২৯ শে মার্চ, সকালে দুই লক্ষ 'হতভাগা' তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের টাউন হলে অধিষ্ঠিত করার জন্য জড়ো হল। বাজনা বাজে - রক্ষী বাহিনীর সঙ্গীনের মাথায় লাগানো ছোট ছোট লাল পতাকা। শোভাযাত্রা করে চারধার থেকে সৈনিক আর নাবিকরা আসছে। মানুষের হাজারো ছোট স্রোত মিলিত হয়ে সৃষ্টি করল এক জনসমুদ্র। রক্ষী-বাহিনীর সঙ্গীনে সূর্যকিরণের ঝলমলানি। সভামঞ্চ অগণিত পতাকায় সাজানো - লালপতাকার ভিড়ের মধ্যেও দু-একটা ত্রিবর্নরঞ্জিত পতাকাও রয়েছে। গানে গানে মুখর এই সব- ব্যান্ডে লা-মার্শাই এর সুর: বিউগল বেজে উঠল - কামান দাগার সংকেত। কমিউনের কামান গর্জন করে উঠল।
মঞ্চে একে একে উপস্থিত হলেন কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য আর কমিউনের সদস্যবৃন্দ। সকলের গলায় লাল স্কার্ফ জড়ানো। রেনভিয়ে সভা উদ্বোধন করলেন, "নাগরিকবৃন্দ, আমার হৃদয় আজ আনন্দে ভরে উঠেছে - আমি আনন্দে কথা বলার ক্ষমতা হারিয়েছি। আপনাদের অনুমতি নিয়ে, আমি প্যারিসের মানুষকে অভিনন্দন জানাচ্ছি। তাঁরা গোটা পৃথিবীকে পথ দেখালেন।"
তারপর নির্বাচিত সদস্যদের নাম পড়া হল। কমিউনের লাল পতাকাকে অভিবাদনের বাজনা বেজে উঠলো। দু লক্ষ লোক সমস্বরে মার্শাই গেয়ে উঠল। আবার নিস্তব্ধতা। সেই নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে রেনভিয়ে-র কন্ঠ থেকে নির্গত হল: "জনগণের নামে আমি কমিউনের প্রতিষ্ঠা ঘোষণা করলাম।" সহস্রকণ্ঠে প্রতিধ্বনি - কমিউন দীর্ঘজীবী হোক ! ভিভা লা কমিউন !! পৃথিবী নামক গ্রহের বুকে মানুষ নামক জীব তার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো পার্টিসিপেটরি ডেমোক্রেসির স্বাদ পেয়ে আনন্দে উদ্বেলিত, উচ্ছ্বসিত।
আজ এত বছর বাদে আবার এক ২৯সে মার্চ আমরা যদি ফিরে দেখি তাহলে আবেগের থরথর রূপকথাসম এই ইতিহাস থেকে রুক্ষ বাস্তবের মাটিতে আছড়ে পড়তে বাধ্য আমরা কারণ আমরা জানি যে সেই কমিউন, পারি কমিউন, পৃথিবীর প্রথম সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র দু'মাসের বেশি বাঁচে নি। তাকে প্রতিবিপ্লবীরা রক্তে ডুবিয়ে মেরেছিল। তাহলে কি রেনভিয়ে সেদিন মিথ্যে কথা বলেছিলেন ?
না। উনি মিথ্যে বলেন নি। পারি কমিউন দু'মাসের বেশি বহাল থাকতে পারে নি এটা ঠিক, কিন্তু সেটা সারা পৃথিবী জুড়ে খেটে খাওয়া মানুষের মনে একটা বিশ্বাস তৈরি করে দিয়ে গেছে। নির্বাচন মানেই হল দুটি বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক দলের মধ্যে লড়াই। জনগণের হাতে আর কোনও অপশন নেই, তাকে শাসনকর্তা হিসেবে ওই দুটো দলের মধ্যে একটাকে বেছে নিতে হবে এই বাইনারীর তত্বকে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছিল পারি কমিউন। লেসার ইভল - কম শয়তানদের হাতে আমার জানমালের দায়িত্ব তুলে দিতে বাধ্য নই। আমরা নিজেরাই সক্ষম নিজেদের শাসন করতে - এই বোধ জাগিয়ে তুলেছিল পারি কমিউন। শ্রমিক -কৃষক- মধ্যবিত্তদের নিয়ে তৈরি করা রাজনৈতিক মঞ্চের হাতে পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথমবার ভোট দিয়ে ক্ষমতা তুলে দিয়েছিল জনগণ।
লেসার ইভল - কম শয়তান খুঁজতে আমি আপনি বাধ্য একথা যারা প্রচার করে তাদের সেই তত্ত্বের ওপর সপাটে একটা থাপ্পড় এর নাম পারি কমিউন। পারি কমিউন ইজ ডেড। লং লিভ পারি কমিউন।