সোমবার, ২২ আগস্ট, ২০২২

ফুল্লরা হারেনি ~ মালিনী ভট্টাচার্য

*****************************************
( ২০১৮ সালে গণশক্তিতে এই নিবন্ধ লিখেছিলেন মালিনী ভট্টাচার্য। 
অবশেষে জামিন পেয়েছেন কমরেড ফুল্লরা মণ্ডল। তাই মালিনী ভট্টাচার্যের এই লেখা ফিরে পড়া।)
******************************

'তোমরা এলে কেন? এভাবে তোমাদের দেখার চাইতে না দেখাই তো ভালো ছিল!' আমাদের দেখে এই ছিল তার প্রথম কথা। তার মতোই ক্ষোভ ছিল আমাদের মনেও। ক্ষোভের কারণ? 'সংশোধনাগারে'র অধ্যক্ষকে আগে থেকে আবেদন জানানোর পরেও ফুল্লরার সঙ্গে আমাদের দেখা করতে হলো খোলা বারান্দায় বসে অফিসঘরের সাতপুরু দেওয়াল এবং জানালার গরাদ ও তিনপুরু কালো জালের ফাঁক দিয়ে। বছরদুয়েক আগে যখন ফুল্লরার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম তখনও কিন্তু এই খাঁচার ফাঁক দিয়ে সম্ভাষণের অমানবিক ব্যবস্থা জারি হয়নি! অথচ এটা নাকি জেল নয়, সংশোধনাগার! আমরা তবু কাকুতিমিনতির রাস্তায় যেতে চাইনি। হামলা এবং মামলার এই জমানায় আর বেশি কী প্রত্যাশা করব? আর অফিসঘরের চেয়ারে যাঁরা বসে আছেন তাঁদেরও তো এই জমানায় চাকরি করতে হবে, তাঁরাই বা কী করবেন? ফুল্লরাও সেকথা জানে, তাই ক্ষোভ সামলে সে জনে জনে খবর নেয় পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা মহিলা সমিতি থেকে আসা বা আসতে না-পারা প্রতিটি সাথির, যাদের সঙ্গে দীর্ঘদিন লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে জীবনকে সে জড়িয়ে নিয়েছিল, যাদের সঙ্গে তার প্রাত্যহিকের আজ এক বড়ো ব্যবধান তৈরি করেছে জেলখানার গরাদ।
ফুল্লরা মণ্ডল। মেদিনীপুরের কৃষক পরিবারের মেয়ে সে, যার বাবা এবং দাদাও নিজে হাতে লাঙল ধরে চাষ করেছেন। নিজের চেষ্টায় পড়াশোনা করে ফুল্লরার ইচ্ছা ছিল শিক্ষকতা করার। ঘরের মেয়ে বাইরে গিয়ে চাকরি করবে, বাবার এই দোনোমনাকে মেনে নিতে সে চায়নি। এমন সময়ে ডাক এল পার্টির কাজ করার। সেও তো আরও বৃহত্তর ক্ষেত্রে একরকম শিক্ষকতার কাজই। নিজের পুরো জীবনটাকেই সে লাগিয়ে দিল এই কাজে, দ্বিধা না করে হয়ে গেল হোলটাইমার। পার্টি অফিসই তার ঘর, নিজের বাড়ি আর তার বাড়ি নয়, সপ্তাহে দুই তিনবার যাতায়াতের জায়গামাত্র। পঞ্চায়েত সমিতির কাজ করতে গিয়ে বাড়ল প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের সঙ্গে তার যোগাযোগ। তৃণমূল- মাওবাদী সাজশের রক্তাক্ত দিন যখন জঙ্গলমহলে এল, তখনও তাকে কেউ গণসংযোগের ময়দান ছেড়ে ঘরে ঢুকে পড়তে দেখেনি। আমাদের সঙ্গে এবার দেখা হতে বারবার যেকথা সে বলছিল, তা হলো, বিপদ হতে পারে জেনেই তো পার্টিতে আসা, তাহলে বিপদের সময়ে ভয় পাব কেন? সে বলে, বাড়ির লোকদের জন্য আমি কখনো কিছু করিনি, তাদের কিছুই দিতে পারিনি। কিন্তু তার ভাইপোর কথায়, তুমি আমাদের পুরো পরিবারকে একটা আদর্শ দিয়েছ, তার থেকে বেশি আর কী দেবে? সেটা ধরেই তো আমরা আছি।
ফুল্লরা অনেকবছর ধরে আর বাড়ি ঢুকতেই পারেনি। প্রায় চারবছর হলো বিচারের প্রত্যাশায় সে জেলখানায়। তার জামিনের আবেদন এতদিনেও মঞ্জুর হয়নি, এর মধ্যে মারা গেছেন তার মা ও দাদা, শেষবারের দেখাও সে দেখতে পায়নি। ফুল্লরা মণ্ডল একা নয়। ২০০৭-৮ সাল থেকেই এরাজ্যে যে রাজনৈতিক উথালপাথাল শুরু হয়েছে— যার একটি চরম মুহূর্তই ৩৪ বছরের বামফ্রন্ট জমানার অবসান— তারই ধাক্কায় যেমন ভয় বা বিভ্রান্তি বা লোভ বা সুবিধাবাদের শিকার হয়ে নানাবিধ চাপের মুখে বহু বামপন্থী কর্মীর পশ্চাদপসরণ ঘটেছে, তেমনই এসবকে উপেক্ষা করেই যারা এ আন্দোলনে রয়ে গেছে, সাহস এবং জেদের সঙ্গে প্রতিকূলতার মোকাবিলা করছে এমন কর্মীর সংখ্যাও নগণ্য নয়। দূরবীন দিয়ে তাদের দেখা যাবে না, দেখতে হবে অণুবীক্ষণ যন্ত্রে। কারণ এই বিপন্ন সময়ের শিরা-উপশিরার মধ্যে তাদের অস্তিত্ব, খবরের কাগজে তাদের নাম ওঠে না, টিভি চ্যানেলে তাদের মুখ দেখা যায় না, তবু বিপর্যস্ত হয়েও তারা হাল ছেড়ে দেয়নি, সুবিধাবাদের স্রোতে গা ঢেলে দেয়নি। কেউ হয়তো আছে ফুল্লরার মতোই কয়েদখানায় মিথ্যা মামলার বোঝা মাথায় নিয়ে, কেউ বছরের পর বছর বাড়ির আশেপাশে যেতে পারেনি, কারো অন্নসংস্থান নেই, ভিন রাজ্যে চলে যেতে হচ্ছে।
এই অবস্থায় যাদের পড়তে হয় শুধু তারাই জানে, হতাশাকে এড়িয়ে চলা কত কঠিন, মনোবল ভেঙে পড়ার সম্ভাবনা কত প্রবল। কারণ হতাশা তো হঠাৎ একদিন সকালে মুখের সামনে এসে হাজির হয় না, তা তলায় তলায় অস্তিত্বকে কুরে কুরে খায়, প্রত্যেক বারের হার বা পিছিয়ে যাওয়া একটু করে আত্মপ্রত্যয়কে ক্ষইয়ে দিতে থাকে, মনুষ্যত্বকে নষ্ট করে দীর্ঘমেয়াদি সংশয়ের বিষ ঢেলে। যতদিন না আমরা ভাবতে শুরু করি, যে দিনবদলের লক্ষ্যে জীবনটাই ঢেলে দিলাম তা মরীচিকা মাত্র। যারা গা বাঁচিয়ে ছিল তারা তো দিব্যি আছে। ফুল্লরাদের মনেও যদি কখনো কখনো এ হতাশা আসে, তাহলে কি সেটা খুব অস্বাভাবিক? তাদের অধৈর্য হবার কি কোনও কারণ নেই? আমার এত ধৃষ্টতা নেই যে আমি তাকে বলব, হতাশ হোয়ো না, ভেঙে পোড়ো না, কারণ আমি এটুকু জানি যে, যে কখনো বুক-মোচড়ানো হতাশা অনুভব করে না, যে সংশয়ে বিপন্ন হয় না, তার প্রত্যয়টা মুখের কথামাত্র। আমি এটুকু জানি, যে ফুল্লরা এবং তার মতো আরও অনেকের নিজেদের প্রত্যয়কে ঝালিয়ে নিতে হয় প্রতিদিনের হতাশা আর সংশয়ের আগুনেই। সেখানে ভাবের ঘরে চুরি চলে না।
ফুল্লরা জেলখানার মধ্যে বসেও পড়াশোনা করে, 'গণশক্তি' থেকে নিত্য আহরণ করে বাইরের খবর, অন্য মহিলা কয়েদিদের চিঠি লিখে দেয়, তাদের নানাভাবে সাহায্য করে, যে বাচ্চারা মায়ের সঙ্গে জেলে এসেছে তাদের লেখাপড়া শেখায়। এই মেয়েকে বাইরে থেকে কে সাহস জোগাবে? তাকে আমরা শুধু দিয়ে এসেছি একটি মোটা খাতা আর কলম। বলেছি, এই খাতায় তুমি তোমার নিজের কথা লেখো, লেখো তোমার ছোটবেলা কেমন ছিল, কীকরে তুমি লেখাপড়া শিখলে, পার্টির কাজ করতে গিয়ে মানুষের জীবনের যে অভিজ্ঞতা তুমি সংগ্রহ করেছ লেখো সেই কথা, লেখো এই গারদের আড়ালে যেসব মানুষের সঙ্গে তোমার আলাপ হচ্ছে তাদের কথা। লেখো, ফুল্লরা, লেখো, লেখো। তোমার কলম তো কেউ কেড়ে নিতে পারবে না। যেকাজ সারাজীবন করে এলে, এও তো সেই কাজেরই রকমফের। এর মধ্য দিয়ে তোমার প্রিয়সাথিদের সঙ্গে তোমার সংযোগ থাকবে। আমরা তোমার কথা শুনতে পাব, তোমার অভিজ্ঞতা থেকে নিজেদের অভিজ্ঞতার প্রদীপ জ্বালিয়ে নিতে থাকব।

চলে আসার আগে দুই তিন মিনিটের জন্য আমরা বড়ো লোহার গেটের সামনে এসে দাঁড়ালাম। ফটকের ওপারে সে চলে যাবার আগে একটুক্ষণের জন্য স্পষ্ট কাছ থেকে দেখা গেল তাকে। যে অফিসারটি দরজার পাশে বসেছিলেন, শুনলাম জিগগেস করছেন, এত ভিড় কি তোমার জন্যই নাকি? গেটের ফাঁকে হাত বাড়িয়ে তার হাত দু'টি ধরলাম। সে বলল, এই তো এবার মনটা খানিকক্ষণ খারাপ হয়ে থাকবে, কিন্তু তা হোক, আমি তো আছি এখানে, তোমরা লড়াই করো, জেদ করে গা লাগিয়ে লড়াই, ভাসা-ভাসা লড়াই করলে চলবে না। উঁচু মাথা উঁচু রেখেই সে চলে গেল ফটকের আড়ালে। জানিয়ে গেল সে হারেনি। আমাদেরও হার মানতে বারণ করে গেল। ফুল্লরাকে যদি বিনা অপরাধে জেলে আটক থাকতে হয়, তাহলে বলব তার এই শাস্তি আমাদের সকলের শাস্তি। সেই শাস্তিকে সবাই মিলে ভাগ করে নিতে হলে ফুল্লরার বার্তাকে আমাদের মূল্য দিতেই হবে। ফুল্লরা তার জন্য আমাদের চোখের জল ফেলতে তো বলেনি। সেকথা ভুলে এখনো যদি ভ্রান্তিবশে ভাবি, যা দিনকাল পড়েছে তাতে আগ বাড়িয়ে ফ্যাসাদ না বাড়ানোই ভালো, গয়ংগচ্ছ ভাবে চলাটাকেই যদি এখনও চলা বলে মনে করি, আলস্য আর আত্মাভিমানে যদি বাস্তবের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকি, তাহলে বৃথাই হবে ফুল্লরার বার্তা। তার সঙ্গে এই বিশ্বাসঘাতকতা আমরা যেন না করি। 

#TMCJungleRaj #WestBengal

শুক্রবার, ১২ আগস্ট, ২০২২

চাঁদের রং কি? ~ ডাঃ দোলনচাঁপা দাশগুপ্ত

একটি সাম্প্রতিক আলোচনার পরে, একজন তরুণ স্কুলছাত্র আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিল- "জলবায়ু পরিবর্তন কীভাবে চাঁদকে প্রভাবিত করে"?

প্রথমে আমি ভেবেছিলাম প্রশ্নটি তুচ্ছ, কিন্তু পরে  আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে এটি বেশ গভীর প্রশ্ন। আমাদের বায়ুমণ্ডলের পরিবর্তন চাঁদকে প্রভাবিত করে না, তবে আমরা কীভাবে চাঁদ দেখি সেটাকে প্রভাবিত করে।

APOD থেকে:

 "চাঁদের রঙ কি? এটি রাতের উপর নির্ভর করে। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের বাইরে, প্রতিফলিত সূর্যালোক দ্বারা আলোকিত অন্ধকার চাঁদ,  চমৎকার  বাদামী - ধূসর দেখায়।

পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের ভিতর থেকে দেখা গেলেও, চাঁদ ভিন্নভাবে দেখা যেতে পারে। বৈশিষ্ট্যযুক্ত চিত্রটি খেয়াল করলে বোঝা যাবে, সমস্ত ইতালির  বিভিন্ন অবস্থান থেকে ১০ বছরেরও বেশি সময় ধরে একজন জ্যোতির্বিজ্ঞানীর রেকর্ড করা  (নথিভুক্ত) পূর্ণ চাঁদের আপাত রঙের একটি সংগ্রহ  এই ছবিগুলো। 

একটি লাল বা হলুদ রঙের চাঁদ সাধারণত দিগন্তের কাছাকাছি দেখা চাঁদকে বোঝায় । সেখানে, কিছু নীল আলো পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের মধ্য দিয়ে দীর্ঘ পথ দিয়ে বিক্ষিপ্ত হয়েছে, কখনও কখনও সূক্ষ্ম ধূলিকণাতে ভরা। নীল রঙের চাঁদ আরও বিরল এবং বড় ধূলিকণা বহনকারী বায়ুমণ্ডলের মধ্য দিয়ে দেখা চাঁদকে নির্দেশ করতে পারে। বেগুনি চাঁদ ঠিক কীভাবে  তৈরি হয়েছে  তা স্পষ্ট নয় - এটি বিভিন্ন প্রভাবের সংমিশ্রণ হতে পারে। শেষ চিত্রটি ২০১৮  সালের জুলাইয়ের মোট চন্দ্রগ্রহণকে ক্যাপচার করেছে  -- যেখানে পৃথিবীর ছায়ায় চাঁদ ক্ষীণ লাল দেখাচ্ছে  -- পৃথিবীর চারপাশে বাতাসের মাধ্যমে আলো প্রতিসরণ করার কারণে। পরবর্তী পূর্ণিমা এই মাসের শেষে ঘটবে এবং কোনও কোনও সংস্কৃতিতে 'বিভার মুন'  নামে পরিচিত।

Image Credit & Copyright: Marcella Giulia Pace 


আজ পূর্ণিমা। রাখিপূর্ণিমা। একটি খুব সুন্দর বিষয়কে তুলে ধরেছেন স্যার Somak Raychaudhury  বাংলা মাধ্যমের ছাত্রছাত্রীদের জন্য স্যারের পোস্টটা আমি বাংলায় অনুবাদ করে দিলাম।


সোমবার, ৮ আগস্ট, ২০২২

এসএসকেএমে মেরুদণ্ডের জন্ম (একটি কল্প-গল্প) ~ ডাঃ অরুণাচল দত্ত চৌধুরী

ল্যাবরেটরির নামটা ভজঘট। সলিড সায়েন্টিফিক কাইনেটিকস অফ মিউটেশন সংক্ষেপে এসএসকেএম।  

আসলে কাজ হয় জেনেটিকস আর ইভোলিউশন নিয়ে। রাষ্ট্রীয় কাজ। অতীব গোপন, বলাই বাহুল্য।  ল্যাবে আজকে প্রবল উত্তেজনা। কাগজে একটা খবর বেরিয়েছে। তাই নিয়েই সিনিয়ার সায়েন্টিস্ট মহীতোষ মহলানবিশের নামে গুরুতর অভিযোগ। 

এমনিতে এই ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা পর্যবেক্ষণ ও সিদ্ধান্ত নেবার যে বৈজ্ঞানিক প্রথা সারা বিশ্বে চালু আছে সেইটিই চালু। কিন্তু সে সবই মলিকিউলার লেভেলে। প্রোটিন কার্বোহাইড্রেট ফ্যাট মিনারেল নিয়ে জটিল কাজ কারবার। কখনও কমপিউটার সিমুলেশনে রেজাল্ট দেখে আন্দাজ করার চেষ্টা করা হয় অনাগত ভবিষ্যতে কী ধরণের পরিবর্তন আসতে চলেছে। সাধারণের পক্ষে একপ্রকার অবোধ্যই। সেই সব কাজ জাতির কী কাজে লাগে কেউই জানে না।

ইভোলিউশন মানে বিবর্তন সবাই জানে একটি ধীর প্রক্রিয়া। শতাব্দীর পর শতাব্দী কেটে যায় খুব ছোট পরিবর্তন আসতেও। কাজেই সরাসরি বিবর্তন চাক্ষুষ করা এই ল্যাবের তো বটেই সবাইরই সাধ্যাতীত। তবু কখনও জিন পালটে নতুন প্রজাতি তৈরি করার চেষ্টাও করা হয় অবশ্যি।

বিজ্ঞানী মহীতোষ আবার কবি টাইপের। এই ল্যাবের সর্বাধিনায়ক ডঃ সর্বজ্ঞ এই কবিতার ইস্যুতে ওর ওপর একটু বিরক্তও বটে। ব্যাপার তত সিরিয়াস কিছু না। আসলেই আবেগ সামলাতে না পেরে ওর কবিতা ছাপতে পাঠায় বিভিন্ন ম্যাগাজিনে। সেই আপদগুলি ছাপাও হয়। ডঃ সর্বজ্ঞর ধারণা সেই সব কবিতা ডিকোড করে বিদেশি প্রতিদ্বন্দ্বীরা এই ল্যাবের গোপন সাফল্যগুলি জেনে যাচ্ছে। অথচ এখানে গবেষণার শর্তই হল, কিছুতেই এখানের খবর বাইরের কারওর সঙ্গে শেয়ার করা যাবে না। 

এই না মানে সর্ব অর্থেই না। এখানের চাকরি ছেড়ে দেওয়ার পরও না। এই মর্মে চুক্তিপত্র সই করতে হয়েছে সব রিসার্চারকেই। গতমাসেই তিনি মহীতোষকে তাঁর ঘরে, যেটিকে লোকে আড়ালে টর্চার চেম্বার বলে, ডাকিয়ে এনেছিলেন। 
– তোমাকে আজকেই শো কজ্ নোটিশ ধরাব।
নিরীহ মহীতোষ কাঁপতে কাঁপতে জিজ্ঞেস করেছিল,
– কেন স্যার? 

সর্বজ্ঞ গম্ভীর ভাবে বিজ্ঞান কথাঞ্জলি নামের ওঁচা লিটল ম্যাগাজিনটা তার দিকে এগিয়ে দিলেন। 
– এই কবিতাটা তুমি কেন লিখেছ? 

মহীতোষ গলা বাড়িয়ে দেখে নিয়ে ঢোঁক গিলল। একটা নির্দোষ লিমেরিক। স্যার এটারও খোঁজ পেয়ে গেছেন? বড়ই আপশোষের কথা। 

লিমেরিকটা হল,
লঙ্কা গাছের কোষে মুরগির জিন দিয়ে ঠেসে
নিরামিষ ফলে পাই, মাংসের স্বাদ অবশেষে।
চিলি চিকেনের ভোজ
জুটছে এখন রোজ।
খবরটা গোপনীয়, এক্ষুনি দিচ্ছি না প্রেসে। 

জলদগম্ভীর গলায় বস জিজ্ঞেস করলেন,
– আমাদের এই ল্যাবটা কি খেয়াল খুশির জায়গা? এই ভাবে তুমি ল্যাবের গোপন খবর কবিতাপত্রিকা দিয়ে বাইরে আউট করছ? তুমি জানো, কেনটাকি চিকেন কিম্বা ম্যাকডোনাল্ড আরও কতজন এই রকম আবিষ্কারের জন্য ওঁৎ পেতে বসে আছে? তোমার মাথায় আইডিয়া এসেছে ভালো কথা। সেটা পাবলিশ করার সাহস তোমার হয় কী করে? 

– কিন্তু স্যার এই আইডিয়াটা তো…
– কোনও এক্সপেরিমেন্টেই এখন অবধি ইমপ্লিমেন্টেড হয়নি। এই তো বলবে? কিন্তু এই আইডিয়াটা তোমার মাথায় এসেছে কাজেই এটা ল্যাবের সম্পত্তি, বুঝেছ?
বাধ্য ছাত্রের মত ঘাড় নাড়ে মহীতোষ 

আজ আবার মহীতোষের ডাক পড়েছে টর্চার চেম্বারে।
– তুমি আবারও সেই কাজ করেছ? খবর পাচারের সেই জঘন্য কাজ?
ঘাড় নেড়ে প্রতিবাদ করে মহীতোষ। 

– না হে, ঘাড় নাড়লেই হবে না। ওই যে আগের মাসে কবিতাটার শেষ লাইনে লিখেছিলে  "খবরটা গোপনীয়, এক্ষুনি দিচ্ছি না প্রেসে" লিখেছ তাতেই তো বোঝা যাচ্ছে তোমার ইয়ে কী বলে প্রেস মানে সাংবাদিকদের সঙ্গে দহরম মহরম মানে চেনা জানা মানে গোপন যোগাযোগ মানে… 

মানের সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে ক্লান্ত হয়ে হাঁপাতে থাকেন ডঃ সর্বজ্ঞ।

ততক্ষণে তাঁর হাতে উঠে এসেছে আজকের আনন্দ বার্তা কাগজ।
সেইটি টেবিলের ওপর বিছিয়ে তার হেড লাইনে হাত রাখেন তিনি। প্রশ্ন করেন,
–এটা কী? কে এদের খবর দিল তুমি ছাড়া?

মহীতোষ ঘুম থেকে উঠতে দেরি করে তড়িঘড়ি চলে এসেছে। পড়তে হয় নইলে পিছিয়ে পড়তে হয়। 
পড়েনি। তাই পিছিয়ে পড়েছে। 

আনন্দবার্তা আঠারো পয়েন্টে হেড লাইনে লিখেছে,

অবশেষে বিবর্তনের নতুন দিশা। এসএসকেএমের পরীক্ষাগারে বিশেষ তাপে ও চাপে কিছু কেঁচোর শরীরে শিরদাঁড়ার আভাস দেখা দিয়েছে।