বৃহস্পতিবার, ৩০ এপ্রিল, ২০১৫

May Day - ভরসা দিবস - শুভাশিষ আচার্য্য

আপনি কথা বললে মুখে সুরভিত জোতদারের গন্ধ ছোটে।
রাস্তায় হেঁটে চললে মুঘল বাদশার জুতো শব্দ করে।
হাত নাড়লে, ঠাণ্ডা গাড়ির পেছন সিটের জানলা থেকে,
তেজি ঘোড়ার পিঠের থেকে চাবুক ঘোরে দলিত পিঠে।

একটি রঙিন গল্প ~ অরুণাচল দত্তচৌধুরী

গত মঙ্গলবার দুপুর বারোটা সাতচল্লিশে আচমকা আমাকে দলে ডেকে নিল ওরা। আমি কোনও পার্টি করতাম না। তাই দলত্যাগ বা দলবদল জাতীয় মহান শব্দ আমার বেলা উচ্চারণ করা যাবেনা। দলে ভেড়াল বা দলভুক্তি ঘটল বলা যেতে পারে।

চাকরি পাই নি। কলকাতায় সেজপিসির বাড়িতে অনাহুত আশ্রিত। চাকরির পরীক্ষা দিই আর ফাইফরমাশ খাটি। মান্তুকে ইস্কুলবাসে পৌঁছে দেওয়া, দোকান বাজার মায় কাজের দিদি না এলে ইদানীং এমন কী কাপড়কাচা বাসনমাজাও। কী করা? দাদা বৌদি দু'জনেই অফিস যায়। পিসি বাতে শয্যাশায়ী। আমাকে যে থাকতে দিয়েছে এই ঢের। পরিবারটাকে সব মিলিয়ে মহানুভবও বলা যায়। 

বুধবার, ২৯ এপ্রিল, ২০১৫

এক পশলা বিপ্লব জেগে উঠছে আবার - গোধুলি মিত্র


এক পশলা বিপ্লব জেগে উঠছে আবার
ভেঙ্গে যাওয়া শপথ,
মুচড়ে দেওয়া শিরদাঁড়া জুড়ে জুড়ে
আগুন জ্বালাচ্ছে দধীচি

​বিজয়োৎসব ~ সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়

আমাদের মুখ কালচে কালচে – মাটির মত
মাঠে ময়দানে, পুজো-পার্বনে খুশিরা ডাকতো
বারোয়ারি খানা, ভোগের খিচুড়ি, তপ্ত সুবাস
ছোট্ট পাড়াটা আরো ছোটোদের কান্না ঢাকতো

রবিবার, ২৬ এপ্রিল, ২০১৫

দুপয়সার রবি - গোধুলি মিত্র

              
আমরা যারা রবি ঠাকুর বলি, শুনি, পড়ি বা গাই- আমাদের সাথে রবীন্দ্রনাথের প্রথম আলাপ হয় মা-বাবা, শিক্ষক কিম্বা নিছক পড়ার বইয়ের হাত ধরে। কেউ উপহার পেয়েছি, কেউ বাড়িতে পরম্পরায়, কেউ শখে ,কেউ বা লাইব্রেরীতে। যে মেয়েটার কথা এখন বলব, তার সাথে রবির আলাপ কিছুটা অন্যরকম, কিছুটা ব্যতিক্রম।

শুক্রবার, ২৪ এপ্রিল, ২০১৫

আমোদিনীর হালকা পালক ~ সংগীতা দাশগুপ্তরায়

আমার বড়মাসি ছিল তুমুল সুন্দরী। যাকে বলে ফাটাফাটি সুচিত্রা সেন টাইপ সুন্দরী। তখন ওটাই সৌন্দর্যের মাপকাঠি হিসেবে নাকি ধরা হত। তো মাসিমনি জামালপুরের সুচিত্রা সেন হয়ে বহু উত্তম মধ্যম ও অধমের বুকে দোলা লাগিয়ে চলেছে নিয়মিত। হেনকালে আমার বড়মামুর প্রাণের বন্ধু ভীমমামু মাসিমণির প্রেমে পড়ে একদম হাপুস হুপুস দশা । মুশকিল একটাই যে বন্ধুর বোনকে এভাবে ভাল লাগাটা ঘোরতর নিয়মবিরুদ্ধ। এদিকে বেচারা যত ভাবে ভুলে যাবে 'মনো মানে না' । শেষে মরিয়া হয়ে আগে বড়মামুর কাছেই কনফেস করল। বড়মামুর শুনে আপত্তি নেই কারন বন্ধুটিও বদ্যি (এটা একটা মারাত্মক ক্রাইটেরিয়া) এবং ভারি পরোপকারী ভালমানুষ ধরনের। হালত দেখে বড়মামুই হাল ধরল। মাসিমণিকে একদিন কথায় কথায় বলল "বুঝলি, ভীমের তোকে খুব পছন্দ" ।

বুধবার, ২২ এপ্রিল, ২০১৫

দুনিয়া কাঁপানো ১ দিন - সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়


(পাঠকের কাছে সনির্বন্ধ অনুরোধ, লেখাটি পুরো পড়বেন। নয়ত পড়বেন না)

৩০শে এপ্রিল ১৮৮৬, শুক্রবার

----------------------

আনন্দ –

ü  ৮ ঘন্টা কর্মদিবসের দাবিতে ৪ঠা মে শিকাগো তে বড় জমায়েতের ডাক দিলো মজদুর ইউনিয়ন।

ü  হুমকি ধর্মঘটের, নৈরাজ্যবাদী হামলার আশংকা মার্কিন সরকারের

ü  দাবী অন্যায্য, ধর্মঘট ক্ষতি করছে মার্কিন কর্মসংস্কৃতির – দাবী শিল্পপতি মহলের

শুক্রবার, ১৭ এপ্রিল, ২০১৫

দুষ্টু তিনু ~ প্রকল্প ভট্টাচার্য্য

দুষ্টু তিনু (সম্পুর্ণ নির্দোষ এবং রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রচনা; শ্রী যোগীন্দ্রনাথ সরকারের কবিতা অবলম্বনে)
গড় গড় ঘড় ঘড় চৌত্রিশ সাল
তিন লাফে এল তিনু বদলাতে হাল।
ফাঁকি দিয়ে ট্যাঁকি ভরা এই তার কাজ;
মনে ভাবে, ভারি মজা করিবে সে আজ।
চেপেচুপে বসে তিনু হয়ে গদিয়ান,
কিছুদিন পরে তার স্বরূপ দেখান।
ছড়িগাছা ল'য়ে সিবিয়াই ঘাড়ে চড়ে,
মনে মনে হাসে তিনু, ভয় নাই ধড়ে।
হামা দিয়া সিবিয়াই গুটি গুটি যায়,
ঝুপ করে নেমে তিনু ঢুকিল ডেলোয়।
হেঁট হয়ে সিবিয়াই দেখে চারি ধার,
কোথা গেল তিনুগুলো, খোঁজ মেলা ভার!
রেগে জ্ব'লে জনগণ থর থর কাঁপে,
তিনু গুলো তর্‌ তর্‌ গদি 'পরে চাপে।
সিবিয়াই ভ্যাবাচ্যাকা, সারা গায়ে ঘাম,
মহা খুশি তিনুগুলো ধরিল লাগাম!
তারপরে গেল গোটা রাজ্য চুলোতে,
টাকা, সম্মান সব লুটোল ধুলোতে!

বুধবার, ১৫ এপ্রিল, ২০১৫

একটু খবর নিলে হয় - শুভাশিষ আচার্য্য

তোমাদের কস্টের বেঁচে থাকা মনে জাগায়
অনেক বিস্ময়।
টিভি তে খবরাখবর সকালের বাজার আর
সরকারে প্রত্যয়।
সোম থেকে শুক্র খাটুনি দিন শেষে এসি বা নন এসি
বাসে করে বাড়ি ফিরে বাচ্চার খুনসুটি
এবার একটা গাড়ি কিনলে হয়।
গাড়ির কত হবে ই এম আই সে আবার হিসাবের ব্যাপার
মাস গেলে স্যালারি ক্রেডিট তারপর একে একে সাবার।
সবকিছু ই এম আই জীবনের বীমা নিজস্ব ঘর আনন্দের পার্টি
অতটুকু পয়সা সেই বা আর কি কি সয়।
এদিকে সারাদিন ব্যস্ততা তার মাঝে লাইক ডিস্লাইক হয়নি
কত ছবি শেয়ার হয়নি নিজের কথা বলা হয়নি একেবারে জেরবার
কে জানে কে হল আভিমানি বা কেকে অভিমানিনী।
তোমাদের কস্টের বেঁচে থাকা মনে জাগায়
অনেক বিস্ময়।
ভালবাসা শেয়ার হয় বা নিদেন ই এম আই
একটু খবর নিলে হয়।

মঙ্গলবার, ১৪ এপ্রিল, ২০১৫

গোগ্রাস - সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়


পুঁচকে বলে পুঁচকে? একদম এইটুকুনটি। কোলের ছেলে অস্কার। তা বাপ-মায়ের আর দোষ কি? ছেলের চাঁদপানা মুখটি দেখে বাবা বলে বসলেন ছেলে আমার বড় হয়ে অমুক হবে। ব্যাস। ক্ষুদে ছেলে গোঁসা করে ঠিক করল আর বড় হবে না। তা একটু গোঁয়ার হয় বটে জার্মানরা। তাও আবার যেমন তেমন শহরের জার্মান নাকি? এ হলো ডানৎসিগ (Danzig)। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানির থেকে ছেঁটে নিয়ে যে শহরকে স্বাধীন বলে ঘোষনা করেছিল মিত্রপক্ষ সেই ডানৎসিগ। অস্কার আর বড় হয়নি। ওই তিন বছরেই আটকেছিলো। তিন বছরের জন্মদিনে বাবার দেওয়া একখানা টিনের ড্রাম পিটে পিটে তার যত ডানপিটেমো। টিন-ড্রাম উপন্যাসটি লিখেছেন গুন্টার গ্রাস। ছবিও হয়েছে এই উপন্যাস নিয়ে। অস্কারের মত গুন্টার গ্রাসের জন্মও ওই ডানৎসিগ শহরে।

ছবি এঁকেছেন, লিখেছেন, মূর্তি গড়েছেন। আরো কত কি যে করেছেন!! সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারও পেয়েছেন ১৯৯৯ সালে। ঘুরে বেড়িয়েছেন প্রচুর। শান্তি আন্দোলনের দূত হয়ে ভ্রমন করেছেন একের পর এক দেশ। ১৯৮৬ সাল। গায়ে সাদা ফতুয়া, পরনে নীল-সাদা চেক কাটা লুঙ্গি। মুখে বিড়ি। গ্রাস বাবু হেঁটে চলেছেন কলকাতার রাস্তায়। এ শহরে কাটিয়ে গেছেন বেশ কিছুদিন। কালীঠাকুর তাঁকে বড়ই আশ্চর্‍্য্য করেছিলো। ওই জিভ কাটা মূর্তি নিয়ে পরে লেখালিখি করেছেন গ্রাস বাবু। কলকাতায় তাঁর বেশ আপন আপন লাগত।
 

একটু বাঁয়ে হেলেই থাকতেন। যদিও সাদা কে সাদা, কালোকে কালো বলতে দ্বিধা করেননি কখনো। ইরান, ইজরায়েল, আমেরিকাই হোক, বা হাঙ্গেরিতে সোভিয়েত ট্যাঙ্ক, তাঁর কলমের গ্রাসে সব্বাই পড়েছে। দুই জার্মানি এক হওয়াও তাঁর মনঃপুত হয়নি। বলেছিলেন দুজনের আলাদা রাজনৈতিক অস্তিত্ব থাক, নইলে একজন অন্যজন কে গিলে খাবে। আলাদা স্বতন্ত্র সত্বায় বিশ্বাস করতেন, কিন্তু কাঁটাতারে কখনো বিশ্বাস করেন নি। চাইতেন সারা বিশ্বের সব জাতের মানুষ এসে জার্মানিতে থাকুক। মেলামেশা হোক, নতুন মানব সমাজ গড়ে উঠুক। জীবনের প্রথম দিকে নাৎসি ওয়াফেন এসএসের সৈনিক ছিলেন। ১০ নম্বর ট্যাঙ্ক ডিভিশানে থেকে বিশ্বযুদ্ধ শেষ করেন। সে কথা লুকোন নি। কিন্তু পরবর্তিকালে ভিলি ব্রান্ডটের সোসাল ডেমোক্রাসির একনিষ্ট সমর্থক। তা সত্বেও তিনি যেন ছিলেন আধুনিক জার্মানির বিবেক।

ঝুঁপো-গুঁফো হুঁকোমুখো দেখতে বটে সাহেব কে, কিন্তু রসবোধটি মোক্ষম। জীবনের শেষ দিকে এসে, আত্মজীবনী লেখায় হাত দিলেন যখন, সে লেখার নাম দিলেন – বাইম হাউটেন ডার ৎসুইগেল, মানে পেঁয়াজের খোসা ছাড়ানো। ভেবে দেখুন। ঝাঁঝে চোখে জল আসবে। রান্নার সময় সে খোশার খোশবাইতে পাড়া মাত হয়ে যাবে। আপনি একের পর এক ছাড়িয়েই যাবেন। কিন্তু ভেতরে? স্রেফ ফক্কা।

মানুষটা চলে গেলেন গতকাল। ৮৭ বছর বয়সে। পেঁয়াজ রেখেই গেছেন। পড়ে দেখতে পারেন। গোগ্রাসে।
 
** ছবি ইন্টারনেট থেকে প্রাপ্ত  

শুক্রবার, ১০ এপ্রিল, ২০১৫

গণিত বিজ্ঞান প্রযুক্তি এবং বাংলাদেশের মেয়ে ~ মুহম্মদ জাফর ইকবাল

১.

আমাদের সবারই ধারণা, আমাদের সব কিছু ভুল, আমেরিকা-ইউরোপের সব কিছু ঠিকঠাক। সব কিছু নিখুঁত। লেখাপড়া, জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিষয় হলে তো কথাই নেই, আমরা ধরে নেই পশ্চিমা দেশগুলোর সাথে আমাদের নিশ্চয়ই কোনো তুলনাই হতে পারে না। সেই আমেরিকার একটা পরিসংখ্যান হঠাৎ করে আমার চোখে পড়েছে, পরিসংখ্যানটি মেয়েদের নিয়ে। জ্ঞান-বিজ্ঞানে সেই দেশের মেয়েরা কেমন করছে তার পরিসংখ্যানটি দেখে আমার চোখ রীতিমতো ছানাবড়া হয়ে গেল। বিজ্ঞান-প্রযুক্তিতে তারা ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে কিন্তু তথ্যপ্রযুক্তি বা আরও স্পষ্ট করে বললে কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগে ১৯৮৫ সালে কোনো একটা মহাবিপর্যয় ঘটে যাবার পর সেই দেশের মেয়েরা হঠাৎ করে কম্পিউটার সায়েন্স পড়া ছেড়ে দিল এবং তারপর এই বিষয় মেয়েদের সংখ্যা কমতে শুরু করেছে এবং এখন সেই দেশে কম্পিউটার সায়েন্সে ছেলেমেয়েদের সংখ্যায় রীতিমতো আকাশপাতাল পার্থক্য।

১৯৮৫ সালে কী এমন ঘটনা ঘটেছিল যে কারণে সেই দেশের মেয়েরা কম্পিউটার সায়েন্স পড়া ছেড়ে দিল? সেই সময়টিতে আমি আমেরিকায় ছিলাম এবং মোটামুটিভাবে বিশ্লেষকদের সাথে আমি একমত, সেই সময়টিতে আসলে প্রথমবারের মতো পার্সোনাল কম্পিউটার বা পিসি বাজারে আসতে শুরু করেছিল। এর আগে কম্পিউটার ছিল বিশাল এবং সেগুলো বড় বড় অফিস বা ল্যাবরেটরিতে থাকত। কোনো মানুষ কল্পনাও করতে পারত না যে, সেটা ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্যে নিজের বাসায় পড়ার টেবিলে রাখা সম্ভব। বিশ্লেষকদের ধারণা, পার্সোনাল কম্পিউটার আসার সাথে সাথেই সেই দেশের মানুষেরা সেগুলো কিনতে থাকে।

সেই কম্পিউটার বিশেষ কিছু করতে পারত না। বলা যেতে পারে, সেগুলো ছিল মোটামুটি একটা খেলনা এবং আমেরিকান পরিবারে বাবারা সেই খেলনা নিয়ে খেলতে শুরু করল। বাবার সাথে সেই খেলনায় যোগ দিল তাদের ছেলেরা। যারা পার্সোনাল কম্পিউটার নামের সেই মূল্যবান খেলনাটি বাজারে বিক্রি করতে শুরু করল, তারা সেটাকে শুধুমাত্র পুরুষ এবং ছেলেদের খেলনা হিসেবে বিক্রি করতে শুরু করে এবং বাসার মেয়েটির যত আগ্রহই থাকুক তাকে সেটা নিয়ে খেলতে দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হল না। ছেলেরা ধীরে ধীরে কম্পিউটার নিয়ে সময় কাটাতে শুরু করল, সেটা খুলে ভিতরে দেখতে শুরু করল, যন্ত্রপাতি নাড়াচাড়া করতে শুরু করল এবং কিছুদিনের মাঝে দেখা গেল কম্পিউটার সংক্রান্ত বিষয়টিতে পুরুষদের একচেটিয়া রাজত্ব। মেয়েরা সেখানে পিছিয়ে পড়তে শুরু করেছে এবং তারা আর কখনও ছেলেদের সমান হতে পারেনি।

আমাদের দেশে বিষয়টা এত খারাপ হতে পারেনি। এই দেশে এসে আমি পদার্থবিজ্ঞানের মানুষ হয়েও দীর্ঘদিন কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগটি দেখেশুনে রেখেছি, আমি এই বিভাগ থেকে ছাত্রীদের ঝরে যেতে দেখিনি। বরং ছেলেদের মতো সমান আগ্রহ নিয়ে মেয়েদের এই বিষয়টি পড়তে দেখেছি। তারা হয়তো সংখ্যায় কম, কিন্তু তাদের আগ্রহ কম সেটি কিছুতেই বলা যাবে না।

সায়েন্স কিংবা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে মেয়েরা কেন কম তার কারণ খুঁজে বের করা মোটেও কঠিন নয়। জন্মের পর থেকে তাদের কানের কাছে সবাই ঘ্যান ঘ্যান করে বলে গেছে, 'বড় হয়ে তুমি ডাক্তার হতে পার, কিন্তু খবরদার ইঞ্জিনিয়ার হতে পারবে না'। কাজেই বড় হয়ে তাদের একটা অংশ নিজের অজান্তেই বিশ্বাস করে বসে থাকে যে, মেয়েদের ইঞ্জিনিয়ার হওয়া মনে হয় ঠিক নয়। তাদের অনেকে ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে ভর্তি হয়, কিন্তু সব সময়েই তাদের ভেতর এক ধরনের দুর্ভাবনা কাজ করে। চারপাশের পুরুষ মানুষগুলো তাদেরকে সজ্ঞানে হোক অজ্ঞানে হোক বোঝানোর চেষ্টা করে যে, তারা ভুল বিষয়ে চলে এসেছে। একজন পুরুষ যখন তার জন্যে স্বাভাবিক পরিবেশে কাজ করে, মেয়েটিকে তখন একটা প্রতিকূল পরিবেশে কাজ করতে হয়।

২.
যখন বয়স কম ছিল, তখন প্রচুর গল্প-উপন্যাস পড়েছি, প্রবন্ধের বইগুলো দূরে সরিয়ে রেখেছি। এখন বয়স হয়েছে, হঠাৎ করে আবিস্কার করেছি প্রবন্ধের বই পড়তে বেশ ভালো লাগে। কোনো একটি বিচিত্র কারণে মানুষের মস্তিস্ক কীভাবে কাজ করে সেই ধরনের বই পড়তে আমার খুব আগ্রহ হয় এবং সুযোগ পেলেই সেগুলো পড়ি। পুরুষ এবং মহিলার মস্তিস্কের মাঝে কোনো পার্থক্য আছে কী না সেটা জানার জন্যে আমি অনেক পরিশ্রম করেছি। পুরুষ এবং মহিলার চিন্তাভাবনার প্রক্রিয়াতে পার্থক্য আছে সেটা অনেকেই স্বীকার করেছেন। কিন্তু আমি কোথাও দেখিনি যে, ছেলেরা মেয়েদের থেকে ভালো গণিত, বিজ্ঞান বা প্রযুক্তি বুঝতে পারে সেই ধরনের কোনো তথ্য পাওয়া গেছে।

পৃথিবীর এক নম্বর বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে হার্ভার্ড। তার প্রেসিডেন্ট লরেন্স সামার্স একটা সভায় একবার বললেন, স্কুল-কলেজে ছেলেরা বিজ্ঞান এবং গণিত মেয়েদের থেকে ভালো বুঝতে পারে। সেটা বলার পর সবাই সেই প্রেসিডেন্টের পিছনে লেগে পড়ল; তার কাছে জানতে চাইল তিনি কোথায় সেই তথ্য পেয়েছেন। পৃথিবীতে কোথাও এটা বৈজ্ঞানিক তথ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত নয়। এটা হচ্ছে পুরুষশাসিত সমাজে মাথামোটা পুরুষদের এক ধরনের ব্যক্তিগত বিশ্বাস। এই পুরোপুরি অবৈজ্ঞানিক কথাটা বলার কারণে হার্ভার্ড প্রেসিডেন্টকে বরখাস্ত করেছিল। মজার ব্যাপার হচ্ছে, আমাদের দেশে আমরা পুরুষ মানুষেরা যদি নিরিবিলি কথা বলি এবং ছেলে এবং মেয়েদের বিজ্ঞান ও গণিতে আগ্রহ নিয়ে আলোচনা করি, তাহলে অবধারিতভাবে আমরা তাদের কথায় হার্ভার্ডের প্রেসিডেন্টের বক্তব্যের প্রতিধ্বনি শুনতে পাব।

বেশিরভাগ পুরুষ মানুষেরই মেয়েদের বিজ্ঞান কিংবা গণিতে দখলের ব্যাপারে এক ধরনের অযৌক্তিক নেতিবাচক ধারণা আছে। তাদের একটা প্রধান যুক্তি, গণিতের নোবেল পুরস্কারের সমমানের পুরস্কারের নাম ফিল্ডস মেডেল এবং কোনো মেয়ে কখনও ফিল্ডস মেডেল পায়নি। তারা এখন সেই যুক্তিটি দেখাতে পারবে না; কারণ সর্বশেষ ফিল্ডস মেডেলটি পেয়েছে মরিয়ম মির্জাখানি নামে একজন মেয়ে। মেয়েটি ইরানি বংশোদ্ভূত এবং এখন প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। কিন্তু সেটি আসলে খুব গুরুত্বপূর্ণ নয়; কারণ জ্ঞান-বিজ্ঞানে মেয়েরা ছেলেদের সমান সমান কৃতিত্ব দেখাতে পারছে কী না সেটা যাচাই করার আগে আমাদের প্রশ্ন করতে হবে মেয়েদের কি আমরা ছেলেদের সমান সমান সুযোগ দিতে পেরেছি কী না। আমরা পারিনি। একজন পুরুষ মানুষ তার জীবনের যে সময়টাতে তার ক্যারিয়ারটুকু গড়ে তুলেন, ঠিক সেই সময়াটাতে একজন মেয়েকে সন্তানের জন্ম দিয়ে সন্তানকে মানুষ করতে হয়। জ্ঞান-বিজ্ঞানে অবদান রাখার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়টাতে আমরা কখনও মেয়েদেরকে ছেলেদের সমান সুযোগ দিতে পারি না।

তাই আমরা যদি তাদেরকে ছেলেদের সমান সংখ্যক হিসাবে না পাই তাহলে অবাক হবার কী আছে? যখন একজন মেয়েকে ঠিক একজন ছেলের সমান সুযোগ দিব, তখনই তাদের দুজনের সাফল্যের তুলনা করার একটা সুযোগ পাব, তার আগে নয়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা করার কারণে আমাকে অসংখ্যবার শিক্ষক নিয়োগের কমিটিতে বসে প্রার্থীদের ইন্টারভিউ নিতে হয়েছে। আমার সাথে বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় বড় অধ্যাপকরা থেকেছেন এবং তাদের কথাবর্তা শুনে মাঝে মাঝে আমার হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। একবার একজন মেয়ে প্রার্থী খুব চমৎকার ইন্টারভিউ দেওয়ার পর আমি যখন তাকে শিক্ষক হিসেবে নেওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করেছি, তখন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যাপক আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ''এই মেয়ের বিয়ে হয়নি।"

আমি অবাক হয়ে বললাম, ''তাতে সমস্যা কী?''

''কয়দিন পর প্রেম করবে, বিয়ে করবে।''

আমি আরও অবাক হয়ে বললাম, ''নিশ্চয়ই করবে। সমস্যা কোথায়?''

''তখন সমস্যা শুরু হবে। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই বাচ্চা হবে। ম্যাটার্নিটি লিভ দিতে হবে।''

আমি বললাম, ''দিতে হলে দিব।''

''বাচ্চা জন্মানোর পর আসল মজা টের পাবেন। আজ বাচ্চার জ্বর, কাল বাচ্চার ফ্লু, পরশু চিকেন পক্স। এই মেয়েকে ডিপার্টমেন্টে পাবেনই না।''

আমি অবাক হয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যাপকের দিকে তাকিয়ে রাইলাম। তিনি আমাকে পরামর্শ দিলেন; বললেন, ''মেয়েদের টিচার হিসেবে নেবেন না। একটা ছেলে টিচারের অর্ধেক সার্ভিসও পাবেন না।''

সেই গুরুত্বপূর্ণ অধ্যাপকের প্রত্যেকটা কথাই সম্ভবত সত্যি; কিন্তু আমি সেই কথায় বিন্দুমাত্র গুরুত্ব দেইনি। সন্তানের জন্মকাল এবং লালনপালন প্রক্রিয়ায় ব্যস্ত থাকার কারণে একজন মেয়ের কাছ থেকে অর্ধেক সার্ভিস না পেলেও মেয়েরা অনুগ্রহ করে সন্তান জন্ম দেওয়ার এই দায়িত্বটা পালন করছে বলে এই পুরো মানব সভ্যতার জন্ম হয়েছে এবং পৃথিবীটা টিকে আছে। আমার মায়ের প্রতি আমার কৃতজ্ঞতায় শেষ নেই যিনি সন্তান জন্ম দেওয়ার যন্ত্রণা এবং ঝামেলায় ত্যক্তবিরক্ত হয়ে আমাকে জন্ম দেওয়া থেকে বিরত হননি। তাহলে এই পৃথিবীটাই আমার দেখা হত না।

বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভাগীয় প্রধান হিসেবে কাজ করার সময় আমার মেয়ে সহকর্মীদের জীবনের সন্তানসংক্রান্ত বাড়তি কাজের জটিলতা দেখে আমার মনে হয়েছে, সব বিশ্ববিদ্যালয়েই ছোট শিশুদের দেখেশুনে রাখার জন্যে একটা চমৎকার ডে কেয়ার থাকা দরকার। শুধুমাত্র এই সেবাটুকু দিতে পারলেই আমাদের মেয়ে সহকর্মীদের জীবনটুকু অনেকখানি সহজ হয়ে যেতে পারত।

৩.
আমাদের খুবই সৌভাগ্য যে, আমাদের দেশে মেয়েদের লেখাপড়ায় যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হয়। নিচু ক্লাসে ছেলে এবং মেয়ের সংখ্যা প্রায় সমান সমান। ছেলেমেয়েরা যখন বড় হতে থাকে তখন মেয়েদের সংখ্যা ছেলেদের সংখ্যা থেকে কমতে থাকে। অনেক মা-বাবাই তাদের মেয়েদের লেখাপড়ার পিছনে টাকা-পয়সা খরচ করতে আগ্রহ দেখান না। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তাদেরকে বিয়ে দিয়ে বিদায় করে দিতে অনেক বেশি আগ্রহ দেখান। আমি যখনই ছাত্রীদের সামনে কথা বলার সুযোগ পাই, তখনই অত্যন্ত চাঁছাছোলা ভাষায় তাদেরকে বলি, ''খবরদার, লেখাপড়া শেষ করে একটা চাকরি নেবার আগে কখনও বিয়ে করবে না।''

আমার ধারণা, অনেক বাবা-মা তাদের মেয়েদের মাথায় এই ধরনের বদবুদ্ধি ঢুকিয়ে দেবার জন্যে আমার উপরে খুবই বিরক্ত হন।

আমি মোটামুটি নিশ্চিতভাবে জানি, আমার আজকের এই লেখাটি পড়ে অনেক পুরুষ মানুষই খুব বাঁকা করে একটু হাসবেন এবং তার পাশে বসে থাকা আরেকজন পুরুষ মানুষের সাথে মেয়েদের নিয়ে কোনো এক ধরনের অসম্মানজনক কথা বলবেন এবং মেয়েদের নিয়ে কোনো এক ধরনের কৌতুক করবেন। কেউ কেউ তাদের ব্যক্তিগত জীবনের উদাহরণ দিয়ে প্রমাণ করার চেষ্টা করবেন, গণিত, বিজ্ঞান কিংবা প্রযুক্তিতে মেয়েরা আসলে দুর্বল– মুখে যত যাই বলা হোক। গণিত, বিজ্ঞান কিংবা প্রযুক্তি মেয়েদের বিষয় নয়– মেয়েরা লেখাপড়া করুক, সেখানে তাদের কোনো আপত্তি নেই– কিন্তু গণিত, বিজ্ঞান বা প্রযুক্তির মতো বিষয়গুলো ছেলেদের জন্যেই ছেড়ে দেওয়া বুদ্ধিমানের কাজ।

আমি আশা করছি, আমার এই লেখাটি অনেক মেয়ের চোখে পড়ুক। তার কারণ, আমি নিশ্চিতভাবে জানি আমরা আমাদের দেশের মেয়েদের ছেলেদের সমান গুরুত্ব দিই না। বেশিরভাগ মেয়েই স্বীকার করবে তাদেরকে তাদের পরিবারের ছেলেদের সমান সুযোগ দিয়ে বড় করা হয়নি। তারা অভিযোগ করে বলবে যে, নানা রকম বিধি-নিষেধ দিয়ে তাদের হাত-পা বেঁধে রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। তাদেরকে বারবার বোঝানো হয়েছে, মেয়ে হয়ে জন্ম নিয়েছে বলে তাদের গাণিতিক বা বৈজ্ঞানিক বুদ্ধিমত্তা কম কিংবা বলা হয়েছে, মেয়ে বলে তাদের জীবনে গণিত বা বিজ্ঞানের প্রয়োজন নেই। তাদের বাবা-মা বলেছেন; তাদের ভাইয়েরা বলেছেন; চাচারা বলেছেন; এমনকি তাদের স্কুলের অনেক শিক্ষকও এই কথা বলে এসেছেন।

আমি সবাইকে মনে করিয়ে দিতে চাই যে, একটা ছেলে যেটুকু পারে একটি মেয়েও ঠিক সেটুকু পারে। সত্যি কথা বলতে কী, একটা মেয়েকে তার জীবনে আরও অনেক কিছু করতে হয় যেগুলো একটা ছেলেকে কখনও করতে হয় না। সেই হিসেবে একই জায়গায় পৌঁছানো একটা ছেলে এবং মেয়ের ভেতরে মেয়েটিকে অনেক বেশি কৃতিত্ব দিতে হবে। আমি বহুদিন থেকে এই দেশের ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের সাথে আছি। এই দেশের অলিম্পিয়াড আন্দোলনের সাথে যুক্ত থাকার কারণে আমার খুব চমৎকার কিছু অভিজ্ঞতা হয়েছে। আমি অনেকবার আমার চোখের সামনে সাধারণ একটি শিশুকে অসাধারণ একজন গণিতবিদ হয়ে উঠতে দেখেছি। যে মেয়েটি ভয়ে ভয়ে আমাকে বলেছে, 'স্যার, আমি কিছু পারি না', তাকে আমি বলেছি, 'অবশ্যই তুমি পারবে, কে বলেছে তুমি পার না'– সেই মেয়েটি যখন আমার কথা বিশ্বাস করে। তখন দেখতে দেখতে সে আত্মবিশ্বাসহীন একজন মানুষ থেকে বিস্ময়কর আত্মবিশ্বাসী একজন গণিতবিদ কিংবা কম্পিউটার প্রোগ্রামার হয়ে উঠেছে। পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয় তাদেরকে নেবার জন্যে রীতিমতো কাড়াকাড়ি শুরু করেছে।

তাই মাঝে মাঝেই আমার মনে হয়, আমার যদি সুযোগ থাকত তাহলে আমি আমাদের দেশের সব ছোট ছোট মেয়ের কাছে গিয়ে তাদের বলে আসতাম, বিজ্ঞান, গণিত কিংবা প্রযুক্তি মেয়েদের বিষয় নয়, সেটি মোটেও সত্যি কথা নয়। সত্যি কথা হচ্ছে, লেখাপড়ার ব্যাপারে একজন ছেলে যেটুকু পারে একটি মেয়েও ঠিক ততটুকু পারে। যদি প্রয়োজন হয় আর চেষ্টা করে তারা আরও বেশি পারে।

আমি সব সময় স্বপ্ন দেখি, আমাদের দেশের মেয়েরা আত্মবিশ্বাসী হয়ে বিপুল সংখ্যায় গণিত, বিজ্ঞান, প্রযুক্তিতে এগিয়ে এসে সারা পৃথিবীর একটা ভুল ধারণা ভেঙে দেবে।

মুহম্মদ জাফর ইকবাল
০৮-০৪-২০১৫

​ হুমায়ুন আজাদ ~ রেজাউর রহমান খান

একজন লেখক,কবি, বিদ্বান এবং ভাষাবিদ ।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক ।৭০ টির বেশি বই লিখেছেন , বাংলাদেশ সরকার তাকে মরণোত্তর " একুশে পদক" দিয়েছিলেন ।
কবি হিসেবে লিখা শুরু করেন তিনি ।তারপরে সংবাদপত্রে "কলাম লেখক"।আশির দশকে (১৯৮০ সাল)তার ক্ষুরধার লিখনিতে সামাজিক এবং রাজনৈতিক অবিচার,অনিয়ম এবং দুর্নীতি নিয়ে অত্যন্ত নির্মম ভাষায় লিখেছিলেন তিনি।।
তার সব থেকে খ্যাতনামা বই "নারী"...যা বাংলাদেশ সরকার নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল ।
"পাক সার জামিন শাদ বাদ" ...লিখে তিনি উগ্রপন্থিদের কোপানলে পড়লেন । "মুরতাদ" ঘোষণা করা হল তাকে ....তার বিরুদ্ধে অনেক মিছিল মিটিং হল ।
।প্রায় এক দশক আগে ২৭ ফেব্রুয়ারি,২০০৪ সালে বইমেলা থেকে বাসায় ফিরবার পথে সন্ধ্যার সময়ে জনসমুদ্রের ভিড়ের মাঝেই তাকে ধারাল অস্ত্র দ্বারা কোপান হয় ।সেই ভয়াবহ ক্ষত নিয়ে কিছুদিন বেঁচে থাকলেও জার্মানিতে এর কিছুদিন পর মারা যান ।(সেই দুঃস্বপ্নের ভীতি ,হত্যাযজ্ঞের বিভীষিকা কাটতে না কাটতেই সেই বইমেলা চত্বরেই প্রকারান্তরে ,একই সময়ে একই দিনে একই কায়দায় হত্যা করা হল ব্লগার অভিজিৎকে) ।
হুমায়ুন আজাদ মারা গেলেন ।ধর্ম , বিশেষ করে ইসলাম ধর্ম ...তিনি জীবিত অবস্থায় বিশ্বাস করেন নি।প্রায় তিনি এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্ম নিয়ে ভিন্ন মত পোষণ করতেন ।
নিজ গ্রাম বিক্রমপুরের "রাড়িখালে' নিয়ে যাওয়া হল।।বিখ্যাত গ্রাম, যেখানে আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসু জন্মগ্রহন করেছিলেন। গ্রামবাসী তাকে "মুরতাদ'' মনে করায় গ্রামের কবরস্থানেও স্থান হল না তার ।যদিও ঐ গ্রামের কবরস্তানটি তারি কোলকাতার চাচির উপহার । ঐ গ্রামে কোন কবরস্থান আগে ছিল না।
অবশেষে নিজ ভিটায় তাকে দাফন করা হল।কবর টি বাঁধানো ...একটি বইয়ের মতো ।
ধর্মীয় উগ্রবাদ বাংলাদেশে ছিলনা ।কিন্তু আস্তে আস্তে এর বিস্তার লাভ করছে ...সুস্থ সামাজিক বা রাজনৈতিক ব্যবস্থা এবং বিচার না থাকায় ।আইনের শাসন ও নেই ।ধর্মীয় কার্ড খেলছে রাজনৈতিক দলগুলি ...অন্যদিকে আমরা আস্তে আস্তে মানুষ থেকে অমানুষ এ পরিনত হচ্ছি ।
 



বৃহস্পতিবার, ৯ এপ্রিল, ২০১৫

ফুলমতি ~ সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়

আমার ব্যক্তিগত জিনিসপত্রের সংখ্যা খুব একটা বেশী নয়। কিন্তু যে কটি আছে, তাদের প্রত্যেকটার একটা করে নাম আছে আলাদা আলাদা। কয়েকখানা নাম লোকজন জানে বটে, কিন্তু বেশীরভাগের নামই আমি বাদে দ্বিতীয় ব্যক্তির অজানা। এই যেমন ধরুন গিয়ে নিকুঞ্জবিহারি, সে হলো আমার ক্যামেরা। নিকষ কালো ক্যামেরার শরীরে লেখা রয়েছে নিকন। সেই দেখেই নাম দিয়েছি নিকুঞ্জবিহারি।
আমার মোবাইল ফোনের নাম আনন্দরূপ, ঘড়ির নাম টুনটুনি , মানিব্যাগের নাম বটুকেশ্বর, কলমের নাম কালিকিঙ্কর, যে ব্যাগ নিয়ে আপিস যাই তার নাম কল্পতরু। কল্পতরু নামের সার্থকতা আমার সহকর্মীরা কিছুটা জানেন। আরো আছে দু এক খানা এমন বস্তু। যেমন ধরুন আমার সাধের কিটোস পাদুকা। তার নাম দিয়েছি হিউয়েন সাং। এই মহাজ্ঞানী পর্যটকের প্রতি কোন অসন্মান প্রদর্শন আমার উদ্দেশ্য নয় । ছোটোবেলায় ইতিহাস বইতে দেখেছি, অবিকল আমার কিটোসের মত দেখতে একজোড়া পাদুকা হিউয়েন সাং এর পায়ে। আমার অতি প্রিয় সুইস ফৌজি ছুরির নাম ঘচাং-ফু। মোবাইল ফোন আর ল্যাপটপে দুটোতেই লাগানো যায় এমন একখানা ৩২ গিগাবাইটের ফ্ল্যাশড্রাইভের নাম কিম ফিলবি। এম আই সিক্সেও আছেন, আবার কেজিবি তেও আছেন। কিন্তু যদি বলেন এদের মধ্যে আমার সব থেকে প্রিয় বস্তু কোনটা , আমি এক মিনিটও না ভেবে উত্তর দেবো ফুলমতি। ফুলমতি হলো আমার অতি প্রিয় পুরোনো ফুল-ফুল ছাপের লুঙ্গি। মাঝে মাঝে সে পাল্টায় বটে, কিন্তু নাম একই থাকে।
হিউয়েন সাং
গেল বছর আমার ভাতৃ-ভগ্নীস্থানীয় জনাচারেক ভরা গ্রীষ্মে আমার বাড়িতে পায়ের ধুলো দিয়েছিলো। তারা বাইরে আমাকে সাধারনত যেমন দেখেছে, ভেবেছে আমি তেমনই। বর্তমান পশ্চিমবাংলার শাসক দলের সমালোচনা করি বলে, আমার পোষাক-পরিচ্ছদও যে নেহাৎ "সাজানো ঘটনা", এইটা তারা আন্দাজ করতে পারেনি। শেষে যখন ট্যাক্সি থেকে দেখতে পেল আমি রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে আছি গলির মুখে, উর্ধাঙ্গে একখানা ধুদ্ধুড়ে গেঞ্জি আর নিম্নাঙ্গে ফুলমতি, তারা যারারপরনাই বিস্মিত হলো। আমাকে দাঁড় করিয়ে মোবাইলে ছবি তোলা হলো। "লুঙ্গি ম্যান" বলে সে ছবি সঙ্গে সঙ্গে ছড়িয়েও পড়ল হোয়াটস্‌অ্যাপ মারফত। যাই হোক বোনেদের তর্জনগর্জনে তখনকার মত ফুলমতি আলনার বনবাসে গেল। পাজামা গলিয়ে এলাম। বোন-জঙ্গলের রাজত্বে নিরীহ মানুষের স্বাধীনতা খর্ব হয় একথা কে না জানে? সন্ধ্যে ঢলার মুখে জমাটি আড্ডা মাটি করে "কাল আবার অফিস" দোহাই ঠেলে তেনারা বিদায় নিলেন। আড্ডা ভাঙ্গার আঘাতে মনটা খারাপ হয়ে গেল। ঢিকির ঢিকির পায়ে সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠে আলনা থেকে ফুলমতিকে নামালাম। আহা, লুঙ্গির আরাম আর কিছুতে নেই। মন খারাপে মলম লাগল কিছুটা হলেও।

লুঙ্গির পক্ষে-বিপক্ষে অনেক কিছু বলা যায়। আমি অবিশ্যি প্রানে ধরে বিপক্ষে বলতে পারবোনা। লুঙ্গির তিন ফুটের ঘের আমার স্বাধীনতা। সারা দিনের কাজকম্ম, দৌড়োদৌড়ি, হাঁপাহাঁপি, বকাঝকার থেকে দিনের শেষে লুঙ্গিটি গলালেই শারীরিক স্বাচ্ছন্দ আর মানসিক মুক্তি। বাড়তি পাওনা, লুঙ্গি পরে অস্থানে-কুস্থানে চুলকু করতে বড্ড সুবিধে। মোটের ওপর ভদ্দরনোক সুলভ বস্তু নয় এটি। এই ধরুন না, আপনি গরম কালের সন্ধ্যেবেলা কাজকম্ম সেরে বাড়ি ফিরেছেন, তার পরে গায়ে দু ঘটি জল ঢেলে, চুলে টেরি কেটে, কানের গোড়ায় হালকা পাউডার (কাল ভেদে ডিও) ছড়িয়ে ধোপ দুরস্ত পাঞ্জাবি পাজামা পরে নিজের সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে প্রবেশ করছেন, অথবা টুকটুকে লাল টি শার্ট আর বারমুডা পরে স্টার স্পোর্টস ফোরে আর্সেনাল-চেলসির খেলা দেখতে বসেছেন। টি শার্ট অবশ্য নীল হতেও বাধা নেই। কিন্তু কেন? আমাদের আর্সেনাল থাকতে কোন শা.... । এখানেই লুঙ্গির সার্থকতা। লুঙ্গি পরলে আপনার সামাজিক শ্রেনীসচেতনতার ষষ্টিপূজো হয়ে যায়।আবার অন্যদিকে খিস্তি টিস্তি মারলে লোকে তেমন করে ব্যাঁকা চোখে তাকায়না। এই কারনেই আমার বাড়ির মহিলারা লুঙ্গি নিয়ে মাঝে মধ্যেই ঠারে ঠোরে বুঝিয়ে দেন, বস্তুটা সুবিধের না। অনেক কাল আগে একবার মধ্যরাত্রে দুই মাতাল চেল্লামেল্লি করে সবার ঘুম ভাঙ্গিয়ে পাড়া মাথায় করছিলো। খালি গায়ে লুঙ্গিতে মালকোঁচা মেরে, হাতে একখানা কাটারি নিয়ে রাত আড়াইটের সময় তাদের তাড়া করেছিলাম। দেখলাম, মাতাল তাড়ানো, আর হাতে প্রানঘাতী অস্ত্রর চেয়েও অন্দরমহলে বেশী আপত্তির কারন হয়ে উঠলো আমার মালকোঁচা মারা লুঙ্গি। তবে কিনা আজকাল, বাড়িতে বয়সে সবচেয়ে কম যে মহিলাটির, তিনি রীতিমত প্রকাশ্যে লুঙ্গির বিপক্ষে সোচ্চার। তাঁর বাবা যেন লুঙ্গি পরে কোনো মতেই বন্ধুবান্ধবের সামনে না হাজির হয়, সে ব্যাপারে তিনি সর্বদা সচেতন। 

কবে থেকে লুঙ্গি গলিয়েছি ঠিক মনে নেই। স্কুলের শেষ দিকে থাকতেই মনে হচ্ছে যতদুর। কিন্তু প্রথম দিন থেকেই এই চিত্তজয়ী পোষাক আমাকে পেড়ে ফেলেছে এক্কেরে। ঢিলেঢালা বস্তু। গায়ে কামড়ে লেপ্টে যায়না। ইস্ত্রি করার ঝামেলা নেই, পরার ঝামেলাও যৎসামান্য। গলিয়ে নিন্‌, গিঁট মারুন, গুঁজেনিন। ৩ থেকে ৪ সেকেন্ডে লুঙ্গি পরা যায়, কেউ এই গতিতে পেন্টুল পরতে পারলে লুঙ্গি পরে বাড়ির বাইরে বেরোনো ছেড়ে দেবো কথা দিচ্ছি। লুঙ্গি শুনেই বুঝবেন আমি লোকটা তেমন উচ্চকোটির কেউকেটা গোছের নই। খোঁজ নিয়ে দেখুন, নেতাজী, রবিঠাকুর, সত্যজিত রায়, সৌমিত্র চাটুজ্যে মায় সৌরভ গাঙ্গুলীও লুঙ্গী পরেন না। উত্তমকুমার, জ্যোতিবাবুর নাম এড়িয়ে গেলাম, কারন এনাদের লুঙ্গি পরা ছবি আমি দেখেছি, তবে কিনা সে হলো বেশ বাহারের সিল্কের লুঙ্গি। আমার লুঙ্গি এনাদের চেয়ে আলাদা। সুতির ছাপা লুঙ্গি। তবুও কিভাবে কে জানে, ভুলটুল করেই হয়ত, আমাকে কর্মপলক্ষে ভারতবর্ষের সীমানা পেরতে হয়েছে। এরকমই একখানা হিমালয়প্রমান ভূলের ফলে আমাকে সিঙ্গাপুর যেতে হয়েছিল। বুকটুক বাজিয়ে বললুম – সিঙ্গাপুর যাচ্ছি। অভিজ্ঞ লোকজন বিদঘুটে কিছু নাম বললেন, মুস্তাফা, অর্চার্ড রোড, সেন্তোসা আরো সব খোদায় মালুম কি সব। বন্ধুবান্ধব বলল "পেট ভরে কলা খাস আর দু ছড়া আনিস"। আমার বাবা অল্প কথার মানুষ। যাবার আগে পিতৃবাক্য পেলুম - "ও তল্লাটে ভালো লুঙ্গি পাওয়া যাবার কথা"। বললে আপনার পেত্যয় হবে কিনা জানিনা, কিন্তু ঘটনা বস্তুতপক্ষে এটাই। মালয়-বর্মা অঞ্চলে প্রচুর লুঙ্গির চল। অবিশ্যি আগে চলত বলাই ভালো, গাঁ-গেরামে হয়ত এখনো চলে, তবে আমি ওনাদের গাঁয়ে তেমন ঘুরিনি, তাই বলতে পারবোনা। সিঙ্গাপুরের ঝাঁ-চকচকে রাস্তাঘাটে লুঙ্গি কিনিনি বটে, কিন্তু দেখেছি অনেক বিক্রি হতে। তবে কিনা দামের দিকে তাঁরা বেশ উচ্চকোটির। ওই দামের লুঙ্গি পরলে আমার অভ্যাসের শ্রেনীচরিত্র বদলে যেতে পারে।

লুঙ্গি নিয়ে দু একখানা বিপত্তি যে আমার হয়নি এমনটা হলফ করে বলব না। এই ধরুন না, একবার গলিতে ক্রিকেট খেলা হচ্ছে, আর আমি যথারীতী লুঙ্গি পরে দাঁড়িয়ে আছি। গলির শেষ প্রান্তে একটা বড় নর্দমা, চওড়া গোছের। গলির শচীন মেরেছে তুলে ছক্কা, বল পড়ল নর্দমার ওপারে। ওয়াসিম আক্রম হেঁকে বলল "বলটা দেবে?"। আমিই সবচেয়ে কাছে ছিলুম। বলটা তুলে ফেরত দেবার জন্যে নর্দমা পেরিয়ে ওপাশে যাওয়া দরকার। লাফ মারলুম। দেখলুম আমার পা নর্দমার ওই প্রান্তে প্রায় পৌঁছে গেছে, এমন সময় ব্যাপারটা হলো। লুঙ্গির ঘেরে আটকে গেল পা। ওপার ওবধি পৌঁছলো না। তলপেটে কেমন যেন... কানের দুপাশে হুহু শব্দ। তার পরেই ঝপাং। আফ্রিদি আর দ্রাবিড় এসে টেনে তুললো। কুম্বলে, মালিক, সৌরভ সমেত বাকিরা খ্যাঁক খ্যাঁক করে দাঁত বের করে হাসল। পড়ে যাওয়ার শারীরিক ব্যাথা-যন্ত্রনা যেতে হপ্তা খানেক লেগেছিলো, মানসিক ব্যাথা এখনো আছে।

আমার বাবা চাকরির শেষের দিকে এসে একখানা স্কুটার কিনেছিলেন। আমিই চালাতাম। গাড়ি হামারা তেল তুমহারার ভিত্তিতে কেনা। মানে, স্কুটারের তেল-মোবিলের খরচা, সারাই-ঝাড়াইয়ের খরচা সব আমার। তখন ছাত্র পড়াই, হাতে কিছু পয়সাকড়ি আছে। কিন্তু বাঁচানোর চেষ্টাও আছে তার সঙ্গে। মাসে দু মাসে একবার করে স্কুটারের খোল-নলচে খুলে ধোয়ামোছা করে তেল রগড়ে আবার সব ফিট করে দিতাম নিজেই। মিস্তিরিকে দিলে ৩০০ টাকা চেয়ে বসবে। এই সব কাজ কম্ম করতে লুঙ্গির জুড়ি নেই। মালকোঁচা মেরে লুঙ্গি পরে সেই রকম এক দিন স্কুটার আবার জোড়া দিয়েছি। লাথি মেরে ইঞ্জিন চালিয়ে চড়ে বসেছি, এক পাক ঘুরে আসবো বলে। এদিকে স্টার্ট করতে গিয়ে কখন মালকোঁচা খুলে লুঙ্গি পূর্ণ দৈর্ঘ্যের হয়ে গেছে খেয়াল করিনি। খেয়াল করলাম থামার সময়। ডান পা ব্রেকে রেখে, বাঁ পা বাড়িয়ে নিচে রাখতে গিয়ে দেখি পা পৌঁচচ্ছে না। আবার সেই লুঙ্গির ঘেরের গেরো। না থেমে স্পিড বাড়িয়ে আরেক চক্কর ঘুরে এলাম। আবার দেখি সেই কেলো। কিছুতেই পা যাচ্ছে না। আমাদের পাড়ার লোকজন ভারি পরোপোকারি। কয়েক পাকের পর দু চার জন শুভানুধ্যাইয়ী দেখলাম উপদেশ দিতে শুরু করেছেন। একজন বললেন মালকোঁচা মেরে নাও। হাতে স্কুটারের হ্যান্ডেল, হাত ছাড়া কিভাবে মালকোঁচা মারবো সে বিষয়ে তিনি কিছু বলেন নি। আর একজন আরো দূরদর্শী, বললেন পড়ার সময় ছোট্ট করে লাফ মেরে দিও, তাতে স্কুটার ঘাড়ের ওপর পড়বে না। এনার ওপর আমার এখনো রাগ আছে। একদিন না একদিন ঠিক ল্যাং মেরে ফেলে দেবো রাস্তায়। ধোয়াপোঁছা খোলাখুলির সময় স্কুটারে বেশী তেল রাখতাম না, অযথা নষ্ট হবে বলে। স্কুটার না থামালে তেল শেষ হবে, আর আমিও পড়ে যাবো। আবার থামলেও পড়ে যাবো। এই করতে করতে আরো কয়েক চক্কর হয়ে গেল। শেষের হেনস্থার কথা আর বলছিনা। তবে তেল খতম – খেল খতম, এরকম ধরে নিন। বাঁ পায়ের আধখানা চেঁচে যাওয়া, কপালে একটা বড় আকারের আলু, ডান হাতের মচকানো কবজি, মালাইচাকির ওপরে ঢিপলি, পাঁজরায় ঘিনঘিনে যন্তন্নার সঙ্গে রাস্তায় শুয়ে শুয়ে আবিস্কার করলাম লুঙ্গিটা স্কুটারের পাদানি তে লটকে ঝুলছে। আমার থেকে ফুট চারেক দুরে।    

ওই একবারই। খুলে যাবার ইতিহাস আর নেই। তবে না খোলার ইতিহাস আছে। অবিশ্যি না খোলার কারনটা ঘোর বস্তুতান্ত্রিক। খুলেই কই। সেবার কলকাতায় এলেন ফিফার প্রেসিডেন্ট, আমাদের মোহনবাগান-ইষ্টবেঙ্গল খেলা দেখবেন মাঠে বসে। এদিকে ভাগ্যের বিড়ম্বনায় আমি তখন সাতসমুদ্দুর তেরো নদীর পারে কোন চুলোর সান-ফ্রান্সিস্কোর উপকন্ঠে ফ্রিমন্ট বলে একটা ছোটো শহরে। সেদিন আবার পয়লা বৈশাখ। মাঝ রাতে উঠে ল্যাপটপ খুলে আপডেট দেখছি। মাঝে মধ্যে বাড়িতে ফোন। লোটারা প্রথমেই গোল করে এগিয়ে গেল। একে রাত্রি জাগরন। তার ওপর গোল হজম। সব  মিলিয়ে ঝিমিয়ে গেলাম। কিন্তু গপ্প বাকি ছিলো। মোহনবাগান দু খানা গোল করে খেলাটা জিতল, আর সেই ভোর রাত্রে আমি পেগলে গেলুম। পয়লা বৈশাখের এমন ভোর আমার জীবনে খুব কম এসেছে।  

সপ্তাহান্তের সাফ-সুতরোর দিন আজকে, ডাঁই করে রাখা আকাচা জামাকাপড় নিয়ে গিয়ে বেসমেন্টে ঢোকাতে হবে। গেলহপ্তায় কাচিনি। বড় গামলা ভর্তি জামাকাপড় নিয়ে বেসমেন্টে কাচতে গেলুম। সেখানে অতিকায় সব ধোয়ার যন্ত্র। যন্তর চলতে আরম্ভ করতেই খেয়াল করলুম কেলেঙ্কারি করেছি। আমার যাবতীয় প্যান্ট চলে গেছে ভেতরে। পরে বেরোবার কিছু নেই। দু পাঁচ মিনিটের দ্বীধার পর মাথায় উলের টুপি, গায়ে ছেয়ে রংয়ের জ্যাকেট, নিচে লালচে ফুলমতি আর পায়ে বাদামী স্নিকার পরে আমি ফ্রিমন্ট শহরের রাস্তায় বেরিয়ে এলাম। নেহাত বিদেশ, রাস্তায় কুকুর নেই এক গাদা। কিন্তু পুলিস তো আছে। আমেরিকায় টিনটিনের সেই ছবিটা মনে আছে? যেখানে গাঁইয়া পোষাক পরে থাকার জন্যে পুলিস টিনটিন কে জরিমানা করেছিলো? আমাকে জেলেও দিতে পারে, দৃশ্য-আতংকবাদ ছড়ানোর অপরাধে। মিনিট দশেক হেঁটে বাজারে ঢুকলুম। শুনেছিলাম আমেরিকানরা সাধারনতঃ অদ্ভুত পোষাক পরিচ্ছদ দেখলে ড্যাবা ড্যাবা চোখ করে চেয়ে দেখে না। কে বলেছিলো কে জানে? ডাহা মিথ্যে। ওই সাত-সকালে বহুজোড়া চোখের কৌতুহলি দৃষ্টির সামনে দিয়ে বাজার দোকান সারলাম। একদম শেষে দাম দিচ্ছি যখন কাউন্টারে, দেখি আমাদেরই এক দেশোয়ালি মানুষ। কিছুক্ষন দেখলেন আমার দিকে, তার পরে শুধলেন – "ইন্ডিয়ান?" আমি এক গাল হেসে ওপর নিচে মাথা নেড়ে সায় দিলাম। খুচরো ফেরত নিয়ে চলে আসছি, দেখি ভদ্রলোক পাশের কাউন্টারে তাঁর দেশোয়ালি ভাইকে বলছেন – "দ্যাখলা? কুনো সেন্স নাই"।

আমেরিকায় টিনটিন
যাই হোক, এসব ত গেল বিপত্তির কিস্যা। লুঙ্গি নিয়ে আমার ভালো অভিজ্ঞতার সংখ্যা অনেক বেশী। বাড়িতে একা আমি নই, লুঙ্গি পরেন আমার বাবাও। বাপ-ব্যাটায় গ্রীষ্মের রাতে লুঙ্গি পরে আরাম করে বসে টিভি চালিয়ে বিদেশী ফুটবল দেখি। আমার কন্যা তার দাদুর কোলে উঠে বসে, আর সেই ছোট্ট বেলা থেকে দুই পায়ের ভাঁজে থাকা লুঙ্গির ঝুলি তার ইজি চেয়ার হয়। সেই থেকে সে তার দাদুর আদরের "পুঁটলি দিদিভাই"। আমার কন্যা তার বাবাকে লুঙ্গি পরা অবস্থায় বন্ধুদের কাছে যেতে দিতে নারাজ। খুব আপত্তি। কিন্তু একটা ছোট্ট ঘটনা বলি। ট্রেনে করে কোথায় একটা যাচ্ছি, সে মেয়ের একা একা ট্রেনের বাঙ্কে শুতে ভয় করছে রাত্রি বেলা। আমি কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে রইলাম। শেষে আধ ঘুমন্ত চোখে বলল "তোমার লুঙ্গিটা দাও"। ভাগ্যি ভালো আমি ট্রেনে জিন্স পরে ছিলাম, কিন্তু বেরোবার আগে কেচে পাট করে ফুলমতিকে ব্যাগে ঢুকিয়েছিলাম। সেটা বার করে ওকে দিতেই গায়ে হালকা করে জড়িয়ে নিয়ে এক মিনিটে ঘুমিয়ে পড়ল। পরের দিন জিজ্ঞেস করলাম, "অত তাড়াতাড়ি ঘুমোলি কি করে?"। গরম গরম ডিমের অমলেট খেতে খেতে মেয়ে উত্তর দিলো – "লুঙ্গিটা থাকলেই মনে হয়, তুমি আছো"।

যখন আমি থাকবোনা, তখনও ফুলমতি থেকে যাবে। অলমিতি বিস্তারেন।      

(দু খানা ছবিই ইন্টারনেট থেকে পাওয়া )


শুক্রবার, ৩ এপ্রিল, ২০১৫

অন্ধকার লেখাগুচ্ছ ~ শ্রীজাত

অন্ধকার লেখাগুচ্ছ

1
না, তুমি অক্ষত আছো। আঁচড়ও লাগেনি।
যা হয়েছে, দূর দেশে। পাশের বাড়িতে।
জীবিতের ধর্ম বহু। মৃত এক শ্রেণি।
সেহেতু সুবিধে হয় মাথা গুনে নিতে।
যেসব মাথার কোনও ধড় নেই আর
তাদের কথার দায় কে নেবে তাহলে?
তোমার শহর শান্ত, নিস্পৃহ বাজার
প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে দেয়, অন্য কথা ব'লে
তুমিও তো অন্য লোক, অন্য কোনও নামে
বেঁচে আছো জুড়ে থাকা ধড়ে ও মাথায়...
জল গড়ায় বহু দূর। রক্ত কিন্তু থামে।
সে কী বলছে? ভুলে যেতে? ডাকছে না তোমায়?
যে এখনও ভেবে দেখছ, পথে নামবে কি না -
আমি তার মনুষ্যত্ব স্বীকার করি না!

অন্ধকার লেখাগুচ্ছ(২)
ওকে যা যা বলতে দাওনি, আমি বলব সেটা।
আমি যা পারব না, কেউ ঠিক বলে দেবে।
আমরা তো অক্ষরমাত্র, সময়ই প্রণেতা
দেহ গুনে সবটুকু পাবে না হিসেবে।
এ গ্রন্থ বিরাট। তাকে পড়া শুরু করো।
আমরা যে ছিলাম, আছি, থাকব - জেনে নাও।
মৃতদেহ একইসঙ্গে নীরব, মুখরও
না হলে তো জন্মাত না এই কবিতাও।
পাঁচ আঙুল কাটা গেলে দশ আঙুল জাগে
মুঠো হয়ে গেলে তাতে থাকে না বিভেদ
কাকে মারছ তা অন্তত বুঝে নাও আগে -
তোমার আক্রোশ থাকলে তারও আছে জেদ
তুমি যদি বারংবার কোপ মারতে পারো,
ছিন্ন কাঁধে ফের মাথা জন্মাবে আমারও!

অন্ধকার লেখাগুচ্ছ

মেঘ করে এসেছে এই সমুদ্রের ধারে
বাতাস জীবন্ত শুধু। বাকি সব ক্লীব।
কে দোষী সাব্যস্ত হয়, জলের বিচারে?
বালিতে বিছিয়ে আছে অগনন জিভ...
ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ক্রুশ আর শেকলও -
সে কোন জেরুজালেম? আর এ কোন ঢাকা?
কোনওভাবে যদি তুমি সত্যি কথা বলো,
হিংসা ঠিকই বুঝে নেয় নিজের এলাকা।
সে যেটা বোঝে না, এই সমুদ্র প্রাচীন।
জিভের সমস্ত বাক্য শুষে নিয়ে বালি
জীবন্ত বাতাসে মিশে যাবে একদিন...
কেটে নেওয়া জিভগুলো পড়ে থাকবে খালি।
মৃত্যুরও বলার থাকে কিছু কিছু কথা -
সহজে মরে না কারও বাক-স্বাধীনতা।

অন্ধকার লেখাগুচ্ছ

অমুক বিষয়ে তুমি লিখেছিলে কিছু?
তাহলে এখন কেন প্রতিবাদী এত?
যেখানে সবার মাথা মাটি ছুঁয়ে নিচু,
সেখানে মিথ্যেও কত সহজে বিখ্যাত।
না, লিখিনি। তাহলে কি এখনও লিখব না?
ধর্মের সমীকরণে কাটাব সময়?
ধিক্কারেও দিক দেখাবে পদবি-ভজনা?
যে-ধর্ম এসব বলে, সে আমার নয়।
যে-সত্যির জন্যে আজও প্রাণ দিতে হয় - 
সে হিন্দু না মুসলমান? সে বৌদ্ধ না শিখ?
কারও মাথা উপড়ে যায়, কারও মনে সয়...
কারও মৃত্যুদিন আর কারও বা তারিখ।
হত্যাই হিংসার ধর্ম। এ-কথা জেনেও
যে মৃতের ধর্ম খুঁজছ, মৌলবাদী সে-ও।

অন্ধকার লেখাগুচ্ছ

রাগ তুলে রাখছি আর পড়ে আসছে রোদ...
কার যেন কোথায় কবে এমনি মরে যাওয়া?
গেরস্ত উঠোনে ডাই রান্নার রসদ - 
আনমনে রক্ত দিয়ে নিকিয়েছি দাওয়া
দরগার জমিতে ফোটে মা কালীর জবা
মা মেরির উড়নি বাঁধা গাঁয়ের মসজিদে
এত দূর পৌঁছয় না মিছিল আর সভা
এখানে শাসন করে সোজাসাপটা খিদে।
দিন শেষে দানা চাই। দরজা দিয়ে বসি।
শ্মশানে কাদের ছেলে এনেছে পোড়াতে?
আজ সে-বাড়ি খাওয়া নেই। বাপ-মা উপোসী।
আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে।
হে জননী, আজও যদি আঁচলে আবৃত,
তোমার সন্তান তবে এমনিতেই মৃত।

অন্ধকার লেখাগুচ্ছ

দুটো রুটি বেশি পাবে। পৈতে খোলো আগে।
মকুব হয়ে যাবে সুদ। তসবি ছেড়ে এসো।
মিলবে না সুবিধে, যদি গির্জা ভাল লাগে।
যেখানে যেমন পারে, শর্ত দেয় দেশও।
গরিব লোকের ধর্ম বিক্রি হয়ে যাওয়া।
এ-হাতে ও-হাতে ঘোরা, খাবার তাগিদে।
বাকিরা চালায় দেশ, পালে লাগে হাওয়া...
যে-কোনও দলের ধর্ম জিইয়ে রাখা খিদে।
এরই মধ্যে তুমি খোঁজো, প্রভুর পা-দুটি?
এরই মধ্যে তুমি পাও, আল্লার ইশারা?
বিশ্বাসে মিলায় খিদে। বিক্রি করলে রুটি।
তাদের শাসাও দেখি, ভাগ করে যারা?
যে-দেশে পেটেই জ্বলে অধিকাংশ চিতা,
সে-দেশে বিশ্বাস পণ্য। ধর্ম বিলাসিতা।

অন্ধকার লেখাগুচ্ছ

যে-রংই মাখাও গালে, রক্ত মনে হয়।
নিশ্চিত তোমারই জাদু, হে লেডি ম্যাকবেথ -
গোটা দেশ বৃন্দাবন, হোলির সময়।
রঙের কুয়াশা থেকে জেগে ওঠে প্রেত।
সে বলে, 'আমাকে নাও উৎসবে এবার।
ঠান্ডা এ-কপাল, এসো, পরাও আবির...'
ভিড়ে তো সমস্ত মুখ মিশে একাকার
রং মেখে ভূত হল ছিন্ন হওয়া শির।
মৃত্যুর পরেও একই তাড়া করে ফেরা -
এ কোনও কাব্যের চেয়ে কম কিছু নয়।
শুনেছি সহজে পথ ছাড়ে না প্রেতেরা?
যে-রক্ত মাখাও গালে, রং মনে হয়।
কুড়িয়ে এনেছি মাথা, ফুলের বদলে -
পলাশ ফোটেনি ভাল এ-বছর দোলে।

অন্ধকার লেখাগুচ্ছ

পদবি লেখে না কেন? আপত্তি সবার।
গায়ে কোনও চিহ্ন নেই, সে-ও এক জ্বালা।
গোপনে আরতি করে? নমাজ ক'বার?
শুধু নামে কিছুতেই হয় না ফয়সালা।
পদবিই যদি আজও শ্রেষ্ঠ পরিচয়,
নাম দিয়ে তবে কেন তৈরি এ-সমাজ?
না-মানলে অনেক কিছু সহ্য করতে হয় -
কোটি দাঙ্গা পার করে বেঁচে আছি আজ।
আমারও ঐতিহ্য আছে, একটু দীর্ঘই।
আমারও আস্তিক রক্ত বহু নামে ঋণী
হয়তো সংখ্যালঘু, কিন্ত ভূমিহীন নই
কবীরকে মনে আছে। মান্টোকে ভুলিনি।
আমাদের ধর্ম বাঁচা। কৃষক বা কবি -
ফলনে চেনায় জাত। লাগে না পদবি।

অন্ধকার লেখাগুচ্ছ

মাথা কেটে রাখা আছে মার্বেল পাথরে।
তাজা রক্ত মিশে যাচ্ছে সরু নর্দমায়...
সামনেই দাঁড়িয়ে আছি থলি হাতে ধ'রে
যখন জীবিত ছিলে, চিনিনি তোমায়।
আজ অতিথি বাড়ি আসবে, খাওয়াব দুপুরে।
হে বিখ্যাত মাংস, তুমি নরম, মিহি তো?
দোকানি শুরুর আগে শান দিচ্ছে ক্ষুরে
দোকানিরা চিরকাল যেরকম দিত...
তোমাকে খবর করে রাঁধব আমরাই।
বড় টুকরো তুলে দেব অতিথির গ্রাসে
যত দূরে থাকি, জেনো, গন্ধ ঠিকই পাই
গোড়া থেকে উপস্থিত ঘটনার পাশে।
আস্তে আস্তে কাটা হচ্ছে গুর্দা, রাং, সিনা...
দাঁড়িয়ে দেখছি যারা, তারা কি খুনি না?

অন্ধকার লেখাগুচ্ছ
১০
যদি বলি মূর্তি নয়? সভ্যতার জিন?
যদি বলি ধর্ম নয়? চিন্তাধারাপাত?
বামিয়ানে বুদ্ধ থেকে মস্কোয় লেনিন -
পাথরে হাতুড়ি লাগে। হৃদয়ে আঘাত।
আমরা ধান ফলিয়েছি ইনকায়, মিশরে
আমরাই গেয়েছি গান রোমে, হরপ্পায়
আজও তার স্রোত বইছে রক্তের ভিতরে -
তুমি ভাবো এক আঘাতে সবই ভাঙা যায়?
মূর্তি নয়। ভাবমূর্তি। আমার না। তোমার।
গুঁড়ো হয়ে মিশে যাচ্ছে সভ্যতার জলে...
ধর্ম তো সহিষ্ণু। তুমি অধর্মের সার।
পাথর নীরবই থাকে। চিন্তা কথা বলে।
যত পারো ভেঙে যাও, ধর্মবীর সাজো -
সভ্যতার রক্তস্রোত শেষ হয়নি আজও!

অন্ধকার লেখাগুচ্ছ
১১
যখন সমস্ত পথ মিশেছে কবরে
যখন কারওরই চোখে পলক পড়ছে না
যখন গাছেরা নিভছে একটু একটু ক'রে
যখন সূর্যাস্ত লেগে সকলে অচেনা
যখন সবার দরজা বন্ধ শেষমেশ
যখন কথার পিঠে চেপে বসছে ভয়
যখন নদীরা সব ছেড়ে যাচ্ছে দেশ
যখন তোমার মুখ আর তোমার নয়
যখন ঠিকানা ছেড়ে স্বস্তি ভবঘুরে
যখন বিশ্বাস নেই মুঠোর নিভৃতে
যখন হাজার ক্রুশ জেগে উঠছে দূরে
যখন ফারাক শেষ জীবিতে ও মৃতে
তখন নিজের ব'লে কিছু নেই আর
পৃথিবীর সব ক্ষত প্রথমে আমার।

অন্ধকার লেখাগুচ্ছ
১২
নৌকা এসে ভিড়েছিল বাংলার কিনারে।
সোনালি চুলের যুবা, ফিরিঙ্গি সে লোক
ব্যবসায় থাকে না মন। গান বাঁধতে পারে।
সে-গানে জড়িয়ে থাকে গস্পেল আর শ্লোক।

হিঁদু ঘরে বিয়ে করল, মাটি হল নুন
কৃষ্টে আর খ্রিস্টে সে-ই ঘোচাল তফাত।
তোমরা তার চালাঘরে লাগালে আগুন
তারপর পেরিয়ে গেল ক'সহস্র রাত...

আবার সে ফিরে এল। অন্য রূপে ফেরা।
এখনও মানে না কিছু, গেয়ে যাওয়া কাজ,
সহিষ্ণু হল না তবু ধর্মযাজকেরা
কাল যারা মোড়ল ছিলে, মৌলবাদী আজ।

খেয়াল করোনি শুধু মারার সময় -
অ্যান্টনিরা চিরকালই জাতিস্মর হয়।

অন্ধকার লেখাগুচ্ছ
১৩
স্বপ্নে দেখি মরুভূমি। রোদে পোড়া বালি।
ক্যাকটাস না। ফুটে আছে গুচ্ছ কাটা-হাত...
মরীচিকা। জল নয়। চমকানো ভোজালি।
হিংসাই এখানে খাদ্য। ধর্ম অজুহাত।
স্বপ্নে দেখি সমুদ্র। সে বিরাট হাঁ খোলে।
দূরে যে-সূর্যাস্ত, সে-ও রক্তে টলোমলো।
ভার নিয়ে কোনওমতে দিন শেষ হলে
মৃতদের সম্প্রদায় খুঁজে দ্যাখে জলও...
এই সমস্ত স্বপ্নে দেখি। ঘুম আসে না আর।
বাতাসকে প্রশ্ন করি - 'কী তবে উপায়?
কোন পথে শান্তি পাব?'... হাওয়া নির্বিকার।
তারপর ধুলো উড়িয়ে সে বলে আমায় -
'আগে সেই বাড়ি থেকে নিয়ে এসো চাল
যে-বাড়িতে কোনও হত্যা হয়নি গতকাল'।

অন্ধকার লেখাগুচ্ছ
১৪
আবদুল করিম খাঁ-র ধর্ম ছিল গান।
আইনস্টাইনের ধর্ম দিগন্ত পেরনো।
কবীরের ধর্ম ছিল সত্যের বয়ান।
বাতাসের ধর্ম শুধু না-থামা কখনও।
ভ্যান গঘের ধর্ম ছিল উন্মাদনা। আঁকা।
গার্সিয়া লোরকা-র ধর্ম কবিতার জিত।
লেনিনের ধর্ম ছিল নতুন পতাকা।
আগুনের ধর্ম আজও ভস্মের চরিত।
এত এত ধর্ম কিন্তু একই গ্রহে থাকে।
এ-ওকে, সে-তাকে আরও জায়গা করে দেয়।
তবে কেন অন্য পথ ভাবায় তোমাকে?
তোমার ধর্মের পথে কেন অপব্যয়?
যে তোমাকে শিখিয়েছে দখলের কথা -
জেনো সে ধর্মই নয়। প্রাতিষ্ঠানিকতা।

অন্ধকার লেখাগুচ্ছ
১৫
আজও কারা গোধরায় মৃতদেহ খোঁজে
অযোধ্যায় আজও কারা আগলায় মুষল
একদিন সূর্যাস্ত এত ধারালো ছিল যে
লাল হয়ে গেছিল স্বর্ণমন্দিরের জল।
এ-খেলার শেষ নেই। এরই মধ্যে তুমি
যদি বলে ওঠো "কোনও পক্ষই মানি না",
সাক্ষ্যও দেবে না জেনো প্রিয় জন্মভূমি
অন্তিম মুহূর্তে শুধু উগরে দেবে ঘৃণা।
আমি সেই মাটি থেকে কথা বলতে চাই
যে-মাটিতে এখনও সশস্ত্র নীরবতা ;
অসাধারণের মৃত্যু অনিবার্য, তাই
সাধারণের সহায় অন্যমনস্কতা।
এই উপমহাদেশ আমার ঠিকানা
হত্যাটি অনুমোদিত। কথা বলা মানা।

অন্ধকার লেখাগুচ্ছ
১৬
বালক যিশুর দেহ শোয়ানো কফিনে
মা মেরি ধর্ষিতা হন সেই একই তারিখে
রক্তের আদিম রেখা রাস্তা চিনে চিনে
রানাঘাট থেকে চলে লাহোরের দিকে।
আকাশে উড়ন্ত ক্রুশ পরিক্রমা করে
এত কিছু দেখেশুনে সে একটু কাহিলও।
খাদক নিশ্চিন্তে ঢোকে নিরীহের ঘরে -
পাহারায় শাসকেরা বরাবরই ছিল।
হে ক্রুশ, কোথায় ছুটবে আজ তোমার মন?
কোন মাটির দাবি বেশি? কার শিয়রে যাবে?
মাঝখানে যে-কাঁটাতার, মুকুট এখন।
ছটফটাচ্ছে উপযুক্ত মাথার অভাবে।
উঁচু একটা টিলা খুঁজে দাঁড়াও আবার -
নীচে শেষ দেখতে পাবে, এই সভ্যতার।

অন্ধকার লেখাগুচ্ছ
১৭
আকাশ এখনও লাল। সন্ধে, নাকি ভোর?
মানুষ এখনও শুয়ে। ঘুমন্ত, না মৃত?
জল দিয়ে ঘিরে রাখা প্রাচীন শহর...
কিছুটা চোখেরও জল - এমনই কথিত।
শেষ কবে কেঁদেছে তারা? সে কোন নাটকে?
কোন দৃশ্যে ভিজেছিল সবার রুমাল?
খিদে নিয়ে কাঠঠোকরা বসে আছে চোখে...
শোনা যাচ্ছে কাল আর হবে না সকাল।
এইবেলা যে-যার ধর্ম বুঝে নাও, ওঠো !
মরার ও মারার এই শেষতম সুযোগ।
দীর্ঘদিন চলল, কিন্তু কাহিনিটি ছোট -
বাণিজ্য পরম ধর্ম, দেনা বড় রোগ।
তবুও ভুলিনি দ্যাখো, পুরনো প্রথাটি - 
শাইলক বাড়ায় হাত, আমি মাংস কাটি...

অন্ধকার লেখাগুচ্ছ
১৮
এ মাথা ছুঁয়েছে ধুলো, গালিবের ভিটে
এ মাথা নামমাত্র দামে লালনের কেনা
এ মাথা নিজেকে খোঁজে ঢোঁড়াই চরিতে
এ মাথা সহজে জেনো নামানো যাবে না।

এ মাথা স্তম্ভিত, চুপ ফেলিনি'র কাছে
এ মাথা শোয়ানো আলি আকবরের পা'য়
এ মাথা রামকিংকর দেখে তবে বাঁচে
এতবার নত, তাই টানটান হাওয়ায়।

এ মাথা কুরআন জানে, পড়েছে গীতাও।
হেঁটেছে বাইবেল থেকে আদি ত্রিপিটক।
এখন, হ্রদের ধারে, বলো তো কী চাও -
কে হে তুমি? ধর্ম, না অধর্মরূপী বক?

অতও নির্লজ্জ নয় মাথার বাসনা
কাটা গেলে যাবে। তবু নোয়াতে পারব না !

অন্ধকার লেখাগুচ্ছ
১৯
নিথর বাবার কোনও বিছানার পাশে
উন্মাদ মায়ের সামনে, একটা একটা ক'রে
কিউবা থেকে রাশিয়ায়, নভেম্বর মাসে
সেনা-ফিরে-যাওয়া কোনও প্রাচ্যের শহরে
বুকের বাঁদিক ঘেঁষে, চোখের কালিতে
স্বাধীন কণ্ঠের পথে দমকে দমকে
শেষবার জেগে ওঠা শিরা-ধমনীতে
কবরখানার দিকে ধাবিত সড়কে
পরস্পর লড়ে যাওয়া কলমে- কৃপানে
যে-পথে সবার জন্ম, সে-পথ আরও চিরে
'কিছুই মানি না' - এই বাক্যের প্রয়াণে
ধর্মের লড়াই শেষে বিক্ষত শরীরে
যখন যেখানে যত গোলাপেরা ফোটে -
আমার স্নানের জল লাল হয়ে ওঠে।

অন্ধকার লেখাগুচ্ছ
২০
হয় সাদা, নয় কালো। এ ছাড়া বোঝো না।
চরমপন্থার ধ্বনি বেঁধেছ ঘুঙুরে।
ছাইয়ের নীচেই তবু রাখা আছে সোনা -
শুধু খুঁজে নিতে হয় পথে পথে ঘুরে।
তোমরা বানিয়েছ খোপ, লম্বা দাগ টানা
বিরোধ-বিরোধ খেলা, যেন কত রাগ
ওপরে আলাদা। নীচে একই মালিকানা।
শুধু দেখে রাখা, কেউ না-পেরোয় দাগ।
যারা দাঁড়িয়েছে মাঠে, ছোঁয়নি কিনারা
না এ-মাথা, না ও-মাথা, যারা মাঝখানে,
পৃথিবীর সব ধর্মে শ্রেণিশত্রু তারা
ভয় বলে কিছু নেই তাদের অভিধানে।
মতে মিললে চিরসখা, অন্যথায় ফাঁসি -
এ যদি বিশ্বাস হয়, আমি অবিশ্বাসী।


অন্ধকার লেখাগুচ্ছ
২১
সকালে লেখার চাপ, কাগজ-পত্রিকা
বিকেলে থেরাপি আর ডাক্তার দেখানো
সন্ধের মরুতে দূর স্কচ-মরীচিকা...
কোহেন থাকেন, পাশে মেহেদি হাসানও।
শুক্রবার রাতে আসছে বন্ধুদের দল।
কোথায় বেড়াতে যাওয়া, এবারের শীতে?
মগজে পেতেছে আড়ি সঞ্চয়ের ছল -
যদি কিছু রাখা যেত ফিক্সড ডিপোজিটে...
এরই মধ্যে শব্দগুলো কখনও ভাবালে
গ্রীষ্মের দুপুরে আমরা গণতন্ত্রপ্রেমী
গোটা একটা সভ্যতার পতনের কালে 
ধর্মতলা মোড় থেকে হেঁটে একাডেমি।
বচনে বিপ্লবী আর প্রাণে সুরক্ষিত -
আমাদের অবসাদ প্ল্যাকার্ডজনিত।

অন্ধকার লেখাগুচ্ছ
২২
এক মুঠো পৃথিবী, তার আস্ফালন কত !
যে পারছে শাসন করছে যখন তখন
শস্যের পাশের ক্ষেতে দুলে উঠছে ক্ষত...
অথচ পেরোও যদি মাধ্যাকর্ষণ -
একই সঙ্গে সব কিছু নিষ্প্রাণ আর বেঁচে
এক আবর্তে মিশে যাচ্ছে সামান্য-মহৎ
কে জানে কোনদিক থেকে কোথায় চলেছে
নিয়ন্ত্রণহীন এই চেতনার স্রোত...
ভেসে থাকা ধর্ম শুধু। বিদ্যমান থাকা।
আগে ছিল মহা নাস্তি। পরেও কি তাই?
মাঝখানে ঘূর্ণমান সময়ের চাকা
আমরাও ধুলোর মতো ভাসতে ভাসতে যাই...
তুমি কত তুচ্ছ যদি বুঝতে একবার -

লজ্জায় নামিয়ে রাখতে উদ্যত কুঠার।

অন্ধকার লেখাগুচ্ছ [ শ্রীজাত ]
২৩
তোমার বাবার হাতে শান দেওয়া চপার।
তোমার মায়ের দেহ বোমায় সাজানো।
ওরা না-ও ফিরতে পারে। ফেরে অন্ধকার।
সে আনে শাঁখের ধ্বনি। সে আনে আজানও।
দূরে কোন বিস্ফোরণে উড়ে যাচ্ছে লোক
দূরে কার আক্রমণে কাটা পড়ছে গলা
রাতে রূপকথা চায় তোমারও দু'চোখ
সময়ের কাজ তবে রূপকথা বলা।
কে তোমার সঙ্গে ঘোরে, পুজোয় বা ঈদে?
কে স্নান করিয়ে তবে চুল আঁচড়ে দেয়?
এলোমেলো মাথাভর্তি আদরের খিদে...
সিঁথি কেটে ভাগ করা ন্যায় বা অন্যায়।
কী দেব, স্বান্ত্বনা ছাড়া? বেঁচে থাকো প্রাণে।
তফাত কোরো না শুধু শাঁখে ও আজানে।

অন্ধকার লেখাগুচ্ছ 
২৪
না-জেনে ওড়ায় পাতা, এ কেমন ঝড়?
ঘাতক, তোমাকে আমি বহুদিন চিনি।
মাথা কেটে নিয়ে যাও, পড়ে থাক ধড় -
যেটুকু স্বাধীনচিন্তা, জেনো তা স্বাধীনই।
সে ছোটে আলোর মতো। সে বাঁচে বিদ্যুতে।
তাকে দেখা যায় না তবু সে হল দর্শন
তুমি তাকে কোনওদিনও পারবে না ছুঁতে
ধর্মের কৃপাণ হাতে থাকবে যতক্ষণ।
না-বুঝে ঘনিয়ে আসে, এ কেমন শনি?
রায় থেকে রহমান, ছাড় নেই কারও
মেরে যেতে যেতে যেতে বুঝতেই পারোনি -
এরই মাঝে কবে মৃত্যু হয়েছে তোমারও।
এটুকুই অভিশাপ, হে ধর্মের সেনা
মৃতদেহ বয়ে ফিরবে। কবর পাবে না!

অন্ধকার লেখাগুচ্ছ
২৫
প্রথম আজান শুরু। দূর থেকে শোনো।
ফিনকি দিয়ে উঠে আসে প্রতিবেশী ভোর...
যদিও এদিকে ঘুম ভাঙেনি এখনও,
কতদিন ছাড় পাবে, আমার শহর?

আর কতদিন আমি বাস থেকে নেমে
একা হেঁটে বাড়ি ফিরব, সত্যিই জানি না।
হে পৃথিবী, ভেবে দ্যাখো, তোমার হারেমে
মানুষের জন্য কোনও জায়গা আছে কি না।

মুক্ত ভাবনার কোনও দেশ হয় না। তবু
হিংসা ঠিকই টেনে আনে হত্যার সীমানা
কে আজও শাসন করে? কে আমার প্রভু?
মৃত্যু থেকে বড় নয় মৃত্যু-পরোয়ানা।

আজ হয়তো বেঁচে আছি, কাল হয়তো লাশ...
আমি তবু লিখে যাব আমার বিশ্বাস।

অন্ধকার লেখাগুচ্ছ 
২৬
অদ্বিতীয় এই গ্রহ। অসামান্য ভূমি।
ঘূর্ণনে ক্রিয়াটি শূন্য, তবু ঘুরে চলে।
এরই মধ্যে প্রতিক্রিয়া খুঁজে ফেরো তুমি
যে-ধূর্ত সে বরাবরই বিজয়ীর দলে।

এ তবে কেমন যুদ্ধ, এতটা অসম?
এ তবে কেমন শোধ, উগ্র এতখানি?
বাড়িতে ফেরার পথ আজও দীর্ঘতম
পৃথিবীর ব্যর্থতারা আজও অভিমানী।

তুমি ধর্ম মেনেছ ও ভেঙেছ নিজেই।
বিঁধবে বলে বারবার খুঁজেছ পুতুল।
রক্ত ছাড়া এ রোগের উপশম নেই
কিন্তু তুমি শেষ কথা, এ ধারণা ভুল।

রাতে যাকে হত্যা করো, সকালে সে বেঁচে


--
~Saibal

বৃহস্পতিবার, ২ এপ্রিল, ২০১৫

​ স্মৃতির সরণি বেয়ে মহাপ্রস্থানের পথে ~ সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়


আমি লোকটা ঠিক প্রগতিশীল গোছের নই। বরং বেশ কিছুটা রক্ষনশীল আর গোঁড়া বলতে পারেন। পরিচিত জন জানেন, তাই আমি দু একখানা বামপন্থী বুকনি ছাড়লেই তাঁরা মুচকি হাসেন আমি বাঙালি-গুজরাতি তে তফাত মানি। চিনেদের দেখলে তাদের নাক আমার চেয়ে কতটা চ্যাপ্টা আর সাহারার দক্ষিনের আফ্রিকান দেখলে আমি তার চেয়ে কতটা ফর্সা, মনে মনে তার হিসেব কষি আমি তীর্থস্থানে যাই, দুর্গা পূজো , সরস্বতী পূজোয় অঞ্জলী দিই মাঝে মধ্যে। ভোগ খেতে তো কোন কালেই ছাড়িনা, যে কোনো দেবতার, তা সে যত দুর্ভোগই হোক।
তবে আমার গতি-প্রকৃতি, প্রকৃত অর্থে প্রগতি পরিপন্থি কিনা, সেটা ঠিক ঠাওর করে উঠতে পারিনি এখনো যাকগে, সেসব নিয়ে আমার নিজেরই মাথাব্যাথা নেই যখন , তখন আর ফ্যানাচ্ছি না। শুধু এইটুকু বলি, যে প্রগতিশীল বলে পরিচিতি থাকলে আমাকে এই লেখা লেখবার আগে তিনবার ভাবতে হতো, আর শেষে হয়তো প্রগতিশীল তকমার জেল্লা বজায় রাখতে গিয়ে এ লেখা মোটেই লেখা হতো না এবারে আসল কথায় আসি। এ গল্পটা একটা রাস্তা নিয়ে। আমাদের এই বাংলাদেশের রাস্তা নয় (বাংলাদেশ মানে শুধুই পূর্ব বাংলা, এতটা প্রগতিশীল হতে পারিনি – "সে আমারই বাংলাদেশ, আমাদেরই বাংলা রে"শ্যামলিমার তফাত নেই যখন, তখন আর...) আমাদের এখানকার রাস্তাঘাট খুবই রোমাঞ্চকর। বিপদ কোথাও গর্ত হয়ে, কোথাও কোমর জলে, কোথাও ম্যানহোলে, কোথায় ইঁট বাঁধাইয়ের ব্যর্থ ইতিহাসে ওত পেতে আছে। কোথাও সে গাঁকগাঁকে বাসের রেশারেশিতে, অটোর অট্টরোলে, ট্যাক্সির চোখ রাঙানিতে তাকলামাকান বা গোবি মরুভুমী পার হবার মতো চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিতে পারে। তা নিয়ে দুদ্ধর্ষ রোমহর্ষক শিহরন জাগানো লেখা, আমার মত প্রাচীন পন্থী মানুষের আসে না। তাই বেছে নিয়েছি, অনেক শান্তশিষ্ট পায়ে হাঁটা একটা রাস্তা। যদিও সে রাস্তা আজ আর নেই। আবার কখনো তৈরি হবে, সে আশাও দেখছি না। খুলে কই।

২০১৩ সালের বর্ষাকাল শুরুর সময় একটা খবর প্রায় সমস্ত খবরের কাগজ আর টিভি চ্যানেলে দেড় দু সপ্তাহ ধরে মুখ্য হয়ে ওঠে। সেটা হলো কেদারনাথের ভয়াবহ বন্যা, ধ্বংস ও প্রানহানী। বিদেশী কিছু জ্ঞানগম্যি বাড়ানোর চ্যানেলে এখনো দেখি হপ্তায় একবার করে এক ঘন্টার তথ্যচিত্র দেখানো হয়, কিভাবে কেদারনাথে বিপর্য্যয় নেমে এসেছিলো। বিজ্ঞানী ও পরিবেশবীদরা বললেন – আগেই বলেছিলাম, পরিবেশের বুকে বসে এই ভাবে গাছ ওপড়ানো আর রাস্তাঘাট-বাড়িঘর তৈরি ভালো না। লোকসভায় তৎকালীন বিরোধীরা সরকার কে তুলোধোনা করলেন একজন মুখ্যমন্ত্রি তো হেলিকপ্টার নিয়ে উদ্ধার করতে চলে গেলেন নিজের রাজ্যের মানুষকে। ইশ্বরদত্ত ক্ষমতা নিশ্চিত, নাহলে ডুবন্ত মানুষের রাজ্যবিচার মোটেই সহজ কাজ না। এই অসাধ্য সাধন করেছিলেন বলেই বোধহয় সেই ভদ্রলোক আজকে ভারত শাসন করছেন। যাই হোক এই বিপর্যয়কে সনাতন ধর্মের মাথারা বললেন কর্মফল। পূবপাশের দেশের অনেক ওয়েবসাইটে দেখলাম এই ঘটনাকে, দুনিয়া থেকে কাফিরি ঘোচানোর ঐশ্বরিক প্রচেস্টা হিসেবে বর্ননা করা হয়েছেখুঁজে দেখতে পারেন, সেসব বাংলাতেই লেখা। বঙ্গীয় প্রগতিশীল মানুষজন কিছুদিন বাইরে রাজ্য সরকারের নিন্দে আর ভেতরে ধর্ম ও তার কুফল নিয়ে ব্যস্ত রইলেন, কিন্তু গাড়োয়ালের নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া মানুষের জন্যে তাঁরা কিছু করেছেন বলে মনে পড়ছেনাআর পরিশেষে আমাদের রাজ্যসরকার কি করলেন তা নিয়ে নিরব রইলাম। আমার বয়স বাড়ছে। সব বিষয়ে কথা বলাটা বাচালতার লক্ষন।

টিভির পর্দায় এসব ছবি দেখতে দেখতে কত কথাই মনে পড়ছিলো। ওই রুদ্রপ্রয়াগ, গুপ্তকাশি, গৌরিকুন্ড। ভারতসেবাশ্রম সঙ্ঘ আর তার মহারাজরা। পুরোহিত গোবিন্দ শুক্লা ও তাঁর ছেলে গৌতম শুক্লা। কেদারনাথের এই সেবায়েত পরিবার পুরুষানুক্রমে আমাদের বংশের সঙ্গে যুক্ত। কে জানে কত শ বছর ধরে আমরা ওনাদের যজমান ! কেউ কেদারনাথে গেলে, আমাদের বাড়ি ও বংশের নামটুকু বললেই হলো, এক গাল অমায়িক হাসি, লম্বা সিড়িঙে চেহারা, কপালে সাদা চন্দনের তিলক, মাথায় উলের লম্বাটে টুপি, গায়ে আলোয়ান আর ইষৎ হলদেটে ধুতি নিয়ে হাজির হয়ে যান এই গৌতম শুক্লা। বয়স প্রায় আমারই মতো। হয়ত দু চার বছর এদিক ওদিক। ভাঙ্গা ভাঙ্গা বাংলা বলেন, কিন্তু তাতে আদর আপ্যায়নের ত্রুটি হয়না কোন। গোবিন্দ শুক্লা গত হয়েছেন। যতদিন তিনি ছিলেন, তিনিই আসতেন। শুধু কেদারনাথে গেলেই যে দেখা হয় তা নয়, প্রতি বছর শীতের সময় নিয়ম করে যজমান বাড়িতে আসেন। সঙ্গে আনেন কেদারনাথের ব্রহ্মকমল, প্রসাদ, চরনামৃত, আর হয়ত কখনো এক খানা বাঁধানো পট। এক কাপ চা খান। দুটো কথা হয়, কখনো কোনো পরিচিত জনের সম্পর্কে, কখনো আবার নেহাৎই ব্যবহারিক জীবনের কথা। এক খানা ধুতি , কেনাই থাকে, আর ১০০ টি টাকা। এটুকুই চাহিদা বড় সামান্যকে জানে কত বছর ধরে এই আসা যাওয়া চলছে। ভরা শীতে কেদারের পুজো কেদারনাথে হয় না। দীপাবলির পর কেদারের ছড়িদার, বা পুরোহিতরা কেদার বিগ্রহকে নামিয়ে আনেন উখিমঠে। কেদারনাথ তখন ঢেকে যায় বরফে। আবার পরের বছর গ্রীষ্মে কেদারনাথ মন্দিরে ফিরে যায় বিগ্রহ। অক্ষয় তৃতীয়ার দিন মন্দিরের দরজা আবার খোলা হয়।

কেদারনাথ আর পাঁচটা তীর্থের মতো না। একটু আলাদা। বাঙালীরা প্রচুর পরিমানে কেদার আসেন। কিন্তু শুধু মাত্র দেব দর্শনের অভিপ্সা নিয়ে আসেন কি? নাকি অন্য কিছুও আছে, যা শয়ে শয়ে বছর ধরে তীর্থযাত্রিদের টেনে নিয়ে চলেছে হিমালয়ের ওই তুষারাবৃত উচ্চতায়? হরিদ্বার থেকে বাস বা গাড়িতে চড়ে বসা। হৃষিকেশ, দেবপ্রয়াগ, রুদ্রপ্রয়াগ, গুপ্তকাশি পেরিয়ে গৌরিকুন্ড। রাস্তার দুরত্ব ২৩৫ কিলোমিটার। এখানে দেখবেন মন্দাকিনির জল সাদা ফেনা তুলে ঘোর গর্জন করতে করতে ভীম বেগে নিচের দিকে বয়ে চলেছে। সে জলের অন্ততঃ ৩০ মিটার দূরে দাঁড়িয়ে পাশের লোকের সঙ্গে কথা বলতে গেলে তারস্বরে চেল্লাতে হয়। জল স্বভাবতঃই সাম্যবাদী। মানুষকে ছেড়ে দিলে সে চাইবে ওপরে উঠতে, আর জল কেবল ফিকির খোঁজে কি ভাবে নিচের দিকে নামবে। একটু সুযোগ পেলেই সমতলের দিকে দৌড় মারে। জলে আঘাত করুন, সে আঘাত জলের লাগেনা। তার হারাবার কিছু নেই। আপনার হাতে কেবল জলের স্পর্শ লাগবে। আবার এই জলই ফুঁসে উঠলে সব কিছু ভেঙ্গে তছনচ করে দিতে পারে। সাম্যবাদী হতে গেলে বোধহয় এমনটাই হতে হয়। গৌরিকুন্ড পর্য্যন্তই ছিলো গাড়ি চলার রাস্তা। এর পর থেকে বাকি যা বলবো, তা আজকের দিনে আর দেখতে পাবেন না। প্রলয়ংকর বন্যায় সে সব ধ্বংস হয়ে গেছে। গৌরিকুন্ড আসলে মন্দাকিনির ধারে ছোট্ট একফালি জমি। কোথাও পঞ্চাশ ফুট, কোথাও একশ ফুট চওড়া। তা বাদে দু দিকে পাঁচিলের মত খাড়া পাহাড় উঠে গেছে। গৌরিকুন্ডে উষ্ণপ্রস্রবন আছে। মানে মাটি থেকে গরম জল বের হয়। সেই কুন্ডের চারপাশ পাথর দিয়ে বাঁধানো। আর ঐ ফালি জমিতে কিছু যেমন তেমন করে তৈরি ঘর বাড়ি। তার সিংহভাগই ধর্মশালা। খুব সরু একটা পাথর বাঁধানো রাস্তা, যার বেশিরভাগটাই ধাপ কাটা সিঁড়ি। রাস্তার দু দিকে খুপরি খুপরি দোকান। বেশিরভাগই পুরি-সবজি আর জিলিপি-তেলেভাজার। সামান্য কিছু মনিহারি জিনিষপত্রও রয়েছে। সবকিছুই তীর্থযাত্রিদের জন্যে।

সকাল বেলা হরিদ্বার ছেড়ে সন্ধ্যের কিছু আগে গৌরিকুন্ড পৌঁছে বিশ্রাম। এরকম একটা পরিকল্পনাই করেন সবাই। গৌরিকুন্ডে ওই কুন্ড ছাড়া দেখার কিছু নেই। কুন্ডের গরম জলে চানটা কিন্তু দারুন অভিজ্ঞতা। সারা দিনের যাত্রার ধকলে, আর ঠান্ডায় আড়ষ্ঠ হয়ে পড়া শরীর একেবারে তাজা – চাঙ্গা হয়ে যায়। তার পরে একটা দোকানে ঢুকে এক প্লেট পকোড়া আর মালাইদার চা নিয়ে বসুন। মন প্রানে উৎসাহের জোয়ার আসবে। সমতলের শহুরে মানুষ বিশেষতঃ ৭০% বাঙালি কে আজকাল বাইরে গিয়ে দেখি সন্ধ্যে বেলা মুরগি আর সুরার সন্ধান করছেন, আর রাত্রে বিরিয়ানি। সুধী পাঠক, এর একটাও গৌরিকুন্ডে পাবেন না। শহুরে ভারতবর্ষ, আধুনিক ভারতবর্ষ, নবাবি ভারতবর্ষ, সাহেবি ভারতবর্ষের দুরত্ব, গৌরিকুন্ড থেকে দিল্লির ভৌগলিক দুরত্বের চেয়েও অনেক বেশী। গৌরিকুন্ড এখনো যেন আটকে আছে সাবেকিয়ানায়। সাবেকিয়ানা কথাটা কি ঠিক বললাম? বোধহয় না। গৌরিকুন্ডের পরিবেশ মানে, পুরোনো যুগে আটকে থাকা ভারতবর্ষ নয়। শুধু, অন্যরকম। আমাদের চেনা পরিসরের বাইরে কিছু।
রাত থাকতে উঠে পড়ে তৈরি হয়ে নেওয়া। কারন ব্রাহ্মমুহুর্তে রওনা হতে হবে কেদারনাথের দিকে। গাড়ি চলার রাস্তা গৌরিকুন্ডেই শেষ। এর পরে আপনাকে পায়ে হাঁটতে হবে। তবে কিনা এই ভারতবর্ষে ধর্মকর্মের জন্যে "মূল্য ধরে দেওয়া" বলে একটা নিপাতনে সিদ্ধ বন্দোবস্ত আছে। কাজেই আপনার হয়ে অন্য কেউ পদচালনা করতেই পারেন কিছু মূল্যের বিনিময়েমানুষ ও মনুষ্যেতর স্বেচ্ছাসেবক সর্বদাই প্রস্তুত সে জন্যে। আপনি তাদের কাঁধে চড়েই পৌঁছে যাবেন গন্তব্যে। তবে ডুলির বাহক আর ঘোড়া (খচ্চর, মোটেই ঘোড়া নয়) ওয়ালাদের সঙ্গে মূল্যধরে দেওয়া নিয়ে কিঞ্চিত ধস্তাধস্তি এই যাত্রার একটা অছেদ্য অঙ্গ, এক যদি না আপনি পায়ে হেঁটে চলেনএই ব্রাহ্মমুহুর্তে আলো প্রায় ফোটেনি । অথচ রাস্তাঘাটের ঘুম ভেঙ্গে গেছে। এখানে থাকার জন্যে আছে ধর্মশালা, আর একটা কি দুটো একটু হোটেল গোছের বস্তু। তীর্থযাত্রিরা হাতে লাঠি আর সর্বাঙ্গ গরম জামায় ঢেকে বেরিয়ে আসছেন রাস্তায়। এই লাঠি গুলো এখানে ভাড়া পাওয়া যায়। লাঠির তলার দিকটা ধাতু দিয়ে বাঁধানো আর ছুঁচলো। এদিক ওদিক দোকানগুলোয় চায়ের জল ফুটছে। সর্বত্র একটা নীলচে ধোঁয়াটে ভাব। তার কিছুটা কুয়াশা, আর কিছুটা অসংখ্য চায়ের দোকানের উনুনের ধোঁয়া এই চায়ের সঙ্গে সমতলের চায়ের অমিলই বেশী। বাংলা চায়ের অমিল তো চোখে পড়ার মত দুধ বেশী, লিকার ঘন, আদা বা এলাচ থাকতে পারে চায়েকনকনে হাড়কাঁপানো ঠান্ডায়, এই চা, এক ভাঁড় খেলে, আর এক ভাঁড় খেতে ইচ্ছে করে। ভারতবর্ষের সমতলের গনগনে গরম এখানে অনুপস্থিত। গৌরিকুন্ড প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার ফুট উঁচুতে। আর শুধু তাই নয়, এখান থেকে হাত বাড়ালেই হিমালয়ের মূল অংশ, মানে হিমাদ্রী। মন্দাকিনির গা থেকে খাড়া উঠে যাওয়া ঘন সবুজ রঙের পাহাড় গুলোর পেছনে দেখা যাচ্ছে দুধ সাদা শৃঙ্গমালা। হিমালয়ের এত ওপরে বাতাসে ধুলোবালি খুব কম। তাই স্পষ্ট দৃষ্টি চলে বহুদুর। মনে হয় হাতবাড়ালেই ছোঁয়া যাবে বরফ।

পাহাড়ি জায়গা এমনিতে একটু নোংরা হয়। ধোয়াধুয়ির জন্যে জলের বাজে খরচা অনেকেই করেনা। কিন্তু পাশে মন্দাকিনি থাকার জন্যেই বোধহয় গৌরিকুন্ড, অন্যান্য চটির তুলনায় কিছুটা পরিস্কার। তবে কিনা ভোরের আবছা আলোয়, রাস্তায় বেরিয়ে চায়ের গন্ধের সঙ্গে আরো কিছু গন্ধ আপনার নাকে আসবে। এই যেমন ধরুন রাস্তায় ঘোড়ার টাটকা ইয়ে, তখনো হালকা ধোঁয়ার মত বাস্প উঠছে, তার পরে ধরুন ঘোড়া ওয়ালা আর ডুলি বাহকদের অস্নাত দেহজ গন্ধ। সেই সঙ্গে যোগ হয়েছে পচা ফুল পাতা আর বাসি-পচা খাবারের গন্ধ। বাঙালি যাত্রির পেটে গাড়োয়ালি ভাজাভুজি ভালো সহ্য হয়না। অম্বলে ভোগা কিছু বাতকম্মও আশেপাশের বাতাস কে ভারি করেছে। তবে সবই খারাপ এমনটা নয়। ধুপ, টাটকা ফুল, ধুনো এসবের গন্ধও রয়েছে। সেই সঙ্গে টাটকা পুরি সবজি, জিলিপির গন্ধ। সব মিলিয়ে মিশিয়ে এমন একটা কিছু তৈরি হয়েছে, তার তুলনা টানার মত চট করে কিছু খুঁজে পাচ্ছি না।

রাস্তার ওপর গিজগিজ করছে লোক। ওই অত ভোরেও। চায়ের দোকানের সামনে সব চেয়ে বেশী ভিড়। এখানে যাত্রিদের একটা বড় অংশই বাঙালি। তেনাদের বাঁদুরে টুপি, হাল ফ্যাশনের জ্যাকেটের ওপর দিয়ে জড়ানো উলের মাফলার, আর অনভস্ত্য স্নিকার পায়ে আড়ষ্ট হাঁটা দেখে চেনা কঠিন না। এ ছাড়াও আছেন উত্তরাপথের হিন্দিভাষী তীরথ্‌ইয়াত্রি। কিঞ্চিত বয়স্ক একজন নেতা, তাঁর সঙ্গে দল চলেছে কেদারনাথ। নেতা উচ্চস্বরে দেহাতী হিন্দিতে তাড়া দিয়ে ডাকাডাকি-বকাবকি শুরু করেছেন। প্রথমে কয়েক মিনিট একপেশে বকাবকির পরে অপরদিকের আর্টিলারি জবাবি ফায়ার শুরু করে। ইনি গুলাবী ফুলওয়ালি শাড়ির অবগুন্ঠনের নিচে গায়ে জড়িয়েছেন আলোয়ান। নিচে বোধহয় বেগুনী সোয়েটার। কিন্তু বুড়ির জবাবি হামলার এতটাই জোর, দেখলাম দেহাতী বুড়ো, উলটো মুখে ঘুরে লাঠি হাতে কেদারের দিকে একাই হাঁটতে লেগেছে। ওদিকে দেখি চওড়া চৌকো গোঁফ, আর বড়বড় চকচকে চোখ নিয়ে একদল দক্ষিন-ভারতীয় যাত্রি ইতিউতি চাইছেন। তাঁদের পছন্দসই "কাপি" পাওয়া দুস্কর এখানে। সবই চায়ের দোকান। তার ওপরে ভাষার ব্যবধান, এখানে সব কিছুই তাঁদের কাছে অচেনা "নার্ত ঈয়েন্ডিয়ান"। হাফ প্যান্ট আর হুডি পরে কিছু সাদা চামড়ার ছেলে ছোকরাও আছে , দু এক জন কিঞ্চিত বয়স্ক বিদেশীও পাওয়া যাবে ভিড়ের মধ্যে। এনাদের যাত্রার কারন কি নিছক "Exotic India" খোঁজার চেষ্টা? সে তো গোটা দেশেই আছে। নাকি পাহাড়ি সৌন্দর্‍্য্য? সে ও গোটা হিমালয়েই ছড়ানো। হিন্দু তীর্থ দেখতে চাইলেও তিরুপতি আছে, বেনারস আছে, আরো কত কি আছেকি জানি? আমার মনে হয়েছে, এসব একটা কারনও ঠিক নয়। আমি আমি ঠিক যে কারনে কেদার চলেছি, এরাও সেই একই কারনে চলেছে কেদারে।

গৌরিকুন্ডে একটাই রাস্তা। সে রাস্তা উত্তর দিকে চলে গেছে কেদারের পথে। মহাভারতের পঞ্চপান্ডব এই রাস্তা ধরেই মহাপ্রস্থানে গিয়েছিলেন। কাজেই কেদার আবহমানকালের। কত দিন ধরে, কত যুগ ধরে মানুষ এখানে আসছে তীর্থ করতে বলা দুস্কর। মহাভারতে, পথের যা বর্ননা আছে, তার সঙ্গে এখনকার দৃশ্যপট প্রায় সবটাই মিলে যায়। কেবল মাঝে মধ্যে দু একটা বিদ্যুতের খুঁটি, লাক্স কোজির বিজ্ঞাপন আর ম্যাগি নুডলসের সহজলভ্যতা মহাভারতের ওপরে যোগ হয়েছে। আর হ্যাঁ, আমাদের চা খাওয়ার অভ্যেস তৈরি করেছে ব্রিটিশরা। মহাভারতের সময় চা খাবার চল ছিলো না। থাকলে হয়ত পাঞ্চালী – "আঁর পাঁরচিনা" বলে চায়ের দোকানের বেঞ্চিতে বসে পড়তেন, আর মধ্যম পান্ডব চা ও তার সঙ্গে কিঞ্চিত টা এর হুকুম দিতেন দোকানিকে। ভীমসেন খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারটা ভাল বোঝেন। গৌরিকুন্ডের বাড়ি ঘর ঠিক যেখানটায় শেষ হয়, সেখানে ডুলি ওয়ালাদের আড্ডা। ব্যাপারটা মোটেই জটিল না। একটা কাঠের বেঁটে চেয়ার। তার দুই হাতলের সঙ্গে লম্বা লম্বা দু খানা বাঁশ শক্ত করে বাঁধা। আপনি হেঁটে যেতে চাইছেন না কেদারে, এসে বসে পড়লেন ওই ডুলিতে। এবারে চারজন বাহক ওই দু খানা বাঁশ ধরে চেয়ারটা কাঁধের ওপর তুলবে। ডুলিকে অনেকে ডান্ডি ও বলেন। এই বাহকদের পা ফেলা, একটা দেখবার মত জিনিস। মোড় ঘোরার সময় এক দিকের বাহক কে ছোটো পা ফেলতে হবে, অন্য জনকে লম্বা। নিখুঁত হিসেবে এনারা সেটা করেন। আর আমাদের চেনা পাল্কির গানের হুহুম-নার মতো একটা অদ্ভুত সুর করে ছড়া কাটতে থাকেন। এ ছাড়াও আছে কান্ডি। যাঁদের রেস্ত কম, তাঁরা কান্ডিতে চড়েন। একটা ঝুড়িতে যাত্রিকে বসিয়ে, সেটাকেই বাঁশে ঝুলিয়ে বয়ে নিয়ে যান দু জন বাহক। খরচ ডান্ডির তুলনায় কম।

ডান্ডি বলুন বা কান্ডি, পাহাড়ের এই উচ্চতায় যেটা আপনার চোখে পড়বেই, তা হলো মানুষের পেশী শক্তির অপরিমিত ব্যবহার। এ অঞ্চলে চাষবাস খুব একটা হয়না, কারন পাহাড়ে চাষযোগ্য জমি খুব কম। ধাপ কেটে কেটে সরু ফালি জমি বার করে কিছুটা চাষের চেষ্টা করা হয় বটে, কিন্তু সে ব্যবস্থা নেহাৎই অপ্রতুল। আর চাষের পদ্ধতিও মান্ধাতা আমলের। সেচের তেমন সুবিধে নেই, শুধু মাঝে মধ্যে নদী বা সোতা ছাড়া। তাও সারা বছর সব কটায় জল থাকেনা। জীবন ও জীবকা নির্বাহ তাই খুব কঠিন এ সব অঞ্চলে। অনেক দূরে দূরে কিছু সম্পন্ন ছোটো শহর হয়ত আছে, যেমন রুদ্রপ্রয়াগ বা চামোলি কিন্তু সাধারন জনপদবাসি গাড়োয়ালিদের অর্থনৈতিক সঙ্গতি খুবই কম। এই বাজার অর্থনীতির দেশে যার হাতে পয়সা নেই, তার সামাজিক ক্ষমতাও নেই। ভারতবর্ষের আর পাঁচটা অঞ্চলের মত এখানেও সমাজে ধনি-গরিব দুই ই আছে। তবে তাদের অনুপাতটা বড্ড একপেশে। এখানে গরিবের সংখ্যা অনেক বেশী। এরকম ভয়াবহ দারিদ্র আমি খুব কম দেখেছি। কল্পনা করতে পারিনা, পেটে কতখানি খিদে থাকলে ছেঁড়া চট গায়ে, পায়ে রবারের টায়ারের টুকরো বেঁধে একটা মানুষ কনকনে ঠান্ডায় মাঝরাতে উঠে আর একটা মানুষকে কাঁধে তুলে ৬ হাজার ফুট উঠে আবার নেমে আসে। চোখের সামনে এদের দেখে মন কে বোঝাতে চেষ্টা করেছি, এরা পাহাড়ি, এদের অভ্যেস আছে। কিন্তু যতই বোঝাই, এঁদের মুখের ভাঁজে ভাঁজে যে যন্ত্রনা আর বঞ্চনা স্থায়ী ভাবে লেখা হয়ে গেছে, সেটা দেখার পরে ভুল বোঝা অসম্ভব। যতদিন দেবতা আছেন, দেবতায় বিশ্বাস আছে, ভরসা আছে, ততদিন এই গরিব মানুষ গুলো খিদে পেটে জীবন সংগ্রাম চালিয়ে যাবেন। কিন্তু যেদিন দেবতার আসন টলবে, সেদিন এই গরিব মানুষ গুলো কাঁধে করে বয়ে নিয়ে যাওয়া মেদবহুল শেঠ দের ছুঁড়ে ফেলে দেবে ওই মন্দাকিনিতে, সেই সঙ্গে হাজার হাজার বছরের গোলামিকেও বিসর্জন দেবে ওই জলে। এঁরা নিজেরাই নতুন তীর্থ তৈরি করবেন একদিন  

মানুষের কাঁধে চড়ে যেতে যাঁদের মন চায়না, আবার হেঁটে ৬ হাজার ফুট পাহাড়ে চড়তেও যাঁরা নারাজ, তাঁদের জন্যে ডুলির আড্ডার কিছুটা পরেই এক গাল্ হাসি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ঘোড়াওয়ালারা। মুখ দেখলেই বুঝবেন, ঘোড়াওয়ালাদের সবাই গাড়োয়ালি নয়। বরং বেশ কিছু মঙ্গোলিয় মুখ চোখে পড়বে। এরা খুব সম্ভবতঃ নেপাল থেকে যাত্রার মরশুমে এখানে আসে ঘোড়া নিয়ে। আর কিছু লোকজন কে দেখে মনে হয় আরো উত্তর পশ্চিমের। মুখের ভাঙ্গা হিন্দি শুনেও মনে হয়, কেমন যেন একটা অচেনা সুর। এরা কি কাশ্মিরি? কি জানি? জিজ্ঞেস করা হয়নি। দরদস্তুর করতে যে টুকু সময়, তার পরে ঘোড়ায় চড়া। আমি এক কথায় ঘোড়ায় চড়ার কথা বলে দিলাম বটে, কিন্তু আনাড়ির পক্ষে ব্যাপারটা এতটা সোজা নয় এখানে ঘোড়ায় সওয়ার হন প্রধানতঃ দু ধরনের লোকজন। একদল খাস উত্তরভারতের বাসিন্দা। ঘোড়ায় চড়তে দেখে বোঝা যায়, এনাদের কিছুটা অভ্যেস আছে। দ্বিতীয় দল, প্রধানতঃ বাঙালি, আর বেশীরভাগই মহিলা। ঘোড়ায় করে কেদারনাথ যাবার খরচ খুব কম নয়। কিছুটা খরচ বাঁচাবার জন্যে অনেকেই বাড়ির মহিলাদের ঘোড়ায় তুলে দেন, আর পুরুষরা হেঁটে যান। অ্যাকিলিসের গোড়ালির মত, বাঙালির হাঁটু খুব দুর্বল জায়গা। হাঁটু বাঁচাতে আনাড়ি মহিলাদের ঠেলে ঠুলে ঘোড়ার ওপর বসানো হলো। মহিলা আতংকে কাঠ হয়ে বসে আছেন ঘোড়ার ওপর। ঘোড়া একটু একটু নড়ছে। মহিলা শিউরে উঠছেন। "নামিয়ে দাও", "আমি এই ভাবে যেতে পারবোনা", "ওরে বাবা", "ঘোড়া বড্ড নড়্‌ রাহা হ্যায়" এই সব টুকরো টাকরা কথা কানে ভেসে আসবে। এই অবধি তবু ঠিক ছিলো। কিন্তু চার মহিলাকে ঘোড়ায় চড়িয়ে ঘোড়াওয়ালা, ঘোড়াগুলোর পাছায় একটা করে থাপ্পড় মেরে দিলো। আর ঘোড়াগুলো কেদারের দিকে হাঁটতে শুরু করলো। কয়েক কদম চলবার পরে এলো আতংকের দ্বিতীয় লহর। প্রবল বিষ্ময়ে মহিলারা দেখলেন ঘোড়াওয়ালা পেছনে রয়ে গেছে। ঘোড়া গুলো নিজে নিজেই এগিয়ে চলেছে রাস্তায়। এবারে চেঁচামেচির পর শেষ ঘোড়ার আড়াল থেকে বেরিয়ে আসে একটা ছোট্ট পাহাড়ি ছেলে। কতই বা বয়স? ৯-১০ বছর। এই ক্ষুদেই নাকি ঘোড়া নিয়ে যাবে। তার বাবা আরো যাত্রিদের অন্য ঘোড়ার ব্যবস্থা করবেন গৌরিকুন্ডে। আর আসলে ঘোড়ারা নাকি নিজে নিজেই চলে যাবে, কাউকে নিয়ে যাবার দরকার হবে না। মহিলাদের শেষ ভরসাটুকুও চলে যায় যখন তাঁরা আতংকের তৃতীয় ধাক্কায় আবিস্কার করেন সোজা সামনে যাবার বদলে, ঘোড়াগুলো কেমন যেন কোনাকুনি হয়ে খাড়াই রাস্তায় ওপরে উঠছে। শুকিয়ে যাওয়া গলায় চিঁচিঁ করে অনুযোগ করেন "এই বাচ্ছা, তুমহারা ঘোড়া কোনাকুনি কিঁউ যাতা হ্যায়?। গম্ভির গলায় ক্ষুদে পাহাড়ি ওস্তাদ জবাব দেয় –"হিম্মত না হারে মা-জি"। ব্যাস, ওই টুকুই ভরসা। "মা" বলছে যখন, তখন নিশ্চই ফেলে দেবে না ঘোড়া থেকে। আর ভরসা বাবা কেদারনাথ।

"জয় বাবা কেদারনাথ" , "ব্যোম ব্যোম ভোলে" এই সব হাঁক ছেড়ে ভোরের নরম আলোয় তীর্থযাত্রির দল গৌরিকুন্ড পেরিয়ে পা রাখেন কেদারের রাস্তায়। পাথরে বাঁধানো রাস্তা। প্রায় ১০ থেকে ১২ ফুট চওড়া। আর খাদের দিকে রেলিং দেওয়া। কিন্তু সব জায়গায় নয়। খুব খাড়াই রাস্তা নয় প্রথম কয়েক কিলোমিটার। হাঁটা তেমন কঠিনও নয়। কিছুটা অন্তর জলের ব্যবস্থা রয়েছে। মাঝে মাঝে দু একটা বসার জায়গাও দেখা যাচ্ছে। দু পাশের দৃশ্য অতি মনোরম। ডান দিকে মন্দাকিনি বয়ে চলেছে অনেকটা নিচে দিয়ে। আর বাঁ দিকে খাড়া পাহাড়। পাহাড়ে গাছপালার ঘন জঙ্গল। আর সামনের পাহাড় গুলোর গায়ে দেখা যাচ্ছে একটা সরু সাদা ফিতে। ওটাই রাস্তা, চলে গেছে আরো উত্তরে, কেদারনাথের দিকে। গৌরিকুন্ড সমুদ্রতল থেকে প্রায় ৬ হাজার ফুট উঁচুতেআর কেদারনাথ ১২ হাজার ফুট। কাজেই আপনি ট্রেনে আর গাড়িতে চড়ে এ পর্যন্ত যতটা উচ্চতা উঠেছেন, ঠিক ততটা উচ্চতাই আপনাকে উঠতে হবে এবার পায়ে হেঁটে। তফাত আরো আছে। আমার মত হাওড়া স্টেশন থেকে যদি ধরেন, তাহলে প্রায় ২০০০ কিলোমিটারে আপনি একটু একটু করে ৬ হাজার ফুটে উঠেছেন। এবারে বাকি ৬ হাজার আপনাকে উঠতে হবে ১৪ কিলোমিটার দুরত্বের মধ্যে। মানে প্রতি কিলোমিটারে গড়ে প্রায় ৪২০ মিটার। আমাদের পরিচিত যুবভারতি ক্রিড়াঙ্গনের ছাত মোটামুটি মাটি থেকে ১০০ ফুট ওপরে। এবারে ভাবুন, আপনাকে ১ কিলোমিটারের মধ্যে কি পরিমান ওপরে উঠত হবে।

কাকভোরে যাত্রা আরম্ভের উত্তেজনায় শুরুতে অনেকে স্লোগান দেন, কথা বলেন, জোরে জোরে চলতে থাকেন। শুরুর দিকে চারিদিকে কথা অনেক বেশি। কিন্তু আধ ঘন্টার ভেতরেই শব্দ কমে আসে। তখন শুধু ঘোড়ার খুরের খটখট আর গলায় বাঁধা ঘন্টার ঠুংঠুং আওয়াজ, মানুষের জোরে জোরে শ্বাস নেওয়ার শব্দ, রাস্তার ধারের বনের ভেতর ঝিঁঝিঁ পোকার আওয়াজমাঝে মধ্যে দু এক জন ফিরতি পথে নামতে থাকা মানুষের সঙ্গে মুখোমুখি হয়ে যাওয়া ছাড়া গোটা রাস্তায় আর কোনো ভাগাভাগি নেই। সমস্ত রাস্তা জুড়েই ওপরে উঠতে থাকা যাত্রিরা তবে কিনা পয়দল চলা হলেও, দু-পেয়ে আর চার-পেয়ে তে তফাত আছে। প্রায়শঃই ঘোড়াদের জায়গা ছেড়ে দিতে হয়। ব্যাটারা মাঝে মাঝে নাক দিয়ে সর্দি ঝাড়ার মত "ফর্‌র্‌র্‌ ফোঁৎ" করে বিকট এক রকম শব্দ করে। ওইটে আগুপিছু শুনলেই সাবধান হবেন। ব্যাটাচ্ছেলে পিঠে সওয়ার নিয়ে কোনাকুনি ধেয়ে আসছে। মানে মানে রাস্তা ছেড়ে দেওয়াই ভালো।

চলতে চলতে গলা শুকিয়ে যায়। এ রাস্তায় চলার সময় সঙ্গে মালপত্র যতটা সম্ভব হালকা রাখাই ভালো। এক লিটার জলের ওজন ১ কিলো, সেই কবে বইতে পড়েছি ইস্কুলে। এখানে এসে সত্যিটা উপলব্ধি হয় হাড়ে হাড়ে। তবে চিন্তার তেমন কিছু নেই। কিছুটা গেলেই একটা করে জলসত্র পাওয়া যায়। তীর্থযাত্রীদের তৃষ্ণার জল দেওয়া পূন্যের কাজ বলে অনেকের বিশ্বাস। সেই বিশ্বাসে ভর করে মাঝে মাঝেই দু এক জন বসে আছেন জলের জালা নিয়ে। বরফের মত ঠান্ডা কনকনে সে জল পান করলে শরীরে জান ফিরে আসে। আবার হাঁটা শুরু হয় লাঠিতে ভর করে। মাঝে মধ্যে এক একটা মোড় ঘুরলে পাহাড়ের নতুন একটা খাঁজ নজরে আসে। পেছনে তাকালে বোঝা যায়না, কোথা দিয়ে আর কত দূর এলাম। তবে হ্যাঁ, মাঝে মাঝেই এক একটা পাথরের ফলকে কিলোমিটারের হিসেব লেখা রয়েছে।

যাত্রার শুরুতে যে সব অত্যুৎসাহী জোর কদমে পাহাড়ে চড়ছিলেন, এখন ঘন্টা দুয়েক পর তাঁদের অনেকেই ধুঁকতে শুরু করেছেন। পাহাড়ে চড়ার ক্ষেত্রে আপ্তবাক্য হলো গুটিগুটি পায়ে আস্তে আস্তে চলা। বাহাদুরি দেখালেই দম শেষ। যখন মনে হবে আর পারা যাচ্ছেনা, হাঁটু কাঁপছে, কোমর পিঠ ব্যাথায় ভেঙ্গে পড়ছে, তখন একটু রাস্তার ধার করে কোথাও বসে পড়ুন। রাস্তার পাশে বসার জায়গা রয়েছে মাঝে মধ্যে বিশ্রাম নিন, কিন্তু সাবধানেখুব বেশিক্ষন বিশ্রাম নয়। তাহলে অবসাদ চেপে ধরবে। এখনো অনেক রাস্তা সামনে যাবার আছে। ঘড়ি ধরে ৫ মিনিট। তার পরেই উঠে পড়ুন। পরের ২ কিলোমিটারে আর বসা নয়। যদি দলে যান, তাহলে সব দলের মত আপনার দলেও দু একটি কিঞ্চিত কুঁড়ে গোছের লোক থাকবেনই। তাঁরা হয়ত আরো ক-মিনিট বসতে চাইবেন। কিন্তু আপনি যদি দলপতি হন, এসব ওজর আপত্তিতে কান না দেওয়াই ভালো। যত ওপরে উঠবেন, তত দৃশ্যপট বদলাবে। গাছের আকার ছোটো হতে থাকবে। ঝোপঝাড় মিলিয়ে যাবে। আকাশ আরো বেশী করে দেখা যাবে। প্রায় সাত কিলোমিটার পেরিয়ে এসে যখন আপনার মনে হচ্ছে আর এক পা ও এগোতে পারবেন না, গায়ের জামা ঘামে ভিজে চুপচুপে, গলা শুকিয়ে কাঠ, ক্লান্তিতে শরীর ভেঙ্গে পড়ছে, ঠিক তখনই একটা মোড় ঘুরে চোখে পড়বে কয়েকটা বাড়িঘর। আপনি কেদার যাত্রার ঠিক মাঝামাঝি, রামওয়াড়া চটিতে পৌছেছেন।

রামওয়াড়া চটিতে বেশিরভাগ বাড়িই অস্থায়ী কাঠামো। তাও আবার সংখ্যায় সব মিলিয়ে গোটা ১৫-২০ হবে। এখানে যাত্রিরা বিশ্রাম নেন। কিছু খাবার দাবারও পাওয়া যায়। খাবার বলতে পুরি-সবজি, ডাল-ভাত এই সব। তবে কালের নিয়ম মেনে এখানেও হলদে রঙের ম্যাগির প্যাকেট দেখতে পাবেন। আজকাল বেশিরভাগ লোকে সেটাই খায়। তৈরি সহজ, তাড়াতাড়ি হয়, আর টাটকা গরম ধোঁয়া ওঠা খাবার সামনে হাজির রামওয়াড়ায় আধ ঘন্টা জিরিয়ে, অল্প কিছু খেয়ে আবার রাস্তায় নামা। এর পরের চড়াই আরো বেশি। রামওয়াড়ার পরেই দৃশ্যপট বদলাতে থাকে। বড় বড় গাছের আলপাইন অরন্য, যা এতক্ষন সঙ্গে ছিলো, একেবারেই সংখ্যায় কমে আসে। এখন শুধু তৃনভূমি। রাস্তার ডান পাশে মন্দাকিনি এক ভাবে বয়ে চলেছে আমাদের সঙ্গে। দার্জিলিঙের রাস্তায় যেমন চুলের কাঁটার বাঁক বেয়ে গাড়ি কিম্বা ছোট্ট রেলগাড়ি খাড়া পাহাড়ে ওঠে, এবারে এখানের রাস্তায় সেই রকম বাঁক দেখা দিতে শুরু করেছে। বেশিরভাগ রাস্তাই এখন সিঁড়ির মত ধাপ কাটা। চারিদিকের মানুষজন কথা প্রায় বলছেন না। একমাত্র ঘোড়ায় চড়া যাত্রিরা আর ডুলিতে চড়া মানুষজন তাড়াতাড়ি চলেছেন। ডুলির বাহকরা কিভাবে এত তাড়াতাড়ি চলেন সেটা তাঁরাই বলতে পারবেন। মনে হয় বুকের ভেতর বাড়তি দু খানা অক্সিজেন সিলিন্ডার আছে এনাদের। ঘোড়ার ওপর সওয়ারদের দিকে দেখুন। তেনাদের অবস্থা সঙ্গিন। ঘোড়ার পিঠে বসে থাকা সোজা নয়। দুলুনি, তার ওপরে কাঠ হয়ে বসে থাকেন অনভ্যস্ত লোকজন। আর এইখানেই করেন ভুল। শরীর যত আলগা করে বসবেন, তত গায়ে ব্যাথা কম হবে। না হলে ঘোড়ায় চড়ার পরের দিন গায়ে এমন ব্যাথা হয়, হাত পা নাড়ানোই দুস্কর হয়ে ওঠে। কেন জানি, ঘোড়সওয়ারদের দেখে, আপনার সোনার কেল্লার লালমোহনবাবুর কথা মনে পড়বে। সেই উটে চড়ার দৃশ্য।

রামওয়াড়া ছাড়ানোর পর কিছুটা পথ গেলেই, তুষার শোভিত হিমাদ্রীর শৃঙ্গ দেখা দিতে থাকে। ঘন নীল আকাশের বুকে চোখ ধাঁধানো সাদা তুষারে ঢাকা হিমালয় মাথা উঁচু করে রয়েছেমাথায় সাদা পেঁজা তুলোর মত মেঘ লেগে রয়েছেচারিদিক প্রায় শব্দহীন, কেবলমাত্র অনেক নিচে মন্দাকিনির জলের আওয়াজ। বেশিক্ষন তাকানো যায়না, চোখ ঝলসে যায়। কিন্তু এই দৃশ্য আপনাকে ভরসা দেয়। শুকনো মুখে, হাঁপধরা বুকে, ক্লান্ত পায়ে আর টাটানো পিঠ-কোমর নিয়ে আপনার মন আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে নেয়, আর ভাবে, অনেকটা পথ আপনি এগিয়ে এসেছেন। এখানে রাস্তার দুদিকে আর কোনো সবুজ দেখা যায়না। যে উচ্চতায় আপনি উঠে এসেছেন, এখানে উদ্ভিদ জন্মাতে পারেনা। আপনার হাঁফ ধরা শুধু ক্লান্তির জন্য নয়, এখানে সত্যিই বাতাস অনেক পাতলা হয়ে এসেছে। অক্সিজেন কম। খুব সাবধান হবেন। হাঁটার গতি আরো কমিয়ে দিন। অক্সিজেন কম থেকে অনেক রকম উপসর্গ হতে পারে। প্রধানত মাথা যন্ত্রনা আর বমি পাওয়া। ডায়ামক্স বলে একটা ওষুধ আছে, সকালে গৌরিকুন্ড থেকে সেটা একটা খেয়ে বেরোতে পারেন। তাতে এই উপসর্গগুলো এড়ানো যায়। আমি যখন গৌরিকুন্ড থেকে বেরিয়েছিলাম, তখন কেন এ কথাটা লিখিনি? আরে মশাই, এই এতটা হেঁটে এসে তবেই আমার ওষুধের কথাটা মনে পড়েছিলো। তাই আপনাকে আগে বলিনি। ডায়ামক্স খেলে একটা ব্যাপার একটু খেয়াল রাখবেন। বড্ড ঘন ঘন প্রকৃতির ডাক শুনতে পাওয়া যায়। তবে বড় নয়, ছোটো। সে ব্যবস্থা রাস্তার ধারে অনেক। বড়র ব্যবস্থাও আছে বটে, বাঁশের খুঁটিতে চট টাঙিয়ে অস্থায়ী ব্যবস্থা।

চারিদিকে কেবল কালচে পাথর, আর হলদেটে বালি। না আছে মাটি, না আছে সবুজ। কেবল অনেক নিচে মন্দাকিনির দু পাশে অল্প সবুজ ঘাস। কোনো বড় গাছ গাছালি নেই। সে সব অনেক নিচে ছেড়ে এসেছি আমরাসামনে এখন হিমালয়ের মূল শৃঙ্গরাজি স্পস্ট। কেদার শৃঙ্গ দেখা যাচ্ছে, যার মাথাটা ঠিক ছুঁচলো নয়, অনেকটা শিবলিঙ্গের মত গোল। একটা বাঁক ঘুরেই আপনার সামনের যাত্রিদের দলটা ভাঙ্গা গলায় বলে উঠলো "জয় বাবা কেদারনাথ"। সেই সকাল ৬টায় যাত্রা শুরুর সময় আপনি শুনেছিলেন এই হাঁক, এতক্ষন পরে আবার শোনা গেল। কিন্তু ব্যাপারখানা কি? এ জায়গাটা থেকে প্রথমবার কেদারনাথ মন্দির দেখা যায়, এর নাম দেও-দেখনি। আপনি দেখলেন বহু দূরে সত্যিই দেখা যাচ্ছে কেদারের জনপদ। বেশীক্ষন দাঁড়াবার উপায় নেই। ঘন্টা ৬-৭ চলে গেছে যাত্রা শুরুর পরে। বেলা বাড়লে এখানে পাহাড়ের মাথায় মেঘ জমতে থাকে, এবং প্রায় প্রতিদিনই দুপুরের দিকে ঝিপঝিপ করে বৃষ্টি নামে। অনেকেই সেই জন্যে গৌরিকুন্ড থেকে প্লাস্টিকের চাদর নিয়ে আসেন। সেগুলোও লাঠির মতই ভাড়া পাওয়া যায়।

রাস্তার চড়াই ক্রমশঃ বাড়ছে। একটা সময় মনে হয়, শুধুই ধাপ কাটা সিঁড়ি, সমান রাস্তা প্রায় নেই। চলতে চলতে হাঁফ ধরা বাড়তে থাকে, শরীরের ক্ষমতা কমতে থাকে আরো। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হলো, মনের জোর অনেকটা বেড়ে যায়। মনে হয়, ঠিক পারবো, এতটা এলাম, আর একটুখানি, নিশ্চই পারব। আস্তে আস্তে কেমন যেন একটা অবশ লাগার মত অনুভুতি চেপে ধরে শরীর-মনেনেশাগ্রস্থের মত হেঁটে চলাকেদার জনপদ আবার পাহাড়ের ফাঁকে কোথায় হারিয়ে গেছে। শরীরে কষ্ট কি একটু সহনশীল হতে থাকছে? না কি মন, শরীরের কষ্ট থেকে নিজেকে খুব সাবধানে সরিয়ে নিচ্ছে? একটা অপার্থীব জগৎ চারিদিকে। সে জগৎ সুন্দর না অসুন্দর, তার বোধটুকুও যেন লোপ পেয়েছে। সামনে কেবল খাড়াই রাস্তা, তাতে আরো তীর্থযাত্রির হাঁটা। কোথায় আমার বাড়ি? কর্মক্ষেত্র? আত্মিয়স্বজন বা বন্ধুবান্ধব? আমার শিক্ষাদিক্ষা, সংস্কৃতি, অভ্যেস সব কিছুই কেমন যেন অর্থহীন হয়ে যাচ্ছে প্রতিটি পদক্ষেপের সঙ্গেআমি কি ফিরতে চাই বাড়ি? এখুনি ফিরে যেতে বললে ফিরে যাবো? বোধহয় না। আমার যাবতীয় পরিচয় ফিকে হতে শুরু করেছে। এমন কি খিদে তেষ্টার বোধও চলে গেছে অনেক আগেই। সামনে একমাত্র সত্য এই রাস্তা, চারিদিকের অচেনা মানুষগুলো, আর সামনে কোথাও থাকা ওই কেদারনাথ জনপদ। আমি কি ভগবানে বিশ্বাস করি? কখনোই নয়। ধর্মে আশা রাখি? নিশ্চিত ভাবেই না। কেন এলাম এখানে? কে বলেছিলো এই কষ্টের মধ্যে এসে পড়তে? কেউ না, কেউ না, কেউ না। শুধু মনে হয়েছিলো, কয়েক হাজার বছর ধরে, মানুষ কিসের টানে হিমালয়ের এই দুর্গম অঞ্চলে আসছে, সেইটা জানতে হবে। আর আজ, এইখানে , এই রাস্তায় চলতে চলতে, ১২ হাজার ফুটের ওপরে এসে, প্রথম বার মনে হলো সেই কারনটা জানতে পারলাম। বেনারসের গঙ্গার ধারে দাঁড়িয়ে এরকম অনুভুতি হয়েছে আমার। মনে হয়েছে আমার পরে থাকা মুখোস গুলো এক টানে কেউ ছিঁড়ে ফেলে দিলো। মুখোসের আড়ালে, হারিয়ে যাওয়া মানুষটাকে টেনে বের করে আনছে হিমালয়। পিছুটান নেই, অতীত নেই, অন্য কোনো পরিচয় নেই আমার। এই রাস্তা আর এই ভাবে হেঁটেযাওয়া, আমার আবহমানকালের পরিচয়, আমি যাত্রি।

"আরো আগে, ইতিহাসেরও আগে, ওরা কারা?
ইন্দ্রপুরী-ইন্দ্রপ্রস্থ থেকেই বেরিয়ে যাচ্ছে
হিমালয়ের দিকে-
মহাভারতের মহাপ্রস্থানের পঞ্চনায়ক তাদের সঙ্গিনী
স্ব- স্বরূপ- অনুরূপা-
যুদ্ধ জয় 'রেও যারা সিংহাসনে গিয়ে বসল না
কর্ম উদযাপন 'রেও যারা লোলুপ হাতে
কর্মফল বন্টন করল না নিজেদের মধ্যে,
ফলত্যাগ করে কর্মের আদর্শকে রেখে গেল উঁচু 'রে,
দেখিয়ে গেল প্রথমেই পতন হল দ্রৌপদীর-
পক্ষপাতিতার
তারপর একে একে পড়ল আর সব অহঙ্কার
রূপের বিদ্যার বলের লোভের-আগ্রাসের"
অচিন্ত কুমার সেনগুপ্ত, কবিতা উদ্বাস্তু

বিশ্বাস করুন, স্পষ্ট অনুভব করবেন, একে একে আপনার সব কটা অহংবোধ খসে পড়ছে। এর সঙ্গে আস্তিকতার কোনো সম্পর্ক নেই। অনুভুতির জগৎ অবহেলার নয়। অনুভুতি মানুষকে মানবিক করে।

সামনের রাস্তা কিছুটা সমতল। অনেকক্ষন পরে সিঁড়ি ছাড়া এমনি রাস্তা দেখলাম। ক্লান্ত পদক্ষেপে কয়েক কদম এগিয়ে সামনের মোড় ঘুরেই দেখি দৃশ্যপট বদলে গেছে। সামনে একটু নিচেই ছলছল করছে মন্দাকিনি। তার ধারে বেশ কিছু লোকজন রয়েছেন, আরো ৫০০ মিটার দূরে মন্দাকিনির ওপরে একটা সাঁকো, আর সেটা পেরোলেই ওপাশে কিছু ঘরবাড়ি। ঘরবাড়ি গুলোর মধ্যেই মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে কেদারনাথের মন্দির। এবারে আর চড়াই ভাঙ্গা নেই। বরং সামান্য কয়েক পা উৎরাই। কেদারনাথের মন্দির আর তার চারপাশ একদম অন্য  গল্প। সে নিয়ে লিখতে বসিনি। কেদারনাথ মন্দির রয়েছে বহাল তবিয়তে। তবে হ্যাঁ, কেদার জনপদের বিস্তর ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। আর গৌরিকুন্ড থেকে এই রাস্তা আর নেই। এখন উখিমঠ থেকে মন্দাকিনির অন্য পার দিয়ে তীর্থযাত্রিরা কেদারনাথ পৌঁছন। সে রাস্তা কেমন আমি জানিনা। এখনো যাওয়া হয়ে ওঠেনি। তবে যাবার ইচ্ছে রাখি।


গত দু বছর শীতের সপ্তাহান্তে হাসি মুখ নিয়ে গৌতম শুক্লা আসেননি। যে কথাটা চিন্তা করতে চাইনা, এড়িয়ে যেতে চাই, সেটা এখানে লিখবোনা ভেবেছিলাম। বিপর্যয়ের পরে অনেক দিন পর্যন্ত যোগাযোগের চেষ্টা চালিয়েছি। কিন্তু খোঁজ পাইনি এই সদাহাস্যমুখ গরিব মানুষটার। জানিনা গৌতম শুক্লা এখন কোথায়, আদৌ আছেন কিনা। তাঁর খোঁজেই নতুন পথ ধরে আর একবার কেদারনাথ যাবো।