কয়েকদিন জ্বরের ঘোরে পড়েছিলাম। আর আট ভাট কত কথাই ভাবছিলাম। কেন জানিনা কফি হাউজের ভেটকির কথা খুব মনে পড়ছিল। আমি তখন ফার্স্ট ইয়ারে পড়ি। কোন এক দাদা যেন ভেটকিকে দেখিয়ে আমাকে বলেছিলো, ওই দেখ ভেটকি, কফি হাউজের মহাপুরুষ। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে মদ খায়। বাকি সবার সঙ্গেও মদ খায়। মাঝে লিভারটা একটু খারাপ হয়েছিল। তাই এখন লিভ ফিফটি টু দিয়ে মদ খায়। ভেটকিকে দেখেও যেন মনে হল দ্রব্যগুণেই আছে। চোখ মুখে সামান্য একটু লালচে আভা, যেন ঝামরে জ্বর আসছে। আমি মানসচক্ষে দেখতে পেতাম যে ভেটকি এক মনে মদ খাচ্ছে আর তার পাশে রাখা আছে চাটের বদলে একটি লিভ ফিফটি টু এর কৌটো। বিগড়ে যাওয়া মেটে, রগড়ে ঠিক করে নেওয়ার জন্য গম্ভীর মুখে, কয়েক চুমুক মদের পরেই একটি করে ট্যাবলেট গলাধঃকরণ করছে সে।
আমার তখন বাস্তবে মদ খাওয়া নিয়ে ধারণা খুব একটা স্পষ্ট ছিলো না। মদ খাওয়া যা দেখেছি সব সিনেমায়। বাবার কাছে বরাবর শুনেছি যারা মদ বা সিগারেট খায় তাদের চরিত্র খুবই খারাপ হয়। আর যে সব মহিলারা ওইসব খায় তাদের সম্পর্কে তো ইয়ে, যত কম বলা যায় ততই ভালো! হাউজে কিছুদিন আসার পর, টেবিলে এর ওর থেকে সিগারেট চেয়ে দু-এক টান দিয়ে দেখলাম। ভালোই লাগলো। আমার চরিত্র কেউ টান মেরে ধরে হিড় হিড় করে অনেক নিচে নামিয়ে নিয়ে গেল বলে তো মনে হলো না। বরং স্বামী বিবেকানন্দের মতো জিজ্ঞাসু মনে এর তার হুঁকোয় পরীক্ষামূলক টান মেরে দেখা হল জাত যায় কিনা। পরীক্ষার ফলাফল? দেখা গেল আমার মন পবিত্র হলে কি হবে আশেপাশের ছেলেরা খুবই হিংসুটে। দু'দিন যেতে না যেতেই তারা বললো তুই তোর সিগারেট কিনে খা! আমারটা দেব না, ইত্যাদি।
তবে কফি হাউজের নিভে আসা মরা মরা আড্ডায় সবসময় দেখতাম মাতালদের নিয়ে চুটকি বলা হতো। ডজন খানেক এইধরণের চুটকি সব টেবিলেরই হট ফেভারিট ছিল। আড্ডার মরা আঁচে ফুঁ দিতে, বহু ব্যবহৃত ক্লিশে চুটকি গুলো কিন্তু বেশ কাজে দিত! মাঝে মাঝে ওই সবকটা জোকস পুনরায় বসে শোনবার ভয়েও লোকজন তাড়াতাড়ি উঠে বসে কথা শুরু করে দিত! ছেলেরা কোথাও তিনদিনের জন্য বেড়াতে গেলে ফিরে এসে সাতাশ দিন ধরে তার গল্প শোনাত। এক দিন বলতো বেড়াতে গিয়ে কি কি দেখেছে, আর ছাব্বিশ দিন ধরে বলতো কে কে মদ খেয়ে কি কি বিচিত্র আচরণ করেছে! এইসব খিল্লির ফার্স্ট হ্যান্ড অভিজ্ঞতা থেকে আমরা মেয়েরা বঞ্চিতই রয়ে যেতাম। কারণ বাড়ি থেকে কোনোভাবেই অনুমতি পাওয়া যেত না বেড়াতে যাওয়ার। একদল ছেলের সঙ্গে চার-পাঁচ দিন টানা বেড়াতে যাওয়ার প্রসঙ্গ তোলাই যেত না বাড়িতে। আমার বাড়িতে তো একটা একদিনের পিকনিক যাওয়ার জন্য অনুমতি নিতে যা পরিশ্রম করতে হতো, যে আসল পিকনিকের দিনটায় আমার খুব ক্লান্ত লাগতো। মনে হতো গাছতলায় শুয়ে একটু বিশ্রাম নিই। বা এইসব তুশচু হাসি ঠাট্টা খাওয়া দাওয়ার প্রলোভন পরিত্যাগ করে বানপ্রস্থে চলে যাই। চিত্রকূট পাহাড়ে গিয়ে দুর্বাসা মুনির পেছনে লুকিয়ে থাকি। যে শালা আমাকে খুঁজতে আসবে সে ভস্ম হয়ে যাক বা হাফ ডজন অভিশাপের গুঁতোয় ধরাশায়ী হোক!
যাই হোক, বহু ক্লাস মিস করে, গভীর মনোযোগ সহ সব বেড়ানোর গল্প শুনে, ভালো রেজাল্টের আশা অলকানন্দার জলে ভাসিয়ে দিয়ে, আমি আমার চেনা বন্ধুদের মনে মনে কিছুটা ক্লাসিফাই করতে শুরু করি। প্রথম দল ছিলো চার আনার খেয়ে আট আনার নাটক করা টাইপ। এই দলে সবার আগে নাম ছিল বোধহয় বুম্বা আর কামুর। এরা শক্ত পানীয় দু তিন চুমুক খেয়েই, নিজ নিজ বন্ধুবৃত্তে নিজেদেরকে হলমার্ক যুক্ত 'আসল মাতাল' প্রমাণ করার জন্য মহা উৎসাহে ড্রামা আরম্ভ করতো। টিভির সব ঝুল সিরিয়ালে এবং হলে সব হিট সিনেমায় মাতালদের যা যা করতে দেখেছে সবই এক এক করে করত এরা। কিছুই বাদ যেত না।
এদের ঠিক বিপরীত মেরুতে ছিল আরেকটি দল। এরা অনভ্যস্ত শরীরে কিছু পরিমাণ অ্যালকোহল ঢোকায় মাথা ভোঁ ভোঁ করলেও কিছুতেই তা স্বীকার করত না। কিচ্ছুটি হয়নি ভাব দেখিয়ে, নির্লিপ্ত মুখে ঘরের এক কোনায় একটি চেয়ারে চুপ করে বসে থাকতো। হঠাৎ করে 'একটু আসছি' বলে বাইরে গিয়ে বমি করে আবার এসে অম্লানবদনে বসে থাকতো। 'কিছুই হয়নি'র প্রমাণ স্বরপ মাঝে মাঝে স্মিত হেসে 'পা থেকে মাথা পর্যন্ত টলমল করে, দেয়ালে দেয়াল, কার্নিশে কার্নিশ' আবৃত্তি করে শোনাতো। তিন চার লাইন আবৃত্তির পর যেখানটাতে হোঁচট খেত, সেখানে থমকে গিয়ে আবার গোড়া থেকে শুরু করতো। তারপর কেমন একটা লুপে পড়ে যেত। এটা মোটামুটি চলতেই থাকতো।
আর একদল ছিল যারা নিজেদের মস্ত বড় কনোসার ভাবতো। কোনরকম লঘু ক্রিয়া-কলাপ বা বালখিল্যের মধ্যে এরা নিজেকে জড়াতে অপছন্দ করতো। এরা এসে থেকে আকাশে নাক তুলে বসে থাকতো আর বলতো, এই তোরা যে যা পারবি খেয়ে নে। দেখি কার কতটা দম আছে। একটু পরেই অ্যামেচারের দল কাত হয়ে গেলে এরা গম্ভীর মুখে নীলকন্ঠ অবতারের মতন এসে যেখানে যা মদ পড়ে আছে সব ঢক ঢক করে অনায়াসে খেয়ে শেষ করে ফেলত। তবে এরা নিজেদের যোগ্য সম্মান পেতো না দলের কাছে। এদেরকে সবাই ব্লটিং পেপার বলে ডাকতো। অথবা স্পঞ্জ।
এইসবের বহু বছর পরে আমি বাচ্চা নিয়ে সুকল্পদের সাথে বেড়াতে গিয়ে মোনালিসার অভিজ্ঞতা শুনি। সেটা এখানে না বললেই নয়। বিয়ের আগেই সুকল্প তার প্রেসিতে পড়া মিষ্টভাষী হবু স্ত্রীকে বলে নিয়েছিল, আমি কিন্তু বেড়াতে গেলে মদ খাই। মোনালিসা বেচারা এতে দোষের কিছুই দেখতে পায়নি । সে সোনামুখ করে আচ্ছা বলেছিল। বিয়ের দু এক মাস বাদেই সুকল্প বলে চলো, বেড়াতে চলো। তারপর সুকল্প তার তিরিশজন বন্ধুর বিশাল দলে বউ নিয়ে মহাসমারোহে দীঘা ঘুরতে গেল।
সকালবেলায় বন্ধুদের নিয়ে সমুদ্রে চান করতে গেল। গেল তো গেল, আর ফেরার নাম নেই! উদ্বিগ্ন মোনালিসা তখন জনে জনে জিজ্ঞেস করতে থাকলো, হ্যাঁ গো, আমার বর কোথায়? অধিকাংশই টইটুম্বুর মদ খেয়ে ওকে পাত্তাই দিলো না। পরে, কে একজন মায়া করে আঙুল দেখিয়ে বলে দিল, ওই তো আসছে। সেদিকে তাকিয়ে মোনালিসা কিছুই দেখতে পেল না। তারপর সেদিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে দেখতে পেল সুকল্পকে চ্যাংদোলা করে আনা হচ্ছে। হুঁশ নেই। বিকেলবেলায় মোনালিসা সুকল্পকে অনেক ডাকাডাকি করেও তার ঘুম ভাঙাতে পারেনি। সন্ধ্যেবেলায় নিরুপায় মোনালিসা দলের মধ্যে এক দাদার সঙ্গে কি সব মালা ফালা কিনতে দোকানে গেছে। সেখানে আবার এক পরিচিতের সঙ্গে দেখা হয়েছে। দু এক কথার পরেই সে জুলজুল করে চেয়ে মোনালিসাকে ফিসফিস করে বলে, তোর বরের ছবি তো আমরা দেখেছি আগে। তোর সাথে আজ যাকে দেখছি এ তো তোর বর নয়! থতমত খেয়ে মোনালিসা হ্যাঁ মানে, না মানে, বর নয় ঠিক, বরের বন্ধুর সাথে... এইসব আবলান জাবলান অসংলগ্ন উত্তর দিয়ে রাগ করে হোটেলে ফিরে আসে...
কাল বছরের শেষ দিন। তাই আজ সমস্ত মদের দোকানে প্রচণ্ড ভিড়। বুড়ো বাচ্চা লেডিজ জেন্টস সবাই লাইন দিয়েছে। বছর শেষ হয়ে যাচ্ছে বলে। হয় দুঃখে নয় আনন্দে, কি জন্যে ঠিক বলতে পারবো না। হেমিংওয়ে বলতেন, "I drink to make other people more interesting." সেটাই হল কি? আমরা সকলে কি একে অপরের মুখ দেখে খুব বোর হচ্ছি? চারপাশে সবার সবাইকে খুব বিস্বাদ লাগছে? নিজের মোবাইল ঘাঁটতে ঘাঁটতেই ভাবি, সত্যি মাইরি, কি আত্মমগ্ন, যান্ত্রিক লোকজন আমরা সবাই। এর চেয়ে ভেটকি অনেক ভালো ছিলো, ইন্টারেস্টিং ছিলো! কাব্যলোকে আসছে কাল মনে হয় মোবাইল নিয়ে ঢোকা বারণ। মধ্যরাতে মুমূর্ষু তেইশ সালটিকে আলতো করে মদিরায় ভাসিয়ে দেবেন শক্তি আর ভেটকি। নতুন বছরের চিবুক ধরে আদর করে বলবেন, "থুৎনিপরে তিল তো তোমার আছে/ এখন? ও মন, নতুন দেশে যাবি?"