বিরাট বোম্বে শহরে বাল কেশব থ্যাকারে নামে এক সাদামাটা তরুণ আর পাঁচজন নিম্নবিত্ত মারাঠির মতই লোকাল ট্রেনে চেপে অফিস যান।
তার কাঁধে ঝোলানো ব্যাগে থাকে রং, তুলি,পেনসিল, আ্যলুমিনিয়ামের টিফিন বক্স।
ফ্রি প্রেস জার্ণাল কাগজের ব্যঙ্গচিত্রী তিনি । বেতন ৭৫ টাকা।
ওই অল্প টাকায় সংসারের খরচ চলে না বলে তাকে মারাঠা, কেসরী, ধণুর্ধারী প্রভৃতি পত্রপত্রিকা ও বিজ্ঞাপন সংস্থার জন্যেও ছবিও আঁকতে হয়। আঁকতে হয় সিনেমার শো- কার্ড।
অফিসে এতদিন তাঁকে বসতে দেওয়া হত টেলিফোন অপারেটরের পাশে।
খবরের কাগজের অফিসে বিরামহীনভাবে ফোন আসতেই থাকে। কার্টুন আঁকতে গিয়ে কার্টুনিস্টের মনঃসংযোগ নষ্ট হয় বারে বারে।
কর্তৃপক্ষের কাছে ক্রমাগত আবেদন করে কিছুদিন হল একটা নতুন জায়গা পেয়েছেন তিনি।
এই কাগজের আরেক স্টাফ কার্টুনিস্ট এক তরুণ দক্ষিন ভারতীয়। নাম আর. কে. লক্ষণ। কর্তৃপক্ষের স্নেহধন্য লক্ষণের জন্য অফিসে রয়েছে আলাদা চেম্বার।
.............................................................................
" বালাসাহেব ঠাকরের উত্থান আমার চোখের সামনেই ঘটেছিল।
যেদিন ফ্রি প্রেস জার্ণালে যোগ দিই, সেদিনই প্রথম আলাপ করিয়ে দেন এক সহকর্মী।
"ইনি হলেন মিঃ ঠাকরে। আমাদের কাগজের কার্টুনিস্ট।"
ক্ষীণকায় তরুন মিঃ ঠাকরের ঘন চুলগুলি ব্যাকব্রাশ করা । চোখে চশমা, মুখে চুরুট।
ওইসময় আমাদের অফিসে দুজন চুরুট খেতেন। সম্পাদক ও ব্যঙ্গচিত্রী। সম্পাদক নটরাজনের দামী চুরুটের হালকা গন্ধটা বিশেষ প্রিয় ছিল আমার।
কার্টুনিস্টের চুরুটের ঘ্রাণ ছিল উগ্ৰ, কড়া। মোটেই ভাল লাগত না।
বালাসাহেব একটা বড় কাঠের বোর্ডের ওপর কাগজ রেখে টুলির একটানে বড় বড় ছবি এঁকে ফেলতেন।
আঁকার সময় কখনও কখনও একটি পাইপ ধরিয়ে নিতেন দেখেছি।
আরেক ব্যঙ্গচিত্রী আর. কে. লক্ষণের নিজস্ব সাউন্ড প্রুফ ঘর ছিল। তার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকত এক চাপরাশী তাঁর ফাইফরমাশ খাটার জন্য।
মিঃ ঠাকরের ঘরটিকে আমরা বলতাম লাইব্রেরি। কারণ রিভিউ হবার জন্য যত রাজ্যের বই অফিসে দেওয়া হত, সেগুলি স্তূপ হয়ে পড়ে থাকত ওখানে।
মিঃ ঠাকরেকে ফিল্ম পেজ এডিটর ও এক করণিকের সঙ্গে ঘরটিকে ভাগ করে নিতে হয়েছিল।
মিঃ ঠাকরে ছিলেন অর্ন্তমুখী, মৃদুভাষী, ভদ্র, সংযত।
আমরা গর্বিত ছিলাম আমাদের কার্টুনিস্টকে নিয়ে।
তাঁর দুটি ব্যঙ্গচিত্র একটি ব্রিটিশ কার্টুন সংকলনে স্থান পেয়েছিল। লক্ষণের কার্টুন কিন্তু মনোনীত হয়নি।
একবার একটি আমেরিকান সংবাদপত্র ফ্রি প্রেস জার্ণালে প্রকাশিত মিঃ ঠাকরের কার্টুন পুনর্মুদ্রণ করে। সাম্মানিক হিসেবে কার্টুনিস্টের উদ্দ্যেশ্যে একটি ভদ্রস্থ পরিমাণ ডলারের চেক পাঠায়।
সংবাদপত্র কর্তৃপক্ষ কিন্তু পুরো টাকাটাই আত্মসাৎ করলেন। মিঃ ঠাকরেকে বলা হল, তাঁর কার্টুন ফ্রি প্রেস জার্ণালের সম্পত্তি।
মিঃ ঠাকরে ভীষণ রেগে গিয়েছিলেন। অন্ততঃ, তাঁর মত একজন নিরীহ ভদ্রলোকের পক্ষে যতটা রাগ করা সম্ভব !!
আমাদের সংবাদপত্রের কর্তাব্যক্তিরা অধিকাংশই ছিলেন দক্ষিণ ভারতীয়। "
স্মৃতিচারণা করেছেন প্রখ্যাত সাংবাদিক ও কলাম লিখিয়ে বেরহাম কন্ট্রাকটর, তাঁর " Busy Bee ; Best of 1996 - 97 " ( Oriana Communications, 1998 ) বইতে।
….............................................................................
১৯৫২ সালে মাদ্রাজ প্রদেশের তেলুগু ভাষাভাষী অঞ্চল নিয়ে একটি আলাদা রাজ্যের দাবীতে পট্টি শ্রীরামালু ৫৬ দিন অনশন করে মৃত্যুবরণ করেন।
কানাড়া ভাষাভাষী একটি প্রদেশ তৈরীর দাবি নিয়ে জোর সওয়াল করেন আলুরু বেঙ্কট রাও।
১৯৫৩ সালে রাজ্য পুনর্গঠন কমিশন তৈরী করা হয়েছিল। এই কমিশন ভারতে ভাষাভিত্তিক ১৪টি রাজ্য বিভক্ত করার সুপারিশ করে। সাথে থাকবে ৬টি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল।
১৯৫৬ এ পাশ হয় রাজ্য পুণর্গঠন আইন।
ব্রিটিশ আমলে তৈরী বম্বে প্রদেশকে বিভক্ত করে গুজরাটি ও মারাঠিভাষী রাজ্য তৈরির জোরদার দাবী উঠতে থাকে।
কিন্তু রাজ্য পুণর্গঠন কমিশন অদ্ভুতভাবে গুজরাতি ও মারাঠি ভাষাভাষী এলাকাগুলি জুড়ে একটি দ্বিভাষিক রাজ্য তৈরীর প্রস্তাব দেয়। সেইসঙ্গে বিদর্ভ অঞ্চলকে একটি আলাদা রাজ্য হিসাবে গঠন করার সুপারিশ।
এর বিরুদ্ধে সংযুক্ত মহারাষ্ট্র সমিতির নেতৃত্বে তুমুল আন্দোলন হয়।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক, প্রাবন্ধিক কেশব সীতারাম ঠাকরে ছিলেন এই আন্দোলনের একজন বর্ষীয়ান নেতা।
চিত্রশিল্পী , নানারকম বাদ্যযন্ত্র বাজাতে সিদ্ধহস্ত , শাস্ত্রীয় সংগীতে পারদর্শী, সাহিত্যে অগাধ পান্ডিত্য - এহেন বহু গুণের অধিকারী কেশবে ঠাকরের নিজস্ব পারফর্মিং ট্রুপ বা মারাঠি লোকায়ত নাচগানের দল ছিল।
তরুন বয়সে জ্যোতিবা ফুলের জাতপাতবিরোধী "সত্যশোধক" আন্দোলনের সঙ্গে তিনি যুক্ত হয়েছিলেন, একসাথে কাজ করেছেন বাবাসাহেব বি. আর. আম্বেদকরের সাথে।
প্রখ্যাত ইংরেজি সাহিত্যিক উইলিয়ম মেকপিস থ্যাকারের ভক্ত কেশব নিজের পদবীর বানানটি লিখতেন " Thackeray".
তাঁর " প্রবোধন" পত্রিকা মহারাষ্ট্রে তুমুল জনপ্রিয়। "প্রবোধন" কথাটির অর্থ " নবজাগরণ"।
মারাঠা মুলুকে কেশব " প্রবোধঙ্কর" নামেই অধিক পরিচিত।
সিনিয়র ঠাকরে সারা জীবনে অর্থ ছাড়া আর সবকিছুই উপার্জন করেছেন।
জীবনের নানা ওঠাপড়ার সুন্দর বিবরণ তিনি দিয়ে গেছেন " মাঝি জীবনগাথা ; (The Collected Works of Pravodhankar Thakre, Volume 1, মহারাষ্ট্র রাজ্য সাহিত্য আণি সংস্কৃতি মন্ডল, মুম্বই,) বইতে।
এই ঠাকরেরা চান্দ্রসেনীয় প্রভু কায়স্থ।
মহারাষ্ট্রে কায়স্থদের সংখ্যা কম। চান্দ্রসেনীয় প্রভু কায়স্থদের নিবাস ছিল কোলাবা জেলা ও তার আশেপাশে। এঁদের আচার ব্যবহার উচ্চবংশীয় ক্ষত্রিয়ের মত। কায়স্থ প্রভুরা মূলতঃ মসীজীবী।
ব্রাহ্মণদের সঙ্গে একসময় এঁদের সম্পর্ক ছিল আদায় কাঁচকলায়। বুদ্ধিবলে কেউ খাটো নয়, তাই এদের ঝগড়াঝাটি সর্বত্র সর্ব কার্যে চলেছে।
ছত্রপতি শিবাজীর বিশ্বস্ত সেনাপতি বাজী প্রভুর বীরত্বের কথা, ছত্রপতিকে রক্ষা করার জন্য তাঁর পাবনখিন্ডের লড়াইয়ে আত্মদানের কথা মহারাষ্ট্রে কে না শুনেছে ?
শিবাজী মহারাজ কত দূরদর্শী মানুষ ছিলেন। তাঁর একটা সার্বজনীন ভাব ছিল। তাঁর আমলে তিনি দপ্তরে, পল্টনে তিনি সব জাতি, সব ধর্মকে স্থান দিয়েছিলেন। তিনি মারা যাবার পর ব্রাহ্মণ অব্রাহ্মণে রেষারেষি ক্রমশ বেড়ে উঠেছিল।
অনেকে বলেন যে এই কায়স্থ প্রভুরা মহারাষ্ট্রের সাবেক বাসিন্দা নয়, উত্তর ভারত থেকে এসেছে।
এঁদের কূলদেবী বিন্ধ্যাচলবাসিনী -- দেবীর মন্দির মির্জাপুরের কাছাকাছি বিন্ধ্যপর্বতে অবস্থিত, দক্ষিণদেশে নয়।
মারাঠাশাহীর সময় কেশব সীতারাম ঠাকরের এক পূর্বপুরুষ ধোপড়ে অঞ্চলের দুর্গরক্ষক ছিলেন।
লড়াইয়ের সাথে তাঁরা অপরিচিত নন।
..............................................................................
মহারাষ্ট্র বিবিধ চিন্তাধারা ও আদর্শের উৎসভূমি।
বাল গঙ্গাধর তিলকের স্বরাজ্য আন্দোলন, জ্যোতিবা ফুলের সামাজিক সংস্কার আন্দোলন এখান থেকেই শুরু হয়েছে।
নাগপুরের রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ ধীরে ধীরে সারা দেশে শাখাপ্রশাখা বিস্তার করছে।
বাবাসাহেব আম্বেদকরের দলিত চেতনা মহারাষ্ট্রের ব্যাপ্তি ছাড়িয়ে দেশের দূরতম প্রান্তে পৌঁছে যাচ্ছে।
বম্বে শহরে কমিউনিস্ট ট্রেড ইউনিয়নের রমরমা।
কিন্তু এইসব তত্ত্বের প্রবক্তারা মারাঠি মানুষের সংস্কৃতি, জীবিকা , বাসস্থান নিয়ে কিছু বলছে কি ?
স্বাধীনতার বেশিদিন হয়নি, অথচ আজ নিজের শহরেই অবাঞ্ছিত মহারাষ্ট্রের ভূমিপুত্ররা। যারা এককালে ছিল ছত্রপতি শিবাজীর ফৌজের গর্বিত যোদ্ধা, তারা আজ সারা শরীরে আত্মগ্লানি মেখে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
পশ্চিমঘাটের গ্ৰাম্য, দরিদ্র মানুষের বম্বেতে একটাই পরিচয় --- "ঘাটী"। এই মলিন ঘাটীরা সুসজ্জিত বিপণীতে ঢুকে পড়লে বম্বের বাবুরা হাসে।
এই ঘাটি বা গরীব মারাঠিদের পিওন, মুটে, অটোচালক আর পুলিশ কনস্টেবল হিসাবে দেখা যায়। এই পুলিশের হাবিলদারদের অমারাঠিরা ব্যঙ্গ করে বলে "পান্ডু"।
সারা শহর জুড়ে মাকড়সার জালের মত রেল লাইন --- কয়েক মিনিট অন্তর অন্তর ট্রেন। বস্তাবন্দি আলুপটলের মত বোঝাই হয়ে লোক চলেছে। হট্টগোলের মধ্যে কান পাতলে মারাঠি কথা কানে আসে খুব কম।
চোখের সামনে দিয়ে মারাঠি মানুষের নিজের শহরটা, মুখের রুটিটা চুরি হয়ে গেল, তার খেসারত কে দেবে ?
মুম্বাদেবীর স্নেহধন্য এই শহর মুম্বই, আজ নিজের মারাঠি নামটাও হারিয়ে ফেলেছে।
"ওরা" অবশ্য বলে যে কসমোপলিটান বম্বে শহরকে নাকি গড়ে তুলেছে পার্সী, আর্মেনিয়ান, বোহরা মুসলীম আর গুজরাটি জৈনরা। মারাঠিরাই এখানে বেমানান, বহিরাগত।
বম্বের স্টুডিওগুলিতে চোপড়া, কাপুর, আনন্দদের একাধিপত্য !
শহরের উদিপী রেস্তোরাগুলির মালিক দক্ষিণ ভারতীয়রা। রয়েছে পার্সী টি হাউস।
বাল ঠাকরে লক্ষ্য করেছেন দক্ষিণ ভারতীয়রা সবসময় পরস্পর নাকশোঁকাশুকি করে চলে, ভুলেও মারাঠিদের চাকরীতে বহাল করে না।
অফিস কাছারী রেস্তোরাঁ মাদ্রাজী "আন্না"দের, সিনেমাজগত পাঞ্জাবীদের, ইন্ডাস্ট্রিগুলো গুজরাটি আর পার্সীদের --- কেবল গালিগালাজ ও বিদ্রুপ মারাঠিদের জন্য বরাদ্দ !!!
বিদর্ভ ও কোঙ্কন অঞ্চল থেকে প্রচুর মানুষ বম্বের কাপড়ের মিলে কাজ করেন। কিন্তু মিলগুলো ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। মারাঠি "কামগার" ( শ্রমিক )
পরিবারে যাদের চাকরির বয়স হয়েছে, সেইসব বেকার যুবকদের মধ্যে তৈরী হয়েছে তীব্র ক্ষোভ।
বম্বের অপরাধ জগৎকে নিয়ন্ত্রণ করছে যারা , সেই বরদারাজন মুদেলিয়র, হাজী মাস্তান আর করিম লালা পাঠান কেউই মারাঠি নয়। এটা বাল ঠাকরেকে বেশ ভাবিয়ে তোলে।
নানা জাতি, নানা ধর্মের ভিড়ে ধুঁকতে থাকা একটা তৃতীয় বিশ্বের শহর কখনই অপরাধ মুক্ত হবে না।
ফলে মহারাষ্ট্রেও গুন্ডা-মাফিয়া-অপরাধী থাকবেই। মারাঠি গুন্ডা যদি তৈরি না হয়, জায়গা ফাঁকা থাকবে না। ভিন্ন জাতির লুম্পেনরা অপেক্ষা করছে।
অতএব বিজাতীয় গুন্ডার থেকে "আমচি মূলে" (আমাদের ছেলেরা) কম বিপদজনক। কিন্তু আন্ডারওয়ার্ল্ডে "মারাঠি ডন" কোথায় ?
এইসব চিন্তা করতে করতে যখন বাল ঠাকরের মন আনমনা, হঠাৎ ধাক্কা লাগল উল্টোদিক থেকে আসা এক পথচারীর সাথে।
রাগের মাথায় মানুষের মুখ দিয়ে মাতৃভাষা বেরোয়। লোকটি বাল ঠাকরেকে যা তা গালমন্দ করতে লাগল।
লোকটার অনর্গল আ্যন্ডাপ্যান্ডা য়ান্ডুগুন্ডু শুনে রাগের চেয়ে হাসি পেল বেশি।
মাদ্রাজীদের কি আজব ভাষা !!
তবে এই " য়ান্ডুগুন্ডু"গুলোর বড্ড বাড় বেড়েছে।
মালাবার থেকে আসা হকারগুলো শহরের ফুটপাতগুলোতে যত স্মাগলড জিনিস ফিরি করে বেড়ায়।
বাইরে থেকে যতরাজ্যের লোক এসে শহরটাকে ঘিঞ্জি আর অপরাধপ্রবণ করে তুলেছে !!!
কিছু একটা করা দরকার !!
…….......….....................................................
দাদারের ৭৭এ, রানাডে রোডের বাড়িতে সংযুক্ত মহারাষ্ট্র আন্দোলনের নেতা ও কর্মীদের ভিড় লেগেই থাকে। কাছেই শিবাজী পার্ক।
১৯২৫ সালে এ পার্ক স্থাপিত হয়। তখন এর নাম ছিল মাহিম পার্ক। ১৯২৭ সালে স্বাধীনতা সংগ্রামী তথা বিএমসি কাউন্সিলর অবন্তিকাবাই গোখলের উদ্যমে এ পার্কের নামকরণ হয় শিবাজি পার্ক। জনগণের চাঁদায় এখানে শিবাজির একটি মূর্তি স্থাপিত হয়।
বাড়ির হৈ হট্টগোলের মধ্যেই বসার ঘরে চৌকি পেতে বাল ঠাকরে কার্টুন এঁকে চলেন। ইদানিং সংযুক্ত মহারাষ্ট্র আন্দোলনের সমর্থনে প্রায় আটটি কাগজে ব্যঙ্গচিত্র আঁকছেন " মাওলা " ছদ্মনামে। মহারাষ্ট্রের পার্বত্য অঞ্চলের স্থানীয় বাসিন্দাদের বলে "মাওলা"। এঁরাই শিবাজীর বিশ্বস্ত সৈনিক ছিল।
মোরারজী দেশাই কিছুতেই আলাদা রাজ্য দেবেন না মারাঠিদের। শহরের ফ্লোরা ফাউন্টেন এলাকায় ( এখন হুতাত্মা চৌক ) বিক্ষোভরত আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি চালিয়ে পুলিশ ১০৫ জনকে মেরে ফেলল।
" বম্বে" নামে একটি কাগজে ঠাকরের কার্টুন প্রকাশিত হল। মোরারজি দেশাইকে নররাক্ষস রূপে খুলির পাহাড়ের ওপর বসে আছেন।
পুলিশ কেস নথিভুক্ত করল, ফলে কয়েকদিন গা ঢাকা দিয়ে থাকতে হল বাল ঠাকরেকে।
...........................................................................
শেষ পর্যন্ত ফ্রি প্রেস জার্ণালের চাকরি ছেড়ে দিলেন বাল ঠাকরে। মহারাষ্ট্রের খ্যাতনামা নেতা এস. কে. পাতিলকে আক্রমণ করে করা কার্টুন নিয়ে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে তীব্র মতান্তর হয়েছে সদ্য। এছাড়াও নানা কারণে মনটা তিক্ত হয়ে আছে।
ঠিক করলেন, একটি কার্টুন সাপ্তাহিক বের করবেন। সেইসময় মহারাষ্ট্রে স্ত্রী, কিরলোসকার, মৌজ, জ্যোৎস্না ইত্যাদি পত্রিকা থাকলেও কোন কার্টুন সাপ্তাহিক ছিল না। কেবলমাত্র দিল্লি থেকে বেরোত ইংরেজি " শংকরস উইকলি " নামে মূলত কার্টুন ও ফিচারধর্মী পত্রিকা।
" খিঁচো না কামান
না তলওয়ার নিকালো
জব তক মুকাবিল হো
তো আখবার নিকালো। "
তুলিকলমের জোরই আসল জোর।
প্রবোধঙ্কর ঠাকরের এক গুণমুগ্ধের দেওয়া পাঁচ হাজার টাকার আর্থিক অনুদানে প্রকাশিত হল একটি পত্রিকা।
১৯৬০ সালের ১৩ই এপ্রিল , স্থানীয় বালমোহন বিদ্যামন্দিরে বাল ঠাকরের পত্রিকার আনুষ্ঠানিক প্রকাশ উপলক্ষ্যে এসেছিলেন তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী ওয়াই. বি. চবন। প্রবোধঙ্করের গুণমুগ্ধ তিনি।
সমস্ত মারাঠি জনগণের মর্মস্থলের আশা ভরসা থেকে উৎসারিত হয়েছে বলে প্রবোধঙ্কর এর নাম রেখেছেন " মার্মিক"। প্রচ্ছদ জুড়ে বাল ঠাকরের কার্টুন। সঙ্গে কড়া সম্পাদকীয়, শ্লেষাত্বক নিবন্ধ ও সিনেমার পাতা।
ধীরে ধীরে মারাঠি মানুষের মনে জায়গা করে নিল এই পত্রিকা। রবিবাসরীয় ক্রোড়পত্র "রবিবারচি যত্রা" ছিল অন্যতম আকর্ষণ।
.......................................................................
আর্কিটেক্ট মাধব দেশপান্ডে, পদ্মাকর অধিকারী, শ্যাম দেশমুখ এবং বসন্ত প্রধান ( রেলকর্মী ও পরবর্তীতে আইনজীবি ) বম্বে শহরের বিভিন্ন গণেশ মন্ডল, স্থানীয় ক্লাব ও ব্যায়ামশালায় গিয়ে মারাঠি তরুনদের সংগঠিত করার চেষ্টা করতেন।
ওই সময় " মার্মিক " একটি জনপ্রিয় পত্রিকা হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছে। প্রায় ৫০,০০০ কপি বিক্রি হত, প্রায় দু লক্ষ মানুষ পত্রিকাটি পড়তেন।
একদিন তাঁরা ওই পত্রিকায় একটি বিজ্ঞপ্তি দেখলেন। মারাঠিদের স্বার্থরক্ষার জন্যে নিজস্ব সংগঠন তৈরী হবে।
তাঁরা বুঝলেন তাঁদের উদ্যোগের সাথে এই প্রচেষ্টা পুরোপুরিভাবে মিলে যাচ্ছে। তাঁরা সদলবলে বাল ঠাকরের সাথে সাক্ষাৎ করে জিজ্ঞাসা করলেন, এই সংগঠনের কোন কাঠামোর বিষয়ে মিঃ ঠাকরে কিছু ভেবেছেন কিনা।
"কাঠামো ? কিসের কাঠামো ? আমি রয়েছি, কিছু বন্ধু রয়েছেন, আর এই পত্রিকাটা রয়েছে।" বাল ঠাকরে সবিস্ময়ে বললেন।
মাধব দেশপান্ডে ও তাঁর সাথীরা মিঃ ঠাকরেকে বোঝালেন শুধুমাত্র সীমিত লোকবল ও পত্রিকার প্রচারের ওপর ভরসা করলে চলবে না।
পেশাদার দক্ষতায় তাঁরা নতুন দলের সাংগঠনিক কাঠামোর রূপরেখা এঁকে দিলেন। বম্বে মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশনের এলাকাভিত্তিক ম্যাপকে সামনে রেখে প্রতিটি ওয়ার্ডে শাখা প্রমুখের নেতৃত্বে বিভাগ প্রমুখ, ও বিভাগ প্রমুখের অধীনে সাধারণ কর্মীদের মধ্যে দায়িত্ব কিভাবে ভাগ হবে, তার একটি নীল নকশা তৈরি করলেন।
একটা জিনিস তাঁরা লক্ষ্য করেছিলেন, যে পত্রিকা সম্পাদককে যদি তাঁর কমফর্ট জোন থেকে একবার বাইরে বার করে এনে মঞ্চে তুলে দেওয়া যায়, তবেই কেল্লাফতে। মানুষ মন্ত্রমুগ্ধের মত তাঁর কথা শোনে।
এই নিঃস্বার্থ কর্মীরা একমত হলেন যে মারাঠি অস্মিতার মুখ হবেন একজনই -- বালাসাহেব ঠাকরে।
( তথ্যসূত্র : হিন্দু হৃদয় সম্রাট ; সুজাতা আনন্দন, হারপার কলিন্স। )
.............................................................................
" আমি ১৯৬৯ সালে পুনে থেকে বম্বেতে ডেপুটি কমিশনার হিসাবে বদলি হই। জোন থ্রি এলাকাটি আমার দায়িত্বে ছিল। এখানেই শিবাজী পার্ক, বালাসাহেব ঠাকরের খাসতালুক। তাঁর সাথে আমার বেশ কয়েকবার মুখোমুখি সাক্ষাৎ হয়েছিল।
একটা ইন্টারেস্টিং চরিত্র উনি। ওনার সাথে কথা বললে মোটেই রাগ হত না আমার। তবে ওনাকে ক্রমাগত ট্যাকল করতে হত প্রশাসনের তরফ থেকে।
আমাকে বারবার বলতে হত - আপনি এটা করতে পারবেন না -- এটা করলে আমরা এই ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হব।
তখন উনি আমাদের সাথে তর্ক করতেন, কিন্তু কোথাও যেন ওনার মধ্যে পুলিশ প্রশাসনের প্রতি একটা রেসপেক্ট ছিল। উনি জানতেন, একমাত্র আমরাই ওঁকে রুখে দিতে পারি।
মিঃ ঠাকরের সাথে কথা বলে তাঁকে মোটের ওপর মিশুকে ও বন্ধুবৎসল বলেই মনে হয়েছে। তবে বক্তৃতা দেবার সময় যেন তাঁর ঘাড়ে ভূত চাপত। তাঁর কথার তোড়ে সকলে ভেসে যেত। গল্পের ঢংয়ে যখন কথা বলতেন তখন মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনত মাঠভর্তি লোক।
মানুষ তাঁর কথায় হাসত, কাঁদত, ক্রুদ্ধ হত -- মারাঠি হিসাবে গর্ব অনুভব করত। মিঃ ঠাকরে না থাকলে এই নবীন প্রজন্মের ছেলেরা হয়ত বামপন্থী দলে যোগ দিত, অথবা জর্জ ফার্নান্ডেজের সোসালিস্ট পার্টির দল ভারী করত।
তৎকালীন কংগ্রেস মুখ্যমন্ত্রী বসন্তরাও নায়েকের সস্নেহ সমর্থন পেতেন মিঃ ঠাকরে। সেসময় অনেকেই ওনার দল শিবসেনাকে ব্যঙ্গ করে বলত "বসন্তসেনা"। আরো বিভিন্ন প্রভাবশালী ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর মদতও ছিল। তাঁরা চাইতেন মিঃ ঠাকরে কমিউনিস্টদের উৎখাত করুন শহর ও রাজ্য থেকে।
আবার বলছি, মিঃ ঠাকরে খুব বুদ্ধিমান মানুষ --- মানুষের ওপরে প্রভাব বিস্তার করার একটা অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল ভদ্রলোকের। আমাদের পুলিশ ফোর্সের জুনিয়র অফিসার ও কর্মীদের পুরোপুরি নিজের দিকে করে নিতে পেরেছিলেন। এদের সকলেই ছিল মারাঠি।
আমার স্টেশন হাউস অফিসারদের মধ্যে বাল ঠাকরের অসংখ্য গুণমুগ্ধ ছিল। আমি দৈনিক "পুলিস নোটিশ" এর মাধ্যমে তাদের বার্তা দিতাম যে কোন পুলিশকর্মী যদি রাজনৈতিক পক্ষপাতের কারনে কর্তব্যের সাথে আপোষ করে তবে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
প্রখ্যাত পুলিশ অফিসার জুলিও রিবেইরো।
মুম্বই মিরর, সেপ্টেম্বর, ২০১৯
...................................................................
বালাসাহেব ঠাকরের সভাপতিত্বে কোলাপুরে অনুষ্ঠিত কার্টুনিস্টদের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। তিনি সেখানে সকলের সামনে নানা ধরনের ক্যারিকেচার এঁকে দেখিয়েছিলেন।
কার্টুন আঁকায় এ্যনাটমির গুরুত্ব, ক্যারিকেচার কিভাবে অল্প রেখায় পরিচিত মানুষের ব্যক্তিত্বের নির্যাস ফুটিয়ে তোলে, রাজনৈতিক কার্টুন কাকে বলে -- এই বিষয়গুলো নিয়ে প্রাঞ্জল ভাষায় তিনি আলোচনা করেন।
পরবর্তীকালে ভিলে পার্লে ও গিরগামে অনুষ্ঠিত কার্টুনিস্টদের কনভেনশনেও তিনি সাগ্ৰহে যোগদান করেন। মহারাষ্ট্রে কার্টুনশিল্পের প্রচার ও প্রসারে তিনি অকুন্ঠভাবে সাহায্য করেছেন।
২০০০ সালে মহারাষ্ট্রের বিখ্যাত কার্টুনিস্ট শিবরাম দত্তাত্রেয় ফডনিসের ৭৫ বছরের জন্মদিনে যে অনুষ্ঠান হয়, তাতে বালাসাহেব উপস্থিত হয়ে সম্বর্ধনা জানান -- ভূয়সী প্রশংসা করেন বর্ষীয়ান শিল্পীর।
" ফাডনিস ক্যাপশনলেস কার্টুনের একজন সার্থক রূপকার। আমার কার্টুনে অবশ্য সংলাপ থাকত, কারণ আমার অধিকাংশ বক্তব্যই ছিল রাজনৈতিক।" বলেছিলেন বালাসাহেব ঠাকরে।
লক্ষণের " কমনম্যান" এর মতই বালাসাহেবের" মারাঠী মানুস" ছিল কাক্কাজী। এই গোবেচারা, প্রৌঢ় মারাঠি পারিপার্শ্বিক চাপে বিপর্যস্ত।
" মার্মিক ছাড়াও বালাসাহেবের কার্টুন আমি নিয়মিত দেখতাম আওয়াজ, নবযুগ, কেশরী, নবশক্তি ইত্যাদি পত্রপত্রিকায়। আমাকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছিল তাঁর রেখা ও বক্তব্য।" জানান ফাডনিস। ফডনিসের সংলাপহীন কার্টুনের বই " Laughing Gallery" সারা ভারতের কার্টুনিস্টদের কাছে পরিচিত।
.............................................................................
বালাসাহেব ঠাকরে ও আর. কে. লক্ষণ ছিলেন একে অপরের কাজের গুণমুগ্ধ। দুজনেই প্রবাদপ্রতীম ব্রিটিশ কার্টুনিস্ট ডেভিড লোকে অনুসরণ করতেন।
২০১০ সালে একটি স্ট্রোকের পরে লক্ষণ যখন অসুস্থ, বালাসাহেব এসেছিলেন বন্ধুকে দেখতে তাঁর পুনের বাসভবনে।
" রাজনৈতিক নেতা বালাসাহেব ঠাকরে নন, কার্টুনিস্ট বালাসাহেবকে আমাদের বেশি পছন্দ। ঠাকরে পরিবারের সাথে বরাবরের আমাদের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। ওঁর প্রয়াত স্ত্রী মীণাতাই আমার বান্ধবী ছিলেন। ১৯৫০ সালে লক্ষণ ফ্রি প্রেস জার্ণালের চাকরি ছেড়ে দিয়ে টাইমস অফ ইন্ডিয়ায় যোগ দেন। ওখানে চাকরি করা সম্ভব হচ্ছিল না। কর্তৃপক্ষ একটি বিশেষ রাজনৈতিক মতবাদের দিকে ঝুঁকে থাকায় কাজের পরিবেশ ছিল না।
দক্ষিণ ভারতীয়দের বিরুদ্ধে বালাসাহেবের দলের আন্দোলন, সেটির প্রকাশ্য সমালোচনা তাঁর সতীর্থ লক্ষণ কখনও করেননি। এমনকি, কোন কার্টুনও আঁকেননি।
মাঝে মাঝে অবশ্য বলেছেন, ও কি পাগল হয়ে গেল ?
অথবা, এতটা বাড়াবাড়ির কোন দরকার ছিল না।
কিন্তু বন্ধুর রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা ভেবে বিষয়টা নিয়ে সোচ্চার হননি।
হয়ত, নীরব থাকাও একরকমের প্রতিবাদ। "
বলেছেন কমলা লক্ষণ। আর. কে. লক্ষণের স্ত্রী।
মৃত্যুর দুদিন আগেও বালাসাহেব ঠাকরের সঙ্গে ফোনে কথা হয় লক্ষণের স্ত্রীর।
" আমি প্রস্থানের পথে। " বালাসাহেব জানিয়েছিলেন তাঁকে।
বালাসাহেব ঠাকরে ও আর. কে লক্ষণ প্রয়াত হন যথাক্রমে ২০১২ ও ২০১৫ সালে।
.............................................................................
" আমি একজন কার্টুনিস্ট। সকলে খবর পড়ে আর আমি খবরের ভিতরে থাকে যে খবরটা, তা দেখতে পাই।"
পৃথীশ নন্দীকে দেওয়া একটি টিভি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন তিনি।
" মানুষ আমার হুলটাকে নিয়েই ব্যতিব্যস্ত। কিন্তু আমি যে মধুটা তৈরী করি, সেটার আস্বাদ পায় খুব কম লোক।"
ছদ্ম আক্ষেপ করে বলেছিলেন বালাসাহেব।
বালাসাহেব ঠাকরের নির্বাচিত কার্টুন সংকলন "ফটকারে" ( কশাঘাত ) প্রকাশিত হয়েছিল ২০১২ সালের অক্টোবর মাসে। ১৯৪৭ থেকে সত্তরের দশক পর্যন্ত তাঁর ব্যঙ্গের অভিব্যক্তি যে মারাঠি মানুষকে আলোড়িত করেছিল, তাঁর প্রত্যক্ষ প্রমাণ এই বইটি।
চার্চিল, স্ট্যালিন, টিটো, নাসের, মাও সে তুং থেকে নেহরু, ইন্দিরা, মহারাষ্ট্রের নানা রাজনৈতিক কুশীলবদের নানা কান্ডকারখানার তীর্যক অবলোকন রয়েছে এই কার্টুনের বইটিতে।
পোস্ট ; ঋতুপর্ণ বসু
কৃতজ্ঞতা ; প্রসন্ন মাঙ্গরুলকর
তথ্যসূত্র;
The Sena Story by Vaibhav Purandare (Business Publications Incorporated)
Marathi Manoos by Sujata Anandan (Harpercollins)
The Emergence of Regionalism in Mumbai: History of the Shiv Sena by Sudha Gogate (Popular Prakashan Private Limited )