বৃহস্পতিবার, ২৩ নভেম্বর, ২০২৩

বেলা আর বাতুল ~ অরিজিৎ গুহ

বেলা আর বাতুল এর গল্প শুনেছেন? অনেকেই শোনেন নি হয়ত। আসুন শুনে নি। গল্পটা আমরা শুনছি বোম্বের প্রসিদ্ধ ফরাস রোডের এক তওয়াইফের মুখ থেকে।
বেলা ছিল রাওয়ালপান্ডির কাছের একটা গ্রামের মেয়ে। ক্লাস ফোরে পড়ত। বাবার খুব আদরের মেয়ে ছিল। এগারো বছর বয়স। আর কয়েকবছর পরেই হয়ত গ্রামেরই কোনো গরীব ছেলের সাথে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হত, তারপর সুখে ঘরকন্না করতে পারত।
কিন্তু হঠাৎ করেই কী হল, একদিন আল্লাহ হো আকবর বলে একদল লোক ঝাঁপিয়ে পড়ল বেলার বাড়ির ওপর। বেলার বাবাকে তরোয়ালের কোপে ধর থেকে মুন্ডুটা আলাদা করে দিল, মায়ের স্তন কেটে দিল, আর আরো যেসব হিন্দু বাড়ি ছিল সব বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিল। গ্রান্ট রোডের এপারে ফরাস রোডে জিন্নাহ্ সাহেব কোনোদিনও আসবেন না। শরিফ আদমিরা কখনো গ্রান্ট রোড ক্রস করেন না।কিন্তু জিন্নাহ্ সাহেব একবার যদি বেলার সাথে দেখা করতেন, তাহলে হয়ত বেলাকে বোঝাতে পারতেন বেলার সাথে যা হয়েছে তা করার অধিকার কোরাণে কোনো মুসলমানকে দেয় নি।
বেলা এরপর পালিয়ে চলে আসে রাওয়ালপিন্ডি। সেখানে এক মুসলিম দালাল ওকে নিজের হেপাজতে করে নেয়। সেই দালালের থেকে আরেক দালাল ওকে কিনে নেয়। তারপর বেলার ঠাঁই হয় ফরাস রোডের তওয়াইফখানায়। বেলার মুখটা যদি জিন্নাহ্ সাহেব দেখতে পেতেন, তাহলে বুঝতেন 'মাসুমিয়াত কি কোই মজহব নেহি হোতি'। এক সরল নিষ্পাপ বাচ্চা মেয়ের মুখ। সেই মুখে ধর্ম লেখা নেই। সেই মুখে হিন্দুস্তান পাকিস্তান লেখা নেই। সেই মুখ হিন্দু মুসলিম শিখ ইসাই যে কারো মুখ হতে পারে। জিন্নাহ্ সাহেবের বাংলোতে যে বেলার চিৎকারের আওয়াজ পৌঁছায় না!
বাতুল থাকত জলন্ধরের কাছের এক গ্রামে। বাবা খুবই গরীব। মুটে মজুরি করে চালায়। অনেকগুলো দিদি আর ভাইদের নিয়ে তার মধ্যেও শান্তিতে থাকত ওরা। বাতুলদের গ্রামে 'নমাজ আদা' করার কোনো হুকুম ছিল না। বাতুল কোনোসময়ে জিন্নাহ্ সাহেবের গল্প শুনেছিল। সেই থেকে জিন্নাহ্ সাহেবকে খুব পছন্দ করত। গলায় একটা লকেট ঝুলিয়েছিল জিন্নাহ্ সাহেবের ছবি দিয়ে।
হিন্দুস্থান পাকিস্থান ভাগ হওয়ার পর বাতুল স্লোগান দিয়ে ফেলেছিল পাকিস্তান জিন্দাবাদ বলে। ঠিক যেরকমভাবে পাঁচ ছ'বছরের বাচ্চা কোনো কিছু না বুঝেই ইনকিলাব জিন্দাবাদ স্লোগান দিয়ে ফেলে, সেরকমই আরকি।
সেই স্লোগান শুনে গ্রামের জাঠরা এসে প্রথমে ওর বাবার জামা কাপড় খোলাল, তারপর মুখে পেচ্ছাপ করল, তারপর বাবার বুকে ছুরি ঢুকিয়ে দিল। দিদিদের টেনে হিঁচড়ে নিয়ে চলে গেল আড়ালে।
এরপর বাতুলকে যখন এক হিন্দু দালালের থেকে ফরাস রোডের ওই তওয়াইফ কিনে নিল, তখন সে দেখেছিল বাতুলের সারা গায়ে আঁচড় কামড়ের দাগ। পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু তো অনেক পণ্ডিত মানুষ আর উনিও অনেক শরিফ আদমি। তাই উনিও কখনো ফরাস রোডের তওয়াইফখানায় ঢুকবেন না কোনোদিন। কাজেই বাতুলকেও দেখতে পাবেন না কোনোদিন। যদি দেখতে পেতেন, তাহলে হয়ত উনি বোঝাতে পারতেন যখন বাতুলের সাথে এরকম হচ্ছিল, তখন ঋকবেদ স্তম্ভিত হয়ে গেছিল। গুরু গ্রন্থসাহিব বোবা হয়ে গেছিল। কারণ দুই কিতাবের কোথাও যে লেখা ছিল না বাতুলের সাথে এরকম ব্যবহার করার কথা।
নেহেরুজি'র বাংলোতে যে বাতুলের চিৎকারের আওয়াজ পৌঁছায় নি। নেহেরু জি কী করবেন!
কৃষণ চন্দর যখন 'এক তওয়াইফ কি খৎ জিন্নাহ্ সাব অউর নেহেরু জি কো' লিখেছেন তার কিছু আগেই আজাদি এসেছে। কিন্তু তাও বারেবারে ক্ষমতাকে প্রশ্ন করে গেছেন কৃষণ চন্দর।
'মহালক্সমী কা পুল' গল্পে মহালক্সমী পুলের পাশে বসবাসকারী নিম্নবিত্ত শ্রমিক বস্তির যে ছবি এঁকেছেন তার প্রতিটা ছত্রে লুকিয়ে রয়েছে ভদ্র সভ্য উচ্চবিত্তদের প্রতি বিদ্রুপ।
পুলের পাশে মিল মজদুররা তাদের নিজেদের নিজেদের চওলে থাকে। পুলের ওপর ওদের স্ত্রীদের শাড়ি শুকোতে দেওয়া হয়। পাশাপাশি ছটা শাড়ি শুকোতে দেওয়া হয়েছে। শান্তাবাঈ এর ফ্যাকাসে বাদামী রঙের শাড়ির পাশে যে শাড়িটা ঝুলছে শুকোতে দেওয়ার জন্য, সেই শাড়িটাও পাঠকদের চোখে ফ্যাকাসে বাদামী রঙই মনে হবে। কিন্তু কথক, যিনি একজন পয়ষট্টি টাকা মাইনের ক্লাস টেন পাস করা ক্লার্ক, যখন থেকে শাড়িটা দেখেছেন তখন সেটার রঙ ছিল গাঢ় বাদামী। পুরনো হয়ে রঙ হাল্কা হয়ে হয়ে সেটা ফ্যাকাসি বাদামী রঙে পর্যবসিত হয়েছে। তার পাশে রয়েছে মিল থেকে বহিষ্কৃত শ্রমিক ঝাব্বুর স্ত্রী লোড়ির শাড়ি। লোড়ির শাড়ির পাশে ঝুলছে মঞ্জুলার শাড়ি। সব থেকে ঝকমকে শাড়ি ওটা। কারণ মঞ্জুলার কয়েকমার আগে বিয়ে হয়েছে আর বিয়ের শাড়িটাই ঝুলছে। মঞ্জুলার স্বামী কিন্তু অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেছে। মঞ্জুলার পাশে শেষ যে শাড়িটা ঝুলছিল সেটা ছিল বুড়ি মা'র। যার ছেলে সিতু এখন জেলে। সরকার থেকে যখন হরতাল বে আইনি ঘোষণা করা হয়েছিল, তখন সিতুরা জুলুস বের করেছিল হরতালের সমর্থনে। পুলিশ থেকে মহালক্সমি পুলের পাশের চওলে গুলিবৃষ্টি চলে। সবাই ভয় পেয়ে নিজের নিজের চওলের দরজা বন্ধ করে দেয়। পরে যখন সব শান্ত হয়ে যায় তখন দেখা যায় সিতুর মা গুলি খেয়ে মরে পড়ে আছে। বুড়ি মানুষ, হয়ত তাড়াহুড়ো করে নিজের খোপরে ঢুকতে পারে নি। সেই লাল শাড়িটা এখন পরে সিতুর বৌ। সিতু হরতাল করার জন্য জেলে রয়েছে।
একটু পরই মহালক্সমী পুলের ওপর দিয়ে 'ওয়াজির এ আজম' মানে প্রধানমন্ত্রীর কনভয় যাবে। প্রধানমন্ত্রীর চোখেও সেই ঝোলানো শাড়িগুলো চোখে পড়বে না। যতক্ষণ না প্রধানমন্ত্রীর কনভয় যায় ততক্ষণ ধরে সেই শান্তাবাঈদের কলোনির গল্প শুনিয়েছেন কৃষণ চন্দর।
যুবতী শান্তাবাঈ, বৃদ্ধা জীবনা বাঈ বা কথকের মধ্যবয়সী স্ত্রী সবার গল্প মোটামুটি একইরকমের। প্রতি পদে অর্থের হাহাকার, ছোট্ট ছোট্ট সাধ আহ্লাদ আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ না হওয়ায় জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণা আর তারই সাথে কুসংস্কার, সব যেন একসাথে হাত ধরাধরি করে রয়েছে। সবার শাড়িগুলো একসাথে যখন পাশাপাশি উড়তে থাকে তখন প্রত্যেকের শাড়ির রঙগুলো আর আলাদা করে চেনা যায় না।
প্রত্যেকের গল্প বলতে বলতেই কখন যে প্রধানমন্ত্রীর কনভয় চলে যায় বোঝাও যায় না। আসলে কনভয় তো এই মহালক্সমী পুলের পাশে দাঁড়াবে না, প্রধানমন্ত্রীর অত ঠেকাও পড়ে নি। কিন্তু ওই ছ'টা শাড়ি যেন ভারতবর্ষের লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রতিদিনের গল্প বলে যায়।
১৯৩৬ সালে যখন প্রোগ্রেসিভ রাইটার্স অ্যাসোসিয়েশন তৈরি হয় প্রেমচন্দকে সভাপতি আর সাজ্জাদ জাহিরকে সম্পাদক করে, তখন সেই সংগঠন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ইকবাল আর নজরুলের আশীর্বাদ ধন্য হয়ে ওঠে। উর্দু সাহিত্য সেই সময়ে মোটামুটি আগের অবাস্তব আবেগের জায়গা থেকে অনেকটাই সরে এসেছে বাস্তবের মাটিতে।
প্রথম সম্মেলনে আহম্মদ আলি, আলি আব্বাস হুসায়নী, মুলকরাজ আনন্দ, খাজা আহমেদ আব্বাস, শওকত সিদ্দিকে, গোলাম আব্বাস, আহমেদ নাদিম কাশমী প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য নাম হলেও চারজন যারা পরবর্তীকালে উর্দু সাহিত্যের স্তম্ভে পরিণত হয়েছিলেন তারা হলেন সাদাত হাসান মান্টো, রাজিন্দার সিং বেদি, ইসমাত চুঘতাই আর কৃষণ চন্দর। বলা যায় এই চারজন উর্দু সাহিত্যকে শাসন করেছেন। তবে বাকি তিনজন যেমন চরিত্রদের মনস্তাত্ত্বিক জগৎ নিয়ে পরীক্ষা নীরিক্ষা করেছেন কৃষণ চন্দর আবার চিরকাল সাহিত্য রচনা করে গেছেন শোষিত শ্রমজীবী মানুষের পক্ষে। প্রোগ্রেসিভ রাইটার্স অ্যাসোসিয়েশনের পতাকা সার্থক ভাবে বয়ে নিয়ে গেছেন। মান্টোর মতই দাঙ্গা আর দেশভাগকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন।
'গাদ্দার' গল্পে বৃদ্ধ বুলাকি শাহ চারিদিকের শয়ে শয়ে পড়ে থাকা লাশের মধ্যে হাতড়ে হাতড়ে কী যেন খুঁজতে থাকে। বৈজনাথের কন্ঠে চমকে উঠে বলে 'আমি মুসলমান। আমাকে মেরো না।' জবাবে বৈজনাথ যখন বলে মুসলমান হলে এখানেই তোর লাশ ফেলে দেব, তখন উত্তরে বুলাকি শাহ জানায় আমি বুলাকি শাহ। বৈজনাথ এবার আশ্চর্য হয়। গ্রামের সব থেকে বড় মহাজন বুলাকি শাহ! বৈজনাথ জিজ্ঞাসা করে এখানে কী করছ? ততক্ষণে বুলাকি শাহ ভয় কাটিয়ে উঠেছে। বলে সব তো মরে পড়ে রয়েছে এখানে। আমার পরিবারেও কেউ বেঁচে নেই, সম্পত্তিও সব লুঠপাট হয়ে গেছে। শুধু মেয়েটা বেঁচে রয়েছে। তা মেয়েটাকে তো বিয়ে দিতে হবে। যা পাচ্চি এখান থেকে সোনাদানা তাই হাতিয়ে নিচ্ছি পকেট থেকে। তুমিও এসো না। যা পাব ভাগ বাটোয়ারা করে নিয়ে নেব।
স্তম্ভিত হয়ে যায় বৈজনাথ। মানুষ কোথায় নামতে পারে ভেবে! বুলাকি শাহ বলে মেয়ের বিয়ের যৌতুক ছাড়া কেউ তো মেয়েকে বিয়ে করবে না।
দেশভাগ আর দাঙ্গার নানারূপ দেখেছেন কৃষণ চন্দর। বরাবর গল্প বলেছেন নিম্নবিত্ত খেটে খাওয়া গরীব মানুষের। তাঁদের দুঃখ দুর্দশা, লড়াই করা হেরে যাওয়া এবং আবার জানকবুল লড়াই এর জন্য উঠে পড়া, এই গল্পই শুনিয়ে গেছেন। তেলেঙ্গানা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে 'রোটি কাপড়া মকান' এক অদ্ভুত গল্প।
খাজা আহমেদ আব্বাস যখন সিনেমা করবেন বলে ঠিক করলেন, তখন বাংলার বিজন ভট্টাচার্যের 'নবান্ন' আর 'জবানবন্দি' এই দুটো নাটকের গল্প শোনা হয়ে গেছে। ৪৩ এর মন্বন্তরকে খুব কাছ থেকে দেখেছিলেন আব্বাস। এরপর কৃষণ চন্দরের 'অন্নদাতা' গল্পে পড়ে ঠিক করলেন তিনটে গল্পকে একসাথে নিয়ে একটা সিনেমা বানাবেন বাংলার ৪৩ এর মন্বন্তরের প্রেক্ষাপটে।
যথা সময়ে 'ধরতি কে লাল' সিনেমা তৈরি হল আইপিটিএ র সব রথী মহারথীর সাহায্যে। আন্তর্জাতিক খ্যাতিও পেল সেই সিনেমা। এটাই একমাত্র সিনেমা যা আইপিটিএর নিজস্ব প্রযোজনায় তৈরি। সেখান থেকেই ফিল্ম জগতের সাথে যোগাযোগ তৈরি হয় কৃষণ চন্দরের।
এক সময়ে সিনেমার স্ক্রিপ্ট আর গল্প লেখার পেছনে এত সময় দিতে হয়েছিল যে তাঁর নিজের গল্পে সেই প্রভাব পড়েছিল। গল্পের ধার গেছিল কমে।
নীহাররঞ্জন গুপ্তের লেখা 'উত্তর ফাল্গুনি' হিন্দি স্ক্রিপ্ট 'মমতা' কৃষণ চন্দরেরই লেখা। এছাড়াও অসিত সেনের আরেকটি সিনেমা 'সরাফত' যেখানে ধর্মেন্দ্র হিরো ছিল তার গল্পও কৃষণ চন্দরের। কিন্তু তিনি নিজেও বুঝতে পারছিলেন যে সিনেমার জগতে থাকলে তার গল্পের মান নেমে আসছে। অবশেষে ছেড়ে দিলেন সিনেমার জগত। ১৯৭৭ এ যখন মৃত্যু হয় তখন হাসপাতালে তার বেডের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন দ্বিতীয় স্ত্রী সালমা সিদ্দিকি। লিখতে শুরু করেছিলেন নতুন একটি গল্প। কয়েক লাইন লেখার পরই ঢলে পড়েন মৃত্যুর মুখে। ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাকে নিভে যায় উর্দু সাহিত্যের এক স্তম্ভ কৃষণ চন্দরের জীবন দীপ।
১৯৭৭ এ মৃত্যু হলেও একজন লেখক কতটা প্রভাবশালী হতে পারেন তার পরিচয় পাওয়া গেছে এই ২০১৯ সালেও এসে। ২০১৯ সালের এক সার্কুলার জারি করে আইসিএসসি বোর্ডের দশম শ্রেনীর সিলেবাস থেকে 'জামুন কা পেড়' বলে একটি গল্প বাদ দিয়ে দেওয়া হয়েছে। গল্পটিতে খুব তীক্ষ্ণভাবে মজার ছলে ভারতের ব্যুরোক্রেসির প্রতি, লাল ফিতের ফাঁসের প্রতি প্রশ্ন তোলা হয়েছিল। সরকারের সেসব পছন্দ না হওয়াই স্বাভাবিক। কাজেই আজও কৃষণ চন্দর কতটা প্রাসঙ্গিক বোঝা যায়।
১৯১৪ সালের আজকের দিনেই অর্থাৎ ২৩ শে নভেম্বর জন্ম হয়েছিল কৃষণ চন্দরের।

রবিবার, ৫ নভেম্বর, ২০২৩

শান্তিগোপাল, লেনিন ও আমরা ~ শুদ্ধ্বসত্ত্ব ঘোষ

কালীপূজো এসে গেল। এমন সময় রেল কলোনীর বিশাল মাঠ ঘিরে ফেলা হত। টিনের দেওয়াল। দেড় মানুষের বেশী উচ্চতা। সেই টিনের দেওয়াল যা ঘিরছে তা কিন্তু সার্কাস না। তা হল যাত্রা।

ভেতরে ঢুকলে দেখতে পাবেন একটা মঞ্চ হচ্ছে। সেই মঞ্চের চারদিক খোলা। লম্বা দুটো স্লোপ চলে গ্যাছে সাজঘর থেকে সোজা সে মঞ্চে। মঞ্চের সামনে বসবে কনসার্ট পার্টি। তাদের জন্য একটু নীচু করে জায়গা রাখা। কখনো দু পাশেও বসতে দেখেছি তাঁদের। পিছনে সাজঘরের দিক থেকে টেপ বাজতো। সামনে, পিছনে আলোর স্ট্যান্ড বসে যাবে। আলোক নিয়ন্ত্রকের বসার ব্যবস্থা হবে ওই দুটো স্লোপের মাঝখানের অংশে। 
শুনেছি এ সব ব্যবস্থা হল যাত্রা সম্রাট স্বপনকুমারের করা। আধুনিক করেছেন তিনি। রবি ঠাকুরের বাড়ির মেয়ে তাঁর জ্যাঠাইমা। মেজদা, বিজন মুখোপাধ্যায়। শিশির ভাদুড়ির সাক্ষাৎ ছাত্র। তিনি, স্বপনকুমার ছিলেন সনৎ, হলেন স্বপন যাত্রায়। বাবা, দাদার মৃত্যুর পরে, দিদির একমাত্র ছেলে দাঙ্গায় মারা যাবার পরে, বোনের মুখের দিকে তাকিয়ে এসেছিলেন যাত্রায়।   

সন্ধ্যা নামবে একদিন মফস্বলে, শীত আসার আগের সন্ধ্যা। দলে দলে লোক যাত্রার সিজন টিকিট কেটেছে। একেক কোম্পানি আসবে, একেক যাত্রা গাইবে। নট্ট থেকে শুরু করে রয়্যাল বীণাপাণি। সে আমলে শান্তিগোপাল অপেরাও। শান্তিগোপালে আসার আগে বলে নিই আমার ভয় পাওয়ার কথা। মঞ্চে দেখলাম তেমন এক সন্ধ্যায় এক খোঁড়া বাদশার জন্য থালায় সাজিয়ে কাটা মুন্ডু নিয়ে আসছে এক পার্ষদ। অবিকল যেমন দেখতে অভিনেতা একটু আগে খুব লড়ছিলেন বাদশার সঙ্গে তাঁর কাটা মুন্ডু। ভয় পাবো না? তখন কি ছাই জানি ও মুন্ডু মাটির? ও মুন্ডু কৃষ্ণনগরের ফুল-ফলের মতন? তবে বাদশাটি শান্তিগোপাল না, তিনি শিবদাস।

শান্তিগোপাল-ও ভয় দেখালেন। হিটলার-এ। আরেকটু বড় তখন। মেদিনীপুড়, জকপুর, খুড়দা কত কত জায়দায় যাত্রা হয়। বাবার সঙ্গে সঙ্গে, সোনা কাকু, দাদাভাই-এর সঙ্গে চলে যাই। রাত জেগে যাত্রা। দেখতে দেখতে ঘুমিয়েও পড়েছি। আবার আতঙ্কের মধ্যে জেগে থেকেছি সারারাত। স্পার্টাকাসে কালো লোকটা সেই! সেই যে যে স্পার্টাকাসের মতন দাস ছিল, গ্ল্যাডিয়েটর ছিল, যে এরিনায় স্পার্টাকাসকে খুন করতে চেয়েছিল, স্পার্টাকাসের বউ-কে কামনা করেছিল, সেই লোকটা কি কালো, কি ভয় ধরাণো ছিল। অজিতেশ-কে দেখছি আসলে। সেই হাসিটা? কি ক্রুর, কি ভয়ানক! মঞ্চে এসে দাঁড়ালেই মনে হত এই শয়তানটা কেন মরে না? 

কিন্তু যখন স্পার্টাকাস ওকে মারলো না, যখন ও স্পার্টাকাসের বন্ধু হল, যখন ওরা একসঙ্গে বিদ্রোহের কথা বললো, করলো- তখন মন ভরে গেছিলো। মনে হয়েছিল এবারে কেউ স্পার্টাকাসকে হারাতেই পারবে না। ছাই তখন বুঝি শ্রেণী সংগ্রাম কি? সশস্ত্র বিপ্লবের কত কত পথ ও পন্থা? বামের কত মত? যত মত তত পথ না? খুনোখুনি হয়ে যায় বামের বামত্ব মাপতে? কিচ্ছু জানি না এসব। শুধু জানি মালিকেরা বড় ভয়ানক। নিগ্রো মানুষটার চেয়েও। তারা শয়তানের-ও শয়তান। তারা সব লুঠে নেয়। কেমন করে জানলাম? শান্তিগোপাল দেখে। সুকান্ত-র শোন রে মালিক, শোন রে মজুতদার পড়ে। 

সুকান্তর কবিতা, শান্তিগোপালের যাত্রা, সুরেশবাবুর পাপেট থিয়েটার-এর একটি মোরগের কাহিনী সব মিলে মিশে যেত সেই সব শীত সন্ধ্যার অন্তরে অন্তরে। মানুষ গর্জন করতো। মানুষের গর্জন যারা শোনেনি তারা জানে না কেমন ভীষণ সে গর্জন। সমুদ্র-ও শিশু তার কাছে। মহাসমুদ্রের নাদ সে। আমি আমার দুই থেকে বারো অব্দি মজে ছিলাম যাত্রায়। থিয়েটার অল্প স্বল্প এসেছে মফস্বলে। মাচা বেঁধে খুব বেশী দল করতো না ওখানে। ডিহি কলকেতার বাবু মহলের যাত্রা দেখে ফাত্রা লোকের দলে পড়তাম আমরা। 

মফস্বলের-গ্রামের মানুষরা। আমরা সেই ফাত্রা লোক, যারা না খাটলে মাঠ থেকে ধান ওঠে না, যারা না খাটলে কল-কারখানা চলে না। বাবুদের ফুটুনি তিন মিনিটে উবে যায়। আমরা যারা অপমানিত হতাম বাবুদের হাতে, যারা বাবুদের ফাত্রা লোক তারা যাত্রাকে প্রাণ দিয়ে ভালবাসতাম।

শান্তিগোপাল, পোষাকি নাম বীরেন্দ্রনারায়ণ পাল। বাবা প্রেসিডেন্সির ছাত্র, দাদা জজ। ও বাড়ির ছেলে যাত্রা করে না। তিনি করেছিলেন। প্রথমে পাড়ার নাটক, তারপরে গ্রুপ থিয়েটার উদয়াচল, তারপরে একদিন যাত্রা দেখতে দেখতে যাত্রা। বাগবাজারের মদনমোহনতলায় শুরু হত সিজন। সেখানে অমর ঘোষ পরিচালক হয়েছিলেন। 

শান্তিগোপাল, রস্ট্রাম ব্যবহার শুরু করলেন। মাইক্রোফোন এল। চিৎকার করেই যাতে শুধু শোনাতে না হয়। নেপথ্যে টেপরেকর্ডার থেকে শব্দ-প্রক্ষেপণ। এ সব এলো হিটলার-এ। শান্তিগোপাল বলতেন পার্টি ইত্যাদি নয় মানুষকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ থেকে বাকী সব নিয়ে সচেতন করছেন।

আসলে আমরা ভুলেই গিয়েছি নবান্ন, নবনাট্য বাংলার মাঠেঘাটে যত না ঘুরেছে তার চেয়ে বেশী ঘুরেছে যাত্রাপালা। ভক্তিরসের বন্যায় গিরিশেরা পেশাদারী রঙ্গমঞ্চ চুবোচ্ছেন, কারণ যাত্রাতেও ঐ চলছে। একা মুকুন্দদাস বাদ দিলে কেউ আর নীলদর্পণ-এর লড়াইতে ছিল না। যাত্রার দর্শক, গ্রাম-মফস্বলের মানুষই এসেছে সেকালের থিয়েটারে দর্শক হয়ে। একালের দর্শকভেদ আগেই বোধহয় হতে থেকেছে। শহুরে বাবুরা যাকে নাট্য বলবেন, বাকীদের তাকেই নাট্য বলতে হবে। তারপরেও জনগণের কাছাকাছি কিন্তু একমাত্র যাত্রা। জন-রাজনীতিরও কাছাকাছি।

শান্তিগোপাল বুঝেছিলেন। শুধু উৎপল দত্তের কথা আমরা বলি রাজনীতি প্রসঙ্গে। তাঁর কথা বলি না। শান্তিরাম, শান্তিরঞ্জন পেরিয়ে অবশেষে তিনি শান্তিগোপাল হয়েছেন। মম্মথ রায় গলার মালা খুলে দিয়েছেন। গ্রাম বাংলার মাঠে মাঠে রাতের পর রাত ইতিহাস পড়িয়েছেন শান্তিগোপাল। বাংলার এক অনন্য ইতিহাসের শিক্ষক। লোকে বলতো কমিউনিস্ট দালাল। গ্রামের কংগ্রেস গুন্ডা, জোতদার, দালালরা বলতো। লেনিন করে। রাশিয়া যায়। হিটলার করে। আবার আমি সুভাষ-ও করে। মাও সে তুং করে। ব্যাটা নকশাল। কত কি! 
শুনেছি মারার জন্য মুখিয়ে থাকতো তারা। শুনেছি কৃষকদের দল হাতে কাস্তে নিয়ে যাত্রা দেখতে আসতো। দেখেছি পাড়ার কংগ্রেসের ছোট নেতা তড়পে গেলে পালটা রুখে দাঁড়াতে রেলের কর্মী মজদুরদের। যারা ইউনিয়নের লোক। যারা লাল। বা অতিলাল। শান্তিগোপাল  আসবেন-ই। শান্তিগোপাল এসেছিলেন। আমাদের ইতিহাস পড়াতেন। লোকশিক্ষা দিতেন। এবং একটা অনন্য শিক্ষা দিতেন। 
আজ ডিহি কলকেতার বাবুপাড়ার থেটারে এসে দেখি 'লোকে কি খাবে' তা নিয়ে প্রচুর গবেষণা চলে। আমরা যারা গ্রামে-মফস্বলে শান্তিগোপালের একনিষ্ঠ দর্শক, বোকা এবং ফাত্রা লোক- তারা জানি কে কি খাবে ভেবে রান্না হবে না। এ থ্যাটার হোটেল না, কি স্বাস্থ্যকর, কি দরকারী, কি তারপরেও সুস্বাদু তাই রান্না করা দরকার। যদি রাঁধিয়ের দম থাকে তাহলে পাত পেড়ে খাবে পাড়া-বেপাড়ার লোক। না থাকলে উঠোন কেন ব্যাঁকা তা নিয়ে প্রচুর গবেষণা করতে হবে, নাচা হবে না। 
শান্তিগোপাল, আমাদের শিক্ষক হাতে-কলমে দেখিয়ে দিয়েছেন। চাষাভূষো, মজুর-টজুর বিধিবদ্ধ ফাত্রা লোককে শিক্ষণীয় যাত্রা দেখিয়েছেন হাজারে হাজারে বসিয়ে। হ্যাঁ, তারাও দেখে গিয়েছে। সেলাম করে গিয়েছে, আর গর্জনে উত্তাল হয়েছে। মহাসমুদ্রের মহানাদে। 

ঋত্বিক যখন 'আমার লেনিন' করছেন তখন 'লেনিন লেনিন লেনিন লেনিন/ নূতন আশা নূতন দিন' গানের যুদ্ধতৎপরতায় চরিত্র আর ক্যামেরা এগিয়ে যায় যাত্রার মঞ্চের দিকে। 'লেনিন, কথা বলছেন, বোঝাচ্ছেন, ঘুরে বেড়াচ্ছেন এই গ্রাম্য রাজ্যের মাঝে'। নেপথ্যে ভয়েস ওভার বলছে। বলছে লেনিন বাংলার মঞ্চে গাইছেন ইন্টারন্যাশনাল। এই-ই সম্ভবত সেকালের রাজনৈতিক যাত্রার একমাত্র ফুটেজ। যিনি জানেন কোথায় তাকাতে হয় কোন রাজনীতি নিয়ে - তিনিই দেখেন, বাকীরা দেখি দেখি ভাণ করে মাত্র।

ঋত্বিক দেখেছেন। দেখিয়েছেন। আমরা ফাত্রা লোকেরা দেখেছি। রাজনীতি ঠান্ডা ঘরে বসে, গাড়ি চড়ে ঘুরে, ভোট মাপবার বস্তু নয় জেনেছি। বাবুরা পুলিশ-গুণ্ডা দিয়ে বুথস্তরের সংগঠন গড়ে ক্যাডার বেস্‌ড পার্টি হবার খোয়াব দেখেছে। দেখে এখনও। নির্বাচনে হারা জেতা নয়, আদপেই বাংলার মাঠে মাঠে পুলিশ-গুণ্ডা বাদ দিয়ে কত মানুষ হাতের লাঠি কিম্বা কাস্তে নিয়ে উঠে দাঁড়ায়, সেখানেই জোর, ভুলে গেছে তারা। 

এখনো, গ্রামে-মফস্বলে, শহরে বিদ্বেষের পারদ উর্ধগামী। ক'টা সিটে জেতার আনন্দে সেদিকে কারো নজর নেই। এখন নেই শান্তিগোপাল। রাতের পর রাত জেগে, নিঃস্ব হয়ে গিয়েও মাঠে মাঠে আদর্শের বীজ বোনার চেষ্টা নেই। খিল্লি আছে শহুরে আমোদগেঁড়ে মধ্যবিত্তের 'কে তুই শান্তিগোপাল' বলে। আর আছে রাজনৈতিক ভয়াবহ শূন্যতা যেখানে যা খুশীকেই রাজনীতি বলে চালিয়ে হাততালি নেবার পালা। ঘৃণ্যকে ঘৃণা না করতে পারার অক্ষমতাই চিনিয়ে দেয় কে কোন শ্রেণীর পক্ষে, কে কোন রাজনীতির পক্ষে। স্তাবকতা আর সাপলুডোর দিনকালে শান্তিগোপালকে তাই মনে পড়ে।