তিস্তা নদীতে একসময় না কি বজরা চলতো । গত বছর মোটামুটি এই সময়ে জলপাইগুড়ি গেছিলাম এক দিনের জন্য । বিকেলে হেঁটে হেঁটে তিস্তার খাত পার করার সময় দিব্যি যীশুখ্রিস্ট টাইপের ফিলিং হচ্ছিল । এত বড় নদী যীশুও হেঁটে পার করেন নি, আমি নিশ্চিত হয়ে বলতে পারি । একটাই শুধু ব্যাপার, তিস্তায় এক ফোঁটা জল ছিল না । না, সত্যিই, এক ফোঁটাও না ।
তিস্তাকে মেরে ফেললো কে ? এক কথায় বলতে গেলে 'উন্নয়ন' । দশ আনা মেরে ফেলেছে সিকিমের বিভিন্ন জলবিদ্যুৎ প্রকল্প । বাকি ছয় আনার জন্য দায়ী এরাজ্যের তিস্তা প্রকল্প ।
এখন পপুলার ধারণা হলো যে উন্নয়ন মানে সুন্দর নীল সাদা রং, জঙ্গল কেটে সাজানো বাগান আর গাছ কেটে রাস্তা । সেরকমই স্বাধীনতার পরপর দিয়ে উন্নয়নের ধারণা ছিল বড় বড় নদীবাঁধ, জঙ্গল কেটে চাষবাস । তো এই বাংলার শাসককুল ভাবলেন বঞ্চিত উত্তর বাংলার জন্য বড় কিছু করা যাউক । কি করা যাবে, কেন বড় ব্যারেজ ।
সেচ এর ইতিহাস সম্পর্কে যাদের একটু ধারণা আছে তারা জানবেন যে ট্রাডিশনালি কম বৃষ্টিপাতযুক্ত এলাকাতে খাল কেটে জল নিয়ে গিয়ে চাষবাস করতে হয় । যেসব অঞ্চলে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয় সেখানে পুকুরের জলে সেচই দস্তুর । উত্তরবঙ্গে কম বৃষ্টি হয়, এটা দিলীপ ঘোষের মত উচ্চশিক্ষিত লোকজনও দাবী করবেন না । কিন্তু ওই যাকে বলে উন্নয়ন করতে হবে । পুকুর টুকুর দিয়ে সেচ !! ম্যা গো !! পুকুর বুজিয়ে সেই জমিতে চাষবাস হোক, আর নতুন করে জমি অধিগ্রহণ করে সেই জমিতে ক্যানাল কাটা হোক । তবেই উন্নয়ন দেখা যাবে। প্রত্যেক গ্রামে তিনটে নতুন পুকুর কাটাতে হয়তো অনেক কম খরচ হতো, কিন্তু ঐটুকু উন্নয়ন তো দেখাই যাবে না ।
তাই ক্যানাল হলো, গজলডোবায় ব্যারেজ হল, আর তিস্তা নদী মরে গেল । জলপাইগুড়িতেই তিস্তার এই হাল, বাংলাদেশে কি হাল সেটা সহজেই অনুমেয় । তিস্তার নদীখাতের জলধারণ ক্ষমতাও এখন তলানিতে, ফি বছর তাই বন্যা হচ্ছে জলপাইগুড়িতে । তিস্তার অনেক গুলো শাখানদী উপনদী আছে দুই বাংলার উত্তরভাগে । তিস্তা মরে যাওয়ায় তারাও এক এক করে ঝিঙে তুলেছে । গোটা উত্তরবঙ্গের ভূগোল থেকে এক এক করে অনেকগুলো নদীকে মুছে দিয়েছে উন্নয়ন নামের দানব । উত্তরাখণ্ড এ প্রবল বিপর্যয় তো আমরা দেখেছি, এরপরে হয়তো সিকিম, তার পরেই উত্তরবঙ্গের টার্ন আসবে ।
নদী কারো বাপের সম্পত্তি নয়, চীন যেমন ব্রহ্মপুত্রের সব জল বাঁধ দিয়ে আটকে দিতে পারে না, সেটা তিস্তার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য । নদীকে তার নিজের মতো বইতে দেওয়া দরকার । সিকিমের বড় বড় ড্যাম গুলোকে বন্ধ করা হোক, গজলডোবার ব্যারেজ খুলে দেওয়া হোক । বৃষ্টিমুখর উত্তরবঙ্গে সেচের জন্য তিস্তার জলের দরকার নেই, বৃষ্টির জল ধরে রাখতে পারলে সেটা মোর দ্যান এনাফ । হ্যাঁ, এবং এটা বাংলাদেশের জন্যও সত্য । তাদের ক্ষেতে জল দেওয়ার জন্যও তিস্তা বা গঙ্গার জল খালে করে নিয়ে যাওয়ার দরকার নেই ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন