শনিবার, ১ এপ্রিল, ২০১৭

আধার কার্ড ~ সুশোভন পাত্র

দুই ভাই আর এক বোন নিয়ে পাঁচ জনের সংসার। সম্বল বলতে মাথার উপর এক চিলতে ছাদ আর বিঘা খানেক জমি। কত্তা জমিতেই ঘাম ঝরিয়ে ফসল ফলান। চাষের খরচা বাদে 'সেভিংস'টুকু জমা হয় গিন্নীর কাছে। গিন্নী হলেন 'ব্যাঙ্ক'। সেই 'সেভিংস' থেকেই মাসকাবারি খরচা চলে, হেঁশেল ঠেলে ভাত জোটে, মেয়ের বিয়ের জন্য বিন্দু বিন্দু সিন্ধু জমে। সন্ধেবেলা জমা-খরচের হিসেব গিন্নী 'ব্যালেন্স শিটে' তুলে রাখে। 
সেই যে সেবার শহরে মাছের খুব 'ডিমান্ড' হল, বড় ভাইটা মাছ 'সাপ্লাই'র ব্যবসা ধরল। বোনের বিয়ের জমানো সিন্ধু থেকে হাজার পাঁচেক 'লোন' নেওয়ার সময় মা'কে বলেছিল -"ব্যবসা জমলেই  টাকাটা আমি ডবল করে ফেরত দেবো।" মেজ ভাইটাও গতরে খাটতে শহর গেলো। হাজার দুয়েক হাতে নিয়ে বাপের পা ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা  করলো "রোজগার করে বিয়ের সব গয়না আমি শহর থেকেই গড়িয়ে দেবো।"    
হঠাৎ কি যে হল, 'ফাটকা পুঁজি' সব উবে গেলো। শহর জুড়ে 'রিসেশন' এলো। কত লোকের চাকরি গেলো। মাছের 'ডিমান্ড' কমে গেলো। লেমন-ব্রাদার্স শুকিয়ে গেলো। মেজ ভাইটা হারিয়ে গেলো। বড়ভাই'টা পথে বসলো। বোনের বিয়েটা 'জাতীয় অর্থনীতির' মত থমকে গেলো। আর গিন্নীর 'ব্যালেন্স শিটে' অনাদায়ী ঐ লোন গুলো  'নন পারফর্মিং আসেট' হয়েই পড়ে রইলো। বছর ঘুরে নতুন খাতায় পুরনো হিসেবে তুলতে গিয়ে, গিন্নী সেদিন 'নন পারফর্মিং আসেট' কে মাতৃ স্নেহে 'রাইট অফ' করে আঁচলের ডগা দিয়ে চোখের কোণা মুছল।         
গত দুই আর্থিক বছরে এরকম ১ লক্ষ ১৪  হাজার কোটি টাকার 'নন পারফর্মিং অ্যাসেট ' কে 'রাইট অফ' করেও বর্তমানে আমাদের দেশের ২৮টি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কে মোট 'নন পারফর্মিং অ্যাসেট' ৬,১৪, ৮৭২ কোটি টাকা ¹। গত দুই আর্থিক বছরে শতকরা বৃদ্ধি ১৩৫% ² । মায়ের কাছে লোন নিয়ে ফেরত দিতে না পারা বড়-মেজো ভাই'দের তালিকায় প্রথম নাম, রিলায়েন্স। তারপর ভেদান্ত-এসার-আদানি-ভিডিওকন; অ্যান্ড দা লিস্ট গোস অন ³ । অপত্য স্নেহে অন্ধ মা এখন সংসার চালাতে বৃহস্পতি-শনি নিরামিষ খাচ্ছে, চায়ে এক চামচ চিনি কম দিচ্ছে, আর সুযোগ পেলেই প্রভিডেন্ট ফান্ড আর ফিক্স ডিপোজিটে ইন্টারেস্ট রেট কমিয়ে দিচ্ছে। যদিও অঙ্কের হিসেবে ৬,১৪,৮৭২ কোটি টাকার এই 'নন পারফর্মিং আসেট' ২০১৭-১৮'র ঘোষিত ১০০ দিনের কাজ, তফসিলি জাতি উপজাতি উন্নয়ন, নারী কল্যাণ এবং গ্রামোন্নয়নের মত সামাজিক প্রকল্পের সম্মিলিত বাজেট বরাদ্দের দেড়গুণ; প্রতিরক্ষা এবং সড়ক ও পরিবহন উন্নয়নে খাতে বাজেট বরাদ্দের দ্বিগুণ; আর শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে সম্মিলিত বাজেট বরাদ্দের পাঁচ গুন, তবুও গ্রাম সুদ্ধু লোকের মুখে প্রচার হয়েছে, 'আচ্ছে দিন' প্রায় নাকি এসেই গেছে ⁴ । 
কিন্তু গত দুবছরে দেশ জোড়া 'নন পারফর্মিং অ্যাসেট'র রেকর্ড মাত্রায় উল্লম্ফনের পরেও, সদ্য পাশ হওয়া ফিন্যান্স বিলে শুল্ক ও রাজস্ব আদায়, কর কাঠামো সংক্রান্ত নীতি পরিবর্তন করে অনাদায়ী এই বিপুল ঋণ আদায়ের বিষয়ে কোনও চেষ্টাই করেনি কেন্দ্রীয় সরকার। বরং রাজ্যসভা কে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে, ঐ ফিন্যান্স বিলেই ৪০ খানা সংশোধনী এনে আধার কার্ড ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।  
সেই আধার কার্ড, যে আধার কার্ড সম্পর্কে ২০১৫'র অক্টোবরে সুপ্রিম কোর্টের পাঁচ বিচারপতির বেঞ্চ বলেছিল "সরকারি পরিষেবা প্রদানের ক্ষেত্রে আধার কার্ড কোনোভাবেই বাধ্যতামূলক করা যায় না" ⁵ । সেই আধার কার্ড, যে আধার কার্ড সম্পর্কে ২০১০'এ বি.জে.পি সাংসদ যশবন্ত সিনহা'র নেতৃত্বাধীন "স্ট্যান্ডিং কমিটি অফ ফিন্যান্স " ৪৮ পাতার রিপোর্টে লিখেছিল, "আধার প্রচলন অপ্রয়োজনীয় এবং উদ্দেশ্যহীন" ⁶ । সেই আধার কার্ড, যে আধার কার্ড সম্পর্কে নরেন্দ্র মোদী ২০১৪'র ৮'ই এপ্রিল টুইটে করেছিলেন, "আধার দেশের নিরাপত্তার পক্ষে বিপজ্জনক। এটি অপরিণামদর্শী সরকারের একটি পলিটিক্যাল গিমিক" ⁷ ।
আধারের বায়োমেট্রিক এবং রেটিনা স্ক্যানের ডেটা সংগ্রহ করার বরাত আয়ারল্যান্ডের এসেনচার আর ফ্রান্সের মরফো সংস্থার ⁵  ⁸। এই দুই সংস্থাই আবার বিভিন্ন বিদেশী সরকারের গোয়েন্দা বিভাগের উপদেষ্টা হিসেবেও নিযুক্ত। কেন্দ্রীয় সরকার কি নিশ্চিত করে বলতে পারে যে, অন্য দেশের গোয়েন্দা বিভাগের সাথে ডেটা বিনিময়ের মাধ্যমে এই বেসরকারি সংস্থাগুলি দেশের নিরাপত্তার সঙ্গে আপোষ করবে না? আধারের ডেটাবেস তত্ত্ববধান করে যে 'ন্যাশনাল ইনফরমেশন ইউটিলিটিস' তার ৫১% স্বত্ব বেসরকারি সংস্থার  ⁹। কেন্দ্রীয় সরকার কি নিশ্চিত করে বলতে পারে যে এই ডেটাবেস, বেসরকারি ঐ 'প্রফিট মেকিং' সংস্থা গর্হিত কোন কাজে ব্যবহার করবে না? কেন্দ্রীয় সরকার কি নিশ্চিত করে বলতে পারে আমি সরকারি বিরোধী অবস্থান নিলে আমারই 'পার্সোনাল এবং সেনসিটিভ' এই ডেটা  আমারই বিরুদ্ধে নজরদারি করতে ব্যবহার হবে না? যদি না পারে, তাহলে হঠাৎ কি এমন হল যে দুদিন আগের 'পলিটিক্যাল গিমিক' আজ 'অ্যাবসুলুট নেসেসিটি' তে বদলে গেলো? হঠাৎ কি হল যে রাজ্যসভা কে বাইপাস করে, নূন্যতম সাংবিধানিক সৌজন্য ছাড়াই রাতারাতি আধার বাধ্যতামূলক করতে হল ¹⁰ ? 
আপনার বাথরুমের পাশে হয়ত স্টার-জলসা। আর জীবন মানেই জি-বাংলা। 'ডার্টি পলিটিক্স' দেখলেই আপনি হয়ত রুমাল দিয়ে নাক চাপেন। বেসিক্যালি আপনি হয়ত 'অ্যাপলিটিক্যাল'। আপনার মনে হতেই পারে যে তিন তালাক আর অ্যান্টি রোমিও স্কোয়াডের চ্যাংড়ামিতে'ই আমার কি এসে গেলো? লক্ষ্ণৌর গালটি কাবাব বন্ধ হলে আমার সরষে ইলিশের বয়েই গেলো? কিন্তু এই যে আপনার আলোচনার পরিসরটা ক্রমশ  হিন্দু-মুসলিম-শিখ-ক্রিশ্চানে ভরে যাচ্ছে, এই যে চায়ের আড্ডা গুলো সব গরু-শুকর-গোবর-ঘুঁটে নিয়ে ব্যস্ত থাকছে, অফিসের টেবিলে টিকি-দাড়ি-হিজাব-ঘোমটা নিয়ে বিতর্কের ঝড় উঠছে, ঠিক সেই সুযোগেই আপনার নির্বাচিত সরকার আধার বাধ্যতামূলক করে আপনারই নিরাপত্তা বিকিয়ে দিচ্ছে, আপনারই বেডরুমে উঁকি মারতে পৃথিবীর বৃহত্তম 'সার্ভেলেন্স' ব্যবস্থা গড়ে তোলার ভিত খুঁড়ছে, আপনারই কষ্টার্জিত উপার্জন থেকে দেওয়া বড়লোক'দের অনাদায়ী ঋণ মকুবের ব্যবস্থা করছে; এসব কাকতালীয় নয়। একেবারেই নয়। বরং সুপরিকল্পিত। দেয়ার ইস অলওয়েজ অ্যা মেথড ইন ম্যাডনেস। অলওয়েজ…











কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন