বৃহস্পতিবার, ৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

অমৃতা শাহির ~ অরিজিত গুহ

মহব্বতো কি পরখ কা ইয়েহি তো রাস্তা হ্যায়
তেরি তালাশ মে নিকলু তুঝে না পাউ ম্যায়'



 
সাতের দশকের কোনো এক সময়। হিন্দি সিনেমার প্রখ্যাত গীতিকার শাহির লুধিয়ানভির কোনো গানে সুর দেবেন সুরকার জয়দেব। দুজনে মিলে একটা গানের ব্যাপারে আলোচনা করে চলেছেন। শাহির কিছু লিখছেন আর গুনগুনিয়ে সেই লাইনের সুর ভেজে চলেছেন। হঠাৎ জয়দেবের চোখ পড়ল একটা কাপের দিকে। কফির তলানিটা পড়ে শুকিয়ে রয়েছে। বেশ কয়েকদিন আগের কফি খাওয়া একটা নোংরা কাপ। 'এটা এখানে কী করছে?' বলে নোংরা কাপটা হয়ত তুলে অন্য জায়গায় রাখতে যাবেন জয়দেব, খেঁকিয়ে উঠলেন শাহির। 'হাত মত লাগানা'। একদম ছোঁবে না ওটাকে। সরো, সরো বলছি। ঘাবড়ে গেলেন জয়দেব। কি আছে কফির কাপে বুঝতে পারলেন না। কিছুক্ষণ পর শাহির নিজেই বললেন, 'কাপটায় অমৃতা কফি খেয়ে গেছে শেষ যখন এসেছিল। ওর ছোঁয়া লেগে রয়েছে কাপটায়। ওটাতে হাত লাগিও না।'
    জয়দেব বুঝতে পারলেন সবই। শাহির অমৃতার সম্পর্কের ব্যাপারে জানতে কারো বাকি ছিল না সেই সময়ের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে। সম্পর্কের পরিণতি হয়ত কিছু ছিল না। আর ততদিনে প্রায় কুড়ি পঁচিশ বছরের সম্পর্ক এসে ঠেকেছিল তলানিতে। শাহির তখন গায়ক সুধা মালহোত্রার সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছেন। তাও হয়ত মাঝেমাঝে অমৃতার সাথে দেখা হত। দুজনে বসে থাকতেন ঘন্টার পর ঘন্টা। শাহির একের পর এক সিগারেট টেনে যেতেন আর অমৃতা প্রীতম কাপের পর কাপ কফি। কিন্তু দুজনের কেউই কোনো কথা বলতেন না। নিস্তব্ধতার মধ্যেই লোকানো থাকত অনেককিছু। আসলে নৈঃশব্দেরও বাঙ্ময় প্রকাশ আছে কিনা!

   ৩১ আগস্ট ১৯১৯ এ তৎকালীন পাঞ্জাবের গুজরানওয়ালায় যখন অমৃতার জন্ম হয়েছিল তার কয়েকবছর আগেই ব্রিটিশ ভারতে ঘটে গেছে এক নৃশংস গণহত্যার কাহিনী। ১৯শে এপ্রিলের জালিয়ানওয়ালাবাগের গণহত্যা কাঁপিয়ে দিয়েছিল সারা ভারত সহ ব্রিটিশ পার্লামেন্টকেও। এক জ্বলন্ত অগ্নিকাণ্ডের সাক্ষী থেকেছিল পাঞ্জাব। তার কয়েকমাস পরে সেই পাঞ্জাবেই জন্ম হয়েছিল অমৃতা নামের আরেক অগ্নিপিণ্ডের। 
   ৪৭ এর দেশভাগ যে দুটো প্রদেশকে সব থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ করেছিল তার নাম পাঞ্জাব আর বাংলা। এই দুটো প্রদেশই দেশভাগের ফলে তৈরি হওয়া ক্ষত আজও বয়ে নিয়ে চলেছে। পাঞ্জাবের প্রখ্যাত কবি হীর রনঝা কাহিনীর সৃষ্টা ওয়ারিস শাহ কে কবর থেকে তুলে এনে যখন অমৃতা প্রীতম বলেছিলেন তাঁর হীর রনঝা কাহিনীর পৃষ্ঠায় আরেকটা অধ্যায় যোগ করতে, যেখানে শুধু ৪৭ এর পাঞ্জাবের মেয়েদের ভাগ্যবিপর্যয় লিপিবদ্ধ থাকবে, তার বেশ কয়েকবছর আগে থেকেই কবিতার জগতে স্থান করে নিয়েছিলেন অমৃতা। এর জন্য অবশ্য বাবা কর্তার সিং এর অবদানও ছিল বেশ ভালোরকম। কর্তার সিং নিজেও ছিলেন একজন কবি। বাবার সেই ধারাই বর্তেছিল তাঁর ওপর। প্রথমদিকে সাধারণ কিছু কবিতা লিখলেও লাহোরের প্রগতিশীল পরিবেশের প্রভাবে পড়ে কালজয়ী কিছু সাহিত্য রচনা করা শুরু করেন। অমৃতার যখন এগারো বছর বয়স, তখন বিপত্নীক কর্তার সিং লাহোরে চলে আসেন। তখন থেকেই প্রোগ্রেসিভ লেখাপত্রের সাথে পরিচয় হতে থাকে। তারই ফলশ্রুতি 'আজ আখখান ওয়ারিস শাহ নু'। 'An Ode to Waris Sha'. এছাড়াও দেশভাগের ওপর আরেকটা বই যা তাঁকে অমর করে রাখবে তা হচ্ছে 'পিঞ্জর'। ভীষ্ম সাহানির 'তমস' আর অমৃতা প্রীতমের 'পিঞ্জর' একই সাথে উচ্চারিত নাম। 
  ষোলো বছর বয়সে বাড়ি থেকে ঠিক করে দেওয়া ছেলে প্রীতম সিং এর সাথে বিয়ের পর অমৃতা কউর থেকে অমৃতা প্রীতম বলে পরিচিত হতে থাকেন। তবে ছোটবেলার ওই বিয়েটা কোনোদিনই তাঁকে সুখ বা শান্তি কোনোটাই দেয় নি। ১৯৪৪ সাল নাগাদ লাহোরের এক মুশায়রাতে শাহির লুধিয়ানভির সাথে যখন দেখা হয় তখন শাহির মজেছিলেন অমৃতার রূপে আর অমৃতা মজেছিলেন 'কলম কা জাদুগর' শাহিরের কবিতায়। 
    দেশভাগের পর লাহোর থেকে প্রীতম সিং সস্ত্রীক দিল্লিতে চলে এলে শাহিরের সাথে সম্পর্কে আরো জড়িয়ে পড়তে থাকেন। তাঁদের দুজনের আদানপ্রদান হওয়া কিছু প্রেমপত্র সাহিত্যের এক ক্লাসিক নিদর্শন হয়ে রয়েছে। অমৃতা নিজের বিয়ে ভেঙে বেরিয়ে আসতে চেয়েছিলেন শাহিরের হাত ধরে, কিন্তু শাহিরের আদর্শবাদী মূল্যবোধ আর তার থেকেও বড় কথা দায়িত্ব থেকে পালিয়ে বেরানোর মানসিকতা শাহিরকে বাধা দিয়েছিল সম্পর্ককে পূর্ণতা দিতে। অমৃতার কথায়, 

'ম্যায়নে টুটকে প্যেয়ার কিয়া তুমসে
কেয়া তুম ভি উতনা কিয়া মুঝসে

     অমৃতা জানতেন শাহির সম্পর্ককে পূর্ণতা দেবেন না। তাও বারেবারে ছুটে এসেছেন কোনো এক অজানা টানে। এমনকি শাহির যখন জড়িয়ে পড়েছেন সুধা মালহোত্রার সাথে তখনো শাহির ছাড়া আর কারো কথাই ভাবেন নি। প্রীতম সিং এর সাথে বিয়েটা হয়ত ভাঙতই। শাহির সেখানে অনুঘটকের কাজ করেছিলেন। 

'ম্যায় চুপ শান্ত অওর আদৌল খাড়ি থি
সির্ফ পাস ব্যয়ঠে সমুন্দ্র মে তুফান থা।
ফির সমু্ন্দ্র কো খুদা না জানে কেয়া খয়াল আয়া
উসনে তুফান কি এক পোটলি বান্ধি
মেরে হাথো মে থামাই
ঔর হাস কর কুছ দূর হো গয়া'

বারেবারে অমৃতার কবিতায় ঘুরে ফিরে এসেছেন শাহির। শুধু শাহির শাহির আর শাহির। জীবনে আর অন্য কেউ যেন ছিল না। ১৯৬০ এ বিয়ে ভেঙে বেরিয়ে আসার পর শাহিরের কাছে আশ্রয় চান নি। ততদিনে সাহিত্যের জগতে অমৃতা প্রীতম এক বিশিষ্ট নাম। ইতিমধ্যে পুরষ্কারও পেয়ে গেছেন কয়েকটা। তাঁর লেখায় বারেবারে ফিরে আসে মেয়েদের লড়াই আর মেয়েদের আত্মপরিচয়ের কথা। শুরু করেন পাঞ্জাবী কাগজ 'নাগমনি' পার্টনার ইমরোজকে সাথে নিয়ে। এই ইমরোজই শেষ অব্দি জীবনে থেকে গেছিলেন, যদিও কোনোদিনও বিয়ে করেন নি আর ইমরোজকে। লাইফ পার্টনার হিসেবেই থেকে গেছেন উনি।

   অনেকের অভিযোগ ছিল অবশ্য শাহিরের মা'র জন্য নাকি শাহির আর অমৃতার সম্পর্ক পরিণতি পায় নি। কারণ সিঙ্গল মাদার হিসেবে শাহিরকে মানুষ করার পর শাহিরের একটা আলাদা টান ছিল নিজের মায়ের প্রতি। 'ও আপকি বহু বন সকথি থি' অনেক অভিমানে মা'কে বলেছিলেন এই কথাগুলো। কিন্তু ততদিনে সম্পর্ক শেষ হয়ে যায়। সত্যিই কি শেষ হয়? তা নাহলে শাহিরই বা লিখবেন কেন 'মেহফিল সে উঠ যানে বালো/ তুম লোগো পার কেয়া ইলজাম/ তুম আবাদ ঘরো কে বাসি/ ম্যায় আওয়ারা ঔর বদনাম।' লেখার সময়ে হয়ত অমৃতাই এসেছিল চোখের সামনে। ঘর করতে না পারার যন্ত্রণা কুড়ে কুড়ে খেয়েছে সবসময়।

    শেষবার যখন ফিরে আসেন শাহিরের কাছ থেকে, তখন লিখে গেছিলেন 'তুমহারে দরখতি কি তহানি কা যো আসরা মিলা/ মেরে টুটে হুয়ে দিল কা পারিন্দা ঔহি রুক গয়া। যখন তোমার গাছের শাখা খুঁজে পেলাম/ সেখানেই মরে গেল আমার ভাঙা এ মনের পাখি। আর তার সাথে বায়রনের একটা কোট "In her first love, woman loves her lover/ In all the others, all she loves is love."। শাহির বলেছিলেন 'আপ জানে সে পেহলে ইসকা তার্জুমা কর দেঙ্গি?' শাহির অমৃতাকে নিয়ে মনোকষ্টে ভুগলে তাঁকে 'তুম' বলার বদলে 'আপ' বলে ডাকতেন। শাহির লিখেছিলেন তুম চলি যাওগি, পারছাইয়া রহ জায়েঙ্গি/ কুছ না কুছ ইশক কা রানাঈয়া রহ জায়েঙ্গি। 'শাগুন' সিনেমায় মহঃ রফি গানটা গাওয়ার পর শাহির লুধিয়ানভি রফিকে অনুরোধ করেন গানটা আবার রিটেক করার জন্য। ইশক শব্দটা হুস্ন দিয়ে পরিবর্তন করেন। বলেছিলেন অমৃতার জন্য এই লাইনটা লিখেছিলাম। আপনাকে কষ্ট দিচ্ছি জানি, কিন্তু এটাকে যতটা পারা যায় আমার হৃদয় দিয়ে প্রকাশ করব। মহঃ রফি খুশির সাথে গ্রহণ করেছিলেন অনুরোধ। একদম শেষে শাহিরের কথাতেই বলা যায়

'মহব্বত যো আনজাম তক পহুঁছি নেহি
ওয়াহি মহব্বত হ্যায়, বাকি কুছ নেহি'।

আজ ৩১শে অগাস্ট অমৃতা প্রীতমের জন্মদিন। অমৃতা প্রীতম এলে অবধারিতভাবেই চলে আসে শাহির লুধিয়ানভির নাম। দুজনের এই নিরুচ্চারিত ভালোবাসাকে ধরা কারো পক্ষেই হয়ত সম্ভব নয়।

(রিপোষ্টেড)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন