শনিবার, ১১ জানুয়ারী, ২০২০

হিন্দু রাষ্ট্র ~ মধুশ্রী বন্দোপাধ্যায়

আমি চাই না ভারতবর্ষ হিন্দু রাষ্ট্র হোক। 

আমি চাই না ভারতবর্ষ হিন্দু রাষ্ট্র হোক, কারণ আমি এই দেশকে ভালবাসি। 

আমি ভালবাসি এই দেশের প্রাচীন দর্শন, তার ইতিহাস, তার প্রাগিতিহাস। ভারতবর্ষের ইতিহাস, দর্শন, ধর্ম, জাতি, জ্ঞান - কোনকিছু একমুখী নয়। একরূপ নয়।

ধর্মে সে একেশ্বর, নিরীশ্বর, বহু-ঈশ্বরবাদী। বৈদিক উপনিষদ ও বেদ-বিরোধী বৌদ্ধধর্ম, দুই দর্শনেরই জন্ম ভারতবর্ষ। 

আর হরপ্পার মূর্তিপূজা মিশ্রিত হয়ে গেছে মূর্তিপূজাহীন বৈদিক দর্শনের সাথে। তার সাথে এসেছে চার্বাকপন্থী লোকায়ত দর্শন।

যখন এই দেশে জ্ঞানচর্চার পথ ছিল সুগম তখন আরও বিভিন্ন চিন্তার সমাবেশ হয়েছে। তারা শুধু বিশ্বাস করত না। তারা গভীর জ্ঞান অর্জন করতে চাইত। জানতে চাইত, উত্তর খুঁজত পৃথিবীর প্রাচীনতম, জটিলতম প্রশ্নগুলির। 

মানুষ তখন জীবনে ইচ্ছামত ধর্ম পরিবর্তন করতে পারত। এই দেশের প্রথম রাজারা বারেবারে ধর্ম পরিবর্তন করেছে। অশোক করেছে, তার বাবা করেছে, তার ঠাকুরদা করেছে। 

ব্রুনোকে আগুনে পুড়িয়ে মারবার দুই হাজার বছর আগে এই দেশে এক মহাপুরুষ উচ্চারণ করেছেন, 'এই মহাবিশ্ব এক continuum, আগে ছিল, এখনো আছে।' তার জন্য তাকে কেউ পুড়িয়ে মারে নি। 

এই দেশে কোন কিছু একমুখী নয়, পড়তের উপরে আছে পড়ত। 

এদের সবাইকে নিয়ে ভারতবর্ষ টিঁকে আছে। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা বন্ধ হলে, আলোচনা ও চর্চা বন্ধ হলে সেই দেশ শুকিয়ে যাবে। 

ভারতবর্ষের মানুষের শরীরে আছে আফ্রিকান শিকারী-সংগ্রাহক, ইরানীয় শিকারী-সংগ্রাহক, ইন্দো-ইউরোপীয় পশুপালক, অস্ট্রো-এশিয়াটিক কৃষিজীবী, তিব্বতী-বর্মী মাতৃতান্ত্রিক গোষ্ঠীর জীন।
এই উপমহাদেশ ছাড়া এতো মিশ্রণ পৃথিবীর কোন দেশে, কোন অঞ্চলে নেই। 

এই দেশের মানুষ কথা বলে আদিম প্রোটো -জারোয়া, প্রাচীন দ্রাবিড়ীয়, সুললিত বৈদিক সংস্কৃত, অস্ট্রো-এশিয়াটিক, সিনো-তিব্বতী ভাষায়।

প্রশ্ন চাই, প্রশ্ন বন্ধ করা যায় না।

জাবালি প্রশ্ন করেছেন, বুদ্ধ করেছেন, মহাবীর, চার্বাক ও আজীবিক মতবাদ প্রশ্ন করেছে। যেই দেশ, যেই জীবনচর্চা, যে ধর্ম, যে জাতি প্রশ্ন করে না, শুধু মেনে নেয়, শুধু বিশ্বাস করে তার ধ্বংস অনিবার্য। আজ না হয় কাল।

হিন্দু রাষ্ট্র, ধর্ম রাষ্ট্র ভারতবর্ষকে করে তুলবে মৌলবাদী, এক মুখী। তখন প্রশ্ন উঠবে নারীদের নিয়ে, জ্ঞানের চর্চা নিয়ে, জাত নিয়ে, খাদ্যাখাদ্য নিয়ে। আমি সেই ভারত চাই না।

আমি ভারতবর্ষের ধ্বংস চাই না। 

আমি ভারতবর্ষের সাথে পাকিস্তানের তুলনা চাই না। পাকিস্তান এক দুর্ভাগা দেশ। তার দুই নোবেল লরিয়েটকে সে দেশ থেকে তাড়িয়েছে। তার মা-বোনেরা কাপড়ের আড়ালে বন্দী। আমি তাদের প্রতি গভীর সহানুভূতিশীল। আমি চাই না আমার দেশের মেয়েরা ধর্মের নামে বন্দী হোক।

উল্লেখ করছি নবম শতকের জৈন দার্শনিক জীনসেনের উক্তি, পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ মহাজাগতিক জ্যোতির্বিজ্ঞানী কার্ল সেগান তার গ্রন্থ কসমসে এটি উল্লেখ করেছেন -

" Some foolish men declare that a creator made the world. The doctrine that the world was created is ill-advised, and should be rejected. If god created the world, where was he before creation? If you say he was transcendent then, and needed no support, where is he now? "

নবম শতকের ভারতীয় দার্শনিক যিনি প্রচলিত মতবাদ, গতেধরা চিন্তার বিরুদ্ধে কথা বলেছেন, আমেরিকান জ্যোতির্বিদ বিংশ শতকে বই লিখেছেন তার উক্তি স্মরণ করে, কোন ইউরোপীয়র নয়। 

এটাই ভারতের শক্তি; যেদিন থেকে সে ধর্ম রাষ্ট্র হবে সেদিন থেকে সে পিছন  দিকে হাঁটতে থাকবে। 
যেমন এখন হাঁটছে, প্রাচীন সভ্যতার অন্যতম পীঠস্থান - কত আশা জাগানো আতার্তুকের তুরস্ক।  

সকল মানুষকে প্রশ্ন করতে হবে - রাষ্ট্রকে, অবিজ্ঞানকে আর সবচাইতে বেশি করে করতে হবে নিজেকে।

Madhusree Bandyopadhyay
11/01/2020

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন