বোলসোনারো সম্পর্কে দুতিনটে বিষয় যা জানি
জাইর বোলসোনারো সম্পর্কে তাঁর নারী এবং সমকামবিদ্বেষ, পরিবেশধ্বংসী কাজকর্মের কথাই আসে মূলত, অর্থাৎ যা দেখা যায়। যা দেখা যায় না তা হল এর উৎস, নদী তুমি কোথা হইতে আসিয়াছ। বোলসোনারো সাতের দশকের আবিশ্ব এবং আ-লাতিন ডিক্টেটরশিপের জীবাশ্মমাত্র নন, তিনি এর অবশেষ, এর স্মৃতি এবং বর্তমান, তিনি অতীতের দেহধারী। তাঁর মিলিটারি কেরিয়ার নিতান্তই হতাশাব্যঞ্জক, কিন্তু প্রকৃতিগতভাবে জনবিরোধী, দুর্নীতিগ্রস্ত এবং দায়িত্বহীন ক্ষমতার অধিকারী মিলিটারি রেজিমগুলির তিনি মানসিক উত্তরাধিকারী, বাহিনীতে কেমন সার্ভিস দিলেন কী এসে যায় তাতে?
বোলসোনারো একটি মহাদেশীয় আন্তর্জাতিক অগণতন্ত্রের অস্তিত্বে উৎসাহী, যেমন সাতের দশকে সবকটি লাতিন দেশের সামরিক সরকারের মধ্যে ছিল অপারেশন কণ্ডর, সেই অক্টোপাসের শুঁড় আপনাকে যে প্রান্তেই চলে যান টেনে আনবেই। এমনকি ইউরোপে নির্বাসনও নিরাপদ ছিল না, আর্জেন্টিনীয় ফিল্মমেকার হোরহে সেদরোন ফ্রান্সেও টিকতে পারেন নি। তাঁর আত্মীয় অপহৃত হন আর্জেন্টিনীয় উচ্চারণের কিছু রহস্যময় লোকের হাতে, আর প্যারিসীয় পুলিশ দপ্তর সাহায্যের বদলে জেরা করে তাঁকে পৌঁছে দেয় সেই আশ্চর্য চারতলায় যেখানে নিজেকে ছুরি মারতে একটুও অসুবিধা হবে না। ১৯৮১ তে হুলিও কোরতাসার একটি প্রবন্ধ লিখবেন এই আত্মঘাতীকে স্মরণ করে, পড়তে চাইলে সেজ গ্রুপের 'ইনডেক্স অন সেন্সরশিপ' ম্যাগাজিন দেখতে পারেন।
বোলসোনারো সব কয়টি মহাদেশীয় পুণ্যশ্লোক ডিক্টেটরকেই সশ্রদ্ধ স্মরণ করেন বারেবারেই, পেরুর আলবের্তো ফুজিমোরি, চিলের আউগুস্তো পিনোচেত, পারাগুয়াইয়ের আলফ্রেদো স্ত্রোয়েসনার। শেষোক্তজন, বিখ্যাত শিশুকামী ও টিনএজার-ধর্ষক তিনি, বিরোধীদের ইলেকট্রিক করাত দিয়ে খণ্ডবিখণ্ড করাতেন, সেটা টেলিফোনে শুনতেন এল প্রেসিদেন্তে, পরে তার রেকর্ড পাঠানো হত মৃতের আত্মীয়দের কাছে।
ব্রাজিলের ১৯৬৪ থেকে ১৯৮৫ র ডিক্টেটরশিপ নিয়ে ভারী খেদ আছে বোলসোনারোর, কেননা অত্যাচারকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেলেও ব্রাজিলীয় মিলিটারি রেজিমের হত্যার সংখ্যা কম, চিলে আর আর্জেন্টিনার বডি কাউণ্ট অনেক বেশি। তিনি আরও অনেক মৃত্যু চান। বোলসোনারো ১৯৬৪ র ক্যুয়ের দিনটিকে উদযাপন করেন, তিনি ও তাঁর ছেলে সেদিন জাতীয় পতাকা হাতে দাঁড়িয়ে থেকেছেন পার্লামেন্টে, যেখানে পাশেই অন্য এক সাংসদ দাঁড়িয়ে ছিলেন ফ্রায়ার তিতোর ছবি হাতে, ব্রাজিলীয় ডিক্টেটরশিপে নির্যাতিত ও নির্বাসিত যে ফ্রায়ারের ফ্রান্সে আত্মহত্যার গল্প আগে লিখেছি।
প্রাক্তন মানবাধিকার সচিব মারিয়া দে রোসারিওর উদ্দেশে বোলসোনারোর সেই বিখ্যাত "ওঁকে কেউ ধর্ষণ করবে না, উনি কুৎসিত" মন্তব্য কোন প্রসঙ্গহীন ঘটনা নয়। দক্ষিণ আমেরিকার মিলিটারি দশকে টর্চার ক্যাম্পগুলিতে যৌন নির্যাতনের আধিক্য প্রমাণিত। চিলের এক ধর্ষকামী সমাজবিরোধী ও গুপ্তচর সাক্ষাৎকারে তার বিরুদ্ধে ক্যাম্পে রাজনৈতিক কর্মীদের ধর্ষণ করার অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছিল, "এসব জঘন্য, নোংরা, পেচ্ছাপে মাখামাখি, পা বেয়ে রক্ত গড়ানো মেয়েদের কে ধর্ষণ করতে যাবে?" (টমাস সি. রাইটের 'স্টেট টেররিজম ইন ল্যাটিন আমেরিকা' দ্রষ্টব্য)।
এই মহাদেশে পরস্পর বিবদমান নানা রাজনৈতিক গ্রুপের মধ্যে বিসম্বাদ-হানাহানি অসহনীয় হয়ে উঠলে, সংলাপের রাস্তাটুকুও বন্ধ হয়ে গেলে সেখানে হস্তক্ষেপ করত ক্ষমতাভিলাষী মিলিটারি, উচ্চমধ্যবিত্ত গণপরিসর এবং মিডিয়ার একপ্রকার প্রশ্রয়েই, যেহেতু বোঝা যেত না কখন তাদের রাজদণ্ড একেবারে অনির্দিষ্টকালের জন্য পাকাপোক্ত হবে, বোঝা যেত না কখন তারা সব বেসামরিক দলের জন্যই রাজনৈতিক পরিসরটিই বন্ধ করে দেবে। কেউ কেউ, যেমন চিলে, ভেবেছিল প্রতিবেশী দেশগুলির মতো তারা কোনদিনই সামরিক শাসন দেখবে না, তাদের নিরবচ্ছিন্ন গণতন্ত্রই থেকে যাবে। আউগুস্তো পিনোচেত নামক ধূমকেতুর তখনো উদয় হয়নি।
জাইর বোলসোনারো এবং তাঁর সমকাল তাই এক চেকলিস্টও বটে। সবকটা বক্সে টিক পড়ছে কিনা তা দেখে নিতে হয় কেবল।
শেষ করার আগে মারিয়েল ফ্রাঙ্কোর কথা মনে পড়ল। এই বিরোধী রাজনৈতিক নেত্রী ২০১৮ র ১৪ই মার্চ রিওতেই কৃষ্ণাঙ্গী তরুণীদের রাজনৈতিক অংশগ্রহণের এক আলোচনা থেকে ফেরার পথে আক্রান্ত হন। একঝাঁক বুলেটবৃষ্টি তাঁর মৃত্যু নিশ্চিত করেছিল, সংশ্লিষ্টরা একটি ভিজিল্যান্টি মিলিশিয়া হিসেবে চিহ্নিত হয়, দুই আততায়ীই নাকি অতীতে মিলিটারি পুলিশে ছিল, দুজনকেই নাকি একদা পুরস্কৃত করেছিলেন বর্তমান প্রেসিডেন্টের পুত্র। বর্তমানে সেই তদন্ত কেমন চলবে আমি জানি না। কেবল জানি বর্তমান প্রেসিডেন্ট ছিলেন সেবছরের একমাত্র ভোটপ্রার্থী যিনি এই হত্যাকাণ্ডের নিন্দা করতে অস্বীকার করেন।
মারিয়েল ফ্রাঙ্কো কৃষ্ণাঙ্গী, উভকামী, সিঙ্গল মাদার। ফেলে আসা বছরে এই উজ্জ্বল তরুণীটির সঙ্গে তাঁর অনেকদিনের সমকামী পার্টনার মোনিকা বেনিসিওর বিয়ে হত।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন