১. সর্বত্রই, ফ্যাসিস্টরা শাসনক্ষমতায় আসেন বিপুল জনসমর্থন নিয়ে - অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ভোটে জিতে বা তেমনই কোনো "গণতান্ত্রিক" পদ্ধতিতে। জনসমর্থন আদায়ের পরেই সেই সমর্থন যে কোনো দলের পক্ষে নয়, স্রেফ একজন শাসকের প্রতি - যিনি সমর্থনকে একটি বিশেষ আইডিওলজির প্রতি সমর্থন ও ফ্যাসিস্ট লীডার ব্যক্তিটি যে সেই আইডিওলজির সাক্ষাৎ প্রতিমূর্তি - এই ভাবনার নির্মাণপ্রক্রিয়ার শুরু হয়।
২. "গণতান্ত্রিক" পদ্ধতিতে নির্বাচিত হলেও, ফ্যাসিবাদী সরকার যত দ্রুত সম্ভব গণতন্ত্রের পরিসরটি সঙ্কুচিত করে ফেলেন।
৩. ক্ষমতায় আসার সময় তো বটেই, ক্ষমতায় থাকাকালীনও, দেশের একটা বড়ো অংশের মানুষ ফ্যাসিবাদী সরকারকে সমর্থন করেন।
৪. এই সমর্থকদের বেশীর ভাগই সরকার যে ফ্যাসিস্ট, সেইটা চিনে উঠতে পারেন না - তাঁদের সমর্থনের যুক্তি থাকে বিভিন্নধরনের - এইভাবে বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষ বিভিন্ন যুক্তিক্রম নিয়ে ফ্যাসিবাদী সরকারের সমর্থনে থাকেন, অনেকসময় নিজের অজ্ঞাতেই। তাছাড়া, ফ্যাসিস্ট শাসকমাত্রেই বহুরূপীর দক্ষতায় প্রয়োজন অনুসারে "যখন-যেমন-তখন-তেমন যাকে-যেমন-তাকে-তেমন" ধাঁচে নিজেদের মুখ্য এজেন্ডাকে লুকিয়ে উপযোগী পছন্দসই এজেন্ডা খাড়া করতে পারেন।
৫. এইসব সমর্থকেরা যুক্তিতর্ক বা আলোচনার পথ ধরে নিজেদের ভ্রান্তি সম্পর্কে অবহিত হয়েছেন, এমন নজির নেই। যতক্ষণ না পর্যন্ত নিজেরাই ফ্যাসিবাদী আক্রমণের শিকার হচ্ছেন, ততক্ষণ সমর্থন জারি থাকে।
৬. একমাত্র ফ্যাসিবাদী সরকারের পতনের পর এঁদের সামনে পুরো ছবিটা স্পষ্ট হয় - এবং তখন এঁদের সম্বিত ফেরে - এই সমস্ত অপকর্মের সাথে নিজেদের সমর্থন জড়িত ছিল ভেবে যারপরনাই লজ্জিত হন - কিন্তু, সে অনেক পরের কথা।
৭. দেশপ্রেম আর ফ্যাসিবাদী জাতীয়তাবাদ সম্পূর্ণ ভিন্ন দুটি বিষয় - যদিও, দ্বিতীয়টি দাঁড় করানোর জন্যে প্রথমটির যুক্তি ব্যবহৃত হয়।
৮. ফ্যাসিবাদী জাতীয়তাবাদের রেটোরিক যেহেতু ঘৃণা আর বিদ্বেষ ছাড়া দাঁড়াতে পারে না, কাজেই শত্রুর নির্মাণ অনিবার্য - সে শত্রু, সাধারণত, দেশের বাইরের। কিন্তু, দেশের মধ্যেকার ঘৃণা আর বিভাজন ফ্যাসিবাদের উদ্দেশ্যসিদ্ধির মুখ্য উপায়। তাহলে? সমাধান, দেশের একটি বড় অংশকে দাগিয়ে দেওয়া হয় বিদেশী শত্রুর সহকারী হিসেবে। এইটা একটা উপায়।
৯. স্বচ্ছলতার মুহূর্তে ফ্যাসিবাদের উত্থান হয় না - হয়, আর্থিক সঙ্কটের পরিস্থিতিতে। সেই সঙ্কটের পরিত্রাণের পথ হিসেবে চিহ্নিত করা হয় দেশের একটা অংশের মানুষকে শায়েস্তা করা - দেশের মধ্যে ঘৃণা আর বিদ্বেষ জিইয়ে রাখার এ আরেক পথ।
১১. ফ্যাসিবাদী প্রবণতার প্রতিবাদ করতে গেলেই অতীত টেনে উদাহরণ দেওয়া ফ্যাসিস্ট শাসক ও তার সমর্থকদের বড় অস্ত্র - সে উদাহরণ প্রায়শই কাল্পনিক, অতীত প্রায়শই নির্মিত - বর্তমানের ভয়াবহতা ভোলাতে শোনানো হয় দেশবিদেশের ততোধিক ভয়াবহতার গল্প - শাসক সবসময়ই নিশ্চিত থাকেন, জনগণের স্মৃতি বেশীদিন টেকে না - আর সমর্থকদের কথার সুর দেখে সেই নিশ্চয়তা যে কতোখানি বাস্তবসম্মত, তার প্রমাণ মেলে।
১২. ইতিহাস তো বটেই, একেবারে সাম্প্রতিক ঘটনাবলী, এমনকি আর্থসামাজিক পরিসংখ্যান বা তথ্যও এমন সুচতুর দক্ষতার সাথে নির্মিত হয় - নিতান্ত গভীর অনুসন্ধানের মানসিকতা ব্যতীত বাস্তব পরিস্থিতির আন্দাজ পাওয়া দুষ্কর হয়ে যায়। আর, অর্থনৈতিক দুরবস্থা নেহাতই প্রকট হয়ে গেলে, অতীত রাজনীতি বা নির্মিত শত্রুকে দায়ী করার পথ তো থাকেই।
১৩. ফ্যাসিজমের প্রতিবাদ মানেই দেশের বিরুদ্ধে যাওয়া - প্রতিবাদী মাত্রেই রাষ্ট্রদ্রোহী - রাজনৈতিক বিরোধী মানেই দেশের শত্রুর এজেন্ট - ফ্যাসিজমের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো মানেই দেশের স্বার্থকে অগ্রাধিকার না দেওয়া - এই সব প্রচারই ফ্যাসিবাদের সনাতন কার্যপ্রণালী ও বহুপরীক্ষিত অস্ত্র।
১৪. শিক্ষিত ও চিন্তাশীল মানুষদের একাংশ ফ্যাসিস্ট শাসকদের পাশে থাকলেও, তাঁদের গরিষ্ঠ অংশই দাঁড়ান বিপরীতে। অতএব, উচ্চশিক্ষিত ও চিন্তাশীল মানুষেরা যে আদতে দেশের কাজে আসেন না, সেই বার্তা বিভিন্ন পথে আমজনতার মনে ঢোকাতেই হয় - কায়িক শ্রমই দেশের উন্নতির চাবিকাঠি ও মানসিক শ্রম বা বিদ্যাচর্চা অলস সময়যাপন মাত্র - এই এজেন্ডা ফ্যাসিস্ট শাসকের বড় অস্ত্র।
১৫. দেশের ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের বৃহদংশ শাসকের পাশে থাকেন - সংবাদমাধ্যম বা তদনুসারী পথ তাঁরা নিয়ন্ত্রণ করেন ও শাসকের পক্ষে প্রচার জারি রাখেন - অন্তত ততোদিন পর্যন্ত, যতোদিন না দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা এমন তলানিতে ঠেকছে যাতে তাঁদের ব্যবসার বাজার সঙ্কুচিত হতে হতে একেবারে শেষ দশায় পৌঁছায়।
আপাতত, এই ক'টা পয়েন্ট নিয়ে ভাবতে থাকুন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন