শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

পারি কমিউন ~ ডঃ সমুদ্র সেনগুপ্ত

২৯ শে মার্চ, সকালে দুই লক্ষ 'হতভাগা' তাদের  নির্বাচিত প্রতিনিধিদের টাউন হলে অধিষ্ঠিত করার জন্য জড়ো হল। বাজনা বাজে - রক্ষী বাহিনীর সঙ্গীনের মাথায় লাগানো ছোট ছোট লাল পতাকা। শোভাযাত্রা করে চারধার থেকে সৈনিক আর নাবিকরা আসছে। মানুষের হাজারো ছোট স্রোত মিলিত হয়ে সৃষ্টি করল এক জনসমুদ্র। রক্ষী-বাহিনীর সঙ্গীনে সূর্যকিরণের ঝলমলানি। সভামঞ্চ অগণিত পতাকায় সাজানো - লালপতাকার ভিড়ের মধ্যেও দু-একটা ত্রিবর্নরঞ্জিত পতাকাও রয়েছে। গানে গানে মুখর এই সব- ব্যান্ডে লা-মার্শাই এর সুর: বিউগল বেজে উঠল - কামান দাগার সংকেত। কমিউনের কামান গর্জন করে উঠল।

মঞ্চে একে একে উপস্থিত হলেন কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য আর কমিউনের সদস্যবৃন্দ। সকলের গলায় লাল স্কার্ফ জড়ানো। রেনভিয়ে সভা উদ্বোধন করলেন, "নাগরিকবৃন্দ, আমার হৃদয় আজ আনন্দে ভরে উঠেছে - আমি আনন্দে কথা বলার ক্ষমতা হারিয়েছি। আপনাদের অনুমতি নিয়ে, আমি প্যারিসের মানুষকে অভিনন্দন জানাচ্ছি। তাঁরা গোটা পৃথিবীকে পথ দেখালেন।"

তারপর নির্বাচিত সদস্যদের নাম পড়া হল। কমিউনের লাল পতাকাকে অভিবাদনের বাজনা বেজে উঠলো। দু লক্ষ লোক সমস্বরে মার্শাই গেয়ে উঠল। আবার নিস্তব্ধতা। সেই নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে রেনভিয়ে-র কন্ঠ থেকে নির্গত হল: "জনগণের নামে আমি কমিউনের প্রতিষ্ঠা ঘোষণা করলাম।" সহস্রকণ্ঠে প্রতিধ্বনি - কমিউন দীর্ঘজীবী হোক ! ভিভা লা কমিউন !! পৃথিবী নামক গ্রহের বুকে মানুষ নামক জীব তার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো পার্টিসিপেটরি ডেমোক্রেসির স্বাদ পেয়ে আনন্দে উদ্বেলিত, উচ্ছ্বসিত। 

আজ এত বছর বাদে আবার এক ২৯সে মার্চ আমরা যদি ফিরে দেখি তাহলে আবেগের থরথর রূপকথাসম এই ইতিহাস থেকে রুক্ষ বাস্তবের মাটিতে আছড়ে পড়তে  বাধ্য আমরা কারণ আমরা জানি যে সেই কমিউন, পারি কমিউন, পৃথিবীর প্রথম সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র দু'মাসের বেশি বাঁচে নি। তাকে প্রতিবিপ্লবীরা রক্তে ডুবিয়ে মেরেছিল।  তাহলে কি রেনভিয়ে সেদিন মিথ্যে কথা বলেছিলেন ?

না। উনি মিথ্যে বলেন নি। পারি কমিউন দু'মাসের বেশি বহাল থাকতে পারে নি এটা ঠিক, কিন্তু সেটা সারা পৃথিবী জুড়ে খেটে খাওয়া মানুষের মনে একটা বিশ্বাস তৈরি করে দিয়ে গেছে। নির্বাচন মানেই হল দুটি বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক দলের মধ্যে লড়াই। জনগণের হাতে আর কোনও অপশন নেই, তাকে শাসনকর্তা হিসেবে ওই দুটো দলের মধ্যে একটাকে বেছে নিতে হবে এই বাইনারীর তত্বকে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছিল পারি কমিউন। লেসার ইভল - কম শয়তানদের হাতে আমার জানমালের দায়িত্ব তুলে দিতে বাধ্য নই। আমরা নিজেরাই সক্ষম নিজেদের শাসন করতে - এই বোধ জাগিয়ে তুলেছিল পারি কমিউন। শ্রমিক -কৃষক- মধ্যবিত্তদের নিয়ে তৈরি করা রাজনৈতিক মঞ্চের হাতে পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথমবার ভোট দিয়ে ক্ষমতা তুলে দিয়েছিল জনগণ।

লেসার ইভল - কম শয়তান খুঁজতে আমি আপনি বাধ্য একথা যারা প্রচার করে তাদের সেই তত্ত্বের ওপর সপাটে একটা থাপ্পড় এর নাম পারি কমিউন। পারি কমিউন ইজ ডেড। লং লিভ পারি কমিউন।

শনিবার, ২৩ মার্চ, ২০২৪

একটি ল্যাম্প পোস্ট এবং ৬২৩টি মেয়ে ~ ডঃ সমুদ্র সেনগুপ্ত

পাশের বাড়ির বৌদি, বিগত যৌবনা হলেও সাজগোজ করতে কিঞ্চিৎ ভালোবাসেন। আপনি আড় চোখে দেখেন আর পাড়ার চায়ের ঠেকের খাপ পঞ্চায়েতে তাকে আখ্যা দেন ঢলানি মেয়েছেলে বলে। অফিসে নতুন কাজে জয়েন করা মেয়েটি স্বচ্ছন্দে সবার সাথে মেলামেশা করছে দেখে আপনি তাকে আখ্যা দেন বেহায়া বলে। বন্ধু'র কনিষ্ঠ কন্যা, সদ্য কলেজ ছাত্রীকে জিন্স পরতে দেখলে, সিগারেট ফুঁকতে দেখলে আপনার স্থির সিদ্ধান্ত হয়, মামনি গোল্লায় গেছে। শাড়ির আঁচল অবিন্যস্ত দেখলে আপনার ল্যাম্প পোস্টের নিচে দাঁড়ানো মেয়েদের কথা মনে পড়ে। একটা সময় পশ্চিম ইউরোপের ইতালিতে মেয়েদের দেখে আপনার মতো কিছু নীতি পুলিশ সাজা কাকু/ কাকিমা ওই সিদ্ধান্তে আসতেন যে ওদেশের মেয়েগুলি কিঞ্চিৎ বেহায়া, ঢলানী ও বয়ে যাওয়া এম্পটি হেডেড। অথচ কি আশ্চর্য্য দেখুন ওদেশের সেই মেয়েগুলি দ্বিতীয় বিশ্ব মহাযুদ্ধের সময় কি অবাক কান্ডই না ঘটিয়ে ছিল। আপনার নিশ্চয়ই জানা আছে যে ওই ইতালি দেশটাতেই ফ্যাসিবাদ নামক কুখ্যাত মতবাদের জন্ম। ইউরোপের আর পাঁচটা দেশেও ফ্যাসিস্ট আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ওই দেশে ফ্যাসিবাদ বিরোধী সশস্ত্র প্রতিরোধ বাহিনী, যাদের পার্টিজান বলে, সেটা গঠিত হয়ে ছিল। কিন্তু আপনার কি জানা আছে যে দু লক্ষ পঞ্চাশ হাজার সংগ্রামী মানুষ দ্বারা গঠিত সেই বাহিনীর  এক লক্ষ পাঁচ হাজার মানে প্রায় চল্লিশ শতাংশ সদস্য ছিল মহিলা ? যারা পুরুষ কমরেডদের পাশাপাশি স্টেনগান হাতে নিয়ে লড়াই দিয়েছিল ? আজ্ঞে হ্যাঁ যেই "বেহায়া", "ঢলানি" "মেয়েছেলে"র দল। আপনাকে কেউ কি কোনোদিন বলেছে যে ওই মেয়েদের মধ্যে চার হাজার ছশ জন গ্রেপ্তার হয়েছিল, দু হাজার সাতশো পঞ্চাশ জনকে পাঠানো হয়েছিল বিভিন্ন কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে। ওই মহিলাদের আত্মত্যাগ বিফলে যায়নি কিন্তু। ফ্যাসিবাদীদের পরাজয় হয়েছিল। আঠাশ এপ্রিল, ১৯৪৫ ফ্যাসিবাদের সবচেয়ে বড় নায়ককে পার্টিজানরা গুলি করে মারে। মেরে ফেলে দিয়ে যায় মিলান এর প্রধান রেল স্টেশনের চত্বরে। যার পরে ক্রুদ্ধ বিক্ষুব্ধ জনতা পাশবিক আক্রোশে সেই একনায়কের মৃতদেহ উল্টো করে ঝুলিয়ে দেয় ল্যাম্পপোস্টে, জনতা জড়ো হয়ে উল্লাস করে সেই ল্যাম্পপোস্টের নিচে। এর পরে সবাই ঘরে ফেরে। মেয়েরা বন্দুক ফেলে ফিরে যায় অভ্যস্ত জীবনে, ঘরকন্নয়, গেরস্থালির কাজে, মাঠে ফসল তোলার কাজে, ফ্যাশন শো এর রেম্পে। ফেরেনি কেবল ফ্যাসিস্ট/ নাৎসি বাহিনীর হাতে শহীদের মৃত্যু বরণ করা ছশো তেইশ জন মহিলা পার্টিজান। কোনো অজানা সবুজ পাহাড়ের কোলে, আরো সবুজ শান্ত গাছের ছায়ায় তারা চিরকালের মতো ঘুমিয়ে আছে। তাদের মিনি স্কার্ট হাই হিলের খুট খুট শব্দে মুখরিত হবে না আর মিলানের পাথর বাঁধানো রাস্তা। যখনই কেউ "ঢলানি মেয়েছেলে" দের শরীর নিয়ে কথা বলে, মেয়েদের "ডিগনিফায়েড" বেশভূষা নিয়ে জ্ঞান দিতে আসে তখনই কেন জানি সেই মেয়েদের কথা মনে পড়ে যায়। গুডবাই বিউটিফুল। বেলা চাও, বেলা চাও, বেলা চাও চাও চাও।

সন্দেশখালির সাতকাহন ~ রাধাবল্লভ রায়


রায়মঙ্গল-কলাগাছি নদীর কূল ধরে সন্দেশখালির মণিপুর, আতাপুর, ধুচনিখালি, শীতলিয়া। এগুলি একটু পুরনো আবাদ। ওই ধরুন, গত শতকের প্রথম দিকে বা তার একটু আগে আবাদ হয়েছে। লট অঞ্চল। কলকাতার বাবুদের পয়সায় বন-জঙ্গল কাটা হয়েছিল। দারুণ জমি সব। ধান হতো দেখার মতো। বছর সাত-আট আগেও সবুজ ধানের ক্ষেতে মায়াবি ঢেউ খেলে যেত। কিন্তু এখন সে সব নেই প্রায়। সবুজ ধানক্ষেতের জায়গায় ঘোলা-বোবা জল। সেই জলের বুকে ঢেউ ওঠে ঠিকই। কিন্তু সেখানে আকাশের ছায়া পড়ে না, সবুজশাড়ি পরা গ্রাম পুকুরের জানালায় উঁকি মারে না। বোবা-বধির ফিসারি মাঠ। অদ্ভুত এক আঁধারের মধ্যে সে শুধু টাকা প্রসব করে। কোটি কোটি টাকা। সে টাকার কোনও মা-বাপ নেই। জারজ। কিন্তু জারজ হলে কী হবে রাজা-বাদশারা তার কদর বোঝেন। এককালে এখানকার গরিব চাষিদের ঘামরক্ত ভেজা খাজনার পয়সায় জমিদারবাবুদের নাচমহলের ঝাড়বাতি গৌরব ছড়াত। কল্লোলিনী কলকাতায় টাকা উড়ত। আর এখন সন্দেশখালি-গোসাবার পাড়ায় পাড়ায় নাচমহল। ডান্স হাঙ্গামার মত্ত আসরে টাকা ওড়ে। জারজ টাকা। পাড়ায় পাড়ায় রাজা-বাদশা। ঘরে ঘরে শাহাজাদা। বিহার-উত্তর প্রদেশ থেকে নাচনি আসে জুয়ামেলার জলসায়। সেখানে টাকা উড়িয়ে কোমর দোলান পঞ্চায়েত প্রধান, ডিলারবাবু, সমিতির নেতা থেকে ভেড়িমালিক সবাই। কম যান না পরিযায়ী শ্রমিকেরাও। আলোর ঝলকানির সঙ্গে ডিজে মিউজিক ডুম ডুম। তন্বী নৃত্যপটিয়সীর শরীরের ভাঁজে ভাঁজে জারজ বেহিসেবী টাকার চুম্বন, শীৎকার। তারপর অদ্ভুত অশ্লীল এক আঁধারের মধ্যে টাকাদের পাখনা হয়। তারা নতুন মহলবাড়ির চিলেকোঠায় উড়ে যায় সুখসন্ধানী কবুতরের মতো। আর জুয়ার নেশায় ফতুর হয় চাষির সন্তান। হারিয়ে যায় আবাদি মাটির নতুন প্রজন্মের ভবিষ্যৎ। লোনাজল আর মাদকজল পাল্লা দিয়ে মুছে যায় সন্দেশখালির কয়েক প্রজন্ম ধরে অর্জিত শিক্ষা-দীক্ষা-সংস্কৃতি।  এবারে সর্বার্থে সর্বহারা হয় কৃষক। নিভে যায় তাঁদের কঠিন সংগ্রামের কথা। যে সংগ্রাম এগিয়ে চলেছিল আলোর পথে। বিজ্ঞান, যুক্তিবাদ এবং শিক্ষা-সংস্কৃতির পথে।

      সন্দেশখালির ভুবন মণ্ডলের কথা এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে গেল। আমার বাড়ি সন্দেশখালি নয়। তবু ভুবন মণ্ডলকে আমি চিনি। সরকারপাড়ার ভুবন মণ্ডলের বয়স এখন সাতাত্তর। খুলনা জেলার পাইকগাছা থেকে এদেশে যখন এসেছিল তখন ওর বয়স ছিল সতেরো। হজরতবাল মসজিদের ঘটনা নিয়ে ওদেশে গোলমাল শুরু হতে ১৯৬৪ তে ওরা সপরিবারে হাসনাবাদে এসে ঠাই নিয়েছিল। তারপর সেখান থেকে দণ্ডকারণ্য। কিন্তু ভুবন বাবা-মায়ের সঙ্গে যায়নি। শীতলিয়ার বাছাড় বাড়িতে গরু রাখালির কাজে ভর্তি হয় সে। বাছাড়েরা ধনী লোক। তিন-চারশো বিঘে জমি। ভুবন প্রথম বছর পেটেভাতে কাজ করত। তারপর এক সন্ধ্যায় নিতাই বাছাড়ের গিন্নিকে মা বলে ডাকায় ওর পদোন্নতি হয়। পেটেভাতের রাখাল থেকে মাহিন্দার। ছয়-সাত মণ ধানে সারা বছর খেটে দিত বাবুর বাড়ি। বেশি বেশি খাটত। বাবুরা সন্তুষ্ট হত তাতে। যা কিছু ইনকাম হত সব থাকত নিতাই বাছাড়ের গিন্নির কাছে। বছর চার-পাঁচ কেটে যায় এমনিভাবে। কিন্তু কথায় আছে, অভাগা যেদিকে চায় সাগর শুকায়ে যায়। দুর্ঘটনা ঘটল একটা। এক রাতে বাছাড় বাড়িতে ডাকাত পড়ল। লুঠ হয়ে গেল টাকা-পয়সা সোনাদানা। রাতারাতি নিঃস্ব হয়ে যায় অত বড় বাছাড়বাড়ি। মুখ শুকিয়ে গেল ভুবনের। তিল তিল করে জমানো হাজার কয়েক টাকা নিয়ে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিল সে। জমি কিনবে, বিয়ে করবে। মা-বাবাকে দণ্ডকারণ্য থেকে বাংলায় আনবে। কিন্তু সে সব আর বোধহয় হল না। ভাগ্যলক্ষ্মী তার প্রতি কি এতটাই নির্দয় হবে! মাথার মধ্যে দলাপাকানো একটা চিন্তা টন টন করে ভুবনের। কিন্তু দুর্ভাগ্য একা পথ চলে না। সৌভাগ্যও তার পিছনে থাকে।

      এক সকালে অদ্ভুত এক আলো ভাদুরে ধান ক্ষেতে খেলা করছিল। ভুবন সেদিকে তাকিয়ে মাথায় হাত দিয়ে বসেছিল। বাছাড়গিন্নি দোতলার জানালা থেকে দেখতে পায় তাকে। সেইদিন দুপুরে ভুবনের ভাগ্য ফেরে। একসঙ্গে অনেকটা আলো যেন তার দুর্গম যাত্রাপথটি সুগম করে দেয়। সন্দেশখালির সরকার পাড়ায় বাছাড়গিন্নির বাপের বাড়ি। কুসুম তার খুড়তুতো ভাইয়ের মেয়ে। ভুবনের সঙ্গে তার বিয়ে ঠিক করেন তিনি। বিস্ময়ভরা চোখে সে ফিরে তাকাতে বাছাড় গিন্নি বলেছিলেন, " সাত নম্বরের কলোনিখাল পাড়ের চারবিঘে জমি তুই নে। সংসারধর্ম কর। তিনবিঘে জমি তোর টাকায়, আর এক বিঘে আমার আশীব্বাদ। যা।" ভুবন গিন্নিমাকে ঢপ করে একটা প্রণাম করতে বাছাড়গিন্নি ওর মাথায় হাত রেখে বলেছিল, "সবসময় আলোর পথে থাকবি। আঁধারে হাঁটবি না। তাহলি শান্তিতে থাকবি দেখিস। এইটি আমার পরামশ্য।"

      সে বছর স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম হল। আর ভুবন শুরু করল নতুন জীবন। বাড়ি করল, বিয়ে করল, মা-বাবাকে মানা ক্যাম্প থেকে নিয়ে এল। তারপর অনেক কাল কেটে গেছে। দুই ছেলে আর দুই মেয়ে ভুবনের। নিজে হাতে তাদের লেখাপড়া শিখিয়েছে, বিয়ে দিয়েছে। জমির পরিমাণও বাড়িয়েছে কয়েক বিঘে। এখন সে বৃদ্ধ। খাটাখাটনি করতে পারে না আর। বড় ছেলের কাছে থাকে। কিন্তু মনে তার শান্তি নেই। তাহলে কি আলোর পথ থেকে সে বিচ্যুত হয়েছে? অথচ সারাজীবন বাছাড় গিন্নির দেখানো পথেই তো থাকতে চেয়েছে সে। নাতি-পুতিদেরও এগিয়ে দিতে চেয়েছে সেই পথে। তারা লেখাপড়া করুক, প্রতিষ্ঠিত হোক, জগতকে চিনুক। কিন্তু এইখানে ঘটে গেছে বিভ্রম। নতুন সময়ে ভুবনের ছেলেমেয়ে এবং নাতিপুতিরা কোন পথে চলেছে সে আর বুঝতে পারে না। ওরা জমি বোঝে না, টাকা বোঝে। শিক্ষা বোঝে না, স্ট্যাটাস বোঝে। শান্তি বোঝে না, ক্ষমতা বোঝে। সিভিক ভলেন্টিয়ার হয়েছে একজন। মোটরবাইকে গাঁক গাঁক করে ছোটে আর পাড়াসমেত চমকায়। পার্টির মিছিলে হাঁটে আর বোতল বোতল মদ খায়। পঞ্চায়েতবাবুদের সঙ্গে তার ওঠাবসা। মান্যিগণ্যি করে লোকে। ভুবন এটাকে আলো বলবে না আঁধার বলবে বুঝে পায় না। অনুদানের টাকায় পাকা বাড়ি বানিয়েছে সেই নাতি। একটা নয়, দু-দু'খানা। কিন্তু বাড়ির মধ্যে লক্ষ্মীশ্রী নেই, শান্তি নেই। শান্তি নেই ভুবনের মনেও। জমিগুলো চলে গেছে সেখবাবুদের ফিসারিতে। লোনাজল তো বারণ মানে না কোনও। এক ঘেরিতে দু-চারজন রাজি হয়ে গেলে বাকি সকলের কপাল পোড়ে যে। ভুবনের সেই আলোর পথ, সাত বিঘে জমিও এখন লোনাজলের তলায়। কী করবে ভুবন?

      সাত বিঘে জমি থেকে লিজবাবদ বছরে আয় বিয়াল্লিশ হাজার টাকা। দুই কিস্তিতে দুই ছেলে নগদানগদি বুঝে নেয়। ভুবন কিছুই বলতে পারে না। যে জমির সঙ্গে তার জীবন জড়িয়ে সেই জমি আর নেই ভাবতে গিয়ে কষ্ট হয় তার। কিন্তু নিরুপায় সে। সময়কে মেনে নিতেই হয়। চাষবাস উঠে যেতে ওর ছেলেরা এখন সংসার ছেড়ে মহারাষ্ট্রের নাসিকে। বিল্ডিং-এর কাজ করে। মাসে মাসে টাকা আসে বৌমাদের একাউন্টে। আবার সরকারি অনুদান আছে। মাসে মাসে রেশনের চাল, আয়লার চালও। ঘরে ভাতের অভাব নেই। তবু কোনও এক অজানিত কারণে বুকটা ধড়ফড় করে তার। সামনে কোথাও আলো দেখতে পায় না সে। নাতিরা বলে, "এ বুড়ো জমি জমি করে মরলো যে! বুদ্ধি হবে কবে তোমার? শ্মশানে গেলি? ভাবতি পেরেছিলে কোনওদিন পাকা ঘরে শোবে?" ভুবন বোকার মতো তাকিয়ে থাকে ওদের দিকে।

      ভুবনের বড়ছেলের ছোট মেয়েটা ক্লাস নাইনে পড়তে পড়তে বিয়ে করেছে। শরীর হয়নি, তবু শাঁখা-চুড়িতে ঠমক দেয়। মেজ মেয়েটা ডান্স হাঙ্গামার দলের সঙ্গে নিরুদ্দেশ হয়েছিল। তারপর বিহারের এক যৌনপল্লিতে তার খোঁজ মেলে। কিন্তু বাড়িতে ফেরানো যায়নি আর। ফিসফাস কানে এসেছে, মেয়েবাবদ এক লাখ টাকা পেয়েছে বড় ছেলে। সেই টাকায় ফ্রিজ আর রঙিন টিভি কিনেছে বড়বৌমা। ভুবন কিছু বলে না, শুধু দেখে। কেননা সে বুঝতে পারে না এগুলো আলো নাকি অন্ধকার। ছোট ছেলের ছেলেমেয়ে দুটো বই-খাতার বদলে রাতদিন মোবাইল নিয়ে বসে থাকে। হাসি-কান্না সব সেখানেই। খেলার মাঠ ছেড়ে ওরা মোবাইলে মজে থাকে। ছোট বৌমা কিছু বলতে দেয় না। এগুলি শেখা নাকি দরকার। এখানেও ভুবন নিরুপায়। আলো নাকি আঁধার সে ধোঁয়াশা ঘোচে না তার কিছুতেই। ছোট বৌমা গ্রামে হনুমান মন্দির বানানোর জন্য চাঁদা তোলে পাড়ায় পাড়ায়। কখনও মনে ভেবেছে ওটাই বোধহয় আলো। কিন্তু দু-চারদিন ছোট ছেলের বাড়িতে থাকার পর তার মোহভঙ্গ হয়েছে। এপাড়ার নতুন নেতা বিপ্লব হাজরার সঙ্গে ছোটবৌমা কলকাতায় যায় প্রতি সপ্তায়। ছেলের অনুপস্থিতিতে সে-ই এ বাড়ির মালিক। রাত কাটায় এবাড়িতে। গ্রামের লোকে পাঁচ কথা শোনায়। কিন্তু ভুবন বুঝে উঠতে পারে না আলো নাকি অন্ধকার। তাই কিছু বলা হয় না তার। ধানমাঠের লোনাজলের মতো অশান্তির ঢেউ রাতদিন ফেনা তোলে তার মুখের কাছে, বুকের কাছে। গ্যাস্ট্রিকের চুয়া ঢেকুরে পেট জ্বলে যায়, বুক জ্বলে যায়। একটা লাঠি হাতে খালপাড়ে বসে শুকনো মাটির গায়ে দাগ কেটে যায় সে সকাল-বিকেল।

      ভুবনকে চেনা লাগতে পারে আপনাদের অনেকের। এত নিচে দৃষ্টি পড়ে না তো, তাই হয়ত মনে থাকে না। কিন্তু দেখলে নিশ্চয়ই চিনতে পারবেন। গত কাল থেকে গ্রামে হরি নামের মহোৎসব চলছে। আটখানা মাইকের আওয়াজে হরিনাম হুঙ্কারের মতো ছড়িয়ে পড়ছে ফিসারি জলার বুকে। একবার হরি নামে যত পাপ হরে, জীবের সাধ্য নাই তত পাপ করে। হাজার হাজার মানুষ দু'বাহু তুলে নাচছে ওখানে। একে অপরকে জড়িয়ে জড়িয়ে কাঁদছে। ওই দলের মধ্যে ভুবন আছে নিশ্চয়ই। আলোর পথ খুঁজে না পাওয়ার যন্ত্রণা ওখানে অশ্রুধারায় গড়িয়ে পড়ছে জানি।


শুক্রবার, ১৫ মার্চ, ২০২৪

কার্ল মার্ক্স ~ ডঃ সমুদ্র সেনগুপ্ত

নিজেকে মার্ক্সিস্ট বলে দাবি করার খোয়াব কবেই মিলিয়ে গেছে ঠিক যেমনটা মিলিয়ে যায় সুগন্ধির সুবাস এক নিমেষে যখন দামী এসইউভি গাড়ির দরজা দড়াম করে খুলে দিলে। নিজেকে মার্ক্সসিস্ট বলে দাবি করার খোয়াব মিলিয়ে গেছে বাতাসে বিলাস বহুল বিয়েবাড়ির হাজার টাকা প্লেটের ডিনার শেষের তোলা তৃপ্তির উদগার এর মতো। নিজেকে মার্কসিস্ট বলে দাবি করতে হওয়ার মতো ধৃষ্টতার আর কিছুই অবশেষ বাকি নেই নাগাসাকি বিস্ফোরণ শেষের ধ্বংসস্তুপ এর মতো  দুনিয়ার মাঝখানে দাঁড়িয়ে। তবুও আজকের দিনটায় রাউল, রাউল ব্র্যাংকো কেন যেন ভেসে আসেন চিন্তা চেতনায় নিশির ডাকের মতো। পেরুর স্বৈরাচারী শাসক এর হাতে আগুনে আধপোড়া কবি রাউল মনে করেই দেন, মানুষ মারা গেলেও তার চিন্তা চেতনা বেঁচে থাকে, যদি তিনি হন পৃথিবী এর শ্রেষ্ট চিন্তা নায়ক। কার্ল মার্ক্স ইজ ডেড, লং লিভ কার্ল মার্ক্স।

কার্ল মার্ক্স
---------------------------
মার্ক্স, যখন পুঁজি গোটাচ্ছে তার তহবিল, ছড়াচ্ছে চিহ্ন জড়াচ্ছে ভূগোল, নগ্ন দিগন্তে ধেয়ে উড়ে চলেছে তার প্ৰযুক্তির ডানা;
তখন মার্ক্স, আপনার কণ্ঠস্বর আবারো গমগম করে, গমগম করে।

পুঁজি বারে বারে তারে তারে নাচে কুঁদে অকাতরে,
পুঁজি কর্ক ফুঁসে ওঠা কোকাকোলার বোতলে বোতলে,
পুঁজি নিকারাগুয়া থেকে নাইজেরিয়ার কারখানায়,
পুঁজি ফিক করে হাসা ফিকশনে ফিকশনে,
পুঁজি বেয়নেটে বিদ্ধ পোয়াতি নারীর পেটে,
পুঁজি টুপটাপ টুপটাপ রক্ত আর খুনের লাল ফিনকি,
পুঁজি বাজারে ছন্দে ছন্দে দুলে ওঠা দানবীয় হাত,
পুঁজি খুবলে খাওয়া ডলারের দাঁত বসানো সাম্রাজ্যবাদ;
মার্ক্স, এখানেই অনিবার্য হয়ে ওঠে আপনার কণ্ঠস্বর, আবারো গমগম করে, গমগম করে।

বিপ্লবী শিল্পীদের ভায়োলিনে ভায়োলিনে জাগে আপনার তত্বের মূর্ছনা,
ফিলিপিন্সের গেরিলার বন্দুকে বন্দুকে বেরিয়ে আসে আপনারই তরতাজা অক্ষর সব, মহান মার্ক্স।

বদলাও পৃথিবী, পৃথিবী বদলাও, বদলাও পৃথিবী;
বুলেট ব'লে, বদলাও পৃথিবী,
প্রেম ব'লে, বদলাও পৃথিবী,
ঘৃণা ব'লে বদলাও পৃথিবী,
নদী ব'লে বদলাও পৃথিবী,
মা ব'লে বদলাও পৃথিবী।

তৃতীয় বিশ্বের প্রতিটি শ্রমিকের আর কৃষকের দেহে দেহে, ঘামে ঘামে, জবানে জবানে
আপনি মার্ক্স, ঝলকাতে থাকেন, কেবল ঝলকাতে থাকেন; আর
আপনার তত্ব, বুলেট আর বারুদ হয়ে,
ঘৃণা আর প্রেম হয়ে,
ভাঙ্গন আর নির্মাণ হয়ে বেরোতে থাকে; অবিরাম বেরোতে থাকে।

পুয়েরটরিকো থেকে ফিলিপিন্স,
ব্রাজিল থেকে বাহামাস
মার্ক্স, আপনি মহান মার্ক্স,
থাকেন এইখানে, মুহুর্তের উদ্ভাসনে।

কার্ল মার্ক্স ইজ ডেড, লং লিভ কার্ল মার্ক্স।