*****************************************
( ২০১৮ সালে গণশক্তিতে এই নিবন্ধ লিখেছিলেন মালিনী ভট্টাচার্য।
অবশেষে জামিন পেয়েছেন কমরেড ফুল্লরা মণ্ডল। তাই মালিনী ভট্টাচার্যের এই লেখা ফিরে পড়া।)
******************************
'তোমরা এলে কেন? এভাবে তোমাদের দেখার চাইতে না দেখাই তো ভালো ছিল!' আমাদের দেখে এই ছিল তার প্রথম কথা। তার মতোই ক্ষোভ ছিল আমাদের মনেও। ক্ষোভের কারণ? 'সংশোধনাগারে'র অধ্যক্ষকে আগে থেকে আবেদন জানানোর পরেও ফুল্লরার সঙ্গে আমাদের দেখা করতে হলো খোলা বারান্দায় বসে অফিসঘরের সাতপুরু দেওয়াল এবং জানালার গরাদ ও তিনপুরু কালো জালের ফাঁক দিয়ে। বছরদুয়েক আগে যখন ফুল্লরার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম তখনও কিন্তু এই খাঁচার ফাঁক দিয়ে সম্ভাষণের অমানবিক ব্যবস্থা জারি হয়নি! অথচ এটা নাকি জেল নয়, সংশোধনাগার! আমরা তবু কাকুতিমিনতির রাস্তায় যেতে চাইনি। হামলা এবং মামলার এই জমানায় আর বেশি কী প্রত্যাশা করব? আর অফিসঘরের চেয়ারে যাঁরা বসে আছেন তাঁদেরও তো এই জমানায় চাকরি করতে হবে, তাঁরাই বা কী করবেন? ফুল্লরাও সেকথা জানে, তাই ক্ষোভ সামলে সে জনে জনে খবর নেয় পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা মহিলা সমিতি থেকে আসা বা আসতে না-পারা প্রতিটি সাথির, যাদের সঙ্গে দীর্ঘদিন লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে জীবনকে সে জড়িয়ে নিয়েছিল, যাদের সঙ্গে তার প্রাত্যহিকের আজ এক বড়ো ব্যবধান তৈরি করেছে জেলখানার গরাদ।
ফুল্লরা মণ্ডল। মেদিনীপুরের কৃষক পরিবারের মেয়ে সে, যার বাবা এবং দাদাও নিজে হাতে লাঙল ধরে চাষ করেছেন। নিজের চেষ্টায় পড়াশোনা করে ফুল্লরার ইচ্ছা ছিল শিক্ষকতা করার। ঘরের মেয়ে বাইরে গিয়ে চাকরি করবে, বাবার এই দোনোমনাকে মেনে নিতে সে চায়নি। এমন সময়ে ডাক এল পার্টির কাজ করার। সেও তো আরও বৃহত্তর ক্ষেত্রে একরকম শিক্ষকতার কাজই। নিজের পুরো জীবনটাকেই সে লাগিয়ে দিল এই কাজে, দ্বিধা না করে হয়ে গেল হোলটাইমার। পার্টি অফিসই তার ঘর, নিজের বাড়ি আর তার বাড়ি নয়, সপ্তাহে দুই তিনবার যাতায়াতের জায়গামাত্র। পঞ্চায়েত সমিতির কাজ করতে গিয়ে বাড়ল প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের সঙ্গে তার যোগাযোগ। তৃণমূল- মাওবাদী সাজশের রক্তাক্ত দিন যখন জঙ্গলমহলে এল, তখনও তাকে কেউ গণসংযোগের ময়দান ছেড়ে ঘরে ঢুকে পড়তে দেখেনি। আমাদের সঙ্গে এবার দেখা হতে বারবার যেকথা সে বলছিল, তা হলো, বিপদ হতে পারে জেনেই তো পার্টিতে আসা, তাহলে বিপদের সময়ে ভয় পাব কেন? সে বলে, বাড়ির লোকদের জন্য আমি কখনো কিছু করিনি, তাদের কিছুই দিতে পারিনি। কিন্তু তার ভাইপোর কথায়, তুমি আমাদের পুরো পরিবারকে একটা আদর্শ দিয়েছ, তার থেকে বেশি আর কী দেবে? সেটা ধরেই তো আমরা আছি।
ফুল্লরা অনেকবছর ধরে আর বাড়ি ঢুকতেই পারেনি। প্রায় চারবছর হলো বিচারের প্রত্যাশায় সে জেলখানায়। তার জামিনের আবেদন এতদিনেও মঞ্জুর হয়নি, এর মধ্যে মারা গেছেন তার মা ও দাদা, শেষবারের দেখাও সে দেখতে পায়নি। ফুল্লরা মণ্ডল একা নয়। ২০০৭-৮ সাল থেকেই এরাজ্যে যে রাজনৈতিক উথালপাথাল শুরু হয়েছে— যার একটি চরম মুহূর্তই ৩৪ বছরের বামফ্রন্ট জমানার অবসান— তারই ধাক্কায় যেমন ভয় বা বিভ্রান্তি বা লোভ বা সুবিধাবাদের শিকার হয়ে নানাবিধ চাপের মুখে বহু বামপন্থী কর্মীর পশ্চাদপসরণ ঘটেছে, তেমনই এসবকে উপেক্ষা করেই যারা এ আন্দোলনে রয়ে গেছে, সাহস এবং জেদের সঙ্গে প্রতিকূলতার মোকাবিলা করছে এমন কর্মীর সংখ্যাও নগণ্য নয়। দূরবীন দিয়ে তাদের দেখা যাবে না, দেখতে হবে অণুবীক্ষণ যন্ত্রে। কারণ এই বিপন্ন সময়ের শিরা-উপশিরার মধ্যে তাদের অস্তিত্ব, খবরের কাগজে তাদের নাম ওঠে না, টিভি চ্যানেলে তাদের মুখ দেখা যায় না, তবু বিপর্যস্ত হয়েও তারা হাল ছেড়ে দেয়নি, সুবিধাবাদের স্রোতে গা ঢেলে দেয়নি। কেউ হয়তো আছে ফুল্লরার মতোই কয়েদখানায় মিথ্যা মামলার বোঝা মাথায় নিয়ে, কেউ বছরের পর বছর বাড়ির আশেপাশে যেতে পারেনি, কারো অন্নসংস্থান নেই, ভিন রাজ্যে চলে যেতে হচ্ছে।
এই অবস্থায় যাদের পড়তে হয় শুধু তারাই জানে, হতাশাকে এড়িয়ে চলা কত কঠিন, মনোবল ভেঙে পড়ার সম্ভাবনা কত প্রবল। কারণ হতাশা তো হঠাৎ একদিন সকালে মুখের সামনে এসে হাজির হয় না, তা তলায় তলায় অস্তিত্বকে কুরে কুরে খায়, প্রত্যেক বারের হার বা পিছিয়ে যাওয়া একটু করে আত্মপ্রত্যয়কে ক্ষইয়ে দিতে থাকে, মনুষ্যত্বকে নষ্ট করে দীর্ঘমেয়াদি সংশয়ের বিষ ঢেলে। যতদিন না আমরা ভাবতে শুরু করি, যে দিনবদলের লক্ষ্যে জীবনটাই ঢেলে দিলাম তা মরীচিকা মাত্র। যারা গা বাঁচিয়ে ছিল তারা তো দিব্যি আছে। ফুল্লরাদের মনেও যদি কখনো কখনো এ হতাশা আসে, তাহলে কি সেটা খুব অস্বাভাবিক? তাদের অধৈর্য হবার কি কোনও কারণ নেই? আমার এত ধৃষ্টতা নেই যে আমি তাকে বলব, হতাশ হোয়ো না, ভেঙে পোড়ো না, কারণ আমি এটুকু জানি যে, যে কখনো বুক-মোচড়ানো হতাশা অনুভব করে না, যে সংশয়ে বিপন্ন হয় না, তার প্রত্যয়টা মুখের কথামাত্র। আমি এটুকু জানি, যে ফুল্লরা এবং তার মতো আরও অনেকের নিজেদের প্রত্যয়কে ঝালিয়ে নিতে হয় প্রতিদিনের হতাশা আর সংশয়ের আগুনেই। সেখানে ভাবের ঘরে চুরি চলে না।
ফুল্লরা জেলখানার মধ্যে বসেও পড়াশোনা করে, 'গণশক্তি' থেকে নিত্য আহরণ করে বাইরের খবর, অন্য মহিলা কয়েদিদের চিঠি লিখে দেয়, তাদের নানাভাবে সাহায্য করে, যে বাচ্চারা মায়ের সঙ্গে জেলে এসেছে তাদের লেখাপড়া শেখায়। এই মেয়েকে বাইরে থেকে কে সাহস জোগাবে? তাকে আমরা শুধু দিয়ে এসেছি একটি মোটা খাতা আর কলম। বলেছি, এই খাতায় তুমি তোমার নিজের কথা লেখো, লেখো তোমার ছোটবেলা কেমন ছিল, কীকরে তুমি লেখাপড়া শিখলে, পার্টির কাজ করতে গিয়ে মানুষের জীবনের যে অভিজ্ঞতা তুমি সংগ্রহ করেছ লেখো সেই কথা, লেখো এই গারদের আড়ালে যেসব মানুষের সঙ্গে তোমার আলাপ হচ্ছে তাদের কথা। লেখো, ফুল্লরা, লেখো, লেখো। তোমার কলম তো কেউ কেড়ে নিতে পারবে না। যেকাজ সারাজীবন করে এলে, এও তো সেই কাজেরই রকমফের। এর মধ্য দিয়ে তোমার প্রিয়সাথিদের সঙ্গে তোমার সংযোগ থাকবে। আমরা তোমার কথা শুনতে পাব, তোমার অভিজ্ঞতা থেকে নিজেদের অভিজ্ঞতার প্রদীপ জ্বালিয়ে নিতে থাকব।
চলে আসার আগে দুই তিন মিনিটের জন্য আমরা বড়ো লোহার গেটের সামনে এসে দাঁড়ালাম। ফটকের ওপারে সে চলে যাবার আগে একটুক্ষণের জন্য স্পষ্ট কাছ থেকে দেখা গেল তাকে। যে অফিসারটি দরজার পাশে বসেছিলেন, শুনলাম জিগগেস করছেন, এত ভিড় কি তোমার জন্যই নাকি? গেটের ফাঁকে হাত বাড়িয়ে তার হাত দু'টি ধরলাম। সে বলল, এই তো এবার মনটা খানিকক্ষণ খারাপ হয়ে থাকবে, কিন্তু তা হোক, আমি তো আছি এখানে, তোমরা লড়াই করো, জেদ করে গা লাগিয়ে লড়াই, ভাসা-ভাসা লড়াই করলে চলবে না। উঁচু মাথা উঁচু রেখেই সে চলে গেল ফটকের আড়ালে। জানিয়ে গেল সে হারেনি। আমাদেরও হার মানতে বারণ করে গেল। ফুল্লরাকে যদি বিনা অপরাধে জেলে আটক থাকতে হয়, তাহলে বলব তার এই শাস্তি আমাদের সকলের শাস্তি। সেই শাস্তিকে সবাই মিলে ভাগ করে নিতে হলে ফুল্লরার বার্তাকে আমাদের মূল্য দিতেই হবে। ফুল্লরা তার জন্য আমাদের চোখের জল ফেলতে তো বলেনি। সেকথা ভুলে এখনো যদি ভ্রান্তিবশে ভাবি, যা দিনকাল পড়েছে তাতে আগ বাড়িয়ে ফ্যাসাদ না বাড়ানোই ভালো, গয়ংগচ্ছ ভাবে চলাটাকেই যদি এখনও চলা বলে মনে করি, আলস্য আর আত্মাভিমানে যদি বাস্তবের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকি, তাহলে বৃথাই হবে ফুল্লরার বার্তা। তার সঙ্গে এই বিশ্বাসঘাতকতা আমরা যেন না করি।
#TMCJungleRaj #WestBengal