শুক্রবার, ১৫ আগস্ট, ২০২৫

হিন্দু মহাসভা ও স্বাধীনতা আন্দোলন ~ দেবত্তম চক্রবর্তী

১৯১৫ সালের ৯ এপ্রিল, হরিদ্বারের কুম্ভমেলায় প্রতিষ্ঠিত হয় 'অখিল ভারতীয় হিন্দু মহাসভা'। গান্ধী হিন্দু-মুসলমানের ঐক্যবদ্ধ অসহযোগ-খিলাফত আন্দোলনের ডাক দিলেও অসহযোগের তীব্র বিরোধিতা করে কার্যত নিষ্ক্রিয় থাকে মহাসভা। চৌরিচৌরার হিংসার প্রেক্ষিতে গান্ধী আন্দোলন প্রত্যাহার করে নেওয়ার পরে, ১৯২৩ সালে বিরাট হিন্দু পুনরুত্থান অভিযান শুরু করে তারা। সেই বছর অগস্ট মাসে পণ্ডিত মদনমোহন মালব্যের সভাপতিত্বে বারাণসী অধিবেশনে মহাসভা 'শুদ্ধি' কর্মসূচী গ্রহণ করে, 'হিন্দু আত্মরক্ষা বাহিনী' গড়ে তোলারও ডাক দেয়।


 
অসহযোগ-খিলাফতের ব্যর্থতার পরে মুসলমান সমাজের আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনা এবং কংগ্রেসের সঙ্গে যোগসূত্র গড়ে তোলার জন্য, ১৯২৪ সালের ৪ মে লাহোরে অনুষ্ঠিত মুসলিম লিগের সভাপতির অভিভাষণে জিন্না বলেন: "...আমাদের ভুলে যাওয়া উচিত নয়, স্বরাজ অর্জনের এক অপরিহার্য শর্ত হল হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে রাজনৈতিক ঐক্য। ...আমি এই ক্থা বলতে চাই যে, যেদিন হিন্দু ও মুসলমানরা ঐক্যবদ্ধ হবে, সেদিনই ভারতবর্ষ ঔপনিবেশিক স্বায়ত্তশাসন পাবে।" 

অথচ, সেই সম্ভাবনাকে অঙ্কুরে বিনাশ করতে চেয়ে হিন্দু মহাসভার অন্যতম নেতা লালা লাজপত রাই ওই বছরেরই ১৪ ডিসেম্বর 'দ্য ট্রিবিউন' পত্রিকায় ঘোষণা করেন: "আমার পরিকল্পনা অনুযায়ী মুসলমানদের চারটি মুসলিম রাজ্য থাকবে: ১) পাঠান প্রদেশ বা উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত, ২) পশ্চিম পাঞ্জাব, ৩) সিন্ধু এবং ৪) পূর্ব বাংলা। যদি ভারতের অন্য কোনও অংশে একটি [আলাদা] প্রদেশ গঠনের জন্য যথেষ্ট সংখ্যক মুসলিম সম্প্রদায় থাকে, [তাহলে] তাদেরও একইভাবে গঠন করা উচিত। কিন্তু এটা স্পষ্টভাবে বোঝা উচিত যে, এটি অখণ্ড ভারতবর্ষ নয়। এর অর্থ হল, ভারতবর্ষকে স্পষ্টত একটি মুসলিম ভারতবর্ষ এবং একটি অমুসলিম ভারতবর্ষে বিভক্ত করা।" 

এই ঘোষণার পরের বছরে অর্থাৎ ১৯২৫ সালে হিন্দু মহাসভার অষ্টম অধিবেশনে সভাপতি হন লাজপত রাই। ওই বছরের বিজয়া দশমীর দিন কেশব বলীরাম হেডগেওয়ার-এর নেতৃত্বে একটি গোষ্ঠী হিন্দু মহাসভা থেকে বেরিয়ে এসে তৈরি করেন 'রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ' (আরএসএস) নামে এক  নতুন সংগঠন। স্বাধীনতা আন্দোলন সম্পর্কে আরএসএস-এর দৃষ্টিভঙ্গি প্রসঙ্গে সঙ্ঘের অন্যতম তাত্ত্বিক গুরু ও দ্বিতীয় সরসঙ্ঘচালক গোলওয়ালকর বলেন: "ব্রিটিশ বিরোধিতাকে দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদের সমার্থক ভাবা হচ্ছে। এই প্রতিক্রিয়াশীল দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের সমগ্র স্বাধীনতা আন্দোলন, তার নেতৃবর্গ ও সাধারণ মানুষের উপর বিনাশকারী প্রভাব ফেলেছিল।" অর্থাৎ তাঁর মতে ব্রিটিশ বিরোধিতা হচ্ছে 'প্রতিক্রিয়াশীল দৃষ্টিভঙ্গি'!

এহ বাহ্য! ১৯৪০ সালে জিন্নার লাহোর প্রস্তাবের ৩ বছর আগে ১৯৩৭ সালে, হিন্দু মহাসভার আহমেদাবাদ অধিবেশনে সভাপতির ভাষণে উগ্র হিন্দুত্বের জিগির তুলে বিনায়ক দামোদর সাভারকর খোলাখুলি বলেন: "...ভারতবর্ষে দুটি শত্রুভাবাপন্ন  জাতি পাশাপাশি বাস করে। ...ভারতবর্ষকে আজ আর একক (Unitarian) ও সমজাতীয় (homogeneous) জাতি বলে বিবেচনা করা যায় না। বরং পক্ষান্তরে [এ দেশে] প্রধানত দুটি জাতি রয়েছে: হিন্দু ও মুসলমান।" মনে রাখতে হবে, লাহোর প্রস্তাবের বহু আগেই এভাবে এ দেশে দ্বিজাতি তত্ত্বের সূচনা করে হিন্দু মহাসভা।
 
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে ব্রিটিশ সরকারের প্রতি দেশবাসীর দৃষ্টিভঙ্গি কী হবে, সেই প্রসঙ্গে সাভারকর ১৯৪১ সালে ভাগলপুরে হিন্দু মহাসভার ২৩তম অধিবেশনে বলেন: "So far as India's defence is concerned, Hindudom must ally unhesitatingly, in a spirit of responsive co-operation, with the war effort of the Indian government in so far as it is consistent with the Hindu interests, by joining the Army, Navy and the Aerial forces in as large a number as possible and by securing an entry into all ordnance, ammunition and war craft factories।" যদিও ওই সেনাবাহিনীতে মুসলমানদের যোগ দেওয়ার ব্যাপারে তিনি নীরব ও নিষ্পৃহ থাকেন, কারণ তাঁর মতে "মুসলমানেরা প্রথমে মুসলমান, শেষে মুসলমান, এবং কদাচ ভারতীয় নয়।" 

অথচ, ক্ষমতার স্বাদ পেলে হিন্দু মহাসভা যে তার দীর্ঘলালিত মুসলমান-বিদ্বেষ এক লহমায় ভুলে যেতে পারে, এমনকি মুসলিম লিগের সঙ্গে কোয়ালিশন সরকার গড়তেও দ্বিধা করে না, তা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার অব্যবহিত পরে কংগ্রেস মন্ত্রিসভাগুলির পদত্যাগের পর থেকেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আমরা দেখি, 'ভারত ছাড়ো' আন্দোলনের ডাক দিয়ে যখন গান্ধী-সহ প্যাটেল, নেহরু, আজাদ প্রমুখ কংগ্রেসি নেতৃবৃন্দ জেলে বন্দিজীবন যাপন করছেন, তখন হিন্দু মহাসভার দ্বিতীয় প্রধান নেতা শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় লাহোর প্রস্তাবের উত্থাপক ফজলুল হকের অর্থমন্ত্রী হিসাবে বাংলায় প্রায় ১১ মাস দায়িত্ব সামলাচ্ছেন। একই ভাবে উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে খান আব্দুল জব্বর খানের কংগ্রেস মন্ত্রিসভা পদত্যাগ করলে মুসলিম লিগের প্রধানমন্ত্রী সর্দার আওরঙ্গজেব খানের অর্থমন্ত্রী হচ্ছেন হিন্দু মহাসভার মেহেরচাঁদ খান্না। আর ১৯৪৩ সালের ৩ মার্চ, সিন্ধু প্রদেশের আইনসভায় পাকিস্তান প্রস্তাব পাশ হওয়ার পরেও স্যার গুলাম হুসেন হিদায়েতুল্লার নেতৃত্বাধীন মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করার প্রয়োজন বোধ করছেন না মহাসভার তিন মন্ত্রী। এর কারণ একটিই। কারণ ১৯৪২-এর ২৮ অগস্ট 'দ্য বম্বে ক্রনিকল' পত্রিকায় হিন্দু মহাসভার প্রতিনিধিদের নির্দেশ দিয়ে সাভারকর বলেন: "...যতটা সম্ভব রাজনৈতিক ও সামরিক শক্তি দখল করার জন্য হিন্দু সদস্যদের অবশ্যই প্রতিরক্ষা সংস্থা (Defence bodies) এবং কাউন্সিলে তাদের অবস্থানে অটল থাকতে হবে।" 

ব্রিটিশদের সঙ্গে সহযোগিতা করার হিন্দু মহাসভার এই নির্দেশের সঙ্গে সাযুজ্য রেখেই শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ১৯৪২-এর ২৬ জুলাই বাংলার ছোটলাট জন হার্বার্টকে একটি চিঠি লিখে কংগ্রেসকে মোকাবিলা করার পরিকল্পনা ছকে দেন এই ভাষায়: "... কংগ্রেসের ডাকা সারা ভারতবর্ষ ব্যাপী আন্দোলনের ফলে এই প্রদেশে যে পরিস্থিতি সৃষ্ট হতে পারে, আমাকে এখন তার উল্লেখ করতে হবে। যুদ্ধের সময়কালে যদি কেউ গণ-অনুভূতিকে এমনভাবে জাগিয়ে তোলার পরিকল্পনা করে যাতে অভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খলা বা নিরাপত্তাহীনতা ঘটতে পারে, তবে যে কোনও সরকার, তার কার্যক্রমের মেয়াদ যদি স্বল্পকালীনও হয়, তবু সে অবশ্যই এই আন্দোলনকে প্রতিহত করবে।" শুধু তা-ই নয়, ব্রিটিশ সরকারের বিশ্বস্ত মন্ত্রী হিসাবে তিনি আন্দোলন দমন করার ক্ষেত্রে সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দিয়ে একই চিঠিতে ছোটলাটকে জানান: "ব্রিটেনের স্বার্থে নয়, ব্রিটিশরা লাভবান হতে পারে এমন কোনও সুবিধার জন্য নয়, বরং প্রদেশের প্রতিরক্ষা ও স্বাধীনতা রক্ষার জন্য ব্রিটিশদের ওপর ভারতীয়দের আস্থা রাখতে হবে। আপনি গভর্নর হিসাবে, প্রদেশের সাংবিধানিক প্রধান হিসাবে কাজ করবেন এবং আপনার মন্ত্রীর পরামর্শে সম্পূর্ণরূপে পরিচালিত হবেন।"

অন্য দিকে আরএসএস-এর তাত্ত্বিক গুরু গোলওয়ালকর দেশটাকে হিন্দুরাষ্ট্রে পরিণত করার খোয়াবে মশগুল থেকে নির্দ্বিধায় উচ্চারণ করেন: "হিন্দুস্তানের অ-হিন্দু জনগণকে অবশ্যই হিন্দু সংস্কৃতি ও ভাষাকে [হিন্দি] গ্রহণ করতে হবে, হিন্দু ধর্মকে শিখতে হবে এবং সম্মান ও শ্রদ্ধা করতে হবে, হিন্দু জাতি ও সংস্কৃতির গৌরব ছাড়া অন্য কোনও ধারণাই গ্রহণ করতে হবে না।" তাঁর মতে, ". . . in a word they must cease to be foreigners, or may stay in the country, wholly subordinated to the Hindu nation, claiming nothing, deserving no privileges, far less any preferential treatment – not even citizens' rights।" অর্থাৎ সোজা কথায়, কেবল হিন্দু ধর্মাবলম্বী ছাড়া অন্যদের কোনও কিছুই দাবি না করে, এমনকি নাগরিক অধিকারটুকুও বিসর্জন দিয়ে সম্পূর্ণত হিন্দু জাতির অধীনস্থ হয়ে এ দেশে থাকতে হবে। দেশ সদ্য স্বাধীন হওয়ার পরে ১৯৪৭ সালের ৭ ডিসেম্বর, দিল্লির রামলীলা ময়দানে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের বিশাল সমাবেশেও তিনি বলেন: "হিন্দু সমাজের সংহতিই আমাদের লক্ষ্য । এই আদর্শকে সামনে রেখে, সঙ্ঘ তার পথে অগ্রসর হবে এবং কোনও কর্তৃপক্ষ বা ব্যক্তিত্ব দ্বারা বাধাগ্রস্ত হবে না।"

এই ঘটনার অল্প কিছু দিন আগে, ১৯৪৭ সালের ২২ জুলাই ভারতীয় সাংবিধানিক গণপরিষদে গৃহীত ভারতের জাতীয় পতাকাটিকেও সাভারকার বাতিল করে দেন। তার এক সপ্তাহ পরে, জুলাই মাসের ২৯ তারিখে তিনি এক বিবৃতি প্রকাশ করে বলেন: "সিন্ধু থেকে সমুদ্র পর্যন্ত বিস্তৃত অবিচ্ছিন্ন ও অবিভক্ত আমাদের মাতৃভূমি ও পুণ্যভূমি হিন্দুস্থানের জন্য একমাত্র ভাগোয়া [গেরুয়া পতাকা]— যার বুকে অঙ্কিত আমাদের জাতিসত্তার আপন উপস্থিতির প্রকাশে উদ্ভাসিত কুণ্ডলিনী ও কৃপাণ— ছাড়া আর অন্য কোনও কর্তৃত্বপূর্ণ পতাকা হতে পারে না। এটি কারও ফরমায়েশে গড়া নয়, বরং এটি আমাদের জাতীয় সত্তার বিবর্তনের সঙ্গে স্ববিকশিত। এই পতাকা আমাদের হিন্দু-ইতিহাসের সমগ্র দৃশ্যপটকে প্রতিফলিত করে। লক্ষ লক্ষ হিন্দু প্রকৃতপক্ষে এরই পূজারি। ইতিমধ্যেই হিমালয়ের সুউচ্চ শৃঙ্গ থেকে দক্ষিণের সমুদ্র অবধি এটি উড্ডীন। অন্যান্য দলীয় পতাকাগুলিকে বরদাস্ত করা যেতে পারে। [সেই কারণে] এদের কয়েকটিকে এমনকি কিছুটা সম্মানও করা যেতে পারে। কিন্তু কোনও অবস্থাতেই হিন্দুরাজত্বের জাতীয় আদর্শ হিসাবে এই হিন্দু-অনুসারী ধ্বজা, এই ভাগোয়া পতাকা ছাড়া আর অন্য কোনও পতাকাকে আনুগত্যের সঙ্গে অভিবাদন জানানো যায় না।" 

এমনকি স্বাধীনতা লাভের পরেও সঙ্ঘ তাদের জাতীয় পতাকাকে অস্বীকার করার ঐতিহ্য অটুট রাখে। এ প্রসঙ্গে গোলওয়ালকর লেখেন: "...আমাদের নেতারা আমাদের দেশের জন্য একটি নতুন পতাকা বেছে নিয়েছেন। তাঁরা এই কাজ করলেন কেন? এটি নিছকই অনুকরণ মাত্র। …আমরা একটি প্রাচীন ও মহান জাতি, যার গৌরবময় অতীত রয়েছে। তাহলে কি আমাদের নিজস্ব কোনও পতাকা ছিল না? এত হাজার বছর ধরে আমাদের কি কোনও জাতীয় প্রতীক ছিল না? নিঃসন্দেহে ছিল। তাহলে আমাদের মনে এই নিদারুণ শূন্যতা কেন?"

যে হিন্দু মহাসভা কিংবা রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্ঘের সদস্যেরা ভারতে ব্রিটিশ শাসনের শেষ দিন পর্যন্ত ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে নিশ্চুপ থেকেছে, দেশের প্রত্যেকটি স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রতিটি অধ্যায়ের সরাসরি বিরোধিতা করে এসেছে, জন্মলগ্ন থেকেই দেশের মানুষকে সুচতুরভাবে হিন্দু-মুসলমানের বিদ্বেষ বিষে জর্জরিত করেছে, এই সেদিন পর্যন্ত জাতীয় পতাকার চূড়ান্ত অবমাননা করেছে— আজ তারাই সহসা দেশপ্রেমের ঠিকাদারি নিতে চাইছে একচেটিয়া ভাবে!

এই পরিস্থিতিতে আপনারা আগামীকাল মোদি-শাহ অ্যান্ড কোং-এর নবতম গড্ডলিকা প্রবাহের অন্যতম গড্ডল হবেন কি না, সে কথা ভেবে দেখুন।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন