বুধবার, ২২ ফেব্রুয়ারী, ২০২৩

মাতৃভাষা দিবস ~ ডঃ সমুদ্র সেনগুপ্ত

যার অক্লান্ত প্রয়াসে বাংলা ভাষার শহীদ প্রয়াণ দিবস ২১শে ফেব্রুয়ারি কে ইউনাইটেড নেশন্স বা সম্মিলিত জাতিপুঞ্জকে সারা পৃথিবী জুড়ে "মাতৃভাষা দিবস" হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিল তিনি হলেন কানাডা নিবাসী তরুণ বাংলাদেশি রফিকুল ইসলাম।
রফিকুল, যিনি একজন প্রাক্তন মুক্তিযোদ্ধাও বটে, ৯ই জানুয়ারি, ১৯৯৮ তে কানাডায় বসে তৎকালীন ইউএন মহাসচিব কোফি আন্নান কে ভাষা দিবস ঘোষণা করার অনুরোধ জানিয়ে একটি চিঠি লেখেন। যাইহোক, তার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যাত হয় কারণ ওই ধরণের প্রস্তাব কোনো সদস্য দেশের বদলে, ব্যক্তিমানুষের বা সংগঠনের কাছ থেকে আসলে গৃহীত হয় না।
এটি শোনার পরে হতাশ না হয়ে বন্ধু আব্দুস সালামকে সঙ্গে নিয়ে রফিকুল একটি সংগঠন গড়ে তোলেন। তার সেই সংগঠন, Mother Language Lovers of the World" এর আদি সহযোদ্ধা ছিলেন যে ন'জন, তারা হলেন:
◆আব্দুস সালাম ( বাংলা)
◆এলবার্ট ভিনজন ও কারমেন ক্রিস্টোবল (ফিলিপিনো)
◆জ্যাসন মনির ও সুসান হজিন্স (ইংরেজি ভাষা)
◆কেলভিন চাও (ক্যান্টোনিজ)
◆রিনাতে মারটেন্স (জার্মান)
◆নাজনীন ইসলাম (কাছি) এবং
◆করুণা জোশি (হিন্দি)
৭০ এর দশকে নিউ ইয়র্ক শহরে কালচারাল
এসোসিয়েশন অফ্ বেংগল প্রতিষ্ঠিত হয়। তার প্রাণপুরুষ তথা প্রতিষ্ঠাতা রণজিত্ রায়।রফিকুল এবং আব্দুস নিউ ইয়র্ক এ গিয়ে ওঁর সংগে বিস্তারিত আলোচনার পর এই পুরো অপারেশন এর মানচিত্র তৈরি করেন যে কিভাবে এগোলে জাতিপুঞ্জ এর কাছ থেকে এই দাবি আদায় করা যাবে।
এসব সংক্রান্ত মিটিং এ কোনও সদস্য-দেশ কে আনুষ্ঠানিক ভাবে প্রস্তাব পেশ করতে হয়।
ওই মিটিং এ বাংলাদেশ সরকার এই প্রস্তাবটি পেশ করে। সেই হিসাবে বাংলাদেশ সরকারও তার ভূমিকা যথাযথ ভাবে পালন করেছে ।
বাংলাদেশ সরকারের এই প্রস্তাবটি একটি খসড়া সিদ্ধান্ত আকারে ২৬শে অক্টোবর, ১৯৯৯ সালে প্রকাশিত হয়। ২৮ টি সদস্য দেশ সমর্থন করে। এর পরে ১২ই নভেম্বর, ১৯৯৯ ইউএন জেনারেল এসেম্বলিতে ওই খসড়া আরেকটু বড় আকারে পেশ করে ইউনেস্কো এর টেকনিক্যাল কমিটি, কমিশন দুই।
এর পাঁচদিন পরে ১৭ই নভেম্বর, ১৯৯৯ ইউএন ঘোষণা করে যে একুশে ফেব্রুয়ারি কে "আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস", হিসেবে পালন করা হবে। ইউনেস্কো প্রস্তাব স্বীকৃতি দেয় ১৯৫২ সালের ২১শে এর ভাষা শহীদদের। ১৮৮ দেশের ৬৫২৮ টি মাতৃভাষার গৌরবের দিন।
অবশ্যই রফিকুল ও রণজিৎ, ঘটনাচক্রে, একজন মুসলিম আর অন্যজন হিন্দু, এই দুই বাঙালির এই অবিস্মরণীয় অবদান কে মনে রাখবো কিন্তু কি করে ভুলে যেতে পারি ওপরের তালিকায় তার সহযোদ্ধাদের? তালিকার শেষ নামটি ছিল এক হিন্দিভাষী যুবকের, করুণা জোশি।
যারা ভাষাকে ভালোবাসতে জানে তাদের কোনও ধর্ম হয় না, জাত হয় না, জাতিও হয় না। ভাষা সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়তে হলেই অন্য ভাষাকে বা সেই ভাষায় কথা বলা মানুষজনকে অপমান করতে হয় না। যে নিজের মাকে সম্মান করতে জানে, সে অন্যের মা কেও সম্মান করতে শিখে যায়।

মঙ্গলবার, ২১ ফেব্রুয়ারী, ২০২৩

বাঙালী মানে কী ~ রেজাউল করীম

বড় লেখা। না পড়লেই ভালো। পড়লে ক্ষতি হবে না অবশ্য।
জাঁ পল সাত্রে ইহুদি সম্পর্কে বলেছিলেনঃ "ইহুদি" একজন স্বাভাবিক মানুষ। অন্যরা তাকে ইহুদি ভাবে ও তার উপর "ইহুদি" তকমা আরোপ করে। তার উপর যে ঘৃণার পাহাড় গত দুহাজার বছর ধরে নেমে এসেছে তারজন্য তার দায় যৎসামান্য।
এই কথা কটি বলে রাখলাম এজন্য যে আমার পরের কথাগুলো বুঝতে একটু সুবিধা হবে। ১৯৭৯ সাল। গাঁয়ের বাংলা মিডিয়ামে পড়ে কলকাতা শহরে পড়তে এসেছি। ১৫ বছর বয়স আর ত্রিশ কেজি ওজনের বালক মাত্র। ক্লাসে একজন জিজ্ঞাসা করলো, নাম কি? বললাম নাম। বললোঃ ও আমি ভেবেছিলাম, তুমি বাঙালী! এর পরের ধাক্কাটা আরো ভয়ানক। আমার পাশে দুজন আর্টসের ছেলে বসতো। তারা উর্দু মিডিয়ামের কিন্তু নাসির আলির ইংরেজি ক্লাসে তারা আসতো। একজনের নাম এখনো মনে আছে, রিয়াজ। সে বললোঃ তুমি মুসলমান কি রকম? তুমি তো বাংলায় কথা বলছো!
আত্মপরিচয়ের এই সংকট নিয়ে আমার বেড়ে ওঠা। যে হীনমন্যতা পরিচয়ের সংকট থেকে গড়ে ওঠে তা মানুষের অস্তিত্বকে বিপন্ন করে, তার স্বাভাবিক মানসিক বিকাশের অন্তরায় হয়ে ওঠে।
আজ একুশে ফেব্রুয়ারি ফেসবুক ও শহরের আনাচেকানাচে বাঙালীত্বের ঝড় উঠবে। আজ সবচেয়ে বেশি মনে রাখার দিন যে বাঙালী একটি স্বতন্ত্র সংস্কৃতি, কেবলমাত্র একটি বিশেষ ভৌগলিক অঞ্চলের মধ্যে তার সীমানা নয়। শুধু ধর্ম আলাদা বলেই কেউ ব্রাত্য নয়, বাঁকাচোখে হাসা নয়।
গঙ্গা-পদ্মা-করতোয়া-লোহিত্য ছাড়িয়ে মগধ ও প্রাগজৌতিষ একসময় ছিল বাঙালীর চারণভূমি।বাঙালী প্রাচীন জাতি, নিদেন পাঁচহাজার বছরের পুরনো। বাঙালী বর্ণসংকর জাতি- মূলতঃ আদি-অস্ট্রেলিয়, মিশর-এশিয় মেলানিড , আলপাইন ব্রাকিড এবং স্বল্প পরিমান নেগ্রিটো ও মঙ্গোলীয় এই সাড়ে বত্রিশ ভাজা বাঙালী জীনে উঁকি মারে। রক্তপরীক্ষা করে দেখা গেছে বাঙালী উঁচু জাতি, নীচু জাত, হাড়ি বাঙালী, ডোম বাঙালী, মুসলমান বাঙালী, খৃষ্টান বাঙালী সবার জিনগত বৈশিষ্ট্য এক। নাকের উচ্চতা, চোয়ালের হাড়, করোটির আকার, মুখ ওচোখের আকার ও উচ্চতার যে বাহ্যিক ফারাক তার কারন হল দীর্ঘ মুণ্ড ও দীর্ঘ বা মধ্যনাসা এসেছে যথাক্রমে তার অস্ট্রেলিয় ও মেলানিড জীন থেকে আর তুলনামূলক গোল মুণ্ড এসেছে ব্রাকিড জীন থেকে।
বাঙালীর যে বিভেদ তারজন্য শুধু ইংরেজের দোষ দিলে ইতিহাসের শিক্ষা ভুলে করতে হবে। The rise of Islam in eastern frontier বইয়ে ইটন সাহেব লিখেছেন মূলতঃ নীচু শ্রেণীর ১৪টি জাতি হিন্দু থেকে মুসলমান হয়েছে। মূলত চণ্ডাল, লোধ, শবর ও নমস্য শুদ্ররা এবং কারুশিল্পী শ্রেণী মুসলিম হয়। তথাকথিত নীচু শ্রেণীর হিন্দু ও জলচল গোষ্ঠী ও তার উপরের শ্রেণীর নৈমিত্তিক দ্বন্দ্ব ধর্মান্তরের সাথে সাথে বন্ধ হয়নি বরং তা আরো তীব্র হয়েছে। ধর্মত্যাগীর প্রতি বিদ্বেষ হয়তো বেশিই। তাই বাঙালীর ধর্মীয় বিভেদের ইতিহাস ও কম করে হলেও দু হাজার বছরের পুরনো।
আবার এখন যেমন হিন্দু-মুসলমান বিদ্বেষ দেখছি, একসময় এই বাংলায় শাক্ত-বৈষ্ণব বিদ্বেষ ছিল। তার আগে ছিল বৌদ্ধ হিন্দু লড়াই। হরপ্রসাদ লিখেছেন: বৃহত বঙ্গে এক কোটি বৌদ্ধ ছিলেন। এই বঙ্গে হেন গ্রাম ছিল না যেখানে বৌদ্ধ বিহার ছিল না। এখন তার এক খানা ইঁট ও দেখা যায় না। মাঝ খানে ছিল বৌদ্ধ মুসলিম লড়াই। তার ও আগে ছিল উঁচু হিন্দুর সাথে নীচু হিন্দুর লড়াই। বাঙালী ছিল ব্রাত্য। " অঙ্গ বঙ্গ কলিঙ্গ মগধেহপি চ। তীর্থযাত্রা বিনা গচ্ছন্ পুনঃ সংস্কারমর্হতি।।" এই ছিল বিধান- এই সব দেশে যেতে পারেন কিন্তু ফিরতে হলে প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে।
জরাসন্ধ, ভগদত্ত, নরক, পৌণ্ড্র, বাসুদেব এমনকি কৃষ্ণ-জ্ঞাতি নেমিনাথ ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। বৌদ্ধ পুঁথি, বৌদ্ধ বিহার নিশ্চিহ্ন হয়েছে, বৌদ্ধ দেবতা নাম বদলে হিন্দু দেবতা হয়েছেন। তারাদেবী, একজটা, ভদ্রকালি ইত্যাদি। নেড়ে বৌদ্ধ প্রাণভয়ে নেড়ে মুসলিম হয়েছে। অনেকে হিন্দু সমাজে ঠাঁই পেয়েছে অন্তঃজ হিসেবে। উদাহরণ স্বরূপ বৌদ্ধ ডোম পণ্ডিতের কথা উল্লেখ করা যায়। মেথর যে বৌদ্ধ তান্ত্রিকের হিন্দু ধর্মে পুনর্বাসিত হওয়ার চিহ্ন তা দীনেশচন্দ্র সহ অনেকেই মনে করেন। যদি চৈতন্যদেব না থাকতেন তাহলে বাংলায় হিন্দু থাকতেন কিনা সন্দেহ আছে (বৃহত বঙ্গ, পৃঃ ১০-১১)।
বাংলায় চারটি প্রখ্যাত বৌদ্ধ বিহার ছিল। নালন্দা ধ্বংস হয়েছে বখতিয়ারের হাতে। কিন্তু, বিক্রমশীলা, ওদন্তপুর ও সুবর্ণবিহারের কোন খোঁজ নেই। প্রকৃতপক্ষে, বৌদ্ধযুগের অন্তিমপর্ব থেকে সেনযুগ পর্যন্ত লিখিত ধারাবাহিক ইতিহাসের অভাব আছে। অথচ, অজস্র শাস্ত্রের বই রচিত হলেও যেন, ইচ্ছা করেই সামাজিক ইতিহাস লেখা হয় নি। শঙ্কর বিজয় ও শূন্য পুরানে তার কিছু পরিচয় লিপিবদ্ধ আছে বলে অনেকে উল্লেখ করেছেন।
আজ ভাষা দিবসে বাঙালী কি শিখবে যে বাঙালী মানে যে বাংলায় কথা বলে সে নয়, বরং তার চেয়ে বেশি? যে বাংলা বলে, বাঙালীর মতো খায়, বাংলায় ভাবে, বাংলায় স্বপ্ন দেখে সেই বাঙালী- এমন স্বপ্ন যে স্বপ্ন বাঙালীর ঘরে যত ভাইবোন আছে তাকে সে আপনার ভাববে। মুসলমান শুনলেই ভুরু কুঁচকে উঠবে না। শুনতে হবে না যে তুমি বাঙালী না মুসলমান।
বাঙালী যেদিন নিজের ভাষা, সংস্কৃতিকে ভালোবাসতে শিখবে আস্তে আস্তে সে নিজের ভাষায় নিজেকে প্রকাশ করবে, বাংলায় নাম উচ্চারণ করবে গর্বের সাথে। আরবি উর্দুর প্রতি কোন বিদ্বেষ নেই কিন্তু ভবিষ্যতের বাঙালী মন প্রাণ দিয়ে নামে-কর্মে-মরমে বাঙালী হয়ে উঠবে। তবু মনে রাখতে হবে উদার বাঙালী যেমন মিশ্র জাতি তার ভাষাও তেমনি মিশ্র।
বাংলা সংস্কৃতিতে আরবীয় প্রভাব আছে কিন্তু ভাষার ক্ষেত্রে আরবীর চেয়ে ফার্সি প্রভাব বেশি। কোন কোন ক্ষেত্রে ফারসি শব্দ বাদ দিয়ে দৈনন্দিন কথাবার্তা চালানোই মুস্কিল। মনে রাখা দরকার পারসিরা কিন্তু আরবী ভাষা ও সংস্কৃতির বিরোধী। তারাই সর্বপ্রথম কোরান আরবীতে পড়তে অস্বীকার করেছিল।
নীচের অসম্পূর্ণ সারনী গুগল থেকে নেওয়া-
১) বাংলা ভাষায় প্রচুর ফারসি শব্দ এবং ফারসির মাধ্যমে আরবি ও তুর্কি শব্দের অনুপ্রবেশ ঘটেছে; কোনো কোনো ক্ষেত্রে এদের প্রভাবে মূল বাংলা শব্দেরই বিলুপ্তি ঘটেছে। দৃষ্টান্তস্বরূপ বিলুপ্তপ্রায় কয়েকটি বাংলা শব্দ বন্ধনীতে উল্লেখ করা হলো: খরগোশ (শশারু), বাজ (সাঁচান/সয়চান), শিকার (আখেট), নালিশ (গোহারি), বিদায় (মেলানি), জাহাজ (বুহিত), হাজার (দশ শ) ইত্যাদি।
২)দস্তখত জরিমানা, জেরা, অছিয়তনামা, তামাদি, দারোগা, নালিশ, ফয়সালা, ফরিয়াদ, রায়, সালিশ, পারওয়ানে, ফরমান, মুনশি, ওকালতনামা, পেশকার ইত্যাদি।
৩) জমিদার, তখত, তহশিলদার, তালুক, তালুকদার, নবাব, বাদশা, বেগম, বাহাদুর, কামান, তীর, তোপ, ফৌজ ইত্যাদি।
৪) কাগজ, কেচ্ছা, পীর, বুজুর্গ ইত্যাদি।
৫) আতর, আয়না, গোলাপ, গুলদানি, চশমা, দালান, মখমল, ফারাশ ইত্যাদি।
৫)পা, সিনা, গরদান, পাঞ্জা,চশমা।
৬) আচকান, জোববা, চাদর, পর্দা, শালওয়ার, পিরাহান, কামারবান্দ ইত্যাদি।
৭) বিরিয়ানি, গোশত, হালুয়া, কাবাব, কিমা, মোরববা, সব্জি, আনার, কিশমিশ, পেস্তা, বাদাম ইত্যাদি।
৮) হিন্দু, ফিরিঙ্গি ইত্যাদি।
৯) কারিগর, খানসামা, খিদমাতগার, চাকর, দোকানদার, বাজিকর, জাদুকর ইত্যাদি।
১০) বাবা, মা, দাদা, খালা, দামাদ, কানীজ, দোস্ত, ইয়ার ইত্যাদি।
১১) সরাইখানা, মোসাফেরখানা, ইয়াতীমখানা, কারখানা, বালাখানা, আসমান, যমীন, বাজার ইত্যাদি।
১২) খরগোশ, বুলবুল, কবুতর, বাজ, তোতা, হাইওয়ান, জানোয়ার ইত্যাদি।
১৩) আওয়াজ, আবহাওয়া, আতশ, আফসোস, কম, কোমর, গরম, নরম, পেশা, সফেদ, হুশিয়ার, হরদম, সেতার ইত্যাদি।
ফারসি ভাষা বাংলা ব্যাকরণকেও প্রভাবিত করেছে। যেমন ফারসি 'মাদী' ও 'মর্দা' (মার্দ) শব্দের প্রয়োগে লিঙ্গ নির্ধারিত হয়: মর্দা-কবুতর, মাদী-কবুতর; মর্দা-কুকুর, মাদী-কুকুর ইত্যাদি। অপরদিকে ফারসি 'মোর্গ' শব্দটি মোরগ ও মুরগি ।
ফারসি তদ্ধিত প্রত্যয় ও উপসর্গের মাধ্যমে অনেক বাংলা শব্দ গঠিত হয়েছে; আবার অনেক ফারসি শব্দ মূল অর্থসহ বাংলায় ব্যবহূত হচ্ছে; তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে ফারসি আ বা া-চিহ্ন বাংলায় লোপ পেয়েছে; যেমন: কামার কমর; গারম গরম; নারম নরম ইত্যাদি। আবার অনেক বাংলা শব্দ ফারসি তদ্ধিত প্রত্যয় ও উপসর্গের সঙ্গে একাত্ম হয়ে একটি স্বতন্ত্র অর্থ ও ভাববিশিষ্টি শব্দ তৈরি করেছে, যেমন: কেরানিগিরি, বাবুগিরি, দর-পত্তর, বে-গতিক ইত্যাদি।
আজ এই ভাষা দিবসে প্রত্যেক বাঙালী নিজের ইতিহাস নিয়ে ভাবুক। কিভাবে ধর্ম পরিবর্তন হয়েছে, নানা ভাষার সম্মিলনে ভাষা পরিবর্তন হয়েছে, কিভাবে বাঙালী উদারতা অর্জন করেছে।
এই লেখা শুরু করেছিলাম যে কথা দিয়ে সেখানে ফিরে যাই- কোন গোষ্ঠীকে যদি ধর্ম দিয়ে ব্যাখা করার চেষ্টা করা হয়, তার সব সামাজিক সত্ত্বার গায়ে যদি ধর্মের আলখাল্ল পরিয়ে ব্রাত্য করে রাখা হয় তাহলে বৃথা আমাদের বাঙালীত্ব।
বর্তমানে উগ্র ওয়াহাবী চিন্তা-চেতনা ১৮৪০-৭৮ কে মনে করিয়ে দেয়, উগ্র হিন্দুত্ব শশাঙ্কের যুগ মনে করিয়ে দেয়। এই দুই উগ্রতার বিরুদ্ধে বাঁচতে হলে বাঙালীত্বকেই হাতিয়ার করতে হবে। বাঙালী মানে উদারতা, বাঙালী মানে সংস্কৃতির পীঠস্থান, বাঙালী মানে কফি হাউসের আড্ডা, বইমেলা-সংস্কৃতিমেলা, বৈশাখে নববর্ষ উৎসব, বসন্ত উৎসব, দোল, রাখি বন্ধন, ইলিশ উৎসব, রবিবার দুপুরে খাসির মাংস, ফুচকা, ঝালমুড়ি, বাঙালী মানে ঘনাদা-ফেলুদা-টেনিদা-বাঁটুলদা-কেল্টুদা-হাঁদা-ভোদা। আরো কতকি সে লিষ্টির শেষ নেই। মিষ্টিরও শেষ নেই। পৃথিবীতে মিষ্টি দই একমাত্র আমরাই খাই। সাত দশ খানা বাটি সাজিয়ে গাদা গুচ্ছের তরকারি দিয়ে ভাত আমরা ছাড়া আর কেউ খায় না। সুক্তো কেউ খেতে জানে? ফিস্টির নাম কেন পৌষালো কেউ জানে? (বাঙালীর আবেগ ঝরে পড়ে ফিদেলে, চে তে। মাও সে তুং, লিন পিয়াও, মার্কস-এঙ্গেলস- লেনিন- বিপ্লব স্পন্দিত বুকে আমিই লেনিন! এটুকু না বললে বাঙালীর বোঝা যাবে না।)
স্বাধীনতার আগে বিশ্বের জিডিপির ২০ শতাংশ আমাদের ছিল। আবার আমরা জগৎ সভায় আসন নিতে চাই। তার জন্য দরকার জনগনমন ঐক্য, চাই শয়নে স্বপনে বাঙালী হয়ে ওঠার সাধনা।

শুক্রবার, ১৭ ফেব্রুয়ারী, ২০২৩

স্মৃতি বিস্মৃতি ও মৃত্যু ~ শৈবাল বিষ্ণু

বিষাণ বসুর ফ্যান ক্লাবের সদস্য সে বহুযুগ হলো! বিয়ের আগেই হবু স্ত্রীএর কাছে প্রচুর সুখ্যাতি আর সুনাম শুনেছি। আমার বৌ যেহেতু সে ফ্যান ক্লাবের সদস্য, তাই আমিও তাই। কিন্তু সে তো শুধু শুনে শুনেই। ভাগ্যিস ফেবু এলো, আলাপ হলো, লেখা পড়লাম। দেখলাম, নাহ এই লোকটা বেশ চিন্তাশীল প্রবন্ধ লেখে তো, কালচার করতে হচ্ছে মশাই! গুণমুগ্ধ পাঠক হিসেবে ওর লেখা পত্তর পড়ি, চিন্তার খোরাক পাই। এই পর্যন্ত বেশ চলছিল। হঠাৎ করে একটা নীল বই হাতে এসে গেলো। মানে বইটার মলাট নীল রঙের। শুরু তো করে ফেললাম, কিন্তু এগোতেই পারছিনা। ওদিকে লেখক বারবার জিগায় পড়লাম কি? ভালো লাগলো না খারাপ। আবার নাম করা সাহিত্যিকরা বইটা পড়ে ফেলে উচ্ছসিত প্রশংসা করে ফেলছে। আমি এগোতে পারছিনা।

বইটা আসলে মৃত্যু নিয়ে। সহজ পাচ্য? নাহ! গল্পের বইও নয় যে এক ভাবে টেনে নিয়ে যাবে। সমস্যাটা দাঁড়িয়ে গেলো, যত পড়ি, তত মিল পাই। প্রতি পাতায় এমন কিছু কথা পাই, যেগুলো আমার মনের কথা, যেগুলো আমার জীবনের কথা। যে কথা গুলো বলা হয়নি, ঠিক সেই কথা গুলোই। আর তত দেরী হয়। মিলগুলোর জন্যেই দেরী হয়।
না আমার বাবা বুদ্ধিজীবি ছিলোনা, মা যদিও ইস্কুলে পড়াতো। দুর্গাপুর কারখানার শহর, শ্রমিকদের বসবাস। শ্রমিকদের মধ্যেই বেড়ে ওঠা। তারাই আমার বাবা, কাকা, কাকু, জেঠু, মামু, মাসী, পিসী, কাকিমারা। পাড়ার, ওপাড়ার, বাবার অফিসের, বাবার পার্টির। পার্টির গোষ্ঠী ও গোষ্ঠী দ্বন্দ্বের গল্প গুলোও তো এক। এগোই কি করে হুড়হড়িয়ে। সম্ভব নাকি? আমার বাবা আবার নীরব কর্মী থাকতে পছন্দ করতো, স্টেজে উঠে বক্তব্য রাখার ধরে কাছ দিয়েও যেত না। কিন্তু জীবনানন্দ পাঠে নিবীড় মনোযোগ ছিলো, সেই তাঁবুতে থাকার জীবন থেকেই, যখন ডিভিসি, যখন প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা, ড্যাম তৈরী হচ্ছে, ক্যানেল তৈরী হচ্ছে, বাবারা সুইস কটেজে থেকে সার্ভে করছে। সারাদিনের পরে জীবনানন্দ আর সঞ্চয়িতা টুকুই সম্বল, সভ্যতার সাথে যোগাযোগ। আর দুদিনের পুরোনো ডাকে আসা অমৃতবাজার পত্রিকা।
প্রতি পাতায় এমন কিছু প্রশ্ন, এমন কিছু স্মৃতি, এমন কিছু চিন্তা, এমন কিছু ঘটনা পড়ছি, যে মনে হচ্ছে এ তো আমারও গল্প। বাবার যে বছর আশি হলো, সব দাঁত তুলে দিয়ে বাঁধিয়ে দিলো আমার বৌ। বাবার খুশী আর ধরে না। কোনোমতেই কাছ ছাড়া হতে দিত না সেই বাঁধানো দাঁত দুপাটি। সব দাঁত বাঁধানো হয়ে যাওয়া মাত্রেই বায়না ধরলো দুর্গাপুর যাবে, যাবেই। আর ভালো লাগছেনা। আমার বৌকে বললো আশি তো হয়ে গেলো, অনেকদিন হয়ে গেলো পৃথিবীতে, আর কি হবে বেঁচে থেকে। মনে মনে মৃত্যুর জন্যে প্রস্তুতি কি হচ্ছিলো তখন থেকেই? বুঝিনি। বায়না করে দুর্গাপুরে গিয়ে দিন দশেকের মধ্যে হাঁটতে গিয়ে পড়ে গিয়ে ঠিক সেই ফ্রাকচার নেক অফ দা ফিমার, আরও সাত দিনের মধ্যে চুল্লী তে চললো বাবা, সাথে সেই দুপাটি বাঁধানো দাঁত। রোজই মনে হয়, কত কত কথা বাকি রয়ে গেলো। কত কি জিজ্ঞেস করা হয়নি। কত গল্প ভালো করে শোনা হয়নি। কত প্রশ্ন করা হয়নি। বিষাণ লিখেছে অপেক্ষা করে। সেই ২০০৭ থেকে অপেক্ষা করছি, বৃথাই অপেক্ষা। আর হ্যাঁ আমিও তো স্টেডি ছিলাম। কাঁদিনি, প্রলাপ বকিনি , এমনকি প্রকাশ্যে দুঃখপ্রকাশ ও করিনি। বিরিভমেন্টের প্রক্রিয়া নিয়ে লিখেছে বিষাণ, ও পড়াশোনার মধ্যে দিয়ে বোঝার চেষ্টা করেছে। বিষাণের এই বই যদি ২০০৭ এ হাতে পেতাম, কিছু সুবিধে হতো? মনে হয় হতো।
বিষাণ বলেছিলো ওর লেখা বই নিয়ে লিখতে। আর আমি আমার কথা, আমার বাবার কথা লিখে চলেছি। আসলে হয়তো এটাই এই বইয়ের মূল সার্থকতা। মনের কোনো কোণে বাবাকে নিয়ে যে চিন্তাভাবনা গুলো কাউকে বলিনি, কোথাও লিখিনি, সেগুলো বেরিয়ে এলো অজান্তেই । বিষাণ প্রতিটা অধ্যায়ে একটা নতুন দিক নিয়ে ভেবেছে, এবং সব থেকে বড় ব্যাপার একজন পেশেন্ট পার্টি হিসেবে ভেবেছে, দেখেছে, দেখিয়েছে। এটাও কম পাওয়া নয়। মাঝে মাঝে মনে হয় এই যে এতো দৌড়চ্ছি , কেন দৌড়োচ্ছি? যা কিছু দৌড়াদৌড়ি, যা কিছু সঞ্চয় সে কি শুধুই জীবনের শেষের কয়েক ঘন্টা এসি ঘরে, পাঁচ তারা হাসপাতালে চারিপাশে বিপ বিপ শব্দের মধ্যে একটা বেড নাম্বার হয়ে অস্তিত্বহীন, একটা স্টেরাইল, যান্ত্রিক মৃত্যুর জন্যে? জাস্ট কোনো মানে হয়? বিষাণ প্রশ্নটা রেখেছে। আমার মতো এলোমেলো ভাবে নয়, বিশ্লেষণাত্মক ভাবে রেখেছে। তাই বইটা শুধুই যে মৃত্যু নিয়ে তা একেবারেই নয়, বিষাণ বসুর "টুকরো স্মৃতি... ছেঁড়া শোক" প্রকৃত প্রস্তাবে জীবন নিয়েই। যাপন নিয়েই।

তুলসীদাস বলরাম ~ অর্ক ভাদুড়ী

ব্যস্ততার মধ্যে থাকলে বোধহয় দূরবর্তী শোকের অভিঘাত কমে যায়। শোক তো সেয়ানা৷ সে অপেক্ষা করে। নির্জনে কামড়ে ধরবে বলে চুপ করে থাকে। শিকারীর মতো।

তুলসীদাস বলরামের মৃত্যুর খবর পেলাম একটা চা বাগানে বসে। চারদিকে সবুজ আর সবুজ৷ ছোট্ট তিরতিরে নদী। শীতকালে তাকে নদী বলে চেনাই যায় না। নদীর ধারে একটা সরস্বতীর মূর্তি৷ চা বাগানের নির্জনতায় একলা সরস্বতী অপেক্ষা করছেন। নদীতে জল বাড়ুক। সবশুদ্ধ ভাসিয়ে নিয়ে যাবে৷ ততদিন অপেক্ষা।

বলরামও তো থাকতেন নদীর ধারেই। একাকী। ভিড় থেকে দূরে। কোলাহল থেকে দূরে। তাঁর বুকের মধ্যে অভিমান জমতে জমতে পাথর হতে পারত। হয়নি৷ আগ্নেয়গিরি হয়ে ছিল। পরিত্যক্ত, বৃদ্ধ আগ্নেয়গিরি। শেষ কয়েকটা দশক যার অগ্নুৎপাতও ঢেকে যেত বিষন্নতার স্যাঁতস্যাঁতে চাদরে।

মাঝে মাঝে ঝাঁকুনি দেওয়ার চেষ্টা করছিলাম নিজেকে। বলরাম মারা গেলেন! তুলসীদাস বলরাম! যে জার্সি আমার সর্বনাশ ও সর্বস্ব, তার শ্রেষ্ঠ সাধকদের একজন। আমেদ খান ছাড়া তাঁর তুলনা আর কে! যে অবহেলা তিনি পেলেন দশকের পর দশক, যে অভিমান আর অপমানের পাহাড় তাঁকে বইতে হল শেষদিন পর্যন্ত, যে দুষ্টচক্র তাঁকে ঠেলে দিল ছোট্ট ফ্ল্যাটের জেলখানায়, তার ক্ষমা নেই, তার ক্ষমা নেই।

বলরামের প্রতিটি উচ্চারণ যে নির্জন ক্রোধের পবিত্র আগুন জ্বেলে রাখত, সেই অপাপবিদ্ধ অগ্নিই হবে আগামীর মশালের প্রাণ। হয়তো আজ নয়। হয়তো দেরি হবে৷ কিন্তু বলরাম ব্যর্থ হবেন না।

যারা পূর্বজদের থেকে হাঁটার গল্প শুনতে শুনতে বড় হয়েছি, যারা অসংগঠিত সমর্থক মাত্র, ভালোবাসা ছাড়া যাদের এখনও পর্যন্ত আর কোনও অস্ত্র নেই, তাদের বুকের মধ্যে বেঁচে থাকবেন তুলসীদাস বলরাম।

যারা শুনেছি নাটোর থেকে হলদিবাড়ি হাঁটার গল্প, যারা শুনেছি হাঁটতে হাঁটতে পিছনে তাকানো, আগুন আর ধোঁয়ার মধ্যে পুড়ে যাওয়া ঘর যারা শুনেছি হলদিবাড়ি থেকে কলকাতায় আসা, কুকুরবিড়ালের মতো বেঁচে থাকা, যারা শুনেছি ট্রেনের মাথায় মাথায় ভিড়, আঠার গায়ে মাছির মতো ট্রেনের গায়ে জাপটে থাকা মানুষ আর মানুষ যারা শুনেছি ইউসিআরসি, শুনেছি ফুটপাথ থেকে কলোনিপাড়ার হোগলাচালের ঘর, যারা শুনেছি লাল আর লাল-হলুদে বেঁচে নেওয়া প্রজন্মের মহাকাব্য যারা শুনেছি ভাঙা বাংলার প্রতিটি কলোনির সদ্যোজাত কুয়ো আর ইস্কুলের দেওয়ালে কেমন করে আল্পনা এঁকে দিতেন আপনার পূর্বসূরি আমেদ খান, সহস্র যন্ত্রণাকে রাধাচূড়া-কৃষ্ণচূড়ায় রাঙিয়ে দিতেন পঞ্চপাণ্ডব, তাঁদের মধ্যে আপনি বেঁচে থাকবেন, তুলসীদাস বলরাম যারা কখনও ভুলব না কেমন করে টলমলে উদ্বাস্তু কলোনিকে কাঁচা বাঁশের শক্ত ভিতে দাঁড় করাতেন সেকেন্দ্রবাদের যুবক, তাদের বুকের ভিতরে আপনি বেঁচে থাকবেন, তুলসীদাস বলরাম।

আপনার অপমানের বদলা তারা নেবে। আজ না হোক কাল।

বুধবার, ১৫ ফেব্রুয়ারী, ২০২৩

হেরো, ক্লডিয়াস তুমি হেরো ~ মৌমিতা তারণ

সময়টা তখন তৃতীয় শতক। আমার প্রিয় শহর রোম শাসিত হচ্ছে সম্রাট ক্লডিয়াসের খেয়ালখুশিতে। শহরবাসী মোটেই খুশি নয় তাদের স্বৈরাচারী সম্রাটের উপর। আর দশজনের মতো আমিও ক্লডিয়াসকে পছন্দ করতাম না। কেন করতাম না সেকথা আজ তোমাদের শোনাব। তার আগে নিজের পরিচয়টা দিয়ে নিই। 

আমি সেন্ট ভ্যালেন্টাইন। হ্যাঁ সেই ভ্যালেন্টাইন যার নামে গোটা একটি দিন বিশ্ব সংসার প্রেমদিবস পালন করে। ১৪ ফেব্রুয়ারি ---ভ্যালেন্টাইন'স ডে। চার্চের একজন পুরোহিত হিসেবে আমার সবথেকে প্রিয় কাজ ছিল দুটি প্রেমিক মানুষকে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ করা। দুটি হৃদয়ের মিলন ঘটানো। বলা ভাল মানুষকে প্রেমিক করে তোলাই আমার মূলমন্ত্র। আমৃত্যু আমি আমার এই মূলমন্ত্র আঁকড়ে থেকেছি। এর ফলে ওরা আমায় পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিয়েছে। ভ্যালেন্টাইনকে সরালেও পৃথিবীকে ওরা প্রেমহীন করতে পারেনি। আজও 'প্রেমের ফাঁদ পাতা ভূবনে, কে কোথা ধরা পড়ে কে জানে...।' এই রে ! রবি ঠাকুরের বলা কথা আমি তোমাদের শোনাচ্ছি। কোনও মানে হয় ! অবশ্য শোনাব নাই বা কেন ? রবি তো শুধু তোমাদের কবি নন। বিশ্ব তাঁকে স্বীকৃতি দিয়েছে। তিনি বিশ্বকবি। এই রবির কল্পনাই তো একদিন লিখেছিল, 'প্রেমের জোয়ারে, ভাসাব দোহারে....।' আমি জানি সারা পৃথিবী এমনই প্রেমের জোয়ারে ভাসতে চায়। আমার মৃত্যুদিনটি প্রেমের দিন হিসেবে চিহ্নিত হওয়ায় আরও একবার প্রমাণিত হল প্রেম চিরন্তন। তাকে নি:শেষ করার মতো শক্তি এখনও জন্মায় নি। তবে প্রেমের উপর আঘাত এসেছে বারে বারে। সম্রাট ক্লডিয়াস এমনই এক আঘাতকারী। 

নিজের সেনাবাহিনীকে আরও শক্তিশালী করে গড়ে তোলার জন্য ক্লডিয়াস সমাজে বিবাহ নিষিদ্ধ করলেন। তাঁর মনে হয়েছিল বিবাহিত পুরুষ পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এসে সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে চায় না। সম্রাটের এহেন নিষেধাজ্ঞা যুবসমাজের কাছে অমানবিক ঠেকে। ওই হঠকারী নির্দেশে আমিও হতবাক হয়ে পড়ি। পরস্পরের হাত ধরে প্রেমের জোয়ারে ভাসতে চাওয়া মুখগুলো মনে করে আমি কষ্ট পাই । পারলাম না, কিছুতেই পারলাম না ক্লডিয়াসের এই খামখেয়ালিপনা মেনে নিতে। বেশ বুঝতে পারছিলাম এভাবে চলতে দেওয়া ঠিক হচ্ছে না। প্রতিবাদ করা দরকার। এবং তা এখনই। কিন্তু সম্রাটের ক্ষমতার সামনে চার্চের এক পুরোহিতের ক্ষমতা আর কতটুকু ? তাই হাতিয়ার করলাম সেই প্রেমকেই। প্রেম দিয়েই প্রেম বাঁচিয়ে রাখতে চাইলাম। আবার শুরু করলাম দুই প্রেমিককে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ করার মতো পবিত্র কাজ। তবে এবার খুব গোপনে, খুব সন্তর্পণে। ভাবতে পারো চার্চের ভেতর গোপন এক জায়গায় শুধুমাত্র একটি মোমের আলো। তার সামনে বর, কনে আর আমি। আমি ফিসফিস করে বিবাহমন্ত্র আওড়াচ্ছি। আমার সঙ্গে সঙ্গে দু'জোড়া ঠোঁট সেইমতো ফিসফিস করছে। আমি কেবল ওদের ঠোঁট নড়া আন্দাজ করতে পারছি। আমার দুই কান সজাগ। এই বুঝি শোনা যাবে সম্রাটের সেনাদলের বুটের আওয়াজ। সে এক উত্তেজনাময় পরিবেশ। ভয় আর ভালবাসার মিশেল যেন। তবে বেশিদিন পারা গেল না এভাবে। সত্যিই একদিন চার্চের মেঝে কেঁপে উঠল ক্লডিয়াস সেনার পদধ্বনিতে। সেদিনও ছিল এমন এক বিয়ের দিন। অবশ্য ভগবান সহায় ছিলেনন। ছেলেমেয়ে দুটো ঠিক সময়ে পালিয়ে যেতে পেরেছিল। সেনারা কেবল আমায় পেল এবং নিয়ে গেল আমায় জেলকুঠুরিতে। শাস্তি ঘোষণা করল ক্লডিয়াস --- মৃত্যুদণ্ড। কী ভাবছ ? আমি হেরে গেলাম ? উঁহু, একেবারেই না। প্রেমের পূজারী ভ্যালেন্টাইনরা কখনও হেরে যায় না।

সেই অন্ধকার জেলকুঠুরিতে আমার কাছে প্রেমের আলো বয়ে নিয়ে এল শহরের অজস্র তরুণ - তরুণীর পাঠানো ফুল, ভালবাসার চিরকূট এবং' সে '। আমাকে পাহারা দিত যে রক্ষীটি সম্ভবত সেও ছিল এক তুখোড় প্রেমিক। নয়তো আমার সঙ্গে গল্প করার জন্য নিজের মেয়েকে সে অনুমতি দেবে কেন !! মেয়েটি প্রতিদিন আমার কাছে আসতো। বসতো আমার পাশটিতে। আমরা গল্প করতাম। ঘড়ির কাঁটায় খেয়াল রাখিনি কখনও। মনে হত, গল্প তো এখনও শুরুই হল না। এইমাত্র তো এল আমার প্রিয়া। হ্যাঁ ও ছিল আমার প্রিয়া। ওর হাসি, ওর কথা, ওর চাউনি আমার উদ্যম নষ্ট হতে দেয় নি। ক্লডিয়াসকে অস্বীকার করে যে আমি ভুল করি নি সেকথা বারে বারেই ও মনে করিয়ে দিত।

শেষ পর্যন্ত ১৪ ফেব্রুয়ারি ২৬৯ এ. ডি. দিনটির মুখোমুখি হলাম। আর কিছুক্ষণ পর ক্লডিয়াসের সেনা আসবে। পালন করবে তারা সম্রাটের নির্দেশ। কার্যকর হবে আমার মৃত্যুদণ্ড। প্রিয়ার সঙ্গে আজ আর দেখা হওয়ার কোন উপায় নেই। কিন্তু ওকে না জানিয়ে আমি যাই ই বা কি করে ! এদিক ওদিক খুঁজলাম। এক টুকরো কাগজও কোথাও নেই যার উপর আমি ওর জন্য কিছু লিখে যেতে পারি। অগত্যা ওর রেখে যাওয়া কালকের চিরকূটটা হাতে তুলে নিলাম। এই টুকরো কাগজে গতকাল ও আমার জন্য একমুঠো ভালবাসা লিখে এনেছিল। সেই ভালবাসার অপর পিঠে ওর জন্য আমার ভালবাসার প্রতিধ্বনি রাখলাম আমি। লিখলাম, "লাভ, ফ্রম ইয়োর ভ্যালেন্টাইন।"

আমাদের পরস্পরের ভালবাসা বিনিময়ের এই স্টাইল সেদিনের পর থেকে পৃথিবীর সব প্রেমিক প্রেমিকা রপ্ত করল। জানি ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ তেও এর ব্যতিক্রম ঘটবে না। কাগজ কলম হয়ত সেভাবে আর আঙুলের স্পর্শ পাবে না। কিন্তু মোবাইল কিপ্যাড বা স্ক্রিন টাচ করতে আঙুল কসুর করবে না। ১৪ ফেব্রুয়ারি দিনটি আমার মৃত্যুদিন হিসেবে কোনও প্রেমিক মনে রাখে নি। তাদের কাছে ১৪ ফেব্রুয়ারি মানে ভ্যালেন্টাইন'স ডে। আর ভ্যালেন্টাইন মানেই প্রেম, প্রেম এবং প্রেম। পৃথিবীর তাবৎ প্রেমিকের কাছে এক্কেবারে হেরে ভূত সম্রাট ক্লডিয়াস। তবে আর চুপ কেন ? এস সবাই মিলে আমরা ক্লডিয়াসকে দুয়ো দিই --
" হেরো, ক্লডিয়াস তুমি হেরো "।