়ে দাঁড়িয়ে তাই একবার ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলনের দিশা খুঁজতে গিয়ে আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন বাঙালি বিপ্লবী ও মার্ক্সবাদী লেনিনবাদী নেতা সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবন ও জীবনীকে ভুলে গেলে চলবে না।
আজ তাঁর জন্মদিন। লাল সেলাম কমরেড।