রবিবার, ২৬ জুন, ২০১১

খেরোর খাতা ~ অবিন দত্তগুপ্ত


"কখনো সময় আসে জীবন মুচকি হাসে/ঠিক যেন পড়ে পাওয়া চো‍‍‌দ্দো আনা"

     মাঝে মাঝে এমনটা হয়।ফেলে আসা কোনো কিছু ফিরে পেতে ইচ্ছে করে।অনেক দিন না ছোয়া কোনো পুরোনো ভালোলাগাকে ছঁুয়ে দেখতে ইচ্ছা করে।আমার ক্ষেত্রে এই ইচ্ছেগুলো মূলত দিনান্তের ক্লান্তির পর আমায় জুড়ে বসে।

      আজ সেরকমই একদিন।সারাদিনের ক্লেদ সঞ্চনের শেষে আজ হঠাৎই সেই পেছন ফেরার ক্যারাটা মাথার ভেতর তাণ্ডব নেত্ত আরম্ভ করলো।এখন সমস্যা হলো এাই যে এই নির্বাসনা,যেখানে আমার জামা-জুতো আর দু চারটে বই ছাড়া নিজস্ব বলতে কিছুই নেই,সেখানে "পুরানো" পাই কোথায়।হঠাৎ চোে পড়লো একটা ধুলো মাখা লাল ডায়েরি।কোনো কোনো শীতের সকালে কুয়াশাঢাকা সমস্ত কিছু নিজের বড় নিের বলে মনে হয়;তেমনি ওই ডায়েরিটা -- আড়াই বছরের নির্বাসনে যার উপর কোনোদিন
ও চোখ পড়েনি,ওকেই বড্ডো আদরের মনে হলো।হাতে তুলে নিলাম।

     পাতা ওল্টাতে গিয়ে প্রথমেই লক্ষ্য করলাম অনেকগুলো পেজ স্টেপল করা।তারপর বাবার হাতের লেখা।আর কি লেখা তাতে -  না কোন অসুখের জন্য ঠিক কোন ওষুধটা খাওয়া উচিত। বাঁদরের থেকে উদ্ভুত প্রজাতি আমরা,সুতরাং বাঁদরেরই মতো অকারণ অনুসন্ধিৎসা শিরায় শিরায়।ছিঁড়ে ফেল্লাম স্টেপল করা পেজগুলো।
লেখা রয়েছে ;
পূজা ২০০৪
২০/০৯;
--------
গুড্ডুর প্যান্ট -> ৬৫০
গুড্ডুর টি-শার্ট-> ০২৫০
গুড্ডুর শার্ট -> ৩৫০
গুড্ডুর (ইনার্স) -> ৪০
শাড়ি বাবদ নাড়ুকে (ফার্স্ট ইনস্টলমেন্ট) -> ৩০০০
মাতৃবস্ত্রালয় (তুতুন) -> ১৫০০
মায়ের শাড়ি -> ৫০০
বাবার ফতুয়া + লুঙ্গি -> ০৩৫০
.
.
.
সোনালি রেস্টুরেন্ট -> ৭৫
বাসফেয়ার -> ২০
রিক্সা -> ৫
বেশ কিছুদূর পরে এসে পুজোর দিনের খরচগুলো পড়লাম।অক্ষরে অক্ষরে তুলে দিচ্ছি
০৬/১০/০৪ (আজ সপ্তমী)
--------------
১.রিক্সা -> ২৪.০০
২.বাস ->৫.০০
৩.মিষ্টি -> ৫৩.০০
০৭/১০/০৪ (আজ অষ্টমী)
--------------
১.কাগজ ->৩.০০
২.সিগারেট ->২২.০০
৩.মাংস ->১২০
৪.মদ ->২০০
৫.গুড্ডু ->৫০
৬.গুড্ডু (ওর মাকে দেওয়া ও জানেনা) -> ২০০
এরপর আরো অনেক অনেক।
             পড়তে পড়তে ফিরে গেছিলাম আমাদের পুরানো দিনগুলিতে।পোদদার-পার্কের দু কামরার ঘর।দাদু-ঠামি একটায় আর আমরা তিনজন আরেকটায়।সত্য যুগ থেকে কাঠের দরজায় লাগানো 'U'শেপের ছিটকিনিটা তখনো বিশ্বস্ত।অফিস ফেরতা বাবা পকেটের আধুলি-চারআনা-একটাকা গুলোকে ক্যামেরার ফিল্মের কৌটোয় ভরে রাখতো।আর ওই ফিল্মের কৌটোগুলোকেই পাখির চোখ করতাম-আমি..বাপের সুপুত্র।তখন প্রেম চলছিল যে!বাড়ি থেকে ফোন করা মানা সুতরাং পাবলিক বুথ।প্রচুর
কয়েনের দক্কার।

             কিন্তু সব ছাপিয়ে মনে পড়ে যায় ওই েমে নেয়ে আসা মানুষটার একা ডায়েরিতে নিত্য দিনের হিষেব লিখে রাখার  ঘটনাটা।আমি ছোটবেলায় মাকে জিগ্যেস করেছি " মা...বাবা অত কি লেখে?". মা হেসে উত্তর দিয়েছিলো " আগে বিতা লিখতো,স্বপ্ন লিখতো....এখন খেরোর খাতা"
             স্বচক্ষে কোনোদিনও  সেই মহামূল্যবান খাতাটি দেখে উঠতে পারিনি।সব সময়েই তা রেখে দেওয়া হয়েছিল,আমার চোখের আড়ালে।আজ দেখতে দেখতে অনেক কথা স্বচ্ছ হলো।প্রতিদিন বাঁচতে গিয়ে রোজ দুপুরের স্বপ্নগুলো কেন হারিয়ে যাচ্ছে,বুঝতে পারিনি.............বুঝলাম।মাসের শেষে গোল্ড ফ্লেক যখন শুধুই ফ্লেক হয়ে গেছে তখন কপালে হাত দিয়ে ভেবেছি " কি বাজে খরচাটাই না করলাম!!"।বুঝলাম..আমার কোনো হিষেবই ছিল না।আসলে আমরা বেহিষেবির মতো খরচা করেছি এমন অনেক কিছু..যা কিভাবে পেয়েছি,খরচের ব্যস্ততায় তা মনে রাখার প্রয়োজন-ও বোধ করিনি।একটা দুটাকার নোট বাঁচানোর জন্য যে লোকটা পিচের রাস্তায় রীতিমতো ডাইভ মেরেছিলো.....তাররি সন্তান,তার "সব পেয়েছি" সন্তান অবলীলায় হারাতে পারে মোবাইল,মূল্যবোধ,প্রেম,সম্পর্ক্য..........

            বাবার হাতের লেখায় ডুবে যাছ্ছিলাম।খেরোর খাতাও-যে এত্তো রোম্যান্টিক হতে পারে,এমন ধারণা ছিলনা! ডুবতে ডুবতে  হিষেব করলাম নিজের জীবনে 'চোদ্দ আনা' স্বপ্নকে নিলাম তুলে দিয়ে ভদ্রলোক খরিদ করেছেন তার সন্তানের দু-আনা বেঁচে থাকা।
                                  বড্ড বেহিষেবি বাবা আমার

বুধবার, ২২ জুন, ২০১১

গণতন্ত্র, গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা করাই আজ সবচেয়ে বড় চ্যাতলেঞ্জ ~ অজয় দাশগুপ্ত

গণতন্ত্রের জন্য, গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠা ও সাধারণ মানুষের জীবন-জীবিকার স্বার্থে দীর্ঘ সংগ্রামের ফলশ্রুতিতেই পশ্চিমবাংলায় গঠিত হয়েছিল বামফ্রন্ট সরকারগত ৩৪ বছর ধরে গোটা দেশে বামফ্রন্টের পশ্চিমবাংলাই ছিল গণতন্ত্র, গণতান্ত্রিক অধিকারকে সুরক্ষিত ও সম্প্রসারিত করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে উজ্জ্বল উদাহরণ। বামফ্রন্ট সরকার ছিল মানুষের গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষায় অতন্দ্র প্রহরী।
  
কৃষকের জমি ও ফসলের অধিকার, ক্ষেতমজুরের মজুরি অধিকার, বর্গাদার-পাট্টাদারের চাষের অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং রক্ষায় বামফ্রন্ট সরকারই ছিল গ‌্যারান্টি। শ্রমিক-কর্মচারীদের ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার, মালিকপক্ষের সঙ্গে বেতনসহ বিভিন্ন সুবিধা আদায়ের জন্য দর কষাকষির অধিকার প্রতিষ্ঠা, শিক্ষক-অধ‌্যাপকদের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা ও রক্ষার নিশ্চয়তা দিয়েছিল বামফ্রন্ট। বামফ্রন্টের পশ্চিমবাংলায় শ্রমিকের দাবি ও অধিকার রক্ষার লড়াইয়ে মালিকের হয়ে পুলিস গিয়ে গুলি চালায়নি, বরং সরকার শ্রমিকের পাশে দাঁড়িয়ে তাঁর দাবি আদায়ে বাধ্য করেছে মালিককে। সংখ‌্যালঘু মানুষের সম্প্রীতির পরিবেশে সমমর্যাদায় জীবন অতিবাহিত করার নজিরবিহীন নিশ্চয়তা দিয়ে ছিল এই বামফ্রন্ট সরকার। আদিবাসী জনগণ, তফসিলী জাতি, আর্থিক ও সামাজিকভাবে অনগ্রসর মানুষকে সমাজের মূলস্রোতে নিয়ে আসার ক্ষেত্রে, অরণ্যসম্পদের ওপর নির্ভরশীল মানুষের অরণ্যের অধিকার প্রতিষ্ঠায় গোটা দেশে সামনের সারিতে ছিল বামফ্রন্ট সরকারই। নিম্নবিত্ত-মধ্যবিত্ত সাধারণ মানুষ, ছাত্র-যুব-মহিলাসহ সমাজের সব অংশের মানুষের গণতন্ত্র, গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করা, তাকে সম্প্রসারিত করা এবং অর্জিত অধিকার রক্ষা করাই ছিল বামফ্রন্ট সরকারের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব ও কর্তব্য।

        কী ছিল বামফ্রন্টের আগের পশ্চিমবাংলা? মানুষের গণতন্ত্র, গণতান্ত্রিক অধিকারকে কেড়ে নিয়েছিল আজকের তৃণমূলের পূর্বসুরী কংগ্রেসের নেতৃত্বে সরকার। স্বাধীনতার পর থেকে গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য প্রতিটি ক্ষেত্রে মানুষকে নিয়ে লড়াই করেছেন, জেল খেটেছেন, লাঠি-গ‌্যাস-গুলি খেয়েছেন, রক্ত ঝরিয়েছেন বামপন্থীরাই। দীর্ঘ কংগ্রেস শাসনে বামপন্থীরাসহ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি স্বাধীনতা, গণতান্ত্রিক অধিকার কখনই পায়নিপ্রতিটি অধিকারই লড়াই করে অর্জন করতে হয়েছে। তার জন্য এমনকি  জ্যোতি বসুসহ কমিউনিস্ট পার্টি এবং বাম দলগুলির শীর্ষনেতাদের, এমনকি বিশিষ্ট স্বাধীনতা সংগ্রামীদেরও কংগ্রেস আমলে বারবার বিনা বিচারে কারাযন্ত্রণা ভোগ করতে হয়েছে বামফ্রন্ট সরকারের ৩৪ বছরে বিরোধীদের প্রতি এই ধরণের অগণতান্ত্রিক আচরণের একটিও নজির নেই।

   কৃষকদের জমির অধিকার, নিজের জমিতে ফসলের অধিকার প্রতিষ্ঠার যে লড়াই বামপন্থীরা লড়েছে, তা আজো পশ্চিমবাংলাসহ দেশের গণ-আন্দোলনের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। তেভাগার আন্দোলন হয়েছিল বামপন্থীদের নেতৃত্বেই। ছয়ের দশকে জমির আন্দোলন আরো তীব্র আকার নেয়। ১৯৬৭ সালে প্রথম যুক্তফ্রন্ট সরকার এবং ১৯৬৯ সালে দ্বিতীয় যুক্তফ্রন্ট সরকার সেই জমির আন্দোলনকে সহায়তা করেছিলো। ক্ষমতা দখল করার জন্য জমি নিয়ে যারা বামফ্রন্টের বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রচার করেছে, সেই তৃণমূল বা তাদের পূর্বসুরীরা কখনো জমির আন্দোলনের ধারেকাছে ছিল না, ছিল উল্‌টোদিকেই। ১৯৭৭ সালে বামফ্রন্ট সরকারে এসেই পাট্টা রেকর্ড করে, বর্গা রেকর্ড করে ভূমিহীনদের জমির অধিকারকে আইনসম্মত করেভূমি সংস্কারের সেই কর্মসূচী গত ৩৪ বছর ধরেই চলেছে। এমনকি সপ্তম বামফ্রন্ট সরকারের আমলেও প্রায় ১২ হাজার একর জমি গরিব ভূমিহীন কৃষকদের মধ্যে বিলি হয়েছে। সারা দেশে সবচেয়ে বেশি ভূমি সংস্কার হয়েছে পশ্চিমবাংলায়। তথ্যেই প্রমাণিত বামফ্রন্ট সরকারের ভূমিসংস্কার কর্মসূচীর ফলে আদিবাসী, তফসিলী জাতি এবং সংখ্যালঘু মানুষই সবচেয়ে বেশি উপকৃত হয়েছেন।

     বামপন্থীদের নেতৃত্বে বাস্তুহারা মানুষের আন্দোলন, খাদ্য আন্দোলন, ট্রামভাড়া বৃদ্ধি আন্দোলন, শিক্ষক আন্দোলন, জমির আন্দোলন, আধা-ফ‌্যাসিবাদী সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় এরাজ্যে গঠিত হয়েছিল বামফ্রন্ট সরকার। এরাজ্যে সাধারণ মানুষের রাজনৈতিক ও গণতান্ত্রিক অধিকারকেও তাই প্রতিষ্ঠিত করেছিল বামফ্রন্ট সরকার। ১৯৭২ সাল থেকে ১৯৭৭ সালের লোকসভা নির্বাচন পর্যন্ত এরাজ্যে কংগ্রেসী আধা-ফ্যাসিস্ত সন্ত্রাসে খুন হয়েছিলেন প্রায় ১১০০ সি পি আই (এম) নেতা ও কর্মী। ১৯৭০ সাল থেকে ১৯৭৭ পর্যন্ত বিনা বিচারে আটক আইন প্রয়োগে, মিথ্যা মামলায়, হাজার হাজার সি পি আই (এম) নেতা ও কর্মীকে বছরের পর বছর জেল খাটতে হয়। শিক্ষক, অধ্যাপক, উপাচার্য, সরকারী কর্মচারী, খেতমজুর, কৃষক, শ্রমিক, মহিলা, আইনজীবী, চিকিৎসকসহ সব অংশের মানুষের ওপর নেমে আসে খুন, নির্যাতন ও মিথ্যা মামলা, বরখাস্ত হন অনেক সরকারী কর্মী ও শিক্ষক। সন্ত্রাসের জন্য অনেকে কাজে যোগ দিতে পারেননি। ১৯৭৫ সা‍‌লে অভ্যন্তরীণ জরুরী অবস্থার ২০ মাসে বিরোধী নেতাদের গ্রেপ্তার, বাক্‌ স্বাধীনতা হরণ, সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধ, যথেচ্ছ পুলিসী অত্যাচার, সভা-মিছিল-আন্দোলন নিষিদ্ধ করা ইত্যাদি গণতন্ত্র-ধ্বংসের কোনো আয়োজনই কংগ্রেস বাকি রাখেনি। সমাজবিরোধী, পুলিস, কারখানার মালিক ও জোতদার ও কায়েমী স্বার্থের ছিল পোয়াবারো। রাজনৈতিক ও ট্রেড ইউনিয়ন কর্মীদের ব্যাপক হারে ছাঁটাই করা হয়। পুলিসের সাহায্যে কংগ্রেসী গুণ্ডারা মালিকদের দ্বারা পুষ্ট হয়ে অনেককে কাজে যোগ দিতে দেয়নি। এই মালিকরা এবং স্কুল-কলেজ কর্তৃপক্ষ অনুপস্থিতির অজুহাতে তাঁদের ছাঁটাই করে দেয়। কোর্টের আদেশ সত্ত্বেও অনেক ক্ষেত্রে তাঁদের কাজে যোগ দিতেও দেওয়া হয়নি। অসংখ্য ট্রেড ইউনিয়ন অফিস দখল করে নেওয়া হয়। বাসস্থান থেকে উৎখাত হয়েছিল প্রায় ২০ হাজার বামপন্থী কর্মী-সমর্থক পরিবার।

   কিন্তু ১৯৭৭ সালে বামফ্রন্ট সরকারে এসে কোনো প্রতিহিংসা যাতে না হয়, তা যেমন সুনিশ্চিত করেছিল, তেমনি বিনা শর্তে রাজনৈতিক মতামত নির্বিশেষে সব দলের রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তি দিয়েছিলমুক্তিপ্রাপ্তদের মধ্যে ছিলেন ১৭০০ নকশালপন্থী ও কংগ্রেসী বন্দী। ১৯৭২-৭৭ সালে কংগ্রেসের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে অনেককে মিসা ও অন্যান্য আটক আইনে এবং ফৌজদারি মামলায় জেল খাটতে হয়েছিল। এই বন্দী কংগ্রেসীরাসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা ও কর্মীদের বিরুদ্ধে চালু প্রায় ১০ হাজার ফৌজদারি মামলা প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। 'মিসা'য় আটক ২১৮ জনকে জেল থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়। জরুরী অবস্থার সময় যে সব দমনমূলক ব্যবস্থা জারি করা হয়েছিল সব প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। বাক্ স্বাধীনতা, মতামত ও বিরোধিতা করার অধিকার, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা; সভা-সমিতি ও সংগঠন করার স্বাধীনতা এবং আন্দোলনের স্বাধীনতা বামফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় এসে সুনিশ্চিত করে। রাজনৈতিক কারণে যে সব শিক্ষক ও সরকারী কর্মীদের কংগ্রেস আমলে বরখাস্ত করা হয়েছিল তাদের কাজে পুনর্বহাল করা হয়। বামফ্রন্টবিরোধী সমস্ত রাজনৈতিক দলগুলিকে পরিপূর্ণ গণতান্ত্রিক অধিকার দেওয়া হয়।

ভূমি সংস্কার কর্মসূচী যেমন গরিব ভূমিহীন কৃষকের জমির অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছে, গ্রামের মানুষের আয় বেড়েছে, অর্থনৈতিক অধিকার এসেছে, তেমনি পঞ্চায়েতী ব্যবস্থার ফলে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে গ্রামের সাধারণ মানুষের রাজনৈতিক অধিকার গোটা দেশের মানুষের সামনে পঞ্চায়েতে নজির গড়েছে বামফ্রন্টের পশ্চিমবাংলাই। আর্থিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণেও মডেল হয়েছে এরাজ্য। ১৮বছরের ভোটাধিকার, মহিলাদের পঞ্চায়েত ও পৌরসভায় আসন সংরক্ষণেও নজির গড়েছে বামফ্রন্টের পশ্চিমবঙ্গ। শান্তি, সুস্থিতি, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, বিচ্ছিন্নতাবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সব সময় সামনে থেকেছে এরাজ্য।
আজ যখন পশ্চিমবাংলায় বামফ্রন্ট সরকারের বদলে নতুন সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তখন গত ৩৪ বছর ধরে তিল তিল করে অর্জিত এই অধিকার রক্ষার লড়াই করাই রাজ্যের মানুষের সামনে সবচেয়ে বড় চ‌্যালেঞ্জ।

শুক্রবার, ১০ জুন, ২০১১

উন্নয়ন ও রোবোকপ ~ সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়

ঢাকের বাদ্যি বাজতে এখনো অনেক দেরি। সবে জষ্টি মাসের শেষ। বঙ্গে পরিবর্তনের বায়ু বেশ দ্রুতগতিতেই বইছেন (এবং চারমূর্তির সেই ভাল্লুকের মতন টপাটপ মানুষ ও গিলছেন)। বাংলায় ভোটপর্ব চুকতে, আমরা আইপিএল নিয়ে কয়েকদিন লাফালাফি করলাম। কিন্তু কোলকাতার দল ইয়ের মতো পরপর দু খানা খেলায় হেরে প্রতিযোগিতার বাইরে চলে গেল। কয়েক দিন হাসপাতাল সুপার এর বরখাস্ত, অস্ত্র উদ্ধার, রেজ্জাক মোল্লার গোলা বর্ষন, রামদেব নিয়ে হইচই করলাম। কিন্তু কোনটাই ঠিক জমলো না। অগত্যা উত্তেজনায় ইতি। ওদিকে দার্জিলিং সমস্যার ও সমাধান  হয়ে গেল একটা সই দিয়ে। মাওবাদীরাও শুনছি নাকি দন্ডকারন্যে ফিরে গেছে। কিষেনজির টিআরপি পড়তির দিকে।

 

তেমন জমকালো ব্রেকিং নিউজ না থাকলে যা হয়, লোকে বাধ্য হয়ে খবরের কাগজে প্রথম পাতায় "ভারতে সর্বাধিক প্রচারিত প্রথম শ্রেনীর বাংলা দৈনিক" থেকে শেষ "প্রফুল্ল সরকার স্ট্রীট থেকে অভিক কুমার সরকার দ্বারা প্রকাশিত" অবধি পড়ে। পড়তে গিয়ে দেখি, ব্রেকিং নিউজ ছাড়াও দেশে অনেক কিছু ঘটে। বিভিন্ন রাজ্যে চাষি রা কেমন মারমুখি হয়ে উঠেছে। উত্তর প্রদেশে তো মার মার কাট কাট হয়ে গেল, মায় আমাদের বীরভূমে পর্যন্ত দেখলাম চাষিরা জমির দখল নিয়েছে। হ্যাঁ, এই পরিবর্তনের হাওয়াতেও। তা এমন করলে তো মহা মুশকিল। কাগজ পড়তে গিয়ে চোখে পড়লো যে সেজ বা এস ই জেড (মার্কিনি এস ই জি) থেকে এবারে আর এক ধাপ এগিয়ে এন আই এম জেড তৈরি করা হবে। সেটা কি?

 

একটা মৌচাক বলতে পারেন। অনেক গুলো এস ই জেড একটা ঘেরাটোপের মধ্যে গড়ে তোলা হবে। সেখানে থাকবে উৎপাদনের জায়গা, শ্রমিক আবাসন, স্কুল, হাসপাতাল, রাস্তা ঘাট বাজার দোকান সমেত একখানা গোটা শহর। শুধু তফাত হলো, শহরের মতো থাকবে না কোন পৌরসভা। সবকিছুই থাকবে সেখানে যে সব কর্পোরেট সংস্থা থাকবেন, তাঁদের হাতে। তাঁরাই পরিষেবা দেবেন, রাস্তা ঘাট তৈরি করে দেবেন, স্কুল কলেজ বানিয়ে দেবেন। পড়ে বেশ লাগলো। নো পৌরসভা, নো ঘুঘুর বাসা, নো দুর্নীতি। কিছু লাগলে কর্পোরেট গুলো তৈরি করে দেবে। ঠিক সেই রোবোকপ ছবির মতো। রোবোকপ দেখেছেন তো? একটা বিরাট বড় কোম্পানি, ডেট্রয়েট শহর কে কিনে নিলো। পরিকল্পনা হলো, পুরনো শহরটা ভেঙ্গেচুরে নতুন আধুনিক একটা শহর তৈরি করবে তারা। নাম হবে ডেল্টা সিটি। সেই শহরের পুরো পরিচালন ব্যবস্থাই তাদের হাতে। এমন কি পুলিশ পর্যন্ত। লোকজনের বাড়ি ভেঙেচুরে তারা উদবাস্তু দের ব্যারাক বাড়িতে ঢোকালো। অনেক টা নাৎসি কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের মত ব্যাবস্থা পত্র সেখানে। লোকে প্রতিবাদ করতে গেলো, খেলো গুলি। অবশ্য শেষে রোবোকপ (রোবট পুলিস, একটা মানবিক হৃদয় সমেত, সে ই এই গল্পের সুপার হিরো ) সমেত পুলিশ বাহিনি বিবেকের ডাকে সাড়া দিয়ে কর্পোরেট এর কত্তা দের পিটিয়ে তক্তা করে দিলো। হ্যাপি এনড।

 

এক কর্পোরেট কত্তা বলেছেন, টেরিটোরিয়াল আর্মি গুলোকেও কর্পোরেটের হাতে তুলে দিতে। রনবীর সেনা, সানলাইট সেনা রা এবারে কর্পোরেট পালিশ পাবে, আধুনিক অস্ত্র শস্ত্র ও সরকারি অনুমোদন সমেত। এস ই জেড এর ভেতরে এমনিতেই সরকারি শ্রম আইন চলেনা। এন আই এম জেডের ভেতরেও চলবে এমন কোনো লক্ষন তো দেখছি না। সেখানে, কর্পোরেট কত্তারা যা বলবেন সেটাই আইন। শুনতে হবে এনাদের কথা। না শুনলে উড়ে পুলিস এসে একুশ দফা হাঁচিয়ে মারতে পারে। তবে সব পুলিস তো উড়ে নয়। তারা কি ভাবে মারবে তার নিশ্চয়তা নেই। গোটা দেশে টুকরো টুকরো এন আই এম জেড। খন্ড বিখন্ড ভারতবর্ষে কর্পোরেট হাউসের নিজস্ব খাশতালুক। সেখানে আইন চলেনা দেশের। মানুষের হাতে ক্ষমতা নেই সেখানে। মানুষের কন্ঠস্বর নেই। আছে শুধু কর্পোরেটের অঙুলিহেলন, আর আছে লক্ষ লক্ষ মূক সেবাদাস। দেশের মানুষ লড়াই করে নিজের হাতে ক্ষমতা এনেছে। পঞ্চায়েত হয়েছে, নগরপালিকা এসেছে। আজ সেই সব কিছুকে বেচে দেওয়া হচ্ছে বানিয়ার হাতে। আবার সেই বনিকের মানদন্ড। সাধু সাবধান।

 

দেশকে টুকরো টুকরো করে বেচে দেওয়ার পরিকল্পনা। সংসদে বিল পাশ করিয়ে, আরো বেশি করে দেশের দরজা বানিয়াদের কাছে খুলে দিতে গেলে এখনো কিছু বাধার মুখে পড়তে হচ্ছে। সংখ্যায় খুব কমে গেলেও লাল ঝান্ডাধারীরা এখনো প্রানপনে বাধা দিয়ে যাচ্ছে। বাংলায় তো তাদের কাবু করাই গেছে দিদিমনি কে দিয়ে। কিন্তু তার পরেও নয়ডার প্রতিরোধ হচ্ছে। বীরভুমে চাষীরা বেয়াড়া হয়ে উঠছে। তাই, টুকরো করে বেচো। মানুষ কে ভাগ করে দাও। একদল পরিনত হোক কর্পোরেটের ঘেরাটোপের মধ্যে থাকা সেবাদাসে। যদি বেয়াড়াপনা করে, তার জন্য কর্পোরেট সানলাইট সেনারা তো রয়েইছে। আর রোবোকপ? সিনেমায় সে ছিলো। আর ছিলো তার বিবেক। বাস্তবে কি সে থাকবে? আর অন্য দল পড়ে থাক মাঠে ময়দানে। বেওয়ারিশের মত। বেওয়ারিশ, কারন তারা নিজের অর্জিত অধিকার কে রক্ষা করার , সেই জন্য লড়াইয়ের উত্তরাধিকার কে বাঁচিয়ে রাখতে পারেনি। তাই বেওয়ারিশ। হয়ত বেওয়ারিশ কুকুর ধরা গাড়ির মত একদিন বেওয়ারিশ মানুষ ধরা গাড়ি ও আসবে। যেমন নাৎসিরা আনতো। তবে এখনো হয়ত অল্প সময় বাকি আছে। প্রতিবাদ নয়, প্রতিরোধের সময় এটা। প্রতিরোধ করুন এদের। না হলে একদিন ওই মূক সেবাদাস অথবা বেওয়ারিশ হবার জন্য তৈরি হোন।