মঙ্গলবার, ২৯ ডিসেম্বর, ২০২০

দারুণ দিন ~ রজত শুভ্র বন্দোপাধ্যায়

ভয় পেয়ো না, ভয় পেয়ো না, তোমায় আমি মারব না, 
সত্যি বলছি, তোমার সঙ্গে রংবাজিতে পারব না!
মনটা আমার বড্ড নরম, মারতে গেলেই ক্লান্তি হয়, 
ভাষা আমার রুক্ষ হলেও স্বভাব আমার শান্তিময়।

আমার হাতে ডাণ্ডা দেখে ভয় পেয়েছ? মোটেই না! 
ওইটা কেবল লোক দেখানো, কাউকে আমি পেটাই না।
তিলক কাটা সাঙ্গ-পাঙ্গ? যাহ! ওরা সব বালক দল, 
শান্ত-শিষ্ট, ল্যাজ বিশিষ্ট – মন গুলো সব স্বচ্ছ জল!

এস, এস, বসবে এস, পদ্ম ফুলের আসনটায়, 
আদর করে ভরিয়ে দেব, মাথায় করে রাখব তায়।
বসবে এস মামার ঘরে; কই রে মুকু, ফ্যান চালা! 
গেস্ট এসেছেন, কর রে তোয়াজ, এই আদানি, ঠাণ্ডা লা!

দেশ জুড়ে আজ শিল্প এনে উন্নয়নের ডাক ছেড়ে 
করছি কেমন সুব্যবস্থা, সবাই খাবে পাত পেড়ে!
নাহয় দুটো ক্ষেত নিয়েছি, তাইতে আমায় দোষ দেবে?
নয় মরেছে কোন সে চাষা, অন্যরা তো ফল নেবে!

মিছেই কেন বিরোধ কর? বিল বদলের রব তোলো?
পাগড়ি পরে আটকালে পথ, কাজটা কি ভাই ঠিক হলো?
কী বললে ভাই? আদুর দলিল? চোখ বোলাবে চুক্তিতে?
রাজার কাজে নাক গলাবে? এ আবার কী যুক্তি হে!

যাও, ছাড় তো ওসব কথা! ফালতু কেন ভাবছ, ভাই?
আয়েশ করে পায়েস খেয়ো, এই তো জীবন! আর কী চাই?
যাও দেখ গে, মল করেছি, আরাম করে দর কর,
এস্কালেটর চেপেই নাহয় ওপর তলায় ভর কর।

.................................

আরে, আরে, তবুও রাগিস? আইন দেখে ভয় পেলি?
বলছি তো ভাই, গিমিক শুধু, আয় কাছে আয়, বল খেলি!
মিষ্টি করে বলছি এত, হ' না রে ভাই নিমরাজী!
তবুও তোরা কান দিবি না, চালিয়ে যাবি দল-বাজি?

বেশ, ঠিক আছে, ঘাট হয়েছে, থাক তবে তোর রাগ নিয়ে,
মিষ্টি কথা বলব না আর, শোন তবে ভাই মন দিয়ে;
আমি আছি, মোটকা আছে, আছে আমার তিনশো দুই,
সবাই মিলে কামড়ে দেব, আবার যদি লড়িস তুই!!

শনিবার, ২৬ ডিসেম্বর, ২০২০

সোভিয়েতের পতন ~ কৌস্তভ কুন্ডু

১৯৯১, ২৫ শে ডিসেম্বর, ঠিক সন্ধ্যা ৭:৩২ মিনিটে ভেঙে যায় সোভিয়েত ইউনিয়ন। ক্রেমলিনের মাথা থেকে নামানো হয় কাস্তে হাতুড়ি পতাকা। ভেঙে পড়ে দুনিয়ার মুক্তিকামী মানুষের স্বপ্নের সোভিয়েত ইউনিয়ন। 

কিন্তু কি কারণ থাকতে পারে, পৃথিবীর দ্বিতীয় সুপার পাওয়ার তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ার! বহু জায়গায় বহু ব্যখ্যা পড়েছি কিন্তু যুক্তিসঙ্গত লাগেনি, তাই খোঁজার চেষ্টা করলাম নিজের মতো করে।

তবে কি মানুষ চায়নি? কিন্তু ১৯৯১ সালে সোভিয়েত নিয়ে যে রেফারেন্ডাম আনা হয় তাতে ৭৭.৮৫ % ভোট পড়ে সোভিয়েতের পক্ষে। তবে? 
অনেকে বলে অর্থনৈতিক ফেলিওর, যে দেশ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ৩ কোটি প্রাণ দেবার পর ১০ বছরে পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি হতে পারে, অন্য কোনও দেশ দখল না করে, উপনিবেশ ছাড়াই, তারা অর্থনৈতিক ফেলিওর বিশ্বাস করিনা আমি। ১৯৯০ - ৯১ তেও উৎপাদন স্ট্যাটিসটিক্স দেখুন, বা আমেরিকার মানুষের থেকে বেশী প্রোটিন ইনটেক দেখুন, তথ্য কিন্তু সে কথা বলে না।

তবে কি কারণ থাকতে পারে?
আসুন আগে দেখি কি ঘটেছিল সেসময়। মদ বিরোধী আন্দোলন করে কমিউনিস্ট পার্টির ভিতর বিখ্যাত হন এবং ১৯৮৫ সালে কম্যুনিস্ট পার্টির সম্পাদক নির্বাচিত হন মিখাইল গর্বাচেভ। উনি এসে ইমপ্লিমেন্ট করেন পেরেস্ত্রইকা এবং গ্লাসনস্ত। অর্থাৎ খোলামেলা রাজনৈতিক ব্যবস্থা এবং খোলা বাজার। ১৯৯১ এ খোদ কমিউনিস্ট পার্টির জেনেরাল সেক্রেটারি মিখাইল গর্বাচেভ কম্যুনিস্ট পার্টির অফিসে তালা মারেন। সোভিয়েত ভেঙে দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। আগস্ট মাসে যদিও কমিউনিস্ট পার্টির একাংশ চেষ্টা করে গর্বাচেভ কে উচ্ছেদ করার সশস্ত্র অভ্যুত্থান এর মধ্যে দিয়ে, কিন্তু ব্যর্থ হয়। ভোটে জিতে ক্ষমতায় আসেন বরিস ইয়়েলিৎসিন, যে কিনা একসময় ৪ বিলিয়ন ডলার চেয়েছিলেন আমেরিকার প্রেসিডেন্টের কাছে, নির্বাচন জিততে। গর্বাচেভ জানায় রেফারেন্ডাম এ মানুষ নাকি ভয়ে ভোট দিয়েছিল, তাই জনাদেশের বিপক্ষে ভেঙে ফেলা হয়। এরপর ইয়়েলিৎসিন এর নেতৃত্বে এবং আমেরিকার অর্থদপ্তরের সহযোগিতায় ইমপ্লিমেন্ট হয় 'শক থেরাপি', একটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থা যেখানে সমস্ত সামাজিক মালিকানা তুলে দেওয়া হল পুঁজিবাদের হাতে। শুধু সোভিয়েতের ক্ষেত মজুররা প্রতিরোধ করেছিল, তাই আজও রাশিয়ার ৭০% কৃষিজমি যৌথ খামার।

পেরেস্ত্রইকা, গ্লাসনস্ত, শক থেরাপি পরপর অর্থনৈতিক রাজনৈতিক ব্যবস্থা গুলোকে সাজান মাথায় রাখুন।
এবার আপনি যদি ব্যাক ক্যালকুলেশন করে কোনোদিন অঙ্ক মিলিয়ে থাকেন, একটা ব্যাক ক্যালকুলেশন করি চলুন।
প্রথম যে কথাটা মাথায় আসল, সেটা হল শক থেরাপির মধ্য দিয়ে যে হঠাৎ করে যে পুঁজিবাদে পরিণত হল সমাজতান্ত্রিক দেশ। কিকরে সম্ভব!! পুঁজিবাদের জন্য যেটা সবচেয়ে প্রয়োজন, যেটা ছাড়া চলে না, সেটা হল পুঁজিপতি। কিন্তু প্রশ্নটা আসে যে সমাজতান্ত্রিক দেশে যেখানে পুঁজিপতি শ্রেণীটাই অ্যবোলিশড সেখানে পুঁজিপতি এলো কোথা থেকে, পুঁজিই বা এলো কোত্থেকে? এখানেই খটকা লাগে আমার।

এবার শুরু করি ব্যাক ক্যালকুলেশন।
গুগলে যান সার্চ করুন রাশিয়ার বিলিওনিয়ার লিস্ট। এবার পরপর যা নাম আসবে তাদের বায়োগ্রাফি চেক করুন। একটা অদ্ভুত জিনিস দেখবেন, বিলিওনিয়ার লিস্টের ৭০% সোভিয়েত আমলের আমলা অথবা কমিউনিস্ট পার্টির উঁচু লিডার। লজ্জার ব্যাপার।
যেমন ধরুন - রাশিয়ার ৫ম ধনী ব্যক্তি ভাগিট আলেকপেরভ, উনি সোভিয়েত আমলে একটি রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার ডিরেক্টর জেনারেল ছিলেন, এরপরে উনি সোভিয়েতের গ্যাস এবং পেট্রোলিয়াম মন্ত্রকের মন্ত্রী নিযুক্ত হন।
বা, গেনাডি টিমোশেঙ্কো, উনি সোভিয়েতে একটি রাষ্ট্রায়ত্ত তেল কোম্পানির ডেপুটি ডিরেক্টর ছিলেন। অর্ডার অব ফাদারল্যান্ড পেয়েছিলেন। 
বা, সুলেমান কেরিমোভ ডেপুটি ডিরেক্টর ছিলেন আলতাব সংস্থার।
মোট ৪৬ জন বিলিওনিয়ার এর লিস্ট খুঁজে দেখুন ৭০% সোভিয়েত আমলের আমলা অথবা কমিউনিস্ট পার্টির উঁচু লিডার।
এদের হাতেই তুলে দেয় বরিস ইয়েলিৎসিন পুঁজিবাদের ভার, পুঁজি হিসেবে আসে ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্কের অর্থ সাহায্য।

সমস্যাটা শুরু হয়েছিল ১৯৮৫ পেরেস্ত্রইকা, গ্লাসনস্ত আমল থেকে। মিখাইল গর্বাচেভ খোলামেলা ব্যবস্থার নামে কিছু কিছু সংস্থাকে পুঁজি এবং আমলাদের পুঁজিপতি হওয়ার সুযোগ দেন। তখনই রক্তের স্বাদ পেয়ে যায় তারা। তারা বোঝে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পুঁজিবাদ এলে তারা কোটিপতিতে পরিণত হতে চলেছে। তাই তাদের সমর্থন ছিল মিখাইল গর্বাচেভ এবং বরিস ইয়েলিৎসিন দের ওপর। এরাই কমিউনিস্ট পার্টির বড় বড় কমিটিতে মেজরিটি ছিল। ফলে ষড়যন্ত্র হয় সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে ফেলার, আমেরিকার ফান্ড সাহায্য নিয়ে। মিখাইল গর্বাচেভ এবং বরিস ইয়েলিৎসিন এর নাটক, তারা একদিকে দেখাত শত্রু এদিকে অ্যালাই। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙা হয় রেফারেন্ডামে মানুষের ইচ্ছার বিরুদ্ধে। আভ্যন্তরীণ ষড়যন্ত্র, কমিউনিস্ট পার্টির নেতা, আমলারাই ভাঙে সোভিয়েত, তাদের চোখে বড়লোক হওয়ার স্বপ্ন। সোভিয়েত মানুষ ভাঙেনি, ৭৭.৮৫% মানুষের হৃদয়ে ছিল তাদের শ্রমিকরাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়ন। এখনও রাশিয়ার ৭০% কৃষিজমি যৌথ খামার, তাদের হৃদয়ে সোভিয়েত বেঁচে আছে।

কিন্তু প্রশ্নটা আসে এই যে শ্রমিকশ্রেণীর একনায়কতন্ত্রের যে সোভিয়েত মডেলকে আমরা মডেল হিসেবে দেখি, এখানে আদর্শবিচ্যুত দূর্নীতিগ্রস্ত লোকেরা মেজরিটি পেলে কি হতে পারে? ধরুন যেমন উত্তর কোরিয়া, ৬০ এর দশকেই অফিসিয়ালি ঘোষিত ভাবে তারা কম্যুনিস্ট আদর্শ ত্যাগ করে, যুচে নামক একটি জগা খিচুড়ি প্রতিষ্ঠা করে, তার ফলস্বরূপ উত্তর কোরিয়া আজ পুঁজিবাদহীন কিন্তু একটি পরিবারতান্ত্রিক রাজতন্ত্রে পরিণত হয়েছে।  শ্রমিক শ্রেণীর একনায়কতন্ত্রকে আরও স্বতঃস্ফূর্ত, স্টেবল, এবং মাস পার্টিসিপেশন ওয়ালা ব্যবস্থায় পরিণত করতে হবে। মাস পার্টিসিপেশন বলতে লাতিন আমেরিকা খুব ভালো কাজ করছে, তারা পপুলার কমিউনিস্ট পার্টি তৈরী করছে। অন্যদিকে চীন, সেখানে পুঁজিপতি আছে, পুঁজিবাদ আছে, কিন্তু কমিউনিস্ট পার্টির কন্ট্রোল রয়েছে সেসবের ওপর, দেখতে হবে চীনের ভবিষ্যৎ।

মোট কথা মার্ক্সবাদীরা ভুল কে এড়িয়ে যায় না, সেটা স্বীকার করে এবং সমাধান করার চেষ্টা করে, ব্লেমগেম খেলে না। আরও ভাবতে হবে আমাদের। তাই ভাববাদী না তথ্যনির্ভর কারণ খোঁজার চেষ্টা করলাম, বিরোধিতা থাকলে জানান। 
আর আমরা যারা বামপন্থী, যারা একটা বয়সের পর উঠতে বসতে একটাই স্বপ্ন দেখেছি, তাদের একটা সেভিয়েত পতনে স্বপ্নভঙ্গ হবে না। গর্বাচেভ, বরিস ইয়েলিৎসিনরা কমিউনিস্ট আদর্শকে ভেঙে ফেলতে পারবে না। ক্রেমলিনে আবার কাস্তে হাতুড়িই উড়বে।

রবিবার, ২০ ডিসেম্বর, ২০২০

কৃষক আন্দোলন ~ অনির্বান অনীক

আজ পবন দুজ্ঞালের গল্প বলি আপনাদের। শাহজাহানপুর সীমান্তে রাজস্থানী কৃষকদের জান কবুল, মান কবুল হিম্মতের ছবি আমরা দেখেছি। পবন রাজস্থানের অনুপগড় কেন্দ্র থেকে সিপিআই(এম)'এর বিধায়ক ছিলেন। ২০১৮ সালে পরাজিত। সর্বভারতীয় কৃষি-শ্রমিক ইউনিয়নের সম্পাদক। মোদ্দা কথা রাজস্থান সিপিআই(এম)'এর গুরুত্বপূর্ণ নেতৃত্ব।

ঘরসনা, গঙ্গানগর থেকে রাজস্থান-হরিয়ানা সীমান্তে আগত প্রথম জাঠাটি এসেছে পবনের নেতৃত্বে। ট্র্যাক্টরে করে ৬০০ কিলোমিটার পথ। ভুখা মানুষ। দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া গরীব "ছোটোলোকের" দল। পবনের নেতৃত্বে ২ দিন ধরে পাড়ি দিয়েছেন। সঙ্গে এনেছেন ৫ মাসের রেশন। খাবার-দাবার জোগাড়ের দায়িত্বে লাল ঝাণ্ডা। কিষান সভা, কৃষি-শ্রমিক ইউনিয়ন, সুশীল-লিবেরাল সমাজে বহুনিন্দিত সিপিআই(এম)। আলপথ থেকে গলিপথ - দেশের সম্বিৎ ফেরানোর লড়াইয়ের এই শরিকদের নিয়ে পবন একা আসেননি,  সাথে এসেছে পবনের গোটা পরিবার। 


বর্তমানে পবনের দায়িত্বে কৃষক বিক্ষোভের অন্যতম প্রধান কমিউন। এই দেশের রাজপথে, হৃদযন্ত্রে আলোড়ন তুলে আন্দোলনে সামিল হাজারো অন্নদাতা কৃষকের  অন্নের দায়িত্ব কিষান সভা,বিভিন্ন আঞ্চলিক সংগঠন, মসজিদ এবং গুরদোয়ারা পরিচালিত লঙ্গরখানাগুলি কাঁধে তুলে নিয়েছে। এই কমিউনের লঙ্গরখানা তার মধ্যে অন্যতম প্রধান ভূমিকা পালন করছে। পবন, তাঁর স্ত্রী , কন্যা হাতে হাত মিলিয়ে আজ  এই কমিউনে যুদ্ধ লড়ছেন। পবন ব্যস্ত থাকেন রান্নার কাঠ সংগ্রহে, সাহায্য করেন রান্না-বান্নায়, খাদ্যবিতরণে। তাঁর স্ত্রী এবং কন্যা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সাহায্য করেন সবার জন্য রান্না-বান্নায়, সব্জি কুটতে।     
 
খোলা আকাশের নীচে দিল্লী সীমান্তে তাপমাত্রা  চলে যায় শূণ্য ডিগ্রিরও নীচে। শীতল প্রান্তরে অন্নদাতারা তখনো দিয়ে চলেন দিল্লির কৃষক আন্দোলনের লিটমাস টেস্টের রিপোর্ট কার্ড। তবু অন্নদাতার মুখে লেগে থাকে হাসির টুকরোখানি।  দিল্লী সীমান্তে যখন ঊষাকাল, কমিউনিটি কিচেনের দায়িত্ব শীতের ভোরের সুখশয্যা থেকে টেনে তোলে পবনকে। প্রতিটি ভিডিওতে কর্মব্যস্ত পবনের মুখে ছুঁয়ে থাকে এক টুকরো মিষ্টি  হাসি। পুলিস ব্যারিকেডে, ট্র্যাক্টরের উপরে পবনের ছোট্ট মেয়েটি উড়িয়ে দেয় লাল ঝাণ্ডা। সংসদীয় রাজনীতির পাটিগণিতে তুরুপের তাস না হয়েও, প্রতিবারের মত খেটে খাওয়া  মানুষের জীবন-জীবিকার যন্ত্রণার শীতলপাটি হওয়ার দায়িত্ব তো পবনের মত বামপন্থী নেতৃত্বেরই কাঁধে।

এ শুধু বিক্ষোভ নয়, এ এক উৎসব। বিপ্লবের উৎসব। লাল সেলাম।
 
[ অবিন দত্তগুপ্ত র ইংরেজি পোস্ট থেকে আমার অনুবাদ]

শনিবার, ১৯ ডিসেম্বর, ২০২০

গিরগিটি বনাম লাল ঝান্ডা ~ সুশোভন পাত্র

শুভেন্দু অধিকারী বিজেপি জয়েন করল। মহম্মদ ইলিয়াস রয়ে গেলো।
ওহ, ওয়েট! আপনি বোধহয়য় মহম্মদ ইলিয়াস কে চিনতে পারছেন না। তাই তো? স্বাভাবিক। মিডিয়া তে শুভেন্দুর মাঞ্জা দেওয়া পাঞ্জাবি আর অমিত শাহ'র হেলিকপ্টার –এর বাইরে মহম্মদ ইলিয়াসের 'সাধারণ' রাজনৈতিক জীবনে ফোকাস করার মত আপনার সময় কোথায় বলুন!
১১ বছর আগের একটা স্টিং অপারেশন। নন্দীগ্রামের সিপিআই'র বিধায়ক মহম্মদ ইলিয়াসের হাতে প্রায় জোর করেই গুঁজে দেওয়া হল ১০,০০০ টাকা। বিধানসভায় জমা পড়ল স্টিং অপারেশনের সিডি। চিত্রনাট্যর স্ক্রিপ্ট মেনেই, স্বাধিকার ভঙ্গের নোটিশ আনলেন নারদা কাণ্ডে অন ক্যামেরা ৫লাখ ঘুষ খাওয়া সৌগত রায়। স্বাধীন ও নিরপেক্ষ তদন্তের স্বার্থে পদত্যাগ করলেন ইলিয়াস।
আচ্ছা, মনে করুন তো ঐ স্টিং অপারেশনে করেছিল কোন মিডিয়া? সুদীপ্ত সেনের সারদার চিট ফান্ডের কালো টাকায় ফুলে ফেঁপে ওঠা চ্যানেল টেন। ঐ স্টিং অপারেশনে সাংবাদিক কে সেজেছিলেন? তৃণমূলের প্রাক্তন, বিজেপির বর্তমান কচিনেতা শঙ্কুদেব পাণ্ডা। আর ঐ স্টিং অপারেশনের মাস্টার মাইন্ড কে ছিলেন? তৃণমূলের প্রাক্তন, বিজেপির বর্তমান 'জননেতা' শুভেন্দু অধিকারী। নন্দীগ্রামে বামফ্রন্ট বিরোধী বৃহত্তর ষড়যন্ত্রের পার্ট অ্যান্ড পার্সেল -স্টিং অপারেশন।
আজ, ২০২০-র ডিসেম্বর। আজ অবধি তদন্তে ইলিয়াসের বিরুদ্ধে প্রমাণ হলনা কিছুই। হওয়ার ছিলোওনা। আজ যখন শুভেন্দু তৃণমূল থেকে বিজেপি হলেন তখন গুরুতর অসুস্থ ইলিয়াস। দু-বিঘা জমি বেঁচে তাঁর চিকিৎসা চলছে। সংসার চলে কোনওমতে, বিধায়কের পেনশনে। কিন্তু আজও আদর্শের সাথে এক ইঞ্চি আপোষ করেননি ইলিয়াস। আজও লাল ঝাণ্ডার রাজনীতি থেকে এক পা সরে আসেননি ইলিয়াস। আজও ইনকিলাবি স্লোগানে সমাজ পরিবর্তনের ফিনিক্স স্বপ্ন বন্ধক দেননি ইলিয়াস।
সুশান্ত ঘোষের দিকে আঙুল দেখিয়ে বন্ধু আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল, "ঐ লোকটাই কঙ্কাল কাণ্ডের নায়ক না"। বলেছিলাম "মিডিয়া বলে। আমরা বলি না। বিশ্বাসও করি না"। দীর্ঘ আইনি লড়াইর পর আমাদের বিশ্বাসটাই সঠিক প্রমাণিত হয়েছে। CID তথাকথিত 'কঙ্কাল কাণ্ডে'র DNA টেস্টের রিপোর্ট প্রকাশ্যে আনতে পারেনি, অভিযোগের প্রামাণ্য নথি আদালতে জমা দিতে পারেনি, পুলিশও চার্জশিট গঠন করতে পারেনি। আর তাই হাজার চেষ্টা করেও সুশান্ত ঘোষ কে নিজের ভিটে থেকে উৎখাত করার চক্রান্ত সফল হয়নি।
সেদিন মিথ্যে মামলায় সুশান্ত ঘোষ গ্রেপ্তার হওয়ার পর, এই শুভেন্দু অধিকারীই বলেছিলেন "জঙ্গলমহলে লাল ঝাণ্ডা ধরার লোক থাকবে না"।  ৯ বছর পর জঙ্গলমহলে ফিরেছেন সুশান্ত ঘোষ। ধামসা-মাদল বেজেছে। মিছিল সেজেছে। মঞ্চ বেঁধে মিটিংও হয়েছে।
যে মঞ্চে ছিলেন ছিতামণি সরেন। ছিতামণি সরেন সালুকর মা। ঐ যে সালকু'র গলায় ছ-খানা টাঙ্গির কোপ পড়েছিল, লাশটা লালগড়ের জঙ্গলে পাওয়া গিয়েছিলো; সেই সালুকর মা। শরীরের চামড়া পচে গলে যাচ্ছে, পোকাতে কুরে খাচ্ছে সারা দেহ, চারিদিকে দুর্গন্ধ; অথচ মাওবাদী'দের ফতোয়ায়, বৃদ্ধা বিধবা মা'র শত অনুরোধেও, যে সালকুর মৃতদেহ সৎকারের সাহস করেননি ধরমপুর গ্রামের কেউ; সেই সালুকর মা! সিপিআই(এম) মধ্যমকুমারি শাখার পার্টি সদস্য ছিল যে সালকু; সেই সালুকর মা!
সালকুর খুনের পর এই শুভেন্দু বলেছিলেন, "ও সব সিপিএম-র গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব"। আজ শুভেন্দুর সৎ সাহস আছে নাকি একবার ছিতামণি সরেনের মুখোমুখি দাঁড়ানোর। হিম্মত আছে লালগড়ের পার্টি অফিসে আজও যে এক টুকোর লালপতাকা সালকুর রক্ত গায়ে মেখে পতপত করে ওড়ে সেটার দিকে মাথা তুলে তাকানোর?
শুভেন্দু অধিকারীর বিজেপি জয়েন করল! ছিতামণি সরেন রয়ে গেলো।
কদিন আগে হাসপাতালে জ্ঞান ফিরতেই বুদ্ধবাবু নাকি জিজ্ঞেস করেছিলেন, তাঁকে আলাদা VIP পরিষেবা দিতে গিয়ে সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন চিকিৎসা পরিষেবার কোন ক্ষতি হচ্ছে নাকি? আচ্ছা ইনিই কি সেই বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য যে লোকটার "আমরা ২৩৬ ওরা ৩৬"-র গালভরা মন্তব্যে মিডিয়া ঔদ্ধত্য'র মহাভারত লিখেছিল? ইনিই কি সেই বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, নন্দীগ্রামে দাঁড়িয়ে যার সম্পর্কে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, "বুদ্ধদেবের পাঞ্জাবি তে রক্তের দাগ" –বলতেন? ইনি কি সেই বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য যার সম্পর্কে শুভেন্দু অধিকারী "খুনি বুদ্ধর ফাঁসি চাই" স্লোগান দিয়ে মেদিনীপুরের রাস্তায় মিছিল বের করতেন?
বুদ্ধবাবুর তো নিশ্চয় আজ কোন ব্যক্তিগত রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা নেই? ভোটে জিতে মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার অধরা কোন স্বপ্ন নেই? অমুক কমিটির তমুক মেম্বার হয়ে আখের গোছানর ব্যাপার নেই? নিদেনপক্ষে প্রোমোট করার জন্য নাদুস-নুদুস একটা ভাইপোও নেই? তবুও মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে কোনক্রমে ফিরে আসা এই লোকটা জ্ঞান ফিরতেই হাসপাতালের সাধারণ মানুষের অসুবিধার কথা কেন জিজ্ঞেস করছে বলুন তো?
উত্তর খুঁজবেন। একদিকে এই মহম্মদ ইলিয়াস, ছিতামনি সরেনরা। আর অন্যদিকে মিডিয়ার বানানো মুকুল রায় কিম্বা শুভেন্দু অধিকারীর মত 'দোর্দণ্ডপ্রতাপ' তৃণমূলর প্রথম সারির নেতারা। একদিকে সব হারিয়েও লালঝাণ্ডাতেই আস্থা রাখার স্পর্ধা। আর অন্যদিকে ঘুষ খেয়ে, দলের সেকেন্ড ইন কম্যান্ড না হতে পেরে; লাইন দিয়ে বিজেপি-তে গিয়ে আখের গোছানোর ধান্দা। পার্থক্যটা কোথায় বলুন তো? সততার? রাজনৈতিক আদর্শের? না মূল্যবোধের? উত্তর খুঁজবেন।
আজকাল 'সততা', 'রাজনৈতিক আদর্শ', 'মূল্যবোধ' -শব্দ গুলোই বড্ড ক্লিশে হয়ে গেছে রাজনীতি তে। অর্ণব গোস্বামী, সুধীর চৌধুরী, সুমন দে'র সৌজন্যে আপনারও মনে হতে শুরু করেছে শুভেন্দু ইন্সটলমেন্টে বিজেপি তে যাবে –সেটাই তো রাজনীতি। 'ভাগ মুকুল ভাগ' বলা বিজেপি মুকুল কে সংগঠনের মধ্যমণি করে পুষে রাখবে -সেটাই তো রাজনীতি। তোয়ালে মুড়ে মেয়র ঘুষ খাবে -সেটাই তো রাজনীতি। নেতা-মন্ত্রীরা আদর্শ বেচে ভোটের মরশুমে গিরগিটির মত রং বদলাবে -সেটাই তো রাজনীতি।
আসলে এই গিরগিটীময় রাজনীতির রসদ আছে আপনার চারপাশেই। আপনার পরিবারেই, আপনার বন্ধু মহলেই। দেখবেন এই কদিন আগেও আপনার দুঃসম্পর্কের যে আত্মীয় তৃণমূলের শুভেন্দু কে সকাল-সন্ধ্যা খিস্তি করছিল, তারাই কাল থেকে সবার আগে গায়ে শুভেন্দুর নামাবলী জড়িয়ে বসে আছে, নির্দ্বিধায়! আপনার যে বন্ধুরা তৃণমূলের দুর্নীতি নিয়ে চায়ের দোকানে মাতিয়ে দিচ্ছিল তারাই মুকুল রায়ের ঘুষ খাওয়ার ভিডিও দেখে মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছে, নিঃসংকোচে! অবিকল মানুষের মত দেখতে এই প্রাণী গুলোই আসলে গিরগিটী। আদ্যোপান্ত ধান্দাবাজ। আপাদমস্তক সুবিধাবাদী।
তাই কেবল শুভেন্দু-মুকুল নয়, যে রাজনীতি, যে রাজনৈতিক দল এই গিরগিটীদের দল চালানোর দায়িত্ব দেয়, নেতা-মন্ত্রী বানিয়ে মাথায় তুলে নাচে; আর আমার চারপাশে যে মানুষ গুলো সেই রাজনীতি সমর্থন করে, গিরগিটীদের নেতা মানে, এদের প্রত্যেক কে আমি ঘেন্না করি। আমার গর্ব, আমার অতিক্ষুদ্র রাজনৈতিক সামর্থ্যে, আমি এদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে লড়াই করি।

রাত্রি এসে যেথায় মেশে ~ শুভলক্ষী গোস্বামী





*************
আমরা যারা শান্তিনিকেতন আশ্রমকে ভালবাসার আঁধারে জড়িয়ে আজ ও বেঁচে আছি, সে থাকা না থাকার সামিল হয়ে দাঁড়িয়েছে আমাদের কাছে। সারা দিনের ক্লান্তির কালো ছায়া ঘনিয়েছে এসেছে আশ্রমিকদের মনে প্রাণে। প্রভাতের সূর্য কিরণ মনে হয় এক বিষাদের সুর বাজিয়ে চলেছে।।শান্তির নীড় হারা পাখি উড়ে চলে শান্তির খোঁজে। আজ অন্তরে একটি গান‌ই গলা ছেড়ে গাইতে ইচ্ছে করছে,
   "কাঙাল আমারে কাঙাল করেছ আরো কী তোমার চাই।" সত্যি আমাদের সব হতে আপন আমাদের শান্তিনিকেতনের রূপ রঙ সৌন্দর্যের লীলাভূমি সব হতে আপন, তার রূপের সৌন্দর্যে মুগ্ধ সারা বিশ্ববাসী! সেই সৌন্দর্যকে নানা রঙের তুলির আঁচড় কাটতে গিয়ে নিজেদের অপদার্থতার পরিচয়ে পরিচিত করে তুলতে দ্বিধাবোধ করছেন না। উত্তাল সমুদ্রের ভয়ঙ্কর ঢেউ আছড়ে পড়ছে শান্তিনিকেতন আশ্রমে। আমাদের স্মৃতি বিজড়িত দিন,কাল,সব ভাসিয়ে নিয়ে চলেছেন দন্ডায়মান বিদ্যুৎ স্তম্ভ। স্তম্ভিত আপামর  বিশ্ববাসী বাঙালি! গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পদচিহ্ন আঁকা শান্তিনিকেতন। সেই আম্রকুঞ্জ, শালবীথি ,ছাতিম তলা, উত্তরায়ণ সব ভবনে কান্নায় ভেঙে পড়েছে দাও আমায় মুক্তির স্বাদ নিতে এই আকাশে বাতাসে জলে স্থলে উপাসনালয়ের দ্বারে।আজ ভুলুন্ঠিত হয়ে পড়ে আছি তোমাদের সেই পুরনো ঘন্টা তলা !আমি!!এই দেখ আমার ভগ্নদশা। ঘন্টা ধ্বনিত হবে কী করে আমি শরশয্যায় শায়িত।এখান থেকে কার বাড়ি চলে যাব কেউ জানতে পারবে না। তখন  চুরি হয়ে গেছে রাজ কোষে চোর চাই বলে চিৎকার চেঁচামেচি করে পাওয়া যাবে না চোর।চোর তো ঘরে বাইরে কাকে ধরি! এই খেলা চলতে থাকবে! বিদ্যুতের আলো সেখানে এখন পৌঁছতে পারেনি। আমি তাই আলো ফেলে দেখিয়ে দিলাম।চোর ধরতে যদি একটু সুবিধা হয়।

শুক্রবার, ১৮ ডিসেম্বর, ২০২০

কৃষক আন্দোলন ও হান্নান মোল্লা ~ মধুশ্রী বন্দোপাধ্যায়


২০১৮-র মার্চ মাসে মহারাষ্ট্রের কিষান লং মার্চ মনে আছে? প্রায় ৪০,০০০ থেকে ৫০,০০০ কৃষক মহারাষ্ট্র বিধানসভাকে ঘেরাও করার জন্য নাসিক থেকে মুম্বইয় যেতে ১৮০ কিলোমিটার পথ হেঁটেছিলেন। 
ওই অন্দোলনের স্বতঃস্ফূর্ততা, দেশের প্রান্তিক মানুষের প্রধান বাণিজ্য নগরীতে আগমন, তাদের ছেঁড়া চপ্পল, টুটাফাটা চরণযুগল, ধ্রুপদী উপন্যাসের ভাবগম্ভীর আবহাওয়া সৃষ্টি করে। সেই শান্তিপূর্ণ আন্দোলন অনেকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে, অনেক গন্যমান্য দেশের দরিদ্রতম মানুষের পাশে থাকবার প্রতিশ্রুতি দেন।
তৎকালীন মহারাষ্ট্র সরকার দাবি পূরণের আশ্বাস দেওয়ার পরে এই আন্দোলন প্রত্যাহার করা হয়। তবে অনেকেই জানেন না যে, সরকার ওদের দাবিগুলি মেনে নিলেও পরে কার্যকর করে নি।

ওই একই বছরে রাজস্থানে ন্যাশনাল হাইওয়ে ৫২-তে কয়েক হাজার কিসান বসুন্ধরা রাজে সরকারের কৃষকবিরোধী আইন ও পুলিশী দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলেন। কৃষিকাজের ব্যয় বৃদ্ধি, লাভ হ্রাস এবং দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির ফলে কৃষকরা উদ্বিগ্ন।

২০১৮-র শেষের দিকে নভেম্বরের শীতে লাল পতাকা ও ব্যানার বহনকারী কৃষকদের সমুদ্র পূর্ব দিল্লির ইন্দ্রপ্রস্থ পার্ক থেকে মধ্য দিল্লির রামলীলা ময়দান দখল করতে এগিয়ে এসেছিল।
তখন এক পুলিশকর্তা তার স্বাভাবিক উন্নাসিকতায় বলেছিলেন, "আমি বাজি ধরতে পারি যে এখানকার ৮০% কৃষক তাদের দাবি কী এমনকি তাও জানে না"। কয়েক মুহুর্ত পরে, হরিয়ানা থেকে তিনজন কৃষক তাকে বললেন, "এখনই আমাদের জিজ্ঞাসা করুন, আমরা আপনাকে বলে দেব আমাদের আন্দোলনের দাবিদাওয়াগুলি।"

২০১৩-তে বিবিসির রিপোর্ট অনুযায়ী ১৯৯৫ থেকে ২০১১-র মধ্যে অন্ততপক্ষে ২.৭ লক্ষ কৃষক আমাদের দেশে আত্মহত্যা করেছে।

শেষ কয়েক বছর ধরে সারা ভারতবর্ষে একের পর এক কৃষক আন্দোলন চলেছে। দাবি দাওয়া হয়তো ভিন্ন, তবে মূল সুর বাধা আছে এক তারে। ওরা দেশের মানুষকে মেসেজ দিতে চায় যে, কৃষকরা বিপন্ন। আর ওরা বিপন্ন হলে আমরা কেউ ভাল থাকব না। 

এই ফাঁকে একটা কথা একটু আলোচনা করা দরকার। কীভাবে সম্ভব হচ্ছে সারা ভারত জুড়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বিভিন্ন দাবিদাওয়া নিয়ে কৃষক আন্দোলন? কারা সংগঠিত করছে এদের?

২০১৭-তে ২৫০-টি কৃষক সংগঠন নিয়ে তৈরি হয়েছে 'অল ইন্ডিয়া কিষান সংঘর্ষ কোঅর্ডিনেশন কমিটি'। 
এই কমিটি এই বছরে সেপ্টেম্বর মাসে পাশ করা কেন্দ্রীয় সকারের তিনটি কৃষি আইনের বিরুদ্ধে আন্দোলনের ডাক দিয়েছে। আর তাতে সহস্র সহস্র কৃষিজীবী মানুষ যোগ দিয়েছেন। পঞ্জাব, হরিয়ানা সহ দেশের অধিকাংশ রাজ্যের কৃষক এই আন্দোলনের পাশে আছেন।

এ এক যুগান্তকারী সময়।

আমাদের এই বহুধা বিভক্ত দেশে যেখানে প্রতিটি রাজ্যে আছে কয়েকটি আঞ্চলিক দল সেখানে এই আন্দোলনের নেতৃত্ব ধরে রাখা তো সহজসাধ্য কাজ নয়।

সারা দেশ জুড়ে এই ধরণের মানুষের আন্দোলনে আছেন বামপন্থী আন্দোলনের নেতৃত্ব।

হান্নান মোল্লা 'সারা ভারত কিষান সভার সম্পাদক'। এই হাওড়ার মানুষ। বাবা ছিলেন জুট মিলের শ্রমিক। তায় আবার শৈশবেই পিতৃহারা। মায়ের সঙ্গে মামা বাড়িতে মানুষ। জুনিয়ার মাদ্রাসা থেকে প্রেসিডেন্সি কলেজ। এই তার পূর্ববর্তী জীবন।
আর বর্তমানে দিল্লি পুলিশ তার বিরুদ্ধে নোটিস জারি করেছে কৃষক আন্দোলনে নেতৃত্বে দেবার জন্য। কারণ সারা ভারত জুড়ে বিভিন্ন কৃষক সংগঠনগুলিকে একত্রিত করে, তাদের একসাথে চলতে শিখিয়েছে তার মত কিছু বামপন্থী মানুষ। তাদের নেতৃত্বে বিগত কয়েক বছরে কৃষক আন্দোলনগুলি ব্যাপক ভিত্তি পেয়েছে। এই নেতৃত্ব বুঝিয়ে দিয়েছে এবং নিশ্চিত করেছে যে কৃষকের দাবিদাওয়াকে আর পাশ কাটিয়ে যাওয়া যাবে না।

এই আন্দোলনগুলি দেশের প্রান্তিক মানুষের জন্য সংগঠিত হয়েছে। এতে যারা যোগ দিয়েছেন, মনে ভাববার কোন কারণ নেই যে, তারা সকলে বামপন্থী। অনেকে সক্রিয় রাজনীতি, রাজনৈতিক নেতৃত্বকে সরিয়ে রাখবার বাসনাই প্রকাশ করেছেন। তবে সারা ভারত কিষান সভা ও তার নেতৃত্বকে নয়। এরা ভালোই জানে, এদের ছাড়া আন্দোলনে সফলকাম হওয়া মুশকিল।

"In the ongoing farmer agitation, under the umbrella of the All India Kisan Sangharsh Coordination Committee (AIKSCC), Hannan brought together unions from different parts of the country — not just from Punjab. He has made farmer agitations broad-based in the last few years and ensured that they are not sidelined." বলেছেন সুরিন্দর সিং  কিষান সভার রোহতকের সম্পাদক।

আর অভীক সাহা, 'অল ইন্ডিয়া কিষান সংঘর্ষ কোঅর্ডিনেশন কমিটি'র সম্পাদক বললেন,"He's the most soft spoken of all the farmer leaders and has an amazing grasp of the issue as he has been a farmer leader for 40 years."

শেষ করি ছোট্ট একটা কথা দিয়ে। বাংলায় ২১-এর ভোট নিয়ে টানটান উত্তেজনা। টিভির সামনে বসলে মনে হবে টি-২০ ম্যাচ চলছে। কে কবে কোথায় আছেন সেসব মনে রাখতে মাইন্ড ম্যাপ তৈরি করতে হয়। 
এসব চলছে একটি কারণে, ভোট। ক্ষমতা দখল।

তার পাশে এই দীর্ঘ মেয়াদি আন্দোলনগুলি বড়ই পানসে। তবে এই দীর্ঘমেয়াদি আন্দোলন ছাড়া কোথাও মানুষের কোন দাবিদাওয়া সফলকাম হয় নি। দাবি আদায়ে গিমিক চলে না। ধর্ম, বর্ণ, জাতের লড়াইও চলে না। দাঁতে দাঁত চেপে লড়ে যেতে হয়। দিল্লির শীতের রাতে বা মহারাষ্ট্রে খর রদ্দুরে।

এই রাজ্যে বামপন্থীরা দীর্ঘদিন ক্ষমতায় ছিল। তাদের আন্দোলনে ভাটা পড়লে চলবে না। দেশের কৃষকদের থেকে এই রাজ্যকে শিখতে হবে।
মানুষের পাশে তাদের থাকার অঙ্গীকার ভোটের জন্য নয়। ক্ষমতার জন্য নয়।

ক্ষমতা চাই। তবে তা চাই প্রান্তিক মানুষের উন্নয়নের জন্য। যেমন করে একদিন এই রাজ্যে দেশের মধ্যে প্রথম পঞ্চায়েত ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়েছে, বর্গা প্রথা এসেছে, গ্রামের মানুষ প্রথম পয়সার মুখ দেখেছে। 
সেই আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে হবে তাদের।

আর হ্যাঁ, সেই আন্দোলনে আসবে না হিন্দু কি মুসলমান প্রশ্ন, সে গ্রামের না শহরের মানুষ। অথবা সে কতটা জোরে আর কতটা খারাপ ভাষায় চেঁচিয়ে গালি দিতে পারে বিরোধীদের। 
সে হবে মাটি থেকে আন্দোলনের মাধ্যমে উঠে আসা নেতৃত্ব।

যেমন হান্নান মোল্লা।

বুধবার, ১৬ ডিসেম্বর, ২০২০

ট্যাবলেটের ডাইরি ~ অংশুমান মজুমদার

সভা শেষে কাকাকে জিজ্ঞাসা করলুম, 'তিনি কোথায়?' কাকা বলল, 'কে?' আমি মুখ ফসকে নীলকর বলেই শুধরে বললুম, 'ধনকড়।' কাকা বলল, 'তিনি গা ঢাকা দিয়ে চোরের সংখ্যা গুনছেন, কৃষকদের দাবিপত্র নিতে ভয় পেয়েছেন।

কগজেই দেখেছি আজ চাষিদের আজকে রাজভবন ঘেরাও প্রোগ্রাম ছিল। অফিস থেকে কাকার ফোন। বলল, 'যাবি?' আমি রাজি হতেই ফোনের ওধার থেকে কাকার গলা: তাহলে ১০ মিনিটের মধ্যে রেডি হয়েনে আমি তুলে নেব।

অটোটা শিয়ালদা ব্রিজের ওপর থেকে আর এগোতে পারছিলনা। কাকা বলল, 'চল এখানেই নেমে যাই, শিয়ালদা কাছেই, হেঁটে মেরে দিই'। শিয়ালদা স্টেশনে ঢোকার মুখটাতে গিয়ে দেখি মিছিল শুরু হয়ে গেছে। কাকা বলল, 'তাহলে আমরাও পা মেলাই'।

আমি অবশ্য মিছিলের আগা বা শেষ কোনও দিকটাই দেখতে পারিনি। অনেক মানুষ। কাকা বলল, সবাই কে লক্ষ্য কর, দেখবি চাষি, মজুর, ছাত্র, বেকার যুবক, মহিলা সব অংশের মানুষই এই মিছিলে হাঁটছে।

সত্যিই বেশভূষা দেখে, স্লোগান শুনে, ফেস্টুন দেখে খানিকটা বোঝা যাচ্ছে যে ভাঙর থেকে চাষিরা, নদীয়া থেকে ছাত্ররা, ট্রাম কোম্পানির কর্মচারী সবাই মিছিলে।

আমরা যখন রাসমণি রোডে পৌঁছুলুম, সভা সবে শুরু হয়েছে। কত মানুষ! ভীড় ঠেলে এগিয়ে কাকা বলল 'এখানেই দাঁড়াই।' আমাকে বলল, 'সভায় মূল কথাগুলি নোট করবি।' 'রাতে লিখে আমায় দেখাবি।' আমি বললুম, তাহলে কালোজাম কনফার্ম করতে হবে। কাকার মুখ থেকে শুধু 'হুম' শব্দটি বেরুল।

যিনি মঞ্চে বলছিলেন তার নাম জিজ্ঞাসা করতে কাকা বলল ইনি রাজ্যের কৃষক সভার নেতা অমল হালদার। আমি শুরু থেকে দেশের কৃষক নেতা হান্নান মোল্লা সবার বক্তব্যই শুনেছি। কয়েকটা পয়েন্ট নোট করেছি।

১। স্বাধীনতার পর দেশের সবচেয়ে বড় শান্তিপূর্ণ কৃষক আন্দোলন। 
২। কৃষক এবং কৃষি বিরোধী তিনটি আইনই বাতিল করার দাবি থেকে কৃষকরা এক চুল নড়বে না।
৩। অল ইন্ডিয়া কিষাণ সংঘর্ষ কো-অর্ডিনেশন কমিটির ব্যানারে দেশের কমবেশি ৫০০ টি কৃষক সংগঠন, ফেডারেশন লড়াই করছেন।
৪। দেশের কৃষি নীতি কৃষক কেন্দ্রিক নয়। বরং বৃহৎ ব্যবসায়ীদের স্বার্থ দেখার নীতি। 

৫। এই কৃষি নীতি এমনই যে সারাদিন খেটেও কৃষকরা দিনগুজরান করতে হিমসিম খাচ্ছে।
৬। বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার স্বাধীনতার পর সবচেয়ে বেশি কৃষক বিরোধী। 
৭। এই সরকারের দল ক্ষমতায় আসার আগে স্বামীনাথন কমিশনের সুপারিশ কার্যকর করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল কিন্তু ক্ষমতায় এসেই চোখ ওল্টায়।
৮। তিনটি কৃষি সংক্রান্ত আইনের ভিত্তি কৃষি নয় বরং কর্পোরেট ভিত্তি।
৯। সারা দেশের মত এই রাজ্যেও ২১৯ জন কৃষক আত্মহত্যা করেছে। রাজ্য সরকার সেই তথ্য হাপিস করে তিনগুন আয় বেড়ে যাওয়ার ভূয়া প্রচার করছে। 
১০। মিডিয়া দেশের কৃষক আন্দোলনের নামে ভুয়া প্রচার করে বলে খালিস্তানি আন্দোলন। কখনও পাকিস্তান আর চিনের ভূত দেখেছে। 
১১। সারা দেশের কৃষক আন্দোলনকে মর্যাদা না দিয়ে বলার চেষ্টা করেছে এই আন্দোলন শুধু পাঞ্জাবের।
১২। সরকার ভুয়া সংগঠন তৈরি করে এই আন্দোলন ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা করেছে।
১৩। কৃষকদের আন্দোলন প্রতিবাদ থেকে রাস্তায় প্রতিরোধের জায়গায় গেছে।
১৪।  অল ইন্ডিয়া কিষাণ সংঘর্ষ কো-অর্ডিনেশন কমিটির ছত্রছায়ায় থাকা  ৫০০ টি কৃষক সংগঠন, ফেডারেশনের মধ্যে আন্দোলনের রণকৌশল নিয়ে কোনও মতভেদ নেই।
১৫। কৃষি আইন বাতিলের দাবি থেকে দেশের কৃষক সংগঠনগুলি একচুলও নড়বে না। সংশোধন করার সরকারি প্রস্তাব বাতিল করেছে।
১৬। সরকার যে ভাবে লকডাউনের সময় আইন পাস করেছে তার সাথে তুলনীয় ডাকাত যেমন ডাকাতির জন্য রাতের অন্ধকার বেছে নেয়।
১৭। সরকারের কাছে একটাই দাবি কৃষি এবং কৃষক বিরোধী তিনটি কৃষি সংক্রান্ত আইন সহ বিদ্যুৎ বিল ২০২০ বাতিল করতে হবে। 

১৮। সমস্ত জিও পরিষেবা বর্জনের আহ্বান জানানো হয়েছে।
১৯। রাজ্যে রিলায়েন্সের মল, বিক্রয়কেন্দ্র, পেট্রোল পাম্পে পিকেটিং হবে।
২০। রাজ্যের কৃষকদের কাছে আইনের বিষয়বস্তুর বিবরণ বিস্তারিত ভাবে তুলে ধরতে হবে।
২১। দেশের কৃষক আন্দোলন ভাঙার জন্য শুধু পাঞ্জাবের আন্দোলন বলে যে অপপ্রচার চলছে তার যোগ্য জবাব দিতে হবে।
২২। সুপ্রিম কোর্ট কমিটি তৈরি করে কৃষকদের দাবির মিমাংসা করার প্রস্তাব অল ইন্ডিয়া কিষাণ সংঘর্ষ কো-অর্ডিনেশন কমিটির বাতিল করেছে।

সভা শেষে কাকা আমায় ডেকার্স লেনে নিয়ে গেল। এগ ডেভিল খেয়ে বাড়ি ফিরেছি। পয়েন্টগুলি ঠিকঠাক হলে কাল কালোজাম।

মঙ্গলবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০২০

তালাচাবি ~ অমিতাভ প্রামাণিক

বিয়ের এক বছর গড়াতে না গড়াতেই অন্ধকার নেমে এল আরদেশিরের পারিবারিক জীবনে।

বোম্বের ফোর্টে পঁচিশ-ছাব্বিশতলা বাড়ি সমান উঁচু রাজাবাঈ টাওয়ার তৈরি শুরু হয়েছে, যখন তার বয়স মাত্র এক বছর। বছর দশেক লেগেছে পুরো টাওয়ারটা বানাতে। এই রাজাবাঈ হচ্ছেন বোম্বের বিখ্যাত শেয়ার ব্যবসায়ী এবং 'নেটিভ শেয়ার অ্যান্ড স্টক ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশন'-এর প্রতিষ্ঠাতা (পরে যার নাম হবে বোম্বে স্টক এক্সচেঞ্জ বা বিএসই) এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে মেধাবী ছাত্রদের জন্যে স্কলারশিপ চালু করা প্রেমচাঁদ রায়চাঁদের মা। সাড়ে পাঁচ লাখ টাকা খরচা হয়েছে টাওয়ারটা বানাতে, তার মধ্যে দু-লাখ দিয়েছেন প্রেমচাঁদ। ইংরেজ স্থপতি একে বানিয়েছেন লন্ডনের বিখ্যাত বিগ বেনের আদলে। তার মাথা থেকে বোম্বের বহুদূর অবধি দেখা যায়, স্বাভাবিকভাবেই সেখানে ছেলে-ছোকরাদের ভিড় লেগেই থাকে।

তেইশ বছর বয়সী আরদেশিরের নবোঢ়া স্ত্রী উনিশ বছরের বাচুবাঈ ননদ (আরদেশিরের খুড়তুতো বোন) পিরোজবাঈকে নিয়ে চড়েছিল সেই টাওয়ারের মাথায়। সেখানে কী হয়েছিল, তা কেউ ঠিক জানে না, কেউ বলেছে সেখানে নাকি তাদের শ্লীলতাহানির চেষ্টা করেছিল কেউ, দুজনেই নিজের সম্মানরক্ষার্থে সেই উঁচু টাওয়ারের মাথা থেকে ঝাঁপ দিল।

পার্শি নিয়ম অনুসরণ করে তাদের মৃতদেহ রেখে দেওয়া হল পার্শি গোরস্থানে। চিল শকুনে খেয়ে গেল তাদের দেহাবশেষ।

সেটা ১৮৯১ সাল। ভগ্নহৃদয় আরদেশির ভেবে পাচ্ছিল না, সে কী করবে। তার ঠাকুরদা সোরাবজি গুথারজি আর বাবা বুর্জোরজির রিয়েল এস্টেটের ব্যবসা। ছয় ভাইবোনের সবচেয়ে বড় আরদেশির, বাবা-মায়ের ইচ্ছে সে বড় হয়ে নামী উকিল হয়। সেই লক্ষ্যে পড়াশুনাও করছে সে। সে সময় আফ্রিকায় ভারতীয় উকিলদের চাহিদা ভালো। মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী নামে এক বিলেত-ফেরত উকিল গেছেন দক্ষিণ আফ্রিকায় ১৮৯৩ সালে। তার পরের বছর আইনে ডিগ্রি পেয়ে আরদেশির কাজ পেল এক নামী সংস্থায়। এক ক্লায়েন্টের কেস লড়তে তাকে যেতে হল জাঞ্জিবারে।

কেস ভালোই এগোচ্ছিল, আরদেশিরের ক্লায়েন্টের পক্ষেই রায় যেত হয়ত। কিন্তু শেষদিকে আরদেশির বিপক্ষ উকিলের এক ক্রস-এগজামিনে আটকে গেল। প্রশ্নটা ছিল কোনো এক নির্দিষ্ট সময়ে তার ক্লায়েন্টের অ্যালিবাই সংক্রান্ত। আরদেশির তার ক্লায়েন্টের কথামত চলতে রাজি হল না, কেননা তার কোনো প্রমাণ তাদের বা তার কাছে নেই। ক্লায়েন্টের বক্তব্য, আরদেশির তাদের উকিল, তাকে তো তাদের কথামতই চলতে হবে। আরদেশিরের বক্তব্য, আমি আইনের রক্ষক, আমি সত্যসন্ধানী।

ক্লায়েন্ট বুঝে গেল, একে দিয়ে কাজ হবে না। তাকে বরখাস্ত করে অন্য উকিল নিয়োগ করল তারা। আরদেশির দেশে ফিরে এল, বুঝে গেল, তার পক্ষে উকিলগিরি সম্ভব নয়।

বোম্বে ফিরে এক বড়সড় ওষুধের দোকানে কাজে লেগে গেল আরদেশির। দোকানের মালিক ইংরেজ। কিছুদিন যেতেই মালিকের নজরে পড়ে গেল পরিশ্রমী, বুদ্ধিমান আরদেশির। মালিককে বলল, সে এই দোকানের প্রয়োজনীয় কিছু সামগ্রী নিজে তৈরি করতে চায়, যদি পারে তবে সেগুলো ইনি দোকানে রাখবেন কিনা। মালিক বললেন, সেগুলো যদি তাদের নির্দিষ্ট মান বজায় রাখতে পারে, অবশ্যই তিনি দোকানে রাখবেন, বিক্রি করবেন।

ছক প্রস্তুত করে পরের বছর আরদেশির গেল বাবার বন্ধু বড় ব্যবসায়ী মেরবানজি কামার কাছে। সে সার্জিক্যাল ইকুইপমেন্ট বানাবে, তার জন্যে টাকা ধার চাই। কামা তো শুনে অবাক! বাবার কাছে না গিয়ে আরদেশির কেন টাকার জন্যে এসেছে চাচাজির কাছে! আরদেশিরের স্পষ্ট জবাব, বাবার কাছে টাকা চাইলে বাবা তো সেটা উপহার দেবে, ফেরত চাইবে না। সে দান চায় না, ধার চায়, সে কিছু সময় পরেই পরিশোধ করে দেবে এই ধার।

কামা-র কাছ থেকে তিন হাজার টাকা ধার নিয়ে শুরু হল আরদেশিরের হাসপাতালে সার্জনদের ব্যবহারযোগ্য ছুরি-কাঁচি ইত্যাদির কারখানা। প্রতিদিন আরদেশির নিজে পরীক্ষা করে জিনিসপত্রের গুণাগুণ। যখন সমস্ত কিছু তার পছন্দমত হল, সে গিয়ে একদিন ডেকে আনল তার সেই ওষুধের দোকানের মালিককে – এই দেখুন, কী সুন্দর সার্জিক্যাল ইকুইপমেন্ট বানিয়েছি।

মালিক জিনিস দেখে খুব সন্তুষ্ট হল। জিজ্ঞেস করল, কবে সে অর্ডার নিতে পারবে। আরদেশির বলল, আর অতি অল্প একটু কাজ বাকি, এর ওপরে 'মেড ইন ইন্ডিয়া' ছাপ মারা। মালিক বললেন, তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে! এত উৎকৃষ্ট জিনিসে কেউ মেড ইন ইন্ডিয়া ছাপ মারে! 

আরদেশির বলল, আমি কি মিথ্যা বলছি নাকি, এগুলো সব এরা নিজেরা বানিয়েছে, এ তো মেড ইন ইন্ডিয়াই। ওষুধের দোকানের মালিক বললেন, আরে বাবা, এটা মার্কেটিঙের ব্যাপার, ভালো করে ভাবো, বোঝো। ইন্ডিয়া সম্বন্ধে আমি কিছু খারাপ তো বলছি না। অ্যান্টিক-ফ্যান্টিক কিনতে হলে ইন্ডিয়ার জিনিস ঠিক আছে, বড় বড় করে 'মেড ইন ইন্ডিয়া' লেখো তার ওপর। কিন্তু আধুনিক হাসপাতাল-উপযোগী যন্ত্রপাতি 'মেড ইন ইন্ডিয়া'! চলবেই না, কেউ কিনবে না। আমাকে ব্যবসা শেখাতে এসো না, যা বলছি তাই শোনো।

আরদেশির শুনল না। সার্জিক্যাল ইকুইপমেন্টের ব্যবসা অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়ে গেল তার।

মাথার ওপরে ধার, আরদেশির উপায় খুঁজতে লাগল নতুন কিছু করার। লোকের দোকানে কাজ করে তার পোষাবে না, তাকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। প্রতিদিন খবরের কাগজ খুঁটিয়ে পড়ে সে, যদি কোনো আইডিয়া পাওয়া যায়। এ ভাবেই একদিন নজরে পড়ল পর পর বেশ কয়েকদিন ধরে খবর হচ্ছে বোম্বের কিছু কিছু অঞ্চলে চুরিচামারি খুব বেড়ে গেছে। বাড়ি খালি রেখে কোথাও কয়েকদিনের জন্যে বেড়াতে গেলেই ফিরে এসে লোক দেখছে বাড়ি ফাঁকা, চোরে সব চুরি করে নিয়ে গেছে। শুধু বাড়িতে নয়, অফিস-কাছারিতেই একই সমস্যা। রাস্তা দিয়ে সারাদিন পুলিশের গাড়ি ছুটছে, চুরির নতুন নতুন খবর পেয়ে।

খোঁজখবর নিয়ে আরদেশির বুঝল, সমস্যাটা তালা-সংক্রান্ত। লোকে তালা ঝুলিয়ে বেড়াতে যায়, চোরে সেই তালা সহজে খুলে ফেলতে পারে। মানে, ভালো তালা, যা কোনোভাবেই খোলা সম্ভব না, যদি বানানো যায় তবে তার ভালো ব্যবসা হতে পারে।

আরদেশির আবার হাজির হল চাচাজি মেরবানজি কামা-র কাছে – চাচাজি, আপনার টাকা তো ফেরত দিতে পারছি না এখনই। খুব ভালো ছুরি-কাঁচি বানিয়েছিলাম, কিন্তু কিনতে চাইল না দোকানে। এবারে আমি তৈরি করতে চাই এমন তালা, যা কেউ খুলতে পারবে না। আমার আরও কিছু টাকা চাই।

কামা চুরিচামারির খবর কাগজে পড়েছিলেন। তিনি জানেন, আরদেশির কাজের ছেলে। তাও তাকে বাজিয়ে নিতে জিজ্ঞেস করলেন – হ্যাঁ রে, আমাদের পার্শিদের মধ্যে তালা বানাতে জানে কেউ? নাকি তুই-ই হবি প্রথম? আরদেশির বলল, প্রথম কিনা জানি না চাচাজি, তবে আমিই হব বেস্ট। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন।

ডজনখানেক কর্মচারী আর এদিক-ওদিক থেকে সংগ্রহ করা কিছু যন্ত্রপাতি নিয়ে একটা দুশো স্কয়ার ফুটের শেডে শুরু হল আরদেশিরের তালা তৈরির কারখানা, ১৮৯৭ সালে। আরদেশির এমন তালা বানাতে চায়, যা কেউ খুলতে পারবে না। এ তালার চাবি তৈরি হবে প্রথমে, তারপর সেই অনুযায়ী তালা। প্রত্যেকটা চাবি আলাদা, সুতরাং তালাও আলাদা। 'অ্যাঙ্কর' ব্র্যান্ডে সেই তালা বাজারে ছাড়া হল, প্রত্যেকটার সঙ্গে গ্যারান্টি যে এই তালা এর চাবি ছাড়া অন্য কিছু দিয়ে খোলা অসম্ভব।

বিপুল সাফল্য এলো এই তালার ব্যবসায়।

আরদেশির অবশ্য উপলব্ধি করল, দৈনন্দিন সমস্ত প্রয়োজনে এই অতি-সুরক্ষাবাহী তালার প্রয়োজন নেই। তার পরবর্তী পদক্ষেপ কমদামী, সিম্পল তালা। কিন্তু অ্যাঙ্করের চেয়ে এটা যে আলাদা, সেটা যাতে ক্রেতারা কেনার সময় বুঝতে পারে, সে জন্যে তালার বাক্সে লিখে দেওয়া, এতে কিন্তু অ্যাঙ্করের মত সুরক্ষার গ্যারান্টি নেই। তার সঙ্গে বিজ্ঞাপনে আরও যোগ করল সে – তালা কিনতে গিয়ে লিভারের সংখ্যা দেখে গলে যাবেন না। ভালোভাবে তৈরি একটা চার-লিভারের তালা বাজেভাবে তৈরি আট-লিভারের তালার চেয়ে অনেক অনেক বেশি সুরক্ষা দেয়।

আরদেশিরের জিনিসের গুণমান আর তার খোলামেলা বস্তুনিষ্ঠ বিজ্ঞাপন জনগণের আস্থা অর্জন করে নিল। একের পর এক নতুন নতুন ধরনের তালা ডিজাইন করে তার পেটেন্ট নিতে লাগল আরদেশির। এলো গর্ডিয়ান তালা, যার সঙ্গে দেওয়া হয় দুটো চাবি। দুটোর যে-কোনোটা দিয়ে তালাটা খোলা ও বন্ধ দুই-ই করা যায়। তবে কেবলমাত্র দ্বিতীয় চাবিটা দিয়ে এর ভেতরের সেটিং বদলে দেওয়া যায়, দিলে তখন প্রথম চাবিটা অকেজো হয়ে যায় কিন্তু দ্বিতীয় চাবি চলতেই থাকে। এর মানে, প্রথম চাবিটা হারিয়ে গেলে বা কেউ প্রথম চাবিটা কোনোভাবে 'কপি' করে নিলেও কোনো অসুবিধা নেই, দ্বিতীয় চাবি দিয়ে সেটিং বদলে ঐ তালাকেই নতুন-কেনা তালার মত ব্যবহার করা যায়, যেটা প্রথম চাবি দিয়ে খুলবে না আর। এর পর এলো ডিটেক্টর তালা। এর সঙ্গে দেওয়া চাবি ছাড়া এই তালার গর্তে অন্য যে-কোনো চাবি ঢোকালেই এর মধ্যে থেকে এক বোল্ট বেরিয়ে তালাটা জ্যাম করে দেবে, যা ছাড়ানো যাবে শুধু এই চাবি দিয়েই। এর অর্থ এর মালিক সহজেই বুঝে যাবে অন্য কেউ এই তালাটা খোলার চেষ্টা করেছিল, সে সাবধান হয়ে যাবে। এক বিদেশী – চার্লস চাব – এই ধরনের তালার পেটেন্ট করেছিলেন, কিন্তু তাতে ঐ বোল্টের জ্যাম ছাড়াতে দ্বিতীয় এক চাবি লাগত, আরদেশিরের তালায় সে সবের প্রয়োজন ছিল না, একটা চাবিতেই সব ব্যবস্থা। এরপর এল স্প্রিংবিহীন তালা, যাতে বহু ব্যবহারে তালার স্প্রিং আলগা হয়ে লিভারের নড়বড়ে হয়ে যাওয়া আটকানো গেল।

এর পাশাপাশি আরদেশির তার সংস্থার ছোট ছোট পুস্তিকা ছাপাতে লাগল। সেখানে পরিষ্কার লেখা – আমাদের সমস্ত তালাই আধুনিক প্রযুক্তিতে আধুনিক মেশিনে অন্তত পনের বছরের অভিজ্ঞ কর্মীদের দিয়ে প্রস্তুত। আমরা আমাদের সমস্ত পার্টস নিজেরাই তৈরি করি, এগুলো দেশের বা বিদেশের অন্য কোনো জায়গা থেকে কেনা নয়। কাজেই আমাদের তালা একদম স্বকীয় এবং আপনাকে দেবে সম্পূর্ণ সুরক্ষা।

তালা বিক্রি করতে করতেই আরদেশিরের খেয়াল হল, লোক সুরক্ষার জন্যে কেনে সেফ বা সিন্দুক। বাজারের সবচেয়ে ভালো কোয়ালিটির সিন্দুক মানে যেগুলো চোরে খুলতে পারবে না, সেগুলো। কিন্তু সেই সময়েই সানফ্রানসিস্কোয় এক বিশাল ভূমিকম্পের পর এমন বিশাল আগুন লাগল যে সেই আগুনেই লোকের ক্ষতি হল ভূমিকম্পের ক্ষতির চেয়ে অনেক বেশি। দুর্ভাগ্যজনকভাবে লোকের বহু দুর্মূল্য বস্তু যা রাখা ছিল সিন্দুকে, তা পুড়ে ছাই হয়ে গেল। আরদেশির বুঝল, সিন্দুক যদি অগ্নিনিরোধক করা যায়, তবে তার মূল্য অনেক বেড়ে যাবে। যেমন ভাবা, অমনি কাজ। তৈরি হয়ে গেল পৌনে দু-টন ওজনের সম্পূর্ণ সুরক্ষাদায়ী সিন্দুক। কলকাতার ধর্মতলা আর বোম্বের ভিক্টোরিয়া ডকে বিশাল আগুন লাগলেও যে সিন্দুকের ভেতরের জিনিস ছিল সুরক্ষিত।

এগুলো পরের কথা। এর আগে বাবার বন্ধু মেরবানজি কামা-র ধার শোধ করতে গেল যখন আরদেশির, তখন কামা বেশ অসুস্থ। তিনি কিছুতেই আরদেশিরের কাছ থেকে টাকা নিতে চাইলেন না। বললেন, বেটা, এই যে তুই ধীরে ধীরে একটা ব্যবসা দাঁড় করলি, নতুন নতুন জিনিস তৈরি করে ব্যবসা বাড়িয়ে চললি, এ সব নিজের চোখের সামনে দেখার সৌভাগ্যের একটা মূল্য নেই? এ থেকে তুই আমাকে বঞ্চিত করিস না। আমার তো দিন শেষ হয়ে এল, আমি টাকা দিয়ে কীই বা করব? যদি সত্যিই কিছু করতে চাস, আমার ভাইপোটাকে একটু দেখিস, বাবা।

আরদেশির বলল, চাচাজি, আপনার ইচ্ছেই আমার কাছে আদেশ। ওকে আমাদের পার্টনার করে নিচ্ছি।

আরদেশিরের জন্মের কয়েক বছর পর আরদেশিরের বাবা বুর্জোরজি গুথারজি তাদের পারিবারিক পদবি গুথারজি বদলে করে নিয়েছিলেন গোদরেজ। মেরবানজি কামা-র ভাইপো বয়েসকে পার্টনার করে আদরেশিরের কোম্পানির নাম হল – গোদরেজ অ্যান্ড বয়েস ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি।

এর পরবর্তী ঘটনাবলি আপনাদের অজানা নয়। সামান্য তালা থেকে একের পর এক নতুন নতুন ব্যবসা শুরু করে ও তাদের বাড়িয়ে গোদরেজ গ্রুপ এখন সাড়ে চার বিলিয়ন ডলার কোম্পানি, দেশের অন্যতম নামী প্রতিষ্ঠান। কামা-র ভাইপো বয়েস বেশিদিন এই কোম্পানির পার্টনার থাকতে চাননি, নিজেই সরে গেছিলেন এ থেকে। কিন্তু চাচাজির প্রতি কৃতজ্ঞতায় তার নাম এখনও রয়ে গেছে এই কোম্পানির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট।

আরদেশির যখন ছুরি-কাঁচি তৈরি শুরু করেছিলেন, তার বছর দুয়েক আগে কলকাতায় এক বাঙালি এক প্রতিষ্ঠান শুরু করেছিলেন, তার নাম বেঙ্গল কেমিক্যালস। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র যতদিন জীবিত ছিলেন, এর উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি হয়েছিল। কিন্তু আজ গোদরেজ কোথায় আর এ কোথায়!

১৫ ডিসেম্বর ২০২০

রবিবার, ১৩ ডিসেম্বর, ২০২০

রোগ ~ প্রকল্প ভট্টাচার্য্য

কিছু রোগ দাওয়াই লাগে,
কিছু রোগ এমনি সারে,
কিছু রোগ ছড়িয়ে থাকে রাস্তাঘাটে, ক্ষেত খামারে।
কিছু রোগ সংক্রমিত,
কিছু রোগ জন্মাবধি,
কিছু রোগ বদ প্রকৃতির, জঙ্গল আর পাহাড় নদী।
কিছু রোগ পঙ্গু করে।
কিছু রোগ প্রাণেও মারে,
কিছু রোগ যায় না দেখা আলোয় কিংবা অন্ধকারে।
কিছু রোগ একটু বিরল
কিছু রোগ সবার থাকে,
কিছু রোগ আমার আছে। খুব ছোঁয়াচে। চাই তোমাকে!

শনিবার, ১২ ডিসেম্বর, ২০২০

ওটিস এলিভেটর, আমেরিকান আদম, রাজপুত ইভ এবং হিমাচলী আপেল ~ অমিতাভ প্রামাণিক

আসুন, আজ আপনাদের এক মন-ভালো-করা গল্প শোনাই।

লর্ড কার্জনের বঙ্গভঙ্গ রূপায়িত হয়েছিল ১৯০৫ সালে। বিভক্ত দুই বাংলা ফের জুড়ে গেল ১৯১১ সালে, কিন্তু ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী কলকাতা থেকে উঠে চলে গেল দিল্লিতে। এডউইন ল্যুটিয়েন্স নামে এক সাহেব আর্কিটেক্ট এলেন নতুন দিল্লির খোলনলচে বদলে সাহেবসুবোদের উপযুক্ত অফিস ও ভবন ডিজাইন করতে। লাট-বেলাটদের জন্যে পত্তন হল ল্যুটিয়েন্স' ডেলহির।

তবে সাহেবরা তো কলকাতার পচা ঘেমো গরমে হাঁসফাঁস করে এমনিতেই কাহিল হয়ে যেত। গরম পড়লে তারা কলকাতার বাস সাময়িকভাবে উঠিয়ে চলে যেত সিমলায়। সেখানেই পাহাড়ের কোলে ছিল তাদের গ্রীষ্মকালীন রাজধানী।

দিল্লিতে রাজধানী উঠে যাওয়ার আগে কলকাতার কার্জনসাহেব এক গ্রীষ্মের দ্বিপ্রহরে তাঁর সিমলার রাজভবনে নেমন্তন্ন করলেন তৎকালীন ভারতভ্রমণরত আর্চবিশপ অভ ক্যান্টারবেরি, র‍্যান্ডাল ডেভিডসনকে। দ্বিপ্রাহরিক খানাপিনার সময় গল্প করলেন, সিমলার কাছেই একটা কুষ্ঠরোগীদের আশ্রম আছে, সেখানে এক ডাক্তার দম্পতি – মিসেস অ্যান্ড মিস্টার কার্লটন – ভারতীয় কুষ্ঠরোগীদের সেবাশুশ্রূষা করেন। আর্চবিশপ যদি সেটা দেখতে চান, তবে তিনি তার ব্যবস্থা করবেন।

বিশপ সেখানে গেলেন, কাজকর্ম দেখে খুব সন্তুষ্ট হলেন। জানলেন, এখানে এই আশ্রমটা বেশ কিছুদিন আছে বটে, তবে সম্প্রতি আমেরিকা থেকে এক যুবক সেখানে হাজির হওয়ার পর এর কাজকর্মে অনেক গতি এসেছে। যুবকটির নাম স্যামুয়েল ইভান্স স্টোকস। একুশ-বাইশ বছর বয়স তার।

স্যামুয়েলের সঙ্গে কথাবার্তা বলে জানা গেল, সে ফিলাডেলফিয়ার এক ধনী পরিবারের ছেলে। তার বাবা 'স্টোকস অ্যান্ড প্যারিশ মেশিন কোম্পানি' নামে এক বড়সড় যন্ত্রপাতি কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা ও মালিক। তাদের মূল ব্যবসা হচ্ছে এলিভেটর অর্থাৎ লিফট তৈরির। বাবার ইচ্ছে স্যামুয়েল লেখাপড়া শিখে এই ব্যবসার দায়িত্ব নিক। কিন্তু স্যামুয়েলের ব্যবসাপাতিতে একেবারে মন নেই। সে ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়িয়ে বেড়ায়। মা-বাবা অখুশি হলেও ছেলের সব আবদার মেনে নেন। এইভাবেই একদিন ঘুরতে ঘুরতে ফিলাডেলফিয়ার এক চার্চে কার্লটন দম্পতির সঙ্গে তার আলাপ, তাঁরা সেখানে গেছিলেন ভারতীয় কুষ্ঠ মিশনের জন্যে চাঁদা চাইতে। স্যামুয়েল তাঁদের জিজ্ঞেস করলেন, সে তাঁদের কর্মকাণ্ডে যুক্ত হতে পারে কিনা। তাঁরা সানন্দে রাজি হয়ে গেলেন।

১৯০৪ সালের ছাব্বিশে ফেব্রুয়ারি জাহাজে কার্লটনদের সঙ্গে স্যামুয়েল এসে হাজির হলেন বোম্বেতে। সেখান থেকে তাঁরা গেলেন পাঞ্জাবের সাবাটু-তে, সেখানেই লেপ্রসি মিশনের বড়সড় কাজকারবার।

পাঞ্জাবের গরম আর ধুলো সহ্য হল না স্যামুয়েলের, কিছুদিন পরপরই অসুস্থ হয়ে যেতে লাগলেন। তার এক অবস্থা দেখে তাকে পাঠিয়ে দেওয়া হল উত্তরে পাহাড়ের কোলে, সিমলার কাছে কোটগড়ে। সেখানে এক চার্চের অধীনে তাদের এক ছোটোখাটো মিশন চলছে, স্যামুয়েল সেখানেই কাজ করতে পারে। ১৯০৪ সালের মে মাসে স্যামুয়েল চলে গেল সেখানে। এখানেই আর্চবিশপের সঙ্গে দেখা হল তার।

মিশনারিরা কাজের লোক, তাঁরা নিজেদের উদ্দেশ্য পূরণ করে নিতে জানেন। স্যামুয়েলের প্রভূত প্রশংসা করে আর্চবিশপ র‍্যান্ডাল জানালেন, তাঁর ইচ্ছা, স্যামুয়েল ওখানে ফ্র্যান্সিস্কান অর্ডার প্রতিষ্ঠা করে, যাদের বক্তব্য হচ্ছে গরিবদের সেবা করতে গেলে তাদের মধ্যে গরিব হয়ে সন্ন্যাসী হয়ে বাস করো। স্যামুয়েল সন্ন্যাসী হয়ে বাস করতে লাগল কোটগড়ের কাছে থানেদার নামে এক সুন্দর গ্রামে।

ওদিকে ফিলাডেলফিয়ায় এই খবর পৌঁছে গেল স্টোকস পরিবারে। এতদিন মা-বাবা স্যামুয়েলকে নিয়মিত ভালো টাকাপয়সা পাঠাচ্ছিলেন আর সে তা কাজে লাগাচ্ছিল জনগণের সেবায়। যখনই খবর গেল স্যামুয়েল মঙ্ক হতে চলেছে, মায়ের মন কেঁদে পড়ল। ১৯১১ সালে মিসেস ফ্লোরেন্স স্টোকস এসে হাজির হলেন ছেলে স্যামুয়েলের কাছে থানেদারে। অনেক বোঝালেন, এই জীবন তাঁদের জন্যে নয়। বাবার ব্যবসা সে যদি দেখাশুনা করতে নাও চায়, ঠিক আছে, কিন্তু তাকে এইভাবে হতদরিদ্র হয়ে থাকতে হবে কেন? এভাবে সে কীই বা সেবা করতে পারবে?

ছেলে দেশে ফিরতে রাজি হল না। থানেদারে ২০০ একর জমিতে চা-গাছ লাগিয়েছিলেন মিসেস বেটস নামে এক বিধবা ইংরেজ মহিলা। ১৯১২ সালের ৬ই ফেব্রুয়ারি সেই জমি তিরিশ হাজার টাকায় কিনে নিয়ে ফ্লোরেন্স ছেলেকে বললেন, তাহলে এখানে কিছু কর। টাকা-পয়সা যা দরকার, আমাকে বলবি, আমি দেব। নেংটি পরে তুই এদের সেবা কী করে করবি?

স্যামুয়েল ভেবেচিন্তে দেখল, মায়ের কথা ঠিক। আট বছর হয়ে গেছে তার ভারতে আসার পর। এতদিন সে যা করেছে, যাতে স্থানীয় লোকের কাছে তার ভাবমূর্তি অতি উজ্জ্বল, তার পেছনে মা-বাবার অনুদানের বিরাট ভূমিকা আছে। সন্ন্যাসী হয়ে চললে এ সব কিছুই সম্ভব হবে না।

ফ্র্যান্সিস্কান রোব ছুঁড়ে ফেলে দিল স্যামুয়েল। সে বছরেই সেপ্টেম্বরের ১২ তারিখে সে বিয়ে করল স্থানীয় এক ভারতীয় রাজপুত মেয়েকে, খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত যার নাম অ্যাগনেস।

অ্যাগনেস-স্যামুয়েল জুড়ি নতুন উদ্যমে কাজ শুরু করল স্থানীয় লোকজনের সেবায়।

মোগল-সম্রাট বাবর দিল্লির গদিতে কিছুদিন শাসন করে খুব বিরক্ত হয়েছিলেন – এ কেমন দেশ, যেখানে না আছে বসরাই গোলাপ, না আছে ফরগানার উৎকৃষ্ট ফল। মোগল উদ্যান স্থাপন করে তিনি ভূমধ্যসাগরীয় ফল-ফুলাদির চাষের চেষ্টা করেছিলেন। কিছু সাফল্য ছিল, কিছু ব্যর্থতাও। আপেল অবশ্য ফলেনি। ইংরেজরা আপেল খেতে ভালোবাসে, ভারতের ব্রিটিশ সাহেবরা আপেল আমদানি করে জাপান থেকে। ১৮৭০ সালে ক্যাপ্টেন আর সি স্কট নামে ব্রিটিশ আর্মির এক সাহেব নিউটন পিপ্পিন, কিং অভ পিপ্পিন আর কক্সেজ অরেঞ্জ পিপ্পিন নামে তিন প্রজাতির আপেল চাষের চেষ্টা করেছিলেন হিমাচলের কুলু উপত্যকায়। আপেল ফলেছিল যদিও, সে অতি টক আপেল। টক জিনিস আদৌ সহ্য হয় না সাহেবদের জিভে।

১৯১৫ সালে স্যামুয়েল স্টোক্স মা-বাবাকে ভারতীয় বৌ দেখাতে নিয়ে গেল আমেরিকায়। গিয়ে শুনল, সেখানে লুজিয়ানায় স্টার্ক ব্রাদার্স নার্সারি নামে এক কোম্পানি রেড ডেলিশাস নামে এক জাতের আপেল ফলিয়ে তার পেটেন্ট নিয়েছে। এই রেড ডেলিশাস অতি উৎকৃষ্ট আপেল, যেমন কচকচে আর রসালো, তেমনি মিষ্টি। সেই নার্সারি থেকে কয়েকটা চারা কিনে এনে থানেদারে পোঁতা হল পরের বছর শীতে। গাছগুলো ভালোই বেড়ে উঠছে জানতে পেরে বছর পাঁচেক পরে ১৯২১ সালে মা ফ্লোরেন্স বড়দিনের উপহার হিসাবে ওয়াশিংটন থেকে পাঠালেন স্টার্ক ব্রাদার্সেরই পরের দিকে পেটেন্ট-করা গোল্ডেন ডেলিশাস প্রজাতির আপেলের একগুচ্ছ চারা। সেগুলোও পোঁতা হল থানেদারের বাগানে।

থানেদারের বাগান কয়েক বছর পরেই সুস্বাদু আপেল গাছে ভরে গেল। যেমন এর রং, তেমন এর স্বাদ। সিমলার সাহেবরা গপগপিয়ে খেতে লাগল দিশি আপেল। জাহাজ ভর্তি হয়ে রপ্তানি হতে লাগল অন্য দেশে। স্যামুয়েল আরও জমি কিনলেন। স্থানীয় লোকেরা আলু আর প্লামের চাষ ছেড়ে বাগান ভর্তি করে এই আপেলের চাষ করতে লাগল। হিমাচলী আপেল খেয়ে ধন্য ধন্য করতে লাগল সারা দেশের মানুষ। জাপান থেকে আমদানি বন্ধ হয়ে গেল অনতিবিলম্বে।

গল্পটা এইটুকুই। ফিলাডেলফিয়ার 'স্টোকস অ্যান্ড প্যারিশ মেশিন কোম্পানি' পরে কিনে নেয় ওটিস এলিভেটর্স। স্যামুয়েল স্টোক্স হিন্দুধর্মে দীক্ষা নিয়ে সত্যানন্দ নাম নিয়ে আর্য সমাজে যোগ দেন ও থানেদারে পরমজ্যোতি মন্দির নামে এক মন্দির স্থাপন করেন। তাঁর স্ত্রী অ্যাগনেস স্টোক্স স্বামীকে অনুসরণ করে নাম নেন প্রিয়াদেবী। সত্যানন্দ ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে যোগ দেন ভারতের জাতীয় কংগ্রেসে এবং একমাত্র আমেরিকান হিসাবে ব্রিটিশ জেলে বন্দি হন, তাঁর জেলসঙ্গী ছিলেন লালা লাজপত রাই। মায়ের পাঠানো ১৯২১ সালের আপেলের চারাগুলো যখন থানেদারে পৌঁছায়, তখন সত্যানন্দ জেলে, সেই আপেলের চারা পুঁতেছিলেন প্রিয়াদেবী নিজের হাতে।

ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে এই আমেরিকান প্রবাসীর উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল। ১৯২১ সালের কংগ্রেসের ম্যানিফেস্টোতে একমাত্র অ-ভারতীয় হিসাবে তাঁর সই ছিল। তিনি অবশ্য স্বাধীনতা দেখে যেতে পারেননি। স্ত্রী ও ছয় সন্তানকে রেখে চৌষট্টিতম জন্মদিনের আগেই ১৯৪৬ সালের ১৪ই মে তাঁর মৃত্যু হয়।

সঙ্গের ছবিটি সত্যানন্দ ও প্রিয়াদেবীর, নেট থেকে সংগৃহীত।

৭ ডিসেম্বর ২০২০

বৃহস্পতিবার, ১০ ডিসেম্বর, ২০২০

বেশি গণতন্ত্র ~ আর্য তীর্থ

নীতি আয়োগের চেয়ারম্যান সখেদে বলেছেন, ' এই দেশে বড় বেশি গণতন্ত্র রয়েছে!..'       

                 । বেশি গণতন্ত্র।

এখনো এই দেশে  ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে লোকে প্রকাশ্যে  কথা বলে।
এখনো ভোট এলে আশা ও আশঙ্কায় মসনদ থাকে দোলাচলে।
এখনো আড়ালে গিয়ে ভোট দিয়ে  যায়  লোকে যাকে মনে ধরে।
এখনো প্রতিবাদে রাস্তায় নামে নাগরিক,  রাজাদেশ অমান্য করে।

রাষ্ট্রের হুকুমগুলো এখনো হয়ে ওঠেনি দৈনিক উপাসনার মন্ত্র।
ঠিক বলেছেন তাই নীতি-অধিরাজ, এখনো রয়েছে দেশে বেশি গণতন্ত্র।

এখনো মানুষকে  পুরোপুরি ভাগ করা যায়নি শাসক ও বিরোধীতে।
অজস্র মার খেয়ে এখনো চলছে কেউ অনুকুল স্রোত ছেড়ে ঠিক বিপরীতে।
এখনো যুদ্ধ এলে কিছু লোক বলে বসে হোক আলোচনা।
দেশপ্রেম মানে সেনা, এখনো অনেকে মানে ভুল সে ধারণা ।

এখনো কলকারখানা স্কুল নগরে গ্রামাঞ্চলে বসানো যায়নি মগজধোলাই যন্ত্র।
সুতরাং ভুল নেই কোনো, ছড়িয়ে রয়েছে দেশে বড় বেশি গণতন্ত্র।

এখনও রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল ব্রাত্য হননি সাহিত্যচর্চায়।
ধর্ষিতা নিহতের জাতপাত না দেখে এখনো গোটা দেশ গর্জায়।
চাষীকে অন্নদেবতা মেনে এখনো সবাই হয় তার কাছে নতজানু।
এখনো প্রেমকে শেষ করতে পারেনি পোষ্য মানুষখাকী জেহাদ-জীবাণু।

এখনো অনেকে মানে , রাষ্ট্র ও দেশের সংজ্ঞা ভিন্ন ও স্বতন্ত্র।
সুতরাং তর্কের অবকাশই নেই,  বিরক্তিকর ভাবে বেশি দেশে গণতন্ত্র।

রাজাদের ভীষণ ভাবিয়ে,  গনতন্ত্রকে কারা শিখিয়ে দিয়েছে    মহামৃত্যুঞ্জয় মন্ত্র।

বুধবার, ৯ ডিসেম্বর, ২০২০

কৃষক বিল ~ সুশোভন পাত্র

দিলপ্রীত আজকাল লন্ডনে থাকে। আর দিলপ্রীতের বাবা ৩ লক্ষ কৃষকের একজন হয়ে রাত কাটাচ্ছে, দিল্লির টিকরি সীমান্তে।
দিলপ্রীত আমার প্রাক্তন কলিগ। দু-বছরের জুনিয়র। পাঞ্জাবের মোগার স্বচ্ছল কৃষক পরিবারের মেয়ে। ঐ যে বলে না 'পাঞ্জাব দি কুড়ি'; সরোষ কা সাগ, মাক্কি কি রোটি, লোরি, ভাংরার ককটেলে দিলপ্রীত বিলকুল তাই। দিলপ্রীতের IAS পরীক্ষার প্রস্তুতির সময়, অফিসের ভেন্ডিং মেশিনের সামনের করিডোরে দাঁড়িয়ে দিলপ্রীত প্রায়ই বলত

- আপ লোগো কা ইয়ে কমিউনিস্ট ওয়ালি ফান্ডা ইন্ডিয়া ম্যা নেহি চলেগি।

অর্থনীতি, ধর্ম, সংরক্ষণ, বেসরকারিকরণ -গুরুত্বপূর্ণ সব বিষয়ে দিলপ্রীতের অবস্থান আমার ১৮০ ডিগ্রী বিপরীতে। ২০১৪-য় মিডিয়ায় মোদীর হাই-পিচ ক্যাম্পেনে ভেসে 'ভারত ভাগ্য বিধাতার' ৩৬০ ডিগ্রী উন্নতির স্বপ্নে মশগুল দিলপ্রীত বলেছিল

- কুছ তো আচ্ছা করেগা লাগতা হ্যা ইয়ে বান্দা!

প্রায় ৮ মাস পর, শুক্রবার হোয়াটস-অ্যাপে কথা হল, দিলপ্রীতের সাথে। লন্ডনের সাউথব্যাঙ্কের IBM-র অফিসে বসে বলা দিলপ্রীতের কথা গুলো এখনও কানে বাজছে

- আপ তো জরুর ফার্মারস কে সাইড হি হোঙ্গে? ভরসা হ্যা আপ লোগো পে। কিউকি পাপা কি ভরোসে টিকি হুয়ি হ্যা লাল ঝাণ্ডে পে!

দিলপ্রীত কে বলেছি, ভরসা থাকুক। লড়াই হবে শেষ তক। লড়াই হবে এসপার-ওসপার। লড়াই হচ্ছেও, রাজপথে, হৃদযন্ত্রে আলোড়ন তুলে। জ্যোতি বাবু বলতেন, "মানুষ অভিজ্ঞতা দিয়েই বোঝে।" লন্ডনে বসে দিলপ্রীত বুঝেছে, 'অভিজ্ঞতা দিয়েই'। দিল্লির কৃষক আন্দোলনের লিটমাস টেস্টের রিপোর্টে কার্ডে বুঝছে অনেকেই। বুঝছে যে, এখন সংসদীয় রাজনীতির পাটিগণিতে তুরুপের তাস না হলেও সাধারণ মানুষের জীবন-জীবিকার যন্ত্রণটার শীতলপাটি হওয়ার ক্ষমতা বামপন্থীদের আগেও ছিল, এখনও আছে আর পরেও থাকবে। জান কবুল, মান কবুল লড়াই'র হিম্মতটা বামপন্থীদের আগেও ছিল, এখনও আছে আর পরেও থাকবে।
১২দিনের ব্যবধানে দু-বার স্তব্ধ হয়েছে দেশ। ঐ লাল ঝাণ্ডার নেতৃত্বেই। আলপথ থেকে গলিপথ -সম্বিৎ ফিরছে দেশের। চোখ ফুটেছে ভাড়াটে মিডিয়ার। কৃষকদের দাবীর সমর্থনে মিছিল হয়েছে বার্মিংহামে, মিছিল হয়েছে মেলবোর্নে। মিছিল হয়েছে, ক্যালিফোর্নিয়ায়, মিছিল হয়েছে কানাডায়। মিছিল হয়েছে দাঙ্গাবাজদের আখড়া গুজরাটেও। ভয়ে হিন্দুত্ববাদের নব্য ল্যাবেরোটারি উত্তরপ্রদেশে গৃহবন্দী করে রাখতে হয়েছে লাল ঝাণ্ডার সৈনিক সুভাষিণী আলিকে। টেনে হিঁচড়ে প্রিজন ভ্যানে তুলতে হয়েছে লাল ঝাণ্ডার নেত্রী মারিয়াম ধাওয়ালে কে। মিডিয়ার তৈরি মেকি চাণক্যদের গলদঘর্ম কৃষক আন্দোলন কে সামাল দিতে মাঝরাত পর্যন্ত নতজানু হয়ে বসে থাকতে হয়েছে লাল ঝাণ্ডার কৃষক নেতা হান্নান মোল্লাদের সামনে।

সার্কাসের রিং মাস্টার নরেন্দ্র মোদী বলেছিলেন 'কৃষকদরদী বিল'। বলেছিলেন 'ঐতিহাসিক বিল'। আমরা বলেছিলাম হিসেব হবে। হিসেব হবে 'ঐতিহাসিক বিল' মুখ লুকিয়ে পাশ হল কেন? হিসেব হবে, 'কৃষকদরদী বিল' যখন দেশের কিষানরা রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করছে কেন? হিসেব হবে, কোনও রাজ্য সরকারের মতামত নেওয়া হল না কেন? হিসেব হবে, সম্প্রচার বন্ধ করে রাজ্যসভায় মার্শাল লেলিয়ে গলার জোরে ভোট করাতে হল কেন? আসলে 'ব্রহ্মা জানেন গোপন কম্মটি'! বিল ঐতিহাসিকই, তবে কিষানদের জন্য নয়, রিং মাস্টারের পীরিতের কর্পোরেট শিল্পপতি আম্বানি-আদানিদের জন্য।

আম্বানি-আদানিদের স্বার্থেই যুক্তরাষ্ট্রীয় পরিকাঠামোর মুখে লাথি মেরে, ৫৬ বছরের পুরনো 'প্ল্যানিং কমিশন' প্যারালাইজড করে, ২০১৫-তে মোদী ঘটা করে নামিয়েছিলেন 'নীতি আয়োগ'। গতকাল সেই নীতি আয়োগেরই CEO অমিতাভ কান্ত, বিগ-বিজনেস হাউস ভেদান্তের স্পন্সরড, সঙ্ঘ পরিবারের মুখপত্র এবং ফেক নিউজের এপিসেন্টার 'স্বরাজ ম্যাগাজিনের' সান্ধ্য আড্ডায় অন ক্যামেরা বলেছেন, "আমাদের দেশের অর্থনীতি তে বড় ধরণের আর্থিক সংস্কার সম্ভব হচ্ছে না কারণ, too much of democracy"
আমাদের দেশে Democracy-র D-র অবস্থা কেমন? জানে কাশ্মীর। জানেন স্ট্যান স্বামী, সাফুরা জারগর। জানেন গৌরি লঙ্কেশ, বিলকিস বানো। জানেন দিল্লি সীমান্তে পুলিশের লাঠিতে আক্রান্ত কৃষক। আর জানে, বিশ্বজুড়ে গণতন্ত্রের ধারণাকে পরিমাপ করা সুইডেনের গথেনবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের রিসার্চ সংস্থা V-Dem Institute। তাঁদের সাম্প্রতিক রিসার্চে উঠে এসেছে Academic Freedom, Civil Liberties, Rule Of Law এবং Freedom of Expression Index -গত ৬ বছরে Liberal Democracy-র  চারটি সূচকের প্রতিটিতে ক্রমশ নেমেছে ভারত। এমনকি Academic Freedom, Civil Liberties-র সূচকে বর্তমান ভারতের পয়েন্ট স্কোর ১৯৭৫-৭৭ এমারজেন্সির সময়ের তুলানতেও খারাপ।

আসলে অমিতাভ কান্ত নতুন কিছুই বলেননি। ইতিহাসের পাতায় লেখা আছে, পুঁজিবাদের ভাষায় 'বড় আর্থিক সংস্কারের' নামে দেশের সম্পদ বেচে দেওয়ার, আম্বানি-আদানি'দের পকেটে ভরিয়ে দেওয়ার অঙ্কের নিয়মেই 'গণতন্ত্র' ধ্বংসের প্রয়োজন পড়ে। কৃষক-শ্রমিকদের অধিকার বন্দুক-বারুদের বিনিময়ে রক্তাক্ত করার প্রয়োজন পড়ে। হিটলার, মুসোলিনি, ফ্রাঙ্কোর মত ফ্যাসিস্ট ম্যাসকটদের জন্ম দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে। নিও লিবারেল জমানায় যার শুরুটা হয়েছিল চিলি তে। মিল্টন ফ্রিডম্যানের নীতির বাস্তবায়নে, গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সালভাদোর অ্যালেন্দের সরকারের বিরুদ্ধে সিআইএ লেলিয়ে সামরিক অভ্যুত্থানের বাই-প্রোডাক্ট হিসেবে সেবার জন্ম হয়েছিল মার্কা মারা আরেক ফ্যাসিস্টের, পিনোচেতে!

শেষ রক্ষা অবশ্য হয়নি। এই অক্টোবরে চিলি গণভোটের মাধ্যমে আস্তাকুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলেছে পিনোচেতের আমলের সংবিধান। সান্তিয়াগোর রাস্তা আবার সেজেছে সালভাদোরের ছবিতে। চিলির বিহ্বল যৌবন আবার গলা মিলিয়েছে ভিক্টর জারার সুরে। হ্যাঁ, লাল ঝাণ্ডার নেতৃত্বেই। তাই যারা বিদ্রূপ করে আপনাকে জিজ্ঞেস করেন, '৫রাজ্যে বামপন্থীরা কটা আসন পেল?', কিম্বা ঔদ্ধত্যের সাথে ঘোষণা করেন '১৯টি রাজ্যে আমরা ক্ষমতায়', তোরা কটায়?', কিম্বা ব্যাঙ্গ করে বলেন "তোরা তো ৭%। পরের বার তো শূন্য হয়ে যাবি।" তাঁদের ব্যাঙ্গ-বিদ্রূপে মুচকি হাসুন।

আর বিনয়ের সাথে, ওঁদের কাঁধে হাত রেখে, দিল্লির কৃষক আন্দোলনের ভরকেন্দ্রে উড়তে থাকা লাল পতাকার দিকে চোখ রাখতে বলুন। মনে করিয়ে দিন যে, পৃথিবীর প্রত্যেকটা মহাদেশের, প্রত্যেকটা দেশের, প্রত্যেকটা শহরের, প্রত্যেকটা গ্রামের, প্রত্যেকটা জনপদে; হয়ত কোন ফ্যাক্টরির গেটের সামনে, কিম্বা হয়ত কৃষকের এক ফালি জমির মাঝে, হয়ত কংক্রিটের মিছিলে বেকারের কাঁধে, কিম্বা স্বৈরাচারী শাসকের বিরুদ্ধে মেহনতির প্রতিবাদের ভাষায়, কখনও লিঙ্গ বৈষম্যের বিরুদ্ধে উদ্ধত শ্লোগানে সেজে, কখনও যুদ্ধবিরোধী মিছিলে শান্তির পতাকা হয়ে কাস্তে-হাতুড়ি আঁকা ঐ একটুকরো লাল কাপড় কিন্তু ঠিক উড়ছে। আর উড়ছে, মহম্মদ আর রামের নামে মানুষ ক্ষ্যাপাতে নয়, উৎসব আর মেলায় মাতিয়ে রাখতে নয়।

শোষণ-বঞ্চনাহীন নতুন ভোরের স্বপ্নটাকে সাচ্চা করতে। দুনিয়ার মেহনতি মানুষ কে আগলে রাখতে। কিম্বা হয়ত ঠিক এই মুহূর্তে  দিল্লির শীতে, হক আদায়ের লড়াইয়ের স্বার্থে কৃষকদের অস্থায়ী তাবুতে।
----------------------------------------------------------------------
কৃষক সংগঠনগুলো একযোগে সরকারের নতুন দেওয়া রফাসুত্র খারিজ করে জানিয়েছে যে চাষীদের এই আন্দোলন আরো জোরদার হবে।

◾১২ই ডিসেম্বর - সারা দেশের টোলপ্লাজাগুলোকে টোল-মুক্ত করে দেওয়া হবে।
◾১২ই ডিসেম্বর - দিল্লী জয়পুর হাইওয়ে বন্ধ করে দেওয়া হবে।
◾১৪ই ডিসেম্বর - উত্তর ভারতের সমস্ত চাষীদের উদ্দেশ্যে "দিল্লী চলো" আহ্বান।
◾১৪ই ডিসেম্বর - অন্য সমস্ত রাজ্যে চাষীদের উদ্দেশ্যে আহ্বান আঞ্চলিক স্তরে বিক্ষোভ কর্মসূচী নেওয়ার।
◾সমস্ত জিও প্রোডাক্ট, আম্বানি/আদানিদের শপিং মল, পেট্রোল পাম্প বয়কটের ডাক
◾সারা দেশ জুড়ে বিজেপি নেতৃত্ব, তাদের জেলা ও রাজ্য অফিস ঘেরাও
◾আন্দোলনের নতুন স্লোগান - "সরকার কি আসলি মজবুরি - আদানি, আম্বানি, জমাখোড়ি"

দড়িতে এবার টান পড়েছে। এসপার, নয় উসপার। ইয়ে ইনকিলাব হ্যায় স্যার, দিস ইজ রেভোলিউশন।

#standwithfarmerschallenge #জয়কিসান

বুধবার, ২ ডিসেম্বর, ২০২০

কৃষি বিল ~ রামকৃষ্ণ মহাপাত্র

আমি বিলটা পড়েছি। কিন্তু আপনি??????


Farm Bill, 2020:

1) প্রথম বিলটি The Essential Commodities ( Amendment) Bill 2020; এই বিল অনুযায়ী চাল, ডাল, আটা, আলু, চিনি, পিয়াঁজ, ভোজ্য তেল সহ মোট ২০ টির বেশি নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য অত্যাবশ্যকীয় পণ্য তালিকা থেকে বাদ দিয়ে দেওয়া হয়েছে এবং মজুত করার উর্ধ্বসীমা ও তুলে দেওয়া হয়েছে। ১৯৫৫ সালে এই আইনের উদ্দেশ্যই ছিল অভাবের সময় সরকার সরাসরি কৃষকদের থেকে খাদ্যশস্য কিনে গণবণ্টন ব্যবস্থার মাধ্যমে দেশের সাধারণ মানুষদের মধ্যে বিতরণ করবে। এখন থেকে কৃষকদের থেকে এই সমস্ত নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি ক্রয় করার জন্য সরকার আর বাধ্য না, সাথে কর্পোরেট ব্যবসায়ীরা এখন থেকে যত ইচ্ছা দ্রব্যাদি অনির্দিষ্টকালের জন্য গুদামজাত করে কৃত্রিম ভাবে বাজারের মূল্য নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে।

সরকার ঠিকই তো বলেছে বলুন এরকম একটা বিল সত্যি সত্যিই কৃষকদের উন্নতি সাধন করবে না তো কে করবে। আসলে কৃষকরা অশিক্ষিত কিনা, তাই এই বিল ঠিক করে পড়ে বুঝে উঠতে পারেনি!

2) - দ্বিতীয় বিলটি The Farmers Agreement of Price Assurance and Farm Services Bill 2020; যার গালভরা নাম দিয়েছে মূল্য নিশ্চয়তা! এই বিল নাকি কৃষকদের আয় নিশ্চিত করবে! কৃষকদের সাথে সরাসরি পেপসিকো, আদানি, রিলায়েন্স এর মত বড় বড় কোম্পানি'রা চুক্তি করতে পারবে। ব্রিটিশ আমলের সেই নীলকর সাহেবদের নীলচাষের প্রথা একটু ঘুরিয়ে ফিরে আসছে আরকি। বড় বড় কোম্পানি গুলোর সাথে কৃষকদের চুক্তি হওয়ার পর কোনো কারণে উৎপন্ন ফসল পছন্দ না হলে তা কিনতে কিম্বা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ফলে ফসল নষ্ট হলে সেই আর্থিক ক্ষতির দায় নিতে কোম্পানি গুলো বাধ্য না। সরকার বলছে সেক্ষেত্রে ক্ষতির মূল্য পেতে চাষী-রা আইনের সাহায্য নিতে পারে। কিন্তু আপনার কি মনে হয় আদানি, পেপসিকো-দের সাথে আপনার পাড়ার গরীব চাষী মদন দা দের কোর্টের আইনি লড়াই লড়ার মত পকেটের জোর আছে?

3) - তৃতীয় বিলটি The Farmers Produce Trade and Commerce Bill 2020; এর ফলে ক্রেতা ব্যাবসায়িক সংস্থাগুলির সাথে কৃষকরা সরাসরি কেনাবেচা করতে পারবে মুক্তভাবে। এক্ষেত্রে সরকার আর কোনো রকম হস্তক্ষেপ করবে না। 'স্বামীনাথন কমিশনে'র সুপারিশ মেনে খরচের দেড় গুণ দাম কৃষকদের জন্য সুনিশ্চিত করতে হবে সেই দায়ভার থেকে সরকার হাত তুলে নিলো। এমনকি এই বিলে বিদ্যুতের সরবরাহ সম্পূর্ণ বেসরকারিকরণ, বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি এবং বিদ্যুতে কৃষককে ভর্তুকি বন্ধ করার ব্যবস্থার ও উল্লেখ আছে।
সরকার ঠিকই তো বলেছে বলুন এরকম একটা বিল সত্যি সত্যিই কৃষকদের উন্নতি সাধন করবে না তো কে করবে। আসলে কৃষকরা অশিক্ষিত কিনা, তাই এই বিল ঠিক করে পড়ে বুঝে উঠতে পারেনি!

4) - যে দেশের জনসংখ্যার শতকরা ৫২ ভাগ পরিবার কৃষির উপর নির্ভরশীল, যে দেশের কৃষি কাজের সাথে যুক্ত ১৪.৬৫ কোটি পরিবারের মধ্যে ৫৪.৬০ শতাংশ পরিবার ভূমিহীন, যে দেশের সরকার নিজেদের ব্যর্থতা ডাকতে ২০১৬ সালের পর থেকে কৃষক আত্মহত্যার রিপোর্ট প্রকাশ বন্ধ করে দেয় আপনাদের মনে হয় সেই দেশের নিপীড়িত শোষিত অন্নদাতা এই কোটি কোটি কৃষক-রা আদেও ওই কর্পোরেট দের সাথে লড়াই করে বেঁচে থাকতে পারবেন?

১২ মিনিট ৩৭ সেকেণ্ড ছাড়া আমাদের দেশে একজন করে কৃষক আত্মহত্যার পথ বেছে নেন। এই দেশে কোটি কোটি টাকার কর্পোরেট ঋণ মুকুব হলেও কৃষি ঋণ আর মুকুব হয়না। কৃষক দের পরিবারগুলোর একটু ভালো করে বাঁচতে চাওয়ার স্বপ্নগুলো আর সত্যি হয়না। তার বদলে এভাবেই সরকার নতুন নতুন বিল এনে প্রতিদিন প্রতিমুহূর্তে তাদের পায়ের তলাতে পিষে মারতে চাইছে।

5) গণতান্ত্রিক দেশে এই কৃষি বিল কে আপনি সমর্থন করতেই পারেন, সরকারের প্রতি কুণ্ঠাহীন আনুগত্যের জোয়ারে গা ভাসিয়ে আন্দোলনকারী কৃষকদের কঙ্গনা রানাউত এর মত দেশদ্রোহী হিসেবে আপনি দেগে দিতেই পারে, সারাদিন হিন্দু-মুসলিম, মন্দির-মসজিদ, কাশ্মীর-পাকিস্তান করায় ব্যস্ত থেকে কৃষকদের ন্যায্য প্রাপ্য অধিকার নিয়ে কথা বলা কে আপনি 'ওয়েস্টেজ অফ টাইম' বলতেই পারেন কিন্তু জেনে রাখুন আপনার ব্রেকফাস্টের ওই আলুর দম আর ফুলকো লুচি থেকে দুপুরের ভাতের ওই চাল কিম্বা রাতের সব্জির সবটুকুই ওই কৃষক দেরই অক্লান্ত পরিশ্রমের ফসল। ওনারা থাকলে তবেই আপনার রোজের মেনুতে শুক্ত, আলুপোস্ত, পটলের দোর্মা, ফ্রায়েড রাইস এসব থাকবে।

তাই এখন থেকে প্রতিবার যখন এই কৃষি বিলের সমর্থনে কথা বলতে যাবেন শুধু একটাই সংখ্যা মনে রেখে দেবেন, ১২ মিনিট ৩৭ সেকেন্ড। ওই ১২ মিনিট ৩৭ সেকেণ্ড ছাড়া একজন করে কৃষক মৃত্যুর জন্য পরোক্ষভাবে আপনিও দায়ী থাকবেন। হ্যাঁ আপনিও।