বুধবার, ১৩ জুলাই, ২০১৬

কাশ্মীর ~ অনিমেষ বৈদ্য

কাশ্মীর নিয়ে কথা বললেই অবধারিত ভাবে যেটা আসবে তা হলো কাশ্মীরি পণ্ডিতদের কথা। নিজের জন্মভূমি থেকে উৎখাত হওয়ার যন্ত্রণা অপরিসীম। তা অস্বীকার করার কোনও প্রশ্নই নেই। আগে একাধিক বার সেই যন্ত্রণাকে ছোঁয়ার চেষ্টাও করেছি শব্দে। কিন্তু যেটা অবাক লাগে তা হলো কাশ্মীর ইস্যু এলেই শুধুমাত্র কাশ্মীরি পণ্ডিতের কথা তুলে ধরা হয়। প্রতিদিন এতো এতো ইভেন্টের রিকোয়েস্ট আসে কিন্তু আজ পর্যন্ত একটা ইভেন্টের রিকোয়েস্টও পেলাম না যেখানে কাশ্মীরি পণ্ডিতদের এই উৎখাত হওয়ার যন্ত্রণা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। কেউ এসে বলেছে তার নিজের অভিজ্ঞতার কথা। এমন ইভেন্ট হলে আমন্ত্রণ পেতে ইচ্ছুক। আন্তরিক ভাবেই শুনতে যাবো। কিন্তু কাশ্মীরে মানুষ মরলেই শুধু কাশ্মীরি পণ্ডিতদের রেফারেন্স টানা দেখতে দেখতে ক্লান্ত। ওই সিপিএম মেরেছে তাই তৃণমূলের মারকে ন্যায্যতা দেওয়া টাইপ।

কাশ্মীরের মৃত্যু নিয়ে কথা বললেই জঙ্গি সমর্থক। এবং যারা বলছে তাদের অনেকের আবার বিজেপির উপরে অগাধ আস্থা। আবার বিজেপির সঙ্গে সেখানে জোট পিডিপি-র, যারা আফজাল গুরুকে শহীদ মানে। কিন্তু এই জঙ্গি-বিরোধীদের কাছে আবার আফজাল গুরু জঙ্গি। সত্যি! সব হিসেব গুলিয়ে যায়। ঘেঁটে যাই। অবশ্য ঘেঁটে থাকা লোক আবার নতুন করে কী ঘেঁটে যাবে!!!

সরকারি ভাবেই ২০০৯ সালের জুলাই মাস পর্যন্ত কাশ্মীরে হিংসার বলি হয়েছে প্রায় ৪৭ হাজার মানুষ (৭ হাজার সেনা সহ)। নিখোঁজ ৩ হাজার চারশো লোক। নাহ! আমার বলা কথা নয়। সরকারি হিসেব। এই নিখোঁজ, মৃত প্রতিটি কাশ্মীরিই জঙ্গি!! এদের মধ্যে একজনও নেই যে শুধু তার স্বাধীনতার দাবি জানাতেই মিছিলে গিয়ে খুন হয়েছে!!

বিধবা শব্দটির মানে কী তা জানি আমরা সবাই। তাদের দুঃখ, দুর্দশা নিয়ে হাজার আলোচনা হয়েছে। কিন্তু 'আধা বিধবা' শব্দটি শুনেছেন কি? নাহ! আমিও শুনিনি কিংবা জানতাম না আগে। জেনেছিলাম হায়দার সিনেমাটা দেখেই। কাশ্মীরে পুলিশ-সেনা যে সব বিবাহিত পুরুষদের তুলে নিয়ে যায় তাদের স্ত্রীরা 'আধা বিধবা'। কারণ তারা অনেকেই জানতে পারেন না যে তাদের স্বামী আদৌ বেঁচে আছে কি না।

বাসে ভাড়া দেওয়ার পরেও কন্ডাক্টর টিকিট দেখতে চাইলে আমাদের সে কি তুমুল বিরক্তি। কিন্তু কাশ্মীরে প্রতি মুহূর্তে আপনাকে আপনার পরিচয়পত্র দেখাতে হবে। না দেখালে কি পরিণাম হবে তা অনুমান করা যায়। একজন লোক তার বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন, কিন্তু ভিতরে ঢুকছেন না। একজন যেই হুকুমের সুরে পরিচয়পত্র দেখতে চাইলেন ওমনি তিনি 'স্বাভাবিক' হলেন এবং তারপর বাড়ির গেট পেরিয়ে ভিতরে ঢুকলেন। নাহ! আমার কথা নয়। হায়দার সিনেমাটা দেখলেই দেখতে পাবেন। মনে রাখবেন সে সিনেমা ভারত সরকারের অনুমতিপ্রাপ্ত।

জঙ্গিদের সমর্থন করতে হবে না। কিন্তু এই ঘটনাগুলো নিয়েও ভাবা যাবে না তাই বলে!!! এই মানুষদের কথা তুললেও শুনতে হবে ভারত-বিরোধী, জঙ্গি সমর্থক!! আমি নিজে কাশ্মীরি হলে আজাদি চাইতাম কি চাইতাম না জানি না, কিন্তু এই অন্তহীন মৃত্যু মিছিল নিয়ে এই দূরে বসেও একটুও ভাবিত হবো না!!! যদি দেশের কথাও ভাবি তাহলেও তো কাশ্মীরিরা এই মুহূর্ত পর্যন্ত ভারতীয়ই বটে। একজন ভারতীয় হয়ে অন্য ভারতবাসীর মৃত্যু মিছিল নিয়ে চিন্তিত হবে না আমাদের ভারতীয় আবেগ!!! তাই নিয়ে কথা বললেও শুনতে হবে জঙ্গিবাদের সমর্থক!!!

এর থেকে সোজাসুজি বলুন। কাশ্মীরি মাত্রই জঙ্গি, এতোদিনের প্রতিটি মৃত্যুই জঙ্গির মৃত্যু, আর সেই মৃত্যুতে আপনার এক বিন্দুও দুঃখ নেই, সেই মানুযদের নিয়ে আপনার মানবিকতা এক বিন্দুও বরাদ্দ নেই, তারা প্রত্যেকে খুন হওয়ার যোগ্য, এবং আপনি এদের খুন দেখতে চান। এতে অন্তত আপনার বিরোধিতা করলেও আপনার সততার প্রতি শ্রদ্ধা থাকবে।

মঙ্গলবার, ১২ জুলাই, ২০১৬

আকালের সন্ধানে ~ সুশোভন পাত্র

হোয়াটস অ্যাপ গ্রুপ গুলোর ম্যাসেজ ডিলিট করতে করতে সেদিন হঠাৎ করেই একটা ম্যাসেজে চোখ আটকে গেল। অবশ্য বলা ভালো, ভাগ্যিস আটকে গেল! মহারাষ্ট্রের এক ভদ্রলোক, এই ৪৮ডিগ্রিতে, আহমেদনগর থেকে নানদেদ ট্রেন যাত্রার অভিজ্ঞতা লিখেছেন।
বাইরের তীব্র দাবদাহ আর জানলার শুষ্ক, গরম বাতাসের জন্যই সেদিন বোধহয় ৯ ঘণ্টার ট্রেন জার্নিতে স্লিপারটা বেশ ফাঁকাই ছিল । যত্নের অভাবে কম্পার্টমেন্টের একমাত্র মোবাইল চার্জিং পয়েন্টটা খারাপ। আর চাহিদার অভাবে ট্রেনের একমাত্র প্যান্ট্রি কার'টাও বন্ধ। তাই তৃষ্ণা মেটাতে সম্বল হাফ বোতলের গরম জলের কয়েকটা ফোঁটা। আর সময় কাটাতে ভরসা ব্যাগে গোঁজা মারাঠি একটা খবরের কাগজ। দুদিকের জানলায় দিগন্ত বিস্তৃত শুকিয়ে কাঠ বিঘা বিঘা ক্ষেতের সাথে বেশ সামঞ্জস্য রেখেছে সংবাদ শিরোনামটা। "দেশের প্রতি ১০টা আত্মহত্যার ৭ জনই কৃষক"। গত পাঁচ বছরে ভয়ঙ্কর খরা কবলিত এই মহারাষ্ট্রের মারাঠওয়াড়া আর বিদর্ভের কৃষকদের দুর্দশার কথা ভাবতে ভাবতেই ট্রেনটা ঝাঁকুনি দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। জানলার বাইরে তাকাতেই চোখে পড়ল একদল বৃদ্ধ-মহিলা-শিশু হাতে বালতি আর বোতল নিয়ে ট্রেনের দিকে ছুটে আসছে। ট্রেনে উঠেই ঐ দলের মহিলার প্রায় নি:সঙ্কোচেই ট্রেনের কম্পার্টমেন্টের টয়লেটে গিয়ে ট্যাপ খুলে বালতিতে জল ধরতে লাগলো। অন্যদিকে শিশুরা হামাগুড়ি দিয়ে সিটের নিচে আর বয়স্করা উঁকি মেরে আপার বার্থে যাত্রীদের উচ্ছিষ্ট জলের বোতলে অবশিষ্ট এক-দু ফোঁটা জলের খোঁজ শুরু করলো। সবকিছুই চোখের সামনে এত তাড়াতাড়ি আর নিখুঁত ভাবে ঘটছিল যেন সবকিছুই 'ভেরি ওয়েল প্ল্যান্ড'। এক বৃদ্ধের কোলে বাচ্চা একটা মেয়ে। এক সহযাত্রী মেয়েটির হাতে তাঁর জলের বোতলের অবশিষ্ট টুকু তুলে দিতেই, বৃদ্ধ করজোড়ে তাঁকে কৃতজ্ঞতা জানালেন। জলের বোতল পেয়ে যখন বাচ্চা মেয়েটার মুখে একগাল হাসির সোনা ঝরছে ঠিক তখনই সম্বিত ফিরল আহাম্মক রেল পুলিশটার বাঁশিতে। লোকগুলো সবাই ভয়ে হুটোপুটি করে ট্রেন থেকে ঝাঁপ মারল ঠিকই, কিন্তু নিপুণ কৌশলে, ভরা জলের একফোঁটাও কিন্তু মাটিতে পড়ল না। টি.টি.ই এসে রেল পুলিশটাকে ক্ষান্ত করে বললেন, "এটাই এখন ওদের ডেলি রুটিন। গ্রামের পুরুষরা আগের স্টেশনে গিয়ে ট্রেনে ওঠে। সময়, সুযোগ বুঝে চেন টেনে গাড়ি থামায়। ট্রেন থামলে এঁরা ট্রেনে উঠে এইভাবেই 'জল চুরি' করে। আর সেই জলেই কোনক্রমে আরও একদিন খরার সাথে লড়াই করে মরতে মরতে বেঁচে থাকে।"
পূর্ব মহারাষ্ট্রের লাতুর জেলায় প্রতিদিন প্রায় ৫ কোটি লিটার জল লাগে। কিন্তু জলের একমাত্র উৎস মানজার ড্যাম গত তিনমাস ধরে জলশূন্য। বিভিন্ন গাঁয়ের জমিদার আর সুদখোর মহাজনরা নিজেদের প্রয়োজনীয় জলটুকু বাঁচিয়ে কুয়ো গুলো চড়া দামে ভাড়া দিচ্ছেন প্রাইভেট কোম্পানিকে। নতুন লোগোর ঝাঁ চকচকে মোড়কে ১০০০ লিটার সেই জল বিক্রি হচ্ছে ১৫ টাকার বিনিময়ে। আসলে কারও সর্বনাশ হলে পরেই তো কারও পৌষ মাস হবে। তাই না? আর সুইজারল্যান্ডের মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি নেসলে'র সিইও পিটার বার্বেক শুধু মুখেই বলেছিলেন "জল মানুষের মৌলিক অধিকার নয়। তাই জলের বেসরকারিকরণ হওয়া উচিত।" আমাদের লাতুর কিন্তু করে দেখাচ্ছে। সত্যি তো,  "मेरा देश बदल रहा है…आगे बढ़ रहा है"   
অবশ্য সবাই যদি বিদর্ভের দলিত শ্রমিক বাপুরাও তাজনের হতেন তাহলে তো ল্যাঠা চুকেই যেতো। 'উচ্চবর্ণ'র দুয়ারে জল আনতে গিয়ে, অপমানিত, লাঞ্ছিত স্ত্রী'র চোখের জল মুছতে টানা ৪০ দিন, ৬ ঘণ্টার অক্লান্ত পরিশ্রমে তাজনে আস্ত একটা কুয়ো কেটেই তাঁর প্রেম প্রতিজ্ঞার তৃষ্ণা মিটিয়েছেন। দলিত ঘরের সব  বৌ'দেরও 'স্বামী ভাগ্য'ও আবার তাজনের মত নয়। আর তাই থমসন রয়টার্স ফাউন্ডেশন জানিয়েছে মহারাষ্ট্রের অনেক দলিত ঘরের বৌ'রা নাকি পানীয় জল জোগাড় করতে আজকাল বেশ্যা বৃত্তি'ও করছেন। 

এই মুহূর্তে খরা কবলিত দেশের ৩৩ কোটি মানুষ। অবশ্য এটা সেই সরকারী হিসেব যেটা কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বীরেন্দ্র চৌধুরী সংসদে পেশ করার সময় লোকসভা কক্ষে উপস্থিত ছিলেন ১০০'রও কম 'মাননীয়' সাংসদ। বেসরকারি হিসেব বলছে দেশে খরা কবলিত মানুষের সংখ্যা অন্তত ৫৪ কোটি। অর্থাৎ প্রতি ৫ জনে ২ জন। দেশের ৯১টি জলাধারের সঞ্চয় আজ এই দশকের সর্বনিম্ন, মাত্র ২৯%।  সুপ্রিম কোর্ট কেন্দ্রীয় সরকার কে জানিয়েছে "২০১৫-১৬ আর্থিক বছরে খরা কবলিত এলাকা সহ ১০০ দিনের কাজে বকেয়া মজুরি মোট ১২,০০০ কোটি টাকা। এটা কোন কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের নমুনা হতে পারে না।" সত্যি? পারে না? তবে যে শুনলাম শেষ ফিসক্যাল ইয়ারে দেশের আর্থিক বৃদ্ধির হার নাকি 'দুনিয়া কাঁপানো' ৭.৯%? তাহলে কি দেশের এই শ্রী-বৃদ্ধি তে বকেয়া মজুরির হিসেব হয় না? টয়লেটের জলে রান্না-বান্নার 'পুষ্টি গুনের' হিসেব হয় না? লাতুরের গ্রামের মহাজন'দের জল ব্যবসার চড়া সুদের হিসেব হয় না? বাপুরাও তাজনের 'কান্না ঘাম রক্তের' হিসেব হয় না? দলিত বৌ'দের শরীরের দামের হিসেব হয় না? শুধু কি তাহলে সরকারের ২ বছর পূর্তি অনুষ্ঠানে 'পানাম স্ক্যাম' খ্যাত বিগ বি'র ভাড়া, ১০০০ কোটির কসমেটিক বিজ্ঞাপন আর প্রধানমন্ত্রীর বিদেশ ভ্রমণেই দেশের জিডিপি'র পার ক্যাপিটা' তরতরিয়ে চড়কে চাপে?
বুন্দেলখন্ডের খরা কবলিত একটি প্রত্যন্ত গ্রামের গ্রামসভাতে, তৃষ্ণার্ত একটি গরুর মৃত্যু কাহিনীর বর্ণনা শেষে, ক্লাস ফোরের মেয়েটা চোস্ত হিন্দিতে বলল "और उसके बात बो तड़प, तड़प के मोर गई..." খোঁজখবর  নিয়ে দেখা গেল, সত্যিই,  বুন্দেলখন্ডের ১৩টি জেলার প্রায় ১১,০৬৫ গ্রামে, শুধু গত মে মাসেই, জলের অভাবে মৃত্যু হয়েছে যে ৩ লক্ষ গবাদি পশুর তার বেশির ভাগটাই গরু। কিন্তু দেখুন এই 'গো-হত্যা' নিয়ে সঙ্গীত সোম'দের কোন মাথা ব্যথা নেই। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর গলায় 'পিঙ্ক রিভলিউশেনের' হম্বিতম্বি নেই। এই গরুরা বোধহয় 'গোমাতা' নয়। এই গরুর মাংস খেতে বোধহয় কোন আপত্তি থাকবে না। এই 'গোমাতা' আখলাখ'দের ফ্রিজে থাকলেও তাঁদের বোধহয় মরতে হবে না। কারণ সব গোমাতা তো আর রাজনৈতিক পশু হয় না। সব 'গোমাতা' তো আর বিধানসভায় ভোট দেয় না...

বুধবার, ৬ জুলাই, ২০১৬

দেশ ও শিক্ষা ~ সুশোভন পাত্র

আপনি আমিষাশী? মাছ-মাংস-ডিম খান? তাহলে প্রোটিনের জরুরী খাদ্যগুণে শরীর পুষ্ট হওয়া তো দূর, আপনার মিথ্যে বলার, লোক ঠকানোর, যৌন সুড়সুড়ি দেবার এমনকি মানুষ খুন করার প্রবণতাও বেশী -বলছে ক্লাস সিক্সের সি.বি.এস.সি'র টেক্সট বুক। মহারাষ্ট্রের বছর ১৪'র ছেলেমেয়েরা পড়ছে, 'হাউসওয়াইফ'রা গাধার মত। সারাদিন শুধু খেটে মরে। তবে একটু হলেও ভালো। অভাব অভিযোগ করে না, রাগ করে বাপের বাড়িও যায় না। ছত্তিসগড়ের 'সোশ্যাল সায়েন্স'র ক্লাসে ছাত্রছাত্রীরা শিখছে, দেশের ক্রমবর্ধমান বেকারত্বের কারণ মেয়েদের চাকরি করা। দিননাথ বাত্রার বইয়ে গুজরাটের স্কুল পড়ুয়ারা শুনছে, ড: রাধাকৃষ্ণন বলেছিলেন, ভগবান অজ্ঞনতা বশত প্রথমে যে কাঁচা রুটিটা উনুন থেকে বের করেছিলেন, সেটা থেকে জন্ম হয়েছিলো ব্রিটিশ'দের। অতি সাবধানতায় পরের পুড়িয়ে ফেলাটা থেকে জন্ম নিগ্রোদের, আর সবশেষে যেটা ঠিক সময়ে উনুন থেকে বেরিয়ে স্বাদে-গন্ধে-বর্ণে হল অতুলনীয়, সেটা আমরা, মানে 'ইন্ডিয়ান'রা। রাজস্থানের স্কুলে 'মহান সাধু-ঋষির' তালিকায় স্বামী বিবেকানন্দ, মাদার টেরেসা, গৌতম বুদ্ধ, গুরু নানকের পাশে সচিত্র সুশোভিত হচ্ছেন নাবালিকা ধর্ষণে অভিযুক্ত আশারাম বাপু।  
তবে এসবই কেতাদুরস্ত ইংলিশ মিডিয়ামের, ঝাঁ-চকচকে স্কুল বিল্ডিং'র চার দেওয়ালের রঙিন গল্প। দেশের সরকারী শিক্ষা ব্যবস্থার হাঁড়ির হালটা ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট'ই। সর্বশেষ ASER'র রিপোর্টে দেশের ২১.৬% ক্লাস এইটের ছাত্রছাত্রী, ক্লাস টু'র টেক্সট বই'ই পড়তে পারে না। ১৫ বছরের ২৪.৫% স্কুলপড়ুয়ারা ১-১০ সংখ্যা চিনতে পারে না। ৫২.৫% ফাইভের ছাত্র সহজ ভাগের অঙ্ক কষতে পারে না। আর ৭৫.৫%, সামান্য বিয়োগ করতে পারে না।
ভারতবর্ষের প্রতিটি 'দায়িত্বশীল' সরকারই এই ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট ছবি বদলাতে দেশবাসী কে রঙিন স্বপ্ন দেখিয়েছে। কমিশন বসেছে। মিটিং হয়েছে। সার্ভে করেছে। ভাষণে লাল কেল্লার রঙ্গমঞ্চ উপচে পড়েছে। কোঠারি কমিশনের রিপোর্টের কাঠখড় পুড়িয়ে, স্বাধীন ভারতের পার্লামেন্টে, ১৯৬৮'তে প্রথম ন্যাশনাল ইডুকেশন পলিসি পাশ করিয়ে, ইন্দিরা গান্ধী যেবার ১৪ বছর পর্যন্ত সকলের প্রাথমিক শিক্ষা সুনিশ্চিত করার গুরুদায়িত্বটা রাষ্ট্রের কাঁধে তুলে নিলেন, সেবার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়েছিলো পাটলিপুত্র থেকে লোনাভেলা, মগধ থেকে ক্যাওড়াতলা। লোক মুখে প্রচার হল, জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে "শিক্ষা হবে সার্বজনীন"। তারপর গঙ্গা দিয়ে বহু জল বয়ে গিয়ে, সোভিয়েতের পতন আর লগ্নী পুঁজির দাম্পত্যর মধুচন্দ্রিমার গর্ভজাত মুক্তবাজার অর্থনীতির ইনফ্যাচুয়েশেনের লুস-মোশেনে যখন ভেসে যাচ্ছে তাবড় সংবাদ মাধ্যমের দিস্তা-দিস্তা নিউজ প্রিন্ট, ঠিক তখন, ১৯৮৬-৯২'এ আমদানি হল দ্বিতীয় ন্যাশনাল ইডুকেশন পলিসি। প্রান্তিক মানুষের কাছে শিক্ষা পৌঁছে দেওয়ার প্রকারান্তরে, বেসরকারি স্কুলে 'আর্থিক ভাবে দুর্বল' অংশের ২৫% সংরক্ষণের মাধ্যমে, শিক্ষা ক্ষেত্রে অভিষেক হল পি.পি.পি মডেলের। পরবর্তী সময় ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্কের চাপে আর 'লো-কস্ট পরিকাঠামো ও পরিষেবা' প্রদানের উদ্দেশ্যে 'প্যারা টিচারের' আমদানি এবং জনগণনা থেকে পোলিও, জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ -দেশোদ্ধারের সমস্ত গুরু দায়িত্ব মাথায় চাপিয়ে দেওয়া স্থায়ী শিক্ষকদের নিয়োগের ব্যাপক ঘাটতিতে, সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মান যতই পড়েছে ছাত্রছাত্রী'দের মধ্যে ততই বেড়েছে স্কুল ছুটের আর বেসরকারি স্কুলে স্থানান্তরিত হওয়ার প্রবণতা। শিক্ষা ক্ষেত্রেও লাক্ষণিক ভাবে প্রকট হয়েছে ধনী-গরিবের বৈষম্য। NSSO'র ৭১তম সার্ভের তথ্যানুসারে উচ্চশিক্ষায় ভারতবর্ষের ধনীতম ৫%'র ন্যাশনাল এটেন্ডেন্স রেশিও যেখানে ৫৯.৫% , দরিদ্রতম ৫% 'র সেখানে মাত্র ২০.৫% । আর তার মাত্র ৬%, আদিবাসী, দলিত, সংখ্যালঘু, কিম্বা মহিলা। যেখানে ইউনেস্কো রিপোর্ট অনুসারে বিশ্বের বৃহত্তম নিরক্ষরের বাস ভারতবর্ষে, সেখানে ২০২০'র মধ্যে ভারতবর্ষের ৫০% ছাত্রছাত্রী কে প্রাথমিক শিক্ষা লাভের জন্যও নিজের ট্যাঁকের পয়সা খরচ করতে হবে বলে আশঙ্কা। শিক্ষা ব্যবস্থার উপর "কল্যাণকামী" রাষ্ট্রের 'সিস্টেমেটিক' বিমাতৃসুলভতার জন্যই স্বাধীনতার ৬৩ বছর পরও প্রয়োজন হয় RTE'র মত বজ্র আঁটুনির ফোস্কা গেরোর।
সদ্য অপসারিত সংসদীয় রাজনীতির শ্রেষ্ঠ 'মেলোড্রামাটিক' কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী ৩০বছর পর আবার নতুন 'ন্যাশনাল ইডুকেশন পলিসি'র রণডঙ্কা বাজিয়েছেন। অবশ্য উনি তো সেই বিজেপি সরকারের প্রতিনিধি যারা প্রাথমিক শিক্ষাখাতে ১৩,৬৯৭ কোটি এবং উচ্চশিক্ষা খাতে ৩,৯০০ কোটি সরকারী বরাদ্দ হ্রাস করেছে। সেই 'আচ্ছে দিনের' সরকারে মন্ত্রী যারা ১৫%'র ছাড়া বাকিদের জন্য  ফেলোশিপ 'ডিসকন্টিনিউ' করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। উনি সেই মুরলী মনোহর যোশীর যোগ্য উত্তরসূরি যিনি প্যারিসে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন "উচ্চশিক্ষা সমাজের কোন কাজেই লাগে না। তাই যার পয়সার জোর আছে সে পারলে পড়ুক।" উনি সেই ভারত সরকারে নিরবচ্ছিন্নতা যারা ২০০৫ 'ট্রেডেবেল কোমডিটি' হিসেবে শিক্ষা ব্যবস্থার অবারিত দ্বার WTO-GATS'র হাত ধরে উন্মুক্ত করে দিয়েছেন বেসরকারিকরণের জন্য।বাজারে আজ 'শিক্ষা' বিক্রি হচ্ছে চড়া দামে। উচ্চশিক্ষার ৬৫%'ই আজ বেসরকারি। প্রাথমিক শিক্ষায় বিশ্বের গড় বেসরকারিকরণ যেখানে ১৪%, ভারতে সেখানে ২৫%। অ্যাসোচেমের তথ্যানুসারে, ভারতবর্ষের প্রতি বাবা-মা সঞ্চয়ের ৬৫% ব্যয় করতে বাধ্য হন সন্তানের শিক্ষা বা কেরিয়ারের পিছনে।
যে দেশে শিক্ষা এতো মহার্ঘ্য, যে দেশ জাতীয় আয়ের ৬% শিক্ষাখাতে খরচা করার ৫৮ বছরের পুরনো শর্ত এখনও পূরণে ব্যর্থ, যে দেশের হাইকোর্ট স্বাধীনতার প্রায় ৭০ বছর পর রায়দান করে বলে "সরকারও প্রশাসনের দুর্বলতা এবং ইন্ধনেই দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় বেড়েছে ধনী গরীবের বৈষম্য", যে দেশে মন্দির-মসজিদ-গির্জার মোট সংখ্যা স্কুল কলেজের থেকে ৯ লক্ষ বেশী, সে দেশের অঙ্গরাজ্যের টপারদের ত্রিভুজের চারটি বাহুর উপপাদ্য আবিস্কারই স্বাভাবিক, রাষ্ট্র বিজ্ঞানের সাথে রান্নার হেঁশেলের যোগসূত্র খোঁজাই ভবিতব্য, সে দেশের কপালে ইয়ালে ইউনিভার্সিটির ফেক ডিগ্রির কেন্দ্রীয় শিক্ষা মন্ত্রী'ই নসীব, মুসলিম মৌলবি'দের সানিয়া মির্জার পোশাকের ফতোয়াই শিরোধার্য, সমাজবাদী পার্টির মন্ত্রীর শিশু ধর্ষণের জন্য মোবাইল কে দায়ী করাই কাম্য, সে দেশের তো রামদেবই ভগবান, জাকির নায়েকই মসীহা, সে দেশের গো-মূত্রই পানীয়, সে দেশের গোবরে সোনা খোঁজাই বিজ্ঞান...

শুক্রবার, ১ জুলাই, ২০১৬

দ্য আদার... ‪#‎ইনবক্স‬ ~ মনিপর্ণা সেনগুপ্ত মজুমদার

ফেসবুকের "আদার" ইনবক্স একটি স্বর্ণ খনি বিশেষ। নারী মাত্রেই জানেন এর তাৎপর্য‍্য। কত কিসিমের যে লোক হয় এই নেট দুনিয়ায়, তা বোঝার এবং জানার সহজতম উপায় এই "আদার"। আপনি আদার ব্যাপারি হন বা জাহাজের কারবারী, আউট অভ দ্য বক্স ভাবনাচিন্তা কাকে বলে এই ইনবক্স তার জলজ্যান্ত উদাহরণ।

এমনিতে সবাই জানে যে মেয়ে হওয়া এদেশে মোটামুটি একটা অপরাধের সামিল; এই মেয়েদের জন্যেই ধর্ষণের মতন একটা জঘন্য অপরাধ ঘটছে প্রতিনিয়ত; এই অসভ্য, হায়াহীন প্রজাতি কম কম জামাকাপড় পরে, সেজেগুজে দিনের বেলা তো বটেই এমনকি রাত্তিরবেলাতেও রাস্তায় ঘোরাফেরা করে পুরুষ কে প্রলুব্ধ করতে! কী সাংঘাতিক! শাড়ি-সালোয়ার প্রভৃতি সো-কল্ড ভদ্র পোষাকের বাবা-মেসো করে এরা জিন্‌স, হাপু, এমনকি গরম প্যান্ট পর্যন্ত অনায়াসে পরে ঘুরে বেড়ায়। এসব দেখে যদি পাঁচটা ছেলে একটু মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে তাহলে তাদের দোষ কোথায়? আর একথা ব্যাদে আছে যে ছেলেদের মন মেয়েদের মতন প্যাঁচালো নয়, হুঁ হুঁ বাওয়া, ওদের মনে যা, মুখেও তাই। তাই রাস্তায় এর'ম মেয়ে দেখে যদি মধ্যমা অটোমেটিক্যালি উঠে যায় বা চাট্টি রসের কথা মুখ থেকে বেরোয়- তাহলে কী এমন মহাভারত অশুদ্ধ হয়, বুঝিনা।

এত্তসব ট্র্যাফিক আইন হয়েছে, লাইট রে, পুলিশের প্যাট্রোল ভ্যান রে, ক্যমেরা রে, দাদুগীতি রে- আরে বস্‌, কয়েকটা ঝক্কাস দেখতে মেয়ে-পুলিশকে (ইয়েস, আগে মেয়ে, পরে পুলিশ, স্বাভাবিক নিয়মেই) ঝিঙ্কু ড্রেস পরিয়ে মোড়ে মোড়ে দাঁড় করিয়ে দাও, মার্সিডিজ টু রিক্সা , স-ও-ব দেখবে ঠিক জায়গামতন থামছে, চাখছে, যাচ্ছে। Total egalitarian concept- সব্বাই এক, আমরা সবাই রাজা… ইত্যাদি প্রভৃতি।

আচ্ছা, আচ্ছা, যা বলছিলাম… আসলে এই টপিক নিয়ে লিখতে বসলেই আমি একটু, ইয়ে মানে, আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ি আর কী। ক্ষমাঘেন্না করে দেবেন নিজগুণে…
যাইহোক, হচ্ছিল "আদার" ইনবক্স এর কথা। আমি একদিন এক সুন্দর, সুবাসিত সকালে একটি মেসেজ পেলাম, একজন ভীষণ উদ্গ্রীব হয়ে জানতে চেয়েছেন, আমি শুতে কত নিয়ে থাকি। এতে আমি যারপরনাই অবাক হয়ে রিপ্লাই দিয়েছিলাম যে আমি এমনিতেই ঘুমাতে ভালবাসি, তার জন্য কেউ কখনও টাকাপয়সা দেয়নি আমাকে। ওনার বাড়ির মহিলারা শোয়া বা ঘুমানোর জন্য চার্জ করেন বলে সবাইকে অমন ভাবা ঠিক না। এতে করে কেন জানিনা উনি ভয়ানক ক্ষিপ্ত হয়ে গেছিলেন। আরো দু-চারটে কথার পর আমাকে ব্লক করে দিলেন অথচ আমি বুঝতেই পারলাম না যে আমার দোষটা কোথায়!

তাছাড়া, প্রত্যেক মেয়েই কোন না কোন সময় মেসেজ পেয়ে থাকে যে তার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে কেউ তাকে মডেল বানাতে চায় বা ফোটোশুট, বা নিদেনপক্ষে, কোন বিশেষ পোজে তার ছবি দেখতে চায়। সুদূর মরক্কো থেকে শুরু করে নিকারাগুয়া, পারস্য এমনকি মঙ্গল্গ্রহ থেকেও এমত অনুরোধ এলে কোন মেয়েই অবাক হয়না। হওয়ার কথাও নয়, আমরা তো জানি, "আপনা মাংসেঁ হরিণা বৈরী" … কিন্তু ভুসুকু এও বলেছেন যে, "মূঢ়া হিঅহি ণ পইসঈ" অর্থাৎ গাড়লের মগজে এতসব ঢোকেনা, তাই অবাক হওয়া বাদ দিলেও মাঝে মাঝেই মেয়েরা এইসব নিয়ে চিল্লামিল্লি করে, মানে মেয়েদের তো বুদ্ধিশুদ্ধি টেন্ডস টু জিরো …তাই আর কী…। এসব ছাড়াও, আমি_শুধু_চেয়েছি_তোমায়, বল্গাহীন_ভালবাসা, বিছানায়_বক, Sexy_Stud, Eternal_erection, DiscoDick- এরা সকাল-সন্ধ্যায় নিয়ম করে খোঁজখবর নিয়ে থাকে, বিচিত্র বানানে "ভালবাষা" জানায়। Lyf roxxx!

তবু, এতকিছুর মধ্যেও ভরসার কথা এই যে, ইহজীবনে যত এরকম "হাম তো (মহা) পুরুষ হ্যায়, হাম ক্যা নেহি কর স্যকতা, সবকুছ জায়েজ হ্যায়" টাইপ ছেলে দেখেছি, তার দ্বিগুণ দেখেছি ঠিক মানুষের মতন পুরুষ। নিজের বাবা, দাদা,কাকা, স্বামী বা ছেলের কথা বাদ দিলেও বন্ধুস্থানীয় তাদের সংখ্যাটাও বড় কম নয়। এইসব নিয়েই তো জীবন, আমাদের জীবন; সবাই "ওম্মা, দ্যাখ কী ভাল, তকাই আমার" হবে, আয় তবে সহচরী গাইবে নেচে নেচে, তাই হয় নাকি? না হওয়া উচিৎ ।

বেঁচে থাক আমার নারীত্ব, আমার মেয়েলী সারল্য, আমার অকারণ হাসি, (পড়ুন ন্যাকামো) আমার চকিত সতর্কতা, আমার সঙ্গীর পায়ে-পা মিলিয়ে এগিয়ে চলার আনন্দ। সে পিছিয়ে পড়লে দাঁড়াব তার জন্য, কারণ আমি জানি সেও ঠিক তাই-ই করবে। পুনর্জন্ম আছে নাকি? কেউ জানেন? থাকলে, অগলে জনম মে মোহে বিটিয়া হি কিজো।