আমার কিছু বন্ধু অনুযোগের সুরে আমাকে বলেছেন কেন আমি রামনবমীতে অস্ত্রহাতে
মিছিলের নিন্দা করে কিছু লিখছি না। তারা সেকুলারিজম নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন। এ
প্রশ্নও তুলেছেন যে মহরমের মিছিলে অস্ত্রহাতে যে উল্লাস দেখা যায় আমি তা সমর্থন
করি কিনা। সন্দেহ নেই এসব প্রশ্ন সঙ্গত। আমি এসব প্রশ্নের সঠিক উত্তর জানি এমন
দাবী করি না। জানিনা বলাই সঙ্গত। এইসব প্রশ্নের গভীরে ঢোকার আগে একটা সমীকরণের
ব্যাপার বুঝে নেওয়া যাক। এক বন্ধুর বক্তব্যঃ মহরমে যদি অস্ত্র ব্যবহার সঙ্গত হয়
তাহলে রামনবমীতে অস্ত্রহাতে মিছিল শোভাযাত্রা সঙ্গত কাজ। আপাত দৃষ্টিতে এই আংকিক
যুক্তি অকাট্য। এ প্রসঙ্গে একটা গল্প মনে পড়ল। কার কাছে শুনেছিলাম মনে নেই। গল্পটা
এইরকমঃ এক ভদ্রলোক রাস্তা দিয়ে হেঁটে বাজারে যাচ্ছিলেন।স্কুলের কাছাকাছি এসে তিনি
একটি চেনা ছেলেকে দেখতে পেলেন। মনে পড়ল সেদিন বার্ষিক ফল বেরোনোর কথা। ছেলেটিকে
জিজ্ঞেস করলেন ,’ হ্যাঁরে গনশা, আজ রেজাল্ট বেরিয়েছে?’ সে কথার উত্তর না দিয়ে গনশা
বলল,’ তোমাদের প্যালাও ফেল।‘ বল্বাহুল্য গনশা পরীক্ষায় পাশ করে নি কিন্তু প্যালাও
ফেল হওয়াতে তার দুঃখ খানিক কমেছে।‘ এই ধরণের যুক্তি আমি খুব ভয় পাই। সেজন্য এসব
বিষয়ে লিখতে সাহস করি না। আমরা খুশি হতাম প্যালা ও গনশা দুজনেই ভাল করে পড়াশোনা
করে পাশ করলে।
গনশা ও প্যালাদের সংখ্যাধিক্যের দেশে খোলামনে আলোচনা করার বিপদ পদে পদে।
একটা যুতসই নঙর্থক বিশেষণে দেগে দেবে গনশারা। এ বিপদ তো আছেই সারাজীবন মাথার উপর
ঝুলে ডেমোক্লিশের তলোয়ারের মত। তবুও কথার ডালপালা গজাক। ভাই নিখিল চক্রবর্তী
সেক্যুলারিজমের প্রসঙ্গ উত্থাপন করেছে। আমাদের সংবিধানের প্রস্তাবনায় সেক্যুলার
কথাটা সংযোজিত করা আছে। এর প্রকৃত অর্থ কি এবং বাসবে কিভাবে এই নীতি পালিত হয় সে
আলোচনায় পরের পর্বে আসব। আপাতত রামনবমী সবিনয়ে দুচারটি কথা বলতে চাই। আমার ভুল হলে
সহৃদয় পাঠক/পাঠিকা সংশোধন করে দেবেন। কোনো এক চৈত্রমাসে নবমী তিথিতে মর্যাদা
পুরুষোত্তম শ্রী রামচন্দ্র ধরাধামে আবির্ভূত হয়েছিলেন। সে অনেক শতাব্দী আগেকার
ধূসর অতীতের কথা। তিনি স্বয়ং বিষ্ণুর অবতার আর অবতারের জন্মবৃত্তান্ত রহস্যাবৃত
হওয়াটাই স্বাভাবিক। মহারাজা দশরথের সন্তান কামনা পূর্ণ হচ্ছিল না। তাই ঋষির
নির্দেশে তিনি যজ্ঞ করেন। এর পরের কাহিনী এই রামায়ন-মহাভারতের দেশের সকলেই
জানেন।খুব স্বাভাবিক কারণেই সেই সময়ে প্রজারা খুশিতে উদ্বেলিত হয়ে উঠেছিলেন। তারপর
গঙ্গাযমুনা দিয়ে কত যে জলস্রোত প্রবাহিত হয়ে গেছে তার ইয়ত্তা নেই কিন্তু
প্রজন্মান্তরের মানুষের মনে রামসীতার কাহিনী পল্লবিত ও জীবন্ত রয়ে গেছে। আজও
বিহার, উত্তর প্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশ গড়, ঝারখন্ড এবং খোদ দিল্লীতে রামনবমী
পালিত হয় আনন্দ, উল্লাশ ও নৃত্যগীতের সমারোহের মাধ্যমে। বাড়িতে বাড়িতে নানারকমের
মিস্টান্ন তৈরি হয়, ভিয়েন বসে, অতিথির সমাগম হয়’ শোভাজাত্রা বার করা হয়, মেলা বসে
গ্রামে গ্রামান্তরে। নতুন জামাকাপড় পরে বাচ্চারা আনন্দে মেতে ওঠে। রামের প্রশংসায়
গীত রচনা হয়, গাওয়া হয় মহল্লায় মহল্লায়, গ্রামে গ্রামে। রামনবমী আসলে বিশ্বাসীদের
কাছে এক অনন্ত খুশির উৎসব। বাঙালী হিন্দু ঐতিহ্যপরম্পরায় মাতৃপূজক। শক্তির উপাসক।
চৈতন্য প্রভাবে ভক্তিরসে আপ্লুত হয়েছে কখনো। কিন্তু বাঙালী হিন্দু রামভক্ত নয়
সেভাবে কোনোদিন। আমরা শিবের গাজন গাই ধান ভানতে, লাঠি খেলাও হয় কোথাও কোথাও কিন্তু
রামভক্ত বলে বাঙ্গালীকে চিহ্নিত করা যাবে না। এ প্রসঙ্গ থাক। বলার কথা এই যে
রামনবমী-র সঙ্গে অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত মিছিল শোভাযাত্রা একেবারেই বে-মানান। ধর্মীয়
আস্থা ও বিশ্বাসের ‘রাজনীতিকরণ’ ঘটলে তবেই এমন বিসদৃশ ব্যাপার ঘটতে পারে। এটা
রাজনীতি-আরোপিত অস্মিতার বহিঃপ্রকাশ ছাড়া কিছুই নয়। বিপ্রতীপে মহরম একটি অতীব
শোকাবহ ঘটনার বেদনার্ত স্মৃতি। শিয়া সম্প্রদায়ের নিষ্ঠাবান বিশ্বাসী মানুষেরা শোক
পালন করেন নিজেকে কষ্ট দিয়ে। শোক পালনের সঙ্গেও অস্ত্র প্রদর্শন ও আস্ফালনের কোনো
অরগানিক বা আবেগী সম্পর্ক নেই। এখন তো দেখতে পাই অনেকে মহরম পালন করেন
ব্যন্ডপার্টী বাজিয়ে তুমুল উল্লাসের সঙ্গে। প্রকৃত ধর্মবিশ্বাসীদের সঙ্গে এর কোনো
সম্পর্ক নেই। কিন্তু আমি বললেই বা কি হবে। কেউ কি শুনবেন বা ভাববেন? আমাদের হয়ে
ভাবার ভাবনাটা যখন ধর্ম ব্যবসায়ী ও রাজনীতি ব্যবসায়ীদের হাতে আমরা স্বেচ্ছায় বা
অনিচ্ছায়, ভয়ে বা সম্ভ্রমে ছেড়ে দিই তখন এমনি হয়ে থাকে।
মহরম মাসটি শান্তির মাস হিসাবে চিহ্নিত। অনেকগুলি কথা বলার আছে কিন্তু আমি
সে তথ্যের মধ্যে যাব না দুটো কারণে।প্রথমত আমি সব তথ্য জানি না। আবেগ তথ্য নির্ভর
নয়। মানুষের ধর্মবিশ্বাস এবং আবেগ এমন এক দুর্জ্ঞেয় মানসভূমির উপর স্থিত যে যুক্তি
সেখানে আঁচড় কাটতে পারে না। অনেকের সঙ্গে অনেকদুর পর্যন্ত কথা বলার পর এইরকম উত্তর
শুনিঃ ‘ আপনি যা বলছেন তা ঠিক কথা কিন্তু আমি বিশ্বাস করি...’। খুব অসহায় লাগে
তখন। এমনকি তথাকথিত শিক্ষিত ও সজ্জন মানুষদেরও এইরকম কথা বলতে শুনি। আংটি পরা ,
মাদুলি বাবাদুলি বা ঠাকুমাদুলি পরা বা পৈতে প্রথার সমর্থকদের সঙ্গে যুক্তি তর্ক
করে দেখেছি শেষ পর্যন্ত তারা বিশ্বাসের নীরেট পাঁচিল তুলে ‘ নো এন্ট্রি ‘
সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দিয়েছেন। খুব অসহায় বোধ করি। কপালে কতবার যে ঠোকা খেয়েছি তার
ইয়ত্তা নাই। তরুণ তরুণী থেকে সব বয়সী বিশ্বাসীদের কাছ থেকেই একই রকম সমাদর(!)
পেয়েছি। থেমে গেছি বন্ধুত্ব বজায় রাখার খাতিরে। এরা বেশিরভাগই ভাল মনের মানুষ।
আমার দ্বিতীয় কারণ হল আমি একটি হিন্দু পরিবারে জন্মেছি। আমি ধর্ম বিশ্বাসী কিনা সে
প্রশ্ন কেউ করে না। এটা আমার নির্বাচন নয় কিন্তু আমার এক ধরণের ID. ইসলাম ধর্ম
সম্পর্কে কিছু বলতে গেলেই একটা সমস্যা এসে পথ আগলে দাঁড়ায়। আবার সেই NO ENTRY
বোর্ড ঝোলানো। ‘বলি, তুমি কে হে আমাদের ধর্ম নিয়ে কথা বলার? কোরান হাদিস পড়েছো?’
যদি বলি পড়েছি প্রশ্ন আসেঃ ‘আরবিতে পড়েছো?’ না। আরবি জানি না। তাহলে চুপ করে থাকো।
চুপ করে থাকি। আমি তো সংস্কৃতও জানি না এবং বেদ, গীতা, পুরান, উপনিষদ কিছুই
সংস্কৃতে পড়ি নি। যারা রামনবমীতে অস্ত্র নিয়ে মিছিল করার উস্কানিদাতা এবং মহরমে
ঢাল তলোয়াল নিয়ে মিছিলের ফতোয়া দেন তারা সব পড়েছেন তো? বুঝেছেন তো? মুস্কিল খুব।
এই প্রশ্ন করার অপরাধে আমাকে বিপদে পড়তে হতে পারে। কিন্তু প্যালা এবং গনশাদের কাছে
প্রশ্নটাও তো করতে হবে। না হলে ওদের কি হবে? ফেলুদা হয়েই তো থাকতে হবে, তাই না?
ঈশ্বর আল্লাহ বা গড-কে ঢাল এবং তলোয়ার হিসাবে ব্যবহার করলে আমার মত নীরেট বুদ্ধির
মানুষ খুব মুস্কিলে পড়ে যায়।
সেকুলারিজমের কথায় আসা যাক। শ্রী
শ্রী রামকৃষ্ণ সুন্দর একটা কথা বলেছিলেনঃ যত মত তত পথ। আমি এই কথাটাই এখনকার
প্রেক্ষিতে একটু প্যারাফ্রেজ করে ব্যবহার করার অনুমতি চেয়ে নিচ্ছি। এদেশেঃ যত দল
তত রকম সেকুলারিজম। অন্যভাবেঃ যত বুদ্ধিমান মানুষ ততরকমের সেক্যুলার। সমস্যাটা
একাধারে সেমান্টিক ও পেডাগজিক্যাল। পাঠক/পাঠিকাদের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি কারণ এই
দুটি শব্দের আভিধানিক বাংলা প্রতিশব্দ আরো বেশি খটমট। কেন বলছি এই কথা সেটা বলি।
আমাদের সংবিধানে SECULAR শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে ধর্ম-নিরপেক্ষ অর্থে। কি অর্থ
ধর্ম-নিরপেক্ষতার? রাষ্ট্রের কোনো ধর্ম থাকবে না অর্থাৎ রাষ্ট্র কোনো বিশেষ ধর্মের
প্রতি পক্ষপাতিত্ব বা আনুগত্য দেখাবে না। ভাল কথা। সমস্যা এখানেও নয়। রাষ্ট্র তো
একটি বিমূর্ত ধারণা। রাষ্ট্রের ইচ্ছা বা WILL ব্যক্ত ও প্রযুক্ত হয় বা প্রতিপালিত
হয় সরকারের আইনকানুন ও দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে। যাকে পরিভাষায় বলা হয় Governance বা
State craft. বুঝতেই পারছেন ,সহৃদয় পাঠকপাঠিকা, সেমান্টিক ও পেডাগজিতে জড়িয়ে পড়ছে
যুক্তি। কিন্তু এর সহজ ব্যাখ্যা দেবার ভাষা আমার জানা নেই। চেষ্টা করা যাক। এই
সাংবিধানিক অর্থে আমাদের দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলি সবাই ‘সেক্যুলার’। আমি
কেন্দ্রীয় ও রাজ্যস্তরের সব দলগুলিকেই এই বৃত্তের মধ্যে ধরে নিচ্ছি। টেকনিক্যালি
সবকটি দল( ধর্মভিত্তিক গোষ্ঠীগুলি বাদ দিয়ে ) সেক্যুলার বা আমাদের ভাষায়
ধর্মনিরপেক্ষ। বি জে পি দলের সংবিধান খুলে দেখুন। মজাটা এবং সমস্যার জড়ও এইখানে।
একটি শব্দ প্রয়োগের মাধ্যমেই অর্থপ্রাপ্ত হয়। এমনকি অভিধানেও একাধিক অর্থ দেওয়া
থাকে। আমার এক ইংরাজী শিক্ষক বন্ধু দেবনাথ মৈত্রের সঙ্গে আজ প্রথম দুপুরে টেলিফোনে
কথা হচ্ছিল BECAUSE শব্দটি Conjunction, adverb না preposition. ও কথা থাক। আমাদের
প্যালা আর ওদের গনশা-র কাছে ‘সেক্যুলারিজম’ কথা বা অবধারণাটির মানে কি সেটা জানা
খুব গুরুত্বপূর্ণ। কাশ্মীরের ‘আজাদি’র সমর্থকদের সমর্থন করা সেক্যুলারিজম,
তিনতালাকের বিরোধিতা করা ‘সেক্যুলারিজম’ নয় বা সকলের জন্য একই দেওয়ানী ও ব্যক্তিগত
আইন প্রবর্তনের দাবী করা ‘সেক্যুলারিজম’ ইমাম ভাতা চালু করলে পুরোহিত ভাতাও দিতে
হবে এই দাবী সেক্যুলার দাবী ইত্যাদি নানারকম প্রশ্ন উঠে আসে সামনে। এই প্রশ্নগুলির
উত্তর খুঁজতে হবে নিরাবেগ সদর্থক যুক্তির মাধ্যমে। আইনের মধ্যে যদি কোনো বিশেষ
ধর্মাবলম্বীদের প্রতি পক্ষপাত্মুলক কিছু থাকে সে আইন বদল করতে হবে। গীতা,
মনুসমহিতা বা শরীয়তের প্রভাবে যদি রাষ্ট্রীয় আইন ও বিচার ব্যবস্থা পরিচালিত হয় সেই
রাষ্ট্রকে প্রকৃত ‘সেক্যুলার’ রাষ্ট্রের আখ্যা দেওয়া যায় না। আমার তাই মনে হয়েছে
আমাদের রাষ্ট্র সর্বধর্ম সমণ্বয়কারী রাষ্ট্র –প্রকৃত প্রস্তাবে সেক্যুলার নয়।
ভারতীয় ধর্মনিরপেক্ষতার ধারণা সম্পূর্ণ ভিন্ন।
ভাল লাগছে এই জেনে যে কিছু বন্ধু পড়ছেন কষ্ট করে এবং তাদের মতামত ব্যক্ত করছেন। এই বক্তব্যগুলি আমার কাছে খুব মুল্যবান। আমিও শিখছি। এটা অতি বিনয় নয়। এত কিছু জানার ও বোঝার আছে যে সবসময় তা নজরে পড়ে না। আন্তরিক ধন্যবাদ সকলকে।
আশঙ্কা করেছিলাম শব্দের ডালপালা বেরোবে। ছড়িয়ে পড়ছে। প্রসঙ্গে আসা যাক। আমাদের সংবিধানে
secular শব্দটি সংযুক্ত করা হয় সংবিধানের ৪২ তম সংশোধনীর মাধ্যমে। তার মানে এই নয় যে তার আগে আমাদের রাষ্ট্র সেক্যুলার ছিল না।১৯৪৭ সালে ধর্মের ভিত্তিতে দেশ বিভাগ ঘটে।সে রক্তাক্ত ইতিহাসের ক্ষতচিহ্ন ও বেদনা এখনো আমাদের সামূহিক চেতনায় বহমান। খুব স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়ায় সেই অস্থির টালমাটাল সময়ে ভারত রাষ্ট্রকে একটি হিন্দু রাষ্ট্র হিসাবে ঘোষণা করা যেত। হয়তো সেই সময়কার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সামূহিক আবেগের কাছে তা গ্রহণযোগ্যতাও লাভ করতো। কিন্তু আমাদের পরম সৌভাগ্য যে আমাদের সেই সময়কার জাতীয় নেতারা আজকের মত ক্ষীণদৃষ্টিসম্পন্ন ছিলেন না। তাই তারা সংবিধানের প্রস্তাবনায় লিপিবদ্ধ না করেও মৌলিক অধিকার ও নির্দেশাত্মক নীতিমালার মাধ্যমে পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিয়েছিলেন আমাদের রাষ্ট্র থিওক্রাটিক নয় সেক্যুলার অর্থাৎ রাষ্ট্র কোনো বিশেষ ধর্মের পালন পোষণ করবে নাঃ সকল ধর্মাবলম্বী মানুষকে রাষ্ট্র সমান মর্যাদার সঙ্গে দেখবে। এ ছাড়াও আমার মতে যে কথাটি সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ তা হল এই যে ধর্মবিশ্বাস পালন , অনুসরণ ইত্যাদি ব্যাপার একান্তই নাগরিকদের ব্যক্তিগত ব্যাপার। কেউ যদি এথেয়িস্ট বা নিরীশ্বরবাদী অথবা সংশয়বাদী , একেশ্বরবাদী বা দ্বৈতবাদী , অদ্বৈতবাদী বা বহুত্ববাদী হন সে তার একান্তই ব্যক্তিগত ব্যাপার। স্বামী বিবেকানন্দ মায়াবতীতে অদ্বৈত আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেছিলেন শেষের দিকে। না, এখানে আমি অন্য কোন ব্যক্তি নাম উদাহরণ হিসাবে উল্লেখ করবো না। বিপদ আছে খুব। ভক্তদের আমি খুব ভয় পাই।
আরো একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা আমাদের মনে রাখতে হবে। ‘হিন্দু ধর্ম’ শব্দ বা শব্দযুগল আমরা সচরাচর ব্যবহার করি বটে কিন্তু এটি কোনো কোডিফাইড ধর্ম হিসাবে গণ্য হয় না। মাঝে মাঝেই কিছু পরিমাণে হলেও হিন্ধু ধর্মকে কোডিফাই করার চেস্টা হয় নি এমন নয়। কিন্তু বৃহত্তর হিন্দু জীবনবোধ দ্বারা প্রভাবিত মানবগোষ্ঠীর কাছে তা গ্রাহ্য হয় নি। বিবেকানন্দ সহ অনেক এটি বর্ণনা করেছেন একটি জীবন দর্শন বা
way of life. রূপে। অন্যান্য সেমেটিক ও অরগানাইজড ধর্মের মত এই হিন্দু ধর্মের একটিমাত্র সর্বজনমান্য ধর্মগ্রন্থ, একজন প্রফেট বা একজন মাত্র ঈশ্বর ও একটিমাত্র উপাসনালয় স্বীকৃত নয়। সুতরাং হিন্দুধর্ম রাষ্ট্রধর্ম রূপে গৃহীত হলে এদেশের ধর্ম সংকট আরো বেড়ে যেত। হিন্দু জীবন দর্শনের বৃহত্তর পরিধির মধ্যে একটা সামগ্রিক একাত্মকরণের প্রচেষ্টা যুগ পরম্পরায় চলে আসছে। বিরোধ হয়েছে, সংঘর্ষও হয়েছে আবার সমণ্বয়ের সাধনাও পাশাপাশি সমান্তরাল ভাবে চলেছে। মাঝে মাঝে কোডিফিকেশনের চেষ্টাও হয়েছে তবে সেটা গায়ের জোরে বা রাস্ট্রশক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে নয়। কেন আমাদের রাস্ট্রনেতারা সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতার ধারণাটিকে বেছে নিয়েছেন সেটা বোঝার জন্যই এই কথাগুলি বলা। হিন্দুধর্মের তাত্বিক বা আধ্যাত্মিক ভিত্তিভূমি ব্যাখ্যা করার মত জ্ঞানবুদ্ধি আমার নেই। এখানে জন্মান্তরবাদ, জাতিভেদপ্রথা ইত্যাদি প্রসঙ্গ আমি তুলব না। এসব বিতর্কিত বিষয়ের অবতারণা এই আলোচনার পরিধির বাইরে।
হিন্ধুধর্ম সেমিটিক রিলিজিওন থেকে চারিত্রে সম্পূর্ণ আলাদা। হিন্দুরা আত্মার পবিত্রতা (divinity of the soul)-এ বিশ্বাসী। হিন্দুর বিশ্ব দর্শন সেমিটিক রিলিজিওন-এর বিশ্ব দর্শন থেকে একেবারেই পৃথক। একজন প্রকৃত হিন্দুর কাছে কেউ অচ্ছুৎ নয়। বিশ্বের সকলেই তার নিকট আত্মীয় এবং অতিথিকে সে দেবতার মর্যাদা প্রদান করে। এমনকি দেবদেবীরাও হিন্দু জীবন দর্শনে বিশ্বাসীদের কাছে আত্মীয়- একেবারে ‘ঘরের মানুষ’। এতোটাই ঘরের মানুষ যে তাদের নিয়ে দিব্যি ঠাট্টাতামাশাও করা যায়। সেমিটিক রিলিজিওনে এমনটা কল্পনাও করা যায় না।
হিন্ধুধর্ম সেমিটিক রিলিজিওন থেকে চারিত্রে সম্পূর্ণ আলাদা। হিন্দুরা আত্মার পবিত্রতা (divinity of the soul)-এ বিশ্বাসী। হিন্দুর বিশ্ব দর্শন সেমিটিক রিলিজিওন-এর বিশ্ব দর্শন থেকে একেবারেই পৃথক। একজন প্রকৃত হিন্দুর কাছে কেউ অচ্ছুৎ নয়। বিশ্বের সকলেই তার নিকট আত্মীয় এবং অতিথিকে সে দেবতার মর্যাদা প্রদান করে। এমনকি দেবদেবীরাও হিন্দু জীবন দর্শনে বিশ্বাসীদের কাছে আত্মীয়- একেবারে ‘ঘরের মানুষ’। এতোটাই ঘরের মানুষ যে তাদের নিয়ে দিব্যি ঠাট্টাতামাশাও করা যায়। সেমিটিক রিলিজিওনে এমনটা কল্পনাও করা যায় না।
প্রসঙ্গত দার্শনিক কবি রবীন্দ্রনাথের ‘ভারততীর্থ’ কবিতাটির প্রতি সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। ‘হে মোর চিত্ত পুণ্য তীর্থে জাগো রে ধীরে/ এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে’ । এই ‘মহামানবের সাগরতীরে’ মিলিত হয়েছে পৃথিবীর সকল ধর্ম, জাতি, মত ও পথের মানুষ। মহাকবির ভাষায় ,’হেথায় আর্য হেথায় অনার্য হেথায় দ্রাবিড় চীন/ শক হুন দল পাঠান মোগল এক দেহে হল লীন’। ‘হেথায় সবায় হবে মিলিবারে আনত শিরে/ এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে’।
রবীন্দ্রনাথ ভারতবর্ষের আত্মার স্বরূপ যথার্থ চিনেছিলেন। যেমন চিনেছিলেন ভারত-পথিক রাজা রামমোহন রায়, ভারতীয় নবজাগরণের প্রধান পুরোহিত বলে যাকে আমরা সশ্রদ্ধায় স্মরণ করি। এরা দুজনেই ব্রাহ্ম ছিলেন। কিন্তু ভারতাত্মার স্বরূপ চিনতে ভুল করেন নি এঁরা। ‘ভারততীর্থ’ কবিতায় রবীন্দ্রনাথ উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন এইভাবে-‘মা-র অভিষেকে এস এস ত্বরা মঙ্গলঘট হয় নি যে ভরা/ সবার পরশে পবিত্র করা তীর্থ নীরে/ এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে।‘
রবীন্দ্রনাথ ভারতবর্ষের আত্মার স্বরূপ যথার্থ চিনেছিলেন। যেমন চিনেছিলেন ভারত-পথিক রাজা রামমোহন রায়, ভারতীয় নবজাগরণের প্রধান পুরোহিত বলে যাকে আমরা সশ্রদ্ধায় স্মরণ করি। এরা দুজনেই ব্রাহ্ম ছিলেন। কিন্তু ভারতাত্মার স্বরূপ চিনতে ভুল করেন নি এঁরা। ‘ভারততীর্থ’ কবিতায় রবীন্দ্রনাথ উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন এইভাবে-‘মা-র অভিষেকে এস এস ত্বরা মঙ্গলঘট হয় নি যে ভরা/ সবার পরশে পবিত্র করা তীর্থ নীরে/ এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে।‘
দুঃখের বিষয় মঙ্গলঘট এখনো ভরা হয় নি। আর কখনো হবে কিনা আমরা জানি না। ঢাল তলোয়ার আর লাঠি বন্দুক নিয়ে পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধংদেহী মনোভাব নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলে ‘মঙ্গলঘট’ ভরা হবে না।
যে সমস্যকে কেন্দ্রে রেখে এই আলোচনা শুরু করেছিলাম তাহল রামনবমী, মহরম ও সেকুলারিজম। অস্ত্রহাতে রামনবমীর মিছিল এবং অস্ত্রহাতে মহরমের মিছিল একদিকে চলতে থাকুক আর অন্যদিকে রাষ্ট্র সেকুলারিজম প্রতিষ্ঠা করতে সচেষ্ট থাকুক তাহলেই একটা সমাধানের পথ আমরা খুঁজে পাব- এটা নেহাতই অতিসরলীক্রিত ধারণা। সেমিনারে সিম্পোসিয়ামে আলোচিত ও হাতালিত হতে পারে কিন্তু বাস্তবোচিত নয়। কেন নয় সেটা বুঝতে গেলে ইসলাম ধর্মের মুল কয়েকটি কথা বুঝতে চেষ্টা করতে হবে। পবিত্র কোরআন আল্লাহর পবিত্র বাণী ও নির্দেশ। মুসলিম মাত্রেই এই বিশ্বাসে অনড়। হাদিস বা হাদীথ আল্লাহর শেষ নবী হযরত মহম্মদের জীবনাচরণ ও উপদেশাবলীর সংকলন এবং শারিয়া বা শারীয়ত ইসলামিক আইন যা কোরানের নির্দেশ ও শিক্ষা অনুসারে রচিত। একজন বিশ্বাসী মুসলমানের জীবন এই তিনটি মূল আদর্শ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এখানে সেকুলারিজমের কোনো স্থান নেই। রবীন্দ্রনাথ বা কাজী নজরুল ইসলাম আবেগী উদারতায় হিন্দু মুসলিম ঐক্যের স্বপ্ন দেখতেই পারেন কিন্তু সেই কাজটা খুব সহজ নয় বাস্তবায়িত করা। শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান সম্ভব আইনের শাসনের আওতায় থেকে কিন্তু অরগানিক মিলন সম্ভব নয়। এই বাস্তব কথাটা আমাদের মানতে হবে। পছন্দ করি বা না করি।
আর একটা কথা। ইদানীং সমাজে যে উগ্রতার প্রকাশ দেখা যাচ্ছে বিশেষ করে হিন্দুদের একাংশের মধ্যে তার পিছনে একটা পারসেপশানের ব্যাপার আছে। জওহরলাল নেহরুর আমল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত এদেশে সেকুলারিজমের নামে সংখ্যালঘু মুসলিম তোষণ করা হয়েছে এরকম একটা পারসেপশান বা বেদন বা কল্পমূর্তি বেশ কিছু মানুষের মধ্যে বদ্ধমূল হয়েছে। এদেশের মুসলিম ধর্মনেতারা এজন্য অনেকখানি দায়ী। তথাকথিত প্রগতিশীল ইন্টেলেকচুয়ালরাও এই ধারণা তৈরি করতে পরোক্ষে সাহায্য করেছেন। শাহবানু মামলা, কাশ্মীর নিয়ে এদের তাত্বিক অবস্থান , ইত্যাদি নানা বিষয়ে এদের অবস্থান ও কেন্দ্রীয় সরকারের দোদুল্যমানতা সবকিছু মিলে তালগোল পাকিয়ে এই পারসেপশান সৃষ্টি হয়েছে। যে কারণে অনেক সরল ও শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষকেও বলতে শুনি,’ না, বাপু এতখানি তোষণ ভাল নয়।‘ এর সঙ্গে যোগ হয়েছে তিন তালাক ও বহুবিবাহের বিরুদ্ধে সংখ্যা গরিষ্ঠ মানুষের আপত্তি। শিক্ষিত ও সচেতন মুসলিমদের গরিষ্ঠ অংশ এসব সমর্থন করেন না কিন্তু প্রকাশ্যে তারা মত প্রকাশ করতে চান না। এক ধরণের ভয় কাজ করে। যুক্তি যেখানে শেষ হয় হিংসার শুরু সেখান থেকেই। এই যে সারা মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে নানারকম আতংকবাদী চক্র হিংসাত্মকো ধ্বংসাত্মক কাজ করে চলেছে তার বিরুদ্ধে মুসলিম ইন্টেলেকচ্যুয়াল বা সাধারণ শিক্ষিত মুসলিমদের বড় অংশ মুখ খোলেন না। এই কারণেও এমন একটা পারসেপশান তৈরি হয়েছে যে এরা বুঝি এসব সমর্থন করেন। ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় দেখবেন যে অধিকাংশ মুসলমান শান্তিপ্রিয় এবং তারা এসব মোটেই সমর্থন করেন না কিন্তু প্রকাশ্যে বলতে ভয় পান। এই ভয় ভাঙ্গাতে পারেন মুসলিম সম্প্রদায়ের চিন্তাশীল মানুষরাই। হিন্দু বা অন্য কোনো ধর্মের লোকেরা এ বিষয়ে যত সমালোচনা করবেন ততই ভয়ের মানসিকতা , অপছন্দ ও হিংসার মানসিকতা আরো তীব্র হবে। আমি রাজনীতির নেতা ও ধর্মব্যবসায়ীদের উপর একেবারেই আস্থাশীল নই। তারা এই ভয়কে কাজে লাগিয়ে নিজেদের আখের গোছাতে ব্যস্ত। এদেশের ইতিহাসে এর সবথেকে বড় উদাহরণ মহম্মদ আলি জিন্নাহ। আপাদমস্তক সেকুলার এই মানুষটি ক্ষমতার লোভ ও ইতিহাসের হাতছানি উপেক্ষা করতে না পেরে প্রতিষ্ঠা করে গেলেন এমন একটি ধর্ম ভিত্তিক রাষ্ট্র পাকিস্তানের যার বিষময় ফল আজ পর্যন্ত এই উপমহাদেশের মানুষ ভোগ করে চলেছেন। দুটি গরীব ও উন্নয়শীল দেশ তার জাতীয় সম্পদের একটি মোটা অংশ ব্যয় করছে সেনাবাহিনী পোষার জন্য এবং গোলাবারুদ কেনার জন্য। এই বিপুল পরিমাণ অর্থ মানুষের মঙ্গলের কাজে লাগানো যেত।
আমাদের বেশিরভাগ মানুষের সেকুলারিজম skin-deep জানি না এর বাংলা কি কোরব। মীটিং, মিছিল, সেমিনার-সিম্পোসিয়াম, প্রবন্ধ কবিতায় আমরা বেশ অসাম্প্রদায়িক। কিন্তু যেখানে ‘বাঘের ভয়’ সেখানে কিন্তু আমাদের সেকুলারিজমের ‘সন্ধ্যা’ নেমে আসে। এই দেখুন যারা গরু নিয়ে কথা বলতে বেশ উতসাহী তাদের কাছে শুয়োর ‘হারাম’। উচ্চারণ করতেই চাইবেন না। যারা গো-মাতার ভক্ত তাদের যদি বলেন প্রাচীন কালে আর্যরা গরুর মাংস খেত তেড়ে আসবেন তারা। অষ্টমীর সন্দিক্ষণে মোষ বলি দেবার রেওয়াজ আছে এবং তা হিন্দুরাই পালন করেন। রামায়ণ ও মহাভারতে দিগ্বিজয়ের শেষে বিজয়ী অশ ফিরে এলে তাকে বলি দেওয়া হোত ‘অশ্বমেধ’ যজ্ঞ করে। মেধ মানে তো বলি। সে মাংস কারা খেত? কিন্তু কেউ শান্তভাবে শুনলে তবেই তো যুক্তির কথা বলা যায়!
আসুন আয়নায় মুখ দেখি নিজেদের। দেখা দরকার কে কোথায় দাঁড়িয়ে।সিংহাবলোকন ।
ইংরাজীতে একটা সুন্দর অর্থবহ শব্দ আছে panacea যার অর্থ সর্বরোগহর একটি ওষুধ। সেকুলারিজম panacea নয়। রাষ্ট্রীয় আদর্শ আর বাস্তবের মানুষের বিশ্বাস ও আচরণ এক কদাচিত হয়। যেমন ‘মীটিং কা কাপড়া’ আলাদা তোলা থাকে তেমনি সেকুলারিজম ধারণাটি আমরা ব্যবহার করি তোলা জামা কাপড়ের মত। আমাদের জীবন চর্চায় ও চর্যায়, বিশ্বাসে ও আচরণে যতদিন না আমরা প্রকৃত সেকুলার হতে পারছি ততদিন নানা রূপে বিরোধের বীভৎস মুখ বারবার বেরিয়ে পড়বে। ভারতবর্ষ এক প্রাচীন উন্নত সভ্যতার ধারক বাহক ও উত্তরাধিকারী। এ দেশের Ethos (ইথোজ) বা মর্মচেতনায় উগ্র ধর্মান্ধতা নেই।ধর্মহীনতাও নেই। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে দলবদ্ধভাবে মানুষ এদেশে এসেছে। সঙ্গে নিয়ে এসেছে নানান সভ্যতা, নানান কৃষ্টি । লুটেরারাও এসেছে। আবার লুটপাঠ করে অনেকে চলেও গেছে। বেশিরভাগই স্থায়ীভাবে এদেশের মাটিতে শিকড় গেড়েছে। বিভিন্ন সভ্যতা ও ধর্মসংস্কৃতির মধ্যে মাঝে মাঝে লড়াই সংঘর্ষ হয়েছে আবার সমান্তরালভাবে একটা সমণ্বয়ের সাধনাও নিরবচ্ছিন্নভাবে চলেছে। সব মিলিয়ে প্রায় চারশ বছরের মুসলমান শাসন বা পরবর্তী সময়ে একশো নব্বই বছরের ইংরেজ শাসনে এদেশের আপামর জনসাধারণ নিজেদের ঐতিহ্য ও ধর্ম সংস্কৃতি বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছে তার কারণ সনাতন ধর্মের বা হিন্দু জীবন দর্শনের অন্তর্নিহিত শক্তি ও আধ্যত্মিক সম্পদের বলে। যারা এই মূল ব্যাপারটা অনুধাবন করতে পারেন না তারাই হিন্ধু জীবন দর্শনকে আর একটি সেমিটিক রিলিজিওনের মত কোডিফাই করার ব্যর্থ চেষ্টা করেন। হিন্দু বা সনাতন দর্শনের শক্তি ও সামর্থ্য সম্পর্কে যাদের কোনো ধারণাই নেই তারাই এই জীবন দর্শনকে ‘হিন্দুয়ায়ন’ করার চেষ্টা করছেন। যদি এরা রাজনইতিক শক্তির সহায়তায় এই মেটামরফসিস (metamorphosis) করে ফেলতে পারেন সেদিন ভারতবর্ষ আর ভারতবর্ষ থাকবে না। যেটুকু ইতিহাস বুঝি তাতে আমি নিশ্চিত এই অপচেষ্টা সফল হবে না। সতত প্রবহমানা নদীতে বাঁধ দেওয়া যায় না।
এই আলোচনার উপসংহার টানা খুব কঠিন কাজ। আমার মনে হয়েছে কিছু কথা আছে যা আমাদের পীড়িত, ক্ষুব্ধ ও উদ্বেলিত করে কিন্তু সাহস করে বলতে চাই না। নানা ভদ্র শালীন কথার আড়ালে নিজেদের আসল চেহারা ঢেকে রাখি।অথচ বলা দরকার। আসুন নিজেদের প্রশ্ন করি আমাদের কতজনের খুব অন্তরঙ্গ ‘বিধর্মী’ বন্ধু আছে যাদের আনাগোনা আমাদের অন্দরমহল পর্যন্ত। আমাদের পড়শিকে কতটুকু চিনি আমরা? কতটুকুই বা চেনার চেষ্টা করি?
নিজ নিজ ধর্মকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম ধর্ম রূপে ভাবতে আমরা ভালবাসি। এতে আমি দোষ দেখি না কিন্তু অপরের ধর্ম ও জীবনদর্শন সম্পর্কে কিছু না জেনেবুঝে আলগা মন্তব্য করা থেকেই অনেক সমস্যার সৃষ্টি হয়।
অনেকের মুখেই শুনবেন ‘নেড়ে’,’মোছলমান’,’গরু খায়’,’একমাত্র জুতোয় সোজা’ –এই জাতীয় অবমাননাসুচক নিম্নরুচির মন্তব্য যা মানুষকে আহত করে। বিপ্রতীপে,’ কাফির’,’ হিদেন’,’পুতুল পুজক’,’ ‘মালাউন’ জাতীয় অপমানসূচক মন্তব্য। এমনকি তথাকথিত শিক্ষিত মানুষের মুখেও আমি এসব কথা শুনে থাকি। এখনো। বন্ধুত্ব হবে কি করে? বড়দিনের উৎসবে যোগ দিতে আমরা সানন্দে রাজী হই। ‘হ্যাপী ক্রিসমাস’ আনন্দের সঙ্গে বলি। মুসলিম দোকান গুলিতে বড়দিনের এবং নিউ ইয়ার’স এর কেক প্যাস্ট্রি বিক্রী হয় কিন্তু পুজোর ফুল বাতাসা প্রসাদ বিক্রি হয় না। সিমুই বিক্রী হয় হিন্দুর দোকানে, গরুর মাংস নয়। জবাই না বলির পাঁটা তা নিয়ে আমাদের মধ্যে তুলকালাম বেঁধে যায় । আমি একটা NSS Camp-এ যোগ দিতে গিয়ে এ সমস্যা ভোগ করেছি। রাশানালিটি কাজ করে না। অথচ ঐ ক্যাম্পে সকলেই ছিল কলেজ পড়ুয়া ছাত্র।খুব বিষণ্ণ বোধ করি এসবে। তবুও এটা একটা বাস্তবতা। হিন্দুর পুজোয় যে পুতুলগুলি দেবদেবী রূপে আরাধিত এবং পূজিত হয় সেগুলি ‘প্রাণ প্রতিষ্ঠা’র আগে এবং উৎসবের দিনক্ষণ পেরিয়ে যাবার পরে আবার পুতুল। কিন্তু ‘প্রাণ প্রতিষ্ঠার’ পরের সময়কালে এবং বিশ্বাসীর মানসভুমিতে তাঁরা দেবতা ও দেবী। এই ব্যাপারটা বুঝতে হবে এবং শ্রদ্ধা করতে হবে। ঠিক তেমনি বুঝতে হবে মহরম , ঈদ এবং হজ করা একজন মুসলমানের কাছে কতখানি মূল্যবান। বিশ্বাস এবং আবেগের সাথে যুক্তিতর্কের বিরোধ চিরন্তন। নানা সমস্যায় জর্জরিত মানুষের জীবন থেকে তাদের বিশ্বাস ও আবেগ জোর করে কেড়ে নেওয়া যাবে না। কত ভালই না হোত আমরা সকলেই যদি এইসব অতিপ্রাকৃত বিশ্বাসের রহস্যময় দুর্জ্ঞেয়তা থেকে মুক্ত হতে পারতাম! তা যখন হয় নি বা যতদিন না হচ্ছে ততদিন একে অপরের বিশ্বাস এবং আস্থাকে তাচ্ছিল্য ও ঘৃণা না করে বন্ধুর মত, সুপ্রতিবেশীর মত বোঝার চেষ্টা করা ভাল! একে অপরের উৎসবে শরীক হয়ে আনন্দ ভাগ করে নিতে পারতাম যদি খানিকটা বন্ধুত্ব বাড়ত! না, আমি রাজনৈতিক ইফতার বা রাজনৈতিক বিজয়া সম্মীলনীর কথা বলছি না। এসব ভন্ডামি তো হচ্ছেই। তাতে মনের দূরত্ব কমল কই?
মাঠেঘাটে, চায়ের দোকানে, ট্রেনে বাসে নানান আড্ডায় একটা মুখরোচক আলোচনার বিষয় তিন তালাক এবং চারটি বিবাহ। মুসলিম শরীয়ত অনুমোদিত। কোডিফাইড সেমিটিক রিলিজিওনের একটি ইনট্রিনসিক বা মজ্জাগত সমস্যা হোল ধর্ম পুস্তকে যা লেখা আছে তা বদলানো যাবে না। কোরাআনের বাণী বা বাইবেলের বাণী ধ্রুব সত্য। অজর অক্ষয় অমর। অতএব অলঙ্ঘনীয়-sacrosanct
সমস্যার অন্যতম জড় এইখানে। মুস্কিল আরো আছে।বিভিন্ন পন্ডিত বিভিন্ন ব্যাখ্যা এনে হাজির করছেন। কার কথা শুনবেন? একই ধর্মের মধ্যে আবার নানা উপদল সম্পৃক্ত হয়ে আছে। শিয়া ও সুন্নির লড়াইতো একে অপরকে বিনাশ করার চেষ্টায় লিপ্ত। এক গোষ্ঠীর লোক অন্য গোষ্ঠীর মসজিদ ও উপাসনালয় পর্যন্ত ধংস করে দিতে কুন্ঠিত হচ্ছে না। আলোচনায় এসব কথাও উঠে আসছে সমালোচনা ও হেয় করার মানসিকতা নিয়ে। বিরোধের ও অবিশ্বাসের ক্ষেত্র ক্রমেই বেড়ে চলেছে।
পৃথিবীর অন্তত একুশটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে তিনতালাক বৈধ নয়। পাকিস্তানেও নয়। এক বিশেষ পরিস্থিতিতে চারটি বিয়ের অনুমতি দেওয়া হয়েছিল ইসলাম ধর্মের জন্মের সূচনাকালে। অনেক অনেকদিন আগে থাকতেই সে পরিস্থিতির আমূল পরিবর্তন ঘটে গেছে। এই সব মান্ধাতার আমলের প্রথা যে এখনো টিকে আছে তার কারণ মুসলিম পুরুষদের কায়েমী স্বার্থ।
যে সমস্যকে কেন্দ্রে রেখে এই আলোচনা শুরু করেছিলাম তাহল রামনবমী, মহরম ও সেকুলারিজম। অস্ত্রহাতে রামনবমীর মিছিল এবং অস্ত্রহাতে মহরমের মিছিল একদিকে চলতে থাকুক আর অন্যদিকে রাষ্ট্র সেকুলারিজম প্রতিষ্ঠা করতে সচেষ্ট থাকুক তাহলেই একটা সমাধানের পথ আমরা খুঁজে পাব- এটা নেহাতই অতিসরলীক্রিত ধারণা। সেমিনারে সিম্পোসিয়ামে আলোচিত ও হাতালিত হতে পারে কিন্তু বাস্তবোচিত নয়। কেন নয় সেটা বুঝতে গেলে ইসলাম ধর্মের মুল কয়েকটি কথা বুঝতে চেষ্টা করতে হবে। পবিত্র কোরআন আল্লাহর পবিত্র বাণী ও নির্দেশ। মুসলিম মাত্রেই এই বিশ্বাসে অনড়। হাদিস বা হাদীথ আল্লাহর শেষ নবী হযরত মহম্মদের জীবনাচরণ ও উপদেশাবলীর সংকলন এবং শারিয়া বা শারীয়ত ইসলামিক আইন যা কোরানের নির্দেশ ও শিক্ষা অনুসারে রচিত। একজন বিশ্বাসী মুসলমানের জীবন এই তিনটি মূল আদর্শ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এখানে সেকুলারিজমের কোনো স্থান নেই। রবীন্দ্রনাথ বা কাজী নজরুল ইসলাম আবেগী উদারতায় হিন্দু মুসলিম ঐক্যের স্বপ্ন দেখতেই পারেন কিন্তু সেই কাজটা খুব সহজ নয় বাস্তবায়িত করা। শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান সম্ভব আইনের শাসনের আওতায় থেকে কিন্তু অরগানিক মিলন সম্ভব নয়। এই বাস্তব কথাটা আমাদের মানতে হবে। পছন্দ করি বা না করি।
আর একটা কথা। ইদানীং সমাজে যে উগ্রতার প্রকাশ দেখা যাচ্ছে বিশেষ করে হিন্দুদের একাংশের মধ্যে তার পিছনে একটা পারসেপশানের ব্যাপার আছে। জওহরলাল নেহরুর আমল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত এদেশে সেকুলারিজমের নামে সংখ্যালঘু মুসলিম তোষণ করা হয়েছে এরকম একটা পারসেপশান বা বেদন বা কল্পমূর্তি বেশ কিছু মানুষের মধ্যে বদ্ধমূল হয়েছে। এদেশের মুসলিম ধর্মনেতারা এজন্য অনেকখানি দায়ী। তথাকথিত প্রগতিশীল ইন্টেলেকচুয়ালরাও এই ধারণা তৈরি করতে পরোক্ষে সাহায্য করেছেন। শাহবানু মামলা, কাশ্মীর নিয়ে এদের তাত্বিক অবস্থান , ইত্যাদি নানা বিষয়ে এদের অবস্থান ও কেন্দ্রীয় সরকারের দোদুল্যমানতা সবকিছু মিলে তালগোল পাকিয়ে এই পারসেপশান সৃষ্টি হয়েছে। যে কারণে অনেক সরল ও শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষকেও বলতে শুনি,’ না, বাপু এতখানি তোষণ ভাল নয়।‘ এর সঙ্গে যোগ হয়েছে তিন তালাক ও বহুবিবাহের বিরুদ্ধে সংখ্যা গরিষ্ঠ মানুষের আপত্তি। শিক্ষিত ও সচেতন মুসলিমদের গরিষ্ঠ অংশ এসব সমর্থন করেন না কিন্তু প্রকাশ্যে তারা মত প্রকাশ করতে চান না। এক ধরণের ভয় কাজ করে। যুক্তি যেখানে শেষ হয় হিংসার শুরু সেখান থেকেই। এই যে সারা মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে নানারকম আতংকবাদী চক্র হিংসাত্মকো ধ্বংসাত্মক কাজ করে চলেছে তার বিরুদ্ধে মুসলিম ইন্টেলেকচ্যুয়াল বা সাধারণ শিক্ষিত মুসলিমদের বড় অংশ মুখ খোলেন না। এই কারণেও এমন একটা পারসেপশান তৈরি হয়েছে যে এরা বুঝি এসব সমর্থন করেন। ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় দেখবেন যে অধিকাংশ মুসলমান শান্তিপ্রিয় এবং তারা এসব মোটেই সমর্থন করেন না কিন্তু প্রকাশ্যে বলতে ভয় পান। এই ভয় ভাঙ্গাতে পারেন মুসলিম সম্প্রদায়ের চিন্তাশীল মানুষরাই। হিন্দু বা অন্য কোনো ধর্মের লোকেরা এ বিষয়ে যত সমালোচনা করবেন ততই ভয়ের মানসিকতা , অপছন্দ ও হিংসার মানসিকতা আরো তীব্র হবে। আমি রাজনীতির নেতা ও ধর্মব্যবসায়ীদের উপর একেবারেই আস্থাশীল নই। তারা এই ভয়কে কাজে লাগিয়ে নিজেদের আখের গোছাতে ব্যস্ত। এদেশের ইতিহাসে এর সবথেকে বড় উদাহরণ মহম্মদ আলি জিন্নাহ। আপাদমস্তক সেকুলার এই মানুষটি ক্ষমতার লোভ ও ইতিহাসের হাতছানি উপেক্ষা করতে না পেরে প্রতিষ্ঠা করে গেলেন এমন একটি ধর্ম ভিত্তিক রাষ্ট্র পাকিস্তানের যার বিষময় ফল আজ পর্যন্ত এই উপমহাদেশের মানুষ ভোগ করে চলেছেন। দুটি গরীব ও উন্নয়শীল দেশ তার জাতীয় সম্পদের একটি মোটা অংশ ব্যয় করছে সেনাবাহিনী পোষার জন্য এবং গোলাবারুদ কেনার জন্য। এই বিপুল পরিমাণ অর্থ মানুষের মঙ্গলের কাজে লাগানো যেত।
আমাদের বেশিরভাগ মানুষের সেকুলারিজম skin-deep জানি না এর বাংলা কি কোরব। মীটিং, মিছিল, সেমিনার-সিম্পোসিয়াম, প্রবন্ধ কবিতায় আমরা বেশ অসাম্প্রদায়িক। কিন্তু যেখানে ‘বাঘের ভয়’ সেখানে কিন্তু আমাদের সেকুলারিজমের ‘সন্ধ্যা’ নেমে আসে। এই দেখুন যারা গরু নিয়ে কথা বলতে বেশ উতসাহী তাদের কাছে শুয়োর ‘হারাম’। উচ্চারণ করতেই চাইবেন না। যারা গো-মাতার ভক্ত তাদের যদি বলেন প্রাচীন কালে আর্যরা গরুর মাংস খেত তেড়ে আসবেন তারা। অষ্টমীর সন্দিক্ষণে মোষ বলি দেবার রেওয়াজ আছে এবং তা হিন্দুরাই পালন করেন। রামায়ণ ও মহাভারতে দিগ্বিজয়ের শেষে বিজয়ী অশ ফিরে এলে তাকে বলি দেওয়া হোত ‘অশ্বমেধ’ যজ্ঞ করে। মেধ মানে তো বলি। সে মাংস কারা খেত? কিন্তু কেউ শান্তভাবে শুনলে তবেই তো যুক্তির কথা বলা যায়!
আসুন আয়নায় মুখ দেখি নিজেদের। দেখা দরকার কে কোথায় দাঁড়িয়ে।সিংহাবলোকন ।
ইংরাজীতে একটা সুন্দর অর্থবহ শব্দ আছে panacea যার অর্থ সর্বরোগহর একটি ওষুধ। সেকুলারিজম panacea নয়। রাষ্ট্রীয় আদর্শ আর বাস্তবের মানুষের বিশ্বাস ও আচরণ এক কদাচিত হয়। যেমন ‘মীটিং কা কাপড়া’ আলাদা তোলা থাকে তেমনি সেকুলারিজম ধারণাটি আমরা ব্যবহার করি তোলা জামা কাপড়ের মত। আমাদের জীবন চর্চায় ও চর্যায়, বিশ্বাসে ও আচরণে যতদিন না আমরা প্রকৃত সেকুলার হতে পারছি ততদিন নানা রূপে বিরোধের বীভৎস মুখ বারবার বেরিয়ে পড়বে। ভারতবর্ষ এক প্রাচীন উন্নত সভ্যতার ধারক বাহক ও উত্তরাধিকারী। এ দেশের Ethos (ইথোজ) বা মর্মচেতনায় উগ্র ধর্মান্ধতা নেই।ধর্মহীনতাও নেই। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে দলবদ্ধভাবে মানুষ এদেশে এসেছে। সঙ্গে নিয়ে এসেছে নানান সভ্যতা, নানান কৃষ্টি । লুটেরারাও এসেছে। আবার লুটপাঠ করে অনেকে চলেও গেছে। বেশিরভাগই স্থায়ীভাবে এদেশের মাটিতে শিকড় গেড়েছে। বিভিন্ন সভ্যতা ও ধর্মসংস্কৃতির মধ্যে মাঝে মাঝে লড়াই সংঘর্ষ হয়েছে আবার সমান্তরালভাবে একটা সমণ্বয়ের সাধনাও নিরবচ্ছিন্নভাবে চলেছে। সব মিলিয়ে প্রায় চারশ বছরের মুসলমান শাসন বা পরবর্তী সময়ে একশো নব্বই বছরের ইংরেজ শাসনে এদেশের আপামর জনসাধারণ নিজেদের ঐতিহ্য ও ধর্ম সংস্কৃতি বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছে তার কারণ সনাতন ধর্মের বা হিন্দু জীবন দর্শনের অন্তর্নিহিত শক্তি ও আধ্যত্মিক সম্পদের বলে। যারা এই মূল ব্যাপারটা অনুধাবন করতে পারেন না তারাই হিন্ধু জীবন দর্শনকে আর একটি সেমিটিক রিলিজিওনের মত কোডিফাই করার ব্যর্থ চেষ্টা করেন। হিন্দু বা সনাতন দর্শনের শক্তি ও সামর্থ্য সম্পর্কে যাদের কোনো ধারণাই নেই তারাই এই জীবন দর্শনকে ‘হিন্দুয়ায়ন’ করার চেষ্টা করছেন। যদি এরা রাজনইতিক শক্তির সহায়তায় এই মেটামরফসিস (metamorphosis) করে ফেলতে পারেন সেদিন ভারতবর্ষ আর ভারতবর্ষ থাকবে না। যেটুকু ইতিহাস বুঝি তাতে আমি নিশ্চিত এই অপচেষ্টা সফল হবে না। সতত প্রবহমানা নদীতে বাঁধ দেওয়া যায় না।
এই আলোচনার উপসংহার টানা খুব কঠিন কাজ। আমার মনে হয়েছে কিছু কথা আছে যা আমাদের পীড়িত, ক্ষুব্ধ ও উদ্বেলিত করে কিন্তু সাহস করে বলতে চাই না। নানা ভদ্র শালীন কথার আড়ালে নিজেদের আসল চেহারা ঢেকে রাখি।অথচ বলা দরকার। আসুন নিজেদের প্রশ্ন করি আমাদের কতজনের খুব অন্তরঙ্গ ‘বিধর্মী’ বন্ধু আছে যাদের আনাগোনা আমাদের অন্দরমহল পর্যন্ত। আমাদের পড়শিকে কতটুকু চিনি আমরা? কতটুকুই বা চেনার চেষ্টা করি?
নিজ নিজ ধর্মকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম ধর্ম রূপে ভাবতে আমরা ভালবাসি। এতে আমি দোষ দেখি না কিন্তু অপরের ধর্ম ও জীবনদর্শন সম্পর্কে কিছু না জেনেবুঝে আলগা মন্তব্য করা থেকেই অনেক সমস্যার সৃষ্টি হয়।
অনেকের মুখেই শুনবেন ‘নেড়ে’,’মোছলমান’,’গরু খায়’,’একমাত্র জুতোয় সোজা’ –এই জাতীয় অবমাননাসুচক নিম্নরুচির মন্তব্য যা মানুষকে আহত করে। বিপ্রতীপে,’ কাফির’,’ হিদেন’,’পুতুল পুজক’,’ ‘মালাউন’ জাতীয় অপমানসূচক মন্তব্য। এমনকি তথাকথিত শিক্ষিত মানুষের মুখেও আমি এসব কথা শুনে থাকি। এখনো। বন্ধুত্ব হবে কি করে? বড়দিনের উৎসবে যোগ দিতে আমরা সানন্দে রাজী হই। ‘হ্যাপী ক্রিসমাস’ আনন্দের সঙ্গে বলি। মুসলিম দোকান গুলিতে বড়দিনের এবং নিউ ইয়ার’স এর কেক প্যাস্ট্রি বিক্রী হয় কিন্তু পুজোর ফুল বাতাসা প্রসাদ বিক্রি হয় না। সিমুই বিক্রী হয় হিন্দুর দোকানে, গরুর মাংস নয়। জবাই না বলির পাঁটা তা নিয়ে আমাদের মধ্যে তুলকালাম বেঁধে যায় । আমি একটা NSS Camp-এ যোগ দিতে গিয়ে এ সমস্যা ভোগ করেছি। রাশানালিটি কাজ করে না। অথচ ঐ ক্যাম্পে সকলেই ছিল কলেজ পড়ুয়া ছাত্র।খুব বিষণ্ণ বোধ করি এসবে। তবুও এটা একটা বাস্তবতা। হিন্দুর পুজোয় যে পুতুলগুলি দেবদেবী রূপে আরাধিত এবং পূজিত হয় সেগুলি ‘প্রাণ প্রতিষ্ঠা’র আগে এবং উৎসবের দিনক্ষণ পেরিয়ে যাবার পরে আবার পুতুল। কিন্তু ‘প্রাণ প্রতিষ্ঠার’ পরের সময়কালে এবং বিশ্বাসীর মানসভুমিতে তাঁরা দেবতা ও দেবী। এই ব্যাপারটা বুঝতে হবে এবং শ্রদ্ধা করতে হবে। ঠিক তেমনি বুঝতে হবে মহরম , ঈদ এবং হজ করা একজন মুসলমানের কাছে কতখানি মূল্যবান। বিশ্বাস এবং আবেগের সাথে যুক্তিতর্কের বিরোধ চিরন্তন। নানা সমস্যায় জর্জরিত মানুষের জীবন থেকে তাদের বিশ্বাস ও আবেগ জোর করে কেড়ে নেওয়া যাবে না। কত ভালই না হোত আমরা সকলেই যদি এইসব অতিপ্রাকৃত বিশ্বাসের রহস্যময় দুর্জ্ঞেয়তা থেকে মুক্ত হতে পারতাম! তা যখন হয় নি বা যতদিন না হচ্ছে ততদিন একে অপরের বিশ্বাস এবং আস্থাকে তাচ্ছিল্য ও ঘৃণা না করে বন্ধুর মত, সুপ্রতিবেশীর মত বোঝার চেষ্টা করা ভাল! একে অপরের উৎসবে শরীক হয়ে আনন্দ ভাগ করে নিতে পারতাম যদি খানিকটা বন্ধুত্ব বাড়ত! না, আমি রাজনৈতিক ইফতার বা রাজনৈতিক বিজয়া সম্মীলনীর কথা বলছি না। এসব ভন্ডামি তো হচ্ছেই। তাতে মনের দূরত্ব কমল কই?
মাঠেঘাটে, চায়ের দোকানে, ট্রেনে বাসে নানান আড্ডায় একটা মুখরোচক আলোচনার বিষয় তিন তালাক এবং চারটি বিবাহ। মুসলিম শরীয়ত অনুমোদিত। কোডিফাইড সেমিটিক রিলিজিওনের একটি ইনট্রিনসিক বা মজ্জাগত সমস্যা হোল ধর্ম পুস্তকে যা লেখা আছে তা বদলানো যাবে না। কোরাআনের বাণী বা বাইবেলের বাণী ধ্রুব সত্য। অজর অক্ষয় অমর। অতএব অলঙ্ঘনীয়-sacrosanct
সমস্যার অন্যতম জড় এইখানে। মুস্কিল আরো আছে।বিভিন্ন পন্ডিত বিভিন্ন ব্যাখ্যা এনে হাজির করছেন। কার কথা শুনবেন? একই ধর্মের মধ্যে আবার নানা উপদল সম্পৃক্ত হয়ে আছে। শিয়া ও সুন্নির লড়াইতো একে অপরকে বিনাশ করার চেষ্টায় লিপ্ত। এক গোষ্ঠীর লোক অন্য গোষ্ঠীর মসজিদ ও উপাসনালয় পর্যন্ত ধংস করে দিতে কুন্ঠিত হচ্ছে না। আলোচনায় এসব কথাও উঠে আসছে সমালোচনা ও হেয় করার মানসিকতা নিয়ে। বিরোধের ও অবিশ্বাসের ক্ষেত্র ক্রমেই বেড়ে চলেছে।
পৃথিবীর অন্তত একুশটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে তিনতালাক বৈধ নয়। পাকিস্তানেও নয়। এক বিশেষ পরিস্থিতিতে চারটি বিয়ের অনুমতি দেওয়া হয়েছিল ইসলাম ধর্মের জন্মের সূচনাকালে। অনেক অনেকদিন আগে থাকতেই সে পরিস্থিতির আমূল পরিবর্তন ঘটে গেছে। এই সব মান্ধাতার আমলের প্রথা যে এখনো টিকে আছে তার কারণ মুসলিম পুরুষদের কায়েমী স্বার্থ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন