বৈদিকসাহিত্যে সোচ্চারে গোমাংস খাওয়া সমর্থিত। গোবধ, গোমাংস রান্না, খাওয়া, দান, গোমাংসের কার্যকারিতা নিয়ে ভুরিভুরি বিবরণ রয়েছে বৈদিকসাহিত্যে ও বেদত্তোর পৌরাণিক সাহিত্যে। অধুনা প্রচারিত যে, হিন্দুদের শাস্ত্রগুলি নাকি শাকান্ন ভোজনের উপর গুরুত্ব দিয়েছে। তা সর্বাংশে সত্য নয়; বরং শাকান্ন ভোজন থেকে গোমাংস ভোজনের ওপর বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। অতিথি আপ্যায়ণে গোমাংসই শ্রেষ্ঠ ছিল, এমন বিবরণ পাচ্ছি ঋগ্বেদে এবং বৈদিকসাহিত্যে। অতিথি আগমন মানেই গোবধ করতে হবে, গোমাংস দিতে হবে, এটাই ছিল রীতি। অতিথিদের ও গোবধের স্থানকে #গোঘ্ন বলা হতো। আদপে বৈদিক আর্য তথা নর্ডিকরা ছিল বর্বর, দুরন্ত যোদ্ধা এবং যাযাবর ও পশুপালক। চাষাবাদ, খাদ্যোত্পাদন জানত না। পালিত পশুর মাংসই প্রধান খাদ্য, সঙ্গে ফলমূল, দুধ। তারা মূলত মাংসাশী ছিল। তাদের সবচেয়ে প্রিয় ঘোড়ার মাংস, দ্বিতীয় প্রিয় গোমাংস। এজন্যই তাদের ধর্মীয় সমস্ত পরবেই পশুহত্যা ছিল এবং যজ্ঞে দেবতাদের উত্সর্গ করে খেত; অশ্বমেধ, গোমেধ তাদের যজ্ঞের রীতি ছিল। ঘোড়ার মাংস রান্না ও খাওয়ার লোলুপতা ঋগ্বেদে, পরবর্তীকালের গ্রন্থে বর্ণিত। গোমাংসের জন্য হাপিত্যেশের বিবরণও ভুরিভুরি।
বৈদিক আর্যরা হিন্দুকুশ পেরিয়ে যত পূর্ব ও দক্ষিণে ঢুকেছে, দেখেছে অশ্বের তুলনায় গরুর প্রাচুর্য ও সহজলভ্যতা। ফলে আহারে গোমাংস জনপ্রিয় হয়। পরে রীতিই হয়ে ওঠে। মনুসংহিতাতেও গোমাংস নিষিদ্ধ নয়।
ব্যাপক গোবধের জন্য গরুর সংখ্যা কমতে থাকে। গোবধে তিতিবিরক্ত হয়ে বৈদিকদেরই একশ্রেণি এর বিরোধিতা করে। ক্ষোভ প্রশমণে গোমাংস ভোজনের ওপর কিছু কিছু বিধিনিষেধ আরোপিত হয়। পৌরাণিককালেও গোবধ নিষিদ্ধ হয়নি, তবে গোবধ, গোমাংস ভোজন ও ব্যবহার কমানো হয়েছিল।
তারপরেও গোমাংস চলত।
ভারতবর্ষে ইসলাম আগমনের পরেও গোমাংস ভোজন হিন্দু ও ইসলামীদের দ্বারা চলেছে। কিন্তু, হিন্দুরা যেহেতু পৃথক ধর্মের, তাই হিন্দুধর্মের স্বতন্ত্র পরিচয় বজায় রাখতে গোমাংস ভোজন ছাড়ে হিন্দুরা। এইসময়ে খাদ্যে নানান বিধিনিষেধ আনা হয়। মাছ, শূকর, মেষ, মুরগি, পেঁয়াজ, রসুন ইত্যাদি খাওয়া নিষিদ্ধ হয় ব্রাহ্মণদের দ্বারা; ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে নিষিদ্ধ খাদ্যতালিকা রয়েছে। অথচ, তৈত্তিরীয় সংহিতায় ইন্দ্রকে শূকর বলি দেওয়ার কথা রয়েছে। তবে, ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ মতে ব্রাহ্মণরা পূর্ণিমা ছাড়া অন্য তিথিতে দেবতার উদ্দেশ্যে বলিপ্রদত্তের মাংস খেতে পারে।
বাংলা অঞ্চলের মানুষ মাছ খেত সহজলভ্যতায়, স্বাভাবিকতায়। ধর্মরক্ষায় লুকিয়ে খেত। ধরা পড়লে বৌদ্ধ বা পরে ইসলাম হতো। এটা রুখতে সেইসময়ে এই বাংলা অঞ্চলের বিখ্যাত পণ্ডিত ভবদেব ভট্ট, জীমূতবাহন হিন্দু ব্রাহ্মণের মাছ খাওয়ার বিধিনিষেধ তুলে নিলেন ও খাদ্যে, ভোজনে সংস্কার করলেন। এইসময় থেকেই উত্তর ও পশ্চিমভারতের বিশেষত গোবলয়ের হিন্দুদের সঙ্গে পূর্বভারতের হিন্দুদের খাদ্যে, ভোজনে, আচারে স্পষ্ট পার্থক্যের শুরু।
কালে কালে উত্তর ও পশ্চিমভারতের অতি আবেগপ্রবণ একশ্রেণির হিন্দু গরুকে দেবতা বানায়; গরুপূজা শুরু হয় এই ঊনবিংশ-বিংশ শতকে। অথচ, হিন্দুরা যে যে গ্রন্থগুলোকে ধর্মগ্রন্থ বলে এবং মানে, সেসবে গোবধ ও গোমাংস ভোজন রয়েছে রমরমিয়ে। গোদান আদপে গোমাংস দানের অপভ্রংশ রূপ।
হিন্দু ধর্মগ্রন্থ থেকে গোবধ ও গোমাংস ভোজনের উদাহরণ---
১) শ্রাদ্ধে অতিথিদের গোমাংস ভক্ষন করালে পূর্বপুরুষ ১ বছর স্বর্গসুখ পেতে পারে, এই উপদেশ যুধিষ্ঠিরের প্রতি পিতামহ ভীষ্মের, (মহাভারত, অনুশাসন পর্ব, অধ্যায় ৮৮)।
২) বিরাট রাজার গোশালায় দৈনিক ২০০০টি গরু বলি দেওয়া হতো। ফলে রক্তনদী তৈরি হয় রাজপ্রাসাদের গা বেয়ে।
৩) রাম গরুর মাংসের সঙ্গে মদ খেতে ভালবাসত। বনবাস-প্রাক্কালে মায়ের কাছে রামের আক্ষেপ, সে ১৪ বছর গোমাংস খেতে ও সোমরস পান করতে পারবে না এবং সোনার খাটে ঘুমাতে পারবে না; "রাম গোমাংস ভক্ষণ করতেন।" (বাল্মীকী রামায়ণ, আদিকাণ্ড, অযোধ্যাকাণ্ড)।
রাম, লক্ষ্মণ, সীতা বনবাসে যাবার পথে ভরদ্বাজমুণির আশ্রমে বৃষমাংস, মধুপর্ক, ফলমূল খেয়েছিল, (বাল্মীকী রামায়ণ ২/৫৪)।
৪) গোহত্যা এবং গোমাংস খাওয়ার বিধান রয়েছে শতপথ ব্রাহ্মণ ১১১/১/২১।
৫) ঋগ্বেদে বৈদিকআর্যদের গোমাংস খাওয়ার বহু উল্লেখের থেকে---
"ইন্দ্র বলল তাদের খাওয়ার জন্য ২০টি ষাঁড় রান্না করা হয়েছে (ঋগ্বেদ ১০/৮৬/১৪)।
গোমাংস ইন্দ্রের অতিপ্রিয় ছিল।
ঋগ্বেদে অগ্নির উদ্দেশ্যে ঘোড়া, বলদ, ষাঁড়, দুগ্ধহীন গাই, মেষ বলির উল্লেখ আছে। গরু বা ষাঁড়গুলিকে বৈদিকআর্যরা তরোয়াল বা কুড়ুল দিয়ে হত্যা করতো।
একটি বেঁটে ষাঁড় বিষ্ণুর উদ্দেশ্যে, একটি চিত্কপালী শিংওয়ালা গরু ইন্দ্রের উদ্দেশ্যে, একটি কালো গরু পুষনের উদ্দেশ্যে, একটি লাল গরু রুদ্রের উদ্দেশ্যে বলি দেওয়া হতো।
ঋগ্বেদ সংহিতায় "বিবাহসূক্ত"-এ কন্যার বিয়েতে সমাগত অতিথিদের গোমাংস পরিবেষনের জন্য অজস্র গরু বলির বিধান আছে, (ঋগ্বেদ সংহিতা ১০/৮৫/১৩)।
৬) তৈত্তিরীয়ব্রাহ্মণে "পঞ্চশারদীয়-সেবা" নামক ভোজন অনুষ্ঠানের প্রধান বৈশিষ্ট্য, ৫বছরের কম বয়সী ১৭টি বাছুরের মাংসে অতিথি আপ্যায়ন।
৭) বিষ্ণুপুরাণও গোমাংস ভোজনকে সমর্থন করেছে। শ্রাদ্ধের দিনে ব্রাহ্মণদের মৎস্যদানে ২মাস, শশক মাংস দানে ৩মাস, ছাগ মাংস দানে ৬মাস, মেষ মাংস দানে ১০মাস এবং গোমাংস দানে ১১মাস পিতৃগণের আত্মা পরিতৃপ্ত থাকে, (বিষ্ণুপুরাণ ৩/১৬, ঔর্ব্য মুনির বচন)।
৮) গোপালকেরা মাংসের জন্য ছাপ দেওয়া গরুর মাংস কাঁচা অথবা শুকিয়ে বিক্রি করতে পারে, (চাণক্য অর্থশাস্ত্র ২/২৯/১২৯)।
৯) চরকসংহিতা গোমাংসের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা ও পুষ্টিগুণের কথা বলেছে এবং গোমাংস খাওয়া সমর্থন করেছে। গোমাংস বাত, নাক ফোলা, জ্বর, শুকনো কাশি, অত্যাগ্নি (অতিরিক্ত ক্ষুধা বা গরম), কৃশতা প্রভৃতি অসুখের প্রতিকারে বিশেষ উপকারী (চরকসংহিতা ১/২৭/৭৯)।
১০) সুশ্রুতরও একই সুর, গোমাংস পবিত্র এবং ঠান্ডা; হাঁপানি, সর্দিকাশি, দীর্ঘস্থায়ী জ্বর, অতি ক্ষুধা, বায়ু বিভ্রাটের নিরাময় করে, (সুশ্রুতসংহিতা ১/৪৬/৪৭)।
.
প্রশ্ন,
বেদসংহিতা, ব্রাহ্মণগ্রন্থ, পুরাণ, মনুসংহিতা, মহাভারত, রামায়ণ হিন্দুদের ধর্মগ্রন্থ। হিন্দুরা কি এই ধর্মগ্রন্থগুলো মানে না?
.
অতএব, গোমাংস হিন্দুদের বৈধ।
© #কপিরইটভূক্ত
#শমীন্দ্রঘোষ
২০/১০/১৮