১৯৭১ সালে আমার বাবা এবং মা'র প্রথম একে অপরের সাথে আলাপ, সুবোধ মল্লিক স্কোয়ারে ছাত্র ফেডারেশনের মিটিংএ। মা কথা বলতো বাঙাল ভাষায় (হ্যা আমি সেই প্রজন্মের ব্যাক্তি যাদের ছোটবেলায় বাংলা আর বাঙাল দুটো আলাদা ভাষা ছিলো), বাবা কথা বলতো এক অদ্ভুত বাংলামিশ্রিত হিন্দিতে।
মা'র বাবা, মানে আমার দাদুর পরিবার, যাদের দেশ ফরিদপুর, আর বাবা'র বাবা, মানে আমার ঠাকুর্দার পরিবার, যাদের দেশ বরিশাল, কেউ সেই অর্থে ঘটি হারানো উদ্বাস্তু না। পার্টিশনের বহু আগে থেকেই এদের ওপারে দেশের বাড়ি আর এপারে কলকাতার বাড়ি (ওই যাকে আজকাল কায়দা করে townhouse বলে) ছিলো। পার্টিশনের সময় ঠাকুর্দারা এইপারেই থাকতো - পার্ক সার্কাসে। বাবারা স্কুলে পড়াকালীন ঠাকুরদা এবং ঠাকুমা দুজনেই মারা যাওয়ায়, বাবা এবং জ্যেঠুর খাওয়ার জোগানোর এবং গার্জেনগিরি করবার দায়িত্ব নিয়েছিলো পার্ক সার্কাসের পার্টির কমিউনের লোকজন। তিনবেলা খাওয়া, পড়া দেখিয়ে দেওয়া (এবং বলতে বাধা নেই পড়াশুনোয় বিশেষ ধ্যাড়ানো) এসব হতো দিলখুশা স্ট্রিটের পার্টি কমিউনে - যেখানে বসবাস করা অধিকাংশ কমিউনিষ্ট পার্টির নেতা অবাঙালী মুসলমান - শ্রমিক শ্রেনির সদস্য। তাদের মুখের ভাষাই বাবা শিখে ছিলো।
আর দাদুরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ঠিক আগে বার্মায় থাকতো। জাপানিরা আক্রমন করবার পর ব্রিটিশরা বার্মায় বসবাসকারী ইন্ডিয়ান সাবজেক্টদেরকে মিলিটারি গার্ড দিয়ে একটা দুমাসের লং মার্চ করিয়ে ইম্ফল দিয়ে ভারতে প্রবেশ করিয়েছিলো। দাদুরা এসে তাদের যাদবপুরের বাড়িতে ঘাটি গেড়েছিলো।
৮ বছর প্রেম করবার পরে ১৯৭৯ এ আমার বাবা এবং মা বিয়ে করে। তার ঠিক দুবছর আগে, অর্থাৎ ১৯৭৭ সালে ভয়েজার স্পেস মিশনের সূচনা হয়। ভয়েজার ১ এবং ২, দুই মহাকাশযান সৌরজগত পরিক্রমা করতে পাড়ি দেয়। তাদের পেটে ভরে দেওয়া হয় সোনার ফোনোগ্রাফ রেকর্ড - ভয়েজার গোল্ডেন রেকর্ড। এই রেকর্ডে ধরা থাকে মানবসভ্যতার ইতিহাসের গান, কথা, ছবি, পৃথিবীর বিভিন্ন রকম শব্দ, আর সৌরজগতের ম্যাপ। উদ্দেশ্য - যদি কোন ভীনগ্রহের সভ্যতা বা ভবিষ্যতের টাইম ট্র্যাভেল করা মানবসভ্যতার হাতে এটা পড়ে, তাহলে একটা ক্যাপসুলের মধ্যে দিয়ে তারা জানতে পারবে আমাদের কিছুটা ইতিহাস, চিনতে পারবে আমাদেরকে। ২০১২ সালে ভয়েজার ১ এবং ২ সৌরজগতের সীমানা অতিক্রম করে অন্তরীক্ষে প্রবেশ করে। এই সময়কালের মধ্যে সোভিয়েত ধ্বসে পড়ে, ইউরোপে একের পর এক নতুন দেশের সৃষ্টি হয়, গোটা পৃথিবীর এক কোনা থেকে অন্য কোনায় দলে দলে মানুষ পাড়ি দেয়। ভয়েজার গোল্ডেন রেকর্ড ভেসে চলে নিকষ কালো মহাশূন্যে, বন্ধুর খোজে।
আমি বাঙাল ভাষায় কথা বলিনা৷ 'পরিষ্কার বাংলায়' কথা বলি। আমি যেখানে থাকি, সেখানে এখনো আশেপাশে বাঙালভাষা টুকটাক শোনা যায়। একদিন যাবে না। সেই হারিয়ে যাওয়ার দুঃখের চেয়েও বড় আরেকটা দুঃখ আমায় চেপে ধরেছে। হেরে যাওয়ার দুঃখ। ওই বাঙাল ভাষার মতনই আরেকটি মূল্যবান ভাষা আমাকে উত্তরাধিকার সূত্রে দেওয়া হয়েছিলো। প্রতিবাদের ভাষা। প্রতিবাদের সঠিক ভাষা হয় জানেন তো? আমার বাবা মা জানতো। তারা এই শহরের বুকে ভিয়েতনামের জন্যে মিছিল করেছিলো, বাংলাদেশের জন্যে চাঁদা তুলেছিলো। জোন বায়েজরা জানতো। তারা বাংলাদেশের জন্যে নিউ ইয়র্কে কনসার্ট করে গেয়েছিলো। তাদের ভাবতে হয়নি, আমরা আমেরিকান কিনা, আমরা বাঙালী কিনা, আমরা ভিয়েতনামিজ কিনা। তারা ভেবেছিলো, আমরা এই পৃথিবীর মানুষ, তোমাদের তৈরি করা ২০০ বছরের কৃত্রিম কাঁটাতারে আমাদের বয়ে গেছে, আমরা মানুষ!
আমাদের দেখলে কি ভাবতো তারা! আসামে ৪০ লাখ লোক নাগরিকত্ব থেকে বাদ পড়েছে বলে প্রতিবাদ সংগঠিত করবার জন্যে প্রচার করতে হচ্ছে বাঙালীরা আক্রান্ত? ওই ৪০ লাখের মধ্যে যে উত্তর ভারতীয় শ্রমিক, পাহাড়ি উপজাতির চা বাগানের শ্রমিকরা আছে, তাদের ব্যাপারে এই শহর নির্বিকার থাকবে? 'বাঙালী' আক্রান্ত না হয়ে শুধু মানুষ আক্রান্ত হলে আমাদের কিছু করবার নেই? আবার এও বলতে হচ্ছে, ওই ৪০ লাখের মধ্যে হিন্দুও আছে! মানে বাঙালী হিন্দু আক্রান্ত না হলে এই শহরের লোক জাগবে না? তাহলে আর প্রতিবাদ করে লাভ কি? আমরা তো এমনিতেই হেরে গেছি। হেরে ভুত হয়ে গেছি।
আমরা হেরে গেছি কারন আমাদের মধ্যে কেউ নেই যে সামনের লোকটার কলার ধরে বলবে বাঙালী, অসমীয়া, বিহারী, হিন্দু, মুসলমান এসব দিয়ে কিচ্ছু যায় আসেনা, চোখ খুলে দেখো, কতগুলো অসহায় মানুষকে ধরে বেঁধে বাস্তহারা করে, শিকড় ছিড়ে ডিটেনশনে ক্যাম্পে পাঠানোর বন্দোবস্ত পাকা হচ্ছে। এইটাই যথেষ্ট জ্বলে ওঠবার জন্যে! আমরা হেরে গেছি কারন আমাদের মধ্যে কেউ নেই আঙুল তুলে বলবার জন্যে যে তোমাদের এই অসমীয়া বনাম বাঙালী, হিন্দু বনাম মুসলমান, অধিবাসী বনাম অনুপ্রবেশকারীর এই মনভুলানো খেলা আমরা খেলবো না, তোমাদের ছুড়ে দেওয়া রুটির টুকরো নিয়ে আমরা নিজেদের মধ্যে কুকুরের মতন মারামারি করবো না, আমাদের বোকা বানানো বন্ধ করো! আমরা হেরে গেছি কারন আমরা কেউ বুক ঠুকে বলছিনা যে এই পৃথিবীর প্রত্যেকটা মানুষ অভিবাসী আর সেই প্রত্যেকটা মানুষই অধিবাসী। আমরা হেরে গেছি কারন আমাদের মধ্যে একটা চ্যাপলিন নেই যে চেঁচিয়ে বলবে তোমাদের বিশ্বায়ন মেকি, মিথ্যে, তোমরা কথা রাখোনি, তোমাদের বিশ্বায়ন মানে শুধু বহুজাতিক পুঁজির অবাধ বিচরণক্ষেত্র তৈরি করা, আর শ্রমের বিচরণের স্বাধীনতা কেড়ে নিয়ে শ্রমিকদের একে অপরের শত্রু বানিয়ে ছোট ছোট খুপড়িতে বন্দী করে ফেলা। আমি হেরে গেছি কারন ওরা আমাকে শিখিয়ে দিতে পেরেছে আমি বাঙালী হিন্দু, আর পাশের লোকটা অসমীয়া হিন্দু, আর সামনের লোকটা বিহারী মুসলমান, আর আমরা এরকম ভাগ হতে হতে প্রত্যেকে একা দাঁড়িয়ে আছি, নিজেরটুকু রক্ষা করবার জন্যে, আর ওদের শেখানো ভাষাতেই আমি আজকে বলছি 'বাঙালী নিজেকে বাচাও', আমি ভুলে গেছি আমার উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া ভাষা, যেই ভাষা শিখিয়েছিলো - আমরা মানুষ, এটুকুই যথেষ্ট।
২০২৫ সাল নাগাদ ভয়েজার ১ এবং ২ এর বিদ্যুৎ যোগান দেওয়া ব্যাটারী আর জ্বালানি আস্তে আস্তে শেষ হয়ে যাবে। একে একে আলো নিভে যাবে, মেশিন বন্ধ হয়ে যাবে, পৃথিবীতে পাঠাতে থাকা রেডিয়ো বার্তাগুলো বন্ধ হয়ে যাবে। অন্ধকার, নিঃশব্দ, নিঃসঙ্গ মহাকাশে ভূতের মতন ভেসে বেড়াবে দুটো মহাকাশযান। তাদের পেটে লুকিয়ে থাকবে ভয়েজার গোল্ডেন রেকর্ড। যার মধ্যে থাকবে আমাদের কিছু কথা, কিছু গান, কিছু শব্দ, কিছু ছবি। মানবসভ্যতার ভাষা হিসেবে।