কাল ফরিদাবাদে দুটি দলিত শিশুর গায়ে পেট্রল ঢেলে আগুন জ্বালিয়ে জ্যান্ত পুড়িয়ে মেরেছে রাজপূতরা। রাজস্থানের রাজপূতরা এককালে মৃগয়া করতে গিয়ে হরিন, বরাহ শিকার করার সঙ্গে সঙ্গে ভিল উপজাতির মানুষদেরও "শিকার" করতো বলে শোনা যায়। সেই ক্ষাত্রতেজ বোধয় জাগ্রত হয়ে উঠেছিলো ফের, তাই দুটি শিশুকে জ্যান্ত জ্বালিয়ে দিলো। আসলে দলিতদেরই দোষ। খবরের খুটিনাটি পড়ে যা বুঝলাম যে মাস কয়েক আগে এক রাজপূতের মোবাইল ফোনটি ফসকে নর্দমায় পড়ে যায়। রাজপূতের মোবাইল নর্দমায় পড়ে গেলে দলিতদের তো ডিউটি সেটা উদ্ধার করে দেওয়া, হিন্দু শাস্ত্রমতে তো সেটাই সঠিক। দলিত উপস্থিত থাকতে রাজপূত ক্ষত্রিয় নর্দমায় হাত দেবে!! এরকম ঘটনা রাম রাজ্যে কখনো ঘটতেই পারে না। অগত্যা কয়েকজন দলিতকে "অনুরোধ" করা হয় নর্দমায় নামতে, বোধয় টাকা পয়সা দিতেও অরাজি ছিলো না তবুও দলিতদের সকলে নর্দমায় নামতে অস্বীকার করে দেয়। কি আস্পর্ধা ভাবা যায়!! দলিতদের শিক্ষা দিতে এক দল রাজপূত চড়াও হয় দলিত বস্তিতে। কিন্তু কোনো অজ্ঞাত কারণে দলিতরা মাথা নোয়াবে না ঠিক করে, রুখে দাঁড়ায় রাজপূতদের গুন্ডাবাহিনীর বিরুদ্ধে, বাড়ির মেয়েরাও হেঁসো আর বঁটি নিয়ে বেরিয়ে আসে এবং গণপিটুনিতে তিনজন রাজপূত গুন্ডার অকাল মৃত্যু ঘটে। পুলিশ এগারো জন দলিতের বিরুদ্ধে খুনের অভিযোগ দায়ের করে এবং গ্রেফতার করে। কিন্তু রাজরক্ত কি এতে শান্ত হতে পারে? তা ছাড়া আসল অপরাধের জন্যে তো কোনো শাস্তিই হলো না - নর্দমা থেকে মোবাইল তুলে দেওয়ার "অনুরোধ" উপেক্ষা করেছে দলিতরা। আর ঠিক মতো সায়েস্তা না করা গেলে যদি দিকে দিকে দলিতরা এরকম সাহসী হয়ে ওঠে? তাহলে? নাহ এ বরদাস্ত করা যায় না। তাই রাতের অন্ধকারে লুকিয়ে, দলিত বস্তিতে আক্রমন করে, শিশুদের হত্যা করে নিজের ক্ষাত্রশক্তির প্রমান দেওয়ার খুব প্রয়োজন ছিলো। এরকম আক্রমন যে হতে পারে তা দলিতরা সন্দেহ করেছিলো এবং সেই অনুযায়ী পুলিশী পাহাড়া চেয়েছিলো আগেই, দলিত বস্তির ওপর কড়া নজর রাখার কথা ছিলো পুলিশের। কিন্তু রাজপূতরা দলিতদের হাতে অপমানের বদলা নেবে আর তাতে পুলিশ বাধা দেবে, এতো বড় অনর্থ কখনো হিন্দু হৃদয় সম্রাটের রাজত্বে হতে পারে? রাম রাম!
হরিয়ানা এবং তার সংলগ্ন পশ্চিম উত্তর প্রদেশ, ও উত্তর রাজস্থানে, দলিতদের ওপর নানা রকমের অত্যাচারের ঘটনা গত এক বছর ধরে হু হু করে বেড়েছে। খুবই স্বাভাবিক, দেশব্যাপী বর্ণ হিন্দুর ক্ষমতার পুনর্জাগরণ চলছে, সেখানে এরকমই হবে। কোথাও মুসলমান তো কোথাও দলিতদের এই ক্ষমতার বলি হতে হবে। হরিয়ানায় মুসলমান ৫%-এরও কম, তাদেরকে মেরে খুব একটা শক্তিপ্রদর্শন হবে না, বরং দলিত মারলে বর্ণ হিন্দুদের বেশ এককাট্টা করা যাবে। সোনেপাতে তিন চার মাস আগেই একটা ঘটনার কথা মনে পড়ে গেলো। দলিত বস্তির কতগুলি শিশু ক্রিকেট খেলতে খেলতে বল গিয়ে পড়ে আরএসএসের জেলা দফতরের ভেতর। সেখান থেকে বল আনতে গেলে একটি শিশুকে মেরে খোঁড়া করে দেয় হিন্দু বীরেরা। শিশুটির মা বাবা ঘটনাটি নিয়ে দফতরে অভিযোগ জানাতে এলে বেদম মারা হয় তাদের, শিশুটির বাবা দুটি হাতের একাধিক জায়গায় হাঁড় ভাঙ্গে। সেখানেই থেমে থাকেনি, এরপর আরেসএসের দফতর থেকে ৪০-৫০ জনের বাহিনী দলিত বস্তিটিকে আক্রমন করে, যথেচ্ছ মারা হয় লাঠি, হকি স্টিক, শাবল দিয়ে। ১০ জনেরও বেশি দলিত হাসপাতালে ভর্তি হোন মারের চোটে। এরপর তারা পুলিশে অভিযোগ জানাতে গেলে পুলিশ তাদেরকে আরএসএসের সাথে মিমাংসা করে নিতে চাপ দেয়। বস্তির পাশেই একটি দোকানে লাগানো সিসিটিভি ক্যামেরায় আরেসএসের হনুমানদের তান্ডবের ফুটেজ থাকা সত্বেও তাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেওয়া হয়নি। পুলিশকে জিজ্ঞেস করলে তারা জানায় যে বস্তিবাসীরা আরএসএসের সাথে নিজেরাই মিটমাট করে নিয়েছে কিন্তু বস্তিবাসীরা স্পষ্ট বলে যে পুলিশের চাপে পড়েই তারা বাধ্য হয়েছেন।
এখন এরকমই চলবে, কথায় কথায় মুসলমান ও দলিতদের মারধোর খুন করা হবে। আমার তো মনে হয় খুব শীঘ্রই এই তালিকায় খৃষ্ঠান আদিবাসীরাও সামিল হবেন।
একটু ভেবে দেখুন তো যে বিজেপি ক্ষমতায় আসার আগের দশ বছর কি নিয়ে মানুষ চিন্তিত ছিলো? কি নিয়ে সংবাদপত্রগুলো খবর করতো? মনে পড়ে? চাষী আত্মহত্যা, বেসরকারিকরণ, জমি অধিগ্রহণ, খাদ্যের অধিকার, অরণ্যের অধিকার, কেন্দ্র সরকার এবং বিভিন্ন রাজ্য সরকারগুলোর চুরি জোচ্চুরি, মূল্যবৃদ্ধি এসবগুলোই আলোচ্য বিষয় ছিলো তাই না? গত এক দের বছর ধরে তার জায়গা নিয়েছে গোমাংশ, লাভ জিহাদ, ধর্মান্তকরণ, মুক্তমনাদের হত্যা।
প্রশ্ন হচ্ছে যে আগে যে বিষয়গুলো নিয়ে মাথা ঘামাতাম সেগুলো কি আর নেই?
চাষী আত্মহত্যা বন্ধ? বরং উল্টে আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। পাঞ্জাবে তুলা চাষ সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে গেছে এই বছর, আত্মহত্যার মহামারী লাগতে চলেছে আগামী কয়েকদিনের ভেতর। একই অবস্থা মহারাষ্ট্র, কর্নাটক, অন্ধ্রে।
অথবা মূল্যবৃদ্ধি? পেঁয়াজের দাম কমতে না কমতেই হু হু করে বাড়ছে ডালের দাম। সবজির দামও কমার নাম গন্ধ নেই।
ভ্রষ্টাচার? কেন্দ্র সরকারের সবে এক বছর হয়েছে, প্রথম ৫ বছর তো কংগ্রেসের চুরিও ধরা পড়েনি। কিন্তু মধ্যপ্রদেশে একের পর এক কান্ড বেরিয়ে চলেছে। ব্যাপাম কেলেঙ্কারীর পর এখন বেরোচ্ছে চাষীদের ঋণ নিয়ে বিশাল কেলেঙ্কারী।
জমি অধিগ্রহণ আইন কেন্দ্র সংসদে ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হলেও রাজ্যগুলো তাদের আইন বদলাতে শুরু করে দিয়েছে। জমি রাজ্যের আওতায় পড়ে তাই রাজ্যে আইন বদলেই জমি লুঠ করা যায়। দেশের ৭-৮ টি বড় রাজ্য বিজেপির শাসনে, তারা জমির আইন বদলে পুঁজিপতিদের সুবিধে করে দেবে। বাকি রাজ্য থেকে শিল্পপতিরা চলে যেতে থাকবে ওই রাজ্যগুলিতে আর তাই বাকি রাজ্যগুলিও এরপর বাধ্য হবে তাদের জমির আইন বদলাতে। কে কতো পুঁজিপতিদের হয়ে জমি লুঠ করতে পারে তার অসুস্থ প্রতিযোগিতা শুরু হবে রাজ্যগুলোর মধ্যে। হবে কি হয়ে গেছে।
শ্রম আইন বদলানোর পরিকল্পনা চলছে, চালু হতে চলেছে ইচ্ছে খুশি মতো "হায়ার এন্ড ফায়ার", চাকরির সুরক্ষা, শ্রমিক ইউনিয়নগুলোর ক্ষমতা সবই খর্ব হবে। তারই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেসরকারীকরণ চলছে, রেলকে বেসরকারী হাতে তুলে দেওয়ার পরিকল্পনা পাকা, লাইনে আছে স্টেট ব্যাংক এবং এলআইসি।
এবং এরই সঙ্গে জনকল্যাণমূলক প্রকল্পগুলোয় লাল বাতি জ্বালানো শুরু হয়েছে। প্রথম ইউপিএ সরকার অনেক ভুল কাজ করলেও নতুন বেশ কয়েকটি জনকল্যাণ প্রকল্প শুরু করেছিলো। যেমন ১০০ দিনের কাজ, গ্রাম সডক যোজনা, ইন্দিরা আওয়াস যোজনা, জাতীয় গ্রামীন স্বাস্থ্য মিশন প্রভৃতি। তারই সঙ্গে বাজপেয়ীর আমলে শুরু হওয়া সর্ব শিক্ষা অভিযানে বরাদ্দ টাকা বাড়ানো হয়েছিলো অনেকটাই, কেন্দ্রীয় সব বিশ্ববিদ্যালয় এবং গবেষণাগারগুলোতেও টাকা বরাদ্দ বেড়েছিলো অনেকখানি। কিন্তু এই সরকার শুরু থেকেই সব রকম জনকল্যাণ প্রকল্পে টাকা ছাঁটাই করার প্রতিজ্ঞা করেছে। আইআইটি, এনআইটি গুলোর পড়াশুনোর সমস্ত খরচ ছাত্র ছাত্রীদের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়েছে যার ফলে এসব কলেজে পড়বার খরচ ৪ বছরে ৮-১০ লক্ষ টাকায় গিয়ে দাঁড়াবে। একই সঙ্গে কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা কেন্দ্রগুলোতে কয়েকশো কোটি টাকা খরচ কমিয়েছে সরকার। এসব জায়গার সায়েন্টিস্টরা আশংকায় ভুগছেন ভবিষ্যত সম্পর্কে। আজকেই তার ওপর ঘোষণা করেছে যে নেট-জেআরএফ বাদ দিয়ে আর কোনো স্কলারশিপ সরকার দেবেনা। এর ফলে দেশের বিভিন্ন কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বহু ছাত্র ছাত্রী বিপদের মুখে, কারণ খুব কম ছাত্র ছাত্রীই জেআরএফ পান। ইউপিএ আমলে নিয়ম চালু হয়েছিলো যে নেট-জেআরএফ না থাকলেও পিএচডি ছাত্র ছাত্রীদের মাসে ৫ হাজার টাকা স্কলারশিপ দেওয়া হবে। সেই ব্যবস্থা উঠে গেলো। অনেক কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়তে এর পাশাপাশি ছিলো মেরিট কাম মিনস স্কলারশিপ, অর্থাৎ গরিব ঘরের মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের কিছু মাসোহারা দেওয়া হতো যাতে হোস্টেলে থেকে পড়তে তাদের অর্থকষ্ট না হয়। উঠে যাবে তাও। উচ্চশিক্ষায় খরচ কমিয়ে এই টাকা যদি প্রাথমিক শিক্ষায় দিতো তাহলেও একটা কথা ছিলো কিন্তু বাজপেয়ীর তৈরী সর্ব শিক্ষা অভিযানের টাকাও কমানো হচ্ছে। এমনকি হাত পড়েছে মিড ডে মিলেও! কেন্দ্র বাজেটে শিক্ষা খাতে খরচ মোট খরচের শতাংশ হিসেবেই কমিয়ে দিয়েছে সরকার, এর আগে এই কাজ আর কোনো সরকার বোধয় করেনি, এরাই প্রথম। সরকারের উদ্দেশ্য খুবই স্পষ্ট, শিক্ষাকে সরকারের ঘাড় থেকে নামিয়ে বেসরকারী হাতে তুলে দেওয়া। পাল্লা দিয়ে কমেছে স্বাস্থ্যক্ষেত্রে খরচ। গত বাজেটে স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে বরাদ্দ কমানো হয়েছে ৫ হাজার কোটি টাকারও বেশি। এর ফলে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে শিশু ও নারীর পুষ্টির পরিকল্পনাগুলো। অবস্থা এতোই শোচনীয় যে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী মানেকা গান্ধী প্রতিবাদে সরব হয়েছেন, থাকতে না পেরে। কিন্তু মানেকা হয়তো জানেন না যে এই কাজগুলো করার জন্যই এই সরকার এসেছে। পুঁজিপতিরা তাদের ভাঁড়ার খুলে টাকা ঢেলেছিলো এদের নির্বাচনী প্রচারে। দেশে উচ্চবর্ণ ও ধনী যারা (বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দুটো সমার্থক) তাদের একনায়কতন্ত্র চলছে। গণতন্ত্র বা প্রজাতন্ত্র আর এই দেশে নেই। মুশকিল হলো ভোটে গরিব মানুষের ভোটটাও প্রয়োজন হয়, শুধু তো আর শাইনিং ইন্ডিয়ানদের ভোটে জেতা যায় না। তাই কখনো ধর্ম আর কখনো জাতের নামে চলছে মেরুকরণ।
এই বিষবৃক্ষকে শেষ করতে হলে শুধুমাত্র ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বললে হবেনা, শুধুমাত্র সংবেদনশীলতার কথা বা বহুত্ববাদের কথা বললে চলবে না। কয়েকটা ডালপালা কাটলেই বিষবৃক্ষ মরে না, ফের ডালপালা গজিয়ে যায়। যদি এই বিষবৃক্ষকে শেষ করতে হয় তাহলে তার জল ও সারের যোগান আটকাতে হবে। যে পুঁজিপতি এবং ব্যবসায়ীরা এই বিষবৃক্ষকে জল ও সার দিয়ে লালন পালন করছে লড়তে হবে তাদের বিরুদ্ধে, তাদের স্বার্থের বিরুদ্ধে। ধর্মনিরপেক্ষতার লড়াই, দলিতদের লড়াইকে মেলাতে হবে জমির অধিকারের লড়াই, বেসরকারিকরণের বিরুদ্ধে লড়াই, জনকল্যাণ প্রকল্পে বরাদ্দ কমানোর বিরুদ্ধে লড়াই, ছাত্র ছাত্রীদের স্কলারশিপ কমানোর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সঙ্গে। তা যদি করা না যায় এই বিষবৃক্ষকে ধ্বংশ করা অসম্ভব।