শুক্রবার, ২২ সেপ্টেম্বর, ২০১৭

বিষয়- সাগু ~ কৌশিক মজুমদার


জনমেজয় কহিলেন, হে মহর্ষে! আপনি কহিলেন যে, কলিযুগে সাগু নামে এক প্রকার মনুষ্যেরা পৃথিবীতে আবির্ভূত হইবেন। তাঁহারা কি প্রকার মনুষ্য হইবেন এবং পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করিয়া কি কার্য্য করিবেন, তাহা শুনিতে বড় কৌতূহল জন্মিতেছে। আপনি অনুগ্রহ করিয়া সবিস্তারে বর্ণন করুন।
বৈশম্পায়ন কহিলেন, হে নরবর! আমি সেই বিচিত্রবুদ্ধি; ফেসবুককুশলী সাগু তথা সাহিত্য গুন্ডাগণকে আখ্যাত করিব, আপনি শ্রবণ করুন। আমি সেই চস্‌মাঅলঙ্কৃত, উদরচরিত্র, দেড় ব্যাটারি, অপভাষী, কুৎসাপ্রিয় সাগুদিগের চরিত্র কীর্ত্তিত করিতেছি, আপনি শ্রবণ করুন। হে রাজন্, যাঁহারা বিচিত্রস্তাবকাবৃত, সর্বদা খরগহস্ত, বিশ্বজ্ঞানী, এবং মহাপাদুক, তাঁহারাই সাগু। যাঁহারা কুবাক্যে অজেয়, কুভাষাপারদর্শী, মাতৃভাষার বানানে অপটু, তাঁহারাই সাগু। মহারাজ! এমন অনেক মহাবুদ্ধিসম্পন্ন বাবু জন্মিবেন যে, তাঁহারা ঘুটুবাজি ব্যাতীত অন্য কাজে অসমর্থ হইবেন। যাঁহাদিগের দশেন্দ্রিয় অপ্রকৃতিস্থ, অতএব অপরিশুদ্ধ, যাঁহাদিগের কেবল রসনেন্দ্রিয় লেখকবিশেষনিষ্ঠীবনে পবিত্র, তাঁহারাই সাগু। যাঁহাদিগের মস্তক বুদ্ধিহীন শুষ্ক গোময়ের ন্যায় হইলেও কুবাক্যে সক্ষম; হস্ত দুর্ব্বল হইলেও কি বোর্ড ধারণে এবং ভারচুয়াল বিপ্লবে সুপটু; চর্ম্ম কোমল হইলেও পরদ্রব্যবিশেষের প্রহারসহিষ্ণু; যাঁহাদিগের ইন্দ্রিয়মাত্রেরই ঐরূপ প্রশংসা করা যাইতে পারে, তাঁহারাই সাগু। যাঁহারা বিনা উদ্দেশ্যে দল বাঁধিয়া কলহ করিবেন, কলহের জন্য স্ক্রিনসট দিবেন, স্ক্রিনসটের জন্য  ইনবক্স করিবেন, ইনবক্সের জন্য গায়ে পড়িয়া আলাপ জমাইবেন, তাঁহারাই সাগু।
মহারাজ! সাগু শব্দ নানার্থ হইবে। যাঁহারা কলিযুগে ফেসবুকাভিষিক্ত হইয়া, মেম্বার নামে খ্যাত হইবেন, তাঁহাদিগের নিকট "সাগু" অর্থে সাহিত্য গ্রুপের অ্যাডমিন  বুঝাইবে। নির্বোধদের নিকটে "সাগু" শব্দে অপেক্ষাকৃত জ্ঞানী বুঝাইবে। লেখকের নিকট "সাগু" অর্থে আপদ বুঝাইবে। এ সকল হইতে পৃথক্, কেবল সাগুজন্মনির্ব্বাহাভিলাষী কতকগুলিন মনুষ্য জন্মিবেন। আমি কেবল তাঁহাদিগেরই গুণকীর্ত্তন করিতেছি। যিনি বিপরীতার্থ করিবেন, তাঁহার এই মহাভারত শ্রবণ নিষ্ফল হইবে। তিনি লেখকজন্ম গ্রহণ করিয়া সাগুদিগের ভক্ষ্য হইবেন।
হে নরাধিপ! বাবুগণ দ্বিতীয় অগস্ত্যের ন্যায় গ্রুপরূপী মেম্বারদের শোষণ করিবেন, কি বোর্ড ইঁহাদিগের গণ্ডূষ। কিছু লেখক প্রকাশক ইঁহাদিগের আজ্ঞাবহ হইবেন-"বই উদ্বোধন" এবং "ফিতাকাটা" নামক দুইটি অভিনব বিষয় আশ্রয় করিয়া রাত্রি দিন ইঁহাদিগের গ্রুপে ছবি লাগাইতে থাকিবেন। ইঁহাদিগের যেমন মুখে অগ্নি, তেমন জঠরেও অগ্নি জ্বলিবেন। এবং গেট্টু নাম দিয়া পেটোয়া মেম্বার লইয়া তৃতীয় প্রহর পর্য্যন্ত ইঁহাদিগের রথস্থ যুগল প্রদীপে জ্বলিবেন। আলোচিত সঙ্গীতে এবং কাব্যেও অগ্নিদেব থাকিবেন। তথায় তিনি "মডার্ন" এবং "পোস্ট মডার্ন" রূপে পরিণত হইবেন। ফেবুবাসীদের মতে ইঁহাদিগের কপালেও অগ্নিদেব বিরাজ করিবেন। যেকোন লেখককেই ইঁহারা নস্যাৎ করিবেন-ভদ্রতা করিয়া সেই দুর্দ্দর্ষ কার্য্যর নাম রাখিবেন, "রিভিউ"। কেবল বিনা পয়সায় বই দেওয়া লেখক ও প্রকাশকদিগকে ইঁহারা পূজা করিবেন। সেই মন্দিরের নাম হইবে "অ্যাডভেঙ্চার"।
হে নরশ্রেষ্ঠ! যিনি কাব্যরসাদিতে বঞ্চিত, সঙ্গীতে দগ্ধ কোকিলাহারী, যাঁহার পাণ্ডিত্য শৈশবাভ্যস্ত ফেবুগত, যিনি আপনাকে অনন্তজ্ঞানী বিবেচনা করিবেন, তিনিই সাগু। যিনি কাব্যের বা সাহিত্যের   কিছুই বুঝিবেন না, অথচ কাব্যপাঠে এবং সমালোচনায় প্রবৃত্ত, যিনি বারযোষিতের চীৎকার মাত্রকেই সঙ্গীত বিবেচনা করিবেন, যিনি আপনাকে অভ্রান্ত বলিয়া জানিবেন, তিনিই সাগু। যিনি রূপে কার্ত্তিকেয়ের কনিষ্ঠ, গুণে নির্গুণ পদার্থ, কর্ম্মে জড় ভরত, এবং বাক্যে সরস্বতী, তিনিই সাগু। যিনি অন্য গ্রুপ দখলের জন্য কলহ করিবেন, বন্ধুর ইনবক্স পাইয়া পায়ে পা লাগাইবেন, গ্রুপের স্থাপককে বাহির করিয়া দিতে সচেষ্ট হইবেন এবং না পারিলে চোখের জল মুছিয়া নতুন গ্রুপ খুলিবে, তিনিই সাগু। যাঁহার গমন অনাহুত সভায় এবং আহার প্যাকেটের সিঙারা, তিনিই সাগু। যিনি মহাদেবের তুল্য তান্ডবপ্রিয়, ব্রহ্মার তুল্য চতুরানন, এবং বিষ্ণুর তুল্য লীলা-পটু, তিনিই সাগু। হে কুরুকুলভূষণ! বিষ্ণুর সহিত এই বাবুদিগের বিশেষ সাদৃশ্য হইবে। বিষ্ণুর ন্যায় ইঁহারাও দিবারাত্র ফেবুতে অনন্তঅনলাইন হইবেন। বিষ্ণুর ন্যায় ইঁহাদিগেরও দশ অবতার-যথা, কেরাণী, মাষ্টার, প্রকাশক, রিভিউয়ার, ফেবুলেখক, উকিল, আই টি, পা চাটা, সম্বাদপত্রসম্পাদক এবং নিষ্কর্ম্মা। বিষ্ণুর ন্যায় ইঁহারা সকল অবতারেই অমিতবলপরাক্রম লেখকগণকে বধ করিবেন। 
মহারাজ! পুনশ্চ শ্রবণ করুন। যাঁহার বাক্য মনোমধ্যে এক, কথনে দশ, লিখনে শত এবং কলহে সহস্র তিনিই সাগু। যাঁহার বল হস্তে একগুণ, মুখে দশগুণ, পৃষ্ঠে শতগুণ এবং লেখনকালে অদৃশ্য, তিনিই সাগু। যাঁহার বুদ্ধি বাল্যে পুস্তকমধ্যে, যৌবনে বোতলমধ্যে, বার্দ্ধক্যে গৃহিণীর অঞ্চলে, তিনিই সাগু। যাঁহার ইষ্টদেবতা নিজ স্বয়ং, গুরু অন্য অ্যাডমিন, বেদ  ফেবু এবং তীর্থ "জীবনানন্দ সভাঘর" তিনিই সাগু।  যাঁহার যত্ন কেবল পরিচ্ছদে, তৎপরতা কেবল উমেদারিতে, ভক্তি কেবল কলহে, এবং রাগ কেবল সদ্‌গ্রন্থের উপর, নিঃসন্দেহে তিনিই সাগু।
হে নরনাথ! আমি যাঁহাদিগের কথা বলিলাম, তাঁহাদিগের মনে মনে বিশ্বাস জন্মিবে যে, আমরা তাম্বূল চর্ব্বণ করিয়া উপাধান অবলম্বন করিয়া সভা সমিতিতে গিয়া, দ্বৈভাষিকী কথা কহিয়া, এবং লেখকদের গুষ্টি উদ্ধার করিয়া বাংলা সাহিত্য পুনরুদ্ধার করিব।
জনমেজয় কহিলেন, হে মুনিপুঙ্গব!সাগুদিগের জয় হউক, আপনি অন্য প্রসঙ্গ আরম্ভ করুন।

বৃহস্পতিবার, ২১ সেপ্টেম্বর, ২০১৭

রোহিঙ্গা ~ অবিন দত্তগুপ্ত

৪৭-এর দেশভাগের সময় অসংখ্য মানুষ , পায়ে হেঁটে ট্রেনে চেপে ওপার বাংলা থেকে এপার বাংলায় এসেছিলেন । দুরন্ত জীবনযুদ্ধে জয়ী হয়েছিলেন । বুকের রক্ত দিয়ে সেচ্‌ দিয়ে ভবিষ্যতের সম্ভাবনার ফসল বুনেছিলেন । তাদের এই যুদ্ধ , কিন্তু ধর্মীয় ঘৃণা দ্বারা পরিচালিত হয় নি ... বেঁচে থাকাকে ভালবেসেই তারা লড়ে গেছিলেন । সেদিন, তাদের ঘৃণাকে উস্কে দিয়ে তাদের দ্বিতীয়,তৃতীয় বা অজুতবার খুন করতে চেয়েছিল আর এস এস এবং জাতিয় কংগ্রেসের একাংশ । কিন্তু তারা হেরে গিয়েছিল । ভয়ঙ্কর যুদ্ধে বন্ধু খুঁজতে শিকড়হীন মানুষের ভুল হয়নি । ভালোবাসার পক্ষে , বেঁচে থাকার পক্ষে ,তারা বামপন্থীদের হাত ধরে ছিলেন । মা ঈগলের মতো তাদের স্বার্থের লড়াই লড়েছে লাল ঝান্ডা ।

৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের সময় , বর্ডার খুলে দিয়েছিলেন ইন্দিরা গান্ধী । রাজাকার আর খান সেনার হাতে অত্যাচারিত লক্ষ মানুষ সেদিন ভারতের কাছে আশ্রয় নিতে এসছিলেন । মাথা বড় , ছোট শরীরের অভুক্ত বাচ্চাদের কোলে নিয়ে , মায়েরা যশোর রোড ধরে লঙ মার্চ করেছিলেন - হাতে বন্দুক । প্রতিপদে রক্তাক্ষয়ি যুদ্ধ চালিয়ে , সন্তানদের নিয়ে ভারতের জন্য পাড়ি জমিয়েছিলেন অজুত উদবাস্তু জননী । এদের জন্য টাকা তুলতে গিয়ে ৭১এর আজাদগড়ে সি আর পি-র গুলি খেয়ে খুন হয়ে যান বামপন্থী যুবক । আজাদগড় কলোনী - উদবাস্তু রক্তে সেচ্‌ দেওয়া উদবাস্তু ভবিষ্যৎ ।

বহুপরে মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধের সময় ,খবরের কাগজে একটা ছবি বেরিয়েছিল । এক সিরিয় বাবা তার সন্তানকে কোলে নিয়ে বর্ডার-এর দিকে দৌড়াচ্ছে । তাকে পেছন থেকে লাথি মেরে ফেলে দিচ্ছেন এক ইউরোপীয় সাংবাদিক । বাচ্চাটার মাথা বাঁচানোর মরিয়া চেষ্টায় মাথা আগলে রেখেছেন বাবা । আমার ঠামি তখনই প্রায় ৯০,বলেছিল - "ওরা কি ট্রেনটা ধরতে পেরেছে ? " মনের কোন গহিন কোনের স্টেশনের ট্রেন , কোন সীমান্ত পেরনো ট্রেন জানা নেই । তবে ট্রেনে চড়ার ফলাফল যে শিকড় হারানো আর ট্রেনের গন্তব্য যে বেঁচে থাকার এক ফালি আশিয়ানা , এ বিষয় কোন সন্দেহ নাই । আসলে একবার যে উদবাস্তু , তার শিকড় বরাবরের মতো বাঁধা পড়ে যায় শিকড় হারানোয় ।

রোহিঙ্গার মায়েরা তাদের সন্তানদের কোলে নিয়ে ,এভাবেই লড়াই করছেন - বেঁচে থাকার আশিয়ানার খোঁজে । রোহিঙ্গার মানুষ (হিন্দু,মুসলমান এবং বৌদ্ধ) আদতে আমাদেরই উদবাস্তু অতিতের বর্তমান বাসিন্দা । ভারতের ঐতিহ্যের প্রতি তারা আস্থা রেখেছেন । ভারত কখনোই অন্যায় ভাবে ছিন্নমূল মানুষকে ( যে কোন ধর্ম বা ভাষার বা জাতের) ফিরিয়ে দেয় নি । ওরা ভরসা রেখেছেন ভারতের উপর । ভারতের এক কোনে এক চিলতে জমিতে , রক্তের সেচ্‌ দিয়ে ওরা আবার ওনাদের ভবিষ্যতের চাষ করবেন । বরাবরের মতোই এবারও লাল ঝান্ডা ঈগল পাখির মতোই রক্ষা করবে ছিন্নমূল মানুষের অধিকার । কাল ছাত্র ফেডারেশন ও যুব ফেডারেশনের মিছিল , মায়ানমার দুতাবাস-এর লক্ষ্যে । মানুষের বেঁচে থাকার অধিকার , সবচাইতে বড় গণতান্ত্রিক অধিকার ।গণতান্ত্রিক অধিকারের মিছিল । আমার ঠামির এখন জানা-বোঝার আর ক্ষমতা নাই । থাকলে রোহিঙ্গাদের ট্রেনটা কোন স্টেশনে থামবে ,সেই খবরটা অবশ্যই নিতেন ।

সোমবার, ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৭

বাঙ্গালীর দুগ্গাপুজো

"কৈলাস হতে বাপের বাড়ি এসেছে পার্বতী,
সঙ্গে গনেশ, কার্তিক আর লক্ষ্মী সরস্বতী। "

মহালয়ার আর হপ্তা খানেক বাকি। পূজোর আগের লাস্ট উইক এন্ড। কৈলাসে মর্ত্যে যাবার প্রস্তুতি চলছে জোরকদমে। এমন সময় কার্তিক ফেসবুকে স্ক্রোল করা থামিয়ে উত্তেজিত গলায় বলল "খবর শুনেছ?  ইন্দ্র আমাদের মামারবাড়ি যাওয়া নিয়ে ইনজাংশান জারি করছে।"
 সরস্বতী খবরের কাগজ পড়ছিল বিরক্ত মুখে বলল "কেতো ফেসবুক পড়ে ফালতু গুজব ছড়াস না, মর্ত্যের কিছু ভক্ত বাঙালিদের দূর্গাপুজোর ধরনধারণ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে, ভক্ত অসন্তোষের ব্যাপারটা নিয়ে ইন্দ্রের সভায় আলোচনা হয়েছে, ব্যাস এইটুকুই,সব কিছুকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে ফেসবুকে গুজব ছড়ায়।

মা ব্ল্যাকবেরীটা চেক করতে করতে একটু চিন্তিত গলায় বললে "শুধু আলোচনা নয়, ইন্দ্র ম্যাসেজ পাঠিয়েছে, কাল দেবতাদের পাঁচ সদস্যের এক কমিটি দূর্গাপুজোর ধর্মীয় ব্যাপারটা খতিয়ে দেখতে কৈলাসে আসবেন। আমরা যেন কোওপারেট করি।"

লক্ষ্মী রেগে টং, "মা নিজের বাপের বাড়ি যাবে আমরা মামার বাড়ি যাব, তাতে কমিটি কি করবে? আসলে হিংসে। তেত্রিশ কোটির আর কারো তো এরকম মামারবাড়ির আদর নেই।"

গনেশ সবসময় অন দ্য টপ অফ এভরিথিং থাকে। বলল "মা আমি মর্ত্যের ট্রেন্ড টা দেখলাম, সকলে সনাতন হিন্দু ধর্মের দিকে ঝুঁকছে, আমাদের কাল কমিটির কাছে প্রেসেন্ট করতে হবে আমরাও খুব সনাতন।" মা বললেন "কত পুরোনো?  বৈদিক যুগ? মহামায়া রূপে ফিরে যাব?" গনেশ আরে না অতটা না ওই মধ্যযুগের শেষের দিকটা যখন অরাজকতার দরুন কুসংস্কার খুব বেড়েছিল।"

যাই হোক মা আর ছেলেমেয়েরা ঠিক করলেন কমিটির সামনে দূর্গাপূজার সনাতন রূপ তুলে ধরবেন। মা ভেবেছিলেন কমিটিতে অগ্নি, বরুন, পবন ইত্যাদি দেবতারা থাকবেন কিন্তু দেখলেন এসেছেন তিরুপতি, বৈষ্ণোদেবী, স্বামী নারায়ন, সিদ্ধি সাঁইবাবা,  পদ্মনাভন।
গনেশ ফিসফিস করে বললেন এঁরাই এখন স্বর্গের টপ ফাইভ রেভেনিউ জেনারেটর।

প্রশ্নোত্তর পর্ব আরম্ভ হল।

ভক্তির প্রথম স্টেপ হল মূর্তি, সেটার মেটেরিয়ালটা কি? মা জানালেন খড়, মাটি, রঙ। ওঁরা বললেন "ওসব নয় সোনা, রূপা, অষ্টধাতু, রত্নের বিগ্রহ হয়?" মা জানালেন ওসব হয় না তবে কাঠ, কাগজ, শোলা, সিমেন্ট,পাট, দড়ি, পেরেক, ঘুড়ি,ছাতা, ননী, ছানা, বাবলগাম, তাস,  ভাঁড় ইত্যাদি মেটেরিয়াল মূর্তি বা প্যান্ডেলে ব্যবহার হয়। কমিটি একটু হেঁচকি তুললেন।

দ্বিতীয় হল খাওয়া দাওয়া। ভক্তরা কতটা খাওয়ার কৃচ্ছ্রসাধন করে? উপবাস? লবন বিহীন অন্নগ্রহণ, ননভেজ না খাওয়া, ভক্তরা এর মধ্যে কোনটা করে? মা বললেন এগুলো ঠিক করে না তবে বাছারা পূজোর সময় ঢেড় খাওয়ার কষ্ট সহ্য করে। আরসালানের সামনে আড়াই ঘন্টা লাইন দিয়েও মাটন বিরিয়ানি না পেয়ে চিকেন বিরিয়ানি খায়, পুজোর কদিন রোজ সন্ধ্যেবেলা আধকাঁচা এগবিহীন এগরোল খায়, অম্বলে গলা জ্বলে গেলেও ষষ্টি থেকে দশমী ফুচকা খাওয়া ছাড়ে না।"
এহেন কৃচ্ছ্রসাধনের বিবরণে কিন্তু কমিটির মন গলল না। তারা গম্ভীর মুখে পরের প্রশ্নে গেলেন। 

"নামগান কিরকম করে ভক্তরা?" এবার সরস্বতী হাল ধরলেন। পাছে মা প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে বাজা "তোদের ঘুম পেয়েছে বাড়ি যা" বা "এ তুমি কেমন তুমির" কথা বলে বসে, তাই সরস্বতী ঘরোয়া পূজোয় বাজা রবীন্দ্রসংগীত গুলো এগিয়ে দিল। কিন্তু গান গুলো রিভিউ করতে গিয়ে কমিটির মুখ অন্ধকার হয়ে গেল। একে তো নিরাকার উপাসক কবি,তায় মুসলমানের মত জোব্বা পড়া, বড় বড় দাড়ি। তার উপর ঔদ্ধত্য দেখ? লিখেছে "আমায় নইলে ত্রিভুবনেশ্বর তোমার প্রেম হত যে মিছে।"
নাম গানের ঘরে ঢ্যাঁড়া পড়ল।

পরের টপিক ভক্তের পরীক্ষা, কে কত কষ্ট সহ্য করতে পারে দেবতার জন্য। মাথার চুল দান করে? দন্ডি কাটে? ঠান্ডা কনকনে জলে ডুব দেয়, কাঠফাটা রোদে খালি পায়ে হাঁটে? 
মা সোতসাহে জানালেন শরীরপাত করে বইকি? ঠাকুর দেখতে হোল নাইট জাগে, হাই হিল জুতো পরে মাইলের পর মাইল হাঁটে, বাঁশবাঁধা লাইনে দাঁড়িয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা অন্যের কনুইএর গুঁতো খায়। কিন্তু মনের খুশিটা কিছুতেই যায় না। একে অন্যের পা মাড়িয়ে, প্যান্ডেলের লাইনে অন্যের ঘামে ভেজা টিশার্টে মুখ ঘষেও হাসিমুখে মায়ের প্রতিমার সাথে সেল্ফি তোলে।

মা এবং ছেলেমেয়েরা সভয়ে দেখলেন ভক্তের কৃচ্ছ্রসাধনের ঘরেও গোল্লা বসল। এদিকে সরস্বতীর টেবিলে এবছরের পূজোসংখ্যা গুলো রাখা ছিল কমিটির সে দিকে নজর পড়ল। সরস্বতী জানালেন ওগুলো দুর্গাপূজা উপলক্ষ্যে স্পেশালি ছাপা হয়। কমিটি ভাবলেন স্তবস্তুতি প্রার্থনামন্ত্র হবে। খুলে লেখার নমুনা দেখে চক্ষুচরকগাছ। এখানে বড়ই কনফ্লিক্ট হল। কমিটিও কিছুতেই বুঝতে পারছে না ধর্মের সাথে সম্পর্ক বিযুক্ত এইসব সাহিত্যের পুজোর সময় কিসের দরকার? এদিকে মা আর ছেলেমেয়েরাও বুঝতে পারছে না পূজোসংখ্যা ছাড়া দুর্গাপূজো হয় নাকি?

অবশেষে কমিটি শেষপ্রশ্নে পৌঁছল। দুর্গাপূজায় রেভেনিউ জেনারেশন কেমন হয়? গনেশ খাতাপত্র খুলে বসল। এইতো দেখা যাচ্ছে প্রচুর চাঁদা ওঠে, প্লাস পুজোর মাসে বাঙালি গৃহস্থের খরচাপত্র খুব বেড়ে যায়, কর্তাদের নাভিশ্বাস ওঠে। কমিটি জানতে চাইলেন প্রণামীর বাক্স সেকথা বলছে না কেন? মায়ের মন্দির কই? সে মন্দিরের ট্রাস্টফান্ডে সম্পদ কই? রেভেনিউ যাচ্ছে কোথায়? গনেশ জানালো ছড়িয়ে ছিটিয়ে যায়, খানিক থীম শিল্পির ঘরে, খানিক কুমোরটুলিতে, আর্টকলেজে, প্যান্ডেলের মজুরের ঘরে, ঢাকীর ছেলের ধোঁয়াওঠা গরম ভাতে, তাঁতশিল্পির ঘরে, শাড়ীর দোকানদারের মেয়ের বিয়ের খরচে, কাজের লোকের বকশিশে, রক্তদান শিবিরে, কম্বল বিতরনে, অষ্টমীর খিচুড়ি ভোগে, ফুচকাওয়ালার ময়লা পকেটে ছড়িয়ে পড়ে এই রেভিনিউ।
কমিটি হতভম্ব হয়ে গেলেন। এরম ভাবে দেবতারা বর দেন নাকি? ওঁদের সব সোজা হিসাব। মন্দিরে সোনার বিগ্রহ দিলে ব্যাংক্রাপ্টসির হাত থেকে বাঁচিয়ে লন্ডনে পাঠিয়ে দেব, পাঁচসিকের পুজো দিলে ছেলের সর্দি সারিয়ে দেব, মাথার চুল মানত করলে আমেরিকার ভিসা, সোমবার উপোষ করলে এন আর আই বর। এতেই ভক্তের মনে ভয়, ভক্তি জাগে। থীম পুজোর প্যান্ডেলে জন খেটে রোজগারের টাকায় ছেলের চিকিৎসা হলে মানুষ ভগবানকে শ্রদ্ধাভক্তি করবে কেন?

মা মৃদু হেসে বললেন ভক্তি তো চাইনি ভালোবাসা চেয়েছি, স্তব পাইনি, "নবমী নিশি পোহাইও না রে" আকুল আবেদন পেয়েছি, ভক্তের মস্তকমুন্ডন চাইনি, থীমের পূজোয় নিউ হেয়ার স্টাইল পেয়েছি, প্রণামী চাইনি, শিউলি চেয়েছি, বর দিতে চাইনি, আনন্দ দিতে চেয়েছি, ভক্তের শুদ্ধশুচি উপবাস চাইনি বচ্ছরকার দিনে ছেলেপুলের হাতে নারকেল নাড়ু দিয়ে চেয়েছি, মহিষাসুরমর্দিনী হতে চাইনি উমা হতে চেয়েছি।"

তাই বলে কি মায়ের এমন মর্মস্পর্শী বক্তৃতায় কমিটির রায়দানে কোনো হেরফের হল? ওরকম হলে আল্লা, গডের সাথে পাল্লা দিয়ে সনাতন ধর্ম টিকিয়ে রাখা যেত না। কমিটি জানালেন ওঁরা দুর্গার মর্ত্যের ট্যুরের উপর স্থগিতাদেশ জারি করবেন। বাঙালিরা পূজোর নামে এই যে অধর্মীয় কাজ করছে সেটা বন্ধ করা দরকার।
কৈলাসে অন্ধকার নেমে এল। মা জানেন "আর অসুর দমন করব না" বলে ভয় দেখিয়ে কোনো লাভ নেই। অসুরদের সাথে দেবতাদের তলায় তলায় সমঝোতা হয়ে গেছে।

ভোলানাথ ক্যাসুয়ালি ইন্দ্রের সভায় গিয়ে জানালেন "গলাটা বড়ই ট্রাবল দিচ্ছে হে, এতদিন ধরে হলাহল গলায় ধরে রাখা তো চাট্টিখানি কথা নয়। অন্যবার মহামায়া বাপের বাড়ি গেলে কয়েক হাজার ছিলিম গাঁজা চড়িয়ে ব্যাপারটা ম্যানেজে রাখি। তা এবার তো ওদের যাওয়া বন্ধ, হলাহল টা নাহয় ইন্দ্রলোকেই নামিয়ে রাখি?"

ইন্দ্র আমতা আমতা করে বললেন "ইয়ে মানে যাওয়া বন্ধ নয় তো, কতগুলো ব্যাপারে কমিটি আপত্তি করেছে, ব্যাপারটা আলাপ আলোচনার মধ্যে মিটিয়ে নেওয়া যায়।"

মহাদেব বললেন "বাঙালিদের একে আঠারো মাসে বছর, তায় এমনি ল্যাদখোর কিন্তু বাঙালের গোঁ খুব, ওদের বুঝিয়ে সুঝিয়ে ভদ্র হিন্দু করতে সময় লাগবে। ততদিন হলাহলটা তুমিই ধারণ কর না হয়।"

এই কথোপকথনের আধঘন্টার মধ্যেই মায়ের মোবাইলে ইন্দ্রের ম্যাসেজ এল যে কমিটির সবাই স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেছেন, মায়ের বাপেরবাড়ি যাওয়া নিয়ে তেত্রিশকোটির কারোর আপত্তি নেই।
প্রতিবারের মত গৌরী এবারেও বাপেরবাড়ি আসছেন। মা মেনকা পান্তাভাত আর কচুরশাক রেঁধে রেখেছেন।

(সংগৃহীত)

বৃহস্পতিবার, ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৭

সরকারি কর্মচারী ~ সুভাশীষ

পরিবর্তনের সরকার মানুষের আকাঙ্খাতেই ক্ষমতা এসেছিল। আর পূর্বতন সরকার আর পার্টির নানা ত্রূটিবিচ্যুতি ছিল, সে তো তারাই পরবর্তীকালে নানা লেখাপত্রে আত্মসমালোচনা করেছেন। এই দুটো প্রতিপাদ্য নিয়ে আমি কোনও বিবাদ করিনি। কিন্তু গোল বেঁধেছে অন্যত্র। সরকার আর কর্মচারী সংগঠনের আন্ত:সম্পর্ক নিয়ে যে বিশ্লেষণ শুনছি, সেটা নিয়ে কিছু আলোচনা করা দরকার। 

এটি ঠিক যে বামফ্রন্ট সরকারকে রক্ষা করার স্লোগান এই রাজ্যের কর্মচারী সমাজের একটা বিরাট অংশ দিয়েছিলেন। কেউ কেউ অতি উৎসাহে 'চোখের মনির মত রক্ষা করার' কথাও বলতেন। সরকারী কর্মচারীদের সার্ভিস রুলে দলীয় রাজনীতি করার অধিকার নেই। সেটা ব্রিটিশ সার্ভিস রুলে আছে। কিন্তু দেশের  রাজনৈতিক পরিস্থিতির সঙ্গে সরকারী কর্মচারী ও তাদের পরিবারের ভাগ্য যেহেতু অবিচ্ছেদ্যভাবে যুক্ত আছে, তাই নির্বাচনে তাঁরা নির্বিকল্প ভূমিকা পালন করতে পারেনা। আবার সরাসরি কোনও পক্ষকে ভোট দিতে বললে সেটা সার্ভিস রুলে আটকায়। তাই খেয়াল করলে দেখা যাবে নির্বাচনের সময় সংগঠন বলেছে 'জীবন ও জীবিকার অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে সপরিবারে ভোটাধিকার প্রয়োগ করুন।' 

এটা ঠিকই যে ২০১১ সালে বামফ্রন্টে নির্বাচনী বিপর্যয়ের বছরেও কর্মচারীদের ভোট বিপুলভাবে বামফ্রন্টের পক্ষেই গিয়েছিল।  বাম সরকারের প্রতি কর্মচারীদের এই পক্ষপাত তো তাদের অভিজ্ঞতাসঞ্জাত। এখানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল  কর্মচারীদের সঙ্গে বামপন্থীদের এই মৈত্রী কিন্তু গড়ে উঠেছিল বামফ্রন্ট সরকার প্রতিষ্ঠা হওয়ার বহু পূর্বে সুদীর্ঘ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে। সর্বস্তরে  গণতন্ত্রের প্রসার, জমি বা খাদ্যের দাবিতে বিপুল সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এরাজ্যে বামফ্রন্ট সরকার প্রতিষ্ঠা হয়েছিল ১৯৭৭ সালে। দুর্ভাগ্য আজকের প্রজেন্মর জানাই নেই যে এই সব সংগ্রামের মধ্যে ওতোপ্রতোভাবে বামপন্থীরা লড়াই করেছিলেন সরকারী কর্মচারীদের দূরাবস্থা নিরসনেও। লোকসভায়, বিধানসভায় এবং রাস্তায়। 

সরকারি কর্মচারীদের দাবির সমর্থনে আইনসভাগুলিতে জ্যোতি বসু, হরেকৃষ্ঞ কোঙার, ভূপেশ গুপ্ত, জ্যোতির্ময় বসু, এ কে গোপালন, ইন্দ্রজিত গুপ্তদের বহু স্মরণীয় ভাষণ এখনও রোমাঞ্চ জাগায়। 1958 সালে এসপ্লানেড ইষ্টে সরকারি কর্মচারীদের অভিযান  আটকাতে জমায়েত তিন দিক থেকে ঘিরে নিয়েছিল সশস্ত্র পুলিশ। অবধারিত জালিওয়ানাবাগের পরিস্থিতিতে ধূমকেতুর মত আবির্ভূত হয়ে অসীম সাহসে মিছিল বার করে নিয়ে গিয়েছিলেন ৫ ফুট ২ ইঞ্চির এক খর্বকায় বাঙালী। জ্যোতি বসু! 

স্বাধীনতার পর ৭৭ -পূর্ববর্তী পুরো সময়টাই ছিল সরকারী কর্মচারীদের কাছে একটা কালো অধ্যায়। ডাঃ বিধান রায়ের মত মানুষ প্রকাশ্যেই বলতেন, সরকারী কর্মীরা সরকারের গোলাম। বলতেন, কর্মীরা  দাবি নয়; সরকারের কাছে প্রার্থনা করতে পারে। সে সময় কুখ্যাত Service Conduct Rule ছিল। গ্রুপ ডি কর্মীদের অফিসে  বসার অধিকার ছিলনা। সাহেবের ঘরে জুতো খুলে ঢুকতে হত। অধস্তন কর্মচারীরা উপরওয়ালাকে চিঠি শেষ করতেন 'your most obedient servant' বলে। গণতান্ত্রিক পথে আন্দোলন করলে নেমে আসত নির্মম শাস্তির খাঁড়া। পুলিশের লাঠি, গ্রেপ্তারি, হুমকি, বাড়িতে আক্রমণ,  বদলী, পে কাট, সুপারসেশন, সাসপেনসন,  ইনক্রিমেন্ট কাট; মায় সংবিধানের ৩১২ ধারায় আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে সরাসরি বরখাস্ত। 

অনেকে নিশ্চই জানবে সে সময় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য পশ্চিমবঙ্গের মানুষের আন্দোলনের সঙ্গে সরকারী কর্মচারীদের আন্দোলন মিলে মিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল। তাই অবলীলায় সরকারী কর্মীদের মহার্ঘ ভাতার দাবিতে মিছিলে নামতেন সাধারণ মানুষ। এই পটভূমিতেই ৭৭ সালে বামফ্রন্ট সরকার প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে রাজ্যের অন্যান্য অংশের মানুষের সাথে মুক্তির স্বাদ পেয়েছিলেন সরকারী কর্মচারীরাও। তারপর যা হয়েছিল তা ইতিহাস! নিছক পাওনা-গন্ডা ছেড়ে দিলাম, মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন সরকারি কর্মীরা। বাতিল হয়েছিল সার্ভিস কন্ডাক্ট রুল,  অফিসে বসার অধিকার ও মাথার উপর ফ্যান পেয়েছিলেন গ্রুপ ডি কর্মীরা। 'সরকারের গোলাম' থেকে 'জনগণের সেবকে' উত্তীর্ণ হয়েছিলেন কর্মচারী সমাজ। ফেরৎ এসেছিল মাথা উঁচু করে সংগঠন করার অধিকার। দলমত নির্বিশেষে রাইটার্সে, কালেক্টরেটগুলিতে সংগঠনের কাজ করার জন্য অফিসঘর দেওয়া হয়েছিল প্রশাসনের লিখিত অর্ডারে।  কো-অর্ডিনেশন পেয়েছিল, ফেডারেশনও।  সংগঠন মন্ত্রী-আমলাদের সঙ্গে দেখা করতে চাইলে দ্রূত সময় দিতে হবে, সংগঠন চিঠি দিলে উত্তর দিতে হবে--- আদেশনামা বার করেছিল বামফ্রন্ট সরকার। মুখ্যমন্ত্রীরা কর্সমচারীদের সম্বোধন করতেন  'প্রিয় সহকর্মী' বলে। জ্যোতি বসু সার্ভিস রুল পাল্টে ধর্মঘটের অধিকার দিয়েছিলেন রাজ্য কর্মীদের (জরুরি পরিষেবা ছাড়া)। যেটা ভূভারতে নেই। অনেকে মানা করেছিলেন। শোনেননি। আমি নিজের কানে শুনেছি, রাজ্য কর্মীদের সভায় বলেছেন, "ধর্মঘটের অধিকারটা ছাড়বেন না। বামফ্রন্ট সরকারের হাতেও নয়।" 

তাই বলছিলাম, বাম সরকারকে রক্ষা করার শ্লোগানটা কেউ ফতোয়া জারী করে দেয়নি, ওটা উঠে এসেছিল কর্মচারীদের ভিতর থেকে, তাঁদের জীবনলব্ধ অভিজ্ঞতা থেকে। ঠিকই, সময়ের সাথে সাথে যেমন ষাট-সত্তরের দশকের স্মৃতি কর্মচারীদের মধ্যে ফিকে হয়েছে, তেমনই সরকারের মতাদর্শগত অবস্থানও কোথাও-কোথাও শিথিল হয়েছে। কিন্তু ঘটনা হল, সেটা নিয়ে মন্ত্রিসভার সঙ্গে কো-অর্ডিনেশন কমিটির তুমুল সংঘর্ষও হয়েছে। আমরা তাঁর সাক্ষী। ২০০৫ সালে সূর্যকান্ত স্বাস্থ্য দপ্তর বেসরকারী করে হেল্থ কর্পোরেশন গঠন করতে চেয়েছিলেন।পাঁচ হাজার কর্মী নিয়ে স্বাস্থ্য ভবন ঘেরাও করেছিল কো-অর্ডিনেশন কমিটি। সিদ্ধান্ত রদ হয়েছিল। 

জ্যোতিবাবুর সময়কাল থেকেই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রীরা যেতেন কো-অর্ডিনেশনের সম্মেলনে। বাছাই করা বক্তাদের মঞ্চে তুলে দেওয়া হত সরকারের সমালোচনার জন্য। ২০০৪-এর পুরুলিয়া সম্মেলন। সম্মেলন চলাকালীন  প্রলয়াঙ্করি  সুনামি হল এশিয়ায়। সম্মেলনের ভিতরেও সুনামি। অবসরের পর আমলাদের গণহারে পুনর্ণিয়োগসহ নানা ইস্যুতে সরকারকে তুলোধোনা করছেন উত্তর দিনাজপুরের শম্ভু চক্রবর্তী, মুর্শিদাবাদের আশিস বাগচী , উত্তর ২৪পরঘনার খগেন নাগেরা। সেই সময় আমাদের রেজিস্ট্রার ছিলেন এন জি চক্রবর্তী। অবসরের পর তিনিও রি-এমপ্লয়েড হয়েছিলেন  আর সি এস পদে। কো-অর্ডিনেশন সব সংগঠনের কাছে রি-এমপ্লয়েড আমলাদের তালিকা চেয়েছিল। আমরা এন জি চক্রবর্তীর নাম পাঠিয়েছিলাম। কেউ একজন দপ্তর ধরে ধরে এই সব আমলাদের নামের তালিকা পড়ছেন আর আর থমথমে মুখে শুনছেন বুদ্ধবাবু। অথচ কী বৈপরিত্য; তার আধঘন্টা আগে। মঞ্চে উঠেছেন মুখ্যমন্ত্রী। নিরাপত্তারক্ষীদের নানা কায়দা-কানুনের জেরে ১৫মিনিট বন্ধ হয়ে আছে অমন সুশৃঙ্খল সম্মেলন। শেষে ধৈর্যের বাঁধ ভাঙল স্মরজিতদার। (তৎকালীন সাধারণ সম্পাদকের)। মাইক টেনে বললেন, নিরাপত্তা অফিসারদের বলছি, "আমাদের মুখ্যমন্ত্রী, আমরাই নিরাপত্তা বুঝে নেব। আপনারা দয়া করে নেমে যান।'। সম্মেলন কক্ষ ফেটে পড়ল করতালিতে। বিব্রত হয়ে নেমে গেলেন এসপিজি অফিসারেরা। 

সমবায় ক্ষেত্র। রাজ্য সরকার বৈদ্যনাথন কমিটির সুপারিশ কার্যকর করবেই। আমরা বামফ্রন্টের রাজনৈতিক দলিল খুঁজে দেখিয়ে দিলাম কেন্দ্রীয় সরকারের শর্ত মেনে মৌ স্বাক্ষর করলে তা বামফ্রন্টের নীতি বিরোধী হয়ে যাবে। মৌলালীতে সংগঠন আলোচনাসভা আহ্বান করল। বিনয় কোঙারকে বসিয়ে রেখে ক্ষুরধার বক্তব্য রাখলেন প্রণব চট্টোপাধ্যায়। শেষে অসীম দাশগুপ্ত ডেকে পাঠালেন। কো-অর্ডিনেশন কমিটির জেনারেল সেক্রেটারিকে নিয়ে দেখা করলাম। বললেন আপনাদের অবস্থান সঠিক। তবে অনেকগুলো টাকা দেবে। সর্বভারতীয় চাপ আছে। তবে আমরা আইনের ন্যূনতম সংশোধন করব। যদি দেখা যায় নতুন আইনে খুব ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে, আবার  পর্যালোচনা করব। এই ছিল বামফ্রন্ট সরকারের সঙ্গে কর্মচারীদের সম্পর্ক।

এ থেকে কী প্রমাণিত হয়? বামফ্রন্ট সরকারের সঙ্গে কর্মচারীদের লড়াই হয়নি? প্রকৃত প্রস্তাবে সরকার রক্ষা নয়, সেটা ছিল আদতে বামফ্রন্টের নীতি রক্ষার লড়াই। মধ্যেকার দ্বন্দ্বটা তাই ছিল ভ্রার্তৃত্বমূলক, নন-অ্যান্টাগনিস্টিক। কর্মচারী জানত খোদ বামফ্রন্ট সরকারটাকেই  উচ্ছেদ করে দিলে বামফ্রন্টের নীতি রক্ষা করা যাবেনা। তাই আলবাৎ সরকারের সঙ্গে আমাদের লড়াই ছিল, কিন্তু তা শত্রুতামূলক ছিল না। আর নিছক পাওনাগন্ডার কথাও যদি ধরি, স্বাধীনতার পর সব কটা পে কমিশন, ৮-১৬-২৫, হেল্থ স্কিমের মত কর্মচারী স্বার্থবাহী বিষয়ে সারা দেশের মধ্যে পাইওনিয়ার ছিল তো বামশাসিত পশ্চিমবঙ্গই। 

এটা ঠিক যে কেন্দ্রীয় হারে ডিএ আমরা বাম আমলেও কখনও পাইনি, কেবলমাত্র একবার ছাড়া। সবসমই কয়েক কিস্তি পিছিয়ে থেকেছি। কিন্তু মনে রাখা দরকার ১৯৭৭ সালে বামফ্রন্ট ক্ষমতায় আসার বছরে রাজ্য কর্মীদের বকেয়া ডিএ ছিল ৭২%। তবে কেন্দ্রীয় হারে ডিএ পাওয়ার স্বীকৃতিটা এখনকার মত হাই কোর্টে হলফনামা দিয়ে কেড়ে নেওয়া হয়নি। জ্যোতিবাবুতো বটেই, বুদ্ধদেবুও বহুবার প্রকাশ্যে বলেছেন,  কেন্দ্রীয় হারে ডিএ আপনাদের প্রাপ্য। কিন্তু সরকার একটু সমস্যায় আছে। একটু সুযোগ পেলেই দিয়ে দেব। আমরা একটাই পরিবার একটু সমস্যাটা ভাগ করে নিন। এবং ঘটনা হল সে সময় সরকারটা যে সমস্যায় আছে আমরা বুঝতে পারতাম। এই রাজ্যের মন্ত্রী- বিধায়কদের বেতন-ভাতা ছিল সারা দেশের মধ্যে সবথেকে কম। সরকারি অনুষ্ঠানে ফুল দেওয়া অর্ডার করে বন্ধ করে  দিয়েছিলেন অসীম দাশগুপ্ত। সরকারি মিটিং-এ চা-বিস্কুট ছাড়া আর কিছু দেওয়া মানা ছিল। কোনও মন্ত্রী-আমলা ঘর সাজানোয় আড়ম্বর করলে কর্মচারীই রিপোর্ট করত। সেটা পৌঁছে যেত অর্থমন্ত্রীর টেবিলে। মনে আছে একবার বামফ্রন্টের এক মন্ত্রী অ্যাম্বাসেডর ছেড়ে  স্করপিও চড়তে শুরু করায় তুলকালাম করেছিল কো-অর্ডিনেশন কমিটি। আমরা কি এসব বর্তমান পরিস্থিতির সঙ্গে মিলিয়ে দেখব না? 

অনেকে সরকারের সঙ্গে কর্মচারীদের শ্রমিক-মালিক সম্পর্কের কথা বলে। তাই কী? পৃথিবীর ইতিহাসে কবে কোন  মালিক  সার্ভিস রুল সংশোধন করে শ্রমিককে ধর্মঘটের অধিকার দিয়েছে? দিয়ে আবার বলেছে, এই অধিকারটা ছাড়বেন না! কোন মালিক ক্ষমতা দখলের পর প্রথম তিনটে প্রশাসনিক সিদ্ধান্তের একটা নিয়েছে এই মর্মে যে,  কোনও শ্রমিক আন্দোলনে পুলিশ যাবেনা! কোথাও একটুও মনে হয়নি, যে এই সরকারটা অন্য রকম? হ্যাঁ এটা মনে করার কোনও কারণ নেই যে বামফ্রন্ট সরকার সর্বগুণসমন্বিত, ত্রূটিবিচ্যুতিহীন একটি ব্যবস্থা কায়েম করেছিল। তারা নিজেরাও কখনও সেই দাবি করেননি। কিন্তু শ্রমিক-কর্মচারীদের অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার প্রশ্নে যে অবিস্মরণীয় ভূমিকা পালন করেছিল আজ তা মর্মে মর্মে  অনুভব করছে কর্মচারী সমাজ যখন ন্যায্য  দাবিগুলি আজ কুৎসিত ঈঙ্গিতে অনুকম্পার অনুজ্ঞায় বদলে যাচ্ছে। মানুষের উপর বিশ্বাস হারানো পাপ। শেষ পর্যন্ত জনগণের উপর বিশ্বাস আমাদের রাখতেই হবে। আর সেটাই তো এত অপমান আর লাঞ্ছনা সত্বেও আমাদের দপ্তরে কাজের অনুপ্রেরণা যোগায়। সিপিএম আমাদের বেতন দেয়নি, টিএমসি-ও দিচ্ছেনা। আমাদের অন্নের সংস্থান হচ্ছে  রাজ্যের দরিদ্র্যতম মানুষটির পয়সায় যে একটা আট আনার দেশলাই কেনার সময়ও ৫ পয়সা ট্যাক্স দিয়ে যাচ্ছে সরকারি কোষাগারে।  আমার ভাষ্যে একমত না হওয়ার অধিকার সবার থাকছে। স্বাভাবিক। আর আমরাদের লড়াইটাতো ভিন্নমত পোষণের অধিকারের  সপক্ষেও বটে। 

মঙ্গলবার, ১২ সেপ্টেম্বর, ২০১৭

কমিউনিষ্টসুলভ জীবনযাপন ~ আর্কাদি গাইদার

'কমিউনিষ্টসুলভ জীবনযাপন' ইত্যাদি নিয়ে বহু চর্চা চলছে। ইতিমধ্যেই গতকালকে কমিউনিষ্ট পার্টির একজন সদস্য এবিপি আনন্দের স্টুডিওতে এসে ইন্টারভিউতে বলেছেন যে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কাজে তাকে কোথাও যেতে হলে পার্টি থেকে তাকে 'গ্যারেজে' থাকতে দেওয়া হয়েছে। এর থেকে তিনি বাঙালীদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ উপলব্ধি করেছেন।

তো যেটা বলছিলাম, জীবনচর্চা বনাম জীবনচর্যা, এগুলো বেশ ধুসর পরিসর অনেকক্ষেত্রেই। তাই এগুলো নিয়ে চর্চা না করে দুটো গল্প বলি।

২০০৭ সাল। তখন সদ্য ব্যাংগালোরে ট্রেড ইউনিয়ন ফ্রন্টের সাথে অল্প অল্প যুক্ত হচ্ছি। তা এরকম সময় হায়দ্রাবাদে ফ্রী সফটওয়ার কনফারেন্সে আমাদের ভলান্টিয়ার করে পাঠানো হলো। বিভিন্ন রাজ্য থেকে যারা ডেলিগেট এসেছেন, তাদের থাকবার ঘর দেওয়া হয়েছে ইউনিভার্সিটির গেস্ট হাউসে। আমাদের কয়েকজনকে সকালে পাঠানো হলো ত্রিপুরার ডেলিগেটকে নিয়ে সেমিনার হলে আসতে। আমরা সেই ডেলিগেটের ঘরের বাইরে পৌছালাম। ঘর মানে হোস্টেলের যেরকম ঘর হয়, সেরকম। উনি ঘর থেকে বেরিয়ে বললেন - আপনারা একটু বসুন, আমার একটু সময় লাগবে। আমরা বললাম - তাহলে আমরা নিচে আছি, চা সিগারেট খাচ্ছি। নিচে বেশ কিছুক্ষন সময় অপেক্ষা করলাম, তখনও উনি নামছেন না। আবার ওপরে গেলাম। দেখলাম সেই ডেলিগেট একটা বালতিতে নিজের গেঞ্জি জাঙিয়া কেচে জানলায় সেগুলো শুকোতে দিচ্ছেন। আমাদের দেখে হেসে বললেন - সরি, এগুলো জার্নিতে নোংরা হয়ে গেছিলো, তাই কাচতেই হলো। 

ও হ্যা বলে রাখা ভালো, ত্রিপুরার ডেলিগেট ছিলেন সেইসময়ের এবং বর্তমানের ত্রিপুরার মূখ্যমন্ত্রী। 'ফ্রী সফটওয়ার ইন ই-গভর্নেন্স' নিয়ে টক দিতে এসেছিলেন।

২০০৮ সাল। ইতিমধ্যে আমি সরাসরি ট্রেড ইউনিয়ন সদস্য। এবার ঠিক হলো ফ্রী সফটওয়ার ন্যাশনাল কনফারেন্স ব্যাংগালোরে হবে। দায়িত্ব পড়লো আমাদের ঘাড়ে। ব্যাংগালোরের সংগঠনে ফ্রী সফটওয়ার কনফারেন্স সংগঠিত করবার বিষয় অভিজ্ঞ লোক কেউ নেই। তাই আমাদের জানানো হলো যে কেরালার স্টেট প্ল্যানিং বোর্ডের সদস্য জোসেফ থমাস ব্যাংগালোরে আসবেন ১০ -১২ দিন আগে থেকে আমাদের সাহায্য করতে। ঠিক সময় ট্রেন থেকে নামলেন উনি। কলেজের ছাত্রের মতন পিঠে ব্যাগ। নেমেই মিটিং হলো ট্রেড ইউনিয়নের অফিসে। তারপর ওনাকে জানানো হলো যে এই কয়েকদিন ওনার থাকবার এবং খাওয়ার ব্যাবস্থা করে হয়েছে দুই কমরেডের বাড়ি, পালা করে। উনি শুনেই বললেন, থাকবেন না। জিজ্ঞ্যেস করলেন - তোমাদের এই অফিসে রাতে থাকায় নিষেধ নেই তো? তাহলে এখানেই থাকবো। কোথাও যদি লাল ঝান্ডার অফিস থাকে তাহলে সেটা ছেড়ে অন্য কোথাও থাকবো কেন? আমরা তো বুঝতেই পারছি না উনি কিভাবে অফিসে ঘুমোবেন। খাট নেই, গদি তোষক কিছু নেই। কিন্তু উনি থেকেছিলেন। ১২ দিন বেঞ্চের এক কোনে ব্যাগ রেখে তাতে মাথা দিয়ে ঘুমিয়েছিলেন রোজ রাতে।

ওপরের দুই ঘটনার দুই ব্যাক্তি, একই পার্টির সদস্য। আমরা জানি, মার্ক্সবাদী রাজনীতিতে যুক্তি সবার ওপরে, আবেগের খুব একটা জায়গা নেই। কিন্তু এই লোকগুলোকে সামনাসামনি দেখে, হয়তো আবেগে আক্রান্ত হয়েই, মনে হয়েছিলো এই দলটাই করা যায়। এই লোকগুলোকেই কমরেড বলে ডেকে চিরকাল গর্বিত হওয়া যায়।

তো যেই কথা থেকে এত কথার উত্থাপন - ইন্টারভিউ এবং জীবনচর্চা। ১০ বছরের আগের এই দুটো ঘটনা আমার মগজে গরম লোহা দিয়ে খোদাই করা রয়েছে। কালকে মার্কেটে যখন নতুন খোরাক আসবে, তোমাকে কালকেই লোকে ভুলে যাবে। যাও, আপাতত গ্যারেজ হও।

বৃহস্পতিবার, ৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৭

'ঘেউ ঘেউ' বিষয়ক দুতিনটি কথা যা আমি জানি ~ কণিষ্ক ভট্টাচার্য


"তোমাকে কেউ খারাপ কথা বললে তুমি তাকে উলটে খারাপ কথা বলবে না। যে খারাপ কথা বলে সেটা তার শিক্ষা-রুচির অভাবেই বলে। তোমার তার অভাব পড়েনি। তা হলে তোমাতে আর তাতে পার্থক্য থাকে না।" বলে আমার মা আমাকে একটি কবিতা পড়তে দিয়েছিলেন। কবিতাটার শেষ চার লাইন আবার আজ আবার মনে পড়ল। সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের লেখা 'উত্তম-অধম'। তার শেষ চার লাইন ছিল এমন :

"কুকুরের কাজ কুকুর করেছে 
কামড় দিয়েছে পায়, 
তা বলে কুকুরে কামড়ানো কিরে 
মানুষের শোভা পায়? "

আজকে যাকে আমরা কুকুর হিসেবে চিনি সে হল আদিম নেকড়ে। এখন সে যতই ঘেউ ঘেউ করুক না কেন, তার দাঁত আকারে ছোটো হয়ে এলেও, এখনও তার জিনে আত্মরক্ষা আর প্রয়োজনে আক্রমণের তীক্ষ্ণতা আছে। কবীর সুমনের 'বেপরোয়া'  গানটা আমার বড়ো প্রিয়। তার শেষ চারটি লাইন বড়ো ভালো। গানটা শুনতে চাইলে এখানে শুনুন: https://youtu.be/yNA3o62TEBw 

"বেপরোয়া কিছু কুকুরই না হয় হোক
পরোয়া করতে করতে মানুষ মোলো। 
শান্তশিষ্ট ল্যাজবিশিষ্ট লোক
মুখবুজে থেকে প্রভুদের প্রিয় হোক।"

ঘেউ ঘেউ করা কুকুর আমাদের পুরাণ মহাকাব্যের সঙ্গেও যুক্ত। যুধিষ্ঠিরের স্বর্গযাত্রার সঙ্গী ছিল কুকুররূপে ধর্মরাজ। যুধিষ্ঠিরকেও নরক দর্শন করতে হয়। 'ওরিয়ন দ্য হান্টার', যাকে আমরা কালপুরুষ বলি তার পায়ের কাছে রয়েছে 'লুব্ধক', সেও কুকুর। 

লুব্ধক - নবারুণ ভট্টাচার্য
"কোলকাতার ওপরে যে হিংস্র কুকুরটিকে লেলিয়ে দেওয়া হয়েছে সে ঘণ্টায় ১ লক্ষ কিলোমিটার গতিতে এগিয়ে আসছে। তার মাপ ও ওজন এখনই সঠিকভাবে বলা যাচ্ছে না। উন্মত্ত কুকুরটি কোলকাতার ওপরে আছড়ে পড়ে ভস্ম হয়ে উবে যাবে, কিন্তু যে মহা-গহ্বরটি সৃষ্টি হবে তা কুকুরটির ব্যাসের দশগুণ এবং গভীরতা দুগুণ। কুকুরটির যা ওজন তার থেকে একশো গুণেরও বেশি পাথর সে আকাশে উড়িয়ে দেবে। প্রথম আঘাত ও বিস্ফোরণের পর কয়েক লহমা কোনও বাতাস থাকবে না। চাপা আগুন হয়ে ধকধক করে জ্বলবে কোলকাতা। তার পরই আসবে লক্ষ ঝড়ের শেষ নিশ্বাস। দাউ দাউ করে জ্বলে, গলে, পুড়ে ছাই হয়ে খাক হয়ে যাবে কোলকাতা। এর পরে ধুলোর মেঘ বর্মের মতো সূর্যকে আড়াল করবে। কতদিন সেই হিমরাত্রি থাকবে তা বলা যাবে না। ভূ-পৃষ্ঠের তাপমাত্রা মাইনাস ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নেমে যাবে। এবং অনেক মাস ধরে হিমাঙ্কের নিচেই থাকবে। প্রলয়ান্ধকারে কোলকাতাকে ঢেকে রাখবে প্রলয়মেঘ। এই নির্মম ভবিষ্যদ্বাণী মন্ত্রের মতো উচ্চারণ করতে করতে কুকুর উপকথা 'লুব্ধক' তার অন্তিম পর্বে পৌঁছিয়াছে। কোলকাতা এখন এক অসাড়, অপেক্ষমাণ পিঁজরাপোল। তার শাস্তি মৃত্যু। ... ঘেউ ঘেউ!"

পাগলী তোমার সঙ্গে ফেসবুক কাটাব জীবন ~ মনিপর্ণা সেনগুপ্ত মজুমদার

সেসব কোনো এক সোনালী অতীতের কথা। তখন আমরা জানতাম যে  "ট্যাবলেট" হল এক ধরনের গোলাকার বস্তু যা শরীর- টরীর খারাপ হলে লোকে বাধ্য হয়ে গেলে, "ডিক" হল গিয়ে টমের ছোটবেলার বন্ধু, কেউ "ফলো'' করছে মানেই সন্দেহজনক ব্যাপার আর  "ফেস'' এর সাথে 'বুক'  (মন্দ কথা ভাববেন না ) মানে বইয়ের কোন সম্পর্ক নেই । অর্থাৎ ,    "ডোন্ট জাজ আ বই বাই ইটস্‌ কাভার"। তা তারপর অনেক বসন্ত কেটে গেছে, কলকাতা তিলোত্তমা বা মিস্‌ ইন্ডিয়া বা মিস্টার লন্ডন কিছুই হতে পারেনি কিন্তু আমাদের অভিধানে বিস্তর নতুন শব্দাবলী সংযোজিত হয়েছে। আর যেমন দাড়িদাদু বলে গেছেন বহু বছর আগে "বিশ্বজোড়া ফাঁদ পেতেছ, কেমনে দিই ফাঁকি"... আমরা হুবহু তেমনিভাবেই আন্তর্জালের ফাঁসে আট্‌কে পড়েছি। বেরোনোর পথ নেই, আর বেরোলে বেঁচে থাকাই মুশকিল হয়ে দাঁড়াবে কারণ আমরা এখন ঘুম থেকে উঠে দাঁত মাজার ছবিও ফেসবুকে পোস্ট করি। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে কীভাবে সেল্‌ফি তুলতে হয় সে বিষয়ে বিশদ জানার জন্য  দরকার পড়লে এমনকি ডক্টর লোধের সঙ্গেও অ্যাপয়েন্টমেন্ট করতে রাজি হয়ে যাবেন অনেকে। এমনই সংকটাপন্ন অবস্থা! :/  

তা কিছু ত আর করার নেই। জীবন মানে এখন আর জি-বাংলা নয়, জীবন হল ফেসবুক, ট্যুইটার এবং হোয়াটস্‌ অ্যাপ। অস্বীকার করার উপায় নেই মশাই, জীবনের নানা ওঠাপড়া আপনার গায়ে লাগতে দিচ্ছেনা এই এরাই। বোরোলীনের মত চিপকে রয়েছে আপনার সাথে। এরা না থাকলে কিভাবে জানতে পারতেন যে জনতা কত্ত কিছু জা্নে!!কেউ কারো চেয়ে কম যায়না। 
"তুই কুরোসাওয়া নিয়ে জ্ঞান দিচ্ছিস? জানিস আব্বাস কিয়ারোস্তামি আমাদের বাড়িতে এসে নিজে হাতে ইরানী চা বানিয়ে খাইয়েছে ?"  এবার যারা জানেনা তারা গুগ্‌ল করে মরুক আব্বাস মালটা অ্যাকচুয়ালি কে! শেফ্‌ না  ছবি-করিয়ে নাকি চা বাগানের মালিক !! এভাবে তো আমার-আপনার জ্ঞানভান্ডার-ও বৃদ্ধি পাচ্ছে । হুঁ হুঁ বাওয়া, জীবনের ধন কিছুই যায়না ফ্যালা। 

তবে এসব মোটামুটি সহ্যের মধ্যে। মানে আপনার পোষালে পড়ুন,না পোষালে ইলিশের আমদানি এবছর এত বেশি হওয়ার কারণ কী বা ঠিক কী কী করলে পশ্চিমবঙ্গে অচিরেই আবার লাল গোলাপ বিকশিত হবে সে ব্যাপারে অন্যদের সঙ্গে আপনার মূল্যবান মতামত শেয়ার করুন। কিন্তু আসল মুশকিল হল অন্য জায়গায় …সে বিপদের নাম 'লাইক'। 😑

এই 'লাইক' যে কত-শত ন্যাংটো বেলার বন্ধুর বিচ্ছেদ ঘটিয়েছে, কত যুবককে হি-ম্যান বা যুবতীকে ক্যাটরিনা এবং আলিয়ার সংমিশ্রণে তৈরি এক উন্নততর মানুষী তে পরিণত করেছে তার হিসেব কে-ই বা রাখে। আপনি যত বেশি "লাইক" করবেন ততই আপনাকে লোকে লাইক করবে। ভয়ংকর এক ভিশাস সার্কেল। ধরুন, আপনি আপনার ফেসবুকিয় বন্ধু্র ছবি 'লাইক' করলেন, সে করতেই পারেন কিন্তু নিয়ম হল শুধু আপনার বন্ধুর ছবি লাইকালেই চলবে না, সে যদি তার পোষা কুকুরের উকুনের ছবি 'ম্যাক্রো' বলে পোস্ট করে সেটাও আপনাকে লাইকাতে হবে, তার মেজ শালার পিসিশাশুড়ির বাঁধানো দাঁতের ছবি দেখেও "হাউ নাইস, হোয়াট আ সাররিয়াল পিকচার!"  বলতে হবে। পারলে ভালো না পারলে আপনার 'আন্‌সোশ্যাল' হওয়া আটকায় কে! এই 'লাইকের' চক্করে পড়ে কত কত চো…মানে মদ্‌না যে নিজেদের কেউকেটা ভেবে সুখে কালাতিপাত করিতে লাগিল তা আপনার ধারণারও অতীত।

যাইহোক, এসব নিয়ে বেশি ভাবতে বসলে আবার ওদিকে হোয়াটস্‌ অ্যাপে এককাঁড়ি মেসেজ জমে যাবে। ট্যুইটারে হাজারখানেক আপডেট মিস হয়ে যাবে …… অতএব সেই ধর্ম -ই ফলো করা যাক। নেট দুনিয়ার সকল ভাল, আমিও ভাল, তুমিও ভাল :-) 

বিঃদঃ – এসব লিখলাম বলে আবার যেন ভুলেও ভেবে বসবেন না আমি 'লাইক', 'ফলো' ইত্যাদি ব্যাপার অপছন্দ করি। খুব-ই মানে……হেঁ হেঁ…বুঝলেন কিনা… 😍

সোমবার, ৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৭

মাইনরিটি ~ সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়


 (পরশুরামের কুঠারটি ধার করেছি) 

-          প্রাতিঃকালে ব্যোমি হয়?

-          আজ্ঞে … না তো

-          হয় হয় ZIনতি পারোনা

-          সায়ান্নে প্যাটে ব্যাথা হয়?

-          আজ্ঞে তাও তো ...

-          হয় হয় ZIনতি পারোনা, চক্ষু ডুম্বুরাইয়া যায়। তা বাবা, অ্যাালোপ্যাথ ছেড়ে এই বুড়ো কবরেজের কাছে কেনো?

-          আজ্ঞে সে কি আর যাইনি? অ্যালোপ্যাথ, হোমিওপ্যাথ সব করে ফেলিচি কবরেজ মশায়

-          তারা কি বলে?

-          আজ্ঞে একজন বললে স্ট্র্যাঙ্গুলেটেড গ্যাংলিয়া, আর একজন বললে আমার মাথায় ডিফারেন্সিয়াল ক্যালকুলাস হয়েছে, তাই এই চিন্তা আর ভয়

-          তা ভয়ডা কিসের শুনি?

-          আজ্ঞে কবরেজমশায়, সব সময়েই মনে হয় আমি চাপে।  আমাকে যেন পিষে ফেলছে, দম নেবার জায়গা নেই। আমি... আমি সংখ্যালঘু

-          আপনে কি ইয়ে? অবিশ্যি দাড়ি আর টুপি দেখে সেটাই মনে হয়......

-          আজ্ঞে হ্যাঁ কবরেজমশায়, মনে হয়, আমার সবাই আমাকে সন্দেহের চোখে দেখে, টেররিস্ট ভাবে

-          তা আপনের কি করা হয় মিঞা সায়েব?

-          আজ্ঞে আমি রসুলপুর প্রোমোদাসুন্দরী প্রাইমারি ইস্কুলে টিচারি করে...

-          ছেলে মেয়ে কটি?

-          আজ্ঞে আমার তো ওই একটিই...... এইবার এইচ এস পাশ করল, ফার্স্ট ডিভিশনে

-          ট্যাহা পহায় চলে?

-          চলে না কবরেজমশায়, তার ওপর এই মনের ব্যামো, অ্যালোপাথি করাবো, সে সামর্থ কই? অবসরের পর কি করব জানিনা...বাড়িতে আরো লোক জন, আমি একলা চাকুরে...

-          বাড়ি কি নিজের?

-          আজ্ঞে ভাড়া বাড়ি, নিজের করার সামর্থ্য হলো কই? ছেলেকে পড়াতেই......

-          আপনে সইংখ্যালঘু এইটে কে কইলো মিঞা সায়েব?

-          মানে, কবরেজমশায়, আমি তো, আমি তো......

-          ট্যাহা পহা নাই, নিরাপত্তা নাই, চাকরি আছে বটে, কিন্তু তাতে চলে না, পোলারে পড়াইবেন, সে সামর্থ্য নাই...

-          না, মানে আমি তো ঠিক সেই অর্থে খেতে না পাওয়া গরীব মানুষ না

-          ইশকুল বন্ধ হইলে, কি তাড়ায়ে দিলে খাবেন কি? যাবেন কই?

-          কোনো চুলো নেই যাবার কবরেজ মশায়, তার ওপরে এই মনের ব্যামো

-          কিস্যূ হয় নাই আপনের। খামোখা আইছেন এহানে। আপনি মাইনরিটি না

-          মাইনরিটি না?

-          আইজ্ঞা না

-          তাহলে?

-          অই যে, ট্যাহা পহা নাই, সরকারে পকেট ফাঁক করতাসে, এই ট্যাক্সো, ওই কর, নোটবন্দি, তার ওপর জমানো কিস্যু নাই, জমি নাই, কাল কি খাইবেন চাকরি গেলে জানা নাই, আপনি সংখ্যালঘু কয় কেডা মিঞা সায়েব? আপনে হইলেন এই দ্যাশের সংখ্যাগুরু, আপনেরা হইলেন নব্বুই ভাগ। আর যাদের আছে, তারা হইল দশ ভাগ। কি বুঝলেন?

-          কথাটা ভুল বলেন নি । তবে......

-          আবার তবে, টুপি দাড়ি আপনের পছন্দের, আপনের ইমানের, ইমানকে দাঁড়ি পাল্লায় চড়িয়ে কম বেশী মাপনের কি দরকার কন দেহি? বরং জোর গলায় কয়েন, আপনি হইলেন সেই সংখ্যাগুরু যাঁদের বাড়ি আজ আছে, কাল নাই। কাল কি হবে , জানা নাই। দেখবেন, মনের ব্যামো উধাও। এক্কেবারে উধাও

-          তাহলে তো ... কবরেজ মশায়...

-          আবার কি হইল?

-          আপনার কথায় বেশ বল পাচ্ছি।

-          পাইবেনই তো। এবার আপনাদের এই নব্বুইজনের বলটা ওই মাইনরিটি ১০ জনেরে একটু টের পাওয়ান দেহি......