আমরা সদগোপ। হিন্দু মতে শূদ্র। সৎ শূদ্র। গোয়ালা ঘোষ না, চাষা ঘোষ। এসসি ওবিসি নয়, জেনারেল। 'চাষা যে রাস্তায় হাঁটে দশ বছর সে রাস্তায় হনুমান হাঁটে না'- শুনে বড় হয়েছি। তারাশঙ্করের লেখায় পড়েছি, বামুন বাড়ির মেয়েরা বলছে খাবারগুলো ফেলিস না, সকালে সদগোপদের বাড়ির মেয়েদের দিয়ে দিস। ট্র্যাডিশনাল হিন্দু মতে ছোট জাত। গোটা গ্রামটাই সদগোপদের হওয়ায় জাতপাতের ভেদ আম্বেদকরের মত হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি এমন নয়। তবে কিছুটা দেখেছি। বাগদী দুলে মুচি মাহাত পরামানিকরা পাশে থেকেও যে আমাদের চেয়ে নিচু জাতের এমন একটা ধারণা অবচেতনেই তৈরি হয়েছিল দেখে দেখে। কেননা ওরা উঠোন থেকে দুয়ারে ওঠে না, ঘর তো দুরস্থান। কাজ করার সময় ঢুকতে পারে ঘর মুছতে। বাসন মাজতে পারে। কিন্তু একাসনে খেতে পারে না। ওদের থালায় বা হাতে কোন জিনিস একটু উঁচু থেকে ছেড়ে দিতে হয়। খেঁদি বাগদীর বাড়ি আমাদের বাড়ির দশ হাত দূরে। সে ভিক্ষা করেই দিন কাটাত। মাঝে মাঝে দুপুরে খেয়েও যেত বাড়িতে। বয়স হয়েছিল। জল নিতে এলে মা কল পাম্প করে দিত। তখন আমাদের বাড়ির কাজের লোক বলতে ছিল জয়ন্তীদি। একদিন মা ঠাকুরঘরে ব্যস্ত, খেঁদিপিসি এল জল নিতে। তখন জয়ন্তীদি কল পাম্প করে দিতে গেলে সে বলল 'আমি জল নেব না দুলের হাতে।' কেননা দুলেরা নাকি বাগদিদের চেয়েও ছোট জাত। আমাকেই সেদিন কল পাম্প করে দিতে হয়েছিল। অনেক ছোটবেলায়, টু থ্রিতে পড়ি, একদিন ঘোষেদের বাড়ি নিমন্ত্রণ খেতে গেছি। একটা সারিতে বসেছি বন্ধুরা। টেনে তোলা হল আমাদের কয়েকজনকে। বাগদী সাঁওতালদের ছেলেরাই তখন আমার সহপাঠী। বামুন, সঞ্জয়, নিতাই, টিপু। ঐ সারিতে নাকি ব্রাহ্মণরা বসেছে কয়েকজন। বাচ্চা ছিলুম। বুঝিনি। দিব্বি অন্য সারিতে সবাইমিলে খেয়ে চলে এসেছি। বাবার ছোটবেলায় নিয়ম ছিল ভোজ বাড়িতে ব্রাহ্মণে রান্না করবে, ব্রাহ্মণে পরিবেশন করবে। ব্রাহ্মণরা খেতে বসে অনুমতি দিলে অন্যরা বসতে পেত। অনুমতি নিতে হত গ্রামের মোড়লের কাছ থেকে। এখন শুধু প্রথাটা শ্রাদ্ধানুষ্ঠান ে টিকে আছে। এক টেবিলে বসে বামুন বাগদী খাওয়াটা পরিচিত দৃশ্য। কেউ কাউকে উঠিয়ে দেয় না। তবে অনেকে লোক দেখেই বসে। মানে জাত দেখে। স্কুলে অঙ্গনয়ারিতে খাবে খাবে না করে অধিকাংশই খাচ্ছে। সময় অনেক বদলে গ্রামের পাশে রিলায়েন্সের ফোর জী টাওয়ার বসেছে মানে এই নয় যে আত্মীয় কুটুম্ব পাতাতে শুরু করেছে বামুনে বাগদীতে। তিন দশক আগে সদগোপ ও ব্রাহ্মণ পরিবারের এমন একটি প্রণয় ঘটিত বিয়ের পর গ্রাম ষোলোআনায় মিটিং ডেকে ভট্টাচার্য মশাইকে অনুরোধ করা হয়েছিল জামাইকে স্বীকার করে নিতে। সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলছে। জাতের নামে আমরা আলাদা ছিলাম, আলাদাই আছি। সৎ শূদ্রদের মধ্যে কুমার, রায় প্রমুখরা সবচেয়ে উঁচু। কুলিন শূদ্র । এর পরে মিত্তির ঘোষ বোস। শিক্ষিত শূদ্র। কলমে কায়স্ত চিনি/ গোঁফেতে রাজপুত- প্রবাদ ছিল না! তাদের অনেকের পরে আমরা সদগোপরা। তারও পরে 'সানা পানা রাণা/তিন থাকতে মানা।' তারও পরে নাকি বাগদী দুলে ডোম মুচি মেথর ইত্যাদি ইত্যাদি। বামুনদের মধ্যেও ভেদ দেখেছি। পূজারী ব্রাহ্মণরা নাকি নিম্ন শ্রেণীর। অগ্রদানী ব্রাহ্মণরা আরও নিচু। পিণ্ড ভক্ষণ করে কিনা তারা। আরও ভেদ দেখতে চাইলে পাত্র পাত্রীর বিজ্ঞাপন দেখুন আনন্দবাজারে। অনেককাল আগে একবার এই বিষয়ে এক তর্কে জিজ্ঞাসা করেছিলুম চতুর্বর্ণ বিভাজন ব্যবস্থা তুলে দেওয়ার ব্যাপারে হিন্দু হিসেবে গর্বিতরা ঠিক কি ভাবছে!! কোন উত্তর না দিয়ে এড়িয়ে গেছিলেন বিপক্ষের বন্ধু। এই প্রশ্ন আমার আজও। কোটি কোটি হিন্দু যারা প্রতিদিন জানে যে তারা ছোট জাত, তারা কেমন করে গর্বের সাথে বলবে তারা হিন্দু? সামাজিক ভেদ দূর না করে হিন্দু হিসেবে গর্ব বোধ করা এক ধরণের মুর্খামি। একজন ব্রাহ্মণ বলতেই পারেন তিনি হিন্দু হিসেবে গর্বিত। কারণ এই ব্যবস্থায় তিনিই সবচেয়ে বেশী উপকৃত। আমি বলতে পারি না। কারণ আমি এই ব্যবস্থার শিকার।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন