ভারত বর্ষ এই কোভিডের লড়াই শেষ পর্যন্ত জিতেই যাবে। অন্য দেশের তুলনায় সংক্রামিত হবেন অনেক কম, জনসংখ্যার নিরিখে। মৃত্যুহারও হয়তো কমই হবে। কয়েক মাস বাদে আমরা ফিরে যাবো পুরনো জীবনে। নতুন ছন্দে ফিরে আসবে গোটা সমাজ।
তবুও এইসব আশা-ভরসার মাঝেই আমাদের তাড়া করে যাবে কিছু ছবি। ছবিগুলো অনেক কাল আমাদের খোঁচাবে, ভাবাবে, ভয় পাওয়াবে। মাঝে মাঝে হয়তো শিরদাঁড়া দিয়ে নেমে যাবে ঠান্ডা একটা স্রোত। কখনো কারো চোখের কোনে দু ফোঁটা জল।
জামলো মাকদম। বছর বারোর সেই কিশোরী যে তেলেঙ্গানার লঙ্কার ক্ষেতের কাজ হারিয়ে দুশ মাইল হেঁটে ফিরে আসছিল ছত্তিশগড়ে। বন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে। কিংবা নাম না জানা বছর তিনেকের সেই ছেলেটি। চাকা লাগানো সুটকেসের উপরে যে ঘুমিয়ে পড়েছে মে মাসের দুপুরের রাস্তায়। মা তার টেনে চলেছেন দড়ি বাঁধা সুটকেস। অথবা রেললাইনে ছড়িয়ে থাকা রুটিগুলো। মাল গাড়ির চাকা ষোল জন মানুষকে পিষে দিয়ে গেলেও রুটিগুলো রয়ে গেছে। আবার মুজাফফরনগরের থেঁতলানো ট্রাক্টর, যাতে করে ছজন বাড়ি ফিরছিলেন। অথবা মধ্যপ্রদেশের গুনা রাস্তায় পড়ে থাকা ট্রাকের নিচে পিষ্ট কটা লাশ।
চলচ্ছবির মত আমরা দেখে যাই অগুনতি মানুষ হেঁটে চলেছেন ন্যাশনাল হাইওয়ে ধরে। গুরগাঁও রাজস্থান গুজরাট মহারাষ্ট্র কেরল থেকে পুবের রাজ্যে। ঘাড়ে মাথায় বস্তা, ব্যাগ, সস্তার সুটকেস। আর বাচ্চা। ভবিষ্যতের ভারতবর্ষ। এই স্মৃতি নিয়েই তারা নাগরিক হতে চলেছে।
নতুন একটা শব্দ শিখলো ভারতবাসী - পরিযায়ী শ্রমিক। অর্থনীতির ছাত্র রা আরেকবার ঝালিয়ে নিল মাইগ্রেশনের থিওরি, গ্রাম থেকে শহরে শ্রমিকের গতায়াত। সাধারণ মানুষ আবার শিখলো ভূগোল। তেলেঙ্গানা থেকে ঔরঙ্গাবাদ হয়ে মোজাফফরপুর অব্দি ছড়ানো ভূগোল সেই দেশের।
লকডাউন শুরু হওয়ার পর প্রায় পঞ্চাশ দিন বাদে কেন্দ্রীয় সরকারের মুখে শোনা গেল এদের কথা। কি আশ্চর্য যে এত বড় পরিকল্পনার ফাঁকে হারিয়ে গেছিলেন প্রায় দশ কোটি মানুষ। প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন যিনি যেখানে আছেন তিনি সেখানেই রয়ে যাবেন। এই প্রান্তিক মানুষদের ব্যবস্থা রাজ্য কেন্দ্র কেউই করে উঠতে পারলো না প্রায় দু'মাসে, স্রেফ ভোটার নয় বলে। ইতিহাস কেন আমাদের ক্ষমা করবে!
অর্থমন্ত্রীর বয়ানে আগামী প্রকল্প পরিকল্পনা জানা গেল। কিন্তু এই পরিকল্পনা কি পঞ্চাশ দিনের গবেষণার ফসল! এক দেশ এক রেশন কার্ড তো খাদ্যমন্ত্রী পাসোয়ান গত বাজেটেই ঘোষণা করেছিলেন। এই বছরের মার্চে তা সম্পূর্ণ হওয়ার কথা ছিল। সে যদি নাও হয়ে থাকে, এক দেশ এক আধার কার্ড তো ছিলই। তা দিয়ে ভিন রাজ্যের শ্রমিকদের রেশন কেন দেওয়া গেল না তার সদুত্তর পাওয়া যায় না।
পঞ্চাশ দিন বাদে যে ব্যবস্থা নিয়ে আপনি আসলেন মাননীয়া অর্থমন্ত্রী তা খুবই সাধারন, খুবই অপ্রতুল। আশা ও প্রয়োজন দুটোই অনেক অনেক বেশি ছিল। ক্ষমা করবেন ম্যাডাম কিছুতেই বলতে পারছিনা যে দের আয়ে দুরস্ত আয়ে।
দিনের শেষে রাজ্য কেন্দ্র সব সরকারই আমাদের বিশ্বাস করিয়ে ছাড়বেন যে এই করোনা যুদ্ধে আমাদেরই জয় হয়েছে। সংখ্যাতত্ত্বও সে কথাই সপ্রমাণ করবে। রাষ্ট্র তার বিধি নিষেধ পালনে, নিয়মের নিগড়ে, নাগরিকের বাধ্যতায় প্রমাণ রেখে যাবে কি কঠোরতায় আমরা এ জয় সম্ভব করেছি।
তবুও জামলো মাকদমের মাতৃভূমি হিসেবে, সুটকেসের ওপরের নাম-না-জানা ঘুমন্ত বাচ্চাটির জন্মভূমি হিসেবে, এই দেশ শেষমেষ পরাজিত। রেল লাইনের উপরে ছড়িয়ে থাকা রুটিগুলো আজন্ম এই পরাজয়ের দলিল হয়ে থাকবে। সরকার বা রাষ্ট্র জয় ঘোষণা করলেও এই দেশ শেষ পর্যন্ত হেরেই গেছে। পরাজয়ের এই গ্লানি থেকে আমাদের কোনো মুক্তি নেই।
ছবি গুলো বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম থেকে নেওয়া। এত পরিচিত হয়ে গেছে আজ যে আলাদা করে নাম দেবার দরকার নেই। কোলাজ ও স্কেচ এফেক্ট আমার করা কম্পিউটারে।
খুব ভালো লিখেছেন লেখক। সত্যি করোনা আমাদের চোখ খুলে দেখিয়ে দিয়েছে গোটা দেশের দশা ও সেই সঙ্গে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের তুলনায় আমাদের দেশের মান কতটা উপরা বা নিচে।
উত্তরমুছুন