রবিবার, ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৮

নবাবের বাঘ শিকার ~ দ্বৈপায়ন ঘোষ

নবাব সাহেবকে ডাকা হয়েছে বাঘ মারতে। মানুষ খুব রেগে গেছে। এদেশে, বিদেশে সই সাবুদের হিড়িক উঠেছে, আবার তা সময়ের নিয়মে কমেও গেছে। ফেসবুকেরর দৌলতে এক শ্রেণীর মরসুমি সংরক্ষণ-পন্থী তৈরি হয়েছে, যাদের সময় সময় দাবী পায়। আবার দাবী জানানোর সাথে সাথে সেই দাবীর চাপ কমতে কমতে দাবী বন্ধ হয়ে যায়। তারপর নতুন দিন, নতুন দাবী পাওয়া। আগের দিনের দাবী ফ্ল্যাশের জলে ধুয়ে সারা। এই যেমন বছর তিনেক হবে, জোর দাবী পেল উস্তাদ (T-24) নিয়ে। হ্যাশ ট্যাগ আন্দোলন, #Free_Ustad, #Boycott_Ranthambore ইত্যাদি। উস্তাদ আজও উদয়পুরের খাঁচায় আর রণথম্ভোরের দুর্গের সামনে পুরনো দাবী ধুয়ে জনগণ ক্যামেরা হাতে আগের মতই। নবাব সাহেব নিয়েও একই রকম হতে চলেছে বিষয়টা। এখনই দাবীর বেগ কমতে শুরু করেছে, তাই এই বেলা কিছু কথা বলে রাখি, কদিন পরে আর এই কথা গুলর relevance থাকবেনা।
কে এই নবাব সাহেব, আর মানুষ তার উপর রেগেই বা গেল কেন? মহারাষ্ট্রে এক বাঘ মানুষ মারছে। দুবছরে ১৩ জন মানুষকে মেরে খেয়েছে এই জংলী বাঘ (T-11)। কি আর করা যাবে? জঙ্গল কেটে বাঘের ঘড়ে মানুষ ঢুকছে, বাঘে-মানুষে টানাটানি তো হবেই। টানাটানির জোর ইদানীং যা বেড়েছে, দড়ি ছিঁড়ে যাওয়ার যোগার। তাই অবিলম্বে বাঘ ও মানুষকে দুরে সরাতে হবে। Football মাঠে ঝগড়া বাধলে যেমন refereeরা করে। মহারাষ্ট্রের PCCF লোক ডাকলেন। মধ্যপ্রদেশ থেকে পশু চিকিৎসকরা এলেন, আর এলেন নবাব সাহেব। নবাব সাফাত আলী খান, বাড়ি হায়দ্রাবাদ, একজন পেশাদার শিকারি। বছর দুই আগে বিহারে তিন দিনে ২৫০ নীলগাই খুন করা কীর্তিমানদের একজন এই নবাব। তার কীর্তি তাতেই সীমিত নয়। বেআইনি অস্ত্রের কারবারে ধরা পরেছিলেন নব্বইয়ের দশকের গোঁড়ায়। ২০০৫ এ আবার ধরা পরেন বেআইনি shooting expedition এর দায়ে। অস্ত্র ও বণ্যপ্রাণের বেআইনি ব্যবসার নবাবের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি তাঁর private property তে high profile client দের trophy hunting এর সুযোগ করে দেন। দুবছর আগে হিমাচল প্রদেশে এক মানুষখেকো বাঘ শিকারে নিযুক্ত হয়ে দুটো নিরপরাধ চিতাবাঘ মেরে নিজের trophy cabinate সমৃদ্ধ করেছেন এই নবাব। বার বার ওঠা অভিযোগের মধ্যে আছে নবাবের কুখ্যাত trophy hunter হওয়ারই ইঙ্গিত। এহেন কুখ্যাত শিকারিকে তবু বার বার ডেকে আনে আমাদের রাষ্ট্র ও তার ব্যবস্থা, কখনও আমলাতন্ত্র আবার কখনও বিহারের JD(U) বিধায়ক। আমরা প্রতিবাদ করি দুদিন, আবার সব ভুলে যাই।
ছবি সংগৃহীত...

প্রশ্ন ~ অরুণাচল দত্তচৌধুরী


আর কার কার কাছে মাথা নীচু করতে হবে বলো
তালিকা তৈরি হোক এক ... দুই ... তিন ... চার ... পাঁচ ...
কোন মৃতদেহ দেখে, না দেখার চারু ভান করে
সযত্নে পালাতে হবে। দোষনীয় কাদের ছোঁয়াচ!

কোন মন্ত্র উচ্চারণ নিষিদ্ধ  ... থাকব নীরবে
তোমার নির্দেশ পেলে ঠিক কোন গান গাইতে হবে।
বলো হে সমস্ত বলো, মুঠোভরা আছে কত ভয়?
বর্তমান জেনে নিক ভবিষ্যৎ কত অনিশ্চয়! 

মানচিত্রে এঁকে দাও এ স্বদেশ কতটা প্রবাস।
তবে না শাসক তুমি। তবেই না আমি ক্রীতদাস!

একটাই "কিন্তু" আছে এই গল্পে, সেটা তুমি জানো
তোমার এই রাজ্যপাট, ক্ষমতায় সাজানো গোছানো
সমস্ত অর্থহীন, যদি আমি এ'খানে না থাকি ...

গণতন্ত্র বলে দাও, আর কত খাজনা দেওয়া বাকি?

শনিবার, ২২ সেপ্টেম্বর, ২০১৮

মাঝেরহাট ব্রিজ ও নীল-সাদা ধ্বংসস্তূপ ~ কাজল মল্লিক



সম্প্রতি মাঝেরহাট ব্রিজের ভেঙে পড়া বাস্তবের ট্র্যাজেডির পাশাপাশি গুরুত্ত্বপূর্ণ প্রতীকী মূল্য বহন করে | কয়েক বছর ধরে যে একের পর এক সেতু ও উড়ালপুল ভেঙে পড়ছে, এবং ব্রিজের তলা দিয়ে বা ওপর দিয়ে যাওয়ার সময় শহরবাসীর যে হঠাৎ করে সেসব কথা মনে পরে যাচ্ছে ও সে প্রযুক্তির কিছু না বুঝেও অসহায়ভাবে ব্রিজের শরীরের দিকে তাকাচ্ছে এ যাত্রা বেঁচে যাবে কিনা বোঝার জন্য এই ব্যাপারটা এই সময়ের একটি যুগচিহ্ন মাত্র, একটি শক্তিশালী যুগচিহ্ন | 

বস্তুতঃ, রাজ্যের বর্তমান শাসনব্যবস্থায় প্রায় সবকিছুই ভেঙে পড়েছে | অন্য সবকিছু ভেঙে পড়ার দৃশ্য যদিও ব্রিজের মতো অতটা নাটকীয় ও ট্র্যাজেডি অতটা অকস্মাৎ ও তাৎক্ষণিক নয়, সেসব ভেঙে পড়া অনেক ক্ষেত্রেই উপড়ে আনার চেষ্টা করছে আরো অনেক গভীর শিকড়, তাদের অভিঘাত আরো অনেক গভীরে নিহিত |

এই সরকার আসার পরে প্রথমেই যেটা ভেঙে পড়েছে সেটা গণতন্ত্র | গণতন্ত্র শব্দটা বড়, তাই একটু ভেঙে বোঝা দরকার | একদিকে গেছে সরকার ও তার প্রধানকে প্রশ্ন করার অধিকার | খবরে আসা কিছু উদাহরণ সবারই মনে আছে, ডাক্তার শ্যামাপদ গড়াই দিয়ে শুরু, তারপর সারের দাম বাড়ছে কেন জিগেস করে কৃষক শিলাদিত্য, পার্ক স্ট্রিটকাণ্ডে কিছু একটা অপরাধ হয়েছে বলে মনে হয় শুধু এইটুকু বলার জন্য পুলিশ অফিসার দময়ন্তী সেন, রাস্তাঘাটে নিরাপত্তাহীনতা নিয়ে প্রশ্ন করে প্রেসিডেন্সির ওই ছাত্রী, ডেঙ্গু-কে অজানা জ্বর লিখতে না চেয়ে ডাক্তার অরুণাচল দত্তচৌধুরী, ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি | এছাড়া খবরের বাইরে থাকা অসংখ্য ঘটনা ঘটে চলেছে প্রতিনিয়ত যেখানে বিরোধী রাজনীতি করার "অপরাধে" হুমকি প্রলোভন আক্রমণ ও মিথ্যা মামলার সামনে পড়তে হচ্ছে অসংখ্য রাজ্যবাসীকে |

গণতন্ত্র ভেঙে পড়ার আরেকটি সহজবোধ্য দিক হচ্ছে নির্বাচন উঠে যাওয়া | কোথাও কোথাও সরাসরি, যেমন ইস্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় অফিসের বিভিন্ন কমিটি ইত্যাদি | নির্বাচন উঠিয়ে দাও বা অনির্দিষ্টকালের জন্য পিছিয়ে দাও আর ততদিন দলীয় লুটের রাজত্ব বজায় রাখো | আর বড় নির্বাচনগুলো, বিধানসভা পৌরসভা পঞ্চায়েত, যেগুলো আক্ষরিকভাবে উঠিয়ে দেওয়া মুশকিল, সেগুলো কার্যত উঠিয়ে দাও | প্রথমে ভয় দেখাও যাতে লোকে বিরোধীদলের প্রার্থী হতে না চায়, তাতে যাদের বাগে আনা যাবেনা তাদের দলীয় কর্মী তথা গুন্ডা দিয়ে মনোনয়ন জমা দিতে বাধা দাও (পুলিশ ঠুঁটো জগন্নাথ, সুতরাং কিছু বলবে না বা গুন্ডাদেরই সাহায্য করবে), তাতেও না হলে ভয় দেখিয়ে মনোনয়ন প্রত্যাহার করাও | এরপর তো নির্বাচনের দিন তাণ্ডব আছেই - হাতে বালা গলায় মালা কোমরে বন্দুক মুখে শাসানি নিয়ে নেতা থেকে ক্যাডার সবাই নেমে পড়বে | আর যাদের নামার কথা অর্থাৎ পুলিশ তাদের দেখা যাবেনা! এরপর নির্বাচন কমিশনকে নালিশ জানালে তারা সাকুল্যে আড়াইখানা বুথে পুনর্নির্বাচন করবে যেগুলোয় আবার সেরকম গোলমাল হয়নি! আর যেহেতু বড় দেশ, তাই এই সবকিছুর পরও কতিপয় বিরোধী প্রার্থী জিতবে | তাদের জন্য শেষ অস্ত্রটি ছাড়া হবে - যারা এতো বাধাবিপত্তি পেরিয়ে ঝুঁকি নিয়ে এই স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে ভোটে জিতলো, কোনো এক আশ্চর্য কারণে তারা ভোটের দু-চারদিন পরেই "উন্নয়নে" মুগ্ধ হয়ে দল পাল্টে তৃণমূলে যোগ দেবে !

দ্বিতীয় যেটা এই সরকারের আমলে উঠে গেছে সেটা প্রশাসন | আগের অংশেই পরিষ্কার, ভোটের সময় বা অন্য যেকোনো সময়, তৃণমূলের গুন্ডারা যাই করুক, পুলিশ কিছু বলবেনা, এটাই দস্তুর | অন্যান্য "স্বাধীন" কমিশন ফমিশন যা আছে - নির্বাচন মানবাধিকার মহিলা ইত্যাদি - যাদের আদতে সরকার বেআইনি বেপরোয়া কিছু করছে কিনা এটাই দেখার কাজ, সেখানে সব পেটোয়া লোক বসানো আছে, তারা সব দেখেশুনে বলবে কিছু হয়নি |

এরপর যেটা ভেঙে পড়েছে সেটার গুরুত্ত্ব আরও অনেক ব্যাপক, শিকড় অনেক গভীরে | সেটা মূল্যবোধ | আমাদের সমাজে আর যাই হোক কিছু সাধারণ মূল্যবোধ টিকে ছিল, যেমন চুরি করা খারাপ, লোক ঠকানো খারাপ, মিথ্যে কথা বলা খারাপ ইত্যাদি | তৃণমূলের কল্যাণে এখন সেসব উঠে গেছে | তাই ক্যামেরার সামনে ঘুষ নিতে গিয়ে ধরা পরেও নেতারা – ডাক্তার অধ্যাপক থেকে ডকের মাফিয়া – হাসতে হাসতে ঘুরে বেড়াচ্ছে | প্রথমে বললো ভিডিও জাল, তারপর সেটা পরীক্ষা করে ঠিক প্রমাণ হওয়ায় বললো টাকা নিয়েছি ঠিকই, কিন্তু ও অনুদান, তারপর কিছু বলাও ছেড়ে দিলো, কারণ এই জমানায় ওসবে কিছু এসে যায়না | সারদা রোজ ভ্যালির টাকা কোথায় গেলো সে তদন্ত তো চলছে চলবে, পুলিশ প্রমাণ নষ্ট করতে সাহায্য করবে, বিজেপি নিজের স্বার্থে তৃণমূলকে হাতে রাখতে তদন্ত শেষ করতে দেবেনা, আর তার মধ্যে প্রান্তিক সর্বস্বান্ত মানুষের মিছিল বাষ্প হয়ে মিলিয়ে যাবে | আর "ইস্ট জর্জিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের" "ডক্টরেট"-এর হাত ধরে যে যাত্রার শুরু, সেখানে প্রতি পদে মিথ্যা বলাটাকে তো আর কোনো অন্যায় বলা যায়না | চুরি করা, লোক ঠকানো, মিথ্যে বলা এসব যে আগে ছিল না তা নয়, কিন্তু অপরাধীরা আগে অন্তত ধরা পড়লে বুক ফুলিয়ে ঘুরতো না, লজ্জায় মুখে অন্তত একটা কাপড় ঢাকা দিতো, এখন এই সমস্ত অপরাধীরাই – পাড়ার গুন্ডা চোর ডাকাত – ক্ষমতায়, সেই কাপড়টা উঠে গেছে, কারণ সাধারণ মূল্যবোধ ভেঙে গেছে | এই মূল্যবোধ ভেঙে যাওয়ার আরও অনেক দিক আছে, কয়েকটা কিঞ্চিৎ সূক্ষ্ম, যেমন নির্লজ্জ আত্মপ্রচার, ইত্যাদি | দিকে দিকে অনুপ্রেরণার হোর্ডিং আর ছবি, এমনকি রবীন্দ্র সদন  নন্দনের সামনেও বিশাল ফলক, নবরূপে চত্বরের উন্মোচন করলেন মুখ্যমন্ত্রী, ইত্যাদি আরো অসংখ্য উদাহরণ | এই পাগলের মতো আত্মপ্রচারে মনের যা ক্ষতি আর দৃশ্যের যা দূষণ হয়, সেটা বোঝা শাসকদলের নেতানেত্রীদের মানসিক ক্ষমতার অনেক যোজন ওপর দিয়ে যায়, বলাই বাহুল্য, কিন্তু প্রতিদিন ক্ষতিগ্রস্ত হতে হয় রাজ্যবাসীকে | সৌভাগ্যবশতঃ আর সব গেলেও অন্তত হিউমার-নামক বস্তুটি এখনো বাঙালিকে ছেড়ে যায়নি, তাই এই সব ব্যাপার নিয়ে সামান্য কৌতুক রচনাই বাঙালির বাঁচার উপায় হয়ে দাঁড়িয়েছে, যদিও সে-ব্যাপারে হিসেবে সামান্য গোলমাল হলে অধ্যাপক অম্বিকেশ মহাপাত্রর হালও হতে পারে! উদাহরণ আরো অসংখ্য দেওয়া যায়, তালিকা দিতে গেলে মহাভারত হয়ে যাবে, তার প্রয়োজন নেই, বুদ্ধিমান পাঠক বুঝে নেবেন |

আমাদের চোখের সামনেই ভেঙে পড়লো আমাদের রুচি, জ্ঞান ও নান্দনিকতার বিচার | এটা মূল্যবোধের সঙ্গেও যুক্ত | যে যার পছন্দ মতো গান শুনবে, বই পড়বে, সেটা আরেকজনের পছন্দ হোক বা না হোক, এটা চিরকালই ছিল | কিন্তু ভুল তথ্য, ভুল ও কদর্য ভাষা-ব্যবহার, বাছাই-করা রদ্দি সংস্কৃতির এমন সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় মহোৎসব আগে কখনো হয়েছে বলে মনে হয় না (সিদ্ধার্থ রায়ের আমল দেখিনি তবে শুনেছি সেও এক ভয়ঙ্কর সময় ছিল, যাঁরা দেখেছেন তাঁরা বলতে পারবেন বর্তমান সময়ের সঙ্গে কতটা  তুলনীয়) | ডহরবাবু দিয়ে শুরু, তারপর তো তালিকা দিয়ে শেষ করা যাবে না, সঙ্গে আবার সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে বহুল প্রচারিত সব কবিতাও আছে | যেন অশিক্ষা অজ্ঞানতা অপসংস্কৃতির একটা মহোৎসব চলছে | যে কোনো জিনিসে উৎকর্ষের জন্য যে পরিশ্রম করতে হয়, এই সাধারণ মূল্যবোধটাই ধাক্কা খেয়েছে | প্রায় এই জায়গায় পৌঁছেছে বাংলার সংস্কৃতি যেন সরকারের নেতা নেত্রীরা বলতে চাইছেন জানার থেকে না-জানা ভালো, বোঝার থেকে না-বোঝা ভালো, ঠিক ভাষার থেকে ভুল ভাষা এমন কি খিস্তি-গালাগালিও ভালো, ইত্যাদি | যতক্ষণ ভয় দেখিয়ে, মিথ্যা প্রচার করে, গুন্ডা লেলিয়ে ভোটে জেতা যাবে ততক্ষণ এটাই চলবে | ইতিহাসে লিখে রাখার মতো তলানিতে এসে পৌঁছেছি আমরা!

ক্ষমতার লোভে একেবারে দায়িত্ত্ব নিয়ে ভাঙার চেষ্টা হচ্ছে রাজ্যের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি | তোষণের নির্লজ্জ ও হাস্যকর সব পদক্ষেপ করা হচ্ছে, সিদ্দিকুল্লা থেকে ইদ্রিস আলী - মৌলবাদীদের সচেতনভাবে ক্ষমতা দেওয়া হচ্ছে, ভারতের উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে তিন তালাক তুলে দেওয়ার প্রতিবাদ করা হয়েছে সম্ভবত একমাত্র তৃণমূল নেতাদের থেকে | আবার মাঝে মাঝে উল্টোপক্ষর জন্য হনুমান জয়ন্তী, ব্রাহ্মণ ভোজন ইত্যাদি | পুরো পরিবেশটার মধ্যে ধর্ম ও ধর্মচিহ্নের দৃষ্টিকটু বাড়াবাড়ি ও উস্কানি | এই রাস্তায় তৃণমূলের দোসর জুটেছে বিজেপি, কখনো তৃণমূল আগুন জালে বিজেপি হাওয়া দেয়, কখনো উল্টোটা | মানুষের বিরুদ্ধে অমার্জনীয় অপরাধ করে চলেছে নিজেদের ক্ষমতার দৌড় আরেকটু দীর্ঘায়িত করার স্বার্থে |

এই যখন অবস্থা, যে দেশে গণতন্ত্র ভেঙে পড়েছে, প্রশাসন ভেঙে পড়েছে, মূল্যবোধ ও রুচি ভেঙে পড়েছে, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নড়বড় করছে, যে দেশে জোরে চেঁচিয়ে মিথ্যা বলে দিনকে রাত ও তিলকে তাল করাটাই দস্তুর, যে দেশে এমনকি পুলিশ অফিসারের অপরাধকে অপরাধ বলা বা ডাক্তারের ডেঙ্গুকে ডেঙ্গু বলার অধিকারটাও ভেঙে পড়েছে, সে-দেশে একটা সেতু ভেঙে পড়াটা আর বেশি কী? যেকোনো সভ্য সমাজে চুরির ফলে, অবহেলায় একটা উড়ালপুল ভেঙে এতো ক্ষয়ক্ষতি একটা জাতীয় লজ্জার কারণ হতো, সরকার ও নেতাদের দীর্ঘদিন জবাবদিহি করতে হতো, কিন্তু আজকের বাংলায় এটা একটা প্রতীকমাত্র, সমাজের যা কিছু গুরুত্ত্বপূর্ণ সব ভেঙে পড়ার একটা প্রতীক | আমরা এখন একটা ধংসস্তূপের তলাতেই বাস করছি, নীল সাদা রং করা একটা ধংসস্তূপ, আর সেই ধ্বংসস্তূপের ওপরে দাঁড়িয়ে নৃত্য করছে কিছু রাজনৈতিক ভূত |

---------------------------------------------

স্বেচ্ছাচারী, অত্যাচারী, দুর্নীতিগ্রস্ত শাসককূল ইতিহাসের প্রতিটি অধ্যায়েই চেয়েছে গল্পটা এখানেই শেষ হোক, কারণ তাদের কোনো নৈতিকতাবোধ বা জনদরদ নেই | তারা আরো চুরি করে আরো মানুষ মেরে আইনের চোখ এড়িয়ে দীর্ঘজীবন লাভ করতে চায়, কেউ কেউ হয়তো অমরও হতে চায়! কিন্তু এখানেই ইতিহাসের মজা, গল্পটা কখনোই এখানে শেষ হয় নি ! এবং এক্ষেত্রেও হবে না | যতজনকে রাষ্ট্র মারতে চাইবে, ধরতে চাইবে তাদের একটা অংশ প্রতিবাদের নিশানে রূপান্তরিত হবে | অম্বিকেশ মহাপাত্র বা কানহাইয়া কুমাররা একা নয়, তাদের পেছনে মিছিল আছে | জনতা এমনিতে হাড়হাভাতে, রাজনৈতিক গুন্ডারা দেখে ভাবে টোকা দিলেই পরে যাবে, পরে যায়ও অনেকদিন | তারপর যেদিন রুখে দাঁড়ায় সেদিন কেষ্ট হাকিম মদন মেয়র থেকে শুরু করে কোনো দাদা দিদি পার পায় না, সে তার ছাতি ছাপ্পান্ন ইঞ্চি হোক, আর ডিগ্রি ইস্ট জর্জিয়ার হোক | এখানেও সেদিন এলো বলে !

মঙ্গলবার, ৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৮

খান আব্দুল গাফফার খান ~ শিবানন্দ পাল

খান আব্দুল গাফফার খান।
নামটা বর্তমানে খুব একটা পরিচিত নাম নয়। 
৩১ শে আগস্ট, ১৯৩৪ বোলপুর স্টেশনে দাঁড়িয়ে ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সাত সকালে যাত্রীদের কৌতূহল ছিল গুরুদেব কি শান্তিনিকেতন ছেড়ে চলে যাচ্ছেন? কিন্তু তখন কলকাতা যাবার কোনও ট্রেন ছিল না। ট্রেন তো চলে গেলো। তাহলে? জানা গেল, তিনি একজন অতিথিকে রিসিভ করতে এসেছেন। 
কে সেই মান্যগণ্য অতিথি! যার জন্যে স্বয়ং গুরুদেব নিজে উপস্থিত স্টেশনে? 
বর্ধমানের দিক থেকে একটি ট্রেন এসে বোলপুরে থামল। দেখা গেল রেলগাড়ির একটি তৃতীয় শ্রেনির কামরা থেকে নামছেন এক দীর্ঘদেহী বলিষ্ঠ পাঠান যুবক। তাঁকে দেখা মাত্র রবীন্দ্রনাথ এগিয়ে গেলেন, ৪৪ বছর বয়স্ক যুবক নত হবার চেষ্টা করতেই ৭৩ বছরের কবিগুরু তাঁকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। 
খান যুবক না হলেও এমন কিছু মধ্যবয়স্ক নন তিনি। কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথের চেয়েও দু বছরের ছোট। সেদিনের ওই মানুষটিই হলেন খান আব্দুল গাফফার খান। 
সর্বত্যাগী ফকির, খুব সাধারণ একজন মানুষ হিসেবে রয়ে গিয়েছেন ইতিহাসের পাতায়। স্বাধীনতা আন্দোলনের সেই দিনগুলিতে ভারতের মানুষ তাঁকে চিনতেন 'সীমান্ত গান্ধী' হিসেবে। এই মানুষটি শান্তিনিকেতনের কথা শুনেছিলেন গান্ধিজির কাছে। শুনেছিলেন কবিগুরু বোলপুরের কাছে একটি গ্রামে গরীব মানুষের উন্নয়নের জন্যে একটি সংগঠন ও একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। পেশোয়ার থেকে তাই বড়ো পুত্র আব্দুল গনিকে পাঠিয়েছিলেন শান্তিনিকেতনে লেখাপড়া শিখতে। পুত্রের মাধ্যমে তাঁর সাথে রবীন্দ্রনাথের যোগসূত্র। ১৯৩৪ সালে হাজারিবাগ জেল থেকে মুক্তি পেতেই তিনি বাংলায় আসতে চেয়েছেন। তাঁর আন্তরিক ইচ্ছে কবিগুরুর সাথে একটিবার দেখা করার। 
প্রথমে পাটনা গিয়েছিলেন বাবু রাজেন্দ্রপ্রসাদের কাছে। তখন তিনি স্বাধীনতা সংগ্রামী একজন কংগ্রেস কর্মী। পরবর্তীকালে রাষ্ট্রপতি হয়েছেন। পাটনা থেকে শান্তিনিকেতনে খবর পাঠালেন- খান আবদুল গাফফার খান দেখা করতে চান রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে। তাঁর আগ্রহ শ্রীনিকেতন সম্পর্কেও। 
স্টেশন থেকে কবিগুরু তাঁকে প্রথমে নিয়ে এলেন বিশ্বভারতীর লাইব্রেরী প্রাঙ্গণে। সেখানে সমবেত আশ্রমিক, ছাত্রছাত্রী ও অন্যান্যদের সামনে 'অতিথি'র পরিচয় করিয়ে বললেন, খান সাহেবের শান্তিনিকেতন সফর আশ্রমবাসীদের জীবনে স্মরণীয় ঘটনা। তিনি যখন কারান্তারালে গিয়েছেন, পুত্রকে পাঠিয়েছেন এখানে লেখাপড়া শেখার জন্য। এতেই প্রমাণ মেলে বিশ্বভারতীর প্রতি তাঁর কতখানি আস্থা ও মমত্ববোধ আছে। তাঁর অনুভুতি আমাদের স্পর্শ করেছে। 
গাফফার খান একদিনের বেশি শান্তিনিকেতনে থাকতে পারেন নি। একদিনেই তিনি শান্তিনিকেতন-শ্রীনিকেতনের প্রতিটি বিভাগ ঘুরেছেন দেখেছেন, নিজের চোখে। পরের দিন শান্তিনিকেতন ত্যাগের আগে সকালে উদয়ন প্রাঙ্গণে কবি তাঁর সংবর্ধনার আয়োজন করেন। সেখানে বাংলা হরফে লেখা তাঁর ভাষণ কবি উর্দুতে পাঠ করেছিলেন। "থোরেসে অরসেকে লিয়ে অপ হামারে ইহা তসরিফ লায়ে হৈ ...।"
নিজের হাতে খসড়া করা সেই ভাষণে কবি বলেছিলেন, "অল্পক্ষণের জন্যে আপনি আমাদের মধ্যে এসেছেন। কিন্তু সেই সৌভাগ্যকে আমি অল্প বলে মনে করিনে। আমার নিবেদন এই যে, আমার এ কথাকে আপনি অত্যুক্তি বলে মনে করবেন না যে আপনার দর্শন আমাদের হৃদয়ের মধ্যে নতুন শাক্তি সঞ্চার করেছে। প্রেমের উপদেশ মুখে বলে ফল হয় না, যারা প্রেমিক তাদের সঙ্গই প্রেমের স্পর্শমান। তার স্পর্শে আমাদের অন্তরে যেটুকু ভালবাসা আছে তাঁর মুল্য বেড়ে যায়। 
অল্পক্ষণের জন্যে আপনাকে পেয়েছি কিন্তু এই ঘটনাকে ক্ষণের মাপ দিয়ে পরিমাপ কড়া যায় না। যে মহাপুরুষের হৃদয় সকল মানুষের জন্য, সকল দেশেই যাঁদের দেশ তাঁরা যে কালকে উপস্থিত মতো অধিকার করেন, তাঁকে অতিক্রম করেন, তাঁরা সকল কালের। এখানে আপনার ক্ষণিক উপস্থিতি আশ্রমের হৃদয়ে স্থায়ী হয়ে রইলো"। 
সংবর্ধনার উত্তরে গাফফার খান সেদিন বলেছিলেন, "গুরুদেব" তাঁকে যে আন্তরিক সংবর্ধনা জানিয়েছেন, তাতে তিনি অভিভুত। এখানে আশার আগে যা শুনেছিলেন, নিজের চোখে দেখে মনে হচ্ছে তাঁর চেয়েও মহৎ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। কবি এখনে যে আদর্শ অনুসরন করেছেন, তাঁর ভিত্তিতে ভারত উন্নতির পথ খুঁজে পাবে। ধর্মের অপবাখ্যার মধ্য দিয়েই সাম্প্রদায়িক মনোভাবের বিষবাষ্প ছড়িয়ে পড়ে, এর জন্যই ভারতের জনগনের আশা আখাঙ্খার পূর্ণতায় বাধা আসছে। 
গাফফার খান শান্তিনিকেতন থেকে চলে যাবার পর রবীন্দ্রনাথ একটি পত্রে তাঁর সম্পর্কে গান্ধিজিকে লিখেছিলেন- 'এক অকপট সরলতার' মানুষ। রবীন্দ্র প্রয়াণের খবর পেয়ে এই মানুষটি পেশোয়ার থেকে কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে জানিয়েছিলেন, 
 Peshaar 12th Aug. 1941
Dear Mr. Tagore,
 I am deeply grieved to hear of the sad demise of Gurudev. In him India has truly lost the greatest philosopher, poet and a nationalist. I heartily condole with you in your sad bereavement. May God bless his soul and give strength in your preasent trial. 
Yours sincerely, 
Abdul Ghaffar Khan
পঁইত্রিশ বছর পর গাফফার খান আবার শান্তিনিকেতন এসেছিলেন। তখন তাঁর বয়স ৭৯। ক্লান্তিময় বার্ধক্য জাঁকিয়ে বসেছে শরীরে। পাকিস্থান সৃষ্টির ১৭ বছরের মধ্যে ১৫ বছর কেটেছে তাঁর কারাগারে। তিনি 'হিন্দু ও বিশ্বাসঘাতক' এই ছিল তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ। অধিকাংশ সময় নির্জন কারাগার, নয়ত নজরবন্দি। ১৯৬৪ সালে স্বেছা নির্বাসন বেছে নিয়েছিলেন আফগানিস্থানের একটি ছোট গ্রাম জালালাবাদে।স্থির করেছিলেন সেখানেই বাকি জীবন কাটাবেন রবীন্দ্রনাথ ও গান্ধিজির জীবন দর্শন সম্বল করে। 
১৯৬৯ সালে গান্ধি জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন কমিটির সভাপতি জয়প্রকাশ নারায়ণ তাঁকে ভারতে আসার আমন্ত্রণ জানান।তিনি সে অনুরোধ অগ্রাহ্য করতে পারেন না। স্বাধীনতা প্রাপ্তির বাইশ বছর পর বিপর্যস্ত স্বপ্ন ও আদর্শ আর ভাঙা মন নিয়ে তিনি ভারতের মাটিতে পা রেখেছিলেন। দিল্লিতে নেহেরু কন্যা প্রিয় ইন্দুকে বলেছিলেন তাঁকে যেন শান্তিনিকেতন যাওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হয়। 
শান্তিনিকেতন কেন?
মৃদু হেসে উত্তর দিয়েছিলেন, কেন জানো? ১৯৩৪ সালে প্রথম যখন যাই, গুরুদেবের কাছ থেকে স্নেহ ভালবাসা পাবার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। 
১৪ ডিসেম্বর, ১৯৬৯। আগের মতোই রেলের একটি তৃতীয় শ্রেনির কোচ মধ্যরাত্রে বোলপুর স্টেশনে এসেছিল তাঁকে নিয়ে। বাকি রাত সেটি সাইডিং-এ রেখে দেওয়া হয়। গাফফার খান সেখানেই ছিলেন। পরদিন ১৫ ডিসেম্বর সকাল আটটায় তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী অজয় মুখার্জি তাঁকে সেখান থেকে নিয়ে যান শান্তিনিকেতনে। তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় উদয়নের সেই ঘরে, যে ঘরে ৩৫ বছর আগে রবীন্দ্রসান্নিধ্যে কেটে ছিল তাঁর একটি দিন।
তারপর তাঁকে বিশ্বভারতীর আম্রকুঞ্জে চিরাচরিত ধারায় সংবর্ধনা দেওয়া হয়। 
উত্তরে সেদিনও বলেছিলেন, ৩৫ বছর আগে আমি যখন প্রথম এখানে এসেছিলাম গুরুদেবের যে স্নেহ, ভালবাসা পেয়েছি তা আমার অন্তরে আজও বিরাজমান।
তিনি আশ্রমিকদের হোস্টেল, কলাভবন, বিচিত্রা দেখেন। বিচিত্রায় একটি কাঠ খোদাই মানবমূর্তির সামনে দাঁড়ালে তাঁর চোখ থেকে জল গড়িয়ে নামে। বারবার চোখ কচলে মূর্তিটি পরখ করেন। এ মূর্তি যে গড়েছেন তাঁর পুত্র নন্দলাল শিষ আবদুল গনি। 
তিনি ঘুরলেন শ্রীনিকেতন। বহু মানুষ উপস্থিত হয়েছিলেন তাঁকে দেখতে। ছোট একটি বক্তৃতাও দেন। ফেরার পথে উপাচার্য কালিদাস ভট্টাচার্যর কাছে সাঁওতাল পল্লী দেখাবার অনুরোধ করলেন। 
তাঁকে নিয়ে যাওয়া হোল ভুবনডাঙ্গায়। সাঁওতালদের সাথে গাফফার খান মিলিত হলেন। জানতে চাইলেন, স্বাধীনতার আগে যেমন আপনাদের দিন কাটত, তাঁর কি কোনও পরিবর্তন হয়েছে? স্বাধীনতা কি আপনাদের জীবনের স্বাদ বদলে দিতে পেরেছে? 
দোভাষীর মাধ্যমে তিনি যে জবাব পেয়েছিলেন তাতে তাঁর মুখের হাসি মিলিয়ে গিয়েছিলো। হায় গুরুদেব! হায় স্বাধীনতা! 
বুক ভরা আক্ষেপে শুধু এক টুকরো শান্তি ছিল তাঁর শান্তিনিকেতন সফর। ১৯৮৮-র ২০ জানুয়ারি তিনি প্রয়াত হন।