শনিবার, ৩০ জানুয়ারী, ২০২১

ভক্ত ~ রণদীপ নস্কর

জন্তুটার রকম-সকম দেখে আমার ভারি অদ্ভুত লাগল। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, "তুমি কী? তোমার নাম কী?"

সে খানিকক্ষণ ভেবে বলল, "আমার নাম ভক্ত। আমার নাম ভক্ত‌, আমার ভায়ের নাম ভক্ত, আমার বাবার নাম ভক্ত‌, আমার পিসের নাম ভক্ত—"
আমি বললাম, "তার চেয়ে সোজা বললেই হয় তোমার গুষ্টিসুদ্ধ সবাই ভক্ত।"

সে আবার খানিক ভেবে বলল, "তা তো নয়, আমার নাম বিদ্যাসাগর কলেজের ছাত্র! আমার মামার নাম বিদ্যাসাগর কলেজের ছাত্র, আমার খুড়োর নাম বিদ্যাসাগর কলেজের ছাত্র, আমার মেসোর নাম বিদ্যাসাগর কলেজের ছাত্র, আমার শ্বশুরের নাম বিদ্যাসাগর কলেজের ছাত্র—"

আমি ধমক দিয়ে বললাম, "সত্যি বলছ? না, বানিয়ে?"

জন্তুটা কেমন থতমত খেয়ে বলল, "না, না, আমার শ্বশুরের নাম ক্ষুদ্র কৃষক পরিবারের ছেলে।"

কাট টু

শেয়াল বলল, "হাসছ কেন?"

হিজিবিজবিজ বলল, "একজনকে শিখিয়ে দিয়েছিল, তুই সাক্ষী দিবি যে, দেশদ্রোহীর বড় বড় দাড়ি, দেশদ্রোহী ঠিক বানানে লেখে, দেশদ্রোহীর গায়ে বেগুনি রঙ থাকে না। উকিল যেই তাকে জিজ্ঞাসা করেছে, তুমি লালকেল্লা চেনো? অমনি সে বলে উঠেছে, আজ্ঞে হ্যাঁ, লালকেল্লার বড় বড় দাড়ি, লালকেল্লা ঠিক বানানে লেখে, লালকেল্লা লাল হয়, বেগুনি রঙের নয়—হোঃ হোঃ হোঃ হো—"

শেয়াল জিজ্ঞাসা করল, "তুমি মোকদ্দমার বিষয়ে কিছু জানো? কৃষকদের চেনো?"

হিজিবিজবিজ বলল, "তা আর জানি নে? আমি নিজেই ক্ষুদ্র কৃষক পরিবারের ছেলে। আমরা এতটাই গরিব, ট্র্যাক্টর তো দূর, বলদ ছিল না বলে আমাকে দিয়েই চাষ করানো হত। তারপর থেকেই আমার মাথায় বলদের মত বুদ্ধি। আমি একাধারে ক্ষুদ্র কৃষক পরিবারের ছাত্র, বিদ্যাসাগর কলেজের ছেলে, লালকেল্লার অতিথি এবং ভিক্টোরিয়ার প্রত্যক্ষদর্শী। আমি নিজে চোখে দেখেছি কৃষক পরিবারে মূর্তি ভাঙার ঘটনা। এও জানি, বিদ্যাসাগর কলেজে কোনওরকম শ্লোগান ওঠেনি।"

শেয়াল বলল, বটে? তোমার নাম কী শুনি?"

সে বলল, "এখন আমার নাম হিজিবিজ‌বিজ‌।"

শেয়াল বলল, "নামের আবার এখন আর তখন কী? হিজি বিজ্‌ বিজ্‌ বলল, "তাও জানো না? এখন আমার নাম ভক্ত, ভোটের পরেই আমার নাম হয়ে যাবে কর্মহীন, অথবা অ-নাগরিক, অথবা দেশদ্রোহী।" বলে জন্তুটা ভয়ানক ফ্যাকফ্যাক করে হাসতে লাগল।

[সুকুমার রায়ের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিয়ে...] 

বুধবার, ২৭ জানুয়ারী, ২০২১

পতাকা তোলার গল্প ~ সমুদ্র সেনগুপ্ত

পাঞ্জাবের খুব বেশি মানুষকে আমি চিনি না। যাদের চিনি তাদের একজনের পতাকা তোলার গল্প শুনিয়ে যাই-

"মার্চ ১৯৩২ সাল। ওই সময় সবে পরীক্ষা দিয়ে উঠেছি, সায়েন্স প্র্যাকটিক্যাল তখনো বাকি। ভগত সিং এর প্রথম শহিদ বার্ষিকী পালনের কথা হচ্ছে। গর্ভনর এর সেদিন জলন্ধর থেকে ৪০ কিমি দূরে হোসিয়ারপুর দেখতে আসার কথা। জেলা কংগ্রেস কমিটি ঘোষণা করলো যে সেদিন জেলা আদালত প্রাঙ্গনে ইউনিয়ান জ্যাক এর বদলে ত্রিবর্ন পতাকা ওড়ানো হবে। এই কর্মসূচি বানচাল করার জন্য জেলা শাসক আর্মি মোতায়েন করেন আর কেউ পতাকা তোলার চেষ্টা করলে তাকে গুলি করার আদেশ জারি করেন। 

সেদিন হোসিয়ারপুর পোঁছে মন খারাপ। শুনলাম পতাকা তোলার কর্মসূচি বাতিল করা হয়েছে। কংগ্রেস অফিস সম্পাদক হনুমানজির কাছে দাবি করলাম কেন বাতিল হল। উনি প্রশ্ন করলেন, গুলি চালানোর আদেশ এর কথা আমি জানি কি না। তাই শুনে খেপে গিয়ে পাল্টা বল্লাম, "গুলি খাওয়ার ভয়ে আপনারা হাল ছেড়ে দিলেন ? এত জাতির প্রতি অপমান!" উনি পাল্টা চ্যালেঞ্জ করে বসেন," এতই যদি তোমার সাহস, তাহলে তুমিই পতাকা তুলে দেখাও।"

আমি অফিসের একটি ডান্ডায় লাগানো পতাকা খুলে নিয়ে কোর্টের দিকে দৌড়ালাম। সেই আদালত যাকে সেই সময়ে ব্রিটিশ শক্তির একটা নিদর্শন হিসেবে ধরা হতো। কর্মসূচির নির্ধারিত সময় পেরিয়ে যাওয়াতে তখন পুলিশ আর সেনাবাহিনীর মধ্যে একটু ঢিলেঢালা ভাব। তার সুযোগ নিয়ে সিঁড়ি টপকে ছাদে উঠলাম, ইউনিয়ন জ্যাক খুলে নামিয়ে দিলাম। লাগিয়ে দিলাম ত্রিবর্ন পতাকা। তাই দেখার পরে গুলি চালানো শুরু হয়। দুটো গুলি আমার কাছ দিয়ে বেরিয়ে যায়, গায়ে লাগেনি। ডেপুটি কমিশনার বাখলে বেরিয়ে আসেন। আমাকে বাচ্চা ছেলে দেখে তিনি গুলি চালানো বন্ধ করার আদেশ দেন। আমি স্লোগান দিতে শুরু করি। আমার কাছে কোনো অস্ত্র নেই, আমি নিরস্ত্র এটা নিশ্চিত হওয়ার পরে সেনারা সিঁড়ি বেয়ে উঠে আসে। আমাকে গ্রেপ্তার করে জেলে নিয়ে যায়।

পরের দিন বিচার শুরু হয়। ম্যাজিস্ট্রেট নাম জিজ্ঞেস করলে বলি, "আমার নাম লন্ডন তোড় সিং।" আসল নাম কিছুতেই বের করতে পারেনি। যা করেছি তার দায় স্বীকার করি, ভগত সিং এর অনুপ্রেরণার কথা বলি। আমার এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ডের আদেশ হয়। "মাত্র এক বছর ?" ম্যাজিস্ট্রেটকে জিজ্ঞেস করাতে উনি বাড়িয়ে চার বছর কারাবাস এর আদেশ দেন।" 

সেদিন জাতীয় পতাকা তোলার জন্য প্রাণ তুচ্ছ করে এগিয়ে আসা কিশোরের আসল নাম হরকিসেন সিংহ সুরজিৎ। ডান্ডা বেড়ি পরে অকথ্য পরিবেশে হাজতবাস করা সেদিনের সেই কিশোর পরবর্তীকালে ভারতের  মার্ক্সবাদী কম্যুনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক হয়েছিলেন।

সুরজিৎ এর ফ্ল্যাগ পোল ছিল ব্রিটিশ কোর্টের ছাদে লাগানো। এর পাশাপাশি লাল কেল্লার র‍্যামপার্ট এ পতাকা লাগানোর কাহিনী একটু ছোট করে আসুক। 

আরএসএস এর ভাষায়, "ভাগ্যের ধাক্কায় ক্ষমতায় আসা লোকেরা আমাদের হাতে তেরঙা তুলে দিতে পারে তবে হিন্দুরা এটি কখনও শ্রদ্ধা করবেন না, নিজেদের বলে  মনেও করবেন না। তিন শব্দটি নিজেই একটি শয়তানি শব্দ এবং তিনটি বর্ণের সমাহারে তৈরি একটি পতাকা অবশ্যই একটি খুব খারাপ মনস্তত্ত্ব এর জন্ম দেবে। লালকেল্লায় র‍্যামপার্ট এ "ভাগয়া ধজ তুলতে হবে " 

লাল কেল্লার মাথায় এখনো তেরঙ্গা পতাকা উড়ছে। র‍্যামপার্ট এর ফ্ল্যাগপোলে ভাগোয়া ধজ তুলে ধরার ইচ্ছে দেশের মানুষ পূরণ হতে দেয় নি। সেই ইচ্ছে বুকে নিয়ে গুমরে মরা আরএসএস আজ দেশ ভক্তি শেখাতে আসে লন্ডন তোড় সিংদের। হাসি পায়। হাসি।

সূত্র: 
১) সাক্ষাৎকার, মানিনী চ্যাটার্জি, আগস্ট ১৬, ২০০৮ ফ্রন্টলাইন পত্রিকা
২) প্রবন্ধ, আমান সিং, মে ২৬, ২০০৯, শিখ ফিলজফি
৩) প্রবন্ধ, ভেঙ্কটেশ রামকৃষ্ণনন, আগস্ট ১৬, ২০০৮, ফ্রন্টলাইন পত্রিকা।
৪) অর্গানাইজার, আর এস এস মুখপাত্র, ১৪ই আগস্ট, ১৯৪৭

বৃহস্পতিবার, ২১ জানুয়ারী, ২০২১

গোমাংস ভক্ষণ ~ শমীন্দ্র ঘোষ



বৈদিকসাহিত্যে সোচ্চারে গোমাংস খাওয়া সমর্থিত। গোবধ, গোমাংস রান্না, খাওয়া, দান, গোমাংসের কার্যকারিতা নিয়ে ভুরিভুরি বিবরণ রয়েছে বৈদিকসাহিত্যে ও বেদত্তোর পৌরাণিক সাহিত্যে। অধুনা প্রচারিত যে, হিন্দুদের শাস্ত্রগুলি নাকি শাকান্ন ভোজনের উপর গুরুত্ব দিয়েছে। তা সর্বাংশে সত্য নয়; বরং শাকান্ন ভোজন থেকে গোমাংস ভোজনের ওপর বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। অতিথি আপ্যায়ণে গোমাংসই শ্রেষ্ঠ ছিল, এমন বিবরণ পাচ্ছি ঋগ্বেদে এবং বৈদিকসাহিত্যে। অতিথি আগমন মানেই গোবধ করতে হবে, গোমাংস দিতে হবে, এটাই ছিল রীতি। অতিথিদের ও গোবধের স্থানকে #গোঘ্ন বলা হতো। আদপে বৈদিক আর্য তথা নর্ডিকরা ছিল বর্বর, দুরন্ত যোদ্ধা এবং যাযাবর ও পশুপালক। চাষাবাদ, খাদ্যোত্‍পাদন জানত না। পালিত পশুর মাংসই প্রধান খাদ্য, সঙ্গে ফলমূল, দুধ। তারা মূলত মাংসাশী ছিল। তাদের সবচেয়ে প্রিয় ঘোড়ার মাংস, দ্বিতীয় প্রিয় গোমাংস। এজন্যই তাদের ধর্মীয় সমস্ত পরবেই পশুহত্যা ছিল এবং যজ্ঞে দেবতাদের উত্‍সর্গ করে খেত; অশ্বমেধ, গোমেধ তাদের যজ্ঞের রীতি ছিল। ঘোড়ার মাংস রান্না ও খাওয়ার লোলুপতা ঋগ্বেদে, পরবর্তীকালের গ্রন্থে বর্ণিত। গোমাংসের জন্য হাপিত্যেশের বিবরণও ভুরিভুরি।
বৈদিক আর্যরা হিন্দুকুশ পেরিয়ে যত পূর্ব ও দক্ষিণে ঢুকেছে, দেখেছে অশ্বের তুলনায় গরুর প্রাচুর্য ও সহজলভ্যতা। ফলে আহারে গোমাংস জনপ্রিয় হয়। পরে রীতিই হয়ে ওঠে। মনুসংহিতাতেও গোমাংস নিষিদ্ধ নয়।
ব্যাপক গোবধের জন্য গরুর সংখ্যা কমতে থাকে। গোবধে তিতিবিরক্ত হয়ে বৈদিকদেরই একশ্রেণি এর বিরোধিতা করে। ক্ষোভ প্রশমণে গোমাংস ভোজনের ওপর কিছু কিছু বিধিনিষেধ আরোপিত হয়। পৌরাণিককালেও গোবধ নিষিদ্ধ হয়নি, তবে গোবধ, গোমাংস ভোজন ও ব্যবহার কমানো হয়েছিল।
তারপরেও গোমাংস চলত।
ভারতবর্ষে ইসলাম আগমনের পরেও গোমাংস ভোজন হিন্দু ও ইসলামীদের দ্বারা চলেছে। কিন্তু, হিন্দুরা যেহেতু পৃথক ধর্মের, তাই হিন্দুধর্মের স্বতন্ত্র পরিচয় বজায় রাখতে গোমাংস ভোজন ছাড়ে হিন্দুরা। এইসময়ে খাদ্যে নানান বিধিনিষেধ আনা হয়। মাছ, শূকর, মেষ, মুরগি, পেঁয়াজ, রসুন ইত্যাদি খাওয়া নিষিদ্ধ হয় ব্রাহ্মণদের দ্বারা; ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে নিষিদ্ধ খাদ্যতালিকা রয়েছে। অথচ, তৈত্তিরীয় সংহিতায় ইন্দ্রকে শূকর বলি দেওয়ার কথা রয়েছে। তবে, ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ মতে ব্রাহ্মণরা পূর্ণিমা ছাড়া অন্য তিথিতে দেবতার উদ্দেশ্যে বলিপ্রদত্তের মাংস খেতে পারে।
বাংলা অঞ্চলের মানুষ মাছ খেত সহজলভ্যতায়, স্বাভাবিকতায়। ধর্মরক্ষায় লুকিয়ে খেত। ধরা পড়লে বৌদ্ধ বা পরে ইসলাম হতো। এটা রুখতে সেইসময়ে এই বাংলা অঞ্চলের বিখ্যাত পণ্ডিত ভবদেব ভট্ট, জীমূতবাহন হিন্দু ব্রাহ্মণের মাছ খাওয়ার বিধিনিষেধ তুলে নিলেন ও খাদ্যে, ভোজনে সংস্কার করলেন। এইসময় থেকেই উত্তর ও পশ্চিমভারতের বিশেষত গোবলয়ের হিন্দুদের সঙ্গে পূর্বভারতের হিন্দুদের খাদ্যে, ভোজনে, আচারে স্পষ্ট পার্থক্যের শুরু।
কালে কালে উত্তর ও পশ্চিমভারতের অতি আবেগপ্রবণ একশ্রেণির হিন্দু গরুকে দেবতা বানায়; গরুপূজা শুরু হয় এই ঊনবিংশ-বিংশ শতকে। অথচ, হিন্দুরা যে যে গ্রন্থগুলোকে ধর্মগ্রন্থ বলে এবং মানে, সেসবে গোবধ ও গোমাংস ভোজন রয়েছে রমরমিয়ে। গোদান আদপে গোমাংস দানের অপভ্রংশ রূপ।

হিন্দু ধর্মগ্রন্থ থেকে গোবধ ও গোমাংস ভোজনের উদাহরণ---
১) শ্রাদ্ধে অতিথিদের গোমাংস ভক্ষন করালে পূর্বপুরুষ ১ বছর স্বর্গসুখ পেতে পারে, এই উপদেশ যুধিষ্ঠিরের প্রতি পিতামহ ভীষ্মের, (মহাভারত, অনুশাসন পর্ব, অধ্যায় ৮৮)।
২) বিরাট রাজার গোশালায় দৈনিক ২০০০টি গরু বলি দেওয়া হতো। ফলে রক্তনদী তৈরি হয় রাজপ্রাসাদের গা বেয়ে।
৩) রাম গরুর মাংসের সঙ্গে মদ খেতে ভালবাসত। বনবাস-প্রাক্কালে মায়ের কাছে রামের আক্ষেপ, সে ১৪ বছর গোমাংস খেতে ও সোমরস পান করতে পারবে না এবং সোনার খাটে ঘুমাতে পারবে না; "রাম গোমাংস ভক্ষণ করতেন।" (বাল্মীকী রামায়ণ, আদিকাণ্ড, অযোধ্যাকাণ্ড)।
রাম, লক্ষ্মণ, সীতা বনবাসে যাবার পথে ভরদ্বাজমুণির আশ্রমে বৃষমাংস, মধুপর্ক, ফলমূল খেয়েছিল, (বাল্মীকী রামায়ণ ২/৫৪)। 
৪) গোহত্যা এবং গোমাংস খাওয়ার বিধান রয়েছে শতপথ ব্রাহ্মণ ১১১/১/২১।
৫) ঋগ্বেদে বৈদিকআর্যদের গোমাংস খাওয়ার বহু উল্লেখের থেকে---
"ইন্দ্র বলল তাদের খাওয়ার জন্য ২০টি ষাঁড় রান্না করা হয়েছে (ঋগ্বেদ ১০/৮৬/১৪)।
গোমাংস ইন্দ্রের অতিপ্রিয় ছিল।
ঋগ্বেদে অগ্নির উদ্দেশ্যে ঘোড়া, বলদ, ষাঁড়, দুগ্ধহীন গাই, মেষ বলির উল্লেখ আছে। গরু বা ষাঁড়গুলিকে বৈদিকআর্যরা তরোয়াল বা কুড়ুল দিয়ে হত্যা করতো।
একটি বেঁটে ষাঁড় বিষ্ণুর উদ্দেশ্যে, একটি চিত্‍কপালী শিংওয়ালা গরু ইন্দ্রের উদ্দেশ্যে, একটি কালো গরু পুষনের উদ্দেশ্যে, একটি লাল গরু রুদ্রের উদ্দেশ্যে বলি দেওয়া হতো।
ঋগ্বেদ সংহিতায় "বিবাহসূক্ত"-এ কন্যার বিয়েতে সমাগত অতিথিদের গোমাংস পরিবেষনের জন্য অজস্র গরু বলির বিধান আছে, (ঋগ্বেদ সংহিতা ১০/৮৫/১৩)।
৬) তৈত্তিরীয়ব্রাহ্মণে "পঞ্চশারদীয়-সেবা" নামক ভোজন অনুষ্ঠানের প্রধান বৈশিষ্ট্য, ৫বছরের কম বয়সী ১৭টি বাছুরের মাংসে অতিথি আপ্যায়ন।
৭) বিষ্ণুপুরাণও গোমাংস ভোজনকে সমর্থন করেছে। শ্রাদ্ধের দিনে ব্রাহ্মণদের মৎস্যদানে ২মাস, শশক মাংস দানে ৩মাস, ছাগ মাংস দানে ৬মাস, মেষ মাংস দানে ১০মাস এবং গোমাংস দানে ১১মাস পিতৃগণের আত্মা পরিতৃপ্ত থাকে, (বিষ্ণুপুরাণ ৩/১৬, ঔর্ব্য মুনির বচন)।
৮) গোপালকেরা মাংসের জন্য ছাপ দেওয়া গরুর মাংস কাঁচা অথবা শুকিয়ে বিক্রি করতে পারে, (চাণক্য অর্থশাস্ত্র ২/২৯/১২৯)।
৯) চরকসংহিতা গোমাংসের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা ও পুষ্টিগুণের কথা বলেছে এবং গোমাংস খাওয়া সমর্থন করেছে। গোমাংস বাত, নাক ফোলা, জ্বর, শুকনো কাশি, অত্যাগ্নি (অতিরিক্ত ক্ষুধা বা গরম), কৃশতা প্রভৃতি অসুখের প্রতিকারে বিশেষ উপকারী (চরকসংহিতা ১/২৭/৭৯)।
১০) সুশ্রুতরও একই সুর, গোমাংস পবিত্র এবং ঠান্ডা; হাঁপানি, সর্দিকাশি, দীর্ঘস্থায়ী জ্বর, অতি ক্ষুধা, বায়ু বিভ্রাটের নিরাময় করে, (সুশ্রুতসংহিতা ১/৪৬/৪৭)।
.
প্রশ্ন,
বেদসংহিতা, ব্রাহ্মণগ্রন্থ, পুরাণ, মনুসংহিতা, মহাভারত, রামায়ণ হিন্দুদের ধর্মগ্রন্থ। হিন্দুরা কি এই ধর্মগ্রন্থগুলো মানে না?
.
অতএব, গোমাংস হিন্দুদের বৈধ।
© #কপিরইটভূক্ত
#শমীন্দ্রঘোষ
২০/১০/১৮

শনিবার, ১৬ জানুয়ারী, ২০২১

কোভিভ ভ্যাকসিন কিছু প্রশ্ন কিছু জবাব ~ সমূদ্র সেনগুপ্ত

ভারত একটা গণতান্ত্রিক দেশ। টিকা নেয়া না নেয়া নিজস্ব ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত। আমি স্বাস্থ্য কর্মী হিসেবে নিজে নিয়েছি এবং অন্যদের নেয়ার অনুরোধ জানাচ্ছি, গুজবে কান না দিয়ে আপনারাও নিন।  সেই অনুরোধ জানানোর সাথে কেন জানাচ্ছি তা ব্যাখ্যা করার দায় থেকে যায়। 

প্রথমে আসা যাক ভ্যাকসিন ঘটিত পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নিয়ে যার চরম রূপ হল মৃত্যু। গুজব রটানো হয়েছে যে ভ্যাকসিন নিয়ে মৃত্যু ঘটেছে। এ ক্ষেত্রে যা বলার তা হল, টেম্পোরালিটি অর্থাৎ ঘটনাক্রম দিয়ে কজাল অর্থাৎ কার্যকারণ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করা এক ধরণের ফ্যালাসি বা কুযুক্তি। কাক ডাকলো আর তার পরে তাল গাছ থেকে তাল খসে পড়লো এ দুটোর মধ্যে কোনও কার্যকারণ সম্পর্ক নেই। ভ্যাকসিন নিল আর তার পরে মরে গেল মানেই ভ্যাকসিন এর জন্য মরে গেল তা নয়। অন্য কারণ থাকতে পারে। যার মৃত্যুর উদাহরণ দেওয়া হচ্ছে, তিনি ভ্যাকসিন এর কারণে মারা গেছেন সেটি বৈজ্ঞানিক ভাবে প্রমাণিত হয়েছে কিনা দেখতে হবে।

দ্বিতীয় যে গুজব রটানো হচ্ছে তা হল এই যে ব্যবসায়িক বা রাজনৈতিক স্বার্থ পূরণের জন্য ভ্যাকসিন তৈরির যে প্রথাগত পর্যায় বা সময়কাল লাগে তা ক্ষুন্ন করে অস্বাভাবিক দ্রুততায় এই ভ্যাকসিন তৈরি, অনুমোদন ও বাজার এ আনা হয়েছে। এর আগে ভ্যাকসিন তৈরির দ্রুততার রেকর্ড ছিল চার বছর, মাম্পস ভ্যাকসিনের ক্ষেত্রে। ডঃ মরিস হিলম্যান নিজের মেয়ের নামে জেরিল লিন স্ট্রেন তৈরি করেন ষাট এর দশকে। কোভিভ এর ক্ষেত্রে রেকর্ড ভাঙা হল একবছর এর কম সময়ে। 

এটা মনে রাখা দরকার যে সময়ের ওই রেকর্ড ভাঙার পেছনে ব্যবসায়ীক রাজনৈতিক তাগিদ ছাড়াও অন্য কারণ আছে। সারা পৃথিবীতে পঞ্চাশটির বেশি পরীক্ষাগারে একই সাথে একটি রোগের ভ্যাকসিন তৈরির চেষ্টা এর আগে কোনো দিন হয় নি। ষাট এর দশকের পরে মেডিক্যাল সায়েন্স, ন্যানো টেকনোলজি, মলিকুলার বায়োলজি, কেমিস্ট্রি, ফিজিক্স এত এগিয়ে গেছে তা অকল্পনীয়। 

এই এক বছরের রেকর্ড সময়ে আবিষ্কার সম্ভব এর পেছনে বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার গবেষকদের বহু বছরের সাধনা আছে। যেমন অক্সফোর্ড - এস্ট্রাজেনেকা ভ্যাকসিন যে "ভাইরাল ভেক্টর টেকনোলজি" ChAdOx1 কাজে লাগিয়ে তৈরি হয়েছে সেটা গত দশ বছরের গবেষণার ফল। ওই প্রযুক্তি ব্যবহার এই নতুন ভাইরাসের ভ্যাকসিন তৈরির কাজে লেগেছে। ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল এর আরেকটি প্রতিবন্ধকতা অর্থাৎ স্বেচ্ছাসেবক জোগাড় করাও এই ভ্যাকসিন এর ক্ষেত্রে কোনও সমস্যা হয়েই দাঁড়ায় নি। 

তৃতীয় যে গুজব ছড়ানো হচ্ছে তা হল কার্যকারিতা নিয়ে। ভাববাদী শাস্ত্রগুলি থেকে যুক্তিবাদী বস্তুবাদী বিজ্ঞান এখানেই আলাদা যে বিজ্ঞান কোনো দিন দাবি করে না যে শেষ কথা বলে ফেলেছে, আর কিছু বলার নেই। ভ্যাকসিন এর দ্বিতীয় ডোজ এর এক মাস পরের ডাটা সংগ্রহ করা গেছে। এবং দেখা গেছে যে তাতে যথেষ্ঠ পরিমান প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয়েছে টিকা গ্রহণকারীদের শরীরে। বিভিন্ন মানব গোষ্ঠী অনুযায়ী এটা বিভিন্ন রকম হলেও কমবেশী ৭০% এফেক্টিভ (কোভিশিল্ড)। (একটি ভ্যাকসিন এর ক্ষেত্রে ৯০% এর বেশি)। মনে রাখতে হবে যে এযাবৎ কাল ১০০% কার্যকর এমন কোনো টিকা মনুষ্যজাতি আবিষ্কার করতে পারে নি।

ছয়মাস বাদে সক্ষমতা কতটা থাকবে এ প্রশ্ন যারা তুলছেন তাদের সবিনয়ে জানানো দরকার যে ছয়মাসের ডাটা এখনো হাতে আসে নি। আর আসে নি বলে সুনির্দিষ্টভাবে উত্তর দেয়া সম্ভব নয়। 

ভ্যাকসিন নিরাপদ ও কার্যকর কিনা সে নিয়ে ব্যক্তিগত মতামত দেয়ার ও বিতর্কে অংশ নেওয়ার অধিকার কেবল ডাক্তার নয় যে কোনো সাধারণ মানুষের আছে। কেবল অনুরোধ জানাবো যে সপক্ষে যুক্তি সাজানোর সময় জনপ্রিয় মিডিয়ার লিঙ্ক শেয়ার না করে প্রচলিত বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুসরণ করুন। এভিডেন্স বেসড মেডিসিন এর সূত্রঃ ধরে পিয়ার রিভিউ জার্নালে প্রকাশিত বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধকে মান্যতা দিন। 

এই বাজার অর্থনীতির যুগে সবই বিক্রি হয়, বিজ্ঞানী গবেষকদের সততাও সন্দেহের ঊর্ধে নয়, তবে ল্যানসেট পয়সা খেয়ে প্রবন্ধ প্রকাশ করে বলে অতি বড় বামপন্থীরাও অভিযোগ করেন নি। সেই ল্যানসেট এর একটি ঝলক ভারতের কোভিশিল্ড এর আদি সংস্করণ নিয়ে। উৎসাহীরা পুরো প্রবন্ধটি দেখতে গুগলামো করুন। 

এই লেখাটি হয়তো "আপিল টু অথরিটি" ফ্যালাসি দোষে দুষ্ট। কিন্তু ল্যানসেট এর নাম নেয়া ছাড়া উপায় ছিল না। 

শুক্রবার, ১৫ জানুয়ারী, ২০২১

মূর্খ সংবাদ ~ আর্য তীর্থ

লোকটা হঠাৎ ঘরের দেওয়ালে 
আপনমনেই নিজের খেয়ালে
গোটা গোটা করে লিখে দিলো সোজা, মন্ত্রীমশাই মূর্খ!
কেন যে লিখলো, কে জানে বাবা, 
সে দেশে করেনা প্র্যাকটিস ভাবা,
বোকা হাবা সেজে থাবাকে এড়ালে তবে জোটে কিছু সুখ গো!
এ লোকটা মোটে দ্রোহীটোহি না, 
জীবন কাটায় রাজনীতি বিনা,
ছা পোষা বাকি লোকের মতনই ঝঞ্ঝাট চলে এড়িয়ে,
তবু দুম করে চারিদিক দেখে, 
ফেটে পড়ে আজ ওই কথা লেখে
অজানা এখনো কিসে গেলো তার ধৈর্য্যের বাঁধ পেরিয়ে।
বন্ধু এবং পড়শীরা এসে, 
বলে ও পাগল, ফেঁসে যাবি শেষে
কে কোথার থেকে উঁকি দিয়ে নেবে দেওয়াল-লিখন দেখে,
কেন বা ডাকিস বিপদ অযথা, 
লক্ষ্মীটি সোনা, শোন ভালো কথা,
ঘষে ঘষে ফেল মুছে ওই লেখা এখনই দেওয়াল থেকে।
মানুষটা হেসে বলে আরে ধুর, 
পেয়াদা আসবে কেন এতদূর,
বাইরে কোথাও বলতে যাইনি , লিখেছি নিজের ঘরে,
গালি তো দেইনি কোনো অশ্রাব্য , 
অথবা বলিনি কাগজে ছাপবো
লোক আমি নই এত কেউকেটা খবর রাখবে চরে।

কিন্তু লোকটা জানতো না ঠিক,
 সেদেশে নজরে সব নাগরিক,
পারলে মগজে ডুবুরীর মতো সেঁধোয় পেয়াদা যেন, 
পরদিন যেই গিয়েছে আপিস,
 দেখে বেচারির চাকরি হাপিস,
ম্যানেজার তাকে খোলসা করে না কাজ চলে গেলো কেন।
অবশেষে এক বন্ধু পুরোনো, 
ছিটকিনি এঁটে করে দোনোমোনো,
ফিসফিস করে বলে দিলো কানে কী তার ক্রাইমখানা,
মন্ত্রীর নামে দিয়েছে সে গালি, 
রাষ্ট্রের চোখে কড়কড়ে বালি,
এসব কথা যে ভাবাও বারণ , সকলের সেটা জানা। 

বলতে বলতে পুলিশের গাড়ি, 
হুটার বাজিয়ে এলো তাড়াতাড়ি,
থানাতে দারোগা ধমকে বলেন সাহস তো তোর নয় কম 
বলেছিস নাকি মন্ত্রী মূর্খ, 
পেছনে পড়বে এখন হুড়কো,
উনি চটে গেলে বাঁচা মুশকিল , যমকে বরং ভয় কম।
লোকটা বললো, আরে ও সাহেব, 
আমি মন্ত্রীর খাস মোসায়েব,
সকাল বিকেল তাঁকেই  স্মরণ করে তবে জল খাই 
আপনাকে খুলে বলি সোজাসুজি,
 খামোখা হয়েছে ভুল বোঝাবুঝি,
উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে যে চেপে গেছে পুরোটাই।
 ওই যে মন্ত্রী প্রতিবেশী দেশে,
 শয়তান ব্যাটা মানুষের বেশে,
আমি তো বলেছি ওই হতভাগা হস্তীমূর্খ আস্ত,
এদেশে মহান মন্ত্রীমশাই, 
খামোখা কেন বা গালি দেবো ছাই,
আহা ফুলেফেঁপে বেড়ে গিয়ে তাঁর  ভালো হোক আরো স্বাস্থ্য।

দারোগাটি করে প্রবল ভ্রুকুটি, 
কঠিন হস্তে টিপে ধরে টুঁটি,
লোকটাকে বলে ব্যাটা করছিস আমার সঙ্গে চালাকি
ফালতু না দিয়ে ভাংচি ভড়ং , 
সত্যিটা বলে ফেল না বরং,
থার্ড ডিগ্রীটা শুরু করে দেবো যদি দিতে চাস ফাঁকি।

এতদিন ধরে চড়াই লোককে, 
পারবি না দিতে ধুলো এ চক্ষে,
কাদের দেশের মন্ত্রী মূর্খ, আমি তা জানিনা নাকি?

আর্যতীর্থ

লেসার ইভিল ~ সুশোভন পাত্র

তৃণমূল কে হারাতে, বিজেপির প্রতীকে তৃণমূল কেই ভোট দিন।
যেমন ধরুন, তৃণমূলের তোলাবাজ শুভেন্দু কে হারাতে, বিজেপির তোলাবাজ শুভেন্দু কে ভোট দিন।  কিম্বা তৃণমূলের ঘুষখোর মুকুল কে হারাতে, বিজেপির ঘুষখোর মুকুল কে ভোট দিন। আসুন, বাংলার চিটিংবাজ মিডিয়া কে তৃণমূল-বিজেপির বাইনারি ন্যারেটিভে আপনার মাথা খাওয়ার সুযোগ করে দিন। কিন্তু, খবরদার সিপিএম'র কথা বিশ্বাস করবেন না।

ঐ যে আপনি শুনেছিলেন, সিপিএম বলেছিল 'কৃষি আমাদের ভিত্তি, শিল্প আমাদের ভবিষ্যৎ' –আসলে আপনি ওটা ষোল আনাই ভুল শুনেছিলেন। মকর-সংক্রান্তির বাজারে ড্রইংরুমের সোফা তে গা এলিয়ে চুপটি করে এবিপি আনন্দ চালিয়ে বসুন। দেখবেন কিছুক্ষণ পর আপনার মনে হবে নন্দীগ্রামের কেমিক্যাল হাবটা আসলে বানাতে চেয়েছিল শুভেন্দু অধিকারী। চেয়েছিল অখিল গিরি। চেয়েছিল তৃণমূল। চায়নি শুধু বামফ্রন্ট! চায়নি শুধু সিপিএম! চায়নি শুধু বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য!
রিমোট টিপে চ্যানেল বদলে চোখ রাখুন জি-২৪ ঘণ্টার পর্দায়, মনে হবে সিঙ্গুরে আসলে কারখানা করতে চেয়েছিল মুকুল রায়। চেয়েছিল বেচারাম। চেয়েছিল বিজেপি। কদিন পর হয়ত শুনবেন চেয়েছিল মমতাও। চায়নি শুধু বামফ্রন্ট! চায়নি শুধু সিপিএম! চায়নি শুধু বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য!

ঐ যে আপনি দেখেছিলেন, ২০০৬-র ৩রা ডিসেম্বর, সিঙ্গুর ইস্যুতে মমতার ধর্মতলার অনশন মঞ্চের বয়স যখন জাস্ট ৬ঘণ্টা, তখন অনশন মঞ্চে হাজির হয়েছিলেন বিজেপি শীর্ষ নেতা রাজনাথ সিং; আসলে উনি রাজনাথ সিং ছিলেন না, ছিলেন আলাদীনের প্রদীপের জিন। একটা থেকে আড়াইটা; ছিলেন টানা দেড় ঘণ্টা। সাথে সমর্থকরা, বিজেপির দলীয় পতাকা নিয়ে।
সদ্য সংবিধান হাতে বিধানসভার ভাঙচুর করে গণতন্ত্রের শ্রাদ্ধ করা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সেদিন যখন অনশন মঞ্চ থেকে বলছেন "মুখ্যমন্ত্রী ডাকলেও রাজ্য সরকার সাথে সিঙ্গুর নিয়ে কোন আলোচনায় বসব না। যা হওয়ার হোক প্রয়োজনে রক্ত ঝরিয়ে সিঙ্গুর আন্দোলন চলবে" -বিজেপি নেতা রাজনাথ সিং তখন ঠাই দাঁড়িয়ে মমতার পাশে। মাইক হাতে তিনি বলেছিলেন,
- মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় NDA-র গুরুত্বপূর্ণ শরিক। বিজেপি শুধু তাকে সমর্থন করে তাই না, সক্রিয় সমর্থন করে!
সেদিনই সন্ধেবেলা মমতার অনশন মঞ্চে হাজির হয়েছিলেন কার্গিলের নিহত জওয়ানদের কফিন কেলেঙ্কারির 'মিডলম্যান' প্রাক্তন NDA-র প্রতিরক্ষা মন্ত্রী জর্জ ফার্নান্দেজ।

যারা ২০১১-র বামফ্রন্টের নির্বাচনী পরাজয় কে স্বাভাবিক গণতন্ত্রীয় লিনিয়ার ইকুয়েশন মনে করেন, কিম্বা নেত্রী মমতার একক রাজনৈতিক ক্যারিশ্মার জাবর কাটেন, তারা কি বলতে পারেন আজ শুভেন্দু কেন বলছে অটল বিহারী বাজপেয়ী পরামর্শেই এ রাজ্যে নাকি পথ চলা শুরু তৃণমূলের? কেন সেদিন RSS-র প্রত্যক্ষ সমর্থন ছিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তথাকথিত জমি আন্দোলনেও? বলতে পারেন মমতার অনশন মঞ্চের ২০০৬-র রাজনাথ সিং আর আজকের ২০২১-র রাজনাথ সিং কি একই ব্যক্তি না আলাদা? কিম্বা ঠিক কোন কারণে নন্দীগ্রাম ষড়যন্ত্রের 'মাস্টারমাইন্ড' শুভেন্দু বিজেপি ওয়াশিং মেশিনে আজ ধোয়া তুলসী পাতা? সিঙ্গুর আন্দোলনে মমতার ছায়াসঙ্গী মুকুল রায়ের কেন আজ শিল্পের জন্য এই কুমীরের কান্না?
বলতে পারেন পৃথিবীর আর কোন অঙ্গরাজ্যের মহিলা প্রধানের সঙ্গে স্বয়ং এসে দেখা করেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেক্রেটারি অব স্টেট হিলারি ক্লিনটন? কিম্বা ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন? কেনই বা ২০০৭-র ফেব্রুয়ারিতে রাজ্যের আপাদমস্তক এক ধর্মীয় নেতা এবং তৎকালীন নন্দীগ্রাম আন্দোলনের বামফ্রন্ট বিরোধী মুখ সিদিক্কুলা চৌধুরীর সাথে রুদ্ধদ্বার মিটিং করেছিলেন মার্কিন কনস্যুলেটের প্রধান? লেনিনিস্ট কনজাংচারে পেয়দাইশ জঙ্গলমহলে কিষানজীর অবশিষ্ট কিছু শহুরে কোয়ার্টার-হাফ-সেম-ফুল ভক্তরা কি বলতে পারেন পুঁজিবাদের এই ম্যাসকটদের ব্লু-আইড কন্যা মমতার 'ক্লাস ক্যারেক্টার'টা ঠিক কি?

উত্তর খুঁজুন। কারণ আপনার হয়ে রাজনৈতিক নেতাদের এই প্রশ্ন গুলো করবে না গণতন্ত্রের 'চতুর্থ স্তম্ভ' মিডিয়া! আসলে আপনার-আমার মত আম পাবলিক কে এই নেতা-মিডিয়ারা 'মানুষ'ই ভাবে না। ভাবে গুরু-ছাগল। ভাবে এরা ঘাসে মুখ দিয়ে চলে। এরাই আপনাকে ২০১১-র আগে গিলিয়েছিলে 'পরিবর্তন চাই'। এরাই আপনাকে ২০২১-র গেলানোর চেষ্টা করছে 'হয় তৃণমূল না হয় বিজেপি!'

বিশ্বাস হচ্ছে না? আচ্ছা আপনি বরং গত এক মাসের বাংলা সংবাদমাধ্যমের যে কোনও টক শো কিম্বা যে কোনও সাংবাদিক সম্মেলনের ভিডিও প্লে-পস-রিওয়াইন্ড করে দেখুন! দেশে ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক মন্দা, ২৪টি কোয়ার্টারে নিম্নগামী জিডিপি বৃদ্ধির হার, ৪৫ বছরে সর্বোচ্চ বেকারত্ব, হাঙ্গার ইনডেক্সে কিম্বা ডেমোক্রেসি ইনডেক্সে –খেয়াল করে দেখুন তো এসব বিষয়ে কোন সংবাদ মাধ্যম কে কোনদিন দিলীপ ঘোষদের একটাও প্রশ্ন করতে শুনেছেন? শোনেননি তো? আগামী ৩ মাসেও শুনবেন না!

কিম্বা রাজ্যের আম্ফান দুর্নীতি, বেকারত্ব, তৃণমূল নেতা-নেত্রীদের দলবদলের রাজনীতি, সরকারী শূন্যপদ বা সংসদে একের পর এক জনবিরোধী বিলে তৃণমূলের সাংসদদের বিজেপি কে প্যাসিভ সমর্থন– খেয়াল করে দেখুন তো এসব বিষয়ে কোন সংবাদ মাধ্যম কে কোনদিন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কে একটাও প্রশ্ন করতে শুনেছেন? শোনেননি তো? আগামী ৩ মাসেও শুনবেন না!
কেন বলুন তো? উত্তর খুঁজুন! অবশ্যই সিপিএম-র সমালোচনা করুন।  কিন্তু অন্ধ সিপিএম বিরোধিতা ছেড়ে যদি যুক্তির বুনিয়াদী বিন্যাসে বিশ্বাস করেন তাহলে উপরের প্রশ্ন গুলোর বস্তুনিষ্ঠ উত্তর খুঁজুন! সিপিএম-র প্রশ্ন গুলোর উত্তর খুঁজুন।
সিপিএম বলেছিলে, রাজ্যের বেকারদের জন্য বৃহৎ শিল্পের প্রয়োজন। সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম-শালবনী, বেকারদের স্বপ্ন পূরণ করতে চেয়েছিলে সিপিএম। ভুল করেছিল? সিপিএম বলেছিল, ২০১১-র নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেস কালো টাকা ব্যবহার করে ভোট করেছে। সুদীপ্ত সেন, কেডি সিং কিম্বা গৌতম কুণ্ড - সিপিএম ভুল বলেছিল? সিপিএম বলেছিল, নন্দীগ্রামের ষড়যন্ত্রের জন্য আপাদমস্তক দায়ী তৃণমূল। ২০১৪ তে বামফ্রন্ট সরকার কে সিবিআই-র ক্লিনচিট, মমতা সরকারের পক্ষে অভিযুক্ত পুলিশদের পদন্নোতি আর আজকের শুভেন্দু স্বীকারোক্তি -সিপিএম ভুল বলেছিল? সিপিএম বলেছিল, সিঙ্গুরে অনিচ্ছুক কৃষকদের জমি ফেরত দিয়েই না হয় শিল্প হোক। সেদিন রাজি হননি মমতা। আজ সিঙ্গুরে এসে একবার দেখেই যান না হয় –সিপিএম কি ভুল বলেছিল?
সিপিএম বলছে তৃণমূলের জন্যই রাজ্যে বেড়েছে বিজেপি। ভুল বলছে? সিপিএম বলছে একটা নির্বাচন হারলেই তৃণমূল তাসের ঘরের মত ভেঙে পড়বে। ভুল বলছে? সিপিএম বলছে এ রাজ্যের ৯০% বিজেপি নেতা হবেই আসলে প্রাক্তন তৃণমূলী। ভুল বলছে? সিপিএম বলছে বিজেপি হারাতে কেবল বিজেপি নয় হারাতে হবে তৃণমূলকেও? ভুল বলছে? উত্তর খুঁজুন।

হিসেব হবে। রইলাম আমরা। মাটি কামড়ে। শেষতক।

মঙ্গলবার, ১২ জানুয়ারী, ২০২১

মাস্টারদা ~ অরিজিৎ গুহ

Masterda

১৯৩০ সালের ১৮ই এপ্রিলের পর থেকে চট্টগ্রাম শহরে দিনের বেলাতেই রাত নেমে আসত। সূর্য ঢলে পড়লেই ব্রিটিশ মহিলা পুরুষরা কেউ আর ঘরের বাইরে থাকত না, সে যত কাজই থাকুক না কেন। তাদের গ্রাস করেছিল এক অজানা আতঙ্ক। চারিদিকে তারা ফিসফাস শুনতে পেত ওই, ওই যে আসছে। ওই শুনেই যে যেখানে পারত লুকিয়ে পড়ত। তারা সবাই ভুতের ভয় পেত। সেই ভুতের নাম ছিল মাস্টারদা।
     'মাস্টারদা' এই একটা শব্দই প্রত্যেক ইউরোপিয়ানের আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এলাকায় এলাকায় গল্পগাথা যেত মাস্টারদা নাকি যে কোনো সময়ে যে কোনো রকমের বেশ ধারণ করতে পারেন। কোথাও যদি শোনা যেত যে মাস্টারদা মালির বেশ ধারণ করে কোথাও লুকিয়ে রয়েছেন তো পরক্ষণেই শোনা যেত অন্য কোনো জায়গায় সেই একই সময়ে মাস্টারদা নাকি সন্ন্যাসির বেশে কোনো গ্রামবাসীর সাথে কথা বলছেন। কেউ কেউ আবার বলে মাস্টারদা নাকি মন্ত্র জানেন। চোখের সামনে তিনি হাওয়ায় মিলিয়ে যান। চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠনের মামলায় ব্রিটিশ পুলিশ তখন তন্নতন্ন করে খুঁজে বেরাচ্ছে মাস্টারদা কে। অথচ মাস্টারদা কে ধরা শুধু মুশকিলই নয়, নামুমকিন।

    একবার গোপনে খবর পেয়ে এক বাড়ি ঘিরে ফেলল ব্রিটিশ পুলিশ। ইনফরমেশন ছিল ওই বাড়িতে নাকি মাস্টারদা লুকিয়ে রয়েছেন। বাড়ির মালিককে ধরে বেধে পুলিশের কর্তার সামনে হাজির করল কনস্টেবলরা। কর্তা জিজ্ঞাসা করলেন আপনার নাম কি? উত্তর এলো সূর্য সেন। চমকে উঠল পুলিশের কর্তা। কোন সূর্য সেন? উত্তর মাস্টার সূর্য সেন। পুলিশ কর্তার তখন স্নায়ু উত্তেজন চরমে। ভাবছে সারা বাংলাদেশ জুড়ে যে লোকটাকে হন্যে হয়ে খুঁজে বেরাচ্ছে ব্রিটিশ ইন্টালিজেন্স সেই লোকটাকে এত সহজে ধরে ফেলল সে! হাত পা থরথর করে কাঁপা শুরু হয়েছে পুলিশ কর্তার। লোকটাকে গ্রেপ্তার করে চট্টগ্রাম শহরে ইন্টালিজেন্স ব্রাঞ্চে চলে গেল পুলিশ কনস্টেবলরা। সেখান থেকে মাস্টারদা সূর্য সেনের ছবি নিয়ে আসা হল। দেখা গেল এই মাস্টার তো সেই মাস্টার নয়! পরে খোঁজখবর করে জানা গেল এই মাস্টার হচ্ছে স্থানীয় একটা স্কুলের হেড মাস্টার যার নামও সূর্য সেন। মহা পরাক্রমশালী ব্রিটিশ পুলিশ সাধারণ মানুষের চোখে হয়ে উঠল ইয়ার্কির পাত্র। পুলিশ দেখলেই লোকজন এখনকার ভাষায় যাকে বলে ট্রোল করা, সেই ট্রোল করা শুরু করল।

   ছোটবেলা থেকেই অদম্য সাহসী সূর্য সেন ব্রত নিয়েছিলেন ভারতবর্ষকে স্বাধীন করার। সেই লক্ষ্যে রত ছিলেন আজীবন। কলেজে পড়তে পড়তেই অনুশীলন সমিতির সদস্য হন। সেখান থেকেই বিপ্লবী জীবনে হাতেখড়ি। কলেজ শেষ করে চট্টগ্রাম শহরে ফিরে কংগ্রেসে যোগ দেন। সেই সময়ে দেশে কংগ্রেস ছিল ব্রিটিশ বিরোধী একমাত্র বড় রাজনৈতিক শক্তি। কংগ্রেসে থাকতে থাকতেই বাচ্চা বাচ্চা ছেলেদের দেশের প্রতি স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রতি আকৃষ্ট করতে শুরু করেন। স্কুলের অঙ্কের শিক্ষক হওয়ার সুবাদে প্রচুর ছাত্র ছাত্রীর সংস্পর্শে আসার সুযোগ পান। সেই সুযোগকেই কাজে লাগান। ১৯৩০ সালে গণেশ ঘোষ অনন্ত সিংহ সহ আরো কয়েকজন আর বেশ কিছু স্কুল কলেজের ছাত্র নিয়ে বিপ্লবী দল গঠন করে চট্টগ্রামের অস্ত্রাগার লুন্ঠনের পরিকল্পনা করলেন। আর তার সাথে টেলিগ্রাফ অফিস টেলিফোন অফিস আর রেলওয়ে দখল করে পুরো ব্রিটিশ যোগাযোগ ব্যবস্থাকে মূল থেকে উপড়ে ফেলে দিতে চেয়েছিলেন। 

   জালালাবাদ পাহাড়ের যুদ্ধে অনেক সহযোদ্ধা কমরেড নিহত হলেও সূর্য সেনকে ধরা যায় নি। অবশেষে ব্রিটিশ পুলিশকে অনেক নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরানোর পর ধরা পড়েন মাস্টারদা সূর্য সেন। জেল কাস্টডিতেই প্রভূত অত্যাচার করে মেরে ফেলা হয় সূর্য সেনকে। মেরে ফেলার আগে ব্রিটিশ পুলিশ সাঁড়াশি দিয়ে সব কটা দাঁত উপড়ে নিয়েছিল। হাত পায়ের সমস্ত নখ উপড়ে নেওয়া হয়েছিল সূর্য সেনের। কিন্তু তাও তিনি তাঁর আদর্শের প্রতি জীবনের শেষদিন অব্দি অবিচল ছিলেন।

   আমাদের স্মৃতি আসলে খুব দুর্বল। অনেককিছুই ভুলে যাই। এত শত শত বিপ্লবীর আত্মবলিদানও অবলীলায় ভুলে গেছি আমরা। ১৯৩৪ সালের ১২ই জানুয়ারি আজকের দিনেই অকথ্যা অত্যাচার করে মেরে ফেলা হয়েছিল মহান এই বিপ্লবীকে। শরীরটাকে মেরে ফেললেও তাঁর আদর্শকে মেরে ফেলা যায় নি। কারণ Ideas are bulletproof.

রবিবার, ১০ জানুয়ারী, ২০২১

বিজ্ঞান কংগ্রেস ~ অমিতাভ প্রামাণিক

১৯১১ সালে তদানীন্তন ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী কলকাতা থেকে সরে গেল দিল্লিতে। ল্যুটিয়েন্স সাহেব এসে ডিজাইন করলেন ল্যুটিয়েন্স ডেলহির। সেখানকার কিছু রেলপথ উপড়ে ফেলে স্থানান্তরিত করা হল সে কারণে। কলকাতার উন্নতিমূলক কয়েকটা বড়সড় প্রকল্প এ কারণে থেমে রইল বেশ কয়েক বছর, কেননা সাহেবদের লক্ষ্য এখন দিল্লি নির্মাণ।

তাতে কি কলকাতার গুরুত্ব ফট করে কমে গেল? ঠিক তার উল্টো। কয়েকজন বাঘা বাঘা লোক এ সময় উঠে এলেন, যাঁদের মাথা অন্য সকলের চেয়ে ওপরে। রবীন্দ্রনাথ নোবেল পুরস্কার পেলেন ১৯১৩ সালে, দু-বছর পরে নাইট উপাধি। আচার্য জগদীশচন্দ্র ক্রেস্কোগ্রাফ বানিয়ে প্রমাণ করে দেখালেন বিভিন্ন উদ্দীপকের সংস্পর্শে গাছ কেমন প্রতিক্রিয়া দেখায়, তিনি প্রতিষ্ঠা করলেন বসু বিজ্ঞান মন্দির। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র প্রেসিডেন্সী কলেজ থেকে পাততাড়ি গুটিয়ে চললেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সায়েন্স কলেজে, প্রতিষ্ঠা করলেন স্কুল অভ কেমিস্ট্রি। রাজেন্দ্রনাথ মুখার্জির মার্টিন অ্যান্ড কোম্পানি নির্মাণ করল ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, বাংলায় তিনি স্থাপন করলেন দেশের দ্বিতীয় ইস্পাত কারখানা, পড়ে-থাকা হাওড়া ব্রিজ তাঁর সুযোগ্য নেতৃত্বে কলকাতার অন্যতম দর্শনীয় বিস্ময় হয়ে দাঁড়িয়ে গেল ক্যান্টিলিভার ব্রিজ হিসাবে। চিত্তরঞ্জন দাশের সুযোগ্য শিষ্য হিসাবে ভারতীয় রাজনীতির অঙ্গনে উঠে এলেন সুভাষচন্দ্র।

এবং সেই একই সময়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হলেন আশুতোষ মুখোপাধ্যায়। সায়েন্স কলেজ প্রতিষ্ঠা করলেন তিনি। শুধু একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা বিজ্ঞানের ভবন নয়, দেশে বিজ্ঞানচর্চার প্রসার ঘটাতে তিনিই উদ্যোগী হয়ে শুরু করলেন ভারতের সায়েন্স কংগ্রেস। কলকাতায় ১৯১৪ সালে তৈরি এই প্রতিষ্ঠানের প্রথম অধিবেশনের সভাপতি ছিলেন তিনি নিজে। বললেন, তিনি চান প্রতি বছর এর সদস্যরা মিলিত হবে দেশের কোনো এক শহরে, আলোচনা করবে বিজ্ঞানের কোনো এক সাম্প্রতিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে যা দেশের পক্ষেও গুরুত্বপূর্ণ এবং এই অধিবেশনগুলোতে সভাপতিত্ব করবেন কোনো এক বিশিষ্ট বিজ্ঞানী।

নিরবচ্ছিন্নভাবে বিগত একশো সাত বছর ধরে প্রতি বছর এই কংগ্রেসের অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে, যদিও শুরুর সেই গাম্ভীর্য এখন আর নেই। কয়েক বছর আগে একজন বিশিষ্ট নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী একে রাজনৈতিক তামাশা আখ্যা দিয়ে গেছেন।

অথচ শুরুর সেই সময়ে এটা ছিল বিজ্ঞান আলোচনার এক প্রকৃষ্ট মাধ্যম। সভাপতি হতেন বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ও প্রযুক্তিবিদরা। ব্রিটিশ ভারতে সে সময় ভারতীয় বিজ্ঞানীর সংখ্যা হাতে গোনা, তাই ধরে আনতে হত বিদেশীদেরই। আশুতোষের উদ্বোধনের ছয় বছর পর দ্বিতীয় একজন ভারতীয় সভাপতিত্ব করেছিলেন, তিনি আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, ১৯২০ সালে, সপ্তম বিজ্ঞান কংগ্রেসের নাগপুর অধিবেশনে। পরের বছর রাজেন্দ্রনাথ মুখার্জি, কলকাতায়। ১৯২৩ সালে লক্ষ্ণৌয়ের দশম অধিবেশনের সভাপতি ছিলেন এম বিশ্বেশ্বরাইয়া, ১৯২৭ সালে লাহোরের চতুর্দশ অধিবেশনের জগদীশচন্দ্র বসু এবং ১৯২৯ সালে মাদ্রাজে ষষ্ঠ অধিবেশনের চন্দ্রশেখর ভেঙ্কট রামন। এর পরের বছর ১৯৩০ সালে তিনি নোবেল পুরস্কার পান। মধ্যবর্তী সমস্ত অধিবেশনের প্রেসিডেন্ট ছিলেন বিদেশী কেউ।

সমস্ত অধিবেশনই ছিল থিমেটিক। প্রফুল্লচন্দ্রের সময় থিম ছিল আধুনিক ভারতে বিজ্ঞানের উন্মেষ, পরের বছর রাজেন্দ্রনাথের সময় বিজ্ঞান ও শিল্প। বিশ্বেশ্বরাইয়ার অধিবেশনের থিম বিজ্ঞানকেন্দ্র ও বিজ্ঞানী, জগদীশচন্দ্রের অধিবেশনে ইউনিটি ইন লাইফ তথা জীবনে ঐক্য। এইগুলো এবং অন্যান্য সমস্ত অধিবেশনে থিম ছিল বিজ্ঞানের বা বিজ্ঞানচর্চার কোনো সাধারণ বিষয়। রামনের সময় অবশ্য রামনের গবেষণাকেই প্রাধান্য দিতে থিম হল রামন এফেক্ট সংক্রান্ত।

এ সবের অনেক আগেই স্যার আশুতোষ বিজ্ঞান কলেজে অধ্যাপক হিসাবে নিয়ে এসেছেন সত্যেন্দ্রনাথ বসু ও মেঘনাদ সাহাকে, পরের বছর রামনকেও। কিছুকাল পরে ১৯২১ সালে বসু চলে গেলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, সাহা চলে গেলেন এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯২৩ সালে। ১৯২৪ সালে মারা গেলেন স্যার আশুতোষ, রামন এফেক্ট আবিষ্কারের বছর চারেক আগে।

১৯৩৩ সালের বিজ্ঞান কংগ্রেসের অধিবেশন বসল পাটনায়, সভাপতি এল এল ফার্মার, থিম জাতির জীবনে ভূবিদ্যার স্থান। ততদিনে দেশে বিজ্ঞানচর্চায় বেশ কিছু নতুন মুখ উঠে এসেছে। জাতীয় ক্ষেত্রে জায়গা করে নিচ্ছেন শান্তিস্বরূপ ভাটনগর, হোমি জাহাঙ্গির ভাবা, বিক্রম সারাভাই। অধিবেশনের অতিথি হয়ে ভারতে এসেছেন বিখ্যাত নেচার পত্রিকার সম্পাদক স্যার রিচার্ড গ্রেগরি। নেচার পত্রিকা অনুসরণ করেই ভারতে কারেন্ট সায়েন্স নামে এক পত্রিকা বের হয়, তখন তার সম্পাদক রামন। রামনের সঙ্গে গ্রেগরির কথাপ্রসঙ্গে উঠল ইংল্যান্ডের রয়্যাল সোসাইটির কথা। রয়্যাল সোসাইটির ধাঁচে ভারতে একটা সোসাইটি তৈরির পরামর্শ রামনকে দিলেন স্যার রিচার্ড।

রামন সে কথা সভায় পাড়তে অন্যান্যরা একবাক্যে সায় দিল। বিজ্ঞান কংগ্রেস অ্যাসোসিয়েশনের সদস্যরাই হয়ে যাবে এই ইন্ডিয়ান অ্যাকাডেমি অভ সায়েন্সের সদস্য। রামন বললেন, না, এখানে তো তিরিশ জন সদস্যের মধ্যে আদ্ধেকই ব্রিটিশ। তাদের মধ্যে দু-তিন জন ছাড়া সবাই বুড়ো-হাবড়া, সায়েন্সের সঙ্গে তাদের সংস্পর্শ বহুদিন ঘুচে গেছে, ওদের দিয়ে আমাদের কী লাভ? ইন্ডিয়ান অ্যাকাডেমি অভ সায়েন্স হবে শুধু ইন্ডিয়ানদের নিয়ে, ইয়াংদের নিয়ে, যারা সায়েন্সের চর্চা করে একমাত্র তাদের নিয়ে। ফালতু লোক দিয়ে সায়েন্স হয় না, সায়েন্স আর পলিটিক্স আমি এক করতে চাই না।

অন্যরা তাঁর এ কথা মেনে না নিলে রামন রেগেমেগে সে সভা ত্যাগ করলেন। কয়েকদিন পরেই তিনি দক্ষিণ ভারতের কয়েকজন বিজ্ঞানীদের সঙ্গে এক মিটিং করে সে বছরই তাদের নিয়ে ইন্ডিয়ান অ্যাকাডেমি অভ সায়েন্স নামে এক সোসাইটি রেজিস্টার করে ফেললেন। রেজিস্টার্ড এই সোসাইটিকে সরকার দেশের সায়েন্স সোসাইটি বলে মেনে নিল না। রামন এবং সুব্বারাও-এর মত দক্ষিণী বিজ্ঞানীরা সায়েন্স কংগ্রেস অ্যাসোসিয়েশন থেকে পদত্যাগ করলেন। বাকিরা তৈরি করলেন ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল সায়েন্স অ্যাকাডেমি বা ইনসা। এর পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করলেন একে একে মেঘনাদ, ভাবা, ভাটনগর এমনকি রামনের সহকর্মী কৃষ্ণাণ।

রামন পলিটিক্স পছন্দ করেন না অথচ তিনি নিজেই উত্তর-দক্ষিণ বিভাজনে ব্যস্ত – এই ব্যাপারটা কলকাতার কেউ ভালো চোখে দেখল না। রামনও সুযোগ খুঁজছিলেন কলকাতা ত্যাগের। পরের বছর সুযোগ এসে গেল। ১৯৩৪ সালে রামন চলে গেলেন ব্যাঙ্গালোরে, ইন্ডিয়ান ইনস্টিট্যুট অভ সায়েন্সের প্রথম ভারতীয় ডিরেক্টর হিসাবে। কিন্তু পৃথিবীর যাবতীয় উন্নত দেশে যখন একটাই মুখ্য সায়েন্স অ্যাকাডেমি, ভারতে শূন্য থেকে গজিয়ে গেল দুটো এবং এখনও দুটোই সমানভাবে সক্রিয়।

দেশ স্বাধীন হওয়ার সময় যতই এগিয়ে এল, ততই দেখা গেল ইনসার অধিকর্তারাই পেয়ে যাচ্ছেন দেশীয় বড় বড় বিজ্ঞানসংস্থার দায়িত্ব। শান্তিস্বরূপ ভাটনগরের হাতে দায়িত্ব এল বিশাল টাকা খরচ করে বহু গবেষণাগার সমৃদ্ধ সিএসআইআর বা কাউন্সিল অভ সায়েন্টিফিক অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চের। ভাবা পরমাণু গবেষণা শুরু করলেন, তৈরি হল বিএআরসি। সারাভাই দায়িত্ব পেলেন স্পেস রিসার্চের। রামন এ সব শোনেন আর হো হো করে হাসেন – মূর্খের দল, সায়েন্সের নামে টাকা ওড়াচ্ছে দ্যাখো! টাকা দিয়ে কি সায়েন্স কেনা যায় রে ছাগলের দল!

এদের সবাই এবং এদের পৃষ্ঠপোষক হিসাবে জওহরলাল নেহরু হয়ে গেলেন রামনের চোখে শত্রু।

ডিরেক্টর হিসাবে রামন আই আই এস সি-তেও টিঁকলেন না। দু-বছর যেতে না যেতেই তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ এল – তিনি বরাদ্দ টাকার সিংহভাগ বে-আইনিভাবে নিজের ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টের পেছনে খরচা করছেন, অন্য ডিপার্টমেন্টের উন্নতিতে তাঁর কোনো দৃষ্টি নেই। জার্মানি থেকে ম্যাক্স বর্নকে প্রফেসর করে ধরে এনেছেন তিনি, এনে নিজেই তাঁর সঙ্গে ঝগড়ায় জড়িয়েছেন। তাঁর কাছে কাউন্সিলের চিঠি এল – হয় ইনস্টিট্যুট থেকে রিজাইন করো, নয় ডিরেক্টর থেকে রিজাইন করে ফিজিক্সের প্রফেসরগিরি করো। এই দুটোর মধ্যে বেছে না নিলে তাঁকে বরখাস্ত করা হবে। নিরুপায় রামন বেছে নিলেন সম্মানহীন দ্বিতীয় শর্তটাই। ১৯৪৮ সালে রামন রিসার্চ ল্যাবরেটরি নির্মাণ করে তিনি অবশেষে আই আই এস সি-র সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করলেন।

প্রধানমন্ত্রী হওয়ার কিছুকাল পরে জওহরলাল কন্যা ইন্দিরা ও দুই শিশু নাতিকে সঙ্গে নিয়ে ব্যাঙ্গালোরে এসেছেন। ইন্দিরা শুনেছেন নোবেলজয়ী রামনের নাম, তিনি তাঁর সঙ্গে দেখা করতে চান। সুন্দরী ইন্দিরাকে রামন ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখালেন তাঁর রিসার্চ সেন্টার। দোতলার পোর্টিকো থেকে দূরে নন্দী হিলস দেখালেন। তারপর বললেন, বাবাকে গিয়ে বলবে কী দেখলেন, যদি ওঁর সময় হয় উনিও যেন একবার ঘুরে যান এখানে। সেদিন সন্ধেতেই তাঁর কাছে খবর এল, জওহরলাল পরদিন রামন রিসার্চ ল্যাবে আসতে চান।

রামন খুব আতিশয্য নিয়েই জওহরলালকে স্বাগত জানালেন এবং শুরু করে দিলেন তাঁর বক্তৃতা, যার সারমর্ম হচ্ছে তিনি বহু কষ্ট করে এই প্রতিষ্ঠান তৈরি করেছেন, সরকার যেন অবিলম্বে এর পেছনে একটা লাখ দশেক টাকার এনডাউমেন্ট ফান্ড তৈরি করে, যাতে তাঁর পরেও এই প্রতিষ্ঠান চালাতে অসুবিধে না হয়। ফট করে এ রকম টাকার কথা বলায় জওহরলাল খানিকটা অপ্রস্তুত হলেও ঝানু পলিটিশিয়ানের মত উত্তর দিলেন, আপনি এই প্রতিষ্ঠানের ভবিষ্যৎ নিয়ে এত উদ্বিগ্ন হচ্ছেন কেন? সরকার কি আর রত্ন চেনে না? নিশ্চয় এর রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচালনার সমস্ত ব্যাপার সরকার দেখবে।

টাকার প্রতিশ্রুতি না পেয়ে রামন নিরাশ হলেন এবং তারপরেই যা করলেন, সেটা অত্যন্ত অভিনব। জওহরলালকে তাঁর এক ল্যাবরেটরিতে নিয়ে গেলেন, যেখানে একটা টেবিলের ওপর রাখা ছিল দুটো ধাতব পাত। রামনের নির্দেশে সেই ঘরে একটা ইউভি ল্যাম্প বাদে সমস্ত লাইট নিভিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ইউভি ল্যাম্পের আলোয় সেই দুটো পাতের একটা খুব চকচক করছিল। রামন জিজ্ঞেস করলেন, এর মধ্যে একটা সোনা, কোনটা বলুন তো? জওহরলাল চকচকে পাতটা দেখালেন। রামন হো হো করে হেসে উঠে বললেন, ওটাই তো পলিটিশিয়ানদের নিয়ে সমস্যা, স্যার, চকচক করলেই সোনা হয় না। ওটা আসলে তামা, পাশেরটা সোনা।

ঠারেঠোরে রামন বুঝিয়ে দিলেন প্রধানমন্ত্রী অপদার্থ লোকদেরই সোনা ভেবে গাদা গাদা টাকা খরচ করে বিজ্ঞানের পিন্ডি চটকাচ্ছেন।

এ সব সত্ত্বেও রামন ১৯৫৪ সালে ভারতরত্ন উপাধি পেলেন। রাষ্ট্রপতি তাঁর গলায় পরিয়ে দিলেন ভারতরত্নের মেডেল। অপমান গায়ে মেখে থাকলে পলিটিশিয়ানদের চলে না। একই বছরে জওহরলালের নির্দেশেই তাঁকে ন্যাশনাল প্রফেসরের পদও দেওয়া হল।

পরের বছর সেন্ট্রাল এডুকেশন ডিপার্টমেন্ট থেকে রামনের কাছে একটা চিঠি গেল। এডুকেশন সেক্রেটারির সই করা সেই চিঠিতে সবিনয়ে জানতে চাওয়া হয়েছে, ন্যাশনাল প্রফেসর হিসাবে তিনি গত এক বছরে কী করেছেন, তা যেন তিনি চিঠি লিখে জানান।

মাথায় আগুন জ্বলে গেল রামনের। সেক্রেটারিকে ডেকে বললেন একটা হাতুড়ি খুঁজে আনতে। তার সামনেই ভারতরত্নের মেডেলটা ড্রয়ার থেকে বের করে মেঝেতে ফেলে হাতুড়ি দিয়ে বাড়ি মেরে চারখন্ড করে পিসগুলো একটা লেফাফায় ভরে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে রেজিস্টার্ড পোস্টে পাঠিয়ে দিলেন নোবেলজয়ী চন্দ্রশেখর ভেঙ্কট রামন।

১০ জানুয়ারি ২০২১

শনিবার, ৯ জানুয়ারী, ২০২১

আরেক অলিন্দ যুদ্ধ ~ পি বিশ্বাস

বিধান সরণীর এই বাড়িটা। এইখানে সংঘটিত হয়েছিল মাত্র তিনজন বাঙালি বিপ্লবীর সাথে একদল সশস্ত্র ব্রিটিশ পুলিশের গানফাইট। যা ঐতিহাসিক অলিন্দ যুদ্ধের মতই দুর্ধর্ষ, ভয়াবহ। যে কাহিনী বিদেশীর খুনে গুলি, বন্দুক, বোমার আগুনে আজো রোমাঞ্চকর।

চন্দননগরের পুলিশ কমিশনার কুইন সাহেবকে খতম করার পরে দুঃসাহসী দীনেশ মজুমদার ও নলিনী দাস আশ্রয়ের সন্ধানে ছিলেন। পুলিশ তাদের খ্যাপা কুকুরের মত খুঁজছে। ইতিমধ্যে দীনেশ টেগার্টকে হত্যা করতে গিয়ে অল্পের জন্য ব্যর্থ হয়েছেন। তাঁর যাবজ্জীবন কারাদন্ড হলে তিনি মেদিনীপুর জেল ব্রেক করে পালান ও দু বার স্টেটসম্যানের সম্পাদক ওয়াটসনকে হত্যা চেষ্টার অভিযোগে ফেরার ছিলেন। নলিনীও হিজলী জেল পলাতক আসামী। যার মাথার ওপর ৫ হাজার টাকা পুরষ্কার।

অনেক অনুসন্ধানের পর দঃ ২৪ পরগণার মল্লিকপুরের বাসিন্দা নারায়ণ ব্যানার্জী ও তার স্ত্রী শৈলবালা এই বাড়িটি ভাড়া নিয়ে শেল্টার দেন দীনেশ মজুমদার, সাথী নলিনী ও অনুশীলন সমিতির জগদানন্দ মুখার্জীকে।

পুলিশ কিভাবে সন্ধান পেয়ে যায় এই গোপন আস্তানার। ২২ মে, ১৯৩৩ রাত্রের শেষ প্রহর, গোটা কলকাতা যখন ঘুমন্ত, কাউকে প্রস্তুত না হতে দিয়ে, বিপুল বাহিনী নিয়ে আক্রমন করে বসে তাদের হাইড আউট।

দোতালা থেকে শুরু হয় মরণপন সম্মুখ যুদ্ধ। বিনয়-বাদল-দীনেশের মত ব্যাঘ্রবিক্রমে লড়লেন নলিনী-জগদানন্দ-দীনেশ, অন্তিম বুলেটটি নিঃশেষ না হওয়া অব্দি। আহত হয়ে ভূমিশয্যা নিল ডিএসপি পোলার্ড আর ডিআইবি ইন্সপেক্টর মুকুন্দ ভট্টাচার্য। তিন বিপ্লবীই রক্তাক্ত অবস্থায় ধরা পড়েন। বিচারে নলিনী ও জগদানন্দের যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর আর যক্ষারোগে মৃত্যুপথযাত্রী দীনেশ মজুমদারের ফাঁসি হয়ে গেল আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে।

স্বাধীনতাকামী তিন যুবকের অসম রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের স্মৃতি বুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ১৩৬/৪ কর্নওয়ালিশ স্ট্রীটের বাড়িখানা। যদি খোঁজেন, ফুটপাতের দোকানে প্রায় ঢেকে যাওয়া একটা ধুলিমলিন স্মৃতিফলক আপনার চোখে পড়লেও পড়তে পারে।

ওরা আকাশে জাগাতো ঝড়, অথচ ওদের স্মৃতি বলতে কলকাতা শহরে এটুকুই।

রবিবার, ৩ জানুয়ারী, ২০২১

সফদার হাশমী ~ অর্ক রাজপন্ডিত

১৯৮৪ সালের দাঙ্গায় যুক্ত ছিলেন তথ্য সম্প্রচার মন্ত্রী কংগ্রেস নেতা এইচ কে এল ভগত। কোন মধ্যপন্থা নেই। হয় আমরা ভগতের হাত থেকে পুরস্কার নেব না হয় নেব না। জনম'র বৈঠকে বলেছিলেন সফদার।

নাহ! ভগতের হাত থেকে পুরস্কারের ট্রফি আর তখনকার দিনে মোটা অঙ্ক দশ হাজার টাকা না নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল জনম। কথা ছিল, ১৯৮৯ সালের ২ জানুয়ারি সাংবাদিক সম্মেলন করবে জনম। খোলাখুলি জানাবে তাদের অবস্থান।

দিল্লি থেকে বাসে ঝান্ডাপুর যাওয়ার পথে সহযোদ্ধা সুধন্য দেশপান্ডেকে বলেছিলেন সফদার।' ১৮ বছর পর ইউপি সরকার পৌরসভার নির্বাচন করছে। কেউই প্রতীকে লড়ছে না আমরা ছাড়া। আমরাই একমাত্র কাস্তে হাতুড়ি তারায় লড়ছি। ঝান্ডাপুরের যে আমাদের প্রার্থী রামনাথ ঝা খুব মিলিট্যান্ট ট্রেড ইউনিয়ন কর্মী'।

কথা বলতে বলতে বাস এসে দাঁড়ায় ঝান্ডাপুরে। সফদার ও তাঁর কমরেডরা হেঁটে চলেছেন সিআইটিইউ অফিসের দিকে, ওখানেই হবে হাল্লা বোল।

লাঠি আর লোহার রড নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে গাজিয়াবাদ সিটি বোর্ডের মেয়র পদপ্রার্থী কংগ্রেস কর্মী মুকেশ সিং ও তার দলবল। এলোপাথাড়ি মার শুরু। সুধন্য দেশপান্ডে লিখেছেন, 'আমাদের কাছে ঝান্ডার লাঠি ছাড়া কিছু ছিল না, তাই দিয়েই আমরা রুখছি। পাথড় ছুঁড়ে পাল্টা মারার চেষ্টা করছি। সফদার আমাদের নেতা, চেঁচিয়ে উঠলো সবাই সিআইটিইউ অফিস চলো। সিআইটিইউ কমরেড যদুমনি বেহারার ততক্ষণে মাথা ফেটে গেছে, রক্ত ঝড়ছে। আমাদের দেখে এক মহিলা ছুটে এলেন চিৎকার করতে করতে পাঁচ জনের গুলি লেগেছে। তোমাদের একজন পড়ে আছে মাটিতে'।

সুধন্য দেশপান্ডে ও তাঁর কমরেড ব্রিজেশ ছুটছেন রাস্তায়। ব্রিজেশ রাস্তার এক কোনে রক্তাক্ত একজনকে দেখে ভাবছেন আরেকজন কমরেড বিনোদ। কিন্তু তিনি বিনোদ নন, সবুজ সোয়েটার লাল হয়েছে রক্তে, চিনতে পেরেছেন মুহুর্তেই সুধন্য, সফদার!

সফদারের সঙ্গেই খুন হয়েছিলেন সিআইটিইউ কর্মী  রাম বাহাদুর।

নাম গুলো চিনে রাখা দরকার। কারা মেরেছিল সফদারকে। ৫নভেম্বর, ২০০৩  গাজিয়াবাদ কোর্ট দশ জনকে দেষী সাব্যস্ত করে যাবজ্জীবনের সাজা দেয়। মুকেশ শর্মা, দেবী সারন শর্মা, জিতেন্দ্র, রাম অবতার, বিনোদ সিং, ইউনুস আলি, তাহির হুসেন, রমেশ, করণ সিং এবং ভগত বাহাদুর। সবাই ছিল কংগ্রেস কর্মী।

গাজিয়াবাদ আদালতে খুনিদের পক্ষের আইনজীবী সাফাই গেয়েছিলেন, মলয়শ্রী হাসমি যা বলছেন ঠিক না, এটা ঠিক খুন না, একটা স্কাফল! ধস্তাধস্তির জেরে মৃত্যু হয়।

জনম থামেনি। হল্লা বোল থামেনি। একই জায়গায় ফিরে এসেছিলেন সফদারের কমরেডরা হল্লা বোল নাটক নিয়েই।

সফদার বেঁচে আছেন!

সফদারের কমরেডদের  শ্রেণি ঘৃনা মরেনি।

শনিবার, ২ জানুয়ারী, ২০২১

দুই ইঞ্জিনিয়ারের গল্প ~ অমিতাভ প্রামাণিক


- স্যার, একটা কথা বলব, যদি কিছু মনে না করেন?
- বলো।
- আচ্ছা, আমরা এই নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্রোজেক্টে কাজ করছি কেন? আপনি নিশ্চয় শুনেছেন যে আমেরিকা-জার্মানিতে ওরা নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট ইনস্টল করে কোটি কোটি টাকা লস খেয়েছে। তা সত্ত্বেও আমরা এই প্রোজেক্টটা নিলাম কেন?
- ইয়াং ম্যান, ইন্ডিয়ার দরকার নিউক্লিয়ার পাওয়ার। নিউক্লিয়ার পাওয়ার পেতে হলে তো এই পাওয়ার প্ল্যান্ট বানাতেই হবে। আমরা যদি সেই কাজটা না করি, তো কে করবে?

কথাটা যিনি বললেন, তাঁর নাম হেনিং, তিনি একজন ড্যানিশ। ডেনমার্ক যে শুধু শ্রীরামপুরেই কলোনি বানিয়েছিল, তা তো নয়। এই হেনিং-এর বন্ধু ভারতের অ্যাটমিক এনার্জি কমিশনের চেয়ারম্যান ডক্টর হোমি জাহাঙ্গির ভাবা। তিনি জানতেন, এ কাজের উপযুক্ত লোক হেনিং, তাই এই পরিকল্পনার ক্রিটিক্যাল কম্পোনেন্ট যেগুলো, তা তৈরির বরাত পেয়েছে তারই সংস্থা।

হেনিং 'ইউনিভার্সিটি অভ কোপেনহেগেন' থেকে কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ, এখন যার নামের আগে 'টেকনিক্যাল' শব্দটা যোগ হয়েছে। পাশ করেই কোপেনহেগেনের এফ এল স্মিথ অ্যান্ড কোম্পানির একটা অ্যাসাইনমেন্ট জুটে যায় তার কপালে। কাজটা হচ্ছে দক্ষিণ ভারতের কোয়েম্বাটোরের কাছে মাদুক্কারাই নামে এক জায়গায় একটা সিমেন্ট ফ্যাক্টরি দাঁড় করাতে হবে। তার জন্যে যন্ত্রপাতি যা লাগবে, সব আসবে বিদেশ থেকে, তাকে এর ইনস্টলেশন-কমিশনিং করতে সহায়তা করতে হবে। সেটা ১৯৩৮ সাল। কাজে যোগ দিয়েই সে অবাক, এখানে এসে কাজ করছে তার ছোটবেলার স্কুলের বন্ধু সোরেন, ঐ একই কোম্পানির হয়ে। সে সিভিল ইঞ্জিনিয়ার, চার বছর আগে সে ইন্ডিয়াতে এসে সিন্ধুপ্রদেশের রোহরিতে অলরেডি একটা সিমেন্ট কারখানা দাঁড় করিয়ে দিয়েছে, এখন তারও কাজ এই মাদুক্কারাই প্রোজেক্টেই।

যথাসময়ে দুই প্রকল্পের কাজ শেষ হয়ে গেল। বোম্বের কাছে মাথেরান হিল স্টেশনে ছুটি কাটাতে গিয়ে দুই বন্ধু এ ওকে বলল – দেশে ফিরে লাভ নেই। চল, এখানেই একটা কোম্পানি খুলে ফেলা যাক। মনে হচ্ছে, ব্যবসা খারাপ হবে না।

বোম্বেতে এক খুদে অফিস খুলে বসে গেল দুই বন্ধু। অফিস মানে একটা পাঁচ বাই পাঁচ মেঝে, তাতে একটা ছোট্ট টেবিল আর একটা চেয়ার। একজন বসলে অন্যজনের সেখানে জায়গা নেই, তাকে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। ওরা বুঝে গেল, ইন্ডিয়াতে দুধের ভাল চাহিদা আছে। দুগ্ধজাত বস্তু তৈরির যন্ত্রপাতি বিক্রি হবে ভালো। ডেনমার্কের এক ডেয়ারি যন্ত্রপাতি প্রস্তুতকারকের এজেন্ট হিসাবে কাজ করলে আমদানি মন্দ হবে না।

কিন্তু বেশিদিন সে সব চালানো গেল না। বিদেশ হয়ে উঠল উত্তাল, বেধে গেল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। জার্মানি ডেনমার্কের দখল নিয়ে নিল, ফলে ডেনমার্ক থেকে ইমপোর্ট হয়ে পড়ল অসম্ভব। যন্ত্রপাতি না এলে ব্যবসা কী করে চলবে? বাধ্য হয়ে দুই বন্ধু ঠিক করল, তারা নিজেরাই যন্ত্রপাতি তৈরি শুরু করবে। হেনিং এমনিতেই ঝুঁকি নিতে পছন্দ করে, সে বলল, আমরা সব রকম যন্ত্রপাতি বানাব। সোরেন অপেক্ষাকৃত সাবধানী, কিন্তু তার কাজ নিখুঁত, সে প্রবল পরিশ্রমী ও হার্ড টাস্কমাস্টার। একটা ওয়ার্কশপ মতন খুলে প্রথমে কিছুদিন অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের ছোটখাটো কাজকারবার করতে লাগল, মূলত সার্ভিসিং। পরে নিজেরাই ডেয়ারি ইকুইপমেন্ট তৈরিতে মন দিল।

যুদ্ধ ঘনিয়ে এলে অবশ্য তড়িঘড়ি বুঝে গেল আসল মুনাফা এইসবে নয়, বরং যুদ্ধের সঙ্গে সম্পর্কিত ব্যবসায়। যা তৈরি করবে, নিমেষে সব বিক্রি হয়ে যাবে। সুতরাং আদা নয়, তাদের ব্যবসা হতে হবে জাহাজের। কদিন পরেই হিলডা লিমিটেড নাম দিয়ে তারা জাহাজ সারানোর আর জাহাজের প্রয়োজনীয় পার্টস বানানোর কোম্পানি খুলে ফেলল। তরতরিয়ে চলতে লাগল সেই ব্যবসা।

এদিকে টাটারা তাদের সোডা অ্যাশ কারখানা বানানোর পুরো পরিকল্পনা করে তখন গেছে ফেঁসে। তাদের ইঞ্জিনিয়ার আসার কথা জার্মানি থেকে, এদিকে জার্মানির অক্ষশক্তির সঙ্গেই তো ব্রিটিশ মিত্রশক্তির যুদ্ধ! জার্মানি থেকে ব্রিটিশ ভারতে কাকে আসতে দেবে তখন? ফলে টাটারা লোক খুঁজতে লাগল, যদি উপযুক্ত কাউকে এ কাজের জন্যে পাওয়া যায়।

খবর পেয়ে হেনিং আর সোরেন হাজির হল টাটাদের দপ্তরে। তারা নামিয়ে দেবে ওদের বিশাল সোডা-অ্যাশ কারখানা।

সেই কারখানা সাফল্যের সঙ্গে বানিয়ে তাদের ছক বদলে গেল। ছুটকো-ছাটকা কাজ না, তাদের এখন দরকার বড় বড় এমন প্রোজেক্টের কাজ। ইঞ্জিনিয়ারিং আর কনস্ট্রাকশনের কন্ট্রাক্ট নেবে তারা, ক্লায়েন্ট শুধু বলে দেবে তার কী চাই, তারা পুরো কাজটা নামিয়ে দেবে। বিশ্বযুদ্ধের দমক কমে যেতে বিদেশি কোম্পানিদের সঙ্গেও একসঙ্গে কাজ করতে লাগল তারা। আমেরিকার ক্যাটারপিলার ট্র্যাকটর কোম্পানির সঙ্গে কথাবার্তা হল, তারা বড় বড় কনস্ট্রাকশনের উপযোগী হুঁদো হুঁদো সব আর্থ-মুভিং ইকুইপমেন্ট বিক্রি করবে ইন্ডিয়ায়। দেশে তখন বিস্কুট, কাচ, বনস্পতি, সাবান ইত্যাদির কারখানার যন্ত্রপাতি সরবরাহ করে ব্রিটিশ কোম্পানিরা। এরা তাদেরও এজেন্সি নিয়ে ব্যবসা বাড়িয়ে চলল। এক এক রকম বিজনেসের জন্যে আলাদা আলাদা নামের কোম্পানি চালু করে দিল।

যুদ্ধ শেষ হতে আমেরিকান ক্যাটারপিলার ট্র্যাক্টর কোম্পানির ইন্টারেস্ট কমে গেল। তাদের তৈরি বড় বড় আর্থ-মুভার অবশ্য এদের কনস্ট্রাকশনের জন্যে খুবই কাজের। ওরা বলল, তাহলে তোমাদের এগুলো সস্তায় দিয়ে দিচ্ছি, তোমরা কিনে নাও।

জলের দরে হলেও অতগুলো মেশিন কেনার পয়সা তাদের নেই। দরকার ইনভেস্টমেন্টের, তার জন্যে বাজার থেকে টাকা তুলতে হবে। যার কাছেই টাকা চায়, তারাই ওদের কোম্পানির ব্যবসাপত্রের হিসেব দেখতে চায়। কোম্পানিগুলো ছোট ছোট, তাই ধার পাওয়া মুশকিল। বাধ্য হয়ে সবগুলো একসঙ্গে করে তারা একখানা বড় প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি বানিয়ে ফেলল, টাকা চলে এল। দেশ স্বাধীন হতে তাদের নতুন অফিস খুলে গেল দিল্লি, কলকাতা, মাদ্রাজেও। পরের বছর বোম্বের এক বড়সড় জলা এলাকা পরিষ্কার করে সেখানে খুলে বসল বিশাল সাইজের ফ্যাক্টরি।

অ্যাটমিক এনার্জি কমিশনের চেয়ারম্যান হোমি ভাবার মতই ইসরোর চেয়ারম্যান বিক্রম সারাভাই-ও এদেরই শরণাপন্ন হলেন, যখন ১৯৭২ সালে ভারতের স্পেস প্রোগ্রাম শুরু হল। পরে এমনকি ভারতের ডিফেন্স রিসার্চের বড় বড় ইঞ্জিনিয়ারিং প্রকল্পের জন্যেও এদের কথাই ভাবা হয়। প্রতিরক্ষার সামগ্রী ভারতের সরকারী ব্যবস্থায় বেসরকারি সংস্থা থেকে নেওয়া যায় না বলে ওদের কাছ থেকে ডিজাইন চাওয়া হয়। সেই ডিজাইন পরখ করে তার বরাত দেওয়া হয় সরকারি কোনো সংস্থাকে।

হেনিং ও তার বাল্যবন্ধু সোরেন ভারতকেই তাঁদের ঘর বানিয়ে নিয়েছিলেন। নিজেদের তৈরি কোম্পানি থেকে অবসর নিয়েও হেনিং দেশে ফিরে যাননি। ২০০৩ সালে ৯৬ বছর বয়সে বোম্বের ব্রিচ ক্যান্ডি হাসপাতালে মারা যাওয়ার আগে তাঁর নামের আগে অনেকগুলো পুরস্কার জ্বলজ্বল করছে। ১৯৭৬ সালে রামন ম্যাগসেসে থেকে শুরু করে তার পরের বছর ড্যানিশ নাইটহুড হয়ে মৃত্যুর আগের বছর তিনি পেয়েছেন ভারতের পদ্মভূষণ, ভারতীয় ডাক তাঁর নামে পোস্টেজ স্ট্যাম্পও ছাপিয়েছে। সোরেন অবশ্য দেশে ফিরে গেছিলেন প্রায় পঞ্চাশ বছর ভারতে কাটিয়ে, ১৯৮১ সালে। কিন্তু সে তাঁর সহ্য হয়নি, পরের বছরই তিনি সেখানে মারা যান। তাঁর স্ত্রী জীবনের শেষ বছরগুলো কাটিয়েছিলেন কোদাইকানালে তাঁদের পারিবারিক বাড়িতেই।

বিভিন্ন ধরনের কারখানা, কমার্শিয়াল ও রেসিডেন্সিয়াল বিল্ডিং, এয়ারপোর্ট, রানওয়ে, হাইওয়ে, রেলওয়ে, মেট্রোরেল, মনোরেল, এলিভেটেড করিডোর, আইটি পার্ক, হাসপাতাল, টানেল, জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র, পরমাণু শক্তিকেন্দ্র – বহুসংখ্যক বড় বড় প্রোজেক্ট সাফল্যের সঙ্গে রূপায়িত করে দেশনির্মাণের এক অন্যতম সহচর এঁদের এই সংস্থা।


দুই উৎসাহী তরুণ ড্যানিশ ইঞ্জিনিয়ার কলেজ থেকে পাশ করেই চলে এসেছিল ভারতে, সেখানেই কেটে গেল তাদের সমস্ত জীবন। হেনিং হল্ক-লার্সেন এবং সোরেন ক্রিস্টিয়ান টুব্রোর 'লার্সেন অ্যান্ড টুব্রো' এখন আমাদের দেশের সবচেয়ে বড় হেভি ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি এবং কুড়িটা বৃহত্তম মূল্যবান কোম্পানির অন্যতম। 'এল অ্যান্ড টি' এখন পৌনে দু-লক্ষ কোটি টাকার কোম্পানি।
২৩ ডিসেম্বর ২০২০