শুক্রবার, ১২ ডিসেম্বর, ২০২৫

ভারতমাতা ও তার জন্ম ~ অরিজিত মুখার্জী




শিক্ষিত উঁচু জাতের বাঙালি ভদ্রলোকের হাতে ভারতমাতার জন্মের এই গল্পটা অনেকদিন ধরেই লেখার ইচ্ছে ছিল। অনেক টালবাহানার পর লিখেই ফেললাম, কারণ আজকের দিনে এই ন্যারেটিভটা জানা জরুরী। অবশ্যই মৌলিক কিছু নয়, মূলতঃ তনিকা সরকার, সুমিত সরকার, পার্থ চট্টোপাধ্যায়, আশিস নন্দী, মৃণালিনী সিনহা — এরকম বেশ কিছু স্কলারের লেখা পরার পর একটা সাধারণ ভাষায় সিন্থেসিস। আমি ইতিহাসের ছাত্র নই, মানে এই বিষয়ে ফর্মাল কোনো ট্রেনিং নেই। নিজের ইচ্ছেতে কিছু বই পড়ি। পরিচিত লোকজনের সঙ্গে আলোচনা করে বোঝার চেষ্টা করি। এই লেখাটা সেইরকমই। ভুল থাকাই বরং স্বাভাবিক। তাই, যাঁরা ইতিহাসের ছাত্র, তাঁরা শুধরে দিলে উপকৃতই হব।

গল্পটা ঊনবিংশ শতকের আলোকপ্রাপ্ত বাঙালি ভদ্রলোক সমাজকে নিয়ে — যাঁরা সাধারণভাবে শিক্ষিত আর অবশ্যই উঁচু জাতের। গল্পের ক্লাইম্যাক্স ঊনবিংশ শতকের শেষার্ধে, যে সময়ে নানান কারণে তাঁরা খানিকটা অস্বস্তিকর জমির ওপরে দাঁড়িয়ে। কলোনিয়াল ইতিহাসের গবেষকরা মনে করেন এই জমি থেকেই জন্ম নিয়েছিল হিন্দু পুনরুত্থান বা রিভাইভালিজমের আইডিয়া, যার ফাইনাল আউটকাম হয়ে ওঠে একটা ভৌগলিক অঞ্চলকে দেবীর রূপে দেখতে শুরু করা। ঐতিহাসিকভাবে যে কথাটা মনে রাখা দরকার, সেটা হল এই মাতৃমূর্তির জন্ম পুরাণকথা থেকে হয়নি, কারণ ভারত অ্যাজ আ স্টেট/রাষ্ট্র কনসেপ্টটা ব্রিটিশ আমলের। আজকের নেশন-স্টেটের আইডিয়ার মতনই এই দেবীপ্রতিমার আইডিয়াও কাজেই আদপেই "টাইমলেস' নয়, বরং এর জন্ম হয়েছিল ঊনবিংশ শতকের বাংলার কঠিন বাস্তবের মধ্যে। একের পর এক ধাক্কায় — সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক — আইডেন্টটি ক্রাইসিসে ভোগা ভদ্রলোক বাঙালি তখন ক্ষতবিক্ষত। সেই অবস্থার মধ্যে জাতীয়তাবাদী ইন্টেলেকচুয়ালরা একটা আধ্যাত্মিক স্ফিয়ার তৈরী করে নিয়েছিলেন — খানিকটা স্যাংচুয়ারি বলা যায় — ঘরবাড়ি সংসার, বাড়ির মেয়েরা, আর পরিবার — যে স্যাংচুয়ারিতে কলোনিয়াল শাসকের কর্তৃত্ব থাকবে না, সেই অধিকার থাকবে শুধু পরিবারের কর্তা বাঙালি ভদ্রলোকের হাতেই। এই ছিল ব্যাকড্রপ। এই আবহেই জন্ম হয় "দেশমাতৃকা'-র, বলা যায় বঙ্কিমচন্দ্রের হাতেই, এবং অচিরেই এই মাতৃমূর্তি ভারতের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের আইকন "ভারতমাতা" হয়ে ওঠে। 

একটা ক্রনোলজিকাল অর্ডারে এই ঘটনাগুলো পর পর সাজাতে পারলে আমরা সেই সময়ের ছবিটা খুঁজে পাব। 

এই পিরিয়ডটাকে জানতে হলে আমাদের শুরু করতে হবে ১৭৯৩ সালের পার্মানেন্ট সেটলমেন্ট অ্যাক্ট, অর্থাৎ চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের আইন থেকে। অভিজাত হিন্দু বাঙালি ভদ্রলোক শ্রেণী, বা ল্যান্ডহোল্ডিং ক্লাস — আমাদের গল্পের এক চরিত্র — এর জন্মও এই আইনের পরেই। এই আইন অনুযায়ী ল্যান্ডহোল্ডিং ভদ্রলোক জমিদারেরা কোম্পানি বাহাদুরকে দেওয়া পূর্বনির্ধারিত খাজনার বিনিময়ে পাকাপাকিভাবে তাদের এস্টেটের মালিক পরিচিতি পেয়ে যায়, পেয়ে যায় রায়তদের ওপর যেমন খুশী খাজনা চাপানোর স্বাধীনতা। বেসিক্যালি পরজীবী বা প্যারাসাইট বলতেই পারেন এই ক্লাসকে — কারণ এদের বেঁচে থাকা ছিল অন্যের পরিশ্রমের ফসলের ওপর নির্ভরশীল, আর একই সঙ্গে তাদের স্ট্যাটাসও পুরোপুরি নির্ভরশীল ছিল কলোনিয়াল শক্তির ওপর। উল্টোদিকে, এই ভদ্রলোক শ্রেণী আবার নিজেদের অধিকার আর আধিপত্যের ব্যাপারে ছিল মারাত্মক পজেসিভ। এই শ্রেণীরই একটা অংশের অ্যাম্বিশনও ছিল জমিদারির বাইরেও কলোনিয়াল শাসকের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার। ১৮০০ শতকের শুরুর দিকে নানান ধরণের ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে, যেমন জাহাজ বা ব্যাংকিং ইত্যাদিতে বাঙালি ভদ্রলোক ভালোই পরিচিতি পেয়েছিল — দ্বারকানাথ, রামদুলাল দে (মানে ছাতুবাবু-লাটুবাবুর বাবা) ইত্যাদি নাম ইতিহাসে পড়ে থাকবেন। তবে ওপর ওপর আশাব্যঞ্জক হলেও খানিক অনিশ্চয়তাও ছিল সেই যুগের এই অন্ত্রপ্রনরশিপে।

অভিজাত ভদ্রলোক বাঙালির ব্যবসায়িক আশাভঙ্গ হয় ১৮৪০ নাগাদ, যখন একাধিক অর্থনৈতিক অস্থিরতা এসে একের পর এক ধাক্কা মারতে শুরু করে। একাধিক ইউরোপীয় ব্যাংকিং সংস্থা, যেমন ইউনিয়ন ব্যাঙ্ক বন্ধ হয়ে যায়। এই ব্যাঙ্কগুলোর আমানতে থাকা বাঙালি ক্যাপিটাল পুরোপুরি মুছে যায় বাজার থেকে। কোম্পানি সরকার এই ক্রাইসিসের সময়ে ক্লাসিক রেসিজমের ডেফিনেশন মেনে সাদা চামড়ার ইউরোপীয় ইনভেস্টরদের স্বার্থ দেখায় মন দেয়। বাঙালি তথা ভারতীয় ইনভেস্টরদের কাছে একটা স্পষ্ট বার্তা পৌঁছয় — যে আধুনিক পুঁজিবাদী ভবিষ্যতের দরজা দেশীয় পুঁজিপতিদের জন্যে বন্ধ। ওসব সাহেবদের খেলার মাঠ, নেটিভ বাঙালির সেখানে জায়গা নেই। বাঙালি ল্যান্ডহোল্ডিং ভদ্রলোক আচমকা ধাক্কা খেয়ে পিছু হটে আসে আর তার সেফ জোন, অর্থাৎ জমিজমা সম্পত্তির মধ্যে গুটিয়ে যায়। সম্ভাব্য অন্ত্রপ্রনর থেকে বাঙালি ভদ্রলোক হয়ে যায় পুরোদস্তুর ভূস্বামী। তাদের পুঁজি সীমাবদ্ধ থেকে যায় খাজনা বা রেন্টের মধ্যেই। ইউরোপীয়দের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার স্বপ্ন দেখা বাঙালি ভদ্রলোক অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে হয়ে ওঠে অন্তর্মুখী।

অর্থনৈতিক পরিসর ছোট হয়ে আসার পাশাপাশি ঊনবিংশ শতকের প্রথম ভাগে আরও দুটো বড় ধাক্কা খায় এই রক্ষণশীল হিন্দু বাঙালি ভদ্রলোক। এবং এই দুটোকেই সে দ্যাখে তার নিজের সনাতনী সাংস্কৃতিক এবং গার্হস্থ্য জীবনের সার্বভৌমত্বের ওপর আঘাত হিসেবে। প্রথম ঘটনা ১৮২৯ সালে সতীদাহ প্রথা রদের আইন এবং দ্বিতীয় ঘটনা ১৮৫৬ সালের বিধবাবিবাহ আইন। রেনেসাঁর সময় থেকে মুক্তচিন্তায় শিক্ষিত এক শ্রেণীর বাঙালি এই দুই আইনকে প্রয়োজনীয় সামাজিক সংস্কার হিসেবে দেখলেও সংখ্যাগরিষ্ঠ সনাতনী হিন্দু বাঙালির কাছে এই দুটো আইন ছিল পবিত্র ধর্মীয় আচারের মূলে অযাচিত কলোনিয়াল/বিদেশী আক্রমণ। তার কারণটাও সহজবোধ্য। হিন্দু পুরুষের চিরকালীন কনসেপ্ট ছিল স্ত্রীসুলভ ভক্তি, বংশগৌরব আর বিয়ের অলঙ্ঘনীয় পবিত্রতা। সতীদাহ রদ আর বিধবাবিবাহ — দুটোই সেই চিরকালীন সনাতনী হিন্দু পৌরুষের ধারণার ওপর আক্রমণ। হিন্দু বাঙালি ভদ্রলোকের অন্দরমহলে পুরুষই ছিল সর্বময় কর্তা, তার হাতেই যেখানে নিয়ন্ত্রিত হত লিঙ্গ, জাতি আর ধর্মের সমস্ত আচার, পুরুষই ছিল পারিবারিক পবিত্রতার রক্ষক। সেই অন্দরমহলের ভিতরে কলোনিয়াল আইনের ঢুকে পড়ার ধাক্কা সমস্ত সনাতনী ধ্যানধারণাকে নাড়িয়ে দিয়েছিল সেই সময়ে। রামমোহন এবং বিদ্যাসাগর সেই যুগের ভদ্রলোক বাঙালির কাছে হয়ে ওঠেন ভিলেন।

[এবং আজও এর অন্যথা হয় না। উত্তর ভারতীয় সনাতনী হিন্দুর ডেফিনেশনে আজও স্ত্রীকে মুখ বুজে স্বামীর হুকুম মানতে হয়। আজও রক্তের শুদ্ধতা সনাতনী হিন্দুর কাছে জরুরী। এবং আজও অগ্নিসাক্ষী করে বিয়ে করা মানে অলঙ্ঘনীয় জন্মজন্মান্তরের সম্পর্ক। বেশ কয়েক দশক আমরা কিছুটা স্বাধীনভাবে ভাবতে শুরু করেছিলাম। কিন্তু উত্তর ভারতীয় সনাতনী হিন্দুত্বের ছোঁয়ায় নতুন করে সনাতনী হয়ে ওঠা সেদিনের সনাতনী হিন্দু বাঙালির বংশধর আধুনিক বাঙালির মধ্যে যদি আপনি রামমোহন বা বিদ্যাসাগর সম্পর্কে একই ঘৃণার আভাস পান, তাহলে বুঝব এই লেখার উদ্দেশ্য সফল।]

১৮৫৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহের পর কোম্পানির হাত থেকে ক্ষমতা চলে যায় ব্রিটিশ সরকারের হাতে। ইংরিজী শিক্ষায় শিক্ষিত বাঙালি মধ্যবিত্ত ভদ্রলোক তখন বিভিন্ন সরকারি অফিসে চাকরি করে। তার পরিচিতি "বাবু" হিসেবে। সে সাহেবের অনুগত কর্মচারী (যে আনুগত্য খানিকটা ১৮৫৭ সালের ব্যর্থ বিদ্রোহের ফসল), তাকে ছাড়া সাহেবের একটা দিনও চলে না। মোটামুটি এই শতকের মাঝামাঝি সময়ে সরকারি দপ্তর আর সওদাগরি অফিসে চালু হয় ঘড়ির ব্যবহার — ইউরোপীয় স্টাইলে ক্লক টাইম। বাবুর চাকরি বাঁধা পড়ে ঘড়ির নিয়মানুবর্তিতায় — দশটা পাঁচটার অফিসের বাঁধনে — বাঙালি বাবুর কাছে যেটা ছিল পুরোপুরি এলিয়েন একটা ব্যবস্থা। দুই দশকের মধ্যেই সাহেবের অনুগত কর্মচারীর কাছে রোজকার এই সাবর্ডিনেশন আর ঘন্টা মিনিটের চাপ ক্রমশ: দাসত্বের মত মনে হতে থাকে। অফিসের বাইরে বাড়িই তার নিরাপদ স্যাংচুয়ারি হয়ে ওঠে, যেখানে সে কোলাহলহীন ব্যক্তিগত ধার্মিক চিন্তাভাবনার সময় পায় — মধ্যবিত্ত বাঙালির কাছে যা তার ফাঁপা দাসত্বের একদম উলটো পিঠ। দাসত্বের চাপ মধ্যবিত্ত ভদ্রলোকের কাছে বোঝা হয়ে উঠতে শুরু করে।

এই সময়েই আসে ভূমিকম্প (অবশ্যই প্রতীকী অর্থে)। যে জমি ছিল অভিজাত ল্যান্ডেড ক্লাসের মূলধন বা আশ্রয়, সেই জমিই ভয়ানকভাবে কেঁপে ওঠে তাদের পায়ের নীচে — ১৮৭৩ সালে পাবনার রায়তি দাঙ্গার সময়ে। প্রধাণতঃ মুসলমান এবং নীচু জাতের হিন্দু রায়তরা বাড়তে থাকা খাজনা আর জমিদারি অত্যাচারের বিরুদ্ধে সংগঠিতভাবে রুখে দাঁড়ায়। রাতারাতি মুখ থুবড়ে পড়ে ভদ্রলোক জমিদারের শাসনের পিতৃতান্ত্রিক জাস্টিফিকেশন। দাঙ্গা বা বিদ্রোহের ধাক্কা তো ছিলই, কিন্তু তার চেয়েও ভদ্রলোক জমিদারদের কাছে বড় ধাক্কা ছিল কলোনিয়াল শাসকের প্রতিক্রিয়া — অনুগত জমিদারদের প্রতি নয়, বরং রায়তদের প্রতি সরকারি সহানুভূতি, খাজনার অবস্থা যাচাই করার উদ্দেশ্যে রেন্ট কমিশন তৈরী আর প্রজার অধিকার সংক্রান্ত আলোচনার শুরু। হিন্দু বাঙালি ভদ্রলোক নিজেদের দুই দিক থেকে আক্রান্ত মনে করতে শুরু করে — একদিকে তাদের এতদিনের প্রজাদের ঔদ্ধত্য বা ইনসাবর্ডিনেশন, অন্যদিকে সরকার তরফ থেকে তাদের আনুগত্যের পুরস্কার হিসেবে পাওয়া বিশ্বাসঘাতকতা। সেই সময়ের বাংলা কাগজে জমিদারি সম্পত্তির ক্ষতির পাশাপাশি ফলাও করে "নীচুজাতের অপমান"-এর কথাও ছাপা হতে থাকে। লেখা হয় "নারীর অবমাননা" বা "সতীত্ব লঙ্ঘন"-এর কথাও। জমিদারি অত্যাচারের বিরুদ্ধে অপবিত্র ছোটজাত আর মুসলমানদের রুখে দাঁড়ানোর এই ঘটনা অভিজাত মধ্যবিত্ত নির্বিশেষে বাঙালি ভদ্রলোক সমাজে হয়ে দাঁড়ায় কালচারাল এবং সেক্সুয়াল পলিউশন — হিন্দু সম্প্রদায়ের অন্তঃপুরের ক্ষেত্রে যেটা চরমতম অপমান। 

ফাইনাল ধাক্কাটা আসে ১৮৮৩ সালে — ইলবার্ট বিলের সময়ে। ব্রিটিশ সরকার একটা আইন আনার চেষ্টা করে যার ফলে ভারতীয় (অর্থাৎ কালো চামড়ার নেটিভ) ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে ইউরোপীয়দের বিচার হতে পারে। খুবই সাধারণ একটা মানবিক আইন — বিচারব্যবস্থায় একটা সমতা আনার উদ্দেশ্যে। কিন্তু এই প্রস্তাবিত আইনের বিরুদ্ধে ব্রিটিশ সম্প্রদায়ের প্রতিক্রিয়া ব্রিটিশ রাজের চরম জাতিবিদ্বেষকে একদম উলঙ্গ করে দেয় সকলের চোখের সামনে। সরকার এই জাতিবিদ্বেষের সামনে আত্মসমর্পণ করে এবং প্রমাণ করে দেয় যে পশ্চিমী শিক্ষা বা আনুগত্য কোন কিছুতেই কালো চামড়ার ভদ্রলোক "বাবু' ব্রিটিশদের সমকক্ষ হয়ে উঠতে পারবে না; সামাজিক এবং রাজনৈতিকভাবে এই শিক্ষিত হিন্দু ভদ্রলোক শ্রেণী চিরকালই সাদা চামড়ার সাহেবের পায়ের নীচেই থাকবে, অফিস কাছারিতে দশটা পাঁচটার দাসত্ব করবে — ব্লাডি নেটিভ হিসেবে।

১৭৯৩ থেকে ১৮৯০ — এই একশো বছরের মধ্যে অর্থনৈতিক, সামাজিক, কৃষি এবং রাজনৈতিক ক্ষেত্রে একের পর এক ধাক্কা খাওয়ার পর একমাত্র একটাই জায়গা হিন্দু ভদ্রলোক বাঙালির কর্তৃত্বের আওতায় থেকে গিয়েছিল — আর সেটা হল অন্দরমহলের নারীশরীরের ওপর নিয়ন্ত্রণ। শিশু বয়সে বিয়ে, এবং দশ বছর বয়সে রজঃস্বলা হওয়ার সঙ্গেসঙ্গেই গর্ভাধানের জন্যে জোর করে শ্বশুরবাড়ি পাঠিয়ে দেওয়ার আচারের ফলে একাধিক ১০-১২-১৪ বছরের বাচ্চা মেয়ে জবরদস্তি শারীরিক সঙ্গমের ফলে মারা যায়। আদালতে বেশ কিছু মামলা ওঠার পরে ব্রিটিশ সরকারের টনক নড়ে, এবং ১৮৯১ সালে স্বাস্থ্যসংক্রান্ত কারণ দেখিয়ে তারা এজ অফ কনসেন্ট বিলের প্রস্তাব আনে বিয়ের বয়স দশ থেকে বাড়িয়ে বারো করার জন্যে। প্রস্তাব আসার সঙ্গে সঙ্গেই সর্বগ্রাসী প্রতিরোধ শুরু হয় সমাজের চতুর্দিক থেকে। হিন্দু বাঙালি মনে করে মেয়েদের বিয়ের বয়স দুই বছর বাড়ানোর এই প্রস্তাব মোটেও স্বাস্থ্যসংক্রান্ত কারণে নয়, বরং হিন্দু আচারব্যবস্থার ওপর চরম আঘাত যার ফলে মেয়েদের গর্ভ কলুষিত হবে, বংশধারা দূষিত হবে, এবং সবচেয়ে বড় কথা, এর ফলে পতন হবে বাঙালি হিন্দু ভদ্রলোকের শেষ দুর্গ, অর্থাৎ নারীশরীরকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতার। নারীশরীরকে নিয়ন্ত্রণের এই অধিকার রক্ষাই হয়ে ওঠে চারপাশ থেকে আক্রান্ত হিন্দুধর্মকে রক্ষা করার সমান।

[হিন্দু খতরে মে হ্যায় – এনিওয়ান?]

রেনেসাঁর আলোকপ্রাপ্ত বাঙালির প্রগতিশীল রিফর্মার থেকে হিন্দু রিভাইভালিস্ট হয়ে ওঠার গতিপথের ধারণা সবচেয়ে ভালোভাবে বোঝা যায় যদি আমরা বঙ্কিমের লেখা খুঁটিয়ে দেখি। বঙ্কিমের পরিবর্তনও ঊনবিংশ শতকের এই ক্রাইসিসগুলোর মধ্যে দিয়েই এসেছিল। লেখকজীবনের একদম শুরুর দিকে বঙ্কিম ছিলেন ক্ষুরধার সমালোচক — বিশেষ করে নানান পিতৃতান্ত্রিক এবং ব্রাহ্মণ্যবাদী ট্র্যাডিশনের। যেমন ধরুন "সাম্য" (যদিও পরের দিকে বঙ্কিম নিজে এই রচনাকে প্র্যাক্টিকালি অস্বীকার করেন) রচনায় বঙ্কিম এই ব্রাহ্মণ্যবাদী এবং পিতৃতান্ত্রিক আচারব্যবস্থাকে কলোনিয়াল শাসনের চেয়েও খারাপ বলে অভিহিত করেছিলেন। কপালকুণ্ডলায় নায়িকার মুখে শোনা যায় — "যদি জানিতাম যে, স্ত্রীলোকের বিবাহ দাসীত্ব, তবে কদাপি বিবাহ করিতাম না"। বা "বিষবৃক্ষ" উপন্যাসে পুরুষের বহুগামিতা এবং কামনা, ব্রাহ্মণ্যবাদের নানান আচারের মধ্যে মেয়েদের দমবন্ধ করা অবস্থার সরাসরি সমালোচনা পাওয়া যায়। এই পিরিয়ডে বঙ্কিম পশ্চিমী ধ্যানধারণার আদলেই সামাজিক গোঁড়ামোকে আঘাত করেছিলেন। ব্যাঙ্গ করেছিলেন ইংরিজী চালচলনের নকলকারী বাবুদেরও। আবার, বঙ্কিমের ধারণা যে খানিক ফ্র্যাকচার্ড ছিল, তারও প্রমাণ পাওয়া যায় ১৮৭৫ সালে লেখা কমলাকান্তে যেখানে তিনি স্বামীর সঙ্গে সহমরণে যাওয়া নারীর মধ্যে স্ত্রীলোকের আসল রূপ কল্পনা করেন — 

"যখন আমি উৎকৃষ্টা, যোষিদ্বর্গের বিষয়ে চিন্তা করিতে যাই, তখনই আমার মানস—পটে, সহমরণপ্রবৃত্তা সতীর মূর্ত্তি জাগিয়া উঠে। আমি দেখিতে পাই যে, চিতা জ্বলিতেছে, পতির পদ সাদরে বক্ষে ধারণ করিয়া প্রজ্বলিত হুতাশন মধ্যে সাধ্বী বসিয়া আছেন। আস্তে আস্তে বহ্নি বিস্ত‌ৃত হইতেছে, এক অঙ্গ দগ্ধ করিয়া অপর অঙ্গে প্রবেশ করিতেছে। অগ্নিদগ্ধা স্বামিচরণ ধ্যান করিতেছেন, মধ্যে মধ্যে হরিবোল বলিতে বলিতেছেন বা সঙ্কেত করিতেছেন। দৈহিক ক্লেশ-পরিচায়ক লক্ষণ নাই। আনন প্রফুল্ল। ক্রমে পাবকশিখা বাড়িল, জীবন ছাড়িল, কায়া ভস্মীভূত হইল। ধন্য সহিষ্ণুতা! ধন্য প্রীতি! ধন্য ভক্তি! [স্ত্রীলোকের রূপ, কমলাকান্ত]"

কিন্তু ওই পাবনা রায়ট, ইলবার্ট বিল এবং এজ অফ কনসেন্ট বিল নিয়ে কূটকচালির সময় থেকেই বঙ্কিমের বদলের ট্র্যাজেক্টরিটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে, বিশেষ করে রেভারেন্ড হেস্টির সঙ্গে ১৮৮২ সালের একটা বিতর্কের পর থেকেই। রেভারেন্ড হেস্টি (স্কটিশ থিওলজিয়ান এবং স্কটিশ চার্চ কলেজের তৎকালীন প্রিন্সিপাল) সনাতনী হিন্দু ধ্যানধারণাকে আক্রমণ করেছিলেন ব্যাকওয়ার্ড বলে (কলকাতার অ্যালবার্ট হলে ক্রিশ্চানিটি অ্যান্ড কমন সেন্স অফ ম্যানকাইন্ড বলে একটা পাবলিক লেকচার সিরিজে) — মূলতঃ মূর্তিপূজা, এথিকস (যেখানে কৃষ্ণের লীলাপ্রসঙ্গ উঠে আসে) এবং র‍্যাশনালিটি নিয়ে। বঙ্কিম সম্পর্কে অভিযোগ করেন যে তিনি পাশ্চাত্য চিন্তাভাবনা থেকে সিলেক্টিভলি কিছু কিছু জিনিস বেছে নিয়েছেন, এবং হিপোক্রিটের মত হিন্দুধর্মকে ডিফেন্ড করেছেন। ঊনবিংশ শতকের শেষের দিকে বাংলার শিক্ষিত ভদ্রলোক সমাজের সার্বিক অসহায়তার অনুভূতি থেকেই বঙ্কিমের মধ্যেও বদল আসতে শুরু করে। হেস্টির আক্রমণের জবাবে বঙ্কিম বঙ্গদর্শনে একাধিক প্রবন্ধ প্রকাশ করেন, এবং এই বিতর্কের পর থেকেই হিন্দু রিভাইভালিজমের ছাপ দেখতে পাওয়া যায় বঙ্কিমের পরবর্তী রচনাগুলোতে — যেমন কৃষ্ণচরিত্র, ধর্মতত্ত্ব ইত্যাদি। 

বঙ্কিম তাঁর আগের প্রগতিশীল রচনাগুলোকে অস্বীকার করতে শুরু করেন (সাম্য ফর এগজাম্পল), পাশাপাশি গড়তে শুরু করেন জাতীয়তাবাদের একটা নতুন ছবি, যেখানে দেশপ্রেম একই সঙ্গে মিলিট্যান্ট এবং ভক্তিমূলক।

জন্ম হয় দেশমাতৃকার আইডিয়ার — ১৮৮২ সালে আনন্দমঠের মধ্যে দিয়ে। কলমের আঁচড়ে বঙ্কিম সংঘাতের কেন্দ্রে থাকা এই পবিত্র, বিপন্ন, আদর্শ হিন্দু নারীসত্ত্বাকে রূপান্তরিত করলেন এক দেবী চরিত্রে। আঁকলেন পূর্বের গৌরবের ছবি (মা যাহা ছিলেন — সুজলা সুফলা শস্যশ্যামলা), ১৭৭০ সালের দুর্ভিক্ষের আবহে আঁকলেন কালরূপিণী এক নারীকে (মা যাহা হইয়াছেন — অত্যাচারী শাসকের হাতে দেশ যখন শোষিত, দরিদ্র, এবং মৃতপ্রায়), এবং কোন এক ভবিষ্যতে বিদেশী শাসনের অবসানের পর বাংলাপ্রদেশের আইকন — দেবী দুর্গা (মা যাহা হইবেন — দশপ্রহরণধারিণী)। এই মাতৃরূপিণীর দেহ হয়ে উঠল গোটা জাতির মানচিত্র — পবিত্র এবং অলঙ্ঘনীয়, যে কোন কলোনিয়াল আইন বা জমির খাজনার আন্দোলন থেকে বহু দূরের এক সত্ত্বা। 

এই মাতৃমূর্তি বা ডিভাইন মাদার, বাঙালি ভদ্রলোকের এতদিনের অপমানের জবাব দেওয়ার এক রাস্তা খুলে দিল। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে, আদালতে, বা অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে পুরুষত্বহীন "বাবু' নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করল এই দেশমাতৃকার একনিষ্ঠ সন্তান এবং রক্ষক হিসেবে। তাঁর রাজনৈতিক অক্ষমতা বদলে গেল পবিত্র সামরিক কর্তব্যে। তাঁর আহত পৌরুষের নিরাময় হল বীরের আত্মত্যাগের প্রতিশ্রুতিতে। নানান জটিল সামাজিক সংস্কার আর বিভিন্ন বিষয়ে সরকারের কাছে পিটিশন দিয়ে আপোস করার বদলে জাতীয়তাবাদ হয়ে উঠল আবেগ আর ভক্তির মিশেলের পবিত্র ধর্মযুদ্ধ।

এই ছিল দেশমাতৃকার জন্মের ঐতিহাসিক পটভূমি — অনেকদিন ধরে চলে আসা ক্রাইসিসের মধ্যে থেকে তৈরী হওয়া বিপন্ন মাতৃমূর্তি, যাকে যে কোন মূল্যে রক্ষা করা মায়ের যে কোন সন্তানের কর্তব্য। 

এই অবধি কোন গোল নেই, সাধারণভাবে গোটা ব্যাকগ্রাউন্ডটা খানিক জটিল হলেও। শুধু প্রশ্ন থেকে যায় বঙ্কিমের এই দেশমাতৃকা কবে এবং কীভাবে ভারতমাতা হয়ে উঠলেন?

বঙ্কিমের মূল উপন্যাসের দিকে যদি তাকাই, দেখব আনন্দমঠে সন্তানদের মূলশত্রু মুসলমান নবাব এবং অষ্টাদশ শতকের শেষের দিকের দুর্নীতিগ্রস্ত ক্ষয়িষ্ণু মুঘল প্রশাসন। আনন্দমঠের শেষাংশে ব্রিটিশ শত্রু তো নয়ই, বরং শান্তি, শৃঙ্খলা ও ন্যায়ের শাসনের প্রবর্তক — সত্যানন্দ ও চিকিৎসক/মহাপুরুষের মধ্যে বাক্যালাপ মনে করুন...তাহলে, স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে যে এই ব্রিটিশপন্থী, মুসলিমবিরোধী আখ্যান কীভাবে উপনিবেশ—বিরোধী জাতীয়তাবাদের বাইবেল হয়ে উঠল?
আনন্দমঠ, দেশমাতৃকা আর বন্দেমাতরমের এই ট্রান্সফর্মেশন ঘটেছিল জাতীয়তাবাদের স্ট্র্যাটেজিক কারণে। বঙ্কিম নিজে ১৮৮০-র দশকে বসে ১৭৭০ সালের সন্ন্যাসী বিদ্রোহের পটভূমিতে আনন্দমঠ লিখেছিলেন। তাঁর প্রজন্মের কাছে ব্রিটিশ শাসন সম্পর্কে একটা কমপ্লিকেটেড ও খানিক মোহভঙ্গের দৃষ্টিভঙ্গি থাকলেও আশাবাদ পুরোপুরি শেষ হয়ে যায়নি। সেই প্রজন্ম ব্রিটিশ শাসনকে হিন্দু অনৈক্য এবং দুর্বলতার সাজা হিসেবে দেখেছিল, আর ব্রিটিশ শাসককে দেখেছিল আধুনিকতা, বিজ্ঞানমনস্কতা ও যুক্তিবাদের শিক্ষা দেওয়া স্কুলমাস্টার হিসেবে —  যাদের শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে ভারতীয় হিন্দুরা একদিন স্বশাসনের যোগ্য হয়ে উঠতে পারে। 

"সনাতনধর্মের পুনরুদ্ধার করিতে গেলে, আগে বহির্বিষয়ক জ্ঞানের প্রচার করা আবশ্যক। এখন এদেশে বহির্বিষয়ক জ্ঞান নাই — শিখায় এমন লোক নাই; আমরা লোকশিক্ষায় পটু নহি। অতএব ভিন্ন দেশ হইতে বহির্বিষয়ক জ্ঞান আনিতে হইবে। ইংরেজ বহির্বিষয়ক জ্ঞানে অতি সুপণ্ডিত, লোকশিক্ষায় বড় সুপটু। সুতরাং ইংরেজকে রাজা করিব। ইংরেজী শিক্ষায় এদেশীয় লোক বহিস্তত্ত্বে সুশিক্ষিত হইয়া অন্তস্তত্ত্ব বুঝিতে সক্ষম হইবে। তখন সনাতনধর্ম প্রচারের আর বিঘ্ন থাকিবে না। তখন প্রকৃত ধর্ম আপনা আপনি পুনরুদ্দীপ্ত হইবে। যত দিন না তা হয়, যত দিন না হিন্দু আবার জ্ঞানবান গুণবান আর বলবান হয়, তত দিন ইংরেজরাজ্য অক্ষয় থাকিবে। ইংরেজরাজ্যে প্রজা সুখী হইবে — নিষ্কণ্টকে ধর্মাচরণ করিবে। অতএব হে বুদ্ধিমান — ইংরেজের সঙ্গে যুদ্ধে নিরস্ত হইয়া আমার অনুসরণ কর।" [আনন্দমঠ]

বঙ্কিমের এক প্রজন্ম পরে, ১৯০৫ সালে স্বদেশী আন্দোলনের সময়, রাজনৈতিক আবহাওয়া ক্রমশঃ আরও উগ্র হয়ে ওঠে। দুর্ভিক্ষ, জাতিবিদ্বেষ, আর বঙ্গভঙ্গের পরে সাধারণ মানুষের ব্রিটিশ শাসন সম্পর্কে হতাশ হতে শুরু করে। অরবিন্দ ঘোষের মত বিপ্লবীরা মনে করতে শুরু করেন যে তাঁদের গণআন্দোলনের জন্যে প্রয়োজন একটা শক্তিশালী প্রতীকের। এবং শুধুমাত্র স্ট্র্যাটেজিক কারণেই তাঁরা আনন্দমঠের একটা সিলেক্টিভ ন্যারেটিভ বেছে নেন, যেখানে উপন্যাসের শেষে ব্রিটিশপন্থী অংশটুকু বাদ দেওয়া হয়। গল্প শেষ হয় যুদ্ধের ধ্বনি দিয়ে, ব্রিটিশ শাসনকে বৈধতা দেওয়ার দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে নয়। আনন্দমঠ লেখা হয়েছিল তৎকালীন বাংলা প্রদেশের (মানে সুবাহ বাংলা — বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা মিলিয়ে যে প্রদেশ) পটভূমিতে। "সপ্তকোটিকন্ঠ কলকলনিনাদকরালে, দ্বিসপ্তকোটি ভূজৈঃধৃত খরকরবালে" — এখানে সপ্তকোটি অর্থাৎ সাত কোটি সেই সময়ের সেন্সাস অনুযায়ী বাংলা প্রদেশের জনসংখ্যা। জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের প্রয়োজনে বাংলায় অরবিন্দ, মহারাষ্ট্রে তিলক, আর তামিল প্রদেশে সুব্রমনিয়া ভারতীর হাত ধরে বঙ্কিমের দেশমাতৃকা হয়ে উঠলেন ভারতমাতা, বাংলার সাত কোটি সন্তান হয়ে উঠলো সমস্ত দেশবাসী, শত্রু আর কোন বিশেষ ধর্মালম্বী রইল না, বরং হয়ে উঠল যে কোন বিদেশী শাসক। মূল উপন্যাস থেকে বন্দেমাতরমকে বের করে আনা হল জাতীয়তাবাদী স্লোগান হিসেবে।

কিন্তু কিছু সমস্যা থেকেই গেল। বন্দেমাতরমের দেবী হিন্দু দেবী, তার ভাষা সংস্কৃত ও বাংলার মিশেল। কিন্তু বাস্তবে অনেক মুসলমান ধর্মাবলম্বীর কাছে এই প্রকট হিন্দু ইমেজকে সরাসরি গ্রহণ করা একটু সমস্যার হয়ে পড়েছিল ধর্মীয় কারণে, এবং সেটা অযৌক্তিকও নয়। মাথা ঠাণ্ডা করে ভেবে দেখলে এটা আপনারও মনে হবে — যদি আপনাকে এলিয়েন কোন ধর্মীয় স্লোগান দিয়ে কোন জাতীয় অনুষ্ঠানে যেতে হয়। নাস্তিকদের তো যে কোন ধর্মীয় চিহ্নেই অস্বস্তি হবে। তিরিশের দশকে এই বিষয়টা বড়সড় চর্চায় আসে। সেই সময়ে রবীন্দ্রনাথের পরামর্শে বন্দেমাতরমের প্রথম দুটো স্তবককে আলাদা করে আনার পরেও কিছু ক্ষেত্রে অস্বস্তি থেকেই গিয়েছিল। যেমন, মুসলিম লীগ এই গানের দিকে আঙুল তুলে বলত কংগ্রেসের ধর্মনিরপেক্ষতা আসলে হিপোক্রেসি, ভুয়ো। উল্টোদিকে হিন্দু দক্ষিণপন্থী জাতীয়তাবাদের কাছে ১৯৪৭ সালের দেশভাগ হয়ে দাঁড়ায় ভারতমাতার পবিত্র শরীর থেকে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ আলাদা করে দেওয়ার সামিল। হিন্দু মহাসভার পোস্টারে বা প্যামফ্লেটে রক্তাক্ত ছিন্ন অঙ্গের ভারতমাতার ছবি ছাপা হত সেই সময়ে...

আমাদের দুর্ভাগ্য, যে এইখান থেকেই শুরু হয়েছিল ভারতমাতার আইডিয়ার ওয়েপনাইজেশন। ঔপনিবেশিক অপমানের জবাব দেওয়ার প্রতীক হিন্দু জাতীয়তাবাদের হাতে হয়ে দাঁড়িয়েছিল সংখ্যাগুরুর অস্ত্র। আজও তার ব্যতিক্রম হয় না, উলটে এই ধারণা আরো পোক্ত হয়েছে বিভিন্ন কারণে। সঙ্ঘ পরিবারের ভারতমাতার প্রতি শ্রদ্ধা বা বন্দেমাতরমের প্রতি আজকের পীরিত আসলে তাদের নিজেদের প্রতিচ্ছবি হিসেবে ভারতকে দেখার উদাহরণ — যেখানে ভারত দেশটাকে ভালোবাসা মানে ভারতমাতা মূর্তির প্রতি শ্রদ্ধা জানানো; দেশের মানুষ, নদী, বনজঙ্গল, পাহাড়, পশু পাখি সেখানে গৌণ; এখানে দ্বিধা মানে অবাধ্যতা, দেশদ্রোহ। নিজস্ব পলিটিকাল এজেন্ডার রূপায়ণের উদ্দেশ্যেই সঙ্ঘ পরিবার রামজন্মভূমি আন্দোলনকে রামের পবিত্র ভূখণ্ডকে মুক্ত করার ধর্মযুদ্ধ হিসেবে দেখিয়েছিল। বন্দেমাতরম এদের কাছে দেশপ্রেমের নামে প্রশ্নহীন ভক্তিমূলক আনুগত্যের প্রতীক...

=========================================

ভারতমাতার জন্মের গল্প এইটুকুই। প্রাচীন পুরাণকথা থেকে তাঁর জন্ম হয়নি। বরং, বাস্তবে শিক্ষিত বাঙালি ভদ্রলোকের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক সংকটের আগুনে তাঁকে তৈরী করা হয়েছিল। তাঁর সশস্ত্র মূর্তি দাঁড়িয়ে রয়েছে ব্যাঙ্ক ফেলিওর, রেন্ট স্ট্রাইক, জাতিবিদ্বেষ, নারীর অধিকার-বাল্যবিবাহ-বৈধব্য ইত্যাদি নিয়ে আদালত এবং সেই সময়ের সমাজমাধ্যমে তির্যক বিতর্কের ইতিহাসের ওপর। তিনি ঊনবিংশ শতকের কঠিন বাস্তবের মাটিতে হেরে যাওয়া হিন্দু ভদ্রলোকের শেষ আশ্রয় — এক কল্পিত অলঙ্ঘনীয় দেবীমন্দিরের প্রতিমা, উঠতি অ্যান্টিকলোনিয়াল "ইম্যাজিনড কমিউনিটির" ভিত্তি, যাঁকে ঘিরে এক বিচিত্র ভূখণ্ডের নানান ধরণের বৈচিত্রসম্পন্ন অসংখ্য মানুষ এক হয়ে দাঁড়িয়েছিল কলোনিয়াল শাসকের বিরুদ্ধে। আবার একই সঙ্গে তাঁর হিন্দু রূপের জন্যেই অহিন্দুদের সামনে অলঙ্ঘনীয় সীমানা তৈরী হয়েছিল একটা সময়ে। যাদের বিশ্বাস বা ওয়ার্ল্ডভিউ কোন দেবদেবীর প্রতি শ্রদ্ধাপ্রদর্শনের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারেনি, তাদের শুরু থেকেই "অপর" করে রাখা হয়েছে।

ভারতমাতার লিগ্যাসি কাজেই অস্পষ্ট। যে প্রতীক কলোনিয়াল শাসকের বিরুদ্ধে ছিল শক্তিশালী অস্ত্র — একটা, সাহস আর আইডেন্টিটির উৎস — সেই একই প্রতীকের ডিএনএর মধ্যেই লুকিয়ে থেকেছে সংখ্যাগুরুর গা-জোয়ারি। স্বাধীনতার পর থেকেই এই লুকিয়ে থাকা শক্তিকে খুঁচিয়ে জাগিয়ে তুলেছে সঙ্ঘপরিবার। "মা যা হইবেন" — দশপ্রহরণধারিণীর পরিবর্তে "মা যা হইয়াছেন" — দেশপ্রেমের এক লিটমাস টেস্ট — যার মাধ্যমে বহিরাগত "অপর"-কে চিহ্নিত করা যায়। ভারতমাতার গল্প তাই যতটা না পবিত্র দেশপ্রেমের কাহিনী, তার চেয়ে অনেক বেশি জাতীয়তাবাদের ধারালো দ্বিমুখী তরোয়াল সম্পর্কে শিক্ষা — যে প্রতীক স্বাধীনতার লড়াইয়ে লক্ষ মানুষের স্লোগান হতে পারে, লক্ষ মানুষকে এক করতে পারে, সেই একই প্রতীক নতুন ঐতিহাসিক পরিস্থিতিতে এক দেশ — এক ধর্ম — এক ভাষা — এক পোশাক — এক খাদ্যাভ্যাসের নামে জোর করে চাপিয়ে দেওয়া ইউনিফর্মিটির হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারে, উলটে সামাজিক বিভেদকে তীব্র করার অস্ত্র হয়ে উঠতে পারে। 

আধুনিক নেশন-স্টেট নিজেদের লেজিটিমাইজ করার জন্যে যে ধরণের কাহিনী ব্যবহার করে, ভারতমাতা সেই সমস্ত কাহিনীর মধ্যে একইসাথে লুকিয়ে থাকা গঠনমূলক এবং ধ্বংসাত্মক শক্তির টেস্টামেন্ট। 

রেফারেন্স (ইন নো পার্টিকুলার অর্ডার):

(১) Hindu Wife, Hindu Nation: Community, Religion, and Cultural Nationalism, Tanika Sarkar, Permanent Black
(২) Rebels, Wives, Saints: Designing Selves and Nations in Colonial Times, Tanika Sarkar, Permanent Black
(৩) The Truths and Lies of Nationalism as Narrated by Charvak, Partha Chatterjee, State University of New York
(৪) The Unhappy Consciousness: Bankimchandra Chattopadhyay and the Formation of Nationalist Discourse in India, Sudipta Kaviraj, OUP India
(৫) The Swadeshi Movement in Bengal, Sumit Sarkar, People's Publishing House
(৬) 'Kaliyuga', 'Chakri' and 'Bhakti': Ramakrishna and His Times, Sumit Sarkar, Economic and Political Weekly, Vol 27, No 29, Jul 18 1992
(৭) Colonial masculinity: The 'manly Englishman' and the 'effeminate Bengali' in the late nineteenth century, Mrinalini Sinha, Manchester University Press
(৮) Imagined Communities: Reflections on the Origin and Spread of Nationalism, Benedict Anderson, Verso


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন