রবিবার, ১৯ জানুয়ারী, ২০২০

এন-আর-সি যদি ১০০ বছর আগে হত ~ নির্মাল্য সেনগুপ্ত

ভারতে এন-আর-সি যদি ১০০ বছর আগে হত তাহলে সেই সময়কার বিখ্যাত লেখকরা তাদের গল্পে কিভাবে ব্যবহার করতেন? 

বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ঃ

ধু ধু করিতেছে সেতুপুরের মাঠ। সোনালী বালির উপর চিকিচিকি দেখিয়া অপু ভাবিল, বাহ দিদিকে ডাকিয়া আনিলে ভাল হইত৷ দুর্গা এ যাবৎ অনেকবার তাহাকে বলিয়াছে যে সোনারঙা বালির খোঁজ লইয়া আনিলে অপুকে সে তাহার সঞ্চয় থেকে দুইখানি কড়ি দেবে৷ ওই কড়ির উপর অপুর বড়ই লোভ। সে একখানি গাছের ডাল ভাঙিয়া লইয়া বালির উপর নকশা কাটিতে ব্যস্ত হইল৷ হরিহর কখন আসিবে সে জানে না৷ অপেক্ষা করা ছাড়া এখন উপায়ও নাই৷ দলিল সম্মন্ধে অপু মা'কে জিজ্ঞেস করিয়া উত্তর মেলে নাই কোনও৷ সর্বজয়ার মুখে সে শুনিয়াছে সুদূর দিল্লী নামক কোনও এক গ্রামে নরেন্দ্র মোদী নামক এক রাজা আছেন৷ তিনি প্রজাদের দলিল দেখিতে চান, নহিলে সবাইকে দেশছাড়া করিবে৷ অপু দিদিকে জিজ্ঞেস করিয়াছিল, "দিদি, তবে কি আমাদের নিশ্চিন্দিপুর ছেড়ে চলে যেতে হবে? সতুদারাও যাবে?" দুর্গাও এর উত্তর দিতে পারে নাই৷ 

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ঃ 

বৃষ্টি থামার কোনও নাম নেই আজ দুপুর থেকেই৷ ডাঁই করা ঘাসের উপর, চাল থেকে চুঁইয়ে টপ টপ করিয়া জলের ফোঁটা পড়িয়া পচা গন্ধ বাহির হইয়াছে বেশ৷ ঘরের ভিতর আদুড় গায়ে শুইয়া আছে মালতী৷ ঘরের ভিতরেও যে সুবাস ছড়াইতেছে তা বলিতে পারি না৷ মালতীর পায়ের কাছে ঘায়ের উপর মাছি ঘুরিতেছে ভনভন৷ সনাতন পাগলের মত ঘরের আনাচে কানাচে খুঁজিয়া যাইতেছে কিছু। মালতী ড্যাবড্যাব করে তাকিয়া রইয়াছে সনাতনের দিকে৷ তাহার পিঠের পেশী ওঠানামা করিতেছে জোরে জোরে। চোখেমুখে ভয়ের ছাপ৷ ঠোঁটের কাছে অল্প বিস্কুটের গুঁড়ো লাগিয়া আছে এখনও৷ সনাতন বলিল, "কাগজ না পেলে ভিটেমাটি চাটি হবে বুঝেচ? অমন করে দেখচ কী? তোমার ভয় লাগে না?" 
মালতী খিলখিলিয়া হাসিয়া ওঠে। বলে, "যেখানেই যাই, যাব তো তোমার সঙ্গেই৷ আমাকে একা ফেলে পালাবে ভেবেচ নাকি? তা হবে না বাপু..." 

জীবনানন্দ দাশঃ 

একটা চুরুট জ্বালিয়ে মাল্যবান চেয়ারে বসে জানলার দিকে তাকাল। মিহি কোনও সুর ভেসে আসে ওই বাড়ি থেকে৷ সে সুরে কোনও কথা নেই, আকুতি নেই, আলো নেই। আলো কোনওদিন নিজের জীবনে চায়ওনি মাল্যবান। উৎপলা কি চেয়েছে? এই দুর্দিনেও উৎপলা শুয়ে থাকে৷ কেবল শুয়ে থাকে৷ জঙ্গলে আগুন লাগলেও যেমন সজারুর দল ভুলে যায় নদীর দিকে ছুটে চলার কথা। ঝাঁক ঝাঁক শকুন উৎকণ্ঠায় অপেক্ষা করে পোড়া মাংসের গন্ধ নাকে আসার, সেই তীব্র মোদ্দাফরাসের ন্যায় কিছু হিংস্র হায়না দাপিয়ে বেড়ায় হলুদ ফুলের মধ্য দিয়ে। বাতাসে বাতাসে ছাইয়ের সঙ্গে ফুলকি সখা পাতায় কখনও সখনো৷ মাল্যবান ভাবে৷ মিহি সেই সুরের তালে তালে তার চোখের সামনে কোনও কাগজের অবয়ব ফুটে ওঠে। অমিত শাহ কি জানে তার কথা? তার এই অন্ধকার ঘরের ভিতর উৎপলার এক মুহূর্তের ভালবাসার আখাঙখা, অথবা ভালবাসা নয়, শুধু বেঁচে থাকা। একটা অন্ধকার ঘরের ভিতর, সামান্য বেঁচে থাকা ইচ্ছে। 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরঃ 

আমি ভাবিতাম, দেশছাড়া হওয়ার আশঙ্কা বুঝি শুধু আমার। আর কারও হৃদয়গহ্বরে তেমন কোনও উৎকণ্ঠার কারণ, তাহাদের উতলা করিতে পারে নাই আজও৷ তবু আজ এত লোকের সমবেত কণ্ঠস্বর আমাকে সামান্য একটু বল দিল৷ শুস্তা নদীটির উপলমুখরিত পথে নর্তকীর ন্যায় জলবারি, নৃত্য করিয়া চলিয়া যাইতেছে ক্রমাগত। নদীর কিনারে শৈলপদমূলে জড়ো হইয়াছে প্রায় দেড়শত লোক। গগনভেদী কণ্ঠে তাহারা সোচ্চারিত হইতেছে "হাম ছিনকে লেঙ্গে আজাদী..." 

শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ঃ 

ব্যোমকেশ সযত্নে খবরের কাগজটি পাট করিয়া টেবিলে রাখিল। একটি সিগারেট জ্বালাইয়া অন্যমনস্ক ভাবে তাকাইয়া রহিল কাগজটির দিকে৷ 

আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, "কী হল? নতুন কোনও কেস পেলে?" 

বাইরে হ্যারিসন রোডের উপর নবোদবুদ্ধ নগরীর পথে মানুষের ঢল৷ আমাদের এই বসিবার ঘরটির গবাক্ষপথে রাস্তার কিয়দংশ দেখা যায়। কাতারে কাতারে মানুষ নাগরিক আইনের বিরুদ্ধে মিছিলে পথ হাঁটিতেছে। 

ব্যোমকেশ আমার প্রশ্নে সজোরে মাথা নাড়াইয়া কহিল, "আমি একটি পণ করেছি অজিত। যতদিন না সরকার এই আইন ফিরিয়ে নিচ্ছে, সরকারের কোনও কেসে ব্যোমকেশ বক্সী মাথা ঘামাবে না।" 

সত্যজিত রায়ঃ 

লালমোহনবাবু উত্তেজিত স্বরে বললেন, "বলেন কী মশাই! এই এন.আর.পি আইন সত্যিই লাঘু হবে নাকি?" 

আমি আড়চোখে ফেলুদার দিকে তাকালাম৷  রাস্তায় এত যানজট এর আগে আমরা দেখিনি৷ লালমোহনবাবুর সাম্প্রতিক উপন্যাসটা প্রায় ২০০০ কপি বিক্রি হওয়ায় তিনি আমাদের চাঙোয়া নিয়ে চলেছেন। সামনের লরিটা থেকে বেরোনো কালো ধোঁয়া মাঝেমধ্যেই গাড়ির উইন্ডস্ক্রীন কালো করে দিচ্ছে। 

"ওটা এন-আর-সি। এন-আর-পি নয় লালমোহনবাবু। আর হ্যাঁ, লাঘু হয়ে গেছে। কিন্তু মানুষ করতে দেবে না৷" 

"সেটাই তো।" লালমোহনবাবু উত্তেজিত হয়ে সিটের পিছনে একটা পেল্লাই ঘুষি চালিয়ে বললেন, "একি ইয়ার্কি নাকি মশাই। আমার ভোটার আইডি আছে, ভোট দিয়েছি, এখন বলছে সেটা আমার প্রমাণপত্র নয়? ভাই তপেশ, তুমিই বল, এ কী সম্ভব?" 

শিবরাম চক্রবর্তীঃ 
বাড়ি থেকে বেরিয়েই হর্ষবর্ধন ভাবিত হন। ভাইকে ডেকে বলেন, "হ্যাঁ রে গোবরা, ধর আমাদের ধরে ক্যাম্পে ঢুকিয়ে দিল। তারপরে কলকাতা ফিরতে পারব তো আবার?" 

গোবর্ধন বললে, "অত ভেব না তুমি৷ আসামে আমাদের সবাই চেনে৷ তোমারও গোটা আসাম নখদর্পনে৷ একটা কাগজ তুমি জোগাড় করতে পারবে না?"
"তা চেনে বইকি। যুদ্ধেও তো গিয়েছি আমি। যাইনি নাকি? এবার বলবে যে ডিটেনশন ক্যাম্পে যাও? এমন টেনশনে কি ফেলতে পারবে আমাদের?" 

" না না।" তুমি ভয় পেও না দাদা। বাড়ির দলিলের বন্দোবস্ত করে আমরা আমাদের বস্তিতে ফিরে আসব৷ চিন্তা হয় শিব্রামবাবুকে নিয়ে।" 

"তাকে নিয়ে আবার কিসের চিন্তা?" হর্ষবর্ধন মাথা নেড়ে বলেন, "তার আবার চিন্তা কী? তার পিছুটান বলতে তো বোন আর ভাইপোরা। সম্পত্তি বলতে তার আছে কী? ওই বইগুলো? সে নাহয় বই নিয়েই উনি বাংলাদেশে ফিরে যাবেন। এমনিও এখানে কেউ পড়ে না৷" 

"এমন বোল না৷ বন্ধু হয় কিনা আমাদের? তার জন্যেও নাহয় একটা কাগজ বের করে ফেলি আমরা। বলব, উনি হলেন বৌদির ভাই। কেমন হয়?"
"মন্দ বলিসনি তা। তবে এইসব ঝক্কি আমার পোষায় না বাপু। এইসব বন্ধ করলেই ভাল হয় সবথেকে৷ মোদীর জন্যে আমোদই করতে পারছি না শান্তিতে৷" 

"ঠিক বলেছ দাদা। তোমার সর্বধর্ম সমন্বয়ের পরিবর্তে এই ধর্মসর্বস্ব ঝঞ্ঝাট। এ কি ভাল লাগে বল?"

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন