সাগরমেলার আগে বাবুঘাটে একটা ক্যাম্প হয় সন্ন্যাসী আর তীর্থযাত্রীদের জন্য। সেখানে আমি যাই সুযোগ পেলে। আগে যেতাম ভারত চিনতে। এখন তার সঙ্গে অন্য কিছু আকর্ষণও থাকে। সেখানে বাবাজি আসেন প্রায় প্রতিবছর। আমার যে গণিতজ্ঞ বন্ধুটি তাঁর বিশেষ অনুরক্ত, তিনি খবর দেন, "বাবাজি এসে গেছেন।" মানুষটির সারল্য এবং সদানন্দ ভাব আমাদের টানে। ঝাঁকড়া কোঁকড়ানো চুল, এলোমেলো দাড়ি। গায়ে ময়লা চাদর। ক্যাম্পের ভেতরে যেখানে আরামদায়ক তাঁবু হয়, সেখানে থাকেন না। ক্যাম্পের ঠিক বাইরে একটা গাছতলায় খড় বিছিয়ে ধ্যানাসনে বসে থাকেন। সেখানেই রাত্রিবাস। মনকে স্থির করার জন্য এনার গঞ্জিকা প্রয়োজন হয় না, যোগের মাধ্যমেই পারেন। মেলার ক্যাম্পে তীর্থযাত্রীদের জন্য খাবারের বন্দোবস্ত থাকে। কেউ রুটি তরকারি এনে দিলে খান মাঝেমাঝে। অন্য কোনো সামগ্রী গ্রহণ করতে দেখিনি। একবার একজন একটা কম্বল দিয়েছিল লাল রঙের ফুল আঁকা। শীতের রাতে তিনি সেটা আমাকে দিয়েছিলেন। গায়ে দিয়ে বাড়ি চলে যাও, পরে অন্য কাউকে দিয়ে দিয়ো। এই ছিল নির্দেশ। আমি কম্বল গায়ে মেট্রোয় চড়েছি সেই একবারই। বাবাজি কথা বলেন খুব কম লোকের সঙ্গে৷ ঘটনাচক্রে আমাদের সঙ্গে বলেন। কথাগুলো সাধারণ্যে আলোচ্য নয়।
এন আর সি হলে বাবাজির নাম উঠবে না, কারণ তাঁর কোনো কাগজই নেই। গোবর্ধন অঞ্চলে একসময় একটি আশ্রম কুটির বানিয়েছিলেন। সেটা ঝড়ে ভেঙে যাবার পর ওঁর মনে হল কৃষ্ণ বলছেন, এসব ঘরদোর ভালো না। প্রকৃত গৃহত্যাগী সন্ন্যাসীকে নাগরিকত্বের পরিচয়পত্র দেবার হিম্মত রাষ্ট্রের এখনো হয়নি। কিন্তু তাঁর দেশ, মাটি, আকাশ কেড়ে নেবার ক্ষমতা অবশ্যই আছে। এন আর সি হলে বাবাজি কয়েদ হবেন। "সি এ এ", যা নাকি হিন্দুদের রক্ষাকবচ, তা এই হিন্দু সন্ন্যাসীর কাজে আসবে না, কারণ তিনি বাঙলাদেশ, পাকিস্তান বা আফগানিস্তান থেকে আসেননি। তিনি জন্মসূত্রে ভারতীয়।
"তাহলে কী হবে বাবাজি?"
"কিষণ ভগবান জানে।" হাসেন বাবাজি। "আরে বো কানহাইয়া বড়া অটোমেটিক হ্যায়। সব জান লেতা হ্যায়।"
বোঝা গেল। সন্ন্যাসীর প্রাণে ভয় নেই, কারণ সেখানে কৃষ্ণ আছেন। হয়ত কারাগারেই তিনি কৃষ্ণের সাক্ষাৎ পাবেন, যেমন পেয়েছিলেন দেবকী-বসুদেব। কারাগারটি যে আদতে কংসের, সে বিষয়ে সন্দেহ থাকবে না। কারাগারে কৃষ্ণ আবির্ভূত হলে কংসের কী গতি হয়, তাও আমরা জানি। তবু আমরা সামান্য মানুষ। বাবাজির জন্য চিন্তা হয়। যদি দেখি এন আর সি-র পর আর তিনি সাগরমেলায় আসছেন না…
ও হরি! তখন আর কেই বা আসবে মেলায়? তীর্থযাত্রীদের যা দেখেছি এত বছর ধরে, কটা কাঠকুটো বস্তায় নিয়ে গঙ্গা মাঈয়ার ভরসায় বেরিয়ে পড়েছে রাজস্থানের গ্রাম থেকে… কীভাবে ফিরবে জানে না, কাগজপত্র না থাকায় এরা অনেকেই পাকিস্তানি বলে চিহ্নিত হবে। সন্ন্যাসীদের কথা তো ছেড়েই দিলাম। নিরঞ্জনী আখড়া, জুনা আখড়া, ভোলা গিরির আশ্রম উজাড় হয়ে যাবে। হৃষিকেশ, বদ্রিনাথ, নর্মদার তীর থেকে পুলিশ টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাবে সহস্র সন্ন্যাসীকে। থাকবে শুধু মোদী-আম্বানি-আদানি-শাহী। আমেরিকা, সৌদি আরব থেকে তাঁরা আমদানি করবেন শকুন। রপ্তানি করবেন ভারতবর্ষ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন