বৃহস্পতিবার, ৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

আরজি কর কান্ডের নেপথ্যে ~ ডাঃ বিষাণ বসু

এই আন্দোলন এমন অভাবনীয় উচ্চতায় পৌঁছেছে - সমাজের সব অংশের মানুষের পবিত্র ক্রোধ যেভাবে প্রকাশ পাচ্ছে - যে স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ দেখছি প্রতি মুহূর্তে - তাতে একে শুধুই ডাক্তারদের আন্দোলন বা ডাক্তারদের দেখানো পথে আন্দোলন বলে সীমায়িত করার প্রশ্নই নেই। এ একেবারেই জনগণের আন্দোলন। যথার্থ গণ-আন্দোলন। 

একটি মেডিকেল কলেজের একটি ঘটনা - যাকে 'ছোট ছেলেদের ভুল' বলে উড়িয়ে দেওয়া যেতেই পারত - এবং অন্তত একজন, আমার পরিচিত বৃত্তেরই একজন, তা-ই বলেছেন - হ্যাঁ, আরজিকর মেডিকেল কলেজের এক সন্দীপ-ঘনিষ্ঠ 'প্রফেসর' আন্দোলনরত ছাত্রছাত্রীদের বলেছেন, দ্যাখ, রেপ-মার্ডার তো কেউ ইচ্ছে করে করে না, ভুল করে হয়ে গেছে, আর মেয়েটা তো মরেই গেছে, তাকে তো ফিরিয়ে আনা যাবে না, এখন যারা এর'ম করে ফেলেছে তারাও তো আমাদেরই ছেলে, তাদের কেরিয়ারটা তো নষ্ট হতে দিতে পারি না - বিশ্বাস করুন, একজন চিকিৎসক-অধ্যাপক সত্যিসত্যিই এরকম বলেছেন - তো যা-ই হোক, মেডিকেল কলেজের সীমার মধ্যে ঘটে যাওয়া একটি ঘটনা ঘিরে এমন বিপুল আবেগের বিস্ফোরণ আমি সুদূরতম স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারিনি।

তাই একথা একবারও বলতে পারব না, যে, আপনারা এই আন্দোলনটা দেখছেন বাইরে থেকে - আর আমি দেখছি ইনসাইডার হিসেবে। কেননা, আমি জানি, এখানে আমার এবং আপনার অবস্থান একই - আমরা সবাই অংশগ্রহণকারী।

তবু কিছু কিছু দিকের কথা বলব, যেগুলো হয়ত আপনি আজ জানলেন - বা আগামীকাল কোনও 'ব্রেকিং নিউজ'-এর মাধ্যমে জানবেন - অথচ যে খবরগুলো আমি (এবং আমরা) অনেকদিন ধরেই জানি। জানি, এবং আপনাদের জানানোর চেষ্টাও করেছি - জানাতে গিয়ে সরকারের বিরাগভাজন হয়েছি - বাবা মারা যাবার মাসকয়েকের মাথায় বদলি হয়েছি, যে বদলির খবরে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত বয়স্ক মা আরও বিপর্যস্ত হয়েছে, এবং বদলি হয়েছি সদ্য গড়ে ওঠা এমন মেডিকেল কলেজে, যেখানে ক্যানসার চিকিৎসার কোনও বিভাগ থাকা তো দূর, বসার মতো একটি টেবিল-চেয়ারও জোটেনি, এছাড়া আমাকে পদোন্নতির ইন্টারভিউয়ে বসতে দেওয়া হয়নি, ইত্যাদি প্রভৃতি আরও অনেক অভিজ্ঞতা হয়েছে, কিন্তু ব্যক্তিগত অভাব-অভিযোগ ফেসবুকে শোনানো বা প্যানপ্যান করার অভ্যেস আমার কোনও কালেই নেই, তাই আপনাদের এইসব কথা আগে বলিনি, আজও সেসব নিয়ে বিস্তারিত বলব না - তবে স্বাস্থ্য-দফতরের দুর্নীতি ও অনাচারের কথা আমি বারবারই বলে এসেছি, আপনারা শুনে আপাতভাবে বিচলিত হয়েছেন বটে, কিন্তু রাস্তায় নামেননি।

নামলে, 'অভয়া' মেয়েটা হয়ত বেঁচে থাকত। 

তবে হা-হুতাশ করার জন্য এই লেখা নয়। আসলে, এই আন্দোলনের সুবাদে এতজনকে, বিশেষত এত চিকিৎসককে আচমকা 'বিপ্লবী' হয়ে যেতে দেখছি - অনেকেই হয়ত এমনিতে সাতেপাঁচে থাকেন না, কিন্তু এবারে সত্যিসত্যিই তাঁরা বিচলিত হয়েছেন, 'অনেক হয়েছে আর না' বলে রাস্তায় নামছেন, কিন্তু এরই মধ্যে ডাকসাইটে বারবণিতা-সুলভ আচরণকারী কিছু চিকিৎসক-অধ্যাপককে যেভাবে আচমকা সতীলক্ষ্মী সেজে ঘোমটা টেনে তুলসীতলায় প্রদীপ হাতে নামতে দেখছি - তাতে ভয় হচ্ছে, ভোল বদলে এঁদেরও 'মূলস্রোতে' মিশে যাবার সম্ভাবনা। এই মুহূর্তে জল যে খুবই ঘোলা, সে নিয়ে তো সন্দেহের অবকাশ নেই - তাতে কইমাছ সেজে ঝাঁকে মিশে যাওয়া কী এমন কঠিন কাজ? তাই নিজের কিছু দাবিদাওয়া নিয়ে এই লেখা।

এতদিনে আপনারা এটুকু জেনেছেন, যে, স্বাস্থ্য-দফতরে ভয়াবহ দুর্নীতি চলেছে গত কয়েকবছর। আরও নির্দিষ্ট করে বললে, অনাচারের চূড়ান্ত ঘটেছে মেডিকেল কলেজগুলোতে। তো মেডিকেল শিক্ষাব্যবস্থার একজন ইনসাইডার হিসেবে কয়েকটা কথা লিখে রাখা ভালো।

১. গত কয়েকবছর ধরেই ডাক্তারি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র মেডিকেল কলেজগুলোয় বিক্রি হয়। পরীক্ষার কত ঘণ্টা আগে কে প্রশ্ন পাবে, তার উপর দাম নির্ভর করে। অর্থাৎ পরীক্ষার আধঘন্টা আগে পেলে একরকম দাম, দুই ঘণ্টা আগে পেলে আরেকরকম (বেশি দাম)। সঙ্গে দেওয়া হয় স্ট্যান্ডার্ড উত্তর। সুতরাং এনআরএস মেডিকেল কলেজের এবং নর্থ বেঙ্গল মেডিকেল কলেজের ছাত্রছাত্রীদের পরীক্ষার উত্তর কমা-ফুলস্টপ-সহ হুবহু মিলে যায়। (এখানে বলে রাখি, কেনাবেচা কিন্তু সবার জন্য নয়। অধিকাংশ ছাত্রছাত্রীকেই পড়াশোনা করে পাস করতে হয়েছে। সব মেডিকেল কলেজেই।) চিকিৎসক-অধ্যাপকদের সকলেই এটা জানতেন, জানেন। এ নিয়ে যাঁরা বিস্ময়ের ভান করছেন, তাঁদের মামণিকে বলুন কমপ্ল্যান খাওয়াতে।

২. প্রশ্নপত্র বিক্রির সার্কিটের মূল কেন্দ্র - রাজ্য স্বাস্থ্য বিশ্ববিদ্যালয়। সুহৃতা পাল যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, তখন থেকেই এই ব্যবস্থার শুরু। সঙ্গে চক্রের পরিচালক হিসেবে মূল - অভীক দে এবং বিরূপাক্ষ বিশ্বাস। পরীক্ষক হিসেবে কে কোথায় নিযুক্ত হবেন, কে কে 'কথা শোনে' এসব হিসেবনিকেশও ওখানেই কষা হয়।

৩. সুহৃতা দেবী প্রতিভাবান মানুষ। উপাচার্য থাকাকালীন তিনি নিজের ছেলেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে 'মেন্টর' হিসেবে নিয়োগ করেন - ছেলে নিয়মিত মাসোহারাও পেত - নিয়োগ ঘটে পরীক্ষা বা ইন্টারভিউ ছাড়াই। এছাড়াও ছেলের নবগঠিত কোম্পানিকে বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কাউন্সিলের মাধ্যমে বিপুল অঙ্কের কন্ট্র‍্যাক্ট পাইয়ে দেন। সন্দীপ ঘোষ, সুশান্ত রায়, অভীক দে, বিরূপাক্ষ বিশ্বাস প্রমুখ তারকাদের ভিড়ে সুহৃতা পালের মতো গুণী মহিলার নামটি (বারাসাত মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষা) ইদানীং পেছনের সারিতে চলে গিয়েছে, ব্যাপারটা দুর্ভাগ্যজনক। 

৪. অভীক দে এসএসকেএম হাসপাতালে সার্জারি বিভাগের ছাত্র। প্রান্তিক অঞ্চলে কোভিড বিভাগে 'সার্ভিস' দেবার সুবাদে বিশেষ কোটা পেয়ে তিনি স্নাতকোত্তরে ঢুকেছেন। বর্ধমান শহরের মেডিকেল কলেজের অনাময় ইউনিট কি 'প্রান্তিক অঞ্চল'? তদুপরি, অভীক দে যেসময় 'সার্ভিস' দিয়েছিলেন বলে দাবি করা হয়েছে, সেসময় সরকার 'কোভিড ওয়ার্ড' বন্ধ করে দিয়েছিলেন। তবু অভীক দে কোটা পেলেন কী করে? সার্টিফাই করেছিলেন ডা কৌস্তভ নায়েক। বর্ধমান মেডিকেল কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ। যিনি বর্তমানে রাজ্যের স্বাস্থ্যশিক্ষার সর্বোচ্চ পদে আসীন। ডিরেক্টর অফ মেডিকেল এডুকেশন। ডিএমই।

৪. মেডিকেল এডুকেশন সার্ভিসে বদলি নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ অনেকদিনের। ইদানীং পরিস্থিতি বহুগুণে খারাপ হয়েছে। লাখ লাখ টাকা ঘুষের কারবার। এখানেও ডা অভীক দে ও বিরূপাক্ষ বিশ্বাসের হাতযশ। সঙ্গে আরজিকর মেডিকেল কলেজের এক জুনিয়র ডাক্তার ডা সৌরভ পাল। সে যা-ই হোক, সর্বোচ্চ পদে আসীন ডা কৌস্তভ নায়েকের স্নেহের পরশ তথা স্বাক্ষর বাদে কোনও বদলিই কার্যকর হতে পারে না - পারত না - বলা-ই বাহুল্য। অবশ্য যাঁরা খবর রাখেন, তাঁরা সকলেই জানেন - অভীক দে-ই আসল ডিএমই, বাকি কৌস্তভ নায়েক-টায়েক স্রেফ ফর্ম্যালিটি। এবং রাজ্যের প্রতিটি মেডিকেল কলেজে - হ্যাঁ, প্র-তি-টি মেডিকেল কলেজেই - অভীক দে তথা উত্তরবঙ্গ-লবির বিশ্বস্ত অনুচরেরা রয়েছেন। ছাত্র হিসেবে, বা জুনিয়র ডাক্তার হিসেবে, অথবা চিকিৎসক-অধ্যাপক হিসেবে - ক্ষেত্রবিশেষে প্রশাসক হিসেবেও।

৫. চিকিৎসাক্ষেত্রে নৈতিকতা তথা এথিক্সের দিকটি রক্ষিত হচ্ছে কিনা, তা দেখার ভার রাজ্য মেডিকেল কাউন্সিলের। বিগত নির্বাচনে যাঁরা 'নির্বাচিত' হয়ে এসেছেন - ঠিক কীভাবে তাঁরা জিতেছিলেন, সে বিষয়ে বিস্তারে যাচ্ছি না, শুধু আনন্দবাজারের একটি সম্পাদকীয়-র লিঙ্ক কমেন্টবক্সে দিয়ে রাখছি - তো নির্বাচিতদের মধ্যে রয়েছেন ডা সুদীপ্ত রায় (প্রেসিডেন্ট), ডা সুশান্ত রায় (ভাইস-প্রেসিডেন্ট), ডা অভীক দে প্রমুখ। বিভিন্ন কমিটিতে আমন্ত্রিত সদস্যদের মধ্যে রয়েছেন ডা সন্দীপ ঘোষ, ডা বিরূপাক্ষ বিশ্বাস, ডা সুহৃতা পাল, ডা সৌরভ পাল প্রমুখ। সকলেই, বলাই বাহুল্য, স্বনামধন্য। এহেন মেডিকেল কাউন্সিল যে আমজনতার অভাব-অভিযোগ খুঁটিয়ে দেখা ও মেডিকেল এথিক্সের বিষয়গুলোর পর্যালোচনার চাইতে ব্ল্যাকমেইলিং ও তোলাবাজির দিকে বেশি নজর দেবে, সে নিয়ে তো সংশয়ের অবকাশ নেই।  

৬. মেডিকেল কাউন্সিল ইদানীং মেডিকেল কলেজে কলেজে ঘুরে নতুন ছাত্রছাত্রীদের এথিক্সের পাঠ দিয়ে থাকেন। সেখানেও এঁরাই শিক্ষক। যেমন আমাদের ঝাড়গ্রাম মেডিকেল কলেজে একবার এথিক্স পড়াতে এসেছিলেন বিশিষ্ট নীতিবান অধ্যাপক বিরূপাক্ষ বিশ্বাস ও নীতিচূড়ামণি সুশান্ত রায় মহোদয়। এবং এমন শিক্ষকরা যাতে এতটুকু মনোক্ষুণ্ণ না হন, তাই কলেজে কলেজে অধ্যক্ষরা এমন শিক্ষাক্রমে সকল অধ্যাপক-চিকিৎসকও (যদিও অনুষ্ঠানটি ডাক্তারি ছাত্রছাত্রীদের জন্যই) যাতে অবশ্যই হাজির থাকেন, সেই মর্মে দস্তুরমত হুলিয়া জারি করেন।

৭. কলেজে কলেজে অধ্যক্ষ হিসেবে যাঁরা আছেন, এবং এমএসভিপি হিসেবেও, (বিরল ব্যতিক্রম বাদে) তাঁদের প্রায় সকলেই উত্তরবঙ্গ-লবির ধামাধরা। এঁদের মধ্যে কারও কারও মেরুদণ্ড রয়েছে - সে মেরুদণ্ড কারও জেলি-র মতো, কারও বা রাবারের মতো - অনেকেরই আবার মেরুদন্ডটি সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। স্বাস্থ্যক্ষেত্রে গত কয়েকবছরের এই অভাবনীয় অরাজকতা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়েছে এঁদের সক্রিয় সহযোগিতার সুবাদেই। এঁদের কেউ কেউ কুকাজে সহযোগিতা করেছেন 'উপরমহলের নির্দেশ মেনে', কেউ আবার আগ বাড়িয়ে প্রোয়্যাক্টিভ হয়ে, প্রশাসনের সুনজরে আসার লোভে। অনেক বিভাগীয় প্রধানের ক্ষেত্রেও এই একই কথা। আন্দোলনের ঢেউয়ে এঁরা কেউ কেউ এখন ভালো সাজার চেষ্টা করছেন, কিন্তু আগের কাজকর্মগুলো ভুলে যাওয়া মুশকিল। 

আরও অনেক কথা-ই লেখা যেত - এবং আরও অনেক নামও। কিন্তু লেখাটা ফেসবুকের পক্ষে অলরেডি বেশি লম্বা হয়ে গেছে, আর বড় হলে কেউ পড়বে না।

মোদ্দা কথা হলো, স্বাস্থ্য-শিক্ষাব্যবস্থার যে বেহাল পরিস্থিতি, তাকে অন্তত কিছুটা ভদ্রস্থ অবস্থায় দাঁড় করাতে গেলেও যা যা বদল এখুনি করতে হবে - যে যে বদল না করলেই নয় -

ক) স্বাস্থ্য ভবনের শীর্ষপদে বদল। স্বাস্থ্যপ্রশাসক, যেমন ডিএমই থেকে শুরু করে আমলাদের (প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি ও হেলথ সেক্রেটারি, যাঁরা তৃণমূল ছাত্র পরিষদ আয়োজিত অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকেন, অভীক-বিরূপাক্ষদের সঙ্গে গা-ঘষাঘষি করেন, তাঁদের) বদল। মেডিকেল কলেজগুলোর অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষদেরও বদলি দরকার - তবে শীর্ষপদে বদল ঘটলে, সম্ভবত, তাঁরা আপাতত সমঝে যাবেন। অধিকাংশই হাওয়ামোরগের জাত - হাওয়া বদলাচ্ছে বুঝলে শুধরে যেতে সময় লাগবে না।

খ) বর্তমান মেডিকেল কাউন্সিল এখুনি ভেঙে দিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন তদারকি কাউন্সিল গঠন করে নতুন কাউন্সিল গঠনের প্রক্রিয়া শুরু করা।

এতগুলো কথা এজন্য বলা, কেননা, মূল ঘটনাটা ঘটেছে মেডিকেল কলেজে - যেখানে চরম অরাজকতা ও দুর্নীতির চাষ না হলে এ ঘটনা ঘটতেই পারত না এবং সেই ঘটনাকে লুকোনোর জন্য এতশত অপপ্রয়াসও হতো না - সুতরাং 'অভয়া'-র ধর্ষণ-খুনের ঘটনার 'জাস্টিস' চাওয়ার অন্যতম দিক, অন্তত আমার চোখে, এই পরিস্থিতির বদল। সম্পূর্ণ শুদ্ধিকরণ যদি না-ও হয়, পরিস্থিতির অন্তত খানিকটা উন্নতি।

হ্যাঁ, প্রমাণ লোপাটের জন্য বিনীত গোয়েলের অপসারণের দাবি খুবই যুক্তিযুক্ত। তবে মনে রাখতে হবে, প্রমাণ লোপাট বলতে তিনি এক তাল বিষ্ঠাকে কার্পেটের তলায় চাপা দিতে গিয়ে লেবড়ে ফেলেছেন।

কিন্তু বিষ্ঠাটি এলো কোত্থেকে? এই বিষ্ঠা কোন পায়ুদ্বার হতে নির্গত?

বিনীত গোয়েল - বা বিনীত গোয়েলরা - সরে যেতে পারেন (বা তাঁকে সরিয়েও দেওয়া হতে পারে), কিন্তু মূল উৎসমুখ বিষয়ে এখনই সোচ্চার না হলে পরবর্তী বিষ্ঠা চাপা দেবার জন্য উপযুক্ত সময়ে পরবর্তী কোনও বিনীত গোয়েল ঠিকই হাজির হয়ে যাবেন।


মঙ্গলবার, ৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

কাটছে ভয় ~ সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়

কালচে মেঘ
লালচে মুখ
দিচ্ছে শান
মুষ্ঠিবদ্ধ, যুথবদ্ধ 
রুদ্ররূপ - রুদ্ররূপ
কাটছে ভয়
এই সময় 
থমকে যান
কাঁপছে আজ, কাঁদছে আজ
রাস্তাঘাট - রাস্তাঘাট
বাঁধছে জোট 
উঠছে হাত
গাইছে গান
উচ্চস্বর, হাজার কণ্ঠ
দাও স্লোগান - দাও স্লোগান
অচেনা মুখ
চেনা আবেশ
চাইছে আজ
বিচার চাই, এখুনি চাই
প্রতিবাদ - প্রতিবাদ
হাজার হাত
হাজার পা
লক্ষ মন
চেতনায় লাগছে কি 
আজ আগুন - আজ আগুন?
বাঁধো জোট
ব্যারিকেড
কন্ঠ পাক
আজকে প্রাণ 
দিক স্লোগান দিক স্লোগান

পুলিশ ~ ডাঃ বিষাণ বসু

এ পুলিশ কেমন পুলিশ, পেছন দিকের দরজা ধরো
এ কেমন চাকরি তোমার, মিথ্যে কথার আবাদ করো
এ পুলিশ কেমন পুলিশ, খিড়কি দিয়ে পালিয়ে বাঁচা
প্রমাণ লোপাট করেই খালাস, কাজটি তোমার বড্ডো কাঁচা

চাকরির আগে জীবন, পরেও জীবন, বাড়িতে বাচ্চার মুখ
শুধু কি তেল মেরে আর ঘুষ খাওয়াতেই সবটুকু সুখ
আপিসের বাইরে জীবন, রাস্তা পাড়ায়, ভুলেই গেছো
চাচারা করছে সেটিং, তুমিও এখন পালিয়ে বাঁচো
রাত জেগে চাইছে বিচার, কত মানুষ হচ্ছে জড়ো
(তোমারই) ঘরের মানুষ চাইছে বিচার, মেয়েটাও হচ্ছে বড়

মাইনেয় সুখ হয় না, উপরি চাইছ, জুটছে যে ঘুষ
গাড়ি বাড়ি বিদেশভ্রমণ, বিলাসের হাজার ফানুশ
দাবি চেয়ে জাগছে সবাই, পালানোর জায়গা খোঁজো
মেয়েও তোমায় ঘেন্না করে, অবস্থাটা নিজেও বোঝো

এ পুলিশ কেমন পুলিশ, মান বাঁচাতে মুখ লুকোনো
ফেসবুকের ওই ঢপ ছেড়ে আজ মানুষের স্লোগান শোনো
মানুষের ভিড়ের মাঝে দাঁড়িয়ে আছে তোমাদেরও ছেলেমেয়ে
দাঁড়িয়ে আছে তোমার কাছে মরা বোনের বিচার চেয়ে
এখনও কষছ হিসেব, চাকরির আর প্রমোশনের
হিসেব তোমার মিটবে ঠিকই, চোখের জলে, রাত ও দিনের

ডাঃ বিষান বসু

সোমবার, ২৬ আগস্ট, ২০২৪

আরজিকর কাণ্ড ~ ডাঃ বিষাণ বসু

আরজিকর কাণ্ডের পনের দিন অতিক্রান্ত হওয়ার পর, আমার যেটুকু ব্যক্তিগত উপলব্ধি, তাতে মনে হয়, সেই রাত্রে ঠিক কীভাবে কী ঘটেছিল, তা কখনোই আর পুরোপুরি স্পষ্টভাবে প্রকাশ্যে আসবে না। শুরুর দিনকয়েক কলকাতা পুলিশ যেভাবে সাফল্যের সঙ্গে 'তদন্ত' করেছে, তাতে এখন শার্লক হোমস এরকুল পয়রো ব্যোমকেশ বক্সী একযোগে নামলেও পরিপূর্ণ সত্য উদঘাটনের সম্ভাবনা কম। জড়িত কেউ স্বীকারোক্তি জাতীয় কিছু দিলে একটা ক্ষীণ সম্ভাবনা থাকলেও থাকতে পারে, কিন্তু আপাতত তেমন সম্ভাবনা তো কিছু দেখছি না।
অতএব, হয়ত 'প্রমাণ' হয়ে যাবে, যে, সঞ্জয়-ই এক এবং একক অপরাধী। তার বিরুদ্ধে প্রমাণ মিলেছে, ঘটনাস্থলে পাওয়া স্পেসিমেন-এর সঙ্গে তার ডিএনএ-ও নাকি মিলেছে, অতএব…
মদ খেয়ে চুর একজনের পক্ষে প্রাপ্তবয়স্ক একটি মেয়েকে মারধর করে খুন ও ধর্ষণ এতসব করা সম্ভব কিনা, এসব প্রশ্নও, হয়ত, প্রশ্ন-ই রয়ে যাবে। আমাদের মেনে নিতে হবে, ধর্ষণ যদি সঞ্জয় করে থাকে (মেয়েটির জীবিত অবস্থায় বা মৃতদেহের উপর), তাহলে খুন-ও সে-ই করেছে। হয়ত সঞ্জয় সাজা পাবে, অথবা যথেষ্ট প্রমাণের অভাবে গুরু দণ্ড কিছু পাবে না। এই সব কিছুর সঙ্গে আমাদের মানিয়ে নিতে হবে। এদেশে যেমন হয় আর কি!
এখানে পুলিশ অপরাধী ধরার চাইতে অপরাধের প্রমাণ লোপাট করার কাজে বেশি দক্ষ।
এদেশে সর্বোচ্চ কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা, তাদেরও অপরাধী ধরার রেকর্ড তেমন ঈর্ষণীয় কিছু নয়।
এদেশে মহামান্য সর্বোচ্চ আদালত আগ বাড়িয়ে শুনানি করতে ডেকে আদ্ধেক শুনে পনের দিন বাদে বাকিটা শুনবেন বলেন।
এমতাবস্থায় আমজনতা যায় কোথায়? খড়কুটো ধরে বাঁচার মতো, মোবাইল ফোনে ভেসে আসা অজস্র খবরের মধ্যে আশার আলো খোঁজেন। যে খবরের অনেকটাই কল্পিত। গুজব। কিন্তু আশা করতে যে বড় ভালো লাগে! বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে, অমুকের দিকে সিবিআই এবার নজর দিচ্ছে... তমুকের সঙ্গে অমুকের যোগসাজশ প্রকাশ হয়ে যাবার মুখে...
আশায় আশায়, অনেকেই, খুব খুউব রাগ নিয়ে রাস্তায় নামেন। হাতে হাত রেখে লড়তে চান। প্রশ্ন করেন - এবারেও, এই এত বড় ঘটনার পরেও, কেউ ধরা পড়বে না? অনেকবার আশাহত হতে হলেও, আবারও আশায় থাকেন…
কোনও কোনও সাংবাদিক, দেখলাম, হয়ত শ্লেষের সুরেই তাঁদের প্রশ্ন করছেন - 'উই ওয়ান্ট জাস্টিস' বলে তো মিছিল করছেন, তা জাস্টিস-টা কার কাছে চাইছেন? শুনতে যতোই বিরক্তিকর লাগুক, প্রশ্নটা কিন্তু ভ্যালিড। এমতাবস্থায়, এই আশ্চর্য অবস্থায়, ন্যায় বলতে কী বুঝব? আর সেই ন্যায় কার কাছে চাইব??
দেখুন, এখনও অব্দি 'তিলোত্তমা'-র মৃত্যুরহস্যের সমাধান না হলেও একটা বড় রহস্য কিন্তু প্রকাশ্যে চলে এসেছে। মানে, ওখানে আর অতখানি রহস্য নেই। এবং 'তিলোত্তমা'-র ধর্ষক-খুনীর পরিচয় ততখানি স্পষ্ট না হলেও, এই রহস্যের কুশীলবদের নাম যথেষ্ট স্পষ্ট। সীমাহীন দুর্নীতি ও সেই দুর্নীতির কাণ্ডারীর নাম। নয়ই আগস্ট রাত্তিরের ঘটনা একা সঞ্জয়ের পক্ষে সম্ভব ছিল কিনা, সে নিয়ে সংশয়ের অবকাশ থাকলেও এই দুর্নীতি যে একা সন্দীপ ঘোষের পক্ষে চালিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল না, এবিষয়ে সকলেই নিঃসন্দেহ। খুন-ধর্ষণের দায় একা সঞ্জয়ের কাঁধে ফেলা সম্ভব হলেও হতে পারে - কিন্তু আরজিকর-এর অরাজকতার দায় একা সন্দীপের ঘাড়ে চাপানোর চেষ্টা সফল হওয়া মুশকিল।
এবং এই দুর্নীতি - যা আরজিকর মেডিকেল কলেজে উৎকর্ষের শীর্ষবিন্দু স্পর্শ করেছিল অবশ্যই - কিন্তু তা কেবলমাত্র এই একটি মেডিকেল কলেজে সীমাবদ্ধ ছিল, এমন কখনোই নয়। কথাটা মেডিকেল কলেজের শিক্ষক-অধ্যাপকদের সকলেই জানেন - জানতেন অনেকদিন ধরেই - তবে এখন হয়ত কেউ কেউ সেটা মুখে স্বীকার করতে পারবেন। আর ডাক্তারি-জগতের বাইরের লোকজন হয়ত কথাটা - দুর্নীতির এই লেভেলটা - সে বিষয়ে সদ্য জানলেন। মানে, বর্তমান আমলে দুর্নীতি যে কমবেশি সব জায়গায়ই চলে (আর স্বাস্থ্য-দফতর, প্রায় ঐতিহাসিকভাবে, ঘুঘুর বাসা), এটা সবাই জানেন - কিন্তু চিকিৎসা-শিক্ষার দুনিয়ায় তা যে এই স্তরে পৌঁছেছে, সেটা এখন জানতে পারলেন।
অনেকে হয়ত বলবেন, লাগামছাড়া এই দুর্নীতির শুরু ক্ষমতার পালাবদলের পর থেকেই। হতেও পারে। হতেই পারে। কিন্তু, বর্তমান শাসকদলের একান্ত বিরোধী হয়েও বলি, আমার তেমনটা মনে হয় না। মানে, দুর্নীতি অবশ্যই ছিল - কিন্তু ব্যাপারটা এই স্তরে পৌঁছেছে গত কয়েক বছরে। মোটামুটি বলতে পারি, বিগত মেডিকেল কাউন্সিল নির্বাচনটি পশ্চিমবঙ্গের স্বাস্থ্যব্যবস্থার ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। সে নির্বাচনে ঢালাও দুর্নীতি ইত্যাদি ঘটেছিল - সে আর কোন নির্বাচনে ঘটে না!! - কিন্তু সেই নির্বাচনে জয়ের মাধ্যমে রাজ্যের স্বাস্থ্যব্যবস্থায় শাসকদলের এমন একটি গোষ্ঠীর একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হলো, যাঁরা 'চিকিৎসক' হিসেবে বিবেচ্য হওয়ার যোগ্য কিনা, সে কথা তো ছেড়েই দিন, যাঁরা মানুষ হিসেবেই 'ভিন্ন' স্তরের। চিকিৎসার নৈতিকতার দেখভাল করার দায়িত্বপ্রাপ্ত মেডিকেল কাউন্সিলের হর্তাকর্তা হয়ে বসলেন এমন নীতিবোধহীন কিছু 'চিকিৎসক', সেই দুর্ভাগ্যজনক সত্যির বাইরে আরও বড় বিপদ - এঁদের ক্ষমতা স্রেফ মেডিকেল কাউন্সিলে সীমাবদ্ধ রইল না। মেডিকেল কলেজে কলেজে অধ্যক্ষ থেকে ডিন, সর্বত্র নিযুক্ত হতে থাকলেন এঁদের পছন্দের লোক - সবাই ধামাধরা এমন বলব না, কিন্তু অধিকাংশই তেমনই - স্বাস্থ্যশিক্ষার সর্বোচ্চ স্তরে অধিষ্ঠিতদের ক্ষেত্রেও তা-ই। দেখুন, আরজিকর মেডিকেল কলেজের ঘটনায় মেডিকেল কাউন্সিলের এক কর্ণধার চটজলদি সেখানে হাজির হন, কাউন্সিলের আরও কিছু তরুণ সদস্যদের নিয়ে। মেয়েটির বাবা-মাকে আত্মহত্যার খবর জানানো হলেও, সেই একই সময়ে (বা তার আগেই) তিনি জেনেছিলেন ধর্ষণ ও খুনের খবর - একথা তিনি নিজেই মিডিয়াকে জানান। পুলিশের তদন্তের সময়কালে (নাকি আগেই) তিনি কেন এসেছিলেন? তিনি কেন ধর্ষণ খুনের ঘটনা বিষয়ে অধ্যক্ষের সঙ্গে মিটিংয়ে বসলেন? যে সন্দীপ ঘোষ বিষয়ে এত কথাবার্তা উঠছে, কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট মাসকয়েক আগেই তাঁকে ঢালাও সার্টিফিকেট দিয়েছেন। কাউন্সিলের তরুণ তুর্কীদের প্রায়শই দেখা যেত আরজিকর-এ - এমনকি মেডিকেল কাউন্সিল নির্বাচনের 'বিজয়োৎসব' প্রথম পালিত হয় ওই আরজিকর-এই। মেডিকেল কাউন্সিলের হর্তাকর্তারা স্বাস্থ্যব্যবস্থার প্রতিটি স্তরে নাক গলাচ্ছেন, এমন এর আগে ঘটেনি।
মেডিকেল ছাত্র-রাজনীতিতেও একটা বড় বদল এসেছে এঁদের কল্যাণে। স্টুডেন্টস ইউনিয়ন নির্বাচন তুলে দেওয়ার সুবাদে ছাত্র-রাজনীতি বলতে মূলত দাদাগিরি - তোলাবাজি ইত্যাদি - ও পরীক্ষায় নম্বর বাড়ানো কমানো। শাসক-ঘনিষ্ঠ ছাত্র-রাজনীতি ও শাসক-ঘনিষ্ঠ অধ্যাপক-রাজনীতি যোগাযোগ রক্ষা করে চললেও দুইয়ের মধ্যে একটা দূরত্ব ছিল - দূরত্ব থাকাটাই স্বাভাবিক, এবং বাঞ্ছনীয় - বর্তমানে সেটি মুছে ফেলা গেছে। ছাত্র-নেতারা অধ্যাপকদের 'চমকায়' - অধ্যাপকরাও তাদের তোয়াজ করে চলেন, কেননা বদলি থেকে পদোন্নতি, সবই তরুণ তুর্কীদের হাতে। এবং স্বাস্থ্য-দফতরের শীর্ষ আমলা শাসকদলের ছাত্র-সংগঠনের অনুষ্ঠানে হাজির থাকেন - গদগদ হাসি মুখে পুষ্পস্তবক হাতে ছবি তোলেন - অতএব, আনাড়িরাও চট করে বুঝে যান, ক্ষমতার ভরকেন্দ্র ঠিক কোনখানে।
তো পুরো স্বাস্থ্যব্যবস্থাটা, এই মুহূর্তে, শাসকদলের যে গোষ্ঠীর দ্বারা যেভাবে পরিচালিত হচ্ছে - অনভিজ্ঞ আনাড়ি দুর্নীতিগ্রস্ত মূল্যবোধহীন কিছু জুনিয়র ডাক্তারের দ্বারা, মূলত - সঙ্গে কিছু ঘোড়েল ও ধান্দাবাজ সিনিয়র তো আছেনই, যেমন থাকেন - তার খোলনলচে না বদলালে কিছুই কাজের কাজ হবে না।
জাস্টিস চাই, বলতে - অন্তত এটুকু হোক।
সরকারি কর্মী হিসেবে এবং রাজ্যের একজন নাগরিক হিসেবে, আমার জাস্টিস-এর দাবি আমাদের রাজ্যের মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীর কাছে। একজন চিকিৎসক হিসেবে এবং সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত চিকিৎসক হিসেবে দাবিটা স্বাস্থ্যমন্ত্রীর কাছেও।
সিবিআই তদন্ত করতেই পারে - মহামান্য আদালত বিভিন্ন আকর্ষণীয় 'অবজারভেশন'-এর পর পরবর্তী শুনানির তারিখ শোনাতেই পারেন - কিন্তু নিজের দলের সীমিত কয়েকজন গোষ্ঠীবদ্ধ মাফিয়া সিন্ডিকেট গোছের কিছু চালিয়ে গেলে তা শুধরানোর দায় সেই দলের সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষের। এখানে 'তদন্ত চলছে' বা 'বিষয়টি বিচারাধীন' বলে দায় এড়ানোর সুযোগ নেই। সব জানার পরেও - বিশেষত সব প্রকাশ্যে আসার পরেও - না শুধরাতে চাইলে ধরে নিতে হবে, এই অনাচার চলে এসেছে (এবং চলতে দেওয়া হবে) সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সম্মতিতে।
তো স্বাস্থ্যমন্ত্রী পুলিশমন্ত্রী বা মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ জাতীয় কিছু দাবি আমার এখুনি নেই - গণতান্ত্রিক উপায়ে নির্বাচিত সরকারকে সরাতে গেলে ভোটের মাধ্যমেই সরাতে হবে, পদত্যাগের মাধ্যমে নয় - কিন্তু, জাস্টিস চাই বলতে আমি চাই রাজ্য স্বাস্থ্য-প্রশাসনের খোলনলচে বদল। প্রকাশ্যে যে মুখগুলো রয়েছে - চিকিৎসক-প্রশাসক থেকে শুরু করে আমলা অব্দি সকলেই - এবং আড়াল থেকে যারা কলকাঠি নাড়ছে, তার প্রতিটি স্তরে এখুনি বদল জরুরি। এবং যে চিকিৎসার নৈতিকতার দেখভালের দায়িত্ব যে মেডিকেল কাউন্সিলের, সেই স্টেট মেডিকেল কাউন্সিলের শীর্ষ সদস্যদের নাম যখন দুর্নীতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে যায়, তখন সেই কাউন্সিলকে যে বরখাস্ত করা একান্ত জরুরি, সে তো বলা-ই বাহুল্য।
এটুকু-তে সর্বজনস্বীকৃত জাস্টিস হবে কিনা বলা মুশকিল, কিন্তু অন্তত এটুকুও না হলে যে স্বাস্থ্য-প্রশাসন ও সামগ্রিকভাবে প্রশাসনের উপর মানুষের আস্থা ফিরবে না, সে নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই।
এবং, আমার মতোই, রাস্তায় যাঁরা আছেন, বিশ্বাস করুন, এই পোস্ট হতাশার পোস্ট নয়। অন্তত এই দাবিটুকু যদি আদায় হয়, তা, অন্তত স্বাস্থ্যব্যবস্থার পক্ষে, মস্ত বড় বদল। রাজ্যের স্বাস্থ্যব্যবস্থা এবং আগামী প্রজন্মের ডাক্তারি শিক্ষা - এই দুইয়ের পক্ষেই, এর চাইতে গুরুত্বপূর্ণ কিছু চাহিদা এখুনি মনে পড়ছে না।

বৃহস্পতিবার, ২২ আগস্ট, ২০২৪

এক্সকিউজ মি, প্লিজ ~ শাশ্বত চক্রবর্তী

'এক্সকিউজ মি, প্লিজ'। ভিড়ের মধ্যে থেকে ভেসে  এলো বাজখাঁই আওয়াজটা, একদম বিশুদ্ধ ব্রিটিশ অ্যাকসেন্ট।  জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ মিছিল বেড়িয়েছিলো অমৃতসরে।  সেই মিছিলেই কালা আদমিদের ভিড় ঠেলে সামনে এগিয়ে এলো এক ধলা, হাতে তার মোমবাতি।  আবার গর্জে উঠলো তার বাজখাঁই কণ্ঠ: " উই ওয়ান্ট জাস্টিস"। কাম সারসে, এ যে স্বয়ং জেনারেল রেজিনাল্ড ডায়ার!

- মানে? আপনিই তো গুলি চালালেন? আপনার আবার কিসের জাস্টিস চাই?

- আমি চক্রান্তের শিকার। আমরা ব্ল্যাঙ্ক ফায়ার করেছিলাম। ডিপ্রেশনে ভোগা দেশিগুলো সব কুয়োতে ঝাঁপ দিয়ে সুইসাইড করল। প্রমাণ আছে আমার কাছে,মৃতদের পকেট থেকে প্রেসক্রিপশন পাওয়া গেছে।

 

হতভম্ব জনতাকে আরো অবাক করে দিয়ে মিছিলের আরেকদিকে তখন আবির্ভুত হয়েছেন আরেক সাদা চামড়া। ওরে বাবা, এযে পাঞ্জাবের গভর্নর মাইকেল ও'ডায়ার!

- আপনি তো সেদিনই বললেন ডায়ার যা করেছে ঠিক করেছ। আপনি আবার এখানে?

- উই ওয়ান্ট জাস্টিস।কিছুলোক পাঞ্জাবকে বদনাম করতে চাইছে। এই প্রতিবাদ মিছিলেও সশস্ত্র হামলাকারী মিশে আছে, হয়তো তথ্য প্রমাণ লোপাট করতে চায়। তাছাড়া এটাও জানানো দরকার আমাদের সেক্যুলার গভর্নমেন্ট কিন্তু এখানেও সেক্যুলার কাজই করেছ।

- মানে ?

- মানে হিন্দু-শিখ নির্বিশেষে সেদিন সবাইকে মারা হয়েছ।  ধর্মের ভিত্তিতে কাউকে রেয়াত করা হয়নি।

 

ততক্ষনে মিছিলে হাজির বুদ্ধিজীবী শিরোমনি প্রখ্যাত সাহিত্যিক রুডিয়ার্ড কিপলিং।

- আপনি না সাম্রাজ্যবাদের প্রবল সমর্থক? আপনার মতে তো আবার ডায়ার নাকি ভারতের রক্ষাকর্তা! তা এদিকে কি পথ ভুল করে?

- উই ওয়ান্ট জাস্টিস।  এখন রাস্তায় না নামলে আমার বইয়ের বিক্রি কমে যাবে।  বিবিসি রেডিওতে 'ঘন্টাখানেক সঙ্গে ছিঁড়ুন' অনুষ্ঠানেও ডাক পাবো না আর। জবাব চাই, জবাব দাও।

- কার থেকে জবাব চাইছেন ?

- আপনাদের টেগোর এর থেকে।

- কেনো? উনি আবার এখানে কি দোষ করলেন ?

- আদিখ্যেতা হচ্ছে? নাদের শাহের সেনা যখন দিল্লীতে অতো মানুষ মারলো ,তখন নাইট উপাধি প্রত্যাখানের কথা মাথায় আসেনি ?কেবল দুনিয়ার সামনে ব্রিটিশরাজকে বদনাম করার ফিকির।

 

রবি ঠাকুরের জন্ম ১৮৬১ সালে।  ১৭৩৯ সনে নাদের শাহের আক্রমণের সময়ে তার বয়েস ঠিক কত ছিল সেই কঠিন অঙ্ক কষতে মিছিলের জনতা যখন ব্যস্ত, ঠিক সেই মুহূর্তে উল্টোদিক থেকে একটা ছ্যাকরা গাড়ি এসে থামলো মিছিলের মুখে। আজ শুধুই অবাক হবার দিন। কারণ গাড়ি থেকে নামলেন খোদ দেশের ভাইসরয়, চেমস্ফোর্ড সাহেব।  পরনে ধপধপে সাদা জামা, নীল কোট, পায়ে হাওয়াই চটি আর সাথে তার পোষা একঝাঁক বিড়াল। সাহেব আদর করে এদের নাম রেখেছেন লি-বেড়াল।  সে এক আশ্চর্য জানোয়ার মশায়।  ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বাইরে কোথাও কিছু অন্যায় দেখলে এরাই ভোল পাল্টে সিংহবিক্রমে গর্জে ওঠে সুতীব্র প্রতিবাদে। আর দেশে কোনো ঘটনা ঘটলেই অমনি চেমস্ফোর্ড সাহেবের চটিচাটা মিউমিউ মেনিবিড়াল। আবেগমথিত কণ্ঠে বক্তৃতা শুরু করলেন চেমস্ফোর্ড সাহেব:

" জনতার আবেগকে আমরা সম্মান করি। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে এর চেয়ে অনেক বড়ো নারকীয় গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে মরক্কোতে, যেখানে শাসক স্প্যানিশ; এ্যাঙ্গোলাতে পর্তুগিজ, কঙ্গোতে বেলজিয়ান বা লিবিয়াতে ইতালিয়ান শাসকদের বর্বরতার কথাও ভুললে চলবেনা। আমরা জানি এই মিছিলেও  এইসব ব্রিটিশবিরোধী শক্তির প্রত্যক্ষ মদত আছে।  যাইহোক, জনদরদী ব্রিটিশ সরকার নিহতদের পরিবারবর্গকে আর্থিক সাহায্যের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে।  মৃতের প্রোফাইল অনুযায়ী তার রেটকার্ড ধার্য হয়েছে। পাঁচ হাজার থেকে রেট শুরু ,আর কেউ ডাক্তার হলে তার পরিবার দশ লক্ষ টাকা পাবে। এছাড়া হান্টার কমিশন গঠিত হয়েছে, তাই অপরাধীদের নিস্তার নেই। উই ওয়ান্ট জাস্টিস।"

 

এতদূর শুনে মিছিলের মাঝে দাঁড়িয়ে চোয়া ঢেকুর তুলতে তুলতে জেনারেল ডায়ারের স্বগোতক্তি:

" ধুর মরা এই হয়েছে এক হান্টার কমিশন। গত ছদিন যাবৎ আমাকে ডেকে ডেইলি সাতঘন্টা ধরে সেই একই প্রশ্নগুলো করে যাচ্ছে আর আমিও চপ-সিঙ্গারা গিলতে গিলতে সেই একই উত্তর দিয়ে যাচ্ছি।  এত চপ-সিঙ্গারা খেয়ে আমার শালা অম্বল হয়ে গেলো"।

 

এদিকে কখন আবার মিছিলে যোগদান করেছেন সিডনি রাওলাট সাহেব। তার হাতে প্ল্যাকার্ড : 'এক দুই তিন চার, জনবিরোধী রাওলাট আইনের বহিস্কার'।

- এ আবার কেমন আঁতলামি? আপনিই তো যত নষ্টের গোড়া।  এ তো আপনার কমিটির তৈরী আইন !

- আমরা আইনের রচয়িতা। ল এনফোর্সমেন্টের দায় কেন নিতে যাবো? তাই সবার সাথে আজ আমিও প্রতিবাদে সামিল। উই ওয়ান্ট জাস্টিস"।

 

তারপর মিছিলটা অমৃতসর থেকে ট্রাফালগার স্কোয়ার হয়ে হাতিবাগান পেরিয়ে যেইনা শ্যামবাজার পাঁচমাথার মোড়ে ঢুকেছে, ওমনি--------------------------------------------------------------

ঘুমটা ভেঙ্গে গেলো। উল্টোপাল্টা খেয়ে পেটগরমের স্বপ্ন আরকি। বাস্তবের কোন ঘটনার সাথে মিল খুঁজেতে যাবেননা আবার। এক্সকিউজ মি, প্লিজ।

বুধবার, ৭ আগস্ট, ২০২৪

ভীনেশের লড়াই ~ বিহঙ্গ দত্ত

এই মুহূর্তটার জন্য গোটা অলিম্পিক ধরে অপেক্ষা করে এসেছি। কিন্তু কাল রাতে সৌমিক যখন ড্র জানালো তখন বুঝলাম, এ হওয়ার না। বিশ্ব কুস্তিতে সুজাকি একটা নাইটমেয়ার। ৮২ টা লড়াই লড়েছেন আন্তর্জাতিক পর্যায়ে। একটিও হারেননি। আনসিডেড হয়ে অলিম্পিক মঞ্চে আসার কারণে ভীনেশের ড্র খারাপ হবে সবাই জানত। কিন্তু এক্কেবারে প্রথমেই বাঘের মুখে পড়বে জানা ছিল না। যখন পড়ল তখন রেপচোজের রাউণ্ডের জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় দেখলাম না দুজনেই। 

কিন্তু কেন আনসিডেড থাকলেন ভারতীয় কুস্তির আখড়ার শ্রেষ্ঠ যোদ্ধা? তাঁর লড়াই ৫৩ কিলো ক্যাটাগরিতে। অন্তিমকে জায়গা ছেড়ে দিতে হয়েছে সেই ক্যাটাগরিতে। পাঙ্গাল ভারতের কুস্তির নতুন তারকা। সবার নজর তাঁর দিকে। ভীনেশ যখন ডাইরেক্ট তাঁর নাম পাঠানোর আবেদন করে ফেডারেশনের কাছে সে কি কটূক্তি ভক্তকুলের! এ কারণেই তো আন্দোলন! এ কারণেই তো নমস্য রে*পি*স্ট ব্রিজভূষণজির বিরুদ্ধে কুৎসা! 

সাক্ষীর বয়স হয়ে গেছে। তাঁর দরজা যে এবার বন্ধ হবে সবাই জানত। জানত না যে বজরঙ-এর সঙ্গে এই নোংরামোটা হবে ডোপিং টেস্ট কিট নিয়ে। আরেকবার কোয়ালিফাই করার সুযোগ বরবাদ করে ভক্তকুল উল্লাসে ফেটে পড়ল। বজরঙ নেই। সাক্ষী নেই। ভীনেশ পুরো একা পড়ে গেল। ঠিক করল ওয়েট কমিয়ে খেলবে। 

রেস্টলিং-এ ওয়েট কমিয়ে খেলা ভয়ানক চাপের ব্যাপার। আজকেই দেখছিলাম যে ফুল মিল অব্দি করতে পারে না রেস্টলাররা। জল খাওয়া যায় না প্রপারলি। তাই নিয়ে ভীনেশ লড়ল মাত্র একমাসের নোটিশে এবং কোয়ালিফাই করল। ভক্তকুল বলল ফ্লুক! প্রথম রাউণ্ডেই ফুটে যাবে। 

তাই যখন সুজাকির নাম শুনলাম তখন দমে গেছিলাম। শুধু সরে যাওয়া না, চোট আঘাতের ভয় কাজ করছিল ভীষণভাবে। অনেকেই ১৬-র অলিম্পিকের ওই ভয়ংকর নি ডিসলোকেশনের দৃশ্য ভোলেননি। সেবার স্ট্রেচারে করে রিং ছাড়তে হয়েছিল ২১ বছরের ভীনেশকে। গতবছর সেই হাঁটুর চোটেই কেরিয়ার খতম হতে বসেছিল। অপারেশনের পর ক্রাচ নিয়ে হাঁটতে হত ভীনেশকে। 


দুপুর ৩ টে ১০। ভীনেশ লড়াই শুরু করল। ক্ষিপ্র চিতাবাঘের মতো ওঠানামা। সুজাকিকে ছুঁতে দিল না প্রথম হাফে। তবু একটাবার পায়ের নাগাল পেয়ে গেছিল সুজাকি। ১ সেকেণ্ডের ৫ ভাগের এক ভাগ সময়ের মধ্যে নিজেকে মুক্ত করে ভীনেশ। সুজাকির চোখে ওই প্রথম বিস্ময় দেখেছিলাম। 

কিন্তু উপায়ান্তর না দেখে ট্যাকটিকালি প্যাসিভ হওয়ার কারণে পরপর দুটো হাফেই একটা করে পয়েন্ট গিফট করল সুজাকিকে। ম্যাচের বাকি আর ১০ সেকেন্ড। বিমর্ষ হয়ে গেছি। তখন ঝলসে উঠল তরবারির মতো দুটো হাত! 

এই হাতদুটোকে ধরে টানতে টানতে নিয়ে গিয়েছিল দিল্লি পুলিশ। সাতজন মিলে ছ্যাঁচড়াতে ছ্যাঁচড়াতে ছুঁড়ে ফেলেছিল রাস্তার ধারে। ব্রিজভূষণ সহাস্য মন্তব্য করেছিল- কান্ধো কি জোর কম পড় গ্যায়ি ক্যা? 
 কান্নায় ভেঙে পড়তে পড়তে এই হাতদুটো জড়ো করে ভীনেশ আর বজরঙ্গ বলেছিল সরযূর তীরে মেডেল ভাসিয়ে দেবে। 
সাক্ষী বলেছিল- আই কুইট! 

সেই হাত ঝলসে উঠল। সুজাকি তখন জয়ের জন্য প্রায় নিশ্চিত। একটু কি কোর্টের কোনায় সরে গেছিলেন? ক্রুদ্ধ ঈগলের মতো আঁকড়ে ধরে উল্টালেন ভীনেশ! সপাটে আছড়ে পড়ল সুজাকি কোর্টের বাইরে। রেফারির হাত উঠল দুটো আঙ্গুল উঁচু করে। 

প্রথম খানিকক্ষণ বিশ্বাস হচ্ছিল না। আমি আর সৌমিক দুজনেই হোয়াটস্যাপে বারবার একে অপরকে লিখে যাচ্ছি ওহ মাই গড! ওহ মাই গড! 
অপ্রতিরোধ্য ৮২-র গতি থামল। স্ক্রিনজুড়ে বড়ো বড়ো করে লেখা হল ৮২-১। 

বেলা ৪টে ৩০। পরের লড়াই ইউক্রেনিয়ানের সঙ্গে। রেস্টলিং এক তুমুল নিষ্ঠুর খেলা। যে জিতছে সে দম ফেলার অবকাশ পায় না। আগেই লিখেছি ভীনেশকে ওয়েট কমাবার জন্য কী কী করতে হয়েছে। ওই অশক্ত অবস্থায় কোয়ার্টার খেলার জন্য নামল ভীনেশ। ইউক্রেনিয়ান ওকসানা এদিকে ১০-২ এ ম্যাচ হারিয়ে ফুটছে রীতিমতো। ধীরস্থির শুরু হল। খানিক পরেই বোঝা যাচ্ছিল এ লড়াই ভীনেশ শুধু জেতার জন্য লড়ছে না। লড়ছে এক আকাশ অপমান আর আসমুদ্র লাঞ্ছনার বিরুদ্ধে। ব্রিজভূষণ বলেছিল ১৫ টাকার মেডেলজয়ী! ওই যে সাক্ষীকে চ্যাং দোলা করে নিয়ে যাচ্ছে পুলিশ! বজরঙ-এর মুখে থুথু মেরেছিল ভক্তরা! সবাই দেখো, আমি লড়ছি। সাতজন মিলে টানতে টানতে যখন নিয়ে যাচ্ছিল তখনও হাত থেকে জাতীয় পতাকা সরেনি। সে হাত এত সহজে হার মানবে না। 
 
পরপর সিঙ্গল লেগ অ্যাটাক! ৪-০ তে এগোলো ভীনেশ। ছাড়ার পাত্র নয় ওকসানা। ট্যাকটিকাল মুভে আছড়ে ফেলল ভীনেশকে কোর্টের বাইরে। মাঝে খেলা বন্ধ হল দুইবার। কিছুতেই শেষ টাইম সেট করতে পারছেন না জাজেরা। শেষ ৮ সেকেণ্ড! কোর্টে তখন ঝড় উঠেছে। একটা হিলহিলে সাপের মতো নিজেকে বাঁকিয়ে চুরিয়ে ওকসানার হাত থেকে বাঁচাচ্ছেন ভীনেশ! ফিনিশিং বেল বাজল গম্ভীর সুরে। 

মিডিয়া উত্তাল এখন। কেউ যা ভাবেনি তাই হতে চলেছে কি? ভল্ট ঘেঁটে সোশাল মিডিয়ায় উঠে আসছে দিল্লির রাজপথের ছবি, উঠে আসছে হাতজোড় করে কান্নার বিমর্ষ দৃশ্য! উঠে আসছে বিষাক্ত সাপেদের ছোবল মারার মুহূর্তগুলো! 

রাত ১০টা ১৫। সেমিফাইনাল। বিপক্ষ কিউবান আগের ম্যাচে পুরো সময় খরচাই করতে দেননি। ১০-০ স্কোর করে দিয়েছেন অনায়াসে। কিন্তু এ ধারে ভারে ভীনেশের মাপের রেস্টলার নয় তা বলছিল অ্যানালিস্টরা। এই বছরেই ভীনেশ একে হারিয়েছে ৩-১ এ। লড়াই শুরু। প্রথম হাফে চারবার লেগ অ্যাটাক বাঁচাল ভীনেশ। দ্বিতীয় হাফে যখন প্যাসিভ পয়েন্ট যাচ্ছে ভীনেশের এগেন্সটে তখন কমেন্টেটর খানিক অশান্ত। এত কেন স্লো খেলছে? উল্টোদিকে সাক্ষী তখন বড্ড ঠাণ্ডা গলায় বলল, একটা সুযোগের অপেক্ষা করছে ভীনেশ! পেলে ম্যাচ বের করে নেবে। সুযোগ এল প্যাসিভ পয়েন্টের একদম শেষ ১২ সেকেণ্ডের মাথায়! এবার ডাবল লেগ অ্যাটাক! জানপ্রাণ দিয়ে পাক মারছে গোটা শরীরটা! কোথায় ব্রিজভূষণের চ্যালারা? কোথায় গোদি মিডিয়া? কোথায় আইটি সেলের ট্রলবাজরা? ওই ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপের মেডেলটাকে ১৫ টাকায় কেনা যায় বলেছিলি! সব দাঁত নখ নিয়ে আয়! দেখ, ভীনেশ লড়ছে! পরপর ৪ পয়েন্ট এল। ম্যাচ ওখানেই শেষ। 

কোনও কোনও ইতিহাস তৈরি হয় বড্ড নিশ্চুপে। যাকে দেশদ্রোহী বলে দাগিয়েছিল আইটিসেল বাহিনী তাঁর কাঁধে আজ গোটা দেশের ভার। ওই কাঁধের জোর মাপতে গেছিল ব্রিজভূষণ! আসুন বাহুবলি! মেপে যান! 

সামনে ফাইনাল। ভীনেশ একা নয়। পেছনে ভূতের মতো উঠে আসছে পাঞ্জাব, হরিয়ানা, মহারাষ্ট্রের চাষীরা। উঠে আসছে তাঁর সংগ্রামসঙ্গী সাক্ষী মালিক, বজরঙ্গ, দিদি গীতা, বৃদ্ধ জ্যাঠা মহাবীর সিং ফোগট! উঠে আসছে মতি নন্দীর গল্পের চরিত্ররা! ট্রামের পাদানি থেকে অফিস কামাই করে নামল কমল গুহ। গ্যারেজের কাজ সেরে ছুটতে ছুটতে হাজির হল প্রসূন। শীতল, কালো জল ঠেলে উঁকি দিল কোনির মুখ, রুটির দোকানের মাল নামিয়ে ঋজু হয়ে দাঁড়াল শিবা! সিনা টান করে দাঁড়াল গোটা ভারতবর্ষের মেহনতি! 

ফাইনালের দিন এরা সবাই থাকবে। ভীনেশ ফোগট জানে ওই মারণপ্যাঁচের থেকেও কঠিন ছিল সেদিনের ঘাড়ধাক্কা, থুৎকার! সেদিন হাল ছাড়েনি যে বন্ধুরা, তারা ছেড়ে যাবে না ভীনেশকে। একাকী যাবে না অসময়ে।


সোমবার, ২২ জুলাই, ২০২৪

πকাব্য ~ আশুতোষ ভট্টাচার্য্য

πকারি দরে পটল বেগুন লাউ কুমড়ো বা উচ্ছে
ছাπ  সাড়ির নানা ডিজাইন রঙিন ময়ূরপুচ্ছে!
জলπ আর জল এক নয়, ডিফারেন্স নয় অল্প
চারিদিকে কত শিক্ষিত চোর, πরেট কপি গল্প।
πরিয়া আর πলসের কোন স্থায়ী সমাধান πনে
শিমলা গিয়েছে মুগ্ধ হয়েছি দেবদারু আর πনে।
πথন শিখে মাইথন গিয়ে কোπ নদীর পার্শ্বে , 
πনি তোমার দর্শন প্রভু পৃথিবী বা মহাকর্ষে।
πইক সেπ বরকন্দাজ সাজুগুজু বরযাত্রী
πপয়সার হিসেব কি দেয় কলেজ ছাত্রছাত্রী।
শনি বুধ আর বিশ্যুদবার πইকপাড়ায় যাই না 
মাঝে মাঝে তব দেখা π চিরদিন কেন π না।। 

হ্যাপি ২২/৭ দিবস। যদিওবা অফিসিয়ালি পাই ডে চোদ্দই মার্চ(৩.১৪)।

শনিবার, ১৩ জুলাই, ২০২৪

ইস্কুল, মিড ডে মিল ও তাঁর নিজস্ব অনুভব ~ সীমান্ত গুহঠাকুরতা

 

"মাস দুয়েক হল এক চরম অভাবের সংসারের কর্তা সেজে বসেছি। এ এক অদ্ভুত 'নেই-রাজ্য'। স্কুল-বাড়ি ভেঙে পড়ছে -- রক্ষণাবেক্ষণের পয়সা নেই, শিক্ষক নিয়োগ হয় না -- আংশিক সময়ের শিক্ষকের বেতন দেবার সামর্থ্য নেই,  বাচ্চারা প্রচন্ড গরমে কষ্ট পাচ্ছে -- পর্যাপ্ত পাখা কেনার ফান্ড নেই, স্কুল চত্বরে রাত্রে বহিরাগত সমাজবিরোধী ঢুকছে – নিরাপত্তা রক্ষী রাখার অনুমতি-অধিকার কোনোটাই নেই। বাচ্চাগুলো ক্ষিধেয় মুখ কালো করে ঘুরে বেড়ায় -- তাদের পাতে একটু সুখাদ্য তুলে দেবার ক্ষমতাও নেই। মাথাপিছু বরাদ্দ যা, তা দিয়ে ওই ডাল-ভাত-আলু কুমড়ো অথবা আলু-সয়াবিনের 'থোড় বড়ি খাড়া খাড়া বড়ি থোর' চালিয়ে যেতে হয় দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর। 

কিন্তু ভালোবাসা? সেটুকু কি আছে আমাদের? শাস্ত্রে বলেছে 'শ্রদ্ধায়া দেয়ম্‌', অর্থাৎ যাকে যেটুকু দেবে শ্রদ্ধার সঙ্গে দেবে। শ্রদ্ধা তো অনেক বড় ব্যাপার, বাচ্চাগুলোর পাতে দুপুরের অন্নটুকু তুলে দেবার সময় সামান্য দরদ বা ভালোবাসাটুকুও কি আমাদের থাকে? আমরা, পেটমোটা মধ্যবিত্তের দল আজও তো মিড-ডে মিলটাকে নিছক দয়া হিসেবেই দেখি, ভাবি রাষ্ট্রীয় খয়রাতি। আর আমার মত যারা ব্যবস্থাটার সঙ্গে জড়িত তারা তো এটাকে পড়াশুনার সঙ্গে সম্পর্কহীন একটা উটকো ঝামেলা হিসেবেই গণ্য করি। তাই গ্রামের সেলফ-হেলফ গ্রুপের মহিলারা রান্না করেন, বাচ্চাগুলো থালা হাতে গিয়ে দাঁড়ায়, ভচাৎ করে এক থাবা ভাত আর এক হাতা ডাল এসে পড়ে, সেই থালা নিয়ে গিয়ে ওরা কোনো কোনায় গিয়ে বসে গপগপ করে গেলে। কেউ কোনোদিন ওদের ডেকে জিজ্ঞেসও করে না, 'কীরে, পেট ভরেছে?' কিংবা 'আরে একটু ভাত বা তরকারি নিবি?' কেউ ভুলেও জানতে চায় না, 'আজকের রান্নাটা কেমন হয়েছে রে?' 

মাঝে মাঝে পরিদর্শকরাও আসেন। তিনি রান্নাঘর, ভাঁড়ার ঘর বা খাবার ঘর – কোথাও উঁকিটিও মারেন না। এসেই অফিসঘরে খাতা-পত্তর নিয়ে বসে যান, অর্থাৎ কাগজ-পত্রে হিসেব-নিকেশ ঠিক থাকলেই তিনি খুশি। সেই হিসেব উপর-মহলে গেলে উপর-মহলও খুশ্‌। বাচ্চাগুলো খাচ্ছে, নাকি কাগজপত্র খাচ্ছে – বোঝা দায়!! প্রতিবার পরিদর্শনের শেষে তিনি যখন প্রসন্ন চিত্তে গাড়িতে উঠে বসেন, তোতাকাহিনীর সেই নিন্দুকের মত তাঁকে ডেকে বলতে ইচ্ছে করে, 'মহারাজ, পাখিটাকে দেখিয়াছেন কি?' 

ছোটবেলায় দেখেছি চূড়ান্তের অভাবের সংসারে মা কচু-ঘেঁচু কত কিছু রাঁধত। কিন্তু যা-ই রাঁধুক না কেন, খাবার সময় তা থালায় করে তা সাজিয়ে দিত পরম যত্নে। মায়ের সেই ভালবাসাটুকুই তো অর্ধেক পেট ভরিয়ে দিত। আমি তাই জানি, পাতে কী তুলে দেওয়া হচ্ছে, সেটা বড় কথা নয়, বড় কথা হল সেই খাবারের সঙ্গে মিশে থাকা দরদটুকু, যত্নটুকু, ভালোবাসাটুকু। 

আজ সকাল থেকে টিপটিপ বৃষ্টি। আবহাওয়া মনোরম। হুকুম দিয়েছিলাম, আজ তবে খিচুড়ি হোক। সঙ্গে ভাজাভুজি কিছু হবে না? ডোন্ট পরোয়া। খিচুড়িতেই পড়ল আলু, টমেটো আর ডিম ভুজিয়া। লোভ সামলাতে না পেরে থালা হাতে দাঁড়িয়ে গেলাম ওদের সঙ্গেই এক লাইনে। আনন্দে হইহই করে উঠল ভৈরব বাহিনী। তারপর ওদের সঙ্গেই বসে সুড়ুৎ-সুড়ুৎ করে গরম-গরম খিচুড়ি আর অঢেল গল্প। একজন বলল, 'স্যর, আজ কিন্তু খিচুড়িটা হেব্বি হয়েছে'। বললাম, 'যা, আরেকটু নিয়ে আয়'। একগাল হেসে ছেলে দৌড় মারল থালা হাতে। আরেকজন খেলার টানে অর্ধেক খেয়ে উঠে যাচ্ছিল, বাকিরা ধমক দিল, 'অ্যাই, স্যর বলেছে না, ভাত নষ্ট করতে নেই'। সে বেচারি কাচুমাচু মুখে আবার খাবারে মন দিল। 

'দেশে-বিদেশে'-তে মুজতবা আলি পাঠানদের মেহমান-নওয়াজীর বর্ণনা দিতে গিয়ে দিয়ে একটি বাক্যে লিখেছেন, 'দোস্ত/তুমহারে রোটি, হামারে গোস্ত', অর্থাৎ 'তুমি যে আমার বন্ধু এই আমার পরম সৌভাগ্য, শুধু শুকনো রুটি আছে? কুছ পরোয়া নেই, আমি আমার মাংস কেটে দেব'।"

শুক্রবার, ১২ জুলাই, ২০২৪

চন্দন বসু নিয়ে ~ অশোক চক্রবর্তী

ঢাকা পড়ে থাকা কিছু কথা॥ 

১৯৬৯ এ বিজ্ঞান বিভাগে দ্বিতীয় ডিভিশনে পাশ করে চন্দন ভর্তি হন সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে। ১৯৭১ তে পারিবারিক পরিচিতির সূত্রে ফারুক আবদুল্লা তাকে রাজ্যের কোটায় জম্মু কাশ্মীর মেডিকেল কলেজে ভর্তি করান । ১৯৭৪ তে পড়া অসমাপ্ত রেখে তিনি কলকাতায় ফিরে এসে আবার সেন্ট জেভিয়ার্সে ভর্তি হন । 
১৯৭৭ তে বেঙ্গল ল্যাম্প এ সেলস ম্যানেজমেন্ট ট্রেনি হিসেবে কাজে ঢোকেন ,  স্নিগ্ধা ওয়াহির সঙ্গে প্রেম ও বিয়ে হয়। স্নিগ্ধা হলেন ইন্ডিয়া স্টিমশিপে কাজ করা শিশির ওয়াহি'র বোন। শিশির রিটায়ার করে কলকাতা ফিরে কিছু ব্যবসা করার চেষ্টা করেন। এদিকে ১৯৭৮ এ চন্দনের প্রথম কন্যা হয় এবং যেহেতু তার সংসার আলাদা ছিলো, সেও খরচ সামলানোর জন্য কিছু একটা করার কথা ভাবছিলো। 

এসময় ব্রিটানিয়া বিস্কিট মুর্শিদাবাদে  তাদের সেলস ফ্রাঞ্চাইজি খুঁজছিলো।  শিশির ও চন্দন , "ওম্কার ট্রেডিং কোম্পানী" নামে সেই ফ্রাঞ্চাইজি নেয়।  তখন বিস্কিটের বাজার ছিলো বাংলায় প্রায় ৩০ কোটির আর বৃদ্ধি ছিলো বছরে ২০ % হারে। 

শিশির চন্দন একটা বিস্কিটের নিজেদের কোম্পানী খুলতে চেয়ে ১৯৭৯ তে তৈরি করলো, নিজেদের সঞ্চয়ের ৫ লাখ ক্যাপিটালের "ইস্টার্ন বিস্কিট কোম্পানি"। Durgapur Development Authority এর কাছে ৬০ বছরের জন্য জমি লিজে পেলো,  SME হিসেবে ২ একর, একর প্রতি ৫০,০০০টাকায় ।  ৩৪,০০০ টাকা জমা দিয়ে ও বাকি টাকা ৪ টি কিস্তিতে দেবার চুক্তিতে জমির পজেসন পেলো। এসবই সরকারি নিয়মে চলছিলো। প্ল্যান্ট ডিজাইন সরকারি কর্তাদের পরামর্শ নিয়ে স্ক্রুটিণি করিয়ে জমা দেওয়া হলো আর সেভাবেই প্ল্যান্ট তৈরি এগিয়ে চললো । 

সরকারি নিয়ম মেনে WBFC এর কাছে ২৪ লাখ  ব্যাংক লোনের জন্য কোম্পানী দরখাস্ত করলো। টার্ম ক্যাপিটাল ২৯ লাখ, ওয়ার্কিং ক্যাপিটল ১২ লাখ ,  মোট ৪১ লাখ । মার্চ,  ১৯৮০ স্যাংসন হলো ১৮ লাখ, মে তে ডিসবার্স হয় ৯ লাখ। সরকারি ও ব্যাংকের নিয়মে এক SSI হিসেবে ৩,৪৫ লাখ টাকা ক্যাশ সাবসিডি ও   ৭৫ হাজার টাকা সিড মানি পাওয়ার কথা।  একেতো প্রোজেক্ট আর্থিক সহায়তা ৬৬ % কমিয়ে দিলো ব্যাংক তার উপর ৪,২০ লাখ টাকা আটকে রাখলো তারা। 

এদিকে যখন প্ল্যান্ট অনেকটাই হয়েছে,  DDA আসরে এসে জানালো প্ল্যান্ট ডিজাইনে ভুল আছে। ক্যাশ ক্রাঞ্চ এ ভুগতে থাকা একজন এন্টারপ্রেনার এর কাছে এর চেয়ে বড় দুঃসংবাদ আর হয়না । 

কিন্তু আরও বড় দুঃসংবাদ টা এলো "বিপ্লবী" যতীন ও তার সহোদর(!) সুবোধ বাবুদের দলের কাছ থেকে। আনন্দবাজার/ বর্তমান দের কাজে লাগিয়ে চন্দনের বিরুদ্ধে কুৎসা শুরু করলেন কারন তারা ভেবেছিলেন এতেই জ্যোতি বাবুকে পাঁকে নামাতে পারবেন।  

মমতা দেবীর ভাইপো , হেকিম সাহেবের মেয়ে, মাঝি সাহেবের ছেলে , কাকলী দেবীর দুই ছেলের নাম সম্প্রতি আম জনতা জানতে পেরেছে ডাক্তার বলে। এর বাইরে কতো সব ""পোতিভাবান" ছেলে মেয়ে আছে এমন নেতাদের যারা ডাক্তার হয়ে বসে আছেন। কিভাবে তারা ডাক্তার হয়েছেন তার একটা নমুনা ছিলো মাঝি সাবের ছেলের পরীক্ষা নিয়ে সংবাদ ভাষ্যে। 

এর বাইরে যারা আজ প্রকাশ্যে তাড়া তাড়া নোট নিচ্ছেন, যাদের মধ্যে আছেন অমিত শা'র ছেলে জয় শা বা মমতা ব্যানার্জীর ভাইপো অভিষেক ব্যানার্জী ,(এমনকি মোরারজি'র ছেলে কান্তিভাই)  যাদের কড়ে আংগুল সঞ্চালনে ব্যাংকের কোটি কোটি টাকা লুট হয়ে যায়, যেসব পার্টির খুচরো পাড়ার নেতা ঠিক করে দেন কার কপালে কতো কাটমানি জমা পড়বে  তারা ভাবতেই পারবে না সর্ব শক্তিমান মুখ্যমন্ত্রীর ছেলে ২০/ ২৫ লাখ টাকার সংস্থান না করতে পারার জন্য আর DDA /WBFC স্তরের কিছু পুঁটি অফিসারের বিরোধিতার জন্য এক নবীন এন্টারপ্রেনার তার সঞ্চয় জলে ফেলে বাড়ি চলে এলো। 

জ্যোতিবাবুকে কিছু বলতে হতো না ,  শুধুই জয়কৃষ্ণ বাবু এদের কাউকে দেখে না হাসলেই যখন চন্দন হার্ডল মুক্ত হতে পারতো সেখানে সেটুকু মাত্র এঁরা করেননি।  

আনন্দবাজার/ বর্তমান এবং যতীন/সুবোধ চক্র এক নবীন এন্টারপ্রেনার কে ধংস করতে চেয়েছিলেন ।  

চন্দন তাই বলেছিলেন,  আমার অপরাধ ছিলো আমি জ্যোতি বসুর মতো এক রাজনীতিকের ছেলে হয়ে জন্মেছিলাম তাও আবার এই বাংলায়। 

জ্যোতিবাবুর জন্মদিন উপলক্ষ্যে তাঁর ছেলেকে নিয়ে কেনো লিখলাম ? 
উপসংহার টা হলো ,  জ্যোতি বাবুর এই ঋজু ও সততাকে কোনও মতে  ঢাকা দেওয়া যাবে না  "মমতা সততা শাড়ি"র ঢক্কানিনাদে॥ জ্যোতিবাবু তাঁর পরিবারের ক্ষেত্রেও সৎ জীবন কাটিয়েছেন॥ 

জ্যোতিবাবু / বুদ্ধবাবুর ব্যক্তি সততার ক্ষেত্রে পায়ের নখের যোগ্য নন তাঁদের সমালোচকেরা ॥ রাজনীতির সমালোচকরা রাজনীতির সমালোচনা করুন কিন্তু ব্যক্তিগত সততার প্রশ্নে কিছু বলার আগে নিজের দিকে তাকান ॥  

কৃতজ্ঞতা :  জ্যোতির্ময় হাজরা দা 

তিনি নেই, তাঁর ছড়িয়ে যাওয়া মণিমানিক্য গুলো আছে!❤❤

সোমবার, ১ জুলাই, ২০২৪

ডক্টরস ডে ~ ডাঃ সমুদ্র সেনগুপ্ত


চেতনার জগতের এক মহাশূন্যতা আর ভারসাম্য রক্ষা করার খেলায় নিয়োজিত দুই খেলোয়াড়, চিকিৎসক আর রুগী আর বাকি অসংখ্য মানুষ যারা সবাই স্বঘোষিত আদর্শবান রেফারি হিসেবে হুইসিল মুখে অপেক্ষমান যে চিকিৎসকদের বিন্দুমাত্র ত্রুটি বিচ্যুতি দেখলে "ফাউল" বলে ফুউউউর করে বাঁশি বাজিয়ে দিতে সদা প্রস্তুত এমন অবস্থায় দাঁড়িয়ে আত্মরক্ষার স্বার্থে চিকিৎসক সমাজের একটা বড় অংশ নিজেদের, ঈশ্বর নই, নিছক পেশাদার" এই মডেলটা আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চাইছেন। 

দার্শনিক রেনে দেকর্তে এর দ্বিত্ববাদের এই মডেল, যাতে প্রাণ ও মনকে আলাদা ভাবে দেখানো হয়েছে তার সীমাবদ্ধতা এইখানেই যে সেটা চিকিৎসককে নিরাসক্ত, নৈব্যর্তিক বিজ্ঞান-পেশাদার এর সীমাবদ্ধ ভূমিকায় আটকে রেখেছে। ওই মডেল এর বিপ্রতীপ কোনো মডেল যেখানে যুক্তিশাস্ত্র, মনস্তত্ববিদ্যা, নীতিশাস্ত্র সবকিছুই মিশে আছে,  মেডিসিন এর তেমন  দর্শনতত্ত্ব এর তত্ত্বতলাশ সামান্য একটু করে দেখা যেতে পারে। 

ডাক্তার শব্দটা শব্দতত্ব অনুযায়ী আসলে শিক্ষক থেকে এসেছে। চিকিৎসকের ঐতিয্যপূর্ণ অবয়ব ও অবস্থানের ঐতিহাসিক বস্তুগত উপাদান আছে যার ওপরে দাঁড়িয়ে রুগীর সাথে(এবং তার বাড়ির লোকের সাথে) সংলাপে তার ভূমিকাটা নিরূপিত হচ্ছে।ইন্টেলেকচুয়াল হেজিমনির আসন থেকে সরে এসে (যেমনটা রিচার্ড ফাইনম্যান বলেছিলেন), একজন চিকিৎসক রোগীকে বা তার বাড়ির লোককে ঠিক কি ধরনের যে ভাষা, শব্দ প্রয়োগ করে সংলাপে যাবেন যাতে করে সেটা অন্যদের অনুধাবনযোগ্য হয়, সেটা মস্ত একটা চ্যালেঞ্জ। চ্যালেঞ্জের এটা শেষ নয়, এটা শুরু। 

বিংশ শতাব্দীর মেডিক্যাল এথিক্স এর সম্ভবতঃ সবচেয়ে পরিচিত বিশেষজ্ঞ ডাঃ এডমান্ড পেলেগ্রিনো এর ভাষায় "মেডিসিন হল বিজ্ঞানসমূহের মধ্যে সবচেয়ে মানবিক, শিল্পকলাগুলির মধ্যে সবচেয়ে প্রায়োগিক এবং মানবীবিদ্যাগুলির মধ্যে সবচেয়ে বিজ্ঞানসম্মত।" উনি লক্ষ্য করেছেন যে "মানবজীবনের সমস্ত সমস্যা - নিরাসক্তি, অনুরাগ, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আত্মীয়তা, এমনকি মোক্ষলাভ অবধি মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসে যে অস্তিত্ববাদী পরীক্ষণাগারে তার নাম হাসপাতাল। প্রতিটি মানবতাবাদী প্রশ্ন আরো তীক্ষ্ণ হয়ে ওঠে যখন বস্তুগত পরিবেশে তাকে ফেলা হয়।" 

ঐতিহাসিক ও দার্শনিক প্রেক্ষিতে মেডিসিন এর বিষয়গুলি (স্বাস্থ্য, অসুস্থতা এবং অসুস্থ মানুষ) এবং মেডিসিন এর লক্ষ্যবস্তু (চিকিৎসা, হৃত স্বাস্থ্যের পুনরুদ্ধার, অথবা স্রেফ কষ্ট যন্ত্রণার উপশম) চিহ্নিত করতে আমাদের সাহায্য করেছে কিছুদূর অবধি। পরিবেশগত, পরিকাঠামোগত সীমাবদ্ধতার জন্য যে চিকিৎসক তার অধিত বিদ্যার পুরোপুরি প্রয়োগ করতে পারছেন না, তার মানবতাবাদী প্রশ্নগুলো স্বাস্থ্য ব্যবস্থার প্রশাসক,  আয়োজকদের নির্মম নিরাসক্ত উদাসীনতার নিরেট পাথরের দেয়ালে মাথা কুটে মরছে, দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জের সেইখানে শুরু। ওয়ার্ডে কুকুর বিড়ালের সাথে সদ্যজাত মনুষ্য সন্তানের  শান্তি পূর্ন সহবস্থানকে একজন চিকিৎসকের পক্ষে নিরাসক্ত, নৈব্যর্তিক বিজ্ঞান-পেশাদার হিসেবে মেনে নেয়াকে আর যাই হোক, দেকার্তে মডেল বলা যায় না। 

ডাক্তার তাহলে আর ঈশ্বর রইলেন না, চিরন্তন শিক্ষক রইলেন না, নৈব্যর্তিক পেশাদার রইলেন না, তিনি নেমে আসলেন একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে রুগীদের মাঝে তাঁর যাবতীয় যত্নআত্তি, সমবেদনা ও করুণা দিয়ে রুগীকে জড়িয়ে ধরতে। এই থ্রি সি মডেল (Care, compassion & Charity) অনুযায়ী রোগীকে মেডিক্যাল মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু ধরে নিয়ে মেডিক্যাল দর্শন একজন চিকিৎসককে শেখায় কিভাবে সে রোগীর মধ্যে এক যন্ত্রণাকাতর সহনাগরিককে দেখতে পাবে। এইবার আসছে তৃতীয় চ্যালেঞ্জ। 

কনজ্যুমার প্রটেকশন এক্ট বা ক্রিমিনাল প্রসিডিওর কোড এর যত যাবতীয় ভ্রুকুটি অগ্রাহ্য করে মা উড়ালপুলের ওপর আকস্মিক হৃদ রোগে আক্রান্ত সহ নাগরিক কে সিপিয়ার প্রয়োগ করে যে চিকিৎসক বাঁচিয়ে তুললেন, জনগণের যাবতীয় জয়ধ্বনির মাঝে তিনি সেই নিঃসঙ্গ মানুষ যিনি জানেন মেডিক্যাল এপিস্টেমলজি বা চিকিৎসাবিজ্ঞানের জ্ঞানতত্বের সীমাবদ্ধতা ঠিক কতটা। ওই রুগী বেঁচেছে বলে একই পদ্ধতি প্রয়োগ করে পরবর্তী রুগী টিকে বাঁচিয়ে তোলা সম্ভব হবে, এমন কোনো গ্যারান্টি নেই। 

কোন রোগকে নিরাময় করতে যখন একজন চিকিৎসক ব্যর্থ হ'ন তখন তার সামনে কি কি পথ খোলা থাকছে আসুন একবার দেখা যাক। মেডিক্যাল রাশিবিজ্ঞানের প্রয়োগ হয়তো বলছে ওই নির্দিষ্ট রুগীর আরোগ্য লাভের সম্ভাবনা মাত্র দুই শতাংশ। এই তথ্যটি অবিকৃত, অবজেক্টিভ ভাবে রুগী বা তার বাড়ির লোকের কাছে উপস্থাপন করাই কোনো মানবিক চিকিৎসকের আদর্শ কাজ হতে পারে না। রুগীর বা তার বাড়ির লোকের সাথে সংলাপ এর সাবজেক্টিভ ভাষ্য সেই চিকিৎসককে সেই রুগীর জন্য আলাদা করে প্রস্তুত করতে হয়। প্রব্যবিলিটির থিওরি প্রয়োগ করে কোন নির্বিকল্প একাডেমিক ডিসকোর্স হচ্ছে না। একটি মানুষের বাঁচা মরা এবং অবধারিত মৃত্যু হলে তার শেষ দিনগুলোর জন্য একটা টার্মিনাল ট্রিটমেন্ট প্ল্যান বা পরিকল্পনা তৈরি হয় ওই সংলাপের মধ্যে দিয়ে।

ডাক্তার যেখানে নিরাময়কারী নয়, পেশাদার গ্রিফ কাউন্সিলর মাত্র। অন্ততঃ হাজার খানেক স্টাডি আছে যেখানে রুগী বা তার বাড়ির লোক চিকিৎসকের ডিগ্রি এই সাথে তার ব্যবহার, সমবেদনার ভাষা জানানোর ক্ষমতাকে একজন 'ভালো ডাক্তার" আখ্যা পাওয়ার জন্য সমান গুরুত্বপূর্ণ উপাদান বলে ঘোষণা করেছে। এই বার আসছে চতুর্থ চ্যালেঞ্জ। 

সমাজ সভ্যতার যে বিকৃত অগ্রগতি একই সাথে চিকিৎসা বিজ্ঞানের অভূতপূর্ব উন্নতি ঘটিয়েছে আর একই সাথে স্বাস্থ্য কে মৌলিক অধিকার থেকে রূপান্তরিত করেছে পণ্যে, সেই শীর্ষ বিন্দুতে দাঁড়িয়ে একজন চিকিৎসকের কতটুকু ক্ষমতা আছে সমবেদনার সেই বয়ান ভাষ্য রচনা করার। প্রিয়জনের মৃত্যু তে শোকে অধীর, সাধ্য অতিরিক্ত ব্যয় করে বাঁচাতে না পারার জ্বালা যন্ত্রণায় অস্থির ক্রুদ্ধ জনতার সামনে একজন চিকিৎসক তো অসহায় নিগ্রহের বস্তু, যার ছাল চামড়া ছাড়িয়ে না নেয়া অবধি ওই জনতার শান্তি নেই, "আমি তোমাদের লোক" বলে তাঁকে কেউ ভাবছেই না। 

এত চ্যালেঞ্জের পরেও তাহলে এই পেশায় আসে কেন কেউ? বেশ কিছু পেশা আছে, মানুষ নানা কারণে বেছে নিতে বাধ্য হয় যাতে তার ছাত্র জীবনের অধিত বিদ্যে কাজে লাগে না। ফিজিক্স অনার্স পড়ে ব্যাংক এর চাকরি, ইলেকট্রনিকস এ এম টেক হয়ে মৎস দপ্তরের আইএএস সচিব। সিভিল ইঞ্জিনিয়ার এম বি এ করে টুথ পেস্ট বিক্রি। সে দিক দিয়ে ডাক্তারদের বেশির ভাগই সৌভাগ্যবান। যা শিখেছে, সেটাই রোজ কাজে প্রয়োগ করতে হয়। ডাক্তারি পাস করার প্রত্যেকটা পরীক্ষা খুব ভয়াবহ হয়। প্রচুর ফেল করে, সাপ্লি পায়। এপ্রোন পড়ে ঠক ঠক করে কাঁপতে কাঁপতে আট ঘন্টা ধরে ভাইভা আর প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষা দিতে হয়। যারা দিয়েছে, তারাই জানে সেই নরক যন্ত্রণা কাকে বলে। ফাইনাল পাশ করে যাওয়ার পরে মনে হয়েছিল আঃ কি আরাম, এসব থেকে মুক্তি। কেউ সেদিন বলে দেয়নি যে মুক্তি নেই, এই সবে শুরু। সারা জীবন, রোজ, অসংখ্যবার ওই পরীক্ষায় বসতে হবে।

যেমন ধরা যাক সামান্য জ্বরের রোগী (যদিও সামান্য জ্বর বলে কিছু হয় না)। ডাক্তার অনেক কিছু দেখে ভেবে ওষুধ লিখলেন। জ্বর না সারলে ফেল। সাধারণ থেকে জটিল অস্ত্রোপচার, কথাই নেই, প্রত্যাকটাই এক একটা পরীক্ষা। অসফল মানে রুগীর মৃত্যু। তবুও সারা পৃথিবী জুড়ে, ভারত জুড়ে, অসংখ্য ডাক্তার রোজ কত বার এই পরীক্ষায় বসে স্বেচ্ছায়। মার্কশিট মহাকালের হাতে। পাশ না ফেল, সেটার ওপর নির্ভর করে একটা পরিবারের ভবিষ্যৎ। সবটা জেনে বা না জেনে, এই পরীক্ষায় বসতেই হয়। সিন-আনসিন, কমন-আনকমন যে কোনো প্রশ্ন আসতে পারে। এক্সামিনেশন হল ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই।

সেই কুড়ি বছরের নার্ভাস তরুণ বা তরুণী যে ভাবে এক্সাম হলের সামনে অপেক্ষা করতো, বাঘা বাঘা সব এক্সামিনারের নানা প্রশ্ন ফেস করার আশংকায় তার হাতের তালু ঘেমে যেত, ঘন ঘন জল তেষ্টা পেত, সেই রকম নার্ভাস না হলেও, প্রতিবার একজন নতুন রুগী নামক প্রশ্নপত্রের সম্মুখীন হওয়ার সময় বুকের স্পন্দন সামান্য হলেও দ্রুত হয়, কি একটা আবেগ তিরতির করে কাজ করে। নিজের হার্টবিট এর শব্দ নিজেই শুনতে পায় সেই ডাক্তার। প্রত্যেকবার তাকে যে করেই হোক, পাশ করতেই হবে, ফেলের কোনো জায়গা নেই।

অসফল হওয়ার আশঙ্কায় ভুগে অবসাদগ্রস্ত হয়ে পরার ঝুঁকি নিয়ে, সফল হওয়ার তাগিদে অসম্ভব পরিশ্রমের ফলে বয়সের আগেই বুড়িয়ে গিয়ে, ফুরিয়ে গিয়ে, বার্নট আউট হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি নিয়েও জীবন মৃত্যুর এই খেলায় একজন চিকিৎসক জয়ী হতে চায়।  নিজের বুকে স্টেথো বসিয়ে সে নিজেই শুনে নিতে চায় তার হৃদয়ের সেই শব্দ যেটা বলে দেয় যে সে চ্যালেঞ্জ নিতে প্রস্তুত, সে সুখী হতে চায় না, জয়ী হতে চায়। সুখী চিকিৎসক দিবস বলে কিছু নাই। নো হ্যাপি ডক্টরস ডে।

বুধবার, ২৬ জুন, ২০২৪

রসেবশে রসায়ন ~ অমিতাভ প্রামাণিক

ভাইরা তো ভাই-ই হয়। কিন্তু ভায়রাভাই আলাদা জিনিস। দুই ভায়ের বউরা যেমন পরস্পরের জা (বা ভাজ), দুই বোনের বররা তেমনি পরস্পরের ভায়রাভাই। পৃথিবীর অধিকাংশ জায়গাতেই পুরুষতন্ত্রের প্রাদুর্ভাবহেতু একান্নবর্তী পরিবারে বিবাহিতা মহিলাদের অনেককেই জা-র মুখঝামটা সহ্য করতে হয়, কিন্তু বিবাহিত পুরুষরা ভায়রাভাই-এর ঝামেলা থেকে সাধারণভাবে মুক্ত।
 
যারা ততটা মুক্ত ছিলেন না, তাদের একজোড়ার কথা বলা যাক।
 
এঁদের একজন জন্মসূত্রে ব্রিটিশ, একজন আইরিশ। ব্রিটিশদের সঙ্গে আইরিশদের সম্পর্ক অনেকক্ষেত্রেই আদায়-কাঁচকলায়। আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের অনেকেই আইরিশ বিপ্লবীদের দৃষ্টান্তে অনুপ্রাণিত হতেন, আমেরিকায় গদর পার্টি আইরিশ সংগঠনের সঙ্গে যোগাযোগ করত। কিন্তু ব্যবসায়ীদের ব্যাপারটা আলাদা। ব্যবসার স্বার্থে তারা জাতীয়তা-টতার মতো ক্ষুদ্রতাকে বিসর্জন দিয়ে বৃহত্তর মানবতার আদর্শে বিশ্বাসী। আফটার অল সবার ওপরে টাকাই, থুড়ি পাউন্ডই, সত্য, তাহার ওপরে নাই।
১৮৩৩ খ্রিস্টাব্দ। বাষট্টি বছরের প্রৌঢ় আইরিশম্যান আলেকজান্ডার বেরি নরিস, তাঁর চেয়ে বয়সে দশ বছরের ছোট স্বদেশীয়া বউ ফেবকে বললেন, ছেলেমেয়েগুলো এত বড় হয়ে গেল, এরা কি বিয়ে ফিয়ে করবে না?
 
ফেব দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললেন, সে আর আমি কী করে বলব, বলো! তুমি নিজেও তো ঠিক সময়ে বিয়েটা করোনি। আমার ভাগ্যটা যেমন! কপালে জুটল আধদামড়া পঁয়তিরিশ-ছত্তিরিশ বছর বয়সী বর। তাও যে গোটা পাঁচেক বাচ্চার জন্ম দেওয়ার সৌভাগ্য আমার হয়েছে, সে কেবল পরম করুণাময় ঈশ্বরের করুণা।
আলেকজান্ডার এই দীর্ঘনিশ্বাসের মর্ম জানেন। বছর তিনেক আগে তাঁদের তৃতীয় সন্তান, ষোড়শী কন্যা ফেব, মারা গেছে। তার মৃত্যুর পর মেয়েদের বিয়ের চিন্তা তাঁর মাথায় আসেনি। এদিকে দেখতে দেখতে বড় মেয়ে অলিভিয়ার বয়স হয়ে গেল চব্বিশ, মেজ এলিজাবেথও বাইশ। অ্যান নামে এক ষোড়শী কন্যা ও আলেকজান্ডার নামে পনের বছর বয়সী পুত্রও আছে তাঁদের।
 
আলেকজান্ডার মোমবাতি তৈরি করে বিক্রি করেন। আয়ারল্যান্ডে এই ব্যবসা খারাপ চলছিল না, তবে খবর পেলেন ডলারের দেশ আমেরিকায় নাকি হাওয়ায় ডলার উড়ছে। তাই পাততাড়ি গুটিয়ে জমিজমা বেচেবুচে পরিবার নিয়ে জাহাজে চেপে চলে এলেন সিনসিনাটি। পুরো সিনসিনাটি গ্রাম যেন এক বিশাল কসাইখানা। এখানে বড়সড় শুয়োর-কাটার স্লটার হাউস আছে, সস্তায় অঢেল চর্বি পাওয়া যায়। এই চর্বি দিয়ে কেউ মোমবাতি তৈরি করে, কেউ তৈরি করে আলো জ্বালানোর তেল, কেউ সাবান।
মেয়েদের বিয়ের কথা ভাবলেই তো হয় না, পাত্রও খুঁজতে লাগে। সিনসিনাটি গ্রাম এমন কিছু বড় না, ব্যবসায়ী হিসাবে তাঁদের চেনাশোনার পরিধি কম না। একদিন কথায় কথায় আলেকজান্ডার বউকে বললেন, আচ্ছা, আমাদের জেমস ছোকরাটাকে তোমার কেমন লাগে?
 
ফেব বললেন, কোন জেমস? জর্জবাবুর ছেলে জেমস? সে তো সোনার টুকরো ছেলে। একেবারে আমাদের পালটি ঘর। জেমস তো শুনছি সাবানের কারখানা খুলেছে।
আলেকজান্ডার বললেন, হ্যাঁ। ওরাও আয়ারল্যান্ড থেকে এ দেশে এসেছে, তা প্রায় চোদ্দ বছর হয়ে গেল। ইলিনয় যাওয়ার ইচ্ছে ছিল। যাচ্ছিলেন ওহায়ো নদীতে বোটে চেপে। সেই অবস্থায় অসুস্থ বোধ করায় তাদের সিনসিনাটিতে নেমে পড়তে হয়। জর্জবাবু নার্সারি খুলেছিলেন। জেমস সাবান তৈরি শিখে এখন সাবানের কারখানা তৈরি করে ব্যবসা করবে। জেমসের বয়স তিরিশ বছর। আমাদের অলিভিয়ার সঙ্গে ওকে ভালো মানাবে না?
 
ফেব বললেন, খুব ভালো মানাবে। তুমি কথাবার্তা বলো। সামনের রোববারে ওদের ডাকো না আমাদের বাড়িতে।
 
কিন্তু ভাবলেই তো হ'ল না। দেখা গেল জেমসের প্রতি অন্য একজন অনুরক্তা। কাজেই তার সঙ্গে অলিভিয়ার বিয়ে দেওয়া সম্ভব না। সেই অন্য একজন আবার এই বাড়িরই। অলিভিয়ার বোন এলিজাবেথ। তাতেও সমস্যা নেই। এলিজাবেথের সঙ্গেই তাহলে জেমসের বিয়ে পাকা করা যেতে পারে। কিন্তু বড় বোনের আগেই কি মেজ বোনের বিয়ে দেওয়া ঠিক হবে?
 
এই সব মহান সমস্যায় যখন নরিস পরিবার বিব্রত, তখন মুশকিল আসান হয়ে দেখা দিল আর এক উদীয়মান সম্ভাবনা। এই ছেলেটি আবার তাঁর মতোই মোমবাতির ব্যবসায় আগ্রহী। মাত্র বছরখানেক আগে সে সিনসিনাটিতে এসে আস্তানা গেড়েছে। এর নাম উইলিয়াম। উইলিয়াম প্রোক্টর।
 
তবে সমস্যা নেই, তা নয়। এক তো এ হচ্ছে ইংরেজ। আর দুই, এর একবার বিয়ে হয়ে গেছে। তবে সেই বউ আর বেঁচে নেই। ছেলেটার মাথা ভালো, লেখাপড়া জানা। লন্ডনে কাপড়ের দোকান দিয়েছিল, সে দোকান লুটপাট হয়ে যায়। বাজারে অনেক দেনা, তার এক বন্ধুর পরামর্শে সে পালিয়ে আসে আমেরিকায়। নিউ ইয়র্কে এসে উঠেছিল বছর তিনেক আগে, সেখানেই শুরু করে মোমবাতি তৈরি ও বিক্রি। কিন্তু মোমবাতির কাঁচামালের জন্য নিউ ইয়র্ক মোটেই ভালো জায়গা না। তারই সন্ধানে সে যাত্রা শুরু করে পশ্চিমে, হাজির হয় সিনসিনাটিতে। এখানে পৌঁছাতেই বেচারার বউটা অকালে মারা যায়, তাই এই জায়গা ছেড়ে তার আর অন্য কোথাও যাওয়া হয়নি।
 
এক শুভদিনে একই সঙ্গে অলিভিয়া আর এলিজাবেথের বিয়ে হয়ে গেল। চব্বিশ বছর বয়সী অলিভিয়ার বর বত্তিরিশ বছরের বিপত্নীক ইংরেজ উইলিয়াম। বাইশ বছর বয়সী এলিজাবেথের বর তিরিশ বছর বয়সী আইরিশ জেমস।
 
বিয়ের পর সুখেই জীবন চলছিল তাদের। কিন্তু হঠাৎই আমেরিকায় নেমে এল ব্যবসায়িক মন্দা – ইকনমিক রিসেশন। জিনিসপত্র অগ্নিমূল্য হ'তে শুরু করল। ব্যবসাপাতি চালানো মুশকিল হতে শুরু করল।
 
বৃদ্ধ আলেকজান্ডার নরিস দুই জামাইকে একসঙ্গে ডেকে পাঠালেন। বললেন, বাবাজিরা, শোনো, আমার তো বয়স কম হ'ল না, আমি অনেক বছর ধরে এখানে ব্যাবসাপাতি চালাচ্ছি। আমি জানি, এই দুর্দিন বেশিদিন চলবে না। এক সময় এ থেকে আমরা বেরিয়ে আসব। কিন্তু সেটা ঠিক কবে, তা কেউ জানে না। দুর্দিনই মানুষের চরিত্রের আসল পরীক্ষা নেয়। এ সময় যারা শিরদাঁড়া সোজা রাখতে পারে, সৎভাবে ব্যবসা করতে পারে, তারাই জীবনে উন্নতিলাভ করে। তোমরাও সে ভাবেই নিজেদের ভবিষ্যৎ গড়ে তুলতে পারবে। আমি বলি কী, তোমরা দু'জনে আলাদা আলাদাভাবে ব্যবসা করার বদলে একসঙ্গে মিলে একটা ব্যবসা চালু করো। যে জিনিস থেকে মোমবাতি তৈরি হয়, তা থেকেই তৈরি হয় সাবান। সুতরাং যৌথ ব্যবসায় কোনো অসুবিধা হওয়ার কথা নয় তোমাদের।
 
দুই ভায়রাভাই মন দিয়ে শ্বশুরের কথা শুনল। ১৮৩৭ খ্রিস্টাব্দে শুরু হ'ল তাদের যৌথ ব্যবসা। উইলিয়ম প্রোক্টর ও জেমস গ্যাম্বলের সেই 'প্রোক্টর অ্যান্ড গ্যাম্বল' এখন দুনিয়ার সবচেয়ে বড় নিত্যপ্রয়োজনীয় বস্তুর বহুজাতিক সংস্থা।

* * *
'রসেবশে রসায়ন' সিরিজের দু-নম্বরী নিবেদন 'বীকার থেকে বাজারে' আপাতত প্রস্তুতিপর্বের শেষ অধ্যায়ে। তার একটা পৃষ্ঠা হাত ফসকে মেঝেতে পড়ে গেল বলে ভাবলাম সেটা এই সুযোগে ফেসবুকে সেঁটে দেওয়া যাক।

বুধবার, ১৯ জুন, ২০২৪

টেস্ট টিউব বেবি, ডা: সুভাষ মুখোপাধ্যায়, ও কিছু কুচক্রী ~ ডাঃ সমুদ্র সেনগুপ্ত

"গোড়ার কথা"---
একেবারে শুরুতেই একটি কথা স্বীকার করে নেওয়া ভালো। ডা: সুভাষ মুখোপাধ্যায় এর মৃত্যুদিনে তাকে নিয়ে অজস্র ভুলে ভরা বা অসম্পূর্ণ তথ্য নিয়ে মনগড়া কাহিনীমূলক নানান লেখার রিবাটাল নয় এই লেখাটা। এটা লেখার কারণ অন্য। একটি লেখায় আহুত হয়ে মন্তব্য করেছিলাম যে "ওনার মৃত্যুতে ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজের একজন প্রাক্তনী হিসেবে আমি গভীরভাবে দুঃখিত, পশ্চিমবঙ্গবাসী হিসেবে, ও ভারতীয় হিসেবে, আমি অত্যন্ত ক্রুদ্ধ, এবং বামপন্থী হিসেবে অত্যন্ত লজ্জিত।" এইটে পড়ে এক বন্ধু জানতে চেয়েছেন যে এমনধারা মন্তব্য করার কারণ কি। বলতে পারেন বাকি লেখাটা সেই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার তাগিদে লেখা।

"জীবন খাতার প্রতি পাতায়"---
ডা: মুখোপাধ্যায় ঠিক কি কি কারণে আত্মহনের পথ বেছে নিয়েছিলেন সেটা জানা বোঝার চেষ্টা আমরা অবশ্যই করবো। আমাদের আগেও অনেকেই জানতে বুঝতে চেয়েছেন। তাদের মতামতের মধ্যে অনেক অমিল থাকলেও একটি বিষয়ে অনেকেই একমত যে ওনার মন ভেঙ্গে দেওয়ার জন্য যাদের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো যেতে পারে তাদের অন্যতম হল একটি কমিটি। এই বিখ্যাত বা কুখ্যাত কমিটির কাজকর্মের অনেক নমুনা আমরা পেশ করবো। শুরু করা যাক সেই জায়গাটা থেকে যখন তাঁর আবিষ্কারের কাহিনী শুনে সন্দেহ এর বীজ বপনটা সুকৌশলে এইভাবে ছড়ানো হয়েছিল ওই কমিটি দ্বারা যে উনি তো ফিজিওলজির শিক্ষক, টেস্ট টিউব বেবির উনি কি জানেন। মার্জনা করবেন। আমাদের আলোচনায় এই টেস্ট টিউব বেবি শব্দ গুলি ঘুরে ফিরে আসলেও প্রাজ্ঞ পাঠক জানেন যে আসলে বলতে চেয়েছি ইন ভিট্র ফার্টিলাইজেশন (সংক্ষেপে আইভিএফ) এর কথা যা চলতি ভাষায় টেস্ট টিউব বেবি (বাংলায় নলজাতক) নামে পরিচিত। 

তথ্যগত দিক থেকে ওই কমিটি সঠিক ছিল। সত্যিই তো, ৩রা অকটবর ১৯৭৮ সালে কলকাতার বেলভিউ ক্লিনিকে পৃথিবীর দ্বিতীয় এবং এশিয়া তথা ভারতের প্রথম নলজাতক কানুপ্রিয়া ওরফে দুর্গা জন্ম নেয় তখন তার মানসপিতা ডা: মুখোপাধ্যায় বাঁকুড়া সম্মিলনী মেডিক্যাল কলেজে ফিজিওলজির প্রফেসর। কথায় বলে না, অর্ধসত্য মিথ্যার চেয়েও ভয়ঙ্কর। ওই কমিটি এবং কেউ কেউ সযত্নে যে তথ্যগুলো এড়িয়ে যেতে চায় তা'হল - 

এক) ডা: মুখোপাধ্যায় কলকাতা ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজের ফাইনাল এমবিবিএস পরীক্ষার গাইনকোলজি ও ধাত্রীবিদ্যার শাখায় প্রথম স্থান অধিকার করেছিলেন, "হেমাঙ্গিনী স্কলারশিপ ও কলেজ মেডেল পেয়েছিলেন। আমার জানা নেই যে বন্ধ্যাত্ব নিবারণ এর ভাবনা চিন্তা ঠিক কবে তার মাথায় এসেছিল। কিন্তু এটা অনুমান করা যায় যে ধাত্রীবিদ্যা তাঁর অন্যতম প্রিয় বিষয় ছিল। এই তথ্যটা আমাদের মহামান্য উইকি সাহেব আবার চেপে গেছেন কেন কে জানে। 

দুই) দু'বার পিএইচডি করা এই মানুষটি প্রথমবার উপাধিটি পান ১৯৫৮ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজের ফিজিওলজি বিভাগের প্রধান ড: সচ্চিদানন্দ ব্যানার্জির তত্ত্বাবধানে রিপ্রোডাকটিভ ফিজিওলজি নিয়ে গবেষনা করে যে গবেষণার বিষয়বস্তু ছিল " দি বায়োকেমিক্যাল চেঞ্জেস ইন নর্মাল এন্ড এবনর্মাল প্রেগনেন্সি"।

তিন) এডিনবরাতে জুটিয়ে আনা দ্বিতীয় পিএইচডিটার কথা সুধী পাঠক ভুলে গেলে আরেকবার মনে করিয়ে দি, কলম্বো স্কলারশিপ পেয়ে উনি পিএইচডিটা করতে যেখানে গিয়েছিলেন সেটার নাম, "ক্লিনিক্যাল এন্ডোক্রিনোলজি রিসার্চ ইউনিট। ওনার গবেষণার তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন অধ্যাপক জন লোরেইন যিনি নিজে একজন রিপ্রোডাক্টিভ ফিজিওলজিস্ট হিসেবে পরিচিত; 

চার) নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজে তাঁর সমসাময়িক স্ত্রী-রোগ বিশেষজ্ঞ ডা: বৈদ্যনাথ চক্রবর্তী স্মৃতিচারণে বলেছেন যে উনি উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল এ ও ডা: মুখোপাধ্যায় বাঁকুড়ায় বদলি হয়ে যাওয়ার আগেও তাঁদের মধ্যে আলাপচারিতায় ওই টেস্ট টিউব বেবি নিয়ে গবেষণার কথা উঠে আসে;

এহ বাহ্য। ডা: মুখোপাধ্যায় এমবিবিএস এর আগে ওই প্রেসিডেন্সি থেকে ফিজিওলজি নিয়ে অনার্স পাশ করেছেন এবং এডিনবরা থেকে দ্বিতীয় পিএইচডি করার পরে নীলরতন সরকার এ ফিজিওলজির লেকচারার হিসেবে যোগ দিয়েছেন এই তথ্যই তাঁকে "ফিজিওলজির লোক" হিসেবে দেগে দেওয়া যথেষ্ট কারুর কারুর কাছে। 

"আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে"---
সত্যিই তো। কি এমন হাতিঘোড়া আবিষ্কার করে ফেলেছিলেন যে তাঁকে নিয়ে মাতামাতি করতে হবে। তর্কের খাতিরে যদি মেনেও নি যে তিনিই এশিয়া তথা ভারতের প্রথম ইত্যাদি তথ্য তো এটাই যে তিনি প্রথম হতে পারেন নি, সেকেন্ড বয়। ফার্স্ট বয় তো সেই ব্রিটিশ বায়োলজিস্ট রবার্ট এডওয়ার্ডস যিনি সুভাষবাবুর ৬৭ দিন আগে ওল্ডহ্যাম, ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ে লুই জয় ব্রাউন এর মানসপিতা হয়েছেন ডা: স্টেপটো এর সহযোগিতায়, নোবেল পকেটে পুরেছেন। 

একবারটি দেখে নেওয়া যাক যে গোরা সাহেবের থেকে নেটিভ বাঙালিবাবু কোথায় কোথায় আলাদা। অধ্যাপক এডওয়ার্ডস এর টিম যেখানে স্বাভাবিক ঋতুচক্রের উসাইট ব্যবহার করেছিলেন, সেখানে প্রফেসর মুখার্জির টিম ব্যবহার করেছিল হিউম্যান মেনোপজাল গোনাডোট্রপিন হরমোন স্টিমুলেটেড সাইকেল।  অবাক কথা এই যে আজকাল সবাই এসিস্টেড রিপ্রোডাক্টিভ টেকনলোজির যে পদ্ধতি অনুসরণ করে সেটা নোবেল পাওয়া এডওয়ার্ড সাহেবের ওই ন্যাচারাল সাইকেল নয়, বরঞ্চ খেলাতচন্দ্র স্কুলের বাংলার মাস্টার বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর ছাত্তর ওই ভেতো বাঙালির আবিষ্কার করা স্টিমুলেটেড সাইকেল। সাহেবকে বাঙালির দেওয়া এক নম্বর গোল।

দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য হ'ল ক্রায়ো-প্রিজারভেশন অফ হিউম্যান এমব্রাও - এডওয়ার্ডস এর টিম জরায়ুতে এমব্রাওটিকে প্রতিস্থাপিত করেছিল ওই একই ঋতুচক্রে। অধ্যাপক মুখোপাধ্যায় এর টিম মনে করেছিল যে  ইউটেরাসকে সময় দেওয়া হোক ইমপ্লান্টেশনের জন্য রেডি হতে। তাই অন্য ঋতুচক্র তে এমব্রাওটিকে প্রতিস্থাপনের আগে প্রিজার্ভ করা হয়েছিল হিমায়িত অবস্থায়  ৫৩ দিন রেখে। ওঁর টিম বিশ্বে সর্ব প্রথম এই এমব্রাও ক্রায়ো-প্রিজারভেশন টেকনিক ব্যবহার করে সফল ভাবে। এর পরে দ্বিতীয়বার এই টেকনিক ব্যবহার করে ট্রনসন ও সহযোগীরা নেচার পত্রিকায় প্রবন্ধ লেখেন ১৯৮৩ সালে। এখন এই টেকনিকই ব্যবহার করা হয়। সাহেবকে দেওয়া বাঙ্গালির দু'নম্বর গোল। এই হিমায়িত করা বিষয়টা সুধী পাঠক মনে রাখবেন। আবার আসবে এই প্রসঙ্গ। কুখ্যাত সেই এনকোয়ারী কমিটি এটা নিয়েও ব্যঙ্গ করেছিল। তাদের প্রশ্ন ছিল ওই লোড শেডিং এর বাজারে ফ্রিজে রেখে ঠান্ডা করা গেল কি ভাবে, কারেন্ট চলে যায় নি ?

তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য হ'ল - ট্রান্স ভ্যাজাইন্যাল রিট্রিভাল অফ উসাইট। উসাইট সংগ্রহ করার জন্য ডা: স্টেপটো ব্যবহার করেছিলেন ঝুঁকিপূর্ণ ইনভেসিভ ট্রান্স এবডমিনাল রুট, পেট কেটে ল্যাপরোস্কপি দিয়ে, আর ডা: মুখার্জির টিম করেছিল অপেক্ষাকৃত নিরাপদ মিনিমাল ইনভেসিভ ট্রান্সভ্যাজাইন্যাল রুট। ওনারা কলকাতায় বসে সেই সময়ে আল্ট্রা সোনোগ্রাফি ব্যবহারের সুযোগ পান নি তাই পোস্টিরিয়ার কল্পটমি করতে হয়েছিল। মধ্য-আশির দশক থেকে আল্ট্রা সোনোগ্রাফির সুযোগ নিয়ে ওই ট্রান্সভ্যাজাইন্যাল রুটই ব্যবহার করা শুরু হয় এবং এখন সেটাই চলছে। বাঙালির তিন নম্বর গোল। 

বৈজ্ঞানিক জার্গনের কচকচি ছেড়ে মোদ্দা কথা এটাই দাঁড়ালো যে ডা: মুখার্জীদের আবিষ্কৃত টেকনিক ওই লন্ডন স্কুলের  পদ্ধতি থেকে একেবারেই আলাদা ছিল। পরবর্তীকালে ডা: মুখার্জীর পদ্ধতিটিই মোটামুটি অনুসরণ করা হয় অন্যান্য জায়াগায় কারণ ওনাদের পদ্ধতিটি তুলনামূলক ভাবে অনেক সহজ-সরল, নিরাপদ ও সাফল্যের হার অনেক বেশি। ইস্ট ইয়র্কশায়ার রেজিমেন্টকে মোহনবাগানের দুই-এক গোলে হারানো নয়, এ একেবারে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডকে তিন-শূন্য গোলে হারানো। জিতে মোহনবাগান শিল্ড পেয়েছিল, আর ডা: মুখোপাধ্যায় কি পেয়েছিলেন ?

"কি পেয়েছি তার হিসাব মিলাতে" ---
বেঁচে থাকতে যা যা সাহায্য সহযোগিতা সন্মান পেয়েছিলেন তা নিয়ে বলতে গেলে প্রথমেই বলতে হয় তাঁর স্ত্রী নমিতার কথা। ....

এর পরে বলতে হয় ১৯৬৬ এনআরএস মেডিক্যাল কলেজে তাঁর সমসাময়িক গাইনকলজি বিভাগের এসিস্টেন্ট প্রফেসর বৈদ্যনাথ চক্রবর্তীর কথা। অধ্যাপক চক্রবর্তীর স্মৃতিচারণ অনুযায়ী তিনি ও তাঁর বন্ধু ডা: সুভাষ মুখোপাধ্যায়, দুজনেরই আনকমন সাবজেক্ট নিয়ে গবেষণার ঝোঁক ছিল ও সেই সময়ে সুভাষবাবু এন্ডোক্রিনোলজি নিয়ে কাজ করছেন। সেই সময়ে দুজনেই বয়েস মধ্য চল্লিশ। নিজেদের মধ্যে প্রচুর আইডিয়া ও উৎসাহের আদান-প্রদান হ'ত।

কালক্রম অনুসারে এর পরে আসবে ওনার রিচার্চ টিমের অন্য দুই সদস্যের কথা। টেস্ট টিউব বেবি সংক্রান্ত গবেষণায় ওনার সহযোগী ছিলেন কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের গাইনকোলজি বিভাগের প্রফেসর ডা: সরোজকান্তি ভট্টাচার্য এবং যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ফুড টেকনোলজি ও বায়োকেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের বিভাগীয় প্রধান প্রফেসর সুনীত মুখার্জি। উইকিবাবা আবার ভুল করে এনাকে "ক্রায়ো-বায়োলজিস্ট" বানিয়ে ছেড়েছে। ডা: মুখোপাধ্যায় এর সহযোগী ও আজীবন তাঁর একনিষ্ঠ অনুগামী এই ইঞ্জিনিয়ার মানুষটির কথায় আমরা আবার ফিরে আসবো। আপাততঃ এটুকু বলে রাখি যে সুনীতবাবু .. এর সহযোগিতায় "ডা: সুভাষ মুখোপাধ্যায় মেমোরিয়াল রিপ্রোডাক্টিভ বায়লজি রিসার্চ সেন্টার" গড়ে তোলেন। 

এছাড়াও সহযোগিতার একটি বিচিত্র নমুনা পেশ করা যাক। অধ্যাপক মুখোপাধ্যায় এর গবেষণার জন্য প্রয়োজন "এনিম্যাল হাউস"। অর্থবরাদ্দে কলেজের প্রিন্সিপাল রাজি তবে তার জন্য বিনিময়প্রথায় আসতে হবে। ওনাকে হোস্টেল সুপারের অতিরিক্ত দায়িত্ব নিতে হবে। গবেষণারত এক বিজ্ঞানীর কাছে সময়ের মূল্য অপরিসীম। সেই মূল্যবান সময়ের কিছুটা খরচ হবে হোস্টেলের পেছনে। তাই হোক, অন্য উপায় কি। অধ্যাপক মুখোপাধ্যায় রাজি হয়ে গেলেন। পেলেন ইঁদুর, বাঁদর, গিনিপিগ ওয়ালা এনিম্যাল হাউস। আরেকটা লাভ হয়েছিল, তাঁর গুণমুগ্ধ ছাত্র-ছাত্রীদের তালিকায় যুক্ত হল ওই হোস্টেলের আবাসিকবৃন্দ।

অধ্যাপক মুখোপাধ্যায় এর মৃত্যুর পরে বিশেষকরে তাঁর মরণোত্তর খ্যাতিলাভের পরে তাঁর একসময়ের সহকর্মীদের একাংশ নিজেদের গুণমুগ্ধ বলে দাবি করেছিলেন কিন্তু ওনার বিপদের দিনে তাঁদের আচার-আচরণ তাঁদের বিতর্ক এড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতা তাঁদের মরাল সাপোর্টের অভাব ইত্যাদি দেখেশুনে তাঁদের ওই গুণমুগ্ধতার দাবি ঠিক ধোপে টিঁকছে না।

অধ্যাপক মুখোপাধ্যায় এর চাওয়া-পাওয়ার তালিকায় সর্বশেষ ও সম্ভবত সর্ববৃহৎ অবদান যাঁর, যিনি প্রায় একক প্রচেষ্টায় অধ্যাপক মুখোপাধ্যায় এর ভাবমূর্তিকে একজন টিপিক্যাল ট্র্যাজিক বাঙালি হিরো থেকে বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানীতে রূপান্তরিত করেছেন তিনি কোনও বাঙালিই নন, তিনি নিজে প্রথিতযশা বিজ্ঞানী ও আইসিএমআর এর ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ রিপ্রোডাক্টিভ হেল্থ এর প্রাক্তন ডিরেক্টর ডা: তিরুচিলাপল্লি চেলভারাজ আনন্দকুমার। তাঁর আরেকটি পরিচয় যে তিনি ও তাঁর সহযোগী ডা: ইন্দিরা হিন্দুজা ও তাঁদের টিম ১৯৮৬ সালের ১৬ই আগস্ট ভারতের প্রথম "সায়েন্টিফিক্যালি ডকুমেন্টেড" টেস্ট টিউব বেবির জন্ম দেয়। ওনার এই কাজ ১৯৮৬ সালে আইসিএমআর বুলেটিনে প্রকাশিত হয় এবং  ১৯৮৮ সালে "জার্নাল অফ ইন ভিটরো ফার্টিলাইজেশন এন্ড এমব্রাও ট্রান্সফার" এ প্রকাশিত হয়।

অধ্যাপক সুনীত মুখার্জি ১৯৮৩ সালে ডা: কুমারকে সুভাষ মুখার্জি মেমোরিয়াল বক্তৃতা দেয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানান। ডা: কুমার আসতে পারেন নি। পরে ১৯৯৭ সালে কলকাতায় এআরটি এর তৃতীয় জাতীয় কনফারেন্স এ এসে উনি ডা: সুভাষ মুখার্জী মেমোরিয়াল লেকচার দিতে আসেন। এই সময়ে সুনীতবাবু ডা: কুমারের হাতে তাঁর কাছে সযত্নে রাখা অধ্যাপক মুখোপাধ্যায় এর গবেষণার বেশ কিছু কাগজপত্র ও হাতে লেখা নোটস তুলে দেন এবং অনুরোধ করেন সেগুলি উল্টে পাল্টে দেখতে। 

স্বভাবসিদ্ধ চালে ডা: কুমার ওই কাগজপত্র ও নোটসগুলি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়েন এবং স্তম্ভিত হয়ে যান। ততদিনে ভারতের প্রথম নলজাতক এর আবিষ্কারক হিসেবে তাঁর ভুবন জোড়া খ্যাতি লাভ হয়ে গেছে। তবুও তিনি অসীম সাহস ও উদার্যের পরিচয় দিয়ে সিদ্ধান্ত নেন যে তিনি নন, ডা: মুখোপাধ্যায়ই ভারতের প্রথম টেস্ট টিউব বেবির জনক। তিনি কেবলমাত্র "সায়েন্টিফিক্যালি ডকুমেন্টেড ফার্স্ট টেস্ট টিউব বেবি" এর জনক। তাঁর এই দাবি প্রমাণ করার জন্য তিনি ডা: মুখোপাধ্যায় এর এতাবৎকাল প্রকাশিত ও অপ্রকাশিত গবেষণা কাজের ওপর ভিত্তি করে  একটি নিবন্ধ লেখেন এবং সেটি "দি আর্কিটেক্ট অফ ইন্ডিয়াজ ফার্স্ট টেস্ট টিউব বেবি - ডা: সুভাষ মুখার্জি" এই শিরোনামে কারেন্ট সায়েন্স পত্রিকায় ১৯৯৭ সালে প্রকাশিত হয়। 

কলকাতার কনফারেন্সে যখন ডা: আনন্দ কুমার স্বেচ্ছায় তাঁর প্রথম আসনটি ত্যাগ করে দ্বর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করেন যে, "লেট মি টেল ইউ দ্যাট সুভাষ মুখার্জি মাস্ট বি গিভেন ক্রেডিট ফর দ্যা ফার্স্ট টেস্ট-টিউব বেবি" এবং "অল আদার এচিভমেন্টস ডোয়ারফ ইন কম্পরাইজন টু হোয়াট হি এচিভড" তখন যথারীতি গণমাধ্যম লুফে নেয় এই চনমনে খবরটি। বন্যায় জলের মতো একের পর এক খবরের কাগজে টিভিতে খবর প্রকাশিত হয়। 

"জীবনে যারে তুমি দাও নি মালা"---
অধ্যাপক মুখোপাধ্যায় এর মৃত্যুর পরে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে যে যে উদ্যোগগুলি গ্রহণ করা হয়েছিল তার কয়েকটি উল্লেখ না করলে এই লেখা অসম্পূর্ণ থেকে যেতে বাধ্য। কালক্রম অনুযায়ী:-

১৯৮২ সালে ইন্ডিয়ান ক্রায়োজেনিক্স কাউন্সিল শুরু করেন "ডা: সুভাষ মুখার্জি মেমোরিয়াল অরেশন"। ১৯৮৫ সালে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, ইন্ডিয়ান ক্রায়োজেনিক্স কাউন্সিল এবং বেহালা বালানন্দ ব্রহ্মচারী হাসপাতালের যৌথ উদ্যোগে বেহালায় তৈরি হয় 'ডা: সুভাষ মুখার্জি মেমোরিয়াল রিপ্রোডাক্টিভ বায়োলজি রিসার্চ সেন্টার"। 

এর পরে স্মৃতি রক্ষার কাজকর্মে ভাঁটা পরে কিছুদিন। তাতে আবার জোয়ার আসে ডা: আনন্দ কুমারের প্রবন্ধের পরে। 

২০০২ সালে, তাঁর মৃত্যুর ২১ বছর পরে আইসিএমআর তাঁর বিষয় নিয়ে চর্চার জন্য একটি বারো সদস্যের কমিটি গঠন করেন। কমিটি শব্দটি দেখে সুধী পাঠক আঁতকে উঠবেন না। দিনের শেষে আইসিএমআরও একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান, আমলাতন্ত্র বাদ দিয়ে চলতে পারে না। তবে এবারের অভিজ্ঞতা সুখকর। শেষ অবধি ২০০৩ সালে অধ্যাপক মুখার্জির কাজ স্বীকৃতি পায়। এবং ২০০৮ সালে তাতে সরকারি সিলমোহর পরে।

১৯শে ২০০৬ সালে নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজের একাডেমিক বিল্ডিং এ পশ্চিমবঙ্গ সরকারের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ দপ্তরের স্বীকৃতি হিসেবে একটি স্মৃতিফলক বসে যার আবরণ উন্মোচন করেন তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা: সূর্যকান্ত মিশ্র।

২০০৭ সালে মেডিক্যাল সায়েন্সের জগতে মার্গদর্শনের কাজ করে গেছেন এমন ১১০০ জন বিজ্ঞানীকে নিয়ে ওয়ার্ল্ড ফাউন্ডেশন একটি "ডিকশনারী অফ মেডিক্যাল বায়োগ্রাফি" প্রকাশ করে। তাতে জায়গা পান অধ্যাপক মুখোপাধ্যায়। 

আইভিএফ এর ৩০ বছর পূর্তি উপলক্ষে ২০০৭ সালের ৭ই নভেম্বর ব্রাজিলীয় মেডিক্যাল সোসাইটি একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করে এবং তারা 'ডা: সুভাষ মুখার্জি মেমোরিয়াল রিপ্রোডাক্টিভ বায়োলজি রিসার্চ সেন্টার" কে একটি ট্রফি প্রদান করে।

২০১২ সালে এসিস্টেড রিপ্রোডাক্টিভ টেকনলোজি, রিপ্রোডাক্টিভ বায়োলজি এন্ড এনডোক্রিনলোজির জগতে অসামান্য অবদানের জন্য আইসিএমআর চালু করে "ডা: সুভাষ মুখার্জি পুরস্কার"। 

গণমাধ্যমে ও জনপ্রিয় মাধ্যমে অধ্যাপক মুখোপাধ্যায়কে নিয়ে নানান "চনমনে" চর্চার পাশাপাশি কয়েকটি অবদান আলাদাভাবে উল্লেখের দাবি রাখে। 

প্রখ্যাত কথাশিল্পী রমাপদ চৌধুরী অধ্যাপক মুখোপাধ্যায়ের জীবনী অবলম্বনে ১৯৮২ সালে লেখেন 'অভিমন্যু' উপন্যাসটি। ১৯৯১ সালে এই উপন্যাস অবলম্বনে প্রকাশ পায় তপন সিনহা পরিচালিত ছায়াছবি "এক ডক্টর কি মৌত"। ২০১৯ সালে তাঁর মৃত্যুকে নিয়ে রাজীব সরকার ডকুমেন্টারি ফিল্ম "ব্লাড স্টেইনস নেভার ফেড" মুক্তি পায়। ছবিটি ইউ টিউবে উপলব্ধ। আগ্রহী পাঠক দেখতে পারেন।

একাডেমিক জগতে মেডিক্যাল সায়েন্সের নানান জার্নালে লেখাপত্র এর পাশাপাশি দুটি লেখা অবশ্যই উল্লেখ করা দরকার। ডন নামের পিয়ার-রিভিউড জার্নালে ২০১১ সালের ১১ নং সংখ্যায় প্রকাশিত হয় " লাইফ এন্ড ওয়ার্কস অফ ডা: সুভাষ মুখার্জি" প্রবন্ধটি।

হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী সান্দ্রা বার্নাথর তাঁর পিএইচডির থিসিস হিসেবে রচনা করেন "দ্যা হিস্ট্রি অফ আইভিএফ ইন ইন্ডিয়া" যেখানে তিনি অধ্যাপক মুখোপাধ্যায় এর অবদানকে বিশেষ ভাবে উল্লেখ করেন।

অধ্যাপক মুখোপাধ্যায় এর জীবন ও কাজকর্ম নিয়ে আগ্রহ তৈরি করার উদ্দেশ্যে আইসিএমআর এর অর্থসাহায্যে ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল সায়েন্স একাডেমি একটি প্রজেক্ট নেয়। তার ফলশ্রুতিতে ড: শ্রাবনী মুখার্জি ও ড: রাজভী মেহতা একটি পুস্তিকা লেখেন যেটি নাম, "ডা: সুভাষ মুখার্জি - এ ভিশনারী এন্ড পাইয়নিয়ার অফ আইভিএফ" নামে ২০২০ সালে প্রকাশিত হয়। এই বইটি অন্তর্জাল জগতে পিডিএফ ফরম্যাটে পাওয়া যায়। 

ওপরে উল্লেখিত বেশ কিছু রচনা এই প্রবন্ধ লেখার তথ্য সূত্র হিসেবে কাজ করেছে। একটি বইকে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে ঘনিষ্ঠতার সুবাদে যাতে বায়াসনেস এর অভিযোগ না ওঠে। বইটি হল সুনীত মুখার্জি রচিত "সুভাষ-নমিতা-সুনীতের উপকথা। আগ্রহী পাঠক চাইলে পড়ে দেখতে পারেন।

"এ কাকে দিয়েছ রাজার পার্ট"---
ভালো কথা অনেক হল এবার খারাপ কথা বলার পালা। সেই এনকোয়ারী কমিটি নিয়ে আরো একটু কথা বলা যাক যেটি "দাশগুপ্ত কমিটি" নামেও পরিচিত। কমিটির সদস্যরা হলেন: ডা: মৃণালকান্তি দাশগুপ্ত, রেডিও ফিজিক্স অ্যান্ড ইলেকট্রনিক্স; ডা: ডি এন কুন্ডু, ডিরেক্টর, সাহা ইনস্টিটিউট অফ নিউক্লিয়ার ফিজিক্স, ডা: জে সি চট্টোপাধ্যায় স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ; ডা: কৃপা মিনা, স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ; অধ্যাপক অজিত মাইতি, নিউরোফিজিওলজি, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়; অধ্যাপক অচিন্ত্য মুখোপাধ্যায়, প্রেসিডেন্সি কলেজ।

কোনও গবেষণামূলক কাজের পিয়ার রিভিউ একটি অতি প্রচলিত পদ্ধতি। ওই এক্সপার্ট কমিটি কিছুটা পিয়ার রিভিউ টেকনিক অবলম্বন করে থাকবেন এটা আমরা ধরে নিতে পারতাম। মুশকিলটা এখানেই যে পিয়ার রিভিউয়ার হতে গেলে কিছু যোগ্যতা লাগে, সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কিছু অভিজ্ঞতা লাগে- সেটা যে এই কমিটির সদস্যদের মধ্যে বহুল পরিমানে অনুপস্থিত ছিল তা কমিটির প্রশ্নোত্তর পর্বগুলি খুঁটিয়ে দেখলে ধরা পরবে। শুধু এই লেখক নয়, ডা:আনন্দ কুমার এর মতো বিজ্ঞানীও ওই আপত্তি জানিয়েছেন। তাঁর ভাষায়, "নান অফ দিজ কমিটি মেম্বার্স কুড হ্যাভ হ্যাড এনি ব্যাকগ্রাউন্ড অর ইনসাইট ইনটু মর্ডান রিপ্রোডাক্টিভ টেকনলোজি, এ সাবজেক্ট আপঅন হুইচ দে ওয়ার টু হোল্ড এন এনকোয়ারী"। 

দু'একটি নমুনা পেশ করা যাক, এক সদস্য বই পড়ে সবজান্তাভাব দেখিয়ে ওভাম নেগেটিভলি চার্জড এর সমস্যা নিয়ে কূটপ্রশ্ন তুলে ডা: মুখার্জিকে বিব্রত করতে চাইলেন যেটা আদৌ এই কাজের সাথে সম্পর্ক যুক্ত নয়। সেই সদস্যকে ডা: মুখার্জীর পাল্টা প্রশ্ন ছিল, "আপনি জীবনে কোনোদিন ওভাম দেখেছেন ? দেখেন নি।"

ভ্রূণ হিমায়ণ প্রসঙ্গে এক সদস্য প্রশ্ন করেছিলেন যে এই লোডশেডিং এর বাজারে উনি ফ্রীজে রেখে ঠান্ডা করাটা বজায় রাখলেন কি করে। হ্যাঁ এটা সত্যি যে সেই সময়ে প্রচুর লোডশেডিং হত। এমন প্রশ্ন কোনো সাধারণ মানুষ করলে তাকে মানতো কিন্তু তাই বলে একজন বিশেষজ্ঞ কমিটির সদস্য জানবেন না, তাঁর এই নূন্যতম পড়াশোনাটুকু থাকবে না যে ক্রায়োপ্রিজার্ভেশন এর জন্য বাড়ির ডোমেস্টিক ফ্রিজ নয়, লিকুইড নাইট্রোজেন ব্যবহার করা হয়। 

আরেকটি প্রশ্নের নমুনা এই রকম। এম্পিউলসগুলি হিট সিল করা হয়েছিল জানার পরে এক সদস্যের প্রশ্ন, আচ্ছা, ওই  সময় তাপ লেগে গোটা মিশ্রণটা গলে গেল না কেন। তাকে কে বোঝাবে যে হাজার লক্ষ ওষুধের এম্পিউলস হিট সিলই করা হয় আর কাচ তাপের অত্যন্ত কূপরিবাহী। সেজন্যই অন্য মেটেরিয়াল এর বদলে কাচ ব্যবহার করা হয়। 

আর নমুনা দিয়ে পাঠকদের ধৈর্য্যচুতি ঘটাবো না। মোদ্দা কথা এই যে, ক্রমাগত প্রশ্নকর্তাদের এই ধরনের অপরিসীম অজ্ঞতা মিশ্রিত ঔদ্ধত্যমূলক প্রশ্নবানে জর্জরিত হতে হতে  উত্তরদাতার উত্তরের মধ্যেও ফুটে উঠতে থাকে একধরণের করুণা মিশ্রিত তাচ্ছিল্য। 

এই কমিটি কি রায় দিতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। আমরা এবার একটু জানা বোঝার চেষ্টা করবো যে এই তথাকথিত এক্সপার্ট কমিটির এমন বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয়েছিল কেন। কারণ অধ্যাপক মুখার্জিকে নিয়ে সামান্য চর্চার পরে এই প্রবন্ধ লেখকের এটাই মনে হয়েছে যে কেবলমাত্র খ্যাতি উদ্ভূত ঈর্ষা বা প্রফেশনাল জেলাসি বা তথাকথিত কাঁকড়া মনোবৃত্তি দিয়েই এটা ব্যাখ্যা করা অতি সরলীকরণ হয়ে যাবে।  

সমসাময়িক বিজ্ঞানের জগৎ থেকে অনেকটা এগিয়ে থাকা মানুষের চিন্তাভাবনার নাগাল পাওয়া অন্যদের পক্ষে প্রায়ই সম্ভব হয় নি- এই ঘটনা বিজ্ঞানের ইতিহাসের পাঠক-পাঠিকাদের কাছে অজানা নয়। নাগাল না পাওয়ার ফলে নতুন কোনও আবিষ্কারকে গড়পড়তা মানুষতো বটেই, এমনকি গড়পড়তা চিকিৎসক বিজ্ঞানীর কাছেও "অবিশ্বাস্য" ঠেকতে পারে। অধ্যাপক মুখার্জি যে তার সময়ের চেয়ে অনেকটাই এগিয়ে ছিলেন  এটা তার সমস্ত আলোচকদের কথায় বারবার ঘুরে ফিরে এসেছে। ডা: আনন্দ কুমারের ভাষায় "পাইয়নিয়ারিং ওয়ার্ক"।

অধ্যাপক মুখার্জি গণমাধ্যমেতো বটেই এমনকি  পেশাদার সহকর্মীদের সাথেও তাঁর গবেষণার বিষয়টি নিয়ে খুব বেশি আলোচনা করেন নি, বৈজ্ঞানিক জার্নালে ধারাবাহিক এমন কোনও নিবন্ধ প্রকাশ করেননি যা থেকে ওয়াকিবহাল মহলে এমন ধারণা তৈরি হতে পারে যে উনি একটা বড়সড় ব্রেক থ্রু এর সামনে আছেন। তাই ওনার সাফল্য সংবাদটা একেবারেই অপ্রত্যাশিত ছিল। খবরটা প্রকাশিত হওয়ার পরে প্রচন্ড বিস্ময়বোধের জন্ম দিয়েছিল। এই বিস্ময়বোধ কিন্ত প্রকারান্তরে ওই অবিশ্বাসকেই বাড়িয়ে তুলেছে, বিশ্বাসকে নয়।এই অপরিচিত অচিন্তনীয় পদ্ধতিটি নিয়ে অবিশ্বাস ও সন্দেহ এর মাত্রা উত্তরোত্তর বেড়েছে। 

এর সাথে যে গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টটি যোগ করতে হবে, সেটি হ'ল আমাদের, ভারতীয়দের কলোনিয়াল হ্যাংওভার। সাহেবরা এতকিছু টেকনোলজি ও ফান্ডের সাপোর্ট পেয়ে কিছু করতে পারলো না আর আমাদের ঘরের ছেলে সুভাষ একটা "ডোমেস্টিক" ফ্রিজ নিয়েই কামাল করে দিলো - এ হতেই পারে না। একথা সত্যি যে আজকালকার দিনে সাইনিটিফিক রিসার্চ এর সাফল্যলাভের সম্ভাবনার এর সাথে ওই অত্যাধুনিক টেকনোলজি ও প্রভূত ফান্ডিং যোগসূত্রটি চিহ্নিত এবং সেই কারণে আমাদের মননে স্মরনে গ্রথিত ও প্রোথিত তাই অবিশ্বাসটা খুব আনকমন নয়। 

ভারতীয় তথা বাঙালির আরেকটি বৈশিষ্ট্য এর কথাও না বললেই নয়। কুপমণ্ডূকতা। বিজ্ঞানের জগৎ এ নিজেকে ওয়াকিবহাল রাখতে আপটুডেট রাখতে নিয়মিত বৈজ্ঞানিক জার্নাল পত্রপত্রিকা পড়ে যেতে হয় নৈলে পিছিয়ে পরতে হয় - যে অভ্যাসটি অনেকে বিজ্ঞানীই ত্যাগ করে থাকেন বিশেষ করে তার যদি মাস গেলে একটা ভদ্রস্থ মাইনের বন্দোবস্ত থাকে। এই কমিটির কারুর মধ্যে যে এই মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসা, জাতীয়/ আন্তর্জাতিক স্তরের গবেষনা সম্পর্কে তারা ওয়াকিবহাল - তার প্রমাণ অন্ততঃ তাদের প্রশ্নোত্তরে ধরা পরেনি। 

"দোষ কারো নয় গো মা"---
আমরা এবার ফিরে আসছি অধ্যাপক মুখোপাধ্যায় এর জীবনের সবচেয়ে বিতর্কিত অধ্যায়টিতে। কি এমন ঘটলো যে নোবেল প্রাইজ পাওয়ার বদলে মানুষটি আত্মহত্যা করলেন। 

সিজার করে দুর্গা জন্ম নেয় ৩রা অক্টোবর ১৯৭৮ সালে কলকাতার বেলভিউ হাসপাতালে। তার জন্মের খবর অর্থাৎ সে যে নলজাতক সেটি সংবাদমাধ্যমে ফাঁস হয়ে যায়। অধুনালুপ্ত অমৃতবাজার পত্রিকায় খবরটি প্রকাশিত হয় ৬ই অক্টোবর। 

সেই সময়ে পশ্চিমবঙ্গে প্রথম বামফ্রন্ট সরকার যার স্বাস্থ্যমন্ত্রী ননী ভট্টাচার্য। স্বাস্থ্য অধিকর্তার পদে ডা: মনিকুমার ছেত্রী। স্বাস্থ্য অধিকর্তাই তখন স্বাস্থ্য দপ্তরের সর্বোচ্চ স্বাস্থ্য-প্রশাসক, তখনও এখনকার মতো আলাদা মেডিক্যাল এডুকেশন ডাইরেকটরেট তৈরি হয় নি। তাঁর নির্দেশে ১৯৭৮ সালের ১৯শে অক্টোবর অধ্যাপক মুখার্জি একটি রিপোর্ট জমা দেন। নানান কারণে রিপোর্টটি সংক্ষিপ্ত ছিল। কেন ছিল এ বিষয়ে অধ্যাপক মুখার্জি স্বাস্থ্য অধিকর্তাকে তাঁর লেখা ১লা ডিসেম্বরের চিঠিতে পরে ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন।

ওই রিপোর্ট এর ওপর ভিত্তি করে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের স্বাস্থ্যদপ্তর অধ্যাপক মুখার্জির দাবির সত্যাসত্য জানার জন্য ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল এসোসিয়েশন ও বেঙ্গল অবসটেট্রিক্স এন্ড গাইনকোলজি এসোসিয়েশনের অধীনে একটি "এক্সপার্ট" কমিটি তৈরি করেন। 

১৭ই নভেম্বর, ১৯৭৮ সালে ইনস্টিটিউট অফ রেডিও ফিজিক্স এন্ড ইলেকট্রনিক্স এর সভাঘরে বিশদ আলোচনার পরে কমিটি এই সিদ্ধান্তে পৌঁছায় এবং ঘোষণা করে যে "দ্যা ওয়ার্ক অফ ড: সুভাষ মুখার্জি এন্ড হিজ টিম এজ ইমপ্লজিবল এবং বোগাস।

তদন্ত কমিটির এই রায় সামনে আসার পরে 
অধ্যাপক মুখার্জি ১লা ডিসেম্বরের সেই চিঠিটি লেখেন। তাতে তিনি জানান যে তাঁর প্রাথমিক রিপোর্টটি তৈরি করার জন্য তিনি বিশেষ সময় পান নি। তাকে আরেকটু সময় দেওয়া হোক। আগের সংক্ষিপ্ত রিপোর্টে বেশ কিছু তথ্য হাজির না করার কারণ হিসেবে তিনি জানান যে তার ইচ্ছে ছিল যে "ওই এক্সপেরিমেন্ট এর রিপ্রোডিউসেবিলিটি সম্পর্কে মোটামুটি আশ্বস্ত হয়ে সেটি কোনো স্বীকৃত মেডিক্যাল জার্নালে প্রকাশ করার।"। 

তিনি ওই চিঠিতে তদন্ত কমিটির তোলা একটি বিশেষ পয়েন্ট - তাঁর আবিষ্কৃত হিমায়ণ এর পদ্ধতি ও ডিএমএসও নামের উপাদানের বিস্তারিত তথ্য তিনি জনসমক্ষে আনতে চাননি বলেই ইচ্ছে করেই উল্লেখ করা থেকে বাদ দিয়েছেন কারণ, তাঁর ভাষায়, "আই হ্যাড টু বি কেয়ারফুল টু গার্ড আওয়ার আনপাবলিশড ডাটা বিকজ বাই দ্যাট টাইম আই বিকেম এওয়ার অফ দ্যা পেনিট্রেটিং এফিসিয়েন্সি অফ দ্যা টেনটাকলস অফ দি মাস মিডিয়া।"

ডা: আনন্দ কুমার এই চিঠির বয়ানকে অর্থাৎ ডাটা গোপন রাখার সিদ্ধান্তকে পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছেন। বৈজ্ঞানিক গবেষনা ও তার ফলাফল প্রকাশ সম্পর্কে যাদের বিন্দুমাত্র ধারণা আছে তারাও ডা: কুমারের সাথে একমত হবেন। অন্যের গবেষণার ফল চুরি করে নিজে নামী হওয়া (এবং কিছু ক্ষেত্রে দামী) এর ঘটনা আকছার ঘটে।

গবেষণাপত্র প্রকাশের তাগিদে নিয়োগকর্তার কাছে তথ্য গোপন করার এই "অপরাধ" এর জন্য অধ্যাপক মুখার্জিকে কি নিদারুণভাবে শাস্তি পেতে হয়েছে সেটা আমরা পরে দেখবো। ওই শাস্তি ওনাকে পেতে হয়েছে কারণ দিনের শেষে তিনি অধ্যাপক, বিজ্ঞানী ফিজ্ঞানী কিস্যু নন, তিনি স্রেফ সরকারি চাকুরী করা একজন ডাক্তার। 

একটি তথ্যসূত্র মোতাবেক কেবল এনকোয়ারী কমিটি নয়, কেবল আমলাতন্ত্রও নয়, "সাম প্রফেসনাল বডিজ অলসো হেকেলড হিম ইন সাম মিটিংস", অর্থাৎ ডাক্তারদের কিছু পেশাদারি সংগঠনও কিছু সভায় তাঁকে হেনস্থা করে।  

আমরা আমাদের গোটা আলোচনায় একটি প্রসঙ্গ প্রায় এড়িয়ে গেলাম -সেটা হল, বন্ধ্যাত্ব দূরীকরণ কর্মসূচির অর্থকরী দিকটি। এড়ানো হল এই কারণে নয় যে অর্থ এই লেখকের একটি ব্যক্তিগত অপ্রীতিকর বিষয়, এই কারণেই এড়ানো হল যে এ বিষয়ে পাথুরে প্রমান ও তথ্যের অভাব। 

এসিস্টেড রিপ্রোডাকটিভ টেকনোলজিতে পাইয়নিয়ার হিসেবে বিখ্যাত একজন স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ যিনি পরবর্তীকালে এই ফিল্ডে সুনাম ও অর্থ দুই কুড়িয়েছেন, তিনি ডা: মুখার্জির সাথে বন্ধুত্বের সুযোগ নিয়ে থিসিস চুরি করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছিল। ওনার স্ত্রী যেহেতু নামটি নিতে চান নি তাই সেটি অপ্রকাশিতই রয়ে গেল। 

এনকোয়ারী কমিটি, আমলাতন্ত্র, সহকর্মী, প্রফেশনাল বডি - কাকে বাদ রাখবো ! সাধে কি আর রমাপদ চৌধুরী মশাই তাঁর উপন্যাসের নাম রেখেছিলেন "অভিমন্যু"। পুরানের অভিমন্যু বাঁচে নি। আমাদের অভিমন্যুরও বাঁচার কথা ছিল না।

"যারে দেখতে নারি তার চলন বাঁকা"-
ওই তথাকথিত এক্সপার্ট কমিটির সমালোচনা এবং মাস মিডিয়া সোশ্যাল মিডিয়াতে প্রকাশিত নানান খবর পড়ে কোনো পাঠকের মনে হতে পারে যে অধ্যাপক মুখার্জি তাঁর গবেষণার কাজের ডকুমেন্টেশন এ অবহেলা করেছিলেন, স্ট্যান্ডার্ড নিয়ম অনুযায়ী পিয়ার রিভিউ জার্নালে তাঁর গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করেন নি। প্রকৃত পক্ষে এর কোনোটাই সত্যি নয়। 

তিনি জার্নালে অনেক পেপার পাবলিশ করেছেন, সাইন্টিফিক কনফারেন্স এ বক্তৃতা দিয়েছেন। কয়েকটি উল্লেখ করা হল। হিউম্যান কোরিওনিক গোনাডোট্রপিন এর উৎস সম্পর্কে তাঁর গবেষণা ১৮৭০ সালের হাইপোথিসিসকে ভুল প্রমাণিত করে। ফিমেল ইনফার্টিলিটি নিয়ে টেস্টস্টেরণ এর প্রয়োগ নিয়েও তাঁর গবেষণা ছিল। ফিমেল ইনফার্টিলিটি এর কারণ এর মানসিক চাপ এর যোগাযোগ আছে এনিয়ে তিনি ১৯৭৭ সালের জুলাই মাসে প্যারিসে আন্তর্জাতিক কনফারেন্সে পেপার হাজির করেন।

১৯৭৮ সালের ১৭ই আগস্ট বেলুড় রোটারি ক্লাবে টেস্ট টিউব বেবি নিয়ে বক্তব্য রাখেন। ১৯৭৮ সালের ৩রা অক্টোবর তাঁর টেস্ট টিউব বেবির জন্ম হয়। তিনি তাঁর গবেষণার কিছুটা অংশ ইন্ডিয়ান জার্নাল অফ ক্রায়োজেনিক্স এ প্রকাশ করেন এবং ১৯৭৯ সালের জানুয়ারি মাসে ইন্ডিয়ান সায়েন্স কংগ্রেসে হাজির করেন।

তিনি তার গবেষণা নিয়ে নয়া দিল্লিতে ১৯৭৮ সালের নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত ফিফথ ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স অন হরমোনাল স্টেরয়েড এ আলোচনা করেন। তিনি এ বিষয়টি নিয়ে হার্ভার্ড মেডিক্যাল স্কুলের ল্যাবরেটরি অফ হিউম্যান রিপ্রোডাকশন এর অধ্যাপক জন ব্রিগস এবং কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োকেমিস্ট্রি বিভাগের অধ্যাপক সাক্সেনার সাথে আলোচনা করেন। 

তিনি বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটি দ্বারা আমন্ত্রিত হন এমব্রাও ট্রান্সফার নিয়ে বক্তৃতা দেওয়ার জন্য। তিনি গৌহাটি ও এন্ড জি সোসাইটি দ্বারা আয়োজিত কনফারেন্সে বক্তব্য রাখেন ও একটি মানপত্র দ্বারা সম্মানিত হন। 

আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ  অভিযোগ ছিল অধ্যাপক মুখার্জির টিমের বিরুদ্ধে। মিডিয়া একটা সময় সর্বসম্মতিক্রমে একমত হয় যে অধ্যাপক মুখার্জির সবচেয়ে বড় অসুবিধের জায়গা ছিল তাঁর দাবির সপক্ষে ফিজিক্যাল এভিডেন্স হিসেবে নলজাতককে হাজির করতে না পারা। ১৯৭৮ সালে দুর্গার মা-বাবা প্রভাতকুমার ও বেলা আগরওয়াল তাদের কন্যার জন্মের বিশদ বিবরণ লোকসমক্ষে আনার অনুমতি দেন নি অধ্যাপক মুখার্জিকে।  লোকলজ্জা, রক্ষণশীল মাড়ওয়ারিসমাজে একঘরে হয়ে যাওয়ার ভয় - কারণটা সুধী পাঠক সহজেই অনুমান করতে পারেন। যদিও পরবর্তী কালে এক সাক্ষাতকারে দুর্গার বাবা প্রভাতবাবু দাবি করেছেন যে ভয় নয়, মিডিয়া হাইপ ও এটেনশনে তিনি অস্বস্তি বোধ করেন তাই তার ওই সিদ্ধান্ত। এই প্রসঙ্গে ডা: আনন্দ কুমারের বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য। তিনি বারবার সেই বিশেষ "ইন্ডিয়ান সাইকি" এর কথা বলেছেন যা সন্তান উৎপাদন হীনতা কে, "বাঁজা" হওয়াকে একটা অভিশাপ বলে মনে করে।

একথা মনে করার কারণ নেই যে সশরীরে ওই শিশু দুর্গা ও তার বাবা-মাকে উপস্থিত করলেই সব ঝামেলা মিতে যেত। অধ্যাপক মুখার্জিকে এমন প্রশ্নও শুনতে হয়েছে যে ওই সদ্যজাতক যে  'ইন ভিভো' ফার্টিলাইজেশন অর্থাৎ স্বাভাবিক জনন ক্রিয়ার উৎপাদন নয়, ওনার দাবি মতো 'ইন ভিট্রো' ফার্টিলাইজেশন (আইভিএফ) এর ফসল অর্থাৎ 'টেস্ট টিউব বেবি'- তার কি প্রমাণ আছে। শিশুটির মা বেলা দেবীর ঋতুচক্র স্বাভাবিক থাকলেও তার ফ্যালোপিয়ান টিউব ক্ষতিগ্রস্থ ছিল, স্বাভাবিক পদ্ধতি মেনে ওই মা কোনোদিনই সন্তান ধারণ করতে পারার কথা নয়। ডাক্তারি পরিভাষায় প্রাইমারি ইনফার্টিলিটি। অন্য এক চিকিৎসক তার কেসটা ডা: মুখার্জিকে রেফার করে। তিনি ওই দম্পত্তিকে একটি অভুতপূর্ব পদ্ধতি অবলম্বন করার প্রস্তাব দেন। সেই সময় তিনি ওদের আরো জানিয়ে দেন যে এটি একটি পরীক্ষামূলক পদ্ধতি, এতে সাফল্যের কোনো গ্যারান্টি নেই। দম্পত্তি রাজি হয়ে যায়। 

এক্সপেরিমেন্ট শুরু হয় অধ্যাপক মুখার্জির নেতৃত্বে, তিনি তখন বাঁকুড়া মেডিক্যাল কলেজে পোস্টেড, সপ্তাহ অন্তে বাড়ি আসতেন। উসাইট সংগ্রহ করার আগে ওভারিকে স্টিমুলেট করার জন্য গোনাডোট্রপিন ব্যবহার করা হয়। ট্রান্স ভ্যাজাইন্যাল রুটে ফ্লুইড এসপিরেট করা হয়। শেষ পর্যায়ে এমব্রাওকে লিকুইড নাইট্রোজেন ব্যবহার করে হিমায়িত করা হয়। এই কাজে ডাইমিথাইল সালফক্সাইড (ডিএমএসও) যৌগটিকে ক্রায়োপ্রটেকট্যান্ট হিসেবে ব্যবহার করা হয়। ৫৩ দিন বাদে ভ্রূণ কে হিমায়িত অবস্থা থেকে বের করে ৩৭ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় ১ ঘন্টার জন্য ইনকিউবেটরে দিয়ে গলানো হয় এবং তারপরে মায়ের জরায়ুতে স্থাপন করা হয়। ১৯৭৮ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি বেলা দেবীর প্রেগনেন্সি রিপোর্ট পজিটিভ আসে। এ সবই ডকুমেন্টেড ছিল। 

সর্বোপরি অধ্যাপক মুখার্জির টিমের অন্যতম সদস্য সুনীত বাবুর বক্তব্য অনুযায়ী, ওই দম্পত্তিকে এক্সপেরিমেন্ট চলাকালীন যৌনমিলন থেকে বিরত থাকার কথা বলা হয়েছিল এবং ওরা সেই পরামর্শ মেনে চলেছিলেন। 

ওই দম্পত্তিকে যেহেতু সশরীরে হাজির করা যায় নি সেহেতু অধ্যাপক মুখার্জির কাছে বিশেষ কোনো অপশন ছিল না। তিনি প্রকৃত বিজ্ঞানীর মতোই সুনির্দিষ্টভাবে বলেছিলেন যে এই মুহূর্তে তিনি আইভিএফ এর সপক্ষে কোনো সুনিশ্চিত প্রমাণ দাখিল করতে পারছেন না কিন্তু কোনো জেনেটিক মার্কার তাঁর হাতে থাকলে এটা প্রমাণ করা যেত। সেই সত্তর দশকের শেষের দিকে ভারতের মাটিতে দাঁড়িয়ে এর বেশি কিছু বলা তিনি কেন, অন্য কোনও বিজ্ঞানীর পক্ষেও সম্ভব ছিল না। 

"উটের পিঠে শেষ খড়ের টুকরো"---
তাঁর নিজের কাজকর্ম নিয়ে আলোচনা করার জন্য অধ্যাপক মুখার্জি ১৯৭৯ সালের ২৫শে জানুয়ারি জাপানের কিয়োটো বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাইমেট রিসার্চ সেন্টার আয়োজিত একটি বৈঠকে যোগদানের আমন্ত্রণ পান। খরচ ওদের। তিনি নিয়ম মেনে বিদেশযাত্রার অনুমতি (নো অবজেকশন সার্টিফিকেট) চেয়ে আবেদন করেন। তখনও স্বাস্থ্য ভবন তৈরি হয় নি, রাজ্য স্বাস্থ্যদপ্তরের ঠিকানা রাইটার্স বিলিডিং। তাঁর আবেদনপত্রের ফাইলে রাইটার্স এর কনিষ্ঠ রাইটার বাবু বা বরিষ্ঠ মন্ত্রী কি নোট দিয়েছিলেন তা জানা নেই (একদিন জানার ইচ্ছে আছে)। স্বাস্থ্য অধিকর্তার সই করা চিঠি গেল চটপট তাঁর কাছে। ১৬ই ফেব্রুয়ারি তারিখের ওই চিঠিতে স্বাস্থ্য অধিকর্তা অশেষ দুঃখের সাথে জানালেন যে তাঁর আবেদন নামঞ্জুর। তাঁকে নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে যে তিনি যেন সরকারের অনুমতি ব্যতিরেকে দেশত্যাগ না করেন। ভাবুন একবার, অধ্যাপক মুখার্জি যেন কোনো বিখ্যাত বিজ্ঞানী-গবেষক নন, তিনি যেন কোনও কুখ্যাত অপরাধী যে বিদেশে পালিয়ে যাওয়ার ধান্দায় আছে।

এই পর্যন্ত পড়ে যারা ভাবছেন যে যাক নিশ্চিত হওয়া গেল, এই গল্পের হিরো কে সেতো জানাই ছিল, এইবার ভিলেন কে সেটাও জানা গেল - তাদের জন্য তথ্য হিসেবে দু'একটা কথা। কারণ এই উপাখ্যানটি কোনো রগরগে বাজার চলতি তৃতীয় শ্রেণীর হিন্দি সিনেমার চিত্রনাট্য নয়। এতে সম্পুর্ন সাদা বা সম্পূর্ণ কালো কোনো চরিত্র নেই। সবাই ডিফারেন্ট সেডস অফ গ্রে - ধূসর। স্বাস্থ্য অধিকর্তা ডা: ছেত্রী নিজগুনে একজন প্রোথিতযশা চিকিৎসক ছিলেন। তিনি ১৯৭৬ সালে, বাম সরকারের আগের সরকারের আমলে নিযুক্ত হলেও বাম সরকারের যথেষ্ট আস্থাভাজন ছিলেন এর ভুরি ভুরি প্রমাণ আছে। 

উল্টোদিকে তদানীংতন স্বাস্থ্যমন্ত্রী ননী ভট্টাচার্য  ডুয়ার্স-তরাই অঞ্চলের পরিচিত ট্রেড ইউনিয়ন নেতা থেকে মন্ত্রীর আসনে বসেছিলেন। প্রয়াত এই মানুষটির অতিবড় রাজনৈতিক প্রতিপক্ষও স্বীকার করবেন যে এককথায় তিনি স্বজ্জন ব্যক্তি ছিলেন। অধ্যাপক মুখার্জির এই হেনস্থার জন্য তিনি ডা: ছেত্রীর সাথে বা অন্যকারুর সাথে হাত মিলিয়ে ষড়যন্ত্র রচনা করেছিলেন এটা ভাবা কষ্টকর। কিন্তু হেনস্থাতো হয়েছিল। তাই তার মন্ত্রকের নৈতিক দায়িত্ব তিনি এড়াতে পারেন না, যেমন পারেন না ডা: ছেত্রী। 

উটের কথায় ফিরে আসা যাক। বিদেশ যাত্রা প্রত্যাখ্যান এর ওই ঘটনার অল্প কিছুদিন পরে অধ্যাপক মুখার্জির হার্ট এটাক হয়। সুধী পাঠক, আপনি কি বলবেন জানি না, "দুষ্টজনে" বলে থাকে যে ওই বিদেশযাত্রা প্রত্যাখ্যান আর হার্ট এটাকের মধ্যে সরাসরি সম্পর্ক আছে। অসুস্থ অধ্যাপক মুখার্জি দুটি আবেদন করেন স্বাস্থ্য অধিকর্তার কাছে। স্পেশাল লিভ এবং বাঁকুড়া মেডিক্যাল কলেজ থেকে বাড়ির কাছে বদলি। স্বাস্থ্য অধিকর্তা প্রথমটি নামঞ্জুর করলেও দ্বিতীয়টি মঞ্জুর করেন। তাঁকে ১৯৮১ সালের ৫ই জুন বদলি করা হয় কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ সংলগ্ন রিজিওনাল ইনস্টিটিউট অফ অপথ্যালমোলজিতে "ইলেক্ট্রফিজিওলজি" বিভাগের প্রফেসর হিসেবে। এমন একটি বিভাগ যে বিষয়ে তার কোনও অভিজ্ঞতাই নেই।

এটাই বোধহয় ছিল সেই প্রবাদবাক্যের উটের পিঠে শেষ খড়ের টুকরো। সরকার তাঁকে বিজ্ঞান-সম্মেলনে গিয়ে নিজের গবেষনাপত্র হাজির করার সুযোগ দেবে না, গবেষণার ফলাফল গুছিয়ে লেখার জন্য সময় বের করার ছুটি দেবে না, সহকর্মীরা করবে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ। উট আর বইতে পারে নি। ক্লান্ত শ্রান্ত ন্যুব্জ পিঠ ভেঙে গেছিল। তাঁর বদলির আদেশনামা বেরোনোর ৪৪ দিন পরে ১৯শে জুলাই, ১৯৮১ অধ্যাপক মুখার্জি আত্মহননের রাস্তা বেছে নেন। সুইসাইড নোটে লিখেছিলেন,"প্রত্যেক দিন হার্ট এটাক হওয়ার চেয়ে একবার হওয়া ভালো"।  নোটের এই "হার্ট" শব্দটা বেছে নিয়ে তাঁর এক নিকট আত্নীয় আবেদন করেছিলেন আমাদের কাছে, "দোহাই আপনাদের, দয়া করে ওই হার্ট শব্দটার বাংলা তর্জমা করার সময় "হৃদযন্ত্র" আনবেন না, জানেন তো হার্ট এর আরেকটা বাংলা 'হৃদয়' ?"

"তোমার মৃত্যু আমাদের অপরাধী করে দেয় চে"---
ফিজিওলজি বা বিজ্ঞানের কোনো শাখায় কোনো বাঙালি নোবেল পান নি আজ অবধি।অধ্যাপক মুখার্জির আবিষ্কার বোধহয় সবচেয়ে কাছাকাছি সুযোগ ছিল। 

কয়েকদিন আগে পিতৃদিবসে অনেকেই তাঁর বাবাকে নিয়ে তাদের ভালোবাসা শ্রদ্ধার কাহিনী শুনিয়েছেন। আমার অদেখা এই মানুষটি কে আজ স্মরণ করলাম যিনি ডা: আনন্দ কুমারের ভাষায় ছিলেন ভারতের তথা এশিয়া মহাদেশের প্রথম নলজাতকের "সাইন্টিফিক ফাদার"। গবেষণা পাগল নিঃসন্তান এই মানুষটি আমাদের জন্য যে লিগ্যাসি রেখে গেছেন তা হল এই যে আমরা বাঙালিরা, ভারতীয়রাও পারি। 

তার জীবন কেবল কতগুলি কুচক্রী মানুষের হাতে এক প্রতিভাবান এর মৃত্যুর উপাখ্যান নয়। বাঙালি তথা ভারতীয়রাও যে চেষ্টা করলে বিজ্ঞানেও নোবেল পেতে পারে সেই আত্মবিশ্বাস খুঁজে পাওয়ার জন্যই তাঁর জীবনের কাছে ফিরে যেতে হবে। ফিরে যাবো বার বার দু হাত জড়ো করে তাঁর আশীর্বাদ পেতে।