ভাবতে খুব অবাক লাগে যে লেনিন কি কোনো জাদুমন্ত্র বলে জানতে পেরেছিলেন যে ভারতের নামের একটি দেশে একটি বামপন্থী দলের একটি ফ্যাসিবিরোধী মঞ্চে যোগদানকে ঘিরে গোটা বঙ্গ রাজনীতি তে আলোড়ন পরে যাবে গোটা জুলাই মাস ঘিরে? যে যোগদানকে আপোস হিসেবে চিহ্নিত করতে ওই দলের একদল কর্মী সমর্থক উঠে পরে লাগবেন।
সেই দল যারা ঘোষিত ভাবে মার্কসবাদী লেনিনবাদী তাদের অভ্যন্তরীণ এই বিতর্ককে মাথায় রেখেই কি লেনিন আস্ত একটা প্রবন্ধ লিখে ফেলেছিলেন তার ব্যস্ত জীবনের মাঝে সময় বের করে? ঠিক কি লিখেছিলেন লেনিন একটু দেখা যাক। [সূত্র: লেনিন কালেক্টেড ওয়ার্কস ভলিউম ২৫ পৃষ্ঠা ৩০৯-৩১৪]
যে কোনো বিতর্কিত বিষয় নিয়ে লেখার সময় লেনিন যে ভাবে শুরু করতেন এই প্রবন্ধটা ও সেভাবেই শুরু করছেন, আপোস শব্দটা র একটি সংজ্ঞা নির্মাণ করে। তাঁর ভাষায়, "রাজনীতিতে আপোস শব্দটি বোঝায় নির্দিষ্ট
কিছু দাবির আত্মসমর্পণ, অন্য দলের সাথে চুক্তির মাধ্যমে অন্যদলের দাবির কিছু অংশ ত্যাগ করা।"
এরপরে লেনিন ওই আপোস নিয়ে তার পার্টির দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাখ্যা দেয়া শুরু করেছেন। লেনিন বলছেন, "বলশেভিকদের সম্বন্ধে রাস্তায় ঘোরাফেরা করা একজন সাধারণ মানুষের স্বাভাবিক ধারণা, যে ধারণা যে অপবাদ সংবাদপত্রের জগৎ উৎসাহের সাথে প্রচার করে, সেই অপবাদটি হল বলশেভিকরা কখনই কারও সাথে আপস করতে রাজি হবে না।
মনোযোগী পাঠকের কাছে আশা করা যায় যে এই শব্দগুলি নজর এড়িয়ে যাবে না, "সংবাদপত্রের উৎসাহ"। বামপন্থীদের নিজেদের মধ্যে এই দ্বন্দ্ব দেখে, সংবাদ মাধ্যম কি ভাবে উল্লাস করেছে এই গোটা জুলাই মাসটা ধরে, কি ভাবে পার্টির মধ্যেকার ফাটলটা আরো চওড়া করা যায় উৎসাহ যুগিয়ে, কোনো আপোস নয় এই স্লোগানকে চ্যাম্পিয়ন করার মাধ্যমে কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে আপোসপন্থী হিসেবে দাগিয়ে দিয়ে সেটা লেনিন বোধ হয় মুসোলিয়ামে শুয়ে শুয়ে দেখছেন আর হাসছেন।
বিপ্লবী প্রলেতারিয়েতের পার্টি হিসেবে এই ধারণাটি আমাদের কাছে চাটুকারিতা মাত্র, কারণ এটি প্রমাণ করে যে এমনকি আমাদের শত্রুরাও সমাজতন্ত্র এবং বিপ্লবের মৌলিক নীতির প্রতি আমাদের যে আনুগত্য রয়ে গেছে সেটা স্বীকার করতে বাধ্য হয়। তবুও, আমাদের বলতে হবে যে এই ধারণাটি ভুল।"
কেন ধারণাটি ভুল, সেটি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে লেনিন তুলে এনেছেন এঙ্গেলস যেভাবে ব্ল্যাঙ্কিপন্থী কমিউনিস্টদের সমালোচনা করেছিলেন সেই উদাহরণের কথা যেখানে এঙ্গেলস উপহাস করে বলছেন, "কোন আপস নয়!" এটি একটি ফাঁকা বুলি মাত্র, কারণ পরিস্থিতির জন্য প্রায়শই লড়াকু পার্টির উপর আপোষ করার বিষয়টা অনিবার্যভাবে চেপে বসে, এই বিষয়টা অস্বীকার করা অযৌক্তিক।" [মার্ক্স এঙ্গেলস সংগৃহীত রচনাবলী]।
এঙ্গেলস এর এই শিক্ষার সাথে লেনিন যোগ করছেন, "একটি সত্যিকারের বিপ্লবী পার্টির কাজ এটা ঘোষণা করা নয় যে, সমস্ত আপস ত্যাগ করা অসম্ভব, তার কাজ হল এটাই যে, সব রকম আপসের মাধ্যমে, যখন সেগুলি অনিবার্য হয়, তখন তার নীতির প্রতি, তার শ্রেণির প্রতি, তার বিপ্লবী উদ্দেশ্যের প্রতি সৎ থাকতে থাকতে পারার মধ্যে দিয়ে বিপ্লবের পথ প্রশস্ত করা এবং জনগণকে বিপ্লবে বিজয়ের জন্য শিক্ষিত করা"
আপোস শব্দটা শুনলেই যে সব কমিউনিস্টদের রক্ত গরম হয়ে ওঠে, তাদের উদ্দেশ্যে লেনিনের সাবধানবাণীর তাৎপর্য এটাই যে, পরিবেশ পরিস্থিতি না বুঝে একগুঁয়ে এর মতো আপোস এর বিরোধিতা করার অর্থ হল ব্ল্যাঙ্কিপন্থায় আত্মসমর্পণ করা, এককথায় অতিবাম বিচ্যুতি, বাম সংকীর্ণতাবাদ।
এই অবধি পড়ে যে সব আপোস পন্থীরা আহ্লাদে লাফালাফি করবেন আর যে সব আপোস বিরোধীরা এই লেখক কে দালাল ফালাল বলে দাগিয়ে দেয়ার তোড়জোড় করবেন তাদের একটাই অনুরোধ, আরেকটু পড়তে হবে। কারণ মূল প্রবন্ধের লেখকের নাম ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিন, সফল বিপ্লবের বিচক্ষণ জনক হওয়ার পাশাপাশি তিনি সর্বকালের অন্যতম সেরা বিপ্লবীও বটে। তিনি জানতেন যে বাম সংকীর্ণতা বাদ এর গাড্ড থেকে পার্টিকে বাঁচাতে গিয়ে সেটা আবার ডান পন্থী বিচ্যুতির দিকে ঢলে না যায়। তিনি জানতেন যে সংশোধনবাদী এরা ভবিষ্যতে আপোস নিয়ে ওপরে লেখা তাঁর বক্তব্যকে প্রেক্ষিতহীন উদ্ধৃতি হিসেবে ব্যবহার করার লোভ সামলাতে পারবে না।
তাই একজন আদ্যন্ত দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী হিসেবে লেনিন এইবার আসছেন আপোস প্রসঙ্গে তাঁর দ্বিতীয় পয়েন্টে। আপোস করার দুটি স্পষ্ট ভাগ করছেন উনি। এক, যেখানে পরিস্থিতির চাপে বাধ্য হয়ে আপোস করতে হয় কমিউনিস্ট পার্টিকে আর দুই, যেখানে সেই পরিমাণ বাধ্যবাধকতা নেই, কমিউনিস্ট পার্টি স্বেচ্ছায় আপোস করার রাস্তা বেছে নিচ্ছে।
প্রথম পরিস্থিতির চেয়ে দ্বিতীয় পরিস্থিতির গুরুত্ব কিছু কম নয়, বরঞ্চ বেশি। কারণ সেখানে আপোস করা বা না করা দুটি পার্টি কৌশল প্রয়োগ করার রাস্তা খানিকটা খোলা আছে। সেই পরিস্থিতি তে কমিউনিস্ট পার্টি কি করবে ? লেনিন একটা ফ্রেম ওয়ার্ক তৈরি করার চেষ্টা করছেন, যার জরুরী পয়েন্ট গুলি হল:
এক) কমিউনিস্ট পার্টি কোনো অবস্থাতেই তার সরাসরি এবং প্রধান শ্রেণী শত্রু বুর্জোয়া পার্টি গুলিকে কোনো সমঝোতার প্রস্তাব দেবে না, বড়োজোর মেনশেভিক ও সোস্যালিস্ট রেভ পার্টির মতো পাতি বুর্জোয়া দলগুলিকে দিতে পারে, তারা শাসক দল হলেও;
দুই) এই আপোস সমঝোতাকে একটি ব্যতিক্রমী ঘটনা হিসেবে ধরতে হবে, রুটিন নয়,;
তিন) এই সমঝোতা আপোস হবে অতি স্বল্প মেয়াদী ঘটনা, কোনো পাকাপাকি বন্দোবস্ত নয়;
চার) এই আপোস এর সিদ্ধান্তে ভবিষ্যতে কমিউনিস্ট পার্টি আরো শক্তিশালী হবে নাকি, বিপ্লবের পথ আরো সুগম হবে নাকি।
ফ্যাসিবিরোধী মঞ্চে কমিউনিস্ট পার্টির যোগদানের সিদ্ধান্তকে এইবার আপোস বিরোধী ও আপোসপন্থী দু'দল ই যদি এই লেনিনিয় ফ্রেম ওয়ার্ক এ ফেলে বিচার করেন তাহলে কমিউনিস্ট পার্টির এই অবস্থান নিয়ে কোনো বিতর্ক থাকার কথা নয়। মুশকিল টা এইখানেই যে কমিউনিস্ট পার্টির সভ্য সমর্থকদের একটা বড় অংশ বিতর্কের বদলে বিশ্বাসে আস্থা রাখেন, "বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহুদুর।"
একদল মনে করেন যে পলিটব্যুরো কোনো ভুল করতে পারে না, প্রায় কিং ক্যান ডু নো রং এর ঢংয়ে। অন্যদলের বিশ্বাস যে যাবতীয় প্রজ্ঞার উৎসস্থল হল জনগণের সাথে নিবিড় সংযোগ। ঠাণ্ডা ঘরে থাকা পলিট ব্যুরো থোড়াই জানে শ্রেণী শত্রুর হাতে সদ্য লাঞ্ছিত নিপীড়িত সংগ্রামী জনগণের মনের কথা।
ভাবের ঘরে চুরি সেটা চুরিই। দু পাতা লেনিন পড়ে নিজেকে লেনিনের থেকেও বড় মার্কসবাদী ভেবে নেয়াটা যেমন ভুল, তেমনি পঞ্চায়েতে বুক দিয়ে বুথ আগলিয়েছেন বলেই ডলোরেসস ইবারুরি স্টাইলে "নো পাসারণ" বলে হুংকার ছাড়াটাও ভুল। ভাববাদের চর্চা তো অনেক হল, এবার কিঞ্চিৎ বস্তুবাদের চর্চা হোক, দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের। বিতর্ক হোক সেই পথ ধরে। লেনিন পথ দেখাবেন।