মঙ্গলবার, ৩১ জুলাই, ২০১৮

আসামে এন আর সি ~ আর্কাদি গাইদার

১৯৭১ সালে আমার বাবা এবং মা'র প্রথম একে অপরের সাথে আলাপ, সুবোধ মল্লিক স্কোয়ারে ছাত্র ফেডারেশনের মিটিংএ। মা কথা বলতো বাঙাল ভাষায় (হ্যা আমি সেই প্রজন্মের ব্যাক্তি যাদের ছোটবেলায় বাংলা আর বাঙাল দুটো আলাদা ভাষা ছিলো), বাবা কথা বলতো এক অদ্ভুত বাংলামিশ্রিত হিন্দিতে। 

মা'র বাবা, মানে আমার দাদুর পরিবার, যাদের দেশ ফরিদপুর, আর বাবা'র বাবা, মানে আমার ঠাকুর্দার পরিবার, যাদের দেশ বরিশাল, কেউ সেই অর্থে ঘটি হারানো উদ্বাস্তু না। পার্টিশনের বহু আগে থেকেই এদের ওপারে দেশের বাড়ি আর এপারে কলকাতার বাড়ি (ওই যাকে আজকাল কায়দা করে townhouse  বলে) ছিলো। পার্টিশনের সময় ঠাকুর্দারা এইপারেই থাকতো - পার্ক সার্কাসে। বাবারা স্কুলে পড়াকালীন ঠাকুরদা এবং ঠাকুমা দুজনেই মারা যাওয়ায়, বাবা এবং জ্যেঠুর খাওয়ার জোগানোর এবং গার্জেনগিরি করবার দায়িত্ব নিয়েছিলো পার্ক সার্কাসের পার্টির কমিউনের লোকজন। তিনবেলা খাওয়া, পড়া দেখিয়ে দেওয়া (এবং বলতে বাধা নেই পড়াশুনোয় বিশেষ ধ্যাড়ানো) এসব হতো দিলখুশা স্ট্রিটের পার্টি কমিউনে - যেখানে বসবাস করা অধিকাংশ কমিউনিষ্ট পার্টির নেতা অবাঙালী মুসলমান - শ্রমিক শ্রেনির সদস্য। তাদের মুখের ভাষাই বাবা শিখে ছিলো। 
আর দাদুরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ঠিক আগে বার্মায় থাকতো। জাপানিরা আক্রমন করবার পর ব্রিটিশরা বার্মায় বসবাসকারী ইন্ডিয়ান সাবজেক্টদেরকে মিলিটারি গার্ড দিয়ে একটা দুমাসের লং মার্চ করিয়ে ইম্ফল দিয়ে ভারতে প্রবেশ করিয়েছিলো। দাদুরা এসে তাদের যাদবপুরের বাড়িতে ঘাটি গেড়েছিলো।

৮ বছর প্রেম করবার পরে ১৯৭৯ এ আমার বাবা এবং মা বিয়ে করে। তার ঠিক দুবছর আগে, অর্থাৎ ১৯৭৭ সালে ভয়েজার স্পেস মিশনের সূচনা হয়। ভয়েজার ১ এবং ২, দুই মহাকাশযান সৌরজগত পরিক্রমা করতে পাড়ি দেয়। তাদের পেটে ভরে দেওয়া হয় সোনার ফোনোগ্রাফ রেকর্ড - ভয়েজার গোল্ডেন রেকর্ড। এই রেকর্ডে ধরা থাকে মানবসভ্যতার ইতিহাসের গান, কথা, ছবি, পৃথিবীর বিভিন্ন রকম শব্দ, আর সৌরজগতের ম্যাপ। উদ্দেশ্য - যদি কোন ভীনগ্রহের সভ্যতা বা ভবিষ্যতের  টাইম ট্র‍্যাভেল করা মানবসভ্যতার হাতে এটা পড়ে, তাহলে একটা ক্যাপসুলের মধ্যে দিয়ে তারা জানতে পারবে আমাদের কিছুটা ইতিহাস, চিনতে পারবে আমাদেরকে। ২০১২ সালে ভয়েজার ১ এবং ২ সৌরজগতের সীমানা অতিক্রম করে অন্তরীক্ষে প্রবেশ করে। এই সময়কালের মধ্যে সোভিয়েত ধ্বসে পড়ে, ইউরোপে একের পর এক নতুন দেশের সৃষ্টি হয়, গোটা পৃথিবীর এক কোনা থেকে অন্য কোনায় দলে দলে মানুষ পাড়ি দেয়। ভয়েজার গোল্ডেন রেকর্ড ভেসে চলে নিকষ কালো মহাশূন্যে, বন্ধুর খোজে।

আমি বাঙাল ভাষায় কথা বলিনা৷ 'পরিষ্কার বাংলায়' কথা বলি। আমি যেখানে থাকি, সেখানে এখনো আশেপাশে বাঙালভাষা টুকটাক শোনা যায়। একদিন যাবে না। সেই হারিয়ে যাওয়ার দুঃখের চেয়েও বড় আরেকটা দুঃখ আমায় চেপে ধরেছে। হেরে যাওয়ার দুঃখ। ওই বাঙাল ভাষার মতনই আরেকটি মূল্যবান ভাষা আমাকে উত্তরাধিকার সূত্রে দেওয়া হয়েছিলো। প্রতিবাদের ভাষা। প্রতিবাদের সঠিক ভাষা হয় জানেন তো? আমার বাবা মা জানতো। তারা এই শহরের বুকে ভিয়েতনামের জন্যে মিছিল করেছিলো, বাংলাদেশের জন্যে চাঁদা তুলেছিলো। জোন বায়েজরা জানতো। তারা বাংলাদেশের জন্যে নিউ ইয়র্কে কনসার্ট করে গেয়েছিলো। তাদের ভাবতে হয়নি, আমরা আমেরিকান কিনা, আমরা বাঙালী কিনা, আমরা ভিয়েতনামিজ কিনা। তারা ভেবেছিলো, আমরা এই পৃথিবীর মানুষ, তোমাদের তৈরি করা ২০০ বছরের কৃত্রিম কাঁটাতারে আমাদের বয়ে গেছে, আমরা মানুষ! 

আমাদের দেখলে কি ভাবতো তারা! আসামে ৪০ লাখ লোক নাগরিকত্ব থেকে বাদ পড়েছে বলে প্রতিবাদ সংগঠিত করবার জন্যে প্রচার করতে হচ্ছে বাঙালীরা আক্রান্ত? ওই ৪০ লাখের মধ্যে যে উত্তর ভারতীয় শ্রমিক, পাহাড়ি উপজাতির চা বাগানের শ্রমিকরা আছে, তাদের ব্যাপারে এই শহর নির্বিকার থাকবে? 'বাঙালী' আক্রান্ত না হয়ে শুধু মানুষ আক্রান্ত হলে আমাদের কিছু করবার নেই? আবার এও বলতে হচ্ছে, ওই ৪০ লাখের মধ্যে হিন্দুও আছে! মানে বাঙালী হিন্দু আক্রান্ত না হলে এই শহরের লোক জাগবে না? তাহলে আর প্রতিবাদ করে লাভ কি? আমরা তো এমনিতেই হেরে গেছি। হেরে ভুত হয়ে গেছি। 

আমরা হেরে গেছি কারন আমাদের মধ্যে কেউ নেই যে সামনের লোকটার কলার ধরে বলবে বাঙালী, অসমীয়া, বিহারী, হিন্দু, মুসলমান এসব দিয়ে কিচ্ছু যায় আসেনা, চোখ খুলে দেখো, কতগুলো অসহায় মানুষকে ধরে বেঁধে বাস্তহারা করে, শিকড় ছিড়ে ডিটেনশনে ক্যাম্পে পাঠানোর বন্দোবস্ত পাকা হচ্ছে। এইটাই যথেষ্ট জ্বলে ওঠবার জন্যে! আমরা হেরে গেছি কারন আমাদের মধ্যে কেউ নেই আঙুল তুলে বলবার জন্যে যে তোমাদের এই অসমীয়া বনাম বাঙালী, হিন্দু বনাম মুসলমান, অধিবাসী বনাম অনুপ্রবেশকারীর এই মনভুলানো খেলা আমরা খেলবো না, তোমাদের ছুড়ে দেওয়া রুটির টুকরো নিয়ে আমরা নিজেদের মধ্যে কুকুরের মতন মারামারি করবো না, আমাদের বোকা বানানো বন্ধ করো! আমরা হেরে গেছি কারন আমরা কেউ বুক ঠুকে বলছিনা যে এই পৃথিবীর প্রত্যেকটা মানুষ অভিবাসী আর সেই প্রত্যেকটা মানুষই অধিবাসী। আমরা হেরে গেছি কারন আমাদের মধ্যে একটা চ্যাপলিন নেই যে চেঁচিয়ে বলবে তোমাদের বিশ্বায়ন মেকি, মিথ্যে, তোমরা কথা রাখোনি, তোমাদের বিশ্বায়ন মানে শুধু বহুজাতিক পুঁজির অবাধ বিচরণক্ষেত্র তৈরি করা, আর শ্রমের বিচরণের স্বাধীনতা কেড়ে নিয়ে শ্রমিকদের একে অপরের শত্রু বানিয়ে ছোট ছোট খুপড়িতে বন্দী করে ফেলা। আমি হেরে গেছি কারন ওরা আমাকে শিখিয়ে দিতে পেরেছে আমি বাঙালী হিন্দু, আর পাশের লোকটা অসমীয়া হিন্দু, আর সামনের লোকটা বিহারী মুসলমান, আর আমরা এরকম ভাগ হতে হতে প্রত্যেকে একা দাঁড়িয়ে আছি, নিজেরটুকু রক্ষা করবার জন্যে, আর ওদের শেখানো ভাষাতেই আমি আজকে বলছি 'বাঙালী নিজেকে বাচাও', আমি ভুলে গেছি আমার উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া ভাষা, যেই ভাষা শিখিয়েছিলো - আমরা মানুষ, এটুকুই যথেষ্ট।

২০২৫ সাল নাগাদ ভয়েজার ১ এবং ২ এর বিদ্যুৎ যোগান দেওয়া ব্যাটারী আর জ্বালানি আস্তে আস্তে শেষ হয়ে যাবে। একে একে আলো নিভে যাবে, মেশিন বন্ধ হয়ে যাবে, পৃথিবীতে পাঠাতে থাকা রেডিয়ো বার্তাগুলো বন্ধ হয়ে যাবে। অন্ধকার, নিঃশব্দ, নিঃসঙ্গ মহাকাশে ভূতের মতন ভেসে বেড়াবে দুটো মহাকাশযান। তাদের পেটে লুকিয়ে থাকবে ভয়েজার গোল্ডেন রেকর্ড। যার মধ্যে থাকবে আমাদের কিছু কথা, কিছু গান, কিছু শব্দ, কিছু ছবি। মানবসভ্যতার ভাষা হিসেবে।

রবিবার, ২৯ জুলাই, ২০১৮

কল্পনা দত্ত ~ চন্দন দাস

''ধরা পড়ার পর মাস্টারদা, ফুটুদা আর আমাকে নিয়ে নতুন করে মামলা শুরু হয়েছিল। আমরা কাঠগড়ায় একসঙ্গে দাঁড়াতাম। সেইসময় একদিন ফুটুদা বলেছিলেন, তোকে ভালো লাগে। যদি ফিরে আসি, আমার জন্য অপেক্ষা করবি? আমার মৌনতায় হয়তো সম্মতি ছিল। কারন এর প্রায় দশ বছর পরে যখন জোশী(পিসি জোশী) আমাকে প্রোপোজ করে তখন আমি বলেছিলাম আমি যে তারকেশ্বর দস্তিদারকে কথা দিয়েছি।''
                                          -----'চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার আক্রমনকারীদের স্মৃতিকথা', লেখিকা-কল্পনা দত্ত, পৃষ্ঠা ১২১।

'ফুটুদা' ফিরে আসেননি। ১৯৩৩-এ একইসঙ্গে মাস্টারদা সূর্য সেন এবং ফুটুদা, অর্থাৎ তারকেশ্বর দস্তিদারের ফাঁসির হুকুম হয়েছিল। দিনটি ছিল ১৪ই আগস্ট। 
কে জানতো, তার ঠিক চোদ্দ বছর পর চট্টগ্রামে পা রাখতে পাসপোর্টের প্রয়োজন শুরু হবে? কে জানতো একটা জঘন্য বেইমানীর কাঁটাতার লক্ষ কোটি বছরের জন্য পেতে দেওয়া হবে সংগ্রামী, আত্মত্যাগী একটি জাতির বুকে? কে জানতো স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসকে একা 'দখল' করার উদ্যোগ শুরু হবে একটি দলের পক্ষ থেকে? কে জানতো শাসক আর রাষ্ট্রের সব দখলের ধারাবাহিকতা বজায় থাকতেও, স্বাধীনতার সত্তর বছর পরেও রুখে দাঁড়াবে কল্পনা দত্ত, তারকেশ্বর দস্তিদাররা?
আজও লড়াই আছে। কারন শোষণ আছে। কাঠগড়া আছে, শোষিতের জন্য। তবু স্বাধীন, সার্বভৌম, হেমন্তের আকাশের মত স্বপ্ন আছে আজও। আর আছে আজও, তাকে ধারন করার দুর্জয়, অনবদ্য হৃদয়। সেই হৃদয়ের দুটি প্রকোষ্ট — একটির নাম ফুটুদা। আর একটি সূর্য সেনের বাহিনীর অন্যতম সেনাপতি তারকেশ্বর দস্তিদার। কিন্তু দুই প্রকোষ্ঠের মাঝে কোনও দেওয়াল নেই। কোনদিন ছিল না। 
কাঠগড়ার সেই কয়েকমুহুর্তের বিবরণই তার প্রমাণ।
কল্পনা দত্তের 'শাস্তি' হয়েছিল যাবজ্জীবন দ্বীপান্তরের। রায়ে স্পেশ্যাল ট্রাইব্যুনালের বিচারপতি বলেছিলেন,''মেয়ে বলে এবং কম বয়স বলেই প্রাণদন্ডে দন্ডিত করা গেলো না।'' তবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, দীনবন্ধু অ্যান্ড্রুজের চিঠি এবং লক্ষ মানুষের আবেগ, প্রতিবাদের মুখে কল্পনা দত্তের আন্দামানের কারাগারে পাঠানো রদ করতে বাধ্য হয় ব্রিটিশ শাসকরা। তবে ১৯৩৩ থেকে ১৯৩৯ — দেশের বিভিন্ন জেলে তাঁকে দিন কাটাতে হয়েছিল। রাজশাহীর জেলে বসে মাস্টারদা এবং তারকেশ্বর দস্তিদারের ফাঁসির খবর পেয়েছিলেন। কল্পনা দত্তের কথায়,''মাস্টারদার ফাঁসি কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না, তবু প্রতিজ্ঞা করেছিলাম রাজশাহী জেলে বসে: 'তোমার আদর্শ বহন করে নিয়ে আমরা চলব।'
সেই আদর্শের স্রোত চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহের সেনানী, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, অনন্ত সিংহ, গণেশ ঘোষদের সহযোদ্ধা কল্পনা দত্ত খুঁজে পেয়েছিলেন কমিউনিস্টদের মধ্যে।
আর 'ফুটুদা'? সেই কথা দেওয়া? কল্পনা দত্ত জানিয়েছেন,''দুর্ভিক্ষের পরে বোম্বেতে একটা কনফারেন্স হয়েছিল। সালটা সম্ভবত ১৯৪৩। আমি চট্টগ্রামের প্রতিনিধি হিসেবে সেই কনফারেন্সে যোগ দিয়েছিলাম। সেখানেই জোশী আমাকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়। আমি বললাম আই হ্যাভ প্রমিসিড্‌ তারকেশ্বর দস্তিদার। জোশী বলল, তুমি জানো না ওর ফাঁসি হয়ে গেছে। ও তো আর কোনদিন আসবে না।.....তাও আমি দোনামোনা করছিলাম। বিটি(বিটি রণদিভে), ডক(ড: গঙ্গাধর অধিকারী) এরা ইনসিস্ট করাতে বিয়ে করলাম।'' তারপরও ১৯৯৫-র ৮ই ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত কমরেড কল্পনা দত্ত বেঁচে ছিলেন। সব লড়াইয়ে 'ফুটুদা'-র ঐতিহ্য, আত্মত্যাগের শিক্ষা তাঁর পাথেয় ছিল।
এবারে পাঠকের একটি প্রশ্ন সম্ভবত অবধারিত। আপনি মশাই, কল্পনা জোশী(দত্ত)-র ওই বইটির বিষয়ে এত কথা লিখছেন কেন? বইটির বিজ্ঞাপনে কাজ কী? পাঠকদের জানাই, বইটি বর্তমান বাজারে প্রায় দুর্লভ। একটি কপি জোগাড় করতে যথেষ্ট পরিশ্রম করতে হয়। স্বাধীনোত্তর ভারতের বড় দোষ — স্বাধীনতা সংগ্রামের সংগ্রামী ধারার বই, প্রবন্ধ, চলচ্চিত্রের বিজ্ঞাপন কখনও প্রয়োজনিয় মাত্রায় পৌঁছোয় না। শাসকের ভয় — যদি গুটিকয় মানুষের দারুন অবদানের যে ভাবমূর্তি তিলেতিলে, প্রবল বিজ্ঞাপনের সৌজন্যে গড়ে তোলা হয়েছে, তা যদি প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখে পড়ে যায়। কল্পনা দত্ত, গণেশ ঘোষ, সতীশ পাকড়াশি, সুবেধ সেনরা কেন তেভাগা-তেলেঙ্গানায় জড়িয়ে পড়েছিলেন, কেন স্বাধীনতার পরে তাঁরা কমিউনিস্ট-জীবন বেছে নিয়েছিলেন — এ' সব প্রশ্ন বড় বিপজ্জনক। 
তার চেয়ে সোজা কী? এমন বাজার গড়ে তোলো যেখানে অনেক, অনেক, অনেক সহজে পাওয়া যায় মমতা ব্যানার্জির বই — তা সে 'উপলব্ধি'-ই হোক কিংবা 'কথাঞ্জলী'। কিংবা সাভারকার। চেনেন তো এই মানুষটিকে? পুরো নাম বিনায়ক দামোদর সাভারকার। কল্পনা দত্ত কিংবা সূর্য সেনের কথা বেমালুম ভুলে গেলেও রাষ্ট্র একটি আস্ত বিমানবন্দর 'বীর সাভারকার'-র নামঙ্কিত করেছে। সেটি আন্দামানে। সেখানেই সেলুলার জেল। সেখানে কল্পনা দত্তের নির্বাসন আটকাতে উদ্যোগ নিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, দীনবন্ধু অ্যান্ড্রুজ। আর সেই জেল থেকেই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদকে চিঠি লিখেছিলেন ভারতে 'হিন্দুত্বের' প্রণেতা সাভারকার। কী ছিল তাতে? ঐতিহাসিক এ জি নুরানী তাঁর 'সাভারকার ও হিন্দুত্ব' বইয়ে লিখছেন,''আন্দামানের রাজধানী পোর্টব্লেয়ারে ১৯১১-র ৪ঠা জুলাই সাভারকারকে আনা হয়। কিন্তু বছর কাটতে না কাটতেই তিনি 'ক্ষমার জন্য আবেদনপত্র' জমা দিলেন।...১৯১৩-র ১৪ই নভেম্বরের আরেকটি আবেদনপত্রে এটির উল্লেখ রবেছে। গভর্নর জেনারেলের কার্যনির্বাহী পরিষদের হোমমেম্বার রেগিনাল্ড দ্রাভকের উদ্দেশ্যে লিখিত ১৯১৩ সালের এই আবেদনপত্রটি 'মহামান্য' সম্বোধনে তাঁকে '১৯১১ সালে ক্ষমার জন্য আমি যে আবেদনপত্রটি পাঠিয়েছিলাম' সেটির কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছিল।'' 
ব্রিটিশ শাসকের কাছে সাভারকার আরও কী শপথ করেছিলেন? তিনি লিখেছিলেন,''সরকার যেমনভাবে চাইবেন ঠিক সেই শক্তিতে তাদের হয়ে কাজ করবো। যেহেতু এ আমার বিবেকের উচ্চারণ সেকারণে আমার ভবিষ্যৎ আচরণও তেমনই হবে আশা রাখি। আমাকে জেলে রাখলে কিছুই পাওয়া যাবে না। সে তুলায় অন্য ক্ষেত্রে হয়ত কিছু হতে পারে। পরমশক্তিধরের পক্ষেই সদয়তার মহত্ব দেখানো সম্ভব। কাজেই অনুতপ্ত পুত্র তার পিতৃমাতৃসদৃশ সরকারের দরজা ছাড়া আর কোথায় ফিরে আসতে পারে?''
আহা! স্বাধীনতার যোদ্ধার কী করুণ আবেদন 'পিতৃমাতৃসদৃশ', 'পরমশক্তিধর' ব্রিটিশ সরকারের কাছে।
তবু স্বাধীনতার সত্তর বছরে সাভারকারের দর্শনকেই ছড়িবে দেওয়া হয়েছে দেশজুড়ে। ছড়িয়েছেন তাঁরাই, যাঁরা সূর্য সেনদের দৃষ্টিভঙ্গী, লড়াইয়ের ইতিহাসের প্রকাশ সুকৌশলে আটকেছেন।
তারা নির্দিষ্ট কোনও দল নয়। দলে ভাগ হয়ে আছেন। কিন্তু আদপে শাসক এবং শোষক। মমতা ব্যানার্জি তাদেরই উপাদান।

শনিবার, ২৮ জুলাই, ২০১৮

ডাক্তারি শিক্ষার খরচ ও গ্রামের পোস্টিং ~ ডা: বিষান বসু

কিছু কিছু যুক্তি এমন আজব হয়, যাতে স্তম্ভিত হয়ে যাওয়া ছাড়া পথ থাকে না। পালটা যুক্তি ঠিক কোন জায়গা থেকে শুরু করা যেতে পারে, সেই নিয়েই কনফিউশন। 

সদ্য পাশকরা ডাক্তারবাবুদের বন্ডে বেঁধে গ্রামীণ স্বাস্থ্যপরিষেবায় পাঠানো ও তজ্জনিত জটিলতা নিয়ে আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত অমিতাভবাবুর লেখাটিও সেই জাতের।

আপাত যুক্তিসমূহ সহজপাচ্য। ডাক্তারদের পড়াতে সরকারের খরচ, গ্রামে ডাক্তার না গেলে ক্ষতিপূরণ, আর্থিকভাবে স্বচ্ছল ডাক্তারদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার সুযোগ, অস্বচ্ছল চিকিৎসকদের গ্রামে যেতে বাধ্য হওয়া, তজ্জনিত আর্থিক ক্ষতি, সেই ক্ষতির ক্ষতিপূরণের রাস্তা, স্বচ্ছল-অস্বচ্ছলের বেছে নেওয়ার সুযোগের অসাম্য, গ্রাম-শহরের অসাম্য - সলমাজরির কাজের নিপুণতায় সাজিয়েছেন তিনি।

পড়ে আশ্চর্য হয়ে গেলাম।

আমার তরফে সামান্য কিছু প্রশ্ন। 

আপনারাও ভাবুন। 

অমিতাভবাবুর কাছে পৌঁছোনোর সুযোগ আমার নেই, কেউ, পারলে, প্রশ্নগুলো ওনার কাছে পৌঁছে দেবেন, প্লীজ।

খবরের কাগজে উত্তর পাঠানো যেতো। পাঠালাম না, কেননা আগের অভিজ্ঞতায় দেখেছি, তাঁরা বক্তব্য ছাপাতে যতোখানি আগ্রহী, উত্তর প্রকাশে তার ভগ্নাংশও নন।

প্রথমত, একটু সরকারবাহাদুরকে প্রশ্ন করবেন, একজন ডাক্তার তৈরী করতে সরকারের খরচ ঠিক কতোটা? সরকার একটা শ্বেতপত্র প্রকাশ করবেন, প্লীজ? প্রায়ই শুনছি, এই খরচ প্রায় তিরিশ-চল্লিশ লক্ষ। কিন্তু, কিভাবে হিসেবটা হলো, সেইটা তো পরিষ্কার হওয়া দরকার। মেডিকেল কলেজের, যেহেতু, পুরো, হ্যাঁ পুরো পরিকাঠামোই রোগিদের চিকিৎসার কাজে ব্যবহৃত হয়, সেহেতু, হিসেবটা অতোটা সহজ নয়। আর, সরকারি চাকুরিরত যে ডাক্তারবাবুরা শুধুমাত্র রোগির চিকিৎসা করেন, তাঁদের সাথে মেডিকেল কলেজের চিকিৎসক-শিক্ষকদের (যাঁরা চিকিৎসার সাথে সাথে ছাত্রদেরও পড়ান, পরীক্ষা নেন) বেতনক্রম কিছু ভিন্ন নয়। কাজেই, চিকিৎসক-শিক্ষক নিয়োগের পেছনে সরকারের বাড়তি খরচের কথাটা ঠিক নয়।

তাই হিসেবটা ভেবেচিন্তে করুন। যেমন ধরুন, সাধারণ একটা ইক্যুয়েশন ।

(একটা মেডিকেল কলেজ চালাতে সরকারের বার্ষিক খরচ - সমান সুযোগসুবিধের সমান বেড সংখ্যার সমসংখ্যক রোগীর চিকিৎসা হওয়া একটি সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতাল চালানোর বার্ষিক খরচ) ÷ সেই মেডিকেল কলেজে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা = ডাক্তারি ছাত্রের পেছনে সরকারের বার্ষিক লগ্নি

হ্যাঁ, লগ্নিই। কেননা, সরকার সেই খরচের কথা ফলাও করে বলেন, উশুল করার চেষ্টাও করেন, সাধ্যমত।

পাশাপাশি, একজন ইঞ্জিনিয়ার তৈরিতে, বা একজন সায়েন্স বা যেকোনো শাখার গ্রাজুয়েট তৈরিতে সরকারের খরচ কতো জানাবেন। না, তাঁদের কাছ থেকে উশুল করার জন্যে নয়, শুধু একটা তুলনামূলক আলোচনার জন্যে।

আবার, ধরুন, ডাক্তারি ছাত্ররা যেমন করে ইন্টার্নশিপ করেন (তিনবছরের বন্ডের কথা না হয় তুললামই না), সামান্য টাকায়, হাতেকলমে কাজ শেখার জন্যে, তেমন করে এই বিপুল সংখ্যক ইঞ্জিনিয়ারও সরকারি ক্ষেত্রে কাজ শেখার জন্যে একবছর যদি কাজ করেন, হয়তো গ্রাম-মফস্বলের চেহারাটাই বদলে যেতে পারে। আর, তাহলে, কে জানে, হয়তো ডাক্তাররাও গ্রামে যেতে তেমন করে আপত্তি করবেন না।

দ্বিতীয়ত, ডাক্তারদের গ্রামে যাওয়ার ব্যাপারে অনীহাকে অমিতাভবাবু দেখতে চেয়েছেন মূলত আর্থিক ক্ষতির দৃষ্টিকোণ থেকে। আর ভাবতে চেয়েছেন, সেই আর্থিক ক্ষতির ক্ষতিপূরণের উপায় কী হতে পারে।

কিন্তু, আমার মনে হয়, ব্যাপারটা ঠিক তেমন নয়। 

গ্রামে না যাওয়ার পেছনে আর্থিক ক্ষতি কিন্তু ফ্যাক্টর নয়। কেননা, কর্পোরেটে চাকরির তুলনায় মফস্বলে প্রতিষ্ঠিত প্রাইভেট প্র‍্যাক্টিসের আয়, কোনোভাবেই, কম নয়। সত্যি বলতে কি, ছোটো শহরে অনেক সার্জেনের আয় কর্পোরেট হাসপাতালের অবেক সিনিয়র কনসাল্ট্যান্টকেই লজ্জা দিতে পারে।

প্রশ্নটা, কাজেই, আর্থিক ক্ষতির নয়।

প্রশ্নটা পরিকাঠামোর, ব্যক্তিগত স্বাচ্ছন্দ্যের।

এবার ধরুন, একটি সবদিক থেকে পিছিয়ে থাকা জায়গার হাসপাতালটি হঠাৎ করে একেবারে আন্তর্জাতিক মানের হয়ে উঠবে, এমন তো নয়। হাসপাতালটিকে উন্নত করার পাশাপাশি জায়গাটারও উন্নতি দরকার। যেমন, ভালো স্কুলকলেজ, থাকার স্বাচ্ছন্দ্য, যাতায়াতের সুযোগসুবিধে ইত্যাদি ইত্যাদি।

তা অমিতাভবাবু যখন আর্থিক ইন্সেন্টিভের সর্বময় ক্ষমতায় বিশ্বাস রাখেন, তখন তিনি নিশ্চয়ই চুঁইয়ে আসা বিকাশের তত্ত্বেও আস্থাবান।

শুধু সরকারের মুখাপেক্ষী থাকলে চলবে?

আসুন না, বেসরকারী কোম্পানীরাও তাঁদের অফিস একটু কলকাতার বাইরে শুরু করুন। যেমন ধরুন, আইটি সেক্টর। তাঁদের কাজ তো বিশ্বব্যাপী। অফিস পুরুলিয়ায় হলে অসুবিধে তো কিছু নেই। বা, আনন্দবাজারসহ অন্যান্য সংবাদপত্রের অফিস। চাঁদনি চকের মতো ঘিঞ্জি জায়গায় পার্কিং-এর চাপ ইত্যকার অসুবিধের কথা ভাবতে হবে না, ধরুন, রামপুরহাটের একটু বাইরে অফিসটা শিফট করলে।

ভেবে দেখুন না একবার।

বড়ো বড়ো অফিস থাকলে, জায়গাটারও উন্নতি হবে। ডাক্তারবাবুরাও যেতে গাঁইগুঁই করবেন না। সরকারকেও বন্ডে বেঁধে ডাক্তার পাঠাতে হবে না।

আপনারা সবাই ভাবুন। অমিতাভবাবু আপনিও।

বুধবার, ২৫ জুলাই, ২০১৮

মেডিকেল কলেজ ~ ডা: সমুজ্জ্বল মাইতি

ডাঃ নারায়ন রায় ও ডাঃ ভূপাল বসু, ক্যালকাটা মেডিক্যাল কলেজের দুই ছাত্র, দুজনেরই ১৯৩০ সালে ডালহৌসী স্কোয়্যার বোমানিক্ষেপ মামলায় (চার্লস টেগার্ট সাহেবের গাড়িতে বোমা মারেন দীনেশ মজুমদার) দ্বীপান্তর সাজা হয়, জেল খাটেন আন্দামানে। ১৯৩৩ সালে এঁরা দু'জন এবং উল্লাসকর দত্ত ও সতীশ পাকড়াশির নেতৃত্বে একটানা ৪৫ দিন অনশন করেন পাঁচটি দাবীতে - খাবার যোগ্য খাদ্য, স্নানের জন্য সাবান, ঘুমানোর জন্য বিছানা, নিজেদের মধ্যে কথা বলার সুযোগ ও পড়বার জন্য বই চাই। ন'দিনের মাথায় জোর করে অনশন ভাঙতে গেল কুখ্যাত ব্রিটিশ জেলর ডেভিড ব্যারী। বাধা দিতে গিয়ে প্রাণ হারালেন তিন বন্দী বিপ্লবী - মহাবীর সিং গদর, মোহিত মৈত্র ও মনকৃষ্ণ নবদাস। পরের দিন জলের ঘটিতে দুধ রেখে দেওয়া হ'ল লুকিয়ে। বিপ্লবী সুশীল দাশগুপ্ত রেগে চিৎকার করলেন, 'ওরা জলের জায়গায় দুধ রেখে গেছে, কি করা উচিত আমাদের?' পাশের সেল থেকে ডাঃ নারায়ন রায়ের উত্তর ভেসে এল - 'ফুটবল খেলিস নি কোনোদিন ? কিক্ করতে জানিস না ?' যেমন বলা, তেমনি কাজ। লাথি মেরে দুধের ঘটি ফেলে দিলেন সুশীল। ৪৬-তম দিনে যখন সকলেই প্রায় মরণাপন্ন, বাধ্য হয়ে সব ক'টা দাবী মেনে নিল জেল কর্তৃপক্ষ। দাস ক্যাপিটাল আর কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো সাপ্লাই দেওয়া হয়েছিল ওঁদের দাবী মেনে। শিক্ষক ডাঃ রায় ও ডাঃ পাল, বাকীরা ছাত্র।
                                                                                       
১৯৩৭ সালে মুক্তির দাবীতে আবার শুরু হ'ল আমরণ অনশন। এবারো নেতৃত্বে ডাঃ রায় ও ডাঃ পাল। দাবী মিটল ৩৬ দিন পর। একে একে ছাড়া পেলেন সকলে, পরের বছর জানুয়ারিতে চিরতরে বন্ধ হ'ল সেলুলার জেল।
সিপিআইএম নেতা ডাঃ রায় পরে কোলকাতা কর্পোরেশনের কাউন্সিলর হ'ন, আমৃত্যু অসংখ্য সমাজসেবামূলক কাজে যুক্ত ছিলেন। ডাঃ পাল প্রথমে ফরোয়ার্ড ব্লক, পরে সমাজবাদী পার্টির নেতৃত্ব দিয়েছেন।                                                         
১৯৩৭ সাল ।চীন,জাপানী সাম্রাজ্যবাদী যু্দ্ধে আক্রান্ত । সাংহাই শহরের পতন আসন্ন ।সুং চিং লিং হংকং-এ ।গঠিত হয়েছে China Defence League,International Peace Hospital,যুদ্ধ ফ্রন্টের জন্য বিয়াল্লিশটি Mobile Medical Unit এবং আটটি Medical School।এহেন পরিস্থিতিতে জাপানী আক্রমণের তীব্রতা আরো বৃদ্ধি পেলে,কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটিতে গৃহীত হয় ভারত থেকে চীনে মেডিকেল মিশন প্রেরণের সিদ্ধান্ত । অবশেষে ১৯৩৮ সালে ডাঃ মোহনলাল অটল,ডাঃ মোরেশ্বর রামচন্দ্র চোলকার,ডাঃ দ্বারকানাথ শান্তারাম কোটনিস,ডাঃ রনেন্দ্রনাথ সেন এবং ডাঃ দেবেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়-কে নিয়ে পাঁচ সদস্যের মেডিকেল মিশন গঠিত হয় । ডাঃ দেবেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় ছিলেন কোলকাতা মেডিকেল কলেজের ছাত্র,কোলকাতা মেডিকেল থেকে ডাক্তারি পাশ করে তিনি আসামের ডিব্রুগড়ে চিকিৎসা করতেন। মেডিকেল মিশনের আহ্বান তিনি সাদরে গ্রহণ করেন এবং নেতাজীর সাথে সাক্ষাৎ করে বিদায় সম্বর্ধনা নেন।এই মিশনেরই অন্য সদস্য ছিলেন ডাঃ রনেন্দ্রনাথ সেন,তিনি ছিলেন বেআইনি কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য এবং কোলকাতায় কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম সংগঠক।কিন্তু কমিউনিস্ট বিপ্লবী হওয়ার কারণে সরকার তাঁকে পাসপোর্ট দিতে অস্বীকার করে।তাই তাঁর জায়গাতে মেডিকেল মিশনের অন্তর্ভুক্ত হন ডাঃ বিজয়কুমার বসু।তিনিও ছিলেন কোলকাতা মেডিকেল কলেজের ছাত্র।তিনি ছাত্র জীবনে রাজনীতির সংস্পর্শে আসেন এবং রনেন সেনের মাধ্যমে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ লাভ করেন।স্বভাবতই চীনের ঘটনাবলী প্রত্যক্ষভাবে দেখবার সুযোগলাভে তিনি খুবই আগ্রহী ছিলেন।চীনে পৌঁছে হাঙ্কাউয়ের হাসপাতালে একটানা সতেরোদিন অক্লান্ত পরিশ্রম করে জাপানী আক্রমণে আহত রোগীদের সেবা করেন।এরপর ইচাং-এর একটি হাসপাতালেও প্রায় একমাস কাজ করেন।১৯৩৯ সালে ঘোড়া থেকে পড়ে গিয়ে চৌ-এন-লাইয়ের হাত ভেঙে গেলে তিনি তাঁর চিকিৎসা করেন।১৯৩৯ সালে তিনি ইয়েনানের মডেল হাসপাতালেও যোগ দেন।এখানেই মাও-সে-তুঙ এবং এডগার স্নো-এর সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয়।১৯৪০ সালের শেষের দিকে তিনি চিন ছাছি অঞ্চলে গিয়ে পৌঁছলেন।ডাঃ নর্মান বেথুনের Beshao হাসপাতালেই তিনি নিযুক্ত হন।
১৯৪০-১৯৪২ পর্যন্ত ইয়েনানের জীবনযাত্রা কতটা কষ্টকর ছিল তা ডাঃ বসু প্রত্যক্ষ করেন।খাদ্য বস্ত্র ওষুধের খুব অভাব।শুরু হল 'Production Movement'।এই সময়ে তিনি ইয়েনানের উপকণ্ঠে 'আন্তর্জাতিক শান্তি হাসপাতালে' কাজ করেন।পরে তিনি অষ্টম রুট বাহিনীর Central Outdoor হাসপাতালে নাক-কান-গলা বিভাগের প্রধান হন।ডাঃ বসু ছিলেন প্রথম ভারতীয় যিনি চীনের নির্বাচিত পার্লামেন্টের সদস্য হন।১৯৪১ সালে তিনি চীনের কমিউনস্ট পার্টির ও সভ্যপদ লাভ করেন।
অন্যদিকে,মেডিকেল কলেজের আরেক ছাত্র ডাঃ দেবেশ মুখার্জী।মেডিকেল মিশনের সঙ্গেই চীনে যাওয়ার পর অসুস্থ হয়ে তিনি ভারতে ফিরে আসতে বাধ্য হন।তাঁর একটি কিডনি অপারেশন করে বাদ দিতে হয়।তাসত্ত্বেও সুস্থ হয়ে ওষুধপত্র জোগাড় করে তিনি আবার চীনের পথে রওনা হন।এই সময়ে তিনি প্রায় ১লক্ষ টাকার ওষুধ সংগ্রহ করেন এবং খিদিরপুর ডক থেকে বর্মা উদ্দেশ্যে রওনা হন।কিনতু বর্মাতে পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে ব্রিটিশ সরকার তাঁর পাসপোর্ট কেড়ে নেয় ও তাঁকে ভারতে প্রেরণ করে।ডাঃ দেবেশ মুখার্জী পরবর্তী কালে জাতীয়তাবাদী বিপ্লবী ভাবধারার প্রভাবে সশস্ত্র সংগ্রামের পথ অনুসরণ করেন।১৯৪২ সালে তাঁর কর্মপদ্ধতিতে এর প্রভাব পরিলক্ষিত হয়।
এরপর এল ১৯৪২ সালের অক্টোবর মাস।ভয়াবহ সাইক্লোন আর সামুদ্রিক বন্যার আঘাতে মেদিনীপুর আর ২৪ পরগণা বিধ্বস্ত।২৪৯ বৌবাজার স্ট্রীটে গঠিত হল পিপলস্ সাইক্লোন রিলিফ কমিটি।আবার ১৯৪৩ সালে দামোদরের বন্যা।এবার গঠিত হল পিপলস্ ফ্লাড রিলিফ কমিটি।অনতিবিলম্বে আছড়ে পড়ল ১৩৫০-এর দুর্ভিক্ষ।এই সমস্ত কমিটিগুলিকে মিলিয়ে দিয়ে তৈরী হল পিপলস রিলিফ কমিটি।কোলকাতা মেডিকেল কলেজের বহু ছাত্র,চিকিৎসক এর সাথে যুক্ত হয়ে পড়েন।১৯৪৬ সলে নোয়াখালির দাঙ্গার পর এবং রংপুরে দুর্ভিক্ষ কবলিত এলাকাতে পিআরসি ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করে।মেডিকেল কলেজের যে সব কৃতি ছাত্ররা পিআরসি-র সাথে যুক্ত হয়ে পড়েন তাঁদের মধ্যে ডঃপূর্ণেন্দু ঝাঁ,ডাঃবিমল সেনগুপ্ত,ডাঃকনক কাঞ্জিলাল,ডাঃ হিমাংশু রায়,ডাঃনীরদ মুখার্জীদের নাম শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণীয়।প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে,ডাঃ পূর্ণেন্দু ঝাঁ ছিলেন কোলকাতা মেডিকেল কলেজ স্টুডেন্টস্ ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে অন্যতম।এই কলেজ থেকেই এমবিবিএস পরীক্ষায় দ্বিতীয় স্থানাধিকারী ডাঃ পূর্ণেন্দু ঝা বিভিন্ন গণ-আন্দোলনে অংশ নিয়ে কারাবরণ করেন, আলিপুর ও বক্সার জেলে বন্দী ছিলেন বহুবছর। ১৯৪৮ সালে বিপিএসএফ মেডিক্যাল কলেজে প্রথম স্টুডেন্টস ইউনিয়ন গঠন করলে তিনি সম্পাদক হ'ন। এই সিপিআইএম নেতা পরে কোলকাতা কর্পোরেশনের মেয়র পারিষদ নির্বাচিত হ'ন।                                                         

ক্যালকাটা মেডিক্যাল কলেজের আর এক কৃতী ছাত্র ডাঃ রমেন কুন্ডুর নেতৃত্বে একদল তরুন বিপিএসএফ সদস্য ১৯৪৭ সালে বি টি রণদিভের ডাকে সাড়া দিয়ে রাইফেল কাঁধে তেলেঙ্গানা সশস্ত্র সংগ্রামে যোগ দিতে বেরিয়ে পরেন। সিপিআইএম সদস্য ডাঃ কুন্ডু দেশে-বিদেশে রেডিওলজিতে অধ্যাপনা করেছেন।
এরপর এল ১৯৪৭-এর জানুয়ারী মাস।২১শে জানুয়ারী পালিত হবে ভিয়েতনাম দিবস।ইউনিভারসিটি সিনেট হলের সামনের সিঁড়িতে বিক্ষোভরত ছাত্রদের ওপর পুলিশের গুলি চললো।মেডিকেল কলেজের ছাত্র ধীররঞ্জন সেনকে হাসপাতালে নিয়ে আসার পর মারা গেলেন।শোকপ্রস্তাব প্রকাশিত হল ভিয়েতনাম স্টুডেন্টস্ অ্যাসোশিয়েশনের Hanoi সম্মেলনে।               
১৯৫২ সালে ধর্মতলা স্ট্রীটে যাঁর চেম্বারে শুরু হ'ল স্টুডেন্টস হেলথ হোমের পথ চলা, সেই ডাঃ অমিয় বোস, হেলথ হোমের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক ডাঃ অরুন সেন, দুজনেই ছিলেন ক্যালকাটা মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র। ডাঃ সেন বিপিএসএফের কর্মী।
১৯৫৯ সালের আগস্ট মাস।খাদ্য আন্দোলন শুরু হল।৩১শে আগস্ট সভা ও আইন অমান্য কর্মসূচী নেওয়া হল।প্রায় ১লক্ষ মানুষের শোভাযাত্রা রাইটার্স বিল্ডিং-এর দিকে অগ্রসর হল।'আন্দোলনকারীদর শিক্ষা' দেওয়ার বাসনাকে চরিতার্থ করতে গিয়ে পুলিশের লাঠির আঘাতে ৮০জনের বেশী মানুষ নিহত হলেন। পরের দিন ১লা সেপ্টেম্বর সারা পশ্চিমবঙ্গে সর্বাত্মক ধর্মঘট পালিত হল।ছাত্ররা মিছিল করে রাইটার্স বিল্ডিং-এর দিকে অগ্রসর হলে পুলিশ ছাত্রদের ওপর গুলি চালায়।৪জন ছাত্র নিহত হয়।পরেরদিন মেডিকেল কলেজে মৃতদেহগুলির ময়নাতদন্তের পর মৃতদেহগুলি নিয়ে পুনরায় মিছিল হয়।এই গোটা ঘটনার প্রতি সংহতি জানিয়ে এগিয়ে আসে মেডিকল কলেজের ছাত্ররা।মেডিকেল কলেজে আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন ডাঃ জ্ঞানব্রত শীল,ডাঃ ইন্দ্রজিৎ রায়।প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য ডাঃ জ্ঞানব্রত শীল ছিলেন মেডিকেল কলেজ হস্টেল স্টুডেন্টস্ ইউনিয়নের সম্পাদকও।স্মৃতিচারণায় তিনি লিখেছেন, Our Principal, Prof. Sudhir Bose  came,was stuck dumb for some moment and then commented, I HAVE NOT SEEN SUCH BRUTAL KILLING EVEN IN BRITISH PERIOD''…there was a reportedly Bullet-proof Ambulance in our hospital and our principal allowed some of us to take it in search of Casualties''…                               
ডাঃ অমিত পান, কোলকাতা মেডিক্যাল কলেজের আরেক ছাত্রনেতা এসএফআই রাজ্য কমিটির সদস্য ছিলেন, তাঁর নেতৃত্বে ছাত্ররা কেরোসিনের দাবীতে প্রথমে পুরুলিয়ায়, পরে সারারাজ্যে ব্যাপক ছাত্র-আন্দোলন গড়ে তোলে সাতের দশকে। '৭১ থেকে '৭৭ সন্ত্রাসের পর মেডিক্যাল কলেজে গণতন্ত্র ফেরানোর লক্ষ্যে মেডিক্যাল কলেজ ডেমোক্র্যাটিক স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন (MCDSA) গঠন হ'লে তার প্রথম কনভেনর হ'ন SFI নেতা অমিত পান ও স্বরূপ সরকার।
                                                                 
পাঠক,এটাই ছিল খুব সংক্ষেপে আমাদের মেডিকেল কলেজ বেঙ্গল-এর আন্দোলনের ঐতিহ্য।এর মধ্যে আছে আরো অসংখ্য ছোট বড় ঘটনা।বহু কিছু ই আজ বিস্মৃতপ্রায়।এর পরও আছে নকশাল যুগে বহু মানুষ,ছাত্রের,চিকিৎসকের আত্মত্যাগের ইতিহাস।যে ইতিহাসের সঠিক তথ্য দলিল দস্তাবেজের অভাবে আজ লিখে উঠতে পারলাম না।শুধু বলার বিষয়,''আমরা মেডিকেল কলেজে পড়ি''..এর মধ্যে একটা গর্ব আছে বটে।তবে গর্বটা ঠিক কোন জায়গায় সেটা উপলব্ধির বিষয়।আর যারা আজ হঠাৎ ১৯৭৭ সাল থেকে চল্লিশ বছর হিসাব করে বসলেন,তাদের বলি '৭৭-এর আগে একটা '৭১ ছিল,একটা '৬৬ ছিল,একটা '৫৯ ছিল,একজন ধীররঞ্জন সেন ছিলেন।কিছু মেডিকেলের ছা্ত্রর কিছু ব্যক্তিগত উ্দ্যোগ ছিল।সেই সব কিছুকে ভুলে যাওয়াটা ইতিহাস,ঐতিহ্যকে অস্বীকার করা,সংগঠিত ছাত্র আন্দোলনের অমর শহীদদের অস্বীকার করা।আশা করি নির্দিষ্ট রাজনীতিকে চ্যাম্পিয়ন করতে গিয়ে মেডিকেল কলেজের এত বড় একটা অধ্যায়কে ভুলে যাবেন না।
             ( ডাঃ সুবর্ণ গোস্বামীর কাছ থেকে তথ্য নিয়ে লেখাটিকে একটু বর্ধিত করলাম। )                       

তথ্য সংগ্রহঃ
১। চীনে ভারতীয় মেডিকেল মিশন-অমলেন্দু দে
২। পিপলস্ রিলিফ কমিটির দ্যুতিময় ইতিবৃত্ত
৩। স্টুডেন্টস্ হেলথ্ হোম(প্রথম দশক)-পশুপতিনাথ চট্টোপাধ্যায়
৪। ভারতীয় উপমহাদেশের ছাত্র আন্দোলন-হীরেন দাশগুপ্ত,হরিনারায়ণ অধিকারী
৫। Medical College &  Hospital, Kolkata Wikipedia

বুধবার, ১৮ জুলাই, ২০১৮

আক্রান্ত মেডিক্যাল কলেজ ~ অনিকেত চ্যাটার্জী

১৮৪ বছরের পুরোনো এশিয়ার প্রাচীনতম মেডিক্যাল কলেজকে নিয়ে চলছে রাজনৈতিক স্বার্থের ছিনিমিনি খেলা।

গত তিনবছর ধরে বারবার আবেদনের পরেও কোনোরকম হোস্টেল কাউন্সেলিং প্রক্রিয়া না করায় মেডিক্যাল কলেজের বর্তমান দ্বিতীয়, তৃতীয়, ও চতুর্থ বর্ষের ছাত্ররা কেউই হোস্টেল পায়নি। জলপাইগুড়ি, মালদা, রায়গঞ্জ, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, দিনাজপুর প্রভৃতি দূর দূর জেলা থেকে আসা ছাত্ররা তিন বছর ধরে হোস্টেল অ্যাকোমোডেশন পায়নি এবং প্রিন্সিপাল তাদের আবেদনের প্রতি ভ্রূক্ষেপও করেননি। এছাড়াও, শেষ হোস্টেল কাউন্সেলিং প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যে ফাইনাল ইয়ার এবং ফোর্থ ইয়ারের ছাত্রদের একাংশ হোস্টেল পেয়েছিল, সেই মেইন বয়েজ হোস্টেলের পাঁচতলার টেম্পোরারিভাবে বানানো ফলস সিলিং গত কয়েক মাসে চার-পাঁচবার ভেঙে পড়ে গেছে এবং বেশ কিছু ছাত্র আহত হয়েছে।

এখন, কিছুদিন আগে প্রিন্সিপাল উচ্ছল কুমার ভদ্র একটি নোটিশের মাধ্যমে জানান, নতুন যে ১১ তলা হোস্টেল বিল্ডিং তৈরি হয়েছে (যে হোস্টেলে সব ছাত্রদের থাকার যথেষ্ট রুম রয়েছে), সেই হোস্টেলে কেবলমাত্র নতুন ভর্তি হতে আসা ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্ররাই জায়গা পাবে—অন্য কেউ নয়। এবং, সেই হোস্টেলের সুপারিন্টেন্ডেন্টের পদ দেওয়া হয়েছে এমবিবিএস পাশ তৃণমূল ছাত্রনেতা পার্থপ্রতিম মণ্ডলকে, যার রাজনৈতিক গুণ্ডামি করার যথেষ্ট ইতিহাস রয়েছে। প্রায় ১০০ এর ওপরে ছাত্র যখন হোস্টেল পায়নি, তখন এমসিআই রেগুলেশনের দোহাই দিয়ে নতুন কলেজে আসতে চলা ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্রদের আলাদা করে একটা হোস্টেলে রেখে তৃণমূলের নেতাকে সেই হোস্টেলের সুপার বানানো তৃণমূলের নতুন 'ক্যাডার' বানানোর প্রথম ধাপ বলেই মনে করছি আমরা।

আমরা, মেডিক্যাল কলেজের ছাত্ররা, আমাদের দাবি নিয়ে মেডিক্যাল কলেজের কমন রুমে ব্যাগ-বিছানা-বালিশ নিয়ে অবস্থান শুরু করি। ৫ জুলাই পর্যন্ত প্রায় ৮০ ঘন্টা অবস্থানের পরও প্রিন্সিপাল উদাসীন থাকেন ছাত্রদের দুর্দশার প্রতি — তিনি বলেন "Don't bother me", কখনো বলেন "আমি তোমাদের কোনো দায়িত্ব নেব না", আবার বলেন "তোমাদের ফার্স্ট ইয়ারের ত্রিসীমানাতেও ঘেঁষতে দেব না"! সিনিয়র-জুনিয়র রিলেশনশিপের ঐতিহ্য বহনকারী মেডিক্যাল কলেজে এরকম কথা রাজনৈতিক স্বার্থ ছাড়া বলা যায় না।

এই অবস্থায় আমরা বাধ্য হয়েই গত ৫ জুলাই দুপুর তিনটে থেকে প্রিন্সিপাল রুমের সামনে শান্তিপূর্ণ অবস্থান শুরু করি এবং তাঁকে জানিয়ে দিই, ছাত্রছাত্রীদের ন্যায্য দাবি তিনি এভাবে অগ্রাহ্য করতে পারেন না কোনোভাবেই। এরপরেই মেডিক্যাল কলেজ তার সাম্প্রতিক ইতিহাসের সবচেয়ে অন্ধকার সময় দেখে।

রাত ৮টার সময় প্রিন্সিপালের নির্দেশে প্রায় ৭০-৮০ জন পুলিশ ও উর্দিছাড়া গুন্ডা কলেজ ক্যাম্পাসে এসে মেডিক্যাল কলেজের অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ ব্লকের ভেতরে ঢোকে এবং শান্তিপূর্ণ অবস্থানরত ছাত্রদের ওপর শুরু করে নির্মম অত্যাচার। একের পর এক চড়-ঘুঁষি-লাথি মারতে থাকে ছাত্রদের, ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয় প্রতিবন্ধী ছাত্রদের, উপস্থিত একজন ছাত্রীকে শ্লীলতাহানি করতেও ছাড়েনি এই চটি-পুলিশের দল। টেনে হিঁচড়ে ধাক্কা মেরে ফেলে দেওয়া হয় ছাত্রদের, ছুঁড়ে ফেলা হয় তাদের নিজের কলেজ বিল্ডিংয়ের বাইরে। প্রায় ২০ জন মেডিক্যাল পড়ুয়া আহত হন, যাদের মধ্যে ২ জন গুরুতর আহত। এরপর পুলিশ তৃণমূলের দালাল প্রিন্সিপালকে গাড়িতে নিয়ে চলে যায়। ছাত্রদের ন্যায্য দাবিকে পিষে ফেলতে মেডিক্যাল কলেজের ক্যাম্পাসে পুলিশ ঢুকিয়ে মার খাওয়াতে হলো প্রিন্সিপালকে।

তবে কলেজ ক্যাম্পাসে পুলিশ ঢুকিয়ে দেওয়া প্রিন্সিপালের নোংরা চক্রান্ত মেডিক্যাল কলেজ বাস্তব হতে দেবে না। মেডিক্যাল কলেজের ছাত্রছাত্রীরা এখনো লড়ছে— স্বচ্ছ অরাজনৈতিক হোস্টেল কাউন্সেলিংয়ের দাবিতে। অবস্থান চলছে এখনো।

আমাদের বর্তমান দাবি হলো—
১) মেডিক্যাল কলেজের দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ বর্ষের ছাত্র সমেত যেসকল ছাত্রেরা হোস্টেল পায়নি তিনবছর ধরে, এবং যারা পুরোনো হোস্টেলে নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে থাকছে, তাদের স্বচ্ছ ও অরাজনৈতিক হোস্টেল কাউন্সেলিং প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সিনিয়রিটি ও দূরত্বের ক্রমানুসারে কলেজের প্রত্যেকটি হোস্টেল বিল্ডিংয়ে ( উক্ত New Boys' Hostel সহ) হোস্টেল অ্যাকোমোডেশন দিতে হবে।

২) উক্ত New Boys' Hostel এর সুপারিন্টেন্ডেন্ট কোনো তৃণমূলের এমবিবিএস পাস ছাত্রনেতাকে করা যাবে না। অন্যান্য হোস্টেলের মত এমসিআই রেগুলেশন অনুযায়ী কোনো অ্যাসোসিয়েট/অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর/হেড অফ দ্য ডিপার্টমেন্টকে ওই হোস্টেলের সুপারের পদ দিতে হবে।

৩) ছাত্রছাত্রীদের শান্তিপূর্ণ অবস্থানে কলেজ ক্যাম্পাসে পুলিশ ঢুকিয়ে মার খাওয়ানো প্রিন্সিপালকে অবিলম্বে জবাবদিহি করতে হবে এবং পদত্যাগ করতে হবে।

৪) অবিলম্বে কলেজ কাউন্সিল এর মিটিং ডেকে ছাত্রপ্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে সমস্ত দাবিদাওয়া নিয়ে সুস্থ আলোচনা করতে হবে।

মেডিক্যাল কলেজের সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা তাদের প্রাপ্য হোস্টেলের ন্যায্য দাবিতে লড়ছে। অবস্থানের ঘন্টা যতো বাড়ছে, কর্তৃপক্ষ‌ের ঔদ্ধত্য যতো বাড়ছে, আন্দোলনের তীব্রতাও ততো বাড়ছে ।এই লড়াই আমরা জিতবোই— কলেজের জন্য, আগামীর ছাত্রছাত্রীদের জন্য, আমাদের জন্য। আমাদের পাশে দাঁড়ান। সাথে দাঁড়ান।


*** অনিকেত চ্যাটার্জী ওপরের ছবি তে অনশনকারী আন্দোলনরত মেডিকেল কলেজের ছাত্র ***

মেডিক্যাল কলেজে ১৭০ ঘন্টা অনশন ছাত্রদের ~ কৌশিক দত্ত

মাননীয় প্রফেসর উচ্ছল কুমার ভদ্র সমীপেষু,

আপনার জন্য ছয় মাস পরে ফেসবুকে ফিরতে বাধ্য হলাম। হয়ত এমবিবিএস পাশ করার প্রায় দুই দশক পরে আরো অনেক কিছুতে ফিরতে বাধ্য করবেন আপনি। শুধুমাত্র রোগীর চিকিৎসা নিয়ে সরলরৈখিক জীবন কাটাচ্ছিলাম। আপনি রাজনৈতিক হতে প্ররোচনা দিলেন। প্রায় হাত ধরে টেনে রাস্তায় নামালেন। 

অবশ্য এভাবে আমাদের পরিচালিত করার, ছাত্রাবস্থার দিনগুলো উজ্জ্বলভাবে মনে করিয়ে দেবার অধিকার আপনার আছে। আপনি আমার শিক্ষক ছিলেন। কিছু প্রশংসা আপনার প্রাপ্য। আমার জীবনে দেখা সবচেয়ে স্মার্ট শিক্ষকদের মধ্যে আপনি অন্যতম, আপনার ফ্যাশন সেন্স উচ্চমানের, ইংরেজি উচ্চারণ ভালো, ক্লাস নেবার ক্ষেত্রে প্রযুক্তির ব্যবহারে আপনি সমসাময়িক অনেকের চেয়ে এগিয়ে ছিলেন। অন্য অনেকের ক্লাসে ফাঁকি দিলেও আপনার ক্লাস আমরা করতাম। পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন সূত্রে আপনার সম্বন্ধে নানা বিরূপ মন্তব্য শুনে আপনাকে আরো পূর্ণভাবে চিনলেও আপনার ক্লাসগুলো মনে রেখেছি। 

আপনি যখন আমাদের Community Medicine পড়াতেন, তখনো বিষয়টার নাম ছিল "Preventive and Social Medicine", যে নামের মধ্যে বিষয়টির প্রাথমিক দুটি ভাবনার প্রতিফলন ছিল। Prevention এবং social consciousness যে জনস্বাস্থ্য রক্ষার ক্ষেত্রে জরুরি, সেটা ছিল প্রাথমিক শিক্ষা। আমাদের শেখালেন, অথচ আপনি নিজে সেই বিষয়ে নিদারুণ ব্যর্থতার পরিচয় দিলেন। কলেজের ছাত্রদের অত্যন্ত ন্যায্য একটি দাবিকে আপনি আন্দোলনে পরিণত করলেন এবং দায়িত্ব নিয়ে সেই আন্দোলনকে সুবৃহৎ করে তুলছেন। অথচ অনায়াসে এই সমস্যাকে প্রিভেন্ট করতে পারতেন। কেমন করে? ধাপে ধাপে বলি। দেখুন, ছাত্র হিসেবে ঠিক শিখেছি কিনা। 

প্রথমেই নিয়ম মেনে হস্টেলের সিট অ্যালটমেন্টের কাউন্সেলিং করতে পারতেন এবং সঠিক পদ্ধতিতে হস্টেল সুপারিন্টেনডেন্ট নিয়োগ করতে পারতেন। তাহলে কোনো বিতর্কই হত না। একে বলে "Primordial prevention", অর্থাৎ সমস্যা সৃষ্টি হবার আগেই সুস্থ থাকার চেষ্টা। নাহয়  রাজনৈতিক চাপে গোলমাল করেই ফেলেছেন। ছাত্ররা প্রতিবাদ করামাত্র ভুল স্বীকার করে সংশোধন করতে পারতেন। সেটা হত "Primary prevention", অর্থাৎ রোগের প্রাকশর্ত বা risk factor দেখতে পাওয়ামাত্র ব্যবস্থা নিয়ে রোগটিকে আটকানোর চেষ্টা। সেটাও নাহয় করতে পারলেন না। ছাত্ররা প্রতিবাদ আন্দোলন শুরু করার পর আস্ফালন আর হুমকি থেকে বিরত থাকতে পারতেন, পুলিশ ডেকে না পেটাতে পারতেন। তারা মার খেয়ে অনশনে বসার পরে অন্তত তাদের স্বাস্থ্যহানি বা মৃত্যুর সম্ভাবনাকে গুরুত্ব দিয়ে আলোচনায় বসতে পারতেন। সেটাকে "secondary prevention" বলা যেত, অর্থাৎ অসুস্থ হবার পর সাবধান হওয়া। তাও করলেন না। 

তার ফলে দেখুন অসুখ বেড়ে গেছে। আজ সিনিয়র ডাক্তারদের অনশনে নামিয়েছেন। অন্যান্য পেশার মানুষও এসে সমর্থন জানিয়ে যাচ্ছেন। এতদিনে সংবাদ মাধ্যমও নড়েচড়ে বসেছে। টিভি ক্যামেরা ঘোরাঘুরি করছে কলেজে। সংবাদপত্রের সাংবাদিকের কলম আর এসএলআরএর ফ্ল্যাশ সক্রিয়, দেখতে পাচ্ছি। বিপদ গভীর এখন। কলেজের ছোট প্রতিবাদকে রাজপথে মিছিল করে তুলেছেন, ক্রমশ বড় আন্দোলনে পরিণত করছেন নিজের উদ্যোগে। এখনও আপনার সামনে খোলা "tertiary prevention"-এর রাস্তা। এখনো শুধুমাত্র আইন অনুযায়ী ন্যায্য দাবি মেনে নিয়ে আপনি এড়াতে পারেন বড় মাপের ক্ষতি। এড়াতে পারতেন, কিন্তু আপনি অসুস্থতার অভিনয় করে পলায়নের পথ নিলেন। আপনার শারীরিক পরীক্ষা এবং নর্মাল ইসিজি বলছে, আপনি সুস্থ আছেন। তাতে আমরা খুশি। আপনি সত্যি সত্যি অসুস্থ হলে দুঃখ পেতাম, নাটক করছেন বুঝতে পেরে নিশ্চিন্ত বোধ করছি। 

অথচ যে রাজনৈতিক দলের হয়ে আপনি এসব করছেন, তাঁদেরও কোনো উপকার করছেন না। তাঁরা এখনো সাংগঠনিক শক্তিতে এবং ব্যালটপেপারের গুনতিতে অনেক জায়গায় ভোট জিততে সক্ষম। মেডিক্যাল কলেজে একটি হস্টেল জবরদখল করতে পারার ওপর খুব নির্ভর করে নেই তাঁরা। আপনি যা করছেন, তা নিতান্তুই গোষ্ঠীস্বার্থে। কিন্তু আপনার গোষ্ঠী কোনটা? দল কোনটা? মাল্টিপল চয়েস প্রশ্ন দিলে আপনি নিজেও গুলিয়ে ফেলতে পারেন। 

শুনতে আশ্চর্য লাগলেও সত্যিটা হল, যে ছাত্র সংগঠনটিকে ধ্বংস করার অভিপ্রায় নিয়ে আপনি সংগ্রাম চালাচ্ছেন, সেই এমসিডিএসএ দলটিতে আপনিও ছিলেন এককালে। তারপর ছাত্র পরিষদ, আরএসপি এবং সিপিআইএম, কংগ্রেস, ইত্যাদি করেছেন। আপাতত তৃণমূল কংগ্রেসে আশ্রয় নিয়েছেন নিজ স্বীকৃতি মতে। এত দ্রুত গতিতে বদলেছেন নিজেকে যে হিসেব রাখা কঠিন। আগামী দিনে কোনো বিধানসভা নির্বাচনে আপনাকে বিজেপির প্রার্থী হিসেবে দেখলে অবাক হব না। তাই প্রশ্ন জাগছে, আপনি যা করছেন, তা কি সত্যিই দলের স্বার্থে করছেন? নাকি সাবোতাজ?

শোনা যায় প্রাক্তন জমানায় মালদহ এলাকাবাসী বর্তমান শাসক দলের এক নেতাকে অপমান করেছিলেন। পরবর্তীকালে সেই নেতা স্বীয় ক্ষমতাবলে উত্তম এবং মধ্যম প্রতিশোধ নেন। সেই রাগ কি আপনি পুষছেন মনে মনে? তাই কি ছাত্রদের সামান্য এবং আইনসংগত দাবিকে বিরাট গণ আন্দোলনে পরিণত করে রাজ্য সরকারকে চাপে ফেলতে চাইছেন? 

আপনি যাই করুন, আমরা কিন্তু আপনার ক্লাস করেছিলাম স্যার। শিখেছি কিছু কিছু কথা। "Prevention is better than cure" কথাটা আমরা জানি, সব সাধারণ মানুষের মতোই। আমরা জানি, আজ এই অবদমনকে প্রতিহত না করলে ভবিষ্যতে অত্যাচার মাত্রা ছাড়াবে। তাই চিকিৎসক হিসেবে রোগটিকে বাড়তে না দেবার ব্যাপারে আমরা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। আপনার বর্তমান দলের উপর মহলেও যদি সচেতনক কেউ থাকেন, তবে তাঁরাও বুঝবেন, আপনাকে এবং আপনার রাজনৈতিক আশ্রয়দাতাকে এখনি না থামালে অচিরেই আপনারা দলটির বড় ক্ষতি করবেন। নিজেদের স্বার্থ রক্ষার্থে তাঁরা আপনাদের অসদাচরণে রাশ টানবেন কিনা, তা তাঁরা বুঝবেন। কিন্তু আমরা আপনাদের কাছে পাওয়া শিক্ষাকে ব্যর্থ হতে দেব না। 

অপকর্ম করারও একটা আর্ট আছে। আপনি সেই শিল্পটুকুও রাখেননি, বড়ই মোটা দাগের আচরণ করেছেন এবার। এতদিন ভাবছিলাম, আপনার মতো smart মানুষ, এত crude হয়ে গেলেন কী করে। আজ দেখলাম, আপনি এখনো স্মার্ট। আপনি জানতেন, এবার পিছনো ছাড়া গতি নেই, অথচ ইতোমধ্যে দেওয়ালে ঠেকে আছে আপনার পিঠ। তাই রোনালদো-নেইমারোচিত অভিনয়ে পালালেন। আটজন অনশনরত সদ্য-তরুণকে গুরুতর অসুস্থতার মুখে ফেলে রেখে আপনি বাড়ি চলে গেলেন গাড়ি চড়ে। এবার অন্য কেউ "acting principal" হবেন "actor principal"-এর বদলে। তিনি মেনে নেবেন ছাত্রদের দাবি। আপনি হাত তুলে রেফারিকে বলবেন, "আমি কিছু করিনি। আমাকে ফ্রি কিক দাও।" পাবেন কি ফ্রি কিক? সত্যি কি পালানোর রাস্তা আছে আপনার? আছে কোনো লুকনোর জায়গা? হাজার চোখ আপনাকে দেখছে স্যার। 

মেডিক্যাল কলেজে র‍্যাগিং হয় না। গত পঞ্চাশ বছরে কেউ র‍্যাগিং দেখেনি। আমরা এই কলেজে পড়তে এসে সিনিয়রদের কাছ থেকে অনেক ভালবাসা পেয়েছি। সেই ট্র‍্যাডিশনে আমাদের ছোট ভাই-বোনেদের আমরা ভালবাসি। অনশনরত একজন ছাত্রেরও যদি কোনো গুরুতর ক্ষতি হয়, তবে সেই ভালবাসার আঁচ আপনি অনুভব করবেন। 

অথচ এখনো একটা শেষ সুযোগ ছিল স্যার। অন্যায়ের সিংহাসন থেকে নেমে এসে এই ভালবাসার ফরাসে আমাদের সাথে, আমাদের ছোট ভাইদের পাশে আপনিও বসতে পারতেন একবার। ভুল স্বীকার করে নিয়ে শুদ্ধ হতেন আর গর্বিত অনুভব করতেন এই কলেজের প্রাক্তনি হিসেবে, যেমন অনুভব করছি আমরা। নিজেকে আরো একবার বঞ্চিত করলেন আপনি। আপনার দ্রুত আরোগ্য কামনা করি। শরীর আরো সতেজ হোক আর মন সেরে উঠুক।


সোমবার, ৯ জুলাই, ২০১৮

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় ও স্বাধিকার ~ আর্কাদি গাইদার

৮বির মোড়ে যে সিগারেটের দোকান আছে, সেখানকার সিগারেট বিক্রেতা একবার আমায় বুঝিয়েছিলেন যে সিগারেট বিক্রি করাটাও আসলে একধরনের স্কিলড লেবার। যেটা অধিকাংশ লোকই পারে না।
'এই যেমন আপনি লুজ সিগারেট নেবেন। দোকানদার কি করবে? প্যাকেটের থেকে একটা সিগারেট দু আঙুল দিয়ে টেনে বার করে আপনাকে দেবে। প্যাকেটের ওপরের দিকে থাকে সিগারেটের ফিল্টারের দিকটা। ওই জায়গাটায় আঙুল দিয়ে ধরে বার করবে। আর সেটাই আপনি মুখে দেবেন। ওই ফিল্টারটা তো নোংরা হয়ে গেলো। আসল কায়দাটা কেউ জানেই না। প্যাকেটের এক সাইড হাতের চেটোয় হাল্কা করে মারতে হয়। তখন কয়েকটা সিগারেট লুজ হয়ে একটু বেরিয়ে আসবে। তখন সিগারেটের শরীরটা আলতো করে ধরে টেনে বার করে দিতে হবে। ফিল্টারে আঙুল লাগানো চলবে না।'
প্রচ্ছন্ন আত্মতুষ্টি নিয়ে বলেছিলেন তিনি।

যারা সিগারেট কেনে তারা কি এত ভাবে? আদৌ জানে যে লুজ সিগারেট বিক্রি করতে গেলে প্যাকেট থেকে সিগারেট বার করবারও আলাদা কায়দা থাকে? জানবার প্রয়োজন আছে কি? কিন্তু তবুও এই দোকানদারের কাছে এই কায়দাটা প্রয়োজনীয়। নিজের জন্যে। তাকে কেউ জোর করে না। সে নিজে তাড়িত হয়ে করছে। নিজেই নিজেকে বাধ্য করছে। Watchmen গ্রাফিক নভেলে Rorschach যেমন বলেছিলো - We do not do it because it is expected, or allowed. We do it because we are compelled.'

যেমন তাড়িত হয়ে অনশনে বসেছে যাদবপুরের ছাত্রছাত্রীরা। এডমিশন প্রক্রিয়া পালটালে কিন্তু তাদের ব্যাক্তিগতভাবে কিছু আসবে যাবে না। তাদের তো এডমিশন হয়েই গেছে। তবুও তারা না খেয়ে বসে আছে। কেন? কারন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধিকারের প্রশ্ন এবং ভর্তি প্রক্রিয়াকে তারা আপন মনে করতে তাড়িত হয়েছে।

আচ্ছা ঠিক কতটা তাড়না থাকলে ৬৬ ঘন্টারও বেশি না খেয়ে থাকা যায়? এর জন্যে কোনটা বেশি লাগে - পেটের জোর না শিরদাঁড়ার জোর? দেখেছি সুস্থ শরীরে একবেলা না খেলেই গা গোলায়। আচ্ছা তার থেকেও বেশি কি গা গোলায় না যখন একদা লোকসভার এবং রাজ্যসভার সাংসদ বলেন যে সরকার আর পদ যাওয়ার পরেই তিনি বিশেষ রাজনীতিতে আস্থা হারিয়েছেন এবং তাই তিনি আপাতত জিমন্যাস্টিক্সের খেলা দেখিয়ে এদিক ওদিক লাফালাফি করছেন? আচ্ছা জিমন্যাস্টিক্সের খেলা আর ডুগডুগির বাজনার সাথে বাদর নাচবার মধ্যে গুণগত ফারাক কি?

মইনুল হাসান, ঋতব্রতরা চকচকে তারা। তাদের দিকে সোমশ্রীরা তাকিয়ে থাকে, তাদের জন্যে পতাকা লাগায়, লোক জড়ো করে। তারা এসে গরম গরম কথা বলে। এরপর তারা হঠাত একদিন তাড়না বোধ করে তৃণমুলে চলে যাওয়ার। আর সোমশ্রীরা তাড়িত হয় ৪০ ঘন্টা অনশন করে অসুস্থ হাসপাতালে চলে যাওয়ার।

প্যাকেট একটাই। কোন সিগারেটটা কিরকমভাবে বেছে বার করা হবে, সেটাই আসল। কতজনই বা তফাত বোঝে। তাও, পার্থক্যটা রয়েই যায়। আর কেউ না জানুক, ওই সিগারেট বিক্রেতা তো জানে।

সোভিয়েত ~ অর্ক ভাদুরী


আমাদের ছোটবেলা জুড়ে ছিল দু'টি অলৌকিক প্লেন, যারা ঠোঁটে মৃত্যুপরোয়ানা ঝুলিয়ে উড়ে গিয়েছিল ওয়র্ল্ড ট্রেড সেন্টারের দিকে। ঘুমভাঙা কৈশোরে আমরা দেখেছিলাম অতিকায় বাড়ির পেট থেকে গলগল করে বেরিয়ে আসছে ধোঁয়া, মৃত্যু আর আগুন। তারপরই শুরু হয়েছিল যুদ্ধ। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। ডিনারটেবিলে বাবা-মায়ের সঙ্গে বসে আমরা দেখতাম জলপাই পোশাক আর ট্যাঙ্ক। দেখতাম, আফগানিস্তান গুঁড়িয়ে যাচ্ছে, তালিবান গুঁড়িয়ে যাচ্ছে, আমেরিকা আর আমেরিকার বন্ধু নর্দান অ্যালায়েন্স জিতছে। শুনতাম মোল্লা ওমর নাকি মারা গিয়েছেন। লাদেনকে পাওয়া যাচ্ছে না। আরেকটু বড় হওয়ার পর দেখলাম মাটির নীচ থেকে টেনে বের করা হচ্ছে সাদ্দাম হুসেনকে, লোকটার একমুখ দাড়ি। আমরা দেখলাম দেশে দেশে যুদ্ধের বিরুদ্ধে মিছিল করছে মানুষ। কাগজে পড়লাম সেই মিছিল চিৎকার করছে— ওয়ান টু থ্রি ফোর, স্টপ ইয়োর স্টুপিড ওয়র!

আমরা সোভিয়েত দেখিনি, পূর্ব ইউরোপ দেখিনি। তেভাগা, তেলেঙ্গানা, নকশালবাড়ি, আইপিটিএ, দেশভাগ, ইউসিআরসি— কিচ্ছু দেখিনি। আমরাই প্রথম প্রজন্ম, যাদের ছোটবেলা ছিল বার্বিডলের মতো সুখী, রাংতার মতো ঝকমকে। আমরাই সেই প্রজন্ম, যাদের কাছে বিপ্লব মানে খিল্লি, কারণ ইতিহাস মৃত। স্কুলে পড়ার সময় আমরা শুনেছিলাম, বামফ্রন্টের বিকল্প উন্নততর বামফ্রন্ট আর পুঁজিবাদের বিকল্প পুঁজিবাদ স্বয়ং। শুনেছিলাম, সময় নেই, যা করার করে ফেলতে হবে এখনই। শুনেছিলাম— ডু ইট নাউ। আমাদের বলা হয়েছিল দেওয়াল থেকে শিখতে হবে, দেওয়াল থেকে জানতে হবে। বলা হয়েছিল, দেওয়ালে পিঠ ঠেকার আগে দেওয়াল জুড়ে লিখতে হবে। আমরা লিখেছিলাম— বামফ্রন্ট সরকার, উন্নয়নের হাতিয়ার। আমরা প্রশ্ন করিনি, জানতে চাইনি, ঠিক কবে থেকে, কেন, কীভাবে বামফ্রন্ট সরকার সংগ্রামের হাতিয়ার থেকে উন্নয়নের হাতিয়ারে পরিণত হল! কারা করল এমন? বড় হওয়ার পর আমরা দেখলাম নন্দীগ্রাম। দেখলাম, রাধারাণি আড়ি। দেখলাম, ঝর্ণা মাণ্ডি। আর দেখলাম, কৃষকের অধিকারের কথা বলা মিছিল গিয়ে মিশছে একুশ শতকের নব কংগ্রেসিদের রামধনু জোটে। 

আমরা কোনও কিছুকেই প্রশ্ন করিনি। আমরা জানতে চাইনি এনকেভিডি আর চেকা বিপ্লবের অংশ ছিল কী না! আমাদের প্রশ্ন করার প্রয়োজন পড়েনি, কারণ আমরা জানতাম ভাল করে জয়েন্ট দিতে হবে। তারপরেই প্লেসমেন্ট। এমএনসি আমাকে নিয়ে যাবে সব পেয়েছির দেশে। আমরা জেমস বন্ড দেখতাম। আমরা জানতাম দুনিয়ার কোথাও কমিউনিস্টরা নেই। কমিউনিস্টরা শেষ হয়ে গেছে। ইতিহাস শেষ হয়ে গেছে। আমাদের সদ্য শেখা আঁতলামিতে তা দিয়েছিলেন ফুকুয়ামা। আমরাই সেই প্রজন্ম, যাদের কোনও বিস্ময়বোধ নেই। আমরা অবাক হতাম না, কারণ গোটা দুনিয়াটাই একটা গ্রাম। আমরা জানতাম ইন্টারনেট জানে না এমন কিচ্ছুটি নেই। আমরা কনফিডেন্ট, কারণ পৃথিবীটা এগিয়ে গিয়েছে। লেনিনের মূর্তির গলায় দড়ি দিয়ে টেনেহিঁচড়ে নামানো হয়েছে নীচে। সিনেমায় দেখেছিলাম, অতিকায় লেনিনমুণ্ড ভাসতে ভাসতে মিশে যাচ্ছে আশমানি মেঘে।

লেনিন যেখানে দাঁড়িয়ে থাকেন, তার ঠিক উল্টোদিকেই একটা বিপজ্জনক বাড়ি। একপাশে অশোকা বার, অন্যপাশে বন্দুকের দোকান। লেনিনের কোট সারাক্ষণ হাওয়ায় ওড়ে। হাওয়া না থাকলেও ওড়ে। লেনিনকে উড়তেই হয়। দিনভর তাঁর পায়ের নীচে বসে থাকে প্রেমিকপ্রেমিকা, আপিসমানুষ। লেনিন দেখেন কাপের পর কাপ লাল চা বিক্রি হচ্ছে, লেবুজল বিক্রি হচ্ছে, আদর আর স্বপ্ন বিক্রি হচ্ছে। ট্রামগুমটির রাস্তা পেরিয়ে এল বৃদ্ধ ট্রাম। 'অফিস যাচ্ছি' বলে বেরিয়ে পড়া বেকার যুবক বিড়ি কেনে। কাঁধভর্তি ধার নিয়ে বসে থাকে একা, চুপচাপ। লেনিন দেখেন, অ্যাডিডাস লেখা টি-শার্ট বিক্রি করছে খিদিরপুরের আমিনুল, ষাট টাকা পার পিস। লেনিন দেখছেন, আকাশে এখন মেঘ, বৃষ্টিবিকেল। রাত সাড়ে ন'টায় লেনিনকে সাক্ষী রেখে ডোরিনা ক্রসিংয়ে এসে দাঁড়ান তিন বয়স্কা যৌনকর্মী। তাঁদের খদ্দের জোটে না বহুদিন। রাত বাড়লে লেনিন মাঝেমাঝে ডানদিকে তাকান— আলোয় আলোয় ঝলমল করছে পার্ক স্ট্রিট। ট্রিঙ্কাসের সামনে আলগোছে হাই তুলছেন বিষন্ন পুলিশকর্মী। কয়েকটা বাইক ছুটে গেল, চিৎকার। লেনিন দেখছেন, ছেলেমেয়েদের সাহসী পোশাক। লেনিন দেখছেন কলকাতা শহরের কামনামদির লিঙ্গের মতো আকাশ ফুঁড়ে উঠছে পুরুষালী ফর্টি টু। লেনিন দেখছেন ম্লানমুখ শহীদ মিনার।

আমাদের আইডল আর তাদের বান্ধবীরা জয়েন্টের প্রস্তুতি নিত পাথফাইন্ডারে। তাদের কলেজ ছিল যাদবপুর, শিবপুর, আইআইটি। নিদেনপক্ষে ফিউচার, গুরু নানক বা জলপাইগুড়ি। কয়েকবছরের মধ্যেই অনেকে চেপে বসত বিদেশগামী প্লেনে, পুজোয় গিফট দিত বিদেশী পুলওভার। আমরা জানতাম উন্নয়ন হচ্ছে, শিল্প আসছে, কেটে যাচ্ছে স্থবিরতা। এটা সেই সময় যখন উষা কারখানার কঙ্কাল ঢাকা পড়ছে সাউথ সিটির আদুরে ঠান্ডায়। আমরা সিনেমা দেখতে যেতে শুরু করলাম মাল্টিপ্লেক্সে। বাড়িতে এসি বসল। আমরা পপকর্ন কিনতাম, খবরকাগজ পড়তাম, বিশ্বাস করতাম— ইয়ে দিল মাঙ্গে মোর। আমরা শিখে নিয়েছিলাম ধর্মঘট খারাপ, কারণ স্ট্রাইক হলে উন্নয়ন থেমে যায়। বন্ধ্যা বনধ্— কী স্মার্ট শব্দবন্ধ, তাই না?

গরমকালের রাত্তিরে আচমকা কারেন্ট চলে গেলে বড্ড দমবন্ধ লাগে। হাওয়া ঢোকে না, কারণ জানলা বন্ধ— এসি চলছিল। ফ্যান ঘুরছে না, এসি বন্ধ, অন্ধকার। ঘাম হচ্ছে। ভাল করে ঘুম ভাঙার আগেই বমি পায়। দুর্গন্ধ। ঠাকুমার মৃত্যুর দিন তুমুল বৃষ্টি হয়েছিল, সেই সঙ্গে এতোলবেতোল হাওয়া। ইলেকট্রিক চুল্লি কাজ করেনি। ঠাকুমাকে পোড়ানো হয়েছিল কাঠে। মাথা ফাটার শব্দের মতো এই রাত। পোড়া মাংসের গন্ধের মতো। জানলা খুলতে গিয়ে ছিটকিনি পাওয়া যায় না প্রথমে। রাস্তার আলো জ্বলছ না। জলের বোতল নেই। যতটা সাজাতে পারব ভেবেছিলাম, আদৌ সেভাবে সাজবে জীবন? তোমাকে পাব? পরের প্রোজেক্টটায় নেবে তো আমাকে?

দাদার প্লেনে ওঠার আগের দিন বাড়িতে মাংস হয়েছিল। রবিবার সকালে বাবার বন্ধুরা আসত, সেদিন তাদের না করে দিয়েছিল বাবা। আমাদের বংশে এর আগে বিদেশযত্রা বলতে ঠাকুর্দার। ট্রেড ইউনিয়নের প্রতিনিধিদলের সঙ্গে ষাট সালে না কবে যেন রাশিয়া গিয়েছিল। সেই গল্প শুনে শুনে আমরা বড় হলাম। খুব কিছু আনতে পারেনি— লেনিনের ছবিওয়ালা ব্যাজ, ঠাকুমার জন্য একটা লাল স্কার্ফ আর সোভিয়েত ইউনিয়নের একটা পতাকা। সেগুলোর কথা উঠলেই আমার মনে পড়ে ন্যাপথলিন। আচ্ছা, ন্যাপথলিনের গন্ধ কি বিশ্বায়নবিরোধী নয়?

পিঙ্ক স্লিপ কাকে বলে আমরা জানতাম না। আমরা মানে আমি, বাবা আর মা। বাবার বন্ধুরাও জানত না। হারহারামি এলসিএস'ও না। দাদা কি জানত? জানি না। জানলেও কিছু বলেনি কখনও। যে ছেলেটা এত ভাল চাকরি পেল, বিদেশ গেল, বিয়ে করল, সে একটা গোলাপী স্লিপের জন্য আত্মহত্যা করবে কেন, বুঝিনি। যেমন বুঝিনি গাছগাম্বাট কমিউনিস্টরা ভোগে যাওয়ার পর রাশিয়ায় বেশ্যাবৃত্তি কেন বাড়বে! কেন মানুষ আবার খুনি স্ট্যালিনের ছবি হাতে মিছিল করে, কেন ভোট বাড়িয়ে নেওয়ার সুযোগ পায় জুগানভের পার্টি, কেন নীনা আন্দ্রিয়েভাকে কথা বলতে দেওয়া হয় না! তখনও বুঝিনি কাকে বলে রিসেশন!  আমরা বুঝিনি কেন ওয়াল স্ট্রিটে রাত জাগছিল ছেলেমেয়েরা, বুঝিনি কীভাবে ফিলিপিন্সের অর্ধেকটা দখল করে নিল গেরিলারা! বুঝিনি, কৌমচেতনা কেন বার বার পেড়ে ফেলে আমাদের! আমরা বুঝিনি, কিন্তু অনুভব করছিলাম। আমাদের রক্তমাংসে ঢুকে যাওয়া অতীত আমাদের প্রশ্ন করতে শেখাচ্ছিল। আমরা মারুতির মানেসর কারখানার দিকে দেখছিলাম, খাম্মাম আর মেদিনীপুরের কৃষকের দিকে দেখছিলাম, রাজস্থানের খেতমজুরদের দিকে দেখছিলাম। আমরা তাকিয়ে ছিলাম ফরাসী মুলুকের ধর্মঘটের দিকে, নেপালের মুক্তি সংগ্রামের ওঠাপড়ার দিকে, বেলজিয়ামের শ্রমিক-কৃষক-ছাত্রের মহামিছিলের দিকে। তাকিয়ে ছিলাম দক্ষিণ আমেরিকার দিকে। আমরা বুঝে নিচ্ছিলাম, ইতিহাস কখনও মরে না। মাঝেমধ্যে থমকে দাঁড়ায় মাত্র।

'আমিও আসলে ঘর খুঁজে যাই

খুঁজছ তুমিও, পাচ্ছি টের

যদি পেয়ে যাই আমরা দু'জন

ঘর যেন হয় সক্কলের'

আমি তোমাকে ভালবাসি। তোমার শরীরে শরীর মিশিয়ে আমি পেরিয়ে যাব এই কালসভ্যতার মর্গসন্ধ্যা। তোমার নাভিতে জিভ দিয়ে আমি লিখে দেব পূর্বপুরুষের নাম। তোমার স্তনে দাঁত দিয়ে খোদাই করে দেব বিশ্বাস। তুমিও, তুমিও আমার বুকে-পিঠে-উরুসন্ধিতে-গলায় সাপের মতো, গেরিলার মতো, স্বপ্নদ্রষ্টার মতো লিখে দেবে অনাগত সুদিনের ছবি। তুমি দেখো, তুমি দেখো, ওরা আমাদের শৈশব, কৈশোর লুট করে নিয়ে যাচ্ছে। আমাদের বাবা মা দাদু দিদিমাকে লুট করে নিয়ে যাচ্ছে। আমরা অতীতভ্রষ্ট, অন্ধ, কঙ্কালসার হয়ে পড়ে আছি। ওরা যা কিনতে বলছে, কিনছি। যা করতে বলছে, মুখ বুজে করে যাচ্ছি ঠিক তাই। আমার দমবন্ধ হয়ে আসছে, আমার বমি পাচ্ছে, আমার শিরা উপশিরায় বয়ে যাওয়া রক্ত ঘেন্না করতে বলছে নিজেকে। এ আমি কোথায় এলাম, ভালবাসা! আমার শীত করছে, আমার ভয় করছে! হেরে যাওয়ার ভয়, ছাঁটাই হওয়ার ভয়, ইএমআই দিতে না পারার ভয়। পূর্বপুরুষেরা আমাকে টিটকিরি দেন। তাঁদের গলায় বুলেটের দাগ, শ্রীকাকুলাম। তাঁদের মুখ থ্যাৎলানো, উনষাট সাল। তাঁদের শরীরে কয়েদিপোশাক, বিয়াল্লিশ। তাঁদের বুকের চামড়ায় তপ্ত লৌহশলাকা ঢুকিয়ে রক্ত আর গলা মাংসে খোদাই করে দেওয়া হয়েছে কিছু হরফ, বরানগর। আমি পারছি না। আমি পারছি না। আমি আপ্রাণ ভুলতে চেষ্টা করছি, পারছি না। আমি পারব না। আমি মরে যাব। তুমি আমাকে আদর করো, আমাকে চুমু খাও, চেটে দাও সর্বাঙ্গ আমার। আমার শরীর থেকে মুছে দাও একমেরু শৈত্য এবার।

আমি দেখতে পাচ্ছি প্রিয়তমা, বলশোই থিয়েটারে সন্ধের শো ভাঙছে। রাস্তা আলো করে বাড়ি ফিরছে মলিন পোশাক পরা হাসিখুশি মানুষের দল। কমসোমলের ছেলেমেয়ে একে অন্যের দিকে তাকাচ্ছে ঠারেঠোরে। আমি দেখতে পাচ্ছি পেট্রোগ্রাডের রাস্তায় ফেস্টুন আর ফেস্টুন। এনকেভিডি নেই, চেকা নেই, কেজিবি নেই। তুমি বিশ্বাস করো, বিশ্বাস করো, সত্যিই নেই আর। আমাকে ভদকা এগিয়ে দিচ্ছেন পুতিলভ কারখানার শ্রমিক, আমার পাশে পাশে হেঁটে চলেছে পাভেল ভ্লাসভ, পাভেল কোরচাগিন। বরফ পড়ছে, শীত করছে, আমাকে বাড়ি ফিরতে হবে তাড়াতাড়ি। আমার জন্য অপেক্ষা করছেন পেলাগেয়া নিলভনা। তাঁর হাতে বাইবেল। সন্ধ্যাপ্রদীপের কসম, জান, আমি তোমাকে ভালবাসি, সকালের আজানের কসম। বরফ বাড়ল। শীত করছে। রাত বাড়লে সাশা আর আন্দ্রেই আসবে। আসবে জয়া, শুরা, ইভান, একপেয়ে আলেক্সিই মেরেসিয়েভ। শ্রমিক আর সৈনিকদের সোভিয়েতের দফতরে হেঁটে যাচ্ছি আমি। আমার হাত ধরো। আমি ইউসিআরসি করা বাড়ির ছেলে, আমি কলোনির সন্তান, এই যৌথযাপনে আমার হক আছে। সোভিয়েতে হক আছে আমার।

শুক্রবার, ৬ জুলাই, ২০১৮

যাদবপুর এবং প্রবেশিকা ~ সৌরিত ভট্টাচার্য্য

আবার বড়ো লেখা। তবে কথাগুলো বলা দরকার ছিল 

পশ্চিমবঙ্গ মধ্যশিক্ষা পর্ষদের ও কাউন্সিলের স্কুলগুলোতে ইংরেজি পড়ানো নিয়ে এই লেখা। যারা পর্ষদে/কাউন্সিলে পড়েছেন তারা বিষয়টা ভালো বুঝবেন। আর আপনি যদি আমার মতো কলকাতা থেকে অনেক দূরে কোনো একটি ছোট শহরে বা গ্রামের পর্ষদভুক্ত স্কুলে পরে থাকেন তাহলে আরো ভালো বুঝবেন। আমি সকলের কথা লিখছিনা। আমার কথা লিখছি। আমি পড়েছি এমন একটা সময়ে যখন পঞ্চম শ্রেণীতে না উঠলে ইংরেজি পড়া যেতনা। সিপিএমের দূরদর্শিতা আর র্পারদর্শিতা দুয়ের কারণেই আমরা প্রথম থেকে চতুর্থ শ্রেণী পর্যন্ত ইংরেজি পড়িনি। আলিপুরদুয়ারের ভালো বাংলা মিডিয়াম স্কুল, ম্যাকউইলিয়াম হাইয়ার সেকেন্ডারি স্কুলের পঞ্চম শ্রেণীর প্রবেশিকা পরীক্ষার কিছু দিন আগে তরিহোরি করে ইংরেজি আলফাবেট গুলো সঠিক ক্রমে শেখানো হয়েছিল আর একটা গরুর রচনা মুখস্থ করানো হয়েছিল। যদ্দুর মনে পরে ওই গরুর রচনাটাই পরীক্ষায় এসেছিলো। তারপর পঞ্চম শ্রেণীতে অ্যানুয়াল পরীক্ষায় জিজ্ঞেস করা হয়েছিল ছোট হাতের ও বড়ো হাতের ইংরেজি আলফাবেট সঠিক ক্রমে লিখতে এবং এরোমি আরো কিছু লিখতে যাতে সব মিলিয়ে আমি ১০০ তে ৯০ পেয়ে বাড়ির সকলকে চমকে দিয়েছিলাম। বলে রাখি এটা আমি ১৯৯৫ থেকে ২০০৩ সালের কথা বলছি। এখনো পরিষ্কার মনে আছে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণীতে আমাদের জিজ্ঞেস করা হতো সেন্টেন্স কাকে বলে, ভার্ব কাকে বলে, নাউন কাকে বলে ইত্যাদি। মানে, পরিষ্কার সংজ্ঞা দাও। ইংরেজিতে। বইতে এমন বাজে ভাবে সংজ্ঞা লেখা থাকতো, আর যেহেতু বাড়িতে দেখানোরও কেউ ছিলোনা, শিখতেও ইচ্ছে করতো না. এই সংজ্ঞাগুলো স্কুলে বলতে পারলে ভালো, না পারলে হাতে একটা করে বেতের বাড়ি। চিন্তা করে গা কাঁপতো। তাও সংজ্ঞা মুখস্ত হতো না. অনেক সময় বাংলায় বলে দিতাম, তাতেও পার পেতাম না. এরপর ইংরেজিতে নম্বর কমতে কমতে অষ্টম শ্রেণীতে প্রায় ফেইল করে যাই. খুব কঠিন প্রশ্ন তৈরী করা হয়েছিল. বলেই দেয়া হয়েছিল প্রশ্ন কঠিন হবে. তাই ওরাল ও অন্যান্যতে প্রচুর মার্ক্স্ দেয়া হয়েছিল। অ্যানুয়াল পরীক্ষায় ৬০ এ ১২ পেয়েছিলাম। এরপর বাবা একজনের কাছে প্রাইভেট টিউশন পড়তে পাঠালেন. তিনি পরবর্তী চার বছর গ্রামারের দিকটা অনেক শিখিয়েছিলেন। তবে তাও অনেক ভুলভ্রান্তি রয়ে গ্যাছে. এখনো লিখতে ভুল হয়। হয়তো সারাজীবনই হবে. 

আমার সময়ে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তরে যা ইংরেজি পড়ানো হতো তা হলো মূলত এই গ্রামার আর প্র্যাক্টিক্যাল ইংলিশ। এই যেমন ছুটির দরখাস্ত। বিভিন্ন চাকরির পরীক্ষার দরখাস্ত। প্রেসি, রচনা ইত্যাদি। এগুলো কোনোটাই খারাপ নয় তবে কোনোটার প্রতিই স্বাভাবিক ভাবে ভালোবাসা আসেনা। কারণ ওই নম্র বয়সে ভালোবাসা থাকে অনেক বেশি সাহিত্যের সূক্ষ অনুভবের প্রতি বা বিজ্ঞানের চমৎকার উদ্ধাবনের প্রতি। টেকনিক্যালিটিস এর প্রতি ভালোবাসা তৈরী হতে সময় লাগে। আর এই ব্যাপারটাই মধ্যশিক্ষা পর্ষদ গা করেনি। আমাদের মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিক স্তরে সাহিত্য ছিল কিছু কবিতা আর কিছু গদ্য আর একটা নাটকের অংশবিশেষ। উচ্চমাধ্যমিকেরটা  মনে আছে তাই বলছি। গদ্যে ছিল কতগুলো রসকষহীন প্রবন্ধর অংশবিশেষ যা এমন কিছু লোকজন লিখেছেন যাদের পরবর্তী পনেরো বছরের সাহিত্যচর্চার জীবনে আর কোনোদিনই বিশেষ ভাবে পাইনি। এ জি গার্ডিনারের 'অন লেটার রাইটিং, লুই ফিশারের 'মাই উইক উইথ গান্ধী',  জ্যাকব ব্রনোওস্কির 'টেকনোলজি  ফর মানকাইন্ড' ইত্যাদি। যাদের পেয়েছি ও যারা একটি বিশেষ সময়ের মেজর ইংরেজি গদ্যকার যেমন ডিকেন্স, হার্ডি, এলিয়ট, ব্রন্টে সিস্টার্স, অরওয়েল, ইত্যাদি সিলেবাসে তাদের কেও নেই. আমি বলছিনা এদের সবাইকে পড়াতে হবে. অন্তত, আমাদের এই নামগুলোর সাথে পরিচিত করে দিন যাতে স্নাতকস্তরের পড়াশোনায় হোঁচট খেয়ে না যাই. যে পাঠ্যবই থেকে এসব পড়তে হতো তাতে কিছু উপরুল্লিখিত লেখকের লেখা ছিল..সেগুলো কোনোদিন পড়তে অনুপ্রাণিত করা হতোনা। যতটুকু দরকার ততটুকুই। প্রশ্ন উত্তর দাও. নম্বর পাও. এগোও। 

এই জ্ঞান নিয়ে আমরা মধ্যে কেউ কেউ আসতাম কলকাতায় যাদবপুর, প্রেসিডেন্সি, সেন্ট জেভিয়ার্স এর প্রবেশিকা পরীক্ষা দিতে যেখানে জিজ্ঞেস করা হয় সাহিত্য কি, বিজ্ঞাপন কি সাহিত্যের অংশ, জন ডান কে, মিল্টন এর এরপজিটিকা নিয়ে লেখো, দুর্গেশনন্দিনী নিয়ে লেখো, মকবুল সিনেমা নিয়ে লেখো, ইত্যাদি। খুবই চমৎকার লাগে ভাবতে যে কত কিছু সাহিত্যের অংশ. তবে স্কুলের এইটুকু স্টক নিয়ে ছাত্রছাত্রীরা কোথা থেকে এগুলো নিয়ে লিখবে? কেউ যদি নিজে থেকে পড়াশোনা করে থাকে সে কিছুটা জানবে। তবে ছোট শহরে বা গ্রামে নিজে থেকে পড়াশোনায় বা করবে কি করে? তার জন্য বই পত্র কিনতে হবে, অন্যরকমের গান শুনতে হবে, সিনেমা দেখতে হবে, পারলে বছরে একবার কলকাতা যেতে হবে. কে নিয়ে আসবে। বাবাদের জেনারেশন যারা দেশভাগের পর ওপর বাংলা থেকে এপার বাংলায় এসেছে তারা নিজের জীবন দাঁড় করাতেই সময় গোটা সময়টা বেরিয়ে গ্যাছে। উনাদের দীর্ঘ সময় লেগেছে এটা বুঝতে যে তাদের নিজের বাড়ি এখন আর নিজের নেই. নতুন জায়গা। নতুন ঘর. পরিবার ছেড়াবেড়া। এখন শুধু নিজেদের বাঁচানো আর টিকে থাকার লড়াই। তাই তাদেরকে দোষারোপ করে লাভ নেই. তাদের থেকেই কেউ কেউ আশেপাশের স্কুলে শিক্ষক শিক্ষিকা হয়েছেন ফলে তারাও নিজের কাজটুকু করিয়ে দিয়েই সমাপ্তি টেনেছেন. আর স্কুলে যদি বাংলা মিডিয়াম হয় তাহলে ছাত্র ছাত্রীকে গোটা স্কুল জীবনে ইংরেজি গ্রামার শেখাতে গিয়েই হিমশিম খেতে হয়েছে. আর ইংরেজি মিডিয়াম এ পড়ার মতো অধিকাংশেরই পয়সা ছিলোনা। ইন ফ্যাক্ট, কিছু জায়গায় তো ইংরেজি মিডিয়ামই ছিল না. আলিপুরদুয়ার শহরে আমার সময় মোটের ওপর একটি নামকরা ইংরেজি মিডিয়াম স্কুল ছিল. তবে তাদের ছাত্রছাত্রীদের সমস্যা হতে যে তাদের প্রাইভেট টিউশন পড়াবে কারা? তাই অনেকেই ইংরেজি মিডিয়াম থেকে বাংলা মিডিয়াম এ চলে আসতো। আবার অনেক সময় পয়সা ঠেকলেও অনেকে সিপিএম আইডিওলজির জন্য নিজের ছেলে মেয়েদের বাংলা মিডিয়াম এ ভর্তি করাতেন না। আমার জেনারেশনটা এইরকম কিছু 'ঐতিহাসিক' ভুলের শিকার। আমার পরের জেনারেশন এ পর্ষদে/কাউন্সিলে শুনেছি অনেক নম্বর ওঠে. তবে বিভিন্ন সময়ে অনেকের সাথে কথা বলে বুঝেছি সমস্যাগুলো একই রয়ে গ্যাছে। এখনো সেই কয়েকটা গদ্য কবিতা সংক্ষিপ্ত উত্তর ইত্যাদি। অনেক জায়গাতেই সার্বিকভাবে কোনো অনুপ্রেরণা নেই. কোনো গাইডেন্স নেই. এই রকম ইংরেজি (সাহিত্য) শেখানোর পর যখন সেই ছাত্র বা ছাত্রীটি স্নাতকস্তরে পড়তে আসবে আর প্রবেশিকা পরীক্ষায় ধাক্কা খাবে অথবা পরে কোনো এক কলেজে  ভর্তি হয়ে ইংরেজি সাহিত্যের ইতিহাস, কবিতা, গদ্য, নাটক পুরোপুরিভাবে পরে উত্তর লিখবে ও হোঁচট খাবে, সে ও তো সকলের মতো ভয় পাবে। ভাববে আমি এতগুলো মার্ক্স্ পেয়েও কিছুই জানিনা। আমায় সকলে বললো আমি কত ভালো, আমি ১০০ তে ৯০, ৯৫ এমনকি ৯৯ পেয়েছি। অথচ এখন ৫৫-৬০ তুলতে পারছিনা। মা বাবা পাড়া প্রতিবেশী বলছে আমি কলেজে উঠে বাজে সঙ্গে তলিয়ে গ্যাছি. এই রকম একটি চরম দৈনন্দিন মানসিক ক্রাইসিস এর সাথে যুক্ত করুন বিশ্ববিদ্যালয় গুলোর পরীক্ষায় বড়ো প্রশ্নের আধিপত্য, নোট পড়া, টিউশন পড়া, মার্ক্স্ না ওঠা, আর শেষমেশ স্বীকার করা ইংরেজি বড্ডো কঠিন। আমরা দ্বারা হবে না. 

তাই আজ যখন যাদবপুরে এডমিশন টেস্ট পাল্টাও, মার্ক্স্ দিয়ে বিচার করো, সকলকে সুযোগ করে দাও মার্কা পপুলিস্ট রাজনীতি হচ্ছে, তখন এটাই বলতে হয় যে যাদবপুর প্রেসিডেন্সির মান না নামিয়ে মধ্যশিখা পর্ষদে/কাউন্সিলে কলাবিভাগ পড়ানোর অবস্থার উন্নতি করুন। বাংলার মেজরিটিই পর্ষদের স্কুলে পড়াশোনা করে. তাদের গুরুত্ব দিন. খালি কলকাতা কলকাতা করা বন্ধ করুন. কলকাতার বাইরে ভাবুন। ভাবুন কলাবিভাগের সাব্জেক্ট গুলোকে কিভাবে ইন্টারেষ্টিং উপায়ে পড়ানো যায়. সিলেবাসকে কি করে আপটুডেট করা যায়। কি করে স্কুল ও স্নাতকস্তরের শিক্ষায় একটা মিল তৈরী করে যায় যাতে আমরা স্নাতকস্তরে এসে বিশাল এক ধাক্কা খেয়ে না যাই. নজর দিন কি করে ছাত্রছাত্রীকে অনুপ্রেরণা দেয়া যায়.পরিমান মতো শিক্ষক শিক্ষিকা নিয়োগ করুন। তাদেরকে শিক্ষিত করুন। তাদের বোঝান যে সকল শিক্ষক শিক্ষিকার নিজের ক্লাসে সকল ছাত্র ছাত্রীকে নাম ধরে চেনা উচিত। এই ছাত্র ছাত্রীগুলোর ভালোবাসা প্রয়োজনীয়তা জানা উচিত। স্টুডেন্ট-স্টাফ রেসিওর দিকে নজর দিন. এক্সট্রা কাররিকুলার একটিভিটি বাড়ান। এগুলোর মধ্যে যদি কিছুও করে থাকেন, তাহলে নজর দিন এগুলো সুষ্ঠভাবে সব জায়গায় পালন করা হচ্ছে কিনা? অবশ্যই স্টুডেন্ট দের থেকে ফিডব্যাক নিন. তারপর নজর দিন স্নাতকস্তরে কিভাবে বেটার করা যায়. আপামর বাংলায় স্কুলের শিক্ষা ব্যবস্থা ভালো হলে স্নাতকস্তরে কলেজও ভালো মানের ছাত্রছাত্রী থাকবে। হেলথি কম্পেটিশন হবে. মার্ক্স্ নিয়ে আর ব্যাকডোর দিয়ে কাড়াকাড়ির রাজনীতি কমবে। আর আমাদের মতো অনেক ছাত্রছাত্রীকে কথায় কথায় কলকাতা ছুটতে হবে না, অথবা সারাজীবন হ্যানস্থ হতে হবে না. এগুলো না করে যাদবপুর এডমিশন টেস্ট নেয়া দরকার আছে কি নেই এসব ফালতু বিতর্ক বন্ধু করুন। যাদবপুরের কলাবিভাগ নিয়ে ভাবা বন্ধ করুন। এই বিভাগ রাজ্য স্তরেই নয়, জাতীয় ও আন্তর্জান্তিক স্তরেও সুপরিচিত। তাই সেখানকার শিক্ষক শিক্ষিকারা জানেন তাদের কি করলে ছাত্রছাত্রীদের ও নিজেদের ভালো হবে. মাত্র তো গুটি কয়েক ভালো ইউনিভার্সিটি/কলেজ রাজ্যে পড়ে রয়েছে। তাদের কে তো ভালো থাকতে দিন. তাদের মান মাটিতে নামিয়ে কি লাভ হবে আমাদের?

বৃহস্পতিবার, ৫ জুলাই, ২০১৮

রামায়ন ও ইন্টারনেট ~ অভিজিৎ মজুমদার

টেনিদা একটু গলাটা ঝেড়ে নিয়ে বলল, বুঝলি সেকালেও ফেসবুক, ইন্টারনেট ছিল।

ক্যাবলা চাপাস্বরে বলল, ওই শুরু হল ঢপের চপ।

টেনিদা হুংকার ছেড়ে বলল, "এ্যাই ক্যাবলা কি বললি রা?"

ক্যাবলা তাড়াতাড়ি সামলে নিয়ে বলল, "আমি না, প্যালা বলছিল, আসার সময় দেখে এসেছে কালিকায় চপ ভাজছে। তাই বলছিলাম, একটু চপ টপ হলে এই বৃষ্টিতে ভালো হত।"

আমি সবে প্রতিবাদ করতে যাব, এমন সময় টেনিদা উদাস গলায় বলল, "নাহ্ চপ আর খাবো না। বরং নগেনের দোকান থেকে একটু পকোড়া নিয়ে আয়। যা, ক্যাবলা তুইই যা।"

ক্যাবলা কাতর গলায় বলল, "প্যালার আনার কথা তো?"

টেনিদা বাজখাঁই একটা চিৎকার ছেড়ে বলল, "সিয়াচেনে সৈন্যরা দাঁড়িয়ে আছে আর তুই একটু চপ আনতে পারবি না? যাবি না কি এক চড়ে তোর গালদুটো গুয়াতেমালায় পাঠিয়ে দেব?"

হাবুল বলল, "কিংবা গোরক্ষপুরে।"

আমি দেখলাম আমারও কিছু বলা দরকার। একটু মাথা চুলকে বললাম, "কিংবা গোবরডাঙায়।"

বাঙাল হাবুলটা হাড়জ্বালানি হাসি হেসে বলল, "এই প্যালাডা হাফপ্যান্টুলুন ছাইড়্যা ফুল প্যান্টুল পইড়ল, কিন্তু গোমূত্র আর গোবর ছাড়াইয়া আউগ্যাইতে পাইরল না।"

টেনিদা হাবুলের দিকে কটমট করে চেয়ে বলল, "তোদের সাথে এইজন্য কোনও ইম্পর্ট্যান্ট কথাবার্তা চালানো যায় না। হচ্ছিল পকোড়ার কথা, চলে গেলি গোবরে। ক্যাবলা, তুই কি যাবি না কি... ?"

টেনিদার বাড়ানো হাতটা দেখে ক্যাবলা ব্যাজারমুখে উঠে চারটে পকোড়া নিয়ে এল।

ক্যাবলা ফিরতেই টেনিদা ওর হাত থেকে পকোড়ার ঠোঙাটা ছোঁ মেরে নিয়ে আধখানা পকোড়া ভেঙে হাবুল কে আর ক্যাবলাকে দিল। আমিও হাত বাড়িয়েছিলাম, টেনিদার কটমট করে তাকানো দেখে আবার হাত গুটিয়ে নিলাম।

টেনিদা ধোঁওয়া ওঠা পকোড়ায় একটা কামড় বসিয়ে বলল, "আহা। পকোড়া ছাড়া বর্ষাকাল যেন ব্রাজিল ছাড়া বিশ্বকাপ।"

তারপর বলল, "হ্যাঁ, যেটা বলছিলাম। রামায়নের যুগেও ইন্টারনেট ছিল।"

হাবলা বলল, "মহাভারতে আছিল শুনসিলাম। সঞ্জয় নাকি ফেসবুক লাইভে কুরুক্ষ্যাত্রের যুদ্ধ দেখসিল। রামায়ণ তো তারও আগের কথা। তখনও ইন্টারনেট আছিল?"

টেনিদা একটু উঁচুদরের হেসে বলল, "নষ্ট্রাদামুসের নাম শুনেছিস?"

ক্যাবলা এতক্ষণ হাতের নুন চাটছিল। টেনিদার প্রশ্ন শুনে হাত উঁচু করে বলল, "আমি জানি।"

হাবুল ঘোঁৎ করে একটা নি:শ্বাস ছেড়ে বলল, "তুমি হইত্যাস আমগো গুগুল বাবা। তুমি জানবা না?"

ক্যাবলা হাবুলের কথায় পাত্তা না দিয়ে বলল, "নষ্ট্রাদামুস ষোড়শ শতাব্দীতে ফ্রান্সে জন্মেছিলেন। অনেক ভবিষ্যতবানী করে গেছেন। তবে আজকাল লোকে নিজেদের ইচ্ছেমত কথা ওনার মুখে বসিয়ে দেয়। যেমন, ভারতবর্ষে এমন একজন শাসক আসবে যাকে ইউনেস্কো বেস্ট প্রধানমন্ত্রী অ্যাওয়ার্ড দেবে।"

টেনিদা ক্যাবলার পিঠে একটা বিরাশি সিক্কার চাপড় মেরে বলল, "এই জন্যই তোকে এত ভালবাসি।"

আমি বললাম, "কিন্তু তার সাথে রামায়নের সম্পর্ক কি?"

টেনিদা একটা চওড়া হেসে বলল, "সে সব জানতে হলে ওই পাঁঠার মাংসের ঘুগনী যাচ্ছে, চারপ্লেট ঘুগনী নিয়ে আয়। আর হ্যাঁ, শালপাতায় আনবি, প্লাস্টিকের প্লেটে না।"

আপত্তি জানিয়ে লাভ নেই, চুপচাপ নিয়ে এলাম।

টেনিদা এক প্লেট হাবুল আর ক্যাবলাকে ভাগাভাগি করে দিয়ে নিজে তিনটে প্লেট নিয়ে বসল। আমি জুলজুল করে তাকাতে আমায় বলল, "এই বর্ষায় বাইরের খাবার তোর ওই পটল দিয়ে শিঙিমাছের ঝোল খাওয়া পেটে সহ্য হবে না।"

আমি মনে মনে বললাম, "খাও খাও। সব ভাগাড়ের মাংস। কাল যদি পেট না খারাপ হয়েছে আমার নাম পটলডাঙার প্যালারাম নয়।"



ঘুগনীটা শেষ করে শালপাতাটা আমার দিকে এগিয়ে টেনিদা বলল, "বলতো, রামায়ণ কাকে নিয়ে লেখা?"

শালপাতায় কোণে লেগে থাকা একটুকরো মাংসের কুচি তুলে মুখে দিয়ে বললাম, "কেন, রামচন্দ্রকে নিয়ে।"

টেনিদা একটা পিলে চমকানো হাসি হেসে বলল, "ফুংসুক ওয়াংড়ুর সঙ্গে দেখা হওয়ার আগে আমিও তাই ভাবতাম।"

ফুংসুক ওয়াংড়ুর নাম শুনে দেখলাম সবজান্তা ক্যাবলাও চোখ পিটপিট করে ঘুরে বসল।

-মতলব, বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক ফুংসুক ওয়াংড়ু? যার নামে তিনশো বাষট্টিখানা পেটেন্ট আছে?

ক্যাবলার প্রশ্নে টেনিদা চোখদুটো আধা বুজে মাথা নাড়ল। তারপর বলল, "এই যে গল্পটা তোদের এখন বলব সেটা আমাকে বলেছে তোদের ওই ফুংসুক ওয়াংড়ু। আমি অবশ্য ওকে ফুং বলেই ডাকি। আমরা বুজুম ফ্রেন্ড কি না। এর সঙ্গে আমার প্রথম দেখা সেই যখন আমি টিবেট গেলাম তখন। ফুং তখন অনেকদিন ধরে একটা জুতো বানানোর চেষ্টা করছে। যেটা পায়ে পড়ে লাফালে এক পাহাড় থেকে অন্য পাহাড়ে চলে যাওয়া যায়। একটা জুতো ও বানিয়েছিল বটে, কিন্তু সেটা পড়ে লাফালে হিসেবের থেকে ছাপ্পান্ন ইঞ্চি আগেই ওটা থেমে যাচ্ছিল। আর বুঝতেই পারছিস, পাহাড়ে ওই হিসেবের গোলমাল মানে সোওজা খাদে। বেচারা খুব মনের কষ্টে ছিল। আমি ভাল করে দেখে বুঝলাম যে স্প্রীংটা ও লাগিয়েছে, সেটা দু মিলিমিটার ছোট। আমি টেনে একটু লম্বা করে দিতেই, জুতোটা একদম পারফেক্ট হয়ে গেল। ফুংসুক তো খুশি হয়ে আমাকে জড়িয়ে টড়িয়ে ধরে বলল, মিস্টার টেনি, ওয়াংশু কুশ থুংপা থুংপা। মানে তিব্বতি ভাষায় থ্যাংকু ভেরি ভেরি মাচ। তারপর বলল, 
তুমি আজ আমার এক অনেক বড় সমস্যা সমাধান করে দিলে। এই জুতোর আধা পেটেন্ট তোমার। জানিসই তো, আমি ফকির মানুষ, আমার কোনও লোভ নেই। তাই আমি ওকে না করে দিলাম। তখন ফুং বলল, ঠিকআছে, মিস্টার টেনি। কিন্তু আমরা তিব্বতিরা বিনা প্রতিদানে কিছু নেই না। তোমাকে এর পরিবর্তে আমি এমন একটা গুপ্ত তথ্য জানাবো, যা কেউ জানে না। এক তিব্বতি গুম্ফার সাধুর কাছে লুকিয়ে রাখা পাঁচ হাজার বছরের পুরনো পান্ডুলিপিতে আমি এটা পড়েছি। এই বলে, ও ওর সিন্দুক খুলে একটা তালপাতার পুঁথি বার করল। সেই পুঁথি পড়ে তো আমার আক্কেল গুড়ুম। এই দ্যাখ সেকথা বলতেও আমার গায়ে কাঁটা দিচ্ছে।"

ক্যাবলা একটু নাক কুঁচকে বলল, "তুমি কবে তিব্বত ঘুমতে গেলে? আর তিব্বতী ভাষাই বা শিখলে কবে?"

টেনিদা দাঁত খিঁচিয়ে বলল, "সে খবরে তোর কি দরকার রা? আমি চার বছরে চুয়াত্তর বার কোন দেশে কি কাজে যাই, সব কি তোকে বলে যাব? গল্প শুনতে হলে শোন, নয়তো বাদ দে। আমি চললাম।"

হাবুল হাঁ হাঁ করে উঠল। "ছাড়ান দাও, ছাড়ান দাও। পোলাপান।"

-"হুঁ, পোলাপান। এদের ধরে জলপান করে ফেলতে হয়।"

আমি জিজ্ঞেস করলাম, "ফুংসুক কি বলল?"

-"শোন তবে। রামায়ণ বলতে আমরা কি বুঝি? রামের গল্প, তাই তো? কিন্তু গল্পটা আসলে কাকে ঘিরে বলত?

আমি একটু মাথ চুলকে বললাম, "হনুমান?"

-তোর মুন্ডু। গল্পটা হচ্ছে আসলে সীতাকে নিয়ে। সীতাহরণ হচ্ছে যাবতীয় ঘটনার মূলে। তো এই সীতা কে?

ক্যাবলা বলল, "সীতা মাইয়া জনক রাজার মেয়ে আর রামজীর বিবি।" অনেক বছর পশ্চিমে কাটানোয় ক্যাবলার কথায় এখনো পশ্চিমা হিন্দির টান।

হেঁ, হেঁ করে একটা উচ্চাঙ্গের হাসি হেসে টেনিদা বলল, "সেটাই তো সবাই জানে। কিন্তু ফুংসুক যেটা বলল সেটাই আসল গুপ্তকথা।"

"ফুং তো ওর সিন্দুক খুলে আমাকে পুঁথিটা দিল। কিন্তু, কি বলব তোদের, সেই পুঁথি হাতে নিয়ে আমার চক্ষু চড়কগাছ। দেখি, সেই তালপাতার পুঁথিতে মুক্তোর মত হাতের লেখায় গোটা গোটা বাংলায় পুরো রামায়ণ লেখা।"

-"তিব্বতী গুহার পাঁচ হাজার বছরের পুরনো পুঁথিতে বাংলায় লেখা রামায়ণ? খাইসে।" হাবুল চেঁচিয়ে উঠল।

-অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান যখন কলকাতা থেকে ডায়মন্ড হারবার হয়ে তিব্বত পৌঁছন, তখনই তাঁর হাত ধরে তিব্বতে বাংলা ভাষা জনপ্রিয় হয়েছিল। বুঝলি? কিসুই তো জানিস না। ভারতের আসল ইতিহাস টিতিহাস পড়েছিস কখনো? তোর মাধ্যমিকের সার্টিফিকেটখানা একবার দেখতে হচ্ছে।

-হ। একদিন আমরা হক্কলে আমাগো সার্টিফিকেট লইয়া আমু। তোমারডাও কেও কখনো দ্যাখে নাই।

সার্টিফিকেটের কথা তুলতেই টেনিদা হাবুলের পিঠে হাত রেখে বলল, "আহা, চটিস কেন? তোকে আমি কখনো কিছু বলেছি। ওটা ওই সবজান্তা ক্যাবলাকে বলা। দেখছিস না, মুখখানা কেমন পান্তুয়ার মত করে বসে আছে।"

ক্যাবলা ফিশফিশ করে বলল, "সব গাঁজা। বাংলা ভাষার বয়স খুব বেশি হলে হাজার বছর, লিপির বয়স আরও কম। আর অতীশ দীপঙ্কর মারা গেছেন ১০৫৪ সালে।"

টেনিদা ক্যাবলার দিকে চেয়ে একটা করুণার হাসি হেসে বলল, "রামচন্দ্রের জন্মের আগে যদি রামায়ণ লেখা হতে পারে, স্টেশন তৈরী হওয়ার আগেই যদি সেই স্টেশনে চা বিক্রি হতে পারে, তবে বাংলা ভাষার জন্মের আগে কেন বাংলায় লেখা হতে পারে না শুনি?"

টেনিদার উত্তর শুনে ক্যাবলার মুখটা ভেবলে গিয়ে বাসি বেগুনীর মত হয়ে গেল।

টেনিদা একবার আমাদের তিনজনের মুখের দিকে তাকিয়ে আবার গল্প বলা শুরু করল।

"বুঝলি, সেই পুঁথিতে যা লেখা তাকে রামায়ণ না বলে সীতায়ণ বলাই ভালো। সেখানে কাহিনী শুরুই হচ্ছে জনকরাজার লাঙলে সীতার মাটি ফুঁড়ে উঠে আসা নিয়ে। তারপর আছে সীতার স্বয়ম্বরের বিস্তারিত বর্ণনা। কিভাবে রামচন্দ্র হরধনু ভেঙে সীতাকে নিয়ে এলেন তার গল্প। তারপর শুধু সীতারই গল্প। বনে সোনার হরিণ দেখা, লক্ষ্নণের গন্ডী পেরিয়ে রাবনকে ভিক্ষে দেওয়া, সীতাহরণ, সীতার উদ্ধার থেকে অযোধ্যা ফিরে যাওয়া সব। মায় উত্তরকান্ড পর্যন্ত।"

টেনিদা থামতেই হাবুল বলল, "হগ্গলই তো বোজলাম, কিন্তু ফ্যাসবুক আর ইন্টারনেটের কথা কইসিলা, হেডা কই?"

ক্যাবলাও উত্তেজিত হয়ে বলল, "অওর তুমহারা আঁখ চড়কগাছ কিঁউ হুয়া?"

টেনিদা একবার আমাদের সবার মুখের দিকে তাকাল। তারপর খানিক চুপ করে থেকে গলা নামিয়ে ফিসফিস করে বলল, "সীতা হল আসলে ডেটা। তোর আমার ব্যক্তিগত তথ্য। আর জনকরাজা? সে হল আসলে আধার।"

ক্যাবলা হাত তুলে বলল, "তার মানে হরধনু হল সিকিউরিটি পাসওয়ার্ড?"

"কেয়াবাত।" বলেই টেনিদা একটা বিরাশি সিক্কার থাবড়া বসাতে যাচ্ছিল ক্যাবলার পিঠে। কিন্তু আগেরবারের অভিজ্ঞতায় ক্যাবলা সুড়ুৎ করে সরে গেল আর থাবড়াটা বোঁ করে ঘুরে পড়ল হাবুলের কাঁধে। হাবুল কোঁত করে চেঁচিয়ে উঠল, "খাইসে, খাইসে।"

টেনিদা সেদিকে বিন্দুমাত্র পাত্তা না দিয়ে বলতে লাগল, "ডাটা একবার হাত বদল হয়ে মালিকের কাছ থেকে গেল আধারের কাছে, তারপর সেখান থেকে পাসওয়ার্ড ক্র্যাক করে চলে গেল পরের জনের কাছে।"

-"আর ফেসবুক? তুমি যে বলেছিলে ফেসবুকও ছিল?" অনেকক্ষণ চুপ করে থাকার পর আমারও কিছু একটা বলা দরকার মনে হল।

-"সোনার হরিণটাই তো আসলে ফেসবুক। এই যে তোরা সকাল সন্ধ্যে এটা ওটা লিংকে ক্লিক করিস "আপনি আগের জন্মে কি ছিলেন" অথবা "আপনি কোন বলিউড অ্যাক্টরের মত দেখতে" জানতে, সেগুলো আসলে কি? সেগুলো তো ওই সোনার হরিণের ফাঁদ। লক্ষ্মণ, যে কি না আসলে তোর ফোন বা কম্পিউটারের ফায়ারওয়াল, তার টেনে দেওয়া গন্ডী যদি তুই নিজেই পেরিয়ে যাস, তাহলে তোর ডাটা তো অন্যের হাতে যাবেই। রাবণ তো আর কিছু নয়, ও হল কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা যে সাগর পেরিয়ে এসে তোর ডাটা চুরি করে পালিয়ে যাবে। তারপর সেই ডাটা উদ্ধার করা কি চাট্টিখানি কথা? পুরো লঙ্কাকান্ড একেবারে। শুধু উদ্ধার করেও কি রক্ষে আছে? ডাটা করাপ্ট হল কি না সেই চিন্তাও তো আছে। তাই গল্পের শেষ হচ্ছে সীতার পাতালপ্রবেশ দিয়ে। অর্থাৎ, নিজের ডাটা নিজের কাছে থাকাই ভালো। বুঝলি কিছু?"

ক্যাবলা গভীর সন্দেহের দৃষ্টিতে বলল, "এইসব ওই পুঁথিতে লেখা ছিল?"

-"তবে কি আমি এই ভর সন্ধ্যেবেলা তোদের গাঁজা দিচ্ছি?"

-"দেখাতে পারবে সেই পুঁথি?"

টেনিদা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, "সেটাই তো ট্র্যাজেডি রে। সবে পুঁথিটা পড়া শেষ করেছি, এমন সময় শুনি গুড়গুড় আওয়াজ। তাড়াতাড়ি আমি আর ফুং বাইরে এসে দেখি এক বিশাল বরফের স্রোত ওপর থেকে নেমে আসছে। আর দু মিনিট দেরি হলেই আমরা দুজনেই ওর তলায় চাপা পড়ে যেতাম। কোনওমতে প্রাণ নিয়ে ফিরেছি। ওই পুঁথিটা ওই বরফের তলায় চিরকালের মত চাপা পড়ে গেল।"

-তোমরা বাঁইচলা কি কইর্র্যা?

-"ওই যে ফুংসুক ওয়াংড়ুর জুতো। ওটাই তো এ যাত্রা বাঁচিয়ে দিল। একজোড়াই ছিল, তাই আমি পায়ে পড়লাম আর ফুংকে বললাম আমার হাতটা শক্ত করে ধরতে। তারপর একটা লাফ দিয়েই সোজা অন্য পাহাড়ে।"

আমরা সবাই খানিক চুপ করে বসে রইলাম। তারপর ক্যাবলা বলল, "তো এতসব ঘুরিয়ে লেখা কেন? সিধা সিধা লিখলেই তো পারত।"

টেনিদা মুচকি হেসে বলল, "পুঁথিটা তো নষ্ট্রাদামুসের লেখা। ওনার সব কিছু রহস্য করে লেখার অভ্যেস ছিল না? তাই।"

ক্যাবলা বললে, "সব বাজে কথা- বানানো।"

টেনিদা দাঁত খিঁচিয়ে বললে, "বানানো? তোদের এসব গোপন কথা বলাই আমার ভুল হয়েছে।"

এই বলে চাটুজ্জেদের রোয়াক থেকে নেমে টেনিদা পটলডাঙা স্ট্রীট ধরে হনহন করে হাঁটা দিল।

(সমাপ্ত)