দুই – যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে
যদি প্রেম দিলে না প্রাণে, কেন ভোরের আকাশ ভরে দিলে এমন গানে গানে? না, আলফ্রেড এই গান এই সুর শোনেন নি, এ অনেক পরের রচনা, কিন্তু তার অবচেতনে বেজে যায় এই সঙ্গীতেরই মূর্ছনা। অকৃতদার, সফল পুরুষদের জীবনের লক্ষ্য কী? আরও অর্থ, যশ, সম্মান, প্রতিষ্ঠা? ঠিক কতটা হলে তাকে বলা যায় যথেষ্ট?
নিজের সম্বন্ধে তার ধারণা ভারি অদ্ভুত। পারিবারিক ইতিহাস সংরক্ষণের জন্য মেজদা লুডুইগ যখন তাকে একটা আত্মজীবনী লিখে দিতে বললেন – আর আলফ্রেড যথেষ্ট ভালো লেখেন – তিনি নিজের সম্বন্ধে লিখলেন মাত্র এই কটি বাক্যঃ করুণা-উদ্রেককারী চরিত্র, পৃথিবীতে আসার সময় ডাক্তারের উচিৎ ছিল শ্বাসরোধ করে মেরে ফেলা; সবচেয়ে বড় গুণ – নখ কেটেকুটে পরিস্কার রাখা আর কারও বোঝা হয়ে না থাকা; সবচেয়ে বড় দোষ – বৌ-বাচ্চা, রৌদ্রোজ্জ্বল স্থিতিশীলতা বা হার্দিক ক্ষুধা, এর কোনটাই না থাকা; সনির্বন্ধ অনুরোধ – জ্যান্ত কবর যেন না দেওয়া হয় তাকে; সবচেয়ে বড় অপরাধ – ম্যামনদেবতার (যিনি লোভ বা সম্পত্তির দেবতা) পুজো না করা; জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা – নাথিং!
বলাই বাহুল্য লুডুইগ এটা পড়ে একদমই খুশি হননি। যেমন খুশি হননি প্রিয় ভাইটির সঙ্গিনী হিসাবে এক সামান্য ফুলওয়ালীকে দেখে। ভাই আলফ্রেড কিন্তু ফুলের ঘায়ে মূর্ছা গেছে প্রথম দর্শনেই। মেয়েটির নাম সোফি হেস, অস্ট্রিয়ার এক ফুলের দোকানের সেল্স্গার্ল, তার সাথে মোলাকাৎ এক স্বাস্থ্যচর্চাকেন্দ্রে। আলফ্রেডের বয়স তখন তেতাল্লিশ, সোফির কুড়ি। কিন্তু তাতে কী, ভাল লাগালাগির আবার জাতি-ধর্ম-বয়স আছে নাকি?
লুডুইগ বললেন, রাস্তা থেকে একটা মেয়েকে কুড়িয়ে আনলি ভাই! তোকে নির্ঘাৎ ফাঁসিয়ে বিয়ে করার জন্যে ঝুলোঝুলি করবে, জীবন দুর্বিষহ করে দেবে। একে নিয়ে তুই সুখী হবি ভেবেছিস? ওরে, ভদ্র ঘরের ভালো মেয়ে পছন্দ করে ঘর বসা, তাতেই তুই সুখ পাবি। আমাকে ওর সঙ্গে দেখা করার জন্যে অনুরোধ করিস না, সে অনুরোধ আমি রাখতে পারব না। মেয়েটা ভেবেই বসবে যে আমরা তাকে আমাদের পরিবারের একজন সদস্যা করতে রাজি, আমি তা মোটেও নই।
আলফ্রেড যে মেজদার কথা উড়িয়ে দিয়ে বলিউড স্টাইলে সেন্টু ঝাড়বেন বা অ্যাংরি ইয়াং ম্যানের মত 'মেরে পাস সোফি হ্যায়' বলে তার হাত ধরে ড্যাং ড্যাং করে অন্য জায়গায় গিয়ে বাসা বাঁধবেন – তা করতেই পারতেন, তাঁর পয়সার অভাব ছিল না – কিন্তু পারলেন না, তিনি নিজেও নিঃসন্দেহ নন। সোফিটা যেন কী! হাতের লেখা কাগের ঠ্যাং, বগের ঠ্যাং, আলফ্রেডের লেখা সুন্দর সুন্দর চিঠিগুলো পড়ে কী বোঝে খোদায় মালুম, তার উত্তর বড়ই সাদামাটা। আলফ্রেড যখন তার মধ্যে খুঁজছেন ভালবাসার অতলান্ত সমুদ্র, সে তখন আলফ্রেডের কাছে চাইছে টাকা! শরীর খারাপ টাকা দাও, ঘরভাড়ার টাকা দাও, এটা দাও, ওটা দাও। না বোঝে কবিতা, না বোঝে জীবনদর্শন, শতচেষ্টা করেও আলফ্রেড তার মধ্যে বিদ্যাবুদ্ধি ঢোকাতে পারেন না।
পাঁচটা ভাষায় অনর্গল কথা বলতে পারেন আলফ্রেড, মাতৃভাষা সুইডিশ ছাড়াও ইংরাজী, রাশিয়ান, জার্মান, ফ্রেঞ্চ। লিখতে পারেন কবিতা। এদিকে বয়স বেড়ে যাচ্ছে। জীবনসঙ্গিনী যদি করতেই হয়, এমন একজনের সঙ্গে করতে হয়, যে তাঁর কথা বুঝবে, সুযোগ্য জবাব দেবে, একটা মানানসই কথোপকথন তো হতে হবে। প্যারিসে থাকাকালীন আলফ্রেড সেই মর্মে এক বিজ্ঞাপন দিলেন – ধনী, উচ্চশিক্ষিত প্রৌঢ় ভদ্রলোক খুঁজছেন ভাষা ও সাহিত্যনিপুণা ভদ্রমহিলা, ব্যক্তিগত সচিব হওয়ার ও গৃহস্থালী দেখভাল করবার জন্য। ১৮৭৬ সালের কথা। অস্ট্রিয়ার ভিয়েনা থেকে বার্থা কিন্সকি নামে এক মহিলা তাঁর বিজ্ঞাপনে সাড়া দিয়ে আলফ্রেডের সেক্রেটারি নিযুক্ত হলেন। দুদিনের মধ্যেই এদের দু জনকে দেখা গেল গাড়িতে লম্বা ড্রাইভে বেরোতে, অথবা বাসন্তী সন্ধ্যায় নিভৃতে বই-দে-বুল্যঁয় শহরে পাশাপাশি হেঁটে যেতে। আলফ্রেডের বাড়ির ব্যক্তিগত বইয়ের লাইব্রেরির সংগ্রহ দেখে বার্থা তো মহাখুশি। যুদ্ধমত্ত মানুষ দেখে বীতশ্রদ্ধ আলফ্রেড বার্থাকে বোঝালেন, এরা ভাবে যুদ্ধ যেন একটা খেলা। এমন জিনিস তিনি আবিস্কার করতে চান, যার বীভৎসতায় মানুষের মনে ভয় ঢুকবে, চরম ভয়, যাতে যুদ্ধ করার চিন্তাই আর না আসে এদের মনে।
প্রথম দিন থেকেই বার্থাকে ভীষণ পছন্দ হল আলফ্রেডের, এতদিনে মনের মত এক সঙ্গিনী পেয়েছেন যার সঙ্গে কথা বলে আরাম পাওয়া যায়, যার মাথায় বেশ বুদ্ধি আছে। বার্থাও উচ্ছ্বসিত তার মনিবের সুস্থ চিন্তাভাবনা আর বাক্পটুত্বে। তিনি তার ডায়েরিতে লিখলেন, পৃথিবী বা মানুষ, জীবন বা শিল্প, আজকালের সমস্যা বা চিরন্তন সমস্যা, যা নিয়েই এর সঙ্গে কথা বলি, এত সুন্দর ব্যাখ্যা আর কোথাও শুনিনি।
লজ্জা লজ্জা মুখ করে আলফ্রেড একদিন বার্থাকে একটা চিরকুটে তার লেখা একটা কবিতা পড়তে দিলেন। তার প্রথম লাইনে আছে – তুমি বলো আমি যেন এক অপার বিস্ময়। বার্থা তার চোখ মেলে আলফ্রেডের দিকে চাইতেই আলফ্রেড আরো লজ্জা পেয়ে বললেন, খারাপ লাগল? কী বলব বল, একা থাকি, এটাই আমার এক উদ্ভট শখ। আমি এক আশাহত পুরুষ, মানবজাতির ভবিষ্যতের দিকে নতুন আশা নিয়ে চেয়ে থাকি আমি।
বার্থার বয়স কম নয়, তিনি বুঝতে পারেন, আলফ্রেডের চাই একজনকে যে তাকে বুঝবে, তাকে আদরে সোহাগে যত্ন করে রাখবে। ব্যক্তিগত সচিব নয়, আলফ্রেড খুঁজছে আরো বেশি অন্তরঙ্গতা। কিছু বুঝে ওঠার আগেই অবধারিত প্রশ্নটা এসে গেল, তোমার মনের মন্দির কি খালি আছে, বার্থা? তেত্রিশ বছর বয়সের অভিজ্ঞতা দিয়ে কোনরকমে তিনি বললেন, না, তিনি আর্থার ফন সাটনার নামে এক অস্ট্রিয়ান কাউন্টের বাগ্দত্তা। আর্থারের মা নিমরাজী, তাই বার্থা কিছু টাকাপয়সা রোজগার করে নিজের পায়ে দাঁড়াতে চান।
ব্যবসার এক জরুরী কাজে আলফ্রেডকে সেই সময় তিন সপ্তাহের জন্য প্যারিসের বাইরে যেতে হল। ফিরে এসে দেখলেন বার্থা তার ব্যাগ প্যাক করে নিজের দেশে ফিরে গেছেন। ফেলে রেখে গেছে্ন একটা চিরকুট। দু'সপ্তাহের মধ্যে তার বিয়ের খবরও কানে এল তার। ভগ্নহৃদয় আলফ্রেড ধরেই নিলেন এ জন্মে প্রেম-ট্রেম আর তার দ্বারা সম্ভব হবে না। এত অসুখে ভোগেন তিনি, তাকে দেখতে নিশ্চয় বিচ্ছিরি, কোন মেয়ে তাই তাকে পছন্দই করবে না। সেই বছরেই কয়েক মাস বাদে অস্ট্রিয়াতে ভিয়েনার কাছে এক স্বাস্থ্যচর্চাকেন্দ্রে যে মুহূর্তে কুড়ি বছরের তরুণীটির দেখা পেলেন তিনি, তার ওপরেই গিয়ে পড়ল তার সমস্ত উৎসাহ, অনুরাগ।
এর পর যে কোন ছুতোয় অস্ট্রিয়া চলে যেতেন আলফ্রেড, সোফির সঙ্গে সময় কাটানোর জন্যে। কয়েকদিন দেখা না হলেই লিখতেন লম্বা চিঠি। শুধু প্রেমের কথা নয়, জীবনের কথা, ব্যবসার কথা, ভবিষ্যতের কথা। এ রকম চলতে থাকল সুদীর্ঘ আঠার বছর ধরে।
বদলে জুটল শুধুই হতাশা। সোফির সঙ্গে পরিচয়ের সাড়ে চার বছর পরে – আলফ্রেডের পঞ্চাশ বছর পুরতে মাত্র আড়াই বছর বাকি – গ্লাসগোর এক হোটেল থেকে তিনি সোফিকে চিঠিতে লিখলেন, কাল ট্রেনটা এত লেট করল যে কানেকটিং ট্রেনটা মিস করলাম, না হলে লন্ডন চলে যাওয়া যেত। ঈশ্বরভীরু এই দেশে রোববারে ট্রেন চলে না, ফলে আমি বোকার মত এক বিশাল হোটেলের এক কোণে বন্দী। তোমার জন্যে আমি সমাজে মেলামেশা এক রকম বন্ধই করে দিয়েছি। আর তার ফলে আজকাল টের পাই, আমার কী দুর্বিষহ অবস্থা। কারও সঙ্গে ঠিকমত কথা বলতে পারি না, কেউ ডাকলেও এড়িয়ে চলি, আমি কি আর কোনদিন আমার নিজস্ব আধ্যাত্মিক চেতনার জগতেও ঢুকতে পারব? তোমাকে দোষ দেব না, আমার ছোট্ট সোফি সোনা, এ আমারই দোষ, তোমার এতে কোন হাত নেই। জীবন সম্বন্ধে আমাদের দু'জনের ধ্যানধারণা – আমাদের চেতনার নিয়ত উন্মেষ, মানুষ হিসাবে আমাদের দায়িত্ববোধ, আমাদের শিক্ষাদীক্ষা – সবই এত আলাদা যে আমরা কেউ কাউকে বুঝে উঠতেই পারব না কোনদিন। আমার নিজের ওপরেই লজ্জা হয়, ঘৃণা হয় যে আমি শিক্ষিত লোকের সংসর্গ থেকে এতদূরে সরে এসেছি। কেন তোমাকে এসব লিখছি কী জানি, এ লেখার কোন মানেই হয় না। তুমি এসব বুঝবে না, নিজেরটা ছাড়া তুমি বোঝোই বা কী? আমি যে আমার সময়, যশ, শিক্ষিত সমাজের সঙ্গে আমার ওঠাবসা আর আমার প্রিয় ব্যবসাও জলাঞ্জলি দিতে বসেছি, সে তোমার বোঝার সাধ্য আছে? আমার হৃদয় থেকে রক্তক্ষরণ হচ্ছে বলেই আজ এই তেতো কথাগুলো লিখছি তোমায়, রাগ কোর না। আমারই প্রশয়ে তুমি আমার আধ্যাত্মিক শক্তিকে উপেক্ষা করেছ এতকাল। এ রকমই হয়। যখন কেউ শিক্ষিত সমাজ থেকে নিজেকে সরিয়ে নেয়, চিন্তা ও ভাবের আদানপ্রদান বন্ধ করে দেয়, সে তা ফিরে পাওয়ার শক্তিও হারায়। সোফি, আমার পুতুলসোনা, তোমার সামনে দীর্ঘ পথ, আমি চাইনা আমার মত তোমার দশা হোক।
জীবনের হাফ-সেঞ্চুরির কাছে এসে এক প্রাজ্ঞ, অন্য বহুবিষয়ে সফল পুরুষ যখন নিদারুণ প্রেমহীনতায় এক আনপড় যুবতীকে এইসব কথা শোনাচ্ছেন, ঠিক সেই সময় পৃথিবীর আর এক প্রান্তে এক টীন-এজার বাঙালি তরুণ লিখে শেষ করে ফেলেছে তার প্রেমের প্রথম পাঠ – ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী। জীবনের সঙ্গে তার অদ্ভুত ভালবাসা, তাই মৃত্যুকে সে অবহেলায় বলতে শিখে গেছে, মরণ রে, তুঁহু মম শ্যামসমান।
সোফিকে লেখা আরও বহু চিঠিতে আলফ্রেডের হতাশা ফুটে উঠত স্পষ্ট হয়ে। মেজবৌদি এডলাকেও লিখেছিলেন – তোমার আর আমার মধ্যে কত তফাত দেখ, বৌদি। তোমাকে ঘিরে আছে প্রেম, আনন্দ, গুঞ্জন, মধুময় জীবন। তুমি আদরযত্ন করছ একজনকে, সেও তোমাকে করছে। আর আমি, দিকশূন্য জাহাজের মত ভবঘুরে এক। আমার অতীতের কোন সুখস্মৃতি নেই, নেই ভবিষ্যতের রঙীন স্বপ্নও।
আলফ্রেডের ছোটবেলার কাহিনী আরো করুণ। মা-অন্ত প্রাণ ছিল তার। রোগে ভুগে ভুগে জরাজীর্ণ চেহারা ছিল যে, মা ছাড়া গতিও ছিল না। আঠার বছর বয়সে মা-কে নিয়ে চারশো ঊনিশ লাইনের এক দীর্ঘ কবিতা লেখেন ইংরাজীতে, তাতে শেলীর প্রভাব স্পষ্ট। তার কয়েকটা লাইন এই রকম –
তোমার জন্যে, মাগো, জানো তুমি, ভয় পেয়েছিল যমও,
নয়তো আমার দোলনাটা ছিল মৃত্যুশয্যাসম।
নিবু নিবু সেই প্রদীপের আলো হাওয়াতে বুঝিবা হারায়
তুমি তুলে নিলে কোলে, ভরে দিলে স্তন্যদুগ্ধধারায়।
জ্ঞান হারাই যত, ফিরে চেয়ে দেখি চারিদিকে শূন্যতা –
মৃত্যুর পথে শীর্ণতনুটি, কান্নাও নীরবতা।
মা আন্দ্রিয়েতা পাখির মত আগলে রাখতেন সবকটা ছেলেকেই। আলফ্রেডের অস্পষ্ট মনে আছে, সে তখন চার বছরের বাচ্চা, বড়দা রবার্ট আট আর লুডুইগ ছয়, তাদের তিন ভাই আর মা-কে রেখে বাবা ইমান্যুয়েল ফিনল্যাণ্ডের টুর্কু বলে এক জায়গায় চলে গেলেন ভাগ্যান্বেষণে, চাকরির খোঁজে, স্টকহোমে ব্যবসায় ভরাডুবি হওয়ায়। কী করে তাদের সংসার চলবে, চারটে মুখে দুবেলা রুটি জুটবে কিভাবে, তার কোন হদিশ না দিয়েই।
সে এক অসম্ভব দুঃসময়। নিজের বাবার কাছে কিছু টাকা ধার নিয়ে একটা খাবারের দোকান দিলেন আন্দ্রিয়েতা। ভোরবেলা থেকে রাত্রি অবধি সেখানে হাড়ভাঙা খাটুনি। সঙ্গে তিন ছেলের দেখভাল। একদিন দোকানে বসে আছেন, কে খবর দিল তাদের বাড়ি আগুন লেগে গেছে। পাগলিনীর মত বাড়ি ছুটে গেলেন, সেটা তখন দাউ দাউ জ্বলছে। রবার্ট আর লুডুইগ বাইরে, আলফ্রেডকে দেখতে পেলেন না। আগুন ক্রমশ বেড়েই চলেছে। ভেতরে ঢুকতে যাবেন, পড়শিরা বাধা দিচ্ছে, এই আগুনে ভেতরে যাওয়া মানেই পুরো পুড়ে যাওয়া। কিন্তু আলফ্রেড তো নিশ্চয় ভেতরে, সে তো অর্ধেক পঙ্গু! সব বাধা ছাড়িয়ে আগুনের হলকার মধ্যে ভেতরে ঢুকে গিয়ে বিছানা থেকে তুলে নিয়ে এলেন আলফ্রেডকে। একটাও আসবাব বাঁচেনি আগুনের হাত থেকে। দোকানটা একটু থিতু হয়েছিল, আবার শূন্য থেকে শুরু করতে হবে এই ভাঙা সংসার!
সাত বছর বয়সে যে স্কুলে ভর্তি হয়েছিল আলফ্রেড আর তার আগে তার দুই দাদাও, সেই জেকব প্যারিশ অ্যাপোলোজিস্ট স্কুলে ভদ্রলোকের ছেলেরা পড়তে যায় না। কিন্তু সম্ভ্রান্ত বাড়ির বাচ্চাদের ক্লারা স্কুলে তো অনেক বেশি খরচা, আন্দ্রিয়েতার সাধ্য নেই সেখানে পড়ানোর। দেড় বছর সেই স্কুলে পড়ে ক্ষান্তি দিল আলফ্রেড। ধুর ধুর, ওখানে পড়াশুনা কিছুই হয় না, শুধু গালাগালি আর মারামারি। শিক্ষকরা বাচ্চাদের বেত পিটিয়েও ঠাণ্ডা করতে পারতেন না। তিন রকমের বেত ছিল – লম্বা, মাঝারি আর বেঁটে। ছ'টা বানান ভুল হলেই ডাক পড়ত শিক্ষকের ডেস্কে, তার একধারে হাতের আঙুল বিছিয়ে ধরতে বলা হত, আর বেত দিয়ে সেই আঙুলের ওপর নেমে আসত ছ' ছটা সপাং সপাং বেতের বাড়ি।
ন'বছর বয়সে আলফ্রেড মা আর দাদাদের সাথে চলে গেল রাশিয়ায়, বাবা ইমান্যুয়েল বেশ কিছুদিন আগেই টুর্কু থেকে সেন্ট পিটার্সবার্গে চলে এসেছেন আর বেশ ভালোই গুছিয়ে নিয়েছেন সেখানে। আবার পুরো নোবেল পরিবার একত্র হল। রাশিয়ার সাথে ইংল্যাণ্ডের গণ্ডগোল লেগেই থাকে, তাই অস্ত্রশস্ত্রের ব্যবসা বেশ লাভজনক। ব্যবসায় মাঝে মাঝে মার খেলে কি হয়, ইমান্যুয়েল করিৎকর্মা মানুষ, খুব ছোটবেলা থেকেই তার প্রবল সৃজনীশৈলীর উদাহরণ পাওয়া গেছে। তিনি আবিস্কার করেছেন আধুনিক প্লাইউড, যদিও বিস্ফোরকের দিকেই তার নজর বেশি। রাশিয়ায় তখন অস্ত্রশস্ত্রে নতুন জিনিস উদ্ভাবকদের খুব সম্মান। সেই সুযোগে তিনি রাশিয়ার জেনারেলের সঙ্গে দোস্তি পাতিয়ে ফেলেছেন। ফলে তার ব্যবসাও বাড়ছে। সেন্ট পিটার্সবার্গে প্রাইভেট টিউটরের তত্ত্বাবধানে শুরু হল আলফ্রেডের পড়াশুনা। পদার্থ-রসায়ন আর ইংরাজী সাহিত্য হয়ে গেল ওর সবচেয়ে প্রিয় বিষয়। সেখানেই পরের বছর জন্মালো ওদের ছোট ভাই এমিল।
বাবা বিভিন্ন ধরণের যন্ত্রপাতি আর যুদ্ধাস্ত্র, বিশেষ করে সী- আর ল্যাণ্ডমাইনের ব্যবসা করেন, তার ভাল লাগল না যে আলফ্রেডের মন ক্রমাগত সাহিত্যের দিকে ঝুঁকে পড়ছে, সে নাকি লেখক হতে চায়। পড়াশুনায় সে তুখোড়, বিজ্ঞানে তো বটেই, এইসব ফালতু সাহিত্য-টাহিত্য করে কোন লাভ আছে? পেটের ভাত জুটবে না লেখালিখি করে। সতের বছর বয়স পুরাতেই তাই বাবা তাকে বললেন, আমেরিকা যাবি? জন এরিকসন বলে এক বিজ্ঞানী দারুণ সব গবেষণা করছেন শুনেছি। তাঁর কাছে কাজ শিখবি। আজন্ম গৃহবন্দী আলফ্রেডের কাছে আমেরিকা তো স্বপ্ন। বাবা ইমান্যুয়েলও ভাবলেন, যাক বাবা, সাহিত্যের ভুতটা এবার ঘাড় থেকে নির্ঘাৎ নেমে যাবে। শিখতে যাচ্ছে তো রসায়ন। আমেরিকাতে ক'বছর রসায়নের পাঠ নিয়ে বাড়ি ফিরে এল আলফ্রেড।
ইমান্যুয়েলের সী-মাইনের ব্যাপারটা এই রকম। আগে যে নাইট্রোসেলুলোজের কথা বলেছি, যা দিয়ে বানানো হত নাইট্রো-ফিল্ম, তার আবিস্কার হয় ১৮৪৬ সালে। অন্যান্য দেশে সী মাইন বানাতো লোহার তৈরী খোলের মধ্যে এই নাইট্রোসেলুলোজ পাউডার ভরে দিয়ে। সিঙাড়ার মত জিনিস, পুরের জায়গায় বিস্ফোরক পাউডার। ইমান্যুয়েল এর ডিজাইন পালটে দিলেন। চৌকো বাক্সের মধ্যে ভরলেন এই পাউডার, তার এক প্রান্তে একটা লম্বা লোহার ডাণ্ডা বেরিয়ে থাকল। ঐ বাক্সটার আর একটা ছোট্ট খোপে রাখলেন পটাশিয়াম ক্লোরেট, গন্ধক, চিনি আর একটা কাঁচের অ্যাম্প্যুলে ঘন সালফিউরিক অ্যাসিড। কোন ডুবোজাহাজ ঐ বেরিয়ে থাকা লোহার ডাণ্ডায় ধাক্কা মারলে সেটা গিয়ে ধাক্কা মারতো কাঁচের অ্যাম্প্যুলটায়। সেটা ফেটে অ্যাসিড বেরিয়ে এসে মিশে যেত বাকি জিনিসগুলোর সাথে আর তার ফলে একটা ছোটখাট একটা বিস্ফোরণ ঘটত। এর ধাক্কা গিয়ে পড়ত ঐ বাক্সের নাইট্রোসেলুলোজের ভান্ডারে, আর সেটা মহানন্দে ফাটত তখন প্রবল বিস্ফোরণ ঘটিয়ে।
১৮৪৭ সালে আবিস্কার হয় নাইট্রোগ্লিসারিন বলে এক তরল, ইটালিতে। এ এক আজব বস্তু। বিশুদ্ধ নাইট্রোগ্লিসারিনে আগুন দাও, তেলের মত জ্বলবে, যেন ভাজা মাছটি উল্টে খেতে জানে না। কিন্তু বোতলে ভরে রাখ, এমনিতেই, আর যদি তার সঙ্গে একটু নাইট্রিক অ্যাসিড বা ঐ রকমের কিছু অশুদ্ধতা মিশে থাকে, তাহলে তো বটেই, কথা নেই বার্তা নেই, বিশালভাবে ফাটবে। কখন সেই বিস্ফোরণ ঘটবে, তা আগে থেকে বলা যায় না। সবাই ধরে নিল, এ রকম যার বেয়াদপি, তাকে দিয়ে কাজের কাজ কিছু করানো যাবে না। মাইনের কাজে নাইট্রোগ্লিসারিন ব্যবহারের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে সবাই হাল ছেড়ে দিল। ব্যতিক্রম ইমান্যুয়েল, তিনি হাল ছাড়ার পাত্র নন। আর আলফ্রেড কেমিষ্ট্রি শিখে এসে এসব ব্যাপারে উৎসাহ পেয়ে গেলেন। নিকোলাই জিনিন বলে এক ফরাসী বিজ্ঞানীর কাছে কিছুদিন তালিম নিয়েছিলেন আলফ্রেড, তিনিও উৎসাহিত করলেন আলফ্রেডকে। ১৮৬০ সালে সেন্ট পিটার্সবার্গেই একটা ছোটখাট সফল পরীক্ষা করে ফেললেন তিনি নাইট্রোগ্লিসারিন নিয়ে।
এর মধ্যে আবার এক ঝঞ্ঝাট ঘটে গেছে। ক্রিমিয়ার যুদ্ধে রাশিয়া হেরে গেছে, আর তার ফলে যুদ্ধের আগে ব্যবসায়ীদের দেওয়া সমস্ত কন্ট্রাক্ট নাকচ করে দিয়েছে দেশের অধিকর্তারা। ইমান্যুয়েল আবার ব্যাংক্রাপ্ট! ফলে ঘটিবাটি বেচে স্টকহোমে চলে আসতে বাধ্য হলেন ইমান্যুয়েল। সঙ্গে আলফ্রেড ও তার মা। রবার্ট আর লুডুইগ থেকে গেল রাশিয়াতেই, যদি কোনভাবে ভাগ্য ফেরানো যায়, সেই আশায়।
এর পরের ইতিহাস অতিশয় চমকপ্রদ। ১৮৬৩ সালে নাইট্রোগ্লিসারিন ডিটোনেটর আবিস্কার করলেন আলফ্রেড। পরের বছর সেপ্টেম্বরে সেই ফ্যাক্টরিতে কাজ করছেন, হঠাৎ ঘটল বিশাল এক বিস্ফোরণ। আলফ্রেডের আঘাত ততটা গুরুতর নয়। কিন্তু পাঁচজন মারা গেল, তার মধ্যে একজন আলফ্রেডের চেয়ে দশ বছরের ছোট কনিষ্ঠ ভাই এমিল। শোকের ছায়া নেমে এল নোবেল পরিবারে।
কিন্তু আলফ্রেড দমলেন না। এই বিস্ফোরককে কী করে আরো নিরাপদ বানানো যায়, তার ওপর চলতে লাগল তার নিরন্তর গবেষণা। লাইসেন্স পেয়ে জার্মানীর হামবুর্গ শহরের বাইরে ক্রুমেল শহরে এক বিশাল কারখানা খুললেন তিনি। ১৮৬৬ সালে আবিস্কার করলেন নাইট্রোগ্লিসারিনের সাথে ডায়্যাটোমেশিয়াস আর্থ (এক ধরণের ক্ষুদ্র জীবাণুর মৃত শরীরের খোলস, ধুলোর মতই দেখতে)-এর এমন এক মিশ্রণ, যা বিস্ফোরণ নিয়ন্ত্রণে বহুধাপ এগিয়ে গেল। আলফ্রেড এর নাম দিলেন ডিনামাইট। পরবর্তী দু'তিন বছরে ইংল্যাণ্ড আর আমেরিকা থেকে এর পেটেন্ট পেয়ে গেলেন তিনি। খোলা হল আরো কারখানা। নাইট্রোগ্লিসারিনের সাথে অন্যান্য নাইট্রো- যৌগের মিশ্রণে আরো বিভিন্ন বিস্ফোরক তৈরী করলেন। তার মধ্যে যেটা স্বচ্ছ জেলির মত, তার নাম দেওয়া হল জেলিগ্নাইট বা বিস্ফোরক জিলেটিন। সেটা ১৮৭৬ সালে। খননকার্য, পাথরের চাঙড় ভাঙা ও যুদ্ধাস্ত্র – সব রকমের কাজেই ব্যবহৃত হতে লাগল এই সব আবিস্কারের বস্তু। এর পরেও তিনি আবিস্কার করেন ব্যালিস্টাইট, ধূমহীন বিস্ফোরক ও রকেটের প্রোপেল্যান্ট হিসাবে এর ব্যবহার এখনও হয়।
রবার্ট আর লুডুইগ সেই যে রাশিয়াতে থেকে গেছিল, ওরাও কম এলেমের ছেলে নয়। পৃথিবীতে খনিজ তেলের ক্রমবর্ধমান চাহিদা দেখে রাশিয়ার বেশ কিছু তৈলখনি নিয়ে ব্যবসা শুরু করে তারা ইতিমধ্যে বেশ দু'পয়সা কামিয়ে নিয়েছে। সে সময় সারা পৃথিবীর অর্ধেকের বেশি পেট্রোলিয়াম তোলা হত রাশিয়া থেকেই। সুযোগ বুঝে আলফ্রেড তার ডিনামাইট বিক্রির মুনাফা বিনিয়োগ করল দাদাদের সেই তেলের কোম্পানীর শেয়ারে, আর দিনকে দিন লাল হতে লাগল। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বানানো হল তাঁর কারখানা, কিনে ফেললেন অনেক কোম্পানী, তারমধ্যে অন্যতম হল বোফর্স। কপর্দকহীন নোবেল পরিবার আবার উঠে এল পাদপ্রদীপের আলোয়।
১৮৮৮ সালে ফ্রান্সের কান শহরে বেড়াতে দিয়ে লুডুইগ হৃদরোগে মারা যান। তার শেষকৃত্য সম্পন্ন হওয়ার আগেই আলফ্রেড দেখলেন ফরাসী খবরের কাগজে বড় বড় হেডলাইন – Le marchand de la mort est mort অর্থাৎ মৃত্যুর কারবারীর মৃত্যু হল। নীচে কয়েক কলম জুড়ে আলফ্রেডের সমস্ত বিস্ফোরক নিয়ে ব্যবসার নিন্দা ফলাও করে ছাপা। আলফ্রেডকে মানুষ মারার প্রযুক্তি থেকে মুনাফা লোটার তীব্র সমালোচনা হয়েছে।
প্রথমে বিস্মিত হলেন আলফ্রেড, ব্যাটারা ধরে নিয়েছে তাঁরই মৃত্যু হয়েছে। পরক্ষণেই ক্রোধে লাল হয়ে গেল তাঁর মুখ। ভেবেছে কী এরা, এর আগে যুদ্ধ, হানাহানি, মানুষের আকস্মিক মৃত্যু এসব কিছু ছিল না বুঝি! আর এই আবিস্কারের ফলে খনিগর্ভ খননের কাজ যে ত্বরান্বিত হয়েছে কতগুণ, প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহার বেড়ে গেছে, পাহাড়ি দুর্গম অঞ্চলে রাস্তাঘাট বানানো হচ্ছে, প্রকৃতির ওপর মানুষের অধিকার স্থাপিত হচ্ছে, এসবের কোন মূল্য নেই? উজবুকের দল এসব কবে বুঝবে? ক্রোধ প্রশমিত হলে মনে জাগল অনুতাপ। এত সম্পত্তির মালিক তিনি, সারা জীবনের এত পরিশ্রমের ফসল তাঁর সাড়ে তিনশোর অধিক পেটেন্ট নেওয়া আবিস্কার, এসব কেউ মনে রাখবে না। দেখাই তো যাচ্ছে, তাঁর মৃত্যুর পরে তাঁকে সবাই জানবে মৃত্যুর কারবারী হিসাবে। অসহ্য!
ফ্রান্স ছেড়ে পাকাপাকি ইটালি চলে গেলেন তিনি। পরিবারের কাউকে না জানিয়ে গোপনে এক উইল বানালেন। সেই উইল পরের কয়েক বছরে পাল্টানোও হল কয়েকবার। ১৮৯৬ সালের তারিখে সান রেমো শহরে তাঁর শেষ নিঃশ্বাস বেরিয়ে যাওয়ার পর সেই উইল দেখে পরিবারের সবাই তো হতবাক। কুড়িটা দেশের নব্বইটা কারখানা তাঁর, বিভিন্ন কোম্পানীর নামে। তাঁর সমস্ত সম্পত্তি, যার পরিমাণ তখন ৩১ বিলিয়ন সুইডিশ ক্রোনারেরও বেশি (প্রায় পৌনে দুই বিলিয়ন পাউণ্ড সেই যুগে), তার ৯৪ শতাংশ তিনি দিয়ে গেছেন এক ট্রাস্ট বানাতে, যার নিরাপদ বিনিয়োগের নির্দেশ দিয়েছেন তিনি, তার বাৎসরিক আয় থেকে পাঁচটা পুরস্কার দেওয়ার জন্য – আগের বছর যার অবদান সেই বিষয়ে পৃথিবীশ্রেষ্ঠ বলে বিবেচিত হবে, তাদের। বিষয়গুলি হল পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, চিকিৎসাবিদ্যা, সাহিত্য ও বিশ্বশান্তি।
যে জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণ ছিলেন আলফ্রেড, তার এই পুরস্কারগুলির মধ্য দিয়ে তিনি অমর হয়ে রইলেন। যে দুজন নারীকে জীবনসঙ্গিনী হিসাবে চেয়েছিলেন, তাঁর মৃত্যুর পর তাদের জীবন দু খাতে বয়ে যায়। বার্থার সাথে আলফ্রেডের চিঠিতে যোগাযোগ হয়েছিল আগেই, যুদ্ধের বিরুদ্ধে আর বিশ্বশান্তির সপক্ষে বার্থার আন্দোলন ছিল তীব্র, আর সেই আন্দোলনে সে চেয়েছিল আলফ্রেডের সক্রিয় সাহায্য। ১৮৮৯ সালে তার লেখা 'লে ডাউন আর্মস' বইটা সাড়া ফেলে সারা পৃথিবীতে। তিন বছর পরে বার্ণে শান্তি কংগ্রেসের মুখ্য আয়োজিকা বার্থা অর্থসাহায্য চেয়েছিল আলফ্রেডের কাছে। টাকা দিয়েছিলেন আলফ্রেড, সঙ্গে নোট – তোমার এই কংগ্রেস যদ্দিনে শান্তি আনবে, তার অনেক আগেই আমার কারখানাগুলো তা করে ফেলবে। এই সব চিল্লামিল্লি করে শান্তি আসে না। যখন এক সেকেণ্ডের মধ্যে দু'দল সৈন্য একে অপরকে ধ্বংস করে ফেলতে পারবে, তখন উপায়হীন মানুষ বাপ বাপ বলে শান্তির উপাসনা করবে, তার আগে নয়। আলফ্রেড তাঁর তালিকায় যে 'বিশ্বশান্তি'তে অবদানের জন্য পুরস্কার যুক্ত করেছিলেন, তার পেছনে নিঃসন্দেহে বার্থার প্রভাব ছিল। ১৯০৫ সালে – যে বছর বাংলা ভাগ হয়ে যাওয়ায় ভারতে অশান্তি চরমে – নোবেল শান্তি পুরস্কার যার হাতে উঠে এসেছিল, তার নাম বার্থা ফন সাটনার। অন্যজন সোফি হাঙ্গেরির এক ক্যাভালরি অফিসারকে বিয়ে করে ঘরসংসার শুরু করে। সে সংসার কতটা সুখের হয়েছিল, সে বিবরণ লিখে রাখার সাধ্য তার ছিল না। রবীন্দ্রনাথের নোবেল পুরস্কার পাওয়ার খবর যখন এল শান্তিনিকেতনে, তার বছর খানেক আগে সে মারা যায়।
টেলিগ্রাম পাওয়ার ঠিক একমাস আগে বিদেশ থেকে ফিরে রবীন্দ্রনাথ গান লিখেছিলেন –
কেন তারার মালা গাঁথা
কেন ফুলের শয়ন পাতা
কেন দখিন হাওয়া গোপন কথা
জানায় কানে কানে
যদি প্রেম দিলে না প্রাণে ...
এ যেন তাঁর পুরস্কারদাতা আলফ্রেড নোবেলের সারা জীবনের গান, এক অতৃপ্ত আত্মার আত্মকথন।
পনেরই নভেম্বর টেলিগ্রাম পাওয়ার দুদিন পরেই রবীন্দ্রনাথ তাঁর সম্মতি তার করে দিলেন। কুড়ি তারিখে এল আরও একখানা টেলিগ্রাম, সুইডিশ অ্যাকাডেমির সেক্রেটারির কাছ থেকে। তাতে লেখা, 'Nobel Prize will be solemnly handed over Stockholm 10th of December Invite you heartily though fear time will not allow your coming'. ঠিক হল কবির পক্ষে স্টকহোমে ব্রিটিশ দূতাবাসের প্রতিনিধি এই পুরস্কার গ্রহণ করবেন। তিনি বাংলার তখনকার গভর্ণর লর্ড কারমাইকেলের সঙ্গে যোগাযোগ করলেন কবির কাছ থেকে ধন্যবাদজ্ঞাপক একটা বার্তা আহ্বান করে। কবি সেই চিঠি পেয়ে তার নিজের লেখার টেবিলে বসে রইলেন অনেকক্ষণ। কী লেখা যায়? পরিচিতদের বাচ্চাদের নামকরণ বা আশিস্ চেয়ে একটা কাগজ বাড়িয়ে ধরলে যিনি মুহূর্তের ভিতর খসখস করে লিখে দিতে পারেন অনবদ্য কবিতা, এখন তাঁর কলম দিয়ে শব্দ বের হচ্ছে না।
দশই ডিসেম্বরে নিয়মমাফিক নোবেল পুরস্কারের সম্মানসভায় সে বছরের সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারবিজয়ীর নাম যখন ঘোষিত হল, পুরস্কার নিতে এলেন সুইডেনে ব্রিটিশ অ্যাম্বাসাডার ক্লাইভ। তাকে দেওয়া হল একটা স্বর্ণপদক আর একটা ডিপ্লোমা। ডিপ্লোমার ওপর সুইডিশ ভাষায় লেখা, প্রাপক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, তাঁর অনবদ্য সংবেদনশীল, তরতাজা সুন্দর কাব্যরচনার জন্য, অসামান্য দক্ষতা ও কাব্যশৈলী দিয়ে যিনি নিজস্ব ইংরাজী শব্দে প্রকাশ করেছেন পাশ্চাত্য সাহিত্যের অংশ। ক্লাইভ পাঠ করলেন রবীন্দ্রনাথের বার্তা – সুইডিশ অ্যাকাডেমিকে আমার আন্তরিক শ্রদ্ধা জানাই সেই বাণী হৃদয়ঙ্গম করার জন্যে, যা দূরকে করে নিকট, অপরিচিতকে সহোদর।
ঠিক এর তিরিশ দিন পরে, ১৯১৪ সালের জানুয়ারির নয় তারিখে কলকাতায় গভর্ণরের বাসভবনে এক বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রনাথের হাতে তুলে দেওয়া হয় সেই স্বর্ণপদক ও ডিপ্লোমা।
প্রাতিষ্ঠানিক যে শিক্ষাব্যবস্থা ছিল রবীন্দ্রনাথের দু'চক্ষের বিষ, ছাত্র হিসাবে তিনি যার অন্দরমহলে পা রাখতে চাননি কোনদিন, তার আমূল পরিবর্তন করে শিক্ষক হিসাবে নতুন ধ্যানধারণা প্রবর্তনের অমোঘ যজ্ঞে মেতে আছেন তিনি। না চাহিলে যারে পাওয়া যায়, তার তালিকায় তিরস্কারের সংখ্যাই বেশি, পুরস্কার মেলে কদাচিৎ। নোবেল পুরস্কার তাঁর হস্তগত হলেও তিনি জানতে পারলেন না, এর পেছনে ঘটে গেছে অনেক চাঞ্চল্যকর ঘটনাবলী।
(ক্রমশঃ)