রবিবার, ২ এপ্রিল, ২০১৭

ডালের বড়া ~ কৃশানু


তখন ক্লাস সিক্স। বাড়ি মানে এক কামরা ভাড়ার ঘর, একটু দূরে রান্নাঘর, অনেক দূরে বাথরুম। মা রান্নাঘরে তরকারি কুটতে কুটতে আমায় ডেকে বলল, নতুন পেন্সিলবক্স, ডাকটিকিট, গল্পের বই আর কেনা যাবে না। বাবার চাকরি গ্যাছে। আর বাড়িভাড়ার টাকা যাতে দিতে না হয়, তাই আমরা বাড়ি বানাচ্ছি। নিজেদের।

আজ আমি ক্রোনি ক্যাপিটালিজম নিয়ে আপনাদের গল্প শোনাতে আসিনি। ট্রেড ইউনিয়নের কিছু নেতার বিশ্বাসঘাতকতা বা গোল্ডেন হ্যান্ডশেক নিয়েও নয়। শুধু এটুকুই জানানোর, দুই বোনের বিয়ে দিয়ে, বড় ভাই হিসেবে দীর্ঘদিন সংসার টেনে বাবার হাতে লাখ দুয়েক টাকা মাত্র ছিল। যা পোস্ট-অফিসের মান্থলি ইনকাম স্কিমে রেখে মাসের শেষ কিছু টাকা পাওয়া যেত। বাবা কিছু হাড়ভাংগা খাটুনির উটকো চাকরি করতেন মাস গেলে দু-হাজার টাকার জন্য। মানে যেসব লোকেরা ভিড়ে ঠাসা লোকাল ট্রেনে শ্রান্ত হয়ে নটার সময় বাড়ি ফেরেন, বা নারকেলবাগানের মোড়ে যে মানুষটি এসি২৩এ ছেড়ে দিয়ে ঘন্টায় একটা সি২৩ এর অপেক্ষা করেন, তাদের মতই।  মামা মাসিরা সাহায্য করতেন। আর চারদিকে দেনা। বাড়ির প্রোমোটার থেকে পাড়ার মুদির দোকান।

আমি আর বেশি পেন্সিলবক্স কিনিনি। ডাকটিকিট জমানোও বন্ধ করি। বই পড়া ছাড়তে হয়নি। মামার বাড়ির বিশাল লাইব্রেরী থেকে জুটে যেত। কিন্তু আমাদের লাইফস্টাইলে, যা এমনিতেই খুব উঁচু ছিল না, কিন্তু নিয়মিত ছিল, বড়সড় পরিবর্তন হয়। সুতো দিয়ে কেটে দুভাগ করে ডিম খাওয়া হত। মাসে একবার কেউ এলে মাংস। এই বিলাসিতাও বন্ধ হয়। একমাত্র আমি সপ্তাহে একটা ডিম পেতে থাকি, বাবা- মা ঝোল আলু। সে সংস্থান-ও রোজ হয় না। মাসতুতো দাদা এসে আমায় নতুন বাড়ির বাগানের গাছের ঢ্যাঁড়শ সেদ্ধ দিয়ে ভাত খেয়ে স্কুলে যেতে দেখে অবাক হয়ে যায়। নকাকার দেওয়া ক্রিম কালারের বারমুডা বা নৈনিতাল থেকে আনা সোয়েটার আমার নতুন জামা হয়। মামাতো দাদার জামাকাপড় এনে বাড়িতে পরি, বাইরেও। কিন্তু মধ্যবিত্ত স্কুলে যাওয়া বাড়ন্ত ছেলের প্রোটিনের ঘাটতি মিটবে কোথা দিয়ে? 

আমার মা বিভিন্ন মানুষ-এর ক্যারিকেচার করতে পারে খুব ভাল। মামির থেকে শেখা। আর সেই সংগে, মা-এর অতুলনীয় স্মৃতিশক্তির কারণে অজস্র প্রবাদ, শালকিয়ার বারোঘর ভাড়াটের অসংখ্য গল্প, বীরভুমের গল্প আমাকে ঘিরে থাকত। দাদু ঢাকা থেকে উদ্বাস্তু হয়ে শালকিয়ায় আসেন। বীরভূমে চালের ব্যবসা করে লাভের মুখ দেখেন। মায়ের জন্ম শেখানেই। তার পরপরই সেই ব্যবসা মার খায়। সর্বস্বান্ত হয়ে ফিরে আসেন শালকিয়া।
যা বলছিলাম, অসংখ্য মজার কথা মায়ের মুখে লেগেই থাকত। মধ্যবয়সে পয়সা ও চিকিৎসা-র অভাবে মায়ের শরীরে তখন থেকেই দানা বাঁধতে থাকে রোগ। কিন্তু কপালে ভাঁজ পড়লেও হাসিটি এখনো অটুট।

সেই মা আমাকে কারুর বাড়ির গল্প শোনাত। অতিথি আসায় খেতে দেওয়া হয়েছে। ডাইল আর ডাইলের বড়া। সেইদিনগুলোতেই গল্পটা বলা হত, যেদিন আমার পাতেও তাই। গল্পটা তাই আমি অসংখ্যবার শুনেছি। মধ্যবিত্ত স্কুলে যাওয়া বাড়ন্ত ছেলের প্রোটিন।

আজ আমার ইউরিক এসিড ধরা পড়েছে। মাংস খাই সপ্তাহে দুবার। গুডরিকের রোস্টেড চা। ব্রু গোল্ড কফি। ইউরিক এসিড সামলাবার জন্য স্ট্রবেরি খাই। কারণ আমার বাবা মা আমি - আমরা তিনজন কোনো একসময়ে ডারউইনের থিওরির ঠিক দিকের খোপে ঢুকে যেতে পেরেছি। জীবন আমাদের নিয়ে প্রচুর টানাটানি করলেও। তাই বাবা কোম্পানির বিরুদ্ধে মামলা লড়ে চাকরি যাবার দুই দশক বাদে কিছু টাকা পেয়েছে। ওই দিন অবধি বেঁচে থাকতে পেরেছে,  জেতার খবর এসেছে, যেদিন প্রত্যেকের প্রাপ্য অর্ধেক টাকা উকিল নিয়েছেন। কিন্তু বাবার বহু সহকর্মী সেই দিনটা দেখার অনেক আগেই মারা গিয়েছেন। ভেসে গ্যাছে তাদের সংসার, স্ত্রী ছেলে মেয়ে। আমরা কিন্তু ঢুকে পড়েছি সঠিক খোপে। আরো কিছুদিন সারভাইভ করছি। তাই আমার এখন দু-কামরার ফ্ল্যাট, দমদমে। এটাচড বাথ-ও আছে।
এই লেখা প্রায় শেষ। শুধু আর দুটো কথা বলব। 
এই কুড়ি বছরে মুসুর ডালের দাম বেড়েছে ৬০০ %, কিন্তু ডেইলি ওয়েজ বেড়েছে ৩০০%। মহার্ঘ হয়েছে ডাইল আর ডাইলের বড়া।

এই কুড়ি বছরে স্বল্পসঞ্চয় প্রকল্পে সুদের হার ১২% থেকে কমে হয়েছে ৭.৯%।  আমার যতদূর মনে পড়ে এক লাখ বিরানব্বই হাজার টাকা রেখে আমরা মাসে পেতাম ১৯২০ টাকা। আজকের দিনে হলে পাব ১৩০০ টাকা, কিছু এদিক ওদিক। আজকের দিনে একই পরিস্থিতে কোথায় যেত একটি পরিবার? কোথায় যেতাম আমরা? কোথায় যেতাম আমি?


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন