এই ছবিটা নিয়ে গত কয়েকদিন অনেক খবর আর আলোচনা দেখলাম। একটা বোর্ডের চারপাশে অনেকগুলো সেমিকন্ডাক্টর চিপ গাঁথা। তার মধ্যে নয়নের মণি হল Vikram 32bit processor. দেশ উচ্ছ্বসিত এই সাফল্যে। মাস্টারস্ট্রোক। জগৎ সভায় শ্রেষ্ঠ আসন...ইত্যাদি ইত্যাদি। সাধারণত এগুলোর খুব ডিটেইলে যাইনা। এক্ষেত্রে একটু গেলাম। কারণ নিজে সরাসরি এই ইন্ডাস্ট্রিতে, এই একই কাজের সাথে যুক্ত।
যে চিপগুলো দেখা যাচ্ছে সেগুলো বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের ডিজাইন করা। এবং সম্ভবত চন্ডীগড় এর সেমিকন্ডাক্টর ল্যাবরেটরিতে তৈরি করা হয়েছে। এখানে বলা বাহুল্য সেমিকন্ডাক্টর ল্যাবরেটরি ভারতের একমাত্র যায়গা যেখানে সেমিকন্ডাক্টর চিপ তৈরি হয়। প্যাকেজিং নয়, অ্যাসেম্বলি নয়, সরাসরি ওয়েফার তৈরি করা হয়। চিপ তৈরির সবথেকে জটিল, সবথেকে রিস্কি এবং সবথেকে লাভজনক ব্যাবসা।

কিন্তু এখানে অনেকগুলো কিন্তু আছে। চন্ডীগড় এর এই ল্যাবের টেকনোলজি অন্তত ২৫-৩০ বছর পুরানো। ১৮০ ন্যানোমিটার CMOS নোডের ওপর বেস করে এই প্রসেসর তৈরি হয়েছে। এর নীচে কিছু বানানো সম্ভব নয় সেখানে। প্রযুক্তি বা এক্সপার্টাইজ নেই। কতটা পুরানো এই প্রযুক্তি? আপনি যে ফোনে এই লেখাটা পড়ছেন, তার প্রসেসর নোড ৩ থেকে ২২ ন্যানোমিটার এর মধ্যে। এবার সেটাকে ১৮০ ন্যানো র সাথে তুলনা করুন। ১ ন্যানোমিটার মানে এক মিটারের ১০ কোটি ভাগের এক ভাগ।
নোড কি? খুব সহজে বললে নোড মানে একটা চিপের মধ্যে একটা ট্রানজিস্টার এর একটা ছোট্ট অংশের মাপ (গেট বলা হয়)। সেটা যত ছোট হবে ট্রানজিস্টার তত ছোট হবে আর তত একটা চিপের মধ্যে বেশী সং্খ্যায় ট্রানজিস্টার ঠেসে দেওয়া যাবে। অনেক বেশী অপারেশন একসাথে করা যাবে। একটা আধুনিক মোবাইলের প্রসেসর চিপের মধ্যে ১০-২০ কোটি ট্রানজিস্টর থাকতে পারে।
১৮০ ন্যানোমিটার নোড কম্পিউটার, মোবাইল বা খুব উন্নত কোনও প্রসেসরে আজ থেকে ২৫ বছর আগে ব্যবহার হত। এখন এই নোড মূলত গাড়ী বা মেডিক্যাল ডিভাইসে ব্যবহার হয়।
তার মানে তো ইন্ডিয়া দারুণ ব্যবসা করছে গাড়ি বা মেডিক্যাল ডিভাইসের চিপ বানিয়ে? না। একদমই নয়। কারন চন্ডীগড় এর এই ল্যাবে বানিজ্যিক ভাবে একটাও চিপ তৈরি হয়না। এদের একমাত্র কাস্টমার হল ইসরো বা DRDO. কারন সেখানে সস্তায় দেবার বাধ্যবাধকতা নেই আবার বিশাল পরিমাণে কিছু তৈরিও করতে হয় না।
কেন বানিজ্যিক চিপ তৈরি হয় না? কারন হল প্রফিটেবিলিটি। একটা চিপ বানাতে যদি এক মিলিয়ন ডলার খরচ হয়, তাহলে পরের ১০০ মিলিয়ন চিপ বানাতে ১ ডলার করে খরচ হবে। মনে করুন কয়েক কোটি ট্রানজিস্টর আছে একটা ৫ মিলিমিটার জায়গায়। সেগুলো আবার একটা আরেকটার সাথে বৈদ্যুতিক ভাবে যুক্ত, মানে বাড়ির অয়ারিং আর কি। এবার তাহলে সেরকম একটা সিস্টেমের ভেতর, অন্তত কয়েকশো কোটি জাংশন আর ইন্টারকানেকশন থাকবে। আর সেই ছোট্ট সার্কিট সিলিকনের ওপর বানানো হবে। একটা প্রফিটেবল প্রসেসে ইল্ড ৯০-৯৯% অব্দি হতে পারে। মানে প্রতি ১০০ টা চিপে ৯৯ টা এই কয়েকশো কোটি জিনিসপত্র ঠিকঠাক তৈরি হয়েছে। কোথাও একটাও ভুল নেই। মাত্র একটা কোথাও কানেকশন খারাপ হলে গোটা চিপ কাজ করবে না। এই লেভেলের প্রযুক্তিগত প্রেসিশন মান্য করা হয়। এবং ইঞ্জিনিয়ার রা সেটা করতে সক্ষম। চিপ ইন্ডাস্ট্রি তে যেসব প্রসেস আছে সেগুলো সম্ভবত মানবজাতির বানানো সবথেকে স্টেবল এবং সবথেকে কন্ট্রোলড প্রসেস। সেগুলোর জন্য দরকার টাকা,প্রচুর স্কিলড ওয়ার্কার আর লাভের কথা না ভেবে প্রচুর প্রাথমিক ইনভেস্টমেন্ট। চন্ডীগড় এর ল্যাবে এগুলোর কোনওটাই নেই। তাই mass প্রোডাকশন হয় না।
যা দেখছেন এই ছবিতে তার প্রযুক্তি অন্তত ২৫ বছর আগেকার।
মোদী সরকার গুজরাটে একটা ফ্যাবরিকেশন ফেসিলিটি বানানোর চেষ্টা করছে।।এছাড়া অন্য কোনও উদ্যোগ আপাতত নেই। সেট কতটা সফল হবে সময় বলবে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন