১৩৩৩, ১৩ই ফাল্গুন (২৬ ফেব্রুয়ারি, ১৯২৮) কলকাতার সিটি কলেজ-সংলগ্ন রামমোহন ছাত্রাবাসে সরস্বতী-প্রতিমা স্থাপন করে পুজোর দাবিতে কলেজ-কর্তৃপক্ষ ও ছাত্রদের সংঘর্ষজনিত গোলযোগের সূত্রপাত হয়।
সিটি কলেজ ব্রাহ্মদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত একটি নামকরা কলেজ সেই সময়ে। কিন্তু কলেজের অধিকাংশ ছাত্র ছিল হিন্দু। কলেজের ছাত্রাবাসটির নাম ছিল 'রামমোহন হোস্টেল'। সেই ছাত্রাবাসের অধিকাংশ আবাসিকও হিন্দু। তারা সরস্বতী পুজো আয়োজন করতে চায়।
সে সময়ে সিটি কলেজের প্রিন্সিপাল ছিলেন হেরম্বচন্দ্র মৈত্র। কলেজের সংবিধান অনুসারে সরস্বতী পুজোর মতন ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান করতে দেওয়া চলে না, এই কারণে কর্তৃপক্ষ হস্টেলে পুজো করার অনুমতি দিতে অস্বীকৃত হন। শুরু হয় কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে ছাত্রবিক্ষোভ। বাধাপ্রাপ্ত ছাত্ররা অনশন সত্যাগ্রহ শুরু করে। পক্ষে বিপক্ষে বহুলোক।
এর ছয় বছর আগে ১৯২২ সালে ঐ সিটি কলেজে ইংরেজি বিভাগে যোগ দিয়েছেন এক তরুণ অধ্যাপক। ঠাকুর্দা সর্বানন্দ দাশগুপ্ত ব্রাহ্ম ধর্ম গ্রহণ করাতে তিনিও তাই। বছর খানেক আগে ১৯২৭ সালে প্রকাশিত হল তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'ঝরা পালক'। কবির নামের শেষে দাশগুপ্তের বদলে কেবল দাশ, শ্রী জীবনানন্দ দাশ। আমাদের ছোট্ট এই কাহিনীর নায়ক নন, স্রেফ ট্র্যাজেডির একটা চরিত্র।
নায়কদের দিকে একবার চোখ ফেরানো যাক। আন্দোলনকারী ছাত্রদের সপক্ষে সবচেয়ে বড় নাম এক তরুণ যুব ছাত্রনেতা। বছর খানেক আগে ১৯২৭ সালে মান্দালয় জেল এর কারাবাস থেকে মুক্ত হয়েছেন এই তরুণ তুর্কি নেতা। তার কাছে এটা নিছক পুজোর অনুমতি আদায়ের গোলযোগ নয়, তার চেয়েও কিছু বেশি। ছাত্রদের অধিকার রক্ষার লড়াই কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে। তিনি তখন নেতা বটে তবে নেতাজি নামে খ্যাত হন নি, তখন কেবলই সুভাষ বোস। এলবার্ট হলে বিরাট সভা। জ্বালাময়ী বক্তৃতা।
২রা মার্চ সভায় বললেন, " হিন্দু ছাত্রদের কোমল ধর্মীয় অনুভূতি কে পদদলিত করে সিটি কলেজ কর্তৃপক্ষ এর স্বেচ্ছাচারী আচরণের ফলে সিটি কলেজের ছাত্ররা বর্তমানে যে আন্দোলন শুরু করেছে, তার প্রতি আমার সাগ্রহ ও সাদর সমর্থন আছে। আলোকপ্রাপ্ত ও অগ্রসর ব্রাহ্ম ভদ্রলোকরা হিন্দু ছাত্রদের ওপর নিজেদের ধর্মবিশ্বাস চাপিযে দেয়ার জন্য এতো নিচে কি করে নামলেন তা আমি অনুধাবন করতে অক্ষম।"
কলেজ কর্তৃপক্ষ এর সপক্ষে বেশকিছু নামিদামি ব্যক্তিত্ব। রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়, সি এফ এন্দ্রুজ, প্রফুল্ল চন্দ্র রায়।এবং এবং রবি ঠাকুর। তরুণ নেতার হাতিয়ার যদি হয় তার তেজস্বী বক্তৃতা, প্রৌঢ় কবির হাতিয়ার তাহলে কলম। মর্ডান রিভিউ তে প্রবাসীতে চিঠি, প্রবন্ধ। সেই কলম থেকে বেরিয়ে আসছে এই লেখা, "..... ধর্মের স্বাধীনতাই যদি কাম্য হয় তবে সে স্বাধীনতা শুধু রামমোহন হোস্টেলের হিন্দু ছাত্ররা পাইবে এমন তো নহে, মুসলমান ছাত্ররাও পাইবে। মুসলমানদের পক্ষে গো-কোরবানি ধর্মের অঙ্গ। সুতরাং কর্তৃপক্ষ হোস্টেলে তাহাদের তাহাও করিতে দিতে বাধ্য। সুতরাং এভাবে যুক্তি চলে না। একটা প্রতিষ্ঠিত সমাজের বিধিবদ্ধ কতকগুলি নিয়ম আছে, সেগুলিকে ভাঙিতে চেষ্টা করায় সৌজন্যের অভাব প্রকাশ পায়। সিটি কলেজ ব্রাহ্মদের এবং ব্রাহ্মরা মূর্তিপূজক নয়, একথা প্রত্যেক ছাত্রই জানেন।"
এই সময়ে ময়দানে নামলো সজনীকান্ত দাসের 'শনিবারের চিঠি'। দু দিন আগেই প্রমথ হাতিয়ার নিয়ে রবীন্দ্রনাথকে বাক্যবানে বিদ্ধ করার অনুতাপেই বোধহয় এবার তারা কবির পক্ষে। সুভাষ কে 'খোকা ভগবান' নাম দিয়ে লেখা হলো :- "খোকা ভগবান নামে/ গজানন বঙ্গধামে/ সম্প্রতি খুলেছে রাজ্যপাট।..." ['মর্ত্য হইতে সরস্বতী বিদায়']।
সজনীকান্তের— "হিন্দু রিলিজিয়ন ইনসালটেড (স্বপ্নদর্শন)", অশোক চট্টোপাধ্যায়ের —"এই কি হিন্দু-জাগরণ" এবং যোগানন্দ দাসের—"নায়মাত্মা চৌর্যেন বা লভ্যতে" প্রকাশিত হল। ১৩৩৫ শ্রাবণ সংখ্যা "শনিবারের চিঠিতে প্রকাশিত হল এলবার্ট হলের সেই জনসভা কে ব্যঙ্গ করে :-
"খোকা ভগবান আসিল নিজে,/ চোখের জলেতে বেজায় ভিজে।/ বুকেতে কি জানি ঘটিল দোষ,/ সাক্ষী কুলীন বৈদ্য বোস।/ দেবদ্বিজে অতি ভক্তিমান/ সন্ধ্যা করিয়া তামাক খান।/...গোটে গোটে ছোটে খোকার বাণী/ নববেদ বলে তারে বাখানি। ...বিবাহযোগ্যা পাননি কনে/ কেহ নাই বামে সিংহাসনে।.../ হিন্দুয়ানির পান্ডাপাঁড়/ জয়রব তাই উঠিল তাঁর"। ইত্যাদি [ 'ধর্মরক্ষা']
পরিস্থিতি শান্ত হওয়ার বদলে আরও উত্তপ হয়ে উঠলো। সুভাষ বোস সব হিন্দু ছাত্রদের ওই কলেজ (সিটি কলেজ) ছেড়ে অন্যান্য কলেজে ভর্তি হবার নির্দেশ দিলেন। ফলে অনেকেই অন্যান্য কলেজে চলে যেতে আরম্ভ করল। সেই সময়ে কলকাতা ব্রাহ্মসমাজ থেকে দেশের সব ব্রাহ্ম ছাত্রছাত্রীদের সিটি কলেজে ভর্তি হয়ে কলেজটিকে টিকিয়ে রাখার আহ্বান জানানো হ'ল।
এই যুদ্ধে কার জয় হল জানা নেই। কিন্তু দলে দলে ছাত্র সিটি কলেজ ছেড়ে দিতে লাগলো। কিছু ছাত্র রয়ে গেল। সিটি কলেজের ছাত্র কিন্ত অক্সফোর্ড মিশন হোস্টেলের আবাসিক এক তরুণ যিনি পরে হবেন জীবন বীমা নিগমের কেরানি আর তারও পরে গাইবেন গান যতদিন না পর্যন্ত তার মতো ব্রাত্যজনের সংগীত রুদ্ধ করে দেবে অন্য কোনো কর্তৃপক্ষ।
কিন্তু জর্জ বিশ্বাসরা সংখ্যালঘু। বেশির ভাগই ছেড়ে গেল কলেজ। উল্লেখ যোগ্য ভাবে ছাত্র সংখ্যা হ্রাসের ফলে কলেজ কর্তৃপক্ষ আর্থিক সংকটের মুখে পড়েন এবং তার মোকাবিলার জন্য কিছু তরুণ অধ্যাপককে ছাঁটাই করে ব্যয় সংকোচের চিরাচরিত রাস্তা নেন। এই ছাঁটাই তালিকায় নাম সেই তরুণ কবির। অধ্যক্ষ হেরম্ব চন্দ্র মৈত্র কবির বাবা সত্যানন্দ কে পরিস্থিতি জানিয়ে একটি চিঠিও দেন ও আর্থিক হাল ফিরলে পুনর্বহাল এর আশ্বাসও দেন।
না কবির ফিরে আসা হয় নি। বেকার কবি কে অর্থ কষ্টের মধ্যে পড়তে হয়। এই পোড়া বাংলাদেশে স্রেফ কবিতার বই লিখে কে কবে স্বচ্ছলতার মুখ দেখেছে। বিশেষ করে সেই কবি যার সম্বল তখন কেবলমাত্র একখানি কবিতার বই।
রবীন্দ্রনাথ বিশ্বকবি, সুভাষ বোস দেশনায়ক নেতাজি, বিশাল সব বড় মাপের মানুষ। একযুগ বাদে ১৩৪৫ সালে একজন আরেক জনকে উৎসর্গ করেছেন 'তাসের দেশ' নাটিকা। কেবল সেই কবিই সেই সংঘর্ষের কো ল্যটারাল ড্যামেজ হিসেবে রয়ে গেলেন।
বাগদেবীকে নিয়ে সেবারের যুদ্ধে বলি হয়েছিল বাংলার 'নির্জনতম কবি'র রুটি রোজগার। আজ আবার সরস্বতী পুজো। কিন্তু বাতাসে সেই সংঘর্ষের বারুদের ঘ্রাণ। আজ যেন কোনো কবির জীবনে এমন কোনও ট্র্যাজেডি নতুন করে নেমে না আসে। নইলে বাগদেবীর আরাধনা মিছে।
আগ্রহী পাঠকের জন্য তথ্যসূত্রঃ
১. চিঠিপত্র, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (ঊনবিংশ খন্ড), পৃষ্ঠা ১৩৭, উইকি সংকলন, একটি মুক্ত পাঠাগার
২. চতুরঙ্গ, বর্ষ ৫৬, সংখ্যা এক, ১৪০৩
লাইফ অফ জীবনানন্দ দাশ, মহীতোষ বিশ্বাস, গ্রন্থতীর্থ
৩. ব্রাত্যজনের রুদ্ধসংগীত, দেবব্রত বিশ্বাস
৪. রবি, নেতাজি ও জীবনানন্দ, গৌতম মিত্র, ব্লগ
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন