শুক্রবার, ৩১ অক্টোবর, ২০১৪

সুরা-PUN কথা বা হিজিবিজি হযবরল - কৌশিক দত্ত

দোষ নেবেন না মাননীয়া ও মাননীয়েরা কোনো এক হেমন্ত দ্বিপ্রহরে কিঞ্চিৎ অধিকমাত্রায় সুরারস আস্বাদনের ফল এই আবোল-তাবোল বকবকানি আমার কি সব যে লেখা হযবরল ! কোনো মানে হয়? ভর দুক্কুরে হুইস্কি-সোডা আর মুরগি-মটন? না গো সাহেব এই দিশি সুরায় যা রস তার তুলনা তোমাদের বিলিতি ম্যায়খানায় নেই গা সুকুমার রায় রচনা সমগ্র (সু-রা--) একবার মাথায় চড়াও হলে মাতাল হতে কোহল সন্ধান করতে হয় না

হযবরলআরআবোল-তাবোলপ্রায় সমার্থক হিসেবে ব্যাবহার করি আমরা, অর্থহীন তালগোল পাকানো কাণ্ডকারখানা বোঝাতে সুকুমারের রচনা যে আপাত আজগুবি হলেও নিহিতার্থে অর্থহীন নয় সে কথা এখন বিদ্বজ্জনগণ স্বীকার করেন হাস্যরসের আপাত-নিরীহ অর্থহীনতার নীচে বয়ে যাওয়া ফল্গুটি গঙ্গা-যমুনার নিরমল পানির মতো সুশীতলা নয় নিতান্ত আমিষ, রাজনৈতিক এবং ক্ষেত্রবিশেষে কষ্টকর কস্টিক বিনয় মজুমদারের কবিতা থেকে ভাব চুরি করে শব্দ বদলে বলা যায়দৃশ্যত সরল, কিন্তু প্রকৃত প্রস্তাবে বক্রসুকুমার সাহিত্য এই দ্বিচারিতাই যেকোনো দ্বিচারীর মতো সুকুমারের গতায়াত অবাধ করেছে রাজা আর প্রজা, ছানা আর বুড়ো, কচি আর অতিপাকাদের সকল মুলুকে বস্তুত এই দ্বিচারিতা সূক্ষ্মতম সবকিছুর ধর্ম সূক্ষ্ম মগজাস্ত্র বা সূক্ষ্মতম পদার্থফেলু মিত্তিরের বাপের বাপ বা কোয়ান্টাম কণাউভয়েরই

না, রাজনৈতিক সুকুমারকে নিয়ে আমার নতুন কিছু বলার নেই সে বিষয়ে অনেক কথা বয়ে গেছে দামোদর নদী বেয়ে রাণাঘাট হয়ে তিব্বতের দিকে। আমি বলছি দ্বিচারী সুকুমার, তাঁর পোষা বেড়াল যার দুই খোকা বড় হয়েছিল শ্রয়ডিঙ্গার আর কামুর বাড়িতে, সেই বেড়ালের আজগুবি ঘড়ি আর ত্রিকালজ্ঞ কাকচক্ষু কাকেশ্বর কাকাবাবুর পেন্সিলের কথা। এককথায় খিচুড়ি কিম্বা হযবরল।



এই নামটা আমাকে খুব ভোগাচ্ছিল... “হযবরল”। কেন এই নাম? কেন এই পাঁচটা বর্ণ? শুধুই কি যাহা তাহা আবোল-তাবোল পাঁচফোড়নের পাঁচালি? হবেও বা! ক্ষ্যাপা লোক ইঁটের পাঁজায় বসে বাদামভাজা খেতে খেতে না গিলে না ফেলে যা মনে এসেছে নাম দিয়েছে। দিক না। তারপর একদিন পাশের বাড়ির শ্রীধরবাবুর কালিপুজোয় “কং নমো, খং নমো, গং নমো, ঘং নমো” করে পুরুতের মন্ত্রপাঠ শুনতে শুনতে আর হাসি চাপতে চাপতে হঠাৎ হং নমোয় গিয়ে থোড়া হঠকে এক হট অনুভূতি হল। ইস্কুল কলেজে ধম্মকম্ম আর ধার্মিকদের নিয়ে চিরকাল দেদার খিল্লি করার ফলে এই কথাটা আগে কখনো জানা হয়নি যে মন্ত্রপাঠের আগে প্রতিটা বর্ণকে এভাবে নমস্কার জানাতে হয়। সে যাক। কিন্তু হযবরল কেন? কেন নয় টঠডঢণ? সুকুমার আমাকে এবার বিস্তর ছোটালেন যোগ-সাঙ্খ্য-ফিজিক্সের পথে। কোনোটাই শিখতে পারিনি। কিন্তু সুকুমার না থাকলে এ মধ্যে একমাত্র ফিজিক্স ছাড়া কোনোটাই আদৌ পড়া হত না।

গপ্পোটাকে ছোটো করে বলি নামের সুলুক সন্ধান পাওয়া গেল কুণ্ডলিনি যোগে। এই পাঁচটা বর্ণ বা অক্ষর হল নিচের দিকের পাঁচটি চক্রের বীজমন্ত্র... অবরোহে এবং বর্ণবিপর্যয় সমেত। একদম মেরুদন্ডের মূল থেকে শুরু করে কন্ঠ অবধি পাঁচটা         চক্র মূলাধার, স্বাধিষ্ঠান, মণিপুর, অনাহত, বিশুদ্ধ-র বীজ অনুস্বারাক্রান্ত (দ্বিতীয়ার্থে) ল, ব, র, য, হ। নদী যেমন স্বভবতই উত্তরমুখী, অর্থাৎ প্রশ্ন থেকে উত্তরের দিকে বা মেদিনীপুর থেকে তিব্বতের দিকে যায় অজয়-দামোদর-পদ্মা-মিসিসিপির মতো; জ্ঞান-গঙ্গা তেমনি দক্ষিণা তথা নিম্নগামী। সুকুমারের মতো হিজিবিজবিজ মানুষ স্বভাবতই সাধনার সিঁড়ি উপর থেকে নীচের দিকে চড়েন। বিশুদ্ধ থেকে মূলাধার... ব্যাক টু আড়াই প্যাঁচ জিলিপি সাপের যোগনিদ্রা। আজ্ঞা চক্র ওং-এ ওঠার কোনো দায় নেই। মর্তে থাকি। দেহে থাকি। সগগে যাবার তাড়া নেই কো। বয়েস যেই চল্লিশ হবে চাকা ঘুরিয়ে নেমে আসবো কন্ঠ থেকে মূলাধারে। যোগ বলে ষটচক্র ভেদ করতে সময় লাগে ন্যূনতম পঁইয়তাল্লিশ বছর। অত সময় ছিল না সুকুমারের। সময়ের দখল কোনো বিধিগত সাধনার হাতে ছেড়ে দেবার স্পৃহাও ছিল না। সুকুমার তাই সিঁড়ি বেয়ে নীচে নামতে থাকলেন। এমন সময় আপনি যদি তাঁকে দেখেন কোনো এক খুন্ড মুহুর্তে... ধরা যাক বক্ষে (অনাহত চক্রে)... বুঝতেই পারবেন না তিনি উঠছেন না নামছেন, যতক্ষণ না তাঁকে শুধোচ্ছেন , “বাড়তি না কমতি”? হাইজেনবার্গের আনসারটেইনটি প্রিন্সিপল বলে সুকুমার ঠিক কোন চক্রে আছেন এবং কোন দিকে যাচ্ছেন, সে দুটো ব্যাপার একসাথে সঠিক বলা সম্ভব না। যাকে বলে ইলেকট্রনের গেছো দাদা চরিত্রম। সুকুমার হাইজেনবার্গ অধ্যয়ন করেছিলেন এমন কথা বললে রামছাগলে গুঁতিয়ে দেবে। এই অসামান্য ভাবনা একান্তই তাঁর, যার বালি-পাথর যুগিয়েছিল সম্ভবত সাঙ্খ্যদর্শন। সাংখ্যের অভীষ্টে পৌঁছানোর প্রায়োগিক পদ্ধতি পাতঞ্জলির যোগ, আর যোগের তান্ত্রিক রূপ কুণ্ডলিনী যোগ।

স্থান আর সময়ের ওপর সম্পূর্ণ দখলদারী যেহেতু চাই সুকুমারের, তাই তিনি ব আর র-এর অবস্থান দিলেন এদিক ওদিক করে। দুই নম্বর সুকুমারী খেল। যাতে বাক্স খোলার আগের মুহূর্ত অব্দি বলা না যায় বেড়ালটা জীবিত না মৃত... চশমালংকৃত না রুমালিভূত। হযবরল জুড়েই তিনি এই কাণ্ড করেছেন। অজ্ঞেয়তা, প্রত্যাশার ধ্বস-জনিত অস্বস্তি আর হাসির এক অনাস্বাদিতপূর্ব চানাচুর।

এই কিম্ভূত রচনায় সুকুমার রায় সময় (কাল) আর স্থান (দেশ)-কে নিয়ে এমনভাবে খেলা করেছেন যে সুকুমারী সময়কে স্থানের প্রেক্ষিত ছাড়া ভাবা যায় না, তাঁর দেশকে ছোঁয়া যায় না কালের হাত ধার না করে। দেশকাল যেন একটা যৌগ সত্তা হয়ে ওঠে। স্থানের প্রেক্ষিতে কালের এরকম সংজ্ঞা ততদিনে মাত্র দুজন ভেবছিলেন। কপিল নামে পরিচিত সাংখ্যকার এক অনার্য প্রাক-বৈদিক দার্শনিক, আর আইনস্টাইন নামে এক খ্যাপাটে ইহুদি বেহালাবাদক যিনি মাঝে মাঝে অঙ্ক করতেন আর প্রশ্ন করতেন “সাত দুগুনে কত হয়?” হাতে পেন্সিল নিয়ে চোদ্দর চার নামানোর সঠিক মুহূর্তের অপেক্ষায় এক ক্ষ্যাপা বিজ্ঞানী আর মুহূর্তকে ক্ষুদ্রতম কণার ক্ষুদ্রতম দূরত্ব অতিক্রম করার জন্য প্রয়োজনীয় কাল হিসেবে চিহ্নীত করা এক নির্জন ভাবুক... তাঁদের মাঝখানে গড়াগড়ি দিয়ে হাসছেন হিজিবিজবিজ। 

 ৩০ অক্টবর ২০১৪


বৃহস্পতিবার, ৩০ অক্টোবর, ২০১৪

ছোটলোক ~ প্রকল্প ভট্টাচার্য়্য

টেবিলে বসতে না বসতেই মি: রায়ের ফোন -
' সন্দীপ, একবার আসতে পারবে ?'
ছোটো অফিস, আর মি: রায় হলেন হেড অফিসের লোক, মানে মালিকের ঘরের লোক| তাই ডিপার্টমেন্ট আলাদা হলেও সন্দীপ তাঁকে একটু খাতির করতে বাধ্য | যদিও মনে মনে গালাগালই দেয়, এই কাজ গুছিয়ে নেওয়া, গায়ে - পড়া আত্মীয়তা, সব কিছুর মধ্যেই একটা ছোটোলোকোমি তার চোখে পড়ে | পারতপক্ষে উনি কারোকেই আপনি - আগ্গে করেন না, এই ডাকের মধ্যেও আন্তরিকতা ছাপিয়ে প্রছন্ন অপমান উঁকি দেয় বইকি !

কিন্তু কী আর করা, ছোটো চাকরির দায় | অগত্যা হাতের সমস্ত কাজ মুলতুবি রেখে সে মি: রায়ের কেবিনে গেল |
- ' আর বোলো না, ছোটোলোক একেবারে | অডিটিং- এর এত ঝামেলা- একটা লাইসেন্স আটকে দিয়েছে ব্যাটারা এদিকে | যাক্গে কাজের কথাটা বলি | এখুনি আমার গাড়িটা নিয়ে ব্যাঙ্কে যাও, পাঁচ লাখ টাকা ক্যাশ রেডি রাখতে হবে এখনই !
- ' মানে, আমি ? আসলে কয়েকটা জরুরি কাজ ছিল-'
- ' আরে সব পরে হবে, এ হল বড়ো সাহেবের হুকুম | আমি ব্যাঙ্কে ফোন করে ক্যাশ রেডি রাখতে বলেছি, শুধু যাবে আর আসবে | রমেশ !'
রমেশ ওনার ড্রাইভার | তাকে ডাকা মানেই সন্দীপের আর কোনো কথাই উনি শুনবেন না | অগত্যা সন্দীপ বিড়বিড় করে গালাগাল দিতে দিতে বেরোল |
ব্যাঙ্কে সত্যিই ভিড় নেই, আর টাকাটাও রেডিই ছিল |
চেক জমা দিতেই ক্যাশিয়ার বললেন - " স্যার, হান্ড্রেডে প্রবলেম নেই তো ?"
সর্বনাশ ! একশো টাকার বান্ডিলে পাঁচ লাখ মানে তো থলি করে নিয়ে যেতে হবে ! না:, আজ দিনটাই খারাপ সন্দীপের |
- ' কোনো চিন্তা নেই স্যার, এই যে আমি বান্ডিলগুলো খবরের কাগজে মুড়ে দিচ্ছি |' ক্যাশিয়ার দেঁতো হাসল | তবে স্যার গাড়ি থাকলেও একটু সাবধানে ' বুঝলেন তো, জায়গাটা ছোটোলোকদের কিনা !'
বগলে বড়ো বড়ো দুটো কাগজের বান্ডিলে টাকা নিয়ে সন্দীপ কোনো মতে বেরিয়ে গাড়িতে উঠতে যাবে, রাস্তার দুটো ছেলে তাকে ধরল | ' বাবু, পয়সা !'
সর্বনাশ ! সন্দীপ পা চালাল | রমেশ গাড়িটা পার্ক করেছে রাস্তার ওধারে আর এখন পেছনে জুটেছে এই দুটো আপদ | সন্দীপ যত তাড়াতাড়ি পারল এগোতে লাগল, কিন্তু ছেলে দুটোও ছুটতে লাগল তার পেছনে -
" বাবু, পয়সা বাবু !"
প্রাণপণে রাস্তা পেরিয়ে গাড়ির কাছে পৌঁছতেই ছেলে দুটো সন্দীপকে ধরে ফেলল | রমেশকে দেখে সাহস পেয়ে সন্দীপ ঘুরে দাড়াল ওঁদের টেনে একটা চড় মারবে বলে, কিন্তু ঘুরেই সে থমকে গেল, তোলা হাতটা তোলাই রয়ে গেল |

' বাবু আপনার পয়সা পড়ে গেছিল !' হাঁপাতে হাঁপাতে ছেলে দুটো তাকে কথাটা বলে আর তার হাতে কিছু একটা গুঁজে দিয়েই হাসিমুখে দৌড়ে পালাল |

হতভম্ব সন্দীপ একশো টাকার বান্ডিলটা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়েই রইল | কোন ফাঁকে কাগজের মোড়কের ফাঁক দিয়ে পড়ে গেছিল বান্ডিলটা !!

শুক্রবার, ২৪ অক্টোবর, ২০১৪

la guerre n'est pas finie ~ অবিন দত্তগুপ্ত

কামদুনির মেয়েটার পরিবারকে টাকায় কিনেছিলেন উনি । যাদবপুরের মেয়েটির বাবাকেও হাটতে বাধ্য করা হয়েছিল নোংরা মিছিলে । আমার রাজ্যের ফ্যাসিস্টের এমন অনেক , কুৎসিত গল্প আমার জানা । 

সেই পুতিগন্ধময় পরিবেশ থেকে উদ্ধার করবেন এক ৫৬ ইঞ্চি বুকের মালিক লৌহ পুরুষ ,যিনি ভালো দিন আনবেন ... বাজারি বাতাসে, বোকা বাক্সে আর সাইনিং হৃদয়-এ এমনি স্বপ্নের আনাগোনা । তা, কৃষক মৃত্যু কমলো না , ডিজেলের দাম কমলো না ... কিন্তু উনি আমেরিকায় দুর্দান্ত বক্তিমে দিলেন । সাইনিং মধ্যবিত্ত অমনি আহা বাহা রবে এফ বিতে এবং অন্যত্র লাফ মারল । উনি ঝাঁটা হাতে ক্যামেরার সামনে দাড়িয়ে, ' দাঁড়িয়ে ঝাঁটাও ' প্রতিযোগিতার উদ্বোধন করলে্ন ... পোশাকি নাম, স্বচ্ছ ভারত । অমনি ( বস্তি ফেসিং ফ্ল্যাটে অনিহা )সাইনিং তুমি , ভ্যাকুয়াম ক্লিনার হাতে , খাট ছেড়ে মেঝেতে নামলে( মিনতির মা, একদিন ছুটি পেল ) । 

অথচ , রামের নব অবতারের আসল ইচ্ছা অনুধাবন করতে পেরেছিল ,একমাত্র তার বিশ্বস্ত বানর সেনা । স্বচ্ছ ভারত, অর্থাৎ হিন্দু ভারত , নোংরা বিধর্মী মুক্ত ভারত । এই স্বচ্ছতার অভিযানে ,সামনে থেকে নেতৃত্ব দিলেন এবং দিচ্ছেন হনুমানস্বামী । তো প্রথমত ওনারা বললেন , " এই যে এতো সংখ্যক বিধর্মী , তার মূল কারণ ভালবাসা । এরা বেছে বেছে হিন্দু মেয়েদের সাথে ,প্রেম করে ,শুয়ে পড়ে এবং যে বাচ্চা জন্মায় সে বাপের ধর্ম নেয় ।" ... অতএব, এ একপ্রকারের জিহাদ্‌ , হনুমানস্বামী নাম দিলেন লাভ্‌ জিহাদ । নাম তো দিলেন, এবার প্রমাণ করতে হয় । রামকেও প্রমাণ করতে হয়েছিল রাবণ শয়তান ,তার জন্য শূর্পণখার নাক কাটতেও ( ইজ্জত কাড়তেও ) ,উনি পিছপা হন নি । রাক্ষস খারাপ প্রমাণ করতে পারলে ,রাক্ষস মারতে সুবিধা ,হিউম্যান রাইটস্‌ প্রবলেম করবে না । অতএব লাভ জিহাদের একটা ঘটনা , মার্কেটে উপস্থিত করা চাই ।

মিরাট সম্পর্কে আমার ধারণা , কন্সপিরেসি কেস অব্দি সীমাবদ্ধ । তবে সেই কন্সপিরেসি , যা কিনা আদতে , মুক্তিকামী মানুষকে কাছাকাছি এনেছিল ,এবং সাম্প্রতিক কন্সপিরেসিতে আসমান-জমিন ফারাক্‌ । একটি হিন্দু মেয়ে , একটি বিধর্মী ছেলেকে ভালবেসে পালিয়ে যায় । এরম আমরা আগেও দেখেছি , বিভিন্ন হিন্দি সিনেমায় । গানও আছে " হামনে ঘর ছোড়া হে , রাস্‌মো ক তোরা হে " ...সে যাই হোক । তা বানরসেনা জানান দিল ,মেয়েটিকে জোর করে একটি বিধর্মী অস্বচ্ছ পুরুষ ধর্ষণ করেছে । মেয়েটির বাবা-মা ও একি কথা বলল । হঠাতি, প্রেমে সাহসী মেয়েটি , বাঘিনীর মত উঠে দাড়িয়ে জানালো ,সে স্বেচ্ছায় ছেলেটির হাত ধরেছে ,এবং তার বাপ-মাকে ২৫,০০০ টাকায় কিনেছে , বানর সর্দার । 

এরপর-ও আপনি , সুদিনের স্বপ্নে বিভোর থাকবেন । ধর্মের নামে মানুষ কাটা হলেও , আপনার 'মা' সিরিয়াল বিঘ্নিত হবে না । এসব জানা কথা । কিন্তু লিখি , যদি কারো চোখে পড়ে যায় । ভালোবাসাকে বুঝলেন , সমস্ত ফ্যাসিস্ট ভয় পায় । কারণ ভালোবাসা , যে কোন ক্ষমতার মূল ভিত্তিকে চ্যালেঞ্জ করে । আমরা বাম্পন্থিরা , তাই মানুষে মানুষে ভালবাসার কথা বলি । হিন্দু-মুসলমানে , দলিতে-উচুজাতে , নারীতে-পুরুষে , পুরুষে-পুরুষে, নারীতে-নারীতে । ইচ্ছের কথা বলি ।বলি এই দক্ষিনপন্থার বন্ধ ভেঙ্গে , নতুন সূর্যের ভোরের কথা ...

la guerre n'est pas finie 
( The War is not over )

রবিবার, ১২ অক্টোবর, ২০১৪

ঘটি - সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়

এই কয়েক দিন আগের কথা। সাগরপারে থাকা এক বন্ধু বিজয়া করতে ফোন করেছিলো। কথায় কথায় পুরোনো স্মৃতি ফিরে ফিরে এলো। চল্লিশে পা রাখলে এসব স্মৃতিচারন বেড়ে যায় একটু। ডেকার্স লেনের চিত্তর হোটেল থেকে সাবিরের রেজালা, ব্রাজিল, মোহনবাগান, সিপিএম, পুরোনো বান্ধবীরা, ভাঙ্গা প্রেম, পূজাসংখ্যার পড়তে থাকা মান, ছানাপোনার কির্তি-কলাপ এসব পেরিয়ে কথার তোড় যখন একটু কমেছে, তখন বর্তমানে ফিরলাম। কি করছি, কি করছিনা এই সব। বন্ধু আমাদের পাঁচফোড়নের নিয়মিত পাঠক। তবে লেখালিখি তার ধাতে নেই। বেজায় কুঁড়ে। জানি এ লেখাও সে পড়বে, পড়ে তার “কুঁড়ে” খেতাবের জন্যে আমাকে মনে মনে একটু খিস্তিও দেবে, কিন্তু ওই যে, কুঁড়ের বেহদ্দ, তাই এসব নিয়ে কিস্যু লিখবে না। বন্ধু ১০০% ঘটি, কাজেই এটাই তার স্বভাব। মনে মনে যতই খারাপ লাগুক, মুখ ফুটে সেটা বলতে তার আলিস্যি। কথায় কথায় বললো পাঁচফোড়নে নাকি বাঙালদের নিয়ে প্রচুর লেখা বেরচ্ছে, আর সেগুলো বেশ মুখরোচক ও সুখপাঠ্য। কিন্তু ঘটিদের নিয়ে কোনো লেখা টেখা কেন নেই, সেটা তার মাথায় ঢোকেনা। এর পর, স্বগতোক্তি করলো – জয়ঢাক তো আছে, কিন্তু সেটা পেটায় কে? ওই যে , আর পাঁচজন ঘটির মতো আমাদের দুজনের ও নিজেদের নিয়ে বলতে গেলে এন্তার আলিস্যি। কিন্তু অন্যদিকে, বৈঠকি আসরে বসিয়ে দিন, ঘটিদের মুখে তুবড়ি ছুটবে। তড়বড় করে কথা বলাটা আসেনা ঠিক, ঘটিদের মধ্যে একটু বৈঠকি মেজাজ সব সময়েই থাকে। ধিরে সুস্থে তারিয়ে তারিয়ে গপ্প বলা হবে। সে গপ্প আবার পরিবেশিত হবে নিজস্ব ধারায় আর বিস্তর রসিকতার সঙ্গে। সে রসিকতার রস গ্রহন করতে আবার মাঝে মাঝে একটু সময় লাগতে পারে। এই যেমন আমার এক দাদা-স্থানীয়, তাকিয়ায় হেলান দিয়ে বলতে শুরু করলেন বাড়ির রান্নাবান্না নিয়ে। ওনার অর্ধাঙ্গিনি বাঙাল, উচ্চশিক্ষিতা ও শিক্ষিকা। দাদা বললেন বাঙালরা ভালো রান্না করে। তারপর একটু থেমে বললেন, অন্ততঃ সেরকমই বলে। ব্যাস হয়ে গেল। কিন্তু এ রসিকতা বুঝতে একটু সময় তো লাগেই। তাই ঘটিদের সঙ্গে আড্ডা দিতে গেলে, সময় বড় প্রয়োজন। আর ওই যে, বৈঠকি মেজাজ, সেটা ছাড়া ঘটিদের মুখ খোলানো খুব কঠিন। হ্যাঁ হুঁ করবেন তাঁরা, প্রয়োজনে দু চারটে প্রয়োজনীয় তথ্যও দেবেন। সেটুকুই। আড্ডা জমবে না। অথচ এ লোকটাই ভাইফোঁটায় খাওয়া দাওয়ার পর নাকি এক টানা ১১ ঘন্টা টানা আড্ডা দিয়েছিলো।

ঘটিদের কিছু কিছু শব্দ ও তার প্রয়োগ নিজস্বতা রাখে। এই যেমন ধরুন “সর্বনাশ”। মুজতবা আলীর মত মানুষও ঘটিদের সর্বনাশ বলা নিয়ে এক পাতা লিখে গেছেন। প্রচণ্ড ভিড়ে ঠাসা একখানা বাস এসে দাঁড়ালো বাসস্ট্যান্ডে। ঘটি দেখলেন বাসের দিকে। অস্ফুটে বললেন “সর্বনাশ”। শীতের রাত, খুব গুটিশুটি মেরে কম্বলের তলায় ঢুকে ঘটি দেখলেন ঘরের আলো নেভানো হয়নি। আবার কম্বলের তলা থেকে বেরিয়ে আলো নেভাতে যেতে হবে। “সর্বনাশ”।  আজকাল ঘটিদের ভাষাগত নিজস্বতা অনেকটাই হারিয়ে গেছে। খব সহজেই নতুন প্রজন্মের ছেলে মেয়েদের বলতে শুনি “আড় কত দারিয়ে থাকবো?”। সব কিছুই বদলায়, কাজেই ভাষাও বদলাবে। উচ্চারন বদলাবে। ভুল উচ্চারন হলেও সেই ভুলটা বেশিরভাগ লোকে বললে, সেটাই চলবে। আমার এ নিয়ে কোনো আফশোস নেই। তবে, যেটা নিয়ে অল্প হলেও আছে, সেটা হলো, ঘটিদের জেলায় জেলায় নিজস্ব কিছু প্রবাদ প্রবচন ও বাক্যরীতি আছে, যে গুলো এখন অনেকটাই শুনিনা। ভাষা পাল্টাবে, কিন্তু ওই যে “স্বভাব যায় না ম’লে”। নিজেদের ব্যাপারে যতই মুখচোরা হোন না কেন, এক থালা মিষ্টির সামনে তাঁরা পৃথিবীর অন্য যেকোনো জনগোষ্ঠির থেকে বেশি মুখ খোলা। বিশ্বাস করুন, ১০০% খাঁটি ঘটি কখনো, কোনো কালে, মিষ্টি গুনে খাননি। আশু মুখুজ্যের গোঁফের দিব্যি। যদি কেউ সেটা করে থাকেন, খোঁজ নিয়ে দেখুন, ব্যাটার চতুর্দশ পুরুষে নির্ঘাত ভেজাল আছে। মুজতবা আলী যেমন দেখেছিলেন, খাঁটি পাঠান কখনো আটক্‌ (সিন্ধু নদ) পেরোয় না, আর রমজান খান পেরিয়েছিলো বলে খোঁজ নিয়ে জানা গিয়েছিলো, রমজান খানের ঠাকুমা পাঞ্জাবী। আমার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু (সে আবার নির্ভেজাল বাঙাল) শুনে খুব অবাক হয়ে গিয়েছিলো, রোজ রাতে মিষ্টি আনা হয় বাড়িতে। না হলে খাওয়াই হবে না। সে বেচারা রাতে আয়েস করে ভাত মাছ খায়। তার সঙ্গে ক্ষিরকদম, লবঙ্গলতিকা, পান্তুয়া বা কেশরভোগ চলেনা। আর ঘটিদের, এই সব ছাড়া, রাতের খাওয়া অসম্পুর্ন। অর্থনৈতিক অবস্থা ভেদে বোঁদে, খেজুর গুড় এমনকি ভেলিগুড় পর্যন্ত চলতে দেখেছি। কিন্তু মিষ্টি ছাড়া রাতের খাওয়া কিছুতেই সম্ভব নয়। বাইরের দেশে থাকার সময় আমি এক শিশি জ্যাম কিনে রাখতাম। খাবার শেষে এক চামচ মুখে দিলে, তবে খাওয়া শেষ হতো।

খাওয়া দাওয়ার কথা যখন উঠলোই, তখন বলি, ঘটিদের লুচি প্রেম অস্বাভাবিক ধরনের বেশি। আমার পৈতের পর আমার ঠাকুমা এক বছর নিরামিষ খাবার নিদান নাকচ করে দিয়েছিলেন। কিন্তু আমার মা অতি কষ্টে একটি মাত্র নিয়ম আমাকে মানাতে পেরেছিলেন, সেটা হলো, ভাত খাবার সময় কথা বলা চলবে না। কথা বলে ফেললে, আর ভাত খাওয়া যাবে না। ভাত খাওয়া যাবেনা বটে, কিন্তু অন্য কিছু খেতে বাধা নেই। কাজেই, আমি একটি বছর এই নিয়মের নিদারুন ফায়দা তুলেছিলাম। আমার মত মুখচোরা লাজুক ছেলেও অধিকাংশ দিন স্কুলে যাবার সময় কথা বলে ফেলত, আর ফল স্বরুপ একখানা চিরকুট পাওয়া যেত মায়ের থেকে। স্কুলের ঠিক পাশেই আমার কাকু-কাকিমা থাকতো। আমি সেখানে কাকিমা কে চিরকুট দিয়ে চলে যেতাম ক্লাসে। টিফিনের সময় কাকিমা বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকতো। আমাকে স্কুল থেকে বেরোতে দেখলেই কড়া চড়তো, আর আমি খান কুড়ি-বাইস লুচি খেয়ে স্কুলে ফিরতাম। প্রতি মাসে ভক্তি ভরে একাদশী ও পালন করেছি। কারন সেদিন ও লুচি খাওয়ার দিন। দু বেলা। এখনো প্রতি বছর, জন্মাষ্টমী, দুর্গাপূজোর অষ্টমী এসব দিনে নিয়ম করে দু বেলা লুচি, যাকে ঘটি ভাষায় আমরা বলি ময়দা খাওয়া। কলেজে পড়ার সময় এক বছর আমার এক বন্ধু অষ্টমীর দিন কবজি ডুবিয়ে পাঁঠার মাংস খাবার আমন্ত্রন জানিয়েছিলো। বিনীত ভাবে প্রত্যাখ্যান করেছিলাম। আমার কাছে, অষ্টমীর ময়দার চেয়ে সুস্বাদু খাবার পৃথিবীতে নেই। বন্ধু কে বলেছিলাম, মাংস তো নবমী তে খাবোই। সঙ্গে মিঠে মিঠে ঝুরঝুরে সুগন্ধী পোলাও।

ঘটিদের সমালোচনা বড় অদ্ভুত। ধরুন আপনি একটা ছবি এঁকেছেন, এবং নিজেরই পছন্দ হয়নি ছবিটা। খাশ ঘটি ছবি দেখে বললেন – “বাঃ বেশ এঁকেছ তো, দিব্যি হয়েছে, চালিয়ে যাও!“। আপনি প্রশংসা শুনে বিগলিত হলেন। কিন্তু না। এখানেই শেষ নয়। আপনার পাশে আরো একজন ছবি এঁকেছে, এবং আপনি স্পস্ট দেখতে পাচ্ছেন, সেটা আপনার চেয়ে অনেকটা ভালো এঁকেছে। ঘটি ওটার সামনে দাঁড়িয়ে বলতে শুরু করলেন – “সর্বনাশ, করেছ কি হে? এ তো সাংঘাতিক কান্ড, তোফা হয়েছে ছবিটা!!!”। এবারে আপনি বুঝলেন প্রসংসা কাকে বলে। খাশ ঘটি, মুখের ওপর কখনো চটকরে কোন কিছু কে খারাপ বলবে না। ওটা আপনাকে বুঝে নিতে হবে। বাঙালদের কথা একদম সোজাসুজি, স্পস্ট সরল। তারা মুখের ওপর বলে দেয়। ঘটিদের কথায় কতগুলো স্তর আছে। কারোর সরাসরি নিন্দে করার চলন ঘটিদের মধ্যে নেই বলবো না, তবে বেশ কম। আপনাকে তার প্রশংসার ধরন দেখে ব্যাপারটা বুঝে নিতে হবে। শেষে ফিরি আর এক বন্ধুর কথায়। এই বন্ধু খাশ উত্তর কলকাতার ঘটি, বেঙ্গালুরুতে একখানি বহুজাতীক সংস্থায় কর্মরত। আমি তখন বেঙ্গালুরুতে থাকি। বেশ কয়েকজন বন্ধু মিলে মাঝে মাঝে কাছেই এক বাঙালি রেস্টুরেন্টে খেতে যেতাম। সে খাওয়া চলতো ঘন্টা দেড়েক। জমাটি আড্ডা। আর অদ্ভুত ভাবে, সে আড্ডায় সবাই ছিলো ঘটি। এরকম নিছক ঘটি আড্ডা আর একবার বিদেশে পেয়েছিলাম, সানফ্রান্সিকোতে। আমাদের সবার সঙ্গে এই বন্ধুটি তারিয়ে তারিয়ে খেতো, আর মাঝে আফসোস করতো, রাত্রে বাড়িতে তাকে আবার অখাদ্য-কুখাদ্য খেতে হবে। আমি একদিন বলেছিলাম – তোমার বাড়ি তো পাশের পাড়ায়, এখান থেকে নিয়ে গেলেই পারো মাঝে মধ্যে, তাহলে আর অখাদ্য খেতে হয় না। এক গাল হেসে অমিত দত্ত জবাব দিয়েছিলো, ভাইরে, ঘটিরা কবে থেকে একা একা সুখাদ্য খেতে শুরু করলো?


অনেক কিছুর পারেনা ঘটিরা। একা একা কোন কিছু উপভোগ করতে একেবারেই পারেনা। ঘটিত্বের অন্যতম মাপকাঠি, গুষ্টিসুখ উপভোগ করা। 

শুক্রবার, ১০ অক্টোবর, ২০১৪

মানুষ বাঁধার গল্প ~ অবিন দত্তগুপ্ত

তখন আমার ৬-৭...ধর্মে হিন্দু (ওই শিশুদের যেমন হয় ,বার্থ সার্টিফিকেট মতে)

আমার যুদ্ধের গল্প, যুদ্ধের সিনেমা, যুদ্ধের সিরিয়াল হেব্বি লাগতো । তখন প্রিয় ছিল টিপু সুলতান আর দি গ্রেট মারাঠাস্‌ । আমি চাইতাম পানিপতের যুদ্ধে মারাঠারা জিতুক ,চাইতাম টিপু যেন একটাও যুদ্ধে না হারে । মোদ্দা কথা , টিপু - মারাঠা ইত্যাদিরা তখন আমার কাছে ইস্ট-বেঙ্গলের মত, ওরা জেতা মানে আমার টিম জেতা । যে বছরের কথা বলছি , সে বছর রথের সময় ,আমি একটা তিনতলা(মানে তিন্টে বক্স) রথ টেনেছিলাম। মা দারুণ সাজিয়ে দিয়েছিল ।তারপরের বছর থেকে আর কেন জানি না, রথ টানা হয়নি । যাক সে কথা,পয়েন্টে ফিরি । সালটা ৯২ ... টি ভি তে দেখতাম ,একটা শেয়ালের মত দেখতে বয়স্ক লোক , রথে চড়ে এদিক ওদিক ঘুড়ছে । কয়েক হাজার মানুষ দৌড়চ্ছে তার পিছনে । আমার বেশ লাগত । মহাভারতের , শকুনির মত অনেকটা । দাদুকে দেখতাম ,ওই লোকটাকে দেখলেই ভুরু কুঁচকে হাতের কাগজের দিকে চোখ সরাত । প্রসঙ্গত ,বলে রাখি আমার দাদুর দিনের বেশীর ভাগ সময়টাই ,গনশক্তি নামে একটা কাগজ পড়ে কাটত ।

তো হঠাত-ই একদিন ,সবাই টি ভির সামনে বসে, উদবিগ্ন । আমি ঘরে ঢুকতে গেলেই ,বাবা বকা দিল...পাশের ঘরে যাওয়ার হুকুম হল । আমি বরাবরের অবাধ্য ,মায়ের আঁচলের তলা দিয়ে টি ভির পর্দায় চোখ রাখলাম । স্ক্রিন জুড়ে দেখলাম , কখনো আগুন জ্বলছে ,কখনো তলোয়ার নিয়ে মানুষ ছুটছে , কারুর মাথায় টুপি,কারুর কপালে তিলক । এমনটা অবশ্য আমি আগেও দেখেছি , টিপু সুলতানে অথবা মারাঠায় । মাকে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলাম "এটা কি যুদ্ধ হচ্ছে মা ? " মা ঘাড় নাড়ল ।
"কার কার ?"
"হিন্দু-মুসলিম"।
বার্থ সার্টিফিকেটে হিন্দু ৭ বছরের আমি ,মুহূর্তে দল বেছে নিলাম "কে জিতছে মা ? হিন্দুরা ??"
মা আমার মাথায় আলতো হাত রেখে জানিয়েছিল "মানুষ হারছে ।" মানে বুঝিনি ।
টিভিতে এই যুদ্ধ চলছে যখন ,তখনো দাদু গনশক্তি পড়ছে । আমি জানতাম ,দাদু সব শোনে ।

একঘণ্টা পর , একটা পরিচিত মুখ এলো পর্দায় । দাদুর মতোই চশমা । এই লোকটাকে সবাই হেব্বি ভালবাসত । নাকের ফুটো গুলো আমার একটু বড় বড় লাগতো । কিন্তু লোকটাকে সবাই ভালবাসত ,অতএব আমিও বাসতাম । ওই দাদুটা কে ,জানতে চাওয়ায় ,আমার দাদু বলেছিল ,আমার নেতা, জ্যোতি বোস । সে যাই হোক, উনি আধ্‌ ঘন্টা কি সব বললেন ,বাবা-দাদু গোগ্রাসে গিলল । শেষ হতেই , "কাল তাড়াতাড়ি বেরতে হবে ,খেতে দাও বলে বাবা আমারি মতো লম্ফ-ঝম্প আরম্ভ করল । দাদুর মুখ তখন আবারো ,কাগজে-নিচু ।

পরদিন যখন ঘুম থেকে উঠলাম ,শুনলাম স্কুল বন্ধ । দাদুর খাটে লাফিয়ে উঠে, টি ভি তে চোখ রাখলাম , যুদ্ধ দেখব বলে। বাবা সকাল থেকে বাড়ি ছিল না । বাবা কোথায় গেছে জানতে চাইলে, মা টি ভির দিকে আঙুল তুলে বলল "ওখানে" ।, স্ক্রিনে দেখলাম হাজারে হাজারে লোক হাতে হাত ধরে দাড়িয়ে আছে , কারো মাথায় টুপি ,কারুর পাগড়ি ,কেউ বা খালি মাথায়। কত্ত রং । আমি মাকে জিজ্ঞেস করলাম "বাবা ওখানে কি করতে গেছে, এটা কি হচ্ছে "।
"মানুষ মানুষ কে বাধছে"
"কি ভাবে ?"
"হাত দিয়ে"
"আর বাবা ? "
"দ্যাখ কার হাত ধরে ,দাড়িয়ে আছে " ।
"কিন্তু যুদ্ধ ... যুদ্ধটার কি হল ? এখন কে জিতছে ? "

হাতের গণশক্তি নামিয়ে, আমায় কোলে তুলে , একগাল হেসে দাদু বলল " মানুষ "

--------------------------------------------------------------------------------------------- আমরা কি আরেকবার মানুষকে মানুষের সাথে বাঁধতে পারি না ??? আমার কমরেড যারা ,শেষের প্রশ্নটা তাদের জন্য ।

মঙ্গলবার, ৭ অক্টোবর, ২০১৪

পুজো ও বাঙাল ঘটির ব্যাপার স্যাপার ~ সৌমিক দাশগুপ্ত

জন্মসূত্রে 'বাঘ' হবার দরুণ, বেশ ছোটবেলা থেকেই ব্যাপারটা উপভোগ করে আসছি। বাবা অইলো গিয়া এক্কেরে বরিশাইল্যা কাঠ বাঙাল, আর মা নেহাতই হুগলী জেলার ঘটির মাইয়া। তা পুজো আচ্চার দিনে, আমাদের বাড়ীর নিয়ম ছিল, নিরামিষ আবার কি ? লক্ষ্মীপুজো হোক, বা দুর্গাপুজোর অষ্টমী বা সরস্বতী পুজো, নন ভেজ মাস্ট। আমার ঠাকুমা নাকি মা কে বলতো, "পুজার দিনে, এয়োস্ত্রীগো নিরামিষ খাইতে নাই মনি, ঘরে কিছু না থাকলেও, চাড্ডি পেঁয়াজ কুচাইয়া লইবো গিয়া।" 

তারপর ঠাকুমা তো চলে গেলেন, মা জমিয়ে রান্নাঘরে ঘটি রুল চালু করে দিল। অষ্টমীতে "ময়দা খাওয়া", সরস্বতী পুজোয় খিচুড়ি, লক্ষ্মীপুজোতে (যদিও এটা ঘটিদের নেই আদৌ) পোলাও। আমিও ছোটবেলা থেকে ঘটি খাওয়া দাওয়াতে অভ্যস্ত হয়ে গেলাম। 

তখন ক্লাস এইটে পড়ি। আমার পিসি একদিন ঘরে এসে তুমুল বাওয়াল দিল। এ কি, তোরা ছেলেটাকে অষ্টমীর দিন নিরামিষ খাওয়াস, ঘোর অন্যায়। মানবসভ্যতা বিপন্ন হয়ে যেতে পারে। এমনিতেই ননদ এবং বৌদির সম্পর্ক একটু অম্লমধুর হয় সকলেরই জানা। সেদিন থেকেই, আমার বাবা সাপোর্ট পেয়ে কিরকম হিংস্র হয়ে গেল। তুমি শালা ঘটির মেয়ে, কি করে বুঝবে আমাদের ব্যাপার স্যাপার, অতএব, পরের অষ্টমীতেই মাছ লাও। মা একটু গাঁইগুঁই করলেও, শ্বশুর বাড়ীর রুল ভেবে মেনেই নিল আবার। 

সরস্বতীই একমাত্র অনেক দিন অবধি নিরামিষে বেঁচে ছিলেন। 

তারপর কালের নিয়মে আমার বিয়ে হল, আমার গিন্নী যিনি এলেন, তিনিও ঘটি, এবং উত্তরপ্রদেশীয় প্রবাসী। ইনি যদিও "মাছ ছাড়া ভাত মুখে তুলতে পারেন না", কিন্তু পুজো ইত্যাদির সময় "আঁশ খাবে ? তওবা তওবা, গন্ধি বাত" । ঘরের সমস্ত নারীশক্তি যদি বিপক্ষ শিবিরের হয়, তাহলে সসেমিরা অবস্থা তো হবেই। 

এতদসত্ত্বেও বেঁচে গেলাম। তৃতীয় নারীর আবির্ভাবে। যখন আড়াই বছর বয়স, তখন থেকেই নিদারুণ শাক্ত হয়ে উঠলো। চার বছর বয়সে, শ্রাদ্ধবাড়ীতে নেমন্তন্ন খেতে গিয়ে হুঙ্কার দিয়েছিল, "চিকেন কিধর হ্যায়"। অতএব, আমি বাঁচলাম, আমার বাবা বাঁচল, অষ্টমী বাঁচল, সরস্বতীর কপালে জোড়া ইলিশ জুটল, এমন কি আগামী কাল লক্ষ্মী পুজোর দিনও সকালে জমিয়ে ইলিশ মাছের আয়োজন হয়েছে, রাতে যদিও আমি বেশ ভক্তিভরে ভোগের খিচুড়ী আর নারকেল নাড়ু খাবো। 

কে জানে, সেই বুড়ীই ফিরে এসেছে কিনা। কিচ্ছু বলা যায় না।