শনিবার, ২৬ ফেব্রুয়ারী, ২০২২

প্রতিবাদের গান, প্রতিরোধের জীবন ~ দেবাশিস মৈত্র

নীচের ছবিটা খুব পরিষ্কার নয়, তবু একবার দেখুন।
বল হাতে নিয়ে দৌড়ে আসছে এক কৃষ্ণাঙ্গ যুবক। আশেপাশে ছড়িয়ে রয়েছে বিপক্ষের কয়েকজন শ্বেতাঙ্গ খেলোয়াড়, তারা কেউ এই যুবককে আটকাতে পারেনি।
রাগবি খেলার ছবি, অ্যামেরিকানরা যাকে বলে ফুটবল। রাগবি খেলা আমি বুঝি না, এ-খেলায় আমার কোনো আগ্রহ নেই। আপনাদেরও নেই নিশ্চয়ই। তবু ছবিটা একবার দেখুন। নিছক খেলার ছবি নয়, এক নিপীড়িত জাতিসত্তার মাথা তুলে দাঁড়ানোর ছবি।
ছবিটা তোলা হয়েছিল আজ থেকে একশো পাঁচ বছর আগে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অপেশাদার ফুটবল লিগের একটি ম্যাচে।পেশাদার ফুটবল লিগ সেদেশে তখনও চালু হয়নি, এই অপেশাদার টুর্নামেন্ট ঘিরেই তখন দর্শকদের ছিল অফুরন্ত উৎসাহ। এই প্রতিযোগিতায় অ্যামেরিকার সেরা সব কলেজ আর বিশ্ববিদ্যালয়ের দলগুলি তো অংশ নিতই, পাশাপাশি খেলতে আসত বহু ক্লাব, সংগঠন, এমনকী সেনাদলের রাগবি টিমও।
ছবির এই কৃষ্ণাঙ্গ যুবক ছিল রাটজার্স (Rutgers) কলেজ টিমের সদস্য। সে-ই ছিল দলের একমাত্র কৃষ্ণাঙ্গ খেলোয়াড়, বাকি সবাই শ্বেতাঙ্গ। সত্যি কথা বলতে কি, দু'বছর আগে সে যখন এই কলেজে ভর্তি হয়, তখন প্রথম বর্ষের ১৮৫ জন ছাত্রের মধ্যে সে-ই ছিল একমাত্র নিগ্রো। এখন সে তৃতীয় বর্ষের ছাত্র; দলের বেশির ভাগ সদস্যই তার সহপাঠী, বাকিরা দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। দলের একজনও তখনও কুড়ি বছরে পা দেয়নি।
উনিশ বছর বয়সী এই কৃষ্ণাঙ্গ যুবকের উচ্চতা ছ'ফুট তিন ইঞ্চি, ওজন প্রায় একশো কেজি, অসাধারণ পেশিবহুল শরীর এবং সেই শরীরে দানবের মতো শক্তি। তার জন্য অবশ্য এযুগের সেলিব্রিটিদের মতো এই যুবককে কোনদিন জিমে যেতে হয়নি।নিজের পড়ার খরচ চালানোর জন্য ছুটিছাটায় তাকে নানারকম কাজ করতে হত। বড়লোকদের রিসোর্টে বাসন মাজার কাজই তার বেশি পছন্দ ছিল বটে, কিন্তু সবসময় সে-কাজ জুটত না। অনেক সময় তাকে রাজমিস্ত্রির জোগাড়ের কাজ নিতে হয়েছে, সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বাঁশের ভারা বেয়ে রাশি রাশি ইট তিনতলা-চারতলায় তুলতে হয়েছে। সেটাই ছিল তার ব্যয়াম। তাছাড়া গত দু'বছর ধরে ক্লাসের পড়া অথবা রাগবি দলের ট্রেনিং – কোনোটাতেই সে বিন্দুমাত্র ফাঁকি দেয়নি। ছোটবেলা থেকে সে জানত যে এই দেশের সে এক দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক। নিছক শ্বেতাঙ্গদের সমকক্ষ হয়ে উঠলে জীবনের কোনো ক্ষেত্রেই সে পাত্তা পাবে না, প্রতিদ্বন্দ্বীদের টপকে আরো অনেক দূর এগোতে না-পারলে তার ভবিষ্যৎ অন্ধকার। আর এই অনেক দূর এগোনোর সাধনার জোরেই সে কলেজের টিমে সুযোগ পেয়েছে, এবং গত দু'বছর ধরে দলের সবচেয়ে বড় ভরসার জায়গা হয়ে উঠেছে।
সে-বছর পরপর কয়েকটি লিগ ম্যাচ জিতে, এবং একটি ম্যাচ ড্র করে, রাটজার্স মুখোমুখি হয়েছিল এক ভয়ংকর প্রতিদ্বন্দীর – রোড আইল্যান্ডের "নাভাল রিজার্ভ টিম।" পেশাদার সৈনিকদের এই রাগবি দলে রয়েছে, এক-আধজন নয়, এমন আঠারোজন খেলোয়াড় যারা বিভিন্ন সময়ে অল-অ্যামেরিকান রাগবি দলে নির্বাচিত হয়েছে। তাদের মধ্যে থেকেই এগারোজন সেদিন মাঠে নামবে। খেলা শুরুর আগে ড্রেসিং রুমে প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়দের দেখে সৈনিকদের হাসি আর থামতেই চায় না! "এরা তো সব স্কুলের ছানাপোনা, এরা আমাদের পাঙ্গা নিতে এসেছে বুঝি?" সেকথা শুনে কৃষ্ণাঙ্গ ছেলেটিকে তার দু'একজন সহ-খেলোয়াড় চুপি চুপি বলেছিল, "একবার উঠে দাঁড়া তো! তোর স্বাস্থ্যটা ওরা একবার দেখুক!" কৃষ্ণাঙ্গ ছেলেটি ভাবলেশহীন মুখে বসে রইল, যেন প্রতিপক্ষের ব্যঙ্গবিদ্রূপ তার কানেই ঢোকেনি। সে তো তখন জানে যে খেলা শুরু হওয়ার পর প্রতিপক্ষের যাবতীয় আক্রমণ তারই উপর নেমে আসবে।অপরাধ? একটিই অপরাধ তার – চামড়ার রঙ কালো। রাগবির মতো নৃশংস খেলা পৃথিবীতে আর একটিও নেই, মুষ্টিযুদ্ধ এর কাছে শিশু। একশো বছর আগের সেই দিনগুলিতে রাগবির নিয়মকানুনও ছিল অনেক শিথিল। অদূর অতীতে রাগবির মাঠে বেশ কিছু প্রাণহানির ঘটনাও ঘটে গেছে। আর শ্বেতাঙ্গ প্রতিপক্ষের নির্দয় আক্রমণের শিকার তো আমাদের কাহিনির এই ছেলেটিকে বারেবারেই হতে হয়েছে। আজও নিশ্চয়ই তার অন্যথা হবে না। নীরবে বসে রইল সে, আর সময় হওয়ার পর চোয়াল শক্ত করে মাঠে নামল।
তার পরের ঘটনার সাক্ষী ছিল সেদিন মাঠে উপস্থিত পনেরো হাজার দর্শক। এগারো জন বাঘা বাঘা অল-অ্যামেরিকান টিমের অভিজ্ঞ খেলোয়াড় হাজার মারধোর করেও উনিশ বছর বয়সী এই কৃষ্ণাঙ্গ ছেলেটিকে সেদিন কোনোভাবেই আটকে রাখতে পারেনি। অবিশ্বাস্য ফল হল খেলার। একদল শ্বেতাঙ্গ সৈনিক "স্কুলের ছানাপোনা"-দের কাছে ১৪-০ গোলে ম্যাচ হেরে মাথা নীচু করে মাঠ ছাড়ল।
সেদিনের ওই কৃষ্ণাঙ্গ যুবক পরবর্তী জীবনে তার খেলার মাঠ বদলে নিয়েছিল। রাগবি, বেসবল, বাস্কেটবল অথবা ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ডের জগৎ ছেড়ে সে পা রেখেছিল সংস্কৃতির আঙ্গিনায়। নাটক, চলচ্চিত্র, সংগীত - সর্বত্রই অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়েছিল সে, ঠিক সেদিনের রাগবি ম্যাচের মতোই। সংস্কৃতির জগতে সে হয়ে উঠেছিল বিশ্বের সবচেয়ে খ্যাতিমান শিল্পীদের একজন। বহু নাটক আর চলচ্চিত্রে সে অভিনয় করল, স্বদেশের এবং স্বজাতির গানের ডালি নিয়ে ঘুরে বেড়াল গোটা দুনিয়া। কিন্তু তারপর যখন সে কৃষ্ণাঙ্গদের এবং দরিদ্র মানুষের অধিকার রক্ষার লড়াইয়ে নিজের জীবন উৎসর্গ করে বসল, তখন তার মাতৃভূমির রাষ্ট্রনায়কদের টনক নড়ল -  যেভাবে হোক এই বেয়াদব ছেলেকে আটকাতে হবে!
হ্যাঁ, শেষ পর্যন্ত আটকানো গিয়েছিল তাকে। দেশদ্রোহী হিসাবে তাকে ঘোষণা করে তার গান গাওয়ার এবং অভিনয় করার সমস্ত রাস্তা একে একে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সেজন্য বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র হিসাবে পরিচিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকারকে সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে হয়েছিল তার উপর। হ্যাঁ, এই কৃষ্ণাঙ্গ যুবকের কণ্ঠস্বর চিরকালের মতো স্তব্ধ করে দিতে পেরেছিল তারা। আর, অবিশ্বাস্য মনে হলেও একথা সত্যি, যে-কৃষ্ণাঙ্গ সমাজের জন্য তার জীবনভোর লড়াই, শেষের দিনগুলিতে তাদেরও আর তার পাশে দেখা যায়নি।
আজ থেকে ছেচল্লিশ বছর আগে, ১৯৭৬ সালের ২৩শে জানুয়ারি, নিজের প্রিয় শহর থেকে অনেক দূরে তাঁর দিদির বাড়িতে স্বেচ্ছা-নির্বাসনে কয়েক বছর কাটানোর পর শেষ নিঃশ্বাস ফেলেছিলেন নিঃসঙ্গ পল রোবসন।
## দেবাশিস মৈত্র
তথ্যসূত্রঃ
1. Robeson, Paul. "Here I stand." Beacon Press, Boston. (1958)
2. Hamilton, Virginia. "Paul Robeson: the life and times of a free black man." Harper Collins. (1974)
3. Duberman, M. B. "Paul Robeson." Alfred A. Knopf. (1988).
4. Boyle, S. T. and A. Bunie. "Paul Robeson: the years of promise and achievement." University of Massachusetts Press. (2005)
5. Swindall, Lindsay R. "Paul Robeson: A life of activism and art." Rowman & Littlefield, reprinted 2015.
6. Horne, G. "Paul Robeson: the artist as revolutionary." Pluto Press. (2016)
সঙ্গের ছবিটি উপরের তালিকার চতুর্থ বইটি থেকে নেওয়া।
পল রোবসনের কণ্ঠে একটি নিগ্রো স্পিরিচুয়ালের লিংক দিলাম। সঠিক জানি না, কিন্তু আমার বিশ্বাস করতে ইচ্ছা হয় যে শেষ জীবনে দিদির বাড়িতে স্বেচ্ছা-নির্বাসনে বাস করার সময় এই গানটি পল বারবার শুনতেন।

আনিশ খান ও রাজনীতি ~ সুশোভন পাত্র

এক্সিকিউজ মি! মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, আনিশ খানের মৃত্যু নিয়ে রাজনীতি করবেন না প্লিজ!
রাজনীতি করবেন শুধু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়! আলিয়ার আনিশ থেকে ক্লাসিক্যালের সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় হয়ে ডিক্সো ড্যান্সর বাপি লাহিড়ী -রাজনীতি করবেন শুধু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়! উনি 'ইনসাফ' চাইবেন, উনিই 'ইনসাফ' দেবেন! উনি রিজওয়ানুর মা কে নিয়ে মিছিল করবেন। রেলের যাত্রী পরিষেবা কমিটিতে হালকা করে গুঁজে দেবেন। রিজওয়ানুরের ভাই রুকবানুর তৃণমূলের বিধায়ক হবেন। 'ইনসাফ' মামলা আদালতে রুকবানুরের সাক্ষ্যের অভাবে ঝুলে থাকবে। লাক্স কোজির কোটিপতি মালিক অশোক টোডি তৃণমূলের মাড়োয়ারি সেলের হর্তা-কর্তা-বিধাতা হবে। 'ইয়ে আন্দর কা মামলা হ্যা'-র ক্যাচলাইন লেপটে, তৃণমূল সরকার রিজওয়ানুর কাণ্ডে অপসারিত অভিযুক্ত পুলিশ অফিসারের জ্ঞানবন্ত সিং-র পদন্নোতি ঘটাবে। আর আনিশ খুনের তদন্তে গঠিত সিটের মাথায় ঐ জ্ঞানবন্ত সিং-ই আলো করে বসবে! 
দার্জিলিংয়ের একচিলতে রোম্যান্টিক গ্রাম সিরুবাড়ির পাহাড়ি বাঁকের পাইন ফরেস্টে পুলিশ অফিসার অমিতাভ মালিক খুন হয়েছিলে বিমল গুরুংর গুণ্ডা বাহিনীর গুলিতে। লাখ টাকায় স্ত্রী বিউটি মালিকের শোক বিহ্বল আর্তনাদ বিক্রি হয়েছিলে মিডিয়ার টিআরপি বাড়াতে। স্বামীর মৃতদেহ জড়িয়ে ধরে বিউটি রাজ্য পুলিশের ডিজিকে বলেছিলেন, "স্যার, আমার সব শেষ! বিমল গুরুং-র মাথায় গুলি করুন!" তারপর বিমল গুরুং পলাতক হলেন!  দিল্লিতে বিজেপি নেতা জেপি নাড্ডার মেয়ের বিয়েতে চেটেপুটে ভোজ খেলেন। আর বিধানসভা নির্বাচনের ঠিক ৬ মাস আগে 'পলাতক' বিমল গুরুং মমতার সাথে গোপন বৈঠক সেরে বিজেপি ছেড়ে তৃণমূলে ফিরলেন! বিমল গুরুং বললেন স্বাধীন গোর্খাল্যান্ডের ইস্যুতে মমতাই 'আইডল'!
আর আপনি আলিয়ার আনিশ তৃণমূল-বিজেপি বিরোধী ছাত্র আন্দোলন করত বলে রাজনীতি করছেন? মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, আনিশ খানের মৃত্যু নিয়ে রাজনীতি করবেন না প্লিজ!
রাজনীতি করবেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গৃহপালিত মিডিয়া, পুলিশ আর বুদ্ধিজীবীরা! কলকাতা টিভির কর্ণধার কৌস্তুভ রায় মধ্যরাতে আনিশের বাড়িতে যাবেন। 'মুখ্যমন্ত্রীর পিএ' পরিচয় দেবেন। চাকরি, টাকা, পুলিশি নিরাপত্তা -টোপ দিয়ে ভিক্টিম ফ্যামিলিকে কেনার মিডলম্যান হিসেবে ভাড়া খাটবেন। কোন কৌস্তুভ রায়? ব্যবসায়ী আরপি গ্রুপের চেয়ারম্যান কৌস্তুভ রায়! দিল্লির চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে আর্থিক তছরুপের মামলায় অভিযুক্ত জেল ফেরত আসামি কৌস্তুভ রায়! চিট ফান্ড কাণ্ডে কোটি টাকায় মুখ্যমন্ত্রীর ছবি কেনায় ঘটনায় ইডির লুক আউট নোটিস জারি হওয়া শিবাজী পাঁজার 'বুজম ফ্রেন্ড' কৌস্তুভ রায়। মমতা দরদী সাংবাদিক জয়ন্ত ঘোষালের ভাষ্যে 'চোরি চোরি চুপকে চুপকে' 'নো ভোট্টু' বাবুদের গ্লুইং ফ্যাক্টর কৌস্তুভ রায়! 
পুলিশের গাড়ি রাত একটার পরে আনিশের গ্রামে যাবে। চাইলে বাড়িতে ঢুকবে! আনিশ লাশ হয়ে পড়ে আছে জেনেও ৯ ঘণ্টা পর টনক নড়বে। চার জন মার্কা মারা সিভিক পুলিশ বেমালুম ফেরার থাকবে। সিভিক একজন রসপুরের তৃণমূলী পঞ্চায়েতের উপপ্রধানের ছেলে বেরোবে। বাকি তিনজনকে এলাকার লোক সিভিক কম আর তৃণমূলের মস্তান হিসেবেই বেশি চিনবে। লরি, গাড়ি থেকে টাকা আদায় করবে। পুলিশের পোশাক ফাইন করবে, তোলা তুলবে, ভোটের সময় ছাপ্পা মারবে। আর সোনারপুর বিধানসভার তৃণমূল বিধায়ক লাভলি মৈত্র-র স্বামী সৌম্য রায় হাওড়ার গ্রামীণ পুলিশের সুপার সেজে জাস্ট নাকে তেল দিয়ে ঘুমোবে! 
বুদ্ধিজীবীরা কেউ চেয়ার মুছবেন, কেউ পাগলু নাচবেন, কেউ নন্দনে দুলবেন, কেউ আবার কাক আঁকবেন। আর সিলেক্টিভ প্রতিবাদে মাধ্যমিকের বাধ্য মেয়ে হয়ে, "পাগলী, তোমার সঙ্গে সরীসৃপ জীবন কাটাব" বলে কোরাস গাইবেন! এটা কি সিপিএম-র সরকার নাকি যে আলিয়ার আনিশ মরলে 'ইনসাফ' চাইবেন? ফেস্টুনে-ব্যানারে প্রতিরোধের ব্যারিকেড গড়বেন? রাজপথে মিটিং-মিছিল-জনসভা শেষে বিসেলারির মিনারেল ওয়াটারে স্বস্তির চুমুক দেবেন? সন্ধেবেলা রিমলেস চশমা চাপিয়ে টক শো তে সরকারের বাপ-বাপান্ত উদ্ধার করে ডিনারে টেবিলে গোপন বৈঠক সারবেন? রাত্রে দক্ষিণ কলকাতার পশ ফ্ল্যাটে একটা সাউন্ড স্লিপ। কাল আবার ধর্না মঞ্চ? সিঙ্গুরের 'অনিচ্ছুক'রাই তো আসলে 'আইস অন দি কেক'। শিল্পের বদলে মাছের ভেড়ি হলেই কি গৃহপালিত বুদ্ধিজীবীরা মেরুদণ্ড খুঁজে পাবেন?
আর আপনি আলিয়ার আনিশের খুনে মিডিয়ার নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন? পুলিশের ভূমিকায় বিক্ষোভ দেখিয়ে রাস্তা অবরোধ করছেন? বুদ্ধিজীবীদের শিরদাঁড়া হাতড়ে বেড়াচ্ছেন? মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, আনিশ খানের মৃত্যু নিয়ে রাজনীতি করবেন না প্লিজ!
রাজনীতি করবেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়! উনি ভোটের জন্য মুসলমানদের অন্য ক্যামেরা 'দুধেল গরু' বলবেন। সাপের মুখে চুমু খেয়ে, মস্তান মৌলবি তহা সিদ্দিকিদের পুষবেন! ব্যাঙের মুখে চুমু খেয়ে, ফিচেল দাঙ্গাবাজ মোহন ভাগবত কে উস্কানি দিতে কলকাতায় সভা করতে দেবেন। ভোটের জন্য হিজাব পরবেন, CAA-NRC বিরুদ্ধে নিজের সাংসদদের পার্লামেন্টে ভোটদানে বিরত রাখবেন। আর সংখ্যালঘু উন্নয়নের নামে কে লবডঙ্গা দেখিয়ে, আনিশ মরলে 'ফেভারিট' বলে একটা সিট ঠুকে দেবেন! ঐ সিগারেটে ট্যাক্স বসিয়ে চিটফান্ডের টাকা ফেরত দেওয়ার সিট! কুণাল ঘোষ কে চিটফান্ডে কাণ্ডে গ্রেপ্তার করে তৃণমূলের মুখপত্র বানানোর সিট!
খুব বেশি হলে কমিশন! কমিশন গড়তে আবার বড্ড ভালোবাসেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মুখ্যমন্ত্রী হয়ে এগারোটা কমিশন গড়েছিল মেয়েটা। বছর ঘুরতেই আরও ছটা। এত কমিশন একসঙ্গে জীবনে দেখেনি রাজ্যবাসী। নবান্নের চোদ্দ তলার প্রথম থাকে সে রাখল 'জমি বণ্টনে অনিয়মে'র তদন্ত কমিশন'দের। রাজারহাটের কমিশন'টাকে জড়িয়ে ধরে সে বলল, তুই আমার তুরুপের তাস। দ্বিতীয় থাকে রাখল সব 'গণহত্যার' কমিশন'দের। ২১শে জুলাই কমিশন'টাকে জড়িয়ে ধরে বলল তোর নাম বুদ্ধ ভট্টাচাজ বধ। দিনের শেষে সিপিএমের কেশাগ্র স্পর্শ না করা গেলেও কমিশনগুলোর অশ্বডিম্ব প্রসবে খরচা হয়েছিল ৫ কোটি!
রাজ্যের পুলিশ, সিট, কমিশন -সবটাই আইওয়াশ! আসলে চুনোপুঁটিদের সাসপেন্ড-গ্রেপ্তার করে আনিশ কাণ্ডের শাক দিয়ে মাছ ঢাকার রেসিপি সাজাচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী। সদ্য সন্তানহারা পরিবারের জেদ দেখে খেই হারাচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী। আনিশের গ্রামের সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত বিক্ষোভ কে ভয় পাচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী। পোষা পুলিশ, মিডিয়া, বুদ্ধিজীবীদের নেক্সাসের বিরুদ্ধে বাঙলার যৌবনের প্রতিস্পর্ধা কে রাস্তায় দেখে প্রমাদ গুনছেন মুখ্যমন্ত্রী। এই স্ফুলিঙ্গ যে জঠরে দাবানল হয়ে ওঠার ক্ষমতা ধরছে বিলকুল বুঝতে পারছেন মুখ্যমন্ত্রী। তৃণমূলের শেষের শুরুর দেওয়াল লিখনটা আসলে স্পষ্ট পড়তে পারছেন মুখ্যমন্ত্রী। 
আর তাই মুখ্যমন্ত্রী বলছেন, আনিশ কাণ্ডে বিক্ষোভ-আন্দোলন-রাজনীতি উনি পছন্দ করছেন না! ডিয়ার মুখ্যমন্ত্রী, অকারণ আপনার অপছন্দ নিয়ে চাপ নেবেন না। কারণ আমরাও তো আপনাকে পছন্দ করছি না!

সোমবার, ২১ ফেব্রুয়ারী, ২০২২

ভাষা হোক উন্মুক্ত! ~ সেখ সাহেবুল হক

-'তোর তৈরী সফটওয়্যারের দাম কত রাখবি?'

-'দাম রাখবো কেন? কোনো টাকা পয়সা দিতে হবে না। ভাষার জন্য টাকা নেবো কেন?'

এক সিনিয়রকে এভাবেই বলেছিলেন ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজের এক তরুণ। কালক্রমে তাঁর তৈরী সফটওয়্যার ডিজিটাল মাধ্যমে বাংলা লেখার পন্থাকে খুব সহজ এবং সরল করেছে। 'ami ekjon bangali' টাইপ করলে খুব সহজেই বাংলায় 'আমি একজন বাঙালি' লেখা হয়ে যায়। এর অবদান বাঙালি সন্তান মেহদী হাসানের। 


একসময় কম্পিউটারে বাংলা লেখা ছিল বেশ কষ্টসাধ্য ব্যাপার। টাইপ শেখার মতো বাংলা টাইপ শিখতে হতো। আস্তে আস্তে সড়গড় হয়ে তারপর বাংলা লেখা যেতো। মেহেদী হাসানের  সফটওয়ারের দৌলতে বাংলা লেখা খুব সহজ হলো। কম্পিউটার ছাড়াও স্মার্টফোনে বাংলা লেখার কৌশল আজ আমাদের হাতের মুঠোয়। ফেসবুক স্ট্যাটাস-কমেন্ট ছাড়াও হোয়াটসঅ্যাপ বা অন্য যোগাযোগ মাধ্যমে বাংলা লিখে ভাব বিনিময় সহজ হয়েছে। সর্বোপরি, বাঙালি সাধের খিস্তিখেউড় বাংলায় করতে পারে। বাংলা হরফে গালাগালির স্বাদই আলাদা। যিনি খান, তিনি যেমন ঠিকঠাক স্বাদ পান, আবার যিনি দেন, তিনিও যথাযথ সুখ পান।   

 
বইমেলা উপলক্ষে ২০০৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলাদেশের বাংলা অ্যাকাডেমি চত্বর সেজে উঠেছিল বইয়ের স্টলে। সেবার বইমেলায় 'বাংলা ইনভেনশ থ্রু ওপেন সোর্স', সংক্ষেপে 'বায়োস' নামে একটি সংগঠন অংশগ্রহণ করে। এই সংগঠনের সদস্যরা মেলায় সম্পূর্ণ বাংলায় 'লোকালাইজ করা' একটি লিনাক্স ডিস্ট্রোর প্রদর্শনী করেছিলেন। যার পোশাকি নাম ছিল 'বাংলা লিনাক্স'।

'বাংলা লিনাক্স' -র সাহায্যে বাংলা লেখার পাশাপাশি উইন্ডোর টাইটেল, মেনু বা ফাইলের নামকরণ সবই বাংলায় করা যায়। দুর্দান্ত সিস্টেমটি সবার নজর কেড়েছিল। কারণ বাংলা লেখার জন্য প্রচলিত কীবোর্ড গুলিতে সহজে বাংলা লেখা যেত না। অপারেটিং সিস্টেমটিও সম্পূর্ণ বাংলায় ছিল না।

 
'বায়োস' এর প্রদর্শনীতে একটি ছেলে দাঁড়িয়েছিল, প্রোগ্রামিংয়ে যার ভীষণ আগ্রহ ছিল। সে বাড়ি ফিরেছিল প্রদর্শনীর ব্যাপারে ভাবতে ভাবতে। এরপরই কীভাবে এমন একটা কিছু বানানো যায়, যা দিয়ে অতি সহজে সকলে বাংলা লিখতে পারা যাবে, এই স্বপ্ন তাড়িয়ে বেড়ায় তাকে। বইমেলার সেই ছেলেটিই ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের ছাত্র মেহদী হাসান খান। অভ্র সফটওয়্যার আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে যিনি বাংলা লেখায় নিঃশব্দ বিপ্লব এনেছিলেন। 

 

প্রথমে মেহদী 'বায়োস' এর লিনাক্স নিয়ে চর্চা শুরু করেন। কিন্তু তাঁর কম্পিউটারে উইন্ডোজ থাকায়, বাংলা লিনাক্স দিয়ে কাজ করতে পারছিলেন না। প্রোগ্রামিংয়ে নিবেদিতপ্রাণ ছেলেটির মনে এই ব্যাপারটি নিয়ে তীব্র কৌতুহল ছিলো। সেজন্য বাংলা লিনাক্সের ওই ফন্টটি ইনস্টল করেন। এসময় তার নজরে এলো একটি গুরুত্বপূর্ণ জিনিস। মাইক্রোসফট ওয়ার্ড কীবোর্ডের ইনসার্ট ক্যারেক্টার ব্যবহার করে ওই ফন্টের ক্যরেক্টারগুলো আনা সম্ভব এবং তা বেশ ভালো কাজ করে। তবে এটি বেশ সময়সাপেক্ষ ব্যাপার, বিরক্তির উদ্রেক করে। মেহদী চাইছিলেন বাংলা লেখার এমন একটি সিস্টেম, যার সাহায্যে যে কেউ সহজেই বাংলা লিখতে পারবেন। 

 
ক্রমশ মেহদী উপলব্ধি করলেন, তাঁর একটি কীবোর্ডের প্রয়োজন, যার সাহায্যে ইউনিকোড দিয়ে খুব সহজেই বাংলা লেখা যাবে। কিন্তু কোথাও খুঁজে পেলেন না তিনি। তিনি বুঝতে পারলেন, এমন কীবোর্ড পেতে হলে তাঁকেই তৈরি করতে হবে।

 
ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে পড়াশোনার মাঝে তাঁকে সৃষ্টির নেশা গ্রাস করলো। নাওয়া-খাওয়া ভুলে হোস্টেল রুমের দরজা জানালা বন্ধ করে সারাক্ষণ বসে বসে কী যেন করতে লাগলেন! শিক্ষকরা এবং সহপাঠীরা ভাবলেন, ছেলেটা মায়ের ভোগে গেল!
একদিকে পড়াশোনা অন্যদিকে ইউনিকোডভিত্তিক কীবোর্ড বানানোর চেষ্টা। এভাবেই একদিন মেহদী তৈরি করে ফেললেন একটি প্রোটোটাইপ।

 
এই অ্যাপ্লিকেশনটি মেহদী প্রথমে বানিয়েছিলেন মাইক্রোসফটের ডটনেট ফ্রেমওয়ার্ক ব্যবহার করে। কারণ অ্যাপ্লিকেশনটি তিনি বানিয়েছিলেন উইন্ডোজের জন্য। এইসময় ভারতে আয়োজিত বাংলা ফন্ট তৈরির একটি প্রতিযোগীতায় মেহদী নিজের তৈরি প্রোটোটাইপটি বাংলাদেশ থেকে পাঠালেন। মেহদীকে উদ্যোক্তারা জানালেন, তাঁর তৈরি প্রোটোটাইপটি ঘন ঘন ক্র্যাশ হচ্ছে।

 

মেহদী এবার ডটনেট বাদ দিয়ে 'ক্ল্যাসিক ভিজু্য়্যাল' এর ওপর ভিত্তি করে আবার একটি প্রোটোটাইপ তৈরি করলেন। আর ক্র্যাশের সমস্যা রইলো না। আর এভাবেই তৈরি হলো অভ্রর বর্তমান ফ্রেমওয়ার্ক। সফল হলো বইমেলায় 'বায়োস' এর তৈরি ফন্ট দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে শুরু করা মেহেদীর যাত্রা।

মেহদীর তৈরী অভ্রর ওয়েবসাইটটির নাম ওমিক্রন ল্যাব। অভ্রর সঙ্গে ওমিক্রন ল্যাবের জন্ম। অভ্রর এই অফিসিয়াল সাইট 'ওমিক্রন ল্যাব' কে ছড়িয়ে দেওয়াটা ছিল আরেকটি চ্যালেঞ্জ। সাইটটিকে গ্রহণযোগ্য করে তুলতেও তাঁকে বেশ পরিশ্রম করতে হয়।

 

পড়াশোনায় অমনোযোগী মেহদীকে কয়েকজন শিক্ষক এবং পরিচালন কমিটির লোকজন একসময় মেডিকেল ছেড়ে দিতে বলেন বলেও শোনা যায়। কিন্তু তিনি তখন সাইটে নিয়মিত আপডেট দিতে, ম্যানুয়াল লিখতে, ভার্সন নম্বর বাড়াতে এবং ব্যবহারকারীদের প্রশ্নের উত্তর দিতেই ব্যস্ত। এভাবেই কালক্রমে অভ্র পৌঁছে যায় ব্যবহারকারীদের কম্পিউটারে। 'কম্পিউটার টু-মরো' নামের একটি মাসিক পত্রিকায় সেই খবর প্রকাশিত হয়।

 

এই কর্মকাণ্ড মেহদী একা শুরু করলেও চলার পথে তিনি সঙ্গে পেয়েছিলেন দেশ বিদেশের বন্ধুদের। অভ্রর ম্যাক ভার্সন প্রস্তুতকারী রিফাত উন নবী, অভ্রর কালপুরুষ ও সিয়াম রুপালী ফন্টের জনক সিয়াম, অভ্রর বর্তমান ওয়েবসাইট ও লিনাক্স ভার্সন প্রস্তুতকারী সারিম এবং মেহদীর স্ত্রী সুমাইয়া নাজমুনসহ আরো অনেকের সহযোগিতা পেয়েছিলেন মেহেদী।   

 

'ভাষার জন্য টাকা নেবো কেন?' বলা তরুণটি শেষ পর্যন্ত সত্যিই তাঁর নিজ মাতৃভাষাকে উন্মুক্ত করে দিয়েছেন সকলের জন্য। অভ্র কীবোর্ড পোর্টালটি বিনামূল্যে উন্মুক্ত করেন তিনি। তথ্য প্রযুক্তিতে বাংলা ভাষা উন্মুক্ত হতে থাকে। তৈরী হয় ডিজিটাল মাধ্যমে ভাষার নতুন ইতিহাস।

 
স্কুল-কলেজ, অফিস-আদালত সর্বত্রই অভ্র বিনামূল্যে ব্যবহৃত হচ্ছে। বিনামূল্যে বাঙালি ডিজিটাল মাধ্যমে বাংলা লিখতে পারছে, প্রচারবিমুখ মেহদীর স্বপ্ন সফল হচ্ছে প্রতিটি অক্ষর টাইপের মধ্য দিয়ে। তাঁর স্লোগানই ছিল, 'ভাষা হোক উন্মুক্ত'।

মেহদী হাসান খানের সফটওয়্যার অভ্র বাংলা ভাষাকে দিয়েছে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে বাংলাভাষায় লেখালিখি করার চটজলদি সুযোগ। বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি না পেলেও মেহদী পেয়েছেন বেশ কিছু সম্মাননা। মাইক্রোসফটের অনলাইন সংগ্রহশালায় ইন্ডিক ভাষাসমূহের সমাধানের তালিকাভুক্ত করা হয়েছে অভ্র কীবোর্ডকে। 
অভ্রকে বাংলা কীবোর্ড রিসোর্স হিসেবে ইউনিকোড সংস্থার ওয়েবসাইটে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এছাড়া বাংলা তথ্য প্রযুক্তিতে বিশেষ অবদানের জন্য 'অভ্র টিম' কে বেসিস বাংলা থেকে দেওয়া হয় 'স্পেশাল কন্ট্রিবিউশন' পুরস্কার। ২০১৬ সালে মেহদী হাসান টপ টেন 'আউটস্ট্যান্ডিং ইয়ং পার্সনস' হিসেবে স্বীকৃতি পান।  

শিক্ষকদের আশঙ্কাকে ভুল প্রমাণিত করে ভালো ফল নিয়ে উত্তীর্ণ হলেও চিকিৎসাকে পেশা হিসেবে নেননি। তিনি প্রোগ্রামিংয়ের নেশাকেই পেশা হিসেবে নিয়েছেন।

বাংলা ভাষাকে ডিজিটাল মাধ্যমে উন্মুক্তকারী মেহদী হাসান খান একজন 'যথাযথ রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি না পাওয়া ভাষা সৈনিক'। সালাম, বরকত, জব্বারদের উত্তরসূরী মেহদী। তিনিও লড়াই করেছেন বাংলা ভাষাকে উন্মুক্ত করার স্বপ্ন নিয়ে। অনেকাংশেই তিনি সফল। 

কিন্তু আজও তাঁর বানানো সফটওয়্যার ব্যবহার করে যখন কেউ লেখেন, 'মোল্লারা কবে বাঙালি হলো?' অথবা 'বাংলাদেশি' শব্দ বিকৃত করে গালাগালি দেওয়া দেখলে মনেহয়, আমাদের আরও লড়ে যেতে হবে, মাতৃভাষার জন্য, বাঙালিয়ানার জন্য। যতদিন বাংলা ভাষা থাকবে, ভাষার ইতিহাস থাকবে, বাঙালি সন্তান মেহদী হাসান থাকবেন! ডিজিটাল মাধ্যমে অভ্র ব্যবহার করে লেখা প্রতিটি বাংলা অক্ষর তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে যাবে অজান্তেই।  

তথ্যসূত্রঃ বিভিন্ন বাংলাদেশি ওয়েবসাইট। লেখার মূল তথ্যগুলো সেখান থেকেই ধার করা।

মঙ্গলবার, ৮ ফেব্রুয়ারী, ২০২২

হিজাব নিয়ে বিতর্ক ~ মধুশ্রী বন্দোপাধ্যায়

২০১৪ সালে ফরাসী আদালত সর্বসাধারণের চলাচলের স্থান থেকে ক্রিসমাসের সময়ে যীশুর জন্মের দৃশ্য নিষিদ্ধ করেছিল। ফরাসী আইন অনুসারে, স্কুল, হাসপাতাল এবং স্থানীয় কাউন্সিলের মতো সরকারি স্থানে ধর্মীয় চিহ্ন থাকতে পারে না। যীশুর জন্মের দৃশ্য একটি 'ধর্মীয় প্রতীক' এবং 'পাবলিক স্পেসে ধর্ম নিরপেক্ষতা রাখতে হবে'- এই ফরাসি নীতির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।

বলে রাখা ভাল, ২০১৭ সালের পিউ রিসার্চ অনুসারে ফ্রান্সের ৫৪% নিজেদের খ্রিস্টধর্ম অনুসারী বলে দাবি করেছে। তার মধ্যে ৪৭% ক্যাথলিক চার্চের সাথে যুক্ত। অর্থাৎ তারা যীশু ও মেরির বিভিন্ন প্রতীকচিহ্নকে পূজা করেন। ২০০৪ সালে ওই একই দেশে সরকারি স্কুল এবং হাসপাতালগুলিতে স্পষ্ট ধর্মীয় চিহ্নগুলির প্রদর্শন নিষিদ্ধ করে। সেই সময়ে ওই দেশের শিখ সম্প্রদায় ক্ষুব্ধ হয়েছিল।

একটা দেশের নীতি-আদর্শ তৈরী হয় বহু ঘটনার ঘাত-প্রতিঘাতে। ফ্রান্সের ইতিহাস বড়ই জটিল। একদিকে আছে আফ্রিকা ও এশিয়ার বিভিন্ন দেশে সাম্রাজ্যবাদী ভূমিকা; আবার ওই দেশই প্রথম সাম্য-মৈত্রী-স্বাধীনতার ডাক দিয়েছে। ষাটের দশকে ফ্রান্সের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলনের যে আগুন জ্বলে উঠেছিল তা একসময়ে পৃথিবীর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ছড়িয়ে গিয়েছিল। 

আমাদের দেশের সঙ্গে ফ্রান্সের তুলনা করা যায় না, উচিতও না। আমাদের ধর্ম নিরপেক্ষতার ইতিহাস কণ্টকাকীর্ণ। এখানে শিক্ষায়তনে ধর্মীয় প্রতীক ব্যবহৃত হওয়া নতুন কিছু নয়। ১৯৯৫ সালে রুরকি বিশ্ববিদ্যালয়ে কনফারেন্স গিয়ে অবাক হয়েছিলাম সরস্বতী বন্দনা দিয়ে অনুষ্ঠানের সূচনায়। এদিকের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে এমন অভিজ্ঞতা আগে হয়নি। 

দেশটা বড়, এখানে বিভিন্ন অঞ্চলে আছে বিভিন্ন ধরনের সংস্কৃতি। সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুলে কিছুদিন পড়ার অভিজ্ঞতায় বলতে পারি আমাদের সময়ে সেখানে বাঙালি মুসলমান বন্ধুদের হিজাব পরতে দেখিনি। আবার উত্তর প্রদেশ ও অন্যান্য অঞ্চলের বন্ধুরা কিন্তু পরত। দেশের মুসলিমরাও কোন একশৈলিক চিন্তা ভাবনা করেন না। 

যেদিন সত্যিকারের ধর্মনিরপেক্ষ হতে পারব, সেদিন শিক্ষায়তনে হিজাব বা মাথায় ধর্মীয় পাগড়ি বা সরস্বতী বন্দনা সবকিছুরই বিরোধিতা করতে হবে।

যতদিন না তা হচ্ছে, ততদিন ধর্মনিরপেক্ষ মানুষ কী করবেন? 

ততদিন হিজাব পরার জন্য কোন নারীকে একদল মনুষ্যেতর তাড়া করলে তাদের দিকে তেড়ে যেতে হবে, মেয়েটির পাশে দাঁড়াতে হবে। ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রকে মেয়েটির সুরক্ষা দিতে হবে। রাষ্ট্র তা না দিতে পারলে মেয়েদের নিজেদের মত করে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।
 
আর আমরা? ধর্মনিরপেক্ষরা? আমরা কি তবে হিজাব পরাকে সমর্থন করব? আমরা কি আমাদের প্রতিবাদের ভাষা পাল্টে দেব? 

কখনই না।  

হিজাবের সঙ্গে নারী স্বাধীনতার প্রশ্ন যুক্ত। ইরানের  আয়াতোল্লা খোমেইনীর আগমনের পরে নয় বছরের বড় শিশু, কিশোরী, মহিলাদের আবশ্যিকভাবে মাথা ঢেকে রাখতে হয়। এর প্রতিবাদে হাজার হাজার নারী-পুরুষ একত্রিতভাবে প্রতি বুধবার মিছিল করছেন, প্রকাশ্যে হিজাব খুলে দিয়েছেন। প্রতি মুহূর্তে আন্দোলনকারীদের আশংকা থাকে পুলিশ ধরে নিয়ে গিয়ে জেলে আটকে রাখবে, বিচারের নাম হবে প্রহসন। তবু তারা আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন।

একসময়ে এই দেশে নারীরা সতী হয়েছেন। তবে আজ আর নারী সতী হবার প্রয়োজন বোধ করেন না, নিরামিষ আহার খাবার কোন ইচ্ছা পোষণ করেন না। হিজাব পরা কোন নারীর স্বাধীন অভিব্যক্তি নয়। এই ইচ্ছা আসলে সামগ্রিক সমাজের ইচ্ছা, এক কঠিন অনুভব। সমূহের বোধ ব্যক্তির ইচ্ছা হয়ে গোপনে চারিয়ে যায় মানুষ থেকে মানুষে। যেমন চারিয়ে গেছে ব্রাহ্মণকে অব্রাহ্মণের প্রণামে।

মেয়েটি তার মত করে রুখে দাঁড়িয়েছেন। কারণ রাষ্ট্র নগ্নভাবে বিভাজনের রাজনীতি করছে। আমরা কেউ তার পাশে থাকতে পারিনি। আমরা প্রতিবাদী মেয়েটিকে মুখের ভাষা জোগাতে পারিনি। এটা দেশের ধর্মনিরপেক্ষ শক্তির সামগ্রিক ব্যর্থতা। এই ভাষা জোগাতে হবে। নয়তো দশা হবে ইরানের টুদে পার্টির মত। ইসলামিক বিপ্লবের পর ১৯৮২ থেকে এই পার্টি ওই দেশে নিষিদ্ধ। অধিকাংশ নেতৃবৃন্দ নিহত অথবা কারাগারে। 

একটি ধর্মীয় জিগিরকে বন্ধ করতে অন্য ধর্মীয় জিগির তুলে অসাম্প্রদায়িক উদার চিন্তার বিকাশ সম্ভব নয়। আর যাই হোক, এতে ধর্মনিরপেক্ষতার লড়াই করা যায় না। 
নিজের কাজ অন্যের ঘাড়ে চাপানো যায় না।

দেশের এই ভয়ঙ্কর বিভাজনের রাজনীতির সময়ও সমস্ত ধর্ম নিরপেক্ষ শক্তি কার্যকরী ভূমিকা নিতে পারে না, এখনও এমনকি দেশের বাম শক্তি একত্রিত হতে পারল না।
সেই কাজ যত তাড়াতাড়ি করা যায় ততই মঙ্গল। 

দেশটা বাঁচে। মেয়েটি বাঁচে। আমরা বাঁচি।


08/02/2022

"হিজাব একটি বিতর্ক" ~ ডাঃ সমুদ্র সেনগুপ্ত

হিজাব কি একটি অমানবিক সামাজিক প্রথা? অমানবিক বলতে আমরা সাধারণত বুঝি, যে সামাজিক প্রথা মানলে দেহ ও মনের অপূরণীয় চূড়ান্ত ক্ষতি হয় যেমন সতীদাহ বা সহমরণ প্রথা বা তিন তালাক প্রথা বা মেয়েদের খতনা ইত্যাদি ইত্যাদি। মাথায় সিঁদুর দিলে বা পাগড়ি বাঁধলে বা গলায় পৈতে ঝোলালে বা হিজাব পরলে আপাতদৃষ্টিতে ততটা ক্ষতি হয় বলে আমাদের মনে হয় না। কিন্তু ক্ষতি যে হয় সেটা  অনেকেই মনে করেন এবং তাদের যুক্তিতে সারবত্তা আছে এটা বুঝে নিয়েই আলোচনাটা শুরু করা যেতে পারে।

এ প্রসঙ্গে এটা মনে রাখতে হবে যে হিজাব নিষিদ্ধ করার, বিশেষত বিদ্যায়তনে নিষিদ্ধ করার সপক্ষে যারা আছেন তারা একটা যুক্তি খাড়া করেন যে এর ফলে ছাত্র ছাত্রীদের যে ইউনিফর্ম পরে আসার প্রচলন আছে, সেটা নষ্ট হবে, ডিসিপ্লিন নষ্ট হবে। এর বিরুদ্ধে দুটো কথা বলার। প্রথমত সারা পৃথিবী জুড়ে এমন অসংখ্য স্কুল আছে যেখানে ইউনিফর্মের কোনো বালাই নেই। সে সব ছেলেপুলের লেখাপড়া হচ্ছে না, তাদের ভবিষ্যত ঝরঝরে হয়ে গেছে এমনটা নয়। দ্বিতীয়ত ভারতের সবচেয়ে শৃঙ্খলাবদ্ধ ফোর্সের দিকে তাকানো যাক, ভারতীয় সেনাবাহিনী। তাতে দিব্যি বছরের পর বছর ধরে একদল সৈন্য মাথায় পাগড়ি বেঁধে আসছে। এর জন্য সেনাবাহিনীর ডিসিপ্লিন নষ্ট হয়ে গেছে এমন দাবি অতি বড় পাগলেও করবে না। 

এ প্রসঙ্গে কর্ণাটক সরকার "পাবলিক স্পেস" এর কথা তুলেছে। তাদের যুক্তি স্কুল যেহেতু পাবলিক স্পেস সে জন্য বাড়ি থেকে হিজাব পরে এলেও সেটা খুলে স্কুলে ঢুকতে হবে। ওই একই যুক্তিতে বলা যায় যে তাহলে এবার থেকে নিয়ম করা হোক যে লোকসভা বা বিধানসভায় বা মুখ্যমন্ত্রীর দপ্তরে গেরুয়া পরে আসা যাবে না, ওটা খুলে অন্য কাপড় পরে ঢুকতে হবে। 

হিজাব কি চয়েস? এই মানবিক/ অমানবিক  প্রসঙ্গে এই চয়েস বিষয়টিও উঠে আসে বারেবারে। বাড়ি/পরিবার থেকে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে, মানা/ না মানার কোনো সুযোগ নেই এমন নিদর্শন এর পাশাপাশি স্বেচ্ছায় হিজাব পরেন তারও কিন্তু নিদর্শন আছে। যারা চয়েস করেছেন তাদের সবার চয়েস যে informed choice এটা ভাবার কোনো কারণ নেই। যারা মনে করেন যে হিজাব অমানবিক তারা বড়জোর ওই ইনফর্মেশন ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতে পারেন, সংবিধান প্রদত্ত বাক স্বাধীনতার অধিকারকে কাজে লাগিয়ে জনমত তৈরির চেষ্টা করতে পারেন যেমনটা হয়েছিল তিন তালাকের সময়। কিন্তু গায়ের জোরে হিজাব পরা বন্ধ করতে পারেন না। 

হিজাব কি একটি পুরুষতান্ত্রিক প্রথা? যারা নিজেদের কিঞ্চিৎ আলোকপ্রাপ্ত শিক্ষিত ইত্যাদি মনে করেন তারা সবাই মিলে রে রে করে তেড়ে আসবেন। এটা কোনো প্রশ্ন হল? সব্বাই জানে যে এটা পুরুষতান্ত্রিক প্রথা, এ নিয়ে আলোচনার কোনো অবকাশই নেই। গোল বেঁধে যায় এইখানেই। প্রথাটি যে পুরুষতান্ত্রিক সেই বক্তব্য মেনে নিয়েই এই অবকাশ থেকে যায় যে এই মতামতটা রাষ্ট্র বা সরকার এর পক্ষ থেকে চাপিয়ে দেওয়া যায় কি না। মানুষকে নিজেকে নিজের মতো করে উপলব্ধি করার সুযোগ না দিয়ে, জনমত গঠন না করে এ ভাবে চাপিয়ে দিলে যেটা হয়, যে আইডেন্টিটি ক্রাইসিস এ ভোগা মানুষ তার এথনিক কালচারাল আইডেন্টিটিকে আরো বেশি করে আঁকড়ে ধরে, সেটা ভালো না খারাপ বিচারে না গিয়ে, বিশেষ করে সেই মানুষজন যারা যেদেশে সংখ্যালঘু। 

আরো মস্ত ফাঁকির জায়গা এখানেই যে হিজাব পুরুষতান্ত্রিক বলে চিল্লানোর দলের একটা বড় অংশ সিঁদুর শাঁখা নিয়ে একেবারেই চুপচাপ। যে রাজনৈতিক দল হিজাব নিষিদ্ধ করতে কোমর বেঁধে লেগেছে, তাদের দিকে তাকালেই এই চরম দ্বিচারিতাটা স্পষ্ট হয়ে যাবে। এই আলোকপ্রাপ্তির ধ্যান ধারণাটা আমরা যে পাশ্চাত্য থেকে পেরেছি তার তথাকথিত আলোকপ্রাপ্ত নারী পুরুষদের একটা বড় অংশ ভিয়েতনাম বা ইরাকে নির্বিচারে তাদের সেনা দ্বারা হত্যালীলা নিয়ে সম্পূর্ন নীরব ছিল। 

হিজাব পরার কী সাংবিধানিক অধিকার আছে? সংবিধানে সরাসরি ভাবে হিজাব পরার কোনো উল্লেখ নেই, থাকার কথাও ছিল না। Article 25(1) এ সুস্পষ্ট ভাবে বলা আছে "Freedom of conscience and the right to freely profess, practise, and propagate religion." সুপ্রীম কোর্ট বিভিন্ন সময়ে নিদান দিয়েছেন যে অত্যাবশ্যক ধর্মীয় আচরণ পালনে বাধা দেওয়া যাবে না। হিজাব নিষিদ্ধ করার গা জোয়ারির বিরুদ্ধে যারা সংবিধান প্রদত্ত ধর্মাচরণ এর মৌলিক অধিকারের কথা তুলছেন তাদের মুখ বন্ধ করার জন্য বলা হচ্ছে যে হিজাব কোনো অত্যাবশ্যক ধর্মীয় আচারের অঙ্গ নয়। উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছে যে আমাদের দেশে তো বটেই, পৃথিবীর নানান দেশে ইসলাম অনুরাগীরা হিজাব ব্যবহার করেন না। ধরুন একই যুক্তিতে বলা যায় যে আমিষ খাওয়াটাও হিন্দু ধর্মের অত্যাবশ্যক অঙ্গ নয়। তাই কাল থেকে আমিষ ভক্ষণ নিষিদ্ধ করে দিলে কিছুই কিন্তু বলার থাকবে না। ফাঁকিটা আসলে অন্যখানে। কোন আচার আচরণ অত্যাবশ্যক আর কোনটা নয় এটা ঠিক করে দেওয়ার অধিকার কে কাকে দিল এ প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে না। আমার ধর্মকে আমার মতো করে ব্যক্তিগত পরিসরে ব্যাখ্যা করার সুযোগটাই কেড়ে নেওয়া হল। 

হিজাব পরা নিষিদ্ধ করা নিয়ে আদৌ মাথা ঘামানোর দরকার আছে? যারা মনে করেন দরকার নেই তাদের পক্ষের সবচেয়ে শক্তিশালী যুক্তিটা হল এই যে এসব নিয়ে মাথা ঘামিয়ে সময় নষ্ট করলে "আসল সমস্যা" থেকে নজর সরে যাবে, রুটি রুজির লড়াইটা পেছনে চলে যাবে। এর বিরুদ্ধে এটাই বলা যায় যে রুটিরুজির লড়াইটা ঠিক মতো করতে গেলে একজোট হয়ে থাকাটা খুব জরুরী আর একজোট যাতে না থাকতে পারে লোকজন, সেটা ভেস্তে দেয়ার জন্যই প্রতিক্রিয়ার শক্তিদের এসব আয়োজন। 

হিজাব নিষিদ্ধ করার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ কারা করবেন? যারা বলছেন যে হিজাব পরার পক্ষে হুল্লোড় করে একদল "বাম-ইসলামিক" আসলে মুসলিম সমাজকে পিছিয়ে রাখতে চাইছে, তাদের "অপর" করে রাখতে চাইছে, মেনস্ট্রিম হতে দিচ্ছে না তাদের মনে রাখতে হবে যে এই আলোচনাটা কোনো একটা ভ্যাকুয়াম স্পেসে হচ্ছে না। যে পরিসরে হচ্ছে সেটা ভারত নামের একটা দেশ যার অঙ্গরাজ্য কর্ণাটক যেখানে একটা ফ্যাসিস্ট দল পরিচালিত সরকার হিজাব নিষিদ্ধ করার এই এক্সপেরিমেন্টটা করে দেখছে, সফল হলে গোটা দেশ জুড়ে করবে ভবিষ্যতে। 

সেই এক্সপেরিমেন্টের আঁচ আমার আপনার সবার ব্যক্তিগত জীবনেও আজ বা কাল লাগবে। তখন আর এসব আলোচনা করারই কোনো অবকাশ থাকবে না। শুধু মুসলিমরা নয়, খ্রিস্টান, শিখ এমন কি হিন্দুরাও পার পাবে না। এটা ভাবার কোনো কারণ নেই যে এই অধিকার হরণের খেলাটা কেবল একটি নির্দিষ্ট সম্প্রদায়কে নিশানা বানিয়ে খেলা হবে।

জীবনযাত্রার প্রতিটা পদক্ষেপ ওই ফ্যাসিস্ট শক্তি নিয়ন্ত্রণ করবে। ওদের ইচ্ছে হলে আমিষ খাওয়া নিষিদ্ধ করে দেবে, ভারতীয় সংস্কৃতির দোহাই দিয়ে মহিলাদের জিন্স পরা বন্ধ করবে, পার্কে নারী পুরুষের বসা বন্ধ করবে, রাষ্ট্র বিরোধী দোহাই দিয়ে নানান বইপত্র পড়া নিষিদ্ধ করবে, নাস্তিককে সরস্বতী বন্দনা করতে বাধ্য করবে, হিন্দু বাঙালিকে বাধ্য করবে দ্বিভূজা সরস্বতীর বদলে চতুর্ভুজ সরস্বতীর উপাসনা করতে – ব্যক্তি স্বাধীনতা হরণের এই পিচ্ছিল অবনমনের কোনোই শেষ নেই। ভারতের বহুত্ববাদী সংস্কৃতির বদলে তার জায়গা নেবে সংঘ পরিবারের মনোমত "নাগপুরীয়" সংস্কৃতি। শেষের সেদিন বড় ভয়ংকর। তাই হিন্দু মুসলিম শিখ, নাস্তিক ডান-বাম বাঙালি-অবাঙালি নির্বিশেষে মানুষকে প্রতিবাদ করতে হবে। 

ঠিক কিসের দাবিতে বিক্ষোভ? যারা এতসব জানেন না তাদের কথা বাদ দেওয়া যায়, যারা এসব কিছু জেনেও না জানার ভান করে এই বিতর্কটাকে নিছক একটা একাডেমিক খোলস পরানোর চেষ্টা করেন, একটা "শ্রীনিরপেক্ষ" সাজার চেষ্টা করেন, তাদের অবস্থান সবচেয়ে বিপদজনক। এখনো সময় আছে, সুযোগ আছে, সুবিধাবাদী হাবভাব ছেড়ে স্পষ্ট কথা স্পষ্ট করে বলার, পক্ষ নেওয়ার। হিজাব পরতে দেওয়ার দাবিতে নয়, হিজাব নিষিদ্ধ করার এই ফ্যাসিস্ট কায়দার বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবেই। হিজাব পরা বা না পরার অধিকার সবার আছে। কোনোটাই জোর করে চাপিয়ে দেওয়ার তালিবানি কায়দা মেনে নেওয়া যাবে না।